Wednesday, October 24, 2018

বিশ্বনাথ সিং


মুখ্যমন্ত্রী তখনও আসেননি । বাইরে ভীড়ে ভীড় । আমিও বসে গেলাম এক কোণে । রাত তখন নটা । আর্দালিটা বলল, কখন ফিরবেন জানা নেই ।

সে অবশ্য আমিও জানতাম । ডামাডোল অবস্থা সরকারের । আগেরদিন বিধানসভায় অর্থমন্ত্রী নাস্তানাবুদ হয়েছে বিরোধীপক্ষের হাতে । ইন্ডাস্ট্রিগুলোর তো দেখছেনই কী হাল !

বসে রইলাম । রাত সাড়ে দশটায় মুখ্যমন্ত্রী এলেন । দুএকজনের পরেই আর্দালি বাইরে এসে ডাকল, বিশ্বনাথ সিং !

আমি ভাবিনি যে আমায় দেখতে পেয়েছিলেন বারান্দা দিয়ে ঢোকার সময় । বললে বিশ্বাস করবেন না, দশ মিনিট ! অন্য সকলে যেখানে দেড় দুই মিনিটে বেরিয়ে আসছিল সেখানে দশ মিনিট বসিয়ে রাখলেন আমাকে । গ্রামের খবরাখবর জিজ্ঞেস করলেন ।

... হ্যাঁ, আমাদেরই এলাকার তো । আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামের । সে অনেক কথাবার্তা হল । আমি বললাম আমার কাজ কটার কথা । এক, গ্রামের উত্তরদিকের ক্যানালটার পাড় উঁচু করানো । বিডিও যা উত্তর দিয়েছিল তাও বললাম, যে কোনো ডেভেলাপমেন্ট ফান্ডে একটা কানাকড়িও নেই । অন্ত্যোদয়ের নামে সব হালে উপুড় করে পকেটে ভরেছে । একটা ফান্ডে শুধু কয়েক হাজার টাকা আছে । সেই টাকাটা যদি সেচের ফান্ডে ট্রান্সফার করানো যায়, তবে সে টাকায় কাজটা হয়ে যেতে পারে । ... আপনি একটু দেখুন ব্যাপারটা । সামনেই বর্ষাকাল আসছে । তার আগে কাজটা হয়ে যাওয়া দরকার । তা বললেন দেখব যথাসাধ্য চেষ্টা করে ।

আর কাজ ছিল খুড়তুতো ভাইদুটোর চাকরির । তা তক্ষুনি লিখে দিলেন । একজনের বারৌনিতে, অন্যজনের রোহতাসে ।

তারপর দুখড়া গাইলেন অনেক । তোমরা তো সবেতেই দোষ দেখতে পাও সরকারের । কম্যুনিস্ট পার্টির আবার একটা সত্যাগ্রহ আন্দোলন রয়েছে সামনের মাসে । সরকারের ভিতরেই টাস্‌ল লেগে আছে ।

তোয়াজ করবে না ? ওই এলাকায় যেই দাঁড়াক, তার কাছে আমার চ্যালেঞ্জ, দুহাজার ভোট আমি তার কেটে নেব । আজ পনের বছর ধরে ওই গ্রাম কম্যুনিস্ট পার্টির পাক্কা ঘাঁটি, একটা ভোটও এধার ওধার যাবে না । কম্যুনিস্ট পার্টি জিতুক না জিতুক, সে আলাদা কথা । কিন্তু ওই কটা ভোট এক কথায় কম্যুনিস্ট পার্টির ।

আরে এই গত ইলেকশনেই তো । একটাও বুথে পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত ছিল না । একটাও ভোট পড়ে না জানে, থেকে কী করবে ? ইলেকশনের পর প্রথম গিয়েছিলাম, তা দোষ দিতে শুরু করলেন যে তোমরা আমাদের পোলিং এজেন্টকে মেরে ভাগালে ! আমি বললাম যে আপনাদের একটা ভোটও যেখানে পড়ে না, আপনি ভালো করেই জানেন, সেখানে পোলিং এজেন্টকে মেরে ভাগানোর কথা আসছে কোত্থেকে ? আরে ওর বন্ধুরাই ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল চা খেতে । ওখানে বসে করার তো কিছু ছিল না । তারপর মাল টেনেছিল সেখানেই বচসা তারপর মারপীট ! এখন তার বদনাম দেওয়া হচ্ছে আমাদের ওপর !আরে আমরা কম্যুনিস্ট পার্টি বানিয়েছি, কাউনো লুচ্চা লফঙ্গার দল থোড়েই না ?


বিশ্বনাথ সিং তার ব্যাকব্রাশ কাঁচাপাকা চুলে হাত বোলালো । ছোটো চোখদুটো কুঁচকে আরো ছোটো হয়ে গেল গর্বিত আর সহজ একটা হাসিতে । পান সিগারেট কিছু খায় না তাই সামনের দাঁত চারটে ঝকঝকে । ময়লা নীল টেরিলিনের শার্টের বোতাম খোলা । ভিতরে ছেঁড়া নংরা একটা গেঞ্জি । পিতল রঙের টেরিলিনের প্যান্টটা কালচে হয়ে গেছে । পায়ে হাওয়াই চপ্পল । গামছাটা টেবিল থেকে নিয়ে ঘাম মুছল কপালের । দুটো মেয়ে ঢুকল দোকানে । একজনকে আগেও দেখেছি । মার্ক্স-এঙ্গেলস সিলেক্টেড হিন্দীটা কিনে নিয়ে গিয়েছিল । দ্বিতীয়জন নতুন । একটু পরে ভিতর থেকে এল মহেশ, দাদা, শুনুন তো এরা কোন বই চাইছে ! আমি চাইলাম মেয়েদুটোর দিকে ।
-      আর পি দত্ত, ভারত ...কী যেন !
-      রজনি পাম দত্ত ? আজ কা ভারত ?
-      জী ! জী !
-      আছে নাকি মহেশজী ?

বিশ্বনাথ সিং মাথা নাড়ল, নাঃ, আর থাকলেও সব বাঁধাছাঁদা হয়ে গেছে । আর বার করাও যাবে না। মহেশ ওদিক থেকে একটা বইয়ের প্যাকিং বাক্স কাঁধে উঠিয়ে এনে দোকানের বাইরে রাখল । পাশেই ডাঁই করে রাখা আছে পুরোনো অনেক ছবির এ্যালবাম, বই, গ্রামোফোন রেকর্ড । ওগুলো এমনিই ফেলা যাবে । আমি ওর মধ্যে থেকে হাঁটকে একটু আগে বার করেছি, অজন্তার ফ্রেস্কোর একটা এলবাম, কিছু চিনে তুলি-কালির ছবি, লেনিনের প্রিয় গানের একটা গ্রামোফোন রেকর্ড আর রুশী মহাকাশযান থেকে পৃথিবীতে ভেসে আসা কন্ঠস্বরের একটা ছোট্টো প্লাস্টিক রেকর্ড ।
-      দোকান উঠে যাচ্ছে ম্যাডাম ।
-      মানে, পিপল্‌স বুক ... থাকবেই না ?
-      থাকবে । ওইদিকে, আরিফগঞ্জে, আমাদের অফিসটা দেখেছেন ?
-      কেন ? এখানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, স্টুডেন্টদের হস্টেল !

আবার বিশ্বনাথ সিং জবাব দিল, রুস গির ন গয়া ম্যাডাম ! এখন এ দোকানের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ির মালিক । অত ভাড়া দেওয়া পোষাচ্ছে না । মেয়েদুটো বেরিয়ে গেল ।
............     


