Friday, January 29, 2021

তোমরাও দেখি আমাদেরই মত হলে - ফাহমিদা রিয়াজ (পাকিস্তান)

তোমরাও দেখি আমাদেরই মত হলে
এ্যাদ্দিন ভাই কোথায় লুকিয়ে ছিলে,
ঠিক সেই এক বোকামি আহাম্মকি,
খোয়ালাম যাতে শতাব্দী আমরাও,
আরে বাহ, করি অভিনন্দন! অভিনন্দন নাও!

নাচছে ধর্ম-প্রেত, করবে হিন্দুরাজ স্থাপন?
রবে উল্টো কাজ, ভাঙবে বাগানখানি আপন।

তোমরাও বসে ভাববে হয়েছে আয়োজন সব তেমনই
হিন্দু কে আর কে নয় তার ফতোয়া করবে জারি
ওখানেও হবে কঠিন বাঁচা, ছুটবে ঘাম মাথার
যেমনতেমন কাটবে দিন, আটকাবে দম সবার
সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছ, শিখতে, পড়শিকে দেখনি।

কী দুর্দশা করেছি নিজের, দেখনি তোমরা কিছুই?
কাল ভাবতাম দুঃখে আজ ভাবতেই হাসি পেল,
একদম যেন আমরা, আসলে ছিলামই না দুই জাতি।

অভ্যেস কর, পারবে, চালাও উল্টো পায়ে হাঁটান,
অন্যদিকে মনটা না যায়, পিছনে রাখ নজর,
নিকুচি করেছে শিক্ষার, কর আকাটের গুণগান।

সামনে গর্ত, দেখ না; আন অতীত যুগ ফেরৎ,
জপ করে চল, বার বার বল,
কেমন শ্রেষ্ঠ বীর ছিল, মহিমান্বিত ছিল ভারত,
তাহলেই পৌঁছোবে, একবারে পরলোকে
আমরা তো সেথা আছিই আগের থেকে,

তোমরাও আন এগিয়ে সে দিনক্ষণ,
যাবে যে নরকে সেখান থেকে চিঠি-খৎ দিওখন।


 

Monday, January 25, 2021

চিলেকোঠা

সে কবির ঘর বলতে ছিল চিলেকোঠা।
রাতের আকাশ ফিকে সাদা মুখর শহরছটা।
সদ্য সে ধরেছিল জায়গা দাঁড়াবার,
লিখতে লিখতে বুঝতে চেয়ে বাঁচার সারাৎসার।
 
আর সে বন্ধু, স্বৈরাচারী তান্ডবের দিনে
বেঁচেছিল দূরের চাকরি জুটিয়ে পশ্চিমে।
তারও ঘর চিলেকোঠায়, বৌ-বাচ্চা নিয়ে।
ও ঘরেই ছক কষেছে, লড়েছে এগিয়ে।
 
মালিক ভাবে চিলেকোঠা একটা ঘরের কোন।
আমরা ভাবি বাইরে পেলাম অনেকটা উঠোন।
সাত ঘরের ভেজা কাপড় সরিয়ে কিনারে
দেখাই তো যায় সাগরটা, বন্দরের ওপারে।
 
সেদিন এক চিলেকোঠায় বলতে হাতের ছোঁওয়ায়,
বিরাট এক কৃষ্ণচুড়ার লালহলুদ মাথা!
দূরে দেখি মিনার-কপিকলের দীর্ঘ হাত
শক্ত মুঠোয়, নির্মীয়মান সেতুর লোহার পাত।
 
বস্তুতঃ এই কোঠা, জীবন শুরুর শাপেবর।
ছন্নছাড়া দিনেরাতে স্বপ্ন গোছানোর।
এখন যদি সাজশ করে বাড়িমালিকের পাল,
চিলেকোঠা ভাড়া না দেয়, তাহলেই গোলমাল।

ব্যাঙ্গালোর
১৯.১.২১




 

কাপাস

দুহাজার একুশ, ছাব্বিশে জানুয়ারি।
সশস্ত্র সেলাম নেবে ধাপ্পাবাজ-ধাড়ি,
তন্ত্রে হুমহাম করবে লালকেলায়।
 
গণ থাকবে দূরে এক দিব্য বেলায়
একটু পরে ধরবে নতুন কুচকাওয়াজ।
পতাকা আর কন্ঠধ্বনিই হবে যুদ্ধসাজ।
 
সেলামি হাত তুলে যারা এক-দু-এক
চলার শ্রেষ্ঠ ছন্দে চলবে, তাদের বিবেক
থাকবে দূরে, যেথা তাদের বাপ, মা,
 
বোনেরা আঁকছে দেশের রক্ত-দ্রাঘিমা
দুমাস ধরে মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়ছে।
শস্য-চোরের কালোহাত চেপে ধরছে।
 
আদালত তড়পাচ্ছে কে চাষী, কে নয়!
চাষী, ধনখাঁচা-বাসী চেনাচ্ছে সময়।
ভাবো ধর্মধান্ধায় ঘোলা থাকবে মুক্তি,

চিরকাল? ভারত হারাবে তার শক্তি?
চার্বাক, বুদ্ধ, কবীর এই মাটির আকাশ!
রোদ্দুরে পাকছে গণ-ঐক্যের কাপাস।

ব্যাঙ্গালোর
১৮.১.২১  

 


গণেশদার সাথে

দেখা হওয়া না হওয়ার তো কোনো হিসেব থাকতে পারে না!
রাখতেও নেই হিসেব; এত বছর ধরে জানি সমস্যাগুলো
আমার এক্তিয়ারে মনে হলেই ডাক পড়বে ফোনে, পালবাবু!

তা সে ইন্টারন্যাশনাল গাইতে হোক নব্বইয়ের শুরুতে,
কিম্বা খ্রুশ্চেভ লায়েড পেতে, বইটা বেরোবার পরের বিকেলে,বা
সিপিএসইউবির ইতিহাসের শেষ নপাতা এই সেদিন।

আর সেটুকুই সাহায্য নেবেন যা চেয়েছিলেন; রিকশার দিকে
এগোতে গেলেই বাধা দেবেন নিজেই উঠবেন লাঠির ভরে
শেষ দুপুরে কাঁপতে কাঁপতে, একবার না হোক তিনবারে।

বাহাদুরপুরের পার্টি অফিসটা মনে আছে অনুপম? সে বোধহয়
তোমাদের কলকাতা চলে যাওয়ার পরের ঘটনা। তবু,
মনে তো থাকারই কথা কতবার তো এসেছ পরে, অফিসের,

মানে রামানন্দ ভবনের ছাতে সময় কাটিয়েছ অনেকক্ষণ!
স্মৃতির সিন্দুক ছিলেন। আমি তো পারিনি, যিনি খুলেছিলেন,
তিনিও চলে গেলেন কিছুদিন আগে আর এবার গণেশদাও।

সেদিন তো তাঁকে ডাকিওনি বয়সের কথা ভেবে, সন্ধ্যায়।
তবু এলেন। কাশ্মীর নিয়ে প্রতিবাদসভা। যেচে বললেন।
অস্থির ক্ষোভে ডাকলেন বাঁচাতে কাশ্মীরিয়ত, হিন্দোস্তানিয়ত।    

ব্যাঙ্গালোর
১১.১.২১



বল

মানুষ কি ভয় পায় না?
সাবধানেই এগোয়।
হাতের ভর না দিলেও,
ভরের কাঁধটা ছোঁয়।

পথটা যে কঠিন!
পিচ্ছিলে পা রাখা।
দিনের আকাশটাও
শেষের ছায়া মাখা।

ভরের কাঁধটা কার?
সে তো আরো দুবল!
তবুও সেই তো বায়
স্বপন নদীর জল!

