Sunday, October 18, 2020

ব্রাত্যজনের বিদ্যাসাগর

         লেখার এই নামটা আমার দেওয়া নয়। প্রাণতোষবাবুর। ভুবনেশ্বরে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনাচক্রে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেছিলাম, হিন্দীতে। বিদ্যাসাগরের জীবনের কর্মাটাঁড় পর্যায় নিয়ে। প্রাণতোষবাবু সেই বক্তব্যের ভিত্তিতে একটি বাংলা লেখা লিখতে বললেন ফোনে, ওই ব্রাত্যজনের বিদ্যাসাগরকে নিয়ে...। নামটা নিয়ে নিলাম।

কিন্তু সমস্যা হল, ব্রাত্যজন একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং কিছুটা রাজনৈতিক পারিভাষিক শব্দ। সুত্র প্রাচীন, কিন্তু ব্যবহার আধুনিক। বিদ্যাসাগর নিজের কাজের ক্ষেত্রের প্রসারে দরিদ্র জনসাধারণের সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা কি তাঁর চোখে ব্রাত্য ছিল? এবং সে অর্থে, তাঁদের কাছে পৌঁছোনো কি তাঁর নৈতিক প্রাথমিকতা ছিল? যদি মেনেও নিই যে কিয়দংশে ছিল, সেটা কি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে, তাদেরকে উপেক্ষা করে?

বোধহয় নয়। ব্রাত্যজন বা দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করার সময়েও তাঁর মাথায় নতুন দেশের ক্রমোন্নতির যে পরিকল্পনা ছিল, তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল। বরং, তারা যাতে সেই ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। যখন তিনি ইংরেজ সরকারের দেশীভাষা শিক্ষানীতি অনুসারে বাংলার গ্রামেগঞ্জে একের পর এক আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করে চলেছেন, সেসব বিদ্যালয়গুলির পরিচালনের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা আসছে তার সমাধানের জন্য সরকারের সাথে কথা বলছেন তখন তাঁর মাথায় স্পষ্টভাবে আছে মফস্বল-গ্রামাঞ্চলের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের যাদের ওপর তিনি, তাঁর বাংলা বিদ্যালয়গুলির ছাত্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভরসা করেন সরকারি চাকরিতে জায়গা করে দেওয়া। তার জন্য ইংরেজ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানদেরও সমভাবে এবং সম-মানে শিক্ষা দেওয়া উচিৎ, কিতু তার জন্য প্রয়োজন নিঃশুল্ক শিক্ষা। আর তিনি মনে করেন না যে কোনো (তৎকালীন) সরকার সে ধরণের সার্বজনীন নিঃশুল্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে আগ্রহী বা উদ্যোগী হবে। অর্থাৎ তাঁর নজরে শিক্ষায় সরকারি উদ্যোগের যে উন্নয়নী প্রেক্ষিত, তার গতিটা কেন্দ্রাতিগ। ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে পারে, সময় লাগবে, ব্যক্তিগত উদ্যমের প্রয়োজন হবে, সরকারের নীতিবদল হবে ... কিন্তু সেখানে ব্রাত্য কেউ নয়। কাউকে জেনেশুনে, শ্রেণীগত রণনীতি হিসেবে, অশিক্ষার অন্ধকারে রাখা হয় নি। জেনেশুনে কাউকে দারিদ্রের পাঁকেও ফেলে রাখা হয় নি। বোধোদয় পুস্তিকাতে তিনি স্পষ্ট লিখছেন যে যে ধনী, সে নিজের পরিশ্রমে ধন উপার্জন করেছে। অর্থাৎ যে দরিদ্র, সে যথেষ্ট পরিশ্রম করেনি। এই বক্তব্যের একটা অসাধারণ ইতিবাচক দিক আছে। এতে ভাগ্য, দৈব, নিয়তি-ফিয়তির কোনো জায়গা নেই। কিন্তু শোষণ-দমন বা শ্রেণীগত/জাতিগত শাসনের ধারণারও কোনো জায়গা নেই। তাই ব্রাত্য কেউ নয়।

কিন্তু সত্যিই কি নেই?