আ ই আজ কে বাত বা ? মায়ট্রিক মা পঢ়ত রহনি তবহিয়ে সে ! বিশ্বনাথ সিং আবার ফিরে গেল পুরোনো কথায়, ... ছুটির শেষে বাঁধের ওপর দিয়ে ফিরছিলাম । দেখি ভীড় জমে আছে । ভিতরে ঢুকে দেখি একজন দুসাধ, তালগাছ থেকে পড়ে মরে গেছে । আর লোকজন নিয়ে তখনই ছুটে এসেছে বৈজনাথ সিং । হাতে কিসের শালা একটা চোথা কাগজ। দেখি ওই দুসাধের আঙুলে কালি লাগিয়ে টিপছাপ দেওয়াচ্ছে তাতে । আমি দেখে এগিয়ে শালা ঝাঁপ দিয়ে কাগজ ছিনিয়ে নিলাম । কিসের টিপছাপ ? নাকি ওই দুসাধ পাঁচশো টাকা নিয়েছিল বৈজনাথের কাছে । ভেবেছিল ফিরিয়ে দেবে তাই কাগজ করেনি । হঠাৎ মরে গেল । তাই ! ... মিথ্যে কথা । প্রমাণ আছে কোনো ? আর কে কবে শুনেছে যে মরা মানুষের আঙ্গুলের টিপছাপ নেওয়া হয় ? বেচারার কিছুটা জমি আছে সেটা হড়পাতে চাও তাই শালা মিথ্যে দলিল নিয়ে এসেছ ! বৈজনাথ সিং গর্জিয়ে উঠল, এ হৃদে সিং কে বেটা, তুই ছোটো ছেলে, এসবে লাগতে আসিস  না । দিয়ে দে দলিলটা । আর দলিল ! ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ মুখে রা কাড়ছিল না কিন্তু আমরা চারজন বন্ধু তো ছিলামই । ধাওয়া করতেই দলিলটা হাতে নিয়ে পালালাম । তারপর ওদের দেখিয়ে শালা চোথা কাগজটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে উড়িয়ে দিলাম ।

বাড়ীতে এসে কাউকে কিছু বললাম না । সন্ধ্যেবেলায় বৈজনাথ সিং এসে হাজির । কাকা বাইরে বসেছিল । কাকাই তো বড় করেছে আমাকে আর ভাইদের । পড়াশোনা করেনি কিন্তু জেদি লোক । যা ভাববে ঠিক, তাই ঠিক থাকবে তার জন্য লাঠি চলুক আর বন্দুক চলুক । তা কাঁদুনি গাইল বৈজনাথ সিং । কাকা আমাকে ডাকলেন । গেলাম । যা যা হয়েছিল সব বললাম । শুনে ফিরে তাকালেন কাকা বৈজনাথ সিংএর দিকে । তা বল্‌। তোর কী বলার আছে ? বৈজনাথ সিং বলল, বলার আর কী ? ওইটুকু ছেলে ! সব জায়গায় যদি নাক গলাতে চায় তাহলে চলে ? কোনোদিন যদি কিছু হয়ে যায় ...! শুনেই কাকা ক্ষেপে গেলেন, হয়ে যায় মানে ? তুই কী বলতে চাস ? বলি, মরা মানুষের আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে এটা কে কবে কোথায় শুনেছে ? ঠিক করেছে ও । আবার ওই সব হলে আবার করবে । ছোটো ছেলে বলে কি চোখের সামনে দেখবে, বুঝবে অন্যায় হচ্ছে আর মেনে নেবে ?

বৈজনাথ সিং জানত কাকাকে টলান যাবে না । তাই ঘাঁটাল না বিশেষ । ফিরে গেল । আর আমাদের আর কী ? বুঝতেই পারছেন ! বাড়িতে যে জেঠ লোক, তারই যখন এই ভাব তো আমাদের আর রোখে কে ?


পাঁচ মাস পরে আবার লাগল ঝগড়া ! ...

No comments:

Post a Comment