Saturday, October 17, 2020

ঠিকানাঃ পাটনা ৮০০০...

এ শহরে জন্ম হলো ।
মাঝের কয়েকটি বছর দুএকটা ভিন্ন শহর
                   দুএকটা ছোটো গল্পের জন্য বাদ দিয়ে
কিম্বা কয়েকটা ছোট্টো লিরিক ;
এ শহরে আঠাশ বছর ধরে আছি ।
আজও কি এই শহরের কবি হতে পেরেছি ?
 
কুয়াশার রাত্রে হঠাৎ - বিদ্যুৎ !
বলে ডাক ওঠে পুরোনো মোহল্লার ঝিমিয়ে পড়া মোড়ে ।
ঘুরে তাকাই ।
এ শহরের আঠাশ বছর
দেখি রিলিফের মাল ছেঁড়া বিলিতি সার্জের কোট পরে
উঠে আসে
পুরোনো বাড়ির বেসমেন্টের ভাঙা চাতাল থেকে
কেমন আছো ?
ভালো আছি ।
শুধু এ শহরের দিগন্তে আজো কোনো পাহাড় এলো না,
স্বপ্নের টেলিগ্রামগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরছি
                             আজও সাঁটা হলো না দেওয়ালে ।

শহরের কোনো এক দিগন্তে পাহাড়
                                      অন্ততঃ ছোটো মাটিরও একটা
                                      একটা কিছু উঁচু, যাতে চড়ে
                                                শহর পেরিয়ে দেখা যায়,
সূর্যকে ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের কাছেই ধরে ফেলা যায়,
লাফিয়ে উঠে পড়া যায় জানালা দিয়ে সেঁধিয়ে
                   দিনের খালি কম্পার্টমেন্টের নীলচে করিডোরে
অত্যন্ত জরুরি ।
এতে প্রেম আর শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে ।

এক সময়
একটু বেশি ভাবপ্রবণ ছিলাম ।
একসাথে নিয়ন্ত্রণ করতাম ভবিষ্যতের
সেচ, বন, নগর-বিকাশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জনকমিসারিয়েট ।
পুরো শহরটা ঢেলে সাজাবার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিলাম
কালিনিন-প্রস্পেক্টটাকে মডেল হিসেবে রেখে ।
শেষে আমার
ভাবপ্রবণতার সুযোগ নিয়ে
শহরকে সুন্দর করতে বুলডোজার এগিয়ে এলো ।
আমার এক বন্ধুর ঘর বস্তিতে,
সেই বস্তি ভেঙে দিলো ।
তার ছোটো ভাই মারা গেল শীতের রাতে, সেই রাতে
আমার সমস্ত বিভাগ
দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল,
বুলডোজার আর হাহাকার তুমি কোনদিকে যাবে ?
বুলডোজারের দিকে যাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না ।
আমি সেদিন এই শহরের ভাঙা গলিগুলোর কাছে
অনেকক্ষণ ক্ষমা চেয়েছিলাম ।
তবু বুলডোজারের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে একদিন ।
বুলডোজার কার ! কোনদিকে যাওয়ার !
পাহাড়ের সাথেও বোঝাপড়া করতে হবে ।
কবে হবে ! কিভাবে হবে !


আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন শহরের কবি ?
শহর তো কোনো বাদ নয় !
শিল্পতত্ত্বের কোনো ধারা নয় !
হ্যাঁ ! শহরের কবি !
আপাততঃ রাজনৈতিক সূক্ষ্মতায় যাচ্ছি না,
                             আপনার লাইন ঠিক কি আমার ...
যে লাইনেই থাকুন
এটা তো মানবেন যে জীবনের সুন্দর দিনগুলো আনার
                                                বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ে
যেমন দেশ একটা ফ্রন্ট;
তেমন দেশব্যাপী লড়াইয়ে ক্লোজ-আপ লেন্স লাগিয়ে দেখুন
শহর একটা ফ্রন্ট ।
লড়াই চলছে ।
শত্রুপক্ষ আর মিত্রপক্ষ দুই-ই হাজির ।
হার্ডিঞ্জ রোড আর বেলী রোডে মাঝে মাঝেই
দীঘা গুমটি দুটোর কাছে
সামনা সামনি হয় ।
বাস আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে ব্যারিকেড তৈরি হয় ।
ময়দান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন অফিস, পার্টি অফিস,
হলঘর থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, গোপন আড্ডা,
আর এম এল এ ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে রিপাব্লিক
প্রেসিডেন্ট, পাটলিপুত্র কিম্বা মৌর্য্যের কনফারেন্স রুম অব্দি
প্রায় প্রতিদিনই
দুপক্ষের জেনারেল আর সৈনিকদের মাঝে
ফর্মাল মিটিং আর ইনফর্মাল গেট-টুগেদার হয় ।
তৈরি হয় ডিফেন্স আর অফেন্সের কার্য্যসূচী ।

তা আমি সেই দু পক্ষের এক পক্ষে আছি
(কোন জলের মাছ তা কবিতাই বলবে)
ডাগ-আউটের ভিতরে বসে নিজের ডাইরিতে লিখতে চাই,
এই ফ্রন্টের ভূতত্ত্ব, আবহাওয়া
গাছগাছালি, পশুপাখি,
ঘরবাড়ি, মোহল্লা, বাজার, কারখানা, মানুষেরা ।
মানব মস্তিষ্কের যতেক সুগন্ধ, যথা
                                      ভালোবাসা থেকে আন্দোলন
                                      নৈঃশব্দ থেকে গান ।
মানব মস্তিষ্কের যতেক দুর্গন্ধ, যথা
                                      দয়া থেকে হত্যা, করুণা থেকে ব্যভিচার
                                      মন্দির মসজিদ থেকে কোকতত্ত্ব আর
                                      ব্যাঙের বংশবৃদ্ধি থেকে
                                                বাকস্বাধীনতা জিন্দাবাদ । ...
দেখুন না ডাইরি উল্টে পিছনের পাতাগুলোয়
সেই পঁয়তাল্লিশে রুমানিয়ার এক গ্রামে
দুপুরে বসে লিখেছিলাম সেই মহান বসন্তের কথা ।
তারও আগে
বলশেভিকদের কাছে শিখতে গিয়েছিলাম সতেরোয়
                             ইন্টারন্যাশনালিস্টদের সাথে ।
ইউক্রেনের একটি অঞ্চলে বসে
কাঁচা হাতে অনেক কিছু অনেক পাতা ভরে লিখেছিলাম ।
কেননা ওখানেই
ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার বাবা, মা, ভাই, বোনের
                                                নাম পেয়েছিলাম
বাবা, মা
আঠেরোশো আটচল্লিশের ব্যারিকেডে মারা গিয়েছিলেন,
আমার দুই বোনও একের পর এক
পতাকা হাতে আহ্বান জানিয়েছিলো সাথীদের
আর গুলিবিদ্ধ হয়েছিলো,
ভাইটা
শেষ কম্যুনার্ডদের সাথে পড়েছিলো গোরস্থানের দেওয়ালে ।
দাদুর ছবি পেয়েছিলাম ইংল্যান্ডের একটা কাঠখোদাইয়ে
একজন বৃদ্ধ চার্টিস্ট !
কাঠের সাঁকোর ওপরে, জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ।
মা নাকি বলতেন
আমার আরও দুএকটা ভাই ছিলো ।
                                      কে কোথায় ছিটকে পড়লো,
আমি এসে বড়ো হলাম এই ভারতবর্ষে
হাওড়ায় সেই প্রথম হড়তালের সময় থেকে,
আর তারপর থেকে এখানেই আছি, এখানেই
সারা দুনিয়ার সাথীদের সাথে
                             কদম মিলিয়ে চলা শিখেছি, গান গাওয়া,
বৃটিশের বিরুদ্ধে রেলের চাকা জাম করার থেকে ইদানিং
কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বোটক্লাবে মিছিল নিয়ে যাওয়া,
এত তর্ক, এত জেরবার, এত রক্তপাত
                                      বিপ্লবের পথ খোঁজার দ্বন্দ্বে ...

এই রক্তপাত, এই দ্বন্দ্বের কোনো একদিক নয়
                                      এই পুরোটা দ্বন্দ্ব আমার
এই দেশ, এই উপমহাদ্বীপের ঝড়ের নুন
                                                আমি ভালোবাসি ।

থাক ছাড়ুন ওসব কথা ।
মায়াকভস্কি বলেছিলেন না ?
বলশেভিক কাঁদছে
এটা একটা মিউজিয়ামে রাখবার মতো আজব দৃশ্য !

