Wednesday, March 27, 2024

ভাষাগত সংখ্যালঘু ও বাবাসাহেব

ভাষাগত সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে দেশের সংবিধানের ধারা সংখ্যা ২৯এর প্রসঙ্গ মাঝে মধ্যেই উঠে আসে। ধারাটি তৃতীয় অধ্যায়, ‘মৌলিক অধিকার’এ আছে। যদি আমরা বাংলায় অনুদিত, মুদ্রিত (তৃতীয় সংস্করণ, ২০২২; প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণ যথাক্রমে ১৯৮৩ এবং ১৯৮৭তে প্রকাশিত হয়েছিলো) সংবিধানটা দেখি, দেখবো যে ধারাটির আগে একটা উপশিরোনাম দেওয়া আছে ‘কৃষ্টি এবং শিক্ষা বিষয়ক অধিকার’। ধারাটির অনুচ্ছেদ (১) অথবা (২)য়ে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা (একবচনে বা বহুবচনে) কোথাও নেই। প্রথম অনুচ্ছেদে আছে ‘নাগরিকগণের কোনো বিভাগ’। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ‘বিভাগ’ও নেই; সোজাসুজি ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে ‘কোনো নাগরিক’। কিন্তু সাইডনোটে (ব্যাখ্যামূলক উপশিরোনামে) লেখা আছে ‘সংখ্যালঘুবর্গের স্বার্থরক্ষণ’। যখন নাকি ধারা সংখ্যা ৩০এ ‘সংখ্যালঘুবর্গ’ শব্দটা সাইডনোটেও আছে আর অনুচ্ছেদের কথ্যেও আছে।

কেন? কী করে হলো?  

৮ই ডিসেম্বর ১৯৪৮এ, সংবিধান-সভায় তর্কবিতর্ক চলছিলো। দিনের শেষে ড্রাফটিং কমিটির প্রধান ডাঃ আম্বেদকর উঠে দাঁড়ালেন। কেন “মৌলিক অধিকার কমিটির অনুচ্ছেদ ১৮র ভাষা ড্রাফটিং কমিটি বদলেছে” তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে গিয়ে বললেনঃ

“মূল ‘মৌলিক অধিকার’এর দেওয়া অনুচ্ছেদটা পড়লে লক্ষ্য করবেন যে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা সেভাবে ব্যবহৃত হয় নি যেভাবে, আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব, চাকরিতে প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি কিছু রাজনৈতিক রক্ষাকবচ দেওয়ার জন্য শব্দটা ব্যবহার করতে আমরা অভ্যস্ত। শব্দটি শুধু শব্দটির পরিভাষাগত অর্থেই ব্যবহার করা হয় নি। তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে যারা পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক এবং ভাষিক অর্থে সংখ্যালঘু। উদাহরণার্থে, এই ধারা সংখ্যা ২৩এর উদ্দ্যেশ্যাধীন, যদি ম্যাড্রাস থেকে কিছুসংখ্যক মানুষ কোনো কাজে বোম্বাইয়ে চলে আসে এবং থেকে যায়, তারা পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু না হলেও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু হবে। সমান ভাবে, যদি কিছু সংখ্যক মারাঠি মহারাষ্ট্র থেকে গিয়ে বাংলায় বসবাস করতে শুরু করে, পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু না হলেও তারা বাংলায় সাংস্কৃতিক ও ভাষিক সংখ্যালঘু হবে। এই ধারাটি সংস্কৃতি, ভাষা ও লিপিগত বিষয়ে শুধু পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘুদেরই রক্ষাকবচ দেয় না – যেমন আমি এক্ষুনি ব্যাখ্যা করলাম – সংখ্যালঘুর বৃহত্তর অর্থে দেয়। সে কারণেই আমরা ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা সরিয়ে দিয়েছি। কেননা আমরা অনুভব করেছি যে শব্দটা সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যায়িত হতে পারে, যখন নাকি, ধারা সংখ্যা ১৮* গ্রহণ করার সময় এই সংবিধান-সভার উদ্দেশ্য ছিলো ব্যাপকতর অর্থে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটাকে ব্যবহার করা, যাতে তাদেরও সাংস্কৃতিক রক্ষাকবচ দেওয়া যায় যারা পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু না হলেও সংখ্যালঘু।”

[কন্সটিচ্যুএন্ট এসেম্বলি অফ ইন্ডিয়া ডিবেটস (প্রসিডিংস) – ভল্যুম VII]

এবার, ২০১১র জনগণনা (সর্বশেষ জনগণনা) অনুসারে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বাংলাভাষাভাষী জনতার সংখ্যা দেখা যাক। দুটো রাজ্যে তাদের সংখ্যা ৫০%এর বেশি – পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা (যথাক্রমে ৮৬.২২% এবং ৬৫.৭৩%)। দুটো রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২৫%এর বেশি – আসাম ও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপসমূহ (যথাক্রমে ২৮.৯২% এবং ২৮.৪৯%)। যদিও আসামের ক্ষেত্রে এই প্রতিশত হিসাবে বরাক উপত্যকায় তাদের ৮০.৮৪% সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা যায় না। ঝাড়খন্ডে আর মিজোরামে বাংলাভাষী জনতা যথাক্রমে ৯.৭৩% এবং ৯.৮৩%। নাগাল্যান্ড ও মণিপুর বাদে বাকি সব পূর্বোত্তর রাজ্যগুলোয় বাংলাভাষী জনতা ৫%এর বেশি। নাগাল্যান্ড ও দামন-দিউয়ে তাদের প্রতিশত যথাক্রমে ৩.৭৮ এবং ২.১৫। উত্তরাখন্ড, দিল্লি, ওড়িশা, সিকিম আর মণিপুরে বাংলাভাষী জনসংখ্যা ১%এর বেশি। ভারতের বাকি কুড়িটা রাজ্যের/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সবকটিতেই বাংলাভাষী জনসংখ্যা আছে কিন্তু ১%এর কম। বিহারকেও তাদেরই মধ্যে রাখা হয়েছে – ০.৭৮%।

বোঝাই যায় যে নিজের, পরিবারের এবং রুজিরুটির সুরক্ষার তাগিদে অনেকেই ভাষাগত পরিচয় লুকিয়েছে। অথবা, যা সচরাচর হয় – জনগণনা আধিকারিকেরা প্রশিক্ষণের সময় কর্মীদের কঠোর (মৌখিক) ‘পরামর্শ’ দেয় যে অরিজিনাল ফর্ম ভরাবে না, শুধু স্বাক্ষর করিয়ে নেবে; একটা নোটবুক রাখবে, তাতে ডেটাগুলো নোট করে নেবে। পরে বাড়িতে এসে ফর্মটা ভরে নেবে। তারা সেটায় আরেকটু শর্টকাট করে। নাম, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদি নোট করে নেয়। ভাষাটা খালিই থেকে যায়। পরে বাড়িতে বসে লাইন দিয়ে ‘এইচ’, ‘এইচ’, ‘এইচ’ ভরে দেয়। সবাই হিন্দিভাষী হয়ে গেল!

বিহারে, ১৯৯০এর ‘বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগ’ গঠন সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী ধর্মগত সংখ্যালঘু হিসেবে যেমন ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন, সিখ, খ্রিস্টান ইত্যাদি গণ্য, ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে বাংলা গণ্য। অর্থাৎ ধর্মগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা একই আয়োগে একসাথে ন্যায়ের জন্য দরবার করতে পারে। সরকারের তরফ থেকেও একই বিভাগের মাধ্যমে সংখ্যালঘু কল্যাণের কাজ এবং একই আয়োগের মাধ্যমে সে-সম্পর্কিত অভিযোগের নিরাকরণ হয়।

সময়ে সময়ে বিভিন্ন দাবিতে সরকারের তরফ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বিহার বাঙালি সমিতি পাটনা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছে। পক্ষে রায়ও পেয়েছে। কারণ – প্রথমত ভাষাগত সংখ্যালঘুর মর্যাদা এবং দ্বিতীয়ত সংবিধানের ধারা সংখ্যা ২৯।  

কেন্দ্রীয় স্তরে কিন্তু তেমনটা নয়। দিল্লিতে একই সময়ে যে সংখ্যালঘু আয়োগ তৈরি হয়েছে, সেটা শুধু ধর্মগত সংখ্যালঘুর কাজকর্ম দেখে। ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য একটা আয়োগ নয়, আয়ুক্ত (কমিশন নয়, কমিশনার) বসিয়ে দেওয়া হয়েছে দিল্লি থেকে দূরে, এলাহাবাদে। সে আয়ুক্তের তরফ থেকে মোটা মোটা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় সরকারের কাছে। সেই প্রতিবেদন পড়ে জানতে পারি আয়ুক্তের প্রতিনিধি আমাদের রাজ্যেও এসেছিলো, সরকারি গেস্টহাউজে থেকেছিলো, সরকার যে তথ্য দিয়েছে, পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেছে। আমরা, বিহারের বাংলাভাষীরা কখনো জানতেও পারিনা তেনারা কখন আসেন এবং কখন চলে যান। কখনো সরকারকে বলেনও না যে আমরা বিভিন্ন ভাষিক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করবো।

তাহলে ভাবুন যদি ৮ই ডিসেম্বর ১৯৪৮এ আম্বেদকর সাহেব সংবিধান-সভায় ‘পরিভাষাগত সংখ্যালঘু’ এবং ‘পরিভাষাগত না হলেও সংখ্যালঘু’র মধ্যে তফাতের চুলচেরা বিশ্লেষণে না যেতেন, এবং ধারা সংখ্যা ২৯এর প্রাসঙ্গিক জায়গায় মূল শব্দ সরিয়ে দ্যোতক শব্দ ‘নাগরিকগণের কোনো বিভাগ’ এবং ‘কোনো নাগরিক’ না বসানো হতো, তাহলে কী হতো? আমাদের আজ জনস্বার্থ মামলা করে জেতার আশা কতটা ক্ষীণ হতো আর সংবিধান-সভার সেই বিতর্কের চার মাস আগে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত সংকল্পটারই বা কী হতো যেটা ১৪ই আগস্ট ১৯৪৮ তারিখে গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিলো –

“ … শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে শিশুকে মাতৃভাষা মাধ্যমে পড়াতে হবে, এই নীতি সরকার স্বীকার করে নিয়েছে। সব শিক্ষাবিদেরা মানেন যে এই নীতির যে কোনো ব্যতিক্রম শিশুর পক্ষে এবং ফলতঃ সমাজের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। … এ ধরণের পরিস্থিতি কোনো রাজ্য বা প্রদেশের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোনো একটি ভাষাকে গ্রহণ করা অসম্ভব করে তোলে। যে প্রদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনসমষ্টি বসবাস করে সেখানে কোনো একটি ভাষা গ্রহণ করে সবার ওপর চাপিয়ে দিলে অসন্তোষ ও তিক্ততা অবশ্যই জন্ম নেবে। তার প্রভাব আন্তর্প্রাদেশিক সম্পর্কের ওপর পড়বে এবং ফলে, জবাবী পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট দুষ্টচক্র তৈরি হবে। … ভারত সরকারের অভিমত যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, ভালো হবে যদি উপরুল্লিখিত নীতি সবক’টি প্রাদেশিক ও রাজ্য সরকার অনুসরণ করে।”  

১৯৫৬ সালে হওয়া সংবিধানের সপ্তম সংশোধনে, ‘৩৫০ক’ যোগ করা হলো। তাতে বলা হলো, “প্রত্যেকটি রাজ্য এবং প্রত্যেকটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা হবে যে রাজ্যের ভিতরে ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির শিশুদের যেন শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষণ প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়; এবং রাষ্ট্রপতি যদি প্রয়োজন বা উচিৎ মনে করেন, এসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য যে কোনো রাজ্যকে নির্দেশ জারি করতে পারেন।”

যাহোক, এতো কিছুর পরও, ২০০৯ সালে যখন শিক্ষার অধিকার আইন তৈরি হলো, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের এই বার্তাটায় একটু জল মিশে গেলো – অধ্যায় ৫এর বিভাগ ২৯(এফ) এ লেখা হলো –

“শিক্ষাদানের মাধ্যম হবে, যতটা পারা যায়,” [প্র্যাক্টিকেবল] “শিশুর মাতৃভাষা”।

‘পারা যায়’, ‘প্র্যাক্টিকেবল’ এধরণের প্রাগম্যাটিক প্রবৃত্তিগুলো বিপজ্জনক ফাঁদ তৈরি করে।

সেই সূত্র ধরেই নতুন শিক্ষা নীতি ২০২২এর অনুচ্ছেদ ৪.১১এ লেখা হয়েছে (বাংলা অনুবাদে), “যেখানেই সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম অন্ততঃ পঞ্চম শ্রেণী পর্য্যন্ত তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে অষ্টম শ্রেণী এবং তদুর্দ্ধ পর্য্যন্ত ঘরের ভাষা/মাতৃভাষা/স্থানীয় ভাষা/আঞ্চলিক ভাষা হবে।”

তার মানে, ধরুন পূর্ণিয়া জেলার ঔরাহি হিঙনা গ্রামে, যেখানে সত্তর বছর আগে ফণীশ্বর নাথ রেণুও দিব্যি বাংলা শিখতে পারছিলেন, আজ কয়েকটা বাংলাভাষী ছেলেমেয়ে যদি, বাংলা মাধ্যম তো দূরের কথা বাংলা বিষয় যাতে পড়তে পারে তার বিষয়ে স্কুলের হেডমাস্টারকে বলতে যায়, বা অভিভাবকেরাই যদি বলতে যান, হেডমাস্টার বলতেই পারেন, “কোত্থেকে পাবো বলুন তো বাংলায় পড়াবার বা বাংলা পড়াবার লোক? এবারের ব্যাচেও তো এলো না। মৈথিলী বা উর্দুতে পড়ুক না। বা হিন্দিতেই পড়ুক। শিক্ষানীতিতে তো আঞ্চলিক ভাষা, স্থানীয় ভাষার অপশন রয়েইছে।”

এরকম হাজারটা ঘটনার প্রত্যেকটায় আদালতে যাওয়া কি কারো পক্ষে সম্ভব?

তবুও যদি নিরুপায় হয়ে সব দৃষ্টান্তকে একসাথে নিয়ে আদালতে মামলা করতেও হয়, রক্ষাকবচ তো সেই ধারা সংখ্যা ২৯!

যদিও সবদিক থেকেই বাবাসাহেবকে মালা পরিয়ে পরিয়ে কন্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে, তবু আমরা, ভাষাগত সংখ্যালঘুরা তাঁর প্রতি অনুগৃহীত থাকতেই পারি যে তিনিই ‘মৌলিক অধিকার’এ আমাদের আত্মপরিচয় বাঁচিয়ে রাখার ও প্রয়োজনে লড়াই করার জায়গাটা করে দিয়েছিলেন।

___________________________________

*ধারা সংখ্যাটা শেষ বয়ানে বদলে ২৯ হয়েছিলো।

 



Friday, March 22, 2024

ঘুণপর্ব

রথচক্র

আগে মনে হত আদবানির রথের মিছিল। এখন আন্তর্জালের তথ্যের সঙ্গে নিজের ডাইরির তারিখ মিলিয়ে দেখলাম ঠিক তা নয়। আন্তর্জাল বলছে ১৯৯০এর ২৩শে অক্টোবর তারিখে আদবানি তার রথ নিয়ে পাটনায় ঢুকেছিল। তাই যদি হয় তবে ২২শে সন্ধ্যাবেলা মনে হয় তার অভ্যর্থনার প্রস্তুতি হিসেবে ওদের কোনো একটা ভগোয়া মিছিল চিঁড়িয়াটাঁড় পুল পেরিয়ে ঢুকছিল। বেফ দপ্তরে সবাই বলল আমায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে, কেননা একমাত্র আমারই গান্ধী ময়দান হয়ে যাওয়ার ছিল। ওটাই রোজকার বাড়ির রাস্তা তখন। অশোক রাজপথ ধরে খাজাঞ্চি রোড, বিএমদাস রোড, বাড়ি। দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি সাইকেলে এগোলাম। বেরোবার সময় দেখেছিলাম বিপিবিইএর কয়েকজন নেতা-কর্মী ব্যাঙ্কের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সোল্লাসে অপেক্ষা করছে; মিছিল ও উত্তেজক জিগিরের ঝড়, চিঁড়িয়াটাঁড় পুলের ওপর সে সময়। সোল্লাসে বললাম, যদিও অনেকেই হয়তো আশঙ্কায়ও ছিল, তবে সোল্লাসে, এমনকি হাতে শঙ্খ নিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য যারা দাঁড়িয়েছিল, সংখ্যায় যতই হোক, দাপটের সঙ্গে ছিল।

আমাকে কয়েকজন ঘিরে ধরল বাটলিবয়ের কাছে। মুখভরা দাড়িগোঁফে আমায় মুসলমান ভাবা স্বাভাবিক, তার ওপর উদ্গ্রীব হয়ে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করার বদলে আমি নির্বিবাদে উত্তর দিকে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি, সন্দেহ হতেই পারে। বলুন, বলুন, জয়শ্রীরাম বলুন! বললাম, বলব না। তখনো মার শুরু হয় নি। সাইকেলটা হাত থেকে ছাড়িয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। আর মুখের খুব কাছে এসে হুমকির স্বরে, বলুন, বলুন! পিছন থেকে কোনো ছোট চ্যাংড়া, এ দঢ়িয়ল, বোল! তখনই সামনে একজন ভদ্রগোছের মানুষ এসে জায়গা নিলেন। ওই বাটলিবয়ের বা সে ধরণেরই কোনো প্রাইভেট কম্পানির হিসেবরক্ষক ধরণের ঈষৎ ফর্সা চেহারা, চওড়া কপাল আর রোগা শরীর। বলে দিন না একবার! কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছেন? দেখছেন তো সবাই মারমুখি হয়ে আছে। আপনি কি রামকে মানেন না? আমি বললাম, আপনারা বলেন মর্যাদাপুরুষোত্তম রাম! আর জবরদস্তি তাঁর নাম বলাবার জন্য একজন মানুষের মর্যাদা পায়ে পিষছেন? আমার ইচ্ছে হবে আমি একশোবার রামের নাম নেব, কিন্তু জোর করে আমাকে বলাতে পারবেন না। আমি বলব না।

ভবি ভুলবার নয় দেখে লোকটা সরে গেল, আগের চেহারাগুলো ফের থেকে সামনে এল, অবে, বোল সালে জয়শ্রীরাম! আরো কিছু গালাগাল হয়তো ছিল আর তার সঙ্গে শুরু হল কিল-চড় মুখে, বুকে, পিঠে আর সাইকেলটা মাটিতে ফেলে তার ওপর লাফানো । হঠাৎ একটা জোরদার ঘুষি পড়ল মাথার পিছনে, মাথাটা ভন্ন করে উঠল। ঠিক পড়ে না গেলেও আস্তে আস্তে মাটিতে ভর খুঁজছিলাম। হঠাত শুনলাম একটা চেনা কণ্ঠস্বর, ক্যা হুয়া ভাই, ক্যা হুয়া হ্যয়, দেখেঁ দেখেঁ, অরে, পালদা এ হটিয়ে, ইয়ে অপনা আদমি হ্যঁয় ভাই, হটিয়ে আমি চোখ তুলে দেখি ছাত্র ফেডারেশনের দুটো পরিচিত ছেলে, আইয়ে, আইয়ে, উঠিয়ে এঃ, সাইকিল ছোড়ো ভাই, বোল ন রহে হ্যঁয় অপনা আদমি হ্যঁয়! একজন আমার বগলে হাত লাগিয়ে আমায় ওঠাতে ওঠাতে কানে বলল, দাদা, বোল দিজিয়ে একবার! বুঝতে হি হ্যঁয়, মব মেন্টালিটি হ্যয়। কিছুটা পরিশ্রান্ত হয়ে বললাম, অচ্ছা, বোল দিয়ে, জয়শ্রীরাম। হো গয়া? ছেলেটি টেনে ভিড়ের বাইরে একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসিয়ে দিল আমাকে। আরেকজন সাইকেলটা ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে নিয়ে এল; চাকাদুটো পুরো বেঁকে গিয়েছিল।

কিছুক্ষণ সেখানে বসার পর ওরাই একটা রিক্সা করে দিল। আমি বসার পর সাইকেলটা তুলে দিল। ঠিক মনে নেই ওদের কেউ আমার সঙ্গে বাড়ি অব্দি এসেছিল কিনা। বোধহয় জিজ্ঞেস করেছিল আমি ফিরতে পারব কিনা। আমি বেশ স্মার্টলি বলার চেষ্টা করেছিলাম, পারব। অনেকদিন পর ওই ছেলেটি, তখন উকিল, দেখা হওয়াতে বলল, আপনি বেশ কিছুদিন একদম ট্রমাতে ছিলেন। আমি অস্বীকার করলাম। তবে পরে মনে হল ট্রমা থাকতেও পারে। কেননা ওরা হঠাত এসে পড়বে ভাবি নি। আমি তো মানসিক ভাবে রাস্তায়-অচৈতন্য-হয়ে-পড়ে-থাকা গোছের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আর, ঋত্বিক ঘটক দেখা থাকলেও, নিজের জ্যেঠিমা ও জেঠতুতো ভাইবোনদের সাতচল্লিশে সীমান্ত পার হওয়ার কাহিনী শুনে থাকলেও আমার মাথায় সবচেয়ে জীবন্ত ছিল কিছুদিন আগে পড়া চমন নহালের আজাদি। সেই আমাকেও জয়শ্রীরাম বলে, মানে হামলাকারী ধর্মের বশ্যতা স্বীকার করে বাঁচতে হল। এটাই ট্রমার প্রধান কারণ হয়ে থাকবে।

তবে খুব বেশি ট্রমায় ছিলাম মনে হয় না। কেননা পরের পরের দিন, অর্থাৎ ২৪শে অক্টোবর, ১৯৯০, সকাল সাড়ে দশটায় (বোধহয় গায়ে ব্যাথার জন্য অফিস যাই নি), ডাইরিতে লেখা দেখছি, পরশু রাতে আদবানির রামরথএর চাকার স্বাদ চেখে দেখলাম একটু। নতুন সাইকেলটা একেবারে গেছে। চাকা-টাকা খুলে টিউনিং করাতে হবে। জামার সবকটা বোতাম ছিঁড়েছে। আর পিঠে মাথায় ঘুঁষি। আর অকথ্য গালাগাল। একশোজনের মাঝে টানাহ্যাঁচড়া বল্‌ শালা জয়শ্রীরাম। এর বেশি স্বাদ পেতে চাওয়া বোকামি হত তাই বলে দিলাম শেষ অব্দি। পরিস্থিতি থমথম করছে আদবানির গ্রেপ্তারের পরে। মিডিয়া আর খবরের কাগজের ন্যক্কারজনক ভূমিকা এখনও চলছে। ব্যাপারটা সহজে থামবে না।

এবং তারপরেই একটা দাগ টেনে আমি নিজের প্রিয় বিষয়ে ফিরে যাচ্ছি, দর্শনের যে দুটো ধারা ভাববাদ এবং বস্তুবাদ মানুষের বহির্জগতের সঙ্গে interactionএ এই দুটো ধারার আবশ্যক উৎপত্তি ও বিকাশের বাস্তবিক ভিত্তিটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম কাল থেকে ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ, ট্রমা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। এবং ৩১শে অক্টোবর থেকে লেখা শুরু করেছিলাম শিশুরা স্কুল থেকে ফেরার পথে বড় হয় কবিতাটা। যদিও পুরো ভাবনাটা আসতে অনেক দিন লেগে থাকবে। তবে,
অন্যায় মিছিল করে পথে।
মূঢ়তা আগুন জ্বালে যৌবনের শিরায়।
বিচ্যুতি জাগিয়ে তোলে বিবেকের মোচড়।
মিথ্যা ঝরায় অশ্রু, সমবেদনার।
অমানবিকতা
নিজের শহীদদের রক্তে মাটি ভেজায়।
ক্রূর ভাঁড় হতে চাওয়া
হয় একটা জঙ্গী আন্দোলন।
এই পংক্তিগুলোর প্রাথমিক ভাঙাগড়া তখনই শুরু করেছিলাম প্রতিদিন।        

এখন মনে হয়, ভালোই হয়েছিল। অনেক আগে থেকে আমি প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম যে (তখনকার ভাষায় বলছি) সাম্রাজ্যবাদী পূঁজির শাসন এক ভিন্ন চেহারার দিকে এগোচ্ছে।

অবশ্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল আগের দুটো ঘটনা। প্রথম, ১৯৮৯এর ১লা জানুয়ারি দিল্লিতে সফদরের ওপর আক্রমণ এবং পরের দিন হাসপাতালে তার মৃত্যু। যদিও সফদরকে আমি চিনতাম না। তাঁর জন নাট্য মঞ্চএর সক্রিয়তা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলাম না। বস্তুতঃ তাঁর মৃত্যুর খবরটাই আমাদের মনে তাঁর জন্মমুহূর্ত ছিল। তখন থেকে আজ অব্দি তিনি আমাদের সমবেত চেতনায় ক্রমাগত বড় হয়ে চলেছেন। বরং পরে মনে পড়েছিল যে ১৯৮১ বা ৮২তে ন্যাশনাল ক্যাম্পেন কমিটির মিছিলে যখন দিল্লী গিয়েছিলাম, সমাবেশে একটি নাটক পেশ করা হয়েছিল, মেশিন। খুব ভালো লেগেছিল নাটকটার উপস্থাপনা। ও, তাহলে ওরাই জন নাট্য মঞ্চ! ওতে সফদর ছিল! এই ছিল মনের ভাব।

মারা যাওয়ার খবরটা পেয়েছিলাম ৪ঠা জানুয়ারি আর ডাইরিতে লিখেছিলাম, কমরেড সফদর হাশমির নিহত হওয়ার খবরটায় বিচলিত বোধ করলাম যত না,তার থেকে বেশি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মনে হল যদি এরকম নাটক লিখে ও করে আমিও আঘাত করতে পারতাম এভাবে শত্রুর দুর্বল স্থানে? আর পুরস্কার জুটতো এমন একটা মৃত্যু? ভালো লেখার ইচ্ছেটা subjective হওয়ার দরুন একটা জায়গায় গিয়ে কিরকম fatalist করে দিচ্ছে আর কুৎসিতভাবে সামাজিক উত্তরদায়িত্বহীন! কমরেড সফদর হাশমিকে লাল সেলাম জানাই! তবে ডাইরিতে না লিখলেও মনে আছে, সফদরের হত্যাকে কেন্দ্র করেই বিহারে আমাদের জনবাদী সাংস্কৃতিক মোর্চা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। কমরেড রাজেন্দ্র মন্ডল তখন বোধহয় কাটিহারে চলে গেছেন। মোর্চার নেতা বিদ্যাভূষণ দ্বিবেদী। ১২ই এপ্রিল থেকে ১৯শে এপ্রিল অব্দি এক সপ্তাহ সফদরের জন্মদিন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

ভালো অনুষ্ঠান হয়েছিল। মিছিলের ব্যানার ছিল বড়, সফদরের ছবি নিয়ে, ঢোল, ডফলি, গান ইত্যাদি চলেছিল লাগাতার। যদ্দূর মনে পড়ছে মালা হাশমিকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তিনি এসেছিলেন। শেষ দিনের সেমিনারটা হয়েছিল পাটনা কলেজের সেমিনার হলে। মোদ্দা কথা, আমিও সে সময় থেকে জনবাদী সাংস্কৃতিক মোর্চার কাজে ভালো করে জড়িয়ে পড়লাম, আর যেহেতু নাটকে আমার বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না, আমার ভূমিকাটা ওরা স্থির করে দিল, ভাবধারাগত। অর্থাৎ, মাঝে মধ্যে ঘরোয়াভাবেই আলোচনাচক্র ইত্যাদির আয়োজন হবে এবং তাতে আমাকে সোভিয়েত-বিপর্যয় ও বিশ্বব্যাঙ্ক-আইএমএফ-ডব্লিউটিও প্রযোজিত নতুন বিশ্ব অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বলতে হবে। কাজেই, রামরথএর সারথিদের হাতে মার খাওয়ার বর্ণনা করার সময় যে বললাম প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ আগেই পেয়েছিলাম, তার প্রথম সুযোগ হল এই।

ততদিনে গান্ধী ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোনায় কমরেড রামদেব বর্মার সরকারি আবাসে মোর্চা একটা বড় ঘর (ইংরেজ আমলের বাংলো) পেয়ে গেছে এবং সেখানে নিয়মিত আসাযাওয়া বেড়েছে। সফদরের মা-ও তো সেখানেই এসেছিলেন, ১৯৯২ সালের ২৯শে মে! একটি মোড়ায় বসে বলেছিলেন নিজের শহীদ সন্তানের কথা, সংগ্রামের কথা! প্রস্তুত হওয়ার দ্বিতীয় সুযোগটা করে দিয়েছিল তার ছয় মাস পর ভি.পি.সিং সরকারের মন্ডল কমিশনের সুপারিশ বলবৎ করার ঘোষণা আর তার বিরুদ্ধে তথাকথিত উঁচুজাতের ছাত্রযুবদের তীব্র আন্দোলন, এমনকি আত্মাহুতিও বোধহয়। কেননা ২০শে অক্টোবরের ডাইরিতে লিখছি, সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলনে যুবকেরা আত্মাহুতি দিল। কেই কেউ বলছে এ হতে পারে না, ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই। আগুন লাগানো হয়েছে ওদের গায়ে। তারা এটা বুঝছে না, চল্লিশ বছর ধরে আগুন লাগানো হয়েছে ওদের মাথায়, আগুন লাগানো হয়েছে ভারতবাসীর মাথায়, ধর্মের নামে, জাতের নামে, ভারতবর্ষ যা নয়, যা কখনো হতে পারে না সে সমস্তকিছুর নামে। আত্মাহুতি অর্থহীন! আর আত্ম? সেটা কি অর্থপূর্ণ ছিল? কী অর্থ জেনেছিল সে নিজের জীবনের, আশৈশব?

মাতৃভাষার টান বনাম ইউনিয়নবাজি 

আগের পর্বে (শিঙাফুলে বিকেল) বলেছি যে এক এক করে বন্ধুদের চলে যাওয়ায় একসঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করার আমার পুরোনো মজলিশগুলো উবে গিয়েছিল। সেই চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল নিজের ভাষার আমেজ। আলোকজি, নীলুদি বা শিউবচ্চনজি, ধনঞ্জয়জি সঙ্গে থাকলে আমরা হিন্দিতে কথা বলতাম ঠিকই কিন্তু একটা আমেজ থাকতো বাংলার। রবীনদা তো আগেই আলাদা হয়ে কবে যেন চলে গেলেন। দীপন চলে যাওয়ায় মজলিশের সঙ্গে সঙ্গে সেই আমেজটাও উবে গেল। ট্রেড ইউনিয়ন আর রাজনীতির সঙ্গে কিছু কিছু সাহিত্যেরও কথা হত অনুপমের সঙ্গে। সেও চলে গেল। আগেই ইউনিয়ন, পার্টি আর বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আলোকজি আর দীপন আমাকেই দুষতো যে আমার জন্যই একসঙ্গে সাহিত্যচর্চা আর লেখাপড়া করার কাজটা হয়ে উঠতে পারছে না। এখন আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নতুন নতুন কিছু দায়িত্ব নিয়ে।

আরেকটা মনোগত ব্যাপারও ছিল। ব্যাঙ্কের কাজে গাফিলতির যে ব্যাপারটা সিবিআই মামলা অব্দি গড়িয়েছিল, সেটাও একটা বিপরীত চাপের সৃষ্টি করছিল। যদিও ইউনিয়নে বা অন্যান্য সংগঠনে এটুকু পরিচিতি ছিল যে আমি চুরি করেছি এমন কথা কেউ বিশ্বাস করে নি, তার বাইরের বলয়ে কেউ যে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমায় দেখছিল না, তা কী করে বলতে পারি। আর সিবিআই কেস মানেই তার নিজের কোর্টে সিবিআই জজ কনভিকশন দেবে, সেটা সবাই জানতো। কেননা কনভিকশন রেট বাড়া মানে আই.ও. এবং অন্য কয়েকজনের প্রমোশন। অন্যদিকে ছেলেমেয়ে হয়তো কিছুটা বড় হবে ততদিনে, তাদের চোখের সামনে বাবা জেলে যাবে? ঠিক আছে, যদি তাই যাওয়ার হয়, সবাই যেন দেখে যে একজন ভয়ে ঘরে সেঁধানো মানুষ নয়, সাংগঠনিক কাজকর্মে সবচেয়ে ব্যস্ত, অপরিহার্য মনে হওয়া মানুষটা যাচ্ছে জেলে। তাই একটা ঘোরের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সাংগঠনিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছিলাম।

১৯শে জুলাই ১৯৯২, রাত সাড়ে এগারোটায় ডাইরিতে লিখছি, আলোকজির সাথে কথা হল আজ অনেকক্ষণ। নীলুদিও ছিলেন। সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে দায়িত্ব আমাদের (আমার আর আলোকজির) একসাথে কাজ করার সম্ভাবনার ওপরে বর্ত্তায়, তা পুরো করতে আমরা পারব কি? আমিও in fact কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না, এই মুহূর্তে দৈনন্দিন ব্যস্ততা (যা অনেকাংশে অবশ্যই নিরর্থক ও stereotype) থেকে নিজেকে abruptly মুক্ত করার। তবে তার থেকেও বড় সঙ্কট যে আমি কাজটাকেও পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি না। আর আমারও মত, যে এটা একসঙ্গে বসে পড়াশোনা করার, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার আমাদের পুরোনও cultureটাকে revive করতে পারলেই হবে। কিন্তু কীভাবে হবে সেটা?

এখন নিজের ডাইরি দেখে এটাও বুঝতে পারছি যে মুখে লেখাপড়া করতে পারছি না বললেও আমার ভিতরে বোধহয় সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হয়ে পড়েছিল বাংলায় সাহিত্যচর্চা করার পরিসরের অভাব। রবীনদা, দীপন, অনুপমের চলে যাওয়ায় এ জায়গাটায় একদম একা হয়ে পড়েছিলাম। আর এখন কিছুটা ইতিহাস জানি বলে এটাও বুঝতে পারি যে নব্বইয়ের দশকে বিহার বাঙালি সমিতির নেতৃত্বে গুরুচরণ সামন্ত এসেছিলেন বলে সমিতি বিভিন্ন কাজেকর্মে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এমনকি নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনেরও পাটনা শাখার (সেসময় বোধহয় তরুণ মুখার্জি সম্পাদক ছিলেন) সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তাই ১৯৯২ সালের জুলাইয়ের পর থেকে ডাইরিতে মাঝে মধ্যে উল্লেখ পাচ্ছি, আজ পূর্ণেন্দুদা খবর দিলেন, অমুক জায়গায় কবি সম্মেলন, অমুক জায়গায় গল্প পাঠের আসর আর আমি ভাবছি (উল্লেখ আছে) যাওয়া উচিৎ। আগে হয়তো যেতাম না। বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের খবর দিয়ে ছিলেন পূর্ণেন্দুদা, একটাতেও যাই নি।

অর্থাৎ ধীরে ধীরে, মাতৃভাষার আকর্ষণে আমি বাঙালি সমিতি, একাডেমি, এবং বহু বছর পর আবার করে বাংলায় সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশন এসব দিকে এগোবার তোড়জোড় করছিলাম। শ্রীকৃষ্ণনগর ছাড়ার পর বাসস্থানও যেহেতু ভিখনাপাহাড়ি, রমনা রোড হয়ে বি.এম.দাস রোডে পৌঁছেছিল, এবং তারপরেও সৈদপুর প্রফেসর্স কোয়ার্টার্সে যাবো, তাই এদিককার পাড়ার পরিচিত বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রেমিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছিল পূর্ণেন্দুদা ছাড়াও, বিশেষকরে নাদুদা (বিশ্বজিত সেন), রাণা (রাণা ব্যানার্জি) ও কুমারের (কুমার রাণা) সঙ্গে। পত্রিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়ে চর্চা শুরু হল। পূর্ণেন্দুদা পাটনা আসার পর একটি পত্রিকা বার করেছিলেন, সময়, তাতে আমি ছিলাম না। জীবনময় দত্ত তো সপ্তদ্বীপা কবেই বন্ধ করে দিয়েছেন। বিহার বাঙালি সমিতির সঞ্চিতা সংবাদ-বুলেটিন হিসেবে বেরুতো। আমি নিজের তাগিদে রাজ্য ফেডারেশনের হিন্দি পত্রিকা ক্রান্তিদূত রাঁচি থেকে বেরুনো বন্ধ হওয়ার পর পাটনায়েউ  আনিয়েছিলাম। এক সংখ্যা ক্রান্তিদূত নামেই আর দুই সংখ্যা আন্দোলন নামে বার করে করেছিলাম অরুণের সহযোগিতায়। তার আগে, অরুণের সঙ্গে হিন্দিতে রোজনামচা সাহিত্য বুলেটিন বার করেছিলাম একবার।

মাঝে মধ্যে দীপন বা অনুপম পাটনায় আসত, দু-চার দিনের জন্য। তৃষ্ণার্তের মত আড্ডা দিতাম। দীপনের পাঠানো চিঠিগুলো আমার কাছে ফাইল করা আছে। অবশ্য শুধু দীপন কেন, সবার চিঠিই যতটা বাঁচাতে পেরেছি, নিজের কাছে রেখেছি। নব্বইয়ের দশকই তো চিঠিলেখার শেষ দশক। তারপর পেজার, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি এসে চিঠির জগত শেষ করে দিল। সেই সাহিত্যধর্মী অথচ ব্যক্তিগত ভাববিনিময়ের নিজত্ববিশিষ্ট কথাগুলো আর লেখা হয় বলে জানি না। অন্ততঃ আমি আর দীপন বা অন্যান্য সাহিত্যবন্ধু, বা একান্ত আপন সাহিত্যবোধ-সম্পন্ন কেউ আর সে ধরণের কথা হোয়াটস্যাপে কিম্বা ইমেলে লিখি না। সে এক অদ্ভুত ভালোবাসাময় অপরিমিতি ছিল। পোস্টকার্ডে বা ইনল্যান্ডে আঁটতো না। লেখার জায়গা পুরো ভরে যাওয়ার পর, তার বাঁদিক, ডানদিক, ওপর, নিচ পিঁপড়ের মত বেয়ে বেয়ে নেমে, শেষে পৌঁছোতো ঠিকানা লেখার জায়গাটার ওপরে, আমরা ভালো আছি, কুশল সংবাদ জানিও, ইতি, তারপর ডাকঘরের সিলমোহরে ঢাকা। জানিনা আমার চিঠিগুলো দীপন রেখেছে কিনা। এসবেরই মধ্যে এল বিরানব্বইয়ের নভেম্বর-ডিসেম্বর। এভাবে লিখছি কেননা ঘটনাগুলোকে এভাবেই আমি দেখি।

বিরানব্বইয়ের ২৫শে নভেম্বর দিল্লিতে শ্রমিকদের সংসদমার্চ ও সমাবেশ ছিল। আমি তো বিরাশির সমাবেশের পর আবার কোনো ইউনিয়নগত কর্মসূচিতে দিল্লী এসেছিলাম। নরসিংহরাওয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার নতুন অর্থনীতি ঘোষণা করার পর এটা শ্রমিকদের প্রথম সর্বভারতীয় মিছিল ও সমাবেশ। তার একত্রিশ বছর পর আজ তাৎক্ষণিক উন্মাদনা কেটে গেছে, কিন্তু সংখ্যায় এদেশের ঐতিহাসিক শ্রমিক জমায়েতের একটি ছিল সেই জমায়েত। লালকেল্লা থেকে বোটক্লাব অব্দি মিছিল যাওয়ার পর সমাবেশে ভাষণ শুরু হয়। একটাই কুৎসিত ঘটনা ঘটেছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং মঞ্চে ওঠা মাত্রই একটা বিরুদ্ধ গুঞ্জন শুরু হয়। তিনি বক্তৃতা দিতে মাইকের সামনে দাঁড়াতেই শুরু হয় বিরুদ্ধ স্লোগানবাজি। কারণ একটাই। মন্ডল কমিশনের সুপারিশ বলবত করে অনগ্রসর শ্রেণীদের জন্য আসনসংরক্ষণ। আমি দেখছিলাম চেহারাগুলো। সবচেয়ে মুখর ছিল দিল্লী, গাজিয়াবাদ, মেরঠের স্থানীয় উঁচুজাতের মানুষেরা। তাদের অধিকাংশ আদৌ শ্রমিক মনে হচ্ছিল না, রাজনৈতিক কর্মী ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেসের। যেহেতু সমাবেশের অধিকাংশ মানুষ বাইরে থেকে এসেছে এবং তারা প্যান্ডেমোনিয়াম চাইছিল না তাই শান্ত বসে ছিল। নইলে একবার তাড়া করে ওদের ভাগাতে বেশি সময় লাগতো না।

তবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীও বুঝছিলেন তিনি বেশিক্ষণ থাকলে এরা গোলযোগটা আরো বাড়িয়ে তুলবে। তখন পুলিস সভা বন্ধ করতে বলবে। তাই সৌজন্যের খাতিরে এক লাইনে সমাবেশের সফলতা কামনা করে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। এই সমাবেশের এগারো দিনের মাথায় ভাঙল বাবরি মসজিদ। এটা ঠিক যে ভাঙার কাজটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। সেটা সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করেছিল পরে লিবেরহান কমিশন, তবে টিভি, রেডিও, খবরকাগজ পড়েও বোঝা যাচ্ছিল যে ভাঙার এক একটা গাঁইতি, শাবল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচির অঙ্গ ছিল। এটাও ভূল বলা হবে যে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার পর হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। গম্বুজের ওপর প্রতিমুহূর্তে ক্ষ্যাপানিটা বজায় রাখার, নিজে গাঁইতি চালিয়ে ভাঙার কাজ এগিয়ে নিয়ে চলার, ঠান্ডামাথা কর্মীরাও ছিল। বরং নেতাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সাধ্বীটি যে লাফিয়ে কোলে নাকি পিঠে চড়ে গেলেন সেটা স্ক্রিপ্টের বাইরে ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসন মূক দর্শক হবে সে তো জানা কথাই। কিন্তু ভাঙার ঘটনাটাকে সফল করার জন্য একটা রাইট-উইং কন্সেন্সাস, যাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসন থেকে দেশের একচেটিয়া পূঁজিপতি, সাম্রাজ্যবাদী পূঁজির প্রতিনিধি সুদ্ধু সবাই, খুব বেশি হলে মিষ্টি মিষ্টি দুঃখ আর অসহায়তার কাঁধ উল্টে শামিল, এটা ২৫শে নভেম্বরের শ্রমিক সমাবেশের প্রতিক্রিয়া ছিল।

আমি ছয় তারিখে রাঁচিতে ছিলাম। সাত তারিখে সারাদিন বন্ধের জন্য খড়গপুরে ট্রেনে রইলাম। আট তারিখে ট্রেন চড়েও বালিতে নামতে বাধ্য হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম উত্তরপাড়ায়, দীপনের বাড়িতে। দীপন তখন বিবাহিত। সে বছরই জুনমাসে বিয়ে হয়েছে। তবে রীনা বোধহয় সে সময় নিজের অফিসের ক্লোজারের বিরুদ্ধে ধর্নায় বা কে জানে, মনে নেই। অনুপমও তো তখন উত্তরপাড়ায়! দেখা করেছিলাম কি? মনে নেই। পরের দিন সকালে ডিলাক্স ধরে রাতে পৌঁছোলাম পাটনায়। কার্ফ্যু। তার মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি। বিএমদাস রোড। তালাবন্ধ। বাড়িওয়ালার ঘরে এক কাপ চা খেয়ে আবার স্টেশন। সেখান থেকে অটো ধরে বোরিং রোড। আগে মা-বাবা বোনেদের দেখলাম। তারপর আবার বেরিয়ে বড়শালার ফ্ল্যাটে; ওখানেই সবাই ছিল। ওদিকে পূর্ব পরিকল্পনা মতই অনেক জায়গায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। পরের বছর ৭ই ফেব্রুয়ারি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ছিলাম, নিজেদের ব্যাঙ্কের সম্মেলনে। কমরেড বরেন বসু বললেন আমার মুখের কথাটা। ঠিক যেমন ১০৪৫-৪৬এর ব্যাপক গণআন্দোলনে (মুখ্যতঃ আইএনএ বন্দীদের মুক্তির দাবিতে) পরিলক্ষিত একতা ভাঙতে এল ৪৬এর আগস্টের ভয়াবহ দাঙ্গা, তেমনই ২৫শে নভেম্বরের দিল্লী সমাবেশে পরিলক্ষিত শ্রমিক একতা ভাঙতে ভাঙা হল বাবরি মসজিদ । অবশ্যই এটা প্রধান সত্য নয়। আজ আরো স্পষ্ট ফ্যাসিবাদী কর্মসূচি। কিন্তু ওই যে বললাম, রাইট-উইং কন্সেন্সাস, যার জন্য আজ  কর্পোরেট-কম্যুনাল নেক্সাস কথাটা চালু হয়েছে, তার পূর্বলক্ষণ হিসেবেই ছিল বাবরি ধ্বংস। আগে একতার গম্বুজ ভাঙো, তারপর সংসদের গম্বুজ ভাঙো আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। 

যেমন আগে বলেছি, বাড়ির প্রায় পুরো ভারটা কাজলের ওপর ছেড়ে দিয়ে ইউনয়ন, পার্টি ইত্যাদির সাংগঠনিক কাজকর্ম, বিশেষকরে বিভিন্ন জায়গায় সফর ও ব্যক্তিগত লেখালেখিতে মত্ত ছিলাম। কমবেশি লেখাপড়াও করা আর মাঝেমধ্যে পুরোনো দিনের দুটি মাত্র বন্ধু আলোকজি আর নীলুদির সঙ্গে দেখা করে আসাও রুটিনের মধ্যে ছিল। নতুন রুটিন ছিল, সিবিআই কোর্টে মামলা খোলার পর মাঝেমধ্যে কোর্টে হাজিরা দেওয়া। এসবেরই মধ্যে এসে প্রবেশ করছিল ভাষা ও সাহিত্যের নতুন উষ্ণতা। দুতিনটে কবিসভা, গল্পপাঠসভা ইত্যাদিতে অংশ নেওয়ার পর ব্যাপারটা দানা বাঁধতে শুরু করল। ২৮শে মার্চ ৯৩ রাত এগারোটায় ডাইরিতে লিখছি, আজ বিশ্বজিত সেনের ঘরে কবিতার বা বলা যায় সাহিত্যের আড্ডা বসেছিল। A good beginning। যদি continue করে তাহলে নিশ্চয়ই এ থেকে ভালো কিছু বেরুবে। পূর্ণেন্দুদা, বিশ্বজিত সেন, রাণা, কুমার আর আমি ছিলাম। আর কয়েকদিন পর ১১ই এপ্রিল, রাতে লিখছি, “… লঙ্গরটুলিতে রাণা সুহৃদপরিষদের অফিসে নিয়ে গিয়ে বীজপত্র কবিতা ফোল্ডারের ব্যানার দেখালো। নীল কাপড়ে সাদা থার্মোকল দিয়ে তৈরি করা। খুব সুন্দর হয়েছে। বলল বীজপত্র ১৪ তারিখের মধ্যে বেরিয়ে যাবে।

ডাইরিতে কয়েক পৃষ্ঠা ওল্টাতেই চোখে পড়ল একটি পৃষ্ঠা, ৪ঠা জুন, রাত নটা। বুঝতে পারা যায় ইউনিয়নের সফরগুলো কীভাবে সমৃদ্ধ করছিল আমাকে। দুদিন নওগছিয়া, সুলতানপুর (বারসোই), মেহদিপুর, থানাবিহপুর এবং, অবশেষে পূর্ণিয়া ব্রাঞ্চ ভিজিট করে ফিরছি। পুর্ণিয়া থেকে কাটিহার বাস এত দেরিতে পৌঁছোলো যে আমি টিকিট কেটে চড়তে পারলেও অরুণ কুমার শর্মা পারলো না। ও পরের কোনো ট্রেন ধরে বরৌনি হয়ে সিওয়ান ফিরবে। দুঃসহ গরমে ঘুরছি দুদিন ধরে। গায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। এখন ট্রেনে বসে কালো মেঘের ঘেরাটোপ আর ঝোড়ো ঠাণ্ডা হাওয়া উপভোগ করছি। খাবার খাওয়ার সময় পাইনি। দেখা যাক রাতে কোনো স্টেশনে [যদি] কিছু পাই। একটু আগে দ্বিতীয়বার কুরসেলার কাছে কোশি আর গঙ্গার সঙ্গম দেখলাম। কাল রাত্রে জ্যোৎস্নায় বারসোইয়ের পথে শিরীষ, বাবলার ছায়ায় আর দুপাশে পাট আর ধানক্ষেতের হাওয়া খেতে খেতে ঘুরেছি। তারপর রাত বারোটায় কাটিহার শহরে ঘুরেছি। এবারের ট্যুরটা বেশ প্রাণবন্ত হল। মেহেদিপুরে ভোরবেলায় ঢুকতে ঢুকতে দুটো অদ্ভুত জিনিষ দেখলাম। এক, রক্তাভ ফলে ভরা লিচু গাছ আর নিচে, লিচু জমা করে বাজারে পাঠানোর কাজ। আর দুই, ঢোলের আওয়াজে গ্রামের পাঁচশো লোকের, পুকুর কাটতে শ্রমদান। তা দেখার জন্য কিনারে আরো দুশো ছেলে-মেয়ে-বৌদের ভিড়। মাঝে মাঝে মাইকে আহ্বান।

 

চা আর চানাচুর

 

৮ই জুন ১৯৯৩ আমরা বাড়ি বদলে গেলাম সৈদপুর প্রফেসর্স কোয়ার্টার্স। কোয়ার্টার্স বললেও আসলে খুব পুরোনো ধাঁচের ব্যাচেলর্স ফ্ল্যাট। এই লেখায় এ ঘটনাটার একটাই প্রাসঙ্গিকতা। পূর্ণেন্দুদা আমার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী হয়ে গেলেন। রাস্তায় বেরিয়েই বাজার সমিতির দিকে ওনার ফ্ল্যাট। কাজেই সকাল বিকেল হাতের নাগালে একটু বাঙালিপনার সুযোগ বাড়ল। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে হিন্দির অধ্যাপক সুরেন্দ্র স্নিগ্ধ। তাঁর স্ত্রীও বাঙালি, অলোকা ব্যানার্জি। তার সঙ্গেও বাংলাই চালাতাম। ৫ই জুলাই আলোকজি আর ক্রান্তি (ক্রান্তি ভট্ট) বিয়ে করলেন। কোনো ধর্মানুষ্ঠান নয়, হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত প্রায় দুশো অতিথির সামনে, সিপিআই(এম) এর বয়োবৃদ্ধ নেতা কমরেড কৃষ্ণকান্ত সিং শপথবাক্য পাঠ করালেন। মালাবদল হল, মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ করা হল। ব্যক্তিগত, ইউনিয়ন ও পার্টিগত রোজনামচা যদি ছেড়ে দিই, তিরানব্বইয়ে, মাঝে মধ্যে সাহিত্যের আড্ডা, পূর্ণেন্দুদা, বিশ্বজিত সেন, রাণা ও কুমারের সঙ্গে আরো বেশি ঘনিষ্ঠতা, মাঝে মধ্যে কবিতাপাঠের আয়োজন, বীজপত্র ফোল্ডারের অনিয়মিত প্রকাশ ছাড়া আর কিছু বলার মত নেই।

তবে একটি বড় কবিতাপাঠের আয়োজন হয়েছিল এ সময়। ব্যাপারটা আমার স্মৃতিতে নেই। কিন্তু দেড় বছর পর প্রকাশিত বীজপত্রএর, পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা হিসেবে প্রথম সংখ্যাটা আমার কাছে আছে। তার সম্পাদকীয় লিখেছিলেন পূর্ণেন্দুদা। সেটা থেকেই উদ্ধৃত করছি, কেননা সেসময়কার আমাদের সাহিত্যিক সক্রিয়তার ইতিহাসটা সংক্ষেপে রাখা আছেঃ

বছর দুয়েক আগে অতি সাধারণ ঘরোয়া পরিবেশে পাঁচজন সাহিত্যপ্রেমী লেখক সাহিত্যচর্চার জন্য মিলিত হতেন। তাকে সাহিত্যের আড্ডা বলা যেতে পারে। স্বরচিত কবিতা পড়া, প্রবন্ধ বা স্বরচিত গল্প পড়া এই আড্ডার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। সাহিত্যের নানা সমস্যা নিয়ে বিতর্কের ধাক্কায় কখনও কখনও প্রাত্যহিক জীবনের অতি প্রয়োজনীয় সময়জ্ঞানের শৃংখলাকে ভেঙে যেতে দেখা যেতো। আড্ডাকে সাংগঠনিক রূপ দিয়ে শৃংখলাবদ্ধ করার প্রশ্নে তাঁদের অনীহা ছিল সীমাহীন। মাঝে যখন সাম্প্রদায়িকতার ঝড় এসে মূল্যবোধের ভিত্তিগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল, তখন মনে হল কবিশিল্পীরা এই ঝড়ো হাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কী ভাবছেন দেখা যাক। ব্যাস কাজ শুরু হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবি সম্মেলন তারই অনিবার্য ফলশ্রুতি। বীজপত্রের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পাটনার বঙ্গভাষী কবিরা লঙ্গরটুলির বাঙালি আখড়া বা শূরোদ্যানে ভীড় করে এলেন। পাটনার বাঙালি সমাজের স্ব্বনামখ্যাত প্রবীণ মানুষ জগন্নাথ সরকার সভাপতিত্ব করলেন। প্রায় কুড়িজন নবীন-প্রনীণ কবি কাব্যের ভাষায় জানিয়ে দিলেন তাঁদের চৈতন্যে এখনও সাম্প্রদায়িকতার মড়ক লাগেনি। প্রথম পদক্ষেপের এই অভাবনীয় সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে বীজপত্রের সৈনিকেরা তিনটি ফোল্ডার প্রকাশ করলেন। তার একটি প্রকাশিত হল রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে বাঙালি কবিদের প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে। আরেকটি একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে এবং আরো একটি ফোল্ডার প্রকাশিত হল। এই সাফল্য আপাতদৃষ্টিতে যত সাধারণই হোক না কেন বীজপত্রের সৈনিকদের মনে উৎসাহের জোয়ার সৃষ্টিতে অভাবনীয় ভূমিকা পালন করল। ফলে আরো বড় ধরণের সাহিত্য যজ্ঞের আয়োজন করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন তাঁরা। তারই ফলশ্রুতি এই সাহিত্য পত্রিকার আকষ্মিক আবির্ভাব। …”       

ইতিমধ্যে ছুটকোছাটকা করেও নানান বই পড়েছি, ফিল্ম দেখেছি, কিন্তু যে কাজটার দিকে বারবার ইঙ্গিত করেছিল দীপন এবং আলোকজী সমাজবাদের বিপর্যয়ের পর যে অশনিসংকেতগুলো দেখা যাচ্ছে ভারতের আকাশে, সমবেত অধ্যয়নের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করার ভাবনানির্মাণ এবং সাহিত্যরচনায় পথসন্ধান কাজের পরিভাষাটা ক্রমাগত বেশি প্রসারিত আর জটিল হয়ে চলেছিল আর করছিলাম না প্রায় কিছুই, একমাত্র ডাইরিতে মাঝেমধ্যে নিজের মুখোমুখি বসা ছাড়া। কোনো কোনো বই পড়ে দীর্ঘ নোট লিখছিলাম, তবে ইংরেজিতে। এই দ্বিচারিতাটা ছিল। পারিভাষিক শব্দগুলো ইংরেজিতেই জিভে আসতো বেশি। বাংলায় শুধু এক জায়গায় লিখেছিলাম

মুক্তির দৃষ্টি
 দুদশ বছরে হঠাৎ কিছু পাল্টে যাবে না মানুষের মুখ।
লাল জামার নিচে রুদ্রাক্ষের মালা যাদের রাখার তারা রাখবে।
আমরা সত্ত্বায় ভাঙচুর চালাবো সাথী ও সহচরদের
                                         আন্দোলন গড়ে নিরন্তর,
ফসল বোনার ও তোলার মাস বাদ দিয়ে। 

অবশ্য বন্ধুরাও কেউ কিছু করছিল না বা করলেও আমায় ডাকেনি যে শিগগির এস, এ বিষয়টা নিয়ে কিছু কথা আছে। আর আমাদের নতুন সাহিত্য-আড্ডায় তো এসব নিয়ে কোনো কথাবার্তাই হত না। তবে আমার জন্য লাভজনক ছিল যে বাংলা কবিতা ও পত্রপত্রিকা নিয়ে অনেক কথা হত। বছরের শেষে দক্ষিণে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সপরিবারে যেমন লোকে যায় ছুটিতে। তবে কন্যাকুমারী তো কন্যাকুমারীই। তা তুমি যেভাবেই যাও। মনটা চাঙ্গা হল অনেকখানি। চুরানব্বইয়ের শুরুতেই একটা মনে রাখার মত ঘটনা ঘটল। জীবনে প্রথমবার ও এখন অব্দি শেষবার, আমি আর আলোকজি এক মঞ্চে কবিতা পড়লাম। দীপনের সঙ্গে তো আজও পড়িনি।

২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, রাত এগারটা

আজ খুব সহজ ও অনাড়ম্বর ভাবে কয়েকটি নতুন ব্যাপার হয়ে গেল। বিহার বাঙালি সমিতি, পাটনা শাখা ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে আয়োজন করল দ্বিভাষী (বাংলা, হিন্দি) কবি সম্মেলনের। এটা প্রথম। দ্বিতীয়, ওই সম্মেলনের আলোকজি আর আমি একসাথে কবিতা পড়লাম। প্রথমবার। তৃতীয়, নীলুদি এলেন এবং যেভাবে এলেন তা এক মহত্তম কবিতা। হাঁপাতে হাঁপাতে জোর কদমে হেঁটে প্রায় পৌনে সাতটায় এসে পৌঁছোলেন। প্রেরণার মিটিং থেকে আসছিলেন। আলোকজি ও ক্রান্তি তখনই এসেছিলেন। নীলুদি আমাকে বললেন, বাইরে চলো। বাইরে গিয়ে বললেন, চা খাবো। চায়ের দোকান খুঁজে দাঁড়াতে ব্যাগ থেকে বার করলেন চানাচুরের প্যাকেট। বললেন, ভীষণ খিদে পেয়েছিল। দুজনে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা আর চানাচুর খেলাম। এই বয়সে, যৌবনের দেবীর মত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ওনাকে দেখে মন শ্রদ্ধায় ভরে উঠলো।

চুরানব্বই বছরটা আসতে আসতে মোটামুটি একটা ছন্দ গড়ে তুলতে পেরেছিলাম দৈনন্দিনে যাতে লেখালিখির জন্য নিয়মিত একটা স্পেস ছিল। কিন্তু শেষ অব্দি তার কোপটা গিয়ে পড়ত কাজলের ঘাড়ে। সংসারের সব ঝক্কি ওকেই সামলাতে হত। আর সেই স্পেসটাও মাঝেমধ্যেই অধিকার করে নিত ইউনিয়ন আর পার্টির কাজ। তবু সেই স্পেসটা ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। লেখার মেজাজটাও পাল্টাচ্ছিল। নানান প্রশ্নের সামনে নিরুত্তর হয়ে, অনির্দিষ্ট স্টেটমেন্ট-ধর্মিতা আর প্রচ্ছন্ন একটা তির্যক ভঙ্গি জেগে উঠছিল। বিষয় হিসেবে চলে আসছিল প্রত্যক্ষ প্রাত্যহিক, তা সে সর্বভারতীয় সিটু সম্মেলনের স্বেচ্ছাসেবকগিরি হোক, কমপ্যাসনেট এ্যাপয়েন্টমেন্টে ব্যাঙ্কে চাকরিতে ঢোকা বিধবার তিন সন্তানকে নিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া হোক বা আমাদের পত্রিকাবিক্রি ও নানান অনুষ্ঠান হোক। সুহৃদ পরিষদ ও হেমচন্দ্র পাঠাগার'কে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল রাণা এবং অন্যান্য কয়েকজন মিলে। যদিও সংস্থাটা পাটনার মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, শেষ পর্য্যন্ত বাঁচানো যায়নি, তবে একটি মনোজ্ঞ সন্ধ্যার কথা মনে আছে, রাণার ডাকে আমি, নাদুদা দুজনেই গিয়েছিলাম। কম বয়সের ছেলেমেয়েরাও ছিল অনেক। কবিতা আবৃত্তি, গল্পপাঠ, গান এবং সবশেষে খাওয়াদাওয়া। সুহৃদ নামে একটি হাতেলেখা পত্রিকাও বেরিয়েছিল রাণার চেষ্টায়।

পুরো বছরে বেশ কয়েকটি বড় আয়োজনে যথেষ্ট সময় দিতে হয়েছিল। মার্চে সর্বভারতীয় সিআইটিউ সম্মেলন, জুনে আমার ব্যাঙ্কের সংগঠনের সম্মেলন, সেপ্টেম্বরে ব্যাঙ্কের সর্বভারতীয় ফেডারেশনের (বেফি) সম্মেলন, তারপর এক মাস বেফি সম্মেলনের স্মরণিকা সম্পাদন ও প্রকাশনের কাজে রায় প্রিন্টার্সে দৌড়োনো  । এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে ডাইরির পাতায় যখন তখন করা কবিতার মকশো, কাটাকুটি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু এক লাইনও দিনলিপি বলে কিছু লেখা নেই। যখন নাকি নানা রকমের বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল সেসব দিনগুলোয়। সিআইটিউ সম্মেলনে ভূমি-আন্দোলনের ওপর প্রদর্শনী তৈরি করেছিলাম, তার নোটস আছে অন্য নোটবুকে, সম্মেলনের দিন এক বিদেশী মহিলা পৌঁছেছিলেন আর্ট কলেজের কিছু অব্যবস্থার প্রশ্ন নিয়ে, কেউ ওনাকে আমার কাছে যেতে বলেছিল। নিজের সম্মেলনে আমি সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে সভাপতি হলাম, কেননা অন্য ফোরামে কাজ বেড়ে গিয়েছিল, বেফি সম্মেলনের সাজসজ্জা কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম, বিশাল সেই ব্যানার (তখন তো আর ফ্লেক্স নেই, কাপড়ের ওপর থার্মোকল) , ফাইবারের শহীদবেদী, তিনধাপ স্টেজ ইত্যাদি করাতে অনেক সময় গিয়েছিল। এসব কোনো কথাই ডাইরিতে নেই, তবে মনে আছে তাই লিখছি।

এক পোয়া

রায় প্রিন্টার্সে স্মরণিকা ছাপানোর কথা উঠল তো আবার বলতে ইচ্ছে হল যে প্রেসের কাজের মত, মানে ছাপাই সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের মত সুখ হয় না। তখনই মহেশজির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ফেডারেশনের পত্রিকা ক্রান্তিদূত, পরে আন্দোলনএর কাজ রাঁচি থেকে পাটনায় আনা হল, দায়িত্ব ঘাড়ে চাপলো। ঘোষদা রায় প্রিন্টার্সের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। দোতলায় কম্পোজিটর, রোগা-পাতলা মহেশজি বন্ধু হয়ে উঠলেন। অবশ্য বাংলার কাজ নয়, সবই হিন্দি বা ইংরেজির কাজ, আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট পোস্টার-বিলে কাঠের টাইপের কাজ। মহেশজির সঙ্গেই বসে বসে ৮৪তে বড় কাজ করলাম বেফি সম্মেলনের স্মরণিকা। বোধহয় পুরোনো টাইপসেটে শেষ বড় কাজ আমার সেটাই ছিল। অফসেট তত দিনে বাজার ধরতে শুরু করে দিয়েছে। বড় ট্রেডল বসে যাচ্ছে। ফ্ল্যাট মেশিনও বসবে বসবে করছে। তবু চলেছে আরো বেশ কিছু দিন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে। আরে আমাদের মত ছোট কাজকরিয়েদের অফসেট তো পোষাবে না।  

এসময়টাতেই এসে গিয়েছিল আরো দুধরণের ছাপার কাজ। এসে গিয়েছিল মানে আমার রোজনামচায়, কাজদুটো তো আগের থেকেই ছিল। একটা পোস্টার ছাপাই, লিথোগ্রাফ মেশিন। রমনা রোডেই ছিল লেবেল লিথো প্রেস। পোস্টারের প্রথম নকশা করে নিতাম। আর্টিস্ট তো নই, আর সংগঠনে মাল্টিকালারের পয়সাও থাকত না। তাই বিশেষ করে হিন্দির ক্যালিগ্রাফিক টাইপ দেখে দেখে যতটা সম্ভব আলাদা আলাদা আকৃতি এবং আকারে বিষয়টা সাজাতাম যাতে দুটো রঙেও (লাল আর কাগজের সাদা) মোটামুটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর প্রেসকে দিতাম। লিথোর বড় বড় কার্বন বলগুলো খুব টানতো। একটা কালচে ভাব ছেয়ে থাকতো বন্ধ ঘরটাতে। পরে লেবেল লিথো উঠে গেল। তখন গেলাম সব্জিবাগে, আজাদ লিথো প্রেসে। আজাদ লিথোতেই একদিন ঐতিহাসিক ঘোষণা শুনলাম। লিথো উঠে যাচ্ছে। ১৮-২০ অফসেটে ছাপছে। ২২-৩০ এখন কিছুদিন ছাপবে লিথোয়, তবে পয়সা থাকলে ২২-৩০ কেন তার দ্বিগুণ সাইজেরও পোস্টার অফসেটে ছেপে দেবে চেন্নাই, তখন ম্যাড্রাস। ট্রান্সপোর্টে আনিয়ে নাও। ১৯৯৪তে বেফির দুহাজার পোস্টার সেভাবেই ছাপিয়ে আনা হল। তার কিছু পরেই তো এল ফ্লেক্স আর ভিনাইলের বোর্ড। নতুন রোজগারে নতুন ছেলেগুলোও অলক্ষ্যে ট্রেনিং সেরে, মফঃস্বল শহর থেকে ঘামতে ঘামতে কাজের টেবিলে হাজির হয়ে যায়। সেদিন দেখছিলাম কী অসাধারণ কর্মপটু মিডিয়া গ্রাফিক্সের রোগা পাতলা ছোট্ট ছেলেটি। অনওয়র বা কী যেন নাম। রোজ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে। চটপট কী সুন্দর ডিজাইন করে ফ্লেক্সের ব্যানারগুলো। লাল শালু বা সাটিনের ওপর সিল্ভার বা সাদা পেন্ট দিয়ে লেখা ব্যানারের দোকানগুলো সব উঠে গেল। এসে গেল ফ্লেক্সের ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন। কত রঙের বাহার! কিন্তু শালুর লাল আর রইল না। ফ্লেক্স যদি টানা লালও হয়, ছাপাই বলে কিনারে সাদা বর্ডার ছাড়তেই হবে। শালু যেন এখন শুধু লাল পতাকায় থেকে চ্যালেঞ্জ করে, দেখা, কিনারটাও লাল করে, তবে বুঝি!

কত সময় আমি ফালতু বইয়ের প্রুফ দেখায় মিছিমিছি নষ্ট করেছি! ভাবতেও অবাক লাগে। কেন? না প্রেসের মালিক, বা ডাটা সেন্টারের মালিক বন্ধুস্থানীয় মানুষটি হয়তো অনুরোধ করেছিল। কখনো কিছু পয়সাও পেয়েছি হয়তো, কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। চাকরি একটা করছিলামই। এমন কিছু অভাবের সংসার নয়। কিন্তু ওই যে, দেখতে দেখতে, প্রুফ দেখার চিহ্নগুলো মকশো করা! শিখে নেওয়া! সেটাই ছিল যথেষ্ট পুরস্কার। কয়েক বছর পর একবার তো হাজার পৃষ্ঠার বৌদ্ধসাহিত্য-সম্পর্কিত বিরাট গ্রন্থ নিয়ে বসে গেলাম, ঝন্টুর কথায়। তাও আবার ছত্রিশ হাজার না কত বৌদ্ধ দেবদেবী, শুভ-অশুভ শক্তির লড়াই আরো কত সব ব্যাপার! এই নাকি বৌদ্ধদর্শন! তবুও দেখে দিলাম পুরোটা। প্রুফ শুধরে দিলাম। বোধগয়ার কোনো মঠের মোহান্ত ভদ্রলোক নাকি ঝন্টুকে বলেছিলেন গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে এক কপি আমাকেও পাঠিয়ে দেবেন। কুড়ি বছরেও পেলাম না। লাবণী মারা যাওয়ার পর তার থিসিসটা প্রকাশ করা নিয়ে কত আলোচনা করলাম তার মা, মানে রাত্রিদির সঙ্গে। পুরো প্রুফটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সংশোধন করলাম। যাঃ শালা, কবে মাঝখান থেকে অন্য প্রকাশক পান্ডুলিপি কিনে নিয়ে বইটা বার করে দিল, রাত্রিদি খবরটা দিলেন না পর্য্যন্ত। তবুও কখনো মনে হয় নি, সময়ের ক্ষতি হল। প্রুফ দেখার সুখটা রয়ে গেছে। আর রাত্রিদির নিজের বইটাও তো। সেটা অবশ্য আমরাই ছাপলাম। মানে আমার আর পূর্ণেন্দুদার প্রতর্ক সাহিত্য সংসদ। প্রচ্ছদও আমার করা। যদ্দুর আমি চেক করেছি, একটাও মুদ্রণ-প্রমাদ নেই বইটাতে।

আর প্রুফ দেখা তো মাত্র একটা কাজ। তাও বাড়িতে বসে করার। আসল সুখ তো প্রেস পাড়ায় বসে থাকার, মেশিনের ঘটর ঘটর বা গিলোটিনের ঘ্যাঁস শব্দ, কেমিক্যালের গন্ধ, কালি, কাগজের গন্ধ, কথাবার্তা, ঠাট্টা-তামাশা এসবে বুঁদ হয়ে থাকার। মাঝে মধ্যে মনে হয়, তাহলে কি চাকরি না করে একটা প্রেস খুলে বসে ব্যবসা করা উচিৎ ছিল? এক জ্যোতিষি নাকি আমার ছোটো বেলায় তাই বলেছিলেন। 

যারা আছে লাইনে তারা জানে যে লেখার যেমন নেশা, আঁতলামোর যেমন নেশা, ছাপার কাজের নেশাটাও কম নয়। ঠিক পাগলের মত বা উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতে না হলেও নাওয়া-খাওয়া ভুলতে হয়, জামাকাপড়ে তেলকালি মাখতে হয়, একটু ওস্তাদিও মারতে হয় আর সেটাই আনন্দ। সেটাই ঘোর। এবং মালটা যথাযথ ছেপে গেলে রাগমোচন।

এটা ঠিক যে আর কেউ আমার মত এ কাজে বুঁদ হয়ে থাকতে পারত না। গুরুজনদের তো ব্যাপারই আলাদা। গুরুচরণদা, দীপকদা, ভগবানদা, এমনকি পূর্ণেন্দুদাও ছিলেন ধ্রুপদী যুগের প্রুফ রিডার। বা টেক্সট এডিটর। প্রেসের লোক বাড়িতে এসে প্রুফ রেখে দিয়ে যাবে, তাঁরা সময় মত দেখে ফোন করবেন প্রেসের লোককে, সে আবার এসে নিয়ে যাবে। আর আমার নিজের জেনারেশনের বন্ধু কলমবাজেরা, আড্ডায়, সিগরেটে, লেখার টেবিলে, অনুষ্ঠানে সব জায়গায় আছে, প্রেসে যাবার বেলায় কেউ নেই। প্রুফ দেখাও (মানে নিজের লেখা বাদ দিয়ে) তাদের পোষায় না।

আর আমি? লম্বা লম্বা সীসের টাইপগুলো হাতে নিয়ে দেখা, এক শীর্ষে সূক্ষ্ম উঠে আছে অক্ষর বা অক্ষরাংশ, যতিচিহ্ন এক পৃষ্ঠা কম্পোজ হয়ে গেলে গ্যালিটা সুতো দিয়ে শক্ত করে বাঁধার কাজটা দেখা, ট্রেডলে চাপানোর অপেক্ষা করা, গ্যালি প্রুফের নন-ব্লিচড হলদেটে কাগজের রোলটা হাতে ঘষে তার অমসৃণ গাটা বোঝা, তারপর গ্যালি প্রুফগুলো ঝোলায় ভরে যুদ্ধজয়ের হাসি মুখে পাড়ায় ফিরে আসা, হয় নিজের ঘরে বা বন্ধুর মেজানাইন ফ্লোরের চিলতে কুঠরিটায় বসে প্রুফ কারেকশন করা তারপর সেকেন্ড প্রুফ, কখনো থার্ড প্রুফ তারপর ফাইনাল ফর্মা সেট করে ফ্ল্যাট মেশিনে চড়ানো। পৃষ্ঠার কী নিখুঁত হিসেব! কীভাবে বোঝেন ওঁরা! যাতে ভাঁজ করার সময় ঠিক পরের পর পৃষ্ঠা থাকে এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ ! ফর্মার বস্তার সাথে বাঁধাইকরের কাছে পৌঁছোন, ছোট ছোট বাচ্চাছেলেগুলোকে অবাক হয়ে দেখা, কী অভ্যস্ত ছন্দে তারা দুলে দুলে একের পর এক কাগজের তা নিয়ে স্কেল দিয়ে ভাঁজ করে করে ফর্মা সাজিয়ে ফেলছে! সব সাজান হয়ে গেলে বাঁধাই। কত রকমের বাঁধাই ছোটো পত্রিকার জন্য স্টেপল, তাও দুরকম, সেন্টার স্টিচ বা সাইড স্টিচ, মোটা বইয়ের জন্য সেলাই, তারপর আঠা দিয়ে মলাট লাগানো

পরে আমি নিজেও বাড়িতে দুধরণের বাঁধাই নিয়ে প্রয়োগ করেছি। মোটা পকেটবুকের বাঁধাই খুলে গেলে ঝামেলায় না গিয়ে সোজা ব্যাঙ্কের নোট স্টিচিং মেশিন দিয়ে সাইড স্টেপল মেরেছি, আর মোটা আর্টপেপারের এ্যালবামের বাঁধাই খুলে গেলে ওস্তাদ দপ্তরির মত পৃষ্ঠাগুলোকে দুই মিলিমিটার জায়গা ছেড়ে ছেড়ে গুছিয়ে, ক্ল্যাম্প দিয়ে আটকে ফেবিকল লেপেছি। তার পর ক্ল্যাম্প খুলে আবার সমান করে গুছিয়ে ক্ল্যাম্পের চাপে রেখে দিয়েছি এক ঘন্টা। সে বাঁধাই আজও চলছে।

সে যা হোক, বাঁধাইয়ের দোকানে সবচেয়ে দেখার মত হয় ফাইনাল পার্টটা। এক সেট বই যখন ভালো করে গুছিয়ে ফেলা হয় গিলোটিনে ঘচ, পরিষ্কার মসৃণ প্রেসকাট! তখন তো ফরাসি বিপ্লবের গিলোটিনের কোনো ছবিও দেখিনি, বাইন্ডারের গিলোটিনটাই জানতাম।

ম্যানেজার সাহেব, শেষ হয়ে আসছে, আনিয়ে নিন আধ কিলো, আর এক পোয়া এ ধরণের যে বাক্য যে ডায়লগের অংশ হতে পারে, তা প্রেসে বসেই জেনেছিলাম।

আর তারপর সেই এ বা সমস্ত অক্ষরের ডিজাইনের কত রকম দেখলাম। দেখতে দেখতে ফুরিয়েই গেল সীসের অক্ষরগুলো। উঠে গেল ট্রেডল বা ফ্ল্যাট মেশিন। জানি না, পুরোনো পরিচিত কম্পোজিটরেরা তাদের শেষ জীবনের যক্ষ্মা সারানোর সময় কোনো মাইনে পাওয়া কাজে ছিল কি ছিল না বা মালিক তাদের কত খোরপোষ দিয়েছিল ডিজিট্যালে যাওয়ার সময়। আমরা তো সহজে পৌঁছে গেলাম ডিজিট্যালে। কম্পিউটারের সামনে বসে, খোলা পেজমেকারে বা কোরেলে ফাইল দেখতে দেখতে, পৃষ্ঠার লীডের মাপ নিয়ে বচসা করতে করতে আজ পেরোলাম বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশো বছর। ট্যাবে পিডিএফে বই পড়তে পড়তে মনশ্চক্ষে বিদ্যাসাগরকে দেখছি দুপুরে কলকাতা থেকে শ্রীরামপুরের অধর টাইপ ফাউন্ড্রিতে যাচ্ছেন, গিয়ে বলছেন, ক-এ আর কএ মূর্ধণ্যষ খিয়এর আকারে, আকৃতিতে একটা সমতা থাকবে তো! ইংরেজি টাইপ এত সুন্দর তৈরি হয়! বাংলা টাইপফেসগুলো দেখুন তো, কেমন ছন্নছাড়া, ছোট, বড়! লাইন সাজাতে বেশি স্পেস দিতে হয়, বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা বেড়ে যায়, দাম বেড়ে যায়! একটু দেখুন যাতে যুক্তাক্ষরগুলো একটু ভালো করা যায়!

বীজপত্র

অক্টোবরের শেষেই বোধহয় পূর্ণেন্দুদা আমাকে জানিয়েছিলেন যে কলকাতায় কোনো সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। আয়োজকরা তাঁকে ডেকেছিল, কিন্তু তিনি চোখের সমস্যার জন্য যেতে পারবেন না। আমি কি যাবো? একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলাম অবশ্য, যে নিজের অধিকারে আমি যাচ্ছি না, তবে রাজি হয়েছিলাম। তারপর ফোনে কথা হয়েছিল না চিঠি এসেছিল, আমি জবাব দিয়েছিলাম মনে নেই। ৮ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ থেকে চিঠি পেলাম, ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের স্বাক্ষরে যে ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় পৌঁছোতে হবে। ডাইরিতে সোজা ১৫ই ডিসেম্বরের রাতের লেখা দেখে বুঝতে পারছি যে বেফি সম্মেলনের স্মরণিকা তখনও প্রেসে, আমি রোজ দৌড়োচ্ছি লংগরটুলি। আর এটাও বুঝতে পারছি যে ১৬, ১৭ তারিখে বেফির সেন্ট্রাল কমিটি বা জেনেরাল কাউন্সিলেরও মিটিং ছিল কলকাতায়। তার আগে ১২ই ডিসেম্বরের রাতে আমি অন্যান্য ঘটনার উল্লেখের পর লিখছি, কলকাতায় ১৬, ১৭, ১৮ তারিখের কোনো কার্য্যক্রম হাতে আসেনি। তবে যদি বলতে হয় কিছু, কোনো কিছুতে পার্টিসিপেট করতে হয়, কী বলব?   সাংগঠনিক (১) পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ ও জনবাদী লেখক সঙ্ঘ বহির্বঙ্গের বাংলা লেখকদের স্থান এর মাঝে কোথায়? হয় জনবাদী লেখক সঙ্ঘে বাংলার উইং তৈরি হোক, নইলে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিকের পরিচয় ভৌগোলিক না হয়ে ভাষাকেন্দ্রিক হোক। শিল্পসম্পর্কিত (১) সমালোচনার সঙ্কট, (২) বাস্তববাদের অর্থ নিরূপণ, (৩) স্যাক্রিলেজ/ব্ল্যাস্ফেমি বনাম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, (৪) নায়ককে চিহ্নিত করার কাজ। তারপরঃ

১৫ই ডিসেম্বর / রাত দশটা

আজ সকালে কলকাতা পৌঁছে প্রথম টিবরেওয়াল ধর্মশালায় BEFI Souvenir  রাখলাম। Distributionএর কাজ কিছুটা করলাম। বাকিটুকু Com. P. N. Singh কে বুঝিয়ে দিলাম। স্নান সেরে গেলাম অনুপমের অফিস। অনুপম নেই। তারপর দীপনের অফিস। দীপন নেই। মনটা মুষড়ে পড়ল। এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে শেখরের সঙ্গে তিনটে অব্দি কাটালাম। অমিতের সাথেও একটু কথা বলে চলে এলাম ২, কিড স্ট্রিট। ভলান্টিয়ার কাউকে দেখলাম না। কাউন্টারে নিজের নাম, ঠিকানা, উদ্দেশ্য বলাতে গণতান্ত্রিকের রিজার্ভ করে রাখা একটা ঘর দিল, ৪০২। এক পট চা আনিয়ে খেতে খেতে নেরুদার জনগণ কবিতাটা পড়লাম। তারপর নিজের কবিতার ডাইরি খুলে কিছু কলম খোঁচাখুঁচি করলাম [কে জানে, এটা আবার কোন ডাইরি!] তখনই ঘরে ঢুকলেন শ্রী সিরাজুদ্দিন আহমেদ। ত্রিপুরা থেকে। তাঁর সাথে কথা হল ঘন্টাখানেক। কম কথার, ভীষণ অমায়িক মানুষ। কথাচ্ছলে কথা জেনে নিতে পারেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর এলেন সুব্রত চৌধুরি। আমাদের দেখাশোনার ভার যাঁর ওপর। বেলঘরিয়া হাইস্কুলের তরুণ শিক্ষক। ডক্টরেট করেছেন বাংলা নাটকে কৃষক সমাজএর ওপর। আমার ধর্মশালা যাওয়ার ছিল ব্যাগ আনতে। একসাথেই নিচে নামলাম। সুব্রত চৌধুরি আমায় বাসে তুলে দিলেন। সরি! নামার পথে আলাপ সেরেছিলাম আসাম থেকে আসা শ্রী বিজন পাল চৌধুরি ও নতুন সাহিত্য পরিষদের সভাপতি শ্রী তোষেশ্বরের সাথে। তাঁরা সপরিবারে এসেছেন। বাংলাদেশ থেকে শ্রীমতী সেলিনা হোসেন এসে কোথাও বেরিয়েছিলেন। ধর্মশালা থেকে ফিরে (P. N. Singh, B. Prasad ছিলেন না, Arjun Prasadএর সাথে কথা হল) লাউঞ্জে আলাপ হল বাংলাদেশ থেকে আসা শ্রী কামাল লোহানী, শ্রী বশির আল হেলালের সাথে। শ্রীমতী সেলিনা হোসেন বসেছিলেন কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপ হল না। তারপর রাতের খাবার খেতে গেলাম MLA হোস্টেলের canteenএ। খেয়ে ফিরছি, তখন গাড়ি করে ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ঢুকলেন। একটু পরেই ত্রিপুরার গৌতম দাশগুপ্ত এলেন। আলাপচারিতা কালকের জন্য স্থগিত রেখে যে যার ঘরে কিম্বা গৃহ অভিমুখে। এখন একা। কাল সকালে উঠতে হবে।

সম্মেলনে তিন দিন আনন্দে কাটল। দীপন আসত, নীলুদি আসতেন, অনুপম আসত। নীলুদিকে তো বাংলা অনুবাদক হিসেবে আমরা বিহারের প্রতিনিধিও করে নিয়েছিলাম। তবে কলকাতার সাহিত্যমহলে বিশেষ যাওয়া আসা নেই বলে সেভাবে কারোর সঙ্গেই আলাপচারিতায় এগোতে পারলাম না। দীপন, নীলুদি, অনুপমের সঙ্গেই সময় কাটত। তবে পুরো সম্মেলনের নোট নিয়ে ফিরে এলাম।

নাদুদার বাড়িতে বৈঠক হল। নাদুদা, পূর্ণেন্দুদা, রাণা, কুমার, আমি। স্থির হল, বীজপত্র ফোল্ডার তো ভালোই বেরুচ্ছে। ইতিমধ্যে চারটে বেরিয়ে গেছে। এবার ছাপাইয়ে যাওয়া যাক।

বীজপত্রছেপে বেরুলো। প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪০২।

ডাইরিতে কিছু লেখা নেই। মনে হচ্ছে ফিরে এসেই অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রথম সংখ্যার জন্য কলকাতার বাংলা সাহিত্য সম্মেলন নিয়ে দীর্ঘ লেখাও তৈরি করেছিলাম। একটু অদ্ভুত ধরণের। চিরাচরিত রিপোর্টিং না করে নিজের মত করে আলোচনার শীর্ষক সাজালাম; বললাম, সম্মেলন যে সম্ভাবনা ও প্রশ্নগুলোকে রেখাঙ্কিত করল তা দেখা দরকার। ৭ই এপ্রিল তারিখে ছোট্টো এক লাইন আছে ডাইরিতে, আজ শূরোদ্যানে বাসন্তী পুজোর আঙিনায় বীজপত্র বিক্রি করলাম কুমার, নাদুদা আর আমি।

বীজপত্র পত্রিকার ভালো একটা ইংরেজি রিভিউ করলেন ভগবানদা, প্রফেসর ভগবান প্রসাদ মজুমদার। একটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিকে প্রকাশিত হল। ততদিনে প্রেসের লাইনে কম্পিউটার এসে গেছে। বীজপত্র কম্পোজ হতে লাগল ঘোষদার (সুবীর কুমার ঘোষ) এস্‌সেল কম্পিউটার্সে। তিনিই ছাপিয়ে আনার ব্যবস্থা করতেন। চারপাঁচটাই সংখ্যা বেরিয়েছিল, তবে সংখ্যাগুলো ভালো এবং সুন্দর ডিজাইনে ছিল। পূর্ণেন্দুদা, নাদুদা, কুমার, রাণা এবং আমার সম্মিলিত প্রয়াস তো ছিলই সুবীরদাও প্রেসে বসে কম সাহায্য করতেন না।   

প্রযুক্তির যুগবদল

কম্পিউটার সেন্টারের মালিক আমাদের সবার প্রিয় সদাহাস্যমুখ ঘোষদা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে রিটায়ারমেন্টের পর তিনি কম্পিউটার সেন্টার খুলেছিলেন। এসসেল কম্পিউটার্স। যখন ঘোষদা আছেন তখন আর চিন্তা কিসের? এই মনোভাবে আমাদের ইউনিয়নের কাজ নিয়ে আগে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বীজপত্র নিয়ে গেলাম, সমস্যা হল টাইপিস্ট নিয়ে। চটপটে একজন বাংলা টাইপিস্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও পত্রিকার চারটে সংখ্যা তাঁর হাত দিয়ে বেরুলো। তখনই বোধহয় কুমার চলে গেল কলকাতায়, বীজপত্র আর বেরুলো না। তারপর ঈক্ষণ একটা সংখ্যা। সেটাও বোধহয় ঘোষদার হাতে বেরিয়েছিল। কিন্তু বাংলা টাইপিস্ট নিয়ে সমস্যাটা ছিলই। ঝন্টুর সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল গুরুচরণদার বাড়িতে। যখন আমাদের সাহিত্যপ্রয়াসের সমষ্টিগত রূপ বলতে রয়ে গেলাম শুধু পূর্ণেন্দুদা আর আমি, তখন ঝন্টুদের প্রিন্টস কেয়ারকে ধরলাম। প্রতর্ক কোনো রকমে দুটো সংখ্যা বেরুলো। তারপর তাও বন্ধ হয়ে গেল। নীট অভিজ্ঞতা হল এটাই, যে একজনকে থাকতেই হবে যার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হবে পত্রিকা। নইলে যতই বড় হোক সাহিত্যগোষ্ঠি, পত্রিকা বন্ধ হবেই হবে। আর আমাদের মধ্যে কেউ এমন কখনো ছিল না যার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান পত্রিকা। সবাই বড় মাপের মাল্টিফেরিয়াস বুদ্ধিজীবী।     

আরেক ধরণের ছাপাই কাজ, সাইক্লোস্টাইল, তাতেও যুগবদল এল। সাইক্লোস্টাইলের সঙ্গে কিছু মজার গল্প জড়িয়ে আছে। এমার্জেন্সির সময়, একটা স্বঘোষিত গুপ্ত সংগঠনে আছি। সেকেন্ড হ্যান্ড ডুপ্লিকেটিং মেশিনের দরকার। একজনকে পাঠানো হল জেস্টেটনারের অফিসে। সে খবর নিয়ে এল, কে কিনছে, কোথায় ব্যবহার হবে, কী কাজে ব্যবহার হবে সব লিখে দিতে হবে এবং সেসব ভেরিফিকেশনে যাবে। আমরাও আনকোরা। আরেকবার অন্যভাবে ঝালিয়ে দেখতে গেলামই না। নিজের বদভ্যাস মত আমি বললাম, দেখা যাক নিজেরা তৈরি করা যায় কিনা। স্টেনসিল যোগাড় করলাম। ডুপ্লিকেটিংএর কালি যোগাড় করলাম ব্যবহার করা হাফ-টিউব। রুটি বেলার বেলন-চাকি কিনে ব্যাপারটা করতে চেষ্টা করলাম। হল না বলব না। তবে যত কষ্ট করতে হল, যত কালি মাখলাম, যত সময় নষ্ট হল, সেসব দেখে ভাবা গেল যে হাতে কপি করেই চলুক আপাতত। অথচ এমার্জেন্সি শেষ হওয়ার দুএক বছরের মধ্যে এমন ঠেকের খোঁজ পেয়ে গেলাম যেখানে মেশিন, স্টেন্সিল, কালি, মায় প্রয়োজনে টাইপিস্ট পর্য্যন্ত সব ফ্রিলি এভেলেবল। যদিও কাজের ক্ষেত্রটা ছিল ইউনিয়ন, গুপ্ত কিছু না, কিন্তু স্টেনসিলে টাইপ করে এনে চেষ্টা করাই যেতে পারত। জানতামই না ঠেকটার কথা। অবশ্য ইউনিয়নেও স্টেনসিলে টাইপ কখনো নিজে করিনি, খুব খারাপ করতাম। করত শঙ্কর বা অনুপম বা অন্য কেউ। জীবনে একবারই আমার নিজের কাটা স্টেন্সিলে ডুপ্লিকেশন হয়েছে, সে আবার আরেক গল্প। আমার বাংলা টাইপরাইটারের গল্প। অনেক শখ করে কিনেছিলাম। অনুপম কলকাতায় সেলেন্ড হ্যান্ড টাইপরাইটারের খোঁজ নিয়ে যোগাড় করে রেখেছিল। আমি কলকাতায় গিয়ে নিয়ে এলাম। তখন রাজেন্দ্রনগর স্টেশনটা হয় নি। তবে ইয়ার্ড, তাই ট্রেন দাঁড়িয়ে যেত। ওই ভারি বস্তাবন্দি টাইপরাইটার নিয়ে পাথরে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা অব্দি গেছি। সেটা ১৯৯৫ সাল। কুমহরারের ফ্ল্যাটে প্রথম খেপে গিয়ে ছিলাম, দু-আড়াই বছর। দুতিন বছর রেললাইনের এপারে প্রফেসর্স কোয়ার্টারে কাটিয়ে নতুন সহস্রাব্দে আবার গেছি কুমহরারের ফ্ল্যাটে।

যা বলছিলাম, সাইক্লোস্টাইলের কাজও বন্ধ হল যুগবদলে। এসে গেল অন্য ধরণের ছাপাইয়ের সুযোগ জেরক্স। প্রথম জেরক্স। কার্বনের গুঁড়ো, খাড়াই প্লেট, কাগজ শুকনো রাখার জন্য ড্রয়ারের ভিতরে একশো ওয়াটের বাল্ব। সেটাও গেল। এল নতুন জেরক্স। পুরোনো ছেঁড়া ছেঁড়া বই নতুন কপি করতে লাগলাম জেরক্সে। দিল্লী গিয়ে দেখলাম বিদেশি বইয়ের রঙিন জেরক্স কপি দেদার বিকোচ্ছে।

জেরক্সে নিয়মিত ডকুমেন্ট কপি তৈরি করার কাজ, সাইক্লোস্টাইলের বদলে নতুন আসা কম্পিউটারে টাইপ করিয়ে (পরে শিখে নিজেই করে) ওতেই শখানেক কপি করে সার্কুলার তৈরি করার কাজ এসব তো চলছিলই। নতুন জিনিষ করলাম, ডাকবাংলোয় প্রতিলিপি দোকানটায় গিয়ে আমন্ত্রণপত্র তৈরি করলাম নতুন ধরণের। নতুন বলব না, হয়তো আরো অনেকেই করা শুরু করেছিল, পরে তো দেখলাম সেটাই ট্রেন্ড হয়ে গেছে। অর্থাৎ একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজে এক-তৃতীয়াংশে বা আদ্ধেকে (প্রয়োজনানুসারে) একটা ছবি বা ডিজাইন কপি-পেস্ট করে, অনুষ্ঠানের নাম, বিষয়-চুম্বক ও আমন্ত্রণ টাইপ করে সেটাকে ফ্লুরোসেন্ট কালার জেরক্স পেপারে (সবুজ, কমলা, হলুদ ইত্যাদি)  কপি করে নেওয়া। তারপর স্কেল বসিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আলাদা আলাদা করে নেওয়া। তিরিশটা ছাপালে নব্বইটা হয়ে গেল। একটা আলোচনাচক্র বা সভার জন্য যথেষ্ট। সোজাসুজি হাতে দাও বা খাম কিনে নিয়ে খামে ভরে দাও মান্যগণ্য বুঝে।     

আর করলাম হাতে লেখা পত্রিকা বা বুলেটিন ছাপাই। এটা অবশ্য আমার মাথায় আসে নি। একদিন বুদ্ধমূর্তির কাছে রাণা সাইকেল থামালো। পত্রিকা-ফোল্ডার বিক্রি করছে, বাইলিঙ্গুয়াল স্পর্শ। বাঃ, এ তো ভালো আইডিয়া! আগে ওয়ান-বাই-ফোর ডিমাই চার্ট পেপারে হাতে লিখে, সুন্দর অলঙ্করণ করে তারপর পয়সা বেশি থাকলে স্ক্রিণ করো, রঙিন কালিতে হবে, এমবসের মত সুন্দরভাবে উঠে উঠে থাকবে। আর নয়তো জেরক্স করো। আমার হাতের লেখাও ভালো নয়, অলঙ্করণও ভালো নয়। যদিও আগেও স্ক্রিন প্রিন্টে বুলেটিন বার করেছি হিন্দিতে - রোজনামচা। একটাই সংখ্যা বেরিয়েছিল।

কিন্তু বীজপত্রএর কাজটা, আগেই বলেছি, শুরু করল কুমার, কুমার রাণা, তবু একদিন আমার ঘাড়ে পড়ল। নিজের হাতে লিখতে আর অলঙ্করণ করতে গিয়ে বুঝলাম চলবে না। সেই শেষ একটা বেরিয়েছিল হাতে লিখে জেরক্স। তার পর তো যেমন আগে বলেছি, সোজা কম্পিউটারে ছাপাইয়ে চলে গেলাম।

আসলে আমাদের জীবনের পুরোটা সময় সময়েরই সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে ফুরিয়ে গেছে। পয়সাও থাকত না। যদ্দিনে মোটামুটি একটা এসএলআর ক্যামেরা কেনার পয়সা হল, তার কিছু বছরের মধ্যে সে ক্যামেরার নতুন নামকরণ হয়ে গেল এনালগ ক্যামেরা, বাতিল। যদ্দিনে ছেলেকে ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দিলাম, তার কিছু বছরের মধ্যে এসে গেল স্মার্ট ফোন ডিজিট্যালে ডিএসএলআর না হলে বাতিল। যে হ্যাসেলব্লাডের স্বপ্ন দেখতাম আশির দশকে, নতুন সহস্রাব্দে দেখলাম ওএলএক্সে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ কিনছে না। ঠিক তেমনই হল টাইপরাইটারের সঙ্গেও। কেনার কয়েক বছরের মধ্যে এসে গেল ইলেক্ট্রনিক টাইপরাইটার, তারপর ডেস্কটপ, তারপর ল্যাপটপ। এখন তো অনেকে মোবাইলেই উপন্যাস লিখে ফেলছে। আমার টাইপরাইটারও লোহার দরে বিক্রি হয়ে গেছে।

একটা সময় কম্পিউটারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। জানতাম, আটকাতে পারব না। কিছুটা সচেতনতা পারবে, কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারবো কর্মীসংখ্যায় হ্রাস এবং স্তিমিত করতে পারব হ্রাসের গতি, আর একটা বার্গেনিং কাউন্টার পাব কিছু অধিকার আদায় করতে। শেষে যখন হাতের নাগালে এসে গেল মেশিনটা, শিখেও নিলাম বেশ তাড়াতাড়ি। বাড়ির জন্যও একটা কিনলাম, সাইবার কাফেতে গিয়ে ইন্টারনেটে চিঠিপত্র পাঠানো, কাজকর্ম করা শুরু করলাম সম্ভবতঃ, দুহাজার দশ বা এগারো থেকে কলমের পাট চুকিয়ে দিলাম। নিজের ল্যাপটপেই, বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজি লেখার ওয়র্ড ফাইল তৈরি করি। প্রেসের ঠেক বলতে তিনটে। বাংলার জন্য আশীষ, হিন্দির জন্য অজয়, ইংরেজির জন্য নির্মল। এদের মধ্যেও ঝামেলা। আমি তো রানিং ওয়র্ড ফাইল দিয়ে খালাস। তাও বাংলা আর হিন্দির বেলায় ইউনিকোডে। এখন হিন্দি করবে অজয়, পেজমেকারে। সেটা ইউনিকোড খায় না। বদলাতে হয়। বাংলা করবে আশীষ, কোরেলে, সেটাও ইউনিকোড খায় না। কত বলি, নতুন সফটওয়্যার তো বেরিয়ে গেছে কবে, এডোবের, নাও না কেন? খবরের কাগজগুলো তো দিব্যি ব্যবহার করছে! নাঃ এখানে অসুবিধে আছে। এরই মধ্যে চলছি। 

পুরোনো সাহিত্যবলয়ের আদ্ধেক লোক গত, এক-চতুর্থাংশ ব্যাঙ্গালোরে বা পুনায়। এমনকি সেই মাই ডিয়ার ঘোষদাও গত। আমি যদ্দিন আছি। আপাতত কোরোনা পেরিয়ে এসেছি। অভিযান থেকে বীজপত্র অব্দি র‍্যাকে কোথাও না কোথাও রাখা আছে। অনেককিছু নেইও। এখন তো পত্রিকাও বদলে যাচ্ছে ওয়েবজিনে অথবা সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে। কী মজার খেলা এই বদলগুলো। নিজে পিছলে পড়ে হারিয়ে যেতে যেতেও শেষ পর্য্যন্ত হাসিই পায়। বিশেষ করে তাদের দেখে যারা ১৯৯১এ বিশ্বাস করে নি যে বেঁচে থাকার বা দুনিয়া বদলানোর লড়াইটার একটা ভিন্ন, অপরিচিত প্রেক্ষিতে তারা পৌঁছে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।

মাঝে কোভিড যেমন অনলাইন ক্লাস আর ফ্রম হোম কাজ দেখিয়ে দিল, দেখিয়ে দিল অনলাইন মিটিং আর আলোচনাচক্র, সাহিত্যের আড্ডা, সঙ্গীতের আসর জমিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা, তেমনি দেখিয়ে দিল ইমেলের মাধ্যমে প্রুফ চালাচালি। এখন তো পত্রিকাও ওয়েবজিন হয়ে গেল। বইও ছাপা কয়েকটা বেরোয়, বাকি ছড়িয়ে পড়ে পিডিএফ, ইবুক বা কিন্ডলএ। সাত বছর ধরে 'বিহার হেরাল্ড', 'সঞ্চিতা' বা বইপত্রগুলো সেভাবেই চলছে!  দিব্যি এগোচ্ছে ব্যাপারটা। তবুও ওদের দোকানঘরগুলোর গন্ধ, গল্প আর চা এত টানে, চলে যাই। বলি ভুল বেশি ছিল, সামনে বসে কারেকশন করাবো।

এদিকে গৌড়ীয় মঠ বা ওদিকে সেই কন্যা বিদ্যালয়ের মোড়ে চটজলদি পৌঁছোতে এখন দুদিক থেকে দুখানা ফ্লাইওভার। কন্যা বিদ্যালয়ের মোড় লিখতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল আরে, সেই হলুদ বাড়িটাও তো কন্যা বিদ্যালয়ের পিছনে বড় রাস্তায় সরস্বতীসদন যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল। কী আশ্চর্য সমাপতন, না? সমাপতনের শেষ আপতনটা কী হবে? বেঁচে থাকতে থাকতে এমন কোনো নারীর সঙ্গে দেখা, যে ছোটোবেলায় ওই কন্যা বিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছিল? তেমন কিছু কি অপেক্ষা করছে কোথাও?  

