একটা
দিন হয় ।
ক্যালিগুলার
ভেঁপু বেজে ওঠে ।
কয়েক
কোটি মানুষ – যে কোনো একটি মানুষ
তার
জীবনের অপমানের বিনিময়ে গড়তে শুরু করে
জীবনের
প্রতি তার গৌরবময় অধিকার ।
কাজের
প্রথম ঝোঁকটা কেটে গেলে
কথাবার্ত্তাও শুরু হয় ইতস্ততঃ ।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে
আমার আপনার বিগত ব্যক্তিগত রাত ও সকাল
আমার আপনার সকলের হয়ে ওঠে ।
কথা জারি থাকে ।
দুপুরের বিরতিতে, চায়ের দোকানে, ফুটপাথে,
বিকেলের মিছিলে, সমাবেশে,
বা হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া যে কোনো জায়গায়
সিনেমা হলে, বাসে, বাজারে, ডাক্তারের ক্লিনিকে ।
বিভিন্ন প্রসঙ্গ ওঠে, আলোচনা হয়,
চারপাশের দুনিয়া তৈরি করে চলে সেই আলোচনার
নিত্য
নতুন রসদ ।
প্রত্যেকটি মানুষ তার চিন্তার সমর্থন খোঁজে
যাতে জীবনে সে শক্তি পেতে পারে
বা জীবনকে শক্তি দিয়ে আনন্দ পেতে পারে ।
কথা কখনো বাঁধে, কখনো বাঁধতে পারে না
বেশির ভাগ হলুদ পাতার মতো ওড়ে
আরো বিষণ্ণ করে । ...
... ... ... ... ...
তবু কথা চলে । কথা জারি থাকে কেন না
আমার আপনার দুঃসময় একে-অন্যের হলে
তা সুসময়ের একটি বনিয়াদ ।
২
আন্দোলনের দিনগুলো আসে ।
বাইরের ঘটনাগুলো নিয়ে যে যা খুশি বলুক
তার আসল পরিচয়টা যাচাই হয় এই দিনগুলোয়
কেউ নিকারাগুয়ার বিপ্লবী সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে
বড় বেশি চিন্তিত, কিন্তু
মিটিংএর বিকেলটায় তার
বাড়ির একটা ‘জরুরি কাজ’ মনে পড়ে যায় ।
কেউ কোনো কিছু নিয়েই চিন্তিত নয় তবু
মিটিংগুলোয় খুব বেশি করে থাকে
বিশেষ করে নেতৃত্বের কাছ ঘেঁষে –
তাড়াতাড়ি পড়ে নেয় বিগত সার্কুলারগুলো
ভাষণ
দেয়
চোখ কাড়ে বড় নেতার, কেননা
তার নিজের একটা কাজ তাকে করিয়ে নিতে হবে ।
কেউ খুব বেশি প্রশ্ন করে ।
সব কিছুতেই তার সন্দেহ –
সন্দেহ একটা অজুহাত তার ভয়ের ।
যে কাজে পুলিশের মারের,
চাকরি খোয়াবার ভয় আছে, সে কাজে
হাত
না লাগাবার ।
কেউ সব কিছু নির্বিকার নিশ্চিন্ত মনে করে যায় ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়
সরকারের উঁচু তলায় তার নিজের লোক আছে ।
তবু এরই মাঝে খোঁজ জারি থাকে – যাচাই
চরিত্রের,
কেননা যে সত্য আমার, আপনার,
সে সত্যের পথে আমাকে ও আপনাকে আসতে হবেই।
আজ না হয় কাল,
পুরো না হয় আংশিক, তা বলে নির্জনতায়
মুক্তি আমারও নেই,
মুক্তি সত্যেরও নেই ।
৩
কথা ও কাজের সূত্রে
দিনগুলো এগিয়ে চলে ।
সকলের রাত দিন, চব্বিশটা ঘন্টা
কেউ একলা হাজার চেষ্টায়ও জানতে পারে না।
কবে বলা কোন কথা
কার মনে কি ছাপ ফেলে রেখেছে
কবে করা কোন কাজ
কার মনে কি স্মৃতি তৈরি করেছে
আমরা সবসময় জানতে পারি না । ...
আর একদিন হঠাৎ কেউ একটা প্রশ্ন করলো এমন –
আমি চমকে উঠলাম বা কেউ একটা উত্তর দিলো এমন –
চলতি প্রশ্নের –
যাতে চোর ধরা পড়ে গেল আমারই মনে ।
কেউ বুঝলো না, কেউ হেসে উড়িয়ে দিলো,
কেউ চেপে দিতে চাইলো তীক্ষ্ণ ধূর্ততায় কিন্তু
সাড়া
জাগলো কারুর চোখে ।
আশার একটা উজ্জ্বল বিন্দু
সুপারনোভার স্পন্দনে বিচ্ছুরণ শুরু করলো আলোর –
“তাহলে আরেকজন ?