তাবলে কি বসব,
ফেরত গিয়ে ঘরে?
তবে আকাশ কিইবা?
ভোরের মর্মরে?

বাঁচার ভিড়ে হাঁটা
তাই তো ভালোবাসা!
তাই তো আমিতুমি
অনেক মনের আশা!

কোথায়, এসো দর্প!
হও শিরস্ত্রাণ।
রঙে, চিহ্নে,
জীর্ণ যুগল কাঁধ
গাইছে ন্যায়ের গান!

ব্যাঙ্গালোর
৭.১.২০



 

তাঁবু গেছে কত দূর?

অন্যায়ে চোখেচোখ,
আপোষ না মানা রোখ!
শীত, জল, হিমপিঠ,
হাতেহাতে ঘনগিঁঠ।
 
শত্রুও ভিনদেশ না,
নির্বাচিত সরকার।
বলছে মরলে কী?
আমরা কি দায়ভাগী?
 
শিবির-শহর পথে
পথভাঙা নয়া গতে
সংস্কৃতি রচি যথা,
ইতিহাসে সভ্যতা!
 
উড়ালপথের থাম,
গ্রন্থালয়ের ঠাম!
তাঁবুর ভিতরে বান
তাতেই দাঁড়িয়ে গান!
 
বেলা বাড়ে সভামাঠে,
স্লোগান, ঐক্য-ঠাটে!
ঢোকে দল নানাভাষী,
সারা দেশপথে চাষী।
 
দুপুরে লাইনে রোজ
পথেই ভারতভোজ!
তাঁবু গেছে কত দূর?
বদলটা যত দূর!
 
ব্যাঙ্গালোর
৬.১.২১



বেঙ্গালুরু – ৪ জানুয়ারি ২০২১

সকাল থেকে কয়েক ঝাঁক পায়রার
বিষন্ন ওড়াউড়ি শূণ্য স্কুলবাড়িটার ছাতে, কার্নিশে,
বারান্দায় ... শিশুরা আসছে না এক বছর হতে চলল।

সামনে মারিয়াম্মা মন্দিরেরই খোলা মাঠে
অনুষ্ঠান হত ওদের জয়ন্তী উদযাপন বা বার্ষিক
পুরস্কার বিতরণ, নাচ, গান, খেলা দেবীও কি বিষন্ন?

বিষন্ন সবাই, দক্ষিণের এই শহরের দেয়ালে অঙ্কিত
জননায়কেরা (বুদ্ধ ও আম্বেদকরকে দেখতে পারছি),
প্রাতঃস্মরণীয়েরা (এক কুভেম্পুকে চিনছি),

স্কুল বন্দ থাকা চাট্টিখানি কথা?
এ দেশটার নতুন হয়ে ওঠার সমস্ত রকম
মানে সমস্ত রকম ভোরের রাস্তায়

দৌড়োনো খেলোয়াড় থেকে রাত জেগে বেলা অব্দি ঘুমোনো
কবি অব্দি হয়ে ওঠার গানের দেড়শোরও বেশি বছরে
প্রধান আবহ-সুর, স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের কিচিরমিচির

অথবা না যেতে পারা বাচ্চাদের জন্য ক্ষোভ, বিতর্ক ...
আর সেই স্কুল বন্দ কত মাস!
আমরা অনলাইন ক্লাসে খুঁজছি আশার নতুন গড়ন

ব্যাঙ্গালোর
৪.১.২১



দিল্লীর প্রবেশপথগুলোয়

কৃষকেরা তলাচ্ছিল মৃত্যুর পল্বলে
গত বছর চেনাল পথ রক্ত-পায়ে চলে
আজ তাদের বাড়ছে ভীড় বাঁচার অমলে

চারাচ্ছে শাসক, দেশে হিংসাধর্ম-স্রাব
মারছে মানুষ মাথায় দিয়ে পাষন্ডতার আব
বছরে হত্যার তারা লুকোচ্ছে হিসাব
 
কৃষকই আটকাল তাদের, শ্রমিক আছে সঙ্গে
তন্ত্রপ্রধানেরা ভয়ে ভুল করছেন রঙ্গে
মাঝমাঠে ভারত-মাই হাসছেন ভ্রুভঙ্গে   

কোথায় ছিলে আনন্দ?
আগেও তো পুহিয়েছি রোদ এত শীতে
বন্ধু-ভীড়ে গা-ঘেঁসেছি, কলহে-পীরিতে
পাইনি এমন ছন্দ!

ব্যাঙ্গালোর
৩.১.২১



 

বি এম দাস রোড

ভেষজ কারখানা থেকে ছড়ানো ঝাঁজগন্ধ যেমন, ঘরের নিচু ছাতটাও
সয়ে গিয়েছিল; রেললাইনের ওপারের নতুন পাড়ার মানুষ, মজেছিলাম
রাস্তাটার বাঙালি নামে, আমাদের ঘরবাঁধার বাঙালিয়ানায় চারদিকে
কোচিং, স্কুল, কলেজের যুবমুখ, পাশেই মুসলমানি মোহল্লায়
রোজার সন্ধ্যার শির-চা, পুরোনো বন্ধুদের স্মৃতি, দুয়া-সালাম ...
ভালো লাগার সবকিছুই কাছে কাছে ডিওয়াইএফের অফিসঘরটায়
বসে গান গাওয়া, রাহুল পাঠচক্র, ফুটবলে যুবপ্রচার কলেজের মাঠে!

দুচার বছরের থাকায় কত কি দেখলাম বল! ভুমিকম্প, রামশিলাদাঙ্গা,
বাবরিপতন, কার্ফ্যু ... ওদিকে ঘাড়ে ভুয়ো মামলার খাঁড়া, ঝঞ্ঝাট ...
তার মাঝেই রাতে নিজের রক্ত আবার ব্লাডব্যাঙ্কে থলেয় ভরে সাইকেলে
তিন মাইল তোমার প্রসূতিশয্যায় পৌঁছোলাম; তোমায় দেওয়া হল
প্রথম জানলাম দুজনের রক্তের গ্রুপেও মিল দেখছিলাম সারারাত,
জ্ঞানে ফিরে, কন্যার জন্মে প্রসন্ন ঘামবিন্দু তোমার উত্তপ্ত কপালের!

এখন আর আমরা নেই। কিন্তু পাড়াটা রয়েছে জানো? উন্নয়নে চাপা।
গলির ভিতরে আরো সরু গলি খুলে গেছে, নালার ওপরে পাটাতন!
সে কারখানা নেই কিন্তু ভেষজ ঝাঁজ আরো অসহ্য ভিতরগলির পচা ইঁটে।
সে রোদটাও দুপুরে একবার নামে মাঝগলি অব্দি ছড়ানো সাবানফেনায়।
পৃথিবী সমতল নয়। কোণ-ঠাসলে পড়বেনা জীবনাংশ। শাসকের ভ্রান্তি।

 

ব্যাঙ্গালোর
২৮.১২.২০



 

ঈশ্বর

জ যে কিছুই করিনি! ভাত পাব, ঈশ্বর?
ভালো হত, আমার এমন কথায়
কান না দিয়ে বেরোতে ঘর থেকে
কুড়ুল কাঁধে, গুঁজতে বনে ঝর্ণামুখে পাথর।

আমার সব কাজের ছকে সারাটা দিন ঘুরে
বাড়িয়ে তুলতে বাধা; আমার রাগে
হাসতেওনা, নিরেট, যেন জন্তু আমি,  
ঘ্যানঘ্যানানি না থামালে ঢিল মারতে ছুঁড়ে।

মুশকিল যে তোমায় গড়েছিলাম মনের মত।
যাতে পাথর সরাতে রাতগুলো
না মনে হয় নেকড়ের ঘেরাবন্দি
ঝর্ণামুখে ঝিমোলে, ইঁদুর না চাটে ক্ষত।  

গুরু ছিলে, বন্ধু ছিলে, হলে রাজার ছায়া!
রাজার আদত শত্রু আমি; যা পারি,
পাথর খুঁড়ি। কুড়ুল কাঁধে বেরোই।
তবু স্মৃতি বিবর্ণ এক বন্ধুত্বের মায়া।

ব্যাঙ্গালোর
২১.১২,২০



অবাক কান্ড

শাসকেরা লুকোচ্ছিল ইতিহাসের রোদ।
সরকারি লোক লাগিয়ে বশ্যতার কালো
পর্দাগুলো টাঙাচ্ছিল সত্যের জানলায়।
যাতে দেশের ছেলেমেয়ে জানতেও না পায়
ভুগোল নয়, ধর্ম নয়, রাজার ধ্বজাও নয়,
দেশ গড়ে অন্যায়ের দীর্ঘ প্রতিরোধ।

এমন হল, বর্তমানই ভাঙছে ঝুঠের মৌজ।
ইতিহাসের পর্দা দিচ্ছে খুলে।
ছেলেমেয়ে দেখছে চোখ মেলে
অবাক কান্ড! বন্ধ রাজধানী?
তাহলে আয়, এখানেই ব্রেক টানি
ঢোকার মুখেই তাঁবু তুলুক লাঙলবাহীর ফৌজ!

হাড়কাঁপানো সকালে এই ফৌজ ঘিরে বাড়ছে দেশের আশ!
হাতের গরম, কথার মরম, রুটির নরম সাঝা করছে বসে, 
ভালো থাকতে চাওয়া পৃথ্বীর যুদ্ধনিঃশ্বাস।

ব্যাঙ্গালোর
২১.১২.২০



মাঝরোদ্দুর

ভাষার কথা যদি বলো,
মা আমার বাংলা তবে,
হিন্দিধাই মা।
মাঝরোদ্দুর আমার খেলা,
একটেরে ছায়ায় গিয়ে
ছন্দ পাই না ।
 
মুখে লেথোই ধড়িবাজির
তিলকধারী সরকারি
ভাষার দাদাগিরি।
কিন্তু মাথায় থাকে পাড়ার
গলিতে ধাইমায়েরও হাত,
পথ দাপিয়ে ফিরি।
 
মাঝরোদের কুঁয়োতলা
বাল্টিটা ওই ডুবো ডুবো
পাঠাচ্ছে ঢুপ-ঢুপ?
মাতৃভাষায় খুঁজি বরং
কার বুকে বাজছে আর
কার বুকটা চুপ!
 
জলই আমার দুই মা,
যখন যেমন শব্দ, লিপির
জুড়ি করতল
প্রতিধ্বনি শুনি আমার
ডাকের – খাই কুঁয়োর মিঠে,
কেঁপে ওঠা জল।

ব্যাঙ্গালোর
২৫.১২.২০


 

ভাষাপ্রসঙ্গ

ট্র্যাডিশন বাঁচিয়ে রাখব স্যার!
দুমুঠো পাটশাক, স্নেহের ছাত্রটিকে দিতে
চড়া রোদ্দুরে হাঁকাব সাইকেল
পেরুব খানাখন্দ, অশথতলা
যা আমাদের বয়সকালে হবে আরো একপ্রস্থ দমছুট জীবনধারণ

ট্র্যাডিশন এমনিতেও বড় শক্ত জিনিষ
মনে রাখে পুরোনো ছোবল
প্রণয়ের পাবকস্পর্শ অবিনাশী
বৃষ্টিতে নীরবে মুছে যাওয়ার স্বচ্ছতা
বাদাম কেনার এক ছটাক কার্বাইডের আলো
বিশ্বাসের
হয়ে ওঠা ভারতবর্ষ জননী
সুনীল জলধি হতে, বিপর্যস্ত অবেলায়
এবং লেগে থাকা এবং অভিমানের
হিমশক্তি ঢেকে রাখা কাজের গরম।

নতুন লোহার গেটে জং ধরেছে পুরোনো বৃষ্টিতে;
আপনার প্রজন্মের সেই তেজীয়ান
দিদিটি, দেখছি বয়সের ভারে ঝুঁকে
তবু একাই এক কেয়ারি ক্রিসান্থিমামে একশ ...
নবজাগরণ! র‍্যাডিকাল মনন!
স্মরণের ভিত্তিচিত্রে জনমনে উদ্বীক্ষণ!
গিয়ে দাঁড়াচ্ছি নতুন মুখ, ঈষৎ সন্দেহপ্রবণ।

ট্র্যাডিশন বাঁচিয়ে রাখব স্যার !
লিখব উপচে পড়া প্রায় হিজিবিজি পোস্টকার্ড
সংগঠন ব্যক্তিমন মিলিয়ে মিশিয়ে,
উল্টো করে লেখা নিজের বাতগ্রস্ত হাঁটুর কুশল,
ছাপিয়ে ভাঙাচোরা লাইনে আরো একটি কাজের নির্দেশ,

পুরো না হলে মানুষমুড়িয়ায়
গিয়ে নিজেই দেখব,
শক্ত ঢেলা ভাতের সাথে ভাষাও কিভাবে মরিয়া হয়ে লড়ছে;
পঁচিশ বছর পর
পুরোনো কাঁঠালগাছ পেরিয়ে ডাক দেব
রামনাথ!
শব্দে আছ না ব্রহ্মে?
স্কুলটা রয়েছে ! রয়েছে কিচিরমিচির শিশুদের !
এস করি রৌপ্য নাকি স্বর্ণজয়ন্তী উৎসব,
অভাবের
এবং অবশ্যই, স্বভাবেরও।

 

৩.২.২০০০



বিবেকানন্দ পথ

শিকাগো শূণ্যের নিচে সকালে
বিবেকানন্দ পথের সামনে দাঁড়িয়ে ওই গাইডের অজ্ঞতায়
মুচকি হেসে আপনি চুপ থাকতে পারতেন ডাক্তার এস.কে.সিং

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কম্পানির বাস ।
বসে তিরিশটি দেশের চিকিৎসক প্রতিনিধি ।
আপনিও দেশছাড়া সাতাশটা বছর
এবং কার কী আসে যায়
যদি উনিশ শতকের শেষের এক ভারতসাধক
চিত্রিত হন আজকের দালাল বণিক তান্ডবের আদিপুরূষ ?
 
