Monday, July 26, 2021

সঞ্চিতার কয়েকটি সম্পাদকীয়


সঞ্চিতার কয়েকটি সম্পাদকীয়

বিহারের জয়

ভোটযজ্ঞ সমাপন হইয়াছে। নতুন সরকারের শপথগ্রহণ হইবে ২০শে নভেম্বর। কে জিতিল, কে হারিল সে প্রসঙ্গে না যাইতে চাহিলেও এ কথাটুকু বলা তো অবশ্য কর্তব্য যে বিহার জিতিয়াছে। বিহারের আপামর জনসাধারণ জিতিয়াছে। বিহার সারা দেশ ও বিশ্বের মন জয় করিয়াছে ভোটপর্বের সারাটা সময় ব্যাপিয়া তাহার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সৌহার্দ্রে, শান্তিতে এবং পশ্চাদপদতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে তাহার নারী ও যুবদের, ভোটদানে ব্যাপক অংশগ্রহণে। তাই সঞ্চিতার পক্ষ হইতে বিহারের জনতাকে অভিনন্দন!

এবার বিহারী বাঙলাভাষীদিগের কোমর বাঁধিবার পালা। সদ্য ইমেলে প্রাপ্ত কয়েকটি সংবাদপত্রের কর্তিত অংশে পূর্ণিয়ার এক স্বনামধন্য বাঙলাভাষী কবির কথা পড়িলাম। তিনি বলিয়াছেন, গর্বের সাথে নিজেকে বাঙলাভাষী বিহারী বলিতে ভালোবাসেন। ভালো লাগিল। এককালে বিহার বাঙালি সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রতিটি সভাসমিতিতে ‘প্রবাসী বাঙালী’র মিথ্যাপরিচয় ত্যাগ করিয়া নিজেদের ‘বাঙলাভাষী বিহারী’র আত্মপরিচয়ে জ্ঞাপিত করিতেন এবং সকলকে আহবান করিতেন এই আত্মপরিচয় গ্রহণে। নিঃসন্দেহে আমরা বিহারী। তাই বলিতেছি যে ভোটযজ্ঞের সমাপনের পর এবার আমাদিগের কোমর বাঁধিবার পালা। কেননা আমাদের সমস্যাসংক্রান্ত কিছু সুরাহা যেমন ইলেকশন কমিশনের বিজ্ঞপ্তির কারণে বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছিল, কিছু নতুন সরকারের প্রতীক্ষারত ছিল।

টিইটি উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্য হইতে বাঙলা শিক্ষক নিয়োগের কার্য বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছিল। প্রশাসনিক স্তরে সে কার্য অনতিবিলম্বে শুরু করাইবার প্রয়োজনে সমিতিকে তৎপর হইতে হইবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা শিক্ষকের কয়টি পদ রিক্ত, সে পরিসংখ্যান আমরা জানিয়াছি। ইহাও সমিতির তৎপরতায় সম্ভব হইয়াছে। এক্ষণে সে রিক্ত পদগুলিতে নিয়োগের মামলাটি পাটনা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়াস করিবে সমিতি।

সমিতির ও বিশেষ করিয়া সমিতির সভাপতি ডাঃ দিলীপ সিংহের অক্লান্ত ব্যক্তিগত প্রয়াসে বিহারের বিদ্যালয়ী শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে বাঙলা সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তকের পুনঃপ্রবর্তন সম্ভব হইয়াছিল। বিগত বৎসরে প্রশাসনিক গোলযোগের কারণে টেক্সটবুক কমিটি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে নাই। পিডিএফ ফাইল করিয়া পুস্তকগুলি তাহাদের ওয়েবসাইটে দিয়াছিল, এবং প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে তাহাদের বিজ্ঞপ্তি গিয়াছিল যে, যে ছাত্ররা পুস্তকটি ডাউনলোড করিয়া মুদ্রিত করাইলে সে ব্যয় তাহারা পাইবে। এবারে এখন হইতেই চেষ্টা করা প্রয়োজন যাহাতে টেক্সটবুক কমিটি পুস্তকগুলি শিক্ষাবৎসরের প্রারম্ভেই মুদ্রণ করায়।                 

ইহার পর শিক্ষাসংক্রান্ত আরো একটি কাজ করিতে হইবে। জানা গিয়াছে যে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই) সম্বদ্ধ বিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দিয়াছে যে যেন এ বৎসর হইতে ছাত্রদের নতুন প্রকারের ফর্ম ভরিতে দেওয়া হয় যাহাতে মাতৃভাষাসহ, তাহারা শিখিতে চাহে এমন তিনটি ভাষার উল্লেখ বাধ্যতামূলক। সত্যই যদি এমত নির্দেশ জারি হইয়া থাকে তাহা হইলে আমাদিগের তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষাসংক্রান্ত এ কার্যগুলির সাথে রহিয়াছে কার্যের আরেকটি দিক। বিহারে পুনর্বাসিত উদ্বাস্তু জনসাধারণের নানা প্রকার সমস্যার সমাধানে বিহার বাঙালি সমিতি বিগত পাঁচ বৎসর যাবৎ ‘শরণার্থী বিকাস প্রাধিকরণ’ গঠনের দাবীতে সংগ্রামরত। এই দাবীকে ফলপ্রসু করিতে অনতিবিলম্বে সরকারের সাথে কথা বলিতে হইবে।

একটি সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। ১২-১৩ ডিসেম্বর ২০১৫য় পাটনায় বিহার বাঙালি সমিতির রাজ্যস্তরীয় সাধারণসভা অনুষ্ঠিতব্য। সেই অনুষ্ঠানে নতুন সরকারের প্রতিনিধিদিগকে আমন্ত্রিত করিয়া তাহাদিগের সম্মুখে এই দাবী গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত করিতে হইবে। এবং সেইক্ষণ হইতেই শুরু হইবে সমিতির গণসক্রিয়তার নবপর্যায়।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, নভেম্বর ২০১৫

 

 

সময়োপযোগী

ইংরাজি বৎসর ২০১৫র শেষ মাসে দু’টি দিন অতীব আনন্দে অতিবাহিত হইল। বিহার বাঙালি সমিতির কেন্দ্রীয় পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে (অথবা, প্রচলিত শব্দে – সম্মেলনে) আমরা, সমিতির বিভিন্ন শাখায় কর্মরত সদস্য এবং প্রতিনিধিগণ একত্র হইবার সুযোগ পাইলাম। পাটনার বি সি রায় পথে ঐতিহ্যবাহী রামমোহন রায় সেমিনারীর প্রসারিত প্রাঙ্গণে, সভাগারে বিহারের বাঙলাভাষী জনসমুদায়ের নানান সমস্যা লইয়া আলোচনা হইল। শাখা অথবা স্থানীয় স্তরে বাঙলাভাষীরা প্রতিদিন যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সেসব আলোচনা বাদে নবনির্বাচিত ও রাজ্যশাসনে নিযুক্ত রাজ্যসরকারের সমীপে আমাদের দাবীগুলি নতুন করিয়া কী উপায়ে পেশ করা সমীচীন হইবে... এমুহুর্তে আন্দোলনের পথে যাওয়া উচিৎ হইবে কিনা... আগামী ৭ই এপ্রিল ২০১৬য়, সমিতির প্রতিষ্ঠাদিবসে গণসমাবেশ... ইত্যাদি বিষয়ও উঠিয়া আসিল।

সত্য বলিতে কি, এই সম্মেলন ঠিক এই সময়েই সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন ছিল। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন ঘোষিত হইবার বেশ কিছু দিন পূর্ব হইতে বাঙালি সমিতি, নির্বাচনে বাঙালি প্রার্থী দাঁড় করাইবার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিকট আপীল করিয়াছিল। কেউ কর্ণপাত করে নাই। স্বাভাবিক ভাবে, বাঙালি সমিতির নেতৃত্ব ও কর্মীবৃন্দ বিষয়টি লইয়া ঈষৎ ক্ষুব্ধ ও তিক্ত মনোভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু রাজনীতিতে এই মনোভাব লইয়া অধিক দিন বসিয়া থাকিলে মানুষে পথ চলার ক্ষমতা হারাইয়া ফেলে। বিহারের জনতার রায় নুতন, সদ্যসমাগত এক শক্তিশালী বাস্তব যাহাকে, সেই জনতারই একাংশ রূপে, স্বাগত জানাইতে আমরা বাধ্য; এবং তাহা জানাইতে যেন কার্পণ্য না হয়। বাঙালি সমিতির এই সম্মেলন রাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবকে সমবেতস্বরে স্বাগত জানাইবার এবং আপন দাবীগুলিকে পুনর্বার একযোগে পেশ করিবার অবসর করিয়া দিল।            

 সকলে একত্র হইয়া সম্মেলনের আনন্দ উৎসবটিকে রাজনৈতিক সার্থকতা প্রদান করিতে পারিলাম।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, ডিসেম্বর ২০১৫

 

 

স্বাগত ইংরাজি নুতন বৎসর ২০১৬

কী প্রকারে এই নুতন বৎসরকে স্বাগত জানাই? বৎসরের দ্বিতীয় দিবস পাঞ্জাবের পাঠানকোট হইতে দুঃস্বপ্নের ন্যায় এক সংবাদ লইয়া আসিল। উগ্রপন্থী জঙ্গী হানার পরিসর কুলীন, মহার্ঘ হোটেলের অলিন্দ, দেশের সংসদের উদ্যান ছাড়াইয়া ভারতীয় বায়ুসেনার, দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত বিমানবন্দর অব্দি পৌঁছাইয়া গিয়াছে। ষষ্ঠদিনে মোরা জানিলাম, অবশ্যই ছয় জঙ্গী নিহত, কিন্তু ন্যাশন্যাল সিক্যুরিটি গার্ডসের কমান্ডো, বায়ুসেনার গরুড় কমান্ডো এবং সেনাবাহিনীর সাতটি অমুল্য প্রাণের বিনিময়ে।

ইতিমধ্যে অনেক জল গড়াইয়াছে। এমত সুরক্ষিত এক ঘাঁটিতে জঙ্গীগণ প্রবেশ করিল কিভাবে, প্রবেশ করিলেও তাহাদের হত্যা করিতে এতটা সময় কেন লাগিল, সাতটি প্রাণই বা কেন দিতে হইল... ইত্যাদি প্রশ্ন উঠিয়াছে এবং উত্তরের সন্ধানে ন্যাশন্যাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সী (এনআই) কে নিযুক্ত করা হইয়াছে।

কিন্তু অন্য একটি প্রশ্নও জাগিয়াছে। জঙ্গী হানা বিফল করা গিয়াছে। কিন্তু তাহাদের উদ্দেশ্য কি শুধুই হানা ছিল? অথবা, ভারত-পাকিস্তান যৌথ-বার্তা ঘোষণার এক মাসের ভিতরে এই হানা বস্তুতঃ ওই যৌথ-বার্তার প্রক্রিয়াকে বিফল করিবার উদ্দেশ্যে করা হইয়াছিল। লক্ষণীয় যে জাইশ-এ-মহম্মদ নামক জঙ্গীগোষ্ঠী গর্বের সাথে হানার দায়িত্ব নিয়াছে। উগ্রপন্থী ও জঙ্গী গোষ্ঠীগুলির ক্রিয়াকলাপে  পাকিস্তানের গোয়েন্দাসংস্থা ও সেনাবাহিনীর একাংশের পরোক্ষ ও কিয়দংশে প্রত্যক্ষ সমর্থন আছে ইহা সর্ববিদিত। কিন্তু পাকিস্তানের সরকারও উহাদের নিয়ন্ত্রণ করিতে ব্যর্থ। এমত পরিস্থিতিতে এই হানাকে সামনে রাখিয়া ভারত সরকারের, পূর্বনির্দ্ধারিত কর্মসূচী অনুসারে যৌথ-বার্তায় অগ্রসর হওয়া উচিৎ যাহাতে জঙ্গী হানার উদ্দেশ্য বিফল হয় এবং দেশ শান্তি ও আর্থিক উন্নয়নের পথ হইতে বিচলিত না হয়।          

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জানুয়ারি ২০১৬

 

 

 

ফেব্রুয়ারি – বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি

ইউনেস্কো সংকল্প অনুসারে ২১শে ফেব্রুয়ারী আজ বেশ কয়েক বৎসর যাবৎ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস । অর্থাৎ বিশ্বের সাতশ’ চল্লিশ কোটি (আনুমানিক) অধিবাসী সেদিন নিজেদের সাত হাজার (প্রায়) মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার, সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখার সংকল্প নেবে ! সাত হাজার ভাষার মধ্যে আড়াই হাজারের বেশি ভাষা আজ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির চাপে বিপন্ন । আরো অনেক ভাষার নিশ্বাস নেওয়ার পরিসর সংকীর্ণ ও বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে । তারপর রয়েছে আমাদের মত মানুষদের সংকট – বিভিন্ন কারণে নিজ মাতৃভাষার মূলকেন্দ্র থেকে দূরে, অন্য ভাষার প্রাধান্যে জীবনধারণে মাতৃভাষা হারাতে থাকার সংকট ; ভাষাটি বিপন্ন না হলেও বিপন্ন হয়ে উঠছে কোটি কোটি মানুষগুলোর ভাষিকতা ।

এই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কি ফিরিয়ে আনা যায় ? সীমিত ক্ষেত্রে হলেও বিহার বাঙালি সমিতি কিন্তু কাজটা করেছে । পশ্চিম চম্পারণ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বাঙালি উদ্বাস্তু কলোনির যে মানুষটি কাজেকর্মে, এমনকি পরিবারেও পুরোদস্তুর ভোজপুরী হয়ে গিয়েছিল, বিহার বাঙালি সমিতির ব্যানারের তলায় লোককে জড়ো করতে করতে সে আবার ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শুরু করেছে, নিজেকে পুনরাবিষ্কার করছে যে সে বাংলাভাষী । এটা শুধু ভাষায় ফিরে আসা নয়, সুস্থ জীবনবোধে ফিরে আসা, ভারতের গণতান্ত্রিকতার প্রত্যয়ে ফিরে আসা ।

