ওরা বলেছিলো –
“অত্যাচারী ব্রিটিশ ! ভারত
ছাড়ো !”
ওরা ভেবেছিলো এভাবেই
শ্রাবণের পুকুরে তাদের গ্রামগুলোর বিম্ব
বধুর লজ্জারুণ গোড়ালির মতো নামবে ।
মকাইয়ের ক্ষেতের ভিতরে
গানের বোলে, শিশুদের মুখে
ফিরে আসবে মন্বন্তরে মৃত স্বজনেরা ।
স্কুলের মাস্টারমশাই
চশমা খুলে, চোখের জল মুছে,
ওদের কাঁধে হাত রেখে বলবেন –
“কতোজনে কত কিছু দেয়,
তোরা স্বাধীন ভারতবর্ষ দিলি, পৃথিবীকে,
আমাকে !”
ওরা ভেবেছিলো এভাবেই
রাস্তায়, ট্রেনে যে কোনো মানুষের চেহারায়
যে কোনো মুহুর্ত্তে
কয়েক হাজার বছরের আলোছায়া খেলে যাবে।
যে ফসল আর রেলের চাকা ঘোরায়
সে, দেশের চাকা হাতে নেবে।
হয়তো ওরা এসব কিছুই ভাবেনি,
শুধু আলোড়িত এক স্বপ্নের ঘোরে
যৌবনের অদম্য সাহসে এগিয়ে গিয়েছিলো ।
কিন্তু ওদের যাওয়া
সেই বিশিষ্ট স্থান আর কালে
এই সমস্ত কথাকে ধারণ করেছিলো।
ভগৎ সিং’এর অনেক পরে ওরা যুবক হয়েছিলো ।
কিষাণ সভা গড়ে ওঠার পরে ওরা কৃষকের ঘরে বড়ো হয়েছিলো ।
ব্রিটিশ গুলি চালালো ।
ওরা এক এক করে
আমাদের রক্তে লীন হয়ে গেল । ...
আমরা তা ভুলে যাই ।
তখন শিল্পীর কাজ শুরু হয় ।
তিনি রঞ্জন রশ্মি ফেলেন আমাদের ওপর ।
আর তখন চোখের সামনে হাওয়ায়
ফুটে ওঠে
আমাদের রক্তের অন্তর্ছবি –
সাতটি শরীরের ব্রোঞ্জ ।
হয়তো তিনিও
বেশী কিছু ভাবেন না ।
শুধু অতীতকে গাইবার জন্য কাজ করেন ।
কিন্তু তাঁর ওই কাজ করা,
ওই বিশিষ্ট স্থান আর কালে
আমাদের অন্য কিছু মনে করায় ।
আমরা দেখি
শ্রাবণের পুকুরে গ্রামগুলোর বিশ্ব –
কোথায় ?
নেই ! উজাড় হতে চলেছে ।
মন্বন্তর
রাজধানীর রাস্তায়
রোজ গাড়িতে বসে
অর্থমন্ত্রক, চেম্বার অফ কমার্স, বিধায়কদের
ফ্ল্যাটে আর পাঁচতারা হোটেলগুলোর কামরায়
আসা যাওয়া করছে ।
গানগুলো মালিকের হৃদয় পরিবর্ত্তন করতে করতে
চরিত্রহীন হয়ে গেল ।
মাস্টারমশাই অনশনে বসে আছেন একত্রিশ বছর ধরে –
স্ত্রী মারা গেলেন গর্ভাশয়ে ক্যান্সারে,
মেয়ে কার্বোলিক খেয়ে চলে গেল –
চশমার ফাটা কাঁচে থরের ধুলো উড়ছে ।
তেরঙা থেকে ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ির নিচে
বিমান থেকে ঝরে পড়া তেরঙা আবীরের নিচে
চকচক করছে
ফসল আর রেলের চাকা ঘোরানো মানুষটির
রক্তলাগা বেয়নেট, রাইফেলের কালো নল ।
আমন্ত্রিত জনসমুদ্রের মাঝ দিয়ে
স্বাধীনতা
একটি রহস্যময় ধূসর অবতারের মতো চলেছে
আর তার পেছনে
ভাড়া খেটে নাচতে নাচতে চলেছে
ভারতীয় সংস্কৃতি ।
হয়তো ওরা
যারা নাচছে, যারা মার্চ করছে, যারা ‘দেশের গৌরব’
উপাধি পাচ্ছে,
ওরা এসব কিছুই জানেনা, ওরা
বস্ততঃ স্বাধীনতার গর্বে ও আনন্দেই এসব করছে,
কিন্তু ওদের এই সমস্ত কিছু করা,
এই বিশিষ্ট স্থান আর কালে,
মুর্খ ভাঁড়ামোর চেয়ে বেশী কিছু নয় ।
আমরা বলিনা আর – “ব্রিটিশ ! ভারত ছাড়ো !”