তাহলে আরেকজন ?” ...
এরপর যা হয় – অসফল সংকেতকে বাদ দিয়ে –
তা আজকের জীবনের
একটি মহত্ত্বম ও জটিল কাহিনী ... ।
লেখকদের আহ্বান জানিয়ে
আমি শুধু এটুকুই বলছি –
যে এগোয়, সেই জানে,
কতো দুরূহ পরীক্ষার মাঝ দিয়ে তার বয়স
কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর বয়স হয়ে ওঠে ।
৪
একসাথে কাজ করি – সংগঠনে আমরা কমরেড ।
এক আন্দোলন গড়ে তুলি
বিভিন্ন ক্ষেত্রের দাবীগুলো একসাথে নিয়ে এসে –
সেই
মোর্চায় আমরা কমরেড ।
হয়তো এক পার্টিতেই আছি –
এক সেলে কিম্বা ভিন্ন সেলে –
ভাবধারা,
লক্ষ্য ও কার্যসূচীতে আমরা কমরেড ।
কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়া
তার থেকেও বেশি ! এই খোঁজ
ওই ভাবধারার পিছনের নিতান্ত ব্যাক্তিগত রাস্তায়
হাতে হাত ধরে হাঁটা,
প্রেমিক যুগলের মতো অধিকারে । এই অধিকার –
যেমন প্রেমিকা দেয় তার প্রেমিককে নিজের গর্ভের স্পন্দন
কান পেতে শুনতে । এই একতা
উত্তরের নয় – উত্তরের ফাটলগুলোয় ।
একতা প্রশ্নের ।
একতা সংশয়ের ।
একতা স্বপ্নের ।
তাই কথা শুরু হয় – আবার – নতুন মাত্রায় ।
বিভিন্ন সমস্যা,
যতটুকু জানে তারা, একে অন্যকে বোঝাতে পারে ।
যেখানে বোঝাতে পারে না
বিশ্বাসের হাত বাড়ায় ।
সত্যকে এক সাথে খুঁজবার আহ্বান জানায় ।
ইতিহাস থেকে পাওয়া স্বপ্ন ও গানের সাহায্য নেয় ।
অতীতের সব বেদনার
গোধূলির নদীর ওপার থেকে ডাকে ।
ব্রুনোর শরীর জ্বালানো আগুন ...
স্পার্টাকাসের দলের শেষ যোদ্ধার
মৃত্যুর
আগের উচ্চারণগুলো,
ক্যাভাইনাকের সৈন্যের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো শ্রমিকের
হাতের
বারুদের দাগগুলো
শেষ কম্যুনার্ডদের রক্তে ভেজা গোরস্তানের ভাঙা ইঁটগুলো
অথবা চীন-ভিয়েৎনাম যুদ্ধে মৃত কৃষকের চোখের
শূণ্যতার
ছোপগুলো
এসবই রঙ হয়ে ওঠে তাদের সংশয়দীর্ণ সন্ধ্যার । ...
আবার
কাম্পানেল্লার সূর্যের শহরও তাদের শহর হয়ে ওঠে ।
ডেভিড যা স্পার্টাকাসকে বলেছিলো
তা
তারাও মন দিয়ে শোনে ।
তারা আবার ভাঙে ব্যাস্টাইল ।
সাইলেসিয়া লিয়ন্সের ব্যারিকেড তারা গড়ে ।
তারা বেঁচে থাকা বিস্মৃত কম্যুনার্ড হয় –
এবার আর ব্যাঙ্ক তারা ছেড়ে দেবে না প্রাক্তন
ডিরেক্টারদের হাতে,
জহ্লাদদের তারা ক্ষমা করবেনা ।
তারা রোমাঞ্চিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়
দুনিয়া কাঁপানো দশটা দিনের রাশিয়ায়,
তারা ক্রেমলিন অধিকার করে,
তারা দূর উত্তর সাগরের কাছে একটি গ্রামের মোড়ে দাঁড়িয়ে
ঘোষণা করে লেনিনের লেখা
শান্তির ডিক্রী ।
জমির ডিক্রী ।
শ্রমজীবী জনতার অধিকারের ডিক্রী ।
শ্বেত আতঙ্কের বিরুদ্ধে গণভিত্তিক
লাল আতঙ্ক
ছড়াবার ঘোষণা । ...
