Wednesday, January 13, 2021

মার্ক্সবাদ ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস - দুটো আবিষ্কারের প্রসঙ্গ

 মার্ক্সবাদকে মার্ক্সবাদ-এঙ্গেলসবাদ বলি না কেন? বা আরো স্পষ্ট করলে, যদি এই নতুন বিশ্বদৃষ্টিকে পরবর্তি কালে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ বলে অভিহিত করতে পারি, তাহলে মার্ক্সবাদ-এঙ্গেলসবাদ বলতেই বা বাধা কোথায়? এঙ্গেলস বলতে মানা করেছিলেন কেন? নিপাট ভালোমানুষি বা উদারমনা সৌজন্যের খাতিরে, না কঠোর বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ছিলেন বলে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বলা যেমন ভালোমানুষি নয়, অযৌক্তিক উদারতাও তো ভালোমানুষি নয়। সাময়িকভাবে ভয় হতে পারে। তা এঙ্গেলস ভয় পাবেন কাকে?

উদারমনা তো উনি নিশ্চয়ই ছিলেন। বিনয়ীও ছিলেন। সবসময় নিজেকে সেকন্ড ফিড্‌ল বলতেন, যা নাকি উনি ছিলেন না। মার্ক্সের জীবনকালেও (যাতে ম্যাঞ্চেস্টারের মিলে কেরানিগিরির আঠেরো বছর শামিল আছে) এঙ্গেলস বৈজ্ঞানিক সমাজবাদী ভাবনার বিকাশে সমান ভূমিকায় ছিলেন আর মার্ক্সের মৃত্যুর পর বারো বছর তো একা এঙ্গেলসই ছিলেন।

বিপ্লবী সক্রিয়তায় (লেখা ছাড়াও) এঙ্গেলসের ভূমিকা তো বিস্ময়কর। এক নজরে দেখলেঃ

·        কলোনে, পাশে বন্দুক রেখে ন্যু রাইনিশে জাইটুঙের সম্পাদকীয় দপ্তর সামলানো;

·        বিপ্লবী সামরিক অভ্যুত্থানে এলবারফেল্ডে, ব্যাডেন-প্যালেটিনেটে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া;

·        ১৮৫০শে লন্ডনে পলাতক জার্মান রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য ধর্মশালা (ইংরেজি অর্থে রাতে শোবার জায়গা) চালানো, খাবারের জন্য লংগর চালানো (মানে চাঁদা তুলে খাওয়ার ব্যবস্থা করা) আর ওদের রোজগারের ব্যবস্থা করা;

·        ম্যাঞ্চেস্টারে বসে মার্ক্সের নামে লাগাতার ন্যুয়র্ক ডেলি ট্রিবিউনে সংবাদ-প্রতিবেদন লিখে যাওয়া যাতে মার্ক্সের কিছু আয় হয়;

·        তারই সাথে মিলের কেরাণিগিরির ফাঁকে ফাঁকে নিজের নামেও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা যাতে সে আয় আরেকটু বাড়ে;

·        প্যারিস কমিউনের পরাজয়ের পর পলাতক কম্যুনার্ডদের সাহায্য সংগ্রহ অভিযান চালানো;

·        প্রথম আন্তর্জাতিকের সচিব হিসেবে ইটালিতে, স্পেনে ও আরো বিভিন্ন দেশে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে ব্যাপৃত থাকা হোক (কেননা ওনার ভাষাজ্ঞানের কথা মনে রেখেই ওনাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনটে দেশের ভার দেওয়া হয়েছিল, বাকি উনি নিজের তাগিদে বাড়িয়ে ছিলেন);

... এক কথায় এঙ্গেলসের জবাব নেই।

আর তাত্ত্বিক লেখা!

·        মার্ক্সের সাথে যুক্তভাবে লেখা বইগুলোয় হোলি ফ্যামিলি, জার্মান আইডিওলজি, কম্যুনিস্ট ইস্তাহার ইত্যাদি এঙ্গেলস আর মার্ক্সের ভূমিকা সমান।

·        সমাজবদলের লক্ষ্যে একই বৈপ্লবিক শ্রেণির কাছে দুজনে দুদিক থেকে পৌঁছেছিলেন মার্ক্স দর্শনের দিক থেকে আর এঙ্গেলস সমসাময়িক ইতিহাসের দিক থেকে।

·        মার্ক্সকে অর্থনীতি বুঝবার তাগিদটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন এঙ্গেলসই, তাঁর প্রবন্ধের মাধ্যমে; মার্ক্স নিজেই বলেন যে প্রধান অর্থনৈতিক পারিভাষিক শব্দগুলো এঙ্গেলসই ধরিয়ে দিয়েছেন।