যখন বিদ্যাসাগর সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিজের দেহ-মন-ধন সবকিছু নিয়োজিত করেন এই কথাটা মাথায় নিয়ে যে ওদের কাছে কেউ পৌঁছোচ্ছে না না সরকার না কলকাতার বাবু তখন কি সেই ব্রাত্য বা বহিষ্কৃত শব্দটাই তাঁর মাথায় খেলে না? তিনি কি ভাবেন না যে সরকারের দায় সরকার স্বীকার না করুক, বাবুদের-জমিদারদের-রাজাদের দায় তারা স্বীকার না করুক, তাঁকে তো যেতেই হবে ওই সাধারণ মানুষের কাছে! তিনি যে দায়বদ্ধ! কিসের দায়? একজন পুরোদস্তুর মানুষ হবার দায়!

তাই ব্রাত্যজনের বিদ্যাসাগর মানে জনগণের বিদ্যাসাগর।         

 

জনগণের বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের কোনো পর্যায় নয়। বিদ্যাসাগর প্রথম থেকেই জনগণের বিদ্যাসাগর। কিন্তু তাঁর জীবনের কর্মাটাঁড় এবং কর্মাটাঁড়-পরবর্তী পর্যায় একটা অন্য কারণে বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

কারণটা হল বাংলার নবজাগরণ নিয়ে চর্চার একটা সাধারণ সীমাবদ্ধতা। যাঁরা এই নবজাগরণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমাদের চিনিয়েছেন, পরবর্তী যুগের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বশর্ত হিসেবে এই নবজাগরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মহতী ভূমিকা চিহ্নিত করেছেন, তাঁরা যেমন এর প্রভাবক্ষেত্রের পরিসর শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সীমিত রেখেছেন, যাঁরা এই নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে এর সমালোচনা করেছেন তাঁরাও, ওই মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমিত ছিল বলেই দোষারোপ করেছেন। অর্থাৎ, তাঁদেরই ভাষায় বললে, দুদলই একই ডিস্কোর্সএর দুদিক হয়ে রয়ে গেছেন।

অথচ, তাঁদেরই লেখা পড়ে আমরা জেনেছি এই নবজাগরণের গণমুখী একটি চরিত্রের কথা, কাজের কথা। সেই কাজগুলোর সমষ্টিকে একটি নতুন ধারা মেনে নেব না কেন? নতুন অভিমুখ মেনে নেব না কেন?

অবশ্য, সমালোচকের পক্ষ বলবেন যে ওই গণমুখী অভিমুখেরও ভাবধারাগত চরিত্র তো মধ্যবিত্ত! তা নিশ্চয়ই। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় বা ভারতে কি সেটা সীমাবদ্ধতা? যদি সীমাবদ্ধতা হতে হয় তাহলে তো পাশাপাশি আরেকটি ভাবধারা সেই সময়কার ভারতে বা বাংলায় থাকতে হবে যার ভাবধারাগত চরিত্র শ্রমজীবী মানুষের! তার সাপেক্ষে না সীমাবদ্ধতা! আছে কি?

অনেক দিন আগে, লেখক অমর দত্ত মহাশয় (আমার সৌভাগ্যক্রমে তিনি কিছুদিন পাটনায় ছিলেন এবং আমাকে বন্ধু করেছিলেন) গণমুখী কাজের এই ধারার দিকে ইঙ্গিত করে একটি ছোট্টো মনোগ্রাফ লিখেছিলেন এবং সেটি পড়েওছিলেন (ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদেরই কোনো সভায় কি? মনে নেই)।

বস্তুতঃ, কর্মাটাঁড় যেহেতু হিন্দী-অঞ্চল বলে কথিত এলাকায় (আগে অবিভাজিত বিহারে এবং অধুনা ঝাড়খন্ডে) এবং আমাদের, অর্থাৎ বিহার বাঙালি সমিতির কাজের ক্ষেত্র যেহেতু বহুলাংশে হিন্দীভাষী অধ্যুষিত, তাই হিন্দী সাহিত্যে বাংলার নবজাগরণের রূপরেখা খুঁজতে শুরু করলাম। এবং দেখলাম যে তাতে রামমোহনের সতীদাহপ্রথা-রোধ, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রয়াস ও বাল্যবিবাহ-রোধ এবং রবীন্দ্রনাথের ভক্তিকাব্য আর নোবেল ছাড়া কিছু নেই। এমনও নয় যে ছিল না। ছিল। অনেককিছু ছিল। কিন্তু হিন্দীর বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক হতে গিয়ে বাংলার নবজাগরণকে শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা হিসেবেই শুধু গ্রহণ করেছে। বাকি জনতার জন্য, ওই সমাজসংস্কার, ভক্তিকাব্য ও নোবেল! সরকারি তথ্য!

