Thursday, October 4, 2018

বিদ্যাসাগর পথ, কর্মাটাঁড়


প্রথম দৃশ্য

[সকাল। একটা বারান্দাওয়ালা পুরোনো বাড়ির একাংশ বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে। সামনে কয়েকটি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। একজন একটু এগিয়ে এসে সেলফোনে কথা বলছে। “হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চিন্ত থাকুন। আমাদের টীমের সবাই এসে গেছে। আপনার মন্ত্রী টন্ত্রী আসার আগে সব কিছু রেডি থাকবে। হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর দ্বিশতবার্ষিকীর ব্যানার তৈরি আছে, প্রতিমার আবরণ, ফেস্টুন, বৃক্ষরোপণের জন্য দশ বারোটা চারা... যে ক’টা আপনারা ডিগনিটারিজরা পুঁতবেন পুঁতবেন, বাকিগুলো আমরা পুঁতে ফেলব।  ... এ্যাঁ, এখন? আমরা রিহার্সালটা দিয়ে রাখছি একবার। এরপর আর সময় পাবো না। রাখছি ফোনটা। মন্ত্রীর গাড়ী বেরুলেই আমাকে ফোন করে দেবেন। ফোনটা রাখে।]

ছেলেটি -       হ্যাঁ, একনম্বর প্ল্যাকার্ডটা দে। কার কাছে আছে। (একজন এগিয়ে দেয়। ছেলেটি বাড়ির সামনে প্ল্যাকার্ডটা গেঁথে দেয়। লেখা আছে ‘নন্দন কানন, কর্মাটাঁড়’। স্টার্ট! মোড়ল, চাষী, চাষীবৌ, শাস্ত্রীমশাই, সতীশ... (আঙুল দেখিয়ে এক এক করে সম্বোধন করে।) সবাই নিজেদের পার্টগুলোয় আছো?... চলো। (বলে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। একটি ছেলে শুধু বাড়ির ভিতরে ঢোকে। বেরিয়ে আসে ঈষৎ মেক-আপ, ধুতি আর ফতুয়া চড়িয়ে। ... বাড়ির সামনের বারান্দায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পায়চারী করছেন। সামনে টেবিলের ওপর একতাড়া কাগজপত্র রাখা আছে। মোড়ল প্রবেশ করে।)
মোড়ল -        পেন্নাম, দেওতা! সে তো আবার কাহিল হয়ে পড়েছে রে! ...ওই যে বুড়ি, যাকে ওষুধ দিয়ে এলি না তুই গতকাল!
ঈশ্বর-           জ্বর কতো?
মোড়ল -        তা তো জানি না। ওর পড়শি বলছিল, একা একা ঘরে কোঁকাচ্ছে ভোর থেকে। তোকেই যেতে হবে আরেকবার, দেওতা।
ঈশ্বর-           তখন থেকে আমাকে দেওতা দেওতা করছিস কেন বল তো?
মোড়ল -        বাঃ, তুই তো দেওতাই। সবাই তো তোকে ঈশ্বর-দেওতা বলে আশে পাশের সবক’টা গাঁয়ে!
ইশ্বর -          বটে। আমি দেওতা। যেমন তুই মোড়ল।
মোড়ল -        (জিভ কাটে, কান ধরে) না, না। ছি। কী বলছিস। আমি কি সত্যি মোড়ল নাকি? গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরি, দশ ঘরের খবরাখবর নিই, হালচাল পুছি ... লোকে তো দুয়োও দেয় যে আমি নাকি একের কথা অন্যকে বলে ঝগড়া লাগাই, পাকামি করি ... মোড়লিপানা করি তাই মোড়ল বলে ঠাট্টা করে লোকে।
ঈশ্বর    -       তা আমাকেও ওই ধরণের দেওতা বানাতে...
সাঁওতাল -     (চাদরের খুঁট খুলে ছয়-সাতটা ভুট্টা বার করে) ও বিদ্যেসাগর, আজ আর আমার বাজারে গিয়ে এ
                   ক’টা
                   বিক্রি করা হবে না। তুই রাখ, পাঁচ গন্ডা পয়সা দে আমায়।
ঈশ্বর    -       দাঁড়া, (মোড়লকে) দ্যাখ, কী বলল আমায়! বিদ্যেসাগর।
মোড়ল -       (সাঁওতালকে, বিদ্যাসাগরকে দেখিয়ে) এ্যাই, ও কে রে?
সাঁওতাল -     (হাঁপাতে হাঁপাতে, ঈষৎ কেশে) বিদ্যেসাগর (কপালে হাত ঠেকিয়ে) দেওতা, দেওতা আমাদের!
ইশ্বর     -       (এগিয়ে এসে মাটিতে ঝুঁকে সাঁওতালের হাতটা টেনে নিয়েছিলেন, নাড়ি দেখছিলেন) তোর তো
                   জ্বর রয়েছে ভালো রকম। একদাগ ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাক আজকের দিনটা।
                   পাঁচ গন্ডা পয়সাও দিচ্ছি।
মোড়ল -       দেখলি... (বিদ্যাসাগরের চোখের দিকে চেয়ে চুপ করে যায়)
ইশ্বর     -       তুই যা, আমি বুড়িকে দেখে আসবো একটু বেলায়। (ভিতরে চলে যান ওষুধ আনতে, ফিরে
                   আসেন, সাঁওতালকে ওষুধ খাওয়ান) যা, ঘরে গিয়ে একটু আরাম কর সারা দিন। জ্বরটা ছেড়ে যাওয়া উচিৎ। না ছাড়লে কাউকে দিয়ে খবর পাঠাবি। আর, এই নে পয়সা (সাঁওতাল চলে যায়)। (মোড়লের দিকে তাকিয়ে) কী রে, তুই গেলি না? আচ্ছা, যাস নি যখন, একটা কাজ করে দিয়ে যা। বারান্দার ওধারে দেখ্‌ এক গোছা শুকনো ডালপালা রাখা আছে। ঘরের ভিতরে মেঝেতে দড়ি আছে আর তাকে ছুরিও আছে। সব নিয়ে যা আর আমার নতুন আমচারাটার চারদিকে একটা বেড়া করে দে তো। কচি পাতা বেরোচ্ছে নিচের দিকে – গরু, ছাগল ঢুকে খেয়ে যেতে পারে। ... পারবি তো?
মোড়ল -       (উঠতে উঠতে) এটা কোনো কাজ? আমাকে দু’একটা ওষুধপত্তর শিখিয়ে দিতিস, আমিও একটু চিকিচ্ছে করতাম মাঝে মধ্যে।
ঈশ্বর    -       (অট্টহাসি হেসে ওঠেন) ওঃ হো হো, এই জন্যে তুই বার বার আসিস এখানে! তা তুই তো জ্বরই বুঝতে পারিস না নাড়ি দেখে! দুটো ওষুধের নাম শিখেই গাঁয়ের কোবরেজকে টক্কর দিবি? ... তখন সত্যি তোকে লোকে ঠেঙিয়ে গাঁছাড়া করবে। আর আমাকেও করবে তোকে শিখিয়েছি বলে। (ঈষৎ গম্ভীর হয়ে) লোকের ভালো করতে চাস ভালো কথা। সেবাশুশ্রুষা কর। পায়ে তেল লাগিয়ে দেওয়া, মাথা ধুইয়ে দেওয়া ... এগুলোও তো অনেক আরাম করে দেয় রুগীর। আর একটু লেখাপড়া শেখ! তুই তো আমার বড়দের স্কুলটাতেও আসিস না নিয়মিত। ওই যখন তখন চেহারা দেখিয়ে যাস।
মোড়ল -       (বারান্দার ওধারে, কাঠের টুকরোগুলো বাছতে বাছতে) লজ্জা করে। সবাই পেছনে লাগে। ... এই
                   ডালগুলো তো জবর! একদম সোজা সোজা তিন হাত। কোত্থেকে পেলি?
ঈশ্বর    -       গাঁয়ে গাঁয়ে যাই তো রুগী দেখতে। ফেরার সময় জঙ্গল থেকে বেছে কুড়িয়ে জড়ো করেছি।