·        বিজ্ঞানে আর নৃতত্বে বস্তুবাদী দ্বান্দিকতার প্রয়োগে এঙ্গেলস তো বিংশশতাব্দির প্রথম থেকেই রেফারেন্স-পয়েন্ট। সহজবোধ্য বৈজ্ঞানিক সমাজবাদে এখনো তাঁর পুস্তিকাগুলো প্রচারপত্রের মত চলে।

·        বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বান্দিকতার প্রয়োগে এখনো এ্যান্টি-ডুহরিঙ ঝালিয়ে নিতে ফিরে যায় মানুষ।

·        আর সর্বহারা বিপ্লবে কৃষকের ভূমিকা বোঝাতে খোদ লেনিন, প্যারিস যাওয়ার পথে এঙ্গেলসের উদ্ধৃতি চিরকুটে লিখে পকেটে রেখে নেন। সেই জার্মানিতে কৃষকযুদ্ধ লেখার সময় থেকে বার বার এঙ্গেলসই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষক, প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের ভূমিকা চিহ্নিত করে গেছেন। শ্রেণী-বিভেদিকরণের অর্থনৈতিক পটভূমিতে বুঝিয়ে গেছেন সর্বহারার বন্ধু হিসেবে কে কোন জায়গায় অবস্থান নেবে।

·        জাতীয়তার প্রশ্ন বনাম বিজয়ী জাতির সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সার দ্বন্দ্ব বুঝতে মার্ক্স দৌড়ে গেছেন এঙ্গেলসের কাছে কেননা ইওরোপের যুদ্ধের মোর্চাগুলোর মানচিত্র এঙ্গেলসের করতলে আঁকা থাকতো।

·        মার্ক্সের পূঁজির প্রথম খন্ড পুরোই হত না যদি এঙ্গেলস তাঁর সংসার চালাবার ভার না নিতেন।

·        দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হতনা আর তৃতীয় খন্ড হিয়েরোগ্লিফিক্স থেকে যেত যদি এঙ্গেলসে নিজের সব কাজ ছেড়ে ওই দুটো খন্ড নিয়ে জীবনের শেষ বারো বছর কাটিয়ে না দিতেন।

সেদিক থেকে উনবিংশ শতকের বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ নিশ্চয়ই মার্ক্সবাদ-এঙ্গেলসবাদ।

কিন্তু দুটো তত্ত্ব; গুরুত্বপূর্ণ দুটো তত্ত্ব, সম্পূর্ণরূপে মার্ক্সের আবিষ্কার ছিল। সে দুটো আবিষ্কারের কথা মনে রেখেই এঙ্গেলস ভবিষ্যত প্রজন্মকে বলে গেছেন যেন ভাবধারা হিসেবে ওটাকে মার্ক্সবাদ বলা হয়।

নতুন কথা নয়। এঙ্গেলস নিজেই ওই দুটো তত্ত্বের আবিষ্কারে মার্ক্সের ভূমিকার কথা বলে গেছেন। প্রথম বললেন মার্ক্সের সমাধিতে দাঁড়িয়ে। বিখ্যাত সেই ভাষণ। পৃথিবীর অনেক ভাষায় এবং বাংলায়ও অনুদিত, বহুপঠিত। ১৮৮৩ সালের ১৭ই মার্চ লন্ডনের হাইগেট গোরস্তানে নিজের বন্ধুর সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস বললেন (ইংরেজিতেই বললেন, যদিও দুজনেই জার্মান এবং যে কজন এসেছিলেন তাঁদের মধ্যেও ইংরেজ কম, ফরাসী দুই জামাই ছাড়া বাকিরা জার্মান), ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন তেমনি মার্ক্স আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম, ...

এই নিয়মপ্রসঙ্গে এঙ্গেলস এরপর বললেন মতাদর্শের অতি নিচে এতদিন লুকিয়ে রাখা ... সহজ সত্য যে রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রথম চাই খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, পরিচ্ছদ, সুতরাং ...। গোরস্তানের ভাষণে কথাটাকে তার অন্তিম ফলশ্রুতি বৈপ্লবিক সক্রিয়তার সুচিমুখে ঘুরিয়ে দেওয়াটাই যথার্থ ছিল।

দ্বিতীয়বার, যখন মার্ক্সের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এঙ্গেলস একাই নিজের স্বাক্ষরে, কম্যুনিস্ট ইশ্তাহারের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা লিখলেন তখন আবার বললেন, ১৮৪৫ সালের আগেকার কয়েক বছর ধরে আমরা দুজনেই ধীরে ধীরে এই সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে চলেছিলাম। স্বতন্ত্রভাবে আমি কতটা এদিকে অগ্রসর হয়েছিলাম তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আমার ইংলন্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা বইখানি। কিন্তু যখন ১৮৪৫ সালের বসন্তকালে ব্রাসেল্‌স্‌ শহরে মার্ক্সের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল, তখন মার্ক্স ইতিমধ্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছেন।

কী সেই সিদ্ধান্ত? তা আমরা জানি। কিন্তু তার মূলে কী ছিল, যা মার্ক্স ব্রাসেল্‌সে এঙ্গেলসকে বলেছিলেন এবং সম্ভবতঃ লিখিত রূপটা পড়িয়েও ছিলেন?

এঙ্গেলস সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ইংলন্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার খসড়া পান্ডুলিপি (যেটাকে তিনি সেখান থেকে বারমেনে গিয়ে বাড়িতে বসে পরিমার্জন করলেন)। আর মার্ক্সের সাথে ছিল অনেক পান্ডুলিপির খসড়া। ওই পান্ডুলিপিগুলোর যা কিছু পরে পাওয়া গিয়েছে সেগুলো একসাথে ১৮৪৪এর আর্থিক ও দার্শনিক পান্ডুলিপিগুলি নামে সোভিয়েত সঙ্ঘ থেকে বেরিয়েছে। শুধু চারটে পৃষ্ঠা আলাদা করে এঙ্গেলস প্রকাশ করেছিলেন ১৮৮৮ সালে লুডউইগ ফায়ারবাখ এবং জার্মান ধ্রুপদী দর্শনের সমাপ্তি নামের পুস্তিকাটির সাথে থিসিস অন ফায়ারবাখ বা ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ, যা আজ বিশ্ববন্দিত এগারটি সুত্র। এই সুত্রগুলোর প্রথমটাই ছিল সেই সিদ্ধান্তের মূলকথা যাকে আমরা বলতে পারি প্রতীতির দ্বান্দিকতা (ডায়ালেক্টিক অফ কগনিশন)।

১। প্রতীতির দ্বান্দিকতা (ডায়ালেক্টিক অফ কগনিশন)

আরেকবার পড়ে নেওয়া যাক প্রথম থিসিসটা।

পূর্ববর্তী সমস্ত বস্তুবাদের এবং ফয়েরবাখের বস্তুবাদও তার অন্তর্ভুক্ত প্রধান দোষ এই যে, তাতে বস্তু (gegenstand), বাস্তবতা বা সংবেদ্যতাকে কেবল বিষয় (object) রূপে বা ধ্যান রূপে ধরা হয়েছে, মানবিক সংবেদনগত ক্রিয়া হিসাবে, ব্যবহারিক কর্ম হিসাবে দেখা হয়নি, কর্তার দিক থেকে (subjectively) দেখা হয় নি। ফলে বস্তুবাদের বিপরীতে সক্রিয় দিকটি বিকশিত করেছে ভাববাদ, কিন্তু তা কেবল অমূর্তভাবে, কেননা অবশ্যই ভাববাদ বাস্তব সংবেদনগত ক্রিয়া ঠিক যা সেই ভাবে তাকে জানে না। ...  

