রাত শেষে সজল হয়ে উঠছে তারাগুলি ।
ঘুমের দহে রূপোর হালের আলতো মোচড় দিয়ে
হারিয়ে গেছে চাঁদ ।
বইছে শিশির, গাছের গুঁড়ি বেয়ে ।
দূর বাংলায় এমনই এক অন্বিত রাত শেষে
খাড়ির মৃদু হাওয়া
ডাবের ভিতর দুধিয়ে দিত জল,
জেগে উঠত ঘরের কোণে সুতোবোনা মেয়ে ।
সারাটা দিন রোদে ফেটে উপচে পড়ত তুলো ।
দিল্লী থেকে আসত মোগল সল্তনতের তাড়া ।
বণিক জাহাজ উত্তমাশা
অন্তরীপের নিত দখল
রেশম পথে, খাইবারে সাত
ভাষার চলত অদলবদল,
দাদন দিতে আসত মহাজনের কারিন্দারা ।
গাঁয়ের হাটে দুপুর বেলায় পছিয়া সদাগর
ফেরি করত চিনি;
রাতে বাপু, মাদুরে চিৎ, পুছতো আকাশটাকে,
“বর্ষা আসছে, খড় কী করে, বল্ তো মা, কিনি ?...
সুতোবোনা মেয়েরা বাংলার –
জেগে উঠত – চাঁপা-আঙুল গাইত কাপাস-গান,
স্বচ্ছরক্ত শিশির শিরার দৈর্ঘা টানটান
যুগের সাঁঝে পাটরানিরা নরককুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার কালে
ডাকত তাদের, ঢেকে নিতে নগ্নতা নিজদেহের
আরো করূণ মোহজালে ।
֍
ইতিহাসের টিকায় লেখা, তারা ছিল কূলীন ঘরের
বালবিধবা, কারণ
চাষের কাজে, ঘরের কাজে হাত ক্ষওয়ানো ছিল তাদের বারণ !
মাঝে মধ্যে পূর্বজন্মে যাই ।
অশরীরে বসে জানি সেই কোনো এক নারীর
দেহদেউলে মধুপর্বের ঝুঁকি –
সূক্ষ্মতম তৃষার তন্তু পাই,
মসলিনেরই সুতোয় গড়া ঊর্ণনাভ প্রায় ।
পাশে থাকে শূদ্রাণী মোর, পাছে বখাই, নিয়ে যেতে চায় ।
পুছি আমার শূদ্রাণীকেই, আপন ভাঙা ঘরে –
“একটিবারও কস্নি তারে, ভাগ্ !
“মরতে আছে ঘরে,
“কিসে বাঁধা পড়ে ?
“জীবনটা কি শিকলের দায়ভাগ ?...”
শূদ্রাণীও হাসে –
ওই নারীও হেসে ওঠে বাঁশবনের ওপারে তির্যক ।
চাঁদের কাঁপন দেখে বুঝি তাদের হাসির অন্ত্যমিল,
যদিও এ কাব্য নয় নারী বিষয়ক ।
֍
রাতশেষে সজল হয়ে উঠছে তারাগুলি – নিভে আসছে ।
শহরপ্রান্তে নো-এন্ট্রির বাইরে লাইন, ট্রাকগুলির
জিরিয়ে নেওয়ার, বাড়ছে ।
মাজার নিঝুম – আধেক দেখছি শালু –
আবির্ভাবের নামালুম সালতারিখ,
এক জিনের তারিফ, মোবারকবাদ...
অশ্বত্থও নতুন পাতায় পান্নাসবুজ জাগছে ।
শহরপ্রান্তে ছোটোবস্তির মহিলারা ইতিউতি
বেশি আঁধার ঝোপের আড়াল খুঁজছে ।
---------
আইজলের মনোরমা !
---------
অনেক প্রশ্ন পাহাড়গুলির সমতলের বিরুদ্ধে আজ জমা ।
অনেক প্রশ্ন অরণ্যানির, অববাহিকার,
অনেক প্রশ্ন দেশের – দেশটা কার ?
֍
কেমন করে বুনট পেল দেশটা তার রক্তসমাগমে ?
ব্লক সদরের সূচী থেকে তুলি
যে কোনো এক গ্রামের নাম, নামের ভিতর
কয়শ’ বছর লাঙল, জাল, ঢেঁকি, তাঁত, হাপর
মিলছে সমে ?
কত হাজার চৈত্ররাতের নিদ্রাহীন, ফুরিয়ে আসা বাতি
গড়ছে কাঠে, কাঁসায়, বস্ত্রে, পোড়ামাটি, পাথরে সুখ্যাতি ?
ফাল্গুনে, অঘ্রাণে বরযাত্রা ও বাসর
মনে রাখে, বিশেষ কোনো গল্প ?
গল্পসূত্রে কোনো পরবের রাত্তিরে আল ধরে হঠাৎ
দেবীদর্শন ? গ্রামখানি হয়
পীঠস্থান – স্মৃতি, শ্রুতির কল্প ?
মৃত্যুভার কাঁধে নিয়ে, জন্মকূজন রেখে পাশের ঘরে
টোলাগুলোর পারাপার, কয় প্রজন্ম ধরে ?...
তারি মধ্যে পঞ্চ আর প্রপঞ্চ বদল ।
দাঁত কামড়ে সয়ে যাওয়ার বল,
শিকল ছিঁড়ে অভিমানী যাওয়া,
অচেনা উজান, ঘৃণার নতুন পালে বাওয়া !
রক্তপাত !... কত ঝোঁকে
শহর থেকে এল নতুন জল ?... নতুন কল ?...
কবে হল বিলুপ্তি, দুর্যোগে ?
আবার ফুঁড়ে উঠল নবশ্বাসে ?
একটু কি বলবেন স্যার, হাকিম !
নিয়েছেন কি উদ্যোগ,
দাখিল করার, মহাফেজে, বিশদে এই স্মৃতিমহীরূহ
এই নামটির পাশে ?
֍
একটি দেশের এই তো এক কোষ, জায়মান !
পথ হতে চায়, কষ্ট ফলায়, দুর্বিপাকে রেঁধে
পরিশ্রমের নুনে অনির্বাণ,
হিন্দ বলতে লড়ে পাওয়ার ভূবন গড়ে প্রাণ !
֍
বুনন তবু বুনন ! ধরে বাতাসী জলনীড়,
উঠোন থেকে উঠে, পা ধুয়ে মানুষটি, বসে তাঁতে ।
জল-ঘর্ষণ, চকিত আলোর বজ্রশাসন ফেরায়
বেঁচে থাকার আটপৌরে চৌহদ্দিটাতে ।
কচুবনে উদোম শিশুর বাজে ক্যানেস্তারা,
নদী মেটে ঘূর্ণিস্রোত, খালে উথাল মৎস্যবীজ,
বাড়ে ধানের চারা ।
কুল ছাপায় বিল, বিলের রহস্যবাখান –
বাপের অশ্রুযন্ত্র মেয়ের অশ্রুতন্তু দিয়ে
বোনে গান ...
মসলিন !...
এক দেশ,
সৃজনধন্য !
এমন মিশেল জানত লোহার
দামাস্কাসে পৌঁছে হত শ্রেষ্ঠ অসি, তাবৎ জাহাঁর
তরী গড়ত শক্তিশালী, তিন সমুদ্রে ছড়িয়ে দিতে পণ্য !
বাপের নামটা কী ?
বলতে পারো হিঁদুয়ানির মোড়ল ?
বলো দেখি মুরুব্বি ইসলামের,
মেয়ের নামটা কী ?
নিজের গান অশ্রু করে মেয়ের
অশ্রু দিয়ে গান বোনাই হিন্দের বন্দিশ !
কবে থেকে শুরু করি বলো !
কবীর ?... না কি তারও আগের, বন্দরে, মাশাল্লা
তোমাদেরই হাতে কলুষ – সেই কোন এক গাঁয়ের বৌ –
বেশ্যার কুর্ণিশ ?
বন্ধু বলে, সখা বলে, বলে আপন প্রিয়তম
কে এমন, ইশ্বরকে দিয়েছিল ডাক !
মানুষজনের কাজে ভীড়ে, ধাক্কা, রগড়, গালি খেয়ে
মুক্তির যে কলোচ্ছলে হাসল ইশ্বর,
ওই হাসি তোমাদের নরক, কুম্ভীপাক !
আগুন নিয়ে খেলছো বটে –
জানোনা যে বৃষ্টিও তো আগুনেরই নাম !
সব্বাইকে সবার মত
আরো আরো হতে দেওয়াই
হিন্দের পয়গাম !
এই তো এক দেশ যেথা জন্ম চায়
পাঁচ ধর্ম, সাত জাত, সতেরো ভাষার নিবিড় সংকর
মাথায়, নাকের হাড়ে
মেঘবিন্দু হয়ে জমে গোন্ডোয়ানার আগ্নেয় ভুস্তর !
֍
একশো নীল পদ্মদ্যূতি ফোটাবে এক উষা –
শিশিরশিরার ঊর্ণনাভে খেলবে রঙীন ইন্দ্রধনুর পুচ্ছ ।
গাছে গাছে গরম হয়ে উঠবে ফলের গুচ্ছ ।
এগিয়ে আসবে নতুন খইয়ের কোজাগরী, গুড়ের মৌতাত
আবার ঠিক এই স্তবকেই দেখা হবে নির্জনে, শেষরাত !
[সঞ্চিতা, শারদ সংখ্যা ১৪১৪য় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment