Tuesday, July 19, 2022

সভা

রোদ গেছে বহুক্ষণ, তবু উত্তপ্ত রাস্তাটা শ্লথ করে গতি,
কখনো চাগায় কদম – যদিও আজ দেরি হয়নি পৌঁছোতে;
বিষয় যাই হোক না কেন – রবিঠাকুর বা জাতীয়করণ,
সভাঘর ভরা হোক অথবা গোনাগুনতি নিজেদের লোক,
ভালো বলি অথবা খারাপ, রক্তের দাগগুলো তো দেখাবোই –
দেশপ্রেম-চর্ব্বনে ভুলে যাবোনা ভুলতে দেবোওনা কাউকে
আখলাক, পহলু খান, একটিও হত্যা আর বেহদ্দটা – যে,
ফাঁসির সে আসামীরা আমাদের মাথায় বসে হাগছে দিব্যি ।

পাটনা
১৯-৬-১৭



Saturday, July 16, 2022

সিঙাড়া

ভাঙা বেঞ্চে বসে এক 
আটপৌরে, অনেকটাই বুড়ো,
পরনে ম্লান সাদা লপেটা, কুর্তা,
এক প্লেট সিঙাড়া-চাট 
আস্তে আস্তে খাচ্ছেন।
চামচ দিয়ে কেটে কেটে 
একেকটা ছোট্টো টুকরো
ঠোঁটে টানছেন, 
স্বল্পদন্তি মুখের 
এক দিক থেকে আরেকদিকে
পাঠাচ্ছেন, 
আবার ফিরিয়ে আনছেন।
গিলতে ফুলে উঠছে গাল, 
গলার পেশিগুলো।...

শরতসন্ধ্যা। 
উৎসব-ঋতুর আবহাওয়া। 
বাজারে ঢুকবার মুখে 
চিরাচরিত যানজট।
পুরোনো স্কুলটার পাঁচিলঘেঁষা 
ট্রান্সফর্মার, সামনে আবর্জনা,
তার সামনে সার্বজনিক 
পুরূষ প্রস্রাবখানা,
তারই সামনে এক ঠেলা-দোকান -
বিক্রি সিঙাড়া, কচুরির।...

একে একে সবাই এসে খাচ্ছে, 
চলে যাচ্ছে,
বুড়োর আর 
শেষ হচ্ছে না খাওয়া। 
দোকানদারেরও তাড়া নেই;
হাজার হোক, 
তার গ্রাহক-পাড়ারই দাদু তো!
বাড়িতে খাওয়ার 
কষ্ট না হোক
একটু চাইতেই পারেন মুখরোচক!
একটু লোভ হতেই পারে।
পেট খারাপ?
হলে হবে!...
বাঁচা-মরা তো লেগেই আছে। 

যানজটে ফেঁসে থাকা টোটোর 
চালক ছেলেটিও
দৌড়ে কিনে আনল দুটো সিঙাড়া।
পাশে বসা আমার দিকে 
এগোলো ঠোঙাটা,
‘খাবেন, কাকু?’ 

ব্যাঙ্গালোর
৫.১১.১৯



হদিশ

হারিয়ে যাই? কই? এত কুনো হদিশ বুকে,  
আকাশ রাখে নজর আর জল চেনে শুঁকে।
ওদেরও তো বয়স হল কত টানবে চুল
জন্মের সে ভাড়াবাড়ির পাড়াও আজ কুল।
চৌকাঠের পরে দু’পা আরেকটি চৌকাঠে
রাখছি কিনা ঘুরে দেখে বেড়াল ধোপার মাঠে। 

কিছু বড় গাছ ছিল আঁধার আমার সাঁঝে
হারিয়ে যেতাম ঘরে ফেরা পাখিগুলোর মাঝে
সেসবও এখন কাঠের দেদার ঠিকেদারি,
দূরত্ব আজ বন্ধুমন, দিলদরিয়ায় পাড়ি। 
একবার গিয়েছিলাম চাকার সুরে দূরে
হারাই নি, বাঁধা পড়ে দেশের হৃদয়পুরে।

শব্দ আছে, কাজ আছে, রাত আছে ভারি, 
পুরোনো ডাইরিটা খুলে চাঁদিপোকা মারি।

১৬.৭.২২



জিরো মাইল

শহর নয়, ভালোবাসার 
জিরো মাইলের কথা ভাবছি।
আমাদের তো বেশির ভাগ সময়
জিরো মাইলেই কাটে ভালোবাসার।

শহরের তো পরে হয়,
ফুলে ফেঁপে উঠলে নগরায়ণ,
ভালোবাসার অনেক আগেই তৈরি হয়
ভালোবাসার জিরো মাইল।

ওই জিরো মাইলেই যখন
ভালোবাসার হদিশ ছিল না,
রাস্তা বলতে 
জলার ধার দিয়ে ঘাসপথ
সুনীলে উধাও,
বৃষ্টির বিকেলে ভিজতে ভিজতে
দুহাত ছড়িয়ে গেয়েছি
‘এসো আলিঙ্গনে’ …

ঈর্ষা করেছি 
চাকায় হাওয়া দেওয়ার
বা চা বিস্কুটের
দোকান খুলে পিছনে
থাকার ঘর তোলা বাবাজিকে
মনে হয়েছে সে আমিই
সন্ন্যাসি অথবা চা করছি
অথবা হাওয়া দিচ্ছি চাকায় 
যেন এসব কিছুই
দূরের এক 
ভালোবাসা গড়তে জরুরি! 

রাস্তাটা ঘরে ফেরার
আনন্দের মত করতে জরুরি।
যেন ভালোবাসার তপ্ত নিঃশ্বাস
শূন্য জিরো মাইলে
মে মাসের রোদ্দূর।

এমনকি ভালোবাসায় পৌঁছেও
আবার ফিরেছি এখানে,
খুঁজেছি সেই ভালোবাসা
যেটা ছিলই না তখন।
আর আশ্চর্য, তবুও পেয়েছি!
তা সে পাটনার হোক
বা বেগুসরায়ের জিরো মাইল,
পুর্ণিয়ার বা অন্য শহরের …

১৩.৭.২২



Thursday, July 14, 2022

মেজাজ

বাসটা ভরছে। ভরুক, বোসো,
             নাহয় একটা ছাড়বে।
চায়ের রঙে ধরছে মেজাজ,
আসমানটাও খুলবে এবার;
এত অধীর হয়েই বা কী করবে?

বাদলা-চায়ে প্রথম চুমুক 
                   হলই বা রোদ্দুরে!
এটা বিহার, চা এখানেও 
       হয়, ওই তো কিশনগঞ্জে,
                   ডুয়ার্সের অদূরে।

দেড়শো বছর, হচ্ছে।
হাতে-হাজা বাচ্চাটা এনে দিচ্ছে।
শেষচুমুকের চিনিটুক্‌ গুলে খাচ্ছি –
শুকিয়ে বেচলে জমি হত এক কিতে। 

এত আকাশ দেখছ যে বারবার,
সময় মাপছ?
                   আছে তেমন ফিতে?



Wednesday, July 13, 2022

সোনার নোখ

সময় যতই আনজান এক হাওয়া
তারও ততই হামলাবাজ চাওয়া ।

বন্ধুরা সব এক এক করে, কে কোথায় ....
সেও যাবে দুই কাঁধ ফাঁসিয়ে বাজের পায়ে।

সাতসকালের আয়না দেখবে ঝড়ের চোখ,
গলিতে রোদজলের গল্পে সোনার নোখ,
চায়ের ঠেকে এক সিগারেট তিন ইয়ার -
                              দিল্লি, দুবাই, জাঞ্জিবার ...
স্কুলছুটিতে মেয়েদলের 
গুনগুন আর সুগন্ধে এক
                             হারিয়ে যাওয়া রাজকুমার।

এই সময়ের মোকাবিলায়
সময়েরও দ্বিগুণ খুনে, আজনবী,
হতেই হবে -
                   রোদচশমায়
                    কাঁধের ছালায়
মরলে সালা মুখের ফেনায় -
                                          আজনবী।

২০.১২.২০০২



Tuesday, July 12, 2022

আভা

গাছের ফাঁকে হঠাৎ চোখে 
রূপ ছেটাল নদীর বাঁক।
রোদঝিলিক, সবুজকালো; 
আর একটু পথ যেতেই 
বসত, বাজার, মাইক বাজছে -- 
স্বাধীনতার স্বপ্নস্মৃতি
উন্নয়নী বিষে ধুঁকেও 
রুখবে দেশে বিষের বাড়। 

শিকড় ঘিরে জনসভা, 
গ্রামশ্রুতির  ঐক্য প্রাচীন।
ভাঙতে পাল্টা ডিস্কো ভজন 
জোরদখলি মন্দিরের। 
তামাশাবাজ বাকিরা সব 
এদিক ওদিক চা খাচ্ছে
ঠিকেদার ছাড়ছে বসে 
ঘোলা জলে চাঁদির টোপ ...

কোথায় গ্রাম? ধ্বসে গেছে, 
ধু ধু এক অপেক্ষাতে,
শিক্ষা নেই, চিকিৎসা আর 
রোজগার – কিছুই নেই
শুধু ক’টি গাড়িরাস্তা, 
নতুন কিছু দোকানদারি; 
সময় তাতেই সস্তা জিন্স, 
সাইকেলছুট এক মেয়ের …
        
চাপানো যায় দোষ, তবু 
শিক্ষক দুই আদর্শবান, 
পড়ান; গ্রামের ঔপন্যাসিক, 
ভাঙা কুঠির ধ্বংসছায়ায়  
লিখে ফেলেন প্রণয়গাথা, 
কবি লেখেন আশার গান;
জোর একটা হাওয়ায় বিকেল 
আভা ছড়ায়, যুদ্ধ চলুক!

১১.৭.২২



Monday, July 11, 2022

পুল ও নৌকো

পুল হয়েছে বলে কি?
নৌকোর কদর কমে গেছে?
কে যাবে রোজ পুল ধরতে
অতটা ঘুরে সাইকেলে?
পাঁচ নম্বর লেভেল ক্রসিংএর
হেই উঁচু ঢাল পেরিয়ে ঘাট,
সাইকেলসুদ্ধু চেপে যাও নৌকোয়
মটোরলাগানো হলে ভালো
নইলেও ক্ষতি নেই
আধঘন্টায় মা গঙ্গার
ওপারে শহরে।

কত শত নৌকোয় কাজের সকালে
সব নদীর প্রবাহে আড়াআড়ি
গ্রামপাড় থেকে শহরপাড়ে চলছে
এদেশের কত হাজার কাজের মানুষ
দূর থেকে পুলগুলো দেখতে দেখতে …
বা হয়ত বড় ঝিলেরও এপার ওপার ...
মাঝে মধ্যে তেমন হাওয়া দিলে
কয়েকটা মেলছে ছেঁড়া পাল!  

নেমে উঠেই, গান লাইসেন্স সামলে
আধার, আইডি সামলে
সাইকেলে টিফিন ঝুলিয়ে আরো 
পাঁচ মাইল,
কাজে পৌঁছোও ঝটপট। 
আবার সন্ধ্যায় ফেরো সেভাবেই। 
দুনিয়া চলছে!
গণেশ রাম চলবে না?
দুখন চলবে না? 
পুল তো ওই দূর থেকেই দেখছি।
জলের দিক থেকে।
যবে থেকে হয়েছে,
চড়া জাগছে যেখানে সেখানে।
পুলে যা ক্ষতি করেছে নৌকোর,
চড়াগুলো আরো বেশি করছে।
কদর?
এবার মাঝি বলবে হেসে –
নৌকোরটা ভাবতে হবে না,
নদীরটা ভাবুন! 

৯.৭.২২  



Thursday, July 7, 2022

আমার জীবনসংগ্রাম ৩

উত্তর ভাগ – উত্তর খন্ড

(১)

জমিদারি নির্মূল হোক

যেই সততা ও নিষ্ঠার সাথে মনে ভরসা রেখে আমি জমিদারির এবং জমিদারদের সংস্কার করার চেষ্টা করেছিলাম, তাদের ও কৃষকদের মাঝে সদ্ভাব আনার চেষ্টা করেছিলাম, দুশ্চিন্তা আর তীব্র হতাশা ছাড়া তার পরিণাম কিছুই হল না। বরং জমিদারদের কুচক্র প্রতিদিন বাড়তে থাকল। ভূমিকম্পের পর যে হৃদয়হীনতার পরিচয় দিল ওরা, তা আজও আমার চোখের সামনে নাচে। সরকারেরই বক্তব্য ছিল যে বিহারে শস্যের দাম ষাট প্রতিশত পড়ে গেছে। ফলে, কৃষকেরা আড়াই টাকার জায়গায় মাত্র এক টাকা দাম পেতে লাগল। ভূমিকম্পে ভালো জমিগুলোও বালিতে ভরে গিয়েছিল, তাতে ফসলও মার খেল। ঠিক তার পরেই এমন বন্যা এল যে কৃষক বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়ল। ভূমিকম্পের কারণে জমির ওপরের পরত এত খারাপ হয়ে গেল যে বৃষ্টি আর বন্যার জল বয়ে যাওয়ার বদলে জায়গায় জায়গায় জমা হয়ে ক্ষেতগুলোকে নষ্ট করতে লাগল। এ সমস্ত সমস্যা নিয়ে যত রকম ভাবে পারা যায় আমরা আন্দোলন করেছি। কিন্তু সরকার এবং জমিদার, দুজনেই বদ্ধ কালা হয়ে গেল। অন্যান্য প্রদেশগুলো কৃষকদের উদ্বেগ-নিরসনে কিছু না কিছু করল। অনেকে বেশিও করল। কিন্তু বিহারের সরকার, এখানকার জমিদার এবং কাউন্সিল যেন সংকল্প করে নিল যে ওরা নড়বে না। সত্যিই একটা কথা কানে তুলল না ওরা।

ফলে, আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম যে জমিদার নামক জিনিষটাই খারাপ। থাকার যোগ্য নয়। নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। তারা মানুষের নামে থাকুক বা অন্য যে কোনো নামে, থাকুক। কিন্তু জমিদার নামে নয়। আমার মনে বসে গেল যে যদি মাটির তৈরি জমিদার হয় সেও ততটাই বিপজ্জনক হবে। ঠিক করে ফেললাম যে জমিদারি নির্মূল করতেই হবে। এ ব্যাপারে কিসানসভার আওয়াজ তোলার সময় এসে গেছে। ১৯৩৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম। দুনিয়ায় আর বিশেষ করে বোম্বাই প্রভৃতি প্রদেশে তো জমিদারি ছাড়াই লোকে খাচ্ছে দাচ্ছে। তাহলে এখানে জমিদার হয়ে কেন কৃষকদের বুকে দুরমুষ চালাবে? রোজগার করে, ব্যাবসা করে খাবে না কেন? শয়তান থেকে মানুষ হবে না কেন?

সে বছর মুজফফরপুর জেলার হাজিপুরে তৃতীয় বিহার প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন হওয়ার ছিল। মাস নির্দ্ধারিত ছিল, নভেম্বর। আমিই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। তাই ভালো সুযোগ পেলাম। সঙ্গীদের বললাম, এবার জমিদারি উন্মুলনের কথা স্পষ্ট ভাবে তুলুন। যদিও আমি নিজের ভাষণে, যেটা ছাপা ছিল, স্পষ্ট ভাবে কথাটা তুলিনি। ইঙ্গিত অবশ্যই দিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল এবং এখনও আছে যে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত প্রসঙ্গ কোনো ব্যক্তি যেন না ওঠায়। কিসানসভা বা এধরণের সংস্থাগুলোই যদি প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ভালো হয়। বিশেষ করে সভাপতি বলে দিলে সবার ওপর একটা দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। তখন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে তাদের অসুবিধা হয়। অবশ্য প্রচারের ক্ষেত্রে সবাই বলতে পারে। তাই নিজের ভাষণে আমি স্পষ্ট করে বলিনি।

হাজিপুরের এলাকাটা সাধারণভাবে ছোটোখাটো জমিদারদের এলাকা। তাই কৃষকে ভরা বলতে পারি না যেমন দ্বারভাঙা, গয়া ইত্যাদি অনেক এলাকার বিষয়ে বলতে পারি। মুজফফরপুরেও এমন অনেক অঞ্চল আছে। তা সত্ত্বেও সম্মেলন ভালো হল এবং একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিল যা কিসানসভার ইতিহাসে অমর থাকবে। আগে বলেইছি যে আমার ভাষণ ছাপা হয়েছিল। আমাদের সম্মেলনে প্রথমবার এমন সুযোগ এসেছিল। যখন লিখেছিলাম, ছাপার আগে আমার সঙ্গীদের দেখিয়ে নিয়েছিলাম। শুধু এটুকু জানতে যে ওরা ভাষণটা পছন্দ করছে কিনা। তখন থেকে এটা একটা প্রথা হয়ে গেছে কিসানসভায় যে সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ আমরা আগেই দেখে নিই। কখনো কখনো বোধহয় তাতে কিছু সংশোধনও করি। এতে নীতিগত সামঞ্জস্য বজায় থাকে এবং কোনো বেপরোয়া কথা সভাপতির মত দায়িত্ববান ব্যক্তির মুখ থেকে বেরুতে পারে না।

হ্যাঁ, আমার ভাষণ সঙ্গীরা পছন্দ করল, শুধু সমাজবাদ বিষয়ে একটা অংশ ওদের অনাবশ্যক মনে হল। আমায় বলা হল ও অংশটুকু বাদ দিলে ভালো হয়। কিন্তু আমি বাদ দিলাম না। আসলে আমি আমার ব্যক্তগত ভাবনা প্রসঙ্গে লিখেছিলাম যে সমাজবাদ ধর্মের বিরোধ যদি নাও করে, ধর্মের কোনো জায়গা হতে পারে না সমাজবাদে। ধর্ম মিশে গেলেই বিশৃঙ্খলা আসবে এবং সমাজবাদ নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে। আমি একথাও লিখেছিলাম যে যতগুলো বস্তুবাদী দর্শন আছে তার মধ্যে এটাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু যেহেতু ওতে ধর্মের কোনো স্থানেই, কাজেই আমার মত মানুষের ওতে কোনো স্থান নেই। এই অংশটুকু সরাতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যদি সমাজবাদ বা মার্ক্সবাদ নিয়ে কোনো কটাক্ষ থাকত তাহলে নিশ্চয়ই সরিয়ে নিতাম। কিন্তু এটা তো তার একটা দিক নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ভাবনা ছিল যেটা কারোর মনে লাগতে পারে না। ধর্ন বিষয়ে আজও আমার ভাবনাচিন্তা মোটামুটি তেমনই আছে। তবুও, তার জন্য সমাজবাদী ভাবনার শরিক হতে আমার মনে আর কোন বাধা নেই। যদিও এখনও শরিক নই এবং তার ভিন্ন কিছু কারণ আছে।

(২)

ধর্মের কথা

এই ধর্মের প্রশ্ন এমন প্যাঁচালো এবং বিপজ্জনক যে লোকের বিভ্রম হতে পারে। আমার ওই ভাষণের ফলে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন আমি জানি। তাই প্রসঙ্গত সে সম্পর্কে এখানে দু’চার কথা বলে নিতে চাই। কথিত যে আত্মার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ধর্মের আবিষ্কার। তারপর তার দুই আকৃতি – বৈজ্ঞানিক এবং ব্যাবহারিক। প্রথমটায় আসে দর্শন ও দার্শনিক ভাবনা। সেই ভাবনাকেই বাস্তবায়িত করতে আসে বহির্গত রূপ এবং ব্যাবহারিক পুজোপাঠ ইত্যাদি।

প্রথমে এর রূপ যেমনই থাকুক না কেন, এর উদ্দেশ্য যতই পবিত্র এবং উঁচু রাখা হোক না কেন, এবং কিছু মানুষ ঠিক তেমনই একে বাস্তবায়িত করে থাকুক না কেন, আজ আমরা সেসব কিছুই দেখতে পাই না। সেসব মানুষ না আগে আমরা দেখেছি, না আজ দেখতে পাই। প্রত্যক্ষে তো এটাই দেখি যে ধর্মে যুক্তি, তর্ক ও ভাবনার কোনো স্থান নেই। এটাই ধর্মের ব্যাবহারিক রূপ। পন্ডিত, মৌলবিএবং ধর্মাচার্যরা যা বলে, চোখ বন্ধ করে মানো। নইলে তোমার বিরুদ্ধে ফতোয়া বেরিয়ে যাবে। ট্যাঁ-ফোঁ করো না। “বেড়ালে যদি উট নিয়ে যায়, বলো হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার!” এই ধর্মাচার্য, গুরু, পন্ডিত প্রভৃতিই বা কেমন, যাদের বুদ্ধির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। আর এ কাজগুলো পৈত্রিক হয়ে যাওয়ায় ওদের আর লেখাপড়া করারও দরকার নেই। ফলে ওরা বেশির ভাগই নিরক্ষর ভট্টাচার্য। অথচ মন্ত্র আর দীক্ষা দিয়ে বৈকুন্ঠে পাঠানর, বেহেশ্তে পৌঁছে দেওয়ার দাবি করবে অবশ্যই। এমনকি সর্বাধিকার সংরক্ষিত! ফলে ধর্মের নামে সবচেয়ে বেশি অন্ধকারের খাতা খোলা। ব্যক্তিগত না হয়ে সামূহিক হয়ে গেছে। ভেড়াদের মতই হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্তান ইত্যাদিদের সমূহ। টিকি আর দাড়ি দিয়েই আমরা হিন্দু আর মুসলমান চিনি।

কিন্তু আমি এই ধর্মকে কোনোভাবেই মানি না। বরং বলতে পারেন যে এমন ধর্মকে আমি সমাজ, দেশ এবং মানবতার শত্রু মনে করি। এ ধর্ম আমাদের স্বাধীনতারও বাধক। যেখানে বিবেকের স্থান নেই, ফতোয়া আর আদেশ চলে, সে জিনিষ আমি মানি না। যদি বুদ্ধিই কুন্ঠিত করে দেওয়া হয় আর বিবেকেরই জায়গা না থাকে, তাহলে তো সব শেষ! আমি বিবেকের মুখে লাগাম আর ঠুলি বরদাস্ত করতে পারি না। যে কথা বুদ্ধিতে আঁটে না, বিবেকে ধরে না, ধর্মের নামে সে কথা মানার বা মানতে বলার আমি কঠোর শত্রু।তাই শিশুদের ধার্মিক শিক্ষা দেওয়ার, যাকে আজ ধর্ম বলা হয় তার শিক্ষা দেওয়ার বিরুদ্ধে। ধর্ম আমার কাছে পুরোপুরি ব্যক্তিগত বস্তু, যেমন বুদ্ধি, হৃদয়, চোখ, নাক ইত্যাদি। দুজন লোকের একটাই বুদ্ধি বা চোখ হতে পারে না। তাহলে ধর্ম কিকরে দুজন মানুষের এক হবে? আর যেমন রোগগ্রস্ত শরীরে অন্নের খিদে থাকে না, পরাধীন ও বিবেকশূন্য আত্মায় ধর্ম বা অধ্যাত্মের খিদে কিভাবে থাকবে? আর সে খিদেকে শান্ত করার উদ্যমই বা কেন? তাই আমার ধর্ম বিচিত্র। তা নিয়ে লোকেদের মনে বিভ্রম থাকা উচিৎ নয়।

সঙ্গে সঙ্গে একথাটাও আমি মানি যে, যে ধর্ম আজ আমরা দেখছি, তারও সোজাসুজি বিরোধ করা বড় রকমের ভুল। তার বিকৃত দিকগুলোর বিরোধ একটা একটা করে করা যেতে পারে; কিন্তু সাধারণভাবে পুরো ধর্মটার নয়। এতে বড় ক্ষতি হতে পারে। দিকগুলোর বিরোধও যুক্তি, তর্কের ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ। যাদের ধর্ম প্রসঙ্গে বলা-কওয়ার অধিকার আছে বলে লোকে মান্য করে, তারাই যদি বিরোধ বা খন্ডন ইত্যাদি করে তাহলে ভালো হয়। অন্যদের এতে মাথা গলান উচিৎ নয়। এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ। ধর্মকর্ম তো সবাই করতে পারে, যার কাছে ধর্ম যা, তেমন ভাবে। তাতে কোনো বিপদ নেই, কোনো বাধাও নেই। কিন্তু এমন কাজ যার হঠাত তীব্র প্রতিঘাত হয় সমূহে, সেকাজ না করাই ভালো, এবং সেটা সমূহকে জানিয়ে। যেখানে তেমন কোনো বিপদ নেই সেখানে সে কাজও করা যায়, যদি যে করছে সে কাজটা ঠিক মনে করে। যারা জনতার মাঝে কাজ করছে তাদের জন্যই আমার এ চিন্তাভাবনা। বাকি মানুষেরা যা ইচ্ছে বলুক বা করুক। তাদের নিয়ে আমি চিন্তা করি না।

হ্যাঁ, তো জমিদারি মেটাবার প্রস্তাব ছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েই হাজিপুরের সম্মেলন সম্পন্ন হল। এটা বুঝে রাখা উচিৎ যে আগে বেশ কয়েকবার এমন অবকাশ এসেছিল যখন সাধারণ কিসানসভায় এবং জেলা কিসান সম্মেলনে জমিদারির বিরুদ্ধে প্রস্তাব এসেছিল এবং পাসও হয়েছিল। এভাবে আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছিল। বিশেষ করে মুজফফরপুরের মনিয়ারি মৌজায় জেলার চাষিদের যে সম্মেলন হয়েছিল তাতে তো এই বিষয়ে নিয়ে বেশ হই চই হয়েছিল। ওখানে প্রথম প্রথম এই প্রশ্নটা ওঠানো হয়েছিল। কংগ্রেসের কয়েকজন বিখ্যাত নেতা, যারা জমিদারদের বন্ধু এবং নিজেরাও নাম-কে-ওয়াস্তে জমিদার, পুরো শক্তি নিয়োজিত করেছিল এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। কিন্তু তবুও ওরা বিচ্ছিরি ভাবে ফেল করেছিল। স্বপ্নেও ওরা ভাবে নি এমনটা হবে। আমিও সেখানে ছিলাম এবং জমিদারি প্রসঙ্গে আমার চিন্তাভাবনার সূত্র ব্যবহার করে ওরা ফায়দা ওঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা ভূলে গিয়েছিল আমার চিন্তাভাবনার অভিমুখটা কী।

(৩)

অল ইন্ডিয়া কিসান-সভা এবং কিসান বুলেটিন

১৯৩৫ সাল শেষ হতে হতে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল কিসান-সভার ইতিহাসে। বাম তরফের অনেক বড় বড় নেতা মীরাটে একত্র হলেন এবং অন্যান্য বিষয় বাদে অখিল ভারত [সর্বভারতীয়] কিসান সভার সংগঠন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁদের মধ্যে বিহারেরও কয়েকজন সঙ্গী ছিলেন আমার, তাঁরাও শেষ অব্দি একমত হলেন এ সিদ্ধান্তে। সেখানে যে সংগঠন সমিতি তৈরি হল এ কাজের জন্য, তার সম্পাদক ওঁরা আমায়, শ্রী এন জি রঙ্গা এবং শ্রী মোহনলাল গৌতমকে নিযুক্ত করলেন। যে পরিস্থিতি আমাদের জমিদারির ব্যাপারে মিছিমিছি এগিয়ে নিয়ে গেল, সেই পরিস্থিতিই আরো এগিয়ে যেতে বাধ্য করল। আমি তো এর বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু কিসানসভায় আজ অব্দি আমার নীতি সব সময় এটাই থেকেছে যে সঙ্গীদের মতামত না নিয়ে কিছু করব না আর যে কাজে ওরা একমত হয়ে যাবে, তা নিয়ে আর বেশি ভাবব না, যদি না প্যাঁচালো ধাঁধার মত কোন ব্যাপার থাকে যার খারাপ প্রভাব পড়তে পারে সভার ওপর। তাই আমি মেনে নিলাম – অল ইন্ডিয়া সভা হোক, দেখা যাবে।

এরপর ওরা এ সিদ্ধান্তও নিয়ে নিল যে ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে লখনউয়ে কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়টাতেই প্রথম অল ইন্ডিয়া কিসান সম্মেলন করা হবে। বোধহয় মীরাটেই সিদ্ধান্তটা হয়েছিল। শেষ ফয়সালাটা হয়তো পরে নেওয়া হয়ে থাকবে। কিন্তু ওদিকে কথা হল আর এদিকে খবরের কাগজে খবরও বেরিয়ে গেল। কিছু বিশেষ ব্যবস্থা তো করতেই হত। কংগ্রেসের প্রস্তুতি ছিলই। বিষয়-সমিতির প্যান্ডালেই সম্মেলন করব স্থির করে অভ্যর্থনা সমিতির কাছে এ বিষয়ে অনুমতি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এটাও ওরা স্থির করে নিয়েছিল যে সভাপতি আমাকেই করা হোক। সে খবর আমায় টেলিগ্রামের মাধ্যমে দেওয়া হল। কিতু টেলিগ্রাম পাওয়ার আগেই আমি লখনউ গিয়ে পৌঁছেছিলাম। কেননা কংগ্রেসের বিষয়-সমিতি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করার ছিল। অন্যেরাও পৌঁছেছিল। ওক্ষানে পৌঁছোতেই আমি সব কথা জানতে পেরে গেলাম। প্রতিটি প্রদেশের বাম তরফের লোকেদের বিশেষ করে পরিচয় পেলাম ওখানে।

তখন থেকে আজ অব্দিকার আমার পাক্কা সঙ্গী প্রফেসর রঙ্গা এবং শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিকের সঙ্গে প্রথম দেখা ওখানেই হল। তার দুমাস আগে রঙ্গাজির বিহার আসার ছিল। আসতে পারেন নি। শ্রী ইন্দুলালজির সঙ্গে চিঠি চালাচালি আগে থেকেই ছিল। আসলে উনি বোম্বাইয়ে একটি প্রচার সংস্থা তৈরি করে কৃষকদের বিষয়ে কখনো কখনো এক-একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতেন। কিছুদিন ধরে আমাকেও পাঠাচ্ছিলেন। ওখানে দেখা হতে আমায় পাঠাবার কারণ বললেন যে কখনো কোনো ইংরেজি খবরের কাগজে আমার কোনো বক্তৃতার অংশ উনি পড়েছিলেন, যাতে অন্যান্য কথার মাঝে আমি বলেছিলাম যে রুটি ভগবানের থেকে বড়। সে কথাতেই আকৃষ্ট হয়ে উনি আমায় চিঠি লিখলেন এবং তারপর ওই ইংরেজি বিজ্ঞপ্তি পাঠাতে লাগলেন।

আমি তো শঙ্কিত ছিলাম যে কে জানে কেমন লোক। কিন্তু সঙ্গীরা বলল আমাদেরই, তখন বিশ্বাস হল। পরে লখনউয়ে এবং তারপর আমাদের দুজনের মাঝে এমন ঘনিষ্ঠতা হল যে তেমন আর কারুর সাথে হয় নি। প্রথম প্রথম শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিকই নিজের উদ্যমে ইংরেজিতে অল ইন্ডিয়া কিসান বুলেটিন বার করে কিসানসভার একটা বড় কাজ করে দিয়েছিলেন। কিসানসভা তাঁর কাছে চিরকাল ঋণী থাকবে। বুলেটিনটা প্রতি পনের দিন অন্তর বেরোয়।

সম্মেলন সম্পন্ন হল। গুরুত্বপূর্ণ সব প্রস্তাব পাস হল। অল ইন্ডিয়া কিসান কমিটির জন্ম হল। প্রতিটি প্রদেশে সে সময় যারা উৎসাহে ভরা কৃষক কর্মী ছিল তাদেরকে নেওয়া হল কমিটিতে। তাদের কাজ আর অধিকার এই হিসেবেই নির্ধারিত হল যে যখন কিসানসভা বসতে পারবে না তখন তার জায়গায় থাকবে ওরা এবং ওই কমিটি। পরে অবশ্য নিয়মাবলী তৈরি করে সম্মেলনকেই অল ইন্ডিয়া কিসান সভার বার্ষিক অধিবেশন নাম দেওয়া হল। সে সময় অল ইন্ডিয়া কিসান সভার তিনজন সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। স্থায়ী সভাপতি রাখা হবে কিনা সেটা নিয়ে তখন কোন সিদ্ধান্ত হয় নি। ভাবা হয়েছিল যে অধিবেশনের সময়টুকুর জন্যই সভাপতি পদ থাকুক, স্থায়ী নয়। অবশ্য পরে বিধি অনুসারে সভাপতির পদ স্থায়ী হয়ে গেল। তিন সম্পাদক সেই পুরোনোই রইলেন – আমি, প্রফেসর রঙ্গা এবং গৌতম। গৌতমজির দায়িত্বে দেওয়া হল অফিস। কিন্তু কিছুদিন পরেই উনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং অফিস আমার দায়িত্বে চলে এল। তখন থেকে আমিই নিয়মিত ওই সভার জেনেরাল সেক্রেটারি থেকেছি আর অফিস আমার কাছেই রয়ে গেছে। শুধু ১৯৩৮-৩৯ ছাড়া, যখন কুমিল্লা অধিবেশনে আমি আবার সভাপতি নির্বাচিত হলাম এবং প্রোফেসর রঙ্গা সাধারণ সম্পাদক। সেই এক বছর অফিস প্রফেসর রঙ্গার সঙ্গে ছিল। লখনউএর পর ফৈজপুরেই অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিক যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। তারপর থেকে সেই পদেই আছেন।

লখনউতেই ভাবা হল যে অল ইন্ডিয়া কিসান দিবস উদযাপন করা হোক। কিন্তু প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় দরকার। তাই পয়লা সেপ্টেম্বর তারিখটা স্থির করা হল। তখন থেকে নিয়মিত প্রতি বছর সারা ভারতে পয়লা সেপ্টেম্বর অল ইন্ডিয়া কিসান দিবস উদযাপন করা হয়। এমনিতে ‘মে ডে’তে আমরা নিয়মিতভাবে শ্রমিকদের সঙ্গ দিই।

অল ইন্ডিয়া কিসান সভার অফিস যেই ১৯৩৬ সালে আমার হাতে এল, আমি অফিসটাকে দৃঢ় করতে প্রবৃত্ত হলাম। বিহার প্রাদেশিক কিসান সভার কাজ থেকে যতটা সময় বাঁচত, আমি ওই কাজেই ব্যবহার করতাম। প্রায় সব প্রদেশে সফরও করেছি – কোথাও এক বার, কোথাও অনেক বার। বেশির ভাগ জায়গায় অনেক বারই গেছি। এই কাজে আমি শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিককে খুব তৎপর দেখলাম। উনি আমার কাছ থেকে জবরদস্তি কাজ করিয়ে নিতেন। ওনার জন্যই আমাকে আলাদা করে সময় বার করতে হত। যখন দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হলাম, তখনও আগের মতই আমার চেষ্টা রইল অল ইন্ডিয়ার অফিসটা দেখার। এই তো গত বছর এত দিনের চেষ্টার পর, দু’একটা ছাড়া বাকি সব প্রদেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিসানসভার মেম্বার তৈরি করিয়ে তাদের থেকে অল ইন্ডিয়ার ভাগ আদায় করেছি। এর আগে আকছার ব্যক্তিগত চাঁদা দিয়ে, অথবা কয়েকটি প্রদেশ থেকে এমনিই আদায় করা পয়সা দিয়ে কোনো রকমে অফিসটা চলত।

কিন্তু আমি এভাবে অফিস চালানর বিরুদ্ধে। কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য শোষিতদের হাতে রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামাজিক অধিকারগুলো পুরোপুরি দেওয়ানোর জন্য, বা বলা যায় লড়াই করে অন্যদের থেকে অধিকারগুলো শোষিতদের পক্ষে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য জনতার যে প্রতিষ্ঠান সব এবং গণআন্দোলন, সেগুলো ততক্ষণ শক্তিশালী হতে পারে না, নিজের উদ্দেশ্যে সফল হতে পারে না যতক্ষণ অন্যদের চাঁদায় বাইরের লোকেদের হাতে সঞ্চালিত হয়। তাই কখনো কখনো সঙ্গীদের কোপভাজন হয়েও আমায় জবরদস্তি কাজটা করতে হয়েছে। ফলে, স্বাবলম্বী হওয়ার পথে কিছু দূর অব্দি ভারতীয় কিসানসভাকে নিয়ে আসতে আমি সক্ষমও হয়েছি।

(৪)

বিহটার চিনি-মিল

বলতে গেলে ১৯৩২ সালেই বিহটায় চিনি তৈরি করার মিল বসানো শুরু হল। মিলের পরিচালক শ্রী রামকৃষ্ণ ডালমিয়া এবং অন্যান্যরা প্রথম দিকে কিছুদিন অব্দি আমার সাহায্যও নিল একটু-আধটু। কিন্তু ওই মিল থেকে আমি যা কিছু শিখলাম, এবং যা কিছু আমায় করতে হল ওখানে, তা আমার জীবনসংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। ওখানেই আমি শিখেছি যে মালদার এবং কায়েমি স্বার্থের পূঁজিপতি কেমন চালাক ভাবে জনতার শোষণ করে। বড় বড় নেতা আর মহাত্মা কিভাবে ওদের জালে ফেঁসে সেই শোষণে সাহায্য করে। তবুও বুঝতে পারে না যে ওরা এমনটা করছে। উল্টে, ওরা ভাবে যে জনতার হিতার্থে ওরা পূঁজিপতিদের কাজে লাগাচ্ছে। যখন নাকি পূঁজিপতিরাই ওদের কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের লাভ এবং উৎপীড়িতদের শোষণের জন্য।

সবচেয়ে প্রথমে ওদের মিলের জন্য জমি পেতে অসুবিধে হল। আসলে বিহটার জমিদারগুলো বড় ধড়িবাজ। কারোর কথা শোনেই না। মিলওয়ালারা আমার কাছে পৌঁছোল যে সাহায্য করুন। আমি বললাম দেখা যাবে। এরই মধ্যে এক দিন এক ভদ্রলোক, দানাপুর লোকাল বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান, কথার ছলে বলল আপনি আশ্রমের চাঁদা নিয়ে চিন্তিত কেন? মিলওয়ালাদের জমি পাইয়ে দিন। তখন তো আর পয়সার কমতি থাকবে না! শুনেই রক্তে আগুন লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দিলাম, “তাহলে কি মিলওয়ালাদের চাকরি বা গোলামিতে নাম লেখাই? নাকি ওদের দরবারী হয়ে যাই?” সে বেচারা থতমত খেয়ে কথাটার ভিন্ন অর্থ বার করতে শুরু করল। যদি কোনো কাজ আমি উচিৎ বা কর্তব্য বুঝে না করতে পারি, টাকার লোভে তো করতেই পারব না। এমন পয়সার ওপর পেচ্ছাপ করি।

এই শেষ কথাটা প্রথমবার বলছিলাম না। ‘লোক-সংগ্রহ’এর প্রেসের ব্যাপারে এমন কথা শোনাবার সুযোগ এসেছিল, আগে উল্লেখ করেছি। সেই প্রেসের জন্যই পাটনার একজন ভালো জমিদার আমায় ছয় শো টাকা দিয়েছিল। কিন্তু আমি সে টাকা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। যখন প্রেসটা কার্যীজির হাতে দিলাম তখন কারুর কাছে কিছু শুনে ঈষৎ রেগে ধমক দিয়ে সে জমিদার আমায় চিঠি লিখল যে অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার জন্য আমি প্রেসে টাকা দিই নি। ওনাকেও আমি এক কথাই লিখেছিলাম যে টাকা আমার ওপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করে বা আমার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করে তেমন টাকায় আমি পেচ্ছাপ করি। আপনি যখন চাইবেন, সুদের সাথে আপনার টাকা ফিরিয়ে দেব। আপনি যে ভালোবাসায় টাকাটা উপকারে দিয়েছিলেন, সেই ভালোবাসার সাথেই আমি টাকাটা বাঁচিয়ে রেখেছি এবং আশ্রমকে দিয়েছি। আশ্রমের রিপোর্টে আপনি দেখতে পারেন। এ কথায় উনি অত্যন্ত লজ্জা পেলেন এবং আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন।

