ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয় কুমার দত্ত, পুরোনো অর্থে দার্শনিক ছিলেন না, কিন্তু উনবিংশ শতকের বাংলায় ও ভারতে বস্তুবাদী জ্ঞানমীমাংসা ও তত্ত্বমীমাংসার নবরূপে উত্তরণ এ দুজনের রচনার এবং কাজের, বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে বিশেষ করে, কাজের পদ্ধতির) মাধ্যমে এক লাফে অনেকটা এগিয়েছিল। ‘নবরূপ’ শব্দটা ইচ্ছে করে ব্যবহার করলাম। তাঁরা দুজনেই জানতেন যে ভারতীয় ষড়দর্শনের কতটা নিরীশ্বরবাদী। মাধবাচার্যের বইয়ে চার্বাকপন্থীদের মত বলে উদ্ধৃত শ্লোকগুলোও তাঁরা জানতেন। এমনি এমনি বিদ্যাসাগর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ বইটার প্রামাণিক সংস্করণ করার জন্য উদগ্রীব হননি। অবশ্যই তাঁরা দর্শন-বিদ্যার প্রথাগত তাত্ত্বিক ছিলেন না, জ্ঞানমীমাংসা বা তত্ত্বমীমাংসায় বস্তুবাদের সত্যতা প্রমাণিত করাকে নিজেদের কাজ মনে করেননি। তাঁদের অনুভবে, ইতিহাসের দায়ভার হিসেবে যে সব কাজকে তাঁরা অগ্রগণ্য মনে করেছিলেন, সেই পথে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু সে সময়কার মহানায়কদের মধ্যে অন্য অনেকের কাজে ও কাজের পদ্ধতিতে যেমন বেদান্ত ও উপনিষদের বাণী ও ধারা খোঁজার চেষ্টা চলে আজও, বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তের কাজ, এবং (বিদ্যাসাগরের বিশেষ করে) কাজের পদ্ধতিতে আমরা ভারতীয় বস্তুবাদের ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টা করতে পারি।
বস্তুবাদী
ধ্যানধারণায় কাজের (অনুশীলনের)
গুরুত্ব
এটা তো সবাই জানেন যে মার্ক্সীয় বস্তুবাদে অনুশীলনের কতটা
গুরুত্ব। বস্তুজগতের
প্রতীতিতে অনুশীলনকে একটি প্রধান উপাদান হিসেবে যুক্ত করেই বস্তুবাদ মার্ক্সীয় বা
দ্বান্দ্বিক হল এবং যাবতীয় ভাববাদকে খন্ডিত করতে সক্ষম হল (থিসিস অন ফায়ারবাখের
প্রথম থিসিস দ্রষ্টব্য; অনুশীলন শব্দটা ওখানে নেই, শ্রম শব্দটাও ওখানে নেই, আছে মানবিক
সংবেদনগত ক্রিয়া, ব্যবহারিক কর্ম বা ‘বৈপ্লবিক’, ‘ব্যবহারিক-সমালোচনামূলক’ ক্রিয়া)।
এই সত্যটা উপলব্ধি করার পরই ব্রাসেলসে
মার্ক্স এঙ্গেলসের সাথে বসে একসাথে প্রথম রচনা শুরু করলেন ‘পবিত্র পরিবার’ এবং তার একটি অধ্যায়ে, ব্রুনো
বাওয়ারের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন জার্মান দার্শনিককুলের চিন্তাধারার সমালোচনা করতে
গিয়ে ফরাসী ও ইংরেজ বস্তুবাদের কথা পাড়লেন।
মার্ক্স
লিখলেন, “Materialism is the natural-born son
of Great
Britain. …… The French imparted to English materialism
wit, flesh and blood, and eloquence. They gave it the temperament and grace
that it lacked. They civilised it. …… Just as Cartesian materialism
passes into natural science proper, the other trend of French materialism
leads directly to socialism and communism.
……
“If man draws all his knowledge, sensation, etc., from the world
of the senses and the experience gained in it, then what has to be done is to
arrange the empirical world in such a way that man experiences and becomes
accustomed to what is truly human in it and that he becomes aware of himself as
man. …… If man is shaped by environment, his
environment must be made human. If man is social by nature, he will develop his
true nature only in society, and the power of his nature must be measured not
by the power of the separate individual but by the power of society.”