আমরা বলি –
“মৃত পুঁজিবাদ ! পৃথিবী ছাড়ো !
ভারত ছাড়ো !
যে সরকার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না,
যে সরকার স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয় পিছনের দরজা দিয়ে
যে অর্থনীতি গোলাম করে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববাজারের,
সে সরকার, সে অর্থনীতি, নিপাত যাক !”
কিন্তু একথাগুলি বলার জন্য
কিভাবে দাঁড়াতে হবে, তা শিখতে
ওই সাতটি ব্রোঞ্জের কাছে গিয়ে দাঁড়াই ।
শীতের রাতে, মিছিল ফেরতা
ওই ব্রোঞ্জের আঙুল বেয়ে ঝরা তড়িৎ বিন্দুর মতো শিশিরে
করতল ভিজিয়ে নিই।
স্বপ্নে যদি ভুলও থাকে,
তাতে স্বপ্নের জন্য প্রাণ দেওয়া সহজ হয়না একটুও ।
ইউনিয়ন জ্যাকের বিরুদ্ধে যারা
তেরঙাকে তুলে ধরেছিলো
তাদের থেকে আমরা শিখে নিই
পৃথিবীর সব রঙের মিথ্যা ব্যবহারের বিরুদ্ধে লাল
পৃথিবীর সব রঙের মুক্তির জন্য লাল
কিভাবে তুলে ধরতে হবে ।
যদি মৃত্যু কালো ঝড়ের মতো ঘিরে নেয়
কিভাবে শিশুদের রক্তে মিশে যেতে হবে ।
ওরা ভেবেছিলো এভাবেই
শ্রাবণের পুকুরে তাদের গ্রামগুলোর বিম্ব
বধুর লজ্জারুণ গোড়ালির মতো নামবে ।
মকাইয়ের ক্ষেতের ভিতরে
গানের বোলে, শিশুদের মুখে
ফিরে আসবে মন্বন্তরে মৃত স্বজনেরা ।
স্কুলের মাস্টারমশাই
চশমা খুলে, চোখের জল মুছে,
ওদের কাঁধে হাত রেখে বলবেন –
“কতোজনে কত কিছু দেয়,
তোরা স্বাধীন ভারতবর্ষ দিলি, পৃথিবীকে,
আমাকে !”
ওরা ভেবেছিলো এভাবেই
রাস্তায়, ট্রেনে যে কোনো মানুষের চেহারায়
যে কোনো মুহুর্ত্তে
কয়েক হাজার বছরের আলোছায়া খেলে যাবে।
যে ফসল আর রেলের চাকা ঘোরায়
সে, দেশের চাকা হাতে নেবে।
হয়তো ওরা এসব কিছুই ভাবেনি,
শুধু আলোড়িত এক স্বপ্নের ঘোরে
যৌবনের অদম্য সাহসে এগিয়ে গিয়েছিলো ।
কিন্তু ওদের যাওয়া
সেই বিশিষ্ট স্থান আর কালে
এই সমস্ত কথাকে ধারণ করেছিলো।
ভগৎ সিং’এর অনেক পরে ওরা যুবক হয়েছিলো ।
কিষাণ সভা গড়ে ওঠার পরে ওরা কৃষকের ঘরে বড়ো হয়েছিলো ।
ব্রিটিশ গুলি চালালো ।
ওরা এক এক করে
আমাদের রক্তে লীন হয়ে গেল । ...
আমরা তা ভুলে যাই ।
তখন শিল্পীর কাজ শুরু হয় ।
তিনি রঞ্জন রশ্মি ফেলেন আমাদের ওপর ।
আর তখন চোখের সামনে হাওয়ায়
ফুটে ওঠে
আমাদের রক্তের অন্তর্ছবি –
সাতটি শরীরের ব্রোঞ্জ ।
হয়তো তিনিও
বেশী কিছু ভাবেন না ।
শুধু অতীতকে গাইবার জন্য কাজ করেন ।
কিন্তু তাঁর ওই কাজ করা,
ওই বিশিষ্ট স্থান আর কালে
আমাদের অন্য কিছু মনে করায় ।
আমরা দেখি
শ্রাবণের পুকুরে গ্রামগুলোর বিশ্ব –
কোথায় ?
নেই ! উজাড় হতে চলেছে ।
মন্বন্তর
রাজধানীর রাস্তায়
রোজ গাড়িতে বসে
অর্থমন্ত্রক, চেম্বার অফ কমার্স, বিধায়কদের
ফ্ল্যাটে আর পাঁচতারা হোটেলগুলোর কামরায়
আসা যাওয়া করছে ।
গানগুলো মালিকের হৃদয় পরিবর্ত্তন করতে করতে
চরিত্রহীন হয়ে গেল ।
মাস্টারমশাই অনশনে বসে আছেন একত্রিশ বছর ধরে –
স্ত্রী মারা গেলেন গর্ভাশয়ে ক্যান্সারে,
মেয়ে কার্বোলিক খেয়ে চলে গেল –
চশমার ফাটা কাঁচে থরের ধুলো উড়ছে ।
তেরঙা থেকে ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ির নিচে
বিমান থেকে ঝরে পড়া তেরঙা আবীরের নিচে
চকচক করছে
ফসল আর রেলের চাকা ঘোরানো মানুষটির
রক্তলাগা বেয়নেট, রাইফেলের কালো নল ।
আমন্ত্রিত জনসমুদ্রের মাঝ দিয়ে
স্বাধীনতা
একটি রহস্যময় ধূসর অবতারের মতো চলেছে
আর তার পেছনে
ভাড়া খেটে নাচতে নাচতে চলেছে
ভারতীয় সংস্কৃতি ।
হয়তো ওরা
যারা নাচছে, যারা মার্চ করছে, যারা ‘দেশের গৌরব’
উপাধি পাচ্ছে,
ওরা এসব কিছুই জানেনা, ওরা
বস্ততঃ স্বাধীনতার গর্বে ও আনন্দেই এসব করছে,
কিন্তু ওদের এই সমস্ত কিছু করা,
এই বিশিষ্ট স্থান আর কালে,
মুর্খ ভাঁড়ামোর চেয়ে বেশী কিছু নয় ।
আমরা বলিনা আর – “ব্রিটিশ ! ভারত ছাড়ো !”
আমরা বলি –
“মৃত পুঁজিবাদ ! পৃথিবী ছাড়ো !
ভারত ছাড়ো !
যে সরকার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না,
যে সরকার স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয় পিছনের দরজা দিয়ে
যে অর্থনীতি গোলাম করে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববাজারের,
সে সরকার, সে অর্থনীতি, নিপাত যাক !”
কিন্তু একথাগুলি বলার জন্য
কিভাবে দাঁড়াতে হবে, তা শিখতে
ওই সাতটি ব্রোঞ্জের কাছে গিয়ে দাঁড়াই ।
শীতের রাতে, মিছিল ফেরতা
ওই ব্রোঞ্জের আঙুল বেয়ে ঝরা তড়িৎ বিন্দুর মতো শিশিরে
করতল ভিজিয়ে নিই।
স্বপ্নে যদি ভুলও থাকে,
তাতে স্বপ্নের জন্য প্রাণ দেওয়া সহজ হয়না একটুও ।
ইউনিয়ন জ্যাকের বিরুদ্ধে যারা
তেরঙাকে তুলে ধরেছিলো
তাদের থেকে আমরা শিখে নিই
পৃথিবীর সব রঙের মিথ্যা ব্যবহারের বিরুদ্ধে লাল
পৃথিবীর সব রঙের মুক্তির জন্য লাল
কিভাবে তুলে ধরতে হবে ।
যদি মৃত্যু কালো ঝড়ের মতো ঘিরে নেয়
কিভাবে শিশুদের রক্তে মিশে যেতে হবে ।
[বোধহয় ১৯৭৬-৭৭এ লেখা; ১৯৮৪তে প্রকাশিত আজকের দিনটার জন্য সঙ্কলন থেকে নেওয়া]
No comments:
Post a Comment