কাজেই আরো বেশি করে একটা দায় এসে পড়ল, গণমুখী নবজাগরণ ও সেই প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের কর্মাটাঁড় পর্যায়টা দেখার।

প্রশ্নগুলো এভাবে দাঁড় করালামঃ

১ - বিদ্যাসাগরের কর্মাটাঁড় পর্যায়ের কাজকর্ম কি নবজাগরণী কাজের ধারাবাহিকতা? নাকি, বিদারণ, বিচ্ছেদ?

তিনি কি বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, নিজের এতদিনকার প্রয়াসের অসফলতায় ভগ্নমনোরথ ও পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সাথে ঘটিত তিক্ততায় বিরক্ত হয়ে কর্মাটাঁড়ে অবসরযাপন করতে এসেছিলেন? আর, তাই যদি হয়, তাহলে নবজাগরণী ব্যক্তিত্বের দিব্যতেজ কাকে বলে? তাকি বিদ্যাসাগরের চরিত্রে নির্বাপিত হয়ে গিয়েছিল?

যদি কর্মাটাঁড় পর্যায়ের কাজেকর্মে নবজাগরণী কাজের ধারাবাহিকতা থেকে থাকে তাহলে এই ধারাবাহিকতায়, নবজাগরণের গণমুখী প্রসারে উনবিংশ শতকের আর কোন কোন খ্যাতনামা মানুষকে পাওয়া যেতে পারে?   

 

শেষ প্রশ্নটাই আগে ধরি। আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। কিন্তু সাধারণভাবে বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছু নাম এমন আসে যে তাদের খ্যাতনামা হওয়ার কারণ হিসেবে রয়েছে কলকাতাকেন্দ্রিক/ নগরকেন্দ্রিক বাবু, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত শহুরে জীবনেরও পরিধির বাইরে করা কিছু কাজ। সবচেয়ে প্রথমেই তো নিতে হয় সেই তেজীয়ান কিন্তু চুড়ান্ত মদ্যপ, অকালমৃত সাংবাদিকটির নাম। হরিশ মুখার্জি। যে দুটি প্রধান কারণে তিনি স্বনামধন্য তার একটি হল, ১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহের প্রতি সমর্থন। অনেক অনেক পরে আমরা সিপাহীবিদ্রোহকে স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম নামে অভিহিত করতে শিখেছি। অথচ বিদ্রোহ শুরু হওয়ার দুমাসের মধ্যে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে, ইংরেজদের অপপ্রচারের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে হরিশ ২১শে মে তারিখের হিন্দু প্যাট্রিয়টে লিখলেন, There is not a single native of India who does not feel the full weight of the grievances imposed upon him by the very existence of British rule in India grievances inseparable from subjection to a foreign rule [The Country and the Government] । আর, এক বছর পর ৬ই মে, ১৮৫৮ তারিখে লিখলেন, History will, we conceive, take a very different view of the facts of the Great Indian Revolt of 1857 from what contemporaries have taken of them. [The Atrocities and Retribution]

এটা তো কলকাতার বাবুদের বা মধ্যবিত্তদের দৃষ্টিভঙ্গী নয়! পুরো উত্তরভারতের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি এমন বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী তো তখন কারোরই ছিল না!

দ্বিতীয় যে কাজটার জন্য হরিশ স্মরণীয় হলেন, সেটা ছিল নীল-চাষীদের পক্ষে লেখা এবং তাদের জন্য আইনী লড়াই। তাঁর এক জীবনীকার দিলীপ মজুমদার লিখছেনঃ

নীলবিদ্রোহে হরিশচন্দ্র যে ভুমিকা পালন করেন তা বিশ্লেষণ করলে নিম্ন উপাদানগুলি পাওয়া যায়

নীলচাষীদের আশ্রয়, উপদেশ ও পরামর্শ দান,

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় নানা সংবাদ প্রকাশ,

নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার জন্য গ্রামবাংলার শিক্ষিত সাংবাদিক বাহিনী গঠন, বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনকে এ বিষয়ে সক্রিয় রাখা,