বিপন্ন ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার সম্মিলিত প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি, জাতিসংঘও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত এবং তার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা কার্যরত । ভাষিকতা হারাতে থাকা মানুষদের ফিরিয়ে আনাও তেমনি জরুরি । নতুন প্রজন্মকে তার মাতৃভাষায় কিভাবে ধরে রাখা অথবা ফিরিয়ে আনা যায়, এই চিন্তা আজ সব পরিবারে । বিহার বাঙালি সমিতির শাখা হোক অথবা স্থানীয় কোনো বাঙালি সাংস্কৃতিক সংস্থা হোক, এমনকি সর্বভারতীয় স্তরের সম্মেলনগুলোয় দিল্লী, আমেদাবাদ, চেন্নাই, মুম্বাই বা জয়পুরের বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠন হোক, দেখাসাক্ষাতে একটি প্রসঙ্গ অবশ্যই উঠে আসে – তাঁরা রবিবারে বাংলা শেখানোর ক্লাস চালাতে পারছেন কিনা, তাতে ছাত্রের সংখ্যা কত, অভিভাবকেরা উৎসাহিত না নির্বিকার ইত্যাদি । বড় কঠিন সময় ! তবু তো লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে ।

হ্যাঁ, লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে এবং সেটাই হবে আমাদের একুশের চেতনা । আমাদের শহীদস্মরণ ।    

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬

 

 

বিহার দিবসে বিহারবাসী বাঙালি

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিহারকে ছিন্ন করার জন্য ১৯১১ সালটা বেছে নেওয়ার পিছনে নিঃসন্দেহে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনকে দুর্বল করার ব্রিটিশ স্বার্থ কার্যকর ছিল, কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে ইতিহাসগত ভাবেই বাংলা ও বিহার দুই ভিন্ন জাতিসত্তা । এটা ঠিক যে বাংলার জাতিসত্তা যতটা প্রতিষ্ঠিত বিহারের জাতিসত্তা ততটা নয় কেননা জাতিসত্তাকে আমরা এক ভাষার সুত্রে দেখতেই অভ্যস্ত । কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রামে ভারতের জাতিসত্তাগুলো নিজেদের আধুনিকভাবে গঠিত করল সেই সংগ্রামের প্রয়োজনেই বাঙলার ভাষা হল বাংলা যেটি সে প্রান্তের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল । কর্ণাটকের ভাষা যে হল কন্নড়, সেটিও সে প্রান্তেরই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল । কিন্তু বিহারের ভাষা হল হিন্দী ও পরবর্তীকালে যোগ হল উর্দু – দুটির কোনোটিই সে প্রান্তের কোনো ভাষাগোষ্ঠির ভাষা ছিলনা । সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ছিল অংগিকা, বজ্জিকা, মগহী, মৈথিলী ভোজপুরী সমেত আরো অনেক এবং এই অনৈক্য ঘোচাতেই বিহারী জাতিসত্তার দিশারীগণ হিন্দীর, অর্থাৎ খড়িবোলির আমদানী করলেন । সময়ের সাথে তাল রাখতে সদুদ্দেশ্যেই তাঁরা এই ঘটনাটি ঘটালেন, কিন্তু এর পরিণামে রাজ্যের নিজস্ব ভাষাগুলির বিকাশসংক্রান্ত এক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হল । সেটি দূর করতেই আবার সরকারের তরফ থেকে সৃষ্ট হল বিভিন্ন ভাষাগত একাডেমী । তাদের কাজকর্মের সমস্যা, সরকারি অনুদানের স্বল্পতা ইত্যাদি এ পরিসরে বিচার্য নয় ।

বিহারে বাংলা এরই মাঝে নিজের জায়গা খুঁজে নিল । একই প্রাচীন ভাষা থেকে নির্গত ভাষাগোষ্ঠির অন্তর্গত হলেও বাংলা সেভাবে বিহারী ভাষা নয় । কিন্তু বাংলাভাষী মানুষেরা পুরুষানুক্রমে বিহারী ; কেন্দ্রীয় ও বিহার সরকারের সিদ্ধান্তক্রমে বিহারী । যেমন ঝাড়খন্ডের বাংলাভাষীরা ঝাড়খন্ডী । তাই বাংলাভাষার অধিকারাদি নিয়ে বিহার বাঙালি সমিতির লড়াই ও সরকার কর্তৃক তার স্বীকৃতি ।

বিহার দিবস তাই আমাদেরও দিবস, আমাদেরও উদ্‌যাপন । ২০১২ এবং ২০১৩ সালে বিহার বাংলা আকাডেমি বিহার দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল । শিক্ষা বিভাগের প্যাভিলিয়নে বিহার বাংলা আকাডেমি স্টল দিয়েছিল । এবারের বিহার দিবসেও একটি দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র হলে ভালো হয় । এ নিয়ে সরকারের সাথে আকাডেমির কথা বলা উচিৎ । সরকারি অনুদান না পেলে আকাডেমি আমাদের সহযোগিতা পাবে । বিহার দিবস আমরা, বাংলাভাষীরা নিজেদের মত করে উদ্‌যাপন করব ।                

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, মার্চ ২০১৬

 

 

 

নারীশক্তি

রিও অলিম্পিকে ভারতের গর্ব হলেন তিন নারী। ব্যাডমিন্টনে রজতজয়ী পি ভি সিন্ধু, মল্লযুদ্ধে কাংস্যজয়ী সাক্ষী মলিক এবং কোনো পদক না জিতেও ভারতের হৃদয়ে সোনার মেয়ে হয়ে ওঠা দীপা কর্মকার। ব্যাডমিন্টনের বিশ্ব-শৃংখলায় ভারতের মেয়েদের সবল উপস্থিতি নতুন নয়। সিন্ধুর নাম তাতে যুক্ত হল। মল্লযুদ্ধেও নারীরা বেশ কিছু সময় ধরেই ছিলেন, সাক্ষীর কাংস্যজয় সে তথ্যটার ওপর আলোকপাত করল। কিন্তু জিমন্যাস্টিকে ভারতের মেয়েদের অগ্রগতির খবর ক্রীড়াবিদেরা রাখলেও সাধারণ মানুষের প্রায় অজানাই ছিল। তাই ত্রিপুরার গ্রামের মেয়ে দীপা কর্মকারের ওই আকাশছোঁয়া লাফ ও হাওয়ায় ডিগবাজি যখন টিভিতে দেখানো হল, ভারতের সাধারণ মানুষ বিস্মিত ও গর্বিত হল স্বভাবতই। এই তাহলে সেই অকল্পনীয় ‘প্রোদুনোভা’ – যা ভারতের মেয়ে, আমাদের ঘরের মেয়ে করছে!...

আবার সাক্ষীর কাংস্যজয় একটি সামাজিক বিড়ম্বনার দিকে আঙুল তুলল। মল্লযুদ্ধের মত পুরুষ-অধ্যুষিত ক্রীড়ায় ভারতের নারীশক্তির প্রতীক হল কিনা খাপ-দৌরাত্মের অঞ্চল – হরিয়াণার মেয়ে! এবং সে সুত্রে হরিয়াণা, দিল্লির অনেক মেয়েরই খবর পাওয়া গেল যারা নামকরা মল্লযোদ্ধা। অভিনেতা, প্রযোজক আমীর খান নতুন যে ফিল্ম তৈরি করছেন, ‘দংগল’, তার বিষয়ও নাকি মল্লযুদ্ধে নারী!

অথচ এই ক্রীড়ার সুত্র ধরে শরীরচর্চা বা স্বাস্থ্যচেতনা সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে কি? সবল, ‘পেশীবহুল’ না হলেও অন্ততঃ পেশীসম্পন্ন শরীরের অধিকারিণী হওয়ার ঝোঁকটা জনপ্রিয় হলে কিছু পুরুষের নোংরা হাত মুচড়ে ভেঙে দেওয়ার নজীর তারা একটু বেশী করে রাখতে পারত।    

প্রকাশোৎসব

শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংএর ৩৫০তম জন্মোৎসব উদযাপনের আয়োজনে পাটনা শহরে সাজ সাজ রব পড়েছে।

গুরু গোবিন্দ সিংএর পিতা গুরু তেগবাহাদুর (শিখদের নবম গুরু) আসাম যাত্রাকালে স্ত্রী গুজরী বাইকে পাটনায় রেখে গিয়েছিলেন। স্বামী যাত্রা থেকে ফিরে আসার আগেই গুজরী বাই, ইংরেজী কালানুসারে ২২শে ডিসেম্বর ১৬৬৬ সালে, একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। বাল্যকালে সেই পুত্রের নাম ছিল গোবিন্দ রায়। পরে তিনিই গোবিন্দ সিং নামে খ্যাত হন।

শিখদের এই দশম গুরু অত্যন্ত সাহসী, ত্যাগবীর, বিদ্বান, বহুভাষাবিদ ও সুকবি ছিলেন। মাতৃভাষা পাঞ্জাবী ছাড়াও তিনি ফারসী, আরবী ও সংস্কৃত জানতেন। শিখ পন্থের নীতিগুলোকে (খালসা) তিনি সুত্রবদ্ধ করেন, গ্রন্থ সাহিবের দশম খন্ড বা দশম গ্রন্থ রচনা করেন এবং সুন্দর কাব্য রচনা করেন। তাঁর জীবনের ঘটনাবলী, তাঁর বিনয়, ঔদার্য ইত্যাদি নিয়ে অনেক কাহিনী আছে যা সত্যিই শিক্ষণীয়। তাঁর স্মৃতিধন্য আজকের পাটনা সিটি স্থিত তখ্‌ৎ শ্রী হরিমন্দির, গঙ্গাতীরের কংগন ঘাট এবং নিকটবর্তী আরো কিছু তীর্থস্থল। ধর্মের নামে মানুষকে ভাগ করার বিরুদ্ধে আজও প্রাসঙ্গিক তাঁর অমর বাণীঃ-

হিন্দূ তুরক কোঊ সাফজী ইমাম শাফী।

মানস কী জাত সভৈ একৈ পহচানবো ।।

আমাদের সৌভাগ্য যে গুরু গোবিন্দ সিংএর জন্ম ও বাল্যলীলায় ধন্য এ শহর আজ আমাদের রাজ্যের রাজধানী। ডিসেম্বরের শেষ থেকেই সারা পৃথিবীর শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা পাটনায় আসবেন। লক্ষ লক্ষ শ্রদ্ধাশীল মানুষের সমাগম হবে। বিহারবাসী হিসেবে আমরা, বাংলাভাষীরা তাঁদের অভ্যর্থনায় প্রস্তুত থাকব।      

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০১৬

 

 

কুড়ি দিলেন, পঁচাত্তর নিলেন

পাঁচ রাজ্যে ভোটের মুখে বাজেট, এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল । আদালতেও নালিশ গিয়েছিল, যদিও আদালত সরকারের এই অধিকার খারিজ করেনি । তাই এ সঙ্কেত তো ছিলই যে এবারে ‘গণ-আকর্ষণী’ কোনো প্রস্তাব বাজেটে থাকবেনা । কিন্তু, সেরকম কোনো খাতে বরাদ্দ বাড়ানো তো দূরের কথা “কী করি বলুন, নির্বাচন কমিশন যদি ধরে?” গোছের হাওয়ায় সব খাতে আরো কাটতি করে নেবে, এটাও অভাবনীয় ছিল । গোদের ওপর বিষফোঁড়া, পরোক্ষ করের খাতে আনুমানিক রাজস্ব সংগ্রহ ধরা হয়েছে পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা, যা গরীব মানুষের মুঠো থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে এবং, অবশ্যই নিম্ন-মধ্যবিত্ত মাবুষের, যাদেরকে আয়করে ছাড় দেওয়া হয়েছে কুড়ি হাজার কোটি, তাদের পকেট থেকেও ছিনিয়ে নেওয়া হবে । হয়ত বেশির ভাগটা তারাই যোগাবে কেননা পরোক্ষ করের সিংহভাগ হল পেট্রল/ডিজেলের ওপর ধার্য আবগারী শুল্ক ।

এমনিতে কাউকে কিছু দেওয়ার জায়গাও রাখেননি তাঁরা, কেননা বাজেটের মাপটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে । ভারতের জনসংখ্যার ১৬২% তপশীলী জাতি এবং ৮২% উপজাতি । সর্বোচ্চ আদালত অনেক আগেই নির্দেশ দিয়েছে যে তাদের কল্যাণের জন্য বাজেট বরাদ্দ যেন জনসংখ্যায় তাদের প্রতিশতের অনুপাতে হয় । তা সত্ত্বেও এবারের (এবং গতবারেরও, এধরণেরই) বাজেটে তাদের কল্যাণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, ক্রমশঃ ২৪৪% এবং ১৪৮% । ঠিক তেমনই, নারীদের কল্যাণের জন্য, যাকে জেন্ডার বাজেট বলা হয়, বরাদ্দ হয়েছে ৫∙৩% ।

কর-প্রণালীর খোলনলচে পাল্টে জিএসটি বাস্তবায়িত হচ্ছে এবছর থেকে । করসংগ্রহ থেকে আনুমানিক আয় ১৩ লক্ষ কোটি টাকা হবে কি ? এক দিন আগের আর্থিক সর্বেক্ষণ যে ছবিটি পেশ করেছে তাতে আর্থিক বৃদ্ধিতে ভাঁটা আসবে আশঙ্কা করা হয়েছে । বলা হয়েছে যে চাহিদা ‘তীব্র’ ভাবে কমবে, বড় রকমের কমতি আসবে কর্মসংস্থানে, চাষে আয় কমবে ইত্যাদি...। তাহলে ?

