স্বর্গত প্রফুল্লরঞ্জন দাশ মহোদয়ের সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়। বেশ মনে পড়ে ১৯১৮ সনের শীতকালে পাটনায় অধ্যাপক হ’য়ে এসেই তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে গেলাম স্টেশন রোডের একটা বড় বাংলোতে যেখানে এখন ফৌজী দপ্তরখানা। এখানে এসেছি জেনে তিনি ও মিসেস ডোরথী দাশ খুব খুশী হলেন; চা ও কেক্ খাওয়ালেন, এবং মাঝে মাঝে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। সেই থেকে দাশ সাহেবের মৃত্যুপর্য্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল তাঁর স্নেহলাভে ধন্য হয়েছি।
ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহারাজীবী প্রফুল্লরঞ্জনের আইনজ্ঞানের কথা
সর্বজন-বিদিত। প্রবলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম ক’রে গেছেন। ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি একটি নিখিল-ভারতীয়
সংস্থার প্রতিষ্ঠা ক’রে আন্দোলন চালিয়েছিলেন।
বিহারে বেঙ্গলী এ্যাসোসিয়েশনও তাঁরই অবদান। তিনিই বাঙালীদের প্রতি অবিচারের প্রতিরোধ
করবার জন্য প্রথম কংগ্রেসী সরকারের আমলে এক স্মারকলিপি রচনা ক'রে বেঙ্গলী এ্যাসোসিয়েশনের
আরো কয়েকজন প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ধায় গান্ধীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাতে
ফলও কিছু হয়েছিল। অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর সর্বশেষ সংগ্রাম যযাতি ভট্টাচার্যের মামলা।
সে-মামলায় তাঁর ভাষণ শুনে আমার মনে হ'ল, এ রকম সাংশ্লেষিক যুক্তি (synthetic
argument) আমি আর শুনি নি। বৈজ্ঞানিক যেমন খণ্ড খণ্ড ঘটনা থেকে একটা প্রাকৃতিক নিয়মে
পৌঁছেন, তিনিও সে-রকম ভাবেই প্রকীর্ণ ঘটনা থেকে একের পর এক বিধানসূত্রে উত্তীর্ণ হলেন।
আমি আদালতে এমন বিশেষ থেকে সামান্যে আরোহ (induction) যে সম্ভব তা কখনও ভাবতে পারি
নি। ফৌজদারী আদালতে জুরির বিচার করতে গিয়ে শুধু ঘটনার বিশ্লেষণই দেখে এসেছি। ব্যারিস্টার
প্রফুল্লরঞ্জনের কথা আমি কিছুই বলতে চাই নি। স্বাধিকার-প্রমত্ত হয়ে যা ব’লে ফেললাম তা আইনজ্ঞরা, আশা করি, ক্ষমা করবেন। তবে এ কথাটা বলা দরকার,
প্রতি মকদ্দমায় যুক্তির খসড়া তৈরি করবার সময় তাঁর যে শ্রম ও অভিনিবেশ দেখেছি তা দুর্লভ।
ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ ক’রে এই নিরলস কর্মযোগী
কাজে বসতেন; কাজের সময় কেহ ঘরে ঢুকলে পায়ের শব্দে তাঁর ধ্যানভঙ্গ হ'ত না। ঘরে ঢুকে
কথা বললে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করা যেত।
মানুষ প্রফুল্লরঞ্জনের যে গুণাবলী আমাকে আকৃষ্ট করেছে তা ছিল তাঁর
কবিপ্রকৃতি, রসজ্ঞান, আদর্শবাদ, দেশপ্রেম ও মানবপ্রীতি। শেষোক্ত গুণ বাইরে প্রকাশ পেত
না এই জন্য যে তিনি খুব সামাজিক মানুষ ছিলেন না, আর সময় সময় তুচ্ছ কারণে হঠাৎ চ’টে যেতেন। তবে তাঁর রাগ ছিল ঠিক খড়ের আগুন, ক্ষণস্থায়ী। একবার তিনি
রেডিওতে একটা ভাষণ দিলেন। আমার কাছে লোক পাঠালেন যেন তাঁর পনরো মিনিটের ভাষণ আমি শুনি।
পরের দিন গাড়ী এসে হাজির, ড্রাইভার মিশ্রিলাল বললে, “সাহেব সেলাম দিয়া”। তাঁর বাড়ী
গিয়ে দেখি তিনি সামনের বড় ঘরটায় ব'সে আছেন। আমাকে দেখেই হেসে প্রশ্ন করলেন, “কেমন লাগল?” আমি বললাম, “চমৎকার বলেছেন, তবে আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না।“ । “কেন ?” “আপনি বলেছেন, পশ্চিম
ইউরোপ ও আমেরিকায় রাজনৈতিক গণতন্ত্র চলছে, আর পূর্ব ইউরোপে চলছে অর্থ- নৈতিক গণতন্ত্র।
আমার মতে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র না হ'লে যথার্থ রাজনৈতিক গণতন্ত্র হ’তেই পারে না।” “কেন?” “কোটিপতিরা তখন ভোট কিনে নেয়। আমেরিকায় এক ভোটের দাম কম পক্ষে “পাঁচ ডলার ও এক বোতল হুইস্কি।" এ ভাবে তর্ক এগিয়ে যাচ্ছে, আর
তার্কিকরাও উত্তেজিত। মৃদুস্বরে আলোচনা চলছিল, এখন দু'দিক, থেকেই তা চীৎকারে পরিণত।
বাড়ীর চাকর-বাকর, কেরানী, স্টেনো, লাইব্রেরিয়ান, সেক্রেটারি সকলে জমায়ৎ! ব্যাপার গুরুতর
দেখে আমি শেষ করলাম এই ব’লে, “I agree to differ”। দাশ সাহেবের
মুখে হঠাৎ মুচকি হাসি দেখা দিল, তিনি বলে উঠলেন, “বয়, কফি লাও”। কফি ও খাবার শেষ
হ'লে তিনি তাঁর একটি দামী সিগার আমাকে দিয়ে বললেন, “জান, রাষ্ট্রের নামে ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষয় আমি সহ্য করতে পারি
না”। আমি বললাম, “বহুজনের কল্যাণের নিমিত্ত ব্যক্তিকে ত্যাগস্বীকার করতেই হবে।” আসল কথা, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দাশ সাহেব যখন ইংলণ্ডে ছিলেন
তখন সেখানকার দার্শনিক উদারনীতিবাদ তাঁকে এমন মুগ্ধ করেছিল যে তার মোহ থেকে তিনি মুক্ত
হতে পারেন নি।
তাঁর কবিপ্রকৃতি আইনের চাপে অতিষ্ঠ হ'য়ে উঠলে আমার ডাক পড়ত। সায়মাশের
পরে তাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আমাকে একটি সিগার দিয়ে এবং নিজেও একটি ধরিয়ে অর্ধ শায়িত অবস্থায়
আলোচনা শুরু করতেন। এ আলোচনায় আর কলেজের আলোচনায় অনেকখানি তফাৎ ছিল। কলেজের আলোচনায়
সচরাচর কাব্যরসের আস্বাদন হয় না; হয় আঁঠি ও খোসা চর্বণ, আর সঙ্গে সঙ্গে যুবকদের মস্তক
চর্বণ। তত্ত্ব ও আঙ্গিকের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে কলালক্ষ্মী সেখানে লজ্জায় মুখ ঢাকেন।
যৌবনে তিনি ছিলেন Shelley’র ভক্ত; ইংরেজীতে
কবিতা লিখলেন The Moth and the Star। Shelley’র শ্বশুর
Godwin-এর নৈরাজ্য-দর্শনের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় জামাতার Prometheus Unbound-এ। এই
কবিতার স্বাধীনতার বাণী প্রফুল্লরঞ্জনকে এক সময় উদ্বুদ্ধ করেছিল। লণ্ডনপ্রবাসের সময়
শ্রীঅরবিন্দের অগ্রজ কবি মনোমোহন ঘোষ প্রফুল্লরঞ্জনকে Mrs. Alice Christiana
Meynell-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। Alice Meynell ছিলেন ইংলণ্ডের বিখ্যাত বিদুষী কবি
এবং গদ্যলেখিকা। তিনিও তাঁর স্বামী এক সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা করতেন। তাঁর কবিতা সম্বন্ধে
Francis Thompson বলেছেন: "The footfalls of her muse waken not sounds, but
silences"। তাঁর Renouncement শীর্ষক সনেট Rossetti'র মুখস্থ ছিল। তাঁর মতে মহিলাকবিদের
রচিত শ্রেষ্ঠ তিনটি সনেটের মধ্যে Renouncement একটি। দুর্ভাগ্য এই যে Alice
Meynell-সম্বন্ধে আমাদের দেশে বিশেষ আলোচনা হয় নি। দাশ সাহেব বলতেন, Mrs. Meynell-এর
মধ্যে যে প্রতিভা ও বৈদগ্ধ্য তিনি দেখেছেন তা আর কোনো মহিলার মধ্যে দেখেন নি। এই মহিলাই
কবি Francis Thompson-কে আবিষ্কার করেন, এবং তিনিই ছিলেন তাঁর কাব্যপ্রেরণার উৎস।
Francis Thompson অতিশয় দরিদ্র এবং সংসার সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন। কাগজ কিনবার পয়সা
ছিল না ব’লে তিনি তাঁর প্রথম কবিতা চিনির ঠোঙার নীল
কাগজে লিখে ছাপাবার জন্য পাঠিয়েছিলেন। Mrs. Meynell প্রফুল্লরঞ্জনকে Francis
Thompson-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রফুল্লরঞ্জন এই ভোলানাথ কবি সম্বন্ধে অনেক গল্প
বলেছেন। ইংলণ্ডের এক সম্ভ্রান্ত লর্ড Francis Thompson-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার ইচ্ছা
প্রকাশ করেন Mrs. Meynell-এর কাছে। কবি গরিব পাড়ায় যত্রতত্র একটা আস্তানা পেলেই সেখানে
মাথা গুঁজতেন, আর সকলকে স্থায়ী ঠিকানা দিতেন এক ঔষধের দোকানের। সেখান থেকেই কবি তাঁর
চিঠিপত্র সংগ্রহ করতেন। Mrs. Meynell এক চা-পার্টির আয়োজন ক'রে লর্ড ও লেডিকে এবং
Francis Thompsonকে নিমন্ত্রণ করলেন। আরো কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে দাশ সাহেবও সে-পার্টিতে
নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সকলে ব’সে আছেন Francis
Thompson-এর অপেক্ষায়, কিন্তু কবির দেখা নেই। পার্টি যখন ভেঙে গেল তখন কবির আগমন, পরিধানে
আধময়লা ফ্রানেলের সুট, চুল উস্কখুস্ক; ক্ষমা চেয়ে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম ডিনারের নিমন্ত্রণ।” এই মরমী কবি Francis Thompson সম্বন্ধেও আমাদের দেশে বিশেষ আলোচনা
হয় নি। শুধু অজিত চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের ‘গীতিমাল্যের’ আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর The Hound of Heaven-এর উল্লেখ করেছেন।
Mrs. Meynell ছিলেন Catholic, আর Francis Thompson-ও ছিলেন তাই। বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক
যুগে ইংরেজী কাব্যসাহিত্যে যাঁর প্রভাব অপরিসীম সেই T. S. Eliot-ও হয়েছিলেন
Catholic। এই সময়েই প্রফুল্লরঞ্জনের সঙ্গে কবি ও নাট্যকার Stephen Phillips এবং কবি
ও প্রাচ্য-আর্ট-সমালোচক Laurence Binyon-এর সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রফুল্লরঞ্জনের The
Moth and the Star and other Poems আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেওয়ার জন্য পুস্তকাকারে
প্রকাশিত হ’লে ইংলণ্ডের সুধীবৃন্দ তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
একদিন Francis Thompson-এর কথা উঠলে তিনি বললেন, “দেখ, কোনও সাহিত্যে কি এই চারটি লাইনের তুলনা পাওয়া যায়?
মিথ্যা হ’য়ে যায়।” তিনি বললেন, “মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গী
যে দু'জনের আলাদা।”
মধ্যবয়সে তিনি Browning-এর ভক্ত হ'য়ে পড়েন। তাঁর মুখে Browning-এর
One Word More এবং The Last Ride Together-এর যে আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা শুনেছি তা অবিস্মরণীয়।
রবীন্দ্রনাথের উপর Browning-এর প্রভাব – যথা, ‘জীবনে যত পূজা হ'ল না সারা’ কবিতায় – নিয়েও আলোচনা হ'ত। প্রফুল্লরঞ্জনের প্রথম যৌবনের কবিতায়
Shelley’র প্রভাব থাকলেও তাতে আমরা ভারতীয় ঐতিহ্যের
(যথা, জন্মান্তরবাদের) সন্ধান পাই, এবং তিনি যে আসলে Browning এবং রবীন্দ্রনাথের মতোই
আশাবাদী তারও প্রমাণ পাই। উদাহরণ-স্বরূপ The Moth and the Star থেকে তিনটি স্তবক উদ্ধৃত
করছি:
এ কবিতা পড়লে Shelley’র “The devotion to something afar”; অথবা, রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসর্গে’র কবিতাঃ
মনে তো পড়েই, আরো বেশী মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র গান:
একদিন তিনি বললেন যে Browning যেমন আর্টের সংজ্ঞার্থ
(definition) দিয়েছেন এমন আর কেউ পারেন নি। এই ব'লে তিনি One Word More থেকে আবৃত্তি
করলেন:
আমি বললাম, এ দিক থেকে দেখতে গেলে চণ্ডীদাসের পদ ঠিক সে-রকম। চণ্ডীদাসের
কোনও artistic pose নেই; তিনি প্রাণ খুলে গান গেয়েছেন using nature that’s an art to others। এখানেই চণ্ডীদাসের সঙ্গে বিদ্যাপতির তফাৎ। কানুদাসও
চণ্ডীদাস-বন্দনায় এ কথা বলতে চেয়েছেন:
প্রফুল্লরঞ্জন ছিলেন চণ্ডীদাসের পরম ভক্ত। আজ প্রায় চল্লিশ বৎসর
পূর্বে আমি কলকাতায় ‘রবিবাসরে’ ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ আলোচনা করেছিলাম। বন্ধুরা – বিশেষ করে
পদকর্তা রামানন্দ বসুর বংশধর ব্যারিস্টার শ্রীযুক্ত শচীন্দ্রনাথ বসু ও মহাজনপদানুরাগী
এ্যাডভোকেট শ্রীযুক্ত জগদীশ সিংহ, পাটনার এক সাহিত্যসভায় সে-সমস্যার পুনরালোচনা করতে
অনুরোধ করলেন। প্রফুল্লরঞ্জন সে-সভার সভাপতি ছিলেন। আমি বিশ্লেষণ ক’রে বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও তরুণীরমণ চণ্ডীদাসের
পদ আলোচনা করেছিলাম। সভাপতির ভাষণে তিনি বললেন যে দ্বিজ চণ্ডীদাসের পদই সর্বশ্রেষ্ঠ;
চণ্ডীদাস বলতে আমরা দ্বিজ চণ্ডীদাসকেই বুঝি। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে
বৈষ্ণবপদাবলীর মাধুর্য প্রথম আস্বাদন করান। চিত্তরঞ্জনের প্রভাবে প্রফুল্লরঞ্জনও পদাবলীর
অনুরক্ত হ'য়ে পড়েন। পদাবলী শুধু আবৃত্তি করলে তার সম্পূর্ণ রসগ্রহণ করা যায় না। কীর্তনিয়ার
মুখে, সুরে, তালে, আখরে যখন তাহা গীত হয় তখনই তা অপূর্ব রসপ্রবাহের সৃষ্টি করে, তখনই
তা হয় অনির্বচনীয় – বিশ্বনাথ কবিরাজের ভাষায় “ব্রহ্মা-স্বাদ-সহোদরঃ”। প্রফুল্লরঞ্জন
কলকাতায় তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী, চিত্তরঞ্জনের কন্যা, শ্রীমতী অপর্ণার ও ব্রজমাধুরী সংঘের
গড়েরহাটী কীর্তন শুনতেন, এবং পাটনায় গণেশ দাস প্রভৃতি বড় বড় কীর্তনিয়াদের আনিয়ে জনগণের
সঙ্গে নোহরসাহী কীর্ত্তন শুনতেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি প্রসিদ্ধ কীর্তনিয়া
শ্রীযুক্ত রাধাচরণ দাস বাবাজীর ‘রাসলীলা’ শুনতে বাঁকিপুর হরিসভায় এসেছিলেন। বাবাজীকে পাটনা থেকে যে উপাধিপত্র
দেওয়া হয় তাতেও তিনি দস্তখত করেন। তাঁর অন্যান্য কীর্তির মধ্যে বাঁকিপুর হরিসভার নাটমন্দিরও
এক শ্রেষ্ঠ কীর্তি। মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি প্রতিমাসে হরিসভায় আর্থিক সাহায্য ক’রে গেছেন।
মোট কথা, বাংলা সাহিত্যে তাঁর যথেষ্ট অধিকার ছিল। চণ্ডীদাসের কথা
আগেই বলেছি। কবিরাজ গোস্বামীর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ছিল তাঁর খুব প্রিয় গ্রন্থ। যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় তখনও তিনি আমাকে
বলতেন মহাপ্রভু ও রায় রামানন্দের সাধ্য-সাধন-বিচার প’ড়ে শোনাতে। আমার পড়বার সময় তিনি অনেক পয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদুস্বরে
আবৃত্তি করতেন। দু'খানি বড় বাঁধানো খাতায় তিনি 'চৈতন্যচরিতামৃতে'র ব্যাখ্যা করেছিলেন
ইংরেজীতে। সে-খাতা দু'খানি অনেক খুঁজেও পাওয়া যায় নি। মৃত্যু পর্য্যন্ত তাঁর মনন-শক্তির
হ্রাস দেখি নি। বঙ্কিমচন্দ্রের এমন অনুরাগী আমি কমই দেখেছি। ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র বহু নিবন্ধের
অংশবিশেষ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে বঙ্কিম-শত-বার্ষিক-জন্মোৎসবে
তিনি ছিলেন সভাপতি। তাঁর সেদিনের ভাষণ তাঁর অন্যান্য ভাষণের সঙ্গে আজ লুপ্ত; নতুবা
বঙ্কিম সম্বন্ধে অনেক নূতন কথা এ কালের লোক জানতে পারত। রবীন্দ্ররচনাবলীর রাজসংস্করণ
তাঁর হাতের কাছে থাকত। রবীন্দ্রনাথের প্রথম ও মধ্যপর্বের অনেক কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল।
একদিন ‘বিদায়-অভিশাপ’ থেকে তিনি এমন আবৃত্তি করলেন যে আমি বিস্মিত হলাম। শ্রীমান তারাশঙ্কর
একবার এখানে মাসদুই ছিল। প্রফুল্লরঞ্জনের সঙ্গে আমি তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। প্রফুল্লরঞ্জনের
প্রতি তারাশঙ্কর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে তার আত্মচরিতে। একদা প্রফুল্লরঞ্জন যখন কলকাতায়
ছিলেন তখন একদিন শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও আমাকে
নৈশভোজনের নিমন্ত্রণ করেন প্রফুল্লরঞ্জনের সঙ্গে সুনীতিকুমারের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
সুনীতিকুমারের পাণ্ডিত্যের প্রতি প্রফুল্লরঞ্জনের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। সুনীতিকুমারের
অনুরোধে বাংলার এক দুঃস্থ সাহিত্যিককে মাসে পঞ্চাশ টাকা ক'রে সাহায্য করবার জন্য প্রফুল্লরঞ্জনকে
ব'লেছিলাম। সাহিত্যিকের সঙ্গে কথা হয় যে তিনি কতগুলি শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবপদ সংগ্রহ করবেন
এবং তা প্রফুল্লরঞ্জনের ব্যয়ে চিত্তরঞ্জন-স্মৃতি-গ্রন্থ রূপে মুদ্রিত হবে। সুনীতিকুমার
ভাবী গ্রন্থের নামকরণ করলেন ‘পদসংহিতা’। বলা বাহুল্য, তিন বৎসর মাসে পঞ্চাশ টাকা পেয়েও দুঃস্থ সাহিত্যিক
কিছুই করলেন না। আমি জানি, সুনীতি কুমারকেও দুঃস্থ সাহিত্যিকরা এ রকম ঠকিয়েছেন। এর
পর থেকে আর দুঃস্থ সাহিত্যিকদের কথা প্রফুল্লরঞ্জনকে বলি নি। তিনি অবশ্য এ কথা ভুলেই
গিয়েছিলেন, কারণ সাহায্যদানের কথা তাঁর মনেই থাকত না।
প্রফুল্লরঞ্জনের সৌন্দর্যজ্ঞানের কথা অনেকেরই জানা নেই। অবনীন্দ্রনাথ,
নন্দলাল, সুরেন কর ও মুকুল দে’র শ্রেষ্ঠ কয়েকখানি
ছবি তাঁর বাড়ীতে শোভা পেত। অবনীন্দ্রনাথের বিশাল চিত্র আওরংজেব – যা আমার মনে হয় তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম – প্রফুল্লরঞ্জনের বসবার ঘরে লটকানো ছিল। আওরংজেব একটু কুঁজো হ’য়ে পিছনে হাত দু’খানি রেখে
একখানি কোরান ধরেছেন, আর সে-কোরানের ‘বুক-মার্ক’ করেছেন একখানি ছোরা। এই ভঙ্গীটি শিশির ভাদুড়ি আলমগীরের ভূমিকায়
প্রথম রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের সময় দেখাতেন। আমার মনে হয় তা এ ছবি থেকেই নেওয়া। রবীন্দ্রনাথ
এ অমূল্য চিত্রসম্পদ শান্তিনিকেতনে দান করতে অনুরোধ করায় প্রফুল্লরঞ্জন তা হাসি মুখে
শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পাঠিয়ে দিলেন! মৃত্যুপর্য্যন্ত সুরেন করের বিশাল চিত্র ‘সাথী’, নন্দলালের ‘অপর্ণা’ ও মুকুল দে’র ‘শিবপার্বতী’ তাঁর বাড়ীতেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি শান্তিনিকেতনে হ্যাভেল-স্মৃতি-মন্দিরের
দ্বার উদ্ঘাটন করেন। সে-সময় তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা কোনও সাময়িক পত্রে সম্পূর্ণ
প্রকাশিত হয় নি। শুভদৈবক্রমে তার এক কপি আমার কাছে আছে। নীচে তা মুদ্রিত হ'লঃ
“গুরুদেব,
সমবেত মহিলা ও সুধীবৃন্দ,
“প্রথমেই মামুলি বিনয় প্রকাশ ক'রে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি
ঘটাবো না। নিজের অযোগ্যতাব কথা জেনেও আমি গুরুদেবের আদেশ শিরোধার্য ক'রে এই অনুষ্ঠানে
যোগদান করতে এসেছি। দেশে এত যোগ্য লোক থাকতে গুরুদেব কেন যে আমার প্রতি এতটা নির্দয়
হলেন তা আমি বুঝতে পারলাম না। খুব সম্ভব, পাটনায় অবস্থান কালে গুরুদেব আমার গৃহে ভারতীয়
চিত্রকলা-পদ্ধতির কয়েকখানি চিত্র দেখে মনে করেছেন আমি ভারতীয় আর্টের একজন সমঝদার। আসলে
আমি আর্টের সমঝদার নই। আইনের কচকচিতে জীবন যখন নীরস হ'য়ে ওঠে তখন অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল,
সুরেন্দ্রনাথ কর প্রভৃতির আঁকা ছবি দেখে আমি জীবনটাকে সরস করবার চেষ্টা করি। আর্টের
ব্যাকরণ বা ছবির অঙ্গের কথা – যা গুরুদেব তাঁর
প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন – আমি মোটেই জানিনা।
ভারতীয় আর্ট আমি ভালবাসি। সে ভালবাসা তো ব্যাখ্যা করবার জিনিস নয়। কেন ভালবাসি তা যে
আমি নিজেই জানি না।
“এই বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যাঁরা ভারতীয়
আর্টে নবযুগ প্রবর্তন করেন মনীষী হ্যাভেল তাঁদের মধ্যে প্রধান। ভারতীয় আর্টকে তিনিই
সর্বপ্রথম গ্রীক ও রেনেসাঁস আর্টের সমান আসন দান করেন, এবং তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয়
চিত্রকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
“এই নবযুগের প্রথমে যখন অনেকেই হ্যাভেলের প্রচেষ্টাকে
সন্দেহের চোখে দেখেছিল, তখন ভগিনী নিবেদিতা, ওকাকুরা ও গুরুদেব এই নবযুগকে সাদরে অভিনন্দন
করেছিলেন। যে ভারতীয় কলালক্ষ্মী অহল্যার মতো পাষাণ হ’য়ে গিয়েছিলেন তাঁকে জীবন্ত করবার জন্য হ্যাভেল নিয়ে এলেন অবনীন্দ্রনাথকে।
অবনীন্দ্রনাথের তুলির স্পর্শে পাষাণেও ফুল ফুটে উঠল। তিনি বিদেশী পদ্ধতি বর্জন ক'রে
ভারতীয় পদ্ধতিকেই গ্রহণ করলেন, এবং নিজের প্রতিভাবলে অজন্তা, মোগল ও রাজপুত চিত্র হতে
আলাদা এক নূতন রীতির সৃষ্টি করলেন। একে চিত্রে নব-গৌড়ীয়-রীতি বলা চলে।
“শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের প্রিয় শিষ্য নন্দলাল
এখন ভারতীয় শিল্প-গগনে সূর্যের মতো দীপ্তিমান। পরলোকগত সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী তাঁর
চব্বিশ বছরের জীবনে ভারতীয় কলালক্ষ্মীর চরণে যে অর্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন তা আমাদের শিল্পভাণ্ডারে
অক্ষয় হ’য়ে থাকবে।
“অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের শিষ্যগণ আজ বাংলার
শিল্পদীপ ভারতের নানা প্রদেশে বহন ক’রে নিয়ে গিয়েছেন।
তাঁদের জয়যাত্রা সফল হোক্।
“বাংলার ‘বন্দে মাতরম্’ যেমন ভারতের জাতীয়
সঙ্গীত ব’লে গণ্য হয়েছে, বাংলার ছবি আঁকার রীতিও তেমনি
ভারতীয় রীতি ব’লে গৃহীত হয়েছে। বাংলা যেন ভারতের মধ্যে এইরূপে
আপনাকে বিলীন ক’রে দেয়। এতেই বাংলার গৌরব।
“এই কুৎসিত জাতিবিরোধের দিনে হ্যাভেলের মতো
সুন্দরের পূজারীর স্মৃতিমন্দির প্রতিষ্ঠার বিশেষ প্রয়োজন। ললিতকলা ও সংস্কৃতি যে জাতীয়
অথবা ভৌগলিক গণ্ডিবন্ধন মানে না, এই স্মৃতিমন্দির তারই প্রমাণ, এবং এই স্মৃতিমন্দিরের
যোগ্য স্থানও এই শান্তিনিকেতন।
“যে মহাকবি
বিশ্বসৌন্দর্যের দ্রষ্টা ও সর্বমানবের কল্যাণকামী, তাঁর অমর কাব্য এই শান্তিনিকেতন
হ’তেই যেন দিকে দিকে বিশ্বমানবতার বাণী প্রচারিত
হয় – এই শুভকামনা নিয়ে আমি হ্যাভেল-স্মৃতি-মন্দিরের
দ্বারোদ্ঘাটন করছি। বন্দে মাতরম্।”
সংগীত ও অভিনয়ে প্রফুল্লরঞ্জনের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। একদিন তিনি ইংলণ্ডের
রোমান্টিক অভিনেতা Sir Henry Irving-এর খুব সুখ্যাতি করছিলেন। আমি বললাম, Bernard
Shaw তো তাকে একেবার নস্যাৎ ক'রে দিয়েছেন। জবাবে তিনি বললেন, Bernard Shaw তো
Shakespeare কেও নস্যাৎ করবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু Shakespeare যে-অমর সে-অমরই রয়ে
গেলেন। বিলাতের শ্রেষ্ঠ অভিনয় দেখেও তিনি বাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যথেষ্ট প্রশংসা
করতেন। তিনি বলতেন যে বাংলার সেদিনের অভিনেত্রী তারাসুন্দরী ফরাসী দেশের জগদ্বিখ্যাত
Sarah Bernhardt-এর তুলনায় কোনো অংশে ছোট ছিলেন না। তিনি শিশিরবাবু ও শম্ভু মিত্রের
অভিনয়েরও খুব তারিফ করতেন। নাটকের কথায় একটা মজার ব্যাপার মনে পড়ল! এতে প্রফুল্লরঞ্জনের
রসিকতার আভাস পাওয়া যাবে। ১৯২৫ সনে আমাদের কলেজে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক অভিনীত হয়।
রাজকীয় চালে আমরা সে অভিনয়ের ব্যবস্থা করি। লখনৌর সরকারী আর্ট কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ
বীরেশ্বর সেন তখন আমাদের কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক। তিনি সমস্ত পরিচ্ছদের চিত্র এঁকে দিলেন।
কলকাতা থেকে পরিচ্ছদ তৈরি হয়ে এল, এল ‘মেক্-আপ’-ও পরিধেয়-বিশেষজ্ঞ। বীরেশ্বর নেমেছিল সেকেন্দর শাহের ভূমিকায়, অধ্যাপক
হরিমোহন মুখোপাধ্যায় কাত্যায়নের, আর আমাকে নামতে হয়েছিল চাণক্যের ভূমিকায়। এপ্রিল মাস,
বেশ গরম, খালি গায়ে কাঁধে একখানি উত্তরীয় ফেলে আমি অভিনয় ক'রে গেলাম। সে সময় দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন ও শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী এখানে ছিলেন। তাঁরা ও প্রফুল্লরঞ্জন প্রায় শেষ
পর্যন্ত অভিনয় দেখেছিলেন। অন্ধ ভিক্ষুক সেজেছিলেন পরলোকগত বিনয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর ঐ
‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ গান শুনে শ্রোতৃ-বর্গ মুগ্ধ হ'য়ে গেলেন। সত্যই অমন গান আর শুনবো
না! পাটনায় সমসাময়িক বহু বিদগ্ধ নর-নারী সে-অভিনয়ে উপস্থিত ছিলেন। আমরা সকলেরই প্রশংসা
অর্জন করলাম। আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন বিখ্যাত দর্শনের অধ্যাপক। তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়া-যুগের
ভব্যতার প্রতীক। পরদিন তিনি আমায় বললেন, “মহিলাদের
সামনে খালি গায়ে অভিনয় করা আপনার উচিত হয় নি; এজন্য শহরে নিন্দা হয়েছে।” একটু রুষ্ট হয়েই বললাম, “চাণক্য খালি
গায়ে অভিনয় করবে না, তবে কি সুট প’রে অভিনয়
করবে?” কথাটা প্রফুল্লরঞ্জন শুনেই শিশুর মতো হো হো’ ক’রে হাসতে লাগলেন,
এবং বললেন যে তিনিই এই খালি গায়ে অভিনয়ের কথা অধ্যক্ষকে বলেছিলেন। ভিক্টোরিয়া-যুগের
ভব্যতার এমন ব্যঙ্গ এক প্রফুল্লরঞ্জনই করতে পারতেন!