তবু কিছু সেদিন চুপ থাকতে দেয়নি আপনাকে ।
চলমান বাসে রীতিমত বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন জ্বালাময়ী !
আর শতাব্দীশেষে, সেদিনের ওই ঘটনা
পাটনায়, ফেব্রুয়ারীর রাতে আমায় শোনালেন ।
 
অস্থির ! এখনো অস্থির নিজের কাছে সৎ থাকতে অস্থির !
অভিনন্দন !
এমনই থাকুন, কমরেড !
 
কী বিড়ম্বনা, তাই না ?
স্বামীজী ধর্মকথা এমন বললেন যে ভারতের বাণী হল !
আর এখন, বণিক তান্ডবের দালালেরাভারতকথায় খুনে, 
বিদ্বেষী এক ধর্ম গড়ে তুলছে !
স্বামীজী দেশের সাধুদের শিক্ষার কাজে লাগাবেন, ভেবেছিলেন।
এরা শিক্ষাকে লাগিয়ে দিচ্ছে জোচ্চোর সাধুদের সেবায় !

স্বামীজী দেখছেন কন্যাকুমারিতে, সুনামির ঢেউ খেতে খেতেও
দেখছিলেন তাঁর ভরসা আছে এ দেশটায় !
এখন তো আর একা নন, প্রাচীন ঋষিকবি থিরুবল্লুবর
তাঁর পাশে মেঘ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে নজর রাখছেন
নাগেরকোয়েল, মাদুরাই হয়ে হিমালয় অব্দি !
 
মুচকি হাসলেন নাকি তিনি, স্বামীজির দিকে ঘুরে তাকিয়ে ?
তুমিও বুঝেছিলে আমার কথা
যে বস্তু মৃত্যুর দিন অমর মিত্র হইয়া তোমার সঙ্গী হইবে সেই বস্তুই ধর্ম ...
স্বামীজি দুহাত জোড় করে প্রণাম করলেন, সমুদ্র
ঝিকিয়ে উঠল !

৪-৮-২০০৩/ পুনর্লিখন, ব্যাঙ্গালোর ৪.১.২১



 

 

Thursday, January 14, 2021

অবক্ষয়-প্রসঙ্গ

সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের মুখ কি কখনও জীবনের উৎসবের মত হতে পারে? কেন হবেনা? অবক্ষয়ও তো একটা জীবনপ্রণালী! সেও তো এক যুদ্ধেরই অপর পক্ষ! আর যুদ্ধসাজের যত উপকরণ ও অস্ত্র, সে তো তার কাছেই বেশি!

আর তার সবটাই তো অবক্ষয় নয়! অবক্ষয় একটা দিশা, এবং সেই দিশার চিহ্ন কিছু বৈশিষ্ট। কিন্তু বৈশিষ্টগুলোকে তো আর প্রসাধনী চিকিৎসার মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া যাবেনা। পুরো জীবনপ্রণালীটারই নিষেধ করতে হবে, পরাজিত করতে হবে এবং সেই দ্বন্দেই নতুন জীবনপ্রণালীর স্বায়ত্ব হবে পুরোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিবাচক উৎপন্নগুলো। এটাই নিষেধের নিষেধ।   

কাকে বলবো অবক্ষয়? খাজুরাহোর বা কোণার্কের মন্দিরের পাথরে যে শতাব্দীর জলহাওয়ার ঘষা, সাম্রাজ্যলালসার সংঘাতের ফাটল, অবলুপ্তি... সেসব তো পাথরের ক্ষয়। মন্দিরগাত্রের অসাধারণ ভাস্কর্যে দেহজ প্রেমলীলার, এমনকি যে উদ্ভট, কৌতুকপূর্ণ যৌনক্রিয়ার চিত্রকল্পগুলো, তাকেও সভ্যতার অবক্ষয় বলার আগে বেশ কিছু কথা ভাবতে হবে। ওগুলো তন্ত্রসাধনার প্রতীকী দৃশ্য হোক, পুরূষ-প্রকৃতির মিলনে মোক্ষপ্রাপ্তির প্রতীক হোক, নিজের রাজত্বে প্রজাদের প্রজাতিগত শক্তির বিকাশে সন্তানোৎপাদনের এবং সে কারণে যৌন-সুস্থতার প্রয়োজনীয়তা বোঝাবার রাজকীয় প্রয়াস হোক, কিছুতেই এককথায় ওই ভাস্কর্যগুলোকে অবক্ষয়ী বলে চিহ্নিত করা যায় না। চিহ্নিতকরণের আগে নিরেট ইতিহাসগত প্রেক্ষিতে খাপে খাপে বসাতে হবে।...  

এসবই ভাবছিলাম। তারই মধ্যে আমার মেয়ে এসে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ও তো ছিলই, আমিও কুইন (হিন্দী ফিল্ম) দেখার পর থেকে কঙ্গনা রনাওতের ফ্যান। অনুপম খের শোএর একটা পুরোনো এপিসোড, ওর মোবাইলে ইউটিউব থেকে দেখতে লাগলাম বসে বসে। বেশ কয়েকটি ইতিবাচক অনুক্ত, অর্ধোক্ত সামাজিক বক্তব্যের রেশ রেখে যাচ্ছে কঙ্গনার প্রতিটি জবাব। কয়েকদিন আগে কঙ্গনার আরেকটা বক্তব্য এসেছিল ফেসবুকে, কেন ও ফর্সা হওয়ার ক্রীমের বিজ্ঞাপন করবেনা তার কারণ হিসেবে; আমি নিজের টাইমলাইনে শেয়ারও করেছিলাম। এই পুরো ঘটনাটাই (মানে এইসব সেলিব্রিটি টকশো ইত্যাদি) তো আমাদের সাধারণ হিসেবে অবক্ষয়ী, পচনশীল সংস্কৃতির উৎপন্ন। তাহলে? কিভাবে নেব কঙ্গনার জবাবের ইতিবাচক অনুক্ত সামাজিক বক্তব্যগুলো? কিভাবে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব মেয়ের সাথে যাতে পুরো ঘটনাটা যে অবক্ষয়ী সংস্কৃতিরই অঙ্গ, সেটা বলার জায়গাটাও থেকে যায়?

তবে সত্যিই কি ঘটনাটা একেবারে পূর্বনির্ধারিতভাবে অবক্ষয়ী সংস্কৃতির অঙ্গ, বা অবক্ষয়ী সংস্কৃতি? অবক্ষয় জিনিষটা কী? মানে এই যা কিছু নিয়ে আজকের বিনোদন শিল্প, মুখ্য বা বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা, টিভির জগত, তার সবটাই কি নিরপবাদ ভাবে অবক্ষয়ী? ১৯৯১এর আগে তো থার্ড, প্যারালাল, প্রতিবাদী ইত্যাদি শব্দগুলো সিনেমার দুনিয়ায় জনপ্রিয় ছিল, সিনে সোসাইটি আন্দোলন ছিল... এখন তো সেসব আর নেই, সবটাই প্রায় মেনস্ট্রীম, অন্তত এদেশে, খুব বেশি হলে ক্রাউড-ফান্ডিং ইত্যাদি নতুন শব্দ কিছু শোনা যায়। উল্টোদিকে, থিয়েটার অবশ্য প্রথম থেকেই প্রতিবাদী বলেই চিহ্নিত। সাহিত্যে এই জাত-ভাগটা আবার অনেক দূর ব্যক্তি ও সংগঠন-নির্ভর; কোন সাহিত্যকে অবক্ষয়ী বলব আর কোন সাহিত্যকে জীবনধর্মী, জীবনমুখী, প্রগতিশীল, গণচেতনাসম্পন্ন... বার বার ধোঁকায় ফেলে দেয়। আর সঙ্গীত? চিত্রশিল্প, ভাষ্কর্য? নৃত্য? যত রকমের শ্রাব্য ও দৃশ্য কলামাধ্যমে যে কাজ হয়ে চলেছে দেশে? যদি নতুন প্রজন্মের সাথে তর্কযুদ্ধে নামতে হয়, কী করে বোঝাবো কাকে বলে অবক্ষয়?

তত্ত্বগত ভাবে নাহয় বলে দিলাম যা স্থিতাবস্থার পক্ষে! বদলের কথা বললেও যা মূলতঃ এই ব্যবস্থাটাকেই, ভূলটুল শুধরে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস। বা উল্টোভাবে যদি বলি, যা কিছু এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নতুন সমাজ নির্মাণের কথা বলেনা, তা থেকে দূরে আটকে রাখতে চায় মানুষকে। কিন্তু সাহিত্যে, সিনেমায়, সঙ্গীতে, শিল্পে এর লক্ষণগুলো ধরা কি সহজ? আর তারপর, এই যে দুএকটা নতুন বস্তু এত জনপ্রিয় হয়েছে আজকাল নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত লড়াই, কিছু নাগরিক মূল্যের জন্য সামূহিক (কিন্তু পুরোনো সাংগঠনিক বৃত্তের বাইরে, তথাকথিত নাগরিক সমাজের, অর্থাৎ মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক) লড়াই... কী করে পুরোটা খারিজ করব প্রথমটাকে বুর্জোয়া আত্মকেন্দ্রিক র‍্যাগস টু রিচেসএর স্বপ্নের রকমফের বলে, আর দ্বিতীয়টাকে সুশীল সমাজের নাটুকেপনা বলে যখন নাকি সবাই দেখতে পাচ্ছি প্রথমটায় অনেকাংশে জুড়ে যাচ্ছে এদেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রামের ছবি আর দ্বিতীয়টার প্রান্তসীমা মিলেমিশে যাচ্ছে গণ-আন্দোলনের সাথে!      

২০০৫ সালে একটা লেখা তৈরি করেছিলাম হিন্দীতে ক্ষয় কা ত্বরণ অবক্ষয়ের ত্বরণ বা এক্সিলরেশন অফ ডেকাডেন্স। গান্ধী সংগ্রহালয়ে পড়েছিলাম কোনো একটা আলোচনাচক্রে, পরে ছেপেছিল লোকরঙ্গ পত্রিকায়। দুদিন আগে পুরোনো পত্রিকাটা বার করেছিলাম অন্য একটা লেখার প্রয়োজনে। পাতা উল্টে এই লেখাটা পড়তে গিয়ে দেখি লেখাটা দুর্বল লাগছে। দুর্বলতার একটা দিক তো যাকে বলে সাহিত্যিক গৃহিণীপনার অভাব। অর্থাৎ লেখার সময় যা মনে আসছে লিখে চলে যাওয়া আর তারপর তার ঠিকমত সম্পাদনা না করা। সেটা আমার চরিত্রগত দোষ। কিন্তু আরেকটা দিক আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক বছর আগে অব্দি আমি নব্য-উদারবাদী অর্থনীতি এবং উন্নত কারিগরীর দ্বান্দিক সম্পর্কটা ঠিক মত বুঝতে পারিনি। এখনও সবটা বুঝেছি বলবনা, কিন্তু ২০১২ সালের শেষে একটা গল্প লিখতে গিয়ে কিছুটা ভাবতে ও বুঝতে হয়েছিল। তা, ওই লেখাটাও এই বুঝের অভাবের দোষে দুষ্ট পেলাম। আরেকটা দিক তো লেখাটায় ছিলইনা। তার কথায় পরে আসব।

ওই লেখাতে মূলতঃ যে জিনিষটা দেখাতে চেয়েছিলাম তা হোলোঃ যখন একটা দেশের সংস্কৃতি নবজীবনে উত্তরণের সংগ্রামে অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি থেকে শক্তি আহরণ করে আর যখন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ তার আগ্রাসনে দেশজ সংস্কৃতির সাথে বলাৎ যোগসাধন করে, দুটোর ফসলে কী তফাৎ হয়। ঠিক মত দেখাতে পারিনি বলাই বাহুল্য। দোষনীয় আরো ছিল, যা দেখাতে পারলামনা, তাও দেখাতে পারলাম বলে দাবি করা। জঘন্য।

সে যা হোক। আমার মনে হয়, এই নব্য-উদারবাদী অর্থনীতি আর উন্নত কারিগরীর মধ্যেকার সম্পর্কটা আমার আশেপাশের অনেকেই ভালো করে বোঝেননা। কেন বোঝেননা তার ইঙ্গিতটা ওই গল্পের মধ্যে ছিল। আমাদের, বা আজ ষাটোর্ধ/সত্তরোর্ধ এমনকি পঞ্চাষোর্ধ ভারতীয়দের জন্য ১৯৯১ সাল একটা ওয়াটারশেড বা জলদেওয়াল। শুধু ভারতীয়ই বা কেন, গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য। কয়েকবছর আগে থেকেই আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছিল জল। কিন্তু তা যে এমন রূপ নেবে, কেউই ভাবেনি। হঠাৎ, বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের প্রথম বছর শুরুর আগে থেকেই উঠল ঝড়। সোভিয়েত সঙ্ঘের পতনই শুধু ঘটলনা, বরিস ইয়েলৎসিন বিয়ারের বোতল হাতে ট্যাঙ্কের ওপর চড়ে হামলা চালালো বোধহয় মস্কো নিউজের অফিসে, তারপর ১০০ দিনে রুশে পূঁজিবাদ পুনর্বহাল করার ঘোষণা করল, পেরেস্ত্রোইকা/গ্লাস্নস্তের নায়ক গর্বাচেভ পালালো আমেরিকায়, টেলিভিজনে ইন্টারভিউ এল একটি রাশিয়ান মেয়ের (আমাদের স্বপ্নের সেই কোমসোমোলের মেয়ের মতই যাকে দেখতে) যে সে ডলার-বেশ্যা, অর্থাৎ খদ্দেররা যাকে ডলারে ভুগতান করবে, হতে চায়... আমেরিকার প্রথম ইরাক-যুদ্ধ শুরু হল,... পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের যুব তখন, একদিকে মন্ডল কমিশন অনুযায়ী সংরক্ষণ নীতি বলবৎ হওয়ার ঘোষণার পক্ষে ও বিপক্ষে আন্দোলিত এবং অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলির, হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে সাম্প্রদায়িক ভোটব্যাঙ্ক সংগঠিত করার প্রয়াস, রথযাত্রা ইত্যাদি ইত্যাদি... আর এসবেরই মাঝে বিশ্বের আরেক কোণে আইবিএম বার করল তার প্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার, যা শুধু অফিসঘরেই নয় সবকটি কাজের জায়গায় বিপ্লব ঘটাবে কিছুদিনের মধ্যে এবং ঢুকে পড়বে ঘরের ভিতরেও, এসে গেল কোমরে আঁটা পেজার, এসে গেল ২জি মোবাইল, আগস্ট মাসে জন্ম নিল ইন্টারনেটের হাইপারটেক্সট ট্রান্সফার প্রোটোকল...আর বছরের শেষ দিকে ভারতে এল নতুন কেন্দ্রীয় সরকার, এসেই ঘোষণা করল, কল্যাণকামী অর্থনীতির দিন শেষ, মিশ্রঅর্থনীতির দিন শেষ, ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডে চলে যাওয়া ভারতের সোনা ফেরত আনার বাহানায় শুরু করা হল নতুন অর্থনীতি, বলবৎ হল আন্তর্জাতিক মুদ্রাকোষের শর্তাবলী, একে একে গ্যাট বা পরবর্তী, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তাবলীগুলোও। কী দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করল আমাদের জীবনযাপন ও ভাবনাচিন্তার পুরো প্রেক্ষিতটাই!

এবং আমরা একটা ভ্রান্তির শিকার হলাম। অবশ্য খুব দোষনীয় নয়, কেননা একদিকে আমাদের চেনাজানা জগৎ ও তৎসম্পর্কিত ধারণা এবং পূর্বানুমানগুলো সম্পূর্ণ বিধ্বস্তপ্রায় আর অন্যদিকে কানের কাছে অহরহ নতুন জমানার, প্রতিভু শুধু নয় সেই জমানায় শিক্ষা/রুজি পাওয়া আমাদেরই সন্তানদেরও কলরব। আমরা, ঠিক স্বীকার না করলেও ভাবতে শুরু করলাম যে নতুন অর্থনীতিরই উৎপন্ন নতুন কারিগরী। শুধু ভারতেই নতুন অর্থনীতির ফলশ্রুতি হিসাবে কম্পিউটার বা সাধারণ অর্থে ডিজিটাল প্রযুক্তি আসেনি, এমনকি বিদেশেও, এসব আবিষ্কারই হতে পেরেছে কোনো একসময়ে আমেরিকায় রেগান, ইংল্যান্ডে থ্যাচার বা ওই ধরণেরই আরো আর্থনীতিক কর্মকান্ডের জমানা এসেছে বলে।

অথচ তা তো ঘটনা নয়। নতুন প্রযুক্তি সম্ভাবিত হয়ে ওঠার চাপেই বদলেছিল পূঁজিবাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্থাপিত অর্থনৈতিক বিন্যাস। পরিবর্তিত বিন্যাস বাড়িয়ে তুলেছিল উৎপাদকতা আর হারিয়ে দিয়েছিল সমাজবাদী দেশগুলোকে। যখন নাকি মার্ক্সবাদের অন্যতম তত্ত্ব ছিল, সমাজবাদী প্রণালী উৎপাদকতা বৃদ্ধিতে নির্ণায়কভাবে হারিয়ে দেবে পূঁজিবাদকে। সমাজবাদী প্রণালীর এই অর্থনৈতিক পরাজয়ই তৈরি করেছিল দেশগুলোর আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সংকট আর ওই নতুন প্রযুক্তির জয়ঘোষকে প্রধান ভাবধারাগত অস্ত্র করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদ। সমাজবাদকে ধ্বংস করতে সফল হয়েছিল। যখন সে লড়াইটা চলছিল তখনই, তার অনুপ্রক্রিয়া হিসেবে রাজীব গান্ধী জমানায় ইয়োরোপীয় বাজার চড়া সুদে থেকে নেওয়া ঋণ, ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট্‌সের সংকট আর নরসিংহ রাওয়ের নতুন অর্থনীতির ঘোষণা।

তার অনেক বছর পর সিওয়ান গিয়েছিলাম জনবাদী লেখক সঙ্ঘের জাতীয় কার্যকারী সমিতির বৈঠকে। ঠিক বৈঠকে নয়, আমি তার সদস্য ছিলামনা, কিন্তু যেহেতু বিহারের মানুষ তাই অভ্যর্থনা সমিতির স্বয়ংসেবক হিসেবে। মেঘলা সকালে স্কুলের মাঠে চা খেতে খেতে ওরা কথা বলছে, মিটিং শুরু হবে একটু পরে, হঠাৎ একজনে গলা তুলতে তার বক্তব্যটা শুনতে পেলাম, কন্টিনিউইটি না রাপচার, সেটা স্থির করতে হবে আমাদের। কানে ধরে গেল। সত্যিই তো, যতই ভাবধারাগত ভাবে খারিজ করে দিয়ে থাকি উত্তর-আধুনিকতাবাদ বা অধুনান্তিক ধারণাগুলো, সেভাবে তো স্থির করিনি ১৯৯১ এর আগে-পরে কন্টিনিউইটি না রাপচার! ধারাবাহিকতা না বিদারণ? আর যদি দুটোরই চিহ্ন থাকে সময়ের সেই সন্ধিক্ষণে? তাহলে কিসের ধারাবাহিকতা আর কিসের বিদারণ?

আজ মনে হয়, বিদারণের মত মনে হলেও তথাকথিত কল্যাণকারী অর্থনীতি/মিশ্র অর্থনীতি থেকে নব-উদারবাদী অর্থনীতিতে সংক্রমণ এক্কেবারে সহজ, সরল ধারাবাহিকতা। আমাদের এই ধারাবাহিকতা বুঝতে অসুবিধে হয় কেননা আমরা মধ্যশ্রেণির মানুষ। আমাদের কাজের জায়গায়, ঘরে, ভাবনাচিন্তায় যে আগ্রাসনগুলোর মোকাবিলা করতে হয়েছে বা হচ্ছে এখনও, অথবা যে আগ্রাসনগুলোর সাথে সমঝোতা করে নিয়েছি, সে আগ্রাসনগুলোতে নব্য-অর্থনীতির স্টিকার ঝুলছে তার প্রযুক্তি হয়ে। যে নতুন সুবিধেগুলো ব্যাবহার করছি সে সুবিধেগুলোও প্রযুক্তিগত আর নব্য-অর্থনীতির স্টিকার লাগানো। যদি দেশের অর্থনীতির প্রত্যন্ত সীমায় দাঁড়ানো মানুষ হতাম গরীব কৃষক, আদিবাসী - আমরাও বলতাম, কই, কিছুই তো বদলালোনা এই সাতটি দশকে! অর্থাৎ, ধারাবাহিকতাকে চিহ্নিত করতাম অনায়াসে। বস্তুত, ধারাবাহিকতা না বিদারণ এই প্রশ্নটাই মধ্যশ্রেণিগত। 