অর্থাৎ পরিবেশটা মানবিক করতে হবে, সমাজের সংস্কারে হাত দিতে
হবে, দার্শনিককে অনুশীলনে নামতে হবে – এতটা অব্দি দার্শনিকেরা মার্ক্সের
আগেই পৌঁছেছিলেন; শুধু ওই অনুশীলনই যে প্রতীতির প্রধান উপাদান সেটা জানেন নি। সেটা
পূর্ণতঃ মার্ক্সের আবিষ্কার।
যাই হোক, ইংরেজ বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে প্রথমেই নাম
আসে ফ্রান্সিস বেকনের। বেকনপন্থী সংস্কারক ছিলেন জেরেমি বেন্থাম এবং বেন্থামের ছাত্র
ছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি উনবিংশ শতাব্দীর ভারতের শিক্ষিত জগতের পরিচিত মানুষ।
খোদ বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন যে মিলের দর্শন ছাত্রদের পড়ানো হোক কিন্তু ব্যালেন্টাইন
সাহেব আপত্তি করেছিলেন। আর অক্ষয় কুমার দত্ত তো রীতিমত দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে
বেকনের মত একজন ভারতবর্ষে কেন জন্ম নিল না।
অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর মহানায়কেরা কেউ দার্শনিক না হলেও,
বেকনের বস্তুবাদ বা মিলের উপযোগিতাবাদে প্রভাবিত ছিলেন। একটাই তফাত টানবো যে বাকি
সবাই, ধর্মের সমালোচনায় তার অযৌক্তিক রূপটার সমালোচনায় নিজেদের সীমিত রেখেছেন এবং,
ফলে নতুন এক ধর্মের খোঁজে এগিয়েছেন যা যৌক্তিক হবে। বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয় কুমার
দত্ত (আরো কিছু অপ্রধান নাম থাকতেই পারে, হয়ত আমি জানি না) নতুন ধর্মের খোঁজে
এগোননি। যুক্তিবাদ তাঁদের কমবেশি টেনে নিয়ে গেছে নিরীশ্বরবাদ, কিছুটা অজ্ঞেয়বাদ এবং
বস্তুবাদে। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তাঁর ‘বাদ’, লেখনী বাদেও, বেশি করে
দেখা গেছে অনুশীলনে, শিক্ষা ও সংস্কারমূলক কাজে ও বিশেষ করে কাজের পদ্ধতিতে। অক্ষয়
কুমার দত্ত, শারীরিক অসুস্থতার কারণে অতটা কর্মযোগী হওয়ার সুযোগ পান নি, কম বয়সেই
সক্রিয় জীবন থেকে সরে এসেছিলেন, তাই তাঁর ‘বাদ’ দেখা যায় তাঁর লেখনীতে। এবং
তাতেই আমরা পাই ধর্ম নিয়ে তাঁর বস্তুবাদী সমালোচনা।
·
এ
নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে যে বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী ছিলেন কি না। না, সে অর্থে ছিলেন
না। কিন্তু বুদ্ধের ইহজাগতিক কার্যকারণ যোজনায় যেমন সর্বময়কর্তার ধারণা অনুপস্থিত
এবং অপ্রয়োজনীয়, বিদ্যাসাগরেরও কার্য ও কার্যপদ্ধতি-নিরূপণ যোজনায় ঈশ্বর অথবা সর্বময়কর্তার
ধারণা অনুপস্থিত এবং অপ্রয়োজনীয়। যে বইয়ে ঈশ্বরের ধারণা যুক্ত করা নিয়ে এত গল্প আছে,
সেই ‘বোধোদয়’এও
ঈশ্বরের স্থান পদার্থ ও চেতন পদার্থের মাঝখানে। তাঁকে প্রথম স্থান দিতে তিনি নারাজ।
চেতনার পরেও নয়। কেননা ঈশ্বর, ‘বোধোদয়’এর
স্থাননিরূপণে, চেতনার প্রাথমিক ও সর্বপ্রধান কারক, এবং সেই চেতনায় তিনি স্রষ্টারূপে
প্রতিষ্ঠিত। এবং সেই চেতনায়, “ঈশ্বর
কি চেতন, কি অচেতন, কি উদ্ভিদ, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নিমিত্ত, ঈশ্বরকে
সৃষ্টিকর্তা বলে। ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। তাঁহাকে কেহ দেখিতে পায় না, কিন্তু তিনি
সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান; আমরা যাহা ভাবি,
তিনি তাহা জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু; তিনি সমস্ত জীবের আহারদাতা ও রক্ষাকর্তা।”
এর পর ‘চেতন
পদার্থ’এ এক জায়গায় ঈশ্বরের
উল্লেখ আছে এবং নেই। জায়গাটা উদ্ধৃত করছি, “সমস্ত
জগৎ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রাণিসমূহে পরিবৃত। অবশ্যই কোনও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার
নিমিত্ত, সমস্ত প্রাণী সৃষ্ট হইয়াছে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য কি, অনেক স্থলে, তাহার নির্ণয়
করিতে পারা যায় না।
“জগতে
কত জীব আছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তার কি অপার মহিমা! তিনি সমস্ত
জীবের প্রতিদিনের পর্য্যাপ্ত আহারের যোজনা করিয়া রাখিয়াছেন।”
উদ্ধৃত অংশটির আগে রয়েছে প্রাণিজগতে বর্তমান প্রকারের বৈচিত্র
এবং পরে রয়েছে তাদের আহার্যের বিবরণ। ঠিক মাঝখানে এই পংক্তিদুটির প্রথমটিতে রয়েছে
প্রাণিজগতে বৈচিত্রের উদ্দেশ্যের দুর্জ্ঞেয়তা বা অজ্ঞেয়বাদ এবং আহার্যের বিবরণের
প্রথমে রয়েছে ভোজনচক্রের সুসামঞ্জস্যের প্রশংসা যা তাঁর মতে ‘সৃষ্টিকর্তার’
সুব্যবস্থা।
‘বোধোদয়’এ ঈশ্বরপ্রসঙ্গ-প্রবেশ
নিয়ে যে প্রচলিত কাহিনী আছে তাতে এই অংশটির উল্লেখ নেই। তাহলে কি মানা যাতে পারে
যে বিদ্যাসাগর মশাই আগেই এ পংক্তিদুটো লিখেছিলেন? যদি তাই হয় তাহলে তিনি যে নিরীশ্বরবাদী
ছিলেননা এটা সত্য। তাঁর মধ্যে দুর্জ্ঞেয়তার বোধ বা অজ্ঞেয়তাবাদ ছিল এটাও স্পষ্ট। ১৮৫২
সালে প্রকাশিত এ বইটি। ডারউইনের অরিজিন অফ স্পেসিস প্রকাশিত হয়েছে ১৮৫৯ সালে।
কাজেই প্রাণিজগতের বৈচিত্র নিয়ে দুর্জ্ঞেয়তা থাকতেই পারে। মজার কথা এই যে তিনি
কিন্তু এই বৈচিত্রের উদ্দেশ্য কোনো ঈশ্বরের হাতে (‘ঈশ্বরই
জানেন’) ছাড়েন নি। এ্যাগনস্টিক বা অজ্ঞেয়তাবাদী থাকা শ্রেয় মনে
হয়েছিল।
[প্যারান্থেসিসে এটাও বলে রাখা যেতে পারে যে, যে বই থেকে
বিদ্যাসাগর মশাই – বিশেষজ্ঞরা নির্দেশিত করেছেন – এই
বইয়ের সামগ্রী সংগ্রহ করেছিলেন – চেম্বার্সের ‘রুডিমেন্টস
অফ নলেজ, থার্ড বুক’ – তাতে শেষের দিকে অধ্যায়
রয়েছে ‘প্রপার্টি –
লেবার’, অর্থাৎ ‘সম্পত্তি
– শ্রম’। কিন্তু বিদ্যাসাগর মশাই
‘বোধোদয়’এ তাঁর অধ্যায়ের নাম রেখেছিলেন
‘শ্রম – অধিকার’, ‘লেবার
– রাইট’। এটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যত্র এ প্রসঙ্গে যাওয়া যেতে পারে।]
ধর্মের বস্তুবাদী সমালোচনা বলতে যা বোঝায়, বিদ্যাসাগর তা
করেন নি। সেটা তাঁর কার্যদৃষ্টির মধ্যে ছিল না। এও হতে পারে, বন্ধু অক্ষয় কুমার
দত্ত কাজটা করছেন বলেই তিনি আরো নিশ্চিন্ত থেকেছেন। তা সত্ত্বেও, ধর্মের বস্তুবাদী
আলোচনা প্রসঙ্গে অক্ষয় কুমার দত্তের কথা পাড়তে গিয়ে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কিছু কথা
বলে নিলাম কেন না উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণে বস্তুবাদী ভাবনাচিন্তার হাই
পয়েন্ট এই দুজনেই । তাঁরা দুজনে মিলে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিশুমস্তিষ্কে সেই
বস্তুবাদের প্রবেশ ঘটিয়েছেন।
দুটো বই পাশাপাশি রাখা যাক। বোধোদয়
ও চারুপাঠ। দুটোরই প্রথম প্রকাশের বছর সম্ভবতঃ ১৮৫২ (বা কাছাকাছি সময়ে)।
বিদ্যাসাগর রচিত তার আগের বই জীবনচরিত (বেতাল পঞ্চবিংশতি বাদ দিলে)
আর চারুপাঠের আগে অক্ষয়কুমারের রচনা ভুগোল, পদার্থবিদ্যা ও
বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার ।
জীবনচরিত এর বিজ্ঞাপনে
বিদ্যাসাগর বললেন বটে মহাত্মাদের জীবনকাহিনী পড়ে আত্মিক উন্নতিসাধনের কথা, কিন্তু
পাড়লেন বিশেষ করে ইয়োরোপীয় জীবনসংগ্রামী জ্ঞানসাধকদের কথা। অর্থাৎ প্রথমে জ্ঞানার্জনের
প্রয়োজনে কঠোর জীবনসংগ্রামের পথে ছাত্রদের উজ্জীবিত করে তারপর দিলেন সেই জ্ঞানের
প্রাথমিক সোপান – বোধোদয় । যার প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেওয়া হল বস্তুপ্রকৃতি,
প্রাণীজগত, মনুষ্যজাতি, মানবশরীর, ধাতুপরিচয়, সংখ্যাপরিচয়, মুদ্রা, শ্রম ও অধিকার ...
মানে সব মিলিয়ে, রোজকার জীবনসংগ্রামে প্রয়োজনীয় ভাবধারাগত সংঘাতে, বৈজ্ঞানিক-চেতনায়
প্রস্তুত থাকার পকেট-বিশ্বকোষ।
আর, বলতে গেলে বিদ্যাসাগরের উলটো পথে, বিজ্ঞানবিষয়ক তিনটে পাঠ্যবই
লেখার পর অক্ষয়কুমার পৌঁছোলেন চারুপাঠ এ। যাতে, আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, পৃথিবীর
পরিমাণ, বৃক্ষ-লতাদির উৎপত্তির নিয়ম ইত্যাদি বিজ্ঞান বা সাধারণজ্ঞান বিষয়ক
প্রস্তাবের মাঝেমাঝে ঢোকালেন নীতিকথা – বিদ্যাশিক্ষা, দয়া, তরুণ-বয়স্ক
ব্যক্তিদের প্রতি উপদেশ, সন্তোষ, কুসংসর্গ, আত্মপ্রসাদ, স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধিসাধন ইত্যাদি।
এইভাবে দুজনে মিলে শিশু ও
বালক-বালিকাদের মনে মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক-চেতনা নির্মাণের ভিত রচনা করলেন ও নানা ধরণের
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়বার অস্ত্র যোগালেন।
এই পর্যায়ের পর বিদ্যাসাগর এগিয়ে গেলেন অন্যরকম কাজে। আর
অক্ষয়কুমার, কিছুটা অসুস্থতার কারণেও, অন্যান্য সক্রিয়তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে
নিয়োজিত করলেন তাঁর ম্যাগনাম ওপাস, “ভারতবর্ষীয়
উপাসক সম্প্রদায়” রচনায়।
·
“ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” রচনাকালে অসুস্থ শরীরে তিনি যে
পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন, বার বার মাথার যন্ত্রণায় মুহ্যমান হয়ে পড়েও যেভাবে এগিয়ে
গেছেন রচনায়, তার অনুসন্ধানে এক অসাধারণ উপন্যাস তৈরি হতে পারে। আমি আপাততঃ, ওই
রচনার সময় ধর্ম সম্পর্কে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গী, তার কয়েকটি দিক দেখিয়ে কথা শেষ করব।
এবং সেটা দেখানোর জন্য ব্যবহার করব মূল গ্রন্ধদুটো নয়, তার প্রথম খন্ডের দীর্ঘ
উপক্রমণিকা।
একটা প্রশ্ন উঠবে, যে উনি তো আর
নতুন কথা কিছু বলছেন না, ইয়োরোপীয় ভারতবিদদের গবেষণালব্ধ তথ্য ও জ্ঞানকে নিজের মত
করে বাংলায় লিখছেন। নিশ্চয়ই, কিন্তু মানছেন কেন? না মানলেও তো পারতেন। বা, ‘ওনারা বলছেন’, ‘সুধী পাঠকেরা নিজেই বিচার করবেন’ ইত্যাদি বলে নিজেকে আলাদা রাখতে
পারতেন। তা কিন্তু উনি করেননি। কথাগুলো নিজের কথা হিসেবে রেখেছেন। এবং সেটাই
গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার নবজাগরণে ধর্মসমালোচনা এসেছে অনেকেরই লেখনীতে। কিন্তু বার
বার তারা যুক্তিগ্রাহ্যতার আবরণে বা মানবিকবোধের প্রয়োজনে নতুন ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা
করেছেন। বিদ্যাসাগর করেননি, আবার সেভাবে সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন নি। অক্ষয় কুমার প্রবৃত্ত
হয়েছেন এবং যতটা গভীরে গিয়েছেন তা চমকপ্রদ। তখনকার কলকাতায় ইংরেজ বা ফরাসী
বস্তুবাদীদের রচনা গ্রন্থাগারে প্রাপ্য ছিল নিশ্চয়ই, এবং তার প্রভাব নিঃসন্দেহে
পড়েছিল সবারই ওপর। তবে ধর্মের বস্তুবাদী সমালোচনা এত বিশদ ভাবে অক্ষয় কুমারের লেখাতেই
পাওয়া যায়।
প্রথম খন্ডের উপক্রমণিকা
বইটির দুই খন্ডেই, মূল বিষয়ে প্রবেশের
আগে দীর্ঘ উপক্রমণিকা আছে। শরীর সুস্থ থাকলে প্রথম খন্ডেই হয়ত পুরোটা লিখতেন।
কিন্তু শারীরিক কারণে তা পারছেন না, তার উল্লেখ রয়েছে প্রথম খন্ডের উপক্রমণিকার শেষে।
প্রথম খন্ডের উপক্রমণিকা তিনি শুরু
করছেন সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে এক আদিম জাতির দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার কাহিনী দিয়ে। এই
কাহিনী বা আর্যদের অভারতীয় মূল সর্বজনবিদিত, তাই সে প্রসঙ্গে কিছু বলার প্রয়োজন
নেই। শুধু এটুকু উল্লেখ্য, যে অক্ষয় কুমার গল্প বলেন নি, কেন সেসময়কার আধুনিক
ইওরোপীয় গবেষণা সত্যাশ্রিত, ভাষাবিজ্ঞানভিত্তিক যে তুলনা দিয়ে সংস্কৃত এবং
ইয়োরোপীয় ভাষাগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক সুনিশ্চিত করা হয়েছে, সেসব তিনি বিশদ ভাবে
উপস্থাপিত করেছেন। তারই মাঝে তিনি বলছেনঃ
“মানবজাতির বুদ্ধি বিদ্যা যখন যেরূপ অবস্থাপন্ন
হয়, তাহাদের জাতীয় ধর্মও প্রায় তদনুরূপ অবস্থায় অবস্থিত হইয়া থাকে। সভ্য ও অসভ্য
জাতিদিগকে সতত এক ধর্ম অবলম্বন করিতে দেখা যায় বটে, কিন্তু সেটি নাম মাত্র; তাহাদের
ধর্ম-জ্ঞান ও ধর্মানুষ্ঠান কদাচ একরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই। অতএব আদিম আর্য্য-বংশীয়দিগের
ধর্মের অবস্থা জানিতে হইলে, তাঁহাদের বুদ্ধি বিদ্যা ও সামাজিক অবস্থার বিষয় পরিজ্ঞাত
হইলে ভাল হয়।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ১৩]
উদ্ধৃতির
শেষ অংশে জোর বর্তমান লেখকের। ধর্মের অবস্থা জানতে হলে, বুদ্ধি, বিদ্যা ও সামাজিক
অবস্থার কথা জানতে হবে, তিনি বলছেন। এখানেই আমরা কার্ল মার্ক্স রচিত “অধিকারের দর্শন”এর বিখ্যাত পংক্তিটির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারিঃ “The
foundation of irreligious criticism is: Man makes religion,
religion does not make man.”
অক্ষয়
কুমার, মানুষ কিভাবে তার ধর্ম তৈরি করল সেটাই বলতে চলেছেন। একটু এগিয়ে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক
ঘটমান বিষয়াদির (ফেনোমেনন) উপাসনা সম্পর্কে বলছেনঃ
“বস্তুতঃ তাদৃশ পূর্ব
কালে ঐ সমস্ত বস্তুরই উপাসনা প্রচলিত থাকা সম্পূর্ণ সম্ভব। সে সময়ে মানব-জাতির
বুদ্ধিবৃত্তি তাদৃশ মার্জিত ও পরিপক্ক হয় নাই, সুতরাং তাঁহারা এই সুকৌশল-সম্পন্ন
পরম সুন্দর বিশ্ব-যন্ত্রের মর্মোদ্ভেদ করিতে সমর্থ হন নাই। তাঁহারা যে সমস্ত বহু-শক্তি-সম্পন্ন
তেজোময় জড় বস্তুর অসামান্য প্রভাব ও উপকারিতা-গুণ দৃষ্টি করিলেন, তাঁহাদেরই দেবত্ব
ও প্রধানত্ব স্বীকার করিয়া অর্চনা করিতে আরম্ভ করিলেন। মানব-জাতির ইতিহাস-গর্ভে
যতই প্রবেশ করা যায়, ততই এই বিষয়টি, সম্ভাবিত বলিয়া প্রতীয়মান হইতে থাকে।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ২৫]
এ তো গেল
প্রকৃতির কথা। সমাজ? অক্ষয় কুমার বলছেন যে সে সময়কার সমাজে বর্ণ-ভেদ বা বর্ণ-বিচার
ছিল না। আবার অন্যদিকে, পরিবার একক-বৈবাহিক সম্পর্কে উন্নীত ছিল। তিনি এটাও দেখছেন
যে বিধবাদের “পুনঃসংস্কার হইত কি না, সে বিষয়ের কোন পক্ষে কিছুমাত্র
প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না”, অর্থাৎ হোক বা না হোক, তাতে বর্ণের কোনো প্রশ্ন আসছে না।
“সামাজিক ব্যবস্থার
মধ্যে ঐ আদিম সময়ে উদ্বাহ-সংস্কার প্রকৃত প্রস্তাবেই প্রচলিত হইয়াছিল ইহা ইতিপূর্বেই
একপ্রকার প্রদর্শিত হইয়াছে। বিধবা শব্দও ঐ বিষয়টি সপ্রমাণ করিয়া দিতেছে। আর্য্যবংশীয়
অধিকাংশ জাতির মধ্যেই বিধবা-বাচক শব্দের সর্বাঙ্গীণ সৌসাদৃশ্য অবলোকিত হইয়া থাকে।
অতএব পতি-বিয়োগ হইলে, ঐ অতীব পুরাকালীন আর্য্য-বনিতারাও বিধবা বলিয়া গণ্য হইতেন
তাহার সন্দেহ নাই। তবে তাঁহাদের পুনঃসংস্কার হইত কি না, সে বিষয়ের কোন পক্ষে
কিছুমাত্র প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। হিন্দুদিগের সামাজিক ব্যবস্থাবলির মুলীভূত
যে বর্ণ-বিভাগ, তাহাও সে সময়ে সম্পন্ন হইয়াছিল এমন বোধ হয় না। ভারতবর্ষীয় ভিন্ন
অন্য দেশীয় আর্য্য-বংশীয়দিগের মধ্যে প্রকৃত প্রস্তাবে বর্ণ-ভেদ ও বর্ণ-বিচার থাকিবার
অণুমাত্রও নিদর্শন লক্ষিত হয় না। অতএব আদিম আর্যেরা একত্র সংসৃষ্ট থাকিতে ঐ বিষয়
প্রচলিত হয় নাই এ কথা নিঃসংশয়ে বলিতে পারা যায়।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ২৬]
দেবাসুরের
যুদ্ধ পরিচিত পুরাণ-প্রসঙ্গ। সে প্রসঙ্গটাকেও অক্ষয় কুমার তাঁর বস্তুবাদী ইতিহাসদৃষ্টি
দিয়েই দেখছেন, এবং তিনটি দিক স্পষ্ট
করছেন – (১) আখ্যানের বাস্তবিক ভিত্তি; (২) ধর্মযুদ্ধের ভিত্তিতে উৎপাদক
শক্তির সংঘাত; (৩) ইতিহাস ব্যক্তি-ভিত্তিক নয় সেদিকে ইঙ্গিত। দেখুনঃ
“পুরাণে ও ব্রাহ্মণে
বর্ণিত দেবাসুরের যুদ্ধ-বিবরণেও হিন্দু ও পারসীকদিগের ঐ ধর্ম-ঘটিত বিরোধ-বৃত্তান্তই
লক্ষিত হইতেছে। পুরাণে ও মহাভারতে হিন্দু-বংশীয় কতকগুলি লোকের ম্লেচ্ছ-ভাব-প্রাপ্তি
বিষয়ের অনেকানেক উপাখ্যান সন্নিবেশিত আছে। হয়ত, তাহার মধ্যেও, এই প্রস্তাবিত
বিসম্বাদ নিদর্শিত রহিয়াছে। [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৫০]
“ইরানি জাতীয়দিগের
মতানুসারে ধর্ম-সংশোধন ও কৃষিকার্য্যের বহুল প্রচলনই ঐ বিরোধ ও বিচ্ছেদ-ঘটনার মূল
কারণ। যদিও এক দিবসে এক জন কর্তৃক এই মহত্ব্যাপার সুসম্পন্ন হইয়াছিল বোধ হয় না, তথাচ
অবস্তানুসারে জরথুস্ত্র-স্পিতম নামক মহাত্মা এই গুরুতর বিষয়ের প্রবল ও কৃত-কৃত্য
প্রবর্তক বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছেন। [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৫১]
এবং তারই
সুত্রে এক্সোডাস বা দুইদিকে অভিনিষ্ক্রমণঃ
“বোধ হয়, পঞ্চনদে অর্থাৎ
পঞ্জাব প্রদেশে ঐ শোচনীয় বিসম্বাদ উপস্থিত হয়। ঐ বিষম বিরোধ-প্রভাবে
হিন্দু ও পারসীকেরা একেবারে স্বতন্ত্র হইয়া পড়িলেন। জরথুস্ত্র-স্পিতমের প্রবর্তিত
সম্প্রদায়ীরা হিন্দুদিগের সহিত পৃথগভূত হইয়া তথা হইতে চির দিনের মত প্রস্থান
করিলেন ও পশ্চিমোত্তর দিক দিয়া ক্রমশঃ বাহ্লীকাদি নানা দেশে ভ্রমণ ও অবস্থান পূর্বক
পারস্তানে গিয়া পারসীক নাম প্রাপ্ত হইলেন; এবং হিন্দুরা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে পূর্ব
ও দক্ষিণ ভাগে অগ্রসর হইয়া ক্রমে ক্রমে বিস্তৃত হইয়া পড়িলেন ও তত্রত্য বিবিধ-বংশীয়
অসভ্য আদিম-নিবাসীদিগকে নির্জিত ও নির্বাসিত করিয়া জয়-পতাকা ও ধর্ম-পতাকা উড্ডীয়মান
করিতে লাগিলেন।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৫১-৫২]
তারপর অক্ষয়
কুমার ধরলেন দেবদেবীদের স্থানিকতা। সবাই সব সময় পরম আরাধ্য ছিলেন না। আখ্যানে বিভিন্ন
সময়ে বিভিন্ন দেব ও দেবীর উল্লেখের পিছনে আছে মানুষের বাস্তবিক অভিযান, খাদ্য ও আশ্রয়ের
খোঁজে।
“দেখিতে পাওয়া যায়, হিন্দুরা
ক্রমে ক্রমে যে যে দেশে অধিবাস করিয়াছেন, সেই সেই দেশের জল-ভাগ ও স্থল-ভাগ-বিশেষকে
দেবতা বা দেবতা-স্বরূপ অথবা পরম পবিত্র দেব-স্থান জ্ঞান করিয়া আসিয়াছেন। অতএব বৈদিক
ধর্মের প্রথম অবস্থার বিবরণ করিতে হইলে তাঁহারা ভারতবর্ষ-প্রবেশ করিয়া প্রথমে কোন
স্থানে অবস্থান করেন তাহার অনুসন্ধান করা আবশ্যক।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৬৯]
“ভারতবর্ষ-মধ্যে
হিন্দুদিগের প্রথম নিবাস-ভূমি পঞ্জাব ও সারস্বত দেশীয় নদী সমুদায়ের পরিচায়ক ভূরি ভূরি
বচন ঋগ্বেদ-সংহিতায় সন্নিবেশিত আছে, কিন্তু তাহাতে গঙ্গা যমুনার নাম অতীব বিরল। পূর্বে
উদ্ধৃত যে ঋকটিতে ঐ দুই নদীর নাম প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাহা ঋগ্বেদ-সংহিতার সমধিক অপ্রাচীন
ভাগেরই অন্তর্গত। সেই ঋকটি রচিত হইবার সময়ে হিন্দুরা পঞ্চনদ ও ব্রহ্মাবর্ত্ত উত্তরণ
পূর্বক জাহ্নবী-জল স্পর্শ করিয়াছিলেন তাহার সন্দেহ নাই, কিন্তু তদানীন্তন আর্য্যেরা
ইদানীন্তনদিগের ন্যায় তাঁহাকে সুখ, স্বর্গ ও মোক্ষপদ-দাত্রী বলিয়া চিনিতে পারেন
নাই। বোধ হয়, সিন্ধু সরস্বতী প্রভৃতির তুল্যরূপ পূজাস্পদ বলিয়াও স্থির করেন নাই।
সিন্ধু ও সরস্বতীর উদ্দেশে যেমন বহুতর স্বতন্ত্র সূক্ত ইক্ত হইয়াছে ঋগ্বেদ-সংহিতায়
গঙ্গা নদীর স্তুতি-গর্ভ এতাদৃশ একটি সূক্তও বিদ্যমান নাই। যাহা হউক, আর্য্যেরা ঐ
সমস্ত বচন-রচনা সময়ে গঙ্গা, যমুনার অন্তর্গত অন্ত্ররবেদী অর্থাৎ দোয়াব পর্য্যন্ত
আগমন করিয়াছিলেন তাহার সংশয় নাই। একটি ঋকে কীকট অর্থাৎ মগধ বা বেহার দেশের নাম নির্দেশিত
আছে, কিন্তু যাস্ক ঋষি উহাকে অনার্য্য-দেশ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৭২]
উপাসনার
লক্ষ্য হিসেবে প্রাকৃতিক ঘটমানতা ও শক্তির সাথে ব্যক্তিরাও আছেন। তাঁরা কারা? অক্ষয়
কুমার বলছেনঃ
“সচরাচর যেমন
লোক-সমাজের একটি অধীশ্বর অর্থাৎ রাজা থাকেন, সেই রূপ বেদ-সংহিতার মধ্যে
হিন্দুদিগের দেব-সমাজেও বরুণ দেবতাকে এবং কখন বা ইন্দ্রাদি দেবতাকেও রাজ-পদে অধিরূঢ়
দেখিতে পাওয়া যায়।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৮৫]
নিচের অংশটা
লক্ষ করে পড়বেন। প্রথম পংক্তিটি উল্টো। বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন যে ধর্মশাস্ত্র
সামাজিক ব্যবস্থার অনুযায়ী, কিন্তু তাতে অনেকের চটে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। পুরোনো
কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা তো ছিলই। কিন্তু প্রথম পংক্তির ওই ঘোমটাটুকুর পর যথার্থ কথাটাই
বলেছেন।
“হিন্দুদিগের সামাজিক
ব্যবস্থাও ধর্মশাস্ত্রের অনুযায়ী। অনতিপ্রাচীন পুরুষসূক্তে চারি বর্ণের বিষয়ই লিখিত
আছে বটে, কিন্তু ঋগ্বেদের প্রাচীনতর সূক্ত সমুদয়ে বর্ণ-বিভেদ থাকিবার কোন সুস্পষ্ট
প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। তাহার দুই এক স্থলে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শব্দ বিদ্যমান
আছে, কিন্তু তাহা কোনরূপেই কুল-পরম্পরাগত বর্ণ-বিশেষ প্রতিপাদক বলিয়া স্থির করা
যায় না। প্রথমে হিন্দুদিগের বর্ণ-ভেদ ছিল না; ভারতবর্ষে আসিয়া প্রয়োজনানুসারে
ক্রমে ক্রমে উহার সুত্রপাত হয়। ঐ ব্যবস্থা সংস্থাপিত হইলেও প্রথমে কুল-পরম্পরাগত ছিল
না, লোকে আপন আপন গুণ-কর্মানুসারে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি বলিয়া উল্লিখিত হইত। এক বর্ণ
হইতে অন্য বর্ণ উৎপন্ন হইত; এমন কি গ্রন্থ বিশেষে এক ব্যক্তি হইতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,
বৈশ্য ও শূদ্র চারি বর্ণেরই উৎপত্তি-প্রসঙ্গ বিনিবেশিত আছে। কালক্রমে যখন এই বর্ণ-ভেদ
কুল-পরম্পরাগত হইয়া আসিল, তখনও এক জাতীয় লোকে তপস্যা-বলে বা গুণ-প্রভাবে অন্য
জাতির পদে অধিরোহণ করিতে পারিত। অন্য জাতির অন্নগ্রহণ ও ভিন্ন জাতীয় স্ত্রীগণের পাণিগ্রহণ
করিতে সমর্থ হইত। বর্ণ-বিচার-প্রণালী যে হিন্দুদিগের সহজাত ব্যবস্থাবৎ প্রতীয়মান
হয়, তাঁহাদের উল্লিখিতরূপ ইতিহাস-বর্ণন আপাততঃ চমৎকার-জনক বোধ হয় বটে, কিন্তু তদীয়
পন্ডিতেরাই নিজ শাস্ত্রে ইহার সমূহ নিদর্শন রাখিয়া গিয়াছেন। অতএব বেদ-সংহিতার যে
সমস্ত প্রাচীনতর ভাগে হিন্দু জাতির প্রথমাবস্থারই ইতিহাস-বর্ণন আছে, তাহাতে উল্লিখিত
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শব্দ কুল-ক্রমাগত বর্ণ-বিশেষ না হইয়া পূর্বোক্তরূপ বৃত্তি বা
কর্ম-বিশেষ-বিজ্ঞাপক ছিল এইরূপই সম্ভব বোধ হয়।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৮৭-৮৮]
কিন্তু
পরবর্তী কালে বর্ণ-ব্যবস্থা প্রস্তরীভূত হল। কাজেই পরবর্তী কালের গ্রন্থে রয়েছে
তার প্রতিফলন। বর্ণব্যবস্থায় শূদ্রের অবস্থানও তিনি এই প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে দিলেন।
“ব্রাহ্মণ সমুদায়ে
হিন্দুদিগের সামজিক ব্যবস্থা নানা বিষয়ে বর্দ্ধিত দেখা যায়। সে সমস্ত সঙ্কলিত
হইবার সময়ে বর্ণ-ভেদ-প্রণালী একরূপ সম্পূর্ণ ছিল তাহার সন্দেহ নাই। তাহার মধ্যে
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এও চারি বর্ণের বিষয়ই সুস্পষ্ট লিখিত আছে। প্রথমোক্ত
তিন বর্ণ আর্য্য-বংশীয়; শূদ্রেরা অনার্য্য। কৃষ্ণবর্ণ দস্যু বা দাসদের সহিত শুভ্রবর্ণ
আর্য্যদিগের বদ্ধ-মূল বিরোধ ও ঘোরতর যুদ্ধ-প্রসঙ্গ ঋগ্বেদ-সংহিতার বহুতর স্থানে
বিস্তৃত রহিয়াছে। ভারতবর্ষের পূর্ব-নিবাসী ঐ দস্যু বা দাসদিগের মধ্যে যাহারা মহাবল
পরাক্রান্ত আর্য্যগণ কর্ত্তৃক পরাভূত হইয়া দাসত্ব স্বীকার করে, তাহারাই শূদ্র বোধ
হয়। ঐ দাস সংজ্ঞাটি শূদ্রদের চিরসঙ্গী হইয়া আসিয়াছে।” [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ৯৮]
হিন্দু ধর্ম
নাকি শান্তিপ্রিয়। ওসব ধর্মযুদ্ধ-টুদ্ধ, ক্রুসেড, জেহাদ ... খ্রিষ্টধর্মে বা ইসলামধর্মে
হয়। অক্ষয় কুমার কি বলেন?
“পাঠকগণ বিবেচনা করিতে পারেন, ইরানীদিগের সহিত
হিন্দুদিগের পৃথক হইবার পর অবধি বৈদিক ধর্ম ভারতভূমির মধ্যে বিনা বিরোধে প্রচারিত
ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু কোন দেশীয় জাতীয় ধর্ম বিনা বিসম্বাদে
প্রচলিত হইবার বস্তু নহে। অবনীমন্ডলে ধর্ম নিবন্ধনে যত যন্ত্রণা, যত নরহত্যা ও যত শোণিত-নিঃসারণ
হইয়াছে, এত আর কিছুতেই হইয়াছে কিনা সন্দেহ। কি পুরাতন, কি অধুনাতন, কি
প্রলীয়মান, কি অভ্যুদয়বান, সকল ধর্মই বিদ্বেষ-কলুষে কলুষিত হইয়া অধর্মের ক্রোড়ে অধিষ্ঠিত
ও পরিপালিত হইয়া আসিয়াছে। হিন্দু ও ইরানীদের বদ্ধ-মূল বিরোধ-প্রসঙ্গ বেদ ও
অবস্তাকে চির-কলঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে। খ্রিষ্টানদের ক্রুসেড ও মুসলমানদিগের ধর্ম-সংগ্রাম
স্মরণ হইলে, হৃদয় কম্পমান হইতে থাকে। হিন্দু ও বৌদ্ধদিগের চির-বদ্ধ বিসম্বাদে বৌদ্ধগণকে
ভারতবর্ষ হইতে একেবারে নির্বাসিত করিয়া দিয়াছে। যুক্তি-বিদ্বেষী স্বমতাসক্ত ধর্মপ্রচারকেরা
এমনি ক্রোধান্ধ ও হতবুদ্ধি হয় যে, বোধ হয় অধুনাতন রাজশাসন প্রণালী সমধিক প্রভাববতী
না হইলে, ভারতভূমি এসময়েও উগ্রতর নিগ্রহ-তাপে পরিতপ্ত হইয়া নর-কন্ঠ-শোণিতে অভিষিক্ত
হইত। অনতিপ্রাচীন শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে যেরূপ ঘোরতর বিসম্বাদ উপস্থিত হয়, পূর্বকালীন
বৈদিক সম্প্রদায়ীদিগেরও পরস্পর তদনুরূপ বিরোধ ও বিদ্বেষ ঘটনা হইয়াছিল তাহার সন্দেহ
নাই। সংহিতায়, ব্রাহ্মণে ও পরিশিষ্টাদি পূর্বতন শাস্ত্রে এবিষয়ের বহুতর নিদর্শন লক্ষিত
হইয়া থাকে। ইন্দ্রদেবের উপাসনা অবলম্বন বিষয়ে ভারতবর্ষীয় আর্য্য-সমাজে যে গুরুতর
মতভেদ ও ঘোরতর বিরোধ-ঘটনা হইয়া যায়, তাহা পূর্বেই একরূপ লিখিত হইয়াছে। ঋগ্বেদ-সংহিতায়
যে ইন্দ্রাগস্ত্য-সংবাদ আছে, তাহা হইত অনূক্ত ঋক্ দুইটি উদ্ধৃত হইতেছে। উহা ধর্ম-সংক্রান্ত
বিরোধ-সূচক ব্যতিরেকে আর কিছুই বোধ হয় না। অনুমান হয়, অগস্ত্য এক সময়ে ইন্দ্রদেবের
উপাসনায় অসম্মত হন ও ইন্দ্র-উপাসকদের প্রতি বিদ্বেষ-পরবশ হইয়া তাঁহাদের অনিষ্ট-চেষ্টা
আরম্ভ করেন।
[দেবনাগরী লিপিতে মূল ঋক্টি উদ্ধৃত
করলাম না]
ঋগ্বেদ-সংহিতা । ১ । ১৭০ । ২।
(অগস্ত্য কহিতেছেন) – হে ইন্দ্র! কেন তুমি আমাদিগের বধাভিলাষী হইতেছ।
মরুদগণ তোমার ভ্রাতা, অতএব তাঁহাদের সদ্ভাব অবলম্বন কর। আমাদিগকে রণে নিধন করিও না।
[দেবনাগরী লিপিতে মূল ঋক্টি উদ্ধৃত
করলাম না]
ঋগ্বেদ-সংহিতা । ১ । ১৭০ । ৩ ।
(ইন্দ্র কহিতেছেন) – ভাই অগস্ত্য! তুমি
হিতকারী বন্ধু হইয়া কি নিমিত্ত আমাকে অমান্য করিতেছ। আমাকে কিছুই দিতে তোমার অভিলাষ
নাই, তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। [ভা.উ.স. ১, ২য় সংস্ক., পৃ. ১০৪-১০৫]
শেষ
করছি
প্রসঙ্গত,
‘ভারতীয়
উপাসক সম্প্রদায়’ এর
দ্বিতীয় খন্ডের উপক্রমণিকার এই লেখায় করে জায়গা বাড়ালাম না কেন ওটা দর্শনসংক্রান্ত
আলোচনা। ষড়দর্শনের অধিকাংশই যে নিরীশ্বরবাদী, তা শুধু বলেন নি, দর্শনগুলোর ব্যখ্যা
করে দেখিয়েছেন কেন তাদের বিশ্বরূপযোজনায় ঈশ্বরের কোনো যুক্তিসঙ্গত স্থান নেই। তবুও,
যুদ্ধংদেহি গোছের দু’একটি উদ্ধৃতি
দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না।
“এখন,
বেদ-প্রাণ হিন্দুমন্ডলি! শ্রবণ কর! তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদ-মন্ত্রের
মীমাংসাকারী পূর্বকালীন আচার্য্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন, না দেবতাই স্বীকার করিতেন।
তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।” [ভা.উ.স. ২, ২য় সংস্ক., পৃ. ৩৯]
এই ষড়দর্শন ও তারপর বেদান্ত নিয়ে আলোচনার পর চার্বাকের কথা বলেছেন। সর্বদর্শনসংগ্রহ থেকে চার্বাক-কথিত বলে উল্লিখিত সবকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন উপক্রমণিকায়, যাতে পাঠক বঞ্চিত না হয়। তারপর অনেকটা অংশ জুড়ে রামমোহন রায়ের প্রশস্তি (ন্যায্য ও প্রাপ্য প্রশস্তি) আছে। আছে মনুসংহিতার তীব্র সমালোচনা। এবং কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে নিজের অসুস্থতা নিয়ে; নইলে আরো অনেক কাজ করে যেতে পারতেন। সেসব কষ্টদায়ক। যা হোক, দ্বিতীয় খন্ডের উপক্রমণিকা নিয়ে অন্যত্র, বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।
ব্যাঙ্গালোর
২৬/২৭.১২.২০
No comments:
Post a Comment