Thursday, October 15, 2020

ইতিহাসবিদ

এক গ্রীষ্মের দুপুরে তাঁকে দেখলাম ।
ধুলো আর আবর্জনা ভরা রাস্তাটার একধার দিয়ে তিনি
বাড়ি ফিরছিলেন ; বগলে কিছু জার্নাল
আর হাতে একটা সদ্যোজাত জামচারা
যার পল্লবিত শীর্ষ তাঁর মাথার
                                      খানিক ওপরে উঠে দুলছিলো ।
আমি দেখলাম তাঁর হাতের সেই শিশুটিকে
অতীতের কোনো মাটিতে তিনি যার শিকড়
প্রসারিত করতে পারবেন না কখনো ।
যাকে দিতে হবে আজকেরই পৃথিবী ।
ফলের কালোগুচ্ছ যেদিন অন্য এক জৈষ্ঠের হাওয়ায় দুলবে
সেদিন হতে পারে তিনি থাকবেন
হতে পারে
তিনি থাকবেন না ।

ধ্বংসের নুন আর ক্ষয়ের রসায়নের সাথে তাঁর করতল
কথা বলে ।
নিজের ভিতরে
তিনি পাখীদের তৈরি করেছেন
যারা মাঝে মাঝে সময়ের বিলুপ্ত ঢেউয়ের দিকে উড়ে যায় ।
ডুব দেয়
অনুভব করে জলের স্তর
                             মাত্রা
                                       ক্ষীণ অন্তঃস্রোত
                                                          দিক
                                                                   ঝড়ের সম্ভাবনা
সমাজের কোনো একটি মুহুর্তের রক্তচাপ ।
একটি মুহুর্ত ।
স্থির ! পৃথিবী, আকাশ, সূর্য্য ও মেঘের ছায়া
স্থির ! চারদিকে জনপদের পর জনপদ !
স্থির ! অসংখ্য মানুষ
                   যে যার নিজের কাজের তৎকালিক ভঙ্গিমায়
স্থির ! শাসকের উদ্যত হাত
স্থির ! বাঁচতে চাওয়া বন্দীর চিৎকার করে ওঠা মুখ
স্থির ! পাহাড়ের কোলে একলা মা
                             তার সন্তানকে ডাকতে গিয়ে
স্থির ! বাদ্যযন্ত্রের ওপরে একটি হাত
স্থির ! তিনটি স্বরের ওপরে আঙুল
স্থির !
সমস্ত কিছু স্থির !
প্রবাহের এক প্রস্থচ্ছেদ ফলকে
যন্ত্রণা, স্বপ্ন, কন্ঠস্বর
জীবনের সেই একটি মুহুর্তের স্থির বিশিষ্ট নিশ্চিতি ! ...
পাখীরা সেই লুপ্ত মুহুর্তের
স্থির, স্তব্ধতার ভিতরে কলরব করে ছড়িয়ে পড়ে ।
অসংখ্য অসম্বদ্ধ ঘটনার মাঝে
পারম্পর্য্য আর কারণের গোপন সূত্রের
খড় আর গভীর শিকড়গুলো খুঁজে খুঁজে তুলে
উঠে আসে
ঢেউয়ের ওপরে আবার !
ডানার কার্বন আর কালের জল ঝেড়ে
কয়েক যুগ নিমেষে পার হয়ে এসে ঢুকে পড়ে
তাঁর বুকের ভিতরে ।
পাখীরা অদৃশ্য
তবু তারা যে ফিরে এসেছে তা
গ্রন্থাগারের এক কোণে হঠাৎ
উজ্জ্বল হয়ে ওঠা তাঁর দুই চোখের দিকে তাকিয়ে
                                                                   জানা যায় । ...
তখন কাগজের ওপর বাক্যেরা বেরিয়ে আসে
ধোঁয়ার ভিতর থেকে যুক্তির ধারালো গ্রানাইটের মতো ।
একদা বিলুপ্ত ধুলো আর কোলাহলে
ভরে যায়, গোধুলির খেলাশেষের গ্যালারীর মতো তাঁর টেবিল
কলম আর চশমার রঙচটা খাপ । ...
একদিন ছাপাখানার যন্ত্র ঘর্ঘর করে ওঠে ।
আর এক আর্দ্র সকালে, শহরের
বইয়ের দোকানগুলোর কাঁচের ভিতরে এসে
                                      রাস্তার দিকে তাকায়
পথচলতি ব্যস্ত আমাদের
হারানো বয়স
অপরিচিত পরিচয় । ...


আর ওই পাখীরা ।
ওদের প্রাণবীজ এই উপমহাদ্বীপের তীরে
বণিকের জাহাজের সাথে মুদ্রার নিয়মের মতো এসেছিলো ।
সার্বজনীন সমতুল্য বলে দুনিয়ায়
ব্রিটিশ রাষ্ট্র নিজেকে কায়েম করেছিলো
সে সোনা, মুদ্রা হওয়া তার অধিকার !
তবে গম কোথায় দাঁড়িয়ে ? কাপড় ? খনিজ ?
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিক্রমা পথে আসা সবকটি জনতা
সাপেক্ষ মুল্য খুঁজতে শুরু করেছিলো নিজেদের ।
নতুন তৈরি শহরের গলিতে ময়দানে
নতুন তৈরি কলেজের সিঁড়িতে, গ্রন্থাগারে
সাম্রাজ্যের প্রহরীর চোখের সামনে দিয়ে
গ্যালিলিওর দূরবীন হয়ে
ক্রমওয়েল, রবেস্পীয়ের কিম্বা গ্যারিবল্ডির নাম হয়ে
শেলীর কবিতা হয়ে,
ঢুকে পড়েছিলো সেই খোঁজ, সাপেক্ষ মূল্যের,
রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হবার জন্য জরুরি ঐতিহাসিক শ্রমের
নিজের মূল্যকে নিজেতে পাওয়ার,
আর ওই পাখীদের প্রাণবীজ স্পন্দনে ভরে উঠেছিলো ।

শহরের বিপন্ন সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে
তামাটে রোদপোড়া চেহারার যুবক
ভাবতে শুরু করেছিলো
কেন এত অপমান ? প্রতিদিন ?
কে আমরা ? কোত্থেকে এসেছি ?
ওদের প্রশ্ন করলে বলবে গ্রীস, রোম,
                                                মধ্যযুগ, নবজাগরণ !
অনেক রক্তপাত, অন্ধকার, তবু বার বার আন্দোলিত মানুষ ।
কি বলবো, যদি আমায় প্রশ্ন করা হয় ?
স্মৃতিতে একটা পুরো দস্তুর মানুষ নেই ?
সবই দেবতার কার্য্যকলাপ ?
কে আমরা ?
কেন আমরা পরাধীন হলাম ?
কখনো কি স্বাধীন ছিলাম ?
কেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত
কামানের গর্জনে ভেঙে দেওয়া গেল না ?
সবই দেবতার হাত ?
অথবা এ সামাজিক জড়তার এক ভয়াবহ অন্ধকার
যা আমাদের নিজেদেরই জীবনের প্রতি
বিশ্বাসঘাতক করে ফেলেছিলো ?
আর জরুরি হয়ে পড়েছিলো
আত্মহননের পাঁকে ডুবে থাকা এই ভূখণ্ডে এক চেঙ্গিস খান ?
তরোয়াল আর ঘোড়ার খুরের দাগ দিয়ে নয়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, কাপড়ের কল আর রেললাইন দিয়ে
ভারতকে ভারত হিসেবে বেঁধে ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছিলো ?
মুক্তিতে জড় ছিলো তাই বন্দীত্বে গতিশীল হয়ে ওঠা
ঐশ্বর্য্যে অসুস্থ ছিলো তাই দুর্ভিক্ষে স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠা
নির্দ্ধারিত হয়ে পড়েছিলো ?...

এই সব প্রশ্নের সাথে প্রাণ পেয়েছিলো সেই পাখীরা ।
ডানার চাড় দিয়েছিলো । আর তাছাড়া
সাম্রাজ্যের জাহাজ নাবিক ছাড়া চলতে পারে না ।
আর যেমন নাবিকের স্মৃতি
                   অনিবার্য্যভাবে ছিলো সাম্রাজ্যবিরোধী
স্মৃতি যাতে সেদিন চেরীর টুকরো বসানো
সোনালী কেক ছিলো যা সে ক্রিসমাসের রাতে কিনতে পারেনি ;
ক্রিসমাসের রাতে তার সন্তানের ব্যথিত নীল চোখ
আর জুতোর ভিতরে বরফগলা ময়লা জল ছিলো
ছিলো শহরের ঘিঞ্জী এলাকায়
                                      ধূসর ধ্বসে যাওয়া গালগুলো
ব্রিজের ওপর ভিখারি,
ছিলো দেওয়ালের বাইরে ঝরে যাওয়া সন্ধ্যাকে
                             দুচোখে পাওয়ার জন্য লড়াই ...
তেমনই এখানেও
সদ্য তৈরি কারখানার আশে পাশে
যদি জেগে উঠছিলো নতুন ম্যাঞ্চেস্টার নতুন লিভারপুল
যদি জেগে উঠছিলো নতুন আইরিশ কোয়ার্টার
লিয়ন্স আর সাইলেসিয়াও কি খুব দূরে ছিলো ?
খুব কি দূরে ছিলো আঠেরোশো আটচল্লিশ ?
এখানেও সেদিন
চলে এসেছিল জেনেভার ডাক
          সন্ধ্যাকে পাওয়ার জন্য হড়তাল । ...
তাই অনিবার্য্য হয়ে পড়েছিলো
খোঁজা,
সেই বিশাল পারম্পর্য্য, সুত্রবোধ,
                                      হাড়ের বয়স,
মায়ের ঘুমপাড়ানী গানে ব্যথা আর বিদ্রোহের তড়িৎপ্রবাহ
যাতে দেশ, দেশ হয়ে ওঠে । ...

অতীত শুধু আবিষ্কৃত হয় না, জন্ম নেয়
জন্ম নিলো ভারতের আত্মচেতনায় ।
মহান ইতিহাসবিদেরা এলেন ।
তাঁরা দেবতার মুখোশ সরিয়ে ফুটিয়ে তুললেন
মানুষের মুখ ।
রাখালের, শিকারীর, যাযাবরের, কৃষকের মুখ ।
তাঁরা দেববাণীর শব্দের মরচে মেপে ফুটিয়ে তুললেন
মানুষের ভাষা ।
রাখালের, শিকারীর, যাযাবরের, কৃষকের ভাষা ।

এবং আমাদের এই বৃদ্ধ ইতিহাসবিদও
তাঁদের উত্তরসূরী হিসেবে এসে এগিয়ে গেলেন । 


তাঁর শরীর একটি একটি করে তাঁর
বছরগুলোকে অতীত করেছে ।
তিনি একশো একশো করে ফিরিয়ে এনেছেন অতীতের বছর ।
পাটনার রাস্তায় শ্রাবণ তাঁকে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছে ।
কাদা ছপছপে রাস্তায় দাঁড়িয়ে
সুদূর প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছেন
ও কিছু নয় ! সূর্য্যের কক্ষপথের ধুলো,
ঋতুদের অক্সাইড আর হাজার বছরের
বর্বর ভাববাদের কুহক !
ওই বৃষ্টির ওপারে
যদিও দেখা যায় না তবু রয়েছে
আমাদের রক্তে লীন দৃশ্যাবলী ।
কী বলছো ?
সম্রাটদের কেচ্ছাকাহিনী ?
না ।
আগে আমি শুল্ক আদায়ের ফর্মানটা চাই ।
রাজ দরবারে একজন সাধারণ মানুষের প্রবেশ !
না, রাজার দানের কাহিনী নয়
ও কোত্থেকে এসেছে, কেন এসেছে, কী করে, জানতে চাই ।
দেবতার বর যে পেয়েছিলো কেন চেয়েছিলো ?
কিভাবে উৎপন্ন হলো প্রবাদ আর কিম্বদন্তিগুলো ?
আর শ্লোকের, মন্ত্রের ভিতরে ওই
                             টুকরো টুকরো জীবনের ছবি ?
আমি সাধারণ শব্দগুলো চাই ।
ধান, মুদ্রা,
জমির সত্ত্ব, তার হাত বদলের নিয়ম
দেনা, খাজনার প্রতিশত,
ডাকাত, পাইক,
বলদ, লাঙল,
তাঁত, সদাগর, লোহা, নুন, নৌকো, মাছ ! ...
যাজ্ঞবল্ক্য ও মনুসংহিতায় এ কিসের লড়াই ?
দুই উৎপাদনব্যবস্থার ?
প্রাচীন রাজনীতি-সাহিত্যে
রাষ্ট্রের কার্য্যপ্রণালী নিয়ে এত প্রখর চিন্তা রয়েছে
রাষ্ট্রের সারবস্তু ও রূপ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই কেন ? ...
......
এই সব বলতে বলতে তাঁর জীর্ণ বার্দ্ধক্যগ্রস্ত শরীর
হাঁটু অব্দি-প্রায় পাজামা আর ছেলের
                                      পুরোনো পাঞ্জাবীটা পরে
আর বুড়ো কর্মোর‍্যান্টের ডানার রঙের শতছিদ্র ছাতাটা
                                      মাথার ওপর মেলে দিয়ে
এগিয়ে গেছে,
একই সাথে আজকের ট্রাফিকের ভীড় ও সময়ের
                                                          ট্রাফিকের ভিতরে ।
মানুষ যেই পথে এগিয়েছে ক্রমান্বয়ে
যে কোনো মানুষের স্মৃতিচারণের মতো তিনিও
অনুসরণ করেন না সেই পথ
                                      পিছোবার বেলায় ।
দশই জুলাই উনিশশো আটাত্তর থেকে সোজা
গুপ্ত সম্রাটদের ঘরে ঢুকে নথীপত্র হাঁটকান ।
কিম্বা কোনো এক বৌদ্ধশ্রমণের সাথে বসে পড়েন
নালন্দার চাতালে ।
বিহার বাংলার পথে ঘোড়া ছুটিয়ে
শহন্‌শাহের আদেশ নবাবের কাছে নিয়ে আসা লোকটির
পাশে পাশে
অদৃশ্য ঘোড়ায় চড়ে যেতে
তাঁর কোমরে ব্যথা হয় না একটুও ।
তন্মুহুর্তে আবার ফিরে আসতে পারেন,
অথবা ফিরেও আসতে হয় না
অতীতের দৃশ্যদৃশ্যান্তরের ফাঁক দিয়ে তাঁর
                                      চোখের সামনে ভেসে ওঠে
আজকের তরুণ এক শিক্ষকের মুখ, তাঁর বিভাগের ;
তিনি তার নমস্কারের প্রত্যুত্তর দেন
                                                অদৃশ্য ঘোড়ায় সওয়ার
                                      কোন জনপদ, কোন শতাব্দী থেকে ?


আজ !
আমি এই কবিতা লিখছি ! আজ !
দিনের পর দিন কতো ছড়িয়ে পড়ছে এই আজ !
যতো গভীর, যতো প্রসারিত হচ্ছে চেতনা
ততো ব্যপ্ত হয়ে পড়ছে ।
মানুষের সমস্ত জন্ম, মৃত্যু ও নবজন্ম
                             আজই তো হলো ।
আজই তো সকালে
আজটেক, সুমের অথবা হরপ্পার রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে
আমি নৌকোর জল ছাঁচছিলাম ।
আজই তো সকালে নালন্দার গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে
                                                          শীতের হাওয়ায়
উত্তরীয়টা ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছিলাম ।
এই তো একটু আগে আমি
মেক্সিকো শহরের একটা বাড়ির পিছন-দরজা দিয়ে বেরিয়ে
কাপড় কাচা সাবানের গন্ধ আর
বাচ্চাদের কলরব পিছনে ফেলে
এখানে পাটনায় এই ঘাসের ওপর বসে লিখছি ।
অদূরে রাখা আমার সাইকেলের
ছায়া পড়ছে জোহানেসবার্গের রেললাইনের ধারের
শ্যান্টির দেয়ালে ।
কেউ ডাকলো আমার নাম ধরে কোত্থেকে ডাকলো ? ...
ইতিহাসবিদ !
এ আমার আপনার প্রতি ঋণ !
তাই এই আটাত্তরের জুলাইয়ের দুপুরে
                                      আমি গাইছি আপনাকে ।
আপনাকে ও আরো সকলকে আমি গাইতে চাই
যাঁরা রক্তের গঠনে হাজার বছরের
                                      বীজ ও বেদনা চিনিয়ে দিয়ে যান । ...


তবু আজ !
কতো সঙ্কটজনক এই আজ !
এইতো দুপুর বেলায়
ইতিহাসবিদের সমবয়সী ওই বৃদ্ধ
বই বাঁধাইয়ের দোকানটা থেকে বেরিয়ে
রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরিয়েছেন ...
তিনি পড়তে জানেন না,
কিন্তু দুবেলা খাবার আর পরনের কাপড় আর
এক চিলতে ঘরভাড়া মজুরির বদলে
বইয়ের আর থিসিসের
সুন্দর টেঁকসই মলাট তৈরি করে গেছেন জীবনভর ...
আর তাঁর পাশে একটি শিশু
সেও পড়া শুরু করতে পারেনি
কিন্তু বইয়ের সুন্দর বাঁধাই করা শুরু করে দিয়েছে ...
আর ওই যে লোকটি
                             ইতিহাসবিদকে নমস্কার করে চলে গেল ;
প্রেসে কাজ করে
ইতিহাসবিদের কাজের পাতার পর পাতা
সে যত্নের সাথে ছেপেছে
কিন্তু কখনো পড়তে পারেনি ...

ইতিহাসবিদ !
আপনি কি ভাবছেন
কী অর্থ
ইতিহাসের পথে বিকশিত একটি শব্দের
যদি আজকে ওই শব্দের রক্তকে যে শরীরে ধারণ করে
সে না জানে
                   ওই শব্দটার ইতিহাস ?

[১৯৭৮]



No comments:

Post a Comment