নিজস্ব রচনাদির মাধ্যমে নীলচাষের স্বরূপ উদ্ঘাটন,

নীল কমিশনে সাক্ষ্যদান,

শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ও মৃত্যুবরণ

আজকালকার ফেসবুকের প্রথা অনুযায়ী ঠিক এই জায়গাটায় আমার লাইক বোতামের শেষ মুখদুটো বসাতে ইচ্ছে করছে, দুঃখরাগ

 

আরেকজনকে দেখা যাক। ইনি দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি। এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী বসুকে তৎকালীন সমাজের কুৎসার হাত থেকে বাঁচাতে বিয়ে করেছিলেন। আজকের উইকিপিডিয়া বলছে, দ্বারকানাথ ১৮৮৬ সালে ভারত সভার পক্ষ থেকে অসম উদ্দেশ্যে রওনা হন। রামকুমারের মতই দ্বারকানাথও সেখানে গিয়ে কুলী সমস্যার সরেজমিনে তদন্ত আরম্ভ করেন। প্রয়োজনে কখনও কুলীর বেশে কখনও বা চা বাগানের আনাচে কানাচে লুকিয়ে দ্বারকানাথ কুলীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন ও তাদের মুখ থেকে তাদের যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। বলা বাহুল্য এই কাজ তাকে বহু বিপদ অতিক্রম করে ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নানা বাঁধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করে করতে হয়। অবশেষে কলকাতায় ফিরে দ্বারকানাথ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি দ্বারা সম্পাদিত The Bengalee পত্রিকায়, Slave Trade in Assam শিরোনামে প্রকাশিত ১৩টি প্রবন্ধে। নিজস্ব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দ্বারকানাথ এতে একাধিক মামলার কথাও প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করেন। এইভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন কিভাবে আইনের বেড়াজালে বহু অত্যাচারী চা-কর উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বেকসুর প্রমাণিত হয় এবং অসহায় কুলীদের ওপর অত্যাচার বজায় রাখে। The Bengalee পত্রিকার পাশাপাশি এই সময়ে দ্বারকানাথ সঞ্জীবনী পত্রিকায় 'আসামে লেগ্রির সন্তান' নামে বাংলায় একটি ধারাবাহিক লিখতেন। এছাড়াও দ্বারকানাথ একপ্রকার নিজস্ব উদ্যোগেই ভারত সভার পক্ষ থেকে এই সময় একাধিক ইশতেহার প্রকাশ করেন। এই ধরণের বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে দ্বারকানাথ অসমে কুলীদের ওপর প্রচলিত অমানবিক অত্যাচার সম্পর্কে কলকাতার সভ্য সমাজকে অবহিত করতে সক্ষম হন এবং সক্ষম হন এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে একটা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে। এই সময়ে দ্বারকানাথ ভারত সভার পক্ষ থেকে বেশ কিছু কুলীদের তাদের চা করদের বিরুদ্ধে মামলা লড়ার জন্য অর্থ সাহায্যও করেন।

 

আর হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথ? তাঁর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা?

শশীপদ বন্দোপাধ্যায়? তাঁর ভারত শ্রমজীবী?

এঁরা বাংলার নবজাগরণের অংশ নন?

এবং আরো একটি নাম। এঁদের আগের। যদিও তাঁর নাম ও কাজ নবজাগরণ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়না, কিন্তু হওয়া উচিৎ। তিনি হলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। দেবত্বের আবরণ বাদ দিলে তাঁর কাজ, বাণী এবং সেই বাণী অনুসারে তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাজ, বাংলায় শিক্ষার প্রসারকে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও নিম্নতম কথিত জাতির মধ্যে পৌঁছোনোয়, যথার্থ প্রেক্ষিতে অবিস্মরণীয়। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় নমঃশূদ্র সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। নবজাগরণী মানবিকতার মর্মকে তো তিনিই ভাষা দিলেন।