বাস্তবতা বা সংবেদ্যতাকে কেবল বিষয় রূপে বা ধ্যান রূপে ধরায়, মানবিক সংবেদনগত ক্রিয়া হিসাবে, ব্যবহারিক কর্ম হিসাবে না দেখায়, কর্তার দিক থেকে না দেখায় পূর্ববর্তী সমস্ত বস্তুবাদের কী ক্ষতি হয়েছে? ক্ষতি এই হয়েছে যে তারা মানুষের ইতিহাসটাই দেখতে পায়না তো সৃষ্টিকে বুঝবে কি করে। কাঠের গুঁড়িটাকে বলবে বাস্তবতা, কাঠের তৈরি টেবিলটাকে বলবে বাস্তবতা অথচ যে ছুতোর মিস্ত্রি টেবিলটা তৈরি করল তার শ্রমটাকে বাস্তবতায় গণ্য করবে না? আর যদি তার শ্রমটাকে বাস্তবতার মধ্যে গণ্য কর, তাহলে মনে রাখবে তার কাজের দুটো মুহূর্ত আছে। প্রথমে সে মাথায় টেবিলটার একটা খসড়া ছবি আঁকে তারপর কাঠের গুঁড়িতে হাত লাগায়; হাত লাগানোর পর্বে পর্বে সে বোঝে কাঠের দাঢ়্য, স্থিতিস্থাপকতা, ভেজা আর শুকনোর তফাত, রেশার মজবুতি, গাঁটের অসুবিধে অর্থাৎ প্রতীতির বিভিন্ন দিক। গুঁড়িতে হাত লাগানোর পর তার শ্রমের বাস্তবিকতা শুরু হয় না মাথায় ছবি আঁকার প্রারম্ভ থেকে? আর যদি মাথার ছবিটাও বাস্তবিকতা হয় তাহলে কাঠের প্রতীতি হল একটা দ্বান্দিক গতি বিষয় থেকে বিষয়ীতে আবার বিষয়ী থেকে বিষয়ে এই শ্রমের প্রক্রিয়াতেই আমরা বিপরীত বস্তু ও চিত্তের, ম্যাটার আর মাইন্ডের ঐক্য ও সংঘর্ষ পাচ্ছি না কি? ... মানুষের পুরো প্রাগিতিহাস ও ইতিহাস তো এই দ্বন্দ্বের ওপর দাঁড়িয়ে! আর এটাকেই যদি বাস্তবিকতার মধ্যে গণ্য না করি তাহলে ইতিহাসটা দেখবই বা কিভাবে?

স্বাভাবিক ভাবেই সে দায়িত্বটা লুফে নেবে ভাববাদ। সে মানবশ্রমের পুরো বাস্তবিকতাটাকে ঈশ্বরীয় শ্রমের সত্যতা হিসাবে উপস্থাপিত করবে। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মাথায় তৈরি হচ্ছে এই জগতের ছবি আর তাকে তিনি পর্বে পর্বে এক্সটার্নালাইজ বা বহির্স্থাপন করছেন!

এটাকে আমরা প্রতীতির দ্বান্দ্বিকতাও বলতে পারি অথবা প্রতীতির শ্রমতত্ত্বও বলতে পারি।

এই প্রসঙ্গে পূঁজি প্রথম খন্ডের অধ্যায় ৭ থেকে একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা।

প্রথমত, শ্রম এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়েই অংশগ্রহণ করে এবং মানুষ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকৃতি ও তার নিজের মধ্যে বৈষয়িক ঘাত-প্রতিঘাতগুলি সূচনা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। ... এইভাবে সক্রিয় হয়ে বাহ্যজগতের সাথে ঘাত-প্রতিঘাতে তাকে পরিবর্তিত করে একই সঙ্গে সে নিজের প্রকৃতিও বদলায়। ... শ্রমের যেসব রূপ আমাদের কেবল পশুর কথাই মনে করিয়ে দেয় সেই আদিম সহজাত-প্রবৃত্তিমূলক রূপগুলি নিয়ে এখন আমরা আলোচনা করছিনা। ... শ্রমকে আমরা পূর্বানুমান করে নিই এমন একটা রূপে যা তাকে একান্তভাবেই মানবিক বলে চিহ্নিত করে। মাকড়সা যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে তার সঙ্গে তাঁতীর কাজের সাদৃশ্য আছে, এবং মৌমাছি তার মৌচাক নির্মাণের কারিগরিতে অনেক স্থপতিকেই লজ্জা দেয়। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মৌমাছির থেকেও সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থপতির তফাৎ এখানেই যে স্থপতি প্রথমে কল্পনায় তার ইমারত তোলে তারপর বাস্তবে সেটিকে গড়ে তোলে।

 অর্থাৎ, রবিঠাকুরের সেই গানটাই একটু উল্টোভাবে আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবেনা/ এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনার বদলে তোমায় জানা আমার ফুরাবে না/ সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে চেনা ...।

এই অংশ শেষ করার আগে হাল্কা ভাবে বলতে পারি যে ইতিহাস তো দূরের কথা, ছুটির দিনগুলোয় দেশেবিদেশে যেসব জায়গায় গিয়ে ভদ্রসমুদায় বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠেন ভার্জিন ফরেস্ট বা প্রিস্টাইন নেচার, তার প্রায় সত্তর প্রতিশত কিন্তু মানবশ্রমের ফসল, সরকারি, বেসরকারি, সামুদায়িক বা ব্যক্তিগত উদ্যমে বনসৃজন।  

প্রতীতির দ্বান্দ্বিকতার উন্মোচন করে বস্তুবাদকে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক করলেন মার্ক্স। এঙ্গেলসও সে জায়গাতেই পৌঁছোচ্ছিলেন, তবে মার্ক্স যেহেতু দর্শনের ও বিশেষ করে হেগেলীয় দর্শনের বিধিবৎ ছাত্র ছিলেন তাই তৎকালীন বস্তুবাদী দার্শনিক পরিভাষাবলির ঠিক সেই হেত্বাভাষে আঘাত করতে পেরেছিলেন যার কারণে বস্তুবাদ বিফলে যাচ্ছিল আর ভাববাদ জয়ী হচ্ছিল বার বার।

এঙ্গেলস বঞ্চিত থেকেছিলেন এই শিক্ষায়, তাঁর পরিবারের ও বিশেষ করে পিতার জন্য। তাই নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে তাঁর সংগ্রাম এক অনুকরণীয় অধ্যায় হল পরবর্তী অনেকের যৌবনে। লরেন্স উইশার্ট প্রকাশিত মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাসমগ্রের দ্বিতীয় খন্ডের সম্পাদকীয় বক্তব্য বলছেঃ-

এঙ্গেলসের পক্ষে অবশ্য প্রগতিশীল দর্শনপথে পৌঁছোন মার্ক্স থেকে অনেক বেশি কঠিন ছিল। বারমেনের এক রক্ষণশীল এবং ধার্মিক পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। পিতা তাঁকে স্কুল ছাড়তে আর ব্যবসা ধরতে বাধ্য করেছিলেন। অর্থাৎ, সমসাময়িক ধার্মিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক প্রবৃত্তিগুলোর গোলকধাঁধার ভিতরে প্রবেশ করে নিজের রাস্তা খুঁজে বার করতে তাঁকে নিজের শিক্ষা স্বাধীনভাবে পুরো করতে হয়েছিল। এই পথে চলতে গিয়ে ছোটোবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের ওপরে ওঠার একটা কষ্টদায়ক আত্মানুসন্ধান পোষিত হয়েছিল। প্রধানত, ধর্ম ও ঈশ্বরতত্ত্বের সমালোচনাত্মক বিশ্লেষণই এঙ্গেলসকে প্রগতিশীল দার্শনিক ভাবনার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সাহিত্যেরও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর বিকাশে, বিশেষ করে শুরুর বছরগুলোয়।

বার্লিন থেকে ড্রেসডেনে আর্নল্ড রুজকে লেখা তাঁর চিঠিটা পড়লে কষ্ট হয়। ডয়েশ জাহ্রবুখের  পত্রিকায় পরের লেখাটা পাঠানোর ছিল। পাঠালেন না। লিখলেনঃ

মহাশয়, শুধু একথাটুকু জানাতে লিখছি যে আপনাকে আর কিছু আমি পাঠাব না। কিছুদিনের জন্য আমি আমার সব সাহিত্যিক কাজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাতে লেখাপড়ায় বেশি সময় দিতে পারি। কারণটা খুব সহজ। আমি যুবক এবং দর্শনে স্বশিক্ষিত। নিজের দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি করতে বা সেই দৃষ্টিভঙ্গীটাকে রক্ষা করতে এটুকু শিক্ষা পর্যাপ্ত। কিন্তু ওই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ঠিক ভাবে ও সফল ভাবে কোনো কাজ করার জন্য নয়। আর আমার কাছ থেকে তো লোকে একটু বেশিই আশা করবে কেননা দর্শনে আমি ট্র্যাভেলিং এজেন্ট। ডক্টরেটের ডিগ্রি নিয়ে দার্শনিক চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ করার অধিকার অর্জন করিনি। ...

তবু, পঞ্চাশ-ষাটের দশকগুলোয় যদি তিনি মার্ক্সের সাথে বসে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কাজ করার সুযোগ পেতেন!  সেই ১৮৪৫এ জুলাই-আগস্টে ম্যাঞ্চেস্টারে এক মাস যেমন কাটিয়েছিলেন মার্ক্সের সাথে! চ্যাটহ্যাম লাইব্রেরির একটা টেবিলের দুদিকে বসে দুজনে নিজের নিজের পড়া পড়ছেন, নোট নিচ্ছেন। হয়ে গেলে এর নোট ও পড়ছে এবং মার্জিনে নিজের মন্তব্য লিখছে! ... সেরকম হলে হয়ত এই দ্বিতীয় আবিষ্কারটা যৌথভাবেই হত।

কিন্তু সে সোনার দিন তো আর আসবে না আপাততঃ। পাগলা মূরটাকে, কাজ না করতে পারার জ্বালায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে তাঁকে, অর্থাৎ এঙ্গেলসকে এর্মেন এন্ড এঙ্গেলস কম্পানির মিলে কেরানিগিরি করতে হবে আঠেরো বছর!

কাজেই, দ্বিতীয় আবিষ্কারটাও মূর অর্থাৎ মার্ক্স একাই করলেন। এই আবিষ্কারটাকে আমরা বলতে পারি মূল্যের দ্বান্দ্বিকতা অথবা মূল্যের শ্রমতত্ত্ব।

(২) মূল্যের দ্বান্দ্বিকতা (ডায়ালেক্টিক অফ ভ্যালু)     

প্রতীতির দ্বান্দ্বিকতার কথা বলতে গিয়ে এঙ্গেলসের যে ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, ১৮৮৩ সালের ১৭ই মার্চ লন্ডনের হাইগেট গোরস্তানে নিজের বন্ধুর সমাধিস্থলে দেওয়া সেই ভাষণেই এঙ্গেলস এগিয়েছিলেন, কিন্তু শুধু এই নয়। বর্তমান পূঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির এবং এই পদ্ধতি যে বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্টি করেছে তার গতির বিশেষ নিয়মটিও মার্ক্স আবিষ্কার করেন। যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে এতদিন পর্যন্ত সব বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রী সমালোচক উভয়েরই অনুসন্ধান অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর সহসা আলোকপাত হল উদ্বৃত্ত মূল্য আবিষ্কারের ফলে।

এর সবকিছুই পূঁজি প্রথম খন্ড মহাগ্রন্থের প্রথম একশো পাতা, যা সবাই বার বার পড়তে বলেন। সমীকরণটা মনে আছে? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, পণ্যের মধ্যে মূর্ত শ্রমের দ্বৈত চরিত্র। যদিও আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় মূল্যের দ্বান্দ্বিকতা, তার আগে এই পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদটা দেখি যেখানে মার্ক্স নিজেই বলেছেন পণ্যের ভিতরে শ্রমের দ্বৈত চরিত্রটি তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন।

প্রথম দৃষ্টিতে পণ্য আমাদের কাছে হাজির করেছিল দুটি জিনিষের এক সংমিশ্রণ ব্যবহারমূল্যের এবং বিনিময়মূল্যের। পরে আমরা এও দেখেছি যে শ্রমেরও আছে দ্বৈত চরিত্র, মূল্যের ভিতর তার যে প্রকাশ ঘটে সেদিক থেকে তার চরিত্র আর ব্যবহারমূল্যের স্রষ্টা হিসেবে তার যে চরিত্র, এই দুই চরিত্র এক নয়। পণ্যের ভিতরে যে শ্রম থাকে, তার দ্বৈত চরিত্র আমিই প্রথম দেখিয়েছি এবং আমিই প্রথম তার পুংখানুপুংখ বিচার করেছি।

এবার আসি মূল্যের দ্বান্দিকতায়। তৃতীয় পরিচ্ছেদ, মূল্যের রূপ বা বিনিময় মূল্য। মূল্যের অভিব্যক্তি কি একটি পণ্য হাতে নিয়ে ঘোরালে ফেরালে পাওয়া যায়? আজকের দিনে একটি শিশু তো বটেই, বড় মানুষও বলবে, কেন? প্রাইস ট্যাগ তো দেওয়াই থাকে! আমরা সাধারণ জীবনে মনেই রাখিনা যে মূল্য আর দাম এক জিনিষ নয়। যাহোক, সেদিকে আর যাব না। মূল্য এবং দামের অন্তর্সম্পর্ক পূঁজির ওই খন্ডেরই পরের পাতাগুলোয় দেওয়া আছে। এখানে প্রশ্নটা করার মানে হল একটা পণ্য হাতে নিয়ে ঘোরালে-ফেরালে বলা যায়, বাঃ, খুব সুন্দর তৈরি করেছে তো! অর্থাৎ, তার ব্যবহারমূল্য তৈরি করেছে যে ব্যবহার্য শ্রম, ... একটি নির্দিষ্ট প্রকারের এবং একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয়িত উৎপাদনশীল শ্রমতার প্রশংসা করা যায়। কিন্তু, পণ্যের মূল্য বলতে যা বোঝায় মানুষের বিশ্লিষ্ট শ্রম, নির্বিশেষ মানবিক শ্রমের ব্যয় তার অভিব্যক্তি পাওয়া যায় কি?  

মার্ক্স বলছেন, এক পণ্যের সঙ্গে ভিন্ন রকম আর এক পণ্যের যে মূল্য-সম্বন্ধ আছে, তাই হল তার সরলতম মূল্য-সম্বন্ধ। আর তা থেকেই, অর্থাৎ, কোনো একটি পণ্যের অবয়ব, আকৃতি, রঙ বা গন্ধ থেকে নয়, অন্য পণ্যের সাথে তার সম্বন্ধ থেকে মূল্যের অভিব্যক্তি আমরা পাই, তাও একটি পণ্যেরঃ অতএব দুটো পণ্যের মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে, তা থেকে আমরা পাই একটি মাত্র পণ্যের মূল্যের সরলতম অভিব্যক্তি। এটাই মূল্যের দ্বান্দ্বিকতা।

এবার আসি সমীকরণটায়।

মূল্যের প্রাথমিক অথবা আপতিক রূপ।

পরিমাণ পণ্য ক = পরিমাণ পণ্য খ, অথবা

পরিমাণ পণ্য ক পরিমাণ পণ্য খ এর সমান মূল্যবান।

২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা

২০ গজ ছিট ১ কোটের সমান মূল্যবান।

১। মূল্যের প্রকাশের দুই মেরু, আপেক্ষিক এবং সম-অর্ঘ রূপ  

[ইকুইভ্যালেন্টএর এই অনুবাদই রয়েছে পীযুষ দাশগুপ্ত কৃত বাংলা অনুবাদে]

মূল্যের রূপ সংক্রান্ত সমস্ত কুহেলিকা এই প্রাথমিক রূপের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। সুতরাং এর বিশ্লেষণই আমাদের সামনে আসল সমস্যা।

ব্যস। আর উদ্ধৃতি দেব না। আমার প্রতিপাদ্য বিষয় এইটুকুই যে মূল্যের এই দ্বান্দ্বিকতা, যে সেটা একটি পণ্যে বিশ্লিষ্ট ভাবে অভিব্যক্ত হয় না, হতে পারে না কেন না সে পণ্য, তার জন্মই হয়েছে বিনিময়ের জন্য (ব্যবহার্য বস্তু হিসেবে তো সে আগে থেকেই ছিল, তার পণ্যরূপ এক নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক উৎপন্ন) অভিব্যক্ত হয় অন্য একটি পণ্যের সাথে এক সম্বন্ধে যার সমানতা নির্ধারিত হয় দুটো পণ্যে নিহিত সামাজিকভাবে জরুরি শ্রমসময়এর সমানতা দিয়ে। আর সেই অভিব্যাক্তি, দুটো পণ্যের নয়, একটির, সমীকরণের বাঁদিকের পণ্যটির। সেই অভিব্যক্তি হয় দুই রূপে আপেক্ষিক, যা সেই পণ্যটিতেই অভিব্যক্ত হয় আর সম-অর্ঘ (বা সমার্ঘ), যা ডানদিকের অন্য পণ্যটিতে অভিব্যক্ত হয়। এই দ্বান্দ্বিক অভিব্যক্তির কারণেই সমীকরণটি বিস্তৃত হতে হতে উলটে যায় একদিন। ডানদিকের, সবার সম-অর্ঘ হওয়া পণ্যটি হয়ে বিশ্বজনীন সম-অর্ঘ্য মুদ্রা। আর পণ্য-বাজারে মুদ্রার চলনের আবশ্যক গতি হিসেবে পূঁজির জন্ম হয়।

এঙ্গেলস এই আবিষ্কারের সময় ম্যাঞ্চেস্টার থেকে এসে এসে পান্ডুলিপি দেখে যাচ্ছিলেন। মার্ক্সকে ধ্যাঁতানি দিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্য সব কাজ ছেড়ে এই কাজে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

পরে, যখন স্যামুয়েল মুর ও এডোয়ার্ড এভেলিং কৃত ইংরেজি অনুবাদটা সম্পাদনা করতে বসেন, তখন যে পাদটীকাগুলো উনি করেন, তার একটি এখানে উদ্ধৃত করতে পারি শুধু এটুকু দেখাতে যে দুই বন্ধু যখন মার্ক্সের পড়ার ঘরে কোনাকুনি একে অন্যের বিপরীতে হাঁটতে শুরু করতেন, মার্ক্সের লেখায় এঙ্গেলস কতটা ঢুকে যেতেন।

বাংলা অনুবাদের পৃষ্ঠা ৬এ সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় বোঝাতে গিয়ে মার্ক্সএর নিজের দেওয়া একটি পাদটীকা রয়েছে, যাতে তিনি নামবিহীন লেখককে উদ্ধৃত করছেন

জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যখন পরস্পরের সঙ্গে বিনিমিত হয়, তখন তাদের মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের উৎপাদনে যতটা শ্রম ও সময় লাগে তার দ্বারা।সাধারণভাবে অর্থের সুদ সম্বন্ধে এবং বিশেষভাবে সরকারী তহবিল সম্বন্ধে (Thoughts on the Interest of Money in General and Particularly in the Public Funds, & c.) লন্ডন, পৃঃ ৩৬। লেখক-পরিচিতি-বিহীন এই চমৎকার গ্রন্থখানি লেখা হয়েছিল বিগত শতাব্দীতে কিন্তু এতে কোন নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া নেই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে দ্বিতীয় জর্জের সময়ে, ১৭৩৯/৪০ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।    

পরে, ইংরেজি অনুবাদের সম্পাদনার সময়, শ্রমের দ্বৈত চরিত্র সম্পর্কে মার্ক্সের ব্যাখ্যার গুরুত্ব বোঝাতে, আর বিশেষ করে ইংলন্ডের গর্ব অ্যাডাম স্মিথের ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে এঙ্গেলসকেও একটি পাদটীকা জুড়তে হয় (দেখুন বাংলা অনুবাদের পৃঃ ১৪)। তিনি কী লেখেন?

যা দিয়ে সর্বতোভাবে এবং প্রকৃতই সব সময়ে সমস্ত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও তুলনা করা হয় তা যে শ্রম, সেকথ প্রমাণ করার জন্য অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন, শ্রমের সমান পরিমাণের শ্রমিকের কাছে সর্বকালে এবং সর্বস্থানে একই হতে বাধ্য। তার স্বাস্থ্যের, শক্তির এবং কর্মের স্বাভাবিক অবস্থায়, এবং তার যে গড়পড়তা কর্মকুশলতা আছে তাতে সে সর্বদাই তার বিশ্রামের, স্বাধীনতার এবং সুখের নির্দিষ্ট এক অংশ ত্যাগ করতে বাধ্য। জাতিবৃন্দের ধনসম্পদ (Wealth of Nations, Book I, Ch.5) একদিকে, অ্যাডাম স্মিথ এখানে (কিন্তু সবখানে নয়) পণ্য-উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয় তার দ্বারা মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে শ্রমের মূল্য দ্বারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের প্রসঙ্গটি গুলিয়ে ফেলছেন, এবং তার ফলে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সম-পরিমাণ শ্রমের মূল্য সর্বদাই সমান। অপরদিকে, তাঁর এই রকম একটা অনুভাবনা আছে যে, যে শ্রম পণ্যের মূল্যের ভিতর অভিব্যক্ত হয়, তা কেবল শ্রম-শক্তির ব্যয় বলেই পরিগণিত হয়; কিন্তু তিনি এই ব্যয়কে কেবল বিশ্রাম, স্বাধীনতা, সুখ প্রভৃতির ত্যাগ বলে মনে করেন, সেই সঙ্গে জীবিত প্রাণীর স্বাভাবিক কাজকর্ম হিসেবে মনে করেন না। কিন্তু তাঁর চোখের সামনে রয়েছে আধুনিক মজুরি-শ্রমিক। অ্যাডাম স্মিথের পূর্বগামী পূর্বোক্ত নাম-পরিচয়হীন লেখক তা ঢের বেশি সঠিক ভাবে বলেছেন, একজন লোক নিজেকে এক সপ্তাহ কাজে নিযুক্ত রেখেছে জীবিকা সংগ্রহের জন্য ... এবং বিনিময়ে যে তাকে অন্য জিনিষ দেয়, সে তার জন্য কত শ্রম ও সময় ব্যয় করেছে তার হিসেব ছাড়া আএ কোন ভাল হিসেব করতে পারেনা তার মূল্যের তুল্যমূল্যের জন্য; ফলতঃ, তার মানে আর কিছু নয়, কেবল কোন নির্দিষ্ট শ্রম-সময়ে তৈরি জিনিষের বদলে ঠিক সেই পরিমাণ শ্রম-সময়ে তৈরি জিনিষের বিনিময়। (I.c. পৃ.৩৯)

নাম-পরিচয়বিহীন লেখকের বইটা দুজনে একসঙ্গেই বসে পড়েছিলেন মনে হয় না?  

 


 

No comments:

Post a Comment