যাহোক, জমিদারদের সাথে কথা বলে আমি ওদের জমি পাইয়ে দিলাম। দাম ইত্যাদি নিয়ে বেশি ঝামেলাও ওরা বাদ দিল। আমি ভাবলাম, বিলেতি চিনির ওপর প্রায় সাড়ে ছ’টাকা মণ ট্যাক্স ধার্য হয়ে যাওয়ায় চিনির মিল তো এখানে খুলবেই। কাল কোনো বিদেশি এসে খুলবে তা থেকে তো অনেক ভালো এই ডালমিয়া, অন্ততঃ গান্ধিটুপি পরে আর নিজেকে কংগ্রেসি বলে! লোকেরাও মানে। কিন্তু এর পরিণতি ভালো হল না। ডালমিয়ার সাহস বেড়ে গেল। ফলে, পরে আমাকে নানাভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করল। বোধহয় লোকেরা ওকে বলেছিল যে এই স্বামীটা বিচিত্র। এমনিতে শুনবে না। যাও আর ধীরে ধীরে ওর সাথে মেলামেশা কর, তাহলে হয়ত ফাঁদে ফেলতে পারবে। নইলে তো টাকাপয়সার কথা বললেই জুতো ওঠাবে।

তাই হল আর ডালমিয়া পরিবার ধীরে ধীরে আশ্রমে আসা যাওয়া শুরু করল। তারপর প্রস্তাব দিল যে তার বোনের এক ছেলে এই আশ্রমেই থাকুক। আমি বললাম দেখা যাবে। পরে ছেলেটির মা আর ঠাকুমাকে দিয়েও কথা বলাল। আমি এড়াতে থাকলাম। এক দিন তো বলল যে ছেলেটির জন্য আশ্রমেই আলাদা বাড়ি বানিয়ে দেবে। তারপর আশ্রমের কয়েকজন হিতাকাঙ্খীকে ধরল, ছেলেটাকে এখানে রাখিয়ে দিন। তারা বলেও দিল হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলে দিলাম “আমার আজ্ঞা না থাকলে ও এখানে ঢুকতে পারবে না”। এ কথায় তারা অবাক হল, কী ব্যাপার? শেষে একদিন যখন তারা জিজ্ঞেস করল, স্পষ্ট বললাম এখানে গরীবের ছেলেরা থাকে। বারো মাস সকালেই ওঠে এবং আশ্রমের সমস্ত কাজ নিজের হাতেই করে। কোনো চাকর নেই। আপনার ছেলে সেটা করতে পারবে না। তাকে রেয়াৎ করে পরলোকে বা ইহলোকে আমি কী জবাব দেব? আমি সেটা করতে পারব না। তাই ওকে এখানে রাখতে পারব না। এভাবে ঝামেলাটা এড়ান গেল।

তা সত্ত্বেও আসা যাওয়া চালু রইল। দশ-কুড়ি দিন পর পর ওরা পাঁচ-ছয় টাকা ছেলেদের জন্য দিয়ে যেত। বলত এ টাকাটা ভোজে লাগিয়ে দিন। ব্রহ্মচারিরা খাবে। কারণ বলত আজ অমুক পুজো, আজ তমুকের জন্মদিন, আজ বাড়িতে বিয়ে, আজ ভোজ ইত্যাদি। ভাবলাম এটা দ্বিতীয় উৎপাত শুরু হল। এভাবেই মাস-পনের দিন পর পর যদি এদের টাকা নিয়মিত আসতে থাকে তাহলে ভালো হবে না। কেননা টাকায় বড় মোহিনী শক্তি আছে। ফলে এই টাকাটাকে ধীরে ধীরে আমি রেয়াৎ করব, মেনে নেওয়া শুরু করব। এখানে মিলে এদের শ্রমিকদের থেকে কাজ নেওয়ার আছে, কৃষকদের থেকে আখ নেওয়ার আছে। সে সময় যখন এরা শ্রমিকদের আর কৃষকদের কষ্ট দেবে, ওদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে তখন এ টাকাগুলো আমার জন্য বিপজ্জনক এবং ফাঁদ হয়ে দাঁড়াবে। এদেরই কারণে, সুবিধে নেওয়ার লজ্জায় আমার বলার সাহস হবে না। কথায় আছে যে চোর যখন চুরি করতে বেরোয় তখন সঙ্গে গুড় রেখে নেয় আর যেই রাস্তায় কুকুর ঘেউঘেউ করে, সে গুড় ওদের সামনে ফেললে ঘেউঘেউ বন্ধ হয়ে যায়। গুড় খেতে গিয়ে ওরা ফেঁসে যায়। ঠিক এটাই এ পূঁজিপতিরা করে। আমাদের ঘেউঘেউ করার লোক বুঝে আগেই গুড় ফেলে। তাই একদিন শক্ত ভাবে বলে দিলাম, আপনারা খুশিমত আসুন যান। কিন্তু দয়া করে এই টাকা দেবেন না। নইলে একদিন আপনারা এখানে গরীবদের ওপর জুলুম করবেন আর এই টাকার মোহিনী মায়া আমার মুখ সেদিন বন্ধ করে দেবে। শুনে ওরা অবাক হল বটে কিন্তু টাকা আর কখনো দিল না। এভাবে এই দ্বিতীয় উৎপাতটাও শেষ হল।

মিলের পরিচালকেরা বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদকেও মিলের একজন ডায়রেক্টর বানিয়ে দিল। ঘোষণা হয়ে গেল যে মিলের উদ্বোধন করবেন পন্ডিত মদনমোহন মালব্য। ওদিকে প্রচার করা হল মিলের শ্রমিকদের জন্য আদর্শ বাসস্থান তৈরি হবে। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য স্কুলের ভালো ব্যবস্থা থাকবে। আমার সাথে কথায় কথায় ওরা একথাও বলত যে ওয়েগ সাদারল্যান্ড প্রভৃতি যে মিলগুলো আছে ইংরেজদের তাতে খরচ অনেক বেশি হয়। আমরা কম খরচ করব। ফলে কৃষকদের যথেষ্ট টাকা দিয়ে আখ নেব, শ্রমিকদের পর্যাপ্ত বেতন দেব এবং তার পরেও আমাদের চিনি ওদের চিনি থেকে সস্তা হবে। যাহোক, মালব্যজি তো এলেন না।

এদিকে মিল যখন অনেকটা তৈরি হয়ে গেছে একদিন কথাচ্ছলে বললেন কৃষক তো তিন আনা মণের দরে আখ দেবে! কেননা ওদের পয়সার দরকার। আমি বললাম ওয়েগ সাদারল্যান্ড তো ছ’আনা দেয়। আপনি মাত্র তিন আনা কিকরে বলছেন? বলতে শুরু করলেন যে ওটুকুতেই পোষাবে। আমি বললাম, এই তো কিছুদিন আগে বলছিলেন যে আমাদের খরচ যেহেতু কম তাই যথেষ্ট পয়সা দিয়েও সস্তায় চিনি বেচব। আজ কী হল? বললেন যোগান আর চাহিদার (Supply and demand) তত্ত্বটারও তো খেয়াল রাখতে হবে। বললাম তত্ত্বটা শুধু আখের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে না চিনির ক্ষেত্রেও? বিদেশি চিনির ওপর ভালো রকম ট্যাক্স লাগানোর পরই তো আপনার মিল খুলতে পেরেছে। ভ্লে গেলেন এত তাড়াতাড়ি? চিনির ক্ষেত্রেও একই তত্ত্ব প্রয়োগ করে মিল খুলুন তো, তবে দেখব! আর যদি এটাই আপনার উদ্দেশ্য হয় তাহলে এখন থেকেই আমি কৃষকদের তৈরি করব যেন ওরা মিলকে আখ না দেয়। তখন বলতে লাগলেন, আপনার কথা কে শুনবে? ওদের তো গরজ, বেহুঁশের মত যে দামে আমরা চাইব সে দামে আখ দেবেই। বললাম, মানছি আপনার কাছে পয়সা আছে। তাই সরকার আর পুলিসও আপনাকে সাহায্য করবে। তেমন মানুষও পেয়ে যাবেন যারা কৃষকদের ফুসলে নেবে। আপনি নোটিশ ইত্যাদি ছাপিয়ে এবং খবরের কাগজের মাধ্যমেও নিজের কাজ বার করে নেবেন এবং প্রথম দিকে আখ পেয়ে যাবেন। তা সত্ত্বেও আমি আমার চেষ্টা ছাড়ব না। তখন হেসে বললেন, যখন আখ আমি পেয়েই যাব, সে চেষ্টায় লাভ? আমিও শুনিয়ে দিলাম। পঞ্চাশ বছর আগে যখন কংগ্রেস তৈরি হল কেউ পুছতো না। কিন্তু কাজে লেগে থাকার ফল হল যে আজ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানায় কংগ্রেস আর সরকারকে নোয়ায়। যদি কোনো বাড়িতে অনবরত দশ-বারো বার সে বাড়ির সদস্যেরা অসুস্থ হয়, ডাক্তার-বদ্যি ডেকে আনা সত্ত্বেও মারা যায়, তার মানে তো এই নয় যে আবার কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার ডাকাই হবে না। উনি চুপ করে গেলেন। আমিও চলে এলাম।

কিন্তু বাঘের চোয়ালের হদিশ পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই পুরো সজাগ হয়ে উঠলাম। কৃষকদের মাঝে আমার প্রচার হল খুব। কুড়িটার বেশি নোটিশ আর একশোর বেশি সভা করে আমি তাদের সতর্ক করলাম যে বিপদ আছে। ওদিকে উনিও অনেক প্রচার চালালেন। কৃষকেরা গুড় তৈরি করা বন্ধ করে দিলে মিলের গোলাম হয়ে পড়বে। এই সত্যিটা জানতেন তাই সর্বশক্তি দিয়ে এমন প্রচার চালালেন যাতে কৃষকেরা ভ্রান্তির শিকার হয় আর গুড় তৈরি করা বন্ধ করে দেয়। পূঁজিবাদের নগ্নরূপ দেখলাম ওখানে। কৃষকদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য এমন এমন নোংরা আর মিথ্যে প্রচার করা হল যে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। শেষে এমনও প্রচার চলল যে আমি মিলের কাছে দু’হাজার টাকা চেয়েছিলাম, না পাওয়ায় বিরুদ্ধে চলে গেছি। কিন্তু এখানে অত বোকা কেউ নয়। কৃষকেরা আমায় ভালো করে জানে। ফলে ওদের প্রচারে কিছুই হল না। গুড় তৈরি করা চলতে থাকল। প্রথম বছরেই এটা হল আমার প্রথম জয়। তারপর তো আমি সে বছরই এবং পরেও, মিলওয়ালাদের বাধ্য করে সাত-আট আনা মণ অব্দি আখের দাম দেওয়ালাম কৃষকদের। যখন নাকি অন্যান্য জায়গায় পাঁচ-ছয় আনাই দর পাওয়া যাচ্ছিল। সরকারও এই দামই ধার্য করেছিল। এভাবে, কে জানে কত লাখ টাকা মিলের কাছ থেকে ছিনিয়ে কৃষকদের দেওয়ালাম। এটা ছিল জয়ের পর আবার জয়। ওদের সাথে আমার লড়াই শুরু হয়ে গেল। স্পষ্ট বলে দিলাম যে শান্তিতে থাকতে দেব না।

পরে ওখানে তিনটে হড়তাল হয়, ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে প্রথম, ১৯৩৮ সালের পয়লা জানুয়ারিতে দ্বিতীয় এবং ১৯৩৮-৩৯ সালে তৃতীয়। প্রথমটা শুধু কৃষকদের ছিল। কয়েক মাস আখ দেওয়া বন্ধ থাকে। মিলের কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হয়। দূর থেকে আখ আনাতে পড়েছিল বারো-চোদ্দ টাকা মণ। তা সত্ত্বেও শুকিয়ে গেল। ফলে সব তেজ বেরিয়ে গেল ওদের। কৃষকদের পায়ে পড়তে পড়তে সময়টা কাটল। তারপর শেষ হল হড়তাল। কৃষকদের সাথে যে খারাপ ব্যবহার করত মিলওয়ালারা, সেসব অনেক কমে এল। যদিও সে হড়তাল সফল হয় নি। আসলে আমার অনুপস্থিতিতে, আমায় জিজ্ঞেস না করেই হঠাত কৃষকেরা মিলের শয়তানিতে ক্ষেপে গিয়ে ওখানে মারপিট করল আর আখ দেওয়া বন্ধ করে দিল। যখন ফিরলাম, অবস্থা দেখলাম। কিছু করার ছিল না। কৃষকদের পক্ষ তো নিতেই হত। ফলে এমন সংগঠন, এমন পিকেটিং আর এমন সতর্কতা রইল মাসের পর মাস যে পুলিসের সাহায্য নিয়ে গ্রাম থেকে আখের গাড়ি আনাতে হল। কত স্বয়ংসেবক ধরা পড়ল পিকেটিংএ। আমরাও প্রথম প্রশিক্ষণ পেলাম হড়তালের।

দ্বিতীয় হড়তাল কৃষক ও শ্রমিক, দু’দলেরই ছিল। এমন সফল হল যে ৪৮ ঘন্টায় মিলের লোকেদের কাঁপুনি ধরে গেল। শ্রমিক সঙ্ঘের সভাপতি শ্রী শ্যামনন্দন সিং, এমএলএর সাথে চুক্তি করে শ্রমিকদের সব শর্ত ওরা মেনে নিল। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়েই হড়তাল ছিল। কিন্তু কৃষকেরা পুরোপুরি সঙ্গ দিল। যখন আদেশ পেল তখনই আবার মিলে আখ আনা শুরু করল।

কিন্তু এর পর ভিতরে ভিতরে মিলওয়ালারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরি হল। গান্ধিবাদি এবং সোশ্যালিস্ট সবকিছুই সেজে থাকা, অ্যাসেম্বলি এবং কাউন্সিলের কংগ্রেসি মেম্বার এবং পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি পদে থাকা কয়েকজন নামকরা নেতাকে ডেকে এনে একটা নকল ইউনিয়ন দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর দ্বিতীয় হড়তালে মেনে নেওয়া শর্তগুলো আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করল। টালবাহানা করতে করতে অতিষ্ঠ করে তুলল। যখন ১৯৩৮-৩৯ এর সিজন (আখ মাড়াইয়ের সময়) শুরু হল তখন আমাদের ইউনিয়নের নেতারা শুধু শ্রমিকদের হড়তাল ডাকল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মারপিট এবং চাপের মুখে দু-আড়াইশোর বেশি শ্রমিক হড়তাল করতে পারল না। ফলে বিফল হল হড়তাল। খুব কষ্ট হল আমার। ইউনিয়নের কাজের সাথে আমার সম্পর্ক না থাকায় এবং ওদিকে সময় না দিতে পারায় সব কথা আমি জানতাম না। অন্যান্য সঙ্গীরা তো ওতে ছিলই এবং ওদেরই ওপর আমার ভরসা ছিল। কিন্তু ওরা ঠিকমত কাজ করছিল না। তাই বিশৃঙ্খলা এল। এখন তো লজ্জায় ওরা পালাতে প্রস্তুত হয়ে গেল।

আমি এটা বরদাস্ত করতে পারলাম না। বললাম, কৃষকদের আখ বন্ধ করে এবং ট্রেনে আসা আখের পিকেটিং করে মিলওয়ালাদের শায়েস্তা করব। কিন্তু বন্ধুরা এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ওর এতটাই পর্যুদস্ত ছিল যে বলতে লাগল আপনিও বেইজ্জত হবেন। কেউ কথা শুনবে না আর পঁচিশ-পঞ্চাশজন জেলে যাওয়ার পর চুড়ান্তভাবে অসফল হব আমরা। সারা দিন ওদের সাথে তর্ক করে ওদের ভরসা দিতে চাইলাম যে কৃষকেরা এমন করবে না, আমার বিশ্বাস আছে ওদের ওপর। কিন্তু ওরা মানতেই তৈরি ছিল না। অনেক চেষ্টাচরিত্তির করার পর সন্ধ্যেবেলায় মানল। ব্যস, আমি ঘোষণা করে দিলাম! তারপর তো বিদ্যুৎ খেলে গেল এবং ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পিকেটিংএ দু-আড়াইশো জন জেলে গেল। আখের গাড়ি সব বন্ধ হয়ে গেল। মিলওয়ালারা ভয় পেয়ে আপোষ করল। আমার কাছে দৌড়ে এল আর মিটমাটের কথা বলে ব্যাপারটা শান্ত করল। এভাবে যেমন তেমন করে শ্রমিকদের রক্ষা করল আবার কৃষকেরা। সবার সম্মান ফিরিয়ে আনল। পরে আমার সঙ্গীরাও লজ্জিত হল।

জনসমষ্টিতে যারা কাজ করে তাদের, জনতার ওপর, নিজের লক্ষ্যের ওপর এবং নিজের ওপর অগাধ বিশ্বাস থাকা উচিৎ। তাহলেই সফলতা পাওয়া যায়। আমার তো কৃষকদের ওপর অসীম বিশ্বাস। ফলে, কখনো আমায় হতাশ হতে হয় নি। সবসময় ওরা সঙ্গ দিয়েছে আমার। প্রথম হড়তালের সময় তো বড় বড় দালাল মিলের তরফ থেকে আমার সাথে ঠগবাজি করতে এল। একজন তো একটু অসভ্যতাও করল। যদিও বাকিরা চালাকি করেই কথা বলছিল। লোকটা যেই বলল আশ্রমকে দশ হাজার টাকা একসঙ্গে এবং দুশো টাকা মাসিক দেওয়া হবে, আমি রেগে চিৎকার করলাম, জিভ ছিঁড়ে নেব রে নীচ, নইলে পালা। আমার সাথে ঠগবাজি করতে এসেছিস? কৃষকদের রক্তের পয়সা নেব আমি? তখন ব্যাটা বেগতিক দেখে পালিয়ে গেল।

মিলের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে কায়েমি স্বার্থের লোকেরা অত্যন্ত দুর্বল হয়। যদি সাহস করে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়ান তাহলে শিগগিরই হার স্বীকার করে নেয়। এটাও দেখলাম যে কৃষক এবং শ্রমিকদের পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হল যে নেতাদের সাথে প্রতারণা করার ওদের পদ্ধতিটা জেনে গেলাম। মিষ্টি ছুরির মত। যদি আমি একটুও নরম হতাম তাহলে দু-চারশ টাকা মাসে এবং কয়েক হাজার টাকা একসঙ্গে নিয়ে আশ্রমে সুন্দর বাড়ি তৈরি করিয়ে দিতাম, অনেক পন্ডিত বহাল করে ছেলেদের লেখাপড়া করাতাম, সুন্দর গ্রন্থাগার তৈরি করিয়ে দিতাম। চারদিকে খবর যেত যে স্বামীজি বড় বড় কাজ করছেন। কিন্তু আসলে কী হত? এটাই তো, যে মিলওয়ালারা আট বা বারো আনার জায়গায় তিন-চার আনা মণ হিসেবেই আখ কিনত এবং কৃষকেরা বাধ্য হয়ে ওদের দিত। কেননা গুড় তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওদের কাছে অন্য কোনো উপায় থাকত না। সরকার যাই দাম ধার্য করুক, জালিয়াতি করে মিলওয়ালারা খুব কম পয়সা দিত। আর আমি? আমি চুপ করে বসে দেখতাম এই লুট, এই বিধ্বংস! মুখ খুলবার সাহস হত না। কেননা তাহলে আবার আশ্রমে আসা ওই পয়সা বন্ধ হয়ে যেত যে! অনেক লিডার ওখানে একাজই করছেন। ফল হত যে এক বছরেই কৃষকদের না জানি কত লাখ টাকা লুটে মিলওয়ালারা পেয়ে যেত এবং সেই রক্ত থেকেই দু-চার ফোঁটা আমাদের দিতে থাকত। এই ব্যাপারই সব জায়গায় হয়। যারা ধনবান আর পূঁজিপতিদের কাছে টাকা নিয়ে সার্বজনীন সেবা করার ভান করে তারা গরীবের রক্ত এভাবেই লুন্ঠন করিয়ে তা থেকে দু-চার ফোঁটা পেয়ে থাকে। এটা ধ্রুব সত্য। 

(৪)

কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলির নির্বাচন

মিলওয়ালাদের সঙ্গে যে আমার লড়াই শুরু হয়ে গেল তার ফল সব দিক থেকেই ভালো হল। আমাদের কংগ্রেসি নেতারা এধরণের লড়াইয়ে খুব ভয় পান এবং চান যে লড়াই-ফড়াই না হোক। এসব লড়াইয়ে এঁরা দেশের, কংগ্রেসের এবং জনতারও ক্ষতির ভূত দেখতে পান। কিন্তু আমি তো এখানে উল্টোটাই দেখলাম। ১৯৩৫ সালে কেন্দ্রীয় অ্যাসেম্বলির যে নির্বাচন হল এবং যে নির্বাচন লর্ড উইলিংটনের ‘কংগ্রেস শেষ হয়ে গেছে’র হিসেবটা ভুল প্রমাণিত করল, তাতে পাটনা এবং শাহাবাদ এই দুই জেলায় কংগ্রেসের তরফ থেকে বাবু অনুগ্রহ নারায়ণ সিং দাঁড়িয়েছিলেন। ওনার বিরুদ্ধে টাকার জোরে শ্রী রামকৃষ্ণ ডালমিয়া এবং হিন্দু স্বার্থের ঠিকেদারির জোরে হিন্দু মহাসভার মন্ত্রী ও যোদ্ধা বাবু জগতনারায়ণ লাল দাঁড়িয়েছিলেন। ডালমিয়ার মাথায় এ আশাও ছিল যে বিহটা এবং ডেহরি-অন-সোনের দুটো মিল এবং তার কয়েক হাজার লোকও তাকে সাহায্য করবে। অন্য দিকে এই দুটো জেলার সঙ্গে অনুগ্রহবাবুর বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। তাই কংগ্রেসি লিডাররা ভয় পেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি জিতলেন এবং খুব ভালোভাবে জিতলেন। ওদিকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যে শুধু হারল তাই নয়, বাবু জগতনারায়ণ লালের জামানতটাও বাজেয়াপ্ত হল। পাটনায় যা ভোট পেল ডালমিয়া তাতে ওরও জামানত বাজেয়াপ্ত হত, যদি শাহাবাদেও একই হিসেবে ভোট পড়ত। কিন্তু ওখানে কিছু বেশি ভোট পেয়ে গেল। তাই রাম-রাম করে জামানতটা রয়ে গেল।

এই নির্বাচনে কয়েকটি মজার ব্যাপার হল। বিহটার দক্ষিণে পালিগঞ্জে একটা সভা ছিল। তাতে অনুগ্রহবাবু এবং বাবু শ্রীকৃষ্ণ সিং উপস্থিত ছিলেন। লেকচার হল। কৃষকেরা শুনল। তারপর একজন কৃষক আমায় স্পষ্ট শোনাল, আপনার কথা তো আমরা মানবই এবং অনুগ্রহবাবুকেই ভোট দেব। কিন্তু এটা বলুন যে এও জমিদার নয় তো? আমি থতমত খেলাম। যাহোক শেষে যেমন তেমন করে ওকে ভরসা দিলাম। জানিনা ওকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলাম কিনা। কিন্তু অভিজ্ঞতাটায় দারুণ খুশি হলাম যে কৃষকদের মাঝে এই চেতনা এসে গেছে। এখন সহজে ওরা জমিদারদের ভাঁওতায় আসবে না।

কিন্তু ওর আশঙ্কা তো অমূলক ছিল না। কেননা ও জানত যে এ লোকটাও জমিদার। পরে তো আমি তিরস্কারও পেলাম। কংগ্রেসি মন্ত্রীমন্ডলের যুগে ওই এলাকারই, ১৮ বছর বয়সের, কোইরি জাতের এক যুবক অদ্ভুত মুখ করে আমায় শুনিয়ে দিল যে আপনার বলাতেই ভোট দিয়েছিলাম আর এখন এই অবস্থা? আমি ওর কাছে স্বীকার করলাম যে ভোট নিয়ে ওরা ধোঁকা দিয়েছে অবশ্যই। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে অন্য কিছু হতে পারত না। হ্যাঁ, ভবিষ্যতে কিছুতেই আর এমন হবে না।

দ্বিতীয় মজার ব্যাপার ছিল যে মিস্টার ডালমিয়া, যেটা পরে নানান সূত্রে জানতে পারলাম, নির্বাচনে এক লক্ষ টাকা খরচ করে ফেলেছিল। এত বাস, মোটর এবং বিভিন্ন যানবাহন আনা হয়েছিল যে অন্যান্যদের জন্য সে সময় যানবাহন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। বেনারস থেকেও বাস এসেছিল ওর কাজে। জলের মত পয়সা টাকাপয়সা খরচ করা হত। যেমন বড়লোকদের সাথে আকছার হয়, কয়েকজন জীহুজুরী করা দরবারিদের কথায় বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে ও জিতবে। এ দেমাকও ছিলই যে টাকা দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। ভোট পাইয়ে দেওয়ার অছিলায় লোকেরা ওর কাছ থেকে টাকাও খুব উপার্জন করল। কিন্তু আমার বিরোধ ছিল তীব্র। ফলে উনি চিৎপটাং হলেন। যদি ওর সাথে আমার লড়াই না থাকত তাহলে এমনটা কখনই হত না। ওর কংগ্রেস বিরোধের ফলশ্রুতি হল যে শ্রী রাজেন্দ্রবাবুকে আমি বিহটা মিলের ডাইরেক্টরের পদ থেকে সরাতে সক্ষম হলাম। যখন মিলের নীতি কৃষকবিরোধী হয়ে পড়ল তখনই, ভূমিকম্পের পরই আমি ওনাকে সরে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু উনি টালবাহানা করছিলেন। কিন্তু এখন আর কী করতেন!

হিন্দু মহাসভার মহারথীর বিরাট গর্ব ছিল যে সে নিশ্চয়ই জিতবে। ওই এলাকা থেকে উনি একবার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওদিকে ওনার নিয়মিত আসা যাওয়া এবং ফন্দিফিকির লেগে থাকত। লবণ সত্যাগ্রহে ওখানেই ধরাও পড়েছিলেন। তাই বেশ কয়েকবার দৃঢ়তার সাথে রাজেন্দ্রবাবুকে বলেও দিয়েছিলেন, অনুগ্রহবাবু নিশ্চিত হারবেন, আপনি ওনাকে সরিয়ে নিং। কিন্তু আমি ভরসা দিয়েছিলাম। তাই উনি নিজের জায়গায় দৃঢ় রইলেন। সে সময় যে নোংরা নোটিশগুলো কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ওরা বার করছিল, সব এনারই কীর্তি ছিল। কংগ্রেসকে সীমান্ত প্রদেশের পাঠান জাতিদের সাথে উনি এক করে দেখাতেন আর বলতেন যে কংগ্রেসের জয় হলে না গরু বাঁচবে, না মন্দির, না বৌ-মেয়ে, না কারোর টিকি। হিন্দুত্বের একটা চিহ্নও থাকবে না! মন্দিরে ঘন্টাও বাজবে না! কিন্তু ওনার কোনো কথাই চলল না। কে জানে পরে কিকরে ওনার কংগ্রেসেরই লেজ ধরে প্রাদেশিক এসেম্বলিতে পৌঁছোবার সাহস হল! কোন ভাবনা থেকে নেতারা ওনাকে শুধু মেম্বার নয়, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিও বানাল। এসব তো রহস্যই থেকে যাবে। কম-সে-কম জনসাধারণের জন্য, এবং মিছিমিছি।

(৫)

কবালা প্রদেশ

প্রথম প্রথম বোম্বাই কংগ্রেসে একটা অদ্ভুত কথা শুনতে পেলাম। আমাকে গান্ধিজি আর রাজেন্দ্রবাবু প্রভৃতির বিরোধ করতে দেখে লোকেরা বেশ কয়েকবার বলল আপনি তো কবালা প্রদেশের। সেখানে তো নিজের ভাবনাচিন্তা চাপা দিয়ে রাখতে হয় আর রাজেন্দ্রবাবুর আদেশ চলে। অর্থাৎ বিহার প্রদেশ ওনার নামে কবালা করা, বিক্রীত। হাসি পেল অবশ্যই। কিন্তু কথাটা বিচ্ছিরিভাবে বিঁধলও। কিছু করার ছিল না। অভিযোগকারীদের অভিজ্ঞতা ছিল এটা। অন্ততঃ কিছুটা সেরকম ব্যাপার ছিলও বটে। তখন অব্দি বিহার থেকে একজনও তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলে নি। সবাই এক সঙ্গেই ভোট দিত।

তারপর লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে যুক্ত প্রদেশ এবং অন্যান্য জায়গার প্রতিনিধিরাও এই একই ব্যাপার নিয়ে বিদ্রুপ করল। কেননা সেখানেও আমি রাজেন্দ্রবাবুর বিরোধ করেছিলাম। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (Proportional representation) যে নিয়ম ছিল, সে নিয়ম সরিয়ে নেতারা আগের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচন রাখতে চাইছিল। সে চেষ্টার তীব্র বিরোধ করলাম আমরা। আরো কিছু ব্যাপার ছিল যেগুলোর বিরোধ করতে হয়েছিল। সেসবে তো আমরা হারলাম। কিন্তু আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে জিতলাম। তারপরও লোকেদের বলতে শুনলাম যে বিহার কবালা প্রদেশ। যদিও লক্ষ্ণৌএর পর ফের থেকে এই বিদ্রুপ আর শুনতে হয় নি। বোধহয় সে কলঙ্ক ধুয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও ধাঁধাটা আমার মনে থেকেই গেল যে এত বড় কলঙ্ক প্রদেশের মাথায় কেন চাপান হল। চিন্তাভাবনার সংগ্রাম তো জরুরি। তাও কংগ্রেসের মত প্রতিষ্ঠানে। যেখানে সব চিন্তাধারার মানুষদের যে আসার এবং বলার সুযোগ আছে তাই নয়, বরং তাদের প্রত্যেককে নেতারা বার বার আমন্ত্রণ জানান যে আসুন, নিজের চিন্তাভাবনার কথা বলুন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করুন। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তো সেজন্যই কংগ্রেসে রাখা হয়েছিল যাতে সব চিন্তাধারার মানুষ আসতে পারেন। বিশুদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিয়মে তো তাদের আসা অসম্ভব হত!

কিন্তু লখনউএর পর শ্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায়ের যে দীর্ঘ চিঠি পেলাম, খাস লখনউয়ে যে ঘটনাগুলো হল এবং তারপরেও অনবরত হতে থাকল, সেসবে সমাধান হল ধাঁধাটার। তখন আমায় স্বীকার করতে হল যে কলঙ্কটা সত্যি ছিল। শ্রী কৃষ্ণবল্লভবাবু হাজারিবাগের নেতা এবং রাজেন্দ্রবাবুর ভক্ত। উনি লিখলেন যে বিহার যতটা এগিয়েছে, যা কিছু সম্মান পেয়েছে তা শুধু এই কারণে যে আমরা ওনাকে সম্মান করেছি এবং চোখ বন্ধ করে ওনার সঙ্গ দিয়েছি। কিন্তু আমি মনোকষ্টে আছি যে সে ব্যাপার আর নেই। খুবই বেদনার ব্যাপার যে আপনি একদিকে আর রাজেন্দ্রবাবু অন্যদিকে থাকবেন আর কংগ্রেসে কুস্তি চলবে। যদি এটা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ভালো হয়। পড়ে অবাক হলাম। উত্তর দিলাম যে সম্মান আর ভালোবাসা তো মনের ব্যাপার। হাটে কেনা হয় না। আমি আজও রাজেন্দ্রবাবুকে সম্মান করি এবং তাঁকে ভালোবাসি। কিন্তু বোম্বাই বা লখনউএ যা কিছু বলেছি বা যে প্রশ্নে বিরোধ করেছি সেসব তো তত্ত্বগত ব্যাপার। চিন্তাভাবনার সংগ্রাম তো ভালো। তাকে অভ্যর্থনা করার বদলে চিন্তাভাবনাকে পিষে ফেলার এ চেষ্টা অত্যন্ত খারাপ, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারই সঙ্গে আমার চোখও খুলে গেল।

লখনউএ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সরাবার যে চেষ্টা নেতাদের তরফ থেকে করা হল, এবং সেখানে হারলেও নিয়মিত যে চেষ্টা ততদিন অব্দি হতে থাকল যতদিন না গত বছর বোম্বাইয়ে সেটা সফল হল, স্পষ্ট বার্তা দিল যে ওরা আসলে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা কংগ্রেসে দেখতে চায় না। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা তাদের নেতৃত্ব এবং অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। ১৯৩৭ সালের মার্চে হওয়া দিল্লির অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির পর গান্ধিজি তো স্পষ্ট লিখেই দিয়েছেন যে কংগ্রেসে এক অভিমত ও এক মত চাই। তারপর থেকে তো এই ‘একটাই ভাবনা এবং একটাই অভিমত’ কথাটা ঐতিহাসিক হয়ে গেছে। এ কথাটা নিয়েই ত্রিপুরিতে এবং তারপর বড় বড় ঘটনা ঘটল এবং শ্রী সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হল। এতে বোঝা যায় যে প্রথম থেকেই নেতারা অন্ধের মতই অনুসরণ চাইছিলেন এবং বিহার তাতে এগিয়ে ছিল। লোকেদের যাতে সন্দেহ না হয় তাই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দিয়েছিল বটে কিন্তু যেই তাতে বিপদ দেখতে পেল চট করে ভোল পাল্টে নিল। 

(৬)

কৃষকদের দাবি – ফৈজপুরের কর্মসূচি

১৯৩৬ সালের আগস্টে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির বৈঠক বোম্বাইয়ে হল। তাতে ভবিষ্যতের এসেম্বলি নির্বাচনের জন্য ঘোষণাপত্র তৈরি করা হল। নির্বাচনকে সামনে রেখে যে কথাগুলো তাতে লেখা হল তা দেশের পক্ষে অনেকটাই প্রগতিশীল ছিল। কিন্তু কৃষক আর শ্রমিকদের পক্ষে আরো কিছু বিশেষ কথা লেখার জন্য প্রগতিশীল ভাবধারার মানুষেরা যে আগ্রহ জানিয়েছিল তা মানা হল না। ফলে সমস্ত চেষ্টা অর্থহীন হল। তবুও, সে জায়গা থেকেই, আমাদের অল ইন্ডিয়া কিসান কমিটির বৈঠকে বিধিবিধান ছাড়া ভারতের কৃষকদের যে দাবীপত্র (Charter of Rights) আমরা তৈরি করলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের সভার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সে দৃষ্টি থেকে বোম্বাইয়ের ঐ বৈঠক ঐতিহাসিক।

কিন্তু যখন ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে ফৈজপুরে কংগ্রেস হল এবং পন্ডিত জহরলাল আবার সভাপতি নির্বাচিত হলেন তখন আরেকবার আমরা চেষ্টা করলাম যেন কৃষকদের কথা কংগ্রেস বিশেষ ভাবে ওঠায়। লখনউয়ে একটা প্রস্তাবের মাধ্যমে কংগ্রেস প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিগুলোকে পরামর্শ দিয়েছিল যে তারা নিজের নিজের প্রদেশে কৃষকদের অবস্থার তদন্ত করে তাদের সুপারিশ অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসকে লিখে পাঠাক, যাতে তারই ভিত্তিতে সারা ভারতের জন্য একটা কর্মসূচি তৈরি করা যেতে পারে। এটা লখনউ কংগ্রেসে আমাদের লড়াই এবং সেখানে অল ইন্ডিয়া কিসান সভা করার ফল ছিল। অল ইন্ডিয়া সভার এটা প্রথম জয় ছিল। সে পরামর্শ অনুসারে বিহার প্রদেশে একটা তদন্ত কমিটি তৈরিও হয়েছিল। প্রত্যেকটি জেলায় সে কমিটি তদন্ত করেওছিল কিন্তু তার রিপোর্ট ছাপা হয় নি। তার কথা পরে আসবে।

তাই যে মুহূর্তে অল ইন্ডিয়া কমিটির কাজ পুরো করে সভাপতি বিষয় সমিতি শুরু করার ঘোষণা করতে উঠলেন, তখনই আমি ওনার মনোযোগ আকর্ষণ করলাম যে ফৈজপুরের পরেই এসেম্বলি নির্বাচন হবে এবং বেশির ভাগ ভোটারই কৃষক। কিন্তু তাদের জন্য কংগ্রেসের কোন বিশেষ প্রোগ্রাম নেই। তাহলে আমরা কী নিয়ে ওদের কাছে ভোট চাইতে যাব? লখনউয়ে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সে অনুসারে তদন্ত হওয়া সত্ত্বেও, অন্ততঃ বিহারে তো কোন রিপোর্ট প্রকাশিত হয় নি। কোন সুপারিশও আসেনি যে কৃষকদের দাবি কী এবং ওদের জন্য কী করা যায়। বেশির ভাগ প্রদেশেরই এই এক অবস্থা।

এ কথায় বিহারের কয়েকজন নেতা রেগে আমায় ধমকালেন। কিন্তু আমি মুখের মত জবাব দিলাম ওদের। তখন সভাপতি এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য আমায় ধন্যবাদ জানিয়ে আশ্বাস দিলেন যে আমরা এই কংগ্রেসে কৃষকদের জন্য কিছু না কিছু বিশেষ প্রোগ্রাম অবশ্যই তৈরি করব। ফলে ওয়র্কিং কমিটির তরফ থেকেই একটা প্রস্তাব এল যাতে লখনউএর প্রস্তাবের উল্লেখ করে, যে প্রাদেশিক কমিটিগুলো এখনো অব্দি তদন্ত করে রিপোর্ট তৈরি করে নি তাদের কাজে দুঃখ প্রকাশ করা হল। অবিলম্বে রিপোর্ট পাঠাবার জন্য তাগাদা দেওয়া হল। কিন্তু যতদিন রিপোর্ট না আসে ততদিনের জন্য ওই প্রস্তাবেরই শেষে কৃষকদের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত কর্মসূচি যোগ করা হল যেটি পরে ‘ফৈজপুর কৃষক কর্মসূচি’ নামে প্রসিদ্ধি পেল। কৃষকদের অধিকারের বিষয়ে অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ওই কর্মসূচিতে। কিন্তু পরে যখন কংগ্রেসের মিনিস্ট্রি তৈরি হল তখন সেসব কথাগুলো মোটামুটি ভাবে ধামাচাপাই রাখা হল। ওদের ভাষায় যথাযথ বাস্তবায়ন হল না।

ফৈজপুরে অল ইন্ডিয়া কিসান সভার দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশন হল। সভাপতি ছিলেন প্রফেসর রঙ্গা। আহমদনগরের শ্রী মহাদেব বিনায়ক ভুসকুটে অভ্যর্থনা সমিতির অধ্যক্ষ ছিলেন। সেখানে মহারাষ্ট্রের কয়েকজন যুব সোশ্যালিস্টের সক্রিয়তা এবং ডক্টর ভুনেকরের স্বভাবসিদ্ধ স্পষ্টবাদিতার ফলে ঝামেলা হতে হতেও হল না এবং আমাদের কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল। সেখানেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে কংগ্রেসের লেজুড় করলে আমাদের সভা শক্তিশালী হতে পারবে না। কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় প্রধানত তারই কাজ হয়। ফলে সভার কাজ গুরুত্ব পায় না। আমরাও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না। ফলে স্বাধীন ভাবে অল ইন্ডিয়া কিসান সভার বার্ষিক অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

ফৈজপুরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা হল এবং যেটা তারপর থেকে প্রতিটি কংগ্রেস অধিবেশনের সময় করা হয়ে আসছে, সেটা হল কৃষকদের দীর্ঘ পদযাত্রা এবং মিছিল (Kisan marches and procession)। শ্রী ভুসকুটের অক্লান্ত পরিশ্রমে দুই-তিন শো মাইল সৈন্যদলের মত কুচকাওয়াজে পায়ে হেঁটে কৃষকদের জাঠা ঠিক সময়ে ফৈজপুরে পৌঁছে গেল। শ্রী রঙ্গা, শ্রী যাজ্ঞিক এবং অন্যান্যদের সাথে আমি তিন-চার মাইল এগিয়ে গিয়ে জাঠায় শামিল হলাম। আমাদের সাথে নারী ও পুরুষের একটি বিশেষ দল ওদের স্বাগত জানিয়ে আনতে পৌঁছল। সেখান থেকে হেঁটেই ফিরলাম সবাই। গিয়েওছিলাম হেঁটে। কংগ্রেস নগরের ঝান্ডা চকে বিশাল সভা হল। তাতে সভাপতি ছিলেন প্রফেসর রঙ্গা। আমরা সবাই সময় বুঝে সে অনুসারেই ভাষণ দিলাম। বিশাল ভীড় ছিল। রাষ্ট্রপতি পন্ডিত জহরলাল নেহরুও কিছুক্ষণের জন্য সেখানে এলেন এবং সভায় শামিল হলেন। দু-চার কথা বলে চলেও গেলেন।

লখনউএ আমরা চেষ্টা করে কৃষকদের জন্য কংগ্রেসের খোলা অধিবেশনের টিকিট বিনামূল্যে যোগাড় করেছিলাম। এখানে সেটা হতে পারল না। হাজার চেষ্টা করেও আমাদের হতাশ হতে হল। গ্রামাঞ্চলে এটা প্রথম কংগ্রেস ছিল। কৃষকদেরই শক্তিতে কংগ্রেসের শক্তি তৈরি হল এবং ভবিষ্যতে তার বৃদ্ধি হওয়ার ছিল। ফৈজপুরের পরই অবিলম্বে কৃষকদেরই ভোটে কংগ্রেসে জয়ী হওয়ার ছিল। কয়েকশো মাইল পায়ে হেঁটে কৃষকেরা এসেওছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা উপেক্ষিত হল। কংগ্রেস এবং তার অভ্যর্থনা সমিতির নেতাদের মনোবৃত্তি এই ঘটনায় দৃষ্টিগোচর হয়। গ্রামাঞ্চলের কংগ্রেস কাদের লাভের জন্য, সে প্রশ্নের সমাধান সেদিনই এই ঘটনায় হয়ে গেল।

(৮)

বিহারের কৃষক তদন্ত কমিটি

ফৈজপুরের পর এসেম্বলিগুলোর যে নির্বাচন হল তার কথায় আসার আগে, যেমন আগে বলেছি, বিহারের কৃষক তদন্ত কমিটির অবস্থা বলা জরুরি। কেননা ফৈজপুরের প্রোগ্রামের সাথে তার সম্বন্ধ আছে। আরো অনেক কথা আছে। আগেই বলেছি যে লখনউ কংগ্রেসের সময় আমাদের চেষ্টার ফলে তদন্তের প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। সেখানে আমরা ওয়র্কিং কমিটির কয়েকটি কথার ভালো বিরোধ করেছিলাম এবং খুব লড়েছিলাম আমরা। মনে আছে, বেশি ঠান্ডা ছিল বলে লাহোরে গরীব দর্শক ও প্রতিনিধিদের খুব কষ্ট হয়েছিল। তাই, গান্ধিজির চাপে সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে কংগ্রেস ফেব্রুয়ারি-মার্চেই, গরম পড়ার শুরুতেই হবে। প্রতিনিধি শুল্ক পাঁচ টাকার জায়গায় এক টাকাও তিনিই করলেন আর বললেন যে গরীবের কংগ্রেস। গরীব পাঁচ টাকা কোত্থেকে দেবে? কিন্তু লখনউয়ে আবার ডিসেম্বরে কংগ্রেস করার প্রস্তাব নেতারাই দিল! তাও গান্ধিজির মত নিয়েই! প্রতিনিধি শুল্কও পাঁচ টাকা করে দিল আর কংগ্রেসের নির্বাচিত মেম্বার এবং পদকর্তাদের খদ্দর পরাও জরুরি করা হল।

আমি বললাম, ঠিকই তো! গরীবদের সাথে কংগ্রেসের তো আর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আবার ডিসেম্বরে হওয়ার প্রস্তাব। এখন তো কাউন্সিলে গদিবাজি করিয়েদের জমানা আর ফেব্রুয়ারি মার্চে ওদের ফুরসৎ থাকে না! পাঁচ টাকাও ওরাই দিতে পারে। খদ্দর তো দামি, গরীবে পরতেই পারবে না! ফলে কংগ্রেস ধনী এবং মহাজনদের হাতে যাবে! তাও আবার গান্ধিজির মত নিয়ে! দরিদ্রনারায়ণের ভালো পুজারী বেরোলেন! কথাটা শুনে ডক্টর পট্টভিসিতারামৈয়া আস্তে করে আমায় বললেন যে আপনি ভয়ঙ্কর এক স্বামী “You are a terrible swami”!

যাহোক, লখনউএর পর পাটনায় বিহার কংগ্রেসের কার্যনির্বাহীর মিটিং হল এবং লখনউ কংগ্রেসের প্রস্তাবানুসারে কৃষকদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি তৈরি করার প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত হল। যখন প্রশ্ন উঠল যে কমিটিতে কে কে সদস্য হবে, স্বাভাবিকভাবে কৃষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমিই থাকতে পারতাম। কার্যনির্বাহীর সদস্য তো আমি ছিলামই। সেটা কোনো জরুরি শর্তও ছিল না। তখন রাজেন্দ্রবাবু বললেন, আপনি থাকলে হতে পারে যে কমিটির রিপোর্ট সর্বসম্মত হবে না (বাকি সবাই এ কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল)। আর আমরা চাই সর্বসম্মত হোক রিপোর্ট। যাতে তার দাম থাকে, ওজন থাকে। আরেকটা কথা। আপনি থাকলে জমিদারেরাও চেল্লাবে আর সরকারও চেল্লাবে যে এই রিপোর্ট তো কিসান সভার! তাই আপনি তদন্ত কমিটিতে না থাকলে ভালো হয়।

কিন্তু আমি এ যুক্তি বুঝতে পারলাম না। রিপোর্ট সর্বসম্মত হোক, এটা অদ্ভুত কথা! এমন তো কোথাও দেখিনি। বিহারের ‘কবালার’র অসুখ এখানেও কাজ করছে বোধহয়! কিন্তু একা আমার থাকার জন্য পুরো রিপোর্টটাকে কিসান সভার রিপোর্ট বলা হবে, এটা বিদঘুটে যুক্তি ছিল। আমি কি এতই বিপজ্জনক এবং প্রভাবশালী ছিলাম যে বিহার কংগ্রেসের আটজন বড় নেতা আমার প্রভাবে চলে আসত এবং নয়জন মেম্বারের লেখা রিপোর্ট কিসান সভার রিপোর্ট হয়ে যেত? তা সত্ত্বেও দেখলাম এই একটা ব্যাপারের ওপর প্রচুর জোর খাটান হচ্ছে। যদি না মানতাম তাহলে বোধহয় সব কাজই থেমে যেত।

কিন্তু এটাও অসহ্য ব্যাপার ছিল যে বিশেষ করে কৃষকদের বিষয়ে কংগ্রেস কমিটির রিপোর্ট ছেপে যাবে আর আমি জানতেও পারব না। কেমন করে হবে? কে জানে কী উল্টোপাল্টা লেখা হবে! কোনো গ্যারান্টি থাকবে? নিজের ভয়টা আমি বললাম। তাতে বলা হল যে রিপোর্ট লেখার আগে কমিটি আপনাকে সুযোগ দেবে যাতে তাদের সাথে আপনি সব প্রশ্নে তর্কবিতর্ক সেরে নেন। রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেও সেটা দেখার এবং তাতে সংশোধনের পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে আপনাকে। এ আশ্বাস পেয়ে আমি স্বীকার করে নিলাম এবং রাজেন্দ্রবাবুর সভাপতিত্বে নয়জন ভদ্রলোককে নিয়ে তদন্ত কমিটি তৈরি হল। কিন্তু পাটনা-গয়ার কেউ নিশ্চিত থাকুক, সে কথা ভেবে আমার সোশ্যালিস্ট বন্ধু শ্রী গঙ্গা শরণকেও ওই কমিটির একজন মেম্বার রাখা হল। এটাও তাজ্জব ব্যাপার ছিল যে একজন সোশ্যালিস্ট কিসান-সভাবাদী থাকা সত্ত্বেও এবার যে রিপোর্ট তৈরি হবে সেটাকে কিসান-সভার বলা হবে না।

সারা প্রদেশে ঘুরে ঘুরে কমিটি তদন্ত পুরো করল। পাটনায় তো আমিও বেশ কয়েক জায়গায় রইলাম। ওদের তদন্তের ব্যাপার খবরের কাগজও প্রকাশ করছিল। বেশ কয়েক জায়গায় কৃষকেরা যে বয়ান দিল যে বোন আর মেয়েদের বিক্রি করে জমিদারের খাজনা দিতে হয়েছে, সেটা খবরের কাগজেও ছেপেছিল। দ্বারভাঙায় তো এক মহিলা এতটাও বলল যে দ্বারভাঙা মহারাজের তহসিলদার আমাকে আর আমার শ্বশুরকে ডেকে খাজনা চাইল। না দিতে পারায় হুকুম করল যে এর কাপড় ছিনিয়ে নিয়ে একে ল্যাংটো কর আর শ্বশুরের পায়ের সঙ্গে এর পা বেঁধে দাও! পরে যারা মিনিস্টার হয়েছিল তাদের সামনেই এই বয়ান দেওয়া হয়েছিল! সারকথা এই যে জমিদারি অত্যাচারের আসল রূপ সামনে চলে এল। কৃষকদের দাবিও স্পষ্ট হয়ে উঠল।

পরে কমিটির সম্পাদক আমায় চিঠি লিখল যে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে। তার এক কপি আপনার কাছে যাবে। অবাক হলাম যে তৈরি হওয়ার আগে আমায় সুযোগ দেওয়া হল না কেন? তেমনই তো কথা হয়েছিল! ভাবলাম, তবুও বাঁচালে যে দ্বিতীয় সুযোগটা আসছে! কিন্তু আজ অব্দি সে রিপোর্টের দর্শন করতে পারলাম না। তাকিয়ে রয়ে গেলাম। শুনেছি যে রিপোর্ট লেখা হয়েছিল এবং তার কপি মেম্বারদের কাছে পাঠানোও হয়েছিল! কিন্তু আমি বঞ্চিত রয়ে গেলাম। তাগাদাও দিলাম। কিন্তু আজ অব্দি শুধু ছাপার কথাই চলছে, ছাপা আর হয় নি। তাই তো ফৈজপুরে আমি পরিষ্কার করে শুনিয়ে দিয়েছিলাম। ভিতরে ভিতরে ক্ষিপ্ত তো ছিলামই। আমার কথা শুনে দু’একজন রেগে কিছু বলতে গিয়েছিল। কিন্তু বলত কী? কংগ্রেসের প্রস্তাব, বিহারের কার্যনির্বাহীর প্রস্তাব এবং নিজেদের সংকল্পে জল ঢালা আর বার বার কথার খেলাপ করা লোকগুলোর মুখ ছিল কোথায় কিছু বলার? যদি ফৈজপুর কংগ্রেসের প্রস্তাবের পরেও সেই রিপোর্ট ছাপা হত তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তাও করতে পারল না। এভাবে লাগাতার দুটো কংগ্রেসের প্রস্তাব নির্মমভাবে পায়ের নিচে পিষল। তারপরেও অন্যান্যদের বিদ্রোহী কংগ্রেসি বলার সাহস করে।

ব্যাপারটা হল যে ওরা ১৯৩১ সালেও তো একবার তদন্ত করেছিল। কিন্তু রিপোর্ট ছাপল না। কেন? বলা হল যে সত্যাগ্রহ শুরু হয়ে গিয়েছিল আর রিপোর্ট ছাপার সুযোগই পাওয়া যায়নি। কেননা মাঝপথেই পুলিস সব কাগজপত্র উঠিয়ে নিয়ে গেল আর ফেরত পাওয়া যায় নি। আর যখন দ্বিতীয়বার, কংগ্রেসের প্রস্তাব অনুসারে তদন্ত হল তখন? তখন তো পুলিসের বাহানা ছিল না। তাহলে কী ব্যাপার ছিল? ব্যাপারটা খুব বড়, ছিল এবং আছে। বিহারের কংগ্রেসি লিডাররা জমিদার এবং জমিদারের পাকা লোক। এক এক জনের বিষয়ে গুনে গুনে বলা যেতে পারে। আর ওরা রিপোর্টে লিখতই বা কী? জমিদারি প্রথা আছে বলে জমিদারেরা এত পাপ আর অত্যাচার করেছে কৃষকদের ওপর, এবং এখনও করে যে মানুষের বুক কেঁপে ওঠে, মনুষ্যতা আশ্রয় খোঁজে। যদি সেসব কথা লেখা হত তাহলে নিজেদের, মিজেদের আত্মীয়স্বজনদের এবং বন্ধুদেরই ফ্যাসাদে ফেলতে হত। ফলে নিজেরই মুখে কালি লেপতে হত। আর যদি সেসব কথা না লিখত তাহলে কৃষকদের মধ্যে আর বাইরের দুনিয়ায় মুখ দেখান অসম্ভব হয়ে যেত। এসেম্বলি নির্বাচনে কৃষকেরা কংগ্রেসকে ভোটও দিত না। তখন মন্ত্রিমন্ডল কিভাবে তৈরি হত? এটাই ছিল দু’তরফা বিপদ যেটা ওদের হাঁড়ি ভেঙে দিল হাটে।

আরেকটা ব্যাপার ছিল। অবশ্য কংগ্রেস কোন সিদ্ধান্ত নেয় নি। তবুও ভিতরে ভিতরে মন্ত্রিমন্ডল গঠনের সব প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছিল। এমত অবস্থায় যদি সেই রিপোর্টে স্পষ্ট সুপারিশ থাকত যে কৃষকদের জন্য কী কী করা উচিৎ তাহলে ওরা বাঁধা পড়ে যেত। কেননা শুধু ছোটমোটো সুপারিশগুলো রাখলে কৃষকেরা রিপোর্টটা উঠিয়ে লিডারদের মুখের ওপরই নির্মমভাবে ছুঁড়ে মারত। আর যদি কৃষকদের ইচ্ছে মত সুপারিশ রাখত তাহলে কৃষক তো খুশি হত এবং ভোটও দিত। কিন্তু আগে থেকেই ভাবী মন্ত্রীদের হাত বাঁধা পড়ে যেত। তারপর তো সব সুপারিশ পুরো না করতে পারলে বাঁচোয়া হত না।

কিন্তু সে দশায় ‘কৃষক-জমিদার’ সমঝোতার নামে জমিদারদের সঙ্গে এই নেতাদের গোষ্ঠিতন্ত্র আর জোট কিকরে চলত? তাই ভাবা হল, কিচ্ছু লিখ না। সবকিছু ভাসা ভাসা রাখ। নির্বাচনের ঘোষণায় রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে লেখা হয়েছিল বলে ইস্তফা দেওয়ার পালা চলে এল। কৃষকদের কথা বললে তো প্রলয় শুরু হয়ে যেত। কৃষকদের থেকে তো ভোট নেওয়ার ছিল। সেটা তো নির্বাচনের আগে তদন্ত করে হয়েই গেল। এখন আবার রিপোর্ট ছেপে কেউ বোকামি করবে কেন?

(৯)

এসেম্বলিগুলোর নির্বাচন

১৯৩৭ সালের শুরুতেই নতুন বিধান অনুসারে প্রাদেশিক এসেম্বলিগুলোর নির্বাচন হল। বিহারে প্রাদেশিক কংগ্রেসের কার্যনির্বাহীর জিম্মায় ছিল কংগ্রেসি প্রার্থীদের নাম বাছার কাজ। আমিও তার সদস্য ছিলাম। ফলে, প্রার্থীদের নাম চয়ন এবং নির্বাচনে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার হল সেটা উল্লেখযোগ্য। অনেক আগে থেকে কথা হত এবং কখনো কখনো গান্ধিবাদি লোকেদের মধ্যে কেউ কেউ যারা প্রদেশের সব খবরাখবর রাখত, এখনো রাখে, আমায় বলেছিল যে আপনার তো মিনিস্টার হওয়া উচিৎ এবং কৃষি প্রভৃতির দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ। কেননা কৃষকদের কথা তো আপনিই বোঝেন।

আরেকটা কথা। পাটনার বিহটা এলাকায় এতদিন যে ভদ্রলোক জিতে আসছিলেন তাঁকে এবং গয়ার শ্রী রামেশ্বর প্রসাদ সিংকে হারানও জরুরি ছিল। কিন্তু কারোর হিম্মত ছিল না ওখানে দাঁড়াবার। বড় বড় লিডাররা আজ যত ইচ্ছে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কথা বলে নিক। কিন্তু সবার বুক কাঁপত। তাই ইঙ্গিতও দেওয়া হত যে অন্ততঃ এক জায়গায় আমিই দাঁড়িয়ে যাই। কিন্তু আমার উত্তর সব সময় একটাই হত যে আমি সে ধরণের কাজের জন্য সব দিক থেকে অযোগ্য। আমার জনতার মধ্যে কাজ করা উচিৎ।

তবুও আমি সন্ত্রস্ত থাকতাম। এমন না হয় যে হঠাত চাপ পড়ে এবং আমার ভিতরে দুর্বলতা ঢুকে পড়ে। সেটা ভালো হবে না। তাই যখন ভোটারদের লিস্ট তৈরি হচ্ছিল তখনই উদ্যোগ নিয়ে নিজের নাম ওই লিস্টে আসতে দিই নি। যদিও সঙ্গীরা জিদ করছিল। আমার অভিমত এই যে আমার নাম যেন ভোটার লিস্টে কখনো না আসে। তবুও, লোকেরা অবাক হবে শুনে যে কংগ্রেসি মন্ত্রিদের জমানায় যখন আমার সাথে প্রাদেশিক কংগ্রেসের লিডারদের দ্বন্দ্ব চলছিল তখন সত্য আর অহিংসার পুজারিরা চম্পারণ, সারন এবং অন্যান্য জেলায় এতদূর প্রচার চালিয়েছিল যে আমি তো মিনিস্টার হতে চাইছিলাম আর যখন হতে পারলাম না, কংগ্রেসের শত্রু হয়ে গেলাম।

হ্যাঁ, প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী যখন কংগ্রেসের প্রার্থী বাছতে লাগল আমি অদ্ভুত তামাশা দেখলাম! বুঝতেই পারলাম না কোন নীতিতে প্রার্থীরা নামাঙ্কিত হচ্ছে। কোথাও জেলে যাওয়া, বরবাদ হওয়া খাঁটি কংগ্রেসিদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে আর কক্ষনো জেলে না যাওয়া, কাল অব্দি খদ্দরটুকুও না পরা বড় জমিদার এবং তার বন্ধুদের নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন লোকও নেওয়া হচ্ছে যে নিজের অত্যাচারের জন্য কৃষকদের মাঝে কুখ্যাত। যে কক্ষনো খদ্দর পরেনি, গভর্ণরের অভ্যর্থনায় এবং দরবারে শুধু শামিল নয় আগ বাড়িয়ে থেকেছে, বড় বড় নেতারা যেমন করে হোক তার নাম ঢোকানোর জন্য আদাজল খেয়ে লাগছে। এমন গোষ্ঠিতন্ত্র দাঁড় করানো হচ্ছে যাতে এমন লোকেদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো প্রার্থীই না পাওয়া যায়, আর সবাই বাধ্য হয় তাদেরকেই নিতে। দায়িত্ব নিয়ে অনেকে আমায় বলল যে ‘লালা’র বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াবে না। ‘লালা’ এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক যিনি প্রায় একটা মহাভারতের পরেও কংগ্রেস প্রার্থী হতে পারলেন না। কোথাও জাত-পাতের কথা চলছিল, কোথাও প্রিয়পাত্র এবং আত্মীয়স্বজনের।

মতলববাজির এমন খেলা কখনো দেখি নি। তাই স্তম্ভিত ছিলাম। বার বার মনে চিন্তা আসত এরাই দেশকে স্বাধীন করবে? একেই জাতীয়তা বলে? আসলে সাম্প্রদায়িকতা (Communalism) এবং জাতীয়তা (Nationalism), দুটোর মধ্যে তফাৎ খুব কম, একটা অবস্থায় গিয়ে সেটুকুও গায়েব হয়ে যায়।

আমার সামনে তো তিনটে মাপকাঠি ছিল। আমার কাছে সবচেয়ে ভাল ছিল সে যে তিনটেতেই উতরোবে। নইলে দুটোয় এবং শেষমেশ একটাতেও। প্রথমত, প্রার্থী যেন কংগ্রেস এবং দেশের জন্য জেল, জরিমানার সাজা ভালোরকম ভুগে থাকে, দ্বিতীয়ত, যেন গরীব হয় বা গরীবের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়, তৃতীয়ত, যেন কিসান-সভাবাদি হয়। তিনটে গুণ না পেলে কিসান-সভাবাদি হওয়ার মাপকাঠি ছেড়ে দিতাম আর দুটো না পেলে গরীব হওয়ারটাও ছাড়তাম। কিন্তু যে দেশের জন্য কিছু ভোগেই নি, কোনো সর্বনাশ দেখেনি নিজের জীবনে তাকে তো দেখতে পারতাম না। কিন্তু সমস্যা এটাই যে আমি একাই ছিলাম এই নীতিতে। ফলে বার বার তেতো গিলতে হচ্ছিল। ভাবতাম কংগ্রেসের সম্মান জড়িয়ে আছে। বিরোধ করে যদি এই ঝগড়া থেকে নিজেকে আলাদা করে নিই তাহলে সমস্যা হতে পারে। তাই সহ্য করতে থাকলাম। কিন্তু যখন ব্যাপারটা বাড়তে বাড়তে সহ্যের শেষ সীমা অতিক্রম করল আমি স্পষ্ট বলে দিলাম আর চলবে না। অবস্থা খারাপের দিকে যাবে। “I have reached here the breaking point”। তা সত্ত্বেও বন্ধুরা কথাটা বুঝল না। তখন কার্যনির্বাহী থেকে ইস্তফা দিয়ে আমি আলাদা হয়ে গেলাম। পরিষ্কার লিখে দিলাম, এর অর্থ এই নয় যে আমি কংগ্রেসের বিরোধ করব বা সাহায্য করব না। বিরোধের তো কথাই ওঠে না। সাহায্যও করব। কিন্তু এই প্রার্থীদের নাম চয়নের দায়িত্ব নিতে পারব না আর যেখানে যেখানে মনে হবে সাহায্য করা উচিৎ সেখানেই করব। ইস্তফা দিয়ে উৎকল চলে গেলাম। পুরীতে উৎকল প্রাদেশিক কিসান সম্মেলনের সভাপতিত্ব করার ছিল।

সেখান থেকে ফিরে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের সাত পৃষ্ঠার চিঠি পেলাম। তাতে প্রার্থীদের নামাঙ্কনগুলো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করার চেষ্টার সাথে সাথে আমাকে ইস্তফা ফেরত নিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। অনেক আগে কখনো আমি ওনাকে বলেছিলাম, এ বছর আপনি প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি হলে আশা করি আমরাও ন্যায় পাব এবং কংগ্রেসেরও জয় হবে। সে কথাটারই উল্লেখ করে উনি লিখলেন, আপনার বলাতেই আমি সভাপতি হলাম আর আপনি মাঝপথে আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দিলেন! আমি অসুস্থ। ভাবুন আমার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে! এই ইস্তফার খারাপ প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে জানতে পারলাম যে যেদিন আমি ইস্তফা দিয়েছিলাম সেদিন সারারাত উনি ঘুমোন নি। কাজেই জবাবে আমি লিখলাম, আপনার যুক্তিটুক্তির কোনো প্রভাব পড়েনি আমার ওপর। কিন্তু যদি আপনি ভাবেন যে আমার ইস্তফা কংগ্রেসের সফলতাকে প্রভাবিত করবে তাহলে নিন, আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। এই লিখে ইস্তফা ফেরত নিয়ে নিলাম।

তারপর সব শক্তি লাগিয়ে দিলাম নির্বাচনে। যে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামে নামিয়েছিলাম এবং ওই জমিদারদের শত্রু করে তুলেছিলাম কৃষকদের, সেই জমিদারদের ভোট দেওয়ানোর জন্য যখন নিজেই গেলাম ওই কৃষকদের মাঝে (কেননা, নইলে হেরে যাচ্ছিল ওরা), তখন এক ধাঁধার সম্মুখীন হলাম। বিরোধিদের প্ররোচনায়ও এবং স্বাভাবিকতায়, কৃষকেরা আমায় প্রশ্ন করল, এই জল্লাদকে ভোট দেব? আপনি বলছেন? ভুলে গেলেন একে? জমিদারদের সামনেই করল প্রশ্নগুলো। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ওদের রাজি করলাম। বললাম, আপনাদের প্রশ্ন যথার্থ। কিসান-সভার সমঝদারিও তাই। কিন্তু এখানে তো কংগ্রেসের ব্যাপার আর কংগ্রেস বড়। ওরা আমার কথা মানল। বলল আপনার আদেশ শিরোধার্য।

আজ ভাবি আমি ঠিক করেছিলাম না ওদের ধোঁকা দিয়েছিলাম। কেননা সেই জমিদারগুলো তো আজ কয়েকগুণ বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে আর ওই কৃষকেরা কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে আসে। কিন্তু সত্য এই যে সেদিনের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি ছিল। কোনো না কোনো এক দিন পরিস্থিতিটা আসতই। ভালো হল যে আগেই এল। এটা ধ্রুব সত্য যে আর ওই পরিস্থিতি তৈরি হবে না। তবুও, এটুকু ভুল তো আমাদের ছিলই যে আমরা কিসান-সভা থেকে অন্ততঃ হাতে গোনাও কয়েকজন প্রার্থী দাঁড় করাই নি।

কংগ্রেসের মন্ত্রিমন্ডল তৈরি হওয়ার আগের কিছু কথা এখানে বলা জরুরি। সেগুলো এই নির্বাচনসংক্রান্তই। ওই সময়ের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কিত কিছু জরুরি কথা এতে থাকছে না। সেগুলো পরে বলা যাবে। নির্বাচনে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। দু’একজন ছাড়া বাকি সব প্রার্থী জয়লাভ করল। গয়ার রামেশ্বরবাবু খুব হুঙ্কার ছাড়তেন। আমরা একজন মাঝারি স্তরের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাঁকে বিচ্ছিরি ভাবে হারালাম; হালত খারাপ করে দিলাম তাঁর। শেষ অব্দি তাঁকে বলতে হল, কিসান-সভা সব ডুবিয়ে দিল। নইলে দেখতাম কংগ্রেস কিকরে জেতে। বিহটার এলাকায় শ্রী রজনধারী সিং এমনভাবে হারলেন যে আর হুঁশ রইল না। ভাগ্য ভালো যে জামানত বেঁচে গেল। যদিও, অনার অতিমাত্রায় বিশ্বাস ছিল যে উনি এমনি জিতে যাবেন। যাদের ওপর পুরোপুরি ভরসা করেছিলেন তারাও ওনার বিরোধী হয়ে গেল। ওই নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতা হল যে যারা পয়সার লোভে ওনার তরফ থেকে ছাপ্পা (bogus) ভোট দিতে গিয়েছিল তাদের মধ্যে থেকেও চার ভাগের তিন ভাগ কংগ্রেসি প্রার্থী শ্রী শ্যামনন্দন সিংকেই ভোট দিল। যে ধরা পড়ত সেই হাত জোড় করে বলত, আমরা গরীব মানুষ, পয়সার জন্য আসি। যেতে দিন আর খেতে দিন। আটকাবেন না। সেই নির্বাচনেই এ গানটাও খুব চলল, “কিন্তু কুঠুরিতে গিয়ে বদলে যাব”। অর্থ এই যে চাপে পড়ে যদি বিরোধির তরফ থেকেই যেতে হয়, সেই খাওয়ায়, দাওয়ায় আর গাড়ি চড়ায় তাহলে কবুল করে নাও। কিন্তু ভোট দেওয়ার কুঠরিতে গিয়ে কংগ্রেসকেই ভোট দিও। প্রচুর প্রভাব পড়ল এই গানটার। সে সময় থেকেই এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে আছে।

গয়ার জাহানাবাদ এলাকা থেকে খুব ঝামেলা করে আমাদের পুরোনো কিসান-সভাবাদি ডঃ যুগলকিশোরের নাম দেওয়ানো গিয়েছিল। কংগ্রেসের লিডারেরা তো জনান্তিকে এ কথাও বলল যে জিদ করে ডঃ যুগলকিশোরের নাম তো দেওয়ালো, কিন্তু উনি হারবেন নিশ্চিত আর কংগ্রেস একটা সিট খোয়াবে! ফলাফল দেখে ওদের চোখ খুলল কিনা কে জানে। জাহানাবাদ এলাকায় তো কিসান-সভার কুকুরও জিততে পারত। অথচ আমাদের বন্ধুদের মগজটাই অনন্য! অন্যান্য সব জায়গায় হাজার হাজার টাকা কংগ্রেসের নির্বাচন তহবিল থেকে খর্চা করা হল। জাহানাবাদকে এক পয়সা দেওয়া হল না। এটা দ্বিতীয় অত্যাচার। কিন্তু কৃষকেরা জেতালো আর খুব ভালো ভাবে জেতালো।

(৯)

মসরখ কনফারেন্স এবং কংগ্রেসি মন্ত্রিমন্ডল

নির্বাচন শেষ হতেই সারন (রাজেন্দ্রবাবুর) জেলার মসরখে প্রাদেশিক রাজনৈতিক সম্মেলন হল। তাতে একটি প্রস্তাব ছিল, দাম দিয়ে জমিদারি শেষ করা হোক। তার ওপর যে সংশোধনী ছিল কিসান-সভার লোকেদের যে দাম না দিয়েই জমিদারি শেষ করা হোক, সেটাই পাশ হল। মূল প্রস্তাব পড়ে গেল। অদ্ভুত উদ্দীপনা ছিল। উপস্থিত জনতা আমার ভাষণ শোনার জন্য উদগ্রীব ছিল। কয়েকজন জমিদার পুরোনো পুঁথি দেখিয়ে জমিদারি প্রমাণ করতে চাইল। আমি মুখের মত জবাব দিলাম। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় নেতারা সেই প্রস্তাবটাকে কার্যতঃ বাতিল করল। মন্ত্রী হওয়ার আগে ভাবী মন্ত্রীরা কৃষকদের সভায় এবং কনফারেন্সে যেতেন, জমিদারি উন্মুলনের প্রস্তাব পাশ করাতেন। যদিও সবাই জানে যে মন থেকে তারা চাইতেন না। কিন্তু কৃষকদের ওপর মোহিনী মায়া ছড়াবার ভালো রাস্তা ছিল এটা। যেই মন্ত্রী হলেন, ব্যস, জমিদারদের সঙ্গে চুক্তির পর চুক্তি হওয়া শুরু করল। এমন মতলববাজি! এমন নাট্যলীলা!

নির্বাচনের পর মাত্র কিছুদিনের জন্য দ্বিতীয় মন্ত্রীমন্ডল তৈরি হতে পেরেছিল। কেননা আমাদের বন্ধুদের সামনে কিছু বাধা ছিল। পরে সেসব সরে গেল এবং কংগ্রেসি লোকেরা এসে গদিতে বিরাজমান হলেন। আগে কংগ্রেসের কোনো সিদ্ধান্ত হয় নি। তাই ১৯৪৭ সালের মার্চে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির মিটিং হল। সেখানেই সিদ্ধান্ত হল যে কংগ্রেসিরা মন্ত্রীর পদ স্বীকার করতে পারে। সে বৈঠকে মন্ত্রীপদ গ্রহণ করার স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলো দেওয়া হত সেসব শুনে হাসি পেত। খদ্দরের বহুল প্রচার হবে। সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উড়বে। যেন এসবই রাজনীতি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের অর্থ। লেকচারবাজিও হল – “আইন ইত্যাদি তৈরি করে কৃষক এবং শ্রমিকদের আরামের ব্যবস্থা করব। ওরা ক্লান্ত। বিচলিত। ওদের কিছু ত্রাণ দেওয়া জরুরি। আমরাই এ কাজ ভালো করে করতে পারি।” আসলে ক্লান্ত তো হয়েছিলেন লিডাররা এবং তাদের বন্ধুবর্গ। কিন্তু কৃষকদের কাঁধে চড়ে পার হচ্ছিলেন। সেটাই সহজ অজুহাত!

কিন্তু হল কী? উড়ল? সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা? গভর্নরের বাড়ি, সেক্রেটারিয়েট, অ্যাসেম্বলি ভবন এবং কাছারিগুলোয় দেখাও গেল পতাকা? অন্যান্য জায়গায় তো উড়ল, বিশেষ করে যুক্ত প্রদেশে তো কলেজগুলোতেও উড়ল। বিহারে তাও হল না। কাছারি প্রভৃতির তো কথাই নেই। প্রাইভেট স্কুলগুলোরও কথা ছেড়ে দিন। কোথাও কোথাও অবশ্য উড়ল, পরে ঠান্ডা হয়ে গেল সব। বলা হল, ম্যানেজিং কমিটি যদি চায় তেরঙা ওঠাতে পারে। তাহলে কংগ্রেসি মন্ত্রীমন্ডলের করারটা ছিল কী? দিল্লিতে তো ভাবী মন্ত্রীরাই এ দায়িত্ব নিয়েছিল। এখন ম্যানেজিং কমিটির ঘাড়ে ফেলে দেওয়া হল। তাও যদি ছেলেদের মধ্যে ভিন্ন মত না থাকে তবে! সারকথা, জাতীয় পতাকার যতটা অসম্মান কংগ্রেসি মন্ত্রীদের সময় হল, ততটা আর কখনো হয় নি। যে পতাকার গৌরবে দেশ আগে বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছিল, সে পতাকা জ্বালানো হল, পায়ের নিচে পেষা হল! কোথাও কোথাও তো, যখন অন্য কেউ তৈরি হল না, আমাদের নেতারা নিজের হাতে স্কুল থেকে এই পতাকা নামাল। ইতি, পতাকা প্রসঙ্গ।

রইল কৃষক ও শ্রমিকদের প্রসঙ্গ। শ্রমিকেরা কী পেল সেটা তো বলেই দেয় বোম্বাই আর কানপুরে গুলি চালনা আর টিয়ার গ্যাসের প্রয়োগ। ওদের হড়তাল ভাঙতে অসফল করতে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করা হল বোম্বাইয়ে। আইনও এমন তৈরি হল যে শ্রমিকদের খোলাখুলি সে আইনের বিরোধ করতে হল। আর যখন ওরা বিরোধ জানাতে হড়তাল করল তখন কংগ্রেসি সরকার এবং কংগ্রেস সমস্ত শক্তি লাগাল সে হড়তাল ভাঙতে। তা সত্ত্বেও সফল হল হড়তাল! জামশেদপুর, ঝরিয়া, ডেহরি, বিহটা প্রভৃতি জায়গায় মিলের শ্রমিকেরা কি বিহারের মন্ত্রীমন্ডলকে কখনো ভুলবে?

কৃষকদের সেবার কথা নিয়ে কিছু না বলাই ভাল। মন্ত্রীমন্ডলের প্রশংসায় তো অনেক পঞ্চমুখ হওয়া গেল, এই করেছে, সেই করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে ইংরেজিতে দুটো চটি বই লিখে আমি সব পর্দা ফাঁশ করে দিয়েছি। তার হিন্দি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। বইদুটোর নাম (1) ‘The other side of the shield’, (2) ‘Rent reduction in Bihar: How it works’। দুটো বইয়ের একটারও মধ্যে থেকে কোনো একটা কথার উত্তর এখনো অব্দি না মন্ত্রীরা দিতে পেরেছে না ওদের পৃষ্ঠপোষকেরা।

ইতিমধ্যে জমিদারদের সঙ্গে দুই দুই বার জোট বেঁধে কৃষকদের গলায় যে ভোঁতা ছুরি চালানো হয়েছে সে কথা কে না জানে। খাড়া ফসল বাজেয়াপ্ত করার অধিকারটা আইনের মাধ্যমে সহজ করে কৃষকদের যে লাভটা দেওয়া হয়েছে সে লাভের কথা ওরা জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলবে না। খাজনা কম করা নিয়ে যে ঝামেলা হল, আর সব মিলিয়ে কৃষকের ঝুলিতে যে এল শূন্য, সেটা কখনো ওরা ভূলবে না। দু’একটা আইন যা কৃষকদের হিতার্থে তৈরি হল, তার ভাষা এমন করা হল যে জমিদারেরা সেসব আইন ব্যর্থ করে দিল। ভাগচাষের জমির নগদ অংশের লেনদেন সহজ করা হল। কিন্তু হাজার বার চ্যাঁচামেচি করেও ফসল কাটার মজুরি এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধান না হওয়ায় কৃষকদের লাভ তো হলই না, উল্টে ক্ষতি হয়ে গেল।

এসব প্রসঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাস আছে যা বিহার প্রাদেশিক কিসান-সভার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সংক্ষেপে এই সমস্ত এবং আরো কিছু অন্য প্রসঙ্গ উপরে উল্লিখিত চটিবই দুটোতে লেখা হয়েছে।

লোকেরা বলে আমি নাকি প্রথম থেকেই স্থির করে নিয়েছিলাম মন্ত্রীদের বিরোধ করব এবং তাদের দুর্নাম রটাব। কিন্তু আমি কী চাইছিলাম তার অকাট্য প্রমাণ তো এটাই যে মন্ত্রীমন্ডল গঠনের পরে পরেই আমি বিশ্রাম করতে পাঞ্জাব হয়ে কাশ্মীর চলে গেলাম। ভরসার সাথে সঙ্গীদের বলে গেলাম, ফৈজপুরের প্রোগ্রাম এবং কংগ্রেসের নির্বাচন ঘোষণা দুটোই তো হল। ওরা এসবের বাস্তবায়ন করবেই। আপনারা পরামর্শ দিতে থাকবেন। আপাততঃ আমার তো আর কাজ নেই? একটু বিশ্রাম করে আসি।

শুধু তাই নয়। ওখান থেকে এসে দুবার প্রিমিয়ারের সঙ্গে দেখা করলাম এবং স্পষ্ট বললাম, এক-দুই বছর বা একটা নির্দিষ্ট সময়-সীমায় একের পর যা কিছু করতে চান আমায় পরিষ্কার করে বলে দিন। যাতে আমি কৃষকদের বুঝিয়ে দিতে পারি কবে কী হবে। কেননা কৃষকেরা চিন্তিত হয়ে আছে। যেহেতু আমাদের কাছেও কোনো খবর নেই, ওদের কী বলে বোঝাব? অথচ কোনো উত্তর পেলেন না। তাহলে করতাম কী? আমার তো আর ওনার সাথে ডোবার কথা ছিল না! আমার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা সত্ত্বেও কতটা ঠান্ডা মাথায় কাজ করেছি লোকে জানে। মিছিমিছি দুর্নাম রটাবার কাজ তো কয়েকজন লোক নিয়েই রেখেছে।

আমি দিল্লী হয়ে পাঞ্জাব গেলাম। সেখানে লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডিতে সভা করে শ্রীনগর চলে গেলাম। এক মাস পরেই বেশকিছু কারণে ওখান থেকে ফিরে আসতে হল। কাশ্মীর যাত্রাপ্রসঙ্গ চিত্তাকর্ষক তাই পরে লিখব। ফেরার পর জানলাম, মন্ত্রীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমার সঙ্গীরা ২৩শে আগস্ট ১৯৩৭শে পঞ্চাশ হাজার কৃষকদের একটা ভালো প্রদর্শন সংগঠিত করেছে এক্কেবারে খাস পাটনার ময়দানে। কৃষকদের নিয়ে এসেম্বলি ভবন অব্দিও গেছে! কিন্তু তার ফল কিছু হয় নি। একটু বেরিয়ে এগিয়ে এসে মন্ত্রীরা কৃষকদের সঙ্গে যে দেখা করবে সেটুকুও করেনি, ওদের আশ্বাসও দেয় নি! উল্টে বদনাম করেছে! এই সব প্রদর্শনেরও সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরের পৃষ্ঠাগুলোয় থাকবে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষোভ অনিবার্য ছিল।

এরি মধ্যে ২৪শে আগস্ট ১৯৩৭শে কাশ্মীর থেকে ফিরে এলাম। দেখলাম কিছু হয়ও নি আর লক্ষণও ভালো নয়। তাই রাগ হল অবশ্যই। চিন্তায় পড়লাম, পুরো কর্মসূচিটাই জলে যাবে না তো? কেননা মন্ত্রীদের তো ভালো করেই জানতাম। জমিদারদের সাথে তাদের যোগসাজশ আগে থেকেই ছিল। এদিকে আরো বেড়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৩৭ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরে যখন অল ইন্ডিয়া কিসান দিবস উদযাপন করা হল, সে সময় গয়ার কৃষকদের একটি বিরাট বড় সমাবেশে আমি তীক্ষ্ণ ভাষায় কথা শোনালাম এবং পরিষ্কার বলে দিলাম যে আমরা এত সহজে হাল ছাড়ব না। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে ফল খারাপ হবে। এ কথায় আমার মন্ত্রী বন্ধু এবং তাদের পার্শ্বচরদের খুব খারাপ লাগল যে খোলাখুলি তাদের বিরুদ্ধে বলা হল। কিন্তু আমি করতাম? আমার তো উপায় ছিল না।

যাহোক, তারপর সঙ্গীদের পরামর্শে এবং আগ্রহে মন্ত্রীদের সাথে কথা হল। আমি ওদের পরিষ্কার বললাম যে সাধারণতঃ আমি সরকারি লোকেদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করি না। তাই আজ অব্দি দেখা করিনি। তবুও যখন প্রয়োজন হবে এবং আপনারা চাইবেন, আমি আসব। এটাই আমার স্বভাব তাই নিরুপায়। ওঁরা প্রশ্ন করলেন, আমরা সরকারি লোক? আমি বললাম, অবশ্যই!