[মোড়ল ডালগুলো দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঁধের ওপর ফেলে। বাকি দড়ির গোছা আর ছুরিটা নিয়ে চলে যায় আমগাছের দিকে। বিদ্যাসাগর, সাঁওতালের রেখে যাওয়া ভুট্টাগুলো নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢোকেন।]   


দ্বিতীয় দৃশ্য

[দুপুর বেলা। প্রথম ছেলেটি ঢুকে বাড়ির সামনের প্ল্যাকার্ডটা পাল্টে করে দেয় ‘গেরস্থ ঘর’। আরেকটি ছেলে উঁকি মারে নেপথ্য থেকে।]

দ্বিতীয় ছে-      শুধু একটা প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে দিলে হবে? নন্দন কাননের বাড়িটা পাকা। আর এ গেরস্ত ঘর খড়ের ছাউনি, ওপরে লাউমাচা, দাওয়া আর উঠোনটা মাটির...
প্রথম ছে        -         অতশত মঞ্চসজ্জা নিয়ে হবে এই ছোট্টো নাটক? তাও থিয়েটারের স্টেজ হবে না, নেতাদের ভাষণের মঞ্চ হবে। আর পরে যদি করতেও হয় তো পথনাটিকার ধরণে করবো। তখন তো (বাড়ির অংশটাকে ইংগিত করে) এটুকুও পাবো না।

[ছেলেটি আর কথা না বাড়িয়ে একটা বড় চটের ছালা ভিতর থেকে টানতে টানতে এনে ছুঁড়ে ফেলে বাড়ির ছাতের ওপর। তারপর টেনে নামিয়ে ঢেকে দেয় ছাতটা। প্রথম জন হেসে ওঠে, “এটা কী হল? আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার চল!” দুজনেই বেরিয়ে যায়। ... বিদ্যাসাগর গাঁয়ের পথ ধরে ভিনগাঁ থেকে ফিরছেন। ঘরের দাওয়া থেকে পথের প্রান্ত অব্দি ছোট্টো জায়গাটায় একফালি বেগুনের খেত। বিদ্যাসাগর বসে পড়লেন। ভিতর থেকে এক বৌ পড়ি মরি করে দৌড়ে এল।]

বৌ       -       এ্যাই, কে, কে ওখানে? বেগুন চুরি করার মতলব? ওঠ! ওঠ বলছি। (বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে বৌটি এক হাত ঘোমটা মাথার ওপর টেনে জিভ কাটলেন।) ইশ্বর-দেওতা! আমি চিনতে পারিনি। ক্ষমা করবেন।
ঈশ্বর    -       (তখনও বেগুনের দিকে তাকিয়ে) তোমরা এই প্রথম বেগুন ফলালে, না আগেও লাগিয়েছ?
বৌ       -       প্রথম। আপনি একটু বসুন না দাওয়ায়, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। এই তো পিছনেই, আতা গাছটা কাটছে। ফল হয় না। (বলে দৌড়ে চলে যায় পিছনে, এবার দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে)।
চাষী     -       আপনি এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে। একটু বসবেন না বিদ্যেসাগর? আমার বৌ বুঝতে পারে নি আপনি বসে আছেন ওখানে। ওর দোষ নেবেন না। একটু বসুন এসে। না এলে আমরা অপরাধী হয়ে থাকবো।
ঈশ্বর    -       আমি কিছু মনে করিনি গো। ভরদুপুরে অজানা কেউ খেতের ওপর ঝুঁকে থাকলে তো সন্দেহ হতেই পারে। আচ্ছা চল, দাওয়ায় গিয়ে বসি। (বলে নিজেই গিয়ে কিনারে বসে পড়েন)।
চাষী     -       আ হা হা, ধুলোতে বসলেন কেন? (বৌকে) একটা আসন নিয়ে আয় না শীগগিরই! (বৌ ভিতরে চলে যায়)।
ঈশ্বর    -       লাগবে না। পরিষ্কার আছে জায়গাটা। যা বলছিলাম শোনো। বেগুনগুলো এ কেমন ধারা হয়েছে? ছোট্টো, কোঁকড়ানো, তাও প্রতিটা চারায় একটা দুটো করে? বেগুন তো এ মাটিতে ভালো হওয়া উচিৎ।
বৌ       -       (ততক্ষণে আসন নিয়ে এসে আসন হাতে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে) সেই তো। আমি তো বলেছিলাম, আমাদের গ্রামে কত ভালো বেগুন হয়। আপনি এই আসনটায় বসুন দেওতা। (বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়ালে বৌটি আসন পেতে দেয়। বিদ্যাসাগর আবার বসে পড়েন)।
চাষী     -       যা বীজ পেলাম জামতাড়ার বাজারে তাই তো এনে লাগালাম। কেন এমন হল! আপনি একটু সরবত খাবেন বিদ্যেসাগর? দূর থেকে আসছেন, ক্লান্ত হয়ে। আমরা ছোটো জাত নই দেওতা, বৈশ্য। (বিদ্যাসাগর চোখ উঠিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকান আর আসন ছেড়ে উঠে পড়েন) না, না, ঘাট হয়েছে, মানে, আমরা জানি আপনি জাতপাত মানেন না, কিন্তু... সরবতটুকু খেয়ে যাওয়ার...
ঈশ্বর    -       (হেসে ফেলেন) সরবত নয়, জল দাও এক ঘটি। সেটাও খাবো না কিন্তু, আগেই বলে দিচ্ছি। না,
                   কোনো রাগে টাগে নয়। কড়া রোদ্দুর তো। আর এতটা পথ যেতে হবে এখন। এখন পেটে জল গেলে ক্ষতি হবে। তবে হ্যাঁ, ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে শরীরটা চাঙ্গা করে নিই। যাও মা, একটু জল এনে দাও। অন্য কোনোদিন তোমার হাতের সরবত খেয়ে যাবো, ঠিক আছে?
                   (বৌটি জল এনে দিলে বিদ্যাসাগর খেতের দিকে সরে এসে ঘাড়ে মাথায় জল দেন, কুলকুচো করেন; ওদিকে বৌটি কিছু একটা ইশারা করে বরকে খোঁচাতে থাকে)
চাষী     -       ইয়ে, বৌ বলছিল ও কি আপনার টোলে আসতে পারে?
ঈশ্বর    -       (মুখে হাসি নিয়ে বিদ্যাসাগর ঘুরে তাকান; বৌটি হাত থেকে ঘটি নিয়ে একটা গামছা এগিয়ে দেয়) বাঃ, এতো উল্টো স্রোত বইছে!
চাষী     -       আজ্ঞে?
ইশ্বর     -       গেরস্থ ঘরের পুরূষমানুষেরা মেয়ে-বৌদের লেখাপড়া শেখাতে চায় না, পড়তে দিতে চায় না। তোমরা তো নতুন যুগের মানুষ গো! ক’পুরূষ ধরে আছো এ গাঁয়ে?
চাষী     -       আমার পূর্বপুরূষের ভিটে জামতাড়ার কাছে। সেখানে আমার দাদারা থাকে। আমি একটু জমি নিয়ে এখানে বসবাস শুরু করেছি দশ বছর হল।
বৌ       -       (নিজে থেকেই) দশ এখনো হয় নি। ন’বছর চলছে। আমার বাপের বাড়ি এখানেই, তবে অনেকটা        উত্তরে। আমাদের গাঁ থেকে যতদূর মিহিজাম, ততদূর কর্মাটাঁড়।
ইশ্বর     -       তা, প্রশ্নটার মানে বুঝলাম না!
চাষী     -       মানে, ও তো বৌ, এক বাচ্চার মা। তা বাচ্চা মেয়েদের সাথে বসতে বেমানান লাগবে, আবার বড় বড় পুরূষমানুষদের সাথে...
ইশ্বর     -       লেখাপড়া না শেখাটাই সবচেয়ে বেশী বেমানান আজকের যুগে। ও মেয়েদের স্কুলে বসতে চায় তো দিব্যি বসবে, কিচ্ছু ভাবার দরকার নেই। আর ওর সময় সুবিধে যদি বড়দের স্কুলের সময় হয়, তাহলে ওর জন্য আলাদা জায়গা থাকবে পর্দা দেওয়া। আসবে, আসতে দেবে তুমি, এটাই বড় কথা। আসি এবার, অনেক বেলা হল। ও হ্যাঁ, এবার যখন কলকাতায় যাব, তোমার জন্য ভালো বেগুনের আর টমেটোর, দেখেছ টমেটো, বিলিতি বেগুন বলে অনেকে, তা সেই টমেটোরও ভালো বীজ নিয়ে আসব। এত খারাপ ফলন হবে কেন? (বিদ্যাসাগর বেরিয়ে যান)
বৌ       -       আশ্চর্য, তুমি একবার খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে না? দুপুর শেষ হতে চলল। নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি ওনার। এখানেই পুকুরে স্নান করে দুটো ভাত খেয়ে যেতেন! আমাদেরই পূণ্য হত।
চাষী     -       ভূল হয়ে গেল, (নেপথ্যের দিকে এগিয়ে) ইশ্বর-দেওতা!
বৌ       -       আঃ, এখন পিছন থেকে ডাকছে। রাখো। পরে একবার গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসো। এখন নিজে আগে চানটা সেরে এস, আমি ভাত বাড়ছি। (চাষী একটা টাঙানো গামছা টেনে কাঁধে ফেলে পিছনে চলে যায়, বৌটি ভিতরে চলে যায়)।   
    

  তৃতীয় দৃশ্য

[প্রথম ছেলেটি ঢুকে বাড়ির সামনের প্ল্যাকার্ডটা পাল্টে করে দেয় ‘কর্মাটাঁড় রেলস্টেশন’। ছাতের ওপরকার ছালাটা টেনে নামিয়ে পিছনে ফেলে বেরিয়ে যায়। ...নন্দন কানন যাওয়ার রাস্তা। তরূণ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং তাঁর ভ্রমণসঙ্গী সতীশ বসু বেরিয়ে হেঁটে আসছেন।]

শাস্ত্রী    -       সতীশ,এই কর্মাটাঁড় স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের নামটা পড়েছিলে বোর্ডে?
সতীশ   -       না, খেয়াল করিনি তো!
শাস্ত্রী    -       তুমি যাঁর কাছে যাচ্ছো, তাঁর বিষয়ে কথিত আছে যে ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে প্রথমবার কলকাতা আসার সম শুধু মাইলস্টোন দেখে দেখে ইংরেজী সংখ্যা পড়া শিখে ফেলেন। আর তুমি, একটা স্টেশনে নামলে, স্টেশনমাস্টারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় কোথায় থাকেন, স্টেশনমাস্টার ইংরেজও নয়, বাঙালী, তার নামটাও পড়ে নিতে চাইলে না?
সতীশ   -       ওই জন্যেই তো! প্ল্যাটফর্মে এক মিনিট দাঁড়াতেও ইচ্ছে হল না।
শাস্ত্রী    -       মানে?
সতীশ   -       আমি তো আর বুঝিনি উনি বাঙালি না মারাঠি, তাই ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি কি জানেন, বাংলার বিখ্যাত মানুষ, বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত ইশ্বরচন্দ্র শর্মা এখানে কোথায় থাকেন।
শাস্ত্রী    -       তারপর?
সতীশ   -       মুখটা বেঁকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ইয়েস স্যার, উই আর ব্লেস্‌ড দ্যাট দ্য গ্রেট ম্যান লিভস হিয়ার। বুঝে গেলাম উনিও বাঙালি। জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, বাঙালি, তবে বিখ্যাত তো নই যে আমার জন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করে দেবে সরকার বাহাদুর! আপনারা যান, ওই বিখ্যাত মানুষটার কাছে যান। স্টেশনের বাইরে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করুন, দেখিয়ে দেবে। তারপর যাহোক, আমাদের মালপত্রগুলো রাখার ব্যবস্থার কথা বললাম, একদিন পর আবার ট্রেন ধরব
                   লখনউ যাওয়ার, বললাম, তো করে দিলেন।
শাস্ত্রী     -      আশ্চর্য তো, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পায়ে কষ্ট আছে বলে সরকার কর্মাটাঁড়ের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করিয়ে দিয়েছে। সবাই জানে ব্যাপারটা। বিদ্যাসাগর একজনই আছেন সারা দেশে। তাঁর জন্য সরকার করতেই পারেন। তাতে স্টেশনমাস্টারের কিসে কষ্ট?  
সতীশ   -       জায়গাটা বেশ শান্ত আর নিরিবিলি, না?
শাস্ত্রী    -       হুঁ, কিন্তু রুক্ষ, পাহাড়ি! লাল মাটির দেশ।
সতীশ   -       তবে এই রাস্তাটা বেশ ছায়া ছায়া। কী বিরাট গাছগুলো দেখ! অনেক বয়স হবে। ...শুনেছি মনের কষ্টে এখানে এসে থাকছেন বিদ্যাসাগর মশাই।
শাস্ত্রী    -       আরে দূর, ইশ্বরদাদা হিমালয়। মনোকষ্ট, সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাওয়া, এসব ওনার ধাতে নেই। পায়ে বড় চোট পেলেন না? পেটটাও ভালো থাকেনা। ডাক্তাররা তো কবে থেকেই বলছিল হাওয়াবদল করতে। ... এটা ঠিক যে নারায়ণের ব্যবহারে দাদা কষ্ট পেয়েছেন। ... তুমি আবার এসব প্রসঙ্গ ওনার সামনে তুলোনা! (একটা বিরাট বটগাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন, তার বিরাটত্বের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকান) দেখেছো, কী বিশাল! কত বয়স হবে বলো তো!
                                                দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে
                                                নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,
                                                তরুরাজ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,
                                                বিধির করূণা তুমি তরু-রূপ ধরি!
                                                জীবকূল-হিতৈষিণী, ছায়া-সুসুন্দরী,
                                                ...
                                                দেব নহ; কিন্তু গুণে দেবতার মত।

সতীশ   -       বাঃ! কার লেখা?
শাস্ত্রী    -       মাইকেল মধুসুদন দত্ত। পড়েছ?
সতীশ   -       বাবার আলমারীতে আছে। মেঘনাদবধ কাব্য। কিন্তু ভীষণ শক্ত।
শাস্ত্রী    -       এটা চতুর্দশপদী। এই মানুষটাকে কত সাহায্য করলেন বিদ্যাসাগর। সারা গায়ের মোদো গন্ধ আর পাগলামির ভিতরে বসে থাকা অমূল্য প্রতিভাটাকে বিদ্যাসাগরই চিনতেন। জানতেন যে মানুষটার যশ হবে না। সবাই বলবে শুধু ভাঙচুর করে গেছে। কিন্তু ওই ভাঙচুরটাও যে বাংলা ভাষার প্রয়োজন ছিল সেটা বিদ্যাসাগরই জানতেন।   
সতীশ   -       আপনি তো ওনার কাছে থেকেই পড়াশোনা করেছেন?
শাস্ত্রী    -       স্কুলে পড়ার সময়। আমার নন্দদাদা আর উনি প্রিয় বন্ধু ছিলেন তো। আর দেখ, কেমন ভাগ্য আমার। হেয়ার স্কুলে শিক্ষকের চাকরিটা পেলাম – দাদাও আর দেখার জন্য রইলেন না, ভাবলাম ইশ্বরদাদাকে প্রণাম করে আসি, গিয়ে শুনলাম তিনি এখানে। ভাগ্যিস লখনউয়ে এই এ্যাক্টিং স্যাংস্কৃট টিচারের কাজটা পেলাম, তাই আজ ইশ্বরদাদাকে প্রণাম করতে পারবো। কী হল, অত আস্তে আস্তে হাঁটছ কেন, শরীর খারাপ লাগছে, জ্বর আসেনি তো? একটু সাবধান থাকতে হবে আমাদের। তুমিও ম্যালেরিয়ার রুগী আর আমিও জ্বর থেকে উঠেছি।
সতীশ   -       ওই সামনের গেটটাই না?
শাস্ত্রী    -       ঠিক বলেছ, ওই তো, ডানদিকে লেখাই আছে ‘নন্দন কানন’। পান্ডববর্জিত টাঁড়ের শুকনো লালমাটিতে একা একা থাকার জন্য বাড়ির নাম ‘নন্দন কানন’ বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাড়া আর কে      রাখবেন। এই না হলে একটা মানুষের জন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করিয়ে দেয় সরকার বাহাদুর? মনে আছে তো, কী বললাম! কর্মাটাঁড়ে এসে কেন থাকছেন, কবে কলকাতায় ফিরবেন, জিজ্ঞেস কোরো না। কী দরকার, একদিনের জন্যে তো এসেছি।
সতীশ   -       ওরেব্বাপ! ওখানে ঢোকার পর আমি বোবা। সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, সারা বাঙলার স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন, দুশোটার বেশি স্কুল খুলেছেন, তারপর কত বই, সংস্কৃতের পন্ডিত, হিন্দু সমাজের সংস্কার করেছেন... বাপ্‌রে, গুনতি ভুলে যাবার যোগাড়, ইংরেজ সাহেবরাও সমীহ করে চলেন ... একটা প্রশ্ন করলেই তো আমি গেছি।
শাস্ত্রী    -       হাঃ হাঃ, গিয়ে দেখবে, উনি এক্কেবারেই সেরকম নন। খবর পেয়ে গেছেন তো আমরা আসছি। দেখবে কত কিছু খাবার আনিয়ে রেখেছেন।


চতুর্থ দৃশ্য

[প্রথম ছেলেটি অথবা আরো কোনো একজন ঢুকে বাড়ির সামনের প্ল্যাকার্ডটা পাল্টে আবার করে দেয় ‘নন্দন কানন, কর্মাটাঁড়’। আলো দিয়ে সকাল বোঝা যায়। বিদ্যাসাগর বাড়ির বারান্দায় টেবিল চেয়ারে বসে বইয়ের প্রুফ দেখছেন। বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলেন হরপ্রসাদ এবং সতীশ।]

ইশ্বর     -       ঘুরে এলি? কেমন লাগল জায়গাটা? আর আমার ওই কচি আমগাছগুলো? একটা দুটো করে আনিয়ে সব লাগিয়েছি। এবারের আনা চারাটার চারদিকে বেড়া দেওয়ালাম গতকাল।   
শাস্ত্রী    -       আপনি সেই ভোরবেলা থেকে এখনও প্রুফ দেখছেন? আর এ তো ‘কথামালা’ দেখছি। তাও প্রথম সংস্করণ নয়। এর প্রুফ তো আপনার দেখার প্রয়োজনও নেই। ছাপাখানার প্রুফ-রীডারও তো দেখে নিতে পারবে। (একটা ফর্মা উঠিয়ে) রাত জেগে জেগে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে...
ইশ্বর     -       আসলে ভাষা জিনিষটা এমনই। যতবার পড়ি, শব্দগুলো চোখের সামনে দিয়ে যায়, দৃষ্টি আটকে যায়, এখানে এ থেকে আরেকটু ভালো শব্দ দেওয়া যেতে পারতো না? ইস্‌, এই শব্দটা বাধছে। অর্থটা ঠিকই আছে কিন্তু দ্যোতনা কি ওই অর্থতেই ছড়াচ্ছে ... ? কিছুতেই মন স্পষ্ট হয়না,কাটকুট করে চলি সর্বদা। সে যা হোক, তোরা জলখাবার খাবি তো? (সতীশের দিকে তাকান) ভয় পেয়ো না। ক্ষেতের ভুট্টা তুলে হাতে দেব না। হা হা, ভালো জিনিষ আনিয়ে রেখেছি তোমাদের জন্য! তুমি এত ছোটো, নিজে আবার ম্যালেরিয়ার রুগী, কী করে যাবে অত দূর হরপ্রসাদের সাথে, ভাবতেই পারছি না। মহেন্দ্রনাথ বসু, তোমার বাবা, তার সাথে তো বিশেষ খাতির আছে আমার। তোমাকে ভালো করে না খাওয়ালে কী বলবেন মহেন্দ্রবাবু! কী আনিয়েছি তোমার জন্য জানো?   
শাস্ত্রী    -       সে ওর ঘুম চোখেই দেখা হয়ে গেছে। হাঁড়ি ভর্তি ছানাবড়া আর মতিচূর। কোত্থেকে আনালেন? বর্ধমান থেকে?
ইশ্বর     -       এখানে আর কোথায় পাবি ওসব?
                   (এক দল সাঁওতাল মেয়ে প্রবেশ করে। এসে নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্করা ও ছুটোছুটি করতে থাকে। তারই মধ্যে থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে আসে।)
মেয়ে    -       ও বিদেসাগর, কিছু খাবার দে আমাদের।
                   (বিদ্যাসাগর ঘরের দিকে যাওয়ার জন্যে ওঠেন।)
শাস্ত্রী    -       আপনি তো ওই দাম দিয়ে, না, দান দিয়ে, দান দিয়ে কেনা ভুট্টাগুলো এবার বিলোবেন। তার সাথে ওই মতিচূর ও ছানাবড়াও কয়েকটা দিয়ে দিন। এক এক হাঁড়ি খাবে কে?
ইশ্বর     -       আরে দূর! মতিচূর আর ছানাবড়া! কী ভেবেছিস, ওরা খুব অবাক হবে আর আনন্দে লাফিয়ে উঠবে? তারিয়ে তারিয়ে খাবে? ওদের শুধু খাবার চাই। যেমন ভুট্টা, তেমনই মতিচুর আর ছানাবড়া। ক্যোঁৎ করে গিলবে, খেয়ে নেবে। ওদের দিয়ে কোনো লাভ নেই। (ভিতর থেকে ভুট্টা বার করে এনে মেয়েদের দিতে দিতে) ওসবের সমঝদার লোকও আছে এখানে বুঝলি! এখান থেকে এক ক্রোশ দূরে একটা গ্রাম আছে, কোরা। সেখানে এক মারহাট্টা রাজা আছে। এক সময় যখন বাঙলায় বর্গীর আক্রমণ চলছিল সে সময় ওরা এখানে এসে ছোটোখাটো রাজত্ব গড়ে তোলে। সে রাজত্ব আর নেই। রাজা, ব্রাহ্মণ, সৈন্যসামন্ত, অন্য জাতের মানুষ সব মারহাট্টা ছিল, এখন সাঁওতালদের সাথে থেকে সাঁওতাল হয়ে গেছে। তবে ওই, ভালো খাবার যদি দাও, একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে খাবে, জিজ্ঞেস করবে, জিনিষটা কী, কী ভাবে তৈরি হয়েছে, কী কী দেওয়া হয়েছে, কোথা থেকে আনানো হয়েছে...
শাস্ত্রী    -       তাহলে এক কাজ করি। আমাদের সাথে লুচি আছে কয়েকটা। পরশু ভাজা। সেগুলো দিয়ে দিই ওদের।
ইশ্বর     -       আছে নাকি? কই, আন্‌ তো!
                   (হরপ্রসাদ ছুটে বেরিয়ে যান, স্টেশনের মালপত্র থেকে লুচির প্যাকেটটা বার করে আনতে। সতীশও বেরিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর মেয়েগুলোকে হাঁক দেন।) এ্যাই মেয়েরা, এদিকে শোন। (মেয়েরা এগিয়ে যায়।) খিদে পেলে, ‘বিদেসাগর খাবার দে’ বলতে সাতজন – এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত – আর বিকেলে আমার ইস্কুলে আসতে দুজন? বাকিরা কোথায় থাকে? কে কে আসেনি পরশু?
                   (যে মেয়েটি এগিয়ে এসে খাবার চেয়েছিল সে নিজেকে আর আরেকজনকে আঙুল দিয়ে দেখায়।)
মেয়ে    -       আমরা দুজনে এসেছিলাম।
ইশ্বর     -       বাকি রইল ক’জন?
মেয়ে    -       (আস্তে আস্তে ভেবে ভেবে গোনে) এক... দুই... তিন... চার... পাঁচ। (বিদ্যাসাগরের দিকে
                   তাকিয়ে) পাঁচ।
ইশ্বর     -       (ওই পাঁচজনকে) আসো না কেন তোমরা?
                   (মেয়েগুলো চুপ থাকে। শেষে বিদ্যাসাগর ওই গুনতি করা মেয়েটিকেই ডাকেন; তখনই হরপ্রসাদ
                   ও সতীশ ঢোকে। হরপ্রসাদ কলাপাতার মোড়ক খুলে লুচিগুলো শোঁকেন)
শাস্ত্রী    -       গরম জিনিষ, পাতাগুলোকে সেদ্ধ করে দিয়েছে, লুচিতেও পাতার গন্ধ। দিয়ে দিই ওদের?
ইশ্বর     -       দাঁড়া, আমায় দে। ওভাবে দেয় নাকি। কলাপাতাগুলো মেলে লুচিগুলো ছড়িয়ে রাখেন তার ওপর।
                   দুটো উঠিয়ে হাওয়ায় নাড়েন। তারপর শোঁকেন) এই তো আর গন্ধ নেই। (দুটো আরো উঠিয়ে
                   মুড়ে ভিতরে রাখার জন্য ওঠেন)
শাস্ত্রী    -       ওটা কী করছেন।
ইশ্বর     -       খাবো রে! তোর মায়ের হাতে ভাজা?
শাস্ত্রী    -       না, বড় বউয়ের।
ইশ্বর     -       তবে আরো ভালো! নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বিধবা পত্নীর! বড় ভালো বন্ধু ছিলো আমার, নন্দকুমার। (নিজের জন্য ভিতরে রেখে এসে আরো কয়েকটা লুচি তুলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলেন) নে খা। আর তুই যখন পালের গোদা তুই সবাইকে টেনে নিয়ে আসবি আমার ইস্কুলে, মনে থাকবে! (হরপ্রসাদের উদ্দেশ্যে) দেখলি, কেমন করে গপ গপ করে খেয়ে ফেললো লুচিগুলো। না রস বুঝলো না স্বাদ! (সাঁওতাল মেয়েগুলো বেরিয়ে যায়)। চল, বেলা হয়ে গেল। তোরা জলখাবার খেয়ে নে। একটু ঘুরে আয়। (দুজনকে নিয়ে ভিতরে চলে যান)


পঞ্চম দৃশ্য

[প্রথম ছেলেটি এসে একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে দর্শকদের বলে, “এখানে মাটিতে বাঁধানো একটা আসন ছিল।   বিদ্যাসাগর বিকেলে এখানে এসে বসতেন। এখানেই আজ প্রতিমাস্থাপন এবং অনাবরণ হবে।” বলে বেরিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর সেখানে এসে বসেন। সামনে পাঁচজন বয়স্ক সাঁওতাল পুরূষ এসে বসেন।]

ইশ্বর     -       (একটা স্লেট আর স্লেটপেন্সিল মাটি থেকে উঠিয়ে নেন) এ জিনিষদুটো তোমাদের কাছে আজ নেই। আমি কলকাতা থেকে কয়েকটা আনাবার ব্যবস্থা করেছি। আর বই, সবাইকার হাতে একেকটা দিয়েছি? (সবাই ‘হ্যাঁ’এ মাথা নাড়ে) তবে, বই ধরে শুরু করার আগে একটা খেলা খেলি। আমি এক এক করে তোমাদের নাম লিখবো। দেখবো কে কে নিজের নাম চিনতে পারো। তবে তারও আগে (স্লেটে বড় করে লেখেন, ‘সাঁওতাল’), বল তো, কী লিখলাম? (স্লেটটা ওদের দিকে এগিয়ে দেন)
                   (ওরা এক এক করে স্লেটটা নেয়। লেখাটা দেখার আগে স্লেটটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে) ওটাকে বলে স্লেট। চারদিকে কাঠের তৈরি খাপ আর মাঝখানে পাথর বসানো। ওই পাথরটাকে স্লেট পাথর বলে। ওরকমই হয়, পাতলা ফালির মত, গায়ে গায়ে লেগে বড় পাথরখন্ড হয়ে থাকে। ফালিগুলোকে আলাদা করতে হয়, মসৃণ করতে হয়, কেটে চৌকো করে ওই খাপটা আটকাতে হয়। পাথরটা আমাদের দেশেও হয়। তবে জিনিষটা ইংরেজরা নিয়ে এসেছে এদেশে। এখন এদেশেও তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। ...কেউ পড়তে পারল লেখাটা? (সবাই ‘না’এ মাথা নাড়ে। ততক্ষণে প্রথম দৃশ্যের মোড়ল ঢোকে। গাঁএর বাকি মানুষদের পাশে না বসে একটু তফাৎ রেখে বসে।) তুই পারিস পড়তে? (মুখ না তুলে কাঁদতে থাকে) কী হল?
মোড়ল -       বুড়িটা মরে গেল রে দেওতা! (বিদ্যাসাগর থমকে যান। বাকি সকলেও থমকে যায়। তারপর দু’একজন প্রশ্ন করে)
দু’একজন-     কোন বুড়ি? কার কথা বলছে মোড়ল?
ওদেরই
একজন -       আমাদের, বারমুন্ডির, সুবি মুর্মু, সবাই ঠানদি বলতো।
দু’একজন-     কী হয়েছিল?
সেজন   -       হবে আবার কী। সাত বুড়ির এক বুড়ি। বয়সের গাছপাথর নেই। মরবে না? একা মানুষ। এতদিন বেঁচেছিল তা শুধু আমাদের এই ইশ্বর-দেওতার সেবায় আর ওষুধে। দিনের পর দিন গিয়ে বুড়ির পায়ে তেল মাখিয়ে দিয়ে এসেছেন। ওষুধ খাইয়ে এসেছেন। 
ঈশ্বর    -       চেয়েছিলাম এই শীতটা অন্ততঃ পার করে যাক। গরম এলে আপনিই কিছুটা আরাম হত। পারলাম না। দেখলি তো। এই জন্য তোদের মানা করি দেবতা বলতে। সাধারণ মানুষ আমি।
মোড়ল -       (প্রায় ঝগড়ার মত করে) এবার তুই বোকার মত কথা বলছিস। বাঁচামরা দিয়ে দেওতা হয়? তাহলে তো কেউ মরতই না। (আকাশের দিকে আঙুল তুলে) ভগবান তো সব দেওতার বড়। মরত কেউ? যারা বড় মানুষ, ভালো মানুষ, আমাদের রাস্তা দেখায়, হাত ধরে, তারাই দেওতা। (ইতিমধ্যে দ্বিতীয় দৃশ্যের চাষী ও তার বৌ ঢুকেছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে তারা একটু দূরে।)
চাষী     -       ভূল দিনে এসে পড়লাম বিদ্যেসাগর মশাই। মেয়েদের টোলটা কবে করেন?
ঈশ্বর    -       ভূল দিন বলে কিছু হয়না ভাই লেখাপড়ায়। আমিই তো বলেছিলাম ব্যবস্থা করে দেব। তবে সেটা হতে আরো এক সপ্তাহ দেরি হবে। আমার ওই বাড়িরই বারান্দায় ব্যবস্থা হবে ইস্কুলের। তাহলে আলাদা বসার আর পর্দার ব্যবস্থা করতে পারব। তা এসেই যখন পড়েছ মা, তুমিও শুরু করে দাও তো। (চাষীকে) ওই স্লেটটা ওকে দাও। (বৌটিকে) হ্যাঁ, তুমি পড়তে পারো কী লেখা আছে স্লেটটায়?
চাষীবৌ -       (বানান করে পড়ে) স, সএ আকার, ওপরে এটা কী?
ঈশ্বর    -       চন্দ্রবিন্দু বলে ওটাকে। ওটা থাকলে সব মিলিয়ে হবে ‘সাঁ’।
চাষীবৌ -       সাঁ, ও, ত, তএ আকার, তা, ল। সাঁ, ও, তা, ল। সাঁওতাল!
ঈশ্বর    -       ঠিক ধরেছিলাম আমি সেদিন। তুমি জানো। তাই আরো শেখার নেশাটা আছে। (বাকি বয়স্ক গ্রামীণদের) দেখলে, তোমরা সাঁওতাল। অথচ ‘সাঁওতাল’ এই সুন্দর কথাটা পড়তে পারলে না। সামনের সপ্তাহ থেকে তোমাদের জন্য বারান্দায় জায়গাও তৈরি হয়ে যাবে আর স্লেটও চলে আসবে। নিয়মিত আসতে হবে কিন্তু। (চাষীবৌকে) আর তুমি মেয়েদের স্কুলটাতেই এসো। তুমিই হবে এ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার, আমার সহায়ক। ছটফটে মেয়েগুলো তো বসতে চায় না, শুধু খেলার মতলব, তুমিই ওদের বসাবে, অক্ষরজ্ঞান করাবে। একটা ব্ল্যাকবোর্ডও আনাবো ভাবছি। তাহলে আজ যাও। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
                   (সবাই বেরিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর উঠে বাড়ির ভিতরে চলে যান।)

[স্টেজের আলো কমে আসে। সন্ধ্যা। দলে দলে সাঁওতাল মেয়েপুরূষ ঢোকে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঠটায় বসে। কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বালায়। বিদ্যাসাগর ঘরের ভিতর থেকে একটা চাদর জড়িয়ে, হাতে একটা আলো নিয়ে এসে চেয়ারে বসেন। কাগজপত্র টেনে নিয়ে তাঁর কাজও করতে থাকেন। সাঁওতালদের দু’একজন তাঁর হাতের ইশারায় ঘরের ভিতর থেকে কয়েক গোছা ভুট্টা নিয়ে এসে সবাইকে ভাগ করে দেয়। তারা আগুনে ভুট্টা সেঁকে খেতে খেতে গান গাইতে থাকে।]       


ষষ্ঠ দৃশ্য

[আগের শেষ দৃশ্যের ওপর সামনের দিকে আলো জ্বলে ওঠে। আলোটা আস্তে আস্তে পিছনে ছড়িয়ে পড়ে। যে বিদ্যাসাগর সেজেছিল সে স্টেজের সামনের দিকে এসে নেপথ্যে হাঁক দেয়। প্রথম ছেলেটি, অর্থাৎ নাটকের নির্দেশক ঢুকে বাড়ির সামনে লাগানো প্ল্যাকার্ডটা খুলে নেয়]

ছেলেটি -       যা, তুই জামাকাপড়টা পাল্টে নে। অবশ্য এই ড্রেসেও থাকতে পারিস। মন্দ লাগছে না। (নেপথ্যে ডাকে) এবার একটু হাত লাগাও ভাই সবাই! সবাই এসে পড়বেন। (সাঁওতাল মেয়েরা উঠতে যায়, ওদের বাধা দেন) তোরা কোথায় চললি?
মেয়েরা -       যাচ্ছিনা, আসছি এক্ষুণি, ফুল আনতে হবেনা বিদেসাগর-দেওতার জন্য? তোদের ডারেক্টার তো রাস্তা থেকে টেনে এনে আমাদের বসিয়ে দিল। আমরা ফুল টুল নিয়ে পরে আসতাম। (দল বেঁধে বেরিয়ে যায়। ওদিকে দুটো ছেলে ডানদিক থেকে টানতে টানতে নিয়ে আসে পেডেস্টাল সুদ্ধু বিদ্যাসাগরের আবক্ষ-প্রতিমা।)
ছেলেটি -       (সামনে দর্শকদের উদ্দেশ্যে) প্রায় একশ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়েছিল ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই নতুন কর্মভূমি – কর্মাটার। শেষে বিহার বাঙালি সমিতির প্রচেষ্টায় কর্মাটারের এই নন্দন কানন বাঁচানো গেল। আপনারা জানেন বিহারের বিভাজনের পর এখন কর্মাটার শহর, স্টেশন বিদ্যাসাগর ঝাড়খন্ডের জামতাড়া জেলার অন্তর্গত। তা সেই ১৯৯২এ প্রতিমাস্থাপন থেকে আজ এই দ্বিশত জন্মবার্ষিকী অব্দি আমরা এই নাটকে একসাথেই ধরার চেষ্টা করব। লড়াইটা চলছে। এই ভাষাতীর্থ গড়ে তোলার।
                   (একজন ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে ঢোকেন। সঙ্গে তাঁর দুজন সহায়ক।)
ডাক্তার -       সরি। একটু দেরি করে ফেললাম বোধহয়। কোথায় বসব আমরা। (প্রতিমা টেনে নিয়ে আসা ছেলে দুজনের একজন এগিয়ে আসে)
ছেলেটি২ -     আপনি তো চোখের ডাক্তার। মিহিজাম থেকে। ক্যাম্পের জন্য এসেছেন তো। আমার সাথে আসুন। (ডাক্তার এবং সহায়কদের নিজের সাথে নিয়ে যায়। ডাক্তারের ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।)    
                   (কয়েকটি মেয়ে এবং ছেলে ঢোকে। তারা প্রতিমার সামনে একটা পর্দা টাঙানো, ফুল ইত্যাদি দিয়ে জায়গাটা সাজানো এবং আলপনা দেওয়ায় মেতে ওঠে। একজনের হাতে ফেস্টুন/ঝান্ডি লাগানো দড়ি – এক  প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অব্দি টাঙালে দেখা যায় তাতে বাংলা বর্ণগুলো লেখা আছে।)
ছেলেটি৩-      (এগিয়ে এসে) এতো গেল সাজসজ্জা। এরপর হবে শ্রদ্ধানিবেদন। কিন্তু দায়? বিদ্যাসাগর তো এখানে এসেছিলেন অসুস্থ শরীর নিয়ে, পেটে দুরারোগ্য ব্যাধি, খোঁড়া পা... একটু অবসর নিতে, আরাম করতে। ইতিহাসে যাকে বলে অক্ষয় অবদান, তা তো তিনি রেখে এসেছিলেন কলকাতায়, সারা বাংলায়। দিনের পর দিন স্মার্ত পন্ডিত আর রক্ষণশীল বাঙালি ভদ্রলোকেদের ব্যক্তিগত আক্রমণ সহ্য করেও যা তিনি ভেবেছিলেন, করেছিলেন। রামমোহনের সতীহত্যারোধ আর বিদ্যাসাগরের বিধবাবিনষ্টিরোধের ভিত্তিতে আজ আমরা নারীমুক্তি আন্দোলনের কথা বলছি। (আলপনা দিতে থাকা একটি মেয়ে এগিয়ে আসে)
মেয়েটি -       বাংলা বর্ণমালার তিনি কারিগর; তাঁকে গুরু করে আমরা মাতৃভাষা শিক্ষার কথা বলছি; আমরা শিক্ষার অধিকারের কথা বলছি। (আরেকটি ছেলে এগিয়ে আসে।)
ছেলেটি৪ -     ঝড়ে জলে বৃষ্টিতে নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুরে ঘুরে এই কর্মাটাঁড়ের গ্রামে গ্রামে তিনি গরীব মানুষের চিকিৎসা করেছেন, সেবা করেছেন, কলকাতা থেকে উন্নত বীজ নিয়ে এসে, চাষের নতুন পদ্ধতি জেনে এসে তিনি এখানকার চাষীদের শিখিয়েছেন, সেই সুত্র ধরে আজ আমরা প্রান্তিক জনতার উন্নয়নের প্রশ্নগুলো তুলে ধরছি। স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা বলছি।
(একদল মানুষ ঢুকে পড়ে। তার মধ্যে মন্ত্রী, সান্ত্রী, বাঙালি সমাজের নেতারা আরো অনেকে আছে। তারি মধ্যে অন্য দিক থেকে কয়েকজন পুরূষ ও মহিলা ‘জিন্দাবাদ’এর স্লোগান দিতে দিতে সামনে চলে আসে। সান্ত্রীরা ওদের আটকায়। বাঙালি সমাজের হর্তাকর্তাদের দুএকজন এগিয়ে আসেন।)
হর্তাকর্তা-      কী ব্যাপার!
স্লোগান দিতে
থাকা দলের
একজন -       হামরা মন্ত্রীজীকে আবেদন দিতে এসেছি।
হর্তাকর্তা-      কিসের আবেদন?
একজন -       (সোজা মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে) ইহাঁ কা বালিকা বিদ্যালয় ইন লোগোঁনে অচানক বন্ধ্‌ কর দিয়া, মন্ত্রীজী! হামসাব কা তিন চার মাহিনে কা তনখাহ বাকি হ্যয়।
মন্ত্রী      -       (হর্তাকর্তার উদ্দেশ্যে) কেয়া বাত হ্যয়?
হর্তাকর্তা  -    বংগলা মিডিয়াম স্কুল খোলা থা হাম লোগো নে। কিসী তরহ চন্দা ইকট্‌ঠা করকে ইতনা সাল চলায়া। আব ন চন্দা দেনেওয়ালে হ্যঁয়, না বচ্চে হ্যঁয় পঢ়নে ওয়ালে। ইনসে হমারা ওয়াদা হ্যয়, ইনকি তনখাহ থোড়া থোড়া করকে দে দেংগে। পর স্কুল, বিদ্যাসাগর কী কর্মভূমি পর খড়া হোকর বোলনে মেঁ শর্ম আতী হ্যয়, বংগলা মিডিয়ম মে অব চল নহী পায়েগা। অংরেজি মিডিয়ম খোলনে কে লিয়ে কুছলোগ বোল রহে হ্যঁয়। ওয়সে আপ সরকার হ্যঁয়, হমনে কই প্রস্তাও আপকো দিয়ে হ্যঁয় ...
মন্ত্রী      -       ঠিক হ্যয়, (দু তরফকেই) হম বিচার করেংগে। (হর্তাকর্তাকে) অগর অংগ্রেজি স্কুল খুলে তো
                   ইনহে অগ্রাধিকার দিজিয়েগা, ইয়োগ্যতা কে মুতাবিক।
হর্তাকর্তা -     জী, বিল্কুল সরকার! ইয়ে ইনসে কহা হুয়া হ্যয়।
                   (সবাই চলে যায় প্রতিমা অনাবরণের দিকে।)
সেই প্রথম
ছেলেটি -       দেখুন কী অবস্থা! বাংলাভাষাই শেষ হয়ে আসছে।
মেয়েটি -       শিক্ষার অধিকারই কি সদর্থে বলবৎ? আর নারীদের কী অবস্থা আজ দেশে?
ছেলে২ -       কত বলব? তবু এক মহামানবের পথে চলব! মানুষের দিকে, তার জীবনসংগ্রামের দিকে থাকব সব সময়!
                   (ওদিকে প্রতিমা অনাবরণ সম্পন্ন হয়। হাততালি দেয় সকলে। একটি ব্যানার মেলে ধরে তিনজনে মিলে –
‘বিদ্যাসাগর দ্বিশতজন্মবার্ষিকী
নারীর অধিকারের পথে
মাতৃভাষার অধিকারের পথে
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারের পথে
বঞ্চিত মানুষের অধিকারের পথে’)


মাপ্ত


No comments:

Post a Comment