Wednesday, October 24, 2018

শিল্পীর প্রতিশোধ


পকেটমারি নিঃসন্দেহে একটা শিল্প । কী নিপূণ শল্যচিকিৎসা ! পকেটের ভিতর ঠিক যে ফোলা জায়গাটার কথা ভেবে ভেবে আপনি ট্রেনের কামরায় দিব্যি হাওয়া খেতে খেতেও শুয়ে ঘুমোতে পারছেন না, ফোঁড়ার মত টিস দিচ্ছে বার বার, আপনার হৃদয় ও মস্তিষ্ককে বন্দী করে রেখেছে ... আপনি কিছু বুঝতে পারার আগেই সেই ফোলা জায়গাটা গায়েব, আপনি মুক্ত । কিছুক্ষণ পকেটের কাটা ফাঁকটায় বোকার মত হাত ঢুকিয়ে, যন্ত্রণায় হায় হায় করে নেওয়ার পর আপনি নিশ্চিন্তে, মানে চিন্তা করেও যখন লাভ নেই, ঘুমোতে পারেন সত্যি বলতে কি, না চাইলেও ঘুমিয়েই পড়েন ক্লান্তিতে । 
বর্ধমান স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই সাধারণ কামরায় গেটের মুখে ঢুকবার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তি । হঠাৎ সব কোলাহল ছাপিয়ে একটা গালাগালের নির্ঝর প্রবাহিত হল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সকলকে ঠেলে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল একটা রোগা দড়ি পাকান লোক । সাদা প্যান্ট, সাদা পাঞ্জাবী, গলায় বজরঙ্গবলীর সুতো আর কদমছাঁট চুল । পাতলা গোঁফ । হাতে একটা ছোট্টো ফোমের হাতব্যাগ যা তখনকার অফিসবাবুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল । বিহার অঞ্চলের বহুভাতে বা রিসেপশনে সন্ধ্যেবেলায় বরের বাবা বা কাকা, মানে যাঁরা ফান্ড ইঞ্চার্জ হতেন, তাঁরাও রাখতেন । এক খোপ থেকে রান্নার দেখনদারকে হঠাৎ জরুরি হওয়া অতিরিক্ত চালের দাম দিতেন, অন্য খোপে নিমন্ত্রিত অনেকের দেওয়া গিফ্‌ট এনভেলপ গুঁজে রাখতেন ।
লোকটি সিট খোঁজার জন্য এগিয়ে এল না । বিপরীত দিকের বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল এবং আশে পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা বিশেষ করে সেই সব লোকেদের সাথে যারা নিজেদের জামাকাপড়ে, চেহারায় প্রতিফলিত শ্রেণীদোষে ধ্যাঁতানি খাওয়ার থেকে পেচ্ছাপখানার ধারে শুয়ে পড়া শ্রেয়ষ্কর মনে করে ঠিক তেমনই আত্মবিশ্বাসী হাসিঠাট্টা আরম্ভ করল যেমন ঠিকেদারের দালাল ঠিকেদারের জনদের সাথে করে ।
বাইরে মে মাসের রাত । ট্রেনটা ভারতের তদানীন্তন কুড়ি হাজার মাইল বাতিল রেলপথের মাত্র কয়েকশো মাইলে, গতি কম হাল্লা বেশির রীতি অনুসরণ করে ম্যাটার ইন মোশনএর উচ্চকিত জানান দিতে দিতে চলছিল ।
লোকটি মস্করা জারি রেখেছিল বার বার ঘুমিয়ে পড়া এক বৃদ্ধের সাথে । বিবাহকেন্দ্রিক রসিকতা, যা এমত অবস্থায় কথার পিঠে কথা জাগিয়ে রাখার জন্য হয়ে থাকে । হঠাৎ তার চোখ পড়ল ছেলেটির ওপর । পড়তেই তার চোখদুটো, ওস্তাদ জহুরির মত, মুক্তোর মালার মাঝে একটা নকল পূঁতি দেখে ফেলার মত কুঁচকে উঠল , তুই এখানে কোত্থেকে ? তোকে আগে দেখেছি মনে হচ্ছে ! ছেলেটি নিরীহ চোখ তুলে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ।
-       কোত্থেকে উঠেছিস ?
-       আজ্ঞে, হাওড়া থেকে ।
-       যাবি কোথায় ?
-       আজ্ঞে, পাটনায় ।
-       কলকাতায় কোথায় থাকিস ? (ছেলেটি একটা জায়গার নাম বলে) বুঝেছি ।
লোকটি প্রজ্ঞার গভীর স্তরে কিছু একটা সংকেত পাওয়ার মত মুখভঙ্গি করে আমাদের দিকে, অর্থাৎ সিটে, বাঙ্কে, দুটোর মাঝখানে গাদাগাদি হয়ে থাকা সমবেত ভদ্র ও আধাভদ্র মন্ডলির দিকে মুখ ফেরাল ।
-       ভাই, আপনারা সবাই একটু সামলে চলবেন । এ মালকে আমি চিনি । এরা একলা ওঠে না । মনে হচ্ছে পুরো গ্যাংটাই এই ট্রেনটায় উঠেছে । নিজেদের পকেট, জিনিষপত্র ইত্যাদি সামলে রাখবেন ।
বলে, ঘুরে তাকাল ছেলেটির দিকে, দেখি তোর টিকিটটা দেখি ! টিকিটটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে ফিরিয়ে দিল । একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বগতোক্তি গোছের করল, চল ! বোঝা যাচ্ছে সারারাত তুই কাউকে ঘুমোতে দিবি না ।
আমি ওদের কথার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম । বেঁটে, কালো, মজবুত গড়ন । কদমছাঁট চুল, ভোঁতা নাক, মোটা ঠোঁটে হাওড়া স্টেশনে খাওয়া পানের লালচে রেখা । এই দুঃসহ গরমেও ওর জমকালো শার্টের নিচে ততোধিক জমকালো একটা কলারওয়ালা পলিয়েস্টার গেঞ্জি । গলায় জোড়া খুকরির লকেট ঝোলানো কালো সুতো । জংঘার কাছে উত্তেজকভাবে আঁটসাট একটা ধুসর সবুজ প্যান্ট । কোমরে ৭৮৬ মার্কা বাক্‌লসের বেল্ট । পায়ে জমকালো চটি, সাধারণতঃ যে ধরণের চটি মুসলমান গরীব ছেলেরা ধান্দায় দুপয়সা কামালে পরে । দেখে পকেটমার মনে হয় না । কিন্তু একটা ইংগিত আছে চেহারায় । বিশেষ করে জংঘাদুটোয়, নাক আর ঠোঁটে । চোখদুটোর অভিব্যক্তিশূন্যতায় । অর্থাৎ, সিনেমায় ব্ল্যাক করা, মদ খেয়ে ফুর্ত্তি করা, দল বেঁধে নিষিদ্ধপল্লিতে যাওয়া, মারপিট করা ... ছেলেটি সেই যে প্রথম প্রশ্নের সাথে উঠে দাঁড়িয়েছিল তারপর আর বসে নি । মুখে একটা বিনীত বাধ্য ভাব, যদিও শরীরের পেশীগুলো জানলা দিয়ে আসা হাওয়ার চাপে দুর্বিনীত ভাবে ফুটে উঠছিল । শেষে লোকটির এক ধ্যাঁতানি খেয়ে বসে পড়ল ছেলেটি ।
হয়ত ঘুমে ঢুলছিলাম । ট্রেন কখন দুর্গাপুরে ইন করেছিল জানি না। ঢুলুনি ভাঙল একটা কর্কশ চিৎকারে । চোখ খুলে দেখলাম লোকটি ছেলেটিকে জাগাচ্ছে রুক্ষ স্বরে, এ্যাই, ওঠ শালা !
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটি । লোকটি ওর গায়ে কোথাও হাত না লাগাল না । ওর সামনাসামনি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হিসহিসিয়ে উঠল, ভালো চাস তো ব্যাগটা দিয়ে দে !
তখনও ঘুমে ঢুলছিল । লোকটি ওর মাথাটা সজোরে দেয়ালে ঠুকল, ভালো চাস তো দিয়ে দে বলছি ব্যাগটা । আমি একটুও মারব না তোকে ।
যেন এতক্ষণে বুঝতে পারল প্রশ্নটা । মুখ তুলে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মত করে প্রশ্ন করল, কোন ব্যাগ ?
-       ও, তুই এখন ব্যাগটা চিনিসও না !
একটু ক্ষণ তাকিয়ে ওর মুখ ঠাহর করল লোকটি । তারপর হঠাৎ বেদম জোরে একটা ঘুষি চালাল ওর বুকে । ছেলেটি বুকে হাত চেপে ডুকরে উঠল ।
ব্যাপারটার ইশ্বরীয় রসিকতায় সকলেই নড়ে চড়ে উঠে বসেছিল ততক্ষণে । আড়ালে হাতের স্পর্শে নিজেদের পকেট ও মালপত্রের ঠাহর নিতে নিতে তারা সমাজের বিবেকের মত চারদিক থেকে মুখ বাড়িয়েছিল, কী হল ? হলটা কী ? যে ওর টুপি চেনাল তাকেই ও টুপি পরাল ? যাস্‌সালা !...