যাহোক, কথা হল এবং আমি বললাম যা কিছু জিজ্ঞেস করার আমার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করে নিন। এটাও স্থির হল যে প্রজাসত্ব আইনে সংশোধন সম্পর্কিত বিল আগে আমায় দেখিয়ে কথা বলে তারপর প্রকাশিত করলে অসুবিধে কম হবে। নইলে খোলাখুলি বিরোধ করতে হবে। কিন্তু কী করা হল? উল্টে সংশোধনে খাজনা আদায়ের মামলাগুলো দেওয়ানি আদালত থেকে সরিয়ে রাজস্ব-বিভাগের আধিকারিকদের দায়িত্বে দেওয়ার চেষ্টা করা হল। বিল তৈরিও হয়ে গেল! শেষে অনেক কষ্টে সেটা আটকান গেল!

পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি শ্রীকৃষ্ণ বল্লভ সহায় নিজের যুক্তি পেশ করার সময় বললেন, রাজস্ব বিভাগ তো আমাদের অধীনে থাকবে! তাই অফিসারদের দিয়ে যা চাইব তাই করিয়ে নেব! কিন্তু আদালত তো স্বাধীন! আমি উত্তর দিলাম, স্বরাজ্য কি পেয়ে গেছেন? চিরকাল গদীতে বসেই থাকবেন? স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আর কোন প্রশ্ন নেই? আর যদি আপনি গদীতে থাকেন তাহলে কী হবে? একটু ভাবুন। তখন চুপ করে রইলেন। কিন্তু ওনার কথায় এটাও জানা গেল যে এরপর আবার সংগ্রাম শুরু করার চিন্তাভাবনা ওরা ছেড়েই দিয়েছে।

আরেকটি উল্লেখনীয় ঘটনা হয়ে গেল এবং তাতে আমি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি আন্দাজ করে নিলাম। যখন দু’একবার পাটনায় লক্ষ লক্ষ কৃষকদের অংশগ্রহণে বড় বড় প্রদর্শন হয়ে গেল, পরে দেখা হলে প্রাইম মিনিস্টার আমায় বললেন, স্বামীজি, এই হাঙ্গামার (Mob) প্রতি সতর্কতা বজায় রাখুন। আমি চুপ করে শুনতে থাকলাম। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম একদিন এই কৃষক জনগণকে মাস (Mass) বলত এই লোকগুলোই। আজ সেটাই মব (Mob) হয়ে গেল! এই কৃষক জনগণ আগেও মবই ছিল। মাঝে প্রয়োজনবশত মাস হয়েছিল। আবার সেই মব-এর মবই রয়ে গেল। কেননা এখন আর এদের প্রয়োজন বোধহয় এই নেতাদের নেই, এবং যাদের প্রয়োজন নেই তাদেরকে এই নামেই কায়েমী স্বার্থের লোকেরা চিরকাল চিহ্নিত করে এসেছে। সরকারও এদেরকে মব বলে সব সময় আর এখন আমাদের মন্ত্রীরাও সরকার হয়েছে! সে কারণেও বোধহয় এই মব শব্দটা মুখে চলে এসেছে! কিন্তু, কিমাশ্চর্যমতঃ পরম।

প্রজাস্বত্ব আইনে যে প্রথম সংশোধন আনা হল এবং তার যে বিল পেশ হল সেটা মঞ্জুরির জন্য কংগ্রেস পার্টির কাছে এলই না! বিচিত্র ব্যাপার! এর প্রতিবাদে আমি শ্রী যমুনাকার্যী এমএলএকে দিয়ে অ্যাসেম্বলির দুই-তৃতীয়াংশ (৬৯) সদস্যের স্বাক্ষর সম্বলিত আর্জি করালাম যে ওই সংশোধনী বিল পার্টিতে পেশ করা হোক। কিন্তু কোনো ফল হল না। সে আর্জিতে এই সদস্যেরাই ফৈজপুর প্রোগ্রাম এবং কংগ্রেসের নির্বাচন ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে কৃষকদের দাবি সূচিবদ্ধ করে অনুরোধ জানাল যে সেগুলো পুরো করা হোক। কিন্তু কে শোনে?

ঋণ সম্পর্কিত যে আইন তৈরি হল সেটা কৃষকদের জন্য ছিলই না। তাতে দলিলভিত্তিক ঋণ এবং দলিলবিহীন ঋণে সুদের দর ক্রমশঃ ৯ এবং ১২ প্রতিশত রাখা হয়েছিল। কংগ্রেস পার্টি সেটাকে ৬ এবং ৭ প্রতিশত করল। তবুও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই যে জায়গায় ছিল সেখানেই নিয়ে যাওয়া হল দরগুলো। এই আইনটা এত বিচ্ছিরি তৈরি করা হয়েছিল যে দুই-দুই বার হাইকোর্টকে বলতে হল যে আইনটার আবশ্যক ধারাগুলোই বেআইনি। তৃতীয়বার কোর্ট এমন মন্তব্য করল যে লজ্জা হয়।

এরা (মন্ত্রী এবং তাদের সঙ্গীরা) ফৈজপুর প্রোগ্রাম তো ভুলেই গেল। কত কথা ওদের মনে পড়াতে হল। তা সত্ত্বেও, ‘এমন লেখা আছে?’ গোছের মন্তব্য করেও – অদ্ভুত ব্যাপার যে – পরোয়াই করল না। শেষে বাধ্য হয়ে, প্রজাস্বত্ব আইনে সংশোধনের সময় দুই-তিন বার কংগ্রেস পার্টির কিসান-সভাবাদী সাত-আটজন সদস্য, কিসান কাউন্সিলের অভিমতে, পার্টির নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে ভাষণ দিল এবং পার্টির পক্ষে ভোট দিল না! কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কিছু করার হিম্মত ওরা জোটাতে পারল না! 

(১১)

কাশ্মীর সফর

কাশ্মীর সফরের উল্লেখ আগে করেছি। তার কিছু বর্ণনা এখানে সেরে আরো কিছু কথা লেখার ইচ্ছে আছে। আগে দু’দিনে বাস নিয়ে যেত রাওয়ালপিন্ডি থেকে শ্রীনগর। কিন্তু আজকাল একদিনেই, রাত হতে হতে পৌঁছে যাওয়া যায়। তাও আবার সকালেই রওনা দিয়ে। পাহাড়ে প্রচুর চড়াই আর উৎরাই। মারী হয়ে যেতে হয়। মারী পৌঁছোলে মেঘের সঙ্গে অবশ্যই দেখা হয়। মনোরম যাত্রাপথ। দুদিকের খাড়া পাহাড় এবং সবুজ জঙ্গল মন কেড়ে নেয়। বেশির ভাগ রাস্তা ঝিলমের ধারে ধারেই তৈরি হয়েছে। নদীর কলস্বরে মুগ্ধ হয়ে যায় হৃদয়।

মাঝপথে দুটো জায়গা আছে মেল নামে। এখান থেকেই কাশ্মীর রাজ্য শুরু হয়। প্রত্যেকটি জিনিষের কঠোর চেকিং হয়। তবেই এগোতে পারে বাস এবং মানুষেরা। প্রত্যেকটি লোককে জিজ্ঞেস করা হয়, কেন যাচ্ছেন? যদি কারোর লেকচার দেওয়ার থাকে তাহলে যেতে অসুবিধা হবে। আমাকেও প্রশ্ন করা হল আমি ওখানে লেকচার দেব কিনা। আমি না বললাম। কেননা পুরোপুরি বিশ্রাম করার ছিল। আসলে পাঞ্জাবের গুপ্তচর পুলিসের পাঠানো সংবাদ ওরা পায় নি। তার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছেছিলাম। নইলে অসুবিধে হতই। শ্রীনগরে পৌঁছোতেই গুপ্তচর পুলিসের লোকেরা পরের দিন সকালে হাজির হয়ে গেল। তারপর থেকে তো প্রতিদিন দু’একবার এসেই পড়ত। যখন আমি পহেলগাঁও হয়ে অমরনাথের দিকে রওনা হয়ে গেলাম ওরা হঠাত চিন্তিত হয়ে উঠল। যখন ফিরে এলাম ওরা শান্তি পেল।

আমি ওখানকার বিশেষ কিছু কথাই লিখব যা আমায় প্রভাবিত করেছিল। জিনিষের দাম সর্বত্র বেশি। এত বেশি যে বিরক্তি এসে যায়। হাওয়া এত বেশি যে পেট ফেঁপে যায় এবং সবকিছু বিস্বাদ লাগে। লেবু খুব আক্রা। বাইরে থেকেই আসত। কিন্তু টমেটো ইত্যাদি সবরকম শাকসব্জি প্রচুর এবং সস্তা পাওয়া যেত।

যারা চা খায় না তাদের ওখানকার পাহাড়ি হাওয়ায় খুব কষ্ট পেতে হয়। আমি তো চা খাই না। তাই সারাক্ষণ কষ্ট পেতে হয়েছিল। ওখানে যারা থাকে, গরীব থেকে গরীব মানুষও দিনেরাতে পাঁচ বার চা খায়। দুধ আর চিনি তো তাদের জন্য দুর্লভ। তাই নুন মিশিয়েই খায়। যারা লাঙল চালায় তারা ক্ষেতেই নিয়ে যায় আর সেখানেই খায়।

নারী আর পুরুষের পোষাক তো একই রকম। হ্যাঁ, টুপি পরলে বিশেষভাবে চেনা যায় পুরুষ। পুরো কাশ্মীরে ৯৫ প্রতিশত মুসলমানের বাস এবং তারা বড়ই গরীব। যদি শিকারা না চালায়, টাঙ্গা না চালায়, হাউস বোট ভাড়ায় না দেয় যাত্রীদের, উলের কাপড় না বোনে আর ফল প্রভৃতি না ফলায়, তারা না খেয়ে মরে যাবে!

আর যখনই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়, না খেয়ে মরার দিন চলেই আসে। কেননা সে অবস্থায় বাইরে থেকে যাত্রীরা পৌঁছোয় না। কাকে ভাড়া দেবে নৌকো আর জিনিষ কিনবে কে? তাই ওখানকার মুসলমান জনসাধারণ দাঙ্গাকে ভীষণ ভয় পায় এবং ত্রস্ত হয়ে থাকে। পহেলগাঁও থেকে ফেরার সময় বাসে, ওদিকে উলের কাপড় বেচতে যাওয়া এক মুসলমান যুবককে এ বিষয়ে স্বগতোক্তি করতে শুনলাম। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। ও ছিল ভুক্তভোগী। কেননা উলের কাপড় তৈরি করত।

ওখানে কৃষকদের ওপর, সুদে পয়সা দেওয়া মহাজনেরা খুব অত্যাচার করে। কৃষকদের ভাষা বোঝা তো কঠিন ছিল। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম সুদখোরের নামেই ওরা রাগে ফেটে পড়ত। রাজ্যের কর এবং খাজনাও বেশিরকম। তা সত্ত্বেও কৃষকদের জন্য বিশেষ ভাবে কিছুই করা হয় না। প্রায় আড়াই কোটি টাকা আয় থেকে ষাট লক্ষ টাকা তো শুধু একা মহারাজার চাই। তারপর আবার শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের চিন্তা কে করবে? তার জন্য পয়সাই বা কোত্থেকে আসবে?

ওখানে মুসলমানদের দুটো পার্টি দেখলাম। একটা মোহম্মদ আবদুল্লা সাহেবের। সে পার্টিই এখন কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সকে চালায়। রাষ্ট্রীয়তার প্রশ্ন তারা ত্যাগ করেছে। এটাই এখন সেখানকার জবরদস্ত পার্টি। দ্বিতীয়তঃ একজন মৌলবী সাহেব আছেন। কিন্তু একবার সত্যাগ্রহ শুরু করে পরে রাজ্যের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার জন্য একটু চাপে আছেন। কিন্তু আবদুল্লা সাহেব যেমন ছিলেন তেমনই শক্তভাবে আছেন। দু’একজন ভালো এবং কাজের শিখ এবং হিন্দু লোকজনও এনার সঙ্গে আছেন। তাই এনার ভালো প্রভাব। সরদার বুধা সিংএর খুব তারিফ শুনলাম। কিন্তু ওনার সাথে দেখা করতে পারলাম না। স্বাধীনতার আন্দোলন ওখানে প্রারম্ভিক অবস্থায়। ফলে আন্দোলন এখনো মধ্য শ্রেণীরই হাতে।

দু’তিনজন নবযুবকের সাথে, এবং একজন মৌলবীসাহেবের সাথে কথা বলে খুব আনন্দ পেলাম। যুবকদের মধ্যে গ্র্যাজুয়েট এবং কলেজপড়ুয়া দুইই ছিল। আর মৌলবীসাহেব একটি উর্দু খবরের কাগজের সম্পাদক ছিলেন। দেখলাম ওরা যুগটাকে খুব ভালো করে বোঝে। ধর্মের গোঁড়ামি তো একেবারেই নেই। ভবিষ্যতের শুভ সংকেত। মৌলবীসাহেব ওখানকার কৃষকদের সমস্যা বুঝতেন। এটাও আনন্দের ব্যাপার ছিল।

শ্রাবণের পূর্ণিমায় বাবা অমরনাথের দর্শন করা হয়। সেদিন ওখানকার সাধুদের একটা বড় দল অন্যান্যদের সাথে ওখানে পৌঁছোয়। দলটাকে ছড়ি বলা হয়। আসলে দলটা যখন রওনা দেয় তখন সামনে একজন সুদৃশ্য একটি লাঠি বা ছড়ি নিয়ে চলে। তার ওপর ফুল ইত্যাদি নিবেদিত হয়ে থাকে। তা থেকে দলটাকেই ছড়ি বলা হয়। আমি এবং আমার সঙ্গী একটু আগেই রওনা হয়ে গেলাম। কেননা ছড়ির সঙ্গে গেলে চটিগুলোতে জায়গা বা জিনিষপত্র পাওয়া অসম্ভব হয়ে যেত।

পহেলগাঁও অব্দি তো মোটর আর বাস যায়। তারপর হয় হেঁটে যেতে হয় নয় টাট্টুতে চেপে। মালপত্র বইবার জন্য টাট্টু থাকেই। প্রায় ৮-১০  মাইলের পর একটা করে চটি থাকে। সেখানেই লোকে থেকে যায়। প্রথম চটি চন্দনবাড়ি। সেখানে আমরা থেকে গেলাম। পরের দিন প্রায় সোজাসুজি দু-আড়াই মাইল চড়াই পার করলাম এবং শেষনাগের চটিতে গিয়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারলাম। সন্ধ্যেবেলা পঞ্চতরণী পৌঁছে গেলাম।

মাঝে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় পৌঁছোতেই বৃষ্টি এবং ছোট ছোট শিলাবৃষ্টির সাথে মোলাকাত হয়ে গেল। পঞ্চতরণীর একটু আগেই জায়গাটা। প্রতিদিনই এমন হয়। এক মাইল দূরত্বে টিনের দুটো কামরা তৈরি করা আছে। দৌড়ে লুকিয়ে পড়া যায়। আমরাও লুকিয়ে পড়লাম।

পঞ্ছতরণীর আগে, এমনকি চন্দনবাড়িরও আগেই পাহাড়ের ওপর শুধু বরফ আর বরফ দেখা যায়। জোরে হাওয়া চলে। গাছও নেই, পাতাও নেই। নিচে থেকেই (চন্দনবাড়ি থেকে) কাঠ নিয়ে এসে জ্বালায় লোকেরা। কিছু দূর অব্দি ভুর্জপত্রের বৃক্ষ ছিল। তারপর সেটাও গায়েব। কিন্তু শ্যাওলার মত ঘাস ছিল যেগুলো ভেড়ারা খেত আর ধীরে ধীরে খেতে খেতে পাহাড়ে চড়ে যেত। ভেড়াওয়ালারা তাঁবু গেড়ে দিনরাত পড়ে থাকে। কখনো কখনো রাতে বেশি বরফ পড়লে বিপদ এসে পড়ে। মৃত্যুও হয় তখন। দেখলাম ওই ভয়ানক শীতেও টাট্টুগুলো রাত ভর ওই ঘাসই খেতে থাকত।

রাস্তায় এত ঠান্ডা যে শরীরের যে অংশটা ঢাকা পড়েনি সেখানেই রক্ত উঠে আসে। ফিরে আসার পর সে অংশের ওপরের চামড়া শুকিয়ে আঁশের মত ঝরে পড়তে থাকে। আমাদের মুখগুলোরও একই দশা হল। রাস্তায় একজন পঙ্গুকে শুয়ে শুয়ে ঘষটে এগোতে দেখলাম। কী মনোবল! কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সে।

অমরনাথের গুহার এক দিকে একজন বিহারি বাবা ছিলেন। দিন রাত ওখানেই থাকতেন। আর কেউ তো রাতে ওখানে থাকে না। যে যেত সেই ওনাকে কিছু কাঠ আর আহারের জিনিষপত্র দিয়ে আসত। কাঠ জ্বালাতেন সারা দিনরাত আর তার ওপর নির্ভর করেই থাকতেন।

গুহার দরজাটা চওড়া। কোনায় একটু বরফ জমে থাকে। তার ওপর মাঝে মধ্যে জলের ফোঁটা পড়তে থাকে, বোধহয় ওপরের পাহাড়ের বরফ গলে গলে। এ কারণেই জায়গাটা বরফ হয়ে থাকে। আর কিছুই দেখলাম না। ওই বরফই বাবা অমরনাথ নামে খ্যাত।

স্নান-টান করার জন্য কাছেই সুন্দর, কিন্তু ঠান্ডা জলের কুন্ড আছে। ময়না বা চখার মত কয়েকটি পাখি দেখলাম। তাও খুব কম। মন্দিরে কয়েকটি পায়রা দেখা গেল। রাস্তায় কাকের মতই দেখতে কোনো পাখি ছিল। কিতু পায়ের নিচের অংশ এবং ঠোঁট সাদা। ডাকছিলও অদ্ভুত স্বরে। জিনিষপত্র বয়ে নিয়ে চলা মানুষেরা তো গরীব মুসলমান ছিল। ওরা ছাড়া ওদিকে আর আছেই বা কে? কিন্তু ওদের স্বাভিমান দেখে মন আনন্দে ভরে উঠল।

শ্রী ভীষ্মজী সাহনি, এম.এ. নামে এক যুবক শ্রীনগরে এবং ওই যাত্রায় আমাদের সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখলেন এবং আরামে রাখলেন আমাদের। উনি রাওয়লপিন্ডির বাসিন্দা। ওদিকে নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছে ছিলেন।

যখন ওখান থেকে ফিরলাম, রাওয়লপিন্ডি থেকেই গোয়েন্দারা আমাদের পিছনে ছিল। লাহোরে তো আধ ডজন, গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল ট্রেন ছাড়া অব্দি। দু-একজন লাগাতার ট্রেনে রইল। এমনকি মেরঠের পরেও যখন বার বার ওদের স্টেশনে আসতে দেখলাম, তারপর হাথরস ছাড়িয়ে এগোনর পরেও, তখন ক্রোধ জাগল যে এই কংগ্রেস মিনিস্ট্রিই বা কেমন পদার্থ, যে পুলিস শান্তিতে থাকতেই দিচ্ছে না! তারপর যখন ওপরের বার্থে উঠে সকাল সকালই শুয়ে পড়লাম, তখন গিয়ে ওরা ঘাড় থেকে নামল।

(১১)

প্রাদেশিক কিসান কনফারেন্সগুলো

১৯৩৫ সালে হাজিপুরে যে প্রাদেশিক কিসান কনফারেন্স হয়েছিল তারপর পরের বছর বিহপুরে (ভাগলপুর) হওয়ার ছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে হয়েও গেল। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ সভাপতি ছিলেন। তখন অব্দি কোনো সমস্যা হয় নি। সমস্যা তার পর হওয়ার ছিল। বিহপুরেই হিন্দিতে ‘জনতা’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করার এবং তার জন্য ‘জন সাহিত্য সঙ্ঘ’ স্থাপন করার কথা ভাবল বন্ধুরা। কিন্তু আমি স্পষ্ট বলে দিলাম, আমি ওতে নেই। নানান খবরের কাগজ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার তার ভিত্তিতেই আমি না করেছিলাম। বিশেষ করে টাকার প্রশ্ন ছিল, এবং জনগণের দেওয়া টাকাকে যে ধরণের দায়িত্বহীনতার সাথে আমরা দেখি এবং ব্যবহার করি বা অপব্যয় করি, সেটা সব সময় আমার বিবেকে বাধে। তাই হাজার বলা সত্ত্বেও এবং কয়েকজন বন্ধুর, ওদের দোষ-গুণ ওদের মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দেওয়ার জন্য আমার ওপর রাগ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমি ‘হ্যাঁ’ করলাম না। তবুও শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ আমার স্বীকৃতি ছাড়াই আমার নাম ওতে দিয়ে দিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি অস্বীকার করতে পারলাম না। সেটাই ভুল হল। তার ফল ভুগতে হল পরে।

হ্যাঁ, তো বিহপুরে দ্বিতীয় দিন সভাপতিজি কোনো অনিবার্য কাজে চলে গেলেন এবং আমাকেই অধ্যক্ষতা করতে হল। আমাদের সভায় পতাকার প্রশ্ন আগে থেকেই উঠেছিল। সেটা ওখানে আরো তীব্র হয়ে উঠল – কেমন হবে পতাকা। অনেকে লাল এবং তেরঙা একসাথে রাখার পক্ষে ছিল। তা নিয়ে সভায় অনেক বিতন্ডা চলল। কংগ্রেসি কয়েকজন বন্ধু বড় ঝামেলাও পাকাল। প্রস্তাব তো এটাই রাখা হয়েছিল যে এ ব্যাপারে সবক’টি সভা থেকে অভিমত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। কিন্তু কনফারেন্সে উৎপাত চালানো হল। সন্ধ্যার সময়। তারপর রাত হয়ে গেল। কয়েক ঘন্টা ধরে কয়েকজন, কিছু যুবক ও ছাত্রদেরকে বিভ্রান্ত করে চ্যাঁচামেচি করতে থাকল। আমার সঙ্গীরা বার বার ঘাবড়ে যাচ্ছিল। আমি মাথা ঠান্ডা রেখে বসেছিলাম। অনেক বোঝালাম, করজোড়ে বিনতি করলাম। কিন্তু যখন ওরা চুপ করল না তখন বললাম এদের ক্লান্ত হতে দাও। তখন কাজ হবে। তাই হল। যখন ওরা ক্লান্ত হয়ে ঠান্ডা হল তখন কাজ শুরু হয়ে পুরো হল। যদি আমি ঘাবড়ে যেতাম তাহলে সব কিছু ভন্ডুল হয়ে যেত।

১৯৩৭ সালে আমাদের কনফারেন্স মুঙ্গের জেলার বাছোয়ারায় হওয়ার ছিল। মহন্ত সিয়ারাম দাস ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির অধ্যক্ষ এবং পন্ডিত যদুনন্দন শর্মা ছিলেন সভাপতি। কিন্তু মুঙ্গের জেলা কংগ্রেস কমিটি, প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী এবং প্রধানমন্ত্রীর সর্বশক্তি নিয়োজিত হল যাতে কনফারেন্সটা অসফল হয়। তা সত্ত্বেও পরিণতি হল যে কিসান সভার ইতিহাসে ওটা অদ্বিতীয় কনফারেন্স হল। লক্ষাধিক কৃষক অংশগ্রহণ করল। হ্যাঁ, লক্ষাধিক!

ব্যাপারটা এমন ছিল যে সে বছরই মুঙ্গের জেলা কংগ্রেস কমিটি প্রস্তাব নিয়ে ফেলল, কোনো কংগ্রেসি কিসানসভায় অংশগ্রহণ করবে না। তারপর প্রদেশের কার্যনির্বাহীও সে প্রস্তাব সমর্থন করে দিল। প্রধানমন্ত্রীর তো জেলাটাই! এদিকে ওখানে আমাদের মুখ্য কিসান কর্মী ছিলেন পন্ডিত কার্যানন্দ শর্মা যিনি পাকা কংগ্রেসি। অভ্যর্থনা সমিতির অধ্যক্ষেরও একই অবস্থা! তাই অসুবিধা হল। অভ্যর্থনা সমিতির অধ্যক্ষ ওখানকার কংগ্রেসি নেতাদের পায়ে পড়ে অনুরোধ জানালেন যেন সম্মেলনটা হতে দেওয়া হয়। কিন্তু তেনারা তো অহঙ্কারে মাথায় চড়ে ছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড তাঁদের, কংগ্রেস কমিটি তাঁদের এবং মন্ত্রীরাও তাঁদের! কাজেই তেতোর ওপর তেতো!

এমন নয় যে শুধু প্রস্তাব গৃহীত হল। আমাদের বাছোয়ারা সম্মেলন বিফল করতে কংগ্রেসের সর্বশক্তি নিয়োজিত হল। মাসাধিক কাল আগে থেকে শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের দল, বাজনা পার্টির সাথে পাঠানো হল যাতে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করা যেতে পারে, আটকান যেতে পারে। কিন্তু ফল হল উল্টো এবং ওরা চুড়ান্তভাবে অসফল হল। অভ্যর্থনা সমিতির অধ্যক্ষ নিজের ভাষণে পুরো কাহিনীটা শুনিয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে দিলেন। নিজেও কাঁদতে থাকলেন। সভাপতির ভাষণ তো দারুণ হল। তাতে সংস্কারপন্থী নেতাদের মনোবৃত্তির কড়া সমালোচনা ছিল।

সারকথা, যে ওই সম্মেলন আমাদের আধিপত্য কায়েম করল। যখন লম্বা প্যান্ডালে লোকেরা আঁটল না তখন আলাদা মিটিংও করতে হল। লাউড স্পীকার থাকার পরেও এই অবস্থা হল।

ওদিকে বিহার প্রাদেশিক প্রথম আখ সম্মেলন হল পন্ডিত যমুনা কার্যীর অধ্যক্ষতায়। তারপর নেতা আর মন্ত্রীরা আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারার আশা ছেড়ে কৃষকদের যাতে কিছু লাভ হয় সেদিকে মন দেওয়া শুরু করল।

ষষ্ঠ বিহার প্রাদেশিক কিসান সম্মেলন হল ১৯৩৯ সালের শুরুতে, দ্বারভাঙা জেলার বৈনিতে (পুসা রোড স্টেশন)। দ্বারভাঙা জেলার কংগ্রেসি নেতারা তো কখনোই কিসান-সভাকে দুচোখে দেখতে পারতেন না। ফলে সমস্ত শক্তি লাগিয়ে সম্মেলনের বিরোধ করল। তবুও লক্ষাধিক কৃষক এল আর আমরা পুরোপুরি সফল হলাম। প্যান্ডাল এবং তার সাজসজ্জা ওখানকার বিশেষত্ব ছিল। অভ্যর্থনা কমিটির অধ্যক্ষ ছিলেন পন্ডিত রামনন্দন মিশ্র। ওনার এবং তার সাথে পন্ডিত ধনরাজ শর্মা, পন্ডিত যমুনাকার্যী, ডাঃ রামপ্রকাশ শর্মা আর তাঁদের সঙ্গীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কর্মতৎপরতার ফল হল যে শত্রুরা কিছুই করতে পারল না। সভাপতি ছিলেন বড়হিয়া-টাল সত্যাগ্রহের যোদ্ধা পন্ডিত কার্যানন্দ শর্মা। দেখার ব্যাপার ছিল যে সভাপতি নিজের লালজামা পরা শতাধিক কিসান সেবকদের সাথে খালি পায়ে প্রায় আশি মাইল পায়ে হেঁটে সম্মেলনে পৌঁছেছিলেন।

ওখানেই শ্রী শ্যামনন্দন সিং এমএলএর সভাপতিত্বে দ্বিতীয় প্রাদেশিক আখ সম্মেলনও হল।

১৯৩৯ সালের শেষে না হয়ে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চম্পারণ জেলার মোতিহারিতে বেশ জাঁকজমকের সাথে হল সপ্তম প্রাদেশিক সম্মেলন। মোতিহারিতে কৃষক আন্দোলনের জন্ম তো সেই ১৯২৭ সালেই অনেক ঘটনার পর হয়েছিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই, গান্ধিবাদিদের প্রবল এবং সংগঠিত যে বিরোধের মোকাবিলা করে সে আন্দোলনকে এগোতে হয়েছিল সেটা দেখার মত। ওটাকে মানা হয় গান্ধিজির জেলা। ওখানে গান্ধিবাদ ছাড়া অন্য কিছুর নাম নেওয়া পাপ মনে করা হয়! কাজেই কিসান-সভার কথা তো ‘কাবায় কুফ্র’! ফলে অনেক অসুবিধে হল। কিন্তু আমাদের সাহসী এবং উদ্যমী কর্মীরা দারুণ কাজ করল। আজ তো ওখানে কিসান-সভা যথেষ্ট সুদৃঢ়। ফলে সম্মেলনের প্যান্ডাল ইত্যাদি দেখার মত করে তৈরি হয়েছিল। সাফল্যও ভালোরকম হল এবং কয়েকজন বাইরের নেতাও এলেন। স্বাগতাধ্যক্ষ ছিলেন শ্রীমহন্ত ধনরাজপুরি এবং সভাপতি রাহুল সাংকৃত্যায়ন।

ওখানেই আমার সভাপতিত্বে বিহার প্রাদেশিক তৃতীয় আখ সম্মেলন হল ধূমধাম করে। আমার ভাষণ ছাপা ছিল। তাতে আখের কৃষকদের সমস্ত সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে বিশদে। আসলে আখের কৃষকদের সমস্যা এখন এত গভীর এবং জটিল হয়ে গেছে যে ভালো করে হাতে না নিয়ে কাজ চলতে পারে না। সত্যিকারের প্রাদেশিক আখ সম্মেলন বস্তুতঃ মোতিহারিতেই হল। দশ-বারোটা প্রস্তাবও গৃহীত হল যাতে সব রকম সমস্যার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। একটা উপসমিতিও তৈরি হল যেটা বিধিবিধান তৈরি করবে। নিয়মিত পদকর্তারাও নির্বাচিত হলেন। এ সম্মেলনের সবচেয়ে সুন্দর ফল হল যে বিহটার এলাকায় আনুষ্ঠানিক ভাবে গঠিত আখ সংঘ যে এ্যাদ্দিন ছিল না সেটা তৈরি হয়ে গেল এবং বিঘাপ্রতি এক আনা চাঁদা দিয়ে আখের কৃষকেরা তার সদস্য হয়েছে। এই সফলতার পরিণামে পুরো প্রদেশে শিগগিরই এভাবেই আখ সংঘ তৈরি হবে। এটা না করে কাজ চলবে না। 

(১২)

কৃষকদের সমাবেশ

১৯৩৭ সাল এবং ১৯৩৮ সালে বিহারের কৃষকদের বড় বড় সমাবেশ হয়েছিল পাটনা শহরে। পুরো প্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষকের জমায়েত হত। বড় কথা যে কিসান তহবিলের জন্য পয়সাও ওরা সঙ্গে করে নিয়ে আসত। সেপাইদের মত লাইন বেঁধে ওরা শহরে ঢুকত, যাতে রাস্তাও বন্ধ হত না আর লোকে খুব প্রভাবিত হত। অন্যান্য শহরেও সমাবেশ হয়েছিল। গয়ার প্রথম সমাবেশের কথা ১৯৩৩ সালের প্রসঙ্গেই লিখেছি। পাটনার প্রথম সমাবেশের কথাও লিখেছি।

১৯ নভেম্বর – ১৯৩৭ সালেই পুরো প্রদেশে দাপটের সাথে কৃষক-দাবি-দিবস উদযাপন করা হল। আমরা ঠিক করলাম যে এসেম্বলির যতগুলো নির্বাচনক্ষেত্র আছে, প্রত্যেকটিতে কৃষকদের জমায়েত এক দিনে এবং একই সময়ে হোক। ওখানকার নির্বাচিত কংগ্রেসি প্রতিনিধিও তাতে অংশগ্রহণ করুক। নিজের থেকে যদি না আসে তাহলে কৃষকেরা এমনিই তাদেরকে ডাকুক এবং তাদেরই সামনে নিজেদের দাবি পেশ করুক। সব জায়গার জন্য আমরা একটা সামগ্রিক দাবিপত্রও তৈরি করেছিলাম। একই দিনে প্রদেশের শতাধিক জায়গায় সে দাবিপত্র পড়া হল। চেষ্টা করা হল যে নির্বাচন ক্ষেত্রের একেক কোণা থেকে লোকেরা জমা হোক। কৃষকেরা গান গেয়ে এবং স্লোগান তুলে সমাবেশে আসুক। এসবে আমরা পর্যাপ্ত সাফল্য পেলাম। তারপর ২৬.১১.৩৭ এ পাটনায় এক লক্ষ কৃষকের দ্বিতীয় প্রদর্শন হল।

একই ভাবে ১৯৩৮ সালেও পাটনায় দুটো বড় সমাবেশ হল। প্রথমটা তো হল গরমকালে, বাঁকিপুরের মাঠে। দ্বিতীয়টাও সেখানেই হল কিন্তু বর্ষাতে। গরমকালে যে জমায়েতটা হয়েছিল সভার পর সেটা মিছিল হয়ে শহরে বেরুল জাঁকজমকের সাথে। কিসান-সভা দপ্তরে এসে সে মিছিলের সমাপন হল। তাতে কংগ্রেসি মিনিস্টার ডাঃ মাহমুদ এবং অন্যানরাও শামিল ছিলেন; তাঁরা কিছু বক্তব্যও রাখলেন। ওঁদেরই সামনে আমরা কৃষকদের দাবিগুলো পেশ করলাম এবং ওঁদের জবাব দেওয়ার সুযোগ দিলাম। পরে আমরা ওঁদের বক্তব্যের জবাব দিলাম এবং কৃষকদের রায় জানলাম।

যখন বর্ষা কালে আমরা ১৫.৭.৩৮ তারিখে সমাবেশের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলাম, জমিদারেরা এবং সরকার প্রবলভাবে বিরোধ করল। আসলে আমার সম্পর্কে ‘লাঠি আমাদের জিন্দাবাদ’ কথাটা খুব প্রচার করা হয়েছিল। ফলে জমিদারদের খবরের কাগজগুলো মিথ্যে মিথ্যে লিখে সরকারকে খেপাল যে কৃষকেরা বর্শা, বল্লম আর লাঠিতে সজ্জিত হয়ে আসছে। আমরা এ মিথ্যা প্রচারের খন্ডনও করলাম এবং কৃষকদের নির্দেশ দিলাম যে পথে কেউ কোথাও উৎপাত করলেও যেন কেউ কিছু না বলে। কেননা সবার হেঁটেই আসার ছিল। তা সত্ত্বেও সরকার পাটনায় পুলিস এক্ট এবং ১৪৪ ধারা জারি করে দিল। শহরের বাইরে এবং গ্রামাঞ্চলে জমিদারের লোকেরা এবং পুলিসের লোকেরা কৃষকদের ভয় পাওয়াতে আর বিভ্রান্ত করতে থাকল যে যেও না, গুলি চলবে। তবুও, কে মানবে এসব কথা? চাষের দিন বর্ষাকাল এবং এ সমস্ত কুচক্র সত্ত্বেও পঞ্চাশ হাজারের বেশি কৃষকেরা জমা হল সেদিন।

খাড়া ফসল বাজেয়াপ্ত করার আইন তৈরি হচ্ছিল। আমাদের তীব্র প্রতিবাদ করার ছিল। তাই পুরো শক্তি লাগিয়ে দিলাম। প্রত্যেকটি সমাবেশের সময় এধরণের কিছু না কিছু বিশেষ বিচার্য প্রশ্ন থাকত। এ বার তো কংগ্রেসিরাও বিরোধ করছিল। মিনিস্টারদের বাংলোর চার দিকে এবং এসেম্বলি ভবনটাকেও ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল লাল পাগড়িওয়ালারা। ঘোড়সওয়ার এবং অন্যান্য অস্ত্রসজ্জিত বাহিনিও মোতায়েন ছিল। মিনিস্টারদের এই অবস্থা দেখে কৃষকদের চোখ খুলে গেল।

যাহোক, সভা হল। যথারীতি আমিই সভাপতি ছিলাম। প্রতি বার আমিই হতাম, প্রথম বার শুধু হইনি। কেননা ছিলাম না। সভাতেই সিদ্ধান্ত হল যে এবার এসেম্বলি ভবন, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েটের দিকে মিছিল যাবে এবং আমিই সামনে থাকব। কোনো উঁচু সওয়ারিতে বসে, যাতে কৃষকেরা এদিক ওদিক না যায় এবং এসেম্বলিতে না ঢোকে, যেমন প্রথম বার ঢুকে ছিল। তাই হল। এক মাইল লম্বা মিছিল ছিল এবং বিরাট চওড়া রাস্তা ভরে হাঁটছিল। একটু একটু বৃষ্টিও পড়ছিল। কয়েক ঘন্টা লাগল। আমি এত স্লোগান তুললাম যে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, কী চেপেছিল মাথায়। দারুণ মেজাজ ছিল। সরকারি পাড়াকে সেদিন আমরা নাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

বিগত দুটো সমাবেশেই দানাপুরের গোলাদারেরা ভেজা ছোলা, কাঁচালঙ্কা, এবং নুন বিতরণ করেছিল যাতে ক্ষুধার্ত কৃষকেরা জলপান করে নেয়।

পরে আমার সাথে দেখা হলে মুল্করাজ আনন্দও বললেন যে এই সমাবেশগুলোর সময় উনি স্পেনে এবং অন্যান্য দেশে ছিলেন। সেখানে এই সমাবেশের বর্ণনা পড়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন। বললেন, প্রত্যেকটি সমাবেশ স্পেনের লড়াইকে এবং ওখানকার কৃষক-শ্রমিক সরকারকে প্রচুর সাহায্য করেছে। কেননা বোঝা যেত যে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহের ভাবনা ভরে উঠছে, মানে ইংরেজ সরকার দুর্বল হচ্ছে। আর ইংরেজ সরকারের দুর্বল হওয়ার অর্থই ছিল স্পেনের মানুষের মনোবল বেড়ে ওঠা এবং বেশি সাহায্য পাওয়া! সমাবেশের এতটাই গুরত্ব!

(১৩)

বুদ্ধিভেদ – লাঠি আমাদের জিন্দাবাদ

১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চম্পারণ জেলা কমিটি একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নিল যে চম্পারণে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর যে সফর হওয়ার আছে সেটা থামান হোক, তাতে যেন কোন কংগ্রেসি অংশগ্রহণ না করে এবং স্বামীজিকে লেখা হোক যে আপনার সফরে এখানকার লোকেদের মধ্যে ‘বুদ্ধি ভেদ’ হওয়ার আশঙ্কা আছে, অতএব এই সফর করবেন না। এই মর্মে কোন চিঠি আমার কাছে অবশ্য আসে নি। কিন্তু আমার সফর বিফল করতে ওখানকার কংগ্রেসিরা পুরো জোর লাগিয়ে দিল। আসলে চম্পারণ তো শুধু পথ দেখাল। পুরো প্রদেশেই কংগ্রেসের লিডাররা চাইত না যে কিসান-সভা কায়েম থাকুক। তাই চম্পারণের পরই সারণেও একই ব্যাপার হল এবং মুঙ্গের আর প্রদেশের কংগ্রেস কমিটিও একই কাজ করল। এটা তো আগেই লেখা হয়েছে।

চম্পারণ গীতার ‘ন বুদ্ধিভেদজনয়েদ’এর ভালো মানে বার করল ওরা চাইল যে ওখানে গান্ধিবাদ ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ যেন না শোনা যায়, অর্থাৎ যে অবস্থা তখন অব্দি ছিল সেটা বহাল থাকে। কিন্তু আমার প্রথম সফর হয়ে যাওয়ার পর যে কিসান-সভার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল তাতে বিপদ দেখা দিল।

তবে আমার প্রোগ্রাম তো থামে না। তাই মার্চের প্রথম থেকে পুরো জেলায় চব্বিশটা মিটিং করার প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেল। সমস্ত শক্তি লাগিয়ে তার বিরোধ করাও শুরু হয়ে গেল। মিটিংএ যাওয়া থেকে লোকেদের আটকান তো হলই, জায়গায় জায়গায় কালো পতাকাও দেখান হল। বিচিত্র হট্টগোল চলছিল। কিন্তু আমার অবস্থা তো সেই – ‘কাঁদল ভীম, হল চারগুণ’! যা মনে আছে, চব্বিশটার মধ্যে থেকে বাইশটা মিটিং হল। তিনটে হতে পারল না কিন্তু নতুন একটা মিটিং হয়ে গেল। এমনও হল যে লৌরিয়ার মত জায়গাগুলোয় মাত্র ২৫-৫০ জন লোক ছিল। বাকিরা দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল, যেন মিটিংএ গেলে পাপ হবে। কয়েকটি মিটিংএ আবার কয়েক হাজার করে লোক এল, বিশেষ করে শহরে এবং বেশ কয়েকটি গ্রামাঞ্চলেও। মোটামুটি তাও ৪০-৫০ হাজার মানুষ আমার কথা শুনল। প্রশংসনীয় ছিল আমাদের নতুন কর্মীদের এবং ব্যবস্থাপকদের ভুমিকা। ‘জিমি দশননহি মহুঁ জীভ বেচারী’র [তুলসী-রামায়ণে বিভীষণ রামকে বলছে, আমি লঙ্কায় এমনভাবে আছি “যেমন দাঁতের পাটির মাঝে জিভ”] দশাতেও ওরা সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিল। ওরা প্রস্তুতি করে এগিয়ে যেত আর তার পরে আমরা মিটিং করতাম।

ভিত্তিহরোয়াতে তো জায়গা অব্দি পাওয়া গেল না। তখন নুর মোহম্মদ নামে একজন মুসলমান যুবক যে আমাকে চিনতও না, নিজের খেতের কাঁচা মটর উপড়ে ফেলল আর সেখানে সভা করতে বলল! পরে জানতে পারলাম ওর ওপর কেমন চাপ এসেছিল। বয়কট করার হুমকি তো পেলই, এমনকি ওর ভাইয়ের কিছু টাকা কোথাও গচ্ছিত ছিল সে টাকা ফেরত পাবে না সে হুমকিও শুনতে হল কিন্তু সে কিচ্ছু শুনল না। সে নিজের ক্ষেত দিতে তৈরি হওয়ার পর রাস্তার পাশেই আরেকটি জমি পাওয়া গেল এবং শামিয়ানাও জোগাড় হল। সভা আমরা সেখানেই করলাম কিন্তু সভার পর সবার সাথে আমি ওই ক্ষেতে গেলাম এবং তার মাটি মাথায় ঠেকিয়ে বললাম, কিসান-সভার ইতিহাসে এই ক্ষেত এবং এই মুসলমান যুবক অমর থাকবে। এভাবেই সবাই সভার শিকড় মজবুত করবে। সেই যুবকের সাথে সে বছরই মোতিহারি কনফারেন্সের সময় দেখা হল।

এক সভায় তো যখন বিরোধীরা আর কিছু করতে পারল না তখন মিটিংএ এসেই চ্যাঁচামেচি করতে শুরু করল এবং বলতে চাইল। আমি বলা বন্ধ করে চলে এলাম। পরে, জানিনা কী সমস্ত বকবক করে গিয়েছিল।

এই সফরেই জেলা কিসান-সভার জন্ম হল। সফর শেষ হল দশ দিনে। তারপর দ্বিতীয় সফর হল ১৯৩৮ সালের গরম কালে। তত দিনে আমাদের লোকবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেসের লোকেরাও তেমন বিরোধ করল না। যদিও মোটরগাড়ি দৌড়ল। মোকাবিলায় পাল্টা সভা করা হল। লোকেদের হুমকি দেওয়া হল। কিন্তু কে শুনবে? প্রথম বার যারা আসেনি তারা পরে আপশোষ করেছিল। তাই এবার ওরা প্রায়শ্চিত্ত করল। তারপর তো যখন আশ্বিন মাসে বিজয়াদশমীতে বেতিয়া মেলার সময় সভা করতে গেলাম তখন সভাতেই ওখানকার নেতা শ্রী প্রজাপতি মিশ্র আগের ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল। ঝামেলাই শেষ হয়ে গেল। ওর ক্ষমা চেয়ে নেওয়ায় কিসান-সভার প্রভাব বাড়িয়ে দিল। সে গান্ধিবাদের নীতি অনুসারে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ঠিকই করেছিল। আমিও আগের কথা ভুলেই গেলাম।

চম্পারণ জেলার প্রথম সফরের পর সারণ (ছাপরা) জেলাতেও সফর হল। সেখানেও কংগ্রেসের নেতারা ভালো রকম বিরোধ করল। রাজেন্দ্রবাবু এবং প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির হুকুম ছাপিয়ে বিলি করে লোকজনকে আটকান হল। বেশ কয়েক জায়গায় কালো পতাকা দেখান হল। ভৈরবায় তো ওদের সঙ্গীরা মারপিট করার জন্য তৈরি ছিল। ফলে সভা ছেড়ে দিতে হল। আমাদের আগে আগে কংগ্রেসের নেতারা মোটরগাড়িতে করে দৌড়ত, সভাস্থলে গিয়ে হুকুমনামা শোনাত আর সবাইকে আমাদের সভায় থাকতে মানা করত। কিন্তু ওদের চলে যাওয়ার পর লোকেরা আবার জমা হয়ে যেত এবং আমি পৌঁছোলে আমার কথা শুনত। কাটোয়ায় কালো পতাকা নিয়ে ছেলেরা নাকাগুলোয় (রাস্তার মোড়) দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু যখন সভায় ভীড় ভেঙে পড়ল ওরাও শামিল হয়ে গেল। ওখানেই “স্বামীজি ফিরে যান” শুনতে পেলাম। কিন্তু প্রথমবারের সফরেই আমাদের কাজ হয়ে গেল। যখন ১৯৩৮এর ফেব্রুয়ারিতে আমি দ্বিতীয় বার গেলাম তখন বিরোধের পুরোনো ধরণ ছেড়ে দেওয়া হল! কিন্তু মদ্যনিষেধের সরকারি লরিগুলোতে চড়ে তারই প্রচারের বাহানায় নেতারা গেল এবং আমাদের চলে আসার পর দু’একটা সভায় উল্টোপাল্টা বললও। আগে নয়। কাজেই আমরা পরে জানতে পারলাম। ফলে তৃতীয় বা চতুর্থ সভার পর ওদের দুর্দশা হল। ভৈরবাতেও ওদের একবার হারতে হল। সিওয়ানে তো ওরা কথা বলতেই পারল না। লোকেরা আমার পর ওদের কথা শুনতে রাজিই হল না। গোপালগঞ্জে আমার সভার পাশেই সভা করে আমারই সঙ্গে সঙ্গে জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতিও চেল্লাল। কিন্তু ফল কিস্যু হল না।

একটা জরুরি কথা। আমার সামনে একটা বিকট সমস্যা এদিকে কয়েক বছর ধরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে কংগ্রেসের নেতারা শেষ অব্দি কৃষকদের সাথে প্রতারণা করবে। ফল হবে যে যেহেতু আমরা, মানে কিসান-সভাওয়ালারাও কংগ্রেসি, আমাদের ওপর কৃষকদের বিশ্বাস থাকবে না। কাজেই এর বিহিতের একটা রাস্তা বার করতে হবে। কিন্তু রাস্তা দেখতে পাচ্ছিলাম না। যদি কিসান-সভাকে কংগ্রেস থেকে আলাদা কৃষকদের একটি বিশেষ সংস্থা বলি তাহলে ওরা অকারণে কংগ্রেস থেকে বেশি সভাকেই বেশি ভালোবাসবে। ফলে কংগ্রেস দুর্বল হবে। আর যদি এমন কিছু না করি তাহলে শেষে সেই অবিশ্বাসের বিপদ! অদ্ভুত এক ধাঁধা মনে হচ্ছিল। মনে দুশ্চিন্তাও ছিল অসীম আর কষ্টও।

এই দুশ্চিন্তার মধ্যেই সারণ, চম্পারণ এবং মুঙ্গেরের উপরোক্ত ঘটনাগুলো হল, যেগুলোকে প্রাদেশিক কংগ্রেসও এক প্রকারে স্বীকৃতি দিল। ফলে রাস্তা কিছুটা পরিষ্কার হল। কিন্তু আমার ওপর হিংসার অভিযোগ এনে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, খোদ রাজেন্দ্রবাবুর সভাপতিত্বে যে নিন্দাপ্রস্তাব পাশ করল প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী, তাতে আমার রাস্তা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল! ওরাই কিসান-সভাকে কংগ্রেস থেকে ভিন্ন প্রমাণ করে দিল! খুব প্রচারও করল ব্যাপারটার। ওদের লোকেরাই বলা শুরু করল যে অমুক লোকটা কিসান-সভার আর অমুক কংগ্রেসি।

ওই প্রস্তাবের পর আমি প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলাম। প্রশ্ন এটাই ছিল যে আমি ওই কার্যনির্বাহীর মেম্বার ছিলাম। তা সত্ত্বেও আমাকে একটা সুযোগ না দিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে প্রস্তাব পাশ করা হল। অক্ষম্য অপরাধ ছিল এটা। আমার কাছে ওই মিটিংএর খবরও পৌঁছোয় নি। ফলে আমি, যেমন আগে বললাম, সফরে ছাপরায় চলে গেছি। হয়ত ঠিক মিটিংএর দিন নোটিশটা বিহটায় গিয়ে থাকবে। কিন্তু তাতে কী? খবর তো আমি পাইই নি। এতই দরকার ছিল তো আমায় টেলিগ্রাম কেন করা হল না? আমি জানি যে অন্যান্য মেম্বারদের টেলিগ্রাম করা হয়েছিল এবং পরে সে খবর ছেপেওছিল। যাই হোক, আমাকে তো বিশেষ করে খবর দেওয়া জরুরি ছিল। মিটিং কি পেছোন যেত না? ১৩ই ফেব্রুয়ারিতেই প্রস্তাবটা পাশ করতে হত? এতটাই জরুরি ছিল? কী বিগড়ে যাচ্ছিল এমন? জেনেশুনে ছাপরায় আমার প্রোগ্রামটা নষ্ট করার ছিল? কেননা আগেই তার খবর ছেপেছিল? কোন পরিস্থিতিতেই আমি এই গুরুতর অন্যায় কেনই বা বরদাস্ত করতাম? আমার স্বাভিমান আমায় বলছিল যে এমন কমিটি থেকে এক্ষুনি সরো।

এখন একটু ‘লাঠি আমাদের জিন্দাবাদ’ বা ডান্ডা কাল্ট (Danda cult) এর গল্প শুনুন। আমার সম্পর্কে এটা একটা ঐতিহাসিক উক্তি হয়ে গেছে। কার্যনির্বাহীর উপরোক্ত প্রস্তাবে তো এই উক্তির দিকে ইশারা করাই হয়েছিল, কানপুরে এক দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে স্বয়ং বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই উক্তির উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন যে আমি নাকি কৃষকদের বলে বেড়াই যে জমিদারদের স্পষ্ট বলে দাও – ‘কেমন করে খাজনা নেবে, লাঠি আমাদের জিন্দাবাদ’। কিন্তু আমার সব স্পীচের শর্টহ্যান্ড রিপোর্ট তো নিয়মিতভাবে দুজন সিআইডি ইন্সপেক্টর লিখত। তাই আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, ওই রিপোর্ট পড়ে প্রমাণ করুন তবে বুঝি! শ্রী মহাদেব দেসাই ‘হরিজন’ পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন। ওনাকে জবাবও আমি মুখের মত দিয়েছিলাম। হরিপুরা কংগ্রেসের সময় খবরের কাগজে বেরিয়েছিল সে জবাব। জানি না এই উক্তিটা কোত্থেকে এবং কিভাবে তৈরি করে আমার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। মিথ্যা প্রচারের একশেষ! বাহ, ধন্য সত্য আর ধন্য অহিংসা!

কিন্তু এটা অবশ্যই সত্যি যে আমি কৃষকদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে লাঠি বা ডান্ডা চালাতে বলতাম। করতামই বা কী? কৃষকেরা ভয়ে কাঁপত, জমিদারের আমলারা জুতো আর লাঠি দিয়ে ওদের পিটিয়ে বাড়ির সমস্ত জিনিষ লুট করে নিত। এমনকি বৌ-মেয়ের ইজ্জতও বাঁচত না। আমি হাজার বার সভায় ওদের বোঝালাম যে এটা বেআইনি, বন্ধ করুন। নইলে ভালো হবে না। কিন্তু কে শোনে? কৃষক তো মোকাবিলা করবে না। গরীব, দুর্বল কাজেই কেস-মোকদ্দমাতেও পেরে উঠবে না। কাজেই কিসের পরোয়া, এটাই ওরা ভাবত।

তখন আমি আত্মরক্ষার্থে লাঠি ইত্যাদি ব্যবহার করার কথা কৃষকদের খোলাখুলি বলা শুরু করলাম। এটাও বোঝালাম যে ফৌজদারী কার্যবিধি আইন এর সমর্থন করে। তখন গিয়ে কৃষকদের চোখ খুলল। দু-এক জায়গায় শয়তানদের ওরা শায়েস্তাও করল। ফলে ওই শয়তানি আর আতঙ্কের রাজত্ব সব সময়ের জন্য শেষ হল। এটাই আমার ডান্ডাবাদ বা ডান্ডাকাল্ট। এতে গান্ধিবাদিরা রাগল অবশ্যই। এমনকি আমার সঙ্গীরাও কাঁ-কাঁ করতে লাগল যে এবার এটা বন্ধ করুন। কিন্তু আমি স্পষ্ট বললাম, এ উপদেশ তো কৃষকদের জন্য অমৃত। কেন ছাড়ব? আর এটা তো আইনি অধিকার। তাহলে কী সমস্যা? লোকেরা বলল, কংগ্রেস এটা করতে মানা করে। আমি জবাব দিলাম যে ওই অহিংসা শুধু স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্যই।

কিন্তু এধারে অবস্থাটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে সর্বত্র অহিংসার নামে নপুংসকতার পাঠ পড়ান হচ্ছিল যে কোথাও কিছু বোল না। যদিও, গান্ধিজি নিজেই বলেছেন অহিংসার নামে নপুংসকতার থেকে হিংসা ভালো। তাও বার বার। কিন্তু শুনত কে? কিন্তু এটা প্রসন্নতার ব্যাপার যে ১৯৪০ সালের এই জুন মাসে ওয়র্কিং কমিটি আবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে অহিংসার ব্যবহার শুধুমাত্র স্বাধীনতার সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্য ক্ষেত্রে নয়। আজ আমাদের মালিকেরাও এটা পছন্দ করে। কেননা ওনাদের তো জার্মানির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রয়োজন, তাই না?

এটাই আমার ডান্ডাকাল্ট এবং ডান্ডাবাদ। আসলে আমি তো দন্ডী সন্ন্যাসী রূপেই পরিচিত। আমার কাছে বাঁশের একটা দন্ড হামেশাই থাকে। এখন অব্দি সেটা ধার্মিক ছিল। কিন্তু এখন রাজনৈতিক এবং আর্থিক হয়ে গেছে! তাই, সে বুদ্ধিতেই ওই দন্ড আমি নিজের করে রেখেছি। এই ডান্ডাবাদ ওই দন্ডের প্রতি আমার নতুন ভালোবাসা এবং আমার মনে ওটার নতুন গুরুত্বের জন্ম দিয়েছে। তাই বোধহয় এই ডান্ডাবাদ আমার নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার ছিল!

(১৪)

বড়হিয়া, রেওড়া

১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল অব্দি বিহারে কৃষকেরা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ লড়াই করেছে, যার জন্য শুধু কৃষকেরাই নয়, বিহারের কিসান-সভা প্রসিদ্ধি পেয়েছে। এমনিতে তো ছোট-মোট কয়েকশো সংঘর্ষ হয়েছে ওদের, জমিদার এবং সরকারের সঙ্গে। তার মধ্যে বড়হিয়া, রেওড়া এবং মাঝিয়াওয়াঁর বকাশ্ত সংগ্রাম (সত্যাগ্রহ) ঐতিহাসিক। ওই লড়াইগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কও ছিল আমার। তাই ওগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জরুরি।

বড়হিয়া – বড়হিয়া টালের আন্দোলন সবচেয়ে পুরোন। কংগ্রেসি মিনিস্ট্রি তৈরি হওয়ার অনেক আগে ১৯৩৬ সালের জুন মাসে শুরু হয়ে ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি অব্দি চলেছিল। এখনো ওখানে ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বলছে। বড়হিয়া মৌজা পাটনার পূর্বদিকে ই.আই.আর.এর স্টেশন এবং মুঙ্গের জেলার বিরাট বড় গ্রাম। তার দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম এবং রেললাইন থেকে দক্ষিণের লক্ষাধিক বিঘা জমিকে বড়হিয়া টাল বলা হয়। সেখানলার মাটি শক্ত কালো এবং তাতে শুধু রব্বির ফসল হয়। বর্ষাকালের শুরুতেই সমস্ত জমি জলে ভরে যায় এবং অক্টোবরে শুকোয়। মাটি চষার দরকার হয় না। শুধু বীজ রুয়ে দেওয়া হয় এবং ফাল্গুন-চৈত্রে তৈরি ফসল কেটে নেওয়া হয়। প্রচুর ফসল ফলে। তাই এক এক জন জমিদার খুব সহজে হাজারো বিঘা চাষ করে।

টালে দ্বীপের মত দূরে দূরে গ্রামের বসত। বর্ষাকালে নৌকো করেই যাওয়া আসা করা যায়। শুধু এক হড়োহড় নদী মাঝখান দিয়ে বয়। তারই জল খায় প্রায় সবাই। কুঁয়ো খুব কম, কোনো কোনো গ্রামে হয়ত আছে। ফলে নোংরা জল খেতেই হয়। ১৫ বছর ধরে মুঙ্গেরে কংগ্রেসের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড রয়েছে। কিন্তু গরীবদের খোঁজখবর কে নেয়? পাকা সড়ক বলতে কিছুই নেই। বাসিন্দা অধিকাংশ ধানুক, ঢাঢ়ি, মাল্লা ইত্যাদি। পুরোনো জমানায় ওরাই জমির মালিক ছিল। পরে বড়হিয়া এবং অন্যান্য গ্রামের জমিদারেরা ছলে-বলে-কৌশলে ওদের জমি ছিনিয়ে নিল। তবুও ভাগচাষের নামে সে জমি ওদের চাষ করতে দিত। ফলে প্রজাস্বত্ব আইন অনুসারে সে জমির ওপর কৃষকদের কায়েমি হক হয়ে গেছে। কেননা ১২ বছরের বেশি তো সবাই সে জমি চষেছে।

বিহারের জমিদারদের কব্জায় যে জমি আছে সেগুলো দুধরণের – জিরাত (সীর) এবং বকাস্ত (খোদকাস্ত)। ১৮৮৫ সালের আগে যে জমিগুলো জমিদারের চাষে লাগাতার ১২ বছর ছিল সেগুলোকে জিরাত বলা হয়। সেগুলো নির্দ্ধারিত। কমতে-বাড়তে পারে না। কিন্তু যে জমিগুলো এমনটা না হওয়া সত্ত্বেও কাগজে ওদের কব্জায় লেখা আছে সেগুলোই বকাস্ত। আইন এটাই যে লাগাতার ১২ বছর যে বকাস্ত জমিতে কোনো রাইয়ত (কৃষক) চাষ করবে সে জমির ওপর তার কায়েমি (occupancy) হয়ে যাবে। তেমন কৃষক আবার যে বকাস্ত জমি ১ বছরও চষবে, সেটাও তার কায়েমি হয়ে যাবে। আসলে কৃষকের কাছে কোনো মৌরুসি বা কায়েমি জমি থাকলেই যে জমি সে চষবে সেটা কায়েমি হবে। কোনো মৌজায় যার পরিবারে ১২ বছর ধরে লাগাতার চাষের কাজ চলছে, সে যেই বকাস্ত জমি চষে, তখনি সে জমির ওপর তার কায়েমি অধিকার হয়ে যায়।

এই আইন অনুসারেই টালের কৃষকদের অধিকার হয়েছিল জমির ওপর। কিন্তু সেটা ওরা জানত না। জমিদারেরাও কখনো ভাবে নি যে ওরা জমির ওপর হক চাইবে। জমিদারেরা সাধারণতঃ কারোর কাছেই কোনো প্রমাণ থাকতে দেয় নি যে সে জমি চষে। রসিদে বা কাগজে-টাগজে কিছু লিখে দিত না। সব কাজ মুখে মুখে চলত! তাহলে আর চিন্তা কিসের? তারা কংগ্রেসি আর প্রাইম মিনিস্টারের আদুরে! তাই, যাকে বলে ‘করলার ওপর নিম নয়, নিমের ওপর করলা চড়ে বসল’।

এদিকে কৃষক আন্দোলন যখন কৃষকদের মাঝে চেতনা আনল এবং তাদের অধিকার বোঝাল তখন তারা ওই জমির ওপর নিজেদের দাবি ঠুকল। জমিদারেরা সে দাবি সোজাসুজি অস্বীকার করল। ব্যস, এটাই কলহের মূল। কৃষক তো মোকদ্দমা লড়তে পারত না। কেননা কাগজে কোন প্রমাণ ওদের কাছে ছিল না। ফলে ওখানকার আমাদের যোদ্ধা পন্ডিত কার্যানন্দ শর্মার পরামর্শে ওরা সত্যাগ্রহ (সোজা টক্কর) শুরু করল। এধরণেরই বকাস্ত সত্যাগ্রহ বিহারের রেওড়া ইত্যাদি গ্রামে হাজারটা জায়গায় হয়েছে। কৃষকেরা, তাদের সেবকেরা মার খেল, হাড় ভাঙাল, জেলে গেল, লুন্ঠিত হল কিন্তু তাও দাবি করা জমি থেকে সরল না এবং মারপিটের কোন জবাবও দিল না। লাল উর্দি পরে শ’য়ে শ’য়ে নারী-পুরুষ পন্ডিত কার্যানন্দ শর্মার নেতৃত্বে এই সংগ্রামের সঞ্চালন করে গেল। মুখের হাসি বজায় রেখে তারা সবরকম কষ্ট সহ্য করল, স্বয়ং কার্যানন্দজিকে দুবার এই সংগ্রামে জেলে যেতে হল। দু-দুবার ঘোড়সওয়ার এবং অস্ত্রসজ্জিত পুলিস হামলা চালাল টালে। প্রথন বার ১৯৩৭ সালের মার্চে, শতাধিক সংখ্যায়, এবং দ্বিতীয় বার আবার ১৯৩৯এ ওই সময়েই। কখনো তিনজন কখনো পাঁচজন বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটও ওখানে লাগাতার মোতায়েন করা হল। সে ছাড়া, অক্টোবর-নভেম্বরে যখন ফসল বোনার সময় এল তখন তো বিশেষ করে পুলিস, ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঘোড়সওয়ার ওখানে পৌঁছোতেই থাকল।

শর্মাজি প্রথমবার ১৯৩৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হলেন এবং জুন মাসে ছাড়া পেলেন। তাঁর ওপর এবং ১৯ জন অন্যান্য সঙ্গীদের ওপর ১২০ বী, ১১৭, ১০৭ ইত্যাদি ধারায় মামলা চলেছিল। পরে সেসব শেষ হয়ে গেল। দু-আড়াইশো কৃষকও গ্রেপ্তার হয়েছিল। প্রায় সবার ওপর মিথ্যে মামলা চালানো হল। পরে অধিকাংশ খারিজ হয়ে গেল। দ্বিতীয় বার শর্মাজি ২রা মে ১৯৩৯এ গ্রেপ্তার হলেন। তাঁর সঙ্গীরাও গ্রেপ্তার হলেন।

টালের বিষয় নিয়েই ১৯৩৬ সালের অক্টোবরে মুংগেরে, ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখপুরায়, ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লক্ষীসরাইয়ে, ১৯৩৮এর নভেম্বরে লক্ষীসরাইয়ে এবং ১৯৩৯এর ফেব্রুয়ারিতে টালেই, পালিতে কিসান সম্মেলন হল। লক্ষীসরাই সম্মেলনে একশোজন কৃষকের যে জাঠা আসছিল তাদেরকে বড়হিয়ায় শ্রী পঞ্চানন শর্মার নায়কত্বে বিশ্রীভাবে মারধোর করা হল! এমনিতে তো টালের সত্যাগ্রহে বৃদ্ধ নারী-পুরুষেরও হাড় ভেঙেছিল। কিন্তু তারা এত শান্ত রইল যে সরকারের অফিসারদের বাধ্য হয়ে বলতে হল সত্যিই, এরাই শান্তি সেনা।

দ্বিতীয় গ্রেপ্তারীর পরেই পন্ডিত কার্যানন্দ শর্মা এবং শ্রী অনিল মিশ্র, ‘কৃষক-শ্রমিক বন্দীদের রাজবন্দী ঘোষণা করা হোক’ এই দাবিতে জেলে পুরো দেড় মাস অনশন করলেন। শেষে কংগ্রেসের মন্ত্রীরা তাঁদেরকে মরণাপন্ন মনে করে জেল থেকে ছাড়ল। ‘কৃষক বন্দী রাজবন্দী’ এই দাবির জন্য শ্রী রাহুল সাংকৃত্যায়নকেও দুবার, দশ দিন আর আঠেরো দিনের অনশন করতে হয়েছিল। শরীরের অবস্থা খারাপ হওয়ায় দুবারই উনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। এই একই দাবিতে শ্রী জগন্নাথ প্রসাদ এবং ব্রহ্মচারী রামবৃক্ষ (দুজনেই সারণ জেলার) জেলে পুরো ৯০ দিন ভুখ হরতাল করেছিলেন এবং মৃত্যুশয্যাতেই তাঁরা রেহাই পান। এ সমস্ত ঘটনা কংগ্রেসি মন্ত্রীদের সময়ে হল! কিন্তু ওরা ভ্রুক্ষেপ করল না! কৃষক বা শ্রমিক বন্দীদেরকে ওরা রাজবন্দী মানলই না।

প্রথম বার শ্রী কার্যানন্দ শর্মাজির গ্রেপ্তারীর পর পন্ডিত যদুনন্দন শর্মাকে আমরা প্রাদেশিক কিসান-সভার তরফ থেকে টালে পাঠালাম। উনি সেখানে চার দিকে ঘুরে দেখভাল করতে লাগলেন। আমাকে তো মনেও নেই কতবার টালে যেতে হয়েছে।

১৯৩৭ সালের জুন মাসে শ্রী রাজেন্দ্রবাবু, শ্রী কৃষ্ণ সিং প্রভৃতির একটি কমিটি গঠিত হল। তাঁরা কয়েকটা সিদ্ধান্তও নিলেন, যদিও কৃষকদের তাতে বেশি কিছু লাভ হওয়ার ছিল না। তা সত্ত্বেও আমরা কৃষকদেরকে সেসব সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার পক্ষে রায় দিলাম। কিন্তু জমিদারেরাই মানল না। পরে তো সে কমিটির সিদ্ধান্তগুলোই চেপে যাওয়া হল।

আবার ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে মুঙ্গেরের কালেক্টর একটা দ্বিতীয় পঞ্চায়েত তৈরি করল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সেটাকে দিল। সে পঞ্চায়েতও অনেক ধ্যাড়াল। শেষে অনেক কষ্টে, আর যখন দ্বিতীয় বার শর্মাজির সভাপতিত্বে মুঙ্গের কাছারিতেই ধরনা দেওয়ার জন্য কৃষকদের অসংখ্য জাঠার পর জাঠা রওনা দিতে লাগল তখন, শর্মাজির ও অন্যান্যদের গ্রেপ্তারীর পরেই কিছু করল। কোনো রকমে এক হাজার বিঘা জমি, তার ওপর কৃষকদের অধিকার বলে কৃষকদেরকে দিল। এখনও, আরো এক হাজার বিঘা থেকে কিছুটা বেশিই জমির ওপর কৃষকদের দাবি বহাল রয়েছে। কমিটি কিছু করতে পারে নি। হ্যাঁ, এরই মধ্যে বড়হিয়া টালের লাগোয়া কুসুম্ভা টালের ১৮০০ বিঘা জমির ওপর জমিদার, পাটনার কোন নবাব সাহেব, কৃষকদের অধিকার মেনে নিয়েছে।

১৯৩৬ সালের জুন মাসে টালের কৃষকেরা কালেক্টরের কাছে প্রথম দরখাস্ত পাঠিয়েছিল। তাদের দুটো জাঠা গিয়ে কালেক্টরের সাথে দেখাও করল। তারপরই জমিদারদের নাদিরশাহি শুরু হল এবং একেক ইঞ্চি জমি ছিনিয়ে নেওয়া হল। তারপর ১৯৩৭ পেরোতে না পেরোতে কমরপুরে কৃষকেরা প্রচন্ড মার খেল। অথচ উল্টে ৩২টার বেশি ১০৭এর কেস জমিদারেরা কৃষকদেরই বিরুদ্ধে রুজু করল। ব্যাস, পুরো গ্রাম খালি করে মানুষেরা শিশু, পশু সব নিয়ে রওনা হল। সঙ্গে লম্বা লম্বা পোস্টারে জমিদারের নাম এবং তার করা অত্যাচার মোটা মোটা অক্ষরে লেখা ছিল! কয়েক দিন ধরে হেঁটে তারা মুঙ্গেরে পৌঁছোল। রাস্তাতেই হট্টগোল শুরু হল। মুঙ্গেরে যখন প্রতিটি গলিতে স্লোগান তুলে ওরা ঘুরল তখন ভালোরকম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। শেষে কালেক্টরের চাপে কয়েকজন কংগ্রেসি নেতার একটি তৃতীয় কমিটি তৈরি হল পঞ্চায়েত করার জন্য। সে তো আজ অব্দি বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে।

এভাবে বড়হিয়া টালে জমিদারদের অনাগ্রহ এবং সরকার ও মন্ত্রীদের দুর্বলতার জন্য, বরং বলা যায় ওরা জমিদারদের উৎসাহ যোগাল আর সমস্যাগুলো ধামাচাপা দিয়ে রাখল বলেই কৃষকেরা ন্যায় পেল না। যদিও কৃষকেরা পৌরুষের সঙ্গে কষ্ট সইল এবং লড়াইটা লড়ল। পথপ্রদর্শকও ওরা পাকাপোক্ত পেল। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রৈপুরা গ্রামের। ওখানকার নারী-পুরুষের পৌরুষ দেখে তো আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু ওরা এক ইঞ্চিও জমি পেল না! ক্ষুধার্ত, নগ্ন ওরা! ধন্য তুমি ন্যায়! ধন্য তুমি শোষণ!

রেওড়া – ১৯৩৮ সালের শেষে পাটনা জেলার মসৌঢ়িতে পাটনা জেলা কিসান সম্মেলন হওয়ার ছিল। তার আগেই বড়হিয়া টালের পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হয়ে পড়েছিল। মন্ত্রীরাও কিছু করতে পারে নি আর পঞ্চায়েত কমিটি বা কংগ্রেসি লিডারেরাও কিছু করতে পারে নি। কৃষকেরা বিরক্ত হয়ে উঠছিল। খিদেয় মরছিল তারা। আমরাও কিসান-সভার তরফ থেকে এখনো অব্দি ওদের শুধু উপদেশই দিয়েছিলাম। এটা ঠিক যে বড়হিয়া টালের সত্যাগ্রহ ব্যক্তিগত ভাবে শর্মাজি এবং আমরা চালাচ্ছিলাম। কিসান-সভা খোলাখুলিভাবে লড়াইটা নিজের হাতে নেয় নি। আসলে কিসান-সভা তখনো অব্দি সত্যাগ্রহ অব্দি পা বাড়ায় নি। বিহারের সব জায়গায় এমনি অবস্থা ছিল। কংগ্রেসি মন্ত্রীদের জমানায় তো জমিদারদের সাহস আরো বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে কংগ্রেস-জমিদার চুক্তিগুলোর ফলে। তাই অত্যাচার বাড়ছিল। জমি ছিনিয়ে নেওয়া চলছিল বেধড়ক। ফলে কৃষক সব জায়গায় এসব দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। বিপদ ছিল যে যদি আমরা সভার তরফ থেকে ওদের শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে নিয়োজিত না করতাম, ওরা মারপিট এবং লুটপাট শুরু করে দিত। এদিকে দু-তিন মাস আগে থেকেই পন্ডিত যদুনন্দন শর্মা অতিষ্ঠ হয়ে রেওড়ায় (গয়া জেলার নওয়াদা সাবডিভিশনে ওয়ারিসলিগঞ্জ থেকে ৮-১০ মাইল উত্তরে) কৃষকদের প্রস্তুত করার জন্য নিজের ক্যাম্প খুলে দিয়েছিলেন। তাতে কিসান-সেবক ভর্তি করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।

রেওড়ার অবস্থা ছিল যে ওখানে প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমি ছিল এবং পুরোটাই জমিদার নিলাম করিয়ে নিয়েছিল। গ্রামে ৫-৬ শো মানুষ কানি পরে খিদেয় মরছিল। ব্রাহ্মণদের মেয়েরা বিক্রি হল আর জমিদার সেই বিক্রির টাকা থেকেও আদ্ধেক নিয়ে নিল জমিদারি হকে! আর বাকিটুকু খাজনায়! তারপরও জমি বাঁচল না। কয়েকজন বৃদ্ধা যাঁরা বেঁচেছিলেন, নিজেদের কাহিনী শোনালেন। কোথাও ঘরের চালে লাউ ফলল তো একটা জমিদারের হয়ে গেল! দুটো ছাগল হল তো একটা তার! গাঁয়ের লোকেদের কাছে একবার সে দুধ চাইল। কিন্তু পেল না। ছিল না। তখন সে নাকি বলল, যা আমি শুনলাম, মহিলাদের দুয়ে আনো!

জমিদারের কাছে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে, মন্ত্রী আর লিডারদের কাছে দৌড়ে দৌড়ে কৃষকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শেষে ওরা পন্ডিত যদুনন্দন শর্মাকে পাকড়াও করল। উনিও জমিদারকে অনেক বোঝালেন। বিঘা প্রতি তিরিশ টাকা সেলামি দিয়েও জমি নিতে তৈরি হল কৃষকেরা। এটা হলে এক বারে চল্লিশ হাজার টাকা পেয়ে যেত জমিদার! কৃষকেরা কর্জ-টর্জ নিয়ে বা যে কোনো ভাবে দিতই টাকাটা! কিন্তু কে শোনে!

তখন শর্মাজি বললেন, খেত চষো আর যেটুকু ধান রুয়েছ, ফসল কেটে নাও। কৃষকেরা জবাব দিল, আমরা উপদেশ চাই না। আমরা তো ভেবেছিলাম আপনি কোনো পথে এগিয়ে দেবেন। কিন্তু যখন আপনিও লেকচারই দেবেন, তখন যান। আমাদের মরতে দিন। আর কিছু না হয় তো আগে আপনি লাঙল নিয়ে চলুন, ক্ষেত চষুন। ধান কাটুন। পিছনে আমরাও থাকব, আপনার সাথেই মরন। শর্মাজির মনে কথাটা ধরে গেল আর ওখানেই থেকে গেলেন। আমায় খবর পাঠিয়ে দিলেন যে এবার আমি জেলে যাব। এমনটাই অবস্থা। আপনি একবার আসুন আর দেখে যান। না জিজ্ঞেস করে এগিয়ে গেছি, ক্ষমা করবেন। আসলে দুই শর্মা (কার্যানন্দ আর যদুনন্দন) তখনো অব্দি আমায় জিজ্ঞেস না করে এধরণের পদক্ষেপ কখনো নেয়ও নি আর বিশেষ কোনো কাজও করেনি। আমি গেলাম সেখানে। পঁচিশ হাজার কৃষক – নারী, পুরুষ ও বালকদের অপূর্ব সভা ছিল! আমিও অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেলাম।

তারপর মসৌঢ়ি কনফারেন্সের সময় বক্তব্যে আমি প্রথমবার রাখলাম যে এখন আর কোনো উপায় নেই – কিসান-সভাকে এগোতে হবে এবং কৃষকদের সোজাসুজি লড়াই, সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দিতে হবে। নইলে কৃষকেরা আমাদের প্রতিও হতাশ হয়ে পড়বে; ভাববে যে আমরা শুধু লেকচার দিয়ে বেড়াই। এইসব লেকচার আর প্রস্তাব তো লেখাপড়া জানা লোকেদের জন্যই। ওরা এসবে ক্লান্ত হয় না। কিন্তু জনগণ তো সর্বদাই কাজ করে এবং কথা বলে কম। তাই ওদের কাজ দেওয়া এবার আমাদের কর্তব্য। আমরা কংগ্রেসি মন্ত্রীদের বিরক্ত করার জন্য নয়, নিজেদের অস্তিত্ব কায়েম রাখার জন্য এবং নিজেদের কর্তব্য পুরো করার জন্যই এগোব। এবং নিশ্চয়ই এগোব।

ব্যস, মন্ত্রী আর জমিদারদের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। আমায় অনেক কিছু ভালো-মন্দ শুনতে হল। কিন্তু সম্মেলনে আমি অ্যাপিল করলাম যে রেওড়া যেন সব কৃষকের তীর্থ হয়ে ওঠে। ডাক আসতেই যেন কৃষক পায়ে হেঁটে চার দিক থেকে দৌড়ে পৌঁছোয়। অন্ন, ধান দিয়ে সাহায্য করে। তেমনটাই হল। শয়ে শয়ে লোক ওখানে খাবার খেতে থাকত। জেলে যাওয়ার জন্য ভীড় ছল মানুষের। আমিও মাঝে মধ্যেই ওখানে যেতাম। শর্মাজি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তো ওখানেই থাকতে শুরু করলাম। প্রাদেশিক কিসান কাউন্সিলের একটি বৈঠকও হল ওখানে। সমস্ত কৃষক নেতা এবং কর্মীরা জমা হল। সরকার চিন্তায় ছিল। শয়ে শয়ে পুলিশের জওয়ান, তাদের অফিসার, গুপ্তচর এবং দুজন ম্যাজিস্ট্রেট ওখানে মোতায়েন ছিল। কিন্তু কৃষকেরা এগিয়ে চলল।

ওখানকার নারীরা আমাদের বিশ্বাস যোগাল। বলল পুরুষেরা পিছিয়ে যায় তো যাক। আমরা তো আপনার সঙ্গ দেব সবসময়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিন্টেকার সাহেব আমায় ওখানে হারাতে এসেছিলেন। নিজেই হেরে বিলেতে চলে গেলেন! সবার তাজ্জব লাগছিল যে কী হয়ে গেল! ওদের তো ওখানে খাবার পাওয়া অসম্ভব ছিল। অন্যান্য গ্রামে থাকত! তাও দুর্দশায়! জমিদার লাঠির বাড়ি খাওয়া সাপের মত ফোঁস ফোঁস করছিল, কিন্তু বেকার। রেওড়া জমিদার এবং সরকার, দুপক্ষের জন্যই আতঙ্ক হয়ে উঠল!

গয়া জেলা কংগ্রেস কমিটিও আমাদের সত্যাগহের সমর্থন করেছিল। ব্যস, প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি রেগে উঠল এবং কার্যনির্বাহী প্রস্তাব গ্রহণ করে ওদেরকে বকল। আজ্ঞা না নিয়ে চালিয়ে যাওয়া সত্যাগ্রহকে ওরা অবৈধ সাব্যস্ত করল।

এতে আধিকারিকেরা সাহস পেল। স্পেশ্যাল ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে বুক ফুলিয়ে আমাদের সে প্রস্তাব দেখাল। আমরা হেসে বললাম এসব অনেক দেখেছি। তখন তিনি সাহস হারালেন।

কৃষকদের মনোভাব এমন ছিল যে ওদের যে কেউ কিছু প্রশ্ন করলে বা মিটমাটের কথা বললে মুখ ফিরিয়ে নিত আর বলত পন্ডিত যদুনন্দন শর্মাকে জিজ্ঞেস করুন। আমরা তো ওনারই হুকুম মানব। কারোর কোনো কথা চলল না আর শেষ অব্দি আমরা জিতলাম।

কৃষকেরা জমি পেল – সে জমি চাষা, রাখাল সবাইকেই দেওয়া হল। একটা ঘরও জমিহীন থাকল ন। শর্মাজির সঙ্গে কালেক্টর হিন্টেকার সাহেব জমিদারদের তরফ থেকে চুক্তি করলেন। কেননা জমিদার লিখিতভাবে ওনাকে অধিকার দিয়েছিল। প্রায় দেড়শো বিঘা জমিদারকে দিয়ে বাকি জমি কৃষকেরা পেল। কংগ্রেসের বকাস্ত তদন্ত কমিটি দেড়শো বিঘার ওপর জমিদারের কব্জা দেখিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে অতটা জমি দিতে হল। কিছু করার ছিল না। নিজেদেরই কমিটি আগে বলেছিল এমন।

রেওড়ায় তো আগে যে মুহুর্তে কৃষক ক্ষেতে যেত, পুলিস লাঙল ইত্যাদি ছিনিয়ে নিয়ে যেত। কেননা নোটিশ সাঁটিয়ে ক্ষেত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। পরে, এক-একটা লাঙল দশ-কুড়িজন কৃষক জাপটে ধরত; কিছুতেই ছাড়ত না, কেননা ছেড়ে দিলে তাতে গরীবেরই ক্ষতি। তাতেই পুলিস হার মানল! যেদিন সব ক’জন কৃষক নেতা ওখানে ছিল সেদিন মহিলারা এমন কামাল সত্যাগ্রহ করল যে পুলিস লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, জমিদারির নাশ হোক’এর স্লোগান মহিলারা তুলল, পুলিশের সামনেও, পেছনেও। আসলে পুলিস মহিলাদের লাঠা [মাপের বাঁশ] থামাতে গিয়েছিল। কিন্তু মহিলারা দল বেঁধে শক্ত ভাবে রইল এবং লাঠা চালাতে থাকল। সেটাই শেষ টক্কর ছিল। তারপর তো আর পুলিশের হিম্মত হল না। আমরা সমস্ত কিছু দেখছিলাম এবং দূরে দাঁড়িয়ে হাসছিলাম। পরে কাছেও গেলাম।

ত্রিপুরি কংগ্রেসের সময় শর্মাজি এবং তাঁর সঙ্গীরা জেল থেকে ছাড়া পেলেন। লড়াই যখন চলছিল, সরকার হাজার বার লোভ দেখাল যে দফা ১৪৫এ ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে ফয়সালা করিয়ে দেবে। তারিখ রাখল। খবর পাঠাল। কৃষকেরা গেল না তো গেলই না। তবে শেষে জয় হল।

মাঝিয়াওয়াঁ এবং অন্যান্য জায়গা -  এ লড়াইগুলো বাদে গয়ারই মাঝিয়াওয়াঁ, আনুয়াঁ, আগদা, ভালুয়া, মাঝোয়ে, সাঁড়া ইত্যাদি গ্রামগুলোয় কৃষকেরা সফলভাবে সত্যাগ্রহ সংগ্রাম করল। এছাড়া শাহাবাদের বড়গাঁও, দরিগাঁও প্রভৃত গ্রামে, সারণ জেলার আমোয়ারি, পরসাদি, ছিতৌলি, দ্বারভাঙার রাধোপুর, দেকুলি, পন্ডৌল, পড়রি (বিথান), পাটনার দরমপুরা, অঙ্কুরি, জলপুরা, তরপুরা, বেলদারিচক প্রভৃত গ্রামেও কৃষকেরা দৃঢ়তার সাথে এই লড়াই চালাল। চম্পারণ এবং ভাগলপুরেও লড়াই হল এবং লোকে জেলে গেল। পুর্ণিয়া তো খুবই পিছিয়ে আছে। ওখানে না কিসান-সভা মজবুত না তেমন কর্মী আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে মুজফফরপুরে কোনো সংগ্রামও হল না আর এদিকে কিসান-সভার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজও দেখা গেল না। যখন নাকি সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান নেতারা ঐ জেলারই। এদিকে ওখানকার কিসান-সভা নিজের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণও দেয় নি, দুঃখের কথা।

মাঝিয়াওয়াঁয় তো আসলে মহিলারাই সত্যাগ্রহ করল আর শুধু ওই গ্রামের নয়, বরং আশেপাশের গ্রামের মহিলারা তাতে পুরোপুরি সহযোগিতা করল। যখন টেকারি রাজের গুন্ডারা লাঠি নিয়ে ওদেরকে ক্ষেত থেকে সরাতে গেল, ওরা শক্তভাবে ওখানেই রইল। গুন্ডাগুলোকে দু-তিনজন করে মিলে আছাড়ও দিল। আর যখন জমিদার ভাড়ার মহিলাদের পাঠাল তখন ওই সাহসী নারীরা এই ভাড়াওয়ালিগুলোকে কথায় কথায় ভাগিয়ে দিল। পাটনার দরমপুরাতেও মহিলারা এবং শিসগুরাই লড়াই জিতল। তেমন বাহাদুরি আর কোথাও আমি দেখতে পাই নি।

সাঁড়াতেও মহিলারা পুলিশের ঘেরাবন্দী ভেঙে ক্ষেতে লাঙল চালাল আর পুলিশদের পালাতে বাধ্য করল। আনুয়াঁতে ক্ষেতেই কুঁড়েঘর বানিয়ে বাল-বাচ্চাদের সাথে সব কৃষকেরা থাকতে শুরু করল। তখন সব চেষ্টা করেও সরকার হেরে গেল। কৃষকেরা ১৪৪, ১৪৭ আর ১০৭ প্রভৃতি ধারারও পরোয়া করল না। কাছারিতেও গেল না, জেলেও গেল না। ওরা বলল হয় এটাকেই জেল বানিয়ে দিন অথবা পশু ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের জেলে নিয়ে চলুন। এদেরকে ছেড়ে আমরা কোথায় যাব?

দ্বারভাঙার রাঘোপুরে তো গুলিও চলল। কিন্তু রক্তে রক্তাক্ত হয়েও কৃষকেরা দৃপ্তভাবে ওখানেই রইল। পন্ডৌলের সত্যাগ্রহ তো অদ্ভুত হল। ওখানেই দ্বারভাঙা মহারাজকে শিক্ষা নিতে হল। দেকুলিতে শয়ে শয়ে কৃষক জেলে গেল। তাদেরকে বরবাদ করা হল। কিন্তু ওখানকার সুদখোর জমিদারকে ওরা নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়ল। এমন দারুণ বহিষ্কার করা হল যে একটা লোকও পাওয়া অসম্ভব হয়ে গেল তার পক্ষে! বিথানে দ্বারভাঙা মহারাজের যে নাদিরশাহি চলছিল গরীবেরা সে নাদিরশাহি মাটিতে মিশিয়ে দিল আর জমিদারির জৌলুস শেষ করে দিল। আমাদের সমস্ত প্রধান কর্মী লাগাতার জেলে বন্দি ছিল, তবুও তাদের মনোবল ভাঙল না।

আমোয়ারির ঘটনাবলি তো রাহুল সাংকৃত্যায়নের উপবাসের জন্য ভালোই খ্যাতি পেল। উনি দু’বার জেলে গেলেন এবং প্রতিজ্ঞা অনুসারে উপবাস করলেন। প্রথম বার তো সরকার (কংগ্রেসি) কৃষক বন্দীদের রাজবন্দী মানতে প্রায় তৈরিও হয়ে গিয়েছিল। শুধু রাজবন্দীর পরিভাষা নিয়ে তাদের অসুবিধে ছিল। সেটারও প্রায় প্রায় সমাধান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে চুপ করে গেল সরকার।

রাজবন্দী হিসেবে মান্যতা পাওয়ার জন্য শুধু এমন নয় যে আমাদের ৮-১০ জন প্রধান কর্মীই প্রাণ পণ করেছিল, পুরো প্রদেশেই আমরা তীব্র আন্দোলন করলাম, দিবস উদযাপন করলাম। অখিল ভারতীয় কিসান-সভাও এতে আমাদের সঙ্গ দিল। কিন্তু সরকারের কোনো হেলদোল দেখা গেল না।

ওই আন্দোলন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখলাম। কংগ্রেসি নেতাদের মনোভাবেরও পুরো ঝলকটা আমরা দেখতে পেলাম। এটাই কম ছিল নাকি? আমোয়ারির সত্যাগ্রহ থেকেই সেটা শুরু হল এবং পুরো প্রদেশে কথাটা ছড়িয়ে পড়ল।

আমোয়ারিতে শ্রী রামবৃক্ষ ব্রহ্মচারী নারী ও পুরুষদেরকে নিয়ে যে অপূর্ব সংগঠন দাঁড় করালেন এবং সেখান থেকে সীওয়ান অব্দি ১৪ মাইল হাঁটা মিছিলের যে সুন্দর ব্যবস্থাপনা করলেন, যাতে নারীরা লাল কাপড় পরেছিল, সীওয়ান শহরে আমরা সে মিছিলের যে গুরুত্ব দেখলাম এবং ওখানে লোকেদের ওপর তার যে প্রভাব পড়েছিল … সেসব কথা চিরস্মরণীয় থাকবে। যখন সেই ব্রহ্মচারীজিকেই মধ্য রাতের পর পুলিস গ্রেপ্তার করতে এল, মহিলারা ঘিরে এমনভাবে রুখল যে পুলিস হতবাক হয়ে গেল। পরে বোঝানোর পর তাদেরকে অনেক কষ্টে সরান গেল। ব্রহ্মচারীজি তো ইস্পাতে তৈরি। কৃষক বন্দীদের প্রশ্নে পুরো ৯০ দিন ক্ষুধার্ত রইলেন এবং মৃত্যুশয্যাতেই ছাড়া পেলেন। শুধু ওনার গ্রাম সবলপুর নয়, কিসান আন্দোলন এবং আমিও তাঁর মত সঙ্গী পেয়ে গর্বিত। শ্রী কার্যানন্দ, শ্রী যদুনন্দন, শ্রী রাহুলজির মত গোনাগুনতি সঙ্গীদের মধ্যে উনিও রয়েছেন। নিঃসন্দেহে যেমন মুঙ্গেরের জন্য কার্যানন্দ আর গয়ার জন্য যদুনন্দন, তেমনই সারণের (ছাপরা) জন্য রাহুলজি এবং তিনি তেমনই এক সঙ্গী পেয়েছেন। 

(১৫)

এই লড়াইগুলো থেকে শিক্ষা

এই সব লড়াইয়ে দু’হাজারের বেশি কৃষক এবং কিসান-সেবক, নারী, পুরুষ এবং শিশুরা জেলে গেল। প্রচন্ড মার খেল। কয়েকজন মারাও গেল। কিন্তু কৃষকেরা সাহস হারাল না, অবিচল রইল। আজও তেমনই সাহস রয়েছে ওদের বুকে। ওরা দেখিয়ে দিয়েছে যে রণক্ষেত্র তৈরি, আমরা তৈরি। নারীরা যে পরাক্রম দেখাল সেরকম কিছু দেখার সুযোগ তো আমরা অন্য কোন ভাবেই পেতাম না। কৃষকদের মধ্যে শ্রেণীর চেতনা এমন জেগে উঠল এবং দূর-দূরান্তের কৃষকেরা এমন ভাবে তার শরিক হল যে সবার তাজ্জব হল। চাষা, রাখাল, ভূমিহীনেরাও তাতে শামিল হল। সব জাত এবং সব ধর্মের লোকেরা অংশগ্রহণ করল। দ্বারভাঙায় তো হাজীরাও জেলে গেল।

আমি এদিকে সদ্য পাটনার বেলদারিচকে দেখলাম যে দুজন কৃষককে ক্ষেতেই গুলি করে মারা হল। কিন্তু অন্যান্য কৃষকেরা শান্ত রইল এবং নিজেদের কাজে ব্যস্ত থেকে গেল। ফলে জমিদারকে পুলিসের ভয়ে লুকোতে হল। কৃষকদের কখনো এমন অসুবিধে হয় নি। কিন্তু যেই একটু বেচাল হয়, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দিশেহারা দৌড় আর সমস্ত পরিশ্রম বরবাদ হয়ে যায়। ঘর-গেরস্থালিও শেষ হয়। তাই মোতিহারির প্রাদেশিক সম্মেলনে আমিই প্রস্তাব রাখলাম যে যে কোনো পরিস্থিতিতে – এমনকি হামলা হলেও, বর্তমান অবস্থায় পূর্ণ শান্তি বজায় রাখা জরুরি। কেননা জমিদারেরা ভাবছে, হামলা করব আর যদি কৃষকেরা জবাব দেয় তাহলে খুনখারাপিতে ওদের ফাঁসিয়ে আতঙ্কিত করে দেব। শ’খানেক জায়গায় যদি এমনটা হয় তাহলে তো পুরো আন্দোলনটাই চাপা পড়ে যাবে। তাই বর্তমান অবস্থায় সাধারণ ভাবে, এমনকি আত্মরক্ষার জন্যও হিংসা না করার প্রস্তাব দিলাম।

এই লড়াইগুলোয় আমরা মোকদ্দমা লড়তে অস্বীকার করেছিলাম। এমনিতেও কৃষকদের পক্ষে সাধারণতঃ মোকদ্দমা লড়াই অসম্ভব। আসলে সত্যাগ্রহ সংগ্রামে মনোযোগ নিবদ্ধ করা এবং ত্যাগের ভাবনা আর সাহস বাড়িয়ে তোলাটা উদ্দেশ্য ছিল। কেস লড়লে আমাদের মনোযোগ বিঘ্নিত হয় আর মনে দুর্বলতাও চলে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর যখন ধীরে ধীরে সেই শক্তিটা চলে এল তখন আমাদের ওই নীতিটা আর পছন্দ হল না এবং প্রয়োজন বুঝে মোকদ্দমাও লড়ে নিলাম। সব মিলিয়ে তাতে লাভই হল। এখন তো আমি স্থির করে নিয়েছি যে আইনি অস্ত্রের যত সাহায্য নেওয়া সম্ভব নেওয়া হোক। কেননা আমাদের সত্যাগ্রহ গান্ধিজিওয়ালা তো আর নয়! আমরা তো এতে শান্তির নীতি গ্রহণ করেছি শুধু লাভ দেখে। কিন্তু কেস না লড়লে আমাদের ভালো ভালো কর্মীদেরকেই জেলে পুরে দেওয়া হয় যাতে পথপ্রদর্শকের অভাবে সব লড়াই বন্ধই হয়ে যায়। তাই আমি মানি যে প্রয়োজন বুঝে কেস লড়া উচিৎ এবং জামিন দিয়ে কর্মীদের বাইরে আনা উচিৎ।

সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল যখন লড়াই শুরু করে মিটমাটের কথা বলতে প্রবৃত্ত হলাম। আকছার সব জায়গায় এমনটাই হল। কখনো অস্বীকার করলাম না। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলল প্রবৃত্তিটা ভালো নয়। ওতে ফাঁসিয়ে জমিদার এবং আধিকারিকেরা আমাদের বড় বেশি নাজেহাল করল। দ্বারভাঙায় তো আমাদের লোকেদের খুবই তিক্ত অনুভব হল। কমবেশি একই অবস্থা হল অন্যত্রও। গয়াতেও সেরকমই কিছু একটা হল। এমনকি রেওড়াতেও পরে আমাদের অনেক অসুবিধের সম্মুখীন হতে হল। ওখানেও এখনো অব্দি কিছু না কিছু ঝামেলা চলছেই। তাই আমি তো এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছি যে সাধারণভাবে, লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার পর আমাদের মিটমাটের ঝামেলায় পড়াই উচিৎ নয়। হেরে যাব, হেরে যাব। এমন সময়ে হেরে গেলেও লাভ হয়। কেননা নিজেদের দুর্বলতাগুলো জানা হয়ে যায়।

আমরা এটাও দেখলাম যে অবিচল থেকে মনে ভরসা রেখে যদি কাজ করি তাহলে টাকা, অন্ন বা মানুষের অভাবে কাজ থামে না। এই তিনটে জিনিষ কৃষকই পাইয়ে দেয়, তাও সহজেই। আমাদের বড় ভূল হয় যখন জনগণের লড়াই আমরা পরের পয়সায় এবং লোকবলে জিততে চাই। সে জয় যদি হয়ও, আমি তাকে পরাজয় মানি। কেননা কৃষক সে লড়াইয়ে স্বাবলম্বী হবে না, আর লড়াইয়ের আসল উদ্দেশ্য তো সেটাই! পরের শক্তিতে যে হক পেয়েছি সে হক তো কখনো আবার কেউ ছিনিয়ে নেবে। আমি তো কৃষকদের দেখেছি যে ওরা সবকিছু করতে পারে, খিদেয় মরেও আমাদের সাহায্য করতে পারে যদি আমাদের মধ্যে, নেতাদের মধ্যে ভরসা এবং দৃঢ়তা থাকে। সে ভরসা যদি না থাকে তাহলে নিশ্চিত আমরা হারব, এই সত্যটাও অনুভব করলাম।

(১৬)

কুমিল্লা, হরিপুরা, গয়া এবং পলাসা

১৯৩৮ সালের মে মাসে অখিল ভারতীয় কিসান-সভার তৃতীয় অধিবেশন বাংলার পূর্ব সীমান্তে কুমিল্লায় হল। আমিই তার সভাপতি ছিলাম। আমার ভাষণ ইংরেজি, হিন্দি এবং বাংলায় ছাপা হয়েছিল। সে ভাষণ নিয়ে কিসান-সভার কয়েকজন বিরোধী – যাদেরকে বামপন্থী বলা হয় – পরে কিছু কটাক্ষও করেছিল। আমায় তার কড়া জবাব দিতে হয়েছিল। লোকে বলে মুসলমানরা কিসান-সভা চায় না, বিশেষ করে বাংলার মুসলমান। কিন্তু কুমিল্লা জেলায় তো ৯৫ প্রতিশত মুসলমান! ওখানে সরকার, [ফজলুল] হকের মিনিস্ট্রি এবং কথিতরূপে কিছু আপন মানুষেরাও খুব প্রচার চালিয়েছিল কিসান-সভার বিরুদ্ধে। এমনকি সরকার, সভা না হতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানান অসুবিধে সামনে রাখল। কিন্তু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিসান-সভার সঙ্গীদের সজাগ দৃঢ়তা এবং অক্লান্ত উদ্যমে সভার কাজ প্রসন্নতার সাথে সম্পন্ন হল। যে পরিস্থিতিতে তারা সাফল্য অর্জন করল সেটা অসাধারণ ছিল।

আমার পৌঁছোনোর পর এক অতুলনীয় মিছিল স্টেশন থেকে বেরিয়ে শহরে ঘুরল। বিরোধীরা ভাবেও নি এমন সফল হবে মিছিল। কাজেই একটা থাপ্পড় খেল ওরা। তখন সমস্ত শক্তি লাগাল সভা যাতে সফল না হয়। শহরের চার দিকে গুন্ডারা দাঁড়িয়ে গেল এবং মেরেধরে আসতে থাকা কৃষকদের দলকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। আমাদের প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীরাও শহরে রাস্তায় চলতে গিয়ে মার খেলেন এবং কেউ কুশল জিজ্ঞেস করার ছিল না। চার দিকে মুসলিম লীগওয়ালারা হাল্লা করছিল এবং মিছিল বার করছিল। কখন কে মার খেয়ে যাবে সে বিপদ ছিল সর্বক্ষণ! তবুও কৃষকেরা এল এবং ভালোরকম এল। ওখানে যখন আমি ধর্মের ধাপ্পাবাজির হাঁড়ি ভাঙলাম তখন মুসলমান কৃষক এবং মৌলবিরা আমার কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল! লাফিয়ে উঠল তারা! আমি স্পষ্ট বোঝালাম কি করে রুটি খোদার থেকেও বড়।

আমার ভাষণের বাংলা অনুবাদ মাঝে মাঝে আমার সঙ্গী শ্রী বঙ্কিম মুখার্জি করে যাচ্ছিলেন। কেননা লিখিত ভাষণের বাইরে আমি মৌখিকও বলেছিলাম। কিন্তু যখন আবার শেষে আমায় বলতে বলা হল তখন আমি এক শর্তে বলা স্বীকার করলাম যে আমার ভাষণের যেন বাংলা অনুবাদ না হয়; আমার সহজ হিন্দিই যেন কৃষকেরা বোঝে। ওরা শর্ত স্বীকার করে নিল এবং আমাকে ডেকেই ছাড়ল। ওখানেই ‘ওরে ভাই চাষী, সত্য কথা শোন’ বলে বাংলা গানটা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জানিনা কতবার গানটা গাওয়ালাম!

কুমিল্লার যাত্রাপথে বাংলায় কে জানে কত স্টেশনে বাঙালি যুবকদের দল পেলাম যারা অভ্যর্থনা করতে এসেছিল। অনেকগুলো অভিনন্দনপত্রও পেলাম। আমি আশ্চর্যচকিত হয়ে পড়ছিলাম। পূর্ববাংলায় বা বলা যায় বাংলায়ই এটা আমার প্রথম সফর ছিল। ওরা আমার সাথে পরিচিতও নয়। সামান্য যে কাজ করেছিলাম কৃষকদের মাঝে এটা তারই ফল ছিল।

এ ব্যাপারটা ভালোও এবং খারাপও। ভালো তো এই জন্য যে সার্বজনিক সেবকেরা উৎসাহ পায়, এবং এরই বলে তারা কঠোরতম ক্লেশ সহ্য করতে পারে। কিন্তু ক্ষতি এই যে এভাবে বর্ষার ব্যাঙের মত নেতাদের সংখ্যা আমরা বাড়িয়ে দিই। যাকে আমরা ভালো করে পরখ করলাম না, ঠুকে-বাজিয়ে কাজেরও করলাম না, তাকে এমনিই নেতা মানব কেন? পরে যদি ধোঁকা দেয়? আজকাল তো কৃষক আর শ্রমিকদের সংগ্রামে সবচেয়ে বড় বিপদ আসে নেতাদের তরফ থেকেই।

কুমিল্লা যাওয়ার আগেই ওড়িশায় পন্ডিত নীলকন্ঠ দাস ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মে একটা গোলমাল পাকিয়েছিলেন। স্বাধীন কিসান-সভার বিরোধ করে বলেই ফেলেছিলেন যে যে কংগ্রেসের মেম্বার নয় সে কিসান-সভারও মেম্বার হবে না – এমনই কিসান-সভা চাই। আমি ওনাকে জবাব দিলাম যে কংগ্রেস আর কিসান-সভার দৃষ্টিভঙ্গিতে যে মৌলিক পার্থক্য আছে তাই আপনি জানেন না। কংগ্রেস রাজনীতির আয়নায় অর্থনীতি এবং রুটিকে দেখে এবং রাজনীতি থেকেই ওই প্রসঙ্গে আসে। অর্থনীতি আর রুটির প্রশ্নকে নিজের প্রশ্ন করে রাজনীতির সাধন হিসেবে। যখন নাকি কিসান-সভা অর্থনীতি আর রুটিরই আয়নায় রাজনীতিকে দেখে এবং সাধন মনে করেই সেটা অব্দি পৌঁছোয়। তাই স্বাধীন কিসান-সভা হওয়া অনিবার্য।

পন্ডিত জহরলাল রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি বক্তব্যে স্বাধীন কিসান-সভার সমর্থন অবশ্যই করেছিলেন কিন্তু লাল ঝান্ডাকে আক্রমণ করেছিলেন। বলেছিলেন কৃষকদের ঝান্ডা তেরঙাই হওয়া উচিৎ। ঠিক এর পরেই, ১৯৩৭ সালেই অল ইন্ডিয়া কিসান কমিটির বৈঠক হল গয়ার নেয়ামতপুর আশ্রমে। সে কিসান কমিটি কিসান-সভা সম্পর্কে আমার ওড়িশায় দেওয়া বক্তব্যের সমর্থন করে ঝান্ডার প্রশ্নে পন্ডিত নেহরুকে লম্বা জবাব দিল। লাল ঝান্ডার সমর্থনও করল। ওখানেই অল ইন্ডিয়া কিসান সভার বিধান আমরা পাশ করলাম। তারপর নভেম্বরে কলকাতায় কমিটির আবার বৈঠক হল এবং প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল যে কৃষক লাল ঝান্ডাই রাখবে।

১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি গুজরাটে প্রথম সফর করলাম। হরিপুরা কংগ্রেসের সময় কৃষকদের জাঠা পায়ে হেঁটে আসবে এবং সুন্দর একটা সমাবেশ হবে তার প্রস্তুতিও নিলাম। শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিক এবং তাঁর সঙ্গীদের অদম্য উৎসাহ ও কর্মতৎপরতার ফলে সে সমাবেশ অভূতপূর্ব হল। ২০-২৫ হাজার কৃষকেরা তাতে অংশগ্রহণ করল। সর্দার বল্লভভাইয়ের আজ্ঞা ছিল যে কংগ্রেস নগরে কেউ মিছিল বার করতে পারবে না। কিন্তু আমরা সে আজ্ঞা মানলাম না এবং খুব ভালো করে মিছিল ঘোরালাম। সন্ধ্যেবেলায় সভা করলাম, ভাষণও হল।

গুজরাটের সে সফরে জানতে পারলাম যে বারদৌলির কিসান সত্যাগ্রহ মাত্র ১০-১৫ প্রতিশত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং ধনী কৃষকদের ব্যাপার ছিল। সেখানকার আসল কৃষককে তো রানিপরজ, দুবলা আর হালি বলা হয়। এদের জমি ছিনিয়ে মাত্র ১০-১৫ প্রতিশত লোকেদের হাতে চলে গেছে। আসল কৃষকেরা তো ফসলের আদ্ধেক ভাগে দিয়ে সেই ওদেরই, ধনীদেরই কাছ থেকে ওই জমিগুলোই আবার নেয় আর চাষ করে। এমন জুলুম যে চিনেবাদাম এবং তুলোর ফসল থেকেও আদ্ধেক দিতে হয়। যদি ফসল নষ্ট হয় তাহলে ওদের নগদ টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। ওদের দিকে এখনো অব্দি না সরদার বল্লভ ভাইয়ের চোখ গিয়েছে, না গান্ধিজির আর না কংগ্রেসের।

এই হালি আর দুবলারা মহাজন আর ধানিদের গোলাম হয় এবং তাদের অনুমতি না নিয়ে কোথাও যেতে আসতে পারে না। যদি যায় তাহলে ধরে ফিরিয়ে আনা হয়। কেউ ওদের রাখেও না।

আমার সফর গুজরাটের বেশ কয়েকটি জেলায় খুব সফল হল। সে বছরই গুজরাট প্রাদেশিক কিসান-সভার ভিত তৈরি হল। শ্রী ইন্দুলাল এবং তাঁর সঙ্গীদের কর্মনিষ্ঠায় আজ তো সে কিসান-সভা যথেষ্ট শক্তিশালী। আমাদের সভার কার্যকলাপেই হালিদের গোলামি অনেকটা শেষ হয়েছে এবং সাহুকারদের নাদিরশাহী না-থাকার মতই। যদিও অত্যাচার এখনো হয়। কিন্তু আজ হালিদের মধ্যে সাহস রয়েছে।

হরিপুরা কংগ্রেসে শ্রী সুভাষবাবু সভাপতি ছিলেন। উনি নিজের ভাষণে কিসান-সভার সমর্থন করলেন। বিপরীতে সর্দার বল্লভ ভাই নিজের ভাষণে কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আমাদের ওপর আক্রমণ করলেন। ফলে বিষয় সমিতিতে এমন হট্টগোল শুরু হল যে বাধ্য হয়ে সভাপতি তাঁকে মাঝ-ভাষণেই বসিয়ে দিল! তখন গিয়ে শান্তি ফিরল মিটিংএ!

১৯৩৯ সালের এপ্রিলে রেওড়া সত্যাগ্রহের সফলতার পর এবং ত্রিপুরি কংগ্রেসের পর শিগগিরই গয়ায় অখিল ভারতীয় কিসান-সভার চতুর্থ বার্ষিক অধিবেশন আচার্য নরেন্দ্র দেবের সভাপতিত্বে সম্পন্ন হল। গয়ার আমাদের আসল স্তম্ভ পন্ডিত যদুনন্দন শর্মা তো রেওড়া সত্যাগ্রহের সূত্রে জেলে ছিলেন। অধিবেশনের মাত্র একমাস আগে বেরিয়েছিলেন। ফলে অধিবেশনের প্রস্তুতির জন্য সময় পেলেন আসলে ১৫ দিন। তারই মধ্যে প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা এবং জিনিষপত্র সংগ্রহ, সেছাড়াও আরো সমস্ত প্রস্তুতি করতে হল। স্বাগতাধ্যক্ষ তো আমরা ওনাকে আগেই নির্বাচিত করেছিলাম। অবশ্যই আমাদের কর্মীরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গয়া শহরের উত্তর দিকে যতগুলো এলাকা আছে, যার কিছু অংশ সদর সাবডিভিশনের এবং বাকিটা জাহানাবাদের, সেখানকার মানুষেরা ধান সংগ্রহ করায় এবং কিসান-সেবক দল তৈরি করায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। প্রায় সমস্তটা ভার ওই এলাকার কাঁধেই পড়েছিল। নওয়াদাও কিছুটা করল। আওরঙ্গাবাদ তো বেপাত্তাই রইল।

জমিদার এবং কয়েকজন কংগ্রেসি বন্ধু সর্বশক্তি লাগিয়ে অধিবেশনে বাধা দিতে চাইল। কৃষকদের উসকে দেওয়ার হাজারটা রাস্তা খোঁজা হল। কে জানে বিরুদ্ধে কতগুলো নোটিশ এবং কতগুলো রচনা ছাপা হল। সভায় কৃষকেরা না আসুক সেদিকেই নজর রইল প্রধানত। কিছুদিন আগেই গয়াতে দাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল। তাই হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের কথা বলে উসকে দেওয়া সহজ ছিল।

কিন্তু আমরাও পুরো সজাগ ছিলাম। মিটিংএর পর মিটিং করে গয়া শহরের বাতাবরণ আমরা এমন করে দিলাম যে সে ভয়টাই কেটে গেল। অন্যান্যদের অনুমানে, সম্মেলনে সোয়া লাখের বেশি কৃষক এসেছিল। প্যান্ডাল ছিল গির্জাঘরের মাঠে। কম খর্চায় চমৎকার ছিল প্যান্ডাল। সবাই স্বীকার করল যে আমরা সব দিক থেকে সফল হয়েছিলাম। কিসান তহবিলে পয়সা দেওয়ার অ্যাপিল তো কৃষকদের উদ্দেশে করেইছিলাম। কুড়িটার বেশি বাক্সে তালা লাগিয়ে ওপরে ফুটো করে জায়গায় জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। লাল উর্দি পরা সেবকেরা কৃষকদের সাবধান করত যে কিসান তহবিলে পয়সা দাও। পয়সা এসেওছিল প্রচুর।

আমার মতের বিরুদ্ধে কয়েকজন বন্ধু ওখানে প্রদর্শনীর ঝঞ্ঝাট করল। মিছিমিছি হয়রান করল আমাদের। আরো অসুবিধের সৃষ্টি করল জিদ করে যে তাতে শুধু খদ্দর থাকবে। ফলে কয়েক হাজার টাকার ক্ষতি হল। যদি কৃষকদের কাজে লাগে এমন জিনিষ থাকত প্রদর্শনীতে এবং সেসব ঠিকমত আসতে পারত তাহলে ক্ষতি না হয়ে লাভ হত। কংগ্রেসের প্রদর্শনী তো আর ছিল না।

এটা বলব যে সে সময় পুলিস আমাদের সাথে পুরোপুরি সহযোগিতা করল। প্রতিনিধি এবং দর্শকদের থাকার খুবই ভালো ব্যবস্থা ছিল। রেলওয়ে প্রথম দিকে একটু গোলমাল করল এবং টিকিট না নিয়ে প্ল্যাটফর্মে অভ্যর্থনা করতে যেতে দিল না। তবে যখন আমরা রাগ দেখালাম, অনুমতি দিয়ে দিল। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্যও বাধা দেওয়ার ফল ওদেরকে ভালো মতই ভোগ করতে হল, যখন সভার পর পুরো গাড়িতে কৃষকেরা বিনা টিকিটে বসে গেল এবং ট্রেন থামাতে হল। শেষে পুলিস আমাদের রাত্রে খবর দিল। মোটরে করে ওয়জিরগঞ্জে গিয়ে আমরা কৃষকদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে নামালাম, তবে ট্রেন এগোল। ওরা ট্রেনটাকেই থামিয়ে দিয়েছিল। এর আগে মানপুরেও এমনই হয়েছিল। সেখানেও পুলিশের জওয়ানরা হার মেনেছিল। তখন আমরাই সেখানেও কৃষকদের সরিয়েছিলাম। আসলে পন্ডিত যদুনন্দন শর্মার গ্রেপ্তারীর পর যখন যখন ওনার কেস উঠত আদালতে, পাটনা-কিউল লাইনে হাজার হাজার কৃষক গয়ায় যেত আসত। ওরা কখনো টিকিট নিত না। আগেও একাধ বার আমাদের ভরা ট্রেন থেকে ওদেরকে নামাতে হয়েছে। ওখানকার কৃষকদের এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে বিশেষ বিশেষ সময়েই।

গয়ার অধিবেশনে অন্যান্য প্রস্তাবের সঙ্গে বিধানে সংশোধনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হল। সে কমিটি পরে বিধানের সংশোধন তৈরি করল এবং ১৯৩৯ সালের জুন মাসে বোম্বাইয়ে অখিল ভারতীয় কিসান কমিটি সেটা পাশ করল। এখন সে বিধান অনুসারেই কিসান-সভার কাজ হচ্ছে।

সে সভায় আরো একটা ব্যাপার হয়ে গেল। সভাপতিজি নিজের ছাপা ভাষণে লাল ঝান্ডার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেছিলেন। সেসব কথা শুনে কয়েকজন সঙ্গীর মনে খটকা লাগল। গোলমাল হতে হতে বেঁচে গেল। কোনোরকমে ব্যাপারটাকে সামলালাম। সভাপতিজি বলেছিলেন কিসান-সভার মনোভাব তেরঙা ঝান্ডার প্রতি পুরোপুরি সম্মানজনক নয়। বরং সে ঝান্ডা রাখার বিরোধীর মত। কিন্তু পরে আমরা এ সম্পর্কে নিয়ামতপুরের বক্তব্য এবং তারপর গৃহীত কলকাতার প্রস্তাবের প্রতিলিপি তাঁর কাছে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এতে আপনার লেখা কথাগুলো কোথায় আছে এবং কী অভাব আছে যা আপনি পুরো করতে চান? কিন্তু উনি কোনো জবাব দিলেন না। ফলে ঝান্ডার বিষয়ে আমাদের কিসান-সভার আগে থেকে যে মন্তব্য ছিল তাই রইল। এভাবে লাল ঝান্ডা, যার ওপর কাস্তে এবং হাতুড়ির আকৃতি আঁকা আছে, কিসান-সভার ঝান্ডা হিসেবে মান্য হল। ফলে বিহার প্রাদেশিক কিসান-সভাকেও সেটা মানতে হল। ফলে বিবাদটাই শেষ হয়ে গেল।

গয়ার পর পঞ্চম অধিবেশন অন্ধ্র প্রদেশে আমন্ত্রিত হল। ১৯৪০ সালের মার্চের শেষে বিশাখাপট্টনম জেলার পলাসা স্টেশনের কাছে কাশি বুগ্‌গায় সেই অধিবেশন হল। যদিও সেটা পলাসা অধিবেশনের নামেই খ্যাত হল। প্রতিদিন প্রবল বৃষ্টি সত্ত্বেও অধিবেশন সফল হল। পর্যাপ্ত সংখ্যায় কৃষকেরা অংশগ্রহণ করল। অধিবেশন সংক্রান্ত কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখনীয়। প্রথম তো, অধিবেশনের মনোনীত সভাপতি মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ঠিক তখনই গ্রেপ্তার হলেন বলে অধিবেশনে আসতেই পারলেন না। শুধু তাঁর ছাপা ভাষণ পৌঁছোল এবং সেটাই বিলি হল। তাঁর অনুপস্থিতিতে পাঞ্জাবের পুরোনো কিসান সেবক, বয়োবৃদ্ধ যোদ্ধা বাবা সোহন সিং ভাকনা সভাপতিত্ব করলেন। পরে সে বছরের জন্য স্থানাপন্ন হিসেবে তিনিই নির্বাচিত হলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা হল যে অধিবেশনের শেষ দিনে জমিদারি প্রথার পুতুল পোড়ানর ঘোষণা হওয়ায় সরকার চিন্তিত হল। ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ দফা অনুসারে নোটিশ তামিল করল সভাপতিজি, স্বাগতাধ্যক্ষ শ্রী শ্যামসুন্দর রাও, এম.এল.এ., শ্রী প্রফেসর  রঙ্গা প্রভৃতি ছ’জনের ওপর। নোটিশে ছিল, এই যে ঘোষণা হয়েছে কোনো জমিদারের পুতুল পোড়ান হবে এতে অশান্তি ছড়াবে, তাই এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। পুলিস আর ম্যাজিস্ট্রেটের এটুকু ভদ্রতা-জ্ঞান নেই যে জমিদারের নয়, জমিদারি প্রথার পুতুল পোড়ানর ছিল। যে পুতুলটা তৈরি হয়েছিল তাতে লেখাও ছিল। সে যা হোক, বড় সংখ্যায় পুলিস মোতায়েন ছিল এবং বিপদ ছিল যে রাত্রে পুতুল পোড়ালে ধরপাকড়ের সঙ্গে সঙ্গে মারধোরও করবে। এ ভয়ও ছিল যে জমিদারের গুন্ডারা হয়ত সভাতেই বসে আছে এবং ঠিক সে সময়টাতেই গোলমাল করবে। তাই সভার শেষে পুতুলটা সভার মাঝখানে নয়, একটু দূরে সরিয়ে পোড়ান হল। কাজেই কোনো বাধা এল না। শ্রী ইন্দুলালজি নিজের ভাষণে আধিকারিকদের বকলেনও। তারা মুখ ঝুলিয়ে বসে রইল। আমি দেখলাম, দিনের বেলায় ওই পুতুলটাকে নিয়ে ওখানকার কৃষকেরা মিছিল করে বাজারে ঘুরল এবং জুতো, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে পুতুলটাকে মারতে মারতে গেল। তাদের ভিতরে অদ্ভুত উদ্দীপনা ছিল।

ওই অধিবেশনের পরেই শ্রী রঙ্গাজি গ্রেপ্তার হলেন এবং পরে অধিবেশনে দেওয়া ভাষণের জন্য ওনার ওপর ভারত রক্ষা আইন অনুসারে কেস চলল। যদিও গ্রেপ্তারী অন্য কারণে হয়েছিল এবং এক বছরের সাজাও তার জন্য আলাদা করে হয়েছিল। ৫০০ টাকা জরিমানাও হয়েছিল। এভাবে, সভাপতি এবং উপসভাপতি দুজনেই জেলে গেলেন। আমি রইলাম জেনারেল সেক্রেটারি, তা আমাকেও পলাসা থেকে ফেরার পর ১৯শে এপ্রিল ধরে নেওয়া হল। এসব তো হওয়ারই ছিল এবং খুশিই ছিলাম। দুঃখের ব্যাপার শুধু হল যে প্রায় দুমাস পরেই পলাসার স্বাগতাধ্যক্ষ শ্রী শ্যামসুন্দর রাওকে সরকার তাঁর গ্রামে নজরবন্দি করল আর তার পরেই উনি মারা গেলেন।

পলাসায় যে প্রস্তাব আমরা জাতীয় যুদ্ধ এবং ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ সম্পর্কে পাশ করলাম সেটা অখিল ভারতীয় কিসান-সভার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব হয়ে থাকবে। সরকার সে প্রস্তাব পরে বাজেয়াপ্তও করে নিল। পলাসায় আমি বেশি বলিনি। প্রথম দিন যখন লাল ঝান্ডার ধ্বজারোহণ আমিই করলাম তখন হিন্দিতে বললাম। তারপর দ্বিতীয় দিনের শেষে ১০-১৫ মিনিট ইংরিজিতেই ভাষণ দিলাম। 

(১৭)

প্রদেশগুলোতে সফর

প্রথম থেকেই আমি সব রকম ভাবে চেষ্টা করেছি যে ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশে, এমনকি বর্মাতেও কিসান-সভা গঠিত হোক এবং সেগুলো অখিল ভারতীয় সভার সাথে সম্পর্কিত থাকুক। আমি খুশি যে এ কাজে আমি সফল হয়েছি। প্রায় প্রতিটি প্রদেশে এবং কিছু দেশীয় রাজ্যতেও কিসান-সভা গঠিত হয়ে গেছে। একথা ঠিক যে পশ্চিমোত্তর-সীমান্তের, তামিলনাড়ুর, আসাম, সিন্ধ আর মহারাষ্ট্র ও মহাকোশলের সভাগুলো দুর্বল এবং বেশি সজাগ থেকে কাজ করতে পারে না। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে গঠিত হয়ে গেছে। একটু আধটু কাজও করেছে ওরা। আশা আছে, নিকট ভবিষ্যতে ওদের শক্তিশালী এবং কর্মতৎপর করতে আমরা সফল হব।

মনে হাজার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এটা তথ্য যে সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধ, তামিলনাড়ু, কেরল আর কর্ণাটক প্রদেশের সফর আজ অব্দি করতে পারিনি। কেননা সে অবকাশই পাই নি। অন্ধ্রতেও শুধু পলাসাই যেতে পেরেছি। সফর তো সে রাজ্যেও করিনি। এই সমস্ত প্রদেশের সঙ্গীরা আমার ওপর ক্ষুব্ধও হয়ে আছে যে আমি ওদের উপেক্ষা করি। কিন্তু আমার অসহায়তাও বোধহয় ওরা বোঝে। কৃষকদের সংগ্রামে ব্যস্ত থাকার জন্য এখনো অব্দি বিহার থেকে ফুরসতই কম পেয়েছি। কাজেই যেতাম কী করে? তবুও যখন যখন সুযোগ পেয়েছি, গিয়েছিও। পাঞ্জাবে তো দুবার গিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকে স্যার সিকন্দর নিষেধাজ্ঞাই জারি করে দিল। গত বছর জুন মাসে দিল্লী গিয়েছিলাম। পাঞ্জাব যাওয়ার কথাই ছিল না। ওখানকার সঙ্গীরা লিখেছিল অবশ্যই। কিন্তু আমি না করেছিলাম। তা সত্ত্বেও দিল্লিতেই, পাঞ্জাব সরকার আমায় নোটিশ ধরাল যে এক বছর পাঞ্জাবে যাওয়া বারণ। এরপর যদি যেতামও, স্যার সিকন্দর আমায় ধরে পাঞ্জাবের বাইরেই কোথাও রেখে দিত। এই নাটকের দরকারটা কী? তাই সীমান্ত প্রদেশের মানুষদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।

এখানেই প্রসঙ্গত একটা জরুরি কথা বলে দিতে চাই। দিল্লিতেই ছিলাম, যখন খবরের কাগজে অবাক হয়ে নিজের বিষয়ে কিছু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বিহারের কংগ্রেসি ইংরেজি দৈনিক ‘সার্চলাইট’ একটা চিঠি ছেপেছে। চিঠিটা নাকি কলকাতায় তার বিশেষ সংবাদদাতা যোগাড় করেছে। চিঠির বিষয়ে বলা হচ্ছে যে ভূতপূর্ব কোন ভাইসরয় লিখেছে ভারতে কারোর কাছে। তাতে লেখা রয়েছে যে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর কংগ্রেস-বিরোধিতায় কংগ্রেস দুর্বল হচ্ছে। সরকারের এই ব্যাপারটার ফায়দা নিক। বক্তব্যটার আরেকটি অর্থ ছিল যে আমি সরকারের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রাখি এবং জেনেশুনে, সরকারেরই ইশারায় কংগ্রেসের বিরোধ করি! আমার হাসি পেল। দিল্লির খোলা সভাতেই আমি এধরণের কথা বলা লোকেদের আহ্বান করলাম। পরে একটা বক্তব্যে ওই জাল চিঠিটার অক্ষরে অক্ষরে ভান্ডাফোড় করলাম। পরে স্টেটসম্যানও বলল চিঠিটা জাল। কিন্তু সত্যবাদী মানুষেরা কতদূর অব্দি শঠতা করে বিরোধীকে ছোট করার চেষ্টা করতে পারে তার প্রমাণ দিল ওই চিঠিটা। উফ! সত্য কী ভয়ঙ্কর!

গুজরাটে তো দুবার ঘুরলাম এবং প্রায় প্রতিটি জেলায় সভা করলাম। এ বছর তৃতীয় সফর ছিল ২০-২১ এপ্রিল এবং ডাকোরের কাছে প্রাদেশিক কিসান সম্মেলনের সভাপতিত্বও করার ছিল। কিন্তু তার আগে ১৯ তারিখেই সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল। ওখানে রানিপরজে আমি সভা করেছি এবং ওদের মধ্যে জীবন আনতে সঙ্গীদের কাজে সাহায্য করেছি। আমি ওদের নাচ, গান দেখেছি এবং আতিথ্য স্বীকার করেছি। সত্যিই কিসান-সভা ওদের, হালি আর দুবলা প্রভৃতিদের এবং খেড়ার ধারালা নামে ক্ষত্রিয়দের আত্মসম্মান ফিরিয়েছে, সাহুকারদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে। রানিপরজের একটা গানের প্রথম লাইনের অর্থই হল কিসান-সভায় অবশ্যই শামিল হও। এর ফল নিশ্চয়ই ভালো হবে। আমাদের অভ্যর্থনায় আসা ছেলে-মেয়েদের এবং নারী-পুরুষদের মধ্যে আমরা উদ্দীপনা দেখেছিলাম।

যুক্ত প্রদেশে তো তিন-চার বার গেলাম। মাত্র কয়েকটি জেলা ছেড়ে বাকি সবগুলোতেই অনেকগুলো করে সভা করেছি। অওয়ধে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ হাজার কৃষকের সভাতেও ভাষণ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। বেশির ভাগ জেলায় শ্রী হর্ষদেও মালবীয়র সঙ্গে গেলাম। উনি এবং ওনার সঙ্গীরা মিটিংএর সুন্দর ব্যবস্থা করলেন। একবারের সফরে তো বলিয়া জেলায় মোটরগাড়িসুদ্ধু একটা কুঁয়োয় পড়তে পড়তে বেঁচেছিলাম। রাস্তাই হারিয়ে ফেললাম আর সারারাত গাড়িটা বেহদিশ ঘুরে বেড়াল!

মহারাষ্ট্র, বরার, মারাঠা, মধ্যপ্রদেশ এবং মহাকোশলেও কোথাও একবার কোথাও দুবার গিয়েছি এবং অনেক জেলায় সভাও হয়েছে। বাংলার কথা আগেই বলেছি। আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এবছরই ফেব্রুয়ারি মাসে গিয়েছিলাম এবং জেলা কিসান সম্মেলনের সভাপতিত্বও করেছিলাম। উৎকলেও দুবার সফর হয়েছে। একটির বর্ণনা তো আগেই এসেছে। দ্বিতীয় বার ১৯৩৯ সালের আগস্টে গিয়েছিলাম, যখন কটকে সভা হল এবং নিষ্ক্রিয় প্রাদেশিক কিসান-সভাকে সক্রিয় করলাম।

আমি দেখেছি যে কৃষক সর্বত্র প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের কর্মীরা হয় ওদের ওপর ভরসা রাখে না, অথবা কংগ্রেস এবং অন্যান্য দলের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ফুরসৎই পায় না। আমি আশ্চর্যের সাথে এটাও প্রত্যক্ষ করেছি যে কিসান-সভার কাজে সোশ্যালিস্টদের থেকে অনেক বেশি উৎসাহী এবং যত্নবান থাকে কম্যুনিস্ট চিন্তাধারার মানুষেরা। কারণটা আমি বলতে পারব না। কিন্তু এতদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই কথাটা বলছি। বেশ কয়েক বার আমি সোশ্যালিস্ট সঙ্গীদের এ ব্যাপারে বকাবকিও করেছি। 

(১৮)

ত্রিপুরি এবং তারপর

১৯৩৯ সালের মার্চে ত্রিপুরিতে (মহাকোশল) কংগ্রেসের অধিবেশন হল। তার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্রী সুভাষচন্দ্র বোস। যদিও কংগ্রেসের ওয়র্কিং কমিটি অথবা বড় নেতারা পর পর দ্বিতীয় বার ওনার সভাপতিত্ব অপছন্দ করল; ডঃ পট্টভিকে বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে সমর্থন করল। তা সত্ত্বেও সুভাষবাবু জিতে গেলেন। এটা দেশের বড় নেতাদের জন্য চুড়ান্ত অপমান ছিল। এমন অপমান ওরা বরদাস্ত করতে পারল না। তাই অবশেষে সুভাষবাবুকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হল। এর পিছনের ঘৃণ্য নাটক ত্রিপুরির আগেই কেমন ভাবে শুরু হল, ত্রিপুরিতে কী কী বীভৎস কান্ড হল এবং তারপর কলকাতার অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে এবং কমিটির আগে কোন কোন ষড়যন্ত্র করা হল সেসব আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। যখন মেনে নেওয়া হয় যে গান্ধিজি ঘটনাবলীর ওপর সত্য আর অহিংসার শিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছেন, তখন সবচেয়ে বড় নেতারাও রাজনৈতিক নোংরামিতে কতটা নিচে নামতে পারেন তা আমি প্রত্যক্ষ দেখেছি। গান্ধিজির নাম নিয়েই হতে দেখেছি!

হরিপুরা কংগ্রেসে কংগ্রেসের মন্ত্রীদের কিছু বলার মুখ ছিল না। কেননা ওদের কাজে সব জায়গায় কৃষক এবং অন্যান্যদের মধ্যে অসন্তোষের আগুন লেলিহান হয়ে উঠেছিল। সে আগুন প্রশমিত করতে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির প্রশ্ন তুলে সবাইকার মনোযোগ সেদিকেই আকৃষ্ট করা হল এবং হরিপুরার ঠিক আগে, বিহার ও যুক্ত প্রদেশের মন্ত্রীদেরকে পদত্যাগ করিয়ে সমস্যা মেটান হল। ঠিক সেরকমই, ত্রিপুরির আগে রাজকোটে গান্ধিজির উপোসের ঘটনা ঘটিয়ে, বা বলা যায় তার শরণ নিয়ে সুভাষবাবুকে সরাবার কুচেষ্টা করা হল! কে চাইবে না যে গান্ধিজির ওপর কংগ্রেসের ভরসা থাকুক? আর গান্ধিজি তো সেখানে ছিলেন না যে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হবে আপনি সুভাষকে চান কিনা? অথচ সেই অজুহাতে, ঘুরিয়ে নাক ধরার মত সুভাষকে ফাঁসিতে ঝোলাবার প্রারম্ভ হল ত্রিপুরির মায়াপুরিতে, যখন নাকি মানুষটা ১০৫ ডিগ্রি জ্বরে আক্রান্ত, মরণাসন্ন হয়ে ওখানেই পড়েছিল! আমার কাছে এ দৃশ্য অসহ্য ছিল। তাই বোম্বাইয়ের পর ওটাই প্রথম কংগ্রেস ছিল যাতে আমি সম্পূর্ণ নীরব ছিলাম! কয়েকজন সঙ্গীও আমার মনের কষ্ট বুঝেছিল।

ত্রিপুরির আগে সুভাষবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয়ও হয় নি আর কোনো কথাবার্তাও কখনো হয় নি। শুধু হরিপুরা কংগ্রেসে ওনার ভাষণ শুনে আমি ওনার দিকে আকৃষ্ট অবশ্যই হয়েছিলাম যখন দেখলাম যে গান্ধিজি আর শ্রী বল্লভভাইয়ের দুর্গে উনি কিসান-সভাকে এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সমর্থন জানালেন। আগেই প্রকাশিত ওনার ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ (Indian Struggle) পড়ে যে কেউ অবাক হবে যে গান্ধিবাদ এবং গান্ধিজির চিন্তা ও কাজের প্রবল বিরোধী হয়েও তাদেরই দুর্গে সে মানুষটা কী করে রাষ্ট্রপতি [জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে] হতে পারল। বিরোধীরা তার ক্ষমতা স্বীকার করে হবে অবশ্যই।

কিন্তু যখন দ্বিতীয় বার তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা উঠল আমি পছন্দ করিনি। কেননা ভয় পাচ্ছিলাম যে লাগাতার দুবার হলে ওনার ওপর নিশ্চয়ই গান্ধিজির জাদু কাজ করতে শুরু করবে। ফলে পুরোনো চিন্তা পাল্টাবে, যেমন অন্যান্যদের হয়েছে, আমি দেখেছি। কিন্তু যখন নির্বাচনের মাত্র দু’চার দিন আগে কিসান-সভারই কাজে কলকাতা গেলাম এবং কয়েকজন সমাজবাদী সঙ্গী বোঝাল যে সুভাষকে সমর্থন করলে, হারি বা জিতি, লাভই হবে তখন মেনে নিলাম। সেখান থেকে ফিরেই আমরা এবং সমাজবাদীরা বক্তব্য জারি করে মাত্র এক দিন আগে সুভাষকে সমর্থন করলাম। তারপর যখন উনি জিতলেন, সে সমাজবাদীরা আনন্দে নাচতে শুরু করল, সারা রাত না নিজেরা শান্তিতে থাকল না আমাদের থাকতে দিল। অথচ পরে আবার ওরাই সুভাষের প্রবল বিরোধী হয়ে গেল! আজ অব্দি আমি বিরোধের কারণ জানতে পারিনি।

ত্রিপুরিতে তাঁর ভয়ানক অসুস্থতার সময় প্রথম প্রথম দু’একবার তাঁর সাথে কথা বলার সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু সে বিশেষ কিছু নয়। তাই সেখানে যা আমার মনোভাব ছিল সেটা তাঁর সাথে ঘনিষ্টতা হওয়ার আগের। সত্যি কথা যে সমাজবাদী সঙ্গীরা শেষ মেশ ওখানে যে মনোভাব নিল এবং বিষয় সমিতিতে গান্ধিজির ওপর আস্থার প্রস্তাবের বিরোধ করেও পরে করল না, সে মনোভাবের কারণ আমি আজ অব্দি বুঝতে পারিনি। ব্যাপারটা আমার খারাপও লাগল। কিন্তু আমি আমার চিন্তা ওখানে চেপে রাখলাম। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট অবশ্যই দিলাম। লোকেরা জানতও যে আমি ওনার বিরোধী। কিন্তু অন্য কাউকেই আমি বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলি নি। তেমন বললে সমাজবাদী পার্টিতে ভাঙন ধরত এবং আমি সে সময় সেটা বাঁচালাম। মাত্র দু’চার জন ছাড়া সে পার্টিরও লোকেরা সবাই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিল। কিন্তু পরে কে জানে কী বুঝে চুপ থেকে গেল। এটুকু তো প্রত্যক্ষ সত্য। খবরের কাগজে সব কথা ছেপেও ছিল।

ত্রিপুরিতেই আমি প্রথমবার চেষ্টা করলাম যে প্রগতিশীল চিন্তাধারার সবাই এক জায়গায় বসে একটা সম্মিলিত কর্মসূচি তৈরি করুক। কিন্তু অসফল হলাম। প্রথম বার প্রত্যক্ষ দেখলাম যে বামপন্থী দলগুলোয়, এক পার্টির সদস্যেরা অন্য পার্টির লোকেদের কতটা অবিশ্বাস করে। এটাও দেখলাম যে বড় বড় নেতারাও প্রতিনিধিদের ক্যাম্পে গিয়ে কিভাবে ক্যানভাসিং করে! একেবারে অস্থির!

ত্রিপুরির সুযোগে বেশ কয়েক দিন আগেই আমি জবলপুরে গিয়ে পৌঁছোলাম এবং কাটনি, মান্ডলা ইত্যাদি জায়গায় ঘুরলাম, মিটিং করলাম। আমার সঙ্গী শ্রী ইন্দুলালজি তো ছিলেনই। উনি তো আগে থেকেই সেখানে গিয়ে বসেছিলেন। উনিই কৃষকদের পায়ে হেঁটে যাত্রা এবং সমাবেশের ব্যবস্থা করছিলেন। সত্যি সত্যিই একদিন তো জবলপুরের কাছ থেকে ত্রিপুরি অব্দি আমাদেরও সেই দলের সাথে পায়ে হেঁটে যেতে হল। দারুণ হল সে সমাবেশ। দূর দূর থেকে পায়ে হেঁটে কৃষকেরা এল এবং দেখার মত জমকালো মিছিল ও সমাবেশ হল। ঝান্ডা চকে সভা হল। কংগ্রেসের ভলান্টিয়ারেরা আমাদের সঙ্গ দিল পুরোপুরি! কোনো বাধা রইল না। দেখে খুশি হলাম। জানি না কেন এমন হল! বোধহয় বাধা দিলে ওরা মানত না তাই অভ্যর্থনা সমিতি বুদ্ধিমানের মত কাজ করল!

ওখানকার কিসান ক্যাম্পে আমাদের অনেকগুলো সভা হল এবং আমরা দেখলাম যে কৃষক পুরো তৈরি আর আমাদের সঙ্গে। মহাকোশলে কিসান-সভার শিকড় ত্রিপুরিতেই নামল।

ত্রিপুরির পর কলকাতায় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির তামাশা দেখলাম। অন্যায়ের চরম সীমা দেখলাম।। সুভাষবাবু রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। আমরা আগে এরকম কিছু চাইছিলাম না। কিন্তু পরে আমাদেরও সঠিক মনে হল। বামপন্থীদের সম্মেলনের আবার একটি চেষ্টা ওখানেও হল। লোকও পেলাম। কিন্তু ফল সন্তোষজনক হল না। সমাজবাদী এবং কম্যুনিস্ট দু’দলই যুক্ত বামপন্থার বিরুদ্ধে ছিল। এ ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

ত্রিপুরির পর রামগড়ে এ বছর কংগ্রেস হল। বিহার ছেড়ে ছোটনাগপুরে সম্মেলন করার অর্থ বুঝলাম না। আমরা তো মানি, যেমন খবরের কাগজেও লিখল যে কিসান-সভার ভয়েই ওখানে করা হল। পাটনা, গয়া, সোনপুর ইত্যাদি জায়গায় তো কয়েক লক্ষ কৃষক জমা হয়ে যেত আর নেতারা কিচ্ছু করতে পারত না। আমরা যা বলতাম কৃষকেরা তাই করত। কিন্তু ছোটনাগপুরের ঘন জঙ্গলে সেটা অসম্ভব ছিল। ওদিককার কৃষক এখনও পুরোপুরি সজাগ হয় নি আর দু-তিনশো মাইল দূর থেকে লক্ষ মানুষের যাওয়া সহজ ছিল না। তবুও কৃষকদের সমাবেশ তো রামগড়েও ভালো হল। অবশ্য বিহারের হিসেবে ভালো বলা যেতে পারে না। কেন এমন হল তা এখানে বলতে আমি প্রস্তুত নই, যদিও আমি জানি। তবে আমাদের মিছিল নিঃসন্দেহে কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতির মিছিল থেকে অনেক বেশি বড় ও জমকালো ছিল। কংগ্রেস তো মেঘের ক্রোধে আসলে হলই না আর যা কিছু হল তা নিছক তামাশা। সবাই একথাটা মানে। অন্যদিকে এটা প্রথম কংগ্রেস ছিল যার ভিতরে বা কংগ্রেস নগরে আমি পা অব্দি রাখলাম না। 

(১৯)

আপোষ-বিরোধী সম্মেলন

এদিকে কংগ্রেসের নেতা আর বামপন্থী পার্টির মনোভাবে আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম বিরক্ত হয়ে স্থির করে নিয়েছিলাম যে নিজের সারাটা সময় কৃষকদের কাজেই লাগাব। এতেও লোকজন এবং কয়েকজন সঙ্গীও, দোষারোপ করল যে রাজনীতি ছেড়ে আমি শুদ্ধ অর্থনীতিতে (Pure economism) লিপ্ত হয়ে পড়েছি। ওদের বুদ্ধিতে হাসিও পেল আর করুণাও হল।

কিন্তু সব সময় রাজনীতিতে থাকতাম বলে একেবারে উদাসীন হয়ে পড়া অসম্ভব ছিল। সুভাষবাবুর সাথে কথাবার্তাও হতে থাকত। এদিকে যখন দেখলাম আপোষের মনোভাব কংগ্রেসি নেতাদের মধ্যে ধীরে ধীরে দৃঢ় হচ্ছে, জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামে ওরা আর নামবে না তখন কয়েকজন সঙ্গী এবং সুভাষবাবুকে নিয়ে স্থির করলাম যে রামগড়ে কংগ্রেসের সময়টাতেই আপোষ-বিরোধী সম্মেলন হোক। ফলে তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। মাত্র এক মাস সময় ছিল। তার ওপর লোকেরা আমাকেই স্বাগতাধ্যক্ষ পদে বসিয়ে দিল। যখন আমি দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলাম তখন ঠিক হল আমার নাম থাকবে কিন্তু দায়িত্ব অন্যেরা নেবে। বলা হল যে আমার নাম থাকলে ভালো প্রভাব পড়বে। হলও তাই। সম্মেলনের সভাপতি সুভাষবাবুর মিছিলের তুলনা হয় না। প্রকৃতি দেবীরও কৃপা হল সম্মেলনের ওপর এবং জবরদস্ত হল খোলা অধিবেশন। লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। কংগ্রেসের ঠিক উল্টো। যদিও বড় বড় নেতা এবং পুরোনো সঙ্গীরাও বাধা দিতে কিছু বাকি রাখে নি। বেহায়াপনায় নেমে গিয়েছিল।

আমার দৃষ্টিতে, সম্মেলনের সফলতার কৃতিত্ব তো এমনিতে অনেক সঙ্গীর ওপর বর্তায়। তবে, পন্ডিত ধনরাজ শর্মা যদি না থাকতেন তাহলে সম্মেলন এতটা সফল কিছুতেই হত না। সম্মেলনে আমি বলেছিলাম এটাই ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। তারপরই তো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি জেলে এসে বসলাম। ওখানে আমরা ইউরোপীয় যুদ্ধে সাহায্যের খোলাখুলি বিরোধ করেছিলাম এবং বিরোধ করার সংকল্প নিয়েছিলাম। ফলে জাতীয় সপ্তাহে প্রথম থেকে শেষ অব্দি বিহার প্রদেশে আমি খোলাখুলি বিরোধ করে গেলাম। আর সে অপরাধেই ধরে তিন বছরের জন্য জেলে পোরা হল আমায়। ২৯.৪.৪০ তারিখে এই সাজা হল।

(২০)

বামপন্থার মিলন

আমি আমার জীবন-সংগ্রামের এই গাথা পুরো করার আগে একটা জরুরি কথা বলে নিতে চাই। একটা কাজে আমি তীব্র আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। পরে বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিই। বামপন্থী বন্ধুরা হামেশাই বলত, যদি আপনি চান তাহলে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে পরস্পরে মিল করাতে পারেন। কিন্তু আমি এ কাজে হাত দিতাম না। কিন্তু ত্রিপুরির পর যখন এ কাজে হাত দিলাম তখন দেখলাম লোকে মিলের বিরুদ্ধে। যারা সবচেয়ে বেশি বুঝদার তারাই বিরুদ্ধে! কিন্তু ১৯৩৯ সালের জুন মাসে যখন বোম্বাইয়ে ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রথম কনফারেন্স হল, শ্রী নরিম্যান এবং অন্যান্যরা আমায় জিজ্ঞেস করল – বামপন্থীদের কোনো কনফারেন্স করা যায় কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। বোম্বাই পৌঁছে সদ্ভাব দেখাতে সেখানে গেলামও আর বক্তব্যও রাখলাম। তারপর সব বামপন্থী দলগুলোর বৈঠক সুভাষবাবুর বাড়িতে হল। বেশ কয়েক দিনের চেষ্টার পর মিল হল এবং যুক্ত বামপন্থী কমিটিও (Left Consolidation Committee) তৈরি হল। তাতে সব দলের প্রতিনিধি রইল। আমি এবং প্রফেসর রঙ্গা কোনো দলের ছিলাম না বলে কিসান-সভার তরফ থেকেই ওই কমিটিতে আমাদের রাখা হল। বোম্বাইয়ে খুব ভালো চলল ওই কমিটির কাজ। নিয়মিত বৈঠক হল এবং অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে কোন প্রস্তাবে কী করা হবে, কে কী বলবে, কী সংশোধন আনা হবে এবং কোন বিষয়ে প্রস্তাব আনা হবে সব বৈঠকে স্থির হল।

সে সময়েই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে ওয়র্কিং কমিটির প্রস্তাব এল যে প্রাদেশিক কংগ্রেসের আজ্ঞা না নিয়ে কেউ যেন সত্যাগ্রহ না করে এবং প্রাদেশিক কমিটিগুলো যেন মন্ত্রীদের পথে বাধা সৃষ্টি না করে। সোজা উদ্দেশ্য ছিল বিহারের কিসান সত্যাগ্রহ বন্ধ করা এবং কংগ্রেসের মন্ত্রীদের অধীনে এনে তাকে বিধিগত করা। আমরা সবাই দুটোরই বিরোধ করা স্থির করলাম। অনেক সঙ্গীরা বলল। সুভাষও বললেন। আমি স্পষ্ট বললাম এ নির্দেশ আমি মানতে পারবনা। পরিষ্কার বলুন, আমরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যাই। এই দ্রবিড় প্রাণায়াম [ঘুরিয়ে নাক ধরার একটা যোগাভ্যাস] কেন? তারপর আমি বোম্বাই থেকে চলে এলাম।

কিন্তু বামপন্থী কমিটি স্থির করল যে ৯ই জুলাই সারা ভারতে এই দুটো প্রস্তাবের বিরোধ হোক। ব্যস, এখান থেকেই আবার গোলমাল হল। রায়সাহেবের দল তো ওই তারিখেই (৯ই জুলাই) সে কমিটি থেকে আলাদা হল। অন্যান্য দল আলাদা হল না কিন্তু অনেকেই ৯ই জুলাই বিরোধ দিবস উদযাপন করল না। আমরা তো পাটনায় ভালো করে উদযাপন করলাম। তারপর সুভাষবাবুকে কংগ্রেসের নির্বাচিত কমিটিগুলো থেকে নিষ্কাশিত করা হল। তা সত্ত্বেও দেখলাম সমাজবাদিরা ঢিলে হয়ে পড়ছে। প্রদেশগুলোতে কিছুই করা হল না।

তারপর কলকাতায় সে কমিটির মিটিং হল যাতে সব ক’টি দল উপস্থিত ছিল। কিন্তু মনে হল তারা সেই কমিটিটাকে ভয় পাচ্ছে। কমিটিতেই জাতীয় সংগ্রাম সপ্তাহ উদযাপন করার সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু খুব ব্যথিত পেলাম দেখে যে আমাদের বড় বড় সমাজবাদিরা পাটনায় বসে রইল এবং আমি হাজার বার বলা সত্বেও ৩১শে আগস্ট থেকে ৬ই সেপ্টেম্বর অব্দি ধার্য সেই সপ্তাহে এক দিনও মিটিং অব্দি করল না। খুব কষ্ট হল। পরে তো বিহার কংগ্রেস আমাকেও কংগ্রেস থেকে আলাদা করে দিল কেননা সত্যাগ্রহ আমি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। থামাই নি।

ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সব দলকে জিজ্ঞেস করে অক্টোবরে নাগপুরে সাম্রাজ্যবিরোধী সম্মেলন হল। কিন্তু সমাজবাদীরা সে সম্মেলনে এল না। যখন নাকি আমি শ্রী জয়প্রকাশবাবুকে আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম। দুঃখ হল। আবার ১১-১২ অক্টোবরে আমরা সবাই লখনউয়ে মিলিত হলাম। কিন্তু দেখলাম যে সমাজবাদিরা নিজেদের দেড় ইঁটের মসজিদ আলাদাই তৈরি করবে। ওদের বুঝিয়ে বুঝিয়ে হেরে গেলাম। সেখান থেকে বিহারে ফিরলাম এবং অন্যান্য সমাজবাদী সঙ্গীদের সাথে কথা বললাম। তারা রাজি হল যে প্রসন্নভাবে একসঙ্গে মিলেমিশে লড়ব। তবুও, কথা দিয়েও জানি না কেন ওরা নিশ্চুপ রয়ে গেল! ব্যস, ৭ই নভেম্বরে সবাইকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখে সবার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিলাম। চিঠিতেই সমস্ত কারণ দেওয়া রয়েছে।

(২১)

উপসংহার

ভেবেছিলাম শেষে নিজের প্রধান প্রধান চিন্তাগুলোও লিখে এই কাহিনী পুরো করব। কিন্তু এর শরীর তো এমনিতেই স্ফীত হয়ে উঠেছে। তাই বাধ্য হয়ে সে খেয়াল ছাড়তে হল। সেসব চিন্তা এবার আলাদা করেই লিখব স্থির করেছি।

কিন্তু এটুকু তো জেনেই রাখা উচিৎ যে শাসনের লাগামগুলো অন্যান্যদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি খেটে রোজগার করা জনগণের হাতেই দেওয়ার পক্ষপাতী। ওদের কাছ থেকে নিয়ে বা ওদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পাইয়ে দেওয়া বা দেওয়ানোর পন্থাগুলো আমি ভুল মনে করি। আমাদের লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হবে। তাহলেই আমরা সে লাগাম নিজের হাতে রাখতে পারব। এটা সত্য যে সহজে পেয়ে গেলে আবার ছিনিয়ে নেবে ওরা। সেভাবে পাওয়াকে আমি স্বপ্নের সম্পত্তি মনে করি।

এর জন্য আমাদের সংকল্পে দৃঢ় কর্মী এবং নতুন নেতাদের দল তৈরি করতে হবে। কিন্তু যারা কোথাও না কোথাও আর্থিক প্রোগ্রামের ভিত্তিতে কৃষক, শ্রমিকদের সংগঠন করে নি, তাদের লড়াইয়ে সোজাসুজি শামিল হয় নি তারা আমাদের নেতা বা কর্মী হতে পারে না। আমি বইয়ের জ্ঞান চাই না। শুধু বইয়ের জ্ঞানে ধোঁকা হয়। আমি লড়াই আর লড়াকু চাই। আর্থিক লড়াই ছেড়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ের আমি বিরোধী। আমি আর্থিক যুদ্ধটাকেই স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত করতে চাই। আমি সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক বিপ্লব চাই আর এটা অন্য কোনোভাবে হতে পারে না। আমি তেমনই মানুষদের সঙ্গ দেব।

দলাদলিতে বিরক্ত হয়ে গেছি বলে আমি কোনো রাজনৈতিক দলে শামিল হতে ভয় পাই। যদ্দুর পারি আমি কোনো দলে শামিল হব না। 

অবশিষ্ট ভাগ

(১)

পশ্চাৎপট

এখন পর্য্যন্ত যা কিছু লেখা হয়েছে তা ১৯৪০ সালের এপ্রিলে যে জেলে গিয়েছিলাম তখন অব্দিকার গাথা। জেলে এই দু’বছর কেমন কাটল আর সেখানে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল, সেসব কথা একেবারেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ছেড়ে গেছে। এটা ঠিক যে জীবন-সংগ্রামের এই কাহিনী জেলেই লেখা হয়েছে। কিন্তু জেলে পৌঁছোতেই লেখা শুরু করে দিয়েছিলাম। ফলে পরের কথাগুলো লেখা সম্ভব ছিল না। সেগুলো বাকি রয়ে গেল। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চে আমি জেল থেকে ছাড়া পেলাম। তখন থেকে আজ, ১৯৪৬ সালের মাঝ অব্দিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লিপিবদ্ধ হতে পারে নি। সে ঘটনাগুলো না লেখা হলে এ কাহিনী অসমাপ্ত থেকে যাবে, এই ইতিবৃত্ত অপূর্ণ মনে করা হবে। ঘটনাগুলোর মধ্যে কয়েকটি তো মুখ্য, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তত্ত্বের দৃষ্টি থেকে সেগুলোর স্পষ্ট উল্লেখ একান্ত জরুরি। সেগুলোর ওপর আলোকপাত না হলে অনেক ভ্রান্তি এবং মিথ্যে ধারণার আশঙ্কাও থেকে যাবে। তাই সংক্ষেপেই, সব কথা লিখে এই রামকাহিনী [ইতিবৃত্ত] আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া (আপটুডেট করে দেওয়া) জরুরি।

(২)

জেলের দু’বছর

১৯৪০ সালের এপ্রিলের মাঝ থেকে ১৯৪২ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্য্যন্ত প্রায় দু’বছর জেলে কেটেছিল এবং ভালোভাবে কেটেছিল। সাজা ছিল কঠিন। ফলে কিছু না কিছু কাজ করা জরুরি ছিল। ফলও তার ভালোই হওয়ার ছিল। কেননা এই করে ফি বছর প্রায় তিন মাস করে সাজা এমনিই কম হয়ে যায়। একেই ‘মাফি’ বা ‘রেমিশন’ বলে। এটাই জেলের নিয়ম আর সে নিয়মের লাভ না নেওয়া মূর্খতা। কোনো কাজ না করলে শারীরিক, মানসিক ইত্যাদি হাজারটা সঙ্কটও আসতে শুরু করে দেয়। গল্প-সল্প করে মিছিমিছি সময় কাটে। যদিও আমার তা হত না, কেননা আমি আমার এক একটি মিনিট সদ্ব্যবহার করার নিয়ম তৈরি করে নিয়েছিলাম। তবুও জেলের কিছু কাজ করাকে আমি সময়ের সদ্ব্যবহারেরই শামিল করে নিয়েছিলাম এবং স্থির করেছিলাম প্রতিদিন একটু না একটু সুতো নিশ্চয়ই কাটব। আমার চরকা নিয়মিত চলত। এবারের সুতো জেলেরই সম্পত্তি রইল। ছাড়া পাওয়ার সময় পয়সা দিয়ে সে সুতো আমি কিনলাম না। এমনই ভাবনা এল সেসময় মাথায়।

গীতাপাঠ এবং পুস্তক-লিখন

গীতা পাঠ এবং পড়ানোর কাজও চলল। কয়েকজন সঙ্গী জেদ ধরল যে ওদের গীতা পড়িয়ে দিই আর আমি রাজি হয়ে গেলাম। তার সময় নির্ধারিত ছিল এবং কয়েকজন আগ্রহ ও উৎসাহের সঙ্গে নিয়মিত পড়তে আসত।

জীবনী (আমার জীবন-সংগ্রাম) বাদে আমি ‘কৃষক কিভাবে লড়ে?’, ‘বিপ্লব এবং যুক্তফ্রন্ট’, ‘কিসান-সভার স্মৃতি’, ‘খেত-মজদুর’, ‘ঝাড়খণ্ডের কৃষক’ এবং ‘গীতা হৃদয়’ এই ছ’টা বই আরো লিখলাম। এর মধ্যে প্রথম দুটো তো প্রকাশিতও হয়ে গেছে। বাকি কয়টি শিগগিরই প্রকাশিত হয়ে যাবে। এগুলোর মধ্যে ‘গীতা হৃদয়’ তো জেল থেকে বেরোবার ঠিক আগেই লিখতে পারলাম। কে জানে ছাড়া পাওয়ার দু’মাস আগে কেন মনের ভিতরে গেঁথে গেল যে ‘গীতা হৃদয়’ পুরো কর, নইলে ছাড়া পাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে, কাজটা পড়েই থেকে যাবে। ব্যস, কাজে হাত লাগিয়ে দিলাম। মেল ট্রেনের গতি কী বলব, সত্যিই স্পেশ্যাল ট্রেনের গতিতে লিখে গেলাম। তবে গিয়ে এই দীর্ঘ বইটা পুরো হতে পারল। হাতে লেখা কপিতে প্রতিদিনকার তারিখ নোট করা আছে যে কবে কতটা লিখলাম। তার মানে এই নয় যে আজেবাজে কথা লিখে সেরেছি। তা হল না। যা কিছু লেখা হল তা খুব বুঝেশুনে – তাতেও মাত্র দু’ভাগ পুরো হল। তৃতীয় ভাগ লেখা গেল না। তার জন্য কিছু বিশেষ অনুসন্ধান ও অন্বেষণ জরুরি ছিল এবং সেসব বই জেলে পাওয়া যেত না। আমার নিজের মতে ‘গীতা হৃদয়’এ লিখিত কথাগুলো স্বকীয় এবং অনন্য। তার অধিকাংশ চিন্তা পরিণত। কিছু কথা তো লিখতে লিখতে হঠাত মাথায় এল আর আমি নিজেই আশ্চর্যচকিত হলাম। সেসব কথা লিখতে এক অসীম আনন্দের অনুভূতি হল।

আরো কয়েকজন সঙ্গী ছিল যাদের কিসান-সভা গঠনের ইতিহাস বলতাম এবং কৃষকদের মধ্যে কাজ করার শিক্ষা দিলাম। জেলেই শ্রী জয়প্রকাশবাবু এবং অন্যান্য পুরোনো সঙ্গীদের সাথে কখনো কথা বলার এবং ভাববিনিময় করার সুযোগ আসত। কখনো ওরা ভীষণ অসন্তুষ্টও হত। আমার তাতে কিছু করার ছিল না। আমি ওদের সব কথা মানতেও পারতাম না আর ওদের খুশিও করতে পারতাম না।

শ্রী জয়প্রকাশবাবু বার বার আমায় অনুরোধ করতেন যে উনি একটা নতুন পার্টি, ‘পিপলস পার্টি’ (জনতার পার্টি) তৈরি করতে চান যাতে আমারও থাকা উচিৎ। কিন্তু আমি না করতাম। কে বলতে পারে, আমার মনে কথাটা কেন ধরল না? আমার না করাটা ওনার খারাপ লেগে হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এতে উনি আমার প্রতি অপ্রসন্ন হলেন এমন মনে হল না। হ্যাঁ, অন্যান্য বন্ধুরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।       

রাজনৈতিক শিক্ষা নয়, চরকা

আমাদের জেলে যাওয়ার পর মহাত্মাজি কংগ্রেসে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু করলেন যার ফলে সব প্রধান কংগ্রেসিরা জেলে এসে বসল। এভাবে হাজারিবাগ জেলে প্রায় তিন-চারশো এমন ভদ্রলোক এল যারা বিহারের বাছা বাছা কংগ্রেস-সদস্য ছিল। তার মধ্যে কয়েকজন তো যথেষ্ট পড়াশোনা জানা মানুষ। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ, প্রকৃত রাজনীতির জ্ঞান থেকে অনেক দূরে ছিল। আজকাল তো রাজনীতি দর্শন এবং বিজ্ঞান হয়ে গেছে। ফলে তার অধ্যয়ন এবং মন্থন অত্যন্ত জরুরি। সেটা না করলে আমরা ধোঁকা খাব। তবুও দেখলাম সবার চিন্তায় প্রাধান্য শুধু চরকার। রাজনীতিতে মাত্র কয়েকজনের রুচি হয়ত থেকে থাকবে। আমি ওদের বললামও। কিন্তু উত্তর পেলাম, রাজনীতি তো মহাত্মা গান্ধির দায়িত্ব, আমরা সে বিষয়ে বিশেষ কিছু জেনে কী করব? আমরা তো আজ্ঞাকারী সেপাই যাদের কাজ শুধু চরকা চালানো। আমি অবাক হলাম। ভাবলাম, চরকা তো হাতে-পায়ে চলে, মগজ দিয়ে তো আর চলে না। যদি মগজও সেই একই কাজ করে তাহলে মানুষ তো গাধা হয়ে যাবে। কেননা মগজ বিকশিত না হওয়ার পরিণতি তাই হয়। আমাদের দেশটা যেন গাধাদের দেশ যেখানে অন্ধ পরম্পরার পিছনে ছুটে আমরা মরতে থাকি আর সম্পত্তি, সম্মান, ধর্ম সব হারাই। যে দেশে পরলোক এবং স্বর্গ-বৈকুন্ঠের ঠিকে রয়েছে নিরক্ষর এবং দুর্নীতিগ্রস্ত পান্ডা-পুজারিদের হাতে, গোঁড়া এবং পাপী পীর-গুরুদের জিম্মায়, সে দেশের ‘খুদা হাফিজ’। এটা গাধাদের দেশ ছাড়া আর কী? কিন্তু ওখানে আমার কথা শুনত কে? নিরুপায় হয়ে চুপ করে যেতাম।

আমরা এবং সাধারণ কয়েদিরা

এবারের বার আমি হাজারিবাগ জেলে আরো একটা কাজ করলাম। সাধারণ কয়েদিদের সাধারণতঃ সবাই উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখে, সেভাবেই ব্যবহার করে। রাজবন্দীরাও ব্যতিক্রম নয়। হ্যাঁ, কয়েকজন কখনো কখনো ওদের দিকে নজর দেয় অবশ্যই, দু-চারটে মিঠে কথা বলে, কিছু খাবার জিনিষ-টিনিষ দেয়। কিন্তু ওদের প্রতি সবার মনোভাবে পরিবর্তন দরকার। জেলের আধিকারিকেরা যেন ওদের সঙ্গে মানুষের মত ব্যবহার করে এবং খাদ্যে-পানীয়ে ওদের যে অধিকার আছে তা থেকে বঞ্চিত না করে। আমি হাজারিবাগ জেলে এ প্রশ্নই ওঠালাম এবং আমি খুশি যে সফলতাও পেলাম। এর জন্য জেলের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আমায় কখনো লড়াই করতে হয় নি। আসলে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট মেজরনাথ একজন সৎ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ভদ্র মানুষ ছিলেন তাই আমি ওনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ব্যাপারটা স্বীকার করে নিলেন। ফল হল যে জেলে কয়েদিদের ডিসিপ্লিন কায়েম রেখেই ওদের খাদ্যে-পানীয়ে অনেক ভালো বদল এল। ওদের সাথে ব্যবহারও ভালো হতে লাগল। জেলে যদি আধিকারিকেরা কয়েদিদের প্রাপ্য রেশন এবং জামাকাপড়ে চুরি না করে তাহলে কয়েদিদের অনেক স্বস্তিতে থাকতে পারে। তাই হল সেখানে। ফলে যদ্দিন আমি ছিলাম সে কটা বছর ওরা আরামে ছিল এবং খবর পাই যে আজও আমাকে ওরা মনে রেখেছে।

মেজরনাথ

যখন সাধারণ কয়েদিদের প্রতি মেজরনাথের এত সুন্দর মনোভাব ছিল, তখন রাজবন্দিদের বিষয়ে আর বলার কী আছে? ওনার কাজে-কথায় খারাপ অনুভব করেছে এমন কোনো অভাগা রাজবন্দি না থাকারই কথা! জেলের নিয়মগুলো পালন করানই ওনার মুখ্য কাজ ছিল আর তাতে যদি কেউ খারাপ অনুভব করে থাকে তাহলে অন্য কথা। অবশ্য পরে এই সজ্জনতা এবং ভালোমানুষির জন্য মেজরনাথকে মিছিমিছি হয়রানি ভোগ করতে হয়েছিল এবং বছরের পর বছর ওনার ওপর বিভাগীয় তদন্ত চলেছিল। যদিও শেষ অব্দি সসম্মানে, নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে, তা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। জেলের নিয়ম পালন করানর সঙ্গে সঙ্গে যদি নিয়মেরই অনুসারে, রাজবন্দিদের উনি আরাম দিয়ে থাকেন তো খারাপ কী করেছেন? নিয়মকানুন ভাঙলে আলাদা কথা হত। কিন্তু বিদেশি সরকার যে!

রাজনৈতিক পান্ডাগিরি

এবারও জেলে, রাজনৈতিক পার্টিগুলোর উথাল-পাথাল আর হুলুস্থুলু ভিতরে ভিতরে ভালোই চলল। এক রাজবন্দি বসে বসে এ বিষয়ে একটা মজাদার কার্টুন (ব্যঙ্গচিত্র) এঁকে ফেলল যাতে ওই পার্টিগুলোর মনোভাবের ওপরও আলোকপাত ছিল এবং ওদের তথাকথিত সঞ্চালক-সূত্রধারেরা কী করে তার দিকেও ইশারা ছিল। ছবিতে এই সূত্রধারদের হাতে বাঁশি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাঁশি নিয়ে তারা জেলের ফাটকের সামনে দাঁড়িয়েছিল। ওধার থেকে যেই কেউ নতুন রাজবন্দি এল ওখানেই ওকে ফাঁসানর চেষ্টা শুরু হয়ে গেল। এর জন্য জামাকাপড়, বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি সব ধরণের জিনিষ আগন্তুকদের দেওয়া হত যাতে সে কোনো না কোনো একটি পার্টির সদস্য হয় এবং সদস্য থাকে। প্রত্যেকটি পার্টিওয়ালা এই চেষ্টাই করত যে আগন্তুক যেন তার কবলে ফাঁসে। গয়া প্রভৃতি তীর্থের পান্ডারা নিজেদের এজেন্ট এবং দালালদের স্টেশনে এবং ধর্মশালায় পাঠিয়ে নিজের নিজের যাত্রীদের গ্রেপ্তার করে। তেমনই দৃশ্য এখানেও ছিল। পান্ডার দালাল যাত্রীদের ঘরবাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে নিজেদের পালে নিয়ে আসে। এখানেও সে ধরণেরই ব্যাপার হত। আগন্তুক রাজবন্দিদের সঙ্গে নিজের এবং নিজের লোকেদের পূর্ব পরিচয়ের প্রসঙ্গ তুলে তার অনুচিত লাভ নিত নেতারা; পান্ডারাও এ লাভ নিতে পারে না। এভাবে এই দেখার মত রাজনৈতিক পান্ডাগিরি চলত দারুণ এবং শেষ অব্দি অধিকাংশ আগন্তুক, যদি ঘোর গান্ধিবাদি বা ভাবনাচিন্তায় প্রবীণ মানুষ না হত, কোনো না কোনো পার্টিতে ফেঁসেই যেত। এ ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লাগত। কেননা ধার্মিক সম্প্রদায়ের মতই এই রাজনৈতিক সম্প্রদায়গুলো একে অন্যকে গালি দেয় এবং অপর পার্টির নেতাদেরকে দেশদ্রোহী এবং বিশ্বাসঘাতক অব্দি বলে দেয়। প্রত্যেকটা পার্টি ভাবে যে দেশের উদ্ধার একমাত্র তার বলা পথেই হতে পারে। ধর্মওয়ালারাও তো মুক্তির বিষয়ে এমনটাই মানে। একদিকে এই ভালোমানুষেরা দেশব্যাপী জাতীয় ঐক্যের কথা বলে। অন্য দিকে এরা, যারা নাকি হিমালয়-লঙ্ঘনের মত কঠিন ঐক্য আনতে সহায়ক হতে পারে, নিজেরাই নিজেদের মধ্যে জুতো ছোঁড়াছুঁড়ি করতে থাকে। শেষ বিচারে এই পার্টিগুলো এবং এদের নেতাদের মধ্যেই তো বুঝদারি এবং রাজনৈতিক চেতনা আছে। অন্যান্যদের এরাই বোঝারে পারে। কিন্তু এরা নিজেরাই অবুঝ হয়ে পারস্পরিক টিকাটিপ্পনী এবং ছিদ্রান্বেষণেই সারাটা সময় কাটায়। আমি মনে করি কোনো পার্টিতে গেলেই বড় বড় দেশভক্তকে দেশদ্রোহী মনে করা নিছক পাগলামি। আমি এতদূর অব্দি যাওয়ার সাহস রাখি না।

পার্টিতে কেন নয়

আমি যে পার্টিগুলোর প্রতি রেগে থাকি তার একটা বড় কারণ এটাই। আজ আমি পার্টি-লিডারদের দেশভক্ত মানি। কালকেই কোনো একটা পার্টিতে ঢুকব আর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্যদের বিশ্বাসঘাতক ভাবার বোকামি করতে হবে! কমসেকম এটুকু ‘গুরুমন্ত্র’ তো পার্টিতে ঢুকতেই দেওয়া শুরু হবে! এই রঙিন দৃষ্টি অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমি এটাকে ভয় পাই। এটা বোঝার মত ব্যাপারও নয়। বুঝবেই বা কী করে? পার্টিওয়ালারা ব্যক্তিত্ব এবং ব্যক্তিগত বোধকে তো শেষই করে দেয়। পার্টিগুলোয় এসবের কোনো জায়গা নেই! ওখানে ঢুকতেই ব্যক্তি নিরেট সমষ্টি হয়ে যায়! এ অদ্ভুত ম্যাজিক, অনন্য ইন্দ্রজাল, বিচিত্র জড়িবুটি যা ঢুকতেই ছুমন্তর করে দেয়! আমি পার্টিতে গেলাম আর আমার স্বাধীনতাই গায়েব, যখন নাকি আমাদের প্রথম লক্ষ্য এই স্বাধীনতাই। চল্লিশ কোটি জনগণের স্বাধীনতা আমরা অবশ্যই চাই। কিন্তু তার জন্য জরুরি নিজের স্বাধীনতা, নিজের ভাবনা-চিন্তার এবং বলার স্বাধীনতা আমরা খুইয়ে দিই – সমষ্টির, পার্টির স্বাধীনতায় ব্যক্তির, ব্যষ্টির এই স্বাধীনতা হজম করিয়ে দিই। আমার মত তুচ্ছ ব্যক্তি এত বড় ত্যাগ করার হিম্মত রাখে না যে যে স্বাধীনতার জন্য লড়ছি-মরছি সে স্বাধীনতাই নিজের জন্য শেষ করে দিই, নিজেকে নিছক মেশিন বানিয়ে নিই আর এভাবে ‘অনেক খুঁজেও তাকে পেলাম না, ঠিকানা পেলাম কিন্তু নিজের না’ ধরণের বৈদান্তিক বাক্য চরিতার্থ করি। আমি মানি যে একটা সীমা অব্দি ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হ্রাস না এনে কোনো প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। কিন্তু এটাও মানি যে এটা বিস্তারের জায়গাগুলোয়, খুঁটিনাটিতে সম্ভব এবং হওয়া উচিৎ। তত্ত্বের বিষয়গুলোতে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থাকাই প্রয়োজন। এটা অন্য ব্যাপার যে সে বিষয়েও, বিশেষ করে ঐতিহাসিক ক্ষণে এবং যুদ্ধের সময়, যখন জীবন-মরণের প্রশ্ন আছে সামনে তখন প্রতিষ্ঠান বা সমষ্টির আমরা যেন খোলাখুলি বিরোধ না করি। আমরা যদি ব্যক্তিগত ভাবনাটা বলে চুপচাপ বসে পড়ি, সক্রিয় বিরোধ না করি সেটা তো বুঝদারিই হবে। কিন্তু ভাবনাটা শেষই করে দেব, সে তো ভয়ানক কথা!

পার্টিগুলোর কীর্তিকলাপ

জেলে এবার পার্টিগুলোর কীর্তিকলাপের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হল তা ভোলার নয়। ওরা যদ্দূর পারল চেষ্টা করল যে যে ওদের মধ্যে শামিল হল না তার জীবন নারকীয় হয়ে যাক। বিশেষ করে একটি পার্টির তথাকথিত মহারথীদের কৃত্য কাঁদিয়ে এবং রাগিয়ে দেওয়ার মত ছিল। লোকেদের নিজের পার্টিতে ভর্তি করতে এবং যারা ভর্তি হল না তাদের জীবন কষ্টময় করে তুলতে তাদের কোনো পদ্ধতি বাকি রইল না। হুমকি এবং মারপিট পর্য্যন্ত করল তারা। পুরো জেলের বাতাবরণ অত্যন্ত দূষিত হয়ে উঠল। জেলে নিজেদের কুঠরি (সেল) থেকে বাইরে বেরোন অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমার তো দৈনন্দিনটাই এমন ছিল যে প্রতিটি মিনিট কাজে ভাগ করা ছিল। দৈনিক ক্রিয়াগুলো ঘড়ির কাঁটা ধরে সময় মত হত। তা সত্ত্বেও আমি সত্যিই ভয়ে ভয়ে থাকতাম যে এই পার্টির ভূত কে জানে কী করে বসে আর কখন কেমন আচরণ করে। তবুও আমার এই ভয় আমি কারোর কাছে ব্যক্ত করিনি। নইলে ব্যাপারটা আরো বেঢপ হয়ে যেত।

দৈনন্দিন

আমার খাওয়া তো চব্বিশ ঘন্টায় একবার এবং সাধারণত দালিয়াই খেতাম। এটা আমার চিরপরিচিত প্রিয়তম আহার্য। জলে সেদ্ধ গমের দালিয়া আমি পরম তৃপ্তির সঙ্গে খাই। তার সঙ্গে শাক-তরকারি বা দুধেরও দরকার নেই। মিষ্টি তো চাইই না। যদি কখনো নুন-মশলা ছাড়া সেদ্ধ শাক-তরকারি বা গরুর দুধের সঙ্গেও খাই তখনো এমনিই। মিষ্টির প্রয়োজনই মনে হয় না আমার। খাওয়ার পর দুধ খেয়ে নিই। এই একাহারের নিয়ম এখন আজীবন চলবে। এতে আমি নীরোগ এবং হাল্কা থাকি। একবার খাওয়া, দু’বার মিলিয়ে সাত-আট মাইল হাঁটা এবং রাতে কমসেকম সাত ঘন্টা ঘুমোন, এই তিনটের সম্মিলিত পরিণাম হল যে আমি এদিকে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় হল, কখনো অসুখে পড়িন। হ্যাঁ, মাথার কাজ দুধ অবশ্যই চায়। তাই রাতে গরুর দুধ ছাড়া আমার কাজ চলে না।

হ্যাঁ, তো জেলে সন্ধ্যায় দুধ খেয়ে সাতটার সময় ঘুমিয়ে পড়তাম এবং রাত দুটোয় উঠে নিত্যকর্ম, আসন এবং হাঁটাহাঁটি পুরো করে নিতাম সকাল হতে হতে। লোকেরা অবাক হবে যে হাজারিবাগের প্রচন্ড শীতেও আমি ঠান্ডার মধ্যে উঠে সব কাজ সেরে অন্ধকারেই দুই গেলাস গরুর দুধের মাঠা খেয়ে নিতাম এবং নীরোগ থাকতাম। গরমকালে তো আমায় বাইরেই শুতে দেওয়া হত। কিন্তু শীতকালেও জেলওয়ালাদের এমন ব্যবস্থা ছিল যে আমার কুঠরির (সেল) তালা রাত দুটোতেই খুলে দেওয়া হত যাতে আমি শৌচ ইত্যাদি সেরে নিতে পারি। শীতকালে শোয়ার আগেই এক বাল্টি জল ভরে উনুনের ওপর রেখে দিতাম। রাত দুটোয় একটু একটু গরম তো থাকতই – অন্ততঃ হাত পায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মত তো থাকতই না। ফলে সে জলে স্নান করা সহজ হত।

রুশের ওপর জার্মানির হামলা

যখন আমরা জেলে গিয়েছিলাম তখন এটাই বিশ্বাস করতাম যে এই ইউরোপীয় মহাযুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে এবং তাই ইংরেজ সরকারের যুদ্ধোদ্যমে যত দূর সম্ভব বাধা দিতে হতে হবে। এটাকেই ইংরেজিতে war-against-war বলে। মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং লেনিনের রচনা এবং মন্তব্য ইত্যাদি পড়ে এটাই শিখেছিলাম যে সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ধকে সফল হতে দেব না। আমরা এটাও দেখেছিলাম যে এই তত্ত্বের পথে চলেই ১৯১৭ সালে রুশের জনগণ, শ্রমিক এবং কৃষকেরা জারতন্ত্র এবং পূঁজিবাদকে উপড়ে ফেলতে যে সফল হয়েছিল। ওখানকার জনতা এই তত্ত্বের বাস্তবায়ন ঘটাল এবং প্রথমে জারের ও পরে পূঁজিপতিদের শাসন খতম করতে সামর্থ্য অর্জন করল। এই তত্ত্বেরই তো টাটকা পরীক্ষা ছিল ওই ঘটনাবলি/ তাহলে আমরা কেন সেই তত্ত্বের বাস্তবায়নের পথে যাব না? ফলে সে পথেই চলতে চলতে জেলে আসতে হল। সেখানেও, রুশের ওপর হিটলারের হামলা শুরু হওয়া পর্য্যন্ত আমাদের ধারণাটা বজায় থাকল। হামলার এক সপ্তাহ পরেই আমাদের চিন্তা আমূল পাল্টে গেল। ১৯৪১ সালের ২১শে জুন মাঝরাতের পর অর্থাৎ ২২শে জুন হিটলারের আক্রমণ শুরু হল এবং জুন শেষ হতে না হতে আমরা স্বাধীনভাবে, কাউকে জিজ্ঞেস না করে বা কোনোরকম বাদানুবাদে না গিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম যে আগের তত্ত্ব আমাদের ছাড়তেই হবে। হিটলার এবং ওর বিগত দু’বছরের সামরিক গতিবিধির সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আমাদের এমনটা ভাবতে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করল।

ফ্যাসিজমের কামাল

এ ব্যাপারে একটু বিস্তারিত ভাবনাচিন্তা করে নেওয়া জরুরি। কেননা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তত্ত্ব পূঁজিবাদের যুগে এবং তার পরিস্থিতি অনুসারে নিজের জায়গায় সাধারণভাবে ঠিক। কিন্তু এই যুগ সাধারণ পূঁজিবাদের নয়, তার গুন্ডাতান্ত্রিক রূপ, ফ্যাসিবাদের, যাকে নাৎসিজম এবং ফাইন্যান্স ক্যাপিট্যালের যুগও বলা হয়। মার্কেন্টাইল ক্যাপিট্যাল (বাণিজ্যিক পূঁজি) এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিট্যাল (শিল্পপূঁজি) এর যুগ পার করে এই ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের (বিত্তপূঁজি) যুগ এসেছে। মোটা ভাষায় আগেরটাকে পূঁজিবাদি এবং পরেরটাকে সাম্রাজ্যবাদি যুগও বলা যায়, বলা হয়। কিন্তু তৃতীয় যুগ সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুশয্যার যুগ যখন জীবনের সাঁঝবেলায় সে ভীষণ লাফ-ঝাঁপ দেয় এবং সব তোলপাড় করে। মার্ক্স, এঙ্গেলস এবং লেনিন অবশ্যই এদিকে নজর দিয়ে থাকবেন। লেনিন তো বিশেষ ভাবে নিজের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এটাও দেখে থাকবেন যে যুগটা আসছে। কিন্তু তাঁরা এই যুগটাকে দেখেন নি। তাই এর অনুরূপে নিজেদের গতিবিধি বদলাবার নিশ্চিত আদেশ স্পষ্ট ভাবে তাঁরা কৃষক-শ্রমিকদের, শোষিত এবং উৎপীড়িত জনতা এবং তাদের নেতাদের দিয়ে যেতে পারেন নি। যদি তাঁদের এই ফ্যাসিজমের জাদুকরির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকত তাহলে এর সাথে মোকাবিলা করার পথ অবশ্যই স্পষ্টভাবে লিখে যেতেন। কিন্তু তা তো হয় নি।

হিটলার এবং তার সঙ্গী ফ্যাসিস্ট – ইটালি এবং জাপান - এর শাসকদের অভূতপূর্ব জয় এবং তার অসাধারণ প্রস্তুতি, এসব বিষয় বাকি দুনিয়া আগে জানত না। কিন্তু এই জয়ের ফলে জানা শুরু হয়েছিল। আমরা জেলে বসে বসে ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলাম যে কী হচ্ছে, কী হবে, যুদ্ধের পরিণতি কী হবে, এই তিনটে শয়তান মিলেমিশে কী করতে চলেছে? এসব প্রশ্ন আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলছিল, বিশেষ করে হিটলারি জাদু এবং তার অসীম সৈন্যশক্তি আমাদের বাধ্য করছিল যে শুধু বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের পরোয়া না করে আমরা দূর ভবিষ্যতের কথাও ভাবি। আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক আমাদের বলতে শুরু করেছিল যে হিটলার সারা জগতের জন্য, পুরো দুনিয়ার জন্য একটি ভয়ানক বিপদ হতে চলেছে। যখন সীমিত কয়লা, লোহা, পেট্রল ইত্যাদির জোরে সে এমন ভীষণ প্রস্তুতি নিতে পারে তাহলে তো রুশ, ইরাক, পারস্য প্রভৃত জয় করে নিলে সে সারা বিশ্বে একচ্ছত্র রাজত্ব করবে এবং জায়গায় জায়গায় শুধু মানুষজনকে দাবিয়ে রাখার জন্য সৈন্য (occupation army) রাখবে। শুধু জার্মানদের আর্য এবং বাকি সবাইকে অনার্য মানার অভিপ্রায়ও এটাই মনে হচ্ছিল যে জার্মানরা বাকি বিশ্বের অনার্যদের ওপর শাসন করবে, তাদের কাঁচা মাল উৎপন্ন করার জন্য ছেড়ে দেবে এবং সর্বত্র জার্মানির তৈরি পণ্যের বাজার খুলে যাবে। আমাদের মগজে কিছুটা এধরণেরই আলোড়ন ছিল, অস্থিরতা ছিল এবং এই দশা ছিল রুশের ওপর হিটলারের আক্রমণের ঠিক কয়েকদিন আগে থেকে – যেমন যেমন আমরা হিটলার ও তার বন্ধুদের ভোজবাজির মত জয়গুলো দেখছিলাম। তবুও আমাদের মনে হয়েছিল যে এক্ষুনি হিটলার রুশের ওপর হামলা করবে না। বাকি সব দেশ জয় করে দু’এক বছর থামবে তারপর পুরো প্রস্তুতি নিয়ে রুশের ওপর আক্রমণ করবে। নিঃশ্বাসও তো নিতে হবে তাকে!

যখন হঠাত রুশের ওপর হামলা করল হিটলার আমরা চমকে উঠলাম। প্রথমে তো আমাদের বিশ্বাসই হল না যখন একজন সঙ্গী আমাদের বলল হিটলার রুশের ওপর হামলা করে দিয়েছে। তখন অব্দি আমরা সেদিনকার খবরের কাগজ পাই নি। আমরা বললাম, একদম মিথ্যে। যখন সে সঙ্গী দ্বিতীয়বার বলল তখনও আমরা বিশ্বস করতে প্রস্তুত ছিলাম না। যখন তৃতীয় বার বলল তখন আমার মুখ থেকে হঠাত বেরিয়ে গেল হিটলার ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আমিও বুঝতে পারি না কি করে আমি কথাটা বললাম। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলী বলছে যে সে অবশ্যই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। সে ক্ষিপ্ততা কেন এবং কেমন ছিল সে অন্য কথা। আমরা রুশের শক্তি একটু একটু জানতাম। সেটাও এক কারণ ছিল হিটলারকে ক্ষিপ্ত বলার। যখন এক এক করে লেনিনগ্রাড, মস্কো এবং স্টালিনগ্রাডের চার দিকে হিটলারের ঘেরাবন্দি শুরু হল আর জেলে আমাদের সঙ্গীরা বলত এই নিল হিটলার, এই নিল … তখনও আমি বার বার বলতাম ও নিতে পারবে না লেনিনগ্রাড, মস্কো জয় করতে পারবে না হিটলার … ইত্যাদি। এসব কথাও সত্যি হল।

কিন্তু এবার তো আমারও অস্থির লাগতে শুরু করল যে এ কী হতে চলেছে? এই বৈশ্বিক বিপদের (world menace) মোকাবিলা কী করে করা যায়? আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোচ্ছিলাম যে বাকি দুনিয়াকে পারস্পরিক মতভেদ ভুলে এই একমাত্র বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। অন্য পথ নেই। আমরা মানতে শুরু করেছিলাম যে ভারতেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ খতম করে জার্মান ফ্যাসিজম এসে জুড়ে বসবে। ফলে আমরা উনুন থেকে বেরিয়ে চুল্লীতে গিয়ে পড়ব। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদিদের কবল থেকে আজ নয়ত কাল বেরোবার আশা যদিও বা রেখে থাকি হিটলারি পিশাচদের কবল থেকে প্রাণ বাঁচাবার আর পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ কথাটা আমরা কংগ্রেসের একজন প্রমুখ নেতাকে বললাম এবং কয়েক ঘন্টা তাঁর সাথে আমার কথোপকথন চলল। উনি তক্ষুনি কোনো উত্তর না দিয়ে ভেবে পরে উত্তর দেবেন বললেন।

জন স্ট্র্যাচির বই

কিছুদিন পর উনি মিস্টার জন স্ট্র্যাচির একটা টাটকা ইংরেজি বই পাঠিয়ে দিলেন। নাম ভুলে যাচ্ছি। বললেন আমি যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম তা নিয়েই বইটাতে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আমি মন দিয়ে বইটা পড়লাম। আসলে লেখক মিস্টার স্ট্র্যাচি আগে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রতি পার্টির এবং জনতার মনোভাব কী হবে এই বিতর্কে পার্টির সঙ্গে তাঁর তীব্র মতভেদ হল এবং পার্টি থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে এই বইটা লিখলেন। ওনার বক্তব্য ছিল যে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যুগ চলে গেছে। ফ্যাসিজমের এই যুগে চোখ বুঁজে ওই আপ্তবাক্যটা মানা বিপজ্জনক। আজ তো তার বিপরীতেই কাজ করা দরকার। কল্পনা করুন যে লেনিনের সময় বিগত যুদ্ধে কাইজারের জায়গায় হিটলার থাকত এবং তার তেমনই প্রস্তুই থাকত যেমন আজ রয়েছে। তাহলে কি লেনিন জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে জারতন্ত্রের যুদ্ধোদ্যমে বাধা সৃষ্টি করত? কিছুতেই না। কেননা তা করলে ফল হত যে জারকে হারিয়ে লেনিন বা সোভিয়েত শাসনের বদলে হিটলারেরই শাসন হয়ে যেত। ফলে লেনিনের লাভের বদলে ক্ষতি হত এবং রুশের স্বাধীনতা যুগযুগান্তরের জন্য স্থগিত হয়ে যেত। লেনিন জার এবং কাইজার দুজনেরই শক্তি জানত এবং ভরসা ছিল তার যে যদি জারের গদি খালি হয়ে যায়, তাতে এসে বসে পড়ার শক্তি কাইজারের নেই। সাম্রাজ্যবাদের যুগে এমন ঘটনা দেখা যায় নি। তবুও সঙ্কটের মুখোমুখি তো লেনিনকে হতেই হয়েছিল। কিন্তু ফ্যাসিজমের যুগে তো একেবারেই অন্যরকম ব্যাপার। যদি আজ জার ওখানে থাকত এবং রুশের জনগন তাকে হারিয়ে দিত তাহলে খুব সহজে হিটলার করায়ত্ত করত ওখানকার রাজপাট। এমনিতেও এবারও তো হাতের মুঠোয় নিতে নিতে কে জানে কেমন করে পিছলে গেল। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্লোগানে আজ এটাই বিপদ। তাই আজ তো আমাদের কর্তব্য যে ওই পথে না চলে উল্টোটা করা যাতে ফ্যাসিজমের নাগপাশ জড়াতে না পারে। নইলে জনতার নিস্তার নেই। ওই নাগপাশ থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সাম্রাজ্যবাদিদের মোকাবিলা তো পরেও করা যাবে।

আমার মাথায় এ কথাগুলো বসে গেল এবং আমার অস্থিরতা কমতে শুরু করল। আমি তো নিজেও এভাবেই ভাবছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গী কেউ ছিল না। এবার মিস্টার স্ট্র্যাচির মত স্যাঙাৎ জুটে গেল। দিনের পর দিন আমার ভাবনা পরিণত রূপ পাচ্ছিল এবং জেলে বসে আমি ভাবতাম যে এবার সুযোগ এলে আমরা ব্রিটিশ সরকারকে তাদের যুদ্ধোদ্যমে সাহায্যও করতে পারি। এতে কোনো অনৌচিত্য দেখতে পেতাম না। বরং এটাই মনে হত রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দাবি। কেননা যদি ভারতীয়দের বিরোধ সফল হত এবং ইংরেজ এখান থেকে পালাত তাহলে হিটলার বা তোজোরই সরকার এখানে তৈরি হত, গান্ধি, নেহেরু বা আজাদের নয়। আমাদের ওই নিরস্ত্র সেনা ওদের অস্ত্রে-শস্ত্রে সবদিক থেকে সুসজ্জিত বাহিনির সামনে কিভাবে দাঁড়াত? আর যদি আমাদের বিরোধ বিফল হত তাহলে ইংরেজ সরকার আমাদের পিষেই ফেলত। ফলে দুভাবেই আমাদের শুধু ক্ষতিই ছিল।

এসবই ভাবছিলাম, তখনই ১৯৪১ সালের শেষ দিনগুলোয় হঠাত শ্রী ইন্দুলাল যাজ্ঞিকের একটা চিঠি পেলাম জেলে। তাতেও মোটামুটি এধরণেরই কথাবার্তা ছিল। পড়ে তো আমি যারপরনাই খুশি হলাম যে পুরোনো সঙ্গী আমরা দুজনই একই কথা ভাবছি, তাও একে অন্যের থেকে এত দূরে বসে। আমিও উত্তর দিয়ে ওনার ভাবনার প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানালাম। তারপর ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাগপুরে কেন্দ্রীয় কিসান কাউন্সিলের পরিকল্পিত বৈঠকের একটি প্রস্তাব প্রকাশিত হল যাতে বলা হল যুদ্ধোদ্যমে বাধা দেওয়ার নীতি ত্যাগ করা হোক। যুদ্ধে সাহায্য করার ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট কথা ওতে ছিল না। শুধু সোভিয়েত রুশ কে সাহায্য করার কথা ছিল। আসলে প্রস্তাব যারা পাশ করছিল তারা বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিল। ফলে, যুদ্ধোদ্যমে সাহায্য করার কথাটা বিপজ্জনক বুঝে কোনো সিদ্ধান্তে এল না, ছেড়ে দিল। যদিও আমি এ রহস্য বুঝতে পারলাম না। তবে প্রস্তাব পড়ে মন প্রসন্ন হয়ে উঠল।

বিরোধীদের মনোভাব

কয়েকজন যারা এখনো অব্দি কিসান-সভার সঙ্গে ছিল, নাগপুরের এই প্রস্তাবটার বিরোধ করল। ওদের মনোভাব বোঝা মুশকিল। এর আগে অন্ধ্র প্রদেশের পকালায় ১৯৪১ সালের অক্টোবরে অল ইন্ডিয়া কিসান কমিটির বৈঠকে যুদ্ধেরই বিষয়ে যে প্রস্তাব স্বীকৃত হয়েছিল, তাতে ওই সঙ্গীরাও ছিল, সহমত ছিল। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে যে “এই কমিটি স্বাধীনতাকামী ভারতীয় জনগণ এবং বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং যুবকদের বিশাল সমূহকে আপীল করে যে তারা সোভিয়েত রুশকে যত রকম সম্ভব সাহায্য করুক এবং নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সব মোর্চায় তীব্র করার জন্য কাজ করুক” – The AIKC urges upon the freedom-loving people of India, particularly the vast bulk of peasants and workers, students and youths, that they should render all help possible to the USSR and work for the intensification of war against Nazi Germany on all front.”       

নাগপুরের প্রস্তাব থেকে এ প্রস্তাবের ভিন্নতা এবং বিশেষত্ব হল যে সোভিয়েতকে যথাসম্ভব সাহায্য করা ছাড়া নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সবকটি মোর্চাকে বেগবান করার কথা বলল। এখন একটু ভাবা যাক যে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সম্ভাবিত যুদ্ধকে বেগবান করার অভিপ্রায় কী? তাও সবকটি মোর্চায়? ইংল্যান্ড অথবা ফ্রান্সে যে মোর্চা ছিল তাকে শক্তিশালী করার জন্য কী করার প্রয়োজন ছিল? এ কথাটা কি ওরা ভাবল? ওই যুদ্ধে সব রকমের সাহায্য সব জায়গায় দেওয়া ছাড়া আর কী অর্থ হতে পারত কথাটার? অন্য কোনো ভাবে সব মোর্চায় ওই যুদ্ধে গতি কিভাবে আনা যেত? আর যখন সব জায়গায় ওই যুদ্ধে সাহায্যই করার, তখন ওই যুদ্ধের বা যুদ্ধোদ্যমের বিরোধ কিভাবে কেউ করত? কিভাবে সম্ভব হত সেটা? ওই প্রস্তাবে এটাই পরস্পরবিরোধী ব্যাপার ছিল। নাগপুরে যারা বিরোধ করেছিল তাদের কাজে এবং পকালার প্রস্তাবে এটাই পরস্পরবিরোধ ছিল এবং এটাই নাগপুরের প্রস্তাবে থাকতে দেওয়া হল না। বলা হল যে “শান্তির মত যুদ্ধকেও ভাগ করা যায় না”, “War, like peace, is indivisible.” তাই ওতে সাহায্যও করব এবং ওই যুদ্ধের বিরোধও করব, এটা সম্ভব নয়। তাই নাগপুরের প্রস্তাব যখন পকালার বক্তব্য এবং বিরোধীদের কাজে হতে থাকা পারস্পরিক বিরোধটা মিটিয়ে দিল তখন বিরোধীদের ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানান উচিৎ ছিল। কিন্তু তারা উল্টো কাজটাই করল।

কিসান-সভায় বিরোধ

জেল-জীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শেষ করার আগে কিসান-সভার সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ওপর আলোকপাত করা জরুরি। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে জেলে যাওয়ার পরেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে যদিও সোশ্যালিস্টেরা পলাসার প্রস্তাবের সঙ্গে ছিল, তবুও সে প্রস্তাব বাস্তবায়নের কট্টর বিরোধী ছিল তারা। এমনিতেও এ ব্যাপারটা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। জেল যাওয়ার পর স্পষ্ট হয়ে গেল। ওরা নিজেদের সর্ব শক্তি নিয়োজিত করল যাতে পলাসার প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হয়। ব্যাপারটা সবাই এত ভালো করে জানে যে এটা বোঝাতে তর্ক করা, যুক্তি দেখানো বা প্রমাণ পেশ করা অনাবশ্যক। ফলে কিসান-সভার বাকি লোকেদের চোখে, যাতে ফরোয়ার্ড ব্লকের লোকেরাও ছিল, খুব লাগল ব্যাপারটা এবং কিসান-সভার আভ্যন্তরীণ বিরোধ উগ্র রূপ ধারণ করল। এসব খবর আমি জেলে বসেই পেতাম এবং মনটা দুঃখি হয়ে উঠত। কিন্তু করতাম কী? নিরুপায় ছিলাম। এটাও একটা কারণ ছিল যার জন্য, যখন জেলে ‘জনতার পার্টি’র প্রশ্ন উঠল আমি সেই পার্টিতে যেতে অস্বীকার করলাম। একই কারণে আমি তখনও না করলাম যখন সোশ্যালিস্ট সঙ্গীরা গুরুত্বসহকারে, ভবিষ্যতে আবার মিলে-মিশে কাজ করার প্রশ্ন ওঠাল।

এই আভ্যন্তরীণ বিরোধ এতদূর বাড়ল যে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডুমরাওঁয়ে পন্ডিত যমুনা কার্যীর সভাপতিত্বে যে প্রাদেশিক কিসান সম্মেলন হল, সে সম্মেলন থেকে সোশ্যালিস্টেরা বাইরে বেরিয়ে এল। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অন্য ভাবে। ওরা ভিতর-ভিতর চেষ্টা করেছিল যেন কিসান-সভায় ওদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়ে যায়। তার জন্য সব কিছু করল ওরা। কিন্তু যখন কনফারেন্সে ওরা বুঝতে পারল যে ওদের সংখ্যা নগণ্য এবং ওরা নিজেদের উদ্দেশ্যে অসফল হয়েছে, তখন কনফারেন্স থেকে সরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় তো ছিলই না। ফলে শুরুতেই উল্টো মুখে ফিরে বেরিয়ে গেল। সম্ভব ছিল যে ওখানে আগের কাজ এবং চালচলনের ওপর টীকাটিপ্পনী হত। তাই, আগেই বেরিয়ে আসা উচিৎ মনে করল। তখন কিসান-সভায় খাঁটি কিসান-সভাবাদিরা ছাড়া রইল শুধু কম্যুনিস্ট এবং ফরোয়ার্ড ব্লকিস্ট। তবুও সভার কাম অবাধ ভাবে চলছিল। ওদিকে সোশ্যালিস্টেরা একটা আলাদা কিসান-সভা তৈরি করার জন্য সব রকম ভাবে আটঘাট বাঁধল। সে কাজে তারা কদ্দূর সফল হল তা সবাই জানে। আমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি ছাড়া পাওয়ার আগে ব্লকিস্টদেরও আওয়াজ উঠেছিল কিসান-সভার বিরুদ্ধে। কয়েকটি ইস্তফাও দাখিল হয়েছিল। কিন্তু ওদের সাথে আমাদের সঙ্গীদের সম্পর্ক তখনো ভাঙে নি। হয়ত কাঁচা সুতোয় জুড়েছিল। বিহারের কিসান-সভায় তখনো অব্দি কম্যুনিস্টদের সংখ্যা ছিল গোনাগুনতি।

ডুমরাঁওয়ের সংগ্রাম

যখন জেলে ছিলাম তখনই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল কিসান-সভার ইতিহাসে, যা শুনে আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। শাহাবাদ জেলার ডুমরাঁওয়ে খোদ মহারাজার ছলচাতুরি এবং যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কিসান-সভার পরিচালনায় কৃষকরা সংগঠিত লড়াই করল। মাথা উঁচু করল সভার। কৃষকদের জয়ও হল সে লড়াইয়ে। শুধু কৃষকদের নয়, সাধারণ মানুষ এবং ডুমরাঁওয়ের বানিয়াদেরও সঙ্কটের অবসান হল সে লড়াইয়ে এবং সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।                

সমাপ্ত