মনে পড়ছে চার বছর আগে। নির্মলের দোকানে বসে আছি। দোকান বলতে একটা ডেস্কটপের মনিটর, তাও তার সামনে লোক বসলে পেছনটা থাকবে গ্রাহকের দিকে। ঘরটার সাইজ পাঁচ ফুট বাই নয় ফুট। ডেস্কটপের সিপিইউটা টেবিলের নিচে। টেবিলের ওপর মনিটরের পর প্রিন্টার, তারপর আরেকটা সিপিইউ সেটা নাকি তার ভাই আমেরিকা থেকে নিয়ে এসে দিয়েছে, কিন্তু একটু প্রব্লেম করছে, দেখাতে হবে। আজকাল এরকমই দোকান হয় ডাটা এন্ট্রি বা গ্রাফিক্সের কাজের। অজয়ের দোকানটাও এই একই রকম। আশীষের দোকানটা একটু বড় কেননা নিজেই একটা ডিজিট্যাল প্রিন্টার রেখেছে। তবে সাধারণত ছাপাইটা অন্য দোকানে হয় যারা অফসেট আর মিনি অফসেট আর ডিজিট্যাল প্রিন্টার নিয়ে বসে আছে। এখন নয়াটোলার প্রেসপাড়ায় তাই মেশিনের আওয়াজ অনেক কমে গেছে। নিঃশব্দেই বেশির ভাগ কাজ হয়। কার্বনের গুঁড়োও আর নেই হাওয়ায়। তবে জলজমাটা আছে গলির মুখে। হাফ কাপ চা কাগজের কাপে আরো ছোটো হয়ে গেছে। সন্ধ্যে হতে হতে বরং বড় রাস্তায় হাজার হাজার কোচিংএর ছাত্রছাত্রীদের আওয়াজ বেশি হতে থাকে। একদিন তো দেখলাম একটা পুরো ক্লাস প্রত্যেকে নিজের নিজের চেয়ার মাথায় তুলে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিংএর দিকে ছুটছে! এরকমও হয়? আনারসের ভিতরে মাঝখানের শক্ত ভাগটা ঠেলাওয়ালারাও কোনো কাজে লাগায় না। গরুকে দিলে হয়তো খেয়ে নিত, বা খেত না। সেদিন একটি ছেলেকে দেখলাম ঠেলা থেকে ওই শক্ত ডাঁটিটা তুলে এগিয়ে গেল। কামড়ে চিবোতে থাকল। এত খিদে পেয়েছিল?    

নির্মলের দোকানে আমি একা বসে আছি কেননা, নির্মল ডিজিট্যাল প্রিন্টারে একটা ম্যাটার প্রিন্ট করাতে গেছে নিচে। ম্যাটারটা আমারই। প্যালেস্টাইনের ফ্রিডম থিয়েটার থেকে একটা ডেলিগেশন এসেছে পাটনায়। তাদেরকে মেমেন্টো দিতে হবে। মেমেন্টোটা ডিজাইন করেছি আমি। একটা ডিজিট্যাল পেপারে ছটা প্রিন্ট বেরুবে। প্রিন্টটা নিয়ে আরেকজনকে দিয়ে আমি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে যাব চেন্নাই। সেখানে মিটিং করে দুদিন পর ফিরে সোজা হলে ঢুকব যখন মেমেন্টো দেওয়া হবে সবাইকে এবং একটা ওয়েলকাম ফিল্ম স্ক্রিনিং করা হবে। সেই ফিল্মটাও পাটনা সিটিতে সোনুর ডিজিটাল স্টুডিওতে বসে তৈরি করিয়ে এসেছি।

হাঃ, হাঃ, যুগ পাল্টে গেল, নিজের মুখ পাল্টে গেল, বাঁচার অসুখ পাল্টে গেল কিন্তু এসব কাজের নেশা আমার গেল না।

মাতৃভাষা বড় টান

১৯৯৫এ ফিরি। পূর্ণেন্দুদার মাধ্যমে ততদিনে বিহার বাঙালি সমিতি, বিহার বাঙলা আকাডেমি ইত্যাদির কাজকর্মের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে অনেক মানুষকে চিনেওছি। সে সময় আকাডেমিতে একটা সঙ্কট চলছিল। রাজ্য সরকারের নোটিফিকেশনে পূর্ণেন্দুদা অধ্যক্ষ, ইন্দিবর মুখার্জি নির্দেশক। বীথিকা সরকার উপনির্দেশক নিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু বীথিকাদি নরম মনের মানুষ। ইন্দিবরের রূঢ় অপমানজনক কথায় পদত্যাগ করেছেন। গুরুচরণদা এবং আরো অন্যান্যদের সঙ্গে পূর্ণেন্দুদার আলোচনায় স্থির হল যে আমায় উপনির্দেশক হতে বলা হবে। বীথিকাদির অপমানটার বিহিত হওয়া দরকার। ইন্দিবর শাসকীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই রাজি হয়ে গেলাম। ২৮শে জুন ১৯৯৫ তারিখে আমি আকাডেমিতে যোগ দিলাম।

ওদিকে আবার বিহার বাঙালি সমিতির অগ্রজ-সম মানুষদের বোঝানোয় ১২ই ডিসেম্বর, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পাটনা শাখার সভাপতি না সচিব? কী যেন হলাম? মনে নেই।

ছয় বছর সিবিআইয়ের মামলা চলার পর ১৫ই মার্চ ১৯৯৬এ সিবিআই কোর্টের রায় বেরুলো পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আর ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। রায় শুনে ফিরে এসে রাতে একটু কবিতা লিখলাম। পনের দিনের প্রভিজনাল বেল পেয়েছি। সেদিন নাকি পরের দিন, বেফ অফিসে গিয়ে দেখি আমার পরের বোন মানু বসে আছে। ওর বক্তব্য বড় উকিল ধরতে হবে। তার জন্য ও টাকাও নিয়ে এসেছে। বি. বি. ঘোষ আর বি. প্রসাদের সঙ্গে কথা হল বিরজুবাবুর কাছে যেতে হবে আমার উকিল গৌরাঙ্গদাকে নিয়ে। তাই গিয়েছিলাম। পার্মানেন্ট বেল পেয়েওছিলাম।

সে সময় লিখছি কিন্তু চুটিয়ে। কবিতা, গল্প, নাটকের মকশো, বস্তুতঃ সেগুলোই ডাইরি। আলাদা করে ডাইরি এন্ট্রি খুব কম। ইউনিয়নের কাজে ঘুরছি, পার্টির বৈঠকগুলো করছি, আকাডেমির বৈঠকে যাচ্ছি, নাদুদার বাড়িতে বা পূর্ণেন্দুদার বাড়িতে আড্ডা মারছি একদিন কুমারের সঙ্গে তার মহেন্দ্রুর বাড়িতে গেলাম সন্ধ্যায়, মছুয়াটোলি থেকে পম্ফ্রেট মাছ কিনল কুমার। বাড়িতে ওর স্ত্রী কৃষ্ণার হাতের রান্না পম্ফ্রেটের ঝোল আর ভাত খেলাম। সে সময়েই বোধহয় কালিদাস রঙ্গালয়ে একটা কোনো সর্বভারতীয় বাংলা বা বাঙালি সম্মেলন হয়েছিল। গুরুচরণদা বিহারে বাংলা মাতৃভাষা ও সাহিত্যচর্চার অবনতি টাইপের কিছু বিষয় দিয়েছিলেন প্রবন্ধ লিখতে। সেই প্রথম প্রবন্ধ। পড়ে গুরুচরণদা প্রশংসাও করেছিলেন।

সাতানব্বইয়েও ভালো ভালো ব্যাপার হল। কোনো একবার কলকাতায় গিয়ে দীপনকে কিছু কবিতা দিয়ে এসেছিলাম। সেটা ছাপার দিকে এগোলো। দীপনই বাছাই করল কবিতাগুলো। প্রুফ দেখতে গেলাম কলকাতায়। তখন তো কলকাতায় গেলেই হয় নিজের শ্বশুর বাড়ি নয় অনুপমের বাড়ি নয় ইউনিয়নের ধার্য হোটেলঘরে উঠছি। প্রুফগুলো মনে আছে, বাঁশদ্রোণিতে রাতে শ্বশুরবাড়ির ছাতের সিঁড়িতে বসে দেখতাম। কাউকে বিরক্ত না করে সিগরেট খাওয়া  যেত, আর কারুর উপস্থিতিতে বিরক্ত না হয়ে প্রুফ দেখা  যেত।

ওদিকে আলোকজি তখন দিল্লিতে। ক্রান্তিও দিল্লিতে। আলোকজির প্রথম বইয়ের জন্য রাজকমল প্রকাশনের সঙ্গে কথা হয়েছে। একদিন ফোন করে বললেন ওনার ঘরের টেবিলের ক্যাবিনেট থেকে (ওই টেবিলটা দীপনের দেওয়া) ডাইরি আর পত্রিকা ঘেঁটে সমাপ্ত, অসমাপ্ত কবিতা যা কিছু আছে সব ফটোকপি করে পাঠিয়ে দিতে। ৮ই সেপ্টেম্বরে কলকাতায় দীপনের বাড়িতে আমি নিজের কবিতা গোছাচ্ছিলাম। ২৩শে সেপ্টেম্বর আলোকজির কবিতা (১০৪ পৃষ্ঠা)  আলোকজিকে স্পীড পোস্টে পাঠিয়ে দিলাম। নভেম্বরে আমার বইও কলকাতায় প্রেসে গেল। আলোকজির বইও দিল্লিতে প্রেসে গেল। দীপনের বইটাও তখনই গেলে পারত। কিন্তু ওর রৌদ্র অবয়ব প্রকাশ পেল ২০০২য়ে, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ থেকে।

তবে গণতান্ত্রিকএর রাজ্য দপ্তরেই আমার বই সমুদ্র দুভাবে ডাকের আবরণ উন্মোচন অনুষ্ঠান হল। ১৯৯৮এর ১৭ই জানুয়ারি। উন্মোচন করলেন আমার ইচ্ছে মত, হিন্দির শ্রমিকদরদী গল্পকার কমঃ ইজরায়েল। অধ্যক্ষতা করলেন কমঃ ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন, অনির্বাণ দত্ত (যিনি আমার বই প্রকাশ করার পুরো উদ্যোগটা নিয়েছিলেন; এখনও দেখতে পাই বিকেল চারটে নাগাদ বৌবাজার স্ট্রিটের ফুট ধরে ভারি একটা ঝোলাভর্তি আমার বই নিয়ে উনি হেঁটে আসছেন), জিয়াদ আলি, বারিদবরণ চক্রবর্তী ছাড়া আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে, নীলুদি, একরাম, রাণা, সঞ্জয় (তিওয়ারি), অনুপম। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ছিলেন শঙ্কর সেনগুপ্ত, ভব রায়, হিমাদ্রিশেখর ও কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। ইউকো থেকে অমল চক্রবর্তী। আরো  বেশ কয়েকজন ছিলেন। ডাইরিতে লেখা আছে দেখছি, রবীনদার অনুপস্থিতি বুকে বাজছিল। আলোকজির বই, দুনিয়া রোজ বনতি হ্যয়ও তার কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হয়েছিল। আলোকজি ফিরে এসেছিলেন এবং ব্যাঙ্কের পাটনা শাখার ঋণ বিভাগে মনে আছে উনি এসেছিলেন আর আমি আমার বইটা ওনাকে দিয়েছিলাম।

অবশ্য তারপর পুরো সালটা রোজকার নিয়মিত দপ্তর, পরিবার আর সাংগঠনিক কাজেকর্মে কেটে গেল। এদিকে ব্যাঙ্কে আমাদের ফেডারেশনের সভাপতি কমঃ নিসার আহমদ খাঁ মারা গেলেন। পরের বছর পূর্ণিয়ায় কমঃ অজিত সরকারকে হত্যা করা হল। নতুন অর্থনীতি, নতুন প্রযুক্তি চেপে বসছে আর ডাইরিতে যুগটা ধরার চেষ্টা করছি। দুদিক থেকে। ইউনিয়ন কর্মী হিসেবে কর্মচারীস্বার্থের দিক থেকে আর সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে নতুন ধারণানির্মাণের দিক থেকে। সে সময়েই ইউকো ব্যাঙ্কের সর্বভারতীয় সম্মেলনে অতিথি সাংসদ কমঃ দীপঙ্কর মুখার্জির বক্তৃতায় বলেছিলেন, প্রথম পাঁচ বছর ওরা বোঝাবে, আপনি চুপচাপ থাকুন না, আপনার সঙ্গে তো আর কিছু হচ্ছে না। আর পরের পাঁচ বছর বোঝাবে, আর তো যা হওয়ার হয়েই গেছে, এখন আর বলে কী করবেন! আর সে সময়েই জনবাদী লেখক সঙঘের রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল সিওয়ানে। সকালে চা খাচ্ছিলেন কমঃ মুরলীমনোহর প্রসাদ সিং, মনমোহন আরো অনেকে। আমি প্রতিনিধি নই। সাংস্কৃতিক মোর্চার তরফ থেকে ফ্র্যাটার্নাল। শুনলাম কেউ সজোরে বলে উঠল, রাপচার য়া কন্টিনিউইটি। ইয়হ মুখ্য সওয়াল হ্যয়।কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগল। 

নিরানব্বইয়ের জানুয়ারিতে একগাদা পোস্টার এঁকে সদলবলে রওনা দিলাম এর্নাকুলাম, বেফির সম্মেলনে।

থ্যাঁতলানো দাঁতন আর আলতা

পোস্টার নিয়ে কথা বলতে গেলে হাতে লেখা পোস্টারের কথাও সেরে নিতে ইচ্ছে করে। ধানবাদ থেকে তখনো ফিরিনি, কিন্তু লাইনে এসে গেছি। পাটনায় এসেছি ইউনিয়নের সম্মেলনে যোগ দিতে। কেউ বলেছিল, শুভানুধ্যায়ী, আসবি, নেতারা দেখবে, চিনবে, একবার নিজের মুখে বলেও আসবি জেনারেল সেক্রেটারিকে, বাড়িতে গিয়ে এসব করতে হয়! নইলে লালাবাদে আর ভুমিহারবাদে ফেঁসে যাবি, প্রথম খেপে অন্য কারুর হয়ে যাবে! হয়েও ছিল তাই ঝগড়া, চ্যাঁচামেচি করতে হয়েছিল ম্যানেজারের সঙ্গে তবে সম্মেলনের আগের দিন সকালে পাটনায় জেনারেল সেক্রেটারির বাড়িতে গেলাম। পোদ্দারজি। পরে অবশ্য তাঁর ভক্তও হয়ে উঠেছিলাম। খুব সৎ, কর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। ট্রান্সফারের কথ বলব কি বলব না ভাবছিলাম, তার আগেই বলে উঠলেন, ও, সম্মেলনে এসেছ? ভেরি গুড! শোনো, পঞ্চাশটা হাতে লেখা পোস্টার তৈরি করে নিয়ে কাল নিয়ে এস তো ভেন্যুতে! এই সার্কুলারটা নিয়ে যাও, ইস্যুগুলো সব পেয়ে যাবে।

তার আগে কখনো পোস্টার লিখিনি। আঁকার কাগজটাকে ড্রয়িং শীট নয়, চার্ট পেপার বলে তাও অনেক পরে জেনেছি। পঁচিশটা শীট কিনে ভাবলাম, এত বড়, ম্যানেজ করব কী করে? আদ্ধেক আদ্ধেক করে শুরু করলাম বোনেদের স্কুলের সময়কার পোস্টার কালার আর তুলি দিয়ে। সারা রাত জেগেও কুড়ি-বাইশটার বেশি হল না। তবে হলে পোদ্দারজি আর জিজ্ঞেস করলেন না পঞ্চাশটা কেন হয় নি।

নেশাটা রয়ে গেল। ভালো পারি, খারাপ পারি, করে গেছি তার পরেও। তত দিনে একটু আধটু সংগঠনের কাজে হাত পাকাতে পাকাতে বুঝেছি সবাইকে নিয়ে বসে সারা সন্ধ্যে, রাত এধরণের হাতে পোস্টার লেখা, দেয়াল লেখা, ফেস্টুন টাঙানো ইত্যাদির কী গুরুত্ব। ইতিমধ্যে রবীনদা চলে এসেছেন রোজকার জীবনে, রং-তুলি, পোস্টার-এক্রিলিক-অয়েলপ্যাস্টেল, স্যাবলহেয়ার-হগহেয়ার ইত্যাদির দিগন্তটা খুলতে শুরু করেছে। ড্রয়িংএর ড-ও আঙুলে নেই তবু আঁকতে শুরু করলাম। মনে আছে, ভোরের আকাশে সিলুয়েট, পাইল-ড্রাইভারের ওপরে চড়ে কাজ করতে থাকা এক শ্রমিক এঁকেছিলাম। একটু বেলায় রবীনদা এসে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ভূলের কথাতেই ফোরশর্টেনিং জানলাম। 

যাহোক, আমরা তো বাংলার ছেলে ছিলাম না যে ছাত্র জীবন থেকে এসব করার অভ্যেস থাকবে! অভ্যেসটা গড়তে হয়েছে বুড়ো-হাবড়াদের নিয়ে। তারই মধ্যে আমাদের মত খারাপ-লিখিয়েদের জন্য, তাড়াতাড়ি বড় অক্ষর লেখার একটা পথ পেয়ে গেলাম একদিন। সহকর্মী মীরা কক্কড়, আমাদের ভাবীজি (কেননা তাঁর স্বামীও তাঁর সহকর্মী আর সংগঠনে নেতা) বুদ্ধি দিলেন, পুরোনো ব্যবহার করা নিমের দাঁতন যোগাড় কর। ঘেন্না হলে নিমের দাঁতন কিনে মুখটা হাতুড়ি বা নোড়া দিয়ে ছেঁচে নাও। তাতে তুলো জড়িয়ে নাও শক্ত করে। তারপর বাজার থেকে আলতা কিনে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লেখ। করে, ব্যাপারটা বুঝে দারুণ রাস্তা পেয়ে গেলাম। ইউনিয়নের অফিসের ঘরে, সামনের মাঠে সবাইকে বসিয়ে দিলাম দু-তিনটে ডবল-স্কেপ তা-কাগজ বা খবরের কাগজ, দাঁতনের তুলি এক ঢাকনি করে আলতা আর স্লোগানের লিস্ট দিয়ে। লেখো। খারপ হোক, ভালো হোক, স্লোগানগুলো বড় বড় করে লেখো।

মাঝে মধ্যেই দুটো একটা পোস্টার হাতে লিখে ব্যাঙ্কের দেয়ালে সাঁটিয়েছি। বিশেষ করে যে বিষয়ে বিহারে ব্যাঙ্ক ইউনিয়নে পোস্টার হয় নি। যেমন মে দিবসের শতাব্দী, কিছু আর্থিক পরিসংখ্যান ইত্যাদি।

চুরানব্বইয়ে সিটু সম্মেলনে জ্ঞান-দা বললেন পোস্টার প্রদর্শনী করতে। করলাম। তার আগে, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে ভিখনাপাহাড়ি মোড়ের দেয়ালে পোস্টার প্রদর্শনী হল। তাতেও পোস্টার দিলাম দু-তিনটে। হিন্দি ক্যালিগ্রাফির বই কিনে লেখার অভ্যাস করতে শুরু করলাম।  

তবে কত আর পারব, অপটু হাতে। ব্যস, লেগে থাকা আর কি। কাজটা যেন এগোয়।   

তখনই নেশা হল নতুন নতুন কাগজের। ভিখনাপাহাড়ির মোড়ে যখন পোস্টার একজিবিশন হল, বড় ব্রাউন পেপারে নানারকমের রঙিন কাগজ, ভালো ম্যাগাজিনের গ্লসি কাগজ ইচ্ছেমত কেটে কেটে সেঁটে দিয়েছিলাম। কখনো ঘন্টাখানেক বসে যেতাম কেসরিজির দোকানে। ভালো মানুষ ছিলেন। কাগজের হোলসেল ডিলার। তাঁর গুদামে ঢুকে কাগজ বাছতাম, চার্ট, বোর্ড, ব্রাউন, এমনকি বড় ফুল ডিমাই হোয়াইট প্রিন্ট (কাগজের গন্ধ আমার ছোট বেলা থেকেই ভালো লাগে, চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুঁকে বলতাম কোনটা কোরাল আইল্যান্ড, কোনটা মডার্ন প্রোজ, কোনটা বেঙ্গলি সেলেকশন্স)।       

সহস্রাব্দ বদলের দিনগুলি

কিছুদিন আগে থেকেই, গণতান্ত্রিক অনুশীলনের মূলনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা, পূঁজিবাদী গণতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ সঙ্কটে কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ হয়ে যায় এবং তাকে যে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি প্রধান অবলম্বন করে তুলতে পারে, এই বিষয়টা মাথায় ভুসকুড়ি কাটছিল। সুযোগ সুবিধে পেলেই সভায়, বৈঠকে জ্ঞান ঝাড়ার চেষ্টা করছিলাম। ১৯৯৮এর ১৭ই এপ্রিল তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাটাও হয়ে গেল। স্টেট ব্যাঙ্কের মুজফফরপুর জোনে, পই পই করে বারণ করা সত্ত্বেও আমাদের একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ব্যাঙ্কটা বড়। একটা মনোলিথ ইউনিয়ন আছে, তার নেতৃত্ব যেমনই হোক। সেখানে সারা দেশে পঁচিশ-তিরিশ হাজার কর্মচারী একসাথে মিলে যদি নতুন সংগঠন গড়ে তাহলেই টেঁকার সম্ভাবনা নচেৎ আবেগটুকুই সার, এটাই ছিল আমাদের বক্তব্য। তবুও মুজফফরপুর জোনে একটি নেতৃত্ব তৈরি হল এবং পাঁচশো কর্মচারীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা সম্মেলন করে তারা আমাদের সঙ্গে এল। শুরু হল কর্তৃপক্ষ আর পেটোয়া ইউনিয়নের নেতৃত্বে মিলে তাদের দুর্ভোগ বাড়ানোর পুরোনো খেলা। প্রতিবাদ করতেই হত। আমরা পাটনার লোকাল হেড অফিসের সামনে প্রতিবাদ সভা করতে পৌঁছোলাম। পেটোয়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নিজেদের লোকজন নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে কিছুটা আড়ালে ছিল। আমরা একজোট হওয়ার আগেই হামলা চালালো। প্রধান লক্ষ্য ছিলেন আমাদের ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, বী প্রসাদ। তারপরেই ঠিক আমাকে নিয়ে কেন পড়ল বুঝতে পারলাম না। ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেল বি এন কলেজের গেট অব্দি। সেখানে মাটিতে ফেলে হকিস্টিক দিয়ে মারতে শুরু করল। আমাদের পিছু পিছু ছিল আমার ব্যাঙ্কের কমরেড সুরেন্দ্র প্রসাদ। সে বুদ্ধিমানের মত ঝগড়া না বাড়িয়ে, হাত জোড় করে, এ ভইওয়া, ছোড় ন দিজিয়ে, কুছ উলট-সিধা হো জায়েগা তো …” (অর্থাৎ, মৃত্যু না হয়ে যায়) বলে বলে ওদের আটকাচ্ছিল। ইতিমধ্যে একটি ছেলে সোজাসুজি আমার মাথায় তাগ করল। সুরেন্দ্র বকুনির সুরে, হেহ, মাথা পর নহীঁ …” বলায় থমকে গিয়ে সে পায়ে চালালো, ঠিক হাঁটুর ওপরে। তারপর চলে গেল। সুরেন্দ্রের সাহায্যে উঠে দেখলাম, না, ভাঙে নি, লেংচে লেংচে হাঁটতে পারছি। কোথায় গেছে প্রসাদজীরা? জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম পিএমসিএইচ, ইঞ্জুরি রিপোর্ট লেখাতে। আমি আর সুরেন্দ্রও চললাম।

কিছুদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে কাটানোর বাধ্যতা ছিল। বসে শুয়ে সুরেন্দ্রনাথ সেনের ১৮৫৭ পড়ে গেলাম। মাঝে মধ্যে এই ছুটিগুলো যা কাজে লেগেছে না? চাকরির প্রথম দিকে তো পড়তে পড়তে সোজাসুজি ছুটিতেই থেকে যেতাম। দস্তয়েভস্কি, টলস্টয় সেভাবেই পড়েছি। ১৮৯ উইদাউট পে লিভ হয়ে, মাইনে কাটিয়ে শেষে অসুখবিসুখগুলো সহায় হল। দেড় মাস জন্ডিসে কত বই পড়েছিলাম। অতীন বন্দোপাধ্যায়ের নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে দুখন্ড, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়, প্রথম আলো সব কোনো না কোনো অসুখে পড়া। আর অসুখ না হলে বিসুখ এই যেমন ওপরে বললাম, স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে মার খেয়ে। তেমনি, সেই বছরই সেপ্টেম্বরে, বোরিং রোডে বোনের বাড়ি যেতে গিয়ে রিকশা উল্টে গেল। বাঁ-কাত হয়ে পড়ে কলারবোন ক্র্যাক। প্রথম বেহুঁশ হওয়ার অভিজ্ঞতা হল। অর্দ্ধচৈতন্যেও আগে যে কথাটা মনে এল, যাক, একেই বলে ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন জে ডি বার্নালের বইটা (ইতিহাসে বিজ্ঞান) পড়ার জন্য এক মাস মেডিক্যাল লিভ পাওয়া যাবে  

ঈক্ষণ পত্রিকাটা একবার বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। কুমার চলে গিয়েছিল আগেই, প্রতিচীতে কাজ নিয়ে। কৃষ্ণার ট্রান্সফারটা হয়ে যাওয়ায় সপরিবার ফিরে গেল কলকাতায়। রাণা চলে গিয়েছিল গুজরাত, রাজপিপলায়। পত্রিকা দলে নতুন জুড়েছিল সুব্রত, কিন্তু উৎসাহটা দানা বাঁধছিল না।

আটানব্বইয়ের চোদ্দোই জুন কমরেড অজিত সরকারকে হত্যা করা হল পূর্ণিয়ার রাস্তায়। আরো দুজন পার্টি কর্মী মারা গেলেন গুলিতে। এমন কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ৮৯ সালে তাঁর নির্বাচনের প্রচারকাজে পূর্ণিয়ায় গিয়ে, আমার নিজের ছোটোবেলাটা তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। অনুপমের সঙ্গে রাতে ঠিক চিনে চিনে গিয়েছিলাম নওরতনের সেই বাড়িটায় যেখানে আমার শৈশব স্মৃতিসম্পন্ন হতে শুরু করেছিল। বাইসির কৃষক-বাড়িতে মাঝরাতে তাঁর সান্নিধ্যে মুড়ি খেতে খেতে, জেলা স্কুলের মাঠে তাঁর ভাষণ শুনতে শুনতে নিজের পূর্ণিয়া-বাসে, ভাট্টাবাড়ির এক অজানা কিশোর অজিত সরকারকে শামিল করে নিয়েছিলাম। পার্টির নেতা হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবেও রক্তের ছিটে লেগেছিল মুখে।

সেই দশকের প্রাদেশিক রাজনীতির প্রভাবে, ভাগলপুরে বা মধুপুরে বা অন্য কোথাও বাঙালির সম্পত্তি দখলের প্রয়াস, মছুয়াটোলার এক ব্যবসায়ী বাঙালির অপহরণ, গুন্ডার হাতে সরকারি উচ্চ-আধিকারিক এক বাঙালির স্ত্রী-এর প্রাত্যহিক নির্য্যাতন, বাঙালির পলায়ন ইত্যাদি শুনলেও আমি বা আমার পরিবারের কেউই কখনো বিশেষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই নি। কখনো কোনো বিকল্পের কথা ভাবিও নি। যদিও অনুপম বাংলায় ফিরে যাওয়ার পর যখন একটা জমি কিনল, বাড়ি করার জন্য, আমিও তার পাশে একটা টুকরো কিনলাম, বাড়ির ম্যাপও পাস করালাম, বাড়ি তৈরি থেকে বেশি ওটা যেন ভাষাভূমিতে পা-রাখার একটা আবেগ ছিল। বৌও কাজ করে পাটনায়, খেটে খাওয়া মানুষ দুজনে যাবো কোথায়? আর কেনই বা যাব? লড়ার জায়গা তো এটাই। আমার বাংলাভাষা তো বিহারের কথাই বলবে। এটাই দৃঢ় মনোভূমি ছিল। তবে অজিত সরকার মারা যাওয়ার ঘটনায় আরো বেশি করে দেখতে শুরু করলাম বিহারের সঙ্কটটা। কিম্বদন্তি-প্রায় নির্বাচন আয়ুক্ত টি এন শেষনের দেখাশোনায় ছিয়ানব্বইয়ে নির্বাচন হওয়ার পর দেখা গেল বিপূলতর ভোটে আরজেডি এবং লালু প্রসাদ জয়ী হয়েছেন। একটি ব্যক্তিগত আড্ডায় এক সংবাদপত্রের স্থানীয় সম্পাদককে পেয়ে (জাতিগতভাবে উচ্চজাতির এবং সংরক্ষণ-বিরোধী) ইচ্ছে করে উল্টো প্রশ্ন করলাম, কী জি? সেশনও ছাপ্পাভোট রুখতে পারল না? সেই এরাই ফিরে এল, আরো বেশি ভোটে? তিনি বললেন, না পালবাবু, স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর যারা ভোট দিতে যেতে পারে নি গ্রামের জমিদার, বড় জোতদারদের গুন্ডামিতে, তারা এবার প্রথমবার ভোট দিতে পেরেছে, এবং সবাই একপাল্লায় ভোট দিয়েছে লালুজিকে। নওয়াদায় ভোটের দিন আমি আর আরেকজন কমরেড নওয়াদা শহরের অনেকটা আগে থেকে (যেখানে বাস আটকে দিয়েছিল) নওয়াদা শহরের মুখ অব্দি ঠেলায় এবং তারপর বাসস্ট্যান্ড অব্দি পায়ে হেঁটে পার করেছিলাম এবং প্রতিটা বুথে সেই উপচে পড়া গরীব মহিলা-পুরুষের ভিড় দেখেছিলাম ভোটের লাইনে। কিন্তু পশুপালন কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পর যখন শাসক দলের বৈঠকে লালুজির স্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত হল আর ব্যাকসিট ড্রাইভিংএর কথাটা চাউর হল, আমাদের মনেই হচ্ছিল ব্যাপারটা এত সহজ নয়। অজিত সরকারের হত্যায় সেটা আরো প্রমাণ হয়ে গেল। দুর্বল শাসনের সুযোগে আগে থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা আমলাতন্ত্রের একাংশ নিজেদের অকর্মণ্যতা দিয়ে অরাজকতা বাড়িয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। মাঝে মধ্যেই এটা হয়। নীতীশ কুমারের আমলে রণবীরসেনাপ্রমুখের মৃতদেহ নিয়ে পাটনায় তান্ডবের সময়ও পুলিস-প্রশাসনের একাংশের সমরূপ নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে অরাজকতা বাড়ানোর, বরং আগুনে বাতাস দেওয়ার খেলা দেখা গেল। উঁচু জাতের বিষাক্ত মৈত্রীবন্ধন যে কিভাবে গেঁথে আছে দেশের উত্তর-উপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে তা বোঝা যায়।     

সহস্রাব্দ বদলের দিনগুলি

খুচরো লেখালিখি, কিছু ভালো বই পড়া আর নানান কাজের মধ্যে ডাইরির সালের হিসেব ১৯ থেকে ২০র ঘরে পৌঁছে গেল। ৯৯এর ১লা জানুয়ারি লিখেছিলাম একসময় শতাব্দীশেষের এই বছরগুলোর আগমন শিহরিত করবে মনে হত। এখন কেমন সহজ নিরুত্তাপভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।কিছুদিন পরে শুরু করা একটা অসমাপ্ত দীর্ঘ কবিতায় লিখলামঃ

ক্লান্তির শিল্পে কিছু রহস্য কিছু অনুধাবন
                                 না ছড়ালে চলে না।
কিছুতেই মুক্ত হতে পারছি না আমরা কেউই।
ভারতবর্ষ ভুতের মত,
দুঃস্বপ্নের জালের মত লেপটে যাচ্ছে, যতবার
                     নিঃশ্বাস নিতে চাইছি আধুনিক প্রাসঙ্গিকতায়।
এমনকি যা হয়, স্বপ্নহীন সময়ে
দুঃস্বপ্নও মহার্ঘ্য মনে হয় এবং বস্তুতঃ ধন্ধ জাগে,
যে সত্যিই ছাড়াতে চাইছি না জড়াতে চাইছি নিজেকে?

২০০০ সালে পৌঁছে ১০ই জানুয়ারির ডাইরিতে লেখা দেখছি, কম সুনীত চোপড়া গল্প করছিলেন, রাজ্য কমিটির দপ্তরে বসে। গত বৃহস্পতিবার সকালে। কথা উঠল পূঁজিবাদের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা। বর্ণবৈষম্যের সমাপ্তি। এ সূত্রে অন্য একটি কথা মনে এল। কথাটা বললামও ওনাকে। তবে বিস্তারে যাই নি। অফিস যাওয়ার তাড়া ছিল। পূঁজিবাদ যে নিজের অন্তর্গত দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ুছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছে তাকি আনন্দের ব্যাপার? যে দেখ, মার্ক্সবাদের সত্য প্রমাণিত হচ্ছে? A matter of glee? কিন্তু তার সাথে পুরো সমাজটাই তো ভেঙে পড়ছে! অসুস্থ হয়ে পড়ছে! আমরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছি দিনে দিনে! এই contextএই আমি কম সুনীতকে Manifestoর প্রথম প্যারার শেষ পংক্তিটা স্মরণ করিয়েছিলাম যে এই শ্রেণীসংগ্রামের পরিসমাপ্তি হয় বিপ্লবে হবে নয়ত বিবদমান শ্রেণীগুলির সমূহ বিনাশে হবে এবং এখানেই শিল্পসাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গীর একটা প্রসঙ্গ টানতে চাই। সদর্থে গ্রিক ট্র্যাজেডি কিম্বা শেক্সপিয়রিয়ান ট্র্যাজেডি হয়ত আর সম্ভব নয় কিন্তু যে অর্থে আধুনিক যুগের নানা মহৎ উপন্যাস ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে পেরেছে যেখানে নায়ক-নায়িকারা হাজার বৈপ্লবিক সম্ভাবনায় সমন্বিত হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে খলসমাজের প্রতিনিধি খলনায়ক হয়ে যায় এও অন্য এক মৃত্যুবরণ। জনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ তো শহীদের কিন্তু এই নৈতিক মৃত্যু নামহীন। এবং এই দৃষ্টি নিয়ে সমাজটাকে দেখা উচিৎ পূঁজিবাদের ভাঙনকে দেখা উচিৎ অসুখ  ও ধ্বংসকে দেখা উচিৎ।

এসব চলছিল ঠিকই, কিন্তু মাতৃভাষায় আড্ডা মারার আর কোনো জায়গা ছিল না। নাদুদার সঙ্গেও একাডেমির কিছু ব্যাপার নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। দেখা হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক পূর্ণেন্দুদা ছিলেন, মাঝে মধ্যে যেতাম কিন্তু ওনার সঙ্গে সিরিয়াস আলোচনা হতে পারতো, আড্ডা যাকে বলে সেটায় খামতি থেকে যেত।

আর তাছাড়া, মূলতঃ আমি কিছু-একটা-করার ব্যস্ততায় থাকতে ভালোবাসতাম। পত্রিকা বেরুচ্ছে, অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে যে কোনো কাজ, সে জলের যোগাড় হোক বা রাত জেগে প্রুফ দেখা হোক বা আলোচনাচক্রের কীনোট হোক। কিসানসভার স্বর্ণজয়ন্তী সম্মেলনে একদিকে বালতি বালতি জল তুলে এনে ভরেছি হলে খাবার জলের ড্রামগুলো (সে সময় জলের বোতল ছিল না আর শ্রীকৃষ্ণ মেমোরিয়ালে লম্বা পাইপ টেনে নিয়ে যাওয়ার সুবিধে তখনও হয় নি) আর তারই ফাঁকে ফাঁকে স্টেজে গিয়ে ছবি তুলেছি (কম. বিপ্লব দাশগুপ্ত ছবি তুলতে বলেছিলেন; লোকলহরে ছেপেছিল দেখেছিলাম, পিপলস ডেমোক্রেসি বা গণশক্তি জানি না)। শতক বা সহস্রাব্দ বদলের বছরগুলো যত ঘটনাপূর্ণ হবে ভেবেছিলাম, পেরুলো উল্টো, একটা বিমর্ষতার মধ্যে। একদিকে সারাবিশ্বব্যাপী জয়ী নব-উদারতাবাদের উচ্চকিত উৎসব-যাপন, নতুন মিডিয়া-তন্ত্রে ঘরে ঘরে বাজনা বাজাচ্ছে, অন্যদিকে সোভিয়েত বিপর্যয়, নতুন অর্থনীতির চাপ, প্রযুক্তি বিপ্লব, বাবরিধ্বংসের প্রভাবে হিন্দুত্বউত্থান আর কেন্দ্রে অটলবিহারির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার, তার ক্যালাসনেসে ঘটিয়ে দেওয়া কার্গিল যুদ্ধ আর সৈনিকদের মৃতদেহের ওপর দাঁড় করানো দেশভক্তি, নিজেদের রাজ্যে অরাজকতা এসবের সামগ্রিক আক্রমণ বামপন্থী গণসংগঠন, সংগঠিত ক্ষেত্র, বিশেষকরে আমাদের মধ্যবিত্ত কর্মচারী সংগঠনগুলোকে দুভাবে প্রভাবিত করছিল। এক, সাধারণভাবে শ্রেণীচেতনার ক্ষয় আমরাও শ্রমিকশ্রেণী, কথাটা মুখে পুনরাবৃত্ত হলেও জোর কমে আসছিল ভোগবাদের দুনিয়া তাদের গ্রাস করছিল আর দুই, পারম্পরিকভাবে মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-হড়তাল-চুক্তির নিয়মচক্রে নিশ্চিন্ত থাকা নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। সবই হচ্ছিল কিন্তু উৎসাহ, উদ্দীপনার কমতিটা লক্ষ্যনীয় ছিল।

অন্যদিকে আমি, সেই ৯২-৯৪ থেকেই নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে একটা বাংলা সাহিত্যচর্চার একটা স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তোলার গোপন ইচ্ছে পুষছিলাম। কেননা বিহার বা পুরো হিন্দি এলাকার সংগঠন জনবাদী লেখক সংঘ ঘোষিতভাবে হিন্দি-উর্দু লেখকদের জন্য। কম. ইজরায়েলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম এ বিষয়ে। ওনার কথাতেই জনবাদী লেখক সংঘএর বোকারো সম্মেলনে একটা বাংলা সেলের প্রস্তাব করেছিলাম। সেটা হল লোকভাষা সেল এবং তাও চলল না। আমি তাই ভাবছিলাম, আপাত-নিরপেক্ষ, এমনকি পাঁচমিশেলিও একটা যদি নিয়মিত বাংলা সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র গড়া যায়, সপ্তাহান্তে বসা যায়, ত্রৈমাসিক বা ষান্মাসিক পত্রিকা করা যায় কিছুই হচ্ছিল না।

ফলে ডাইরি লেখাও কমে আসছিল। ২০০০ সালে ১২ই জানুয়ারির পর ডাইরি লিখলাম ১লা মে, কলকাতায় বসে। নানান কথার পর লিখলাম, আমারই বিরুদ্ধে প্রথম স্লোগান তোলে আমার মে দিবস/ দ্বিতীয় স্লোগানের আগে তোমার দিকে ঘোরে।

কাছাকাছি সময়ে দুটো ব্যাপার হল। ব্যাঙ্ক পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন বারিদ বিমল ঘোষ। অবসর নেওয়ার দু-এক বছর পর তিনি কলকাতা চলে গেলেন; নেতৃত্বের জিম্মা এল আমার ঘাড়ে। অন্যদিকে, ঝাড়খন্ড ভাগ হয়ে যাওয়ার পর যে সম্মেলনে ব্যাঙ্ক সংগঠনের রাজ্য ফেডারেশন ভাগ হল, সে সম্মেলনে বিদায়ী সভাপতি কমরেড রমানাথ চক্রবর্তীর প্রস্তাবে আমি ফেডারেশনেরও সভাপতি হলাম। নিজের ব্যাঙ্ক সংগঠনে সাধারণ সম্পাদক হয়েই গিয়েছিলাম সেই সাতানব্বইয়ে। স্বভাবতই সাংগঠনিক কাজকর্মে সার্বিক ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেল।  

প্রসঙ্গঃ প্রতর্ক

কয়েক বছর আগে, রাখার জায়গা কম পড়ছিল বলে সবচেয়ে আগে ডাইরিগুলোর আয়তন কম করেছিলাম। প্রথমে সবকটা ডাইরির মলাটগুলো উপড়ে ফেললাম মোটা মোটা পিচবোর্ড আর রেক্সিন, প্লাস্টিকে নেওয়া অনেকটা জায়গা কমে গেল। তারপর প্রথম ও শেষদিকের মুদ্রিত পৃষ্টাগুলো ছিঁড়লাম। তারপর ডাইরির ভিতর থেকে, একসঙ্গে যেখানে পরপর অনেকগুলো সাদা পৃষ্ঠা আছে সেগুলোও বাদ দিয়ে দিলাম। ২০০৩-০৪ পর্য্যন্ত তো বিশেষ ক্ষতি হল না কিন্তু তারপর শুধু থাকল একতাড়া ছেঁড়া কাগজ এত কম লেখা ছিল। মাঝে কোরোনা, দুবছর বাইরে থাকা, বাড়ির জিনিষপত্তর ওলটপালটে অনেকগুলো পৃষ্ঠা আর দেখতেও পাই না কোথায় আছে। বিশেষ করে বড় একটা বিলিতি ডাইরি ছিল আলোকজির দাদা রেখে গিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য ডাইরি লিখিনি, কিছু অনুবাদের খসড়া ছিল। দেখতেই পাই না।

কাজেই, ওই সময়ের পর থেকে এগুনোর জন্য অন্য কোনো সময়সূত্র সন্ধান করতে হবে। পরই বা বলছি কেন। ২০০৩এর ডাইরিতেও তো অনেককিছু নেই দেখছি। প্রতর্কপত্রিকাটা বেরুলো ২০০৩এর জুলাইয়ে, অথচ ডাইরিতে কোনো উল্লেখ নেই। বরং প্রতর্কের ব্যানারে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং ভীষ্ম সাহনীর শোকসভা হল একসঙ্গে, রামমোহন রায় সেমিনারীতে, তার উল্লেখ আছে। শোকসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন শ্যামাদা (জনপ্রিয় এ্যাডভোকেট শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি), হিন্দি ও বাংলার সাহিত্যসমাজ থেকে আলোকধন্বা, অরুণ কমল, মদন কশ্যপ, কর্মেন্দু শিশির, মাণিক মুখার্জি (প্রাবন্ধিক, পথিকৃৎ পত্রিকার সম্পাদক; ইনি বিহারের লোক নন, হয়ত কোনো কাজে এসেছিলেন), পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, আমি তবে ডাইরি বলছে এছাড়া বোধহয় লোক হয়নি।

যাহোক, প্রতর্ক পত্রিকাটা পূর্ণেন্দুদা আর আমার সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার এবং চর্চা-কেন্দ্র তৈরি করার শেষ প্রচেষ্টা ছিল। দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল এবং তৃতীয়টার দুটো প্রুফ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গেল। টাকার অভাবে বোধহয়! মনে নেই। একটা একাউন্টও খোলা হয়েছিল, আমার আর পূর্ণেন্দুদার নামে। তাতে বোধহয় ছ-সাত হাজার টাকাও পড়ে আছে। দুহাজার আমার হবে, বাকিটা পূর্ণেন্দুদার। চলেই গেলেন! তারপর আগামী পনেরো বছর (মানে যদ্দিন পূর্ণেন্দুদা পাটনায় ছিলেন) আর পত্রিকার কাজে এগোতে পারিনি। শুধু প্রতর্ক নামটা রয়ে গেছে প্রতর্ক সাহিত্য সংসদ হিসেবে। পরবর্তীকালে দু-চারটি ভালো বই প্রকাশ করেছে প্রতর্ক সাহিত্য সংসদ। পত্রিকার ভালো ভালো লেখাগুলো প্রায় সব পূর্ণেন্দুদা যোগাড় করছিলেন। ছাপানো দিকটা আমি সামলাচ্ছিলাম। পত্রিকায় লেখাও ছিল তাই সম্পাদকঃ পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং প্রকাশকঃ বিদ্যুৎ পাল। তবে বিহার বাঙালি সমিতির কেন্দ্রীয় পদকর্তারা ছিলেন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। খুবই ভালো হয়েছিল প্রথম সংখ্যাটা। বিশেষ করে এ.কে.রায়ের ছাত্রজীবনে বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে চালানো আন্দোলন সম্পর্কিত লেখা ও চিঠিগুলো।

প্রথম সংখ্যায় সম্পাদকীয় তো পূর্ণেন্দুদা লিখেছিলেন। একটা উত্তর-সম্পাদকীয় ধরণের লেখা আমি লিখেছিলাম। তাতেই বার করেছিলাম আমার ক্ষোভ ও জেদ। লেখাটা তুলে দিলাম। আহা মরি ভেবে নয়, ভাবনাচিন্তা কী ছিল তার নথি হিসেবে।

প্রসঙ্গঃ প্রতর্ক

প্রতর্ক। এই নব উদ্যমের ব্যাখ্যায় গালভারি কিছু নতুন কথা বলার আছে কি? বোধহয় না । বরং কিছুটা আত্মরক্ষার সুরে বলা যেতে পারে যে এখনও চারদিকে সফল কুশলতায় নিজেদের পাশবিক যন্ত্রে পরিণত করতে পারার উল্লাসধ্বনির ভিতরেও সংগঠিত ভাবে মানবিক সক্রিয়তাগুলি জারি রাখা যায় কিনা তার পরীক্ষা এই উদ্যম।

গোর্কি যখন ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের বিখন্ডনের কথা লিখেছিলেন তখন সেটা কষ্টের ব্যাপার ছিল। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার অন্ধ গতিতে মানুষ টেরই পেতনা সে বিখন্ডিত হয়ে চলেছে আর জীবনশিল্পী চাইছিলেন যে সে এই ব্যাপারটা দেখতে পাক। দেখে তার কষ্ট হোক আর সে বুঝতে চেষ্টা করুক সেই সমাজ ব্যবস্থার স্বরূপ যা তাকে এভাবে খন্ড খন্ড করে ফেলছে, বিভাজিত করে ফেলছে। বুঝে বদলাবার চেষ্টা করুক। আজ, প্রায় একশ বছর পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিখন্ডন বা বিভাজন আর কষ্টের ব্যাপার নেই। এখন সবাই জানে এই বিভাজনই জীবনধারণ। নিজেকে দক্ষতার সাথে বিভাজিত করে রাখা, একটি খন্ডের ছাপ আরেকটি খন্ডে পড়তে না দেওয়া একটি শিল্প। ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করার নতুন স্কুলগুলোয় এই শিল্প শেখানো হয়। এমনকি যারা এই বিভাজনকারী সমাজ ব্যবস্থার উন্মুলন ঘটাতে সক্রিয় তাঁরাও এই বিদ্যেয় মুনশিয়ানা আনতে বাধ্য কেননা এই সমাজটাকে নিয়েই তাঁদেরও কাজ। খুব কষ্ট হলে, ওই স্কুলগুলি আধ্যাত্মিকতার কাছে যেতে শেখায়, ধ্যান যোগের অনুশীলন করায়; আমরা জানি অন্যত্ব Otherness না থাকলে স্বত্বের প্রশ্ন ফোঁপরা, তাই চৈতন্যের পারস্পরিক যাচাই করি এই ধরণের উদ্যমে এটাই বোধহয় প্রতর্ক' প্রকাশের দ্বিতীয় - ব্যাখ্যা।

আমরা, সেইসব বাঙলা ভাষীরা যারা ভাষার মূল ভূমি থেকে দূরে থাকি, আমাদের প্রজন্মগুলিকে মাতৃভাষাবিমুখ করে তোলার শাসকীয় চক্রান্তের সামনে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আকছার বলে উঠি আরে আগে ভাষা বাঁচুক ! তারপর তো সাহিত্য ! কথাটা সত্য কিন্তু ভিতরে একটা মিথ্যাকে আড়াল করে রাখে। ইতিহাসের স্বতঃস্ফুৰ্ত গতিতে আগে ভাষা তৈরি হয়েছে লোক মুখে, তারপর তা সাহিত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। পুরোনো ভাষার মৃত্যু হয়েছে লোক মুখে স্থান পায়নি বলে তাই সে ভাষায় সাহিত্যও একটা অতীত স্বর্ণযুগের পর ধীরে ধীরে পতিত হয়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এই পথেই আধুনিক ভারতীয় ভাষা ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাগুলির নির্মাণ। তাহলে কি আজ যা ঘটছে তাও ইতিহাসের স্বতঃস্ফূর্ত গতি? মাতৃভাষা শেখার সুযোগ না পাওয়া, জীবন ধারণের ইঁদুর দৌড়ে মাতৃভাষাবিমুখ হয়ে ওঠা, মাতৃভাষা বিস্মৃতি ও লৌকিক বাচনে বিকৃতি কি স্বতঃস্ফূর্ততায় ইংগিত করছে যে এবার এই বিকৃত ভাষা ও চাপিয়ে দেওয়া ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করতে হবে? বাংলা বাইরে বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস কি ইতিহাসের গতিকে অস্বীকার করে মৃতপ্রায় কিছুকে আঁকড়ে ধরে থাকা? নাকি ভাষাকে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাকে, স্বাধীনতার প্রধান সামাজিক-সাংস্কৃতিক যুক্তিটাকে ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ? আর তা যদি হয় তাহলে ভাষাই সহিত্যকে বাঁচাবের একটা ব্যতিহার গড়ে ওঠে সাহিত্য ভাষাকে বাঁচাবে। এটাই এই পত্রিকা প্রকাশের তৃতীয় ব্যাখ্যা।

প্রথম ব্যাখ্যায় একটি বাক্যবন্ধ এনেছিলাম সফল কুশলতায় নিজেদের পাশবিক যন্ত্রে পরিণত করতে পারার উল্লাসধ্বনি। এই বাক্যবন্ধটি যে প্রবৃত্তিগুলির উদ্দেশে লেখা, তার প্রাসঙ্গিকতা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যাখ্যাতেও রয়েছে। তবু প্রত্যক্ষ প্রসঙ্গ হিসেবে মনশ্চক্ষে ছিল ২৮ শে ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী মাসাধিক কালের গুজরাট। সংগঠিত নিধন যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়ে চলা রাজনৈতিক নেতৃত্বটির হিমশীতল ভবিষ্যৎদৃষ্টি বিশেষ প্রণিধান যোগ্য। তার অঙ্গুলি হেলনে এক বিরাট সংখ্যক ভাতের-মার-খাওয়া মানুষ সারা দেশ জুড়ে, পাশবিক যন্ত্রে পরিণত হওয়ার উল্লাসধ্বনি করে উঠবে ব্যক্তি মানুষ হতে চাইবে পরিচয়হীন উন্মত্ত ভীড় আর ভীড়ের প্রতিটি সদস্য উল্লসিত হবে যে বিধর্মী স্ত্রী পুরুষ শিশু নিধনের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারা কি সফল কুশলতায় নিজেকে পাশবিক যন্ত্রে পরিণত করতে পেরেছে, যেন ভাগবৎ মন্ত্রে মায়া মমতা মোহ ত্যাগ করে হয়ে উঠতে পেরেছে ইতিহাস নির্মাণকারী ধর্মযোদ্ধা এই হল ওই রাজনৈতিক নেতৃত্বটির লক্ষ্য, তার সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রজেক্ট। যারা মরবে তাদের থেকে অনেক বেশী, মানসিক মৃত্যু তাদের ঘটবে যারা মারবে, এবং সেই মৃত্যুই তাদের অভীষ্ট। যাদের হত্যা করা হচ্ছে তাদের মৃত্যু তো সাধনার সাধন মাত্র।

“‘প্রতর্ক জানে, অস্বাভাবিক কিছু দিনের পর স্বাভাবিক সময় ফিরে আসে না। যাকে স্বাভাবিক সময় বলি তার অস্বাভাবিকতা বেড়ে চলে দিনের পর দিন। জীবন্মৃত পাশবিকতা নিশির মত ডাকে জীবনের ব্যপ্ত হতাশায়, ব্যর্থতায়, লাঞ্ছনায় আর নিরর্থকতায়।

আসুন সেই নিশির ডাক থেকে জীবনকে বাঁচাবার নানান ছোট-বড় উদ্যমে এই অকিঞ্চিৎকর উদ্যমটিকেও শামিল করি।

নস্টালজিয়া ২ বড় বটগাছটা

প্রতর্কের কাজের সূত্রে বাংলা প্রেসের কাজে ঘোষদার পর নতুন সহায় হল দুই ভাই, ঝন্টু আর বুলান। গুরুচরণদার মারফতই পরিচয় হয়েছিল। সমিতির কাজগুলো ওরা করত। সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে যে স্মরণিকাটা বেরিয়েছিল তাতে আমার লেখা থাকলেও, বা আমি প্রুফ দেখে থাকলেও ওদের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বাড়ি বললাম কেননা বাড়িতেই তখন তারা কাজকর্ম করত। প্রতর্কের কাজকর্মে তাদের সঙ্গে রীতিমত বন্ধুত্ব গড়ে উঠল এবং নিয়মিত তাদের বাড়ি যাওয়া শুরু হল। প্রতর্ক পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পর প্রফেসর রাত্রি রায়ের একটা বই প্রকাশ করল প্রতর্ক সাহিত্য সংসদ ঋষি অরবিন্দ রচিত নাটকে রস নিয়ে আলোচনা (রাত্রিদি ইংরেজির অধ্যাপিকা ও সুলেখিকা তো ছিলেনই, বাংলাও তাঁর ততই সহজ, প্রাঞ্জল ও প্রাণবান ছিল)। তারপর আরো কিছু কাজ। আমার একটা বই। পরে যখন তারা পুনাইচক থেকে স্বর্ণাসনের ক্যাম্পাসে উঠে এল, নতুন বাড়ি করল, ততদিনে পূর্ণেন্দুদাও কলকাতার বাসিন্দা হতে শুরু করেছেন, আমিও ইউনিয়নের লড়াইয়ে চার্জশিট খেয়ে ট্রান্সফার হয়েছি ফুলওয়ারিশরিফ; সম্পর্কটা ক্ষীণ হয়ে এল।

তবে প্রেসগুলোর সঙ্গে আমার এমনই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সবসময়। নিজে কখনো প্রেসের ব্যবসা করি নি, করলে কেমন করতাম জানি না, কিন্তু প্রেসের কাজগুলো সবরকম কাজ, নতুন-পুরোনো নেশার মত টানে।

তেমনই শ্রমিক মুদ্রণালয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মহেন্দ্রু পাড়ার ওই গলিটা চোখে পড়েছে বহুবার, প্রথম বার ঢুকেও এমন কিছু আলাদা মনে হয় নি অন্যান্য গলিগুলোর থেকে, কিন্তু দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথম ঘরটা পেরিয়ে ভিতরের ঘরে যাওয়ার মত করে একটা ব্যারাকের মত বারান্দায় পৌঁছোন এবং তার শেষ প্রান্তে ডান দিকের শেষ দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে একটা ঢাকা উঠোন, চার দিকে মেশিন বা তার অংশ ছড়ান এবং তিন দিকে ঘর আর পায়খানা, বাথরুম, পুরো স্বতন্ত্র একটা ইউনিট ওটাই শ্রমিক মুদ্রণালয় একটা উপন্যাসের প্লটের মত।

অবশ্য প্রেসগুলো অমনিই হত, তিরিশ বছর আগে অব্দি। শ্রমিক মুদ্রণালয়ের আগেও যে প্রেসে যেতাম, এক সহকর্মীর ভাইয়ের প্রেস, বিশাল বড় জমিদারি কম্পাউন্ডে ছড়ানো নানারকম ব্যবসা পেরিয়ে সবচেয়ে দূরের কোনাটায় জমিদারির বাণিজ্যপূঁজিতে রূপান্তরণের একটা দৃশ্য।

এখন যে ডিজিট্যাল কম্পোজিংএ যাই, শুধু এটুকুই তফাৎ যে বড় উঠোন আর জরাজীর্ণ ঘরের-ভিতর-ঘর-ওয়ালা সে বাড়িগুলোই নেই, ভেঙে বহুতল হয়েছে, শুধু সামনেটা মেক-আপ, বাকি তিন দিক ব্যান্ডেজ-খোলা ঘা। তার ভিতরেও সেই প্যাসেজের ভিতরে প্রায় অদৃশ্য এক ভাঁজ দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, কোনো এক তলার কয়েকটি ঘরের পেছনে লুকিয়ে থাকা একটা ঘর, তরুণ প্রজন্মেরই এক মানুষ কিন্তু চোখ আর কাঁধের অবসাদ বুঝিয়ে দেয় কাজটা বড় ঝক্কির।

সে যা হোক, শ্রমিক মূদ্রণালয়ের বুড়ো মালিক এমার্জেন্সিতে জেল খেটেছিলেন, লোহিয়াপন্থী এবং নকশালপন্থী পত্রিকা ছেপে। যার সূত্রে প্রেসটার সন্ধান পেয়েছিলাম তার বন্ধুস্থানীয় ছিল তাঁর ছেলে। কিছু দিনে আমারও বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেল।

বছরের পর বছর ইউনিয়নের কত কাজ করিয়েছি। হিন্দি কাজ মানেই বিজয়। প্রেসের কাজের ধরণধারণ বদলে যাওয়ায় সেও কিছুটা কম্পিউটারে পেজমেকারে কাজ করা শিখে নিল ছেলের কাছে। ছেলেরা এখন অন্য লাইনে ভালো ব্যবসা করছে, মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে তাই প্রেসের কাজই বন্ধ করে দিয়েছে। নতুন পদ্ধতি কম্পিউটারে কম্পোজ করো, প্রিন্টারে ট্রেসিং বার করো, যাও অফসেটের পাড়ায়, ছাপিয়ে আনো এ বয়সে আর তার পোষালো না।

নীলুদির অনুবাদ করা নাটকদুটো ভেবেছিলাম তাঁর বেঁচে থাকতে থাকতেই ছাপিয়ে ফেলতে পারব। হল না। হঠাত উনি মারা গেলেন। তারপর গ্যালিলিও আর রোশন নাটকদুটো বিজয়কে দিয়ে ছাপালাম। প্রচ্ছদের কাজ ফোটোশপের কাজ তাই ছেলেকে বসতে হল। রবীন্দ্রনাথ ও জনগণমন নিয়ে পূর্ণেন্দুদার লেখাটা হিন্দি করে বিজয়ের প্রেসেই ছাপালাম।

তবে একটা রাত মনে রাখার মত থাকবে। ইউনিয়নের রিপোর্ট ছাপছে। দুদিন দরকার। কিন্তু একদিন পর গয়ায় সম্মেলন। কী করে হবে? বিজয়কে বললাম, রাতভর থাকব, খেয়ে আসছি। তাই গেলাম। রাত তিনটে অব্দি লাগাতার চলল কম্পোজিং, গ্যালি প্রুফ, সেকেন্ড প্রুফ, ছাপাইয়ে যাওয়া। শেষ হলে বিজয়কে বললাম বাইন্ডিং করিয়ে (ছোটো রিপোর্ট, স্টিচের দরকার ছিল না, শুধু স্টেপলিং আর কাটিং) সাতটার মধ্যে আমার কাছে পৌঁছে দিতে। মহেন্দ্রু মোড় ছাড়িয়ে বড় বটগাছটা ভরে শুরু হয়ে গিয়েছিল পাখিদের কিচিরমিচির।

শেষরাতের ওই কিচিরমিচিরই আমাকে দিয়ে জুন দুপুরের ম্যান্ডোলিন লিখিয়েছিল। কারোর ভালো লাগুক না লাগুক, আমি নিজে এখনো পড়ে তৃপ্ত হই। যাহোক, সে রাতে চারটেয় বাড়িতে গিয়ে দুঘন্টা ঘুমোলাম। সাতটায় বিজয় পৌঁছে দিল বান্ডিল। সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে আমি সাড়ে আটটার ট্রেন ধরলাম। একটায় পৌঁছোলাম গয়া। আড়াইটেয় সম্মেলন শুরু হল।

বিহার বাঙালি সমিতি

প্রতর্কের কাজকর্ম আমায় সব দিক থেকেই বিহার বাঙালি সমিতির কাছে নিয়ে এসেছিল। চাকরিতে আছি, কাজেই ইউনিয়নেও আছি, তাও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে, তাই সাংগঠনিকভাবে বিহার বাঙালি সমিতির ভিতরে না ঢুকলেও নানা রকম কাজে জড়িয়ে পড়তে শুরু করলাম। ২০০৪ সালে স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই গুরুচরণদা পাটনার বাইরে ছেলে বা মেয়ের কাছে থাকতে শুরু করেছিলেন। বিহার বাঙালি সমিতির কাজকর্মের সঙ্গে আমাকে জড়ানোর জন্য রইলেন শুধু পূর্ণেন্দুদা। তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই কখনো ডঃ দিলীপ সেনের কাছে (তিনিই সে সময় সমিতির সভাপতি ছিলেন, সাধারণ সম্পাদক মণিকুমার রায় জামালপুরে থাকতেন), কখনো শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কাছে, কখনো প্রভু মুখার্জির কাছে নিয়ে গেছেন। তবে বিশেষ কিছু নয়, চিঠিপত্র-প্রতিবেদন ইত্যাদি হিন্দিতে করে দেওয়া, কিছু পরামর্শ দেওয়া।

তখন বাংলা আকাডেমির নির্দেশক বোধহয় বিশ্বজিত সেন (নাদুদা) ছিলেন আর উচ্চশিক্ষা বিভাগের একটা আধিকারিক রুবি শরণকে অধ্যক্ষ করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই মাঝে মধ্যে আকাডেমির মিটিংএ (বেশির ভাগ সময় ঝগড়া করতে) যেতাম। নাদুদার রেজিমেই অবশ্য আকাডেমি পত্রিকার প্রথম (ও শেষ) সংখ্যা বেরিয়েছিল এবং সেটা ভালো কাজ ছিল। তার আগে ইন্দিবর মুখার্জি আকাডেমি সমাচার বার করেছিলেন দু-তিন সংখ্যা কিন্তু সেগুলো বিশেষ কোনো কাজের ছিল না। আকাডেমির কাজে সেই যে গ্রহণ লেগেছিল নব্বইয়ের দশকে তার ছায়া আজ অব্দি সরে নি। এমনকি পরে যখন ডঃ দিলীপ সিংহকে (আমাদের আজকের ডাক্তারবাবু) অধ্যক্ষ করা হল, সঙ্গে নির্দেশক হিসেবে বিনিতা নারায়ণকে দেওয়া হল। তাঁকেও এ্যাকাডেমিক কোনো কাজ বোঝানো কঠিন ছিল। তবে অনেক জায়গায় তিনি নীরবভাবে উপস্থিত থাকতে অসহমত হতেন না, তাই দুহাজার এগারোর বিহার দিবসের কর্মসূচি, দুহাজার বারো আর তেরোর আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছিল পূর্ণেন্দু শেখর পাল (নিতুদা) তখন বোধহয় সহায়ক নির্দেশক বা কোষাধ্যক্ষ, তাঁরই দেখাশোনায়। সে সময়েই, বা বলতে গেলে আকাডেমির কার্য্যতঃ মৃত্যুর আগে দুটো প্রকাশন হয়েছিল, একটা গুরুচরণ সামন্ত স্মারক গ্রন্থ এবং দ্বিতীয়টা রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ত্রিভাষী সচিত্র জীবনী। প্রথমটায় পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল প্রমুখ আর দ্বিতীয়টায় ডঃ দিলীপ সিংহর। ও হ্যাঁ, সরকার বাংলা পাঠ্যবই ছাপে নি বলে টেক্সট বুক করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে পিডিএফ ডাউনলোড করে তার জেরক্স কপি স্কুলে স্কুলে বিলি করা হয়েছিল।

ঠিক যে সময়টায় এই শতকে বিহার বাঙালি সমিতির ঐতিহাসিক লড়াইটা শুরু হয়েছিল (যার চর্চা আমরা হামেশাই করি), বা তারও এক বছর আগে, যখন বর্তমান সভাপতি প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখনও আমি সমিতির কাজে পুরোপুরি যুক্ত হই নি। সম্ভবও ছিল না, ঘাড়ে ব্যাঙ্ক ইউনিয়নে তিন ধরণের সাংগঠনিক কাজ। তার ওপর প্রতর্ক যে আর বেরোবে না, সেটা আত্মস্থ করতেও সময় লেগেছিল। চাপও ছিল নানা রকম। শাশুড়ি অসুস্থ ছিলেন। মারা গেলেন কিছুদিন পর। তাঁর অসুখের সময় বেপরোয়াভাবে ছুটিতে থেকে কাজল নিজের চাকরি নিয়ে সমস্যায় পড়ল। ছেলে মেয়েরও পরীক্ষাপাশের সময়। আমার ঘাড়ে সংগঠনের কাজ ছাড়াও এল পার্টির রাজ্য কমিটির সদ্য শুরু হওয়া সাপ্তাহিক লোকজনবাদএর সম্পাদনার আদ্ধেক এবং প্রকাশনার প্রায় পুরোটা কাজ। ঝন্টুদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে কিছু বাড়তি কাজও ঘাড়ে নিয়েছিলাম। রাত্রিদির বইটার প্রুফ খুব যত্ন করে দেখেছিলাম বলে আরো কিছু বইয়ের প্রুফ দেখে দিতে বলল। তার মধ্যে এক বৌদ্ধ মঠের মোহান্তের লেখা বইয়ের কথা মনে আছে। পরবর্তীকালের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতে স্বর্গনরকএর মত উর্দ্ধ ও নিম্নলোকের ধারণা, কত হাজার দেবদেবীর ধারণা ইত্যাদি নিয়ে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক কিন্তু হাজার পৃষ্ঠার বই। লেখালিখিও বেশ জোর কলমে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রায় দুমাসে, দিলদার কে দোহে বইটি থেকে দিলদারের সবকটি দোহা অনুবাদ করলাম। নাটক লিখছিলাম। দীর্ঘ কয়েকটি কবিতার ওপর কাজ করছিলাম। শাশুড়ি যখন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন, চিকিৎসা চলছে, তখনই গুরুচরণদা বিশ্বভারতীর এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপককে নিয়ে ব্যাঙ্কে এলেন যে ইনি রবীন্দ্রনাথের একটা নতুন অনুবাদ সঙ্কলন তৈরি করবেন, তুমি পুনশ্চ-এর কবিতাগুলো অনুবাদ করা শুরু করে দাও। মাঝে গুরুচরণদা ছিলেন, নইলে এত সহজে বিশ্বাস করতাম না। সাত-আটটা কবিতা অনুবাদ করেও ফেললাম। যা ভেবেছিলাম। বিশ্বভারতী হোক বা প্রকাশক হোক, যে-ই ছিল  সেই অধ্যাপকের সামনে, সে প্রজেক্টটা ফাইনান্স করতে রাজি হয় নি কাজেই কাজ হবে না। আমিও আর এগোলাম না।

তবে বিহার বাঙালি সমিতির লড়াইয়ে কর্মী হিসেবে আমি তখন থেকেই অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলাম। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কেননা, অন্যান্য সংগঠনে শীর্ষ নেতৃত্বে থেকে তখন আমি ভেদাভেদ মিটিয়ে শ্রেণীগত ভাবে এক থাকার কথা বলছি। অথচ বাংলাভাষার লড়াইয়ে, দুঃখজনক ভাবে শুধু বাঙালি হয়েই থাকছি। দুঃখজনক বলছি কেননা বার বার বলেও, যে এটা সাংবিধানিক অধিকারের লড়াই, যারা বাংলাভাষী নয় তাদেরও পাশে এসে দাঁড়ানো উচিৎ, কেউ দাঁড়ায় নি। বরং তারা, নব্বইয়ের দশকের বৈশিষ্ট্য আত্মপরিচয়ের রাজনীতি’, যাতে বিহারের রাজধানীর মাঠে ময়দানে প্রতিদিন বিভিন্ন জাতের মেরুকরণ চলছে তাতেই, সেই ধরণেরই এক মেরুকরণ হিসেবে, আমাদেরকেও পরিগণিত করছিল। কাজেই অনেকের চোখে দ্বিচারী হয়েও, নিজের চোখে দ্বিচারী নই, এই মীমাংসায় পৌঁছোবার পরই আমি অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলাম। অবসর নেওয়ার পর এবং ক্রমে ক্রমে এখন পুরোপুরিই বিহার বাঙালি সমিতির নেতৃত্বে শামিল হয়ে রয়েছি।   

দৈনন্দিনে যুগবদল

দুহাজার ছয়ে ব্যাঙ্ক টিবিএম হওয়ার এক মাসের মধ্যে ওভারড্রাফট একাউন্ট থেকে ধার নিয়ে আমি বাড়ির জন্য একটা ডেস্কটপ কিনে ফেললাম। ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩তে কম্পিউটারাইজেশনের বিরুদ্ধে হড়তালের ডাক, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বেফির প্রথম আহ্বান ছিল। সে সময় পাটনা রেলওয়ে জাংশনের সামনেটা আজকের মত গ্যাঞ্জাম ছিল না। ফ্লাইওভারও যায় নি ওপর দিয়ে। একটা মোটামুটি সুন্দর পার্ক ছিল এবং মাঝখানে জহরলাল নেহরুর একটা অতি বাজে প্রতিমা ছিল, তাও আবার আঙুলের ডগায় পায়রা নিয়ে। পার্কের বাইরের দিকটা ঘিরে এক চিলতে জায়গা ছিল যাতে ছোট ছোট ব্যবসা বসত যেমন, জুতোপালিশ, সিনেমার গানের বই বিক্রি ইত্যাদি এবং বিশেষকরে পূর্বদিকে বিভিন্ন সংগঠনের ধরনা হত মাঝে মধ্যে। হড়তালের প্রস্তুতি অভিযানে সেখানেই ধরনা হল সারাদিনের। বেশ কিছু পোস্টার এঁকেছিলাম। দীপনের সঙ্গে কম্পিউটার-প্রসঙ্গ নিয়ে লিখিত বাদ-বিবাদও হয়েছিল। সে সময় আমরা আগের রাজনৈতিক গ্রুপটা থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ষাট পার্টির দলিল, আশি পার্টির দলিল, জার্মানিতে নাজিবাদের উদয়, সিপিআই, সিপিআইএম-এর কর্মসূচি, এম-এল-এর লাইন ইত্যাদি পড়ে একটা জায়গায় পৌঁছোতে চেষ্টা করছি।    

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কেউ রোধ করতে পারে না। নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলে আজ বা কাল তা দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করবেই, ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম এটাই ইত্যাদি, ইত্যাদি। এই চাউর কথাগুলোর মধ্যে সবসময় আজ বা কাল ব্যবহৃত হয়। আগে যখন একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠির সঙ্গে ছিলাম, তখনও ব্যাপারটা নিয়ে তর্ক হত। কোনো হিন্দি পত্রিকা, দিনমান বা সাঁচায় সেই ১৯৭৩-৭৪এ দেখেছিলাম খবর, পাঞ্জাবের কৃষকেরা হার্ভেস্টার কম্বাইন থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ফেলে রেখে, বিহার থেকে যাওয়া দিহাড়ি মজুরদের কাজে নিয়োগ করছে। কেননা হার্ভেস্টার কম্বাইনের প্রতি হেক্টেয়ার চালন ব্যয় থেকে প্রতি হেক্টেয়ারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দিহাড়ি মজুরের মোট দেয় মজুরি কম। অর্থাৎ, পূঁজি যদি মুনাফার প্রয়োজনে আধুনিক থেকে পশ্চাৎপদ হতে পারে, নতুন প্রযুক্তি আজ ব্যবহার না করে অনির্দিষ্ট কালএর জন্য স্থগিত রাখতে পারে, একটা তথাকথিত ওয়েলফেয়ার স্টেটে, শ্রমিকশ্রেণীও লড়াইয়ের জোরে সেটা করতে পূঁজিকে বাধ্য করতে পারে, অন্ততঃ চেষ্টাটাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না কিছুতেই।

কম্পিউটার নিয়ে লড়াই শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সভায়, সম্মেলনে আবার সেই ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম ইত্যাদি বলে, লুড্ডাইটদের উদাহরণ পেশ করে লড়াইটাকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা দেখলাম। যদিও তখনও কম্পিউটার কাকে বলে জানা তো দূরের কথা, অটোমেশনও চোখে দেখিনি। কলকাতায় ইলাকো হাউজে জীবনবীমার লড়াই, গ্রিন্ডলেজে ব্যঙ্ককর্মীদের লড়াই সব শোনা কথা। সেই শেখরের বিয়েতে ডিগওয়াডির ফুয়েল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের কলোনিতে গিয়েছিলাম। আমাদের কৌতূহল দেখে তার শ্বশুরবাড়িরই কেউ ল্যাবে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে কিছু দুর্বোধ্য মেশিন দেখেছিলাম সেই প্রথম অটোমেটেড মেশিন দর্শন। পরে পাটনার রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নোট গোনার, বাছাই করার, রিপ্যাকিং করার বড় বড় মেশিন এল, গেটে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছি কিন্তু চোখে দেখি নি। কিন্তু লড়াইটা যতখানি দায়বদ্ধতায় লড়েছিলাম, যখন মেশিনের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া উপায় রইল না, ঠিক ততখানি দায়বদ্ধতায় নিজের জীবনে সেই মেশিন নিয়ে এলাম। প্রথম ডেস্কটপে কাজ করতে শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে ল্যাপটপও কিনে ফেললাম, শুধু অভ্যাস বদলানোর জন্য। কাজ করি বা না করি, ল্যাপটপের ভারটা বওয়া অভ্যাসে আনলাম কুমহরারের বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি ব্রাঞ্চ, বিকেলে ইউনিভার্সিটি ব্রাঞ্চ থেকে পাটনা মেন বা ইউকো, একজিবিশন রোড বা পার্টি অফিস। তখনও পিঠের ব্যাগপ্যাক চলনে আসে নি। সাইড ব্যাগেই নিয়ে যেতাম। আর বোধহয় ২০১১-১২ থেকে হাতে লেখার কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। অলক্ষ্যে কোনো মাস্টারমশাই বোধহয় বললেন, বাঁচলি, যেমন কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা ছিল তোর!

অবসর নেওয়ার পর যখন অতি উৎসাহে প্রথম প্রথম প্রতিদিন, মোটামুটি অফিসের সময় পার্টির রাজ্য কমিটির দপ্তরে গিয়ে বসতে শুরু করলাম, ল্যাপটপটা সঙ্গে থাকত। পরে যখন দেখলাম, আমার ওপর যে কাজের ভার ন্যস্ত হয়েছে সেটা অফিসে বসে না করলেও হয়, বরং বাড়িতে বসে করলেই বেশি সুবিধে হয় তখন অবশ্য অভ্যেসটা ছেড়ে গেল। তবে যেহেতু পড়া এবং লেখা, দুটোরই একমাত্র সম্বল এখন ল্যাপটপ তাই লম্বা সফরে আজকাল আমি রীতিমত কাজের মানুষসেজে যাই। চল্লিশ বছরের চাকরি জীবনে এত কাজের মানুষ হয়ে কখনো যাই নি। শুরুর দিকে একটু বাধো বাধো লাগত। মনে হত ট্রেনে ল্যাপটপ-ফ্যাপটপ বার করে যেন আমি শো করছি! বারো-তেরো সালেই একবার ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার সময় সে ভাবটা কেটে গেল। সামনের সিটে একদল ছেলে বসেছিল। মিস্ত্রি মনে হচ্ছিল হয়ত কাজ খুঁজতে যাচ্ছে। সকালে উঠে জানলার ধারের ছেলেটি ঝোলা থেকে একটা জলের বোতল বার করল। বস্তুতঃ ওই বোতল দেখেই কথা শুরু করলাম আমরা, মানে আমি আর কাজল। বোতলটায় ছোলা ভরা। বোঝাই যাচ্ছিল রাতে ছোলা ধুয়ে, একটু একটু করে আন্দাজ মত বোতলে ভরেছে। তারপর জল ঢেলে বন্ধ করে, ঝোলায় ভরে ট্রেনে চেপেছে। সকালে সে ছোলা ফুলে ভরে উঠেছে বোতল। দুমুঠো দুমুঠো করে খেয়ে পাঁচ-ছ জনের জলখাবার হয়ে গেল। গ্রেট আইডিয়া। পরের বার থেকে আমিও তাই করা শুরু করলাম, বোতলে না হোক শিশিতে। অথবা একদিন আগে ভিজিয়ে, তুলে রুমালে বেঁধে। সে যা হোক, কথা হতে শুরু করল তারা করে কী। বলল ছুতোর মিস্ত্রির কাজ। এখন যাচ্ছে তিরুঅনন্তপুরম। এর আগে ঠিকেয় কাজ করে এসেছে দুবই এবং তার আগে কুয়ালালামপুর। হাসি মুখে শুনে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না স্বাভাবিকভাবেই এইরকম নোংরা জামাকাপড়, হাওয়াই চপ্পল, কাঁচা ছোলায় জলখাবার । কথায় কথায় ল্যাপটপ বার করল। সেই ঝোলা থেকেই, গামছা দিয়ে মোড়া। একটু পুরোনো মডেল, ভারি। ফাইল খুলে ছবি দেখাতে শুরু করল দুবইয়ের হোটেলে কী ধরণের ফার্ণিশিংএর কাজ করেছে, কুয়ালালামপুরের রিসর্টে কী ধরণের এবারে তিরুঅনন্তপুরমে কী ধরণের কাজ করবে সব কাঠের কাজের ডিজাইন! জিজ্ঞেস করলাম, পাসপোর্ট, ভিসা পাসপোর্ট দেখালো, বলল ভিসার ব্যবস্থা ঠিকেদার করে। যাক! আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমিও তাহলে ল্যাপটপ বার করতে পারি কেউ ফাঁটবাজ বুড়ো বলবে না।             

রবীনদার সঙ্গে দেখা

কলকাতায় গেলে ডালহাউসি পাড়ায় দুচারটে জায়গাতেই যেতাম এবং দীপনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে, সেখানেই রাস্তা না পেরিয়ে জিপিওর চৌমাথাটা অব্দি এসে রাস্তা পেরুতাম। সেবার পেরিয়ে অন্যদিকের ফুটে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিগরেট খাচ্ছি আর বাসের লম্বা লাইনটার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ লাইনের পিছনদিকে দেখি রবীনদা দাঁড়িয়ে। সেটা বোধহয় ২০০৭ বা ৮ সাল। তার প্রায় ন-দশ বছর আগে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের অফিসে গিয়েও তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা করেছিলাম। চা-টা খাওয়ালেও বিশেষ কাছে ঘেঁষতে দেন নি। তারপর তো অবসর নিলেন, হারিয়ে গেলেন। বহুবার দীপনকে বললাম ব্যাঙ্কে গিয়ে একটু খোঁজ নাও কোথায় থাকেন, ও খোঁজ পেল না।

হঠাত সেদিন বাসের লাইনে দেখে চেপে ধরলাম। বললেন যাদবপুরে, এইট বি বাসস্ট্যান্ডের পিছনে কিন্তু ও তুমি খুঁজে পাবে না। আমারও তখন যাদবপুরের দিকে যাওয়া হচ্ছিল না (একসময় নিয়মিত গেছি সেন্ট্রাল রোডে মামার বাড়িতে; আজকের দিনটার জন্য ছাপার সময় মাঝে মধ্যে গিয়ে প্রুফ দেখা, বই ডেলিভারি নেওয়া সব ওখান থেকেই করেছি)। কাজেই আবার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।

এক বছর পর হবে। নিজের ব্যাঙ্কের মেন ব্রাঞ্চে সন্ধ্যেবেলা বসে ইউনিয়নের সাথীদের সঙ্গে কিছু আলোচনা করছি, প্রায় আটটা বাজে, দেখি গেট দিয়ে অবিশ্বাস্য দুটো পরিচিত চেহারা ঢুকছে। একজন আমার এদিককার জীবনের পাটনাইয়া বঙ্গালি কাউন্টারপার্ট দেবদত্ত লাহিড়ী, সংক্রমণ পত্রিকার সম্পাদক, রসিক মানুষ, তার মূল শহর ভাগলপুরের ছেলেদের প্রিয় নাটকপাগল মম-দা। যদিও আমরা একে অন্যের দিনযাপনে কালেভদ্রে ভুতের মতই আবির্ভূত হই। আর অন্যজন তার চেয়েও বেশি অবিশ্বাস্য রবীনদা। রবীনদা শুধু যে এলেন তাই নয়, ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে ডাকবাংলো মোড়ে গিয়ে একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসে দুঘন্টা গল্প করলেন। ফোন নম্বর দিলেন। আমার আকাশ তো আবার ভরে গেল প্রায় পঁচিশ বছর পর। শীতের রাতে রবীনদাই চেনাতেন, ওই দেখ, ওটা বৃশ্চিক, দক্ষিণ-পূর্ব আকাশ জুড়ে, ওই তারাগুলো রেখায় রেখায় মেলাও কালপুরুষের তরোয়ালের ডগার তারাটা দেখছ? ওটা বাইনারি স্টার ঐ দেখ, কমলা রঙের তারাটা, রোহিণী আঙুরের গুচ্ছের মত ওটা লঘু সপ্তর্ষি আরেকটু রাত হলে চেনাতেন মিথুন ভোরের দিকে সিংহ । কোনোদিন লোড শেডিংএ শহর অন্ধকার হলে পরিষ্কার আকাশে ফুটে উঠত আমাদের গ্যালাক্সির প্রান্তদেশ মিল্কিওয়ে। রবীনদা চেঁচিয়ে উঠতেন, আহা আহা, দেখ, সত্যিই দুধের নদী

কথা দিয়ে গিয়েছিলেন শিগগিরই আবার আসবেন। চলে এলেন। নিজের দুটো পেন্টিংএর রঙীন জেরক্স করিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে এলেন। সহজ সরল ল্যান্ডস্কেপ, একটা সমুদ্রতট, নারকেলবীথি আর একটা পাকা ধানের ক্ষেত; দুটোরই দিগন্তরেখায় কালোর গাঢ়-গাঢ়তর হয়ে যাওয়ায় রবীনদা-টিপিক্যাল অজানার স্পর্শ। আর তার সঙ্গে দুটো পুরোনো দিনের পেন্টিং, অরিজিন্যাল, তবে ল্যামিনেট করা। একটা আমার পোর্ট্রেট আর একটা কুয়াশাচ্ছন্ন অরণ্য। উঠলেন যেখানে উঠতেন, ভাগ্নের বাড়ি। অতগুলো বোঝা বয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন, খাবার খেলেন। বললাম জীবনদা তো আর পাটনায় নেই, চলুন পূর্ণেন্দুদার সঙ্গে দেখা করে নেবেন; আপনারা চিনতেন তো একে অন্যেকে! বাহাদুরপুরের ফ্লাইওভারটা তখন সদ্য তৈরি হয়েছে। হেঁটে পেরুতে পেরুতে দীপনকে ফোন করলাম। সে তখন আন্দামানে, বলল হ্যাভলক বা কোথাও যাচ্ছে। আলোকজি বোধহয় ছিলেনও না আর প্রসঙ্গটাও তুললাম না। তর্কটা তো প্রথমে ওই দুজনের মধ্যেই শুরু হয়েছিল। লেনিনের একটা ছবি নিয়ে! লেনিনের মুখ এত ক্লিষ্ট, ছায়াচ্ছন্ন কেন? খুবই প্রাসঙ্গিক এবং ন্যায়সঙ্গত তর্কবিতর্ক। অনেক ভালো জিনিষ বেরিয়ে আসতে পারতো সঠিক পথে এগোলে। কিন্তু, ধনঞ্জয়জী এবং আরো সবাই শামিল হয়ে যাওয়ার পর বিতর্কটা চলে গেল ব্যক্তিজীবন নিয়ে সমালোচনার দিকে। আর সে সময়কার আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনটার কাজের ধরণধারণ নিয়ে যে আরেকটা সুস্থ বিতর্ক সম্ভাবিত হয়ে উঠছিল, সেটাও তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে শেষে আমাদের দুভাগ করে দিল।

পূর্ণেন্দুদাও খুব খুশি হয়েছিলেন। রবীনদা গুরুচরণদার সঙ্গেও দেখা করতে চাইছিলেন। যখন জানলেন যে তিনি আজকাল ব্যাঙ্গালোর বা আনন্দে থাকেন, আমায় ঠিকানাটা দিতে বললেন। মনে নেই শেষ অব্দি পাঠাতে পেরেছিলাম কিনা।

তার কদিন পর আমিও গেলাম কলকাতায়, বিশেষ করে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। এক অপূর্ব বেলা কাটলো। বিথোফেনের নাইন্থ সিম্ফনি, মাংসভাত, ছবি, কবিতা, অনেক কথা। ফেরার সময় পাটনায় করা অনেকগুলো স্কেচ ও ড্রয়িং আমাকে দিয়ে দিলেন।

তারপরেও বেশ কয়েকবার কলকাতায় গিয়ে দেখা করেছি। ডালহাউসির অফিস পাড়াতেও ডাকিয়ে এনেছি কথা বলার জন্য। 

কিন্তু দুঃখের কথা, যতদিনে সম্পর্কটাকে আবার সহজ করে তুলতে পারলাম, ততদিনে বয়সের ভারে বিস্মৃতির আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। সেদিন ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আছেন, কলকাতায় না পুনায়। শুনলাম বৌদিকে জিজ্ঞেস করছেন, এ্যাই, আমরা কোথায় আছি? তখন বৌদিকেই ফোনটা দিতে বললাম।

রবীনদার সঙ্গে তাঁর গ্রামে গিয়েছিলাম একবার সেই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বইমেলা উপলক্ষে। রবীনদা তখন গড়িয়ায় উঠতেন। এক উঠোন জুড়ে কয়েকটি কুঁড়েঘর। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। তারই মধ্যে তাঁর ছেলেমেয়ে দুটোও। তোলা ছবিটা এখনো রয়েছে। সেবারই তাঁর সঙ্গে তাঁর গ্রামে গিয়েছিলাম। ওঁয়াড়ি। তাঁর গ্রাম মানে তো বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর গ্রাম। তবে তখন তার গুরুত্ব বোঝার মানসিকতা ছিল না। শুধু একটা পড়ন্ত গ্রাম দেখেছিলাম দুপুরবেলায়। ডাইরিতে লিখেছিলাম,

বিরাট, গোল, রূপকথার বটগাছটার শিকড়ের ওপর বসলাম। দূরে ওঁয়াড়ি গ্রাম। সামনে আদিগন্ত শূন্য, শুধু মাঝে বড় রাস্তার সরু সুতোটা, আর তার দুপাশে দু-একটা ঘর বাড়ি। পিছনেও আদিগন্ত শূন্য। বাঁদিকে দূরে অন্য একটা গ্রাম। পাতায় সর সর শব্দ করে প্রাচীন হাওয়া দিচ্ছে মাঘের দুপুরে।

ছেলেটি এসে বসলো, ও, আপনারা! আমি ভাবলাম পুলিস, গোয়েন্দার লোক। দুএকদিন আগে এখানে ডাকাতি ধরা পড়েছে।     

নয়া জদ্দোজহদ

কাজলের মা, মাসি এবং আমরা সেই বি.এম. দাস রোডের বাড়িতে থাকার সময় থেকেই এক সঙ্গে হয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই একসঙ্গে মাসীর প্রথম এ্যালটমেন্ট, সৈদপুর ক্যাম্পাসে ব্যাচেলর্স কোয়ার্টার্সে উঠলাম; তিনি উইমেন্স কলেজে অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৯৫এ আমার ফ্ল্যাট খরিদের পর রেললাইন পেরিয়ে দু-আড়াই বছর সে ফ্ল্যাটে থাকলাম। তারপর ১৯৯৮এ আবার সৈদপুর প্রফেসর্স কোয়ার্টার্সের ফ্ল্যাটে যেতে হল, কেননা ছেলে তখন ক্রিকেটের কোচিংএ ভর্তি হয়েছে। বারো বছর বয়সে কুমহরার থেকে সাইকেলে করে গুমটি পেরিয়ে তাকে স্টেডিয়ামে যেতে দেবে না তার দিদা। তখনও বাড়ির সামনের রাস্তাটা বাই-পাস, সারাদিন হুড়মুড় করে ট্রাক, বাসের আসাযাওয়া। ২০০২এ মাসির অবসরের পর তিনের শুরুতে অবশেষে আবার এসে কুমহরারের ফ্ল্যটে থিতু হলাম।

এই ফ্ল্যাটে থাকতেই বোরিং রোডে বোনের বাড়িতে বাবা মারা গেলেন। তিন বছর পর কাজলের মা মারা গেলেন। আর এ বছর কাজলের মাসী মারা গেলেন।

২০১১ সালের শেষে পাটনা হাইকোর্ট থেকে আমার মামলার আয় বেরুলো। ১৯৯০এ মামলা রুজু হওয়ার একুশ বছর পর আমি বেকসুর খালাস ঘোষিত হলাম। তার আগেই, ইউনিয়নের লড়াইয়ে চার্জশিট, এনকোয়ারি ইত্যাদির পর একটা সেন্সর পেয়ে খালাস হয়ে গেছি। কাজেই হাল্কা মনে, অবসরগ্রহণের পনেরো দিন আগে নিজের ব্যাঙ্কের সম্মেলন করিয়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব-মুক্ত হলাম। আর অবসরগ্রহণের পর কিছুদিনের মধ্যে ফেডারেশন এবং অন্য সমস্ত জায়গায় মুখ্য দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। বসে গেলাম সেই সমস্ত মোটা বইগুলো পড়তে, যেগুলো বহুকাল যাবত কিনে রাখা আছে কিন্তু পড়া হয় নি। লেখালিখির কাজেও, সারাটা দিন আমায় বাধা দেওয়ার মত কোনো ব্যস্ততা নেই।

২০১৩ সালে কাজলের মামলারও রায় বেরুলো। সসম্মানে সে কলেজে নিজের জায়গায় যোগ দিল সাত বছর পর। মেয়ে ২০১১তেই ব্যাঙ্গালোরে চলে গেছিল; ওখানেই পিজিতে থেকে নতুন কিছু কোর্স করবে এবং চাকরি করবে বলে। ছেলেও তখন ছোটমোটো চাকরি করছে এনজিওতে।

বেশ কয়েকটি মোটা বই অবসরের পর পড়ব বলে রেখে দিয়েছিলাম। সেগুলো প্রায় সব নামিয়ে এক এক করে পড়ে ফেললাম। বেশ কয়েকটা গল্প বা ওই ধরণেরই কিছু স্কেচ ডাইরির পাতায় বা আলাদা খাতায় খসড়া করা ছিল। কিছু ফাইনালও ছিল। সেগুলো সব ল্যাপটপে ওয়র্ডফাইল করে জমা করলাম। এবার আমি পুরোপুরি ডিজিট্যাল যুগের কারবারি। যে বই কিনি নি এবং এখন কলকাতায় গিয়ে কেনার সুযোগও নেই, সেগুলো পিডিএফে নামিয়ে পড়া শুরু করলাম। বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে বসে পড়ার আনন্দ সেভাবে না থাকলেও অভ্যাস করে ফেললাম পড়া, দাগ দেওয়া, পাশে নোট রাখা, দুটো ওপর-নিচে খুলে অনুবাদের কাজ করা ইত্যাদি। 

২০০৭-০৯ এর আন্দোলন থেকেই বেশ মেতে উঠেছিলাম বাঙালি সমিতি আর বাঙলা আকাডেমির কাজে। মাথার ওপর নিতুদা, ডাক্তারবাবুর মত মানুষেরা। পূর্ণেন্দুদা তো ছিলেনই। মাঝে মধ্যে গুরুচরণদাও চলে আসছেন আনন্দ বা ব্যাঙ্গালোর থেকে। গুরুচরণদা একজন দারুণ সংগঠক ছিলেন। প্রত্যেকের মনে হত তাকেই বেশি ভালোবাসেন গুরুচরণদা। আমারও মনে হত। পাটনার বাড়ি বিক্রি করার আগে একটা কাঠের বই-আলমারি (আমার খুব সাধের জিনিষ) আর একগাদা বইও আমায় দিয়ে গিয়েছিলেন। ওদিকে পূর্ণেন্দুদার কথায় টেক্সটবুকের কাজে বীথিকাদিও আমায় ডাকছেন (এক রাতে পীর আলি খাঁর ওপর একটা রচনা লিখে জমা দিয়ে এসেছিলাম পাটলিপুত্র হোটেলে, বীথিকাদির হাতে)। মানে, সাহিত্য কম হোক, মাতৃভাষাটা আকন্ঠ পান করতে পারার আনন্দে বুঁদ হয়েছিলাম। ধরনায়, মিছিলে, সমাবেশে অংশগ্রহণ করায়, স্মরণিকা, ছোট পুস্তিকা বা ব্যানার ইত্যাদি তৈরি করায় ঠিক ততটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম যতটা ইউনিয়নের কাজে।

তখনই কলকাতায় দীপন একটি পত্রিকার সম্পাদনে যোগ দিল। সে-ও মাঝে মধ্যে কবিতা বা গদ্য চেয়ে পাঠাতে শুরু করল আমার কাছে। ২০০৯এ অনেকটা জেদের বশে, নিজের উদ্যোগে বড়বাবু ছেপেছিলাম। ব্যাঙ্কে বলতে গেলে পানিশমেন্ট-ট্রান্সফারে চলে গেছি ফুলওয়ারিশরিফ শাখায়, ইউনিয়নে তার খারাপ প্রভাব পড়ছে, এনকোয়ারি চলছে, কাজেই সেদিকেও সাবধান থাকতে হচ্ছে, ১৯৯৭এর পর কিছু বেরোয়ও নি। এমনকি পত্রিকায় কবিতা-গল্প ইত্যাদি বেরুনোও দূর-অস্ত কেননা, আমার কলকাতা যাওয়া-আসাও হয় না সেরকম আর কোনো পত্রিকা সম্পাদকের ঠিকানাও আমার কাছে নেই। তাই, এমন একটা কিছু লিখতে শুরু করেছিলাম যা, আমার মনে হয়েছিল ভিন্ন ব্যাঙ্কের মত একটি শিল্পে, স্বীকৃত সংখ্যাগুরু সংগঠনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ-কর্মচারী বিরোধ-নিষ্পত্তির একটা স্থায়ী অবয়বের উপস্থিতির প্রেক্ষিতে একটি উদীয়মান প্রতিস্পর্ধী সংগঠনের কাজকর্ম একটি নতুন কর্মীর চোখ দিয়ে দেখানো। কিন্তু বইটা গুরুচরণদার হাতে দেওয়ার পরের দিনই বললেন, রাত্রেই পড়ে ফেললাম হে! ঠিক হয় নি। পরিতৃপ্তি পেলাম না। পূর্ণেন্দুদাও বললেন, উত্তরণ ঘটেনি, বেশির ভাগ গল্পে। কিছুদিন পর, রবীনদাকেও বইটা দিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে পাঁচ পৃষ্ঠার চিঠিতে আমায় তুলোধোনা করলেন। বুঝতেও পারছিলাম গলদগুলো। দীপনের কবিতা চেয়ে পাঠানো আর ২০১১-১২ নাগাদ প্রিয় পঁচিশ সিরিজে আমারও সঙ্কলন বার করার উদ্যোগ নেওয়ায় মনটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল সে সময়।

 ...............