লোকটি তখন পাশের জনকে প্রশ্ন করছিল যে মাঝে ছেলেটি কোথাও গিয়েছিল কিনা । পাশের জন দুর্গাপুর স্টেশনে ছেলেটির একটুক্ষণের জন্য নামার কথা জানাল । লোকটি আবার ঘুরল ছেলেটির দিকে ।
-       কোথায় গিয়েছিলি ?
-       খাবার খেতে ।
-       কী কী খেলি ?
-       দুটাকার পুরি-তরকারি ।
-       কত টাকা ছিল তোর পকেটে ?
-       দশ টাকা ।
লোকটি ওর পকেটে হাত ঢোকাল । একটা পাঁচ টাকার নোট ।
-       শালা, দশ টাকা থেকে দুটাকার খেলে পাঁচ টাকা থাকে ?
-       দুটাকা কোথায় ? দুটাকার আমি আর দুটাকার আমার বন্ধু ।
-       বন্ধু ? বন্ধু কোথায় ?
-       অন্য কম্পার্টমেন্টে বসেছিল । দুর্গাপুরে নামার ছিল, নেমে খেয়ে চলে গেল ।
-       ও, তাই না ? তাহলেও যে ছটাকা থাকে !
-       ওই তো, চার আনার বিড়ি কিনলাম আর বাকি পঁচাত্তর পয়সা ...।
বলে বিড়ি আর পঁচাত্তর পয়সা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠল ছেলেটি । বোধহয় সময় নিচ্ছিল । তখনও ফোঁপানি বন্ধ হয় নি ।
-       মিছি মিছি আমি মার খাচ্ছি । আমি কোনো ব্যাগ দেখিনি, নিইও নি, আমি জাতিতে চামার, আমার ঘর পাটনায়, সেখানে নথুনি চামার মিঠাপুর ঘুমটির ধারে বসে, সে আমার বাবা ... এই তো, এই দেখুন !
যেন বিরাট একটা প্রমাণ বার করে এনেছে নিজের নির্দোষিতার, সেভাবে কান্না থামিয়ে এক মুঠো বিড়ি আর পঁচাত্তর পয়সা ছেলেটি ভিতরের গেঞ্জির পকেট এবং প্যান্টের পিছ-পকেট থেকে বার করে আনল ।
হিন্দী সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অমরকান্তের একটা গল্পে নায়ক চুরির মিথ্যা অভিযোগে মার খায় আর চ্যাঁচায়, আমি বঢ়ই, আমি বঢ়ই । বঢ়ই অর্থাৎ ছুতোর মিস্ত্রী । অমরকান্ত বলেন যে লোকটি নিজের জাতির পরিচয় এমন ভাবে দেয় যেন দুনিয়ায় আর যে যা ইচ্ছা করুক, বঢ়ই জাতির লোক চুরি করতে পারে না ।
তবে এই ছেলেটি আমি জাতিতে চামার সেই অর্থে আওড়াচ্ছে বলে মনে হল না । বরং ভাবটা এমন ছিল যেন ও জানে যে আশেপাশের লোকেরা প্রায় সবাই উঁচু জাতের, আর তাই এটা ওর নিয়তি যে চুরি করুক আর না করুক, মার খাবেই, তবু ! যদি কারো দয়া হয় ...!
এক্কেবারে সেন্টুতে ঘা লাগান রাজনীতি । স্পষ্ট দেখলাম আশেপাশের সবার মুখে এক মুহুর্তের জন্য কথাটার প্রভাব পড়ল ।
লোকটি স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল । তারপর শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার মত করে দাঁতে দাঁত চাপে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, শেষবার তোকে জিজ্ঞেস করছি, ব্যাগটা তুই দিবি কিনা ?
-       আমি ব্যাগটা নিই নি বল...
হঠাৎ বেধড়ক ঘুষি আর কনুইয়ের গুঁতো চালাতে শুরু করল লোকটা, ছেলেটির শরীরের মোক্ষম জায়গাগুলোয় পেটে, পাখনার হাড়ের খাঁজটায়, বুকের একটু নিচের দিকে, কাঁধে, পিঠে, আর নাকে তো বটেই ।
এক ঝোঁক চলার পর লোকটি হাঁপিয়ে উঠল । ছেলেটি ডুকরে কাঁদছিল কিন্তু আশ্চর্য, অজ্ঞান হওয়া তো দুরের কথা, পড়েও গেল না মাটিতে । বসলও না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল । যেন জানান দিচ্ছিল যে আমি ছোটো জাতের, আপনাদের সামনে বসা, তা সে যত মারই খাই না কেন, পড়ে যাওয়ার আগে অব্দি আমার কি সাজে ?
জানান দিতে থাকা এই জন্য বললাম যে ছেলেটি যদি পকেটমার নাও হয়, তাহলেও, কলকাতায় কাজ করা আর ফূর্ত্তি করা সৌখিন ছেলের চেতনার এই স্তর থাকতে পারে না যে ট্রেনে উঁচু জাতের লোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ।
এবার সমাজের বিবেকদের হস্তক্ষেপ করার পর্যায় । এক এক করে প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করল, কী ব্যাপার, কখন হয়েছে, ব্যাগটায় কী কী ছিল ...। মাঝে মাঝে শ্মশ্রুশোভিত স্বগতোক্তি, যা অবস্থা হয়েছে দেশের, কী দিনকাল পড়েছে, কাউকে বিশ্বাস করা যায় না ইত্যাদি । এরই মাঝে ছেলেটি এক্কেবারে মোক্ষম বিষাদ কবিতার সুরে ডুকরে ওঠা শুরু করল ।
লোকটি এদিকে পুরো ঘটনাটা পঞ্চপরমেশ্বরকে শোনাল । বলল, যে সে ছেলেটিকে আগেই ভালোভাবে চিনেছিল ।
-       কী রে, কলকাতায় কোথায় থাকিস তুই ?
-       ওই তো, ...পট্টির দিকে, ...ব্যাপারির দোকানে কাজ করি ।
-       হুঁ, হুঁ, বেশ বুঝেছি তুই কেমন কাজ করিস ।
এবং আবার সে পঞ্চপরমেশ্বরের মুখোমুখি হল ... যে তার ব্যাগে টাকা এমন কিছু ছিল না । মাত্র দেড়শো টাকা, তা যদি ও ফেরৎ নাও দেয় তাহলেও সে কিছু বলবে না । কিন্তু তাছাড়া তার ব্যাগে ছিল পঞ্চাশটা আবেদন পত্র । ট্রান্সফারের । কলকাতা থেকে মোকামা এবং আশেপাশের অঞ্চলে । মোকামায় নেমে, আবেদনগুলো নেতাকে দিয়ে রেকমেন্ড করিয়ে তার দিল্লী যাওয়ার ছিল পরের ট্রেন ধরে । সেখান থেকে ওগুলো স্যাংশন করিয়ে আনার ভার ছিল তারই ওপর । লোকটি দুহাত তুলে রাজসিক আলস্য এবং নিশিন্ততার ভঙ্গী করল ।
-       যা হোক, তাও কোনো ব্য্যাপার নয় । খামোখা একটু দেরি আর ঝুঠ ঝামেলা, এই আর কি । এখন মোকামায় নেমে সবচেয়ে আগে এই খবরটা অফিসে দিতে হবে । তারপর জীপ নিয়ে বেরিয়ে ... মোকামায় এদের একটা দল আছে, সেই দলটার কাছে যেতে হবে । ব্যাগ তো আমি ফেরৎ পাবই । হ্যাঁ, আবেদনগুলো বাজে কাগজ হিসেবে ফেলে দিয়ে থাকলে আবার কলকাতায় গিয়ে সবাইকে দিয়ে লিখিয়ে ডিপার্টমেন্টে ফরোয়ার্ড করাতে হবে । দেরি হবে একটা দিন । (ছেলেটির দিকে তাকিয়ে) তোকে আমি বুঝিয়ে দেব তুই কার হাতে পড়েছিস । হাত পা ভেঙে চিরজীবনের জন্য অকেজো করে রেখে দেব । সোজা কথায় তুই দিলি না । ফের বলছি দিয়ে দে । এখনও বুঝিস নি তোর এবার কী হতে চলেছে ।
ছেলেটি আবার ডুকরে উঠে বিড়বিড় করল, আমি নিই নি বলছি ব্যাগটা ...
তবে রে ! হঠাৎ লোকটি ছেলেটির গালদুটো দুহাত দিয়ে দুদিকে সাঁড়াশির মত টেনে মোচড়াতে শুরু করল । একটু পরেই ঠোঁটের কষ বেয়ে দর দর করে রক্ত বেরিয়ে এল । আর ফেনা ।
রক্তের একটা নিজস্ব প্রভাব আছে । চার পাশের লোকেরা একটা নৈতিক ভীতিতে বিড়বিড় করতে শুরু করল, ছেলেটা পকেটমার নাও তো হতে পারে ! শুধু আন্দাজের ওপর এত মারা উচিৎ নয় । যদি কিছু হয়ে যায় ?
আমার সামনে বসা ছাত্রটি শেষের কথাটা শুনে ফেলল । ওর বাথরুম যাওয়ার ছিল । নিচে নেমে, ঢিলে করে নেওয়া প্যান্টটা বোতাম লাগিয়ে টাইট করতে করতে জবাব দিল, কিছু হয়ে যাবে ! আপনারা সেই ভ্রমেই থাকুন । ওর কিচ্ছু হবে না । এর দশ গুণ মার সহ্য করার ক্ষমতা ওদের থাকে ।