বিজ্ঞানী-স্মরণ, বিজ্ঞান-বরণ

কয়েক বছর আগের কথা, তখন মগধ মহিলা কলেজের প্রাচার্য ছিলেন ডলি সিনহা, পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা । কলেজের অডিটোরিয়ামে বিহার বাঙালি সমিতিকে নজরুল জয়ন্তী উদযাপন করার সুযোগ দিয়েছিলেন । কলেজও যুক্ত হয়েছিল আয়োজনে । অনুষ্ঠান-শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সময় জানালেন নিজের ইচ্ছের কথা, যে বাঙালি সমিতি বাংলার বিজ্ঞানীদেরও স্মরণ করুক ।

এরপর ২০১৫তে, নবপর্যায়ে বিহার হেরাল্ডের প্রকাশন শুরু হয়েছে, এবং তার মাসিক ‘চা-বারান্দা’ আলোচনাসভায় বিজ্ঞানীদের নিয়ে দুটো অনুষ্ঠান হয়ে গেছে । বাঙালি সমিতি এখনও নিজের ব্যানারে সেরকম কিছু করেনি । আলোচনাসভাই করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তবে যেভাবেই হোক, অন্ততঃ চারজন – আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা – কে আমাদের নিশ্চই স্মরণ করা উচিৎ ।

ভবিষ্যতে এ কথাটি আমরা মনে রাখব ।

শিলাপথারে যা কিছু হয়েছে, অত্যন্ত নিন্দনীয়

গত ৮ই মার্চ দেশের সংবাদমাধ্যমের মারফৎ আমরা জানতে পারলাম আসামের ধামাজি জেলায় শিলাপথার শহরে দুঃখজনক কিছু ঘটনা ঘটেছে । হিন্দু(?) উদ্বাস্তুদের নাগরিকতা দেওয়ার দাবিতে নিখিল ভারত বাঙালি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির একটি মিছিল বেরিয়েছিল । অল আসাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আসু)এর অফিসের সামনে আসার পর তারা ওই অফিসের ওপর হামলা চালায় । স্বাভাবিকভাবেই, পুলিস অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারগ্যাস শেল ছোঁড়ে, সব মিলিয়ে ৪৩ জনকে গ্রেফতার করে, পরের দিন এই হামলার প্রত্যুত্তরে গোলাঘাট, রঙ্গিয়া, কামরুপ জেলায় বাঙালি ব্যবসায়ীরা এবং তাদের দোকানপাট আক্রান্ত হয়, সরকারের তরফ থেকে সাবধানবাণী এবং আসুর তরফ থেকে হুমকি উচ্চারিত হয়, পুরো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং... এনবিবিইউএসএস এর নেতা সুবোধ বিশ্বাসকে পলাতক ঘোষিত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং এক লাখ টাকার পুরস্কারের ঘোষণা জারি করা হয় । অবশেষে ২২শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সুবোধ বিশ্বাস ধরা পড়েন ।

আসু অফিসের ওপর হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয় । কিন্তু নিন্দাটা কার প্রাপ্য ? বাঙালি উদ্বাস্তু জনতার ? এনবিবিইউএসএস নেতৃত্বের ? সম্পর্কিত কর্তাব্যাক্তিরা, পুলিস, প্রশাসন কি নিশ্চিত যে অকুস্থলে নেপথ্যে কিছু দাঙ্গাবাজ দালাল সক্রিয় ছিল না ? দাঙ্গাবাজ দালালেরা যদি থেকে থাকে তাহলে তারা মিছিলের মধ্যে ছিল অথবা আসু অফিসের সামনে জমায়েত লোকজনের মধ্যে ছিল ? কেননা এটাও বলা হচ্ছে যে আগে মিছিলের ওপর পাথর ছোঁড়া হয়, পরে মিছিলের ‘লোকেরাও’ পাথর ছুঁড়তে শুরু করে ।

গ্রেপ্তারের পর সুবোধ বিশ্বাস কী বলেছেন জানা নেই । এনবিবিইউএসএস বাঙালি উদ্বাস্তুদের একটি সর্বভারতীয় সংগঠন । নাগপুরে এঁদের সদর দপ্তর । নিজেদের দাবী আদায়ের জন্য সংগঠনটি ছত্রিশগড়ের রায়পুরে, রাজধানী দিল্লিতে ও দেশের বিভিন্ন শহরে সামাবেশ, মিছিল, ধরনা এবং অন্যান্য কর্মসূচী সংগঠিত করে এসেছে এতদিন । কখনো এই সব আন্দোলনে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি । সিলাপথারে যা কিছু হল তার মধ্যে অনেককিছুর ব্যাখ্যা নেই ।

আসামের উদ্বাস্তু সমস্যা জট পাকাচ্ছে প্রতিদিন । মিডিয়া বলছে এনবিবিইউএসএস এর মিছিল, বাঙালি ‘হিন্দু’ উদ্বাস্তুদের লিগ্যাল স্ট্যাটাস যাই হোক না কেন সবাইকে নাগরিকতা দেওয়ার এবং ডি-ভোটার স্ট্যাটাস শেষ করার দাবী জানিয়েছিল । বর্তমান সরকারও পরোক্ষ ভাবে এই আশ্বাস দিয়েছে যে দেশের নাগরিকতা আইনে সংশোধন এনে শুধু বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকতা দেওয়া হবে; অবশ্য এ আশ্বাসও তারা দেয় যে আসাম চুক্তির পবিত্রতা রক্ষা করা হবে । ওদিকে আসু এবং অগপ জোর দিয়ে বলে যে আসাম চুক্তি ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করে না । যদি মুসলমানদের কথা ধরি, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ১৯৪৭ বা ১৯৭১এর পর উদ্বাস্তু হয়ে আসে নি – অনেক আগেই চা-বাগানে এবং অন্য জায়গায় কাজের জন্য ইংরেজরা তাদের পূর্বপুরূষদের লোভ দেখিয়ে আসামে নিয়ে আসে, যদিও তারা নাগরিকতা পায় নি ।

আপাততঃ, বিহারের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত পাঁচ লক্ষ উদ্বাস্তু সহ বিহারের বাঙলাভাষীরা আসামে তাদের ভাষা-ভাইবোনদের ভাগ্যের লিখন নিয়ে চিন্তিত । তাঁরা আসামের রাজ্যপালের বয়ানে স্বস্তি পেতে পারেন । সিলাপথারে আসু অফিসে হামলার ঘটনার নিন্দা করে রাজ্যপাল বলেছেন কাপুরুষতার নজীর এই ঘটনার কুশীলবদের শক্ত হাতে দমন করা হবে । শেষে রাজ্যের জনতার কাছে আবেদন করেছেন যেন তাঁরা, জাতি-বহুল, সংস্কৃতি-বহুল, ভাষা-বহুল ও ধর্ম-বহুল আসামকে আরো শক্তিশালী করেন ।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৭

 

 

এক বিষন্ন নববর্ষ উদযাপন

এবারের নববর্ষ সত্যিই অদ্ভুতভাবে কাটলো । বিহার বাঙালি সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্রী পূর্ণেন্দু শেখর পালের অসাময়িক মৃত্যুতে (১০ই এপ্রিল ২০১৭ ; সংবাদ এই সংখ্যাতেই অন্যত্র রয়েছে) নববর্ষ উদযাপনের সমস্ত কর্মসূচী বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো । তখন সহায় হল কবিগুরুর বাণী । সেই বাণীই হোক সঞ্চিতার এই সংখ্যার সম্পাদকীয় ।

জগতের মধ্যে এই মুহূর্তে যিনি নবপ্রভাতকে প্রেরণ করেছেন তিনি আজ নববর্ষকে আমাদের দ্বারে প্রেরণ করলেন, এই কথাটিকে সত্যরূপে মনের মধ্যে চিন্তা করো। একবার ধ্যান করে দেখো, আমাদের সেই নববর্ষের কী ভীষণ রূপ। তার অনিমেষ দৃষ্টির মধ্যে আগুন জ্বলছে। প্রভাতের এই শান্ত নিঃশব্দ সমীরণ সেই ভীষণের কঠোর আশীর্বাদকে অনুচ্চারিত বজ্রবাণীর মতো বহন করে এনেছে।

মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়; সে এমন শান্তির নববর্ষ নয়; পাখির গান তার গান নয়, অরুণের আলো তার আলো নয়। তার নববর্ষ সংগ্রাম করে আপন অধিকার লাভ করে; আবরণের পর আবরণকে ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে।

বিশ্ববিধাতা সূর্যকে অগ্নিশিখার মুকুট পরিয়ে যেমন সৌরজগতের অধিরাজ করে দিয়েছেন, তেমনি মানুষকে যে তেজের মুকুট তিনি পরিয়েছেন দুঃসহ তার দাহ। সেই পরম দুঃখের দ্বারাই তিনি মানুষকে রাজগৌরব দিয়েছেন; তিনি তাকে সহজ জীবন দেন নি। সেইজন্যেই সাধন করে তবে মানুষকে মানুষ হতে হয়; তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।

তাই বলছি আজ যদি তিনি আমাদের জীবনের মধ্যে নববর্ষ পাঠিয়ে থাকেন তবে আমাদের সমস্ত শক্তিকে জাগ্রত করে তুলে তাকে গ্রহণ করতে হবে। সে তো সহজ দান নয়, আজ যদি প্রণাম করে তাঁর সে দান গ্রহণ করি তবে মাথা তুলতে গিয়ে যেন কেঁদে না বলে উঠি ‘তোমার এ ভার বহন করতে পারি নে প্রভু, মনুষ্যত্বের অতিবিপুল দায় আমরা পক্ষে দুর্ভর’।

প্রত্যেক মানুষের উপরে তিনি সমস্ত মানুষের সাধনা স্থাপিত করেছেন, তাই তো মানুষের ব্রত এত কঠোর ব্রত। নিজের প্রয়োজনটুকুর মধ্যে কোনোমতেই তার নিষ্কৃতি নেই। বিশ্বমানবের জ্ঞানের সাধনা, প্রেমের সাধনা, কর্মের সাধনা, মানুষকে গ্রহণ করতে হয়েছে। সমস্ত মানুষ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আপনাকে চরিতার্থ করবে বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এইজন্যেই তার উপরে এত দাবি। এইজন্যে নিজেকে তার পদে পদে এত খর্ব করে চলতে হয়; এত তার ত্যাগ, এত তার দুঃখ, এত তার আত্মসম্বরণ।

মানুষ যখনই মানুষের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে তখনই বিধাতা তাকে বলেছেন, ‘তুমি বীর।’ তখনই তিনি তার ললাটে জয়তিলক এঁকে দিয়েছেন। পশুর মতো আর তো সেই ললাটকে সে মাটির কাছে অবনত করে সঞ্চরণ করতে পারবে না; তাকে বক্ষ প্রসারিত করে আকাশে মাথা তুলে চলতে হবে। তিনি মানুষকে আহ্বান করেছেন, ‘হে বীর, জাগ্রত হও। একটি দরজার পর আর-একটি দরজা ভাঙো, একটি প্রাচীরের পর আর-একটি পাষাণপ্রাচীর বিদীর্ণ করো। তুমি মুক্ত হও, আপনার মধ্যে তুমি বদ্ধ থেকো না। ভূমার মধ্যে তোমার প্রকাশ হোক।’......

না, না, এ শান্তির নববর্ষ নয়। সম্বৎসরের ছিন্নভিন্ন বর্ম খুলে ফেলে দিয়ে আজ আবার নূতন বর্ম পরবার জন্যে এসেছি। আবার ছুটতে হবে। সামনে মহৎ কাজ রয়েছে, মনুষ্যত্বলাভের দুঃসাধ্য সাধনা। সেই কথা স্মরণ করে আনন্দিত হও। মানুষের জয়লক্ষ্মী তোমারই জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে এই কথা জেনে নিরলস উৎসাহে দুঃখব্রতকে আজ বীরের মতো গ্রহণ করো। (শান্তিনিকেতন ১৪)

শুভ নববর্ষ ১৪২৪ !

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, এপ্রিল-মে ২০১৭

 

 

বার বার কি আদালতেরই শরণাপন্ন হতে হবে?

কিছুটা সময় আগে, বিহার লোক সেবা আয়োগ যখন বিহারের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন বিষয়ের অধ্যাপক, সহায়ক প্রফেসর ইত্যাদির রিক্ত পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করলো, বিহার বাঙালি সমিতির নেতৃবৃন্দের টনক নড়লো। বিষয়গুলোর মধ্যে বাংলা ছিলোনা। সমিতি বিহারের সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরটিআই আবেদন করে জানতে চাইলো তাদের বাংলা ভাষায় অনুমোদিত পদ ও রিক্ত পদ ক’টি। জবাবে পাওয়া গেল যে সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে বিভিন্ন গ্রেডে চার ডজনের বেশী পদ রিক্ত পড়ে আছে। সমিতি, প্রতিবারের মতই, বিহার সরকারের সম্পর্কিত বিভাগের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে যথাসাধ্য তদ্বির করলো। শেষে অসফল হয়ে মাননীয় পাটনা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হল। হাস্যকর ভাবে, দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে সরকার কোর্টকে জানালো যে বাংলা ভাষায় রিক্ত পদ বেশি নেই এবং ‘গুরুত্বহীন’ বিষয়গুলো দ্বিতীয় চরণে ধরা হবে। আরটিআইএর জবাবে যে রিক্ত পদের সংখ্যা জানা গিয়েছিলো, সেগুলো সংলগ্ন করে কোর্ট জানতে চাইলো, যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত লেখা হয়েছে, যে ভাষা লক্ষাধিক বিহারির মাতৃভাষা এবং যে ভাষাকে সরকার সংখ্যালঘু ভাষা বলে স্বীকার করেছে, সে ভাষা কোন ভিত্তিতে সে একই সরকারের কাছে গুরুত্বহীন। এতদিন অব্দি গা-জোয়ারি করতে থাকা বিভাগ এই একটা প্রশ্নেই ঘায়েল হল। প্রধান সচিব ১৮.৫.১৭ তারিখে বিহার লোকসেবা আয়োগকে চিঠি দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ৪৪টি সহায়ক প্রফেসরের পদে নিয়োগ শুরু করার নির্দেশ দিলেন।

যদি সমিতি এই সময়ানুগ পদক্ষেপগুলো না নিতো, এই সমস্ত রিক্ত পদগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্থায়ী ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, আর বিভাগগুলো বন্ধ হয়ে যেত কিছুদিন পর।

পাঠকদের মনে করিয়ে দিই, ২০০৬ সাল থেকে ন্যূনতম চার বার বাংলাশিক্ষাজনিত সমস্যায় সমিতিকে উচ্চ আদালতে যেতে হয়েছে। এক বার পাঠ্যপুস্তকের জন্য, একবার স্কুলশিক্ষকের জন্য, একবার বাংলা আকাডেমির সমস্যায় আর এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নিযুক্তির জন্য। বাঙালি জনসাধারণের অন্যান্য অধিকার, বিশেষ করে বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী বাঙালি উদ্বাস্তুদের অধিকার আদায়ের জন্য মামলা ছেড়েই দিলাম। এবং প্রতিবার, সমিতির কথা মাননীয় কোর্ট শুনেছে – সমিতি বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু কতবার? প্রতিবার আদালতের শরণাপন্ন না হলে কি চলবেই না?