তারা এগোয় একে অন্যের কাছে ।
ধাপে ধাপে, যাচাই করে,
মাঝে মাঝে ফিরে যায় ।
ঝগড়ায় কথা বন্ধ থাকে সাতদিন, আবার আসে ।
হাজার পিছুটান, ভয় ও সুরক্ষার চিন্তা কাটিয়ে
কম জানার খোলস ভেঙে, জানার
আগ্নেয়
অশান্তির দিকে ।
একে অন্যের তারা শিক্ষক ।
কেউ বেশি অশান্ত হয়ে ওঠে । তাকে শান্ত করে অন্যজন ।
কেউ শান্তির আড়াল খুঁজে নেয় । তাকে খুঁচিয়ে বার করে
অন্যজন ।
কোত্থেকে শুরু করবো ?
বড়ো কঠিন প্রশ্ন ।
লিওন্তিয়েভ ? না সোজা ক্যাপিট্যাল ?
স্টালিন ? এমিল বার্ন্স ? এঙ্গেলসের ওই ছোট্টো লেখাটা ?
একজন হয়তো একটু বেশি পড়েছে ।
সে অন্যকে পড়ায় ;
ঘুমোতে তাদের দেরি হয়ে যায় প্রতিদিনই ।
একসাথে রাত কাটালে,
নির্ঘুম ভোর হয়ে যায়, স্টেশনের চায়ের দোকানে ।
আর তারপর
একদিন কোথাও
নদীর তীরে, স্টিমারের অন্ধকার
তারায়
ভরা ক্যাপস্টানের কাছ ঘেঁষে,
ইউনিয়ন কনফারেন্স শেষে নতুন শহরের রাস্তায়,
ডিস্কানেক্টেড বগি ছেড়ে ঘুমন্ত গোমো প্ল্যাটফর্মে,
দিল্লীর শ্রমিক র্যালির ক্যাম্প ছেড়ে
রাস্তার
ধারের কালভার্টে ...
কোথাও এই পৃথিবীর
কোথাও অনেক রাত হয়ে যায়
কোনো একটি রাত অনেক রাত হয়ে যায় ।
দুজনে একে অন্যের খুব কাছে চলে আসে ।
একটা ছোট্টো প্রেম, একটা ছোট্টো বেদনা,
একটা ছোট্টো লোভ, স্বার্থপরতা, একটা ছোট্টো আত্মগ্লানি,
একটা ছোট্টো সন্দেহ, একটা ছোট্টো অন্ধবিশ্বাস,
নদী, মা, গাছ, ঋতু, পাথর, স্বপ্ন, কুয়াশা ও ক্ষত, ...
দুজনে একে অন্যের ভিতরে প্রবেশ করে ।
আকাশ মহাকাশ হয়ে ওঠে ।
তারারা নক্ষত্র ও গ্রহ, এস্টেরয়েড ও অগ্নিপুঞ্জ হয়ে ওঠে
।
অন্ধকার বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ।
অস্তিত্বের নশ্বরতা শাশ্বত হয়ে ওঠে ।
মৃত্যু খুব সহজ, যেন অতিক্রান্ত হয়ে ওঠে ।
দুজনে একে অন্যের ভিতরে সদ্য পূর্ণ জন্ম নিয়ে
একে
অন্যের দিকে তাকায় ।
‘কমরেড’ তারা বলে না,
তাদের দুজনের মাঝের বাতাস
অনুচ্চারিত ওই শব্দটার আয়নাইজ্ড হয়ে ওঠে । ...
৫
আবার একটা দিন হয় ।
সারারাত
বর্ষার কোকিলের গলার ছোট্টো জায়গাটায় দুজনে
নিবিড় বাষ্প হয়ে ছিলাম ;
অন্য এক সূর্যের আলোয় হাত ছাড়াই
একে
অন্যের হাত থেকে
মিশে যাই জীবনের ভীড়ে । ...
বিকেলের সমাবেশে আবার দেখা হয় ।
একে অন্যকে অভিবাদন জানাই
আর
পাঁচজনের মতো ।
তবু এক গভীর সমঝদারী
এক ভালোবাসা, এক বেপরোয়া আস্থা
সেই অভিবাদনের পিছনে আভাস হয়ে থাকে ।
একটা নক্ষত্রের দুটো ঝিলিক হয়ে থাকে ।
সেই নক্ষত্রের জন্য কাজ
দুজনের সামূহিক নির্জনতায়
জারি থাকে ।
[১৯৮০]
No comments:
Post a Comment