তবুও, বিদারণ একটা আছে। এবং সেটা প্রযুক্তিতেই আছে। আবার এটাও সত্য যে প্রধানতঃ মধ্যশ্রেণির জীবনেই আছে। জীবনযাপনের যে দিকগুলো গুণগত ভাবে বদলেছে, তা প্রযুক্তির জন্য বদলেছে। এবং সেটা যে সে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়। একটা নতুন সাংস্কৃতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দেশ (স্পেস অর্থে) ও কালগত বোধ, নতুন ভাষা, নতুন দিনযাপন আর সেগুলোকে নিয়ে এগিয়ে চলার নতুন প্রজন্ম... সব তৈরি করেছে ওই নতুন প্রযুক্তি। তারই সাথে এটাও তথ্য যে নব্য-অর্থনীতি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে এই মধ্যশ্রেণির শক্তি ও কন্ঠস্বর। বাকি শ্রমজীবীশ্রেণিগুলোর শক্তি ও কন্ঠস্বর দাবিয়ে রাখার জন্য।

সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবক্ষয়ের মুখ কি কখনও জীবনের উৎসবের মত হতে পারে? না, পারেনা, কিন্তু মনে হতে পারে, মনে হয় কেননা আমরা, মানে মধ্যশ্রেণির মানুষেরা ধারাবাহিকতা না বিদারণ এই প্রশ্নের ধাঁধায় এখনও ঘুরছি। এখনও মনে করছি যে নব্য-অর্থনীতিরই ফলশ্রুতি নতুন প্রযুক্তি।

মার্ক্স এবং এঙ্গেলস বেশ কয়েকবার ইতিহাসের প্রসঙ্গে দেখিয়েছেন যে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে তাৎক্ষণিক ভাবে পরাজিত এবং রক্তক্ষরণে নিস্তেজ করতে পারলেও শাসক শ্রেণী সেই অভ্যুত্থানের বাস্তব উপাদানগুলোকে নিশ্চিহ্ন বা অবলুপ্ত করতে পারেনা। বাধ্যতায় বিজয়ী শক্তি বরং ওই উপাদানগুলোকে স্বায়ত্ত করে নেয়; নিজের শ্রেণীস্বার্থ বজায় রেখে অবশ্যই। এংগেলস দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখিয়েছেন, যীশুখ্রিষ্টকে ক্রুশে বিদ্ধ করার কয়েক বছরের মধ্যে রোম সাম্রাজ্যের রাজকীয় ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল খ্রিষ্টধর্ম। প্রুশিয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও জার্মান একতার সপক্ষে সবচেয়ে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে সোচ্চার সামাজিক-গণতন্ত্রবাদী আর সমাজবাদীদের নিকেশ করতে সমাজবাদী-বিরোধী আইন বলবৎ করা বিসমার্ক সরকারকে নিজের হাতে (অবশ্যই নিজেদের শ্রেণিস্বার্থের মত করে) জার্মান একতা আনতে হয়েছিল এবং প্রুশিয় রাজতন্ত্রের অধিকার খর্ব করতে হয়েছিল।

ভারতে ১৮৫৭র স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরাজিত করল কম্পানির শাসন। কিন্তু করা মাত্র কম্পানিকে সরিয়ে সংসদীয় ব্রিটেন নিজে শাসক হল - যেমন নাকি দাবি উঠত অনেক মহলেই, যে রাণির ন্যায়পরায়ণ শাসন ভারতের মানুষেরা কম্পানির জন্য পাচ্ছেনা! পেল। কিন্তু কেমন রূপে পেল? যেমন, কম্পানিও হতে পারেনি। সেই একই ক্যানিং সাহেব যিনি নিজের কম্পানি-কালীন রাজত্বে শেষ ভারতীয় সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনের জেলে পচিয়ে দিলেন, রাণি-কালীন রাজত্বে ভাইসরয় বা বড়লাটের মুকুট পরে ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সম্রাট হওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিলেন। কাজ তো পরে, রূপটা আসল। ইংল্যান্ডে নিজের সতীর্থকে চিঠি লিখে জানালেন যে সম্রাট সেজে থাকার এই হামবাগটাকে (বাংলা অর্থে ধাপ্পাবাজিটাকে) জিইয়ে রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আর কাজের ক্ষেত্রে? যে হাত দিয়ে ঝাঁসির রাণি, বাবু কুঁওর সিং এবং বিদ্রোহের অন্য অনেক সামন্ততান্ত্রিক নেতাদের মারলেন, সেই হাত দিয়েই দেশের সামন্ততান্ত্রিক শক্তিকে নানারকম ভাবে তুষ্ট করে (ডালহাউসির নীতিগুলো বাতিল করে) নিজের দরবারের অঙ্গীভূত করে নিলেন। হাজার হাজার বিদ্রোহী সেপাইকে হত্যা করালেন কিন্তু কম্পানির সেনার জায়গায় ভারতীয় সেনা তৈরি হওয়ায় বেতন-সম্পর্কিত অসন্তোষের অনেকটা মিটে গেল (টোটার কাগজ দাঁত দিয়ে ছেঁড়ার সমস্যাটা আগেই মনে হয় মিটে গিয়েছিল)।

অথচ আবার, নতুন রেজিমেন্ট গঠনে ও নামকরণে জাতিবিভেদ ও জাতের অহঙ্কার উস্কে দেওয়া হলেও, নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে যোদ্ধা-জাতি আর অযোদ্ধা-জাতির ধারণা আসাতে, সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ জাত ও পাহাড়ি জাতিগুলি থেকে নিযুক্ত সেপাইদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। আর, সতীপ্রথা-বিরোধী আইন বা বিধবাবিবাহ আইনের মত করে সমাজ ও ধর্মের ক্ষেত্রে কখনও হস্তক্ষেপ করা হবে না বলে ধর্মের ধ্বজাধারীদের আশ্বস্ত করলেও, অন্যদিকে নিয়ে আসা হল ভারতীয় দন্ডবিধি, ভারতীয় উচ্চ আদালত বিধি, ভারতীয় পুলিস বিধি।

অর্থাৎ, বিদ্রোহের অব্যবহিত উপাদানগুলোকে ব্রিটিশ শাসন নিজের ঔপনিবেশিক স্বার্থে স্বায়ত্ব তো করলই, যে উপাদানগুলো অব্যবহিত নয়, সেই মুহুর্তে বিদ্রোহের কারণও ছিল না কিন্তু অসন্তোষের জায়গা তৈরি করছিল, সেগুলোকেও স্বায়ত্ব করল। যীশুখ্রিষ্টের ধর্ম রোম সাম্রাজ্যের ধর্ম হয়ে উঠল, একত্রিত জার্মানি বিসমার্কের অবদান হল। কিন্তু এখানে খোদ ঔপনিবেশিক শক্তিটাই যেহেতু পূঁজিতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মধ্যে একটা সমঝোতা, তার দ্বন্দ্বগুলো এদেশের বিদ্রোহ-প্রশমনের কর্মপদ্ধতিতে মাঝেমধ্যে কিছু বিপরীতধর্মী চরিত্র গ্রহণ করল।

ইতিহাস লেখার ধৃষ্টতা আমি করব না। অনেক প্রসঙ্গ অনুল্লিখিত থাকায় একটা ভূল অর্থ গৃহীত হবে। আমি শুধু বলতে চাইছি যে বৈপ্লবিক শক্তিকে পরাজিত করে প্রতিক্রিয়া বৈপ্লবিক উপাদানগুলোকে স্বায়ত্ত করতে চায় শাসন বজায় রাখার স্বার্থে নিজেকেই বৈপ্লবিক দেখাতে চায়। জীবন্ত উপাদানগুলোকে মৃত সাজ বানিয়ে পরে নেয়। কিন্তু ওগুলো তো মৃত নয়। যেটা মুকুট হিসেবে পরল তার ভিতরে হয়ত শুঁড়গুলো খুলছে ধীরে ধীরে। যেটা গলার মালা হিসেবে পরল সেটা হয়ত খোলস বদলাচ্ছে। ... কাজেই সময় হলে সেই উপাদানগুলোই নতুন শক্তি খুঁজে নেয়, যে শক্তি তাদের যথার্থ রূপে কাজে লাগাবে।

এই ধরণের কোনো পরিস্থিতির বিশ্লেষণেই কি গ্রামশির পরোক্ষ বিপ্লবের তত্ত্ব কাজে লাগে? হতে পারে। তবে আপাততঃ ওদিকে যেতে চাই না। আমি শুধু দেখতে চাইছি যে প্রতিবিপ্লবের জয়ে যখন অবক্ষয়ী সংস্কৃতি গেড়ে বসে, কিন্তু গেড়ে বসার জন্য সমাজে বদলের সম্ভাবনার অনেক উপাদান নিজের স্বার্থে, নিজের মত করে বিকশিত করে, সেই উপাদানগুলোকে চিহ্নিত করা যায় কিনা, তার মধ্যেকার ইতিবাচক সারটা বার করে নিজেদের কাজে লাগান যায় কিনা। আর সেটা করতে গেলে, অবক্ষয়ের মুখটা ভালো করে দেখতে হবে। শিল্প ও সাহিত্যের প্রত্যেকটা রূপে গত তিরিশ বছরের যাত্রাপথে খুঁজতে হবে সাধারণ মানুষের মুখ।  

এ কাজটা আমার একার পক্ষে সম্ভবই না। শিল্পের বিভিন্ন রূপে যারা কাজ করছেন তাদেরকে করতে হবে। গানওলাকে গানের পথ, ফিল্মওলাকে ফিল্মের পথ, নাটকওলাকে নাটকের পথ, নাচওলাকে নাচের পথ, ছবিওলাকে ছবির পথ, কবিতাওলা-গল্পওলা-উপন্যাসওলাদেরকে তাদের কাজের পথ ... শেষ নেই।

কিন্তু করা উচিত, আমার মনে হয়। নতুন কারিগরী বদলে দিচ্ছে ধরণধারণ। আমি বই পড়তে ভালোবেসে এসেছি এই সেদিন অব্দি ... এখন বই কম, পিডিএফ, ইপাব বা কিন্ডল সংস্করণ পড়ি। কিন্তু পড়িই। শুনি না। আমার ছেলে, শুনতে ভালোবাসে। অডিও বুক ওর বেশি ভালো লাগে। এটা কি শুধুই রূপের বদল? পড়তে ভালো লাগা উপন্যাস, গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ,  আর শুনতে ভালো উপন্যাস, গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ প্রথম দিকে একই থাকলেও ধীরে ধীরে কি বদলে যাবে না? শব্দছবির গঠন, ঘটনার বিন্যাস, পর্বের ভাগ ... সবেতেই এর প্রভাব পড়বে না কি? গানের ধরণগুলো দেখুন! কত রকমের বদল এসেছে গত তিরিশ বছরে! যারা মানুষের মাঝে কাজ করছেন, সমাজবদলের লড়াইয়ে ব্যাপৃত আছেন, তাঁরা বুঝতেও পারছেন সেটা তাঁদেরও নতুন গানের রচনারীতি, সুর, গায়কীতে প্রভাব পড়ছে সেই বদলের। তাঁরা অনেকেই বুঝতে পারছেন, পুরোনো দিনের কালজয়ী গণসঙ্গীতের রোমাঞ্চ কম না হলেও, নতুন গান নতুন ভাবে ভাবতে হবে। গত এক বছরের দুটো ভারতবিখ্যাত হিন্দী গানের কথাই ধরুননা কাগজ নহি দিখায়েঙ্গে আর সবকুছ ইয়াদ রখা জায়েগা । ইপ্টার বা সফদরের জনমএর হিন্দী গান থেকে আলাদা নয়? আসামের মিয়াঁ কবিতার অভিব্যক্তি ভিন্ন নয়? ফিল্ম, ছবি ... সবেতেই শ্রেণীযুদ্ধ নতুন উপাদান নিচ্ছে ওই অবক্ষয়ী সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই এবং লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ম্যাপিং নেই। একটা বিশ্লেষণাত্মক ইতিহাস নেই যেটা জানলে গ্রহণ-বর্জন করতে সুবিধে হয়।

নাচটাই ধরুন না। স্টেজে উঠে একক শিল্পী বা শিল্পীগোষ্ঠির শাস্ত্রীয় নৃত্যের কথা বলছি না। সামাজিক জীবনে অন্ততঃ বাৎসরিক একটা নাচের দিনের কথা বলছি, যেদিন সবাই নাচবে। ঔপনিবেশিক নগরায়ণ সারা ভারতেই নাচ-বর্জিত রূপে হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির এলাকাগুলোয়। পাঞ্জাবি, গুজরাতি, রাজস্থানি, অসমিয়া শহরগুলোর সমাজজীবনে নাচ আছে। বাংলায়, বিহারে এবং আরো কিছু এলাকার শহরে নেই। অথচ নাচ আছে। ক্লাবে ইয়োরোপীয় নাচ আছে। ভাসানের ট্রাকে বা পুজো প্যান্ডালে বলিউডি নাচের অক্ষম, হাস্যকর নকল আছে, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের জনান্তিকে ঘরে কোমর দোলানো আছে। যাঁরা শিল্পটা জানেন, শরীর সেভাবে তৈরি তাদের কথা বলছি না। সামূহিকতার কথা বলছি যেমন দুপুরে-রাত্রে সবাই খাবে, তেমনই সন্ধ্যায় সবাই নাচবে। সংস্কৃতির অঙ্গ হবে সেটা। সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল না বলেই কিন্তু তিরিশ বছরে নতুন প্রজন্মে বলিউড ধরছে, আফ্রিকা ধরছে, জুম্বা, এরোবিক্স করছে কিন্তু আমরা আমাদের নাচ নিয়ে কোনো ভাবনাচন্তাই করিনি।মএই সেদিনই আমি আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম যে যুবসংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে কি নাচ নিয়ে ওরা ভাবছে? এই যেমন ধরুন, দুপুরে বা সন্ধ্যায় সবার একসাথে নাচ? ফর্মটা ঝুমুর থেকে নেওয়া যায়। বা তিনচারটে ফর্ম থেকে সংশ্লেষিত করা যায়?

অর্থাৎ গত তিরিশ বছরের অবক্ষয়ী পথের একটা ক্যারেক্টার ম্যাপিং করে তা থেকে নিজেদের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের রূপগুলো নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনার কথা বলছি।