Tuesday, December 29, 2020

ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধতার মধ্যে দিয়েই চিন্তার বস্তুবাদী ধারা এগিয়েছে

১ - যা চলছে, সেটাকে ঈশ্বরের বিধান হিসেবে না মানা, ভাবা যে তা থেকে মুক্তি এই জীবনেই সম্ভব, সে মুক্তি আনার তাগিদে ক্রিয়াশীল হওয়া কোনো কল্পলোকের দুনিয়া বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন নিয়ে নয়; বাস্তব ঐতিহাসিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে সেটাই তো বস্তুবাদী হওয়া! বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ! সেই বিচারে বলা যেতে পারে যে ভারতে উনবিংশ শতকে সমাজবদলের সক্রিয়তার মধ্যেই নিহিত ভারতীয় বস্তুবাদের ধারা। সংস্কার থেকে শুরু করে শাসন বদল অব্দি প্রসারিত সেই সক্রিয়তায় বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায় সেই বস্তুবাদের তত্বগুলো কোথাও বেশি, কোথাও হয়তো বা একটু কম। যখন মীরাটের বিদ্রোহী সেপাইরা বাহাদুর শাহ জাফরকে নিজেদের, অর্থাৎ উদ্দিষ্ট ইংরেজ-মুক্ত ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেও যুদ্ধপরিচালনার জন্য নিজেরাই একটা সামরিক পরিষদ (এ ধরণের সামরিক পরিষদ তার আগে মোগলশাসনে ছিল না) গঠন করেন, তাঁরা ঐতিহাসিক বাস্তবটা অনুধাবন করার পরিচয় দেন; আবার বিদ্যাসাগর মশাই যখন মিসেস কার্পেন্টারের, অতি-উৎসাহে ব্রাহ্মসমাজকে রাজি করিয়ে ফিমেল নর্মাল স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, তিনিও ঐতিহাসিক বাস্তবটা অনুধাবন করার পরিচয় দেন।

২ - এঁরা কেউই নিজেদের দার্শনিক ভাবনা ও বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামান নি। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে দার্শনিক বলতে কেউ ছিলেন না, অর্থাৎ নীতিশাস্ত্র, ঈশ্বরতত্ব, প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের পুনর্মূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনার বড় জোয়ার আসা সত্বেও, দর্শনের মূল দুটো প্রশ্ন তত্বমীমাংসা ও জ্ঞানমীমাংসা নিয়ে আলাদা করে কেউ ভেবেছেন বলে জানিনা। নানাভাবে প্রশ্নদুটোর কাছাকাছি সবাই এসেছেন, আসতেই হবে, কিন্তু সম্মুখীন হন নি। সবচেয়ে কাছাকাছি যাঁরা গেছেন, তাঁরা বস্তুকে সাধারণভাবে এক ঈশ্বরের সৃষ্টি বলেও তার স্বতন্ত্র, স্বয়ম্ভু, স্বনিয়মে ও কার্যকারণসম্পর্কে গতিশীল অস্তিত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, এবং জ্ঞানকে, বস্তুর সাথে মানুষের, বা জগতের সাথে চিত্তের সৃজনী সংঘাতের উৎপত্তি না বললেও, জ্ঞানও যে বস্তু, সেটা চিহ্নিত করেছেন। এ তো গেল তাঁদের কথা, যাঁরা জ্ঞানজগতের মানুষ ছিলেন। বিদ্রোহী সেপাইদের সাথে তো জ্ঞানজগতের মানুষ বলতে ছিলেন শুধু বিভিন্ন প্রদেশের কিছু লোককবি ও শিল্পী।

৩ - কিন্তু তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্যে যদি ভারতীয় বস্তুবাদের ধারাটিকে পুনরাবিষ্কৃত না করি, তাহলে আধুনিক ভারতীয় দর্শনের প্রতিভূ হিসেবে উল্লেখ্য হয়ে থাকবেন আবার শুধু কিছু ভাববাদী দার্শনিক ও গুরু, ঠিক যেমন প্রাচীনকালে হয়েছিল। সেই প্রাচীনকালের ভারতীয় নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদকে চিহ্নিত করার জন্য উনবিংশ শতকে বিদেশী ভারতবিদদের প্রয়োজন হয়েছিল।

৪ - তবে, তার আগে, উনবিংশ শতকের জাগরণ বা নবজাগরণ বা চৈতন্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটাকে একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করা যাক।

ইয়োরোপীয় নবজাগরণে ঈশ্বরের বরপুত্র মানুষকে বৃদ্ধ ঈশ্বরের হাত ছাড়িয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। অব্যক্তে বলতে হয়েছিল, নিচের ওই পৃথিবী, ওই ইহলোক আমার।

ভারতের প্রতিটি জাগরণে মানুষকে ব্রাহ্মণ্যধর্ম, এবং বিশেষ করে বর্ণাশ্রম থেকে মানুষকে মুক্ত করার পথে নিজেকে জাহির করতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, তোমাদের ধর্মপন্থা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আমরা মানি না।

ইওরোপের ঈশ্বর কামড়টা দিতে ছাড়েনি। প্রোটেস্টান্ট, কালভিনিস্ট, মেথডিস্ট আরো নানারকম সংস্কারপন্থা জন্ম নিলেও ক্রিশ্চিয়ানদের মধ্যে ক্যাথলিক বা রোমান ক্যাথলিক আজও সবচেয়ে বিশাল সংগঠিত ধর্মসংগঠন।

৫ - ভারতের প্রতিটি জাগরণের অব্যবহিত পরেই, ব্রাহ্মণ্যবাদ সেই জাগরণের বাণীটাকে ভ্রান্ত দিকে নিয়ে যেতে, সর্ষের মধ্যে ভূত হয়ে ঢুকে গেছে এবং অবশেষে পরাজিত করেছে। করতে পেরেছে কেননা ব্রাহ্মণ্যবাদ বা মনুবাদ বা বর্ণাশ্রম ভারতের আবহমান গ্রাম-সমুদায়-ভিত্তিক অর্থনীতি ও তদ্ভূত স্থানীয় শাসনের কাল-পরীক্ষিত যন্ত্র, এবং, ইসলামী শাসন অব্দি সেই সমুদায়-ভিত্তি ভাঙেনি।

৬ - ইওরোপের বেলায় নবজাগরণ আর ভারতের বেলায় প্রতিটি জাগরণ বলে শুরু করলেও, তিনটে প্রধান কালখন্ড প্রাচীন, মধ্যযুগীন ও আধুনিক ইওরোপেও দেখান হয়। (১) গ্রেকো-রোমান সমৃদ্ধি, শিল্প, সাহিত্য ও চিন্তা-চেতনার যুগ, (২) মধ্যযুগের অন্ধকার ও (৩) ইতালীয় ও ইওরোপীয় নবজাগরণের যুগ থেকে ফরাসী বিপ্লব ও তার পরের যুগ অব্দি। নবজাগরণের সময়টাকে মধ্যযুগের অংশ না ধরে শেষ বা তার থেকে বিচ্ছেদ ও আধুনিক যুগে প্রবেশ বলে ধরা হয়। তার পরবর্তি সময়টা আধুনিকতার ক্রমবিকাশের কাল, একটা ধারাবাহিকতা, কোনো বিচ্ছেদ নেই। প্রাচীন কালখন্ডটাকে ধর্তব্যের মধ্যে এইজন্য আনলাম কেননা ইশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইটা ওই সময় থেকেই ধরা হয় এবং আধুনিক নবজাগরণ-চেতনা ওই কালের সাথেই সম্পর্কিত করে নিজেকে স্বপ্নে ও সম্ভাবনায়। প্রোটাগরাসের বিখ্যাত উক্তি ম্যান ইজ দ্য মেজার অফ অল থিংস, প্লেটোর ব্যাখ্যার আবরণ সরিয়ে নতুন অর্থে জেগে ওঠে।

৭ - সময়কালের ঈষৎ তফাতের সাথে ভারতেরও জাগরণের তিনটে প্রধান কালখন্ড। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের উদ্ভব-কালীন সমৃদ্ধি, শিল্প, সাহিত্য ও চিন্তা-চেতনার যুগ, সূফী-ভক্তি কবিদের উত্থানকালীন সমৃদ্ধি, সাহিত্য ও চিন্তা-ভাবনার যুগ এবং অষ্টাদশ শতকে ইংরেজদের আসার প্রাক্কালের সমৃদ্ধি, ইংরেজ-শাসনের অভিঘাতে আবির্ভূত ধর্মসংস্কার, সমাজসংস্কার, সাহিত্য, শিল্প ও নব্যচেতনার প্রারম্ভ। সূফী-ভক্তি কবিদের সময়টাকে আমরা মধ্যযুগেই ধরি আলোর একটা বিস্ফোরণ, যার পিছনে আছে আরব দুনিয়া থেকে ইসলামি হামলাদার ও ব্যাপারিদের হাতে হাতে আসা আরবী বিজ্ঞান ও কারিগরী কুশলতা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটা সময়। তাই আমাদের মধ্যযুগ ও ইওরোপীয় মধ্যযুগে একটা তফাৎ টানি, ওদেরটা অন্ধকার হতে পারে আমাদেরটা অন্ধকার নয়। বরং ওই আরবী বিজ্ঞান ও কারিগরী ইওরোপে পৌঁছতেই ওদের নবযুগ বা নবজাগরণ শুরু হয়। প্রোটাগরাসের সমধর্মী বা আরো বড় উক্তি, কোনো প্লেটোর ব্যাখ্যার আবরণ ছাড়াই, এই সময়ই ধ্বনিত হয় ভারতে, বড়ু চন্ডিদাসের মুখে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার পরে নাই। সে সময় কেউ প্রাচীন কালের কোনো কিছুর সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করেনি, বা নিজেদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা খোঁজেনি। বরং পরবর্তিতে, উনবিংশ শতকের বাংলায় (হয়ত ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এবং বিপরীত, ঔপনিষদিক ভাবনাকে মানবিক ঐতিহ্যবাহী দেখানোর জন্য) প্রাচীন উক্তি শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা তে ভারতীয় মানবিকতার ধারাবাহিকতাকে অনুরণিত করা হয়।    

৮ - উপরোক্ত কথাগুলো ইওরোপ ও ভারতের মধ্যে তুলনার কোনো প্রয়াস নয়, কিছু ব্যাপার বোঝার চেষ্টা মাত্র। বিশেষ করে ঈশ্বর ও মানুষের লড়াইটা।

ব্রাহ্মণ্যধর্ম তো ভীষণ চালাক সনাতন গ্রামসমাজের আর্থিক কাঠামোয় ক্ষমতায়িত এবং অভিজ্ঞ। ঈশ্বর মানুষকে বলি দিচ্ছে, সেই ঘটনাটাকেও বেশ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল, ওটা সাংকেতিক। পুরুষমেধ মানে, মানুষকে বলি দেওয়া মানে নতুন রূপে তার সৃজন জীবজগত ও চতুর্বর্ণে সৃজন। ঠিক আছে, কিন্তু তার মানে তো এটাও দাঁড়ায় যে যারা চতুর্বর্ণে বিভাজিত নতুন সামাজিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল তাদের সংহার হয়েছিল। যেমন শুনি যে চার্বাক ও চার্বাকপন্থীদের সংহার করা হয়েছিল।

এবং পরবর্তি যুগেও হয়ে চলেছে। তাই, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইটা এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এবং বিপরীতে, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইটার মধ্যে দিয়েই নিরীশ্বরবাদ, এবং প্রসঙ্গক্রমে বস্তুবাদী ধারাটা এগিয়েছে। আর সেই লড়াইয়ের পর্বগুলোই মানবচেতনা, বা মানবকেন্দ্রিকতা, বা শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষের ভাষায় মানবতন্ময়তা, মানবমুখিনতার পর্ব। আর সেই পর্বগুলোর সুত্রেই ভারতের জাগরণ প্রসঙ্গ।

এখন এই প্রশ্নে যাচ্ছিনা যে শুরুতে তো ব্রাহ্মণ্যধর্ম বলেও কিছু ছিল না। শিলীভূত বর্ণব্যবস্থাও ছিল না। ঠিক আছে, ছিল না। কিন্তু যা-ই ছিল, তাতে ভ্রূণাবস্থায় ছিল।

 

তিনটে পর্ব

বৌদ্ধযুগ (সাথে জৈন তো বটেই, অন্যান্য, কম জনপ্রিয়, মক্ষলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলি ইত্যাদি দার্শনিকদের মতগুলোও বিচার্য)

১ - এক নতুন জীবনদর্শন ও জীবনপথ যা জাতিপ্রথাকে অস্বীকার করল।

২ - কার্য-কারণ সম্পর্ক বা যুক্তিকে বিশ্বজগতের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে তুলে ধরল। কিন্তু আলাদা করে সর্বশক্তিমান হিসেবে একটা ঈশ্বরের ধারণার সমালোচনা বোধহয় করল না।

৩ - বুদ্ধের জন্মান্তরের গল্প হিসেবে প্রচলিত জাতক কথাগুলো সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনযাপনের এক অসাধারণ ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করল, এবং তারই মাধ্যমে সমাজে শ্রমজীবী শূদ্র জনগণের সর্বময় ব্যাপ্তি তুলে ধরল। শ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহদের সামাজিক শক্তি যেমন আর্থিক সমৃদ্ধির কালটাকে রেখাংকিত করল, ভগবান বা দেবতা বলে কথিত কেউ যে বস্তুতঃ এই পৃথিবীরই জীব বা জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ সে কথাটাও জোর পেল বুদ্ধের জন্মান্তরের ধারণায়।

সূফী/ভক্তিযুগ

১ - সূফী মতবাদ আরব থেকে যে ইশ্বরপ্রেমে নিমগ্ন হওয়ার যে ধারণা সঙ্গে এনে থাকবে, এখানে আসার পর তাতে নিশ্চয়ই কিছু বদল ঘটে থাকবে। যে ভয়াবহ কৃচ্ছসাধনের কথা, বস্তুতঃ ঈশ্বরের পায়ে মাথা কুটে মরে যাওয়ার চেষ্টায় রত থাকার যে গল্পগুলো ওদিককার প্রারম্ভিক সূফীদের জীবন থেকে পাই, এখানকার সূফী মনে হয় ভারতের আবহাওয়ায় ভক্তির ধারণার সঙ্গে মিশে তার থেকে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আর ভক্তি? সেও সূফীর কাছ থেকে একনিষ্ঠ ঈশ্বরতন্ময়তা শিখেছিল ঠিকই কিন্তু তাকে ভালোবাসার রসে জারিয়ে নিয়েছিল। দুদলের কাছেই ভক্তি, ঈশ্বরতন্ময়তা আর একনিষ্ঠ ভালোবাসা, প্রেমোন্মাদ সমার্থক হয়ে দাঁড়াল।  

২ - মানুষকে ঈশ্বর বা ঈশ্বরকে মানুষ বানাল না। ঈশ্বরকে ঈশ্বরের জায়গাতেই রাখল কিন্তু ভয়ের জিনিষ হিসেবে নয়, একেবারে আপন কোনো ভালোবাসার জিনিষ হিসেবে। সবার, প্রত্যেকের আপন হিসেবে।

৩ - তীক্ষ্ণ, তীব্র সমালোচনার সূর এল প্রথমবার যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের ভড়ংএর বিরুদ্ধে, তেমনই ইসলামী মোল্লাদের ভড়ংএর বিরুদ্ধে; জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িক ভেদের বিরুদ্ধে এবং পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার নামে বুজরুকির বিরুদ্ধে।

৪ - সাহিত্যে এই মতবাদ ভারতীয় অর্থে আধুনিক মানবতাবাদের ভিত্তি তৈরি করল। যদিও আর্থিক সমৃদ্ধির কাল হিসেবে, নিম্নবর্গের জোলা, তাঁতি, কামার, চামার, ছুতোর ... আর্থিক উত্থানের কাল হিসেবে কোনো চিহ্নিতকরণ সেই সাহিত্যে ঘটল না, কিন্তু সমালোচনা ও ঈশ্বরপ্রেমের দুঃসাহসের মধ্যেই সে উত্থানটা নিহিত হল।  

উনবিংশ শতকের নবজাগরণ, বিশেষ করে বাংলার

১ - খৃস্টানমত ও ইসলামেরও জবাব হিসেবে, প্রাচীন সব ভারতীয় পন্থার, বৌদ্ধ, জৈন, বেদান্ত ও ভক্তির সারতত্ত্বের সংশ্লেষণ হিসেবে কলকাতা শহরে জন্ম নিল নতুন পন্থা, ব্রাহ্মসমাজ। পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নমঃশূদ্রদের মধ্যে জন্ম নিল মতুয়াবাদ। (পরবর্তিতে, পৌত্তলিক পূজো আর অপৌত্তলিক বন্দনার মাঝামাঝি সমঝোতায় অনেক গুরুকূল যারা পুজো-অর্চনা না করতে পারো শুধু নামগান করো বলে পথ বাতলাল। অবশেষে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনটাকে সবচেয়ে বড় ভাবে ধরলেন রামকৃষ্ণদেব, তাঁর কালীপুজো দিয়ে, যেখানে ষোড়শোপচার আছে কিন্তু ভক্তির সাথে ভয়ের বদলে আনলেন এক নতুন জিনিষ, বাৎসল্য। যা সমভাবের বন্ধুত্বের (ভক্তি আন্দোলনকালীন ভাবনার) আরো ঘনিষ্ঠরূপ। এর মধ্যে দক্ষিণেশ্বরের কালিবাড়ির একাধারে বীর শূদ্রানী ও ব্রিটিশবিরোধী শিকড় বাঙালি আধুনিকতাকে একটা আরামের জায়গা দিল। বিবেকানন্দ এরই ভিত্তিতে তৈরি করলেন জাতীয় আত্মবিশ্বাসের কেন্দ্রস্বরূপ এক সংস্কারবাদী হিন্দু বিশ্বসত্তা।)

২ - ওদিকে কেশব চন্দ্র সেন মহারাষ্ট্রে যান এবং তাঁর অনুপ্রেরণায়, ১৮৬৭ সালে জন্ম নেয় প্রার্থনা সমাজ। ১৮৫৯-৬০ সালে নিজের শুদ্রউত্থানের ভাবনা নিয়ে আসেন জোতিবা ফুলে; ১৮৭৩এ গড়ে তোলেন সত্যশোধক সমাজ। ১৮৭৫এ জন্ম নেয় আর্য সমাজ। ১৮৮৮ সালে কেরলে নারায়ণ গুরু প্রতিষ্ঠা করেন এযভ শিব। অন্যান্য প্রদেশেও এধরণের নানা সংস্কারপন্থী হিন্দু আন্দোলন জন্ম নিয়ে থাকবে।

মানবমুখীনতা কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করল এবং তার বহির্প্রকাশ ঘটল তিনটি ধারায়ঃ

ক - সমাজসংস্কার (তিন পথে উচ্চবর্ণের ও নিম্নবর্ণের অন্তর্গত সংস্কার; চাষী, নীলচাষী, চা-শ্রমিক ও শিল্প-শ্রমিকদের পক্ষসমর্থন; রাজনীতির আঙিনায় হস্তক্ষেপের প্রয়াস) এবং এতে জোর যোগালঃ

শিক্ষাবিস্তার, বিশেষ করে নতুন পাঠ্যক্রমে ও মাতৃভাষায়

সাহিত্যের জোয়ার

বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী চিন্তাচর্চার সংগঠন নির্মাণ

মাতৃভাষায় সাংবাদিকতার ধারা গঠন

বস্তুবাদী চিন্তার ধারা পুনঃ-উৎসারিত হল যার মুখ্য প্রতিভূ নিঃসন্দেহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ, কিন্তু রামমোহন, এবং হরিচাঁদ ঠাকুর থেকে দয়ানন্দ সরস্বতী অব্দি, সমাজ সংস্কারক সবাই, তাঁদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ও প্রচারকের ভূমিকা সত্ত্বেও ওই ধারার বাহক। আর এভাবে দেখলেই আমরা বিংশ শতাব্দীর বস্তুবাদী চিন্তার পূর্বসুরীদের খুঁজে পাব।

 

 


 

No comments:

Post a Comment