“মুখ্যমন্ত্রী তখনও আসেননি । বাইরে
ভীড়ে ভীড় । আমিও বসে গেলাম এক কোণে । রাত তখন ন’টা । আর্দালিটা বলল, কখন ফিরবেন
জানা নেই ।
“সে অবশ্য আমিও জানতাম । ডামাডোল
অবস্থা সরকারের । আগেরদিন বিধানসভায় অর্থমন্ত্রী নাস্তানাবুদ হয়েছে বিরোধীপক্ষের
হাতে । ইন্ডাস্ট্রিগুলোর তো দেখছেনই কী হাল !
“বসে রইলাম । রাত সাড়ে দশটায় মুখ্যমন্ত্রী
এলেন । দু’একজনের পরেই আর্দালি বাইরে এসে ডাকল, ‘বিশ্বনাথ সিং !’
“আমি ভাবিনি যে আমায় দেখতে পেয়েছিলেন
বারান্দা দিয়ে ঢোকার সময় । বললে বিশ্বাস করবেন না, দশ মিনিট ! অন্য সকলে যেখানে দেড়
দুই মিনিটে বেরিয়ে আসছিল সেখানে দশ মিনিট বসিয়ে রাখলেন আমাকে । গ্রামের খবরাখবর
জিজ্ঞেস করলেন ।
“... হ্যাঁ, আমাদেরই এলাকার তো
। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের । সে অনেক কথাবার্তা হল । আমি বললাম আমার কাজ ক’টার কথা । এক, গ্রামের উত্তরদিকের
ক্যানালটার পাড় উঁচু করানো । বিডিও যা উত্তর দিয়েছিল তাও বললাম, যে কোনো
ডেভেলাপমেন্ট ফান্ডে একটা কানাকড়িও নেই । অন্ত্যোদয়ের নামে সব হালে উপুড় করে পকেটে
ভরেছে । একটা ফান্ডে শুধু কয়েক হাজার টাকা আছে । সেই টাকাটা যদি সেচের ফান্ডে
ট্রান্সফার করানো যায়, তবে সে টাকায় কাজটা হয়ে যেতে পারে । ... আপনি একটু দেখুন
ব্যাপারটা । সামনেই বর্ষাকাল আসছে । তার আগে কাজটা হয়ে যাওয়া দরকার । তা বললেন
দেখব যথাসাধ্য চেষ্টা করে ।
“আর কাজ ছিল খুড়তুতো ভাইদুটোর
চাকরির । তা তক্ষুনি লিখে দিলেন । একজনের বারৌনিতে, অন্যজনের রোহতাসে ।
“তারপর দুখড়া গাইলেন অনেক । তোমরা
তো সবেতেই দোষ দেখতে পাও সরকারের । কম্যুনিস্ট পার্টির আবার একটা সত্যাগ্রহ
আন্দোলন রয়েছে সামনের মাসে । সরকারের ভিতরেই টাস্ল লেগে আছে ।
“তোয়াজ করবে না ? ওই এলাকায় যেই
দাঁড়াক, তার কাছে আমার চ্যালেঞ্জ, দু’হাজার ভোট আমি তার কেটে নেব । আজ পনের বছর ধরে ওই গ্রাম কম্যুনিস্ট
পার্টির পাক্কা ঘাঁটি, একটা ভোটও এধার ওধার যাবে না । কম্যুনিস্ট পার্টি জিতুক না
জিতুক, সে আলাদা কথা । কিন্তু ওই কটা ভোট এক কথায় কম্যুনিস্ট পার্টির ।
“আরে এই গত ইলেকশনেই তো । একটাও
বুথে পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত ছিল না । একটাও ভোট পড়ে না জানে, থেকে কী করবে ?
ইলেকশনের পর প্রথম গিয়েছিলাম, তা দোষ দিতে শুরু করলেন যে তোমরা আমাদের পোলিং
এজেন্টকে মেরে ভাগালে ! আমি বললাম যে আপনাদের একটা ভোটও যেখানে পড়ে না, আপনি ভালো
করেই জানেন, সেখানে পোলিং এজেন্টকে মেরে ভাগানোর কথা আসছে কোত্থেকে ? আরে ওর
বন্ধুরাই ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল চা খেতে । ওখানে বসে করার তো কিছু ছিল না । তারপর
মাল টেনেছিল – সেখানেই বচসা তারপর মারপীট ! এখন তার বদনাম দেওয়া হচ্ছে
আমাদের ওপর !আরে আমরা কম্যুনিস্ট পার্টি বানিয়েছি, কাউনো লুচ্চা লফঙ্গার দল থোড়েই
না ?”
বিশ্বনাথ সিং তার ব্যাকব্রাশ কাঁচাপাকা চুলে হাত বোলালো ।
ছোটো চোখদুটো কুঁচকে আরো ছোটো হয়ে গেল গর্বিত আর সহজ একটা হাসিতে । পান সিগারেট
কিছু খায় না তাই সামনের দাঁত চারটে ঝকঝকে । ময়লা নীল টেরিলিনের শার্টের বোতাম খোলা
। ভিতরে ছেঁড়া নংরা একটা গেঞ্জি । পিতল রঙের টেরিলিনের প্যান্টটা কালচে হয়ে গেছে ।
পায়ে হাওয়াই চপ্পল । গামছাটা টেবিল থেকে নিয়ে ঘাম মুছল কপালের । দুটো মেয়ে ঢুকল
দোকানে । একজনকে আগেও দেখেছি । মার্ক্স-এঙ্গেলস সিলেক্টেড হিন্দীটা কিনে নিয়ে
গিয়েছিল । দ্বিতীয়জন নতুন । একটু পরে ভিতর থেকে এল মহেশ, “দাদা, শুনুন তো এরা কোন বই চাইছে
!” আমি চাইলাম মেয়েদুটোর দিকে ।
-
আর পি দত্ত,
ভারত ...কী যেন !
-
রজনি পাম দত্ত ?
আজ কা ভারত ?
-
জী ! জী !
-
আছে নাকি মহেশজী
?
বিশ্বনাথ সিং মাথা নাড়ল, “নাঃ, আর থাকলেও সব
বাঁধাছাঁদা হয়ে গেছে । আর বার করাও যাবে না”। মহেশ ওদিক থেকে একটা বইয়ের প্যাকিং বাক্স
কাঁধে উঠিয়ে এনে দোকানের বাইরে রাখল । পাশেই ডাঁই করে রাখা আছে পুরোনো অনেক ছবির
এ্যালবাম, বই, গ্রামোফোন রেকর্ড । ওগুলো এমনিই ফেলা যাবে । আমি ওর মধ্যে থেকে
হাঁটকে একটু আগে বার করেছি, অজন্তার ফ্রেস্কোর একটা এলবাম, কিছু চিনে তুলি-কালির
ছবি, লেনিনের প্রিয় গানের একটা গ্রামোফোন রেকর্ড আর রুশী মহাকাশযান থেকে পৃথিবীতে
ভেসে আসা কন্ঠস্বরের একটা ছোট্টো প্লাস্টিক রেকর্ড ।
-
দোকান উঠে
যাচ্ছে ম্যাডাম ।
-
মানে, পিপল্স
বুক ... থাকবেই না ?
-
থাকবে । ওইদিকে,
আরিফগঞ্জে, আমাদের অফিসটা দেখেছেন ?
-
কেন ? এখানে
কলেজ, ইউনিভার্সিটি, স্টুডেন্টদের হস্টেল !
আবার বিশ্বনাথ সিং জবাব দিল, “রুস গির ন গয়া ম্যাডাম ! এখন
এ দোকানের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ির মালিক । অত ভাড়া দেওয়া পোষাচ্ছে না ।“ মেয়েদুটো বেরিয়ে গেল ।
............
“আ ই আজ কে বাত বা ? মায়ট্রিক
মা পঢ়ত রহনি তবহিয়ে সে !” বিশ্বনাথ সিং আবার ফিরে গেল পুরোনো কথায়, “ ... ছুটির শেষে বাঁধের ওপর
দিয়ে ফিরছিলাম । দেখি ভীড় জমে আছে । ভিতরে ঢুকে দেখি একজন দুসাধ, তালগাছ থেকে পড়ে
মরে গেছে । আর লোকজন নিয়ে তখনই ছুটে এসেছে বৈজনাথ সিং । হাতে কিসের শালা একটা চোথা
কাগজ। দেখি ওই দুসাধের আঙুলে কালি লাগিয়ে টিপছাপ দেওয়াচ্ছে তাতে । আমি দেখে এগিয়ে
শালা ঝাঁপ দিয়ে কাগজ ছিনিয়ে নিলাম । কিসের টিপছাপ ? নাকি ওই দুসাধ পাঁচশো টাকা
নিয়েছিল বৈজনাথের কাছে । ভেবেছিল ফিরিয়ে দেবে তাই কাগজ করেনি । হঠাৎ মরে গেল । তাই
! ... মিথ্যে কথা । প্রমাণ আছে কোনো ? আর কে কবে শুনেছে যে মরা মানুষের আঙ্গুলের
টিপছাপ নেওয়া হয় ? বেচারার কিছুটা জমি আছে সেটা হড়পাতে চাও তাই শালা মিথ্যে দলিল
নিয়ে এসেছ ! বৈজনাথ সিং গর্জিয়ে উঠল, এ হৃদে সিং কে বেটা, তুই ছোটো ছেলে, এসবে
লাগতে আসিস না । দিয়ে দে দলিলটা । আর দলিল
! ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ মুখে রা কাড়ছিল না কিন্তু আমরা চারজন বন্ধু তো ছিলামই ।
ধাওয়া করতেই দলিলটা হাতে নিয়ে পালালাম । তারপর ওদের দেখিয়ে শালা চোথা কাগজটা ছিঁড়ে
কুটি কুটি করে উড়িয়ে দিলাম ।
“বাড়ীতে এসে কাউকে কিছু বললাম
না । সন্ধ্যেবেলায় বৈজনাথ সিং এসে হাজির । কাকা বাইরে বসেছিল । কাকাই তো বড় করেছে আমাকে
আর ভাইদের । পড়াশোনা করেনি কিন্তু জেদি লোক । যা ভাববে ঠিক, তাই ঠিক থাকবে – তার জন্য লাঠি চলুক আর
বন্দুক চলুক । তা কাঁদুনি গাইল বৈজনাথ সিং । কাকা আমাকে ডাকলেন । গেলাম । যা যা
হয়েছিল সব বললাম । শুনে ফিরে তাকালেন কাকা বৈজনাথ সিংএর দিকে । তা বল্। তোর কী
বলার আছে ? বৈজনাথ সিং বলল, বলার আর কী ? ওইটুকু ছেলে ! সব জায়গায় যদি নাক গলাতে
চায় তাহলে চলে ? কোনোদিন যদি কিছু হয়ে যায় ...! শুনেই কাকা ক্ষেপে গেলেন, হয়ে যায়
মানে ? তুই কী বলতে চাস ? বলি, মরা মানুষের আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে এটা কে কবে
কোথায় শুনেছে ? ঠিক করেছে ও । আবার ওই সব হলে আবার করবে । ছোটো ছেলে বলে কি চোখের
সামনে দেখবে, বুঝবে অন্যায় হচ্ছে আর মেনে নেবে ?
“বৈজনাথ সিং জানত কাকাকে টলান
যাবে না । তাই ঘাঁটাল না বিশেষ । ফিরে গেল । আর আমাদের আর কী ? বুঝতেই পারছেন !
বাড়িতে যে জেঠ লোক, তারই যখন এই ভাব তো আমাদের আর রোখে কে ?
“পাঁচ মাস পরে আবার লাগল ঝগড়া
! ...
No comments:
Post a Comment