বাথরুম থেকে ফিরে সেও ছেলেটির চুলের মুঠি ধরে দুচারটা ঘুষি ছাড়ল । জুলপি উল্টো দিকে ঘষল । গালাগাল দিল দুচারটে ।
-       ওঃ, আবার কান্না হচ্ছে ! দেখি !
বলে ওর চোখে হাত ছোঁয়াল তারপর চুল ধরে আচমকা হ্যাঁচকা টানে মাথাটা ওঠাল । সমবেত ভদ্রমন্ডলীর দিকে চেয়ে বলল, দেখুন, দেখুন কেমন কান্না ওর । একফোঁটা জল নেই চোখে ।
হাত ও মুখের সুখ হয়ে যেতে ছাত্রটি গর্বিত ভাবে হাত ঝাড়ল নিজের, যেন নোংরা কিছু পরিষ্কার করার সামাজিক কার্য ও নিজে যেচে করেছে । তার পর আবার চড়ে বসল বাঙ্কের ওপর ।
নিচে জানলার ধারের সিঙ্গল সিটে একজন শিক্ষক গোছের মানুষ বসে ছিলেন । ধুতি, ছাই রঙের পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর । চুল বেশির ভাগ পাকা । তাঁর সৌম্যতা দেখে তাঁর সিটে কেউ দ্বিতীয়জন আধপাছা বসতে আব্দার করেনি, তিনিও কাউকে জায়গা ছাড়েন নি । এটুকু তো তাঁর প্রাপ্যই !
তিনি উদাসীন স্বরে দুচার বার বললেন, দিয়েই দে না ব্যাগটা ! কেন পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিস ?
ছেলেটি ব্যালেন্সিং ফোর্সের আভাস পেয়ে হঠাৎ এগিয়ে এল নিজের জায়গা ছেড়ে । হাত জোড় করে শিক্ষকের কাছে নিজের নির্দোষিতার কথা বলতে যাবে তখনই ওর কষের রক্ত টপ করে পড়ল নিচে বসা মানুষটির পায়ের ধারে ।
মানুষটি বেঁটেখাটো । কোনোকিছুর ব্যাপারী । সাথে পরিবার, মালপত্র । এতক্ষণ সে সম্পূর্ণ নিস্পৃহভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করে নি । রক্তের ফোঁটাটা টপ করে পড়ার সাথে সাথে সে বেমক্কা চেঁচিয়ে উঠল, এ্যাই, এ্যাই, খবরদার ! এগোবি না । শালা, সকলের জামাকাপড় নোংরা করে দেওয়ার মতলব !
আসানসোল এল । চলে গেল । চিত্তরঞ্জন । মধুপুর । জসিডি । শিমুলতলা । জমুই । ঝাঝা । একটু পরে ভোর ফুটতে শুরু করল ।
ব্যাপারীর চ্যাঁচ্যানি শুনে ব্যাগ-হারান লোকটি কাঁধ চেপে বসিয়ে দেওয়ার পর সেই যে ছেলেটি ঝিম মেরে বসেছিল তারপর আর একবারও ওঠেনি । নড়েও নি । শুধু দাঁত ঠোঁট চেপে রক্ত আর গাঁজটা মাঝে মাঝে বার করে দিচ্ছিল মুখ থেকে । সেটা গড়িয়ে পড়ছিল কিছুটা ওর জামায়, কিছুটা মেঝেতে ।
ঝাঝার একটু পরে একটা ছোট্টো স্টেশনে এসে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল অন্য একটা ট্রেনকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দিতে । যাত্রীরা, বিশেষ করে পুরুষ যাত্রীরা প্রায় সকলে বাইরে এসে প্ল্যাটফর্মে ও লাগোয়া দেয়ালে বসে পড়ল । ভোরের আবছা আলোয় ছেলেটিকেও নামিয়ে আনল লোকটি ।
বাকি সকলে দেয়ালে চড়ে বসল, ছেলেটি নিচে বসল হাঁটু মুড়ে । আস্তে আস্তে সকালের আলো বেড়ে উঠল । স্টেশন থেকে বাইরে গিয়ে একটু নেমে ছোট্টো দুএকটা জলাজমি । ট্রেনটা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে শুনে অনেকে প্রাতঃকৃত্য সারতে গেল জলার পাশের ঝোপগুলোতে ।
একটু পরে ট্রেনের পিছনের কামরাগুলোর দিক থেকে দুজন জিআরপি একটি ছেলেকে ধরে এগিয়ে এল । ফর্সা, লম্বা, ছিপছিপে শরীরের ছেলে ।
-       কী ব্যাপার ? চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে ।
বলছিলাম না, এদের পুরো গ্যাংটা এক সাথে ওঠে, লোকটি নিশ্চিন্ত ভাব দেখায়, আরো কয়েকটা হবে, এদিক ওদিকের কামরায় ।
ফর্সা ছেলেটি আমাদের ছেলেটির পাশ দিয়ে চলে গেল । দুজনের কেউই একে অন্যের দিকে তাকাল না ।
হঠাৎ আমাদের ছেলেটির পাশে মজা-দেখতে-সেঁটে-থাকা এক বালক উল্লসিত হয়ে ঘোষণা করে, বলছে পায়খানা পেয়েছে ! নিশ্চয়ই পালাবার মতলব !
লোকটি দুহাত দূরে বসেছিল । ওকে ঘিরেছিল কয়েকজন যেন নায়ককে ঘিরে রেখেছে । লোকটি দেয়াল থেকে পা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল । তারপর এগিয়ে এল ।
-       কী রে, পায়খানা পেয়েছে ? না, পালাবার মতলব ?
ছেলেটি করূণ চোখ তুলে তাকাল । তারপর আবার চোখ নামিয়ে ফোঁপাতে থাকল ।
-       যা যা ! এখানে হেগে প্যান্ট নোংরা করতে হবে না । যা পায়খানা করে আয় গিয়ে ।
ছেলেটি তবু উঠল না ।
-       যা বলছি !
ছেলেটি এবার উঠল । কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল ।
-       কী হল ?
-       কেউ সাথে ...
-       কোনো দরকার নেই । পালিয়ে তুই যাবি কোথায় ?
ছেলেটি মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে এগোল কামরার দিকে । ফচকে বালকটি নিজে থেকেই ওর সঙ্গ নিল ।
একটু পরে বালকটি কামরার দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঘোষণা করল, পায়খানাতেই গেছে !
ব্যাগ-হারান লোকটি এদিক থেকে স্নেহশীল ধমক দিল, এ্যাই, নিচে নাম ! ও কোথাও যাবে না । তোর সাথে থাকার কোনো দরকার নেই ।
বালকটি তবুও নামল না। ওখানেই দরজায় দাঁড়িয়ে হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে থাকল । মাঝে মধ্যে ভিতরে গিয়ে দেখে আসছিল ।
সূর্য উঠতে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছিল । হঠাৎ বালকটি উত্তেজিত ভাবে এল দরজার কাছে, নেই ! পালিয়ে গেছে !
বাকি সকলে উত্তেজিত । কিছু করবে এই আশায় ঘুরে তাকাল লোকটির দিকে । কিন্তু লোকটি নিশ্চিন্ত ভাবে যেমন কান খোঁচাচ্ছিল দেশলাই কাঠি দিয়ে তেমনই খোঁচাতে থাকল ।
-       ও কোথাও যেতে পারবে না । মোকামা থেকে কলকাতার মাঝে কোথাও ওর লুকোবার জায়গা নেই । ও বুঝে গেছে কার খপ্পরে পড়েছে ।
সকাল ছটা । ট্রেনটা চলছিল দুদিকের টাল (বর্ষায় জলডোবা প্রান্তর) পিছনে ফেলে । ছেলেটি আর ফিরে আসে নি । কেউ তার টিকিরও দেখা পায় নি ।
আমি বাঢ় স্টেশনে নেমে চা খাচ্ছিলাম । কামরার দিকে চোখ ওঠাতে লোকটিকে দেখলাম দাঁতন করছে । হঠাৎ ওর মুখটা মনে হল শীর্ণ, একটা কিছুর ভয়ে সন্ত্রস্ত আর সতর্ক, চিন্তিত ।দাঁতন সরিয়ে থুথু ফেলে ও কিছুক্ষণ নিরুদ্দিষ্ট ভাবে পাথরের নুড়ির ওপর পড়া থুথুটার দিকে তাকিয়ে রইল ।
ট্রেনটা স্টার্ট নিচ্ছিল । আমি চড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, বেশ কয়েকজনের কাঁধের ধাক্কা খাওয়া সত্ত্বেও ও নিজের ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, অন্যমনস্ক, অন্যদিকে তাকিয়ে । একটুও নড়ছে না । হয়ত, খেয়ালও করছেনা যে ওর ধাক্কা লাগছে ।             
     

[২৭.৪.৮৫]

বিশ্বনাথ সিং


মুখ্যমন্ত্রী তখনও আসেননি । বাইরে ভীড়ে ভীড় । আমিও বসে গেলাম এক কোণে । রাত তখন নটা । আর্দালিটা বলল, কখন ফিরবেন জানা নেই ।

সে অবশ্য আমিও জানতাম । ডামাডোল অবস্থা সরকারের । আগেরদিন বিধানসভায় অর্থমন্ত্রী নাস্তানাবুদ হয়েছে বিরোধীপক্ষের হাতে । ইন্ডাস্ট্রিগুলোর তো দেখছেনই কী হাল !

বসে রইলাম । রাত সাড়ে দশটায় মুখ্যমন্ত্রী এলেন । দুএকজনের পরেই আর্দালি বাইরে এসে ডাকল, বিশ্বনাথ সিং !

আমি ভাবিনি যে আমায় দেখতে পেয়েছিলেন বারান্দা দিয়ে ঢোকার সময় । বললে বিশ্বাস করবেন না, দশ মিনিট ! অন্য সকলে যেখানে দেড় দুই মিনিটে বেরিয়ে আসছিল সেখানে দশ মিনিট বসিয়ে রাখলেন আমাকে । গ্রামের খবরাখবর জিজ্ঞেস করলেন ।

... হ্যাঁ, আমাদেরই এলাকার তো । আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের । সে অনেক কথাবার্তা হল । আমি বললাম আমার কাজ কটার কথা । এক, গ্রামের উত্তরদিকের ক্যানালটার পাড় উঁচু করানো । বিডিও যা উত্তর দিয়েছিল তাও বললাম, যে কোনো ডেভেলাপমেন্ট ফান্ডে একটা কানাকড়িও নেই । অন্ত্যোদয়ের নামে সব হালে উপুড় করে পকেটে ভরেছে । একটা ফান্ডে শুধু কয়েক হাজার টাকা আছে । সেই টাকাটা যদি সেচের ফান্ডে ট্রান্সফার করানো যায়, তবে সে টাকায় কাজটা হয়ে যেতে পারে । ... আপনি একটু দেখুন ব্যাপারটা । সামনেই বর্ষাকাল আসছে । তার আগে কাজটা হয়ে যাওয়া দরকার । তা বললেন দেখব যথাসাধ্য চেষ্টা করে ।

আর কাজ ছিল খুড়তুতো ভাইদুটোর চাকরির । তা তক্ষুনি লিখে দিলেন । একজনের বারৌনিতে, অন্যজনের রোহতাসে ।

তারপর দুখড়া গাইলেন অনেক । তোমরা তো সবেতেই দোষ দেখতে পাও সরকারের । কম্যুনিস্ট পার্টির আবার একটা সত্যাগ্রহ আন্দোলন রয়েছে সামনের মাসে । সরকারের ভিতরেই টাস্‌ল লেগে আছে ।

তোয়াজ করবে না ? ওই এলাকায় যেই দাঁড়াক, তার কাছে আমার চ্যালেঞ্জ, দুহাজার ভোট আমি তার কেটে নেব । আজ পনের বছর ধরে ওই গ্রাম কম্যুনিস্ট পার্টির পাক্কা ঘাঁটি, একটা ভোটও এধার ওধার যাবে না । কম্যুনিস্ট পার্টি জিতুক না জিতুক, সে আলাদা কথা । কিন্তু ওই কটা ভোট এক কথায় কম্যুনিস্ট পার্টির ।

আরে এই গত ইলেকশনেই তো । একটাও বুথে পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত ছিল না । একটাও ভোট পড়ে না জানে, থেকে কী করবে ? ইলেকশনের পর প্রথম গিয়েছিলাম, তা দোষ দিতে শুরু করলেন যে তোমরা আমাদের পোলিং এজেন্টকে মেরে ভাগালে ! আমি বললাম যে আপনাদের একটা ভোটও যেখানে পড়ে না, আপনি ভালো করেই জানেন, সেখানে পোলিং এজেন্টকে মেরে ভাগানোর কথা আসছে কোত্থেকে ? আরে ওর বন্ধুরাই ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল চা খেতে । ওখানে বসে করার তো কিছু ছিল না । তারপর মাল টেনেছিল সেখানেই বচসা তারপর মারপীট ! এখন তার বদনাম দেওয়া হচ্ছে আমাদের ওপর !আরে আমরা কম্যুনিস্ট পার্টি বানিয়েছি, কাউনো লুচ্চা লফঙ্গার দল থোড়েই না ?


বিশ্বনাথ সিং তার ব্যাকব্রাশ কাঁচাপাকা চুলে হাত বোলালো । ছোটো চোখদুটো কুঁচকে আরো ছোটো হয়ে গেল গর্বিত আর সহজ একটা হাসিতে । পান সিগারেট কিছু খায় না তাই সামনের দাঁত চারটে ঝকঝকে । ময়লা নীল টেরিলিনের শার্টের বোতাম খোলা । ভিতরে ছেঁড়া নংরা একটা গেঞ্জি । পিতল রঙের টেরিলিনের প্যান্টটা কালচে হয়ে গেছে । পায়ে হাওয়াই চপ্পল । গামছাটা টেবিল থেকে নিয়ে ঘাম মুছল কপালের । দুটো মেয়ে ঢুকল দোকানে । একজনকে আগেও দেখেছি । মার্ক্স-এঙ্গেলস সিলেক্টেড হিন্দীটা কিনে নিয়ে গিয়েছিল । দ্বিতীয়জন নতুন । একটু পরে ভিতর থেকে এল মহেশ, দাদা, শুনুন তো এরা কোন বই চাইছে ! আমি চাইলাম মেয়েদুটোর দিকে ।
-      আর পি দত্ত, ভারত ...কী যেন !
-      রজনি পাম দত্ত ? আজ কা ভারত ?
-      জী ! জী !
-      আছে নাকি মহেশজী ?

বিশ্বনাথ সিং মাথা নাড়ল, নাঃ, আর থাকলেও সব বাঁধাছাঁদা হয়ে গেছে । আর বার করাও যাবে না। মহেশ ওদিক থেকে একটা বইয়ের প্যাকিং বাক্স কাঁধে উঠিয়ে এনে দোকানের বাইরে রাখল । পাশেই ডাঁই করে রাখা আছে পুরোনো অনেক ছবির এ্যালবাম, বই, গ্রামোফোন রেকর্ড । ওগুলো এমনিই ফেলা যাবে । আমি ওর মধ্যে থেকে হাঁটকে একটু আগে বার করেছি, অজন্তার ফ্রেস্কোর একটা এলবাম, কিছু চিনে তুলি-কালির ছবি, লেনিনের প্রিয় গানের একটা গ্রামোফোন রেকর্ড আর রুশী মহাকাশযান থেকে পৃথিবীতে ভেসে আসা কন্ঠস্বরের একটা ছোট্টো প্লাস্টিক রেকর্ড ।
-      দোকান উঠে যাচ্ছে ম্যাডাম ।
-      মানে, পিপল্‌স বুক ... থাকবেই না ?
-      থাকবে । ওইদিকে, আরিফগঞ্জে, আমাদের অফিসটা দেখেছেন ?
-      কেন ? এখানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, স্টুডেন্টদের হস্টেল !

আবার বিশ্বনাথ সিং জবাব দিল, রুস গির ন গয়া ম্যাডাম ! এখন এ দোকানের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ির মালিক । অত ভাড়া দেওয়া পোষাচ্ছে না । মেয়েদুটো বেরিয়ে গেল ।
............     


আ ই আজ কে বাত বা ? মায়ট্রিক মা পঢ়ত রহনি তবহিয়ে সে ! বিশ্বনাথ সিং আবার ফিরে গেল পুরোনো কথায়, ... ছুটির শেষে বাঁধের ওপর দিয়ে ফিরছিলাম । দেখি ভীড় জমে আছে । ভিতরে ঢুকে দেখি একজন দুসাধ, তালগাছ থেকে পড়ে মরে গেছে । আর লোকজন নিয়ে তখনই ছুটে এসেছে বৈজনাথ সিং । হাতে কিসের শালা একটা চোথা কাগজ। দেখি ওই দুসাধের আঙুলে কালি লাগিয়ে টিপছাপ দেওয়াচ্ছে তাতে । আমি দেখে এগিয়ে শালা ঝাঁপ দিয়ে কাগজ ছিনিয়ে নিলাম । কিসের টিপছাপ ? নাকি ওই দুসাধ পাঁচশো টাকা নিয়েছিল বৈজনাথের কাছে । ভেবেছিল ফিরিয়ে দেবে তাই কাগজ করেনি । হঠাৎ মরে গেল । তাই ! ... মিথ্যে কথা । প্রমাণ আছে কোনো ? আর কে কবে শুনেছে যে মরা মানুষের আঙ্গুলের টিপছাপ নেওয়া হয় ? বেচারার কিছুটা জমি আছে সেটা হড়পাতে চাও তাই শালা মিথ্যে দলিল নিয়ে এসেছ ! বৈজনাথ সিং গর্জিয়ে উঠল, এ হৃদে সিং কে বেটা, তুই ছোটো ছেলে, এসবে লাগতে আসিস  না । দিয়ে দে দলিলটা । আর দলিল ! ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ মুখে রা কাড়ছিল না কিন্তু আমরা চারজন বন্ধু তো ছিলামই । ধাওয়া করতেই দলিলটা হাতে নিয়ে পালালাম । তারপর ওদের দেখিয়ে শালা চোথা কাগজটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে উড়িয়ে দিলাম ।

বাড়ীতে এসে কাউকে কিছু বললাম না । সন্ধ্যেবেলায় বৈজনাথ সিং এসে হাজির । কাকা বাইরে বসেছিল । কাকাই তো বড় করেছে আমাকে আর ভাইদের । পড়াশোনা করেনি কিন্তু জেদি লোক । যা ভাববে ঠিক, তাই ঠিক থাকবে তার জন্য লাঠি চলুক আর বন্দুক চলুক । তা কাঁদুনি গাইল বৈজনাথ সিং । কাকা আমাকে ডাকলেন । গেলাম । যা যা হয়েছিল সব বললাম । শুনে ফিরে তাকালেন কাকা বৈজনাথ সিংএর দিকে । তা বল্‌। তোর কী বলার আছে ? বৈজনাথ সিং বলল, বলার আর কী ? ওইটুকু ছেলে ! সব জায়গায় যদি নাক গলাতে চায় তাহলে চলে ? কোনোদিন যদি কিছু হয়ে যায় ...! শুনেই কাকা ক্ষেপে গেলেন, হয়ে যায় মানে ? তুই কী বলতে চাস ? বলি, মরা মানুষের আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে এটা কে কবে কোথায় শুনেছে ? ঠিক করেছে ও । আবার ওই সব হলে আবার করবে । ছোটো ছেলে বলে কি চোখের সামনে দেখবে, বুঝবে অন্যায় হচ্ছে আর মেনে নেবে ?

বৈজনাথ সিং জানত কাকাকে টলান যাবে না । তাই ঘাঁটাল না বিশেষ । ফিরে গেল । আর আমাদের আর কী ? বুঝতেই পারছেন ! বাড়িতে যে জেঠ লোক, তারই যখন এই ভাব তো আমাদের আর রোখে কে ?


পাঁচ মাস পরে আবার লাগল ঝগড়া ! ...

Tuesday, October 9, 2018

শেষ ক্লাস

[নাট্যস্থলে ৮-১০ বছরের একটি শিশু কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কম্বলটা সরে গেলে শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিজেই গায়ের ওপর টেনে নেয় আবার। পরীর সাজে এক নারী প্রবেশ করে। সে পরীই। তার হাতে জাদুর ছড়ি। কাঁধে ডানা। জাদুর ছড়ি ছুঁইয়ে সে শিশুটিকে স্বপ্নে জাগায়।]

পরী -            ফ্রাঞ্জ! ওঠো!
ফ্রাঞ্জ-           (ঘুম ভেঙে ওঠার মত, স্বপ্নে জাগে) তুমি?
পরী -            হ্যাঁ, আমি। যাবে না?
ফ্রাঞ্জ-           কোথায়?
পরী -            নদীর তীরে! কাল দেখেছিলে না একটা পাখির বাসা? ওটা নামাবো। ওর ভিতর থেকে পাখির বাচ্চাগুলো বার করে হাতের ওপর রাখবো। দেখবো কেমন করে ওরা দু’পায়ে চলার চেষ্টা করে! তারপর অনেকক্ষণ চান করবো নদীতে। জলে ট্রাউট মাছগুলোর ঝিকিমিকি! আহা! ... আবার, কাঠচেরাই কলে কাজ করে যে বুড়ো ওজের – ও তো কথা দিয়েছিলো তোমায় যে অনেকখানি কাঠের গুঁড়ো দেবে! কেমন সোঁদা গন্ধ হয় টাটকা কাঠের গুঁড়োয়! চলো, চলো! অনেকক্ষণ ধরে ঘুরবো শহরের বাইরে মাঠগুলোয়। ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ শুনবো ঝোপে!
ফ্রাঞ্জ -          (উঠে হাত ধরে চলতে শুরু করে) কিন্তু তোমাকে আমার মায়ের মত দেখাচ্ছে কেন? তুমি তো পরী!
পরী-             কেন, পরীরা মায়ের মত হতে পারেনা বুঝি?
ফ্রাঞ্জ-           না, মানে, পারে কিন্তু তাহলে ভয় করে।
পরী -            (হেসে ওঠে) কী ব্যাপার? কিসের ভয়?
ফ্রাঞ্জ-           তুমিও আবার আমাকে স্কুলে যেতে বলবে না তো?
পরী -            বাব্বা! স্কুলকে এত ভয়? আচ্ছা, বাদ দাও স্কুলের কথা। দেখ, (একটু ঘুরে, নাট্যস্থলের অন্যদিকে) আমরা কাঠচেরাই কলের পিছনে রিপার মাঠে পৌঁছে গেছি। আরে! আজ তো হাওয়ায় শীতও নেই! (মাটিতে হাত ছোঁওয়ায়) শিশিরে ভিজে আছে ঘাস!
ফ্রাঞ্জ -          (চিত হয়ে শুয়ে পড়ে ঘাসে) কী ভালো লাগে আকাশটাকে এভাবে দেখতে! (হঠাৎ নেপথ্যে শিশুদের লেখাপড়ার কোলাহল ভেসে আসে। কয়েকজন নামতা মুখস্ত করছে – সতেরো এক্কে সতেরো, সতেরো দুগুণে চৌঁত্রিশ, সতেরো তিনে একান্ন ... । কয়েকজন ভুগোল পড়ছে – বিষুব রেখার ওপরকার আদ্ধেক পৃথিবীকে উত্তর গোলার্ধ এবং ... । তিন চার ধরণের পাঠের কোলাহলে যে এক ছন্দ উৎপন্ন হয়, যেন সে ছন্দেই নাট্যস্থলের এক ধার থেকে এক রোগা বুড়ো মানুষ প্রবেশ করে। তার গায়ে একটা পুরোনো কোট। বাঁ হাতে ছড়ি এবং ডানমুঠোয় চক, বোঝা যায় তিনি স্কুলের শিক্ষক।)
শিক্ষক-         ফ্রাঞ্জ! কোথায় গেলে, ফ্রাঞ্জ! এত দুষ্টু এ ছেলেটা! চোখ সরতেই ক্লাস থেকে অদৃশ্য! নিশ্চয়ই গিয়ে হবে নদীর তীরে। এলে বোঝাবো। আজ এই ছড়ি ওর পিঠে ভাঙবো। একটাও টাস্ক পুরো করে আসে না বাড়ি থেকে। বাড়ির লোকেরাও হয়তো নজর দেয় না! ফ্রাঞ্জ!
ফ্রাঞ্জ -          বাপরে! এ যে মঁসিয়ে আমেল! আমায় খুঁজতে খুঁজতে এখানেও চলে এসেছেন? (পরীর দুটো হাত ধরে টানতে টানতে) আমাকে ঢেকে নাও। লুকিয়ে নাও আমাকে। আমাকে দেখতে পেলে মঁসিয়েঁ এখানেই আমাকে মুর্গী হতে বলবেন। (পরীকে টেনে বসিয়ে তার দুটো ডানা নিজের মুখের ওপর টেনে নেয়)।
শিক্ষক -        (নাট্যস্থলের বাইরে, অদৃশ্য ক্লাসের দিকে হাত নাড়িয়ে) ঠিক আছে। আজকের মত তোমাদের ছুটি। (বাচ্চাদের কোলাহল এখন আনন্দের, সপ্তমে পৌঁছোয়) চুপ, চুপ! একদম চুপ! (সবাই চুপ করে) কাল সবাই সময় মত স্কুলে আসবে। সবাই টাস্ক পুরো করে আনবে। ... আর একটা কথা। কালকের ক্লাস একটা বিশেষ ক্লাস হবে। কাল একটা বিশেষ দিন। সব ক’জন কাচা, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে আসবে। সব ক’টা বই আর খাতা সঙ্গে করে আনবে। বিশেষ করে ভাষাশিক্ষার বই, (একটু থেমে, কিছু ভেবে) মাতৃভাষা, মায়ের মুখের ভাষা, ফরাসী ভাষার বই আনতে কেউ যেন না ভোলে। যাও, এবার ছুটি। (ছুটির কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়; মঁসিয়েঁ আমেলও নাট্যস্থল থেকে বেরিয়ে চলে যান)।
পরী -            (ফ্রাঞ্জের হাতের টানে ইতিমধ্যে ডানাদুটো কাঁধ থেকে খুলে গেছে; ফ্রাঞ্জকে সজোরে নাড়াতে নাড়াতে, কঠোর কন্ঠস্বরে) ফ্রাঞ্জ! ফ্রাঞ্জ! ওঠ্‌! সকাল হয়ে গেছে। স্কুলে যাবি না? এ এক ছেলে হয়েছে আমার! না স্কুলে যাবে না বাড়ির কোনো কাজ করবে! বাপ তোর কখন, সূর্য ওঠার আগে চলে গেছে ক্ষেতে। স্কুলে যাবি না তো যা, বাপের সাথে চাষের কাজও কর! তাও তো কিছু শিখবি! ফ্রাঞ্জ! ওঠ্‌!...
ফ্রাঞ্জ -          (ধড়ফড়িয়ে উঠে) মঁসিয়েঁ আমেল চলে গেছেন?
মা -              কে মঁসিয়েঁ আমেল? সেই তোদের স্কুলের শিক্ষক? এখানে কোত্থেকে আসবেন? স্বপ্ন দেখছিস নাকি?
ফ্রাঞ্জ -          আরে! এখন তো তোমাকে এক্কেবারে মায়ের মত দেখাচ্ছে!
মা -              মায়ের মত! কী যা তা বলছিস?
ফ্রাঞ্জ-           (এবার পুরোপুরি জেগে উঠে) মা! ...ওই পরীদিদি এক্কেবারে তোমার মত... (মেঝের দিকে তাকিয়ে) আর, এই তো ওর ডানাদুটো!
মা -              ও দুটো ডানা? ঘরের জিনিষগুলোও চিনিস না? হাতপাখাদুটোর একটায় বাঁট নেই। কোথায় রেখেছি, পাচ্ছিনা। আরেকটার বাঁট খুলে গেছে । ব্লোপাইপটার ভিতরে কিছু জমে আছে (পরীর ছড়িটা তুলে দেখায়)। হাওয়া দিলে আগুন ধরে না কাঠে। ঘরগুলো কনকন করে ঠান্ডায়। তোর কাছে নিয়ে এসেছিলাম যে একটু ভালো করে মেরামত করে দিবি। তা, ঘুম ভাঙলে তবে তো! এখন বন্ধ কর স্বপ্ন দেখা। শিগ্‌গির তৈরি হ। তোর ধোওয়া জামাকাপড় সিন্দুকের ওপর রাখা। জলখাবারও তৈরি। না খেয়ে বেরোবি না বলে দিলাম।
ফ্রাঞ্জ -          (মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে) কিন্তু, মা! তুমি আজকে কী সুন্দর দেখাচ্ছো! এই পরীদের মত গাউন কোথায় পেলে? একদম পরী মনে হচ্ছে তোমাকে!
মা -              কেন, তুই তো মাঝে মধ্যেই সিন্দুক ঘাঁটিস। মানা করা সত্ত্বেও। চোখেও পড়েনি গাউনটা? তা পড়বে কেন, শুধু অকাজের জিনিষ খোঁজার ধান্ধা। ভাঙা হাতুড়ি, বাঁকা পেরেক, ছেঁড়া কাপড়...। এই গাউনটা আমার বিয়ের। আজ পরলাম এতোদিন পর। (ফ্রাঞ্জের প্রশ্নসঙ্কুল মুখের দিকে তাকিয়ে) তোর সাথে স্কুলে যাবো যে আজ!
ফ্রাঞ্জ -          (আঁতকে উঠে) স্কুলে যাবে! মঁসিয়েঁ আমেল নালিশ করেছেন আমার নামে?
মা -              না, তবে বলেছেন তোর ওপর নজর রাখতে। তুই স্কুলে যাস না অন্য কোথাও চরিয়ে বেড়াস। আর তোর সাথে বসে একটু লেখাপড়াও করবো!
ফ্রাঞ্জ -          ধ্যাৎ। তুমি তো অক্ষরই চেনো না।
মা -              চিনে নেবো! আসল কাজটা তো হবে! তোর ওপর নজর রাখা! (ফ্রাঞ্জের ভয় ও অবিশ্বাসে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে) ওলে আমাল পাগল ছেলে! মুখটা ভয়ে শুকিয়ে একেবারে নীল হয়ে গেল! তোর মনে নেই মঁসিয়েঁ আমেল কী বলেছিলেন গতকাল? আজ একটা বিশেষ দিন?
ফ্রাঞ্জ -          তুমি জানলে কীভাবে? উনি তো স্কুলে বলেছিলেন!
মা -              ওই যে, মঁসিয়েঁ পিয়েরে, ডাকপিয়ন, উনি কাল সন্ধ্যেবেলা প্রতিটা বাড়িতে খবর দিয়েছেন যে আজ সবাইকে স্কুলে পৌঁছোতে হবে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। তাই তো এই গাউনটা বার করলাম। এবার যা। কথা না বলে শিগ্‌গির তৈরি হ তো!
ফ্রাঞ্জ-           (বাইরে যেতে যেতে) বাবাও আসবে স্কুলে?
মা -              নিশ্চয়ই। ওনাকেও তো বলা হয়েছে। তুই তৈরি হয়ে শিগ্‌গির পৌঁছো। আমি ক্ষেতে গিয়ে দেখছি উনি যাবেন কিনা। উনি না যেতে পারলে আমি একাই পৌঁছোবো একটু পরে (মাও বাইরে চলে যান)।