তাছাড়া এতগুলো দশক তো কেটে গেল এদেশেরও !
কী করতে পেরেছি, কী করতে পারিনি,
কিভাবে করা উচিৎ
সেটা বরং শান্ত মনে ভেবে দেখা বেশি দরকার
এভাবে অস্থির হওয়ার থেকে ।
এ মঙ্গলময় ঈশ্বরের দেশ ।
বার বার
আশা জেগে ওঠে, কখনো রাশিয়া কখনো চীনের নামে
কখনো তৃতীয় দুনিয়ার !
আন্দোলন শুরু হতে না হতেই
পার্লামেন্ট স্ট্রীটে রেড ফিল্ডগানের ঘর্ঘর
কানে বাজতে শুরু করে ।
মধ্যরাতের ঘোষণার মুসাবিদা তৈরি শুরু হয়ে যায় । ...
কিন্তু আজও
সবকিছু সত্ত্বেও নিজের দুর্বলতা স্বীকার করছি
এদেশটাকে হাতে তুলে ওজন করতে পারলাম না
                                                যুক্তির পাল্লায়,
থাকবে ? না জলে ডুবে যাবে ?
কী কী পদার্থ দিয়ে তৈরি এ জিনিষটা ?
যাকে দেশ বলছি ?
আর তাই এ প্রশ্ন করছি আজ
আমি কি এই শহরের কবি হতে পেরেছি ?
আপনি ?
নিজের শহরের ? কিম্বা জেলা সদরের ?
শহরতলীর ? নিজের পঞ্চায়েত কিম্বা ব্লক এলাকার ?


আমি জানিনা কোনোদিন
ইস্‌সিক্‌কুলের মতো কোনো হ্রদের ধারে গিয়ে
চিৎকার করে বলতে পারবো কিনা
                             আমার গান এখনো শেষ হয়নি ইস্‌সিক্‌কুল !
একটা প্রাচীন নদী আছে বটে এ শহরের ধার দিয়ে
কিন্তু তার সাথে কোনো কথা বলা মুশকিল ।
বন্যা ও খরা ছাড়া বহুকাল সে আর চোখে পড়ে না,
তাছাড়া আমার গান শুরুই কোথায় হয়েছে যে
শেষ হয়নি, তার বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করবো ?

মাঝে মাঝে
রাস্তার মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে আমি শহরটাকে যাচাই করি
বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে ।
কখনো প্রাচীন পাটলিপুত্রকে নামাই
অশোক রাজপথে বৌদ্ধ পরিব্রাজকের পায়ের ধুলো উড়িয়ে ।
কখনো শ্রীকান্তের সাথে রাজলক্ষ্মীর বাড়ি থেকে ফিরি ।
কখনো যদুনাথ সরকারের সাথে পাটনা কলেজের
                                      ইতিহাস বিভাগে গিয়ে বসি ।
কখনো ঝাউগঞ্জ,
খাজে কলাঁ, পত্থর কী মসজিদ থেকে ওদিকে রুপসপুর গ্রাম অব্দি
ফের নতুন তৈরি আসাম দিল্লি হাইওয়ে থেকে প্রায়
                                                          দানাপুর ক্যান্টনমেন্ট
ওদিকে ফুলওয়ারিশরীফ ...
এই শহরের ছোটো বড়ো মোহল্লাগুলো
তার পুরোনো নোংরা অন্ধকার বাড়িঘর
জলকাদায় ভরা গলি
ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াই ।
ইলিয়টের প্যারডি করে একসময় বলতে পারতাম
প্রাইভেট সেক্টর থেকে পাব্লিক সেক্টরে পূঁজি আসে যায়
ভারতবর্ষের উন্নতির কথা বলে ।
দরিয়াপুর গোলা, মন্দিরি, সালিমপুর আরহরা
                             টিমটিম করে জ্বলে ।
রাস্তার কলে ঝগড়া বাধে,
বাচ্চারা কাঁদে,
ছেঁড়া টুকরো টুকরো দিনরাত বছর পেরিয়ে যায়,
পরবের রাতগুলোয় হত্যা হয়
                                      খুব ছোটো ছোটো কারণে
পুরোনো সরু গলিগুলো থেকে পচাটে হাওয়া ওঠে ইতিহাসের
                                      ক্ষয় ধরা ফুসফুস থেকে যেমন ...
একজন বৃদ্ধ রিকশাচালক ঘুঁষিতে রক্তাক্ত মুখ নিয়ে
বিমূঢ় ভাবে কাঁদে অশ্বত্থ গাছটার নিচে ...
কিন্তু আর না ।
ওসব নিওরিয়্যালিজ্‌মে কোনো কাজ হয় না ।
আর তাই
বেশ কিছু বছর হলো গভীর রাতের
নীল নিঃশব্দ ডায়ালগুলোয় ঘোরা ছেড়ে দিয়েছি ।
এমন নয় যে ব্যাপারটা খারাপ ।
শেষ রাতে স্টেশনের চায়ের দোকানে বিস্কুট
অনেকের সাথে খেয়েছি
ভ্যানগগের সাথে, ঋত্বিকের সাথে ...
ব্রুগেলকে নিয়ে রেণাঁশার সাথে লড়েছি
হিকমতের সাথে পেরিয়েছি এশিয়ার
                             একটি শহরের ওভারব্রীজ ...
আজও ঘুরতে ইচ্ছে করে ;
কতোজনকে নিয়ে গিয়ে দেখানো হলো না রাত তিনটেয়
প্রথম খবর কাগজ ফেরি করা বাচ্চা ছেলেটির মুখ ।
তাজা কাগজ হাত ঘষলে প্রেসের কালি উঠে আসে ।
তাজা মুখ
ঠোঁট ঘষলে আমাদের অনেক বাতেলার দাগ উঠে আসে ।
কিন্ত সময় নেই ।
কাজ এত বেশি আর করতে পারছি এত কম
চাঁদনিতে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে মনে হয়
                   হাড়ে রেডিও কার্বন জমবার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ।