পাটনা মেডিকেল কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত চিকিৎসক শ্রীযুক্ত
শরদিন্দুমোহন ঘোষাল একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা ও প্রযোজক। পাটনার রবীন্দ্র-ভবন ও তৎসংলগ্ন
রঙ্গমঞ্চ নির্মাণে তাঁর কৃতিত্ব সর্বজনস্বীকৃত। তিনি পাটনায় বহু নাটকের সুষ্ঠু নবরূপায়ণ
করেছেন। আমি ‘বিচিত্রায়’ ‘ডাকঘরের’ অভিনয় – যাতে রবীন্দ্রনাথ
ও অবনীন্দ্রনাথ রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন – দেখেছি;
তবু বলবো, শরদিন্দুমোহনের পাটনা রবীন্দ্র-ভবনে ‘ডাকঘরের’ প্রযোজনায় অমল-চরিত্রের
এক নূতন ব্যাখা পেয়েছি। অন্যত্র আমি সে-কথা লিখেছি। নাট্যাভিনয়ে শরদিন্দুমোহন সর্বদা
প্রফুল্লরঞ্জনের উৎসাহ ও প্রশস্তি লাভ করেছেন।
খেলাধূলায়ও প্রফুল্লরঞ্জনের অনুরাগ কম ছিল না। ভারতীয় টেনিসের উন্নতির
জন্য তিনি বহু অর্থ ব্যয় করেছেন। খবরের কাগজ এলেই তিনি ফুটবল ও ক্রিকেটের খবর সর্বাগ্রে
পড়তেন। ১৯১১ সনে মোহনবাগান East Yorks-কে হারিয়ে I. F. A. Shield লাভ করে। সে ম্যাচে
শিব ভাদুড়ি, কানু ও রাজেন সেনের খেলার কথা একদিন তাঁকে বলতে তিনি বললেন, “তুমি সে খেলা দেখেছিলে নাকি? আমিও সে ম্যাচ দেখেছি, সে রকম খেলা
আর দেখবো না।” আমি বললাম. “খেলার ধরণই যে বদলে গেছে, এখন আর সে খেলা পাবেন কোথায়? এখন দলের
খেলা, ব্যক্তির খেলা আর নেই। আমাদের দেশে খেলায়ও একসময় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল, এখন
তা নেই; দলের জন্য ব্যক্তি ত্যাগস্বীকার করেছে।”
তাঁর দেশপ্রেমের কথা সকলেই জানেন। তাঁর দেশপ্রেমে উগ্র স্বাজাত্যবোধ
ছিল না; তা ছিল মানবপ্রেমেরই অঙ্গ। কংগ্রেসের তহবিলে তিনি হাজার হাজার টাকা দান করেছেন।
পাটনার এক জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র যখন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বন্ধ ক'রে দিল তখন তার সম্পাদককে
তিনি মাসে পাঁচশত টাকা ক'রে সাহায্য করতেন। তা ছাড়া যে কোন সংস্থা দেশের কাজ করত তাকে
তিনি মাসে মাসে সাহায্য ক’রে যেতেন। গরিব-দুঃখী,
কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, দুর্গত ছাত্র, গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসী, যে আসত, কিছু-না-কিছু পেত।
যেমন তাঁর রোজগার, তেমনই তাঁর খরচ! চিত্তরঞ্জন ও প্রফুল্লরঞ্জনকে দেখেছি টাকাকে মাটির
ঢেলার মতো জ্ঞান করতে। এটা ছিল তাঁদের বংশেরই ধারা। এঁদের পিতা ভুবনমোহন জ্যাঠা কালীমোহন
ও দুর্গামোহন সকলেই দানশীল ছিলেন। জ্যাঠতুতো ভাই সতীশরঞ্জনেরও অনেক দান ছিল। বহু ধূর্তলোক
এঁদের ঠকিয়েছে সত্য; তবু বলবো, মানুষকে ভালবাসতেন ব’লেই মানুষকে এঁরা বিশ্বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে – “মানুষের প্রতি বিশ্বাস
হারানো পাপ।” প্রফুল্লরঞ্জনের কর্তব্যজ্ঞানও ছিল অসাধারণ।
আমার এক প্রাক্তন ছাত্র ছিল তাঁর সেক্রেটারি। কঠিন রোগে সে মাসের পর মাস শয্যাশায়ী
ছিল। প্রফুল্লরঞ্জন তাঁর চিকিৎসা ও পথ্যের সকল ব্যবস্থা করেছেন, এমনকি, বাড়ী থেকে পথ্য
রান্না ক’রে পাঠিয়েছেন। নিজেও তাকে দেখতে এসেছেন। দুর্ভাগ্য
এই যে এত ক'রেও তাকে বাঁচানো গেল না।
প্রফুল্লরঞ্জনের ব্যসন ছিল রন্ধন। এ কথাটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য
মনে হবে। দেশী ও বিলাতী, বিশেষ ক'রে বিক্রমপুরের রান্নার খুঁটিনাটি তিনি সব জানতেন।
শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীর কাছেই তিনি বিক্রমপুরের রান্না শিখেছিলেন। রান্না ও খাওয়ার
গল্প শুরু হ’লে তা আর শেষ হ'ত না! পাটনার সর্বশ্রেষ্ঠ সূপকার
তাঁর রন্ধনশালায়ই ছিল। প্রতাপ সিং নামে এক পাহাড়ীকে তিনি Firpo-তে পাঠিয়ে, টাকা দিয়ে,
ফরাসী রান্না শিখিয়ে এনেছিলেন। যখন মিসেস ডরোথী দাশ ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য ইংলণ্ডে
বাড়ী ভাড়া ক’রেছিলেন তখন একদিন প্রফুল্লরঞ্জন বললেন, “শঙ্কর (তাঁর পরলোকগত পুত্র) বিলেত থেকে চিঠি লিখেছে, ওদের খাওয়া-দাওয়ার
অসুবিধা হচ্ছে, প্রতাপ সিংকে অবিলম্বে সেখানে পাঠিয়ে দিতে। যাওয়ার আগে সে তোমার চাকরের
কাছ থেকে ঢাকাই পরোটা শিখে নেবে।” সে-সময় আমার একটি
পূর্ববঙ্গের চাকর ছিল যে পূর্ববঙ্গের রান্নায় – বিশেষ ক'রে
ঢাকাই পরোটায় – সিদ্ধহস্ত। তার তৈরি ঢাকাই পরোটা দাশ সাহেব
আগে একদিন খেয়েছিলেন। আমি বললাম, “রাজী আছি,
যদি প্রতাপ সিং আমার চাকরকে চারটি পদের রান্না-যা সে Firpo-তে শিখেছে – শিখিয়ে দেয়।” যথাকালে প্রতাপ
সিং ঢাকাই পরোটা বানানো শিখল; আর চাকরের নাম ক’রে আমি ও
আমার বন্ধু অধ্যাপক যোগীন্দ্রনাথ ঘোষ চারটি বিলাতী পদের রান্না শিখে নিলাম। প্রফুল্লরঞ্জন
নিজে এত রান্না জানতেন, এমন ওস্তাদ বাবুর্চী তাঁর, তবু তিনি ছিলেন স্বল্পাহারী। হাইকোর্ট
থেকে ফিরে এসে দিনে একবার শুক্তো, ঘণ্ট ইত্যাদি দিয়ে ছটাকখানেক চালের ভাত খেতেন। নিরামিষই
তিনি পছন্দ করতেন। আমি বলতাম, “টাকায় ক্ষুধা নষ্ট
করে; দরিদ্রের ক্ষুধা বেশী!"
প্রফুল্লরঞ্জনের রাজকীর আতিথেয়তার কথা এ দুর্দিনে বিশেষ ক’রে মনে পড়ে। স্যর মন্মথ মুখোপাধ্যায় যখন বড়লাটের ক্যাবিনেটে আইন-সচিব
নিযুক্ত হলেন তখন প্রফুল্লরঞ্জন এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। পাটনার বহু লোক তাতে নিমন্ত্রিত
হলেন। গিয়ে দেখি সারা বাড়ী, এমনকি, আমগাছগুলিও লাল নীল আলোয় সজ্জিত। এক বন্ধু মন্তব্য
করলেন, “মনে হচ্ছে যেন আজ স্যর মন্মথর বিয়ে!” দেশী ও বিলাতী দুই রকমের রান্না একের পর এক চলল। অনেকে মাঝখানেই
থেমে গেলেন। মাঝে মাঝে তিনি স্টীমার ভাড়া ক'রে গঙ্গাবক্ষে বন্ধুবান্ধবদের পার্টি দিতেন;
সেখানে পানীয়ের প্লাবনে খাদ্য ভেসে যেত। জলে-স্থলে তিনি পার্টি দিয়েছেন, কেবল অন্তরীক্ষে
সম্ভব হয় নি। আসল কথা, তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে, একটা বিরোধ ছিল; একদিকে তিনি আধুনিক,
অন্যদিকে তিনি সামন্ততান্ত্রিক। তিনি প্রগতিশীল হ’লেও তাঁর মধ্যে মধ্যযুগের রাজকীয় দোষ ও গুণ দু’-ই ছিল। তাঁর জীবনে এ বিরোধের সমাধান হয় নি। এই বেহিসাবী খরচের জন্যই
লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার ক'রেও তিনি মাঝে মাঝে অর্থাভাবে চিন্তিত হ'য়ে পড়তেন। তিনি বুঝতেই
পারতেন না যে দুঃসময়ের জন্য টাকা জমানো দরকার; তিনি ভাবতেন টাকা রোজগার খরচের জন্যই।
একবার তিনি বেঙ্গলী এ্যাসোসিয়েশন ও ‘বিহার হেরল্ডে’র জন্য চাঁদা তুলতে ধানবাদ গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আমায় বললেন যে ধানবাদের
বাঙালীরা বেশ মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছেন, কেবল একজন বড় উকিল ছাড়া। উকিল বললেন, “হাতে তো টাকা নেই।” দাশ সাহেব
বললেন, “তবে একখানি চেক্ লিখে দিন।” তার জবাবে উকিল বললেন, “বলেন কি,
ব্যাঙ্কে টাকা রেখেছি কি তা তোলবার জন্যে! ব্যাঙ্ক থেকে কি টাকা কখনো তোলা যায়!” দাশ সাহেব বলতে বলতে হো হো করে খুব হাসলেন। আমি দেখলাম, দুই বিরুদ্ধ
ভাবের সংঘাতেই যে হাস্যরসের
সৃষ্টি হয় তা নয়, দুই বিরুদ্ধ মনের সংঘাতেও বিশুদ্ধ হাস্যরসের সৃষ্টি
হ’তে পারে।
যিনি এমন হাসতে পারতেন তাঁরই চোখে আবার জল দেখেছি যখন তাঁর মায়ের
কথা অথবা দেশবন্ধুর কথা উঠত। আগেই বলেছি, মানবীয় দোষ ও গুণ দু’-ই তাঁর চরিত্রে সুপরিস্ফুট ছিল; কিন্তু গুণগুলি এত উচ্চস্তরের যে
তার ঔজ্জ্বল্যে সব দোষ অদৃশ্য হ'য়ে যেত। আর দোষে-গুণে মানুষকেই আমরা ভালবাসি, দোষহীন
দেবতাকে দূর থেকে ভক্তি করি।
১৯৪৩ সনের অক্টোবর মাস। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। বাংলা দেশে নিদারুণ
দুর্ভিক্ষ। কলকাতার রাস্তায়ও কঙ্কালসার মৃতদেহ। সে-সময় মুঙ্গেরে হয় বেঙ্গলী এ্যাসোসিয়েশনের
পঞ্চম বার্ষিক-অধিবেশন। তার সভাপতি প্রফুল্লরঞ্জনের ভাষণে যে-আদর্শবাদ দেখেছি তা কখনো
ভুলতে পারবো না। বাংলায় মুদ্রিত সে-ভাষণের এক খণ্ড আমার কাছে ছিল। একজন তা পড়তে নিয়ে
আর ফেরত দেয় নি। ১২ই অক্টোবরের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় তার যে ইংরেজী তরজমা প্রকাশিত হয়েছিল তা থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত
ক'রে এ প্রবন্ধ শেষ করছিঃ
“Will not
the sun rise, bright and cheerful, after this dark, depressing night? Will not
the sharp pang bring forth a new life, a new world in which humanism will be
the highest religion, where the man will not plot to deprive his fellow-men,
but try to serve all, when the gratest good will accrue to the greatest number,
when each will contribute according to his ability, and to each would be given
according to his need?"
[সঞ্চিতা, ১৯৭৫]