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জুন-জুলাই ২০১৭ 

 

 

গুরুচরণ সামন্ত স্মৃতি বক্তৃতা – কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০১৭য় কলকাতার বুদ্ধিস্ট টেম্পল রোডে অবস্থিত ভেন কৃপাশরণ সভাঘরে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভা সম্পন্ন হল। দিনটা ছিল মহাষষ্ঠী, রাস্তায় ভীড়, তবু তার ধকল সামলে বিদ্যাসাগর গবেষণা কেন্দ্র, কলকাতা নিজেদের দায়িত্ব পালন করল। পাটনা থেকে বিদ্যাসাগর জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী – নন্দনকানন উদযাপন কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে উপাধ্যক্ষ ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ এবং সচিব শ্রী সুনির্মল দাশ যেতে পেরেছিলেন। মনোজ্ঞ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর আলোচনাসভার কাজও শুরু হয়। নন্দনকানন উদযাপন কমিটি এবং বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতির তরফ থেকে একটি সুদৃশ্য স্মারক বক্তাদের হাতে তুলে দেন ডাঃ দিলীপ সিংহ মহাশয়। পুরো অনুষ্ঠানটা সুন্দর ভাবে সঞ্চালন করেন বিদ্যাসাগর গবেষণা কেন্দ্রের আহবায়ক শ্রী প্রাণতোষ বন্দোপাধ্যায়। বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা, যাঁদের দাক্ষিণ্যে নন্দনকানন উদযাপন কমিটির শাখা/সহযোগী হিসেবে বিদ্যাসাগর গবেষণা কেন্দ্রের অফিস কলকাতায় খোলা গেছে এবং যাঁদের সহযোগিতা প্রতিমুহূর্তেই অনুভূত হয়, এই আলোচনাসভাও তাঁদেরই সহযোগিতায় হতে পেরেছিল।

এও এক অসাধারণ যোগাযোগ! বুদ্ধপীঠ বিহারের আমাদের বিদ্যাসাগর মশাই কলকাতায় বুদ্ধের আবাসেই গিয়ে উঠলেন! এ যেন প্রাচীন ভারতের যুক্তিবাদী দর্শনচিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ পথিকৃৎএর মুখোমুখি হলেন উনবিংশ শতাব্দীর ভারতের শ্রেষ্ঠ যুক্তিবাদী ও গণমুখী ভাবুক, শিক্ষাবিদ, সমাজ-সংস্কারক, বাংলা বর্ণমালার ও গদ্যের সংস্কারক এবং প্রান্তিক জনসাধারণের উন্নয়নে নিয়োজিত একনিষ্ঠ কর্মী। আমরা সঠিক জানিনা বিদ্যাসাগর বুদ্ধের জীবন ও কর্ম নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিলেন কিনা; তাঁর সাহিত্যে তাঁর তাৎক্ষণিক শিক্ষাচিন্তা ও সংস্কারচিন্তারই প্রসার দেখা যায় – আধুনিক ভাবনার অস্ত্রে কুশল যুব তাঁর লক্ষ্য ছিল। আর তাঁর সময়ে বৌদ্ধদর্শনভাবনাকে দু’হাজার বছরব্যাপী কুহকের আড়াল থেকে আলোয় আনার কাজ, বিদ্বান ইতিহাসবিদেরা, বিশেষ করে জার্মান ভারতবিদেরা শুরুও করেননি; বা হয়ত ঠিক সে সময়েই শুরু করেছিলেন। কিন্তু তবু, রেশটা দেখা যায়। প্রাচীন ভারতের বুদ্ধ, মহাবীর প্রমুখের যুক্তিবাদী দর্শনদিগন্তের রেশ যেন এসে স্পর্শ করে মধ্যকালের ভক্তিযুগের মহান কবিদের, তারপর আরো এগিয়ে এসে আশীর্বাদধন্য করে বাংলার নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ মানুষদের।

আলোচনাচক্রে বক্তাদের যে স্মারক দেওয়া হল, তাতে সুন্দরভাবে বিধৃত আছে বুদ্ধ ও বিদ্যাসাগরের এই মুখোমুখি-ভাব, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইন্টারফেস’।       

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৭ 

 

 

ডাকঘর অভিনয়ের ১০০ বছর

১০০ বছর আগে, ১০ই অক্টোবর, ১৯১৭ তারিখে জোড়াসাঁকোর বিচিত্রাভবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ডাকঘর নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়।

যদিও নাটকটি লেখা হয়েছিল ছয় বছর আগে, ১৯১১ সালে পূজার ছুটির পর এবং প্রকাশিত হয় ১৬ই জানুয়ারি ২০১২। মনের এক বিশেষ অবস্থায় কবি নাটকটি লেখেন, শান্তিনিকেতনের ছাদের উপর মাদুর পেতে পড়ে থাকতুম। প্রবল একটা আবেগ এসেছিল ভিতরে। চল চল বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে হবে সেখানকার মানুষের সুখদুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। সে সময় বিদ্যালয়ের কাজে বেশ ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কি হল। রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার করল। যাই-যাই এমন একটা বেদনা মনে জেগে উঠল। ... আমার মনে হচ্ছিল একটা কিছু ঘটবে, হয়ত মৃত্যু। স্টেশনে যেন তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠতে হবে সেই রকমের একটা আনন্দ আমার মনে জাগছিল। যেন এখান হতে যাচ্ছি। বেঁচে গেলুম। এমন করে যখন ডাকছেন তখন আমার দায় নেই। কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা উভয় মিলে, খুব একটা আবেগে সেই ঞ্চলতাকে ভাষাতে ডাকঘরে কলম চালিয়ে প্রকাশ করলুম। মনের আবেগকে একটা বাণীতে বলার দ্বারা প্রকাশ করতে হল। মনের মধ্যে যা অব্যক্ত অথচ চঞ্চল তাকে কোনো রূপ দিতে পারলে শান্তি আসে। ভিতরের প্রেরণায় লিখলুম। এর মধ্যে গল্প নেই। এ গদ্য-লিরিক। আলংকারিকদের মতানুযায়ী নাটক নয়, আখ্যায়িকা”।

অথচ এই নাটক নয়টির অনুবাদ, দ্য পোস্ট অফিস কিন্তু সাড়া জাগিয়েছিল প্রথম বিশ্বয়ুদ্ধ ও পরে, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও ইয়োরোপে। ইংরেজিতে এর প্রথম অভিনয় হয় ১০ই মে, ১৯১৩ তারিখে, আইরিশ থিয়েটারে। খোদ ইংরেজি কবি ইয়েট্‌সের উদ্যোগে। এটি শুধু ডাকঘরএরই প্রথম অভিনয় নয়, বিদেশের মাটিতে রবীন্দ্রনাথের নাটকেরও প্রথম অভিনয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে নাটকটির ফরাসী শ্রুতি সংস্করণ ফরাসী রেডিওতে ব্রডকাস্ট হয়েছিল। সে সময় ফ্রান্স জার্মানির (হিটলারের) নাৎসি শাসনের অধীনে ছিল। সবচেয়ে চমকপ্রদ ও ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটে পোল্যান্ডে। ওয়ারশ শহরের বস্তীতে একটি অনাথালয় চালাতেন জানুস কোর্চাক। শিশুদের নিয়ে ডাকঘর নাটকের পোলিশ সংস্করণ তিনি মঞ্চস্থ করেন ১৯৪২ সালের ১৮ই জুলাই। তাঁর নিজের কথায়, নাটকটি কথ্য থেকে অনেক বেশী, মনের একটি অবস্থা। আবেগের থেকে বেশী কিছু পৌঁছে দেয় [দর্শকের অন্তরে]। একটি অভিজ্ঞতা... আর অভিনেতারাও অভিনেতার থেকে বেশী, তারা শিশু। কথিত আছে যে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় রবীন্দ্রনাথের নাটক তিনি কেন বাছলেন, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, মৃত্যুর দেবদূতের মুখোমুখি হতে আমাদের সবাইকার শেখা উচিৎ...। তিন সপ্তাহ পরে তাঁকে ও শিশুদেরকে ট্রেব্লিঙ্কা মৃত্যুশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

এহেন নাটকের প্রথম বাংলা পাব্লিক শো (এর আগে একটি অভিনয় হয়েছিল কলকাতারই ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়ে) হয় ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে। প্রথম দিন বিচিত্রার সদস্যদের জন্য। দ্বিতীয় দিন গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য। সে সময় কবি রাজনৈতিক কাজে খুব ব্যস্ত ছিলেন। কবি জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন, কিন্তু রাজনীতির আলোচনা রবীন্দ্রমানসের সমগ্র মূর্তি নহে। এ কথা মুহূর্তমাত্র ভুলিলে চলিবে না যে, তিনি জীবনশিল্পী, আর্টিস্ট ও কবি। তাই দেখি কলিকাতার এই বিচিত্র কর্ম-আবর্তন ও উত্তেজনার মধ্যে বিচিত্রায় চলিতেছে ডাকঘর নাটিকা অভিনয়ের আয়োজন। অভিনয়ের ব্যবস্থায়, নাটকের মহড়ায়, রঙ্গমঞ্চ সম্বন্ধে আলোচনায়, নানা পরিকল্পনা গড়িতে ও ভাঙিতে কবির কী আনন্দ।

রবীন্দ্রনাথ নিজে এই নাটকে ঠাকুরদার ভুমিকায় অভিনয় করেন। দ্বিতীয় দিনের অভিনয়ে দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, বালগঙ্গাধর তিলক, মদনমোহন মালব্য, সিএফএন্ড্রুজ প্রভৃতি।

------------------------------------------

[সব তথ্য রবীন্দ্রজীবনী, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এবং ট্রান্সলেটেড লাইভস, মীনা এলেকজান্ডার থেকে সংগৃহীত]

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, অক্টোবর ২০১৭

 

 

 

বিহার বাংলা সাহিত্য সম্মেলন – ২০১৭

১১ই নভেম্বর ২০১৭য় পাটনার রাম মোহন রায় সেমিনারীর প্রাঙ্গণে বিহার বাংলা সাহিত্য সম্মেলন -২০১৭ অনুষ্ঠিত হল। এধরণের প্রয়াস এই প্রথম। উদ্যোক্তাদের ঘোষণাটিও চমকপ্রদ ছিল যে এই সম্মেলন ‘স্বনামধন্যদের নয় ইচ্ছেধন্যদের’ মঞ্চ। অর্থাৎ যাঁরা কবিসাহিত্যিক হিসেবে কমবেশি পরিচিত, তাঁরা থাকুন কিন্তু মঞ্চ ভরিয়ে তুলতে বেশি কাম্য সেই সব বয়স্ক, গৃহিণী ও কিশোর-কিশোরীদের উপস্থিতি যাঁদের লেখা অবরে-সবরে দুর্গাপুজো, কালীপুজোর স্মরণিকায় দেখা যায়। যাঁদের লেখায় মুন্সিয়ানা হয়ত খামতি থেকে যায় অনেক জায়গায় কিন্তু বিহারে বাংলা সাহিত্যের ধারাটির শুকিয়ে আসা খাতে তাঁরাই মাঝে মধ্যে সামান্য জল নিয়ে আসেন। তাঁদের লেখার ইচ্ছেটাই বিহারে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে একটি বড় অস্ত্র।

১১ তারিখের অনুষ্ঠানে যে সাড়া পাওয়া গেল, তা উপস্থিতির বিচারে হয়ত অপ্রতুল, কিন্তু আগামী পথের সন্ধান ছিল তাতে। এমন কবি পাওয়া গেল যাঁরা কবি হিসেবে অপরিচিত ছিলেন, এমন বন্ধু পাওয়া গেল বিভিন্ন রাজ্য থেকে ১২ তারিখের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকে যাঁরা নিজেদের রাজ্যে এধরণের সম্মেলম করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, উদ্যোক্তাদের প্রয়াসকে মুক্তকন্ঠে সাধুবাদ জানিয়ে গেলেন।

বিহারে এই প্রয়াসে সার্থকতা তখনই আসবে যখন সম্মেলনের বার্তাটি নিয়ে জেলায় জেলায় এধরণের বাৎসরিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, বিশেষ করে সেই জেলা গুলোয় যেখানে বাঙালি সমুদায় ভালো সংখ্যায় আছে, সমিতির সদস্য সংখ্যাও ভালো। অন্ততঃ, ভাগলপুর, কাটিহার, দ্বারভাঙা, পূর্ণিয়া, মুজফফরপুর, বেতিয়া, মোতিহারি,  পাটনা... এসব জেলাগুলোতে তো করাই উচিৎ। আগামী এক বছরের মধ্যেই করলে সেটা একটা আন্দোলনের মত হবে, উৎসাহের একটা জোয়ার আসবে।

আইবার পাটনা সম্মেলন

১২ই নভেম্বর ২০১৭য় হল অল ইন্ডিয়া বেঙ্গলী এসোসিয়েশনের পঞ্চম সম্মেলন। তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, ঝাড়খন্ড, গুজরাত, দিল্লী, হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। যেহেতু ইতিমধ্যে সোসাইটি এ্যাক্টে আইবার পঞ্জিকরণ সম্পন্ন হয়েছে তাই এই সম্মেলনে সদস্যতার শুল্ক ইত্যাদি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাজকর্মের পরিধি নিয়ে আলোচনা। আইবার প্রধান কাজ একটা সর্বভারতীয় কেন্দ্রএর মাধ্যমে সারা ভারতের বিভিন্ন ধরণের বাঙালি সংগঠন ও সংস্থাগুলোর মাঝে সম্পর্ক সুত্র স্থাপন করা এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই সাহায্যের পরিধি কি সীমিত নয়? আসামের নির্যাতিত বাঙালিকে কী সাহায্য দিতে পারবে আইবা? কী সাহায্য দিতে পারবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি উদ্বাস্তদের? বাংলা মাতৃভাষার লড়াইয়েই বা কী ভুমিকা গ্রহণ করবে আইবা? আর সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি কৃষ্টির সংরক্ষণে?

