প্রকৃত শিক্ষা কী, কেন সেই শিক্ষা এবং কিভাবে সে শিক্ষা দেওয়া যাবে এসব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা নিয়ে অনেক লেখা আছে। সে সমস্ত লেখা আমি পড়িনি। কাজেই অক্ষম পুনরুক্তির ব্যাপারটা থেকেই যায়। তবু লিখছি কেননা পড়তে পড়তে, দাগ দিয়ে রাখতে রাখতে অনেক সময় মনে হয়েছে ‘বাঃ, এই কথাটা তো দারূণ! এভাবেও উনি ভাবতেন!’
আর কবি শিক্ষা নিয়ে তো শুধু ভাবনাচিন্তা করেন নি, হাতেকলমে ভারতের
শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তনে একটি নতুন যুগ গড়েছেন প্রথমে পিতার হাতে স্থাপিত শান্তিনিকেতন
ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রসার ঘটিয়ে ও পরে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করে। এরই সাথে শ্রীনিকেতনের
কথাটাও ধরে রাখতে হবে। সে সময় আরো অনেকে হয়তো এ দেশে এধরণের কাজগুলো করছিলেন নিজের
মত করে। হয়তো এত বড় মাপে নয়। হয়তো এত দিকে একসাথে নয়। সারা বিশ্বে
শিক্ষাবিজ্ঞানীরা পূঁজিবাদ-সৃষ্ট সঙ্কটের একটা সমাধান খুঁজছিলেন। একদিকে তাঁরা
বুঝছিলেন যে যুগের সাথে তাল মেলানোর শিক্ষা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছোনো জরুরী।
কিন্তু সেটা করতে গিয়ে শিক্ষা হয়ে পড়ছে মূল্যহীন, যান্ত্রিক – রোজগার ছাড়া কোনো
কাজের নয়। অন্যদিকে মূল্যভিত্তিক শিক্ষা দিতে গেলে যে উন্মুক্ত পরিবেশ, যে মানবিক স্পর্শ
দরকার ছাত্রের প্রাত্যহিকে, তা দিতে গেলে শিক্ষা আর যে কোনো কাজেই লাগুক, রোজগারের কাজে
লাগছে না। (কেননা বিশ শতকের শুরু থেকেই প্রযুক্তির উন্নতি এবং উৎপাদনে তার ব্যবহার
কায়িক শ্রমকেও করে তুলছে শিক্ষাভিত্তিক। যেটা বাড়তে বাড়তে আজ হয়েছে সোজাসুজি প্রযুক্তিগত
শ্রম। নলেজ-ক্যাপিটাল বা জ্ঞানগত পূঁজি কথাটা চাউর হয়েছে বটে, তবে কথাটা
জ্ঞানগত-শ্রম বা নলেজ-লেবার বলাই যুক্তিযুক্ত।) আবার সময়টাও সীমিত – মোটামুটি দশ এবং
আরো পাঁচ নিয়ে পনেরো বছর। এর মধ্যে ছাত্র ভাষা শিখবে, প্রাথমিক প্রকৃতিবিজ্ঞান ও
সমাজবিজ্ঞান শিখবে, অঙ্ক শিখবে... আবার খেলাধুলোও শিখবে, ঈষৎ শিল্পচর্চা শিখবে, নীতিচর্চা শিখবে, একদিকে নিসর্গ ও
অন্যদিকে মানুষের সৃজনীকল্পনার দুনিয়াটা মাঝে মধ্যে বিচরণ করে চিনবে...! কী করে
মেলানো যায় এত কিছু? তাও আবার ব্যবস্থাটা হতে হবে সীমিত খরচে, যাতে সব শিশুকে সেই
শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় আনা যায়।
তাঁবেদার না ‘মনুষ্যত্বে অধিকার’
রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জটা আরেকটু বেশি ছিল। তাঁর দেশে
ঐতিহ্য ব্যাপারটা যে বড্ড ভারী – কাঁধ ছিঁড়ে যায় বইতে গেলে অথচ কেটে ছেঁটে
কিছুটা বইবার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। ওখানেই আছে নীতিশিক্ষা, সৃজনীকল্পনা, শিল্প ও কারূশিল্প
চর্চা এবং ভাষা (তাও আবার একটি শিক্ষার মাধ্যম ছাড়াও আরো দুটো, যেভাবেই ভাবুন)।
তাঁর দেশে আধুনিকতা ব্যাপারটাও সে সময় গোলমেলে – শুধু যান্ত্রিকই
নয়, মূল্যহীনই শুধু নয়, ইংরেজদের
তাঁবেদার-গোলাম হয়ে থাকার বিপদটা থেকে যায়।
এই রকম পরিস্থিতিতে কবিকে ভাবতে হয়েছিল, “আমরা বিদ্যালয়ের
সাহায্যে এ দেশে তাঁবেদারির চিরস্থায়ী ভিত্তি পত্তন করিতে কিছুতেই রাজি হইতে পারি
না”। ইয়োরোপের যে একটি
মাত্র মানুষকে তিনি সাধক ও গুরুর আসনে বসাতে রাজি ছিলেন সেই টলস্টয়ের একটি উদ্ধৃতি
তিনি নিজের লেখায় নিচ্ছেন। তাতে রয়েছে, “The strength of the
Government lies in the people’s ignorance, and the Government knows this… it is most
undesirable to let the Government, while it is spreading darkness, pretend to
be busy with the enlightenment of the people. It is doing this now by means of
all sorts of pseudo educational establishment which it controls, schools, high
schools, universities, academies, and all kinds of committees and congresses.” আজ এই বক্তব্য
কতটা প্রযুক্ত হতে পারে, বা এর সাথে বেসরকারী সংস্থাগুলো যোগ করলে তবেই
প্রযুক্ত হতে পারে এসব নিয়ে বিশদে যাওয়া বিষয়ান্তর হবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সময়ে
তো ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার এটাই সত্য পরিচয় ছিল। কাজেই তিনি ভাবতে বাধ্য ছিলেন
যে, “দেশের লোককে
শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ নিজে না করি, তবে আমরা
সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব – অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব্ – ইহা নিশ্চয়”। তাঁর চার পাশে
ঠিক এখনকার মতই মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত কূপমন্ডুকেরা ছিল যারা শাসনের গোলামিতেই
তোফা আরামে থেকে মাঝে মধ্যে ভবিষ্যৎবাণী করে ‘এদেশের কিস্যু
হবেনা। ইন্ডিয়াকো ভগবান ভী সুধার নহী সকতা ইয়ার!’ এদের প্রতি ঘৃণায়
কবি বলতেন,
“সমস্ত উন্নত সমাজই
সমাজস্থ লোকের নিকট প্রাণের দাবী করিয়া থাকে, আপনাকে নিকৃষ্ট বলিয়া স্বীকার
করিয়া আরামে জড়ত্বসুখভোগে যে সমাজ আপনার অধিকাংশ লোককে প্রশ্রয় দিয়া থাকে সে সমাজ
মরে, এবং না’ও যদি মরে তবে
তাহার মরাই ভালো”। এহেন পরিস্থিতিতে কবি নিজের সৃষ্ট শিক্ষাপ্রণালীতে
এবং ব্যবস্থায় “মনুষ্যত্বের
অধিকারের যোগ্য” মানুষ তৈরির
উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
ভেদের অকল্যাণ থেকে মুক্তি
এই ‘মনুষ্যত্বের অধিকারের
যোগ্য’ মানুষ প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের আরো কিছু কথা অনুধাবনীয়। ইংরেজ যেমন তাঁবেদার তৈরি করার কারখানা
চালাচ্ছিল সনাতন ভারতীয় সমাজও কিন্তু ‘মনুষ্যত্বের অধিকারের যোগ্য’ মানুষ তৈরি করার
অবস্থায় ছিল না। অবশ্যই তখনকার বিশ্বের সেই রকম মানুষের কথা তাঁর জানা ছিল যারা
শুধু ব্যক্তিগত স্তরে অন্যায়ের প্রতিবাদে সীমিত থাকেনি (তিনিও থাকেন নি), প্রয়োজনে সংগঠিত
প্রতিবাদ এমনকি রাষ্ট্রবিপ্লব পর্য্যন্ত সংঘটিত করতে, তার প্রয়াস করতে সচেতন ও
সক্রিয়। আর সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের দেশের জাতিপ্রথা প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের দেশে
বৃত্তিভেদকে ধর্মশাসনের অন্তর্গত করে দেওয়াতে এরকম অসন্তোষ ও বিপ্লবচেষ্টার গোড়া
নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে”। ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্বে ক্ষয় দেখাতে গিয়ে শ্লেষের
স্বরে তিনি বলেন, “আজ ভারতে বিশুদ্ধ ভাবে স্বধর্মে টিঁকে আছে শুধু
শূদ্রেরা। শূদ্রত্বে তাদের অসন্তোষ নেই। এই জন্যেই ভারতবর্ষের-নিমকে-জীর্ণ দেশে-ফেরা
ইংরেজ-গৃহিণীর মুখে অনেকবার শুনেছি, স্বদেশে এসে ভারতবর্ষের চাকরের অভাব তারা বড়ো বেশি
অনুভব করে। ধর্মশাসনে পুরুষানুক্রমে যাদের চাকর বানিয়েছে তাদের মত চাকর পৃথিবীতে
কোথায় পাওয়া যাবে। লাথিঝাঁটা-বর্ষণের মধ্যেও তারা স্বধর্ম রক্ষা করতে কুন্ঠিত হয়না।
তারা তো কোনোকালে সম্মানের দাবী করেনি, পায়ও নি, তারা কেবল শূদ্রধর্ম অত্যন্ত
বিশুদ্ধভাবে রক্ষা করেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করেছে। আজ যদি তারা বিদেশী শিক্ষায়
মাঝে মাঝে আত্মবিস্মৃত হয় তবে সমাজপতি তাদের স্পর্ধা সম্বন্ধে আক্রোশ প্রকাশ করে”। ওই সমাজপতিদের
প্রসঙ্গে অন্যত্র বিদ্রুপ করেন, “অসবর্ণ বিবাহের আইনগত বিঘ্ন দূর করবার প্রস্তাব
হবা মাত্র হিন্দুসমাজপতি উন্বেগে ঘর্মাক্ত কলেবর হয়ে হড়তাল করবার ভয় দেখিয়েছিলেন”।
এবং সবশেষে অনুভব করেন, “ভেদের দুঃখ থেকে ভেদের অকল্যাণ
থেকে মুক্তিই হচ্ছে মুক্তি”।
কী করে মিটবে এই ভেদের অকল্যাণ? সনাতন ভারতের অনেককিছু গ্রহণীয়, কিন্তু এই ভেদ নয়।
তিনি দেখেন,
“স্মৃতিশাস্ত্রে
শূদ্রের প্রতি অধর্মাচরণ করবার অব্যাহত অধিকার”। অথচ পাশবিক
ইংরেজ- শাসন যেহেতু তার ঔপনিবেশিক শোষণের প্রয়োজনেই স্থাপন করছে এমন আইনের শাসন
(পেশাগত বিশেষীকরণ ও সমুদায়গত দুর্বৃত্ত-চিহ্নীকরণ বাদ দিয়ে) যার মূলসুত্রটি হল
(অবশ্যই ভারতীয় প্রজাদের ক্ষেত্রে), “ব্যক্তিভেদে অপরাধের ভেদ ঘটে
না। ব্রাহ্মণই শূদ্রকে বধ করুক বা শূদ্রই ব্রাহ্মুণকে বধ করুক, হত্যা”।
দেশকে চেনা
এ তো গেল মানুষ গড়ার প্রথম স্তরের টানাপোড়েন - প্রাথমিক স্তরে
বিদ্যালয়ী শিক্ষার ভাবধারাগতদিক। তারপর মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয়ের স্তর। প্রতিটি
স্তরের সমস্যাবলী নিয়ে কবি ভাবনাচিন্তা করেছেন, তাঁর সমসাময়িক ভাবনাচিন্তা ও
সরকারী বিভাগীয় কাজকর্মের পর্যালোচনা করেছেন।
ছাত্র-ছাত্রীরা মহাবিদ্যালয়ের বা কলেজের পরীক্ষা দিয়ে ছুটি পেল।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বলে? রুশি লেখক ম্যাক্সিম গোর্কীর বিখ্যাত
আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস-ত্রয়ীর তৃতীয়টি ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়’। রবীন্দ্রনাথের
বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত ধারাণাও একই খাতে। গোর্কী লেখাপড়ার সুযোগ পাননি বলে
ভবঘুরে ও শ্রমিক জীবনের দিনলিপি লিখেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো সাধারণভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যাদের বলে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। দেশ ও মানুষের জীবনকে
গভীরভাবে জানতে হবে। আর সেটা ঘরে বা ক্যাম্পাসে বসে হবে না। পথে নামতে হবে। কোন পথে?
“মহৎ আকাঙ্খার রাগিণী মনে যে তারে সহজে বাজিয়া উঠে,
তোমাদের অন্তরের সেই সূক্ষ্ম, সেই তীক্ষ্ণ, সেই প্রভাতসূর্যরশ্মি নির্মিত তন্তুর
ন্যায় উজ্জ্বল তন্ত্রীগুলোতে এখনো অব্যবহারের মরিচা পড়িয়া যায় নাই; উদার
উদ্দেশ্যের প্রতি নির্বিচারে আত্মবিসর্জন করিবার দিকে মানুষের মনের যে-একটা
স্বাভাবিক ও সুগভীর প্রেরণা আছে, তোমাদের অন্তঃকরণে এখনো তাহা ক্ষুদ্র বাধার
দ্বারা বারংবার প্রতিহত হইয়া নিস্তেজ হয় নাই; আমি জানি স্বদেশ যখন অপমানিত হয়, আহত
অগ্নির ন্যায় তোমাদের হৃদয় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে; দেশের অভাব ও অগৌরব যে কেমন করিয়া
দূর হইতে পারে, সেই চিন্তা নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে তোমাদের রজনীর বিনিদ্র প্রহর ও
দিবসের নিভৃত অবকাশকে আক্রমণ করে; আমি জানি ইতিহাসবিশ্রুত যে সকল মহাপুরুষ
দেশহিতের জন্য, লোকহিতের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করিয়া মৃত্যুকে পরাস্ত, স্বার্থকে
লজ্জিত ও দুঃখক্লেশকে অমর মহিমায় সমুজ্জ্বল করিয়া গেছেন, তাঁহাদের দৃষ্টান্ত
তোমাদিগকে যখন আহ্বান করে তখন তাহাকে আজও তোমরা বিজ্ঞ বিষয়ীর মতো বিদ্রূপের সহিত
প্রত্যাখ্যান করিতে চাও না – তোমাদের সেই অনাঘ্রাত পুষ্পের ন্যায়, অখন্ড
পূণ্যের ন্যায় নবীন হৃদয়ের সমস্ত আশাআকাঙ্খাকে আমি আজ তোমাদের দেশের সারস্বতবর্গের
নামে আহ্বান করিতেছি – ভোগের পথে নহে, ভিক্ষার পথে নহে, কর্মের পথে।”
আর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কী প্রকারে
হওয়া যাবে?
“দেশের কাব্যে গানে ছড়ায়, প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষে,
কীটদষ্ট পূঁথির জীর্ণপত্রে, গ্রাম্য পার্বণে, ব্রতকথায়, পল্লীর কৃষিকুটিরে,
প্রত্যক্ষ বস্তুকে স্বাধীন চিন্তা ও গবেষণার দ্বারা জানিবার জন্য, শিক্ষার বিষয়কে
কেবল পূঁথির মধ্য হইতে মুখস্ত না করিয়া বিশ্বের মধ্যে তাহাকে সন্ধান করিবার জন্য
তোমাদিগকে আহ্বান করিতেছি; এই আহ্বানে যদি তোমরা সাড়া দাও তবেই তোমরা যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র হইতে পারিবে; ...”
ঈষৎ দীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্য ক্ষমা স্বীকার করে নিচ্ছি, কিন্তু জীবনের
বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছোনোর আগে অব্দি শ্রোতাদের চেতনার স্তরে কতটা উন্নতি বক্তা ধরে
নিচ্ছেন, এবং তার জন্য সক্রিয় রয়েছেন নিজের প্রতিষ্ঠানে, সেটা মনে করে তাঁকে প্রণাম
জানানোর জন্যই বলতে গেলে এই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো।
লোকসংস্কৃতি ও অন্ত্যজশ্রেণী
অন্য দেশের কথা জানি না কিন্তু ভারতে এই দুটো শব্দের মধ্যে গভীর
সম্পর্ক আছে। রবীন্দ্রনাথ সে কথাটা জানতেন। শূদ্র সম্পর্কে তাঁর ধারণার যে কয়েকটি
দিক স্পষ্ট চিহ্নিত করা যায় তার একটি অবশ্যই এই যে শূদ্র বলতে হিন্দুসমাজের
অন্তর্গত থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় বহির্গতও বোঝায়।
হিন্দুসমাজের অন্তর্গত অন্ত্যজ (আজকের ভাষায় অনেকাংশে অনুন্নত জাতি
ও সম্পূর্ণ তপশীলী জাতি) ও বহির্গত ‘শূদ্র’সম্প্রদায় (আজকের
ভাষায় তপশীলী উপজাতি) দের মধ্যে একটা অবিরাম আসা যাওয়া ছিল ইতিহাসে, এবং সেটা
রবীন্দ্রনাথ জানতেন। নইলে তিনি “প্রাকৃত লোকদের মধ্যে নুতন নুতন ধর্মসম্প্রদায়ের
সৃষ্টি”র কথা বলতেন না।
এখানে ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি কথাটা মতের বা পন্থের সৃষ্টির দিকে ইংগিত করে। কেন
না উপজাতিদের ক্ষেত্রে পারম্পরিক ধর্ম থেকে নতুন ধর্মে যাওয়ার অর্থ হিন্দুসমাজের
অন্তর্ভুক্ত শূদ্র হওয়া, নয়তো খ্রীষ্টান বা মুসলমান হওয়া। এগুলো তখনও খোলাখুলি হত,
এখনও খোলাখুলি হয়। এবং এই যাওয়া আসার মধ্যে পূজার্চনা পদ্ধতি, সর্বশক্তিমানের
ধারণা বা দেবীদেবতা, সন্ত বা মৌলাদের নাম/শক্তির বাখান, উপাসনাস্থল ইত্যাদির
পরিবর্তন হলেও, যেহেতু ধর্মমতটি আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত তাই সাংস্কৃতিক স্তরে
একেবারে নতুন কিছু উদ্ভাবিত হয় না। স্থানীয় ভাষায় দু’একটা ধর্মসংগীতের
কথা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত শূদ্র বা অন্ত্যজদের কোনো
ক্ষুদ্র অংশেরও নতুন মত বা পন্থ গড়ে তোলার ঘটনা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ফসল
ফলিয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক।
আজ যা কিছুকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলে জানি, শুধু বাংলায় নয় সারা
ভারতে, তার বিরাট অংশ জুড়ে প্রথমতঃ হিন্দুসমাজের বহির্ভূত কৌম ও সম্প্রদায় (এদের
জন্য সাংবিধানিক ‘উপজাতি’ শব্দটাই গোলমেলে) আর দ্বিতীয়তঃ হিন্দুসমাজের
অন্তর্গত শূদ্র বলে চিহ্নিত সম্প্রদায়গুলি।
মতুয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর। কিন্তু প্রায়
যুগ্ম-প্রতিষ্ঠাতার আসনটি দেওয়া হয় তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে, কেননা হরিচাঁদের
ইচ্ছানুসারে অনেকগুলো কাজ গুরুচাঁদই শুরু করেছিলেন। তার মধ্যে প্রধান ছিল
নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয় স্থাপন। আরেকটি বিরাট কাজ তিনি
করেছিলেন, সেটি হল নমঃশূদ্রদের ঐক্যনির্মাণ। নমঃশূদ্রদের বার্ষিক মহাসম্মেলন তিনিই
শুরু করেছিলেন। ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহে নমঃশূদ্রদের যে বার্ষিক সম্মেলন হয় তাতে রবীন্দ্রনাথ
অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই ছোট্টো কিন্তু চমকপ্রদ ঘটনাটি প্রমাণ করে যে কবি
লোকসংস্কৃতির পথে, লোকসাহিত্যের পথে নিজের অনুসন্ধানকে গভীরে নিয়ে যেতে, দেশের
মানুষকে বোঝার নিজের প্রয়াসটা চালিয়ে যেতে কখনো পেছপা হন নি।
এবং এটাই শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি চাইতেন যে তাঁর
তৈরি করা বিদ্যালয়ে, তাঁর সর্বস্ব দিয়ে তৈরি করা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আগামী দিনের
শিক্ষার্থী হবে তারা যেন মনে রাখে –
“জনপদে যেমন চাষবাস এবং খেয়া চলিতেছে, সেখানে কামারের
ঘরে লাঙলের ফলা, ছুতারের ঘরে ঢেঁকি এবং স্বর্ণকারের ঘরে টাকা-দামের মোটরি নির্মাণ
হইতেছে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে একটা সাহিত্যের গঠনকার্য্যও চলিতেছে – তাহার বিশ্রাম
নাই। প্রতিদিন যাহা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন খন্ড খন্ড ভাবে সম্পন্ন হইতেছে সাহিত্য
তাহাকে ঐক্যসুত্রে গাঁথিয়া নিত্যকালের জন্য প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করিতেছে।
গ্রামের মধ্যে প্রতিদিনের বিচিত্র কাজও চলিতেছে এবং তাহার ছিদ্রে ছিদ্রে চির-দিনের
একটা রাগিনী বাজিয়া উঠিবার নিয়ত প্রয়াস পাইতেছে।”
“বাংলায় এমন প্রদেশ নাই যেখানে স্থানে স্থানে প্রাকৃত
লোকদের মধ্যে নুতন নুতন ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি না হইতেছে। শিক্ষিত লোকেরা এগুলির
কোনো খবরই রাখেন না। তাঁহারা একথা মনেই করেন না, প্রকান্ড জনসম্প্রদায়
অলক্ষ্যগতিতে নিঃশব্দচরণে চলিতেছে। আমরা অবজ্ঞা করিয়া তাহাদের দিকে তাকাই না বলিয়া
যে তাহারা স্থির হইয়া বসিয়া আছে তাহা নহে – নুতন কালের নুতন
শক্তি তাহাদের মধ্যে অনবরতই পরিবর্ত্তনের কাজ করিতেছে, সে পরিবর্ত্তন কোন পথে
চলিতেছে, কোন রূপ ধারণ করিতেছে, তাহা না জানিলে দেশকে জানা হয় না।”...
“আমরা নৃতত্ত্ব অর্থাৎ ethnologyর বই যে পড়ি না
তাহা নহে, কিন্তু যখন দেখিতে পাই, সেই বই পড়ার দরুন আমাদের ঘরের পাশে যে হাড়ি ডোম
কৈবর্ত বাগদি রহিয়াছে তাহাদের সম্পূর্ণ পরিচয় পাইবার জন্য আমাদের লেশমাত্র ঔৎসুক্য
জন্মে না, তখনই বুঝিতে পারি পুঁথি সম্পর্কে আমাদের কত বড়ো একটা কুসংস্কার জন্মিয়া
গেছে...”
No comments:
Post a Comment