Wednesday, March 27, 2024

ভাষাগত সংখ্যালঘু ও বাবাসাহেব

ভাষাগত সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে দেশের সংবিধানের ধারা সংখ্যা ২৯এর প্রসঙ্গ মাঝে মধ্যেই উঠে আসে। ধারাটি তৃতীয় অধ্যায়, ‘মৌলিক অধিকার’এ আছে। যদি আমরা বাংলায় অনুদিত, মুদ্রিত (তৃতীয় সংস্করণ, ২০২২; প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণ যথাক্রমে ১৯৮৩ এবং ১৯৮৭তে প্রকাশিত হয়েছিলো) সংবিধানটা দেখি, দেখবো যে ধারাটির আগে একটা উপশিরোনাম দেওয়া আছে ‘কৃষ্টি এবং শিক্ষা বিষয়ক অধিকার’। ধারাটির অনুচ্ছেদ (১) অথবা (২)য়ে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা (একবচনে বা বহুবচনে) কোথাও নেই। প্রথম অনুচ্ছেদে আছে ‘নাগরিকগণের কোনো বিভাগ’। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ‘বিভাগ’ও নেই; সোজাসুজি ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে ‘কোনো নাগরিক’। কিন্তু সাইডনোটে (ব্যাখ্যামূলক উপশিরোনামে) লেখা আছে ‘সংখ্যালঘুবর্গের স্বার্থরক্ষণ’। যখন নাকি ধারা সংখ্যা ৩০এ ‘সংখ্যালঘুবর্গ’ শব্দটা সাইডনোটেও আছে আর অনুচ্ছেদের কথ্যেও আছে।

কেন? কী করে হলো?  

৮ই ডিসেম্বর ১৯৪৮এ, সংবিধান-সভায় তর্কবিতর্ক চলছিলো। দিনের শেষে ড্রাফটিং কমিটির প্রধান ডাঃ আম্বেদকর উঠে দাঁড়ালেন। কেন “মৌলিক অধিকার কমিটির অনুচ্ছেদ ১৮র ভাষা ড্রাফটিং কমিটি বদলেছে” তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে গিয়ে বললেনঃ

“মূল ‘মৌলিক অধিকার’এর দেওয়া অনুচ্ছেদটা পড়লে লক্ষ্য করবেন যে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা সেভাবে ব্যবহৃত হয় নি যেভাবে, আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব, চাকরিতে প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি কিছু রাজনৈতিক রক্ষাকবচ দেওয়ার জন্য শব্দটা ব্যবহার করতে আমরা অভ্যস্ত। শব্দটি শুধু শব্দটির পরিভাষাগত অর্থেই ব্যবহার করা হয় নি। তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে যারা পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক এবং ভাষিক অর্থে সংখ্যালঘু। উদাহরণার্থে, এই ধারা সংখ্যা ২৩এর উদ্দ্যেশ্যাধীন, যদি ম্যাড্রাস থেকে কিছুসংখ্যক মানুষ কোনো কাজে বোম্বাইয়ে চলে আসে এবং থেকে যায়, তারা পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু না হলেও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু হবে। সমান ভাবে, যদি কিছু সংখ্যক মারাঠি মহারাষ্ট্র থেকে গিয়ে বাংলায় বসবাস করতে শুরু করে, পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু না হলেও তারা বাংলায় সাংস্কৃতিক ও ভাষিক সংখ্যালঘু হবে। এই ধারাটি সংস্কৃতি, ভাষা ও লিপিগত বিষয়ে শুধু পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘুদেরই রক্ষাকবচ দেয় না – যেমন আমি এক্ষুনি ব্যাখ্যা করলাম – সংখ্যালঘুর বৃহত্তর অর্থে দেয়। সে কারণেই আমরা ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটা সরিয়ে দিয়েছি। কেননা আমরা অনুভব করেছি যে শব্দটা সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যায়িত হতে পারে, যখন নাকি, ধারা সংখ্যা ১৮* গ্রহণ করার সময় এই সংবিধান-সভার উদ্দেশ্য ছিলো ব্যাপকতর অর্থে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটাকে ব্যবহার করা, যাতে তাদেরও সাংস্কৃতিক রক্ষাকবচ দেওয়া যায় যারা পরিভাষাগত অর্থে সংখ্যালঘু না হলেও সংখ্যালঘু।”

[কন্সটিচ্যুএন্ট এসেম্বলি অফ ইন্ডিয়া ডিবেটস (প্রসিডিংস) – ভল্যুম VII]