প্রশ্নগুলো আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ। তবু আইবা যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে তার ব্যবহারিক তাৎপর্য অনেক। আইবাকে আইবার মতই কাজ করতে দিতে হবে। আরো সংগঠন তো আছে যেগুলো অন্যান্য প্রশ্নে নিরলস ভাবে কাজও করে যাচ্ছে। সব এক সাথেই চলুলনা! সব সংগঠন একই রকম হবে, একই প্রশ্নে একই রকম ভাবে কাজও করবে... এমন তো কোনো কথা নেই, আর থাকা উচিৎও নয়।      

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৭

 

 

যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দীকে সরকারি মর্যাদা দেওয়ানোর জন্য ৪০০ কোটি টাকা? কেন?

হিন্দী ভারতবর্ষের জাতীয় ভাষা নয় আমরা, বাঙালিরা পার্থক্য করতেই ভুলে যাই যে স্টেটএর বাংলা হল রাষ্ট্র আর নেশনের বাংলা জাতি হিন্দী সরকারি রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ অফিসিয়াল ল্যাংগোয়েজ অফ দ্য স্টেট সেটাও ইংরেজির সাথে যৌথ মর্যাদায় এবং অবশ্যই সম্পর্ক ভাষা, লিংক ল্যাংগোয়েজ বা লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা যদি হিন্দীভাষী রাজ্যগুলি মানতে রাজি হয় তাহলে হিন্দী নিঃসন্দেহে হিন্দী জাতীয়তার (তাতে সবকটি হিন্দী রাজ্যের জনতা শামিল হতে রাজি হবে কিনা সন্দেহ আছে) জাতীয় ভাষা হতে পারে

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার ইউএনওতে বা যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দীকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়ানোর জন্য ৪০০ কোটি টাকা খরচ করার প্ল্যান তৈরি করছে!

ডিজিট্যাল প্রযুক্তির এই যুগে, যখন চারদিকে ইংরেজির বোলবালা, ইংরেজিই রোজগারে কাজে লাগছে, সমাজে কিছু মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক/বৌদ্ধিক শক্তির বিভিন্ন কেন্দ্রে সহজে ঢুকবার পথ তৈরি করছে এবং একটা ভেদ তৈরি করছে সমাজে – প্রত্যেকটি ভারতীয় ভাষার ওপর খাঁড়া ঝুলছে সংকীর্ণতর ব্যবহারের – সেখানে কেন এই সুবিধেবাদী তদ্বির?

একটি অনলাইন সংবাদপত্র দ্য ওয়্যার ডট ইনএ একটি সমীক্ষায় লেখক প্রিয়দর্ষন বলছেন, “যখন তারা একটি ভারতীয় ভাষা হিসেবে শুধু হিন্দীকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাবার চেষ্টা করে, তখন অন্যভাষাভাষীরা আহত হয়, তারা ইংরেজীতে সুরক্ষা তালাশ করে আর তাতে এলিটিস্ট, কুলীনতাবাদী ভারতের এজেন্ডাটাই এগোয় ... হিন্দী আরো একটি ফাঁক তৈরি করেছে তৃভাষাসুত্র আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছিল অন্যান্য ভাষাগুলোর কাছাকাছি আসার আমরা তৃতীয় ভাষা হিসেবে সংস্কৃত না শিখে মারাঠি, তামিল, তেলেগু আর বাংলা শিখতে পারতাম সংস্কৃত ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বতন্ত্র বিষয় হতে পারত এতে হিন্দী ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষাগুলোর জন্য এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে হিন্দীর জন্য রোজগার তৈরি হতে পারত সরকারগুলোকে বুঝতে হবে যে ভাষা ইমোশনের ব্যাপার নয় একটা সমাজের মনোজগত প্রতিফলিত করে

ন্যায্য কথা

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 

স্টিফেন হকিংএর চলে যাওয়া

জন্ম – ৮ জানুয়ারী ১৯৪২, অক্সফোর্ড, ইংল্যান্ড

মৃত্যু – ১৪ই মার্চ ২০১৮, কেম্ব্রিজ (নিজের বাড়িতে)

 

১৪ই মার্চ কেম্ব্রিজে তাঁর বাড়িতে স্টিফেন হকিংএর মৃত্যু হল। নামটা লেখার আগে বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক লিখিনি। চলবে তো? মনে হয় চলবে। বৈজ্ঞানিক তো অনেক আছেন পৃথিবীতে। তাঁদের কারো কাজ কম নয়। এমন বৈজ্ঞানিকও আছেন সমসাময়িক, যাঁদের কাজের গুরুত্ব হয়ত স্টিফেন হকিংএর কাজের থেকে বেশি। তাহলে কি তাঁর শারীরিক অক্ষমতাগুলি আমাদের করূণা জাগাতো? তাই তিনি জনপ্রিয় ছিলেন? মানবিক করূণার বিজ্ঞাপনের সামগ্রী হয়ে পড়ে ছিলেন? কিন্তু তা অনেকেরই থাকতে পারে। আধুনিক সময়ে যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাঁর কথা বোধগম্য করা গিয়েছিল, পুরোনো দিন হলে তা হত না, এতদিন হয়ত বাঁচতেও পারতেন না। তাহলে কি ১৯৮৮ তে প্রকাশিত তাঁর সেই কিম্বদন্তি বেস্টসেলার, ‘দ্য ব্রীফ হিস্ট্রী অফ টাইম’ তৈরি করেছিল জনপ্রিয়তা? হতে পারে। কিছুদিনের জন্য হতে পারে। কিন্তু তারপর?

তাঁর জনপ্রিয়তার, আমৃত্যু প্রবহমান জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিল তাঁর অনন্য মানবিকতা। সে মানবিকতায় স্থূল অর্থে ‘কাজের কাজ’ কিছু ছিলনা। হাতে পায়ে অথর্ব, সারাজীবন চলৎশক্তিহীন, তিনি তো আর আফ্রিকা, এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশের কোনো দরিদ্র অঞ্চলে গিয়ে মানুষের সাথে দাঁড়াতে পারতেন না! যা কিছু ছিল তাঁর ক্ষমতা, তা ওই, কথা, মেশিন দিয়ে বলা কথা। কিন্তু সেই কথার জোর মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, এক নামজাদা বৈজ্ঞানিককে নিজেদের সাথে পেয়ে সংগ্রামশীল মানুষ তাঁকে নিজেদের লোক মনে করেছে।

১৯৬৩তেই তাঁর মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ে এবং ডাক্তাররা বলে দেন দু’বছরের বেশি বাঁচবেন না। অথচ তিনি বেঁচে রইলেন আর রোগ ধরা পড়ার ১৬ বছর পরে কেম্ব্রিজে গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর নিযুক্ত হলেন (এই পদে এক সময় স্যার আইজাক নিউটন ছিলেন)।

বলা হয়ে থাকে যে ১৯৯০এর দশকে তাঁকে নাইটহুড দেবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল – দশ বছর পরে জানা যায় যে সে প্রস্তাব তিনি বিজ্ঞানের জন্য সরকারি ব্যয় কম হওয়ার প্রতিবাদে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

কিছুদিন আগে, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর নিজের ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছিলেন, “কেম্ব্রিজে বসবাসকারী একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে আমি আমার জীবন অসাধারণভাবে সুবিধাপন্ন এক বুদবুদের ভিতর কাটিয়েছি। ... কাজেই আমেরিকায় এবং ব্রিটেনে সদ্য, আপাতদৃষ্টিতে কুলীনদের খারিজ করে দেওয়ার ঘটনা, অন্যদের দিকে যেমন, আমার দিকেও আঙুল তোলে। ব্রিটিশ নির্বাচকদের ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যতা খারিজ করা আর আমেরিকান নির্বাচকদের, নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ভরসা করা নিয়ে আমরা যা কিছু ভাবি না কেন, মন্তব্যকারীদের [যাঁরা মিডিয়ায় বিষয়দুটোর ওপর মন্তব্য করছেন – সম্পাদক, সঞ্চিতা] মনে কোনো সন্দেহ নেই যে এই দুটি ঘটনা সেই জনতার ক্ষোভের অভিব্যক্তি ছিল যারা মনে করছিল যে তাদের নেতারা কথা ভুলে গেছে। সবাই মনে হচ্ছে মানছে যে এই ঘটনাদুটো সেই মুহুর্ত ছিল যখন বিস্মৃত মানুষেরা কথা বলে, সর্বর্ত্র কুলীন এবং বিশেষজ্ঞদের উপদেশ আর দিকনির্দেশ ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের কন্ঠস্বর খুঁজে পায়।... এই নির্বাচনদুটোর পিছনে সক্রিয় দুশ্চিন্তাগুলো পুরোটাই বোঝা যায় – বিশ্বায়নের আর্থিক পরিণাম এবং ত্বরান্বিত প্রযুক্তিগত বদল। কারখানাগুলোর স্বয়ংক্রিয় কাজ পরম্পরাগত ম্যানুফ্যাকচারিংএ রোজগার আগেই খেয়ে নিয়েছে। যান্ত্রিক মেধার উদ্ভব ও বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক গভীর অব্দি রোজগার ধ্বংস করবে...

পরিণামে সারা বিশ্বে আগেই বাড়তে থাকা আর্থিক অসমানতা ত্বরান্বিত হবে।”

আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য ছিল লেখাটিতে। এই স্বল্পপরিসরে তা উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। এই কয়েকটি পংক্তিতেই আমরা নিশ্চই বুঝতে পারছি কেমন এক অসামান্য প্রাণ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, মার্চ ২০১৮

 

 

ডিরোজিও

কে ছিলেন হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও? আদ্যন্ত বিলেতি এক নামের মানুষ? এখন যে দিনকাল পড়েছে তাতে যদি বলি যে এই ক্ষণজন্মা তরুণটিই উনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে এক ‘ভারতপ্রেমিক’...! ভারতপ্রেমিক আবার কী? সে তো ইয়োরোপীয় ইন্ডোলজিস্টদের জন্য প্রযোজ্য, ডিরোজিও তো আদ্যন্ত ভারতীয় ছিলেন, জন্মও এখানে, মৃত্যুও এখানে, তাই বলতে হবে দেশপ্রেমিক, দেশপ্রেমের প্রথম ভারতীয় কবিদের একজন এবং উনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণের প্রথম ঢেউটা যাদের কাজেকর্মে শুরু হল, তাদের অনেকেই ডিরোজিওর ছাত্র ছিলেন।

১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে ১৮ই এপ্রিল কলকাতার এন্টালী পদ্মপুকুরে জন্ম গ্রহণ করেন ডিরোজিও। তাঁর বাবা তাঁকে ভর্ত্তি করে দেন সে সময়ের এক নামকরা শিক্ষক ডেভিড ড্রুমন্ডের স্কুলে। কিন্তু বেশিদিন তাঁর স্কুলজীবন চলেনি। ১৪ বছর বয়সে তিনি বাবার কাজে ঢুকে পড়েন, প্রথমে কলকাতায় এবং পরে ভাগলপুরে। ভাগলপুরের গঙ্গার মনোরম নিসর্গ তাঁর কবিহৃদয়কে জাগিয়ে তোলে। কিছু কবিতা কলকাতায় ইন্ডিয়া গেজেটে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে তাঁর বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা, ‘ফকীর অফ জাঙ্গিরা’ ভাগলপুর অঞ্চলেরই কাহিনী। ভাগলপুরে বসেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক ইম্ম্যানুয়েল কান্টের কাজের একটি সমালোচনামূলক সমীক্ষা লেখেন যা কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া জাগায়। ১৮২৮ সালে ডিরোজিও কলকাতায় এসেছিলেন কবিতার একটা বই প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে। এসে জানতে পারেন যে সদ্য তৈরি হিন্দু কলেজে শিক্ষকের একটা পদ খালি আছে। ডিরোজিও আবেদন করেন এবং তাঁরই চয়ন হয়। এরপর আর আড়াই বছর তিনি বেঁচে থাকেন। ২৬শে ডিসেম্বর ১৮৩১এ তাঁর মৃত্যু হয়, মৃত্যুর কারণ এশিয়াটিক কলেরা, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর, ৮ মাস, ৮ দিন। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয় যে এই দুই বছরের শিক্ষক-জীবনে তিনি “আক্ষরিক অর্থে বাংলার তখনকার রক্ষণশীল সমাজে, যার মধ্যে জমিদার, ব্রাহ্মণ এবং নব্যধনীদের একটা নতুন শ্রেণী ছিল, ঝড় তুললেন এবং একটি জাতির ইতিহাসে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর অনপনেয় চিহ্ন রেখে গেলেন। বাংলার নবজাগরণের প্রারম্ভের দিকে এগোবার মানচিত্রটার ওপর যুক্তি আর তর্কের পরম্পরায় এগিয়ে চলার তাঁর অক্লান্ত উৎসাহের স্থায়ী প্রভাব রয়ে গেল।” (সমিত কর, দ্য লিগ্যাসি অফ ডিরোজিও, এ মেসিয়া অফ বেঙ্গল রেনেসাঁ)  

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, এপ্রিল ২০১৮

 

 

বাংলার বাঘ

আশুতোষ মুখার্জিকে বাংলার বাঘই বলা হয় তাই তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে শীর্ষকটা সুপ্রযুক্ত মনে হল স্মরণ করছি কেননা এই মে-জুন তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর মাস তাও এই পাটনা শহরেই একটি মোকদ্দমার শুনানিতে এসে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হয় মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৬৯ বছর  

যদিও তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আজ বরং সেই দিকটা নিয়ে আলোচনা করা যাক যেটি ইষৎ স্বল্পালোচিত বা হয়ত হয়েছে, কিন্তু শক্ত হাতের দক্ষ প্রশাসক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য, বড় গণিতজ্ঞ, বড় আইনজীবী ইত্যাদি গুণের নীচে চাপা পড়ে গেছে

বিদ্যাসাগরের আশীর্বাদধন্য মানুষ এবং তাঁর অনুযায়ী ছিলেন আশুতোষ কাজেই শিক্ষার ব্যাপারে তিনি যে একটি বিরাট স্বপ্নদৃষ্টি নিয়ে কাজ করবেন তাতে সন্দেহ কী? তিনি ছিলেন বলেই সি ভি রমণের মত বিজ্ঞানীকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে আনতে পেরেছিলেন

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “তাঁর বলিষ্ঠ প্রকৃতি শিক্ষানিকেতনে দুরূহ বাধার বিরুদ্ধে আপন সৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্র অধিকার করেছিল এইখানে তিনি সমস্ত ভারতের চিত্তমুক্তি ও জ্ঞানসম্পদের ভিত্তিস্থাপন করতে প্রবৃত্ত ছিলেন তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব ও উদার কল্পনাশক্তি সমস্ত দেশের ভবিষ্যৎকে ধ্রুব আশ্রয় দেবার অভিপ্রায়ে সেই বিদ্যানিকেতনের প্রসারীকৃত ভিত্তির উপর স্থায়ী কীর্ত্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ করেছিল

কিন্তু কোথায় বিশ্বকবি এই কথাগুলো লিখেছিলেন? আশুতোষ মুখার্জির একটি প্রবন্ধের ভূমিকায় প্রবন্ধটির নাম ভারতীয় সাহিত্যের ভবিষ্যৎ! ভাবলে অবাক হতে হয় এই মনষ্বী কিভাবে চিন্তা করতেন ওই প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “স্ব স্ব ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য না হারাইয়া, যাহার যাহা আছে তাহা বজায় রাখিয়া, কী করিয়া ভারতে এক ভাব, এক চিন্তা, এক সাহিত্যের সৃষ্টি করা যাইতে পারে, - কী করিয়া সমগ্রভারতে এক জাতীয় সাহিত্যের নির্ম্মাণ করা যাইতে পারে ... বাঙালী বাঙালীই থাকিবে, পাঞ্জাবী পাঞ্জাবীই থাকিবে, অথচ তাহারা পরস্পরে পরস্পরের যাহা কিছু উত্তম, যাহা কিছু সুন্দর, নির্মল, মনোহর, তাহা নিজের নিজের ভাষায় ফুটাইয়া তুলিয়া ক্রমে, ধীরে ধীরে এক হইতে শিখিবে, ইহাই আমার বক্তব্য ... আমরা এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারি যাহাতে ... বিএ, এমএ উপাধিমন্ডিত বাঙালী যুবক দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হইয়া, বাঙ্গালা সঙ্গে আরো দুএকটা ভারতীয় ভাষা – হিন্দী বা মারাঠী, উর্দু বা তৈলঙ্গী ভাষা শিক্ষা করিবে, ...”

এই ছিল আশুতোষের ভাষাচেতনা সম্পর্কিত চিন্তা শুধু বলেননি, কাজেও করে দেখাতে শুরু করেছিলেন মাতৃভাষাকেন্দ্রিক তৃভাষাসুত্র, যার জন্য আমরা লড়ছি, আশুতোষের স্বপ্ন ও কর্মদৃষ্টি ছিল

এই অক্লান্ত কর্মবীরকে প্রণাম জানাই

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, মে-জুন ২০১৮

 

 

বিহার সরকারের শিক্ষা বিভাগ কি সব মাতৃভাষার সাম্যে বিশ্বাসী ?

মনে হয় না যদি হত, তাহলে এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটাতে পারতো না বিহারে ক্লাস ওয়ান থেকে এইট অব্দি পাঠ্যবই ছাত্রদের নিখরচায় দেওয়ার নিয়ম তারা যাতে সেটা পায় তা দেখার জন্য বিহার শিক্ষা পরিযোজনা পরিষদ রয়েছে যেটি সর্বভারতীয় স্তরে সর্বশিক্ষা অভিযানের অন্তর্গত বইগুলো অবশ্য আর সব পাঠ্যবইয়ের সাথে বিহার রাজ্য পাঠ্যপুস্তক নিগমই ছাপে

বিগত দুবছর বাংলা পাঠ্যবই ছাপা হয়নি সেগুলোর পিডিএফ ফাইল দুটো সংস্থারই ওয়েবসাইটে আপলোড করা ছিল নির্দেশনামা ছিল যে ছাত্রেরা সেই বইগুলো ডাউনলোড করে পড়বে – ডাউনলোড করতে অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রিন্টারে এক কপি ছাপাতে যে খরচ পড়বে তার বিল, স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের অনুমতিক্রমে জেলা শিক্ষা আধিকারিকের দপ্তর থেকে ভুগতান হবে ভেবে দেখুন, গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের একটি শিশু, বাবা, মা, দাদা বা দিদির হাত ধরে সবচেয়ে কাছের সাইবার কাফেতে যাবে (সেটি হয়তো পাঁচ মাইল দূরে); ডাউনলোড করিয়ে, প্রিন্ট করিয়ে, বিল নিয়ে, হেডমাস্টার মশাইয়ের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবে যে এবার পয়সাটা পাওয়া যাবে (হয়তো!) এই তুঘলকী ফরমান মেনেও আমরা শান্তিতে ছিলাম যে শুধু বাংলা নয় আরও কিছু কিছু বিষয়ের বইয়ের সাথে এই ব্যবহার করা হয়েছিল

এবছর কিছুদিন আগে উপরে বিহার শিক্ষা পরিযোজনা পরিষদ এবং নিচে বিহার রাজ্য পাঠ্যপুস্তক নিগমের নাম বড় বড় করে দিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল বিজ্ঞপ্তিটি পুস্তকবিক্রেতাদের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের নামের সূচী, যার প্রতিটির সামনে আলাদা আলাদা প্রিন্টার বা ছাপাই কম্পানির নাম দেওয়া আছে যেখানে বইগুলো ছাপা হচ্ছে বা হয়ে গেছে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে পুস্তকবিক্রেতাগণ যেন তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী বইগুলো সম্পর্কিত প্রিন্টারের কাছে গিয়ে সংগ্রহ করে নেন আরো আরো কথা আছে বইয়ের দামের ভুগতান, রিইম্বার্সমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে যে সমস্ত বইগুলো কাল অব্দি পিডিএফ ডাউনলোডেব্‌ল ফর্ম্যাটে ছিল সে সমস্ত বইয়ের নাম ওই সূচীতে রয়েছে অর্থাৎ সেগুলো ছাপা হচ্ছে এবছর! কিন্তু তাতে বাংলা বই, ক্লাস এক থেকে আট অব্দি কোনোটারই নাম নেই

বিহার বাঙালি সমিতির প্রতিটি শাখা দৃপ্ত কন্ঠে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, খবরের কাগজে সেসব ছেপেওছে, কিন্তু সরকারের শিক্ষাবিভাগের কোনো হেলদোল নেই।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জুলাই-আগস্ট ২০১৮

 

 

 

 

একটি বহির্বঙ্গ পোর্টালের প্রয়োজন

বাংলার বাইরে সারা ভারতে বাংলাভাষী মানুষেরা ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা নিজের নিজের জায়গায় বিভিন্ন ধরণের সংস্থায় সংগঠিতও হয়ে আছেন। কোথাও বাঙালি সমিতি, কোথাও পুজো কমিটি, কোথাও কল্যাণ সঙ্ঘ, কোথাও সাংস্কৃতিক সংগঠন, কোথাও আরো অন্য কিছু! কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যের এইসব সংস্থাগুলোর একে অন্যের সাথে এবং সবার সাথে যথোপযুক্ত যোগাযোগ, সম্পর্ক, বার্তা আদানপ্রদান কি আছে? আমরা, বিহারের বাঙালিরা অন্ততঃ এ ব্যাপারটা নিয়ে কষ্টে থাকি যে অন্যান্য রাজ্যের খবরাখবর জানার কোনো উপায় নেই। রায়পুরের, বিলাসপুরের বা ছত্তিসগড়ের অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী বাঙালিরা এখন কী করছে, বা ভাবছে? রাঁচি, ধানবাদ, জামশেদপুরের বাঙালিরা? বেতুলে বসবাসকারী বাঙালিরা কি এবছর দুর্গোপুজো করবে? পিলিভিতের বাঙালিরা কি তাঁদের কোনো প্রতিনিধিকে ভোটে দাঁড় করাবার জন্য সরব হওয়ার কথা ভাবছেন? গোয়ালপাড়ার বাঙালিরা কি এনআরসি নিয়ে কিছু করছেন, সামাজিক স্তরে? রায়গড়ার উদ্বাস্তু শিবিরে কি স্কুল বাস পৌঁছোচ্ছে এখন? আমরা কেমন আছি, বিহারে, কী করছি তা কি অন্যেরা জানতে পারছেন? মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, দিল্লীর ঈষৎ স্বচ্ছল বাঙালি অধিবাসীরা কি কিছু ভাবেন, প্রয়োজন বোধ করেন যোগাযোগের, সর্বভারতীয় স্তরে, আমাদের মাঝে?

আমরা বিহার হেরাল্ডের প্রকাশনে হাত দিয়ে একটাই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে শেষ অব্দি, অন্ততঃ দক্ষিণ ভারত ছাড়া বাকি রাজ্যের সামান্যতম খবরটুকু পেতে হলে অগতির একমাত্র হিন্দি খবরের কাগজগুলোর স্থানীয় সংস্করণ অথবা তাদের পোর্টালগুলো। স্থানীয় বাজারের কথা ভেবেই হোক, কিম্বা সেখানকার করিৎকর্মা বঙ্গালি দাদার সাথে পরিচয়পাতির খাতিরেই হোক, ছোট ছোট খবরগুলো কিছু কিছু স্থান পেয়ে যায় – উধম সিং নগর মে বঙ্গালি শরণার্থিয়োঁ কী মাংগ... ভিলাই মে রবীন্দ্রজয়ন্তী ... !

ইংরেজি খবরের কাগজের এসব খবরে কিছু যায় আসে না। বাংলা খবরের কাগজের মুনাফাটা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জগতের বাজার ধরেই হতে পারে। 

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, সেপ্টেম্বর ২০১৮

 

জালিয়াঁওয়ালা বাগ হত্যাকান্ডের শতবর্ষ উদযাপন

২০১৯শে দেশ জালিয়াঁওয়ালা বাগ হত্যাকান্ডের শতবর্ষ উদযাপন করছে। আজ থেকে একশো বছর আগে ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল বিকেলে সেই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল। সেদিন ছুটির দিন। বৈশাখী মেলা। গোটা পাঞ্জাবে এবং অমৃতসর শহরে ফৌজি আইন জারি হয়েছে তাই ভয়ে বেশি মানুষ বাড়ি থেকে বেরুতে চাইছিলেন না। তবু, (রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার  প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবিজীবনীতে জানাচ্ছেন “পুলিশের গুপ্তচর হংসরাজের প্ররোচনায় লোকে যথাপূর্ববৎ জালিয়াঁওয়ালা বাগে সমবেত হয়”) কয়েক হাজার মানুষ অমৃতসরের জালিয়াঁওয়ালা বাগ নামের দেয়াল ঘেরা মাঠটাতে জমায়েত হয়েছিল। নতুন বছরের খুশিতে মশগুল তারা টেরও পায় নি কখনো জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে। কোনো প্ররোচনা না থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঢুকবার-বেরুবার একটাই রাস্তা, যেটা সেনাবাহিনীর কব্জায়। কোনোদিকে পালাবার রাস্তা না পেয়ে হাজার খানেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

ইংরেজ সরকার ডাক, তার এবং ছাপাখানার ওপর নজরদারি শুরু করে। খবর ছড়িয়ে দিতে পারে এমন সংবাদপত্র-সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করা হয়। তবু খবর ছড়িয়ে পড়তে খুব দেরী হয়না। বিশ্ব স্তম্ভিত। শহরের মধ্যবিত্ত জগত ভয়াক্রান্ত। জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে কয়েকজনকে ডেকে বলেন একটা প্রতিবাদী সভা করতে – তিনিই সভাপতিত্ব করবেন। কেউ রাজি হয়না। অবশেষে আসে সেই নির্ঘুম রাত। সারা রাত ধরে ভেবে, নিজের ‘নাইট’ সম্মান পরিত্যাগ করার সংকল্প করে ভাইসরয়কে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি আজ ঐতিহাসিক।

জালিয়াঁওয়ালা বাগের নৃশংস হত্যাকান্ড দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন মোড় নিয়ে আসে। দেশের স্বাধীনতা-চেতনায় নতুন মাত্রা যোগকারী ভাবুক এবং নতুন ভারতবর্ষের দুই সর্বপ্রধান দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, দুজনকেই এ ঘটনা ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির তুচ্ছতা নতুন ভাবে চেনায়।

আজও, যে অত্যাচারী শক্তি নিজের পরাক্রম দেখিয়ে জনমানসে ভয় ধরাতে চায়, অত্যাচারের, বর্বর হিংসার প্রতিটি ঘটনায়, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে তাদের তুচ্ছতা যেন নতুন করে চিনতে পারি, প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে পারি। তবেই জালিয়াঁওয়ালা বাগ আমাদের স্মৃতিতে থাকবে।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, এপ্রিল ২০১৯

 

 

রবীন্দ্রপক্ষে বিদ্যাসাগরের ওপর আক্রমণ

রবিঠাকুরের জন্মদিন উদযাপনের অনুষ্ঠান পক্ষকাল ধরে চলে। ঘরোয়া অনুষ্ঠান, ছোটো অনুষ্ঠানও ওই পক্ষের সময়কালেই কোনো একদিন হয়। হয়ত ১৪ই মে সন্ধ্যেবেলাতেও হচ্ছিল! কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামে অথবা ভারতের যে কোনো রাজ্যে! বাংলাদেশে! পৃথিবীতে কোথাও! হয়ত এই বিহারে বা ঝাড়খন্ডেও কোনো জনপদে বাঙালিরা সকাল থেকে সেদিন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সন্ধ্যেবেলার অনুষ্ঠানসূচির! তারই মাঝে তাদের কাছে খবর এসে থাকবে সন্ধ্যেয় – টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় – কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাঙ্গণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মর্মর প্রতিমা দুষ্কৃতিদের আক্রমণে ভুলুন্ঠিত!

অনুষ্ঠান বাতিল হয়নি। হওয়া উচিৎও না। কিন্তু সবাই শিউরে উঠেছিল। কেউ ভাবেনি যে ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি এভাবে হবে। প্রথমবারে যে ঘটনাটির পটভূমির ট্র্যাজিক ব্যাপ্তি সমাজকে মথিত করেছিল, দ্বিতীয়বারে সেই সমাজের অবনতি কমিক ঘটনাবলিতে প্রতিফলিত হবে।

গত শতকের সত্তরের দশকে কলকাতায় বিদ্যাসাগরের প্রতিমা খন্ডন বাঙালিকে বাধ্য করেছিল বিদ্যাসাগর এবং বাংলার নবজাগরণ-প্রসঙ্গকে নতুনভাবে, গভীরতরভাবে জানতে, চিনতে। আজ বিদ্যাসাগরের জীবন ও কৃতিত্ব নিয়ে যত ভালো বই পাই সব ওই প্রতিমাখন্ডনের পরের গবেষণার ফসল।

আর আজকের এই প্রতিমাখন্ডনের পর বাঙালির এক বিরাট অংশকে দেখা গেল একটাই প্রশ্নে ব্যস্ত – কাদের তরফের দুষ্কৃতিরা ভেঙেছে? নিজের নিজের হোয়াটস্যাপে আসা ভিডিও একে অন্যকে দেখিয়ে বলছে – দেখুন, ভিতরের লোকেরাই ভেঙেছে। আরেক দল বলছে – না, এই দেখুন, বাইরে থেকে হামলা চালানো হয়েছিল। এমনকি বাংলা মিডিয়াও একই প্রশ্নে বিভক্ত।

গত শতকের সত্তরের দশকে এসব ভিডিও-ফিডিও, সোশ্যাল-মিডিয়া ইত্যাদি কিছুই ছিল না। তবু সবাই নিশ্চিত ভাবে জানত যে যারা ভেঙেছে তারা অন্যায় করেছে। এর থেকে বড় অন্যায় আর হয় না।

আর আজ? “হ্যাঁ, অন্যায় তো করেইছে, তবে এটা একটা গ্রেটার পলিটিকাল কন্সপিরেসির পার্ট!”

গ্রেটার? বিদ্যাসাগরের প্রতিমা থেকে গ্রেটার?

ঠিকই। আগামী বছর বিদ্যাসাগরএর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী আয়োজনে আমরা যত বড়ই প্রস্তুতি নিই না কেন, আমরা, রবিঠাকুরের ভাষায় বাঙালিই থাকব, বাঙালি থাকাটাই সুখকর মনে হবে - মানুষ হয়ে উঠতে চাওয়ার যে বড় ঝামেলা, কে পোষাবে?    

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, মে ২০১৯

 

 

 

বৃষ্টি, বৃষ্টি

এছাড়া আর কীই বা ভাবা যেতে পারে? অভাবে, অপেক্ষায়, হাহাকারে অথবা তৃষিত মাটি ও মানুষের পরম প্রাপ্তিতে! তাই জুন মাসের সঞ্চিতার সম্পাদকীয়ের জন্য একটাই বিষয় বা প্রসঙ্গ ভাবা গেল – বৃষ্টি!

যদিও এ বৃষ্টির শব্দে লুকিয়ে থাকতে পারছে না জুন মাসের ভয়াবহ খবরগুলো। গ্রীষ্মের দাবদাহে বিহারে একশোর বেশি মানুষের মৃত্যু, মারক এন্সেফেলাইটিসে শুধু মুজফফরপুরেই দেড়শোর বেশি শিশুর মৃত্যু, অধিকাংশ জেলায় খরার প্রকোপ... আর সারা ভারতে, শুধু ভারতে কেন সারা বিশ্বে আসন্ন তীব্র জলসঙ্কট। বহু জায়গায় জল নিয়ে মারকাট শুরু হয়ে গেছে।

লুকিয়ে থাকতে পারছে না কেননা এই এক মরশুমের বৃষ্টিতে যদি খামতি নাও থাকে, যদি অতিবৃষ্টিও হয়ে যায়, তবুও ভূগর্ভের জলস্তর দুশ্চিন্তা দূর করার মত জায়গায় ফিরে আসতে যাচ্ছে না। উপগ্রহ থেকে নেওয়া উত্তরমেরুর কমতে থাকা বরফের আস্তরণের ছবি দেখে ভয় হয়। দক্ষিনমেরুতে নাকি পেঙ্গুইনের একটা পুরো কলোনিই হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেদিন ক্রেণে ওঠানো একটা মৃত তিমির ছবি দেখলাম যার মুখ আর ছেঁড়া পেট থেকে টন টন প্লাস্টিক বেরিয়ে আসছে। সারা পৃথিবী যদি মেঘে মেঘে অন্ধকার হয়ে যায় আবার সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগটার মত যখন, কার্বনে জলের উপর্যুপরি অভিঘাতে প্রথম জৈব যৌগ ও ফলে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল, তবুও কি ধনতান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসন থেকে এই গ্রহের সেই বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে, যা দুই শতাব্দী ধরে ধ্বংস হয়ে চলেছে?

সেদিন কথা হচ্ছিল ডাক্তারবাবুর সাথে। ডাক্তারবাবু বলছিলেন যক্ষ্মা, এখন আর শুধু সাধারণভাবে যাকে যক্ষ্মা বলে জানি সে ছাড়াও, মাল্টি-ড্রাগ-রেসিস্ট্যান্ট এমনকি অল-ড্রাগ-রেসিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে চলেছে। আমার মনে পড়ল রাজ কাপূরের ‘আহ’ ছবিতে শেষের দিকের একটা দৃশ্যে নায়কের চিকিৎসকের সংলাপ। নায়ক (রাজ কাপূর) এর অভিভাবককে তিনি বলছেন, তাঁর হাতে যদি দেড় থেকে দু’বছর সময় থাকত, তিনি এই রোগীকে নিশ্চিত বাঁচিয়ে নিতে পারতেন। কেননা, (তিনি বলে চললেন) সারা পৃথিবীতে যক্ষার ওষুধ নিয়ে গবেষণা একটা নির্ণায়ক জায়গায় পৌঁছেছে – দেড় থেকে দু’বছরের মধ্যে এমন ওষুধ আমাদের হাতে আসবে যাতে যক্ষ্মায় আর কেউ কোনোদিন মরবে না। কিন্তু এই রোগীর আয়ু মাত্র কয়েক মাস। এর মৃত্যু তো অবধারিত!

আমার মনে আছে, ওই ছবিটা পুরোনো সিনেমা হিসেবে দেখার বয়সে অর্থাৎ সত্তরের-আশির দশকে কারুর যক্ষ্মা হয়েছে শুনলেই আমরা খুব সহজে জন্মবোদ্ধার মত বলতাম, “ও কিচ্ছু না, যক্ষ্মা আজকাল একটা অসুখ নাকি! ওই স্ট্রেপ্টোমাইসিন আর আইসোনেক্স পাস দেবে (ভারতে ঘরে ঘরে ডাক্তার তো), নিয়মিত খেতে হবে আর হ্যাঁ, একটু ভালো খাবার খেতে হবে, ব্যাস সেরে যাবে। বরং স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়ে যাবে ভালো খাবারের জেরে!”

আর আজ – ২০১৯এ? অল-ড্রাগ-রেসিস্ট্যান্ট টিবি! কোনো ওষুধেই সারবে না? অবধারিত মৃত্যু? সত্তর বছরের উন্নয়নী কর্মযজ্ঞের নীটফল তাহলে কী?

যক্ষ্মার কথাটা ওই এইএস (অকজিলারি এন্সেফেলাইটিস সিন্ড্রোম) এ পটাপট মরতে থাকা বাচ্চাগুলোর প্রসঙ্গেই মনে এল। কী মানে উন্নয়নী জাঁকজমকের, ফ্লাই-ওভার আর মলের, যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর রোজগারের তিনটে মূলভূত সমস্যার সমাধানের দিকে আমরা এক পা এগুনো তো দূরের কথা, ক্রমাগত পিছিয়ে আসতে থাকি?

বৃষ্টির ঝিরঝিরে পর্দায় আর মনমাতানো সঙ্গীতে এসব কোনো প্রশ্ন থেকেই মনকে সরানো যাবে না। তবু বৃষ্টি তো বৃষ্টিই। জ্বর হলে হোক! একটু প্রাণ খুলে ভিজে নিই! ...  

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জুন ২০১৯

 

 

অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনের ২৫ বছর

এখনও শুনতেই যেন কেমন লাগে, না? জীবিত মানুষের অঙ্গদান তো না হয় তার নিজের ইচ্ছের ব্যাপার, যাকে দিচ্ছে তার সাথে সম্পর্কের ব্যাপার। কিন্তু মরণোত্তর দেহদান! তারপর তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিস্থাপন! চোখ – খুবলে তুলে নেবে! মূত্রাশয়, যকৃৎ, পিত্ত ... কেটে বার করে নেবে! সময় থাকলে হৃৎপিণ্ডও!

অথচ আগুনে ছাই হবে সবই। মাটিতে পুঁতলে কিছু দিনে সব মাটিই হবে। সেটাও এক দান। অগ্নিকে দান। মৃত্তিকাকে দান। যে পৃথিবীতে জন্ম নিলাম, আবার সেই পৃথিবী হলাম। দানের সাথে থাকে স্বপ্ন – নদীর জলে ভেসে ছাই মিশবে মাটিতে, দেহ গলে-পচে মিশবে মাটিতে, পৃথিবীর বুকে সবুজ শস্য ও ফলন হয়ে থাকব।

এখানেও কিন্তু সেই দান, মানুষকে দান। আর স্বপ্ন! কত রকমের! কারো চোখ হয়ে বাঁচব। কারো বুকে ধুকপুক করে ভালবাসব জীবন। কারো শরীরের সুস্থতা ফেরাব জরুরি যন্ত্র হয়ে। আরো আছে। আমার দেহ কেটে চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্ররা দেহযন্ত্রের জটিল নির্মিতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পাবে, হয়ত কঙ্কালটাও থাকবে দাঁড়িয়ে কোনো ক্লাসরুমে। যে মানুষ-সমাজে জন্ম নিলাম, সেই মানুষ-সমাজে রইলাম!

ব্যাপারটা সহজ ছিল না। এখনও সহজ নয়। এত কথার পরও সত্য এটাই যে ভারতে আজও পাঁচ লক্ষের ওপর মানুষ কোনো না কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অভাবে মারা যায় প্রতি বছর। আর এই সত্য সামনে রেখেই আমরা ভারতে ‘মানব-অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন – ১৯৯৪’এর পঁচিশ বছর উদযাপন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি।

এবারের বিহার হেরাল্ডে এ বিষয়ে একটা বড় প্রবন্ধ আছে। লিখেছেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় আমাদের সমিতির সভাপতি ডাঃ দিলীপ কুমার সিংহ। সঞ্চিতার সীমিত পরিসরে পুরো প্রবন্ধটার অনুবাদ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে একটি অংশ, যাতে সহজ প্রশ্ন আর উত্তরের মাধ্যমে অঙ্গদান নিয়ে মনের সন্দেহগুলোর নিরসন করা আছে, এই সংখ্যার ভিতরের পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা হল। প্রবন্ধটাতে লেখক অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন। দেখিয়েছেন যে কোনো ধর্মগ্রন্থেই অঙ্গ প্রতিস্থাপন (বা আরো বিশেষভাবে এক মানুষের অঙ্গ আরেক মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন) নিয়ে কিছু বলা নেই। কাজেই সব ধর্মেই কিছু কিছু মৌলবাদী অংশ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিরোধিতা করে। কিন্তু সাধারণভাবে সব ধর্মেরই প্রগতিশীল অংশ অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

গত ছয়ই জুলাই কলকাতায় ‘গণদর্পণ’ সংস্থার প্রযোজনায় এ বিষয়ে একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেই কর্মসুচি নিয়ে যে প্রতিবেদন ৭ই জুলাই দৈনিক ‘গণশক্তি’তে প্রকাশিত হয় তার একটি প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করছিঃ

“প্রসঙ্গত, ১৮৩২ সাল থেকে শুরু হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে মানুষের মৃতদেহকে কাজে লাগানো। ভারতবর্ষে ১৯৫৬ সালে এবং এরাজ্যে [পশ্চিমবঙ্গে] ১৯৯০ সাল থেকে সংগঠিত রূপে মরণোত্তর দেহদান শুরু হয়। ... শহর-রাজ্য পেরিয়ে সারা দেশে এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ... বিভিন্ন সংগঠনের তরফে ভারত সরকারের কাছে এ বিষয়ে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া জমা দেওয়া হয়। ভারতের আইনসভা ১৯৯৪ সালে আইনটি পাশ করেন। পরে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেক রাজ্যই নিজ নিজ বিধানসভায় আইনটি পাশ করিয়েছেন। উল্লিখিত আইনের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি হয় যে ক্রয়-বিক্রয় না করে অনেক প্রত্যঙ্গ, কলা [টিস্যু], মৃতদেহ নিয়ে অসুস্থ মানুষের স্বার্থে প্রতিস্থাপন করা, গবেষণা করা এবং হবু ডাক্তারদের পড়াশুনার কাজে ব্যবহার করা [যাবে]। এই আইনের বলে বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিস্থাপনের বিষয়টি ক্রমশঃ প্রসার লাভ করছে। তবে এ বিষয়ে এখনও মানুষকে সচেতন করে তোলার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রচার সংগঠিত করার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেন চিকিৎসক থেকে সমাজ সচেতন বিশিষ্টজনেরা।”

এটাই আমাদেরও বক্তব্য হওয়া উচিৎ। বিশেষ করে ভাগলপুর শাখা সহ বিহার বাঙালি সমিতির বিভিন্ন শাখাগুলো যখন রক্তদান বিষয়ে এত সচেতন ও সক্রিয়, ‘মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গদান বিষয়ে’ মানুষকে সচেতন করে তোলার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রচার সংগঠিত করার কাজে তারা নিশ্চয়ই সচেতন হবে।।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জুলাই ২০১৯

 

 

স্বাধীনতা উদযাপনের মাস

আগস্ট মাস, শ্রাবণ আর ভাদ্রের বৃষ্টি ও বৃষ্টিহীন দাহে বেশ কয়েকটি উদযাপনের মাস। বাঙালির বাইশে শ্রাবণ আছে, হিন্দি অঞ্চলে জনপ্রিয় আগস্ট ক্রান্তি দিবস ৯ই আগস্ট আছে, আমরা যারা মনিষীদের স্মরণে রাখতে চাই তাদের জন্য ২রা আগস্ট আছে, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মদিবস... কিন্তু সবচেয়ে বড় উদযাপন স্বাধীনতা দিবস।

জানি, ভিতরের মানুষটা ঠোঁট বেঁকাবে, “কিসের স্বাধীনতা?” তার গোনাতে থাকা ফিরিস্তির একটাও মিথ্যে নয়, দারিদ্র্য, বেকারি, শোষণ, বঞ্চনা, গণতন্ত্রের নামে ধনকুবেরদের দৌরাত্ম ও অপশাসন... তবু, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন এমন একটা পথ যাতে সকালের আলোয় পা রেখে আমরা আমাদের শিশুসন্তানদের হাত ধরে এগোই। কখনো আমরা তাদের ঘুম ভাঙাই, কখনো তারা আমাদের ঘুম ভাঙায়। কখনো তারা আমাদের টানে, কখনো আমরা তাদের টানি। কিন্তু একে অন্যের জন্য, ওই পথটায় হেঁটে, পৌঁছোতে চাই অবশ্যই।

আগস্টে আরো একটা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হই আমরা। অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি। বন্যা ও খরা। ১৬ আগস্টের ডেক্কানহেরাল্ড জানাচ্ছে যে এবছর বিহারের উত্তর দিকে ১৩টা জেলায় বন্যার প্রকোপ আর দক্ষিণ দিকের ১০টা জেলায় খরার প্রকোপ। বিহারের কোশি প্রভাবিত অঞ্চলে জুলাইয়ের শেষ থেকেই ঘরে জল ঢুকতে শুরু করেছে। একটা বড় খবর যে এবার কোশির জল মেচি নদী হয়ে মহানন্দায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। তাহলে প্রতি বছর বন্যার আশঙ্কাও যেমন কমবে, আরারিয়া, কাটিহার, কিশনগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় ২ লক্ষের বেশি চাষজমি সেচের জল পাবে। অন্যদিকে দক্ষিণবিহারের খরাপ্রভাবিত জেলাগুলির সমীক্ষা করে মুখ্যমন্ত্রী চাষীদের ডিজেলে ভর্তুকি দিতে বলেছেন। অর্থাৎ মাটির নিচের জল আরো বেশি করে তুলে আপাততঃ ফসল বাঁচানো হবে। তাহলে ভুগর্ভের জলস্তর আরো কতদূর নামবে?

আমরা বিহারের মানুষ। একচোখ ভরা জল আর একচোখ ভরা দাহ নিয়ে জাতীয় পতাকাকে সেলাম জানাই। কখনো জলটা আনন্দাশ্রু। কখনো দাহটা সংকল্পের তেজ। মনে আছে, কয়েক বছর আগে নির্ভয়ার ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে যে মিছিলের জোয়ার উঠেছিল দিল্লির রাজপথে, তার শরিক একজন, নিজের সন্তানের হাত ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন যে এমন সুযোগ জীবনে কম আসে।

সত্যি কম আসে। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস বছরে একবার সে সুযোগটা করে দেয়। আমরা আমাদের সন্তানদের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই সব অনেক প্রতিশ্রুতির কথা বলি যা এখনো পুরো হয়নি। পুরো করার আহ্বান ওই স্বাধীনতা দিবস আর আকাশে অল্প অল্প হিল্লোলিত হতে থাকা জাতীয় পতাকা।    

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও বেঙ্গল কেমিক্যালস

রবিঠাকুরের সমসাময়িক এই মানুষটি একাধারে বিশ্বখ্যাত রসায়নবিদ, আবিষ্কারক,  ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার অগ্রপথিক, ঘোর স্বদেশী ও স্বাধীনতাপিপাসু শিক্ষাচার্য (ইংরেজদের খাতায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত) এবং ভারতের অগ্রণী উদ্ভাবক-উদ্যমীদের একজন। বাঙালি শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত মানস অন্য অনেক দেশের মত বিজ্ঞান ও শিল্পসচেতন হলে প্রাতঃস্মরণীয় এই আচার্যের ছবি ঘরে ঘরে টাঙাতো, বিশ্বকবির পাশে, কিন্তু দুঃখের কথা, তা তারা নয়, আর তাই প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মতিথি জোর করে মনে করাতে হয়। ফুটপাতে ছবির পসরাতে এনার ছবিও কম পাওয়া যায়। জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মতিথিও মনে করাতে হয়। তাঁর ছবিও কারোর ঘরে পাওয়া যাবে না।

যদি বা মনে করেও নিই, সমস্যা হবে যে উদযাপন করব কিভাবে! রবিঠাকুরেরটা তো সহজ – কিছু গান, কিছু নাচ, কিছু আবৃত্তি আর কিছু ভাবুক ভাবুক কথা। কিন্তু বৈজ্ঞানিকের জন্মদিন উদযাপনে তো বৈজ্ঞানিক ‘নাচ-গান-আবৃত্তি’ হওয়ার কথা – তা পাবো কোথায়?

যাঃ, ‘বৈজ্ঞানিক নাচ-গান-আবৃত্তি’! তা আবার হয় নাকি!

হয় তো! একটু বুদ্ধি খাটাতে হয়।

কিন্তু সে যাক। পরের বছর উদযাপনের প্রস্তাব এলে নাহয় বলা যাবে। আপাততঃ বলার এটুকুই যে সেই প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নিজের হাতে ১৯০১ সালে গড়া, ভারতের প্রথম ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা, শতাব্দী-প্রাচীন বেঙ্গল কেমিক্যালস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ১৮ই জুলাইয়ের আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বিলগ্নিকৃত করার, চার বছর আগে নেওয়া সিদ্ধান্ত এবার কার্যকর হবে।  

সংস্থাটা পশ্চিমবঙ্গে। তবে আমরা বিহার থেকে নৈতিক প্রতিবাদ জানাতে পারি। আরো এই জন্য যে সংস্থাটা লাভের মুখ দেখছিল। সংস্থার বর্তমান প্রধান ভরসা দিয়েছিলেন যে কয়েক বছর পরেই সংস্থাটি ‘মিনি-রত্নে’ পরিণত হবে। আমরা প্রতিবাদ জানাই এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে অনুরোধ জানাই যে তাঁরা যেন এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কথা বলেন, যাতে এই বিলগ্নিকরণ আটকানো যায়।      

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, আগস্ট ২০১৯

 

 

এন.আর.সি.

ভারতবর্ষ তো ছিল? না কী? ছিল না! ১৯৭১এর আগে? ১৯৪৭এর আগে? কখনো এক ছিল। কখনো ছিল না। অবিভক্ত ছিল। বিভক্ত হল। নিজেরই ভিটেতে দাঁড়িয়ে মানুষকে শুনতে হল, তুমি এখন এখানে অবাঞ্ছিত। যাও, তোমার পুরোনো দেশের সেই অংশে যাও যেটাকে এখন তোমার দেশ বলে দাগ কেটে দিয়েছে শাসকেরা। এটা এখন তোমার বিদেশ। ...

গেল সে। গিয়ে শুনল, ও, তুমি তো ওদেশ থেকে এসেছ! তুমি এখানে উদ্বাস্তু! মস্করাও শুনতে হল – “যে নিজের দেশের জন্য প্রাণ ত্যাগ করে তাকে বলে শহীদ, আর যে নিজের প্রাণের জন্য দেশ ত্যাগ করে তাকে বলে উদ্বাস্তু!” মাথা হেঁট করে শুনল সে। তার মনে পড়ল সীমা পার হওয়ার সময় কী হয়েছিল তার মা, তার বৌ তার মেয়ের সাথে, কী হয়েছিল খুঁটে বাঁধা টাকা কটার, বউয়ের কোমরে লুকিয়ে রাখা বহু কষ্টে জোটানো মেয়ের বিয়ের গয়নাগুলোর।

সত্যিই তো, কী বলবে সে? মাথা হেঁট করে শুনে গেল দশকের পর দশক ধরে যে সে বিদেশ থেকে এসেছে, সে এদেশের মানুষ নয়। শুনতে শুনতে সে ভুলে গেল যে ভারতবর্ষ ছিল। আবহমান কাল ধরে ছিল, আছে, থাকবে। সে ভারতবর্ষেরই মানুষ। তার দোষে তার দেশটা আজ তিন দেশে ভাগ হয়নি। কোনো শাসক, কোনো আইনের বা সমঝোতার চোথা দেখিয়ে তাকে বিদেশী সাব্যস্ত করতে পারে না, পারবে না। শাসক চলে যাবে, সে থাকবে। এই পরম সত্যটা সে ভুলে গেল।

আর তাই, এখনও অব্দি পশ্চিমবাংলায় এখনও অব্দি কুড়ি জন মানুষ এন.আর.সি.র ভয়ে আত্মহত্যা করেছে। যখন নাকি সে রাজ্যের বিধানসভায় শাসক দল ও বিপক্ষ দলগুলোর বড় অংশ একযোগে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে পশ্চিমবাংলায় এন.আর.সি. হবে না।

বিহারের বাঙালিদের মধ্যে এখনও অব্দি আত্মহত্যার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বিধানসভায় কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নি কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন যে বিহারে এন.আর.সি. হবে না। আর তাছাড়া বিহারের বাঙালিদের একটা লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তো আছেই। ১৯৩৮এর সেই ডোমিসাইল নিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই। মাটি আঁকড়ে থাকতে তারা জানে।

জানতে হবে, সবাইকে। ধর্মের নামে আলাদা করা তো যাবেই না। সব ধর্মবিশ্বাসের স্থান আছে, থাকবে এখানে।

কেহ নাহি জানে কার আহবানে কত মানুষের ধারা

দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা

হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন

শক-হুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন

 

রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে

ভেদি মরুপথ পর্বত গিরি যারা এসেছিল সবে

তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে কেহ নহে দূর দূর

আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তারই বিচিত্র সুর

 

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, সেপ্টেম্বর ২০১৯

 

 

 

 

রাজধানীর জনবাণী

পুজোর ঠিক মুখে পাটনার মানুষ লাগাতার চারদিন বৃষ্টির মুখে পড়ল। এমন বৃষ্টিও নতুন নয় আর বৃষ্টিজনিত জলে রাস্তাঘাট, বাড়ির নিচের তলা ডুবে যাওয়া, মানুষজনের দুর্ভোগও নতুন নয়। সারা ভারতবর্ষে তো বটেই, এই বিহারেও বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে এই বর্ষাকালে হয়ে থাকে। বড় বড় শহরে হলে খবর হয়, ছোটো শহরে হলে তাও হয়না। পাটনার এই বৃষ্টির আগে থেকেই তো উত্তর বিহারের অনেকগুলো জেলা বন্যার কবলে ছিল, খবর হয়েছিল? সেখানকার মানুষজন কষ্টে ছিল, তারা মেনেও নিয়েছে এই কষ্ট প্রতিবছরের, কিছু করার নেই। সরকারি আমলারা বরং অধীর প্রতীক্ষায় রাজধানীর দিকে তাকিয়েছিল – কবে বন্যাকবলিত জেলার নামে গ্রান্ট ইত্যাদি আসবে, এলে নিজেদেরও কিছু গুছিয়ে নেওয়া যাবে ...।

কিন্তু পাটনার বৃষ্টিতে কিছু হাস্যকর দৃশ্যের অবতারণা করল। দুর্ভোগ তো ছিলই – রাজেন্দ্রনগরে, কঙ্করবাগে ফ্ল্যাটে অথবা বাড়িতে দিনের পর দিন জলবন্দি অবস্থা, গরীবের ঘরে কোমর জল, বেসমেন্ট স্তরে দোকানে কোমর জল, গাড়ি জলের তলায়, খাবার শেষ, ইলেক্ট্রিসিটি নেই, তারপর দিনকর চৌমাথায় জলের ভাসা পেট্রলে অগ্নিকান্ড,...পোকামাকড়, অসুখ ...! কিন্তু হাস্যকর ছিল প্রশাসনের সসেমিরা অবস্থা। আর সেটাই মানুষের ক্ষোভের কারণ হল। উনচল্লিশটার মধ্যে আটত্রিশটা সাম্প কাজ করছে না, আর সেটা ঠিক জল বার করতে গিয়ে জানা গেল? পৌরসভার কর্ত্রী জানেনই না শহরের প্ল্যান বলে কিছু আছে কিনা! আমতা আমতা করছেন! উপমুখ্যমন্ত্রী অসহায়ের মত একটা বারমুডা পরে দাঁড়িয়ে আছেন ওভারব্রীজের ওপর! তাঁকেই উদ্ধার করে আনতে হয়েছে তাঁর বাড়ি থেকে! মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, হাথিয়া নক্ষত্রের বৃষ্টি এমনই হয়! (হয় সে তো আমরাও জানি মন্ত্রীজি, কিন্তু কোনোবার এভাবে উলঙ্গ হয়ে যায় না এই প্রাচীন শহরটার বর্তমান অবস্থা – তাই হাথিয়া-টাথিয়া না বলে একটু আশ্বাস দিয়ে শুরু করতেন বরং!)

যাই হোক, সবই হল। যুদ্ধস্তরে কাজ শুরু হল। পাটনার এই অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা এমন জবর খবর হল যে ছিয়াত্তরের জলপ্লাবনও ম্লান হয়ে গেল। পুনপুনের বাঁধ তৈরি হওয়ার আগে অব্দি শহরের দক্ষিণভাগের অনেকটা এলাকা বর্ষাকালে জলমগ্ন থাকা – সে তো খবরই হয়নি কোনোদিন।

যেমন এই বন্যার আগে অব্দি খবর হয়নি, স্মার্টসিটি হওয়ার দলে নাম লেখানো এই শহরটায় ১৯৬৮র পর থেকে এই একান্ন বছরে বর্জ-নিষ্কাশন প্রণালীর উন্নতি না হওয়া। যখন নাকি জনসংখ্যা, বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধী সেতু হওয়ার পর, তীব্র হারে বেড়েছে। খবর হয়নি যে, যে জার্মান কোম্পানিকে শহরটার বর্জ-নিষ্কাশন প্রণালী আর ঝড়জল-নিষ্কাশন প্রণালীর উন্নতিসাধনের পরিকল্পনা করার বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার গত দুবছরে ডিপিআর দিতে পারেনি কেননা তারা হদিশই পাচ্ছেনা, কিসের ওপর তাদের পরিকল্পনা দাঁড় করাবে, আগে যা কিছু হয়ে আছে মাটির নিচে, তার কোনো মানচিত্র কোথাও আছে কিