বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা ছেলে। নিজের মুলুক থেকে এত দূরে, ধনী মানুষের দয়ায় বড় হওয়া ছেলে। ধুলো মাটিতে জন্ম নিয়ে, কুঠির অলিন্দে, দেউড়ির ছায়ায় ঘুরে দুনিয়া দেখতে শেখা ছেলে।
পীর আলি অন্যরকম হতে পারতেন।
পাটনা বা আজিমাবাদ তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আফিম ব্যবসার কেন্দ্র। শহরে ঘুরে
বেড়াচ্ছে ডাচ, পর্তুগীজ, ইংরেজ বণিকেরা। আজকের গান্ধী ময়দান তখন সাহেবদের রেসকোর্স।
পূবদিকে হাফ-নবাবী আর পশ্চিমে হাফ-সাহেবী শহরটায় অনেক প্রলোভন ছিল গা-ভাসানোর। গা-ভাসানো
লোকগুলোর ঘাড়ে ভর দিয়েই তো চলছিল কম্পানির প্রশাসন।
কিন্তু কী যেন ছিল গঙ্গার বুক থেকে
উঠে আসা হাওয়ায়। মন্দিরের বটের ঝুরিতে, অশ্বত্থের শিহরণে। মাজারের ওপর ঝরে পড়া কাঁঠালি
চাঁপা ফুলগুলোর সুগন্ধে।
মাদ্রাসায় কত ছেলেই তো পড়ে।
পীর আলি অক্ষর ধরে ধরে পৌঁছোতে চাইলেন হিন্দের হৃৎকমলে। কেননা দেখতে পাচ্ছিলেন তার
পাপড়িগুলোর ওপর বণিকতন্ত্রের ছায়া। যেন গায়কের ফুসফুসে আফিমের ছোপ।
সোনার ভারত! তার আসল সোনা তো ছিল
বুকের বল, মাথার স্পষ্টতা আর হাতের জাদু। তাই নিয়েই তো এ দেশ পৃথিবীর বাণিজ্য দখল
করেছিল। হিন্দের কাপড়ের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ত লিসবন, প্যারিসের বাজারে। হিন্দের
ইস্পাত যেত ধারালো তরোয়াল হতে, দামাস্কাসে।
সে দেশের কী অবস্থা! রুগ্ন! হত
দরিদ্র! হীন! সতেরো বছর বয়সে ভূমিকম্প দেখেছিলেন পীর আলি। ধেয়ে আসছে কড় কড় কান ফাটানো
শব্দ, কাঁপছে পায়ের নিচে মাটি। সাত বছর বয়সে ছেড়ে আসা বাবা মায়ের কথা সেদিন খুব
মনে পড়েছিল তাঁর।
কিন্তু পরে মনে হোত এর থেকে
অনেক বড় কোনো এক ভূমিকম্পে ফাটল ধরে গেছে হিন্দের মর্মে। ধ্বসিয়ে দিয়েছে তার নৈতিক
গঠন।
বুভুক্ষুর মত বই পড়তেন পীর
আলি। পড়তে পড়তে কবে যেন সবাইকার চোখে তিনি বিদ্বান হয়ে উঠলেন! রাস্তায় পড়ে থাকা
বাচ্চাটা হয়ে উঠল মওলানা পীর আলি খাঁ! উর্দু, আরবী, ফারসীতে সমান পারদর্শী।
কিন্তু পড়লেই তো শুধু হবে না,
নিজের পায়ে দাঁড়াতেও তো হবে। পালক ধনী মানুষটি পিতার স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন তাকে।
কিছু দিন আগে যেমন নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছেন, পীর আলিরও বিয়ে দিয়েছেন ঘটা করে। সেই
তাঁর কাছেই হাত পাতলেন শেষে। ‘কিছু টাকা চাই, একটা বইয়ের দোকান দেব, ভাবছি।’
তখনও ছাপাখানা আসেনি এদিকে। তার
ওপর উর্দু, আরবীর বই তো ছাপাখানা আসার পরেও বহু বছর অব্দি হাতে লেখাই চলেছে। শহরে
বইয়ের দোকান গোনাগুনতি। পীর আলি নিজের দোকান সাজিয়ে তুললেন লক্ষ্ণৌ, দিল্লী থেকে
বই আনিয়ে। পড়াও চলবে, রোজগারও চলবে।
নানান ধরণের মানুষ, যাঁরা লেখাপড়া
জানেন, দেশ-দুনিয়ার খবর রাখেন, পীর আলিকে চিনে ফেললেন। কত রকমের প্রশ্ন যুবকটির
মনে! কত চিন্তা করে সে! তাঁরা বলাবলি করেন নিজেদের মধ্যে। বই আনানোর সূত্রে দূরের
সুহৃদ বন্ধু ও প্রিয়জনদেরও একটা বড় জগত গড়ে উঠল পীর আলির।
কিছুদিনের মধ্যে অদ্ভুত সব খবর
আসতে শুরু করল চারদিক থেকে। উড়তে লাগল নানা ধরণের গুজব। ইংরেজ ফৌজের হিন্দুস্যানী
সেপাইদের মধ্যে ফুঁসে উঠেছে অসন্তোষ। ওদিকে ঝাঁসী, গোয়ালিয়র, পূণা ... আরো
কতমুলুকের রাজা, রানীরা জোট বাঁধছে কোম্পানির বিরুদ্ধে। শহরের রাস্তায় যাওয়া আসা
করা ইংরেজ অফিসারেরা যেন একটু সতর্ক।
- কে, বলল কে?
- হাজিগঞ্জের শেরশাহী
মসজিদে এক ইমাম এসেছিলেন কলকাতা থেকে। তিনি বলেছেন।
- ব্যাপারীর বজরা যাচ্ছিল
গঙ্গায়। গোয়ালন্দ থেকে এলাহাবাদ। দীঘা ঘাটে রসদ কিনতে থেমে নাবিকেরা বলাবলি করছিল।
- আরে, নটদের দল এসেছিল
কানপুর হয়ে তারাই তো বলল!
- তোমরা জানো না। দানাপুর
ফৌজী ব্যারাকের বাইরে আর্দালী, খানসামাদের নতুন বস্তি উঠছে যে – ওখানেই একদিন গিয়ে শুনেছি।
শ্রীরঙ্গপত্তনে
কবে যুদ্ধে প্রাণ দিল টিপু সুলতান – তার যুদ্ধডাক যেন সাড়া জাগিয়ে তুলেছে দেশে। পীর
আলি তাঁর বইয়ের দোকানে বসে হঠাৎ, যেন সেই যুদ্ধডাক শুনে চমকে ওঠেন।
তিনি মনস্থির করে ফেলেন। এই
সময় কবে থেকে তাঁর বুকে জমছিল গোরাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা! দেশটার মেরুদন্ডে ঘুণ ঢোকাচ্ছে
কোম্পানির শাসন। ... আজ সেই শাসন উৎখাত করার দিন এসে গেছে।
নিজের যা কিছু উপার্জন, সব ঢেলে
তিনি গোপনে গড়ে তুলতে শুরু করলেন বিদ্রোহীদের একটি দল। অস্ত্র যোগাড় করতে লাগলেন।
নীল-সাদা রঙের বিদ্রোহের পতাকা ভাবলেন দলটির জন্য। কাছের দূরের বন্ধুদের সাথে চলল
চিঠির আদান প্রদান – প্রস্তুতির আলোচনা। ক্যান্টনমেন্টে, ইংরেজ প্রশাসনে
সম্পর্কসূত্র গড়ে তুললেন।
লক্ষ্ণৌএ এক মনের সাথী খুঁজে
পেয়েছিলেন বইয়ের ব্যবসার সূত্রে। সেই সাথীর সাহায্যে স্ত্রী আর সন্তানদের লক্ষ্ণৌ
প্রবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন।
চলতে লাগল প্রস্তুতি আর সময়ের
প্রতীক্ষা।
১৮৫৭ সাল। শুরু হোল উনবিংশ শতাব্দীর
সবচেয়ে বড় সামরিক বিদ্রোহ। ভারতে ইংরেজ ফৌজের এক লক্ষেরও বেশি ভারতীয় সেপাই
কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়ল। ব্যারাকপুর থেকে মীরাট, দিল্লী, পেশোয়ার
হয়ে তার ঢেউ আছড়ে পড়ল বিহারেও। বাবু কুঁঅর সিংএর বীরগাথা, দানাপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে
বিদ্রোহী সেপাইদের নৌকায় করে পাড়ি দেওয়ার কাহিনী আজ সবাই জানে।
তেসরা জুলাই পাটনার কমিশনার উইলিয়াম
টেলার একটু বেলায় খবর পেলেন যে পতাকা উড়িয়ে, হাতে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে কয়েকশো মানুষের
একটা দল গুলজারবাগে সরকারি দপ্তরে হামলা চালাতে যাচ্ছে। আবার খবর পেলেন তারা গীর্জা
ঘিরে নিয়েছে। প্রথমে যে দলটা গেল তারা টিকতে পারলো না বিদ্রোহীদের সামনে। কিন্তু
তারা সঠিক খবর নিয়ে এল যে পাটনা আফিম এজেন্সির ভারপ্রাপ্তকর্তা ডেপুটি আফিম এজেন্ট
ডা. লায়েলকে বিদ্রোহীরা নিকেশ করেছে। কমিশনার দানাপুর গ্যারিসন থেকে ব্রিটিশ সৈন্য
চেয়ে পাঠালেন।
ইংরেজ সৈন্য আর ভারতীয় বশম্বদ
সেপাইদের মিলিত শক্তি অবশেষে কাবু করল বিদ্রোহীদের। তখন প্রায় বিকেল। আকাশে আষাঢ়ের
খন্ড খন্ড মেঘ। পীর আলি ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ তুলছিলেন সাথীদের আহ্বান করে। তখনই
মাস্কেটের গুলি লাগল বাঁ কাঁধে।
পরের দিন একুশ জনের ফাঁসী হল।
২৩ জনকে জেলে পাঠানো হল। কমিশনার টেলারের নৃশংসতা সর্ববিদিত। তিনিও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন
পীর আলির সামনে বসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে।
পরবর্ত্তীকালে
একটি বইয়ে তিনি লিখেছেনঃ
“ভারী শিকলে বাঁধা, বাঁ
কাঁধের ক্ষত থেকে বেরুনো প্রচুর রক্তে তার নোংরা জামাকাপড় মাখামাখি, বাঁচার এক
বিন্দু আশা নেই। তবু আমার ও অন্যান্য ইংরেজ ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখে এক
মুহূর্তের জন্যেও উত্তেজনা, হতাশা কিম্বা ভয় খেললো না।
“তাকে প্রশ্ন করা হোল,
এমন কিছু কি সে করতে চায়, যাতে তাকে জীবনদান দেওয়া যেতে পারে? সে পরম নিশ্চিন্ত ভাবে
এবং ঈষৎ অবজ্ঞার সাথে জবাব দিল, ‘কখনো এমন সময় আসে যখন জীবন বাঁচানো ভালো। আবার
এমন সময়ও আসে যখন জীবন খোওয়ানো ভালো।’ (কমিশনার হিসেবে) আমি যে দমননীতি চালিয়েছি তাকে
বিদ্রুপ করে শেষে বলল, ‘আপনি আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারেন, আমার মত আরো অনেককে ফাঁসিতে
ঝোলাতে পারেন। কিন্তু আমার জায়গা নিতে হাজারো মানুষ ছুটে আসবে। আপনার উদ্দেশ্য কখনোই
সফল হবে না। ...”
পাটনায় যেখানে পীর আলি এবং তার
কুড়িজন সঙ্গীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল সেখানে এখন একটি শিশু উদ্যান – ‘শহীদ পীর আলি খাঁ স্মৃতি
পার্ক’।
It's a great saga about one of our freedom heroes, Pir Ali, an erudite, upright man, running a bookshop that was a treasure house of knowledge. Pir Ali's name became quite familiar to research scholars and other knowledge seekers. This great scholar sacrificed all comforts, all readings of book and invested his total money in organizing a group of revolutionaries who will free the Hind. There had spread a news about a revolt among the Indian soldiers who have used hitherto as canon fodder. Pir Ali lead a war against the East India Company and after defeating the first battalion could not continue their victory as the Britishers replenished their army with fresh men. Pir ALi was badly injured. He was hanged to death along with other 20 revolutionaries. Even before his death, he never bent before the heartless army officer and faced death very calmly with his dream of Free Hind. Very well written, a gem of a literary sketch on one of our unsung great heroes of freedom movement. Salute to Pir Ali. Long Live Pir Ali.
ReplyDelete