[দর্শকদের মাঝ থেকে একেক জন একেকটা লাইন বলতে নাট্যস্থলে আসে]

১ -               ১৫ই মার্চ ১৮৭১, মানে আপনাদের সময় থেকে ১৪৬ বছর আগে
২ -               ইওরোপের ফরাসী দেশটা জার্মানি কর্তৃক আক্রান্ত
৩ -              দক্ষিণ ফ্রান্সের আলসাশে লোরেন এলাকাটা জার্মানির কব্জায়
৪ -               আলসাশে লোরেনের প্রত্যেকটি জনপদে জার্মান ফৌজ
৫ -               আজকের সরকারী ফরমান
৬ -               জার্মান সরকারের সিদ্ধান্ত যে আগামীকাল থেকে আলসাশে লোরেন অঞ্চলের কোনো স্কুলে ফরাসী ভাষা পড়ানো হবে না
৭ -               জার্মান ছাড়া আর কোনো ভাষা কোনো স্কুলে পড়ানো হবে না

[অষ্টম জন হাতে একটা লম্বা লাঠি হাতে ঢোকে যার ওপরে একটা বোর্ড লাগানো – ‘টাউন হল’; তার নিচে একটা স্ক্রল ঝুলছে যাতে ওপরে লেখা ‘আজকের সরকারী ফরমান’ এবং তার নীচে তারিখ দিয়ে ফরমানটা লেখা। সে এক জায়গায় দাঁড়ায় এবং বাকি সবাই তাকে ঘিরে ধরে ফরমানটা পড়তে থাকে] ... ফ্রাঞ্জ পরিষ্কার জামাকাপড় পরে, স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রবেশ করে। টাউন হলের সামনে ভীড় দেখে দাঁড়িয়ে যায়। ভাবে, ভীড়ের ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবেনা।]

ফ্রাঞ্জ-           (স্বগত) না, না, ঢুকবো না। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। আর দেরী করলে মঁসিয়েঁ আমেল মেরে আমার হাড়গোড় ভেঙে দেবেন। কে জানে, আজকের ফরমানে কী খারাপ খবর রয়েছে। রোজই তো খারাপ খবরই থাকে (আস্তে, মুখ ভেঙিয়ে) জার্মান সেনার প্রবেশ, বার্লিনের হুকুমনামা... । নাঃ, আজ আর যাবো না টাউন হলের দিকে। (এগোতে যায় কিন্তু পিছিয়ে আসে কেননা সামনের দিক থেকে দুজন জার্মান সৈনিক ঢোকে। ওদের দেখেই আগে ফ্রাঞ্জ তারপর বাকি সবাই দৌড়ে পালিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।)

[জার্মান সৈনিক দুজন নাট্যস্থলের একদিকে বাইরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ে। অন্যদিক থেকে এক বৃদ্ধা ঢোকেন]

বৃদ্ধা -           খুলছি, খুলছি। (দরজা খোলেন, খুলেই ভয়ে পিছিয়ে আসেন) কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
সৈনিক-         মঁসিয়েঁ আমেলকে ডেকে দিন।
বৃদ্ধা-            হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাকছি। ডাকছি। (ভিতরে অন্য প্রান্তে গিয়ে একটা ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ফিসফিস করে বলেন) মঁসিয়েঁ আমেল! শুনছেন? (দরজায় আস্তে চাপ দেন, দরজাটা খুলে যায়) আরে, ভিতরে তো নেই! জলখাবারটাও তো খেলেন না। কী বলি ওদের? নিশ্চয়ই গ্রেপ্তার করতে এসেছে ওনাকে, বা নজরবন্দী করতে। ঘরে নেই বললে ওরা সতর্ক হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং ...(হাতে একটা ঝুড়ি নিয়ে, বাইরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে) আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। উনি ঘুমিয়ে ছিলেন। উঠিয়ে দিয়েছি। আসছেন।... আমি একটু বেরোবো, বাজার করতে, যাই? (বেরিয়ে যান)

[শূন্য নাট্যস্থলে একটা ভালো কোট পরে প্রবেশ করেন মঁসিয়েঁ আমেল। এক এক করে কিছু শিশু ও কিছু বয়স্ক মানুষ প্রবেশ করতে থাকে, এবং তারা মাটিতে (বা চেয়ার, বেঞ্চ ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা হলে তাতে) বসে পড়ে। একজন বৃদ্ধ কর্মচারী স্ট্যান্ডে ব্ল্যাকবোর্ড এবং একটি চেয়ার এনে রাখে, তারপর বাকিদের সাথে পাশ দিয়ে বসে পড়ে।]   
 
আমেল -        (দর্শকদের উদ্দেশ্যে) আমি আমেল। বিগত চল্লিশ বছর ধরে গ্রামের এই স্কুলটায় পড়াচ্ছি। ফরাসী ভাষা, আমাদের মাতৃভাষার শিক্ষক আমি। ... আপনাদেরও তো নিজেদের মাতৃভাষা আছে। আপনার আছে। আপনার আছে। আপনার... । মাতৃভাষা অর্থাৎ সেই ভাষা যে ভাষায় মা আমাদের স্তন্যপান করান। সেই ভাষা যার পথ ধরে আমরা পৃথিবীর যেকোনো অন্য ভাষার অন্তরঙ্গতম সত্যে পৌঁছোতে পারি। যে ভাষাটি হৃদয়ে না থাকলে আমরা কোথাও যেতে পারি কিন্তু পৌঁছোতে পারি না। কেননা ভাষার সত্য তো আর শুধু অক্ষরে, শব্দে আর বাক্যগঠনের ব্যাকরণে থাকে না। ভাষার সত্য (মাটিতে নুয়ে একমুঠো মাটি তুলে) এই মাটিতে মাইলের পর মাইল দুলতে থাকা ফসলের শীষে, দানাগুলো পেকে ওঠার নৈঃশব্দেও থাকে।... আর, আপনাদের কেনই বা বলছি? আমার পর এই পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো বছর পেরিয়ে গেছে। মাতৃভাষার সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রুপান্তরিত হতে, মাতৃভাষার পতাকাকে দেশের পতাকা হয়ে উঠতে আপনারা দেখেছেন। অনেকে শরীক হয়েছেন। ... (বেদনার হাসি মুখে নিয়ে) কিন্তু দেড়শো বছর আগে, পৃথিবীর অনেক নিপীড়িত ভাষার মত ফরাসী ভাষাও নিপীড়িত হয়েছিল, আর আলসাশে লোরেন অঞ্চলের এই গ্রামে আমরা সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা ছোট্টো করে ভাবছিলাম। ... আর তাই, আজ, ১৫ই মার্চ ১৮৭১ আমাদের গ্রামের জন্য এক বিশেষ দিন! (চেয়ারে বসে পড়ে। ইতিমধ্যে আরো অনেকে এসে বসে পড়েছে। সব শেষে ফ্রাঞ্জ দৌড়ে ঢুকতে গিয়ে, দেরী হয়ে গেছে ভেবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যায়)।
                   (কোমল স্বরে) এসো ফ্রাঞ্জ! বসে পড়ো শিগ্‌গির! তোমাকে ছাড়াই আমরা শুরু করতে যাচ্ছিলাম। (ফ্রাঞ্জ তাড়াতাড়ি ঢুকে কাউকে ডিঙোতে গিয়ে পড়ো পড়ো হয়। তারপর ধপ করে বসে পড়ে। ভয় পায় যে শিক্ষক বকবেন অথবা ছেলেটি নালিশ করবে। কিন্তু কেউ কিছু বলেনা। ফ্রাঞ্জ অবাক হয়ে সবাইকে দেখতে থাকে) প্রিয় শিশুরা! ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ! আমি বলেছিলাম যে আজ একটি বিশেষ দিন। ডাকপিয়ন পিয়েরেকে দিয়ে সবার বাড়িতে খবরও পাঠিয়েছিলাম। আর তাই, আজ এই স্কুলে শিশুদের সাথে তাঁদের অভিভাবকেরাও এসেছেন। আপনাদের সবাইকে এজন্য আমার ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আজ বিশেষ দিন কেননা শিশুদের সাথে আজ আমার শেষ ক্লাস। আর তাই, অভিভাবকগণ, এ ক্লাসে আপনাদেরও স্বাগতম! শেষ ক্লাস। বার্লিন থেকে হুকুম এসেছে যে আলসাশে লোরেন অঞ্চলের কোনো স্কুলে এবার থেকে জার্মান ছাড়া অন্য কোনো ভাষা পড়ানো হবে না। কাল তোমাদের নতুন শিক্ষক আসবেন। আজই তোমরা শেষবারের মত ফরাসী ভাষা পড়তে পারবে। তোমাদেরকে অনুরোধ, মন দিয়ে নিজেদের পড়া করো। (এর পর ক্লাস চলে মূকাভিনয়ে বা স্তিমিত আওয়াজে। শিক্ষক কিছু পড়ান, বোর্ডে লেখেন, শিশুদের প্রশ্ন করেন, শিশুরা জবাব দেয়...। ফ্রাঞ্জ, দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্বগত বলতে থাকে।)
ফ্রাঞ্জ -          তার মানে টাউন হলের নোটিশ বোর্ডে এটাই লেখা ছিল! আমি শেষবারের মত ফরাসী পড়ছি? আমি তো লিখতেও পারি না ভালো করে!... মঁসিয়েঁ আমেল চলে যাবেন? ... তাই আজ ইস্ত্রি করা কোট পরে এসেছেন! তাই, বুড়ো ওজের, পুরোনো মেয়র সাহেব, ডাকপিয়ন ওজের, সবাই বসে আছে এখানে। মা, বাবারও তো আসার ছিল? আর মঁসিয়েঁ আমেলের বোন?
আমেল -        ফ্রাঞ্জ! এবার তোমার পালা। (চমকে, হড়বড়িয়ে শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় ফ্রাঞ্জ) উঠে এসো। (ফ্রাঞ্জ নিজের জায়গা থেকে বেরিয়ে শিক্ষকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক হাতের খড়িটা ফ্রাঞ্জের হাতে দেন) লেখো তো - ‘আমি ফ্রাঞ্জ, আলসাশে লোরেনএ থাকি’। (ফ্রাঞ্জ ভাঙাচোরা অক্ষরে লেখে। আলসাশে লোরেনের বানানটা ভুল। অনেকে হেসে ওঠে।) তোমাকে বকবোনা ফ্রাঞ্জ। দেখো কী হয়, ঠিকমত লেখাপড়া না করলে। সব সময় তুমি হয়তো ভাবতে, ‘ওহ, এখন তো অনেকটা কাল পড়ে আছে, কাল নাহয় যাওয়া যাবে স্কুলে’। এবার দেখো কী হল! ... আর শুধু তুমি কেন, এই এলাকার মানুষজনেরাই দুর্ভাগা; লেখাপড়া শেখার কাজটা কালকের উপর ছেড়ে দিল। এখন যদি জার্মানরা আসে আর বলে, “কী? এতো বড়াই করতে যে তোমরা ফরাসী! তোমরা তো নিজেদের ভাষাটাই জানো না! না বলতে পারো না লিখতে পারো!” এমন নয় যে দোষটা একা তোমাদেরই। অনেকের বাবা মা এটাই চাইতো যে তাদের ছেলে ক্ষেতে বা মিলে কাজকর্ম করে কিছু শিখুক, কিছু রোজগার করুক। এখনো সেই অবস্থাতেই আছি আমরা। ... আমিও দোষী। কখনো পড়াতে ইচ্ছে করেনি, তোমাদের দিয়ে স্কুলের বাগানের পরিচর্যা করিয়েছি। কখনো ছুটি দিয়ে দিয়েছি, অথচ তেমন কিছু কাজও ছিলো না। ভালো রোদ উঠেছিলো বলে নদীতে মাছ ধরতে গেছি। (ইতিমধ্যে মঁসিয়েঁ আমেলের বোন অর্থাৎ আমেলের বাসস্থানের সেই বৃদ্ধা মহিলা নিঃশব্দে প্রবেশ করে দাঁড়িয়েছে, হাতে প্যাকিংএর দড়ি, কিছু জিনিষ আর খবরের কাগজের বান্ডিল)।
বোন-            আমেল! আমরা কি এই পুরোনো খবরের কাগজগুলোও নিয়ে যাবো?
আমেল-        জার্মান সৈনিক দুজন এখনো দাঁড়িয়ে আছে?
বোন -           মনে হয় না। নিশ্চয়ই ওরা দপ্তরে খবর দিয়েছে এবং হয়তো এদিকেই আসছে। এসব ভেবেই আমি ঝুড়িতে করে এসব নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। হয়তো তোমার এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ।
আমেল-         আমি তো ওদের ফরমান অমান্য করছি না! ফরাসী ভাষা পড়ানো বন্ধ হবে আগামীকাল থেকে। আজ তো আমরা পড়তেই পারি।
বোন -           জানি না। ওদের মতিগতি বোঝা খুব মুশকিল। একটা মেরুদন্ডহীন রাজা আর তার সরকার না থাকলে কি এসব হতে পারতো? ... যাহোক, খবরের কাগজগুলো?
আমেল -        দিদি! আমরা কি উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা আখরোটের ওই গাছটা নিয়ে যেতে পারবো? চল্লিশ বছর আগে নিজের হাতে চারাটা পুঁতেছিলাম। আর ছাত অব্দি পৌঁছে যাওয়া হপএর লতাটা? চল্লিশ বছরের স্মৃতির একটা অংশ আমাদের সাথে আছে। বাকিটা সেই সমস্ত কিছুর সাথে, এই সমস্ত মানুষজনের সাথে আছে যাদের সাথে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। ... কিন্তু, হ্যাঁ খবরের কাগজ। নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো এই খবরের কাগজগুলো। (কাগজগুলোর ওপর হাত বোলান) কেননা এগুলো ফরাসী-আলসাশের খবরের কাগজ, জার্মান-আলসাশের নয়। (বোন চলে যান। আমেল মাথা নত করে বসে পড়েন যেন মাথাটা ভারী হয়ে গেছে। ওপরে ছাতের কাছে পাখির আওয়াজ পেয়ে ওপরে তাকান।)

[ক্লাস যেমন ছিলো তেমনই থাকে। মুকাভিনয়ে, ঈষৎ পরে আমেল নিজের কাজে ব্যাপৃত হন। নাট্যস্থলের অন্যদিকে সেই দুজন জার্মান সৈনিক ঢোকে।)

১ম -             ধ্যাস্‌সালা, ভাল্লাগে না।
২য় -             কী হল?
১ম -             কী হবে? সক্কালে উঠে গ্রামের এক প্রান্তে এতক্ষণ একটা ফাঁকা বাড়ি পাহারা দিলাম। এবার ছুটছি অন্য প্রান্তে, স্কুলে, হয়তো ওটাও ফাঁকা পাবো।
২য় -             কেন, ফাঁকা বাড়ি থেকেই তো ওই সুইস ঘড়িটা হাতালি।
১ম -             বাঃ, আর ওই পুরোনো রূপোর বাতিদানটা। ওটা কে হাতালো?
২য় -             ঠিক আছে। আমিই হাতালাম। মানে বলছি, ভালোই তো হল, সকালের কামাইটা। তো, ভাল্লাগে না বলছিস কেন?
১ম-              আরে, অন্য কোনো একটা বাড়িতে পাঠাতে পারতো না? (২য় জনের দিকে চোখ মেরে) যেখানে সুন্দরী মেয়ে থাকতো দুটো। বা নাহয় একটাই। ওতেই দুজনের কাজও চলে যেত, কী বলিস?
২য় -             তুই শুধরোবি না। (প্রথমজন কথার উত্তর না দিয়ে এক দিকে দৌড়ে গিয়ে সজোরে নিজের তরোয়ালটা চালায়। তারপর নিচে হাত ডুবিয়ে একটা রক্তাক্ত খরগোশ ঠ্যাং ধরে উঠিয়ে আনে।)
১ম -             যাক বাবা, একটা জোগাড় তো হল। দুদিন ধরে শুধু কালো রুটি খাচ্ছি। এবার আগে এটাকে পোড়াবো, দুজনে মিলে খাবো, তারপর ডিউটি। কী বলিস! (২য় জনেরও চোখ চকচক করে খরগোশটা দেখে।)
২য় -             দাঁড়া, শুকনো কাঠ জোগাড় করার ভারটা আমার। (সে এগিয়ে যায়। নাট্যস্থল থেকে বেরিয়ে যায়। তারপরেই হিড়হিড় করে একটি কাঠকুড়ুনি মেয়েকে টানতে টানতে ঢোকে।) এই দ্যাখ। মাথায় বোঝাই শুকনো কাঠ, অথচ দেবে না। এখন বল, তোর কাঠ চাই, না (মেয়েটার শরীরের দিকে অশ্লীল ভাবে আঙুল দেখিয়ে) এটা চাই। নাকি দুটোই চাই।
১ম -             (হঠাৎ গলার স্বরটা অদ্ভুত রকমের দ্বিধান্বিত হয়ে যায়) শুধু কাঠ রেখে নে যে কটা প্রয়োজন। মেয়েটাকে যেতে দে।
২য়-              (মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে গালে হাত বোলায়) কেন রে? এখনই তো খুঁজছিলি!
১ম -             (তরোয়ালের হাতলের ওপর হাতটা শক্ত হয়, আবার ঢিলে করে সরিয়ে নেয়, মেকি কটাক্ষে) তোর কোনো স্বাদের বোধ নেই। আমি বলছিলাম কোনো ধনী ঘরের আদুরে বেটির কথা আর তুই কাঠকুড়ুনির চক্করে পড়ে গেলি। ভাগা ওকে। (মেয়েটিকে) অ্যাই, দেখি তোর কাঠ (জোর করে তার কাঠের বান্ডিলটা নামিয়ে আন্দাজ মত কয়েকটা কাঠ রেখে নেয়। তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে নাট্যস্থলের বাইরে পাঠিয়ে দেয়।)

[দুজনে মিলে আগুন জ্বালায়। তরোয়ালে গেঁথে খরগোশটাকে আগুনের ওপর ধরে রাখার ব্যাবস্থা করে। গুনগুন করে গান ধরে।]

২য় -             (নিজের জলের থলেটা বার করে। দেখে জল নেই) তোরটায় জল আছে?
১ম -             নাঃ।
২য় -             একটু জল নিয়ে আসি নদী থেকে, তুই বোস। (বলে বেরিয়ে যায়)
১ম -             (দর্শকদের দিকে) লোরেনেরই পুবদিকে জার্মান এলাকায় আমার গ্রাম। এই একই রকম। ছোটোবেলায় আমার দিদিও কাঠ কুড়িয়ে আনতো। আমি কতবার গেছি তার সাথে। এখন এসব এই ভদ্রপুঙ্গবকে বলে তো লাভ নেই। তাই কায়দা করলাম। ... (ছুরি দিয়ে খরগোশটার ভালোভাবে পোড়া অংশটা খোঁচায়। একটু উঠে আসে ছুরির ডগায়। ফুঁ দিয়ে দিয়ে সেটা মুখে দেয়, চিবোয়) আঃ ! (একটা কাঠির ভর দিয়ে বড় টুকরো কাটার চেষ্টা করে। এবং এটাই চলতে থাকে)।    

[ক্লাসে আওয়াজ জোরালো হয়ে ওঠে।]

আমেল -        সবাই পড়া করো নিজের। আজ কেউ আগে ছুটি পাবে না।
ফ্রাঞ্জ -          (স্বগত) জার্মান সৈনিকেরা এলে তো ছাতের এই পায়রাগুলোকেও বলবে (সৈনিকের ভঙ্গীতে) ‘হেএই! লেফ্‌ট-রাইট, জার্মান বলো!’ কিন্তু ফুর্‌র্‌র করে উড়ে যাবে পায়রাগুলো। বেচারাগুলো ভয়ের চোটে হাগু করে ফেলবে ওদের হেলমেটের ওপর (হাসে)। মঁসিয়েঁ আমেল মাঝেমধ্যে ইতিহাসও পড়ান। আমি তো, যখনই প্রাচীন ইতিহাস পড়ি, মঁসিয়েঁ আমেলই মনে পড়েন। এনার থেকে প্রাচীন তো কাউকে দেখতেই পাইনা। ...বুঝতে পারছিনা কান্না পাচ্ছে কেন! এটাকেই কি দুঃখ বলে? কেন দুঃখ? ফরাসী না শিখতে পেরে? মঁসিয়েঁ আমেলের চলে যাওয়াতে? মঁসিয়েঁ আমেলের দুঃখ দেখে? যবে থেকে স্কুলে আসছি মঁসিয়েঁ আমেলকে এত দুখী কখনো দেখিনি।
(পিছন থেকে টুপি পরা এক বুড়ো মানুষ উঠে দাঁড়ায়)
আমেল-        কী ওজের? কিছু বলবে?
ওজের -        (হাতে পাতলা ছেঁড়া একটা বই) অক্ষরবোধটা আছে আমার কাছে মাস্টারমশাই। সকাল থেকে এটাই আবার থেকে পড়ছিলাম। এই অক্ষরগুলো জুড়ে ‘ফ্রান্স’ কী করে লেখা হয় মাস্টারমশাই? (শিশুরা হাসে আবার শিক্ষকের মুখ দেখে চুপ করে যায়)
আমেল -        কী করবে জেনে? কখনো তো স্কুলে গেলে না। আর এখন ... (বোর্ডের কাছে যায়; বড় বড় করে লেখেন) ‘আলসাশে লোরেন, ফ্রান্স’। তার নিচে জুড়ে দেন ‘ভিভা লা ফ্রান্স’।

[দৃশ্যপট আবার সৈনিকের দিকে। ১ম সৈনিক মাংস খাচ্ছে।]

১ম-              হারামজাদা গেল কোথায় জল আনতে। (বলতে বলতে ২য় জন চলে আসে) কোথায় গেছিলি? (হেঁচকি তোলে) দে, জল দে তো!
২য়-              জল? ওঃ না, আনা হয়নি।
১ম-              মানে?
২য়-              (রহস্যময় ভাবে হাসে)
১ম -             (লক্ষ করে দেখে) এ্যাই, তোর মুখে ওগুলো কী? আঁচড়ের দাগ!
২য় -             জবর্দস্ত বিল্লী ছিলো মাইরি। বাগে আনতে ...
১ম -             (হঠাৎ মুখের ভাবটা বদলে যায়) তুই ... ওই কাঠকুড়ুনি ... (২য় জন অশ্লীল ভাবে হাসে, ১ম জন ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর, লড়তে লড়তে ওরা নাট্যস্থলের বাইরে চলে যায়। একটু পর ১ম জনের তীক্ষ্ণ মৃত্যু-আর্তনাদ ভেসে আসে। দ্বিতীয়জনও ছুরির আঘাতে আহত, টলতে টলতে আগুনের কাছে এসে বসে মাংস খেতে থাকে)।
২য় -             শালা। যবখেকো চাষী! আমার সাথে পাল্লা দেবে! দরদ উথলে পড়ছিলো ওই মাগীটার জন্য!

[নেপথ্যে বেশ কয়েকটি বুটের আওয়াজ হয়। অফিসারের সাথে দশ বারো জন জার্মান সৈন্যের একটা দল নাট্যস্থলে ঢুকে পড়ে।]

অফিসার-      (২য় সৈনিককে মাংস খেতে দেখে কলার চেপে ধরে) তোমাদের না স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল?
(ততক্ষণে আরেকজন সৈনিক ১ম জনকে ঝোপে পড়ে থাকতে দেখতে পায়)।
জন -        আরেকটি এদিকে স্যার, এ তো মরেই গেছে মনে হচ্ছে।

[নতুন দলের দুজন, এ দুজনকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায়। বাকি দলটা অফিসারের নেতৃত্বে স্কুলের দিকে এগিয়ে যায়।]

আমেল -        (‘আলসাশে লোরেন, ফ্রান্স’ লেখাটা তাড়াতাড়ি ‘ভিভা লা ফ্রান্স’) বলো সবাই, আমার সাথে, ‘ভিভা লা ফ্রান্স’! ফ্রান্সের জয় হোক! ফরাসী ভাষার জয় হোক! মাতৃভাষার জয় হোক! (সবাই বলতে থাকে। অফিসার গিয়ে আমেলকে ধাক্কা দেয়। আমেল পড়ে যায়।)

[দৃশ্যটা এখানেই, ‘মাতৃভাষার জয় হোক’ ধ্বনির সাথে স্থির করা যেতে পারে।]


  
সমাপ্ত



[মূল ফরাসী গল্প, আলফোঁস দোদে (Alphonse Daudet) লিখিত ‘লা দেনিয়ে ক্লাস’এর স্বচ্ছন্দ নাট্যরূপান্তর]