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব কাজের মধ্যে নবজাগরণী ব্যাপারটা কোথায়? নবজাগরণে গণকল্যাণ হতেই পারে, হওয়াই উচিৎ, কিন্তু তা হতে হবে নতুন ভাবনার জাগরণে, সৃজনে, উদ্ভাবনে। বিনয় ঘোষ মহাশয়ও তাঁর বিখ্যাত কৃতি বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজএ স্পষ্টভাবে রেখেছেন যে রেনেশাঁর মানবকেন্দ্রিকতা বা এ্যান্থোপোসেন্ট্রিজম মধ্যযুগীন ইশ্বরকেন্দ্রিকতার বিপরীত এক নতুন চেতনা, কিন্তু তা মানবতাবোধ নয়। তাহলে এই দরিদ্রের উপকার, দুঃস্থের সেবা, চাষীর, কুলির, শ্রমিকের, আদিবাসীর, অস্পৃশ্য-কথিত জাতের দুঃখকষ্ট নিয়ে চিন্তা নবজাগরণ হয় কী ভাবে?

হয়। কেননা, বাংলার নবজাগরণে সবচেয়ে সক্রিয় এবং সবচেয়ে সোচ্চার যে শ্রেণী, তার মানবকেন্দ্রিক চিন্তার মানবতাবোধে রূপান্তরণই তো এক নতুন চেতনার উন্মেষ!

যে কালটি নবজাগরণের কাল, সে কালেই গ্রামবাংলার সমাজচিত্র কেমন ছিল তা বোঝাতে বিনয় ঘোষ মহাশয় তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। উদ্ধৃতিটি সংগৃহীত হয়েছে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সংখ্যা ৮৪, চতুর্থ ভাগ, শ্রাবণ ১৭৭২ শকাব্দ থেকে। পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদীগের দুরবস্থা শিরোনামে এই ধারাবাহিক রচনায়, খাজনা আদায়ের জন্য কিছু ভূস্বামী প্রজাদের ওপর কিরকম অত্যাচার করতেন তার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছে যে এই সব প্রজাদের অবস্থা ক্রীতদাসের থেকেও বেশি খারাপ। অনাবৃষ্টি হোক, আকাল হোক, খাজনা দিতে হবেই। না দিলে ওই ভূস্বামীদের বাবুগিরি, বেলেল্লাগিরি চলবে কী করে? লেখক তাঁর রচনায় সেই সব নির্যাতন-কৌশলগুলোও তালিকাবদ্ধ করেছেম, খাজনা না দিতে পারলে প্রজাদের যা পোহাতে বা ভুগতে হত। যেমন, দন্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত, চর্মপাদুকা প্রহার, বংশকাষ্ঠাদির দ্বারা বক্ষস্থল দলন, খাপরা দিয়া কর্ণ ও নাসিকা মর্দন, ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ, পৃষ্ঠিভাগে বাহুদ্বয় নীত রাখিয়া বন্ধন করিয়া বংশদন্ডাদির দ্বারা মোড়া দেওয়া, গাত্রে বিছুটি দেওয়া, হস্তদ্বয় ও পাদদ্বয় নিগড়বদ্ধ করিয়া রাখা, কর্ণধারণ করিয়া ধাবন করানো, দুইখান বাখারির একদিক বাঁধিয়া তাহার মধ্যে হস্ত রাখিয়া মর্দন করা (যন্ত্রটির নাম কাটা), গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রৌদ্রে পাদদ্বয় অতি বিমুক্ত রাখিয়া ইষ্টকোপরি ইষ্টক হস্তে দন্ডায়মান করিয়া রাখা, অত্যন্ত শীতের সময় জলমগ্ন করা ও গাত্রে জল নিক্ষেপ করা, গোণীবদ্ধ [শব্দটা বুঝলাম না] করিয়া জলমগ্ন করা, ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধান্যের গোলায় পুরিয়া রাখা (যখন ভিতরটা সবচেয়ে গরম আর ভাপালো হয়), চুনের ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখা, কারারুদ্ধ করিয়া উপবাসি রাখা, অথবা ধান্যের সহিত তন্ডুল মিলিত করিয়া আহার করিতে দেওয়া, গৃহ মধ্যে রুদ্ধ করিয়া লঙ্কা মরীচের ধূম প্রদান করা।

আহা, কী শৈল্পিক বৈচিত্র! সবই মানুষের ওপর অত্যাচারার্থে। কেন? কলকাতার বাবুসমাজের জাঁকজমক বাড়াতে, ইংরেজ বড়সাহেবদের চোখে সম্মাননীয় থাকতে। এই ধরণের শ্রেণী-পরিস্থিতিতে নবজাগরণী চিন্তাচেতনা, কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। গ্রাম থেকে শহরের দিকে যাওয়া অর্থপ্রবাহে তৈরি হচ্ছিল শহরকেন্দ্রিক চেতনার উৎসব। বিপরীতে শহর থেকে গ্রামের দিকে যাওয়ার এক মানবদরদী চিন্তাধারা যদি ওই বাবুসমাজের (এবং তার আনাচেকানাচের নিম্নবিত্ত শহুরে চাকরিজীবী সমাজের) একাংশকে প্রভাবিত করে থাকে তা কি ওই নবজাগরণেরই অংশ নয়? যদি না হয়, তাহলে শতাব্দীর শেষে যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হল তার মধ্যে এই নবজাগরণের ধারাবাহিকতা কী ভাবে দেখব?

 

কর্মাটাঁড়ের ইশ্বর-দেওতার কাজকর্মগুলো একেবারে নতুন ছিল না। আনুমানিক ১৮৭৩-৭৪ থেকে তিনি কর্মাটাঁড়ে আসাযাওয়া এবং অনেকদিন করে থাকা, স্থানীয় লোকজনের সাথে বন্ধুত্ব এবং শিক্ষা, চিকিৎসা, সাহায্য এবং কিছু উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করেন। ইংরেজ সরকারের সাথে মতান্তর ও মনান্তরের ফলে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরেও নিজের উদ্যোগে রবং বন্ধুজনের সাহায্য নিয়ে বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয় ইত্যাদি খোলার কাজ তাঁর অব্যাহত ছিল। এমনকি তাঁর হাতে তৈরি কলেজ, মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশনও এই সময়েই স্থাপিত হয়েছিল। কর্মাটাঁড়ে স্থানীয় আদিবাসী ও অন্যান্য পরিবারের সন্তানদের নিয়ে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলার মধ্যে নতুন কৃতিত্বের দিকটা ছিল, সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং ন্যায্য কারণে শহুরে-বাঙালী বিদ্বেষী আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা। এত দূর গেল সে বিশ্বাসযোগ্যতা যে তিনি তাদের কাছে দেবতা হয়ে উঠলেন। তবে বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কজন ছিল, শিক্ষকই বা, তাঁকে ছাড়া আর কেউ ছিল কিনা, জানা যায়নি এখনো। তবে, কথাটা যখন বালিকা বিদ্যালয় হিসেবেই আসছে, পাঠশালা হিসেবে নয়, তখন আশা করা যায় যে ঠিক মত গবেষণা হলে জানা যাবে যে তিনি ছাড়াও অমুক অমুক স্থানীয় শিক্ষিত মানুষ তাঁকে শিক্ষকতার কাজে সাহায্য করতেন, এবং এত সংখ্যক ছাত্রী ছিল বিদ্যালয়ে। বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন যে খুব কঠিন হয়নি একবার তাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠার পর, সেটা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় লিখিত স্মৃতিচারণে সাঁওতালদের সাথে বিদ্যাসাগরের সহজ মেলামেশার ছবি দেখেই বোঝা যায়। পরবর্তী কালে, যখন বিহার বাঙালি সমিতি নন্দন কানন কিনে নিল, সমিতিও ঐতিহ্য বহাল রাখতে বালিকা বিদ্যালয় শুরু করল। ২০০৩ সালের টেলিগ্রাফ খবরের কাগজের পাতায় দেখা যায় যে সে সময় (অর্থাৎ ২০০৩ সালে) ওই বালিকা বিদ্যালয়ে ৩০০র মত ছাত্রী এবং আটজন শিক্ষক/শিক্ষিকা ছিলেন।

নতুন কাজ ছিল, প্রৌঢ় শিক্ষার ব্যবস্থা। বিদ্যাসাগর যেমন ভারতে প্রথম টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের ব্যবস্থা (নর্মাল স্কুল) করেছিলেন, তেমনই প্রৌঢ় শিক্ষাও আরম্ভ করেছিলেন, এবং সেটা এই কর্মাটাঁড়ে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিদ্যাসাগরের এই অবদান স্মরণে রেখে একশো বছর পর, ১৯৭৯-৮০ সালে বিহার সরকার যখন প্রৌঢ় শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করার কথা ভাবল, সেই প্রৌঢ় শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন হল কর্মাটাঁড়ে, নন্দনকাননের প্রাঙ্গণেই। মুখ্যমন্ত্রী এলেন, হোমরাচোমরারা এলেন।... নন্দন কানন থেকে তখন গোটা এলাকায় একশোটারও বেশী প্রৌঢ় শিক্ষা কেন্দ্র সঞ্চালিত হত।

তৃতীয় কাজ, চিকিৎসা। এটাও নতুন ছিল না। আকালের পর বর্ধমান জেলায় গিয়ে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছিলেন। ঘরে ঘরে গিয়ে ওষুধপত্র দেওয়া। পথ্যাদির ব্যবস্থা করা এবং শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে নিজের হাতে সেবাশুশ্রুষা করা ... এসবই আগে করার অভিজ্ঞতা, বরং যুদ্ধস্তরে করার অভিজ্ঞতা ছিল। কাজেই, কর্মাটাঁড় এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে সেবাশুশ্রুষা করা, ওষুধপত্র ও পথ্যের ব্যবস্থা করা, নন্দনকাননে দাতব্য চিকিৎসালয় চালানো, তাঁর জন্য নতুন ছিল না। তাঁর আগেও ওই এলাকায় কেউ দাতব্য চিকিৎসালয় চালাতো কি না তার খোঁজ খবর নেই। তাঁর একটি ডাইরি ছিল, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার। বোধহয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে আছে। তার দুটি পৃষ্ঠা ইন্দ্র মিত্র লিখিত করূণাসাগর বিদ্যাসাগর বইটিতে উদ্ধৃত রয়েছে। তা থেকে কর্মাটাঁড়ের দিনগুলো সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। তবে তাঁর রোগনির্ণয়ে ও চিকিৎসায় তাঁর অধ্যাবসায়ের দিকটা বোঝা যায়। তাঁর সে কাজের স্মৃতিরক্ষার্থে আজও নন্দন কাননে দাতব্য চিকিৎসালয় চলে। চালায় নন্দন কাননএর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি

চতুর্থ কাজ ছিল, চাষীদের চাষের কাজে সাহায্য করা। যেহেতু তাঁর নিয়মিত কলকাতায় এবং বর্ধমানে যাওয়া আসা ছিল, তিনি, যাঁরা তাঁর সম্পর্কে ছিল সে চাষীদের জন্য উন্নত মানের বীজ কিনে আনতেন এবং তাদের সরবরাহ করতেন। এ সংক্রান্ত উল্লেখ পাওয়া গেছে মাত্র, বিশদ কিছু এখনও জানা যায় নি।

পঞ্চমে ও শেষে তাঁর দিনযাপন। কোনো কাজ নয়। কিন্তু উল্লেখ্য এই জন্য যে শহুরে শিক্ষিত সমাজের ব্যক্তির, তাও আবার শিক্ষিত, বিদ্বান, মনস্বীর দিনিযাপন থেকে সেটা ছিল ভিন্ন। তিনি নির্জনতাকামী ছিলেন না। এমনও নয় যে হাতে কোনো কাজ নেই। সকাল থেকে নিজের লেখার প্রুফ দেখছেন, লেখা আবার থেকে লিখছেন অথচ তারই মাঝে ক্রমাগত সাঁওতাল চাষীদের আসাযাওয়া। যেমন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, চাষীরা আসছে, ও বিদ্যেসাগর, একটাও বিক্রি হয়নি, তুই রাখ, কিছু পয়সা দে! বিদতাসাগর ওদেরকেই বলছেন ঝুড়ি থেকে সব ভুট্টা নামিয়ে ঘরের তাকে রেখে দিতে আর পয়সা দিয়ে দিচ্ছেন। আবার সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের দল আসছে, ও বিদ্যেসাগর, খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দে! বিদ্যাসাগর সেই ভুট্টা অথবা ঘরে যা কিছু খাবার আছে ওদেরকে খেতে দিচ্ছেন।... এক্কেবারে নিখাদ সমাজকর্মীর জীবন। যত দান, পাত্রে এবং অপাত্রে তিনি করেছেন সে তুলনায় কয়েক ঝুড়ি ভুট্টার দাম, পকেটে পয়সা থাকলে এধরণের সমাজকর্ম হয় টাইপের তাচ্ছিল্যকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। একটু ক্ষতির হিসেবেও এটা জনজীবনকে ভালোবাসার পাটিগণিত।

এটা জানা যায় না যে কর্মাটাঁড়ের সাঁওতালিঘেঁষা বাংলা শুনে তাঁর ভাষাচিন্তা প্রভাবিত হয়েছিল কিনা, তবে এটা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য যে বর্ণপরিচয়এর শেষ সংস্করণ কিন্তু তিনি কর্মাটাঁড়ের নন্দন কাননে বসেই তৈরি করেছিলেন। প্রকাশস্থান হিসেবে খুব সহজেই কলকাতা উল্লেখ করতে পারতেন, কিন্তু করেন নি। কর্মাটাঁড় উল্লেখ করেছিলেন।

 

বিদ্যার সাগর তো তিনি ছিলেনই। দয়া ও করূণার সাগরও তিনিই ছিলেন। ব্রাত্যজনের বা জনগণের বিদ্যাসাগরকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা প্রাণের সাগরএরও দেখা পাই। শব্দজোটটা ব্যবহার করতে দেখলাম তড়িত কুমার বন্দোপাধ্যায়কে। যিনি বিদ্য্যাসাগরের বিজ্ঞানমানস শিরোনামে একটি ছোট্টো প্রবন্ধসংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, ভূমিকা লিখেছিলেন বিমান বসু। সত্যি প্রাণের সাগর। প্রত্যেকটি কাজের ক্ষেত্রে কত উন্নত, মানবদরদী চিন্তা ছিল তাঁর।               

তড়িতবাবু চিকিৎসক বিদ্যাসাগর শিরোনামে তাঁর প্রবন্ধে লিখছেন,

তাঁর চিকিৎসা অভিযানের এক দুর্দমনীয় অভিজ্ঞতার চিত্র পাব যদি আমরা একটু পিছিয়ে সেই মন্বন্তরের (১৮৬৬) ফিরে যাই। সময় ১৮৬৮ সাল। দুর্ভিক্ষের পরই বর্ধমানে ম্যালেরিয়া জ্বর সংহারমূর্তিতে হাজির হল ... রোগে ত্রাহি ত্রাহি রব্ব ... চিকিৎসার লোক নেই ... ঘরে ঘরে কান্নার রোল ... গ্রামে গ্রামে দিবারাত্র শ্মশান জ্বলছে ...কে কার কল্যাণে এগিয়ে আসবে? হিন্দু প্যাট্রিয়ট তার কম্বুকন্ঠে এ সংবাদ পরিবেশন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে ... কিন্তু ব্যাপক ব্যবস্থা কই! সেই শ্মশানক্ষেত্রেই হাজির হলেন বিদ্যাসাগর। রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডিস্পেন্সারি স্থাপন করলেন। ওষুধ ও পথ্যের ব্যবস্থা করলেন। তিনি কলকাতায় ফিরে সেই ম্যালেরিয়ার বীভৎস রূপ তৎকালীন ছোটলাট গ্রে-সাহেবের কর্ণগোচর করলেন। অতঃপর ব্যবস্থা হল অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য স্থানে স্থানে ডিস্পেন্সারি খোলা; জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পীড়িত ব্যক্তিকেই ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করলেন বিদ্যাসাগর। এই সময়ের একটি মহতী মানবসেবার বিবরণে আমরা বিহারীলালকেই অনুসরণ করবঃএই সময় প্যারিচাঁদবাবুর ভ্রাতুস্পুত্র ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ মিত্র মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেক সাহায্য করিতেন। তাঁহার উপর ডিস্পেন্সারির সম্পূর্ণ ভার ছিল। কুইনাইন বড় মূল্যবান, অথচ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছিল। এই জন্য গঙ্গানারায়ণবাবু পরামর্শ দেন যে, কুইনাইনের পরিবর্তে সিঙ্কোনা ব্যবহার করা হউক।

বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন গরীবের রোগ বলিয়া প্রকৃত ঔষধ ব্যবহার করিবে না; এও কি কখনো হয়? দুঃখী ধনী সবার প্রাণ তো একই, পরন্তু রোগও এক।....

 




 

 

No comments:

Post a Comment