কত কিছু জানতে হবে আর কত তাড়াতাড়ি ।
কত কিছু করতে হবে আর
এগিয়ে আসছে আবার একটা রাজনৈতিক সংকট ।
একসময় লিখেছিলাম
                             যতদিন যাচ্ছে তত কঠিন হয়ে পড়ছে বলা
                             আমার দেশ ।
তখন বুঝিনি তার তাৎপর্য্যটা পুরোপুরি ।
লিখেছিলাম
                   কে জানে মাদলকে মাদল বলতে চাওয়া
                   আমার কন্ঠনালীকে কতটা গড়েছে !
                   হয়তো আমার এ উচ্চতাও
                   আমের মঞ্জরী ছোঁওয়ার জন্য হয়েছিলো ।
এখন দেখতে পারি
মাদল, কন্ঠনালী, আমের মঞ্জরী, উচ্চতা ও আমার দেশ
পাঁচটা শব্দের পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে শত্রুর
পাঁচ রকমের ভাঙনের রাজনীতি ।
এখন দেখতে পারি যে একটু বেসামাল হলেই
পাঁচ রকম ভাঙনের রাজনীতির গোপন কামরায়
ভাড়াটে সঙ্গমের খেল দেখাতে লেগে যেতে পারে
মাদল, কন্ঠনালী,
                   আমের মঞ্জরী, উচ্চতা,
                             আমার দেশ।
                   তথা এমনই আরো শব্দগুলো
ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, করুণ আর কালসিটে পড়া চেহারায় ।


বিকেলে গোলামি থেকে খালাস পেয়ে
ইউনিয়ন অফিসের দিকে যাই ।
কমরেডের সাথে দেখা হয় ।
কী হলো কালকের মিছিলে সংগঠনের
ব্যানার দেখলাম না যে ?
 না ! গ্রামে পরশুর হত্যার ঘটনাটার
প্রভাব পড়েছে ওখানে । লীডারশিপ
নিজেদের মধ্যে লড়ে গেছে জাতের ভিত্তিতে ।
গ্রুপটাকে দিয়ে চাপ দেওয়াতে হবে ওখানে । নইলে
ইউনিয়ন ভেঙে যেতে পারে । ... আরে হ্যাঁ শুনুন !
অস্ত্রভস্কির ইস্পাত বইটা আছে আপনার কাছে ?
দিননা । আরেকবার পড়বো ভাবছিলাম ।

বিজ্ঞান ভবনের পিছনে সূর্য্য নেমে যায় ।
ময়দানের অন্ধকার খাঁজগুলোয়
মেয়েরা মরে । বেশ্যারা জন্ম নেয় ।
আমি ও আমার কমরেড
ঘুরতে ঘুরতে আলোচনা করি, কাঁটা দিয়ে কাঁটা
তোলার অর্থাৎ জাত দিয়ে জাত ভাঙার
কালকের কার্য্যক্রম ও তারই সাথে
বাবুশকিনের জীবন ।...

তাই তো বলছিলাম
এ শহরে জন্ম হলো,
এ শহরে আঠাশ বছর ধরে আছি,
আজও কি এ শহরের কবি হতে পেরেছি ?

[১৯৮০]




No comments:

Post a Comment