এবার, ২০১১র জনগণনা (সর্বশেষ জনগণনা) অনুসারে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বাংলাভাষাভাষী জনতার সংখ্যা দেখা যাক। দুটো রাজ্যে তাদের সংখ্যা ৫০%এর বেশি – পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা (যথাক্রমে ৮৬.২২% এবং ৬৫.৭৩%)। দুটো রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২৫%এর বেশি – আসাম ও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপসমূহ (যথাক্রমে ২৮.৯২% এবং ২৮.৪৯%)। যদিও আসামের ক্ষেত্রে এই প্রতিশত হিসাবে বরাক উপত্যকায় তাদের ৮০.৮৪% সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা যায় না। ঝাড়খন্ডে আর মিজোরামে বাংলাভাষী জনতা যথাক্রমে ৯.৭৩% এবং ৯.৮৩%। নাগাল্যান্ড ও মণিপুর বাদে বাকি সব পূর্বোত্তর রাজ্যগুলোয় বাংলাভাষী জনতা ৫%এর বেশি। নাগাল্যান্ড ও দামন-দিউয়ে তাদের প্রতিশত যথাক্রমে ৩.৭৮ এবং ২.১৫। উত্তরাখন্ড, দিল্লি, ওড়িশা, সিকিম আর মণিপুরে বাংলাভাষী জনসংখ্যা ১%এর বেশি। ভারতের বাকি কুড়িটা রাজ্যের/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সবকটিতেই বাংলাভাষী জনসংখ্যা আছে কিন্তু ১%এর কম। বিহারকেও তাদেরই মধ্যে রাখা হয়েছে – ০.৭৮%।

বোঝাই যায় যে নিজের, পরিবারের এবং রুজিরুটির সুরক্ষার তাগিদে অনেকেই ভাষাগত পরিচয় লুকিয়েছে। অথবা, যা সচরাচর হয় – জনগণনা আধিকারিকেরা প্রশিক্ষণের সময় কর্মীদের কঠোর (মৌখিক) ‘পরামর্শ’ দেয় যে অরিজিনাল ফর্ম ভরাবে না, শুধু স্বাক্ষর করিয়ে নেবে; একটা নোটবুক রাখবে, তাতে ডেটাগুলো নোট করে নেবে। পরে বাড়িতে এসে ফর্মটা ভরে নেবে। তারা সেটায় আরেকটু শর্টকাট করে। নাম, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদি নোট করে নেয়। ভাষাটা খালিই থেকে যায়। পরে বাড়িতে বসে লাইন দিয়ে ‘এইচ’, ‘এইচ’, ‘এইচ’ ভরে দেয়। সবাই হিন্দিভাষী হয়ে গেল!

বিহারে, ১৯৯০এর ‘বিহার রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগ’ গঠন সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী ধর্মগত সংখ্যালঘু হিসেবে যেমন ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন, সিখ, খ্রিস্টান ইত্যাদি গণ্য, ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে বাংলা গণ্য। অর্থাৎ ধর্মগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা একই আয়োগে একসাথে ন্যায়ের জন্য দরবার করতে পারে। সরকারের তরফ থেকেও একই বিভাগের মাধ্যমে সংখ্যালঘু কল্যাণের কাজ এবং একই আয়োগের মাধ্যমে সে-সম্পর্কিত অভিযোগের নিরাকরণ হয়।

সময়ে সময়ে বিভিন্ন দাবিতে সরকারের তরফ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বিহার বাঙালি সমিতি পাটনা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছে। পক্ষে রায়ও পেয়েছে। কারণ – প্রথমত ভাষাগত সংখ্যালঘুর মর্যাদা এবং দ্বিতীয়ত সংবিধানের ধারা সংখ্যা ২৯।  

কেন্দ্রীয় স্তরে কিন্তু তেমনটা নয়। দিল্লিতে একই সময়ে যে সংখ্যালঘু আয়োগ তৈরি হয়েছে, সেটা শুধু ধর্মগত সংখ্যালঘুর কাজকর্ম দেখে। ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য একটা আয়োগ নয়, আয়ুক্ত (কমিশন নয়, কমিশনার) বসিয়ে দেওয়া হয়েছে দিল্লি থেকে দূরে, এলাহাবাদে। সে আয়ুক্তের তরফ থেকে মোটা মোটা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় সরকারের কাছে। সেই প্রতিবেদন পড়ে জানতে পারি আয়ুক্তের প্রতিনিধি আমাদের রাজ্যেও এসেছিলো, সরকারি গেস্টহাউজে থেকেছিলো, সরকার যে তথ্য দিয়েছে, পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেছে। আমরা, বিহারের বাংলাভাষীরা কখনো জানতেও পারিনা তেনারা কখন আসেন এবং কখন চলে যান। কখনো সরকারকে বলেনও না যে আমরা বিভিন্ন ভাষিক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করবো।

তাহলে ভাবুন যদি ৮ই ডিসেম্বর ১৯৪৮এ আম্বেদকর সাহেব সংবিধান-সভায় ‘পরিভাষাগত সংখ্যালঘু’ এবং ‘পরিভাষাগত না হলেও সংখ্যালঘু’র মধ্যে তফাতের চুলচেরা বিশ্লেষণে না যেতেন, এবং ধারা সংখ্যা ২৯এর প্রাসঙ্গিক জায়গায় মূল শব্দ সরিয়ে দ্যোতক শব্দ ‘নাগরিকগণের কোনো বিভাগ’ এবং ‘কোনো নাগরিক’ না বসানো হতো, তাহলে কী হতো? আমাদের আজ জনস্বার্থ মামলা করে জেতার আশা কতটা ক্ষীণ হতো আর সংবিধান-সভার সেই বিতর্কের চার মাস আগে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত সংকল্পটারই বা কী হতো যেটা ১৪ই আগস্ট ১৯৪৮ তারিখে গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিলো –

“ … শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে শিশুকে মাতৃভাষা মাধ্যমে পড়াতে হবে, এই নীতি সরকার স্বীকার করে নিয়েছে। সব শিক্ষাবিদেরা মানেন যে এই নীতির যে কোনো ব্যতিক্রম শিশুর পক্ষে এবং ফলতঃ সমাজের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। … এ ধরণের পরিস্থিতি কোনো রাজ্য বা প্রদেশের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোনো একটি ভাষাকে গ্রহণ করা অসম্ভব করে তোলে। যে প্রদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনসমষ্টি বসবাস করে সেখানে কোনো একটি ভাষা গ্রহণ করে সবার ওপর চাপিয়ে দিলে অসন্তোষ ও তিক্ততা অবশ্যই জন্ম নেবে। তার প্রভাব আন্তর্প্রাদেশিক সম্পর্কের ওপর পড়বে এবং ফলে, জবাবী পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট দুষ্টচক্র তৈরি হবে। … ভারত সরকারের অভিমত যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, ভালো হবে যদি উপরুল্লিখিত নীতি সবক’টি প্রাদেশিক ও রাজ্য সরকার অনুসরণ করে।”  

১৯৫৬ সালে হওয়া সংবিধানের সপ্তম সংশোধনে, ‘৩৫০ক’ যোগ করা হলো। তাতে বলা হলো, “প্রত্যেকটি রাজ্য এবং প্রত্যেকটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা হবে যে রাজ্যের ভিতরে ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির শিশুদের যেন শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষণ প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়; এবং রাষ্ট্রপতি যদি প্রয়োজন বা উচিৎ মনে করেন, এসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য যে কোনো রাজ্যকে নির্দেশ জারি করতে পারেন।”

যাহোক, এতো কিছুর পরও, ২০০৯ সালে যখন শিক্ষার অধিকার আইন তৈরি হলো, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের এই বার্তাটায় একটু জল মিশে গেলো – অধ্যায় ৫এর বিভাগ ২৯(এফ) এ লেখা হলো –

“শিক্ষাদানের মাধ্যম হবে, যতটা পারা যায়,” [প্র্যাক্টিকেবল] “শিশুর মাতৃভাষা”।

‘পারা যায়’, ‘প্র্যাক্টিকেবল’ এধরণের প্রাগম্যাটিক প্রবৃত্তিগুলো বিপজ্জনক ফাঁদ তৈরি করে।

সেই সূত্র ধরেই নতুন শিক্ষা নীতি ২০২২এর অনুচ্ছেদ ৪.১১এ লেখা হয়েছে (বাংলা অনুবাদে), “যেখানেই সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম অন্ততঃ পঞ্চম শ্রেণী পর্য্যন্ত তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে অষ্টম শ্রেণী এবং তদুর্দ্ধ পর্য্যন্ত ঘরের ভাষা/মাতৃভাষা/স্থানীয় ভাষা/আঞ্চলিক ভাষা হবে।”

তার মানে, ধরুন পূর্ণিয়া জেলার ঔরাহি হিঙনা গ্রামে, যেখানে সত্তর বছর আগে ফণীশ্বর নাথ রেণুও দিব্যি বাংলা শিখতে পারছিলেন, আজ কয়েকটা বাংলাভাষী ছেলেমেয়ে যদি, বাংলা মাধ্যম তো দূরের কথা বাংলা বিষয় যাতে পড়তে পারে তার বিষয়ে স্কুলের হেডমাস্টারকে বলতে যায়, বা অভিভাবকেরাই যদি বলতে যান, হেডমাস্টার বলতেই পারেন, “কোত্থেকে পাবো বলুন তো বাংলায় পড়াবার বা বাংলা পড়াবার লোক? এবারের ব্যাচেও তো এলো না। মৈথিলী বা উর্দুতে পড়ুক না। বা হিন্দিতেই পড়ুক। শিক্ষানীতিতে তো আঞ্চলিক ভাষা, স্থানীয় ভাষার অপশন রয়েইছে।”

এরকম হাজারটা ঘটনার প্রত্যেকটায় আদালতে যাওয়া কি কারো পক্ষে সম্ভব?

তবুও যদি নিরুপায় হয়ে সব দৃষ্টান্তকে একসাথে নিয়ে আদালতে মামলা করতেও হয়, রক্ষাকবচ তো সেই ধারা সংখ্যা ২৯!

যদিও সবদিক থেকেই বাবাসাহেবকে মালা পরিয়ে পরিয়ে কন্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে, তবু আমরা, ভাষাগত সংখ্যালঘুরা তাঁর প্রতি অনুগৃহীত থাকতেই পারি যে তিনিই ‘মৌলিক অধিকার’এ আমাদের আত্মপরিচয় বাঁচিয়ে রাখার ও প্রয়োজনে লড়াই করার জায়গাটা করে দিয়েছিলেন।

___________________________________

*ধারা সংখ্যাটা শেষ বয়ানে বদলে ২৯ হয়েছিলো।

 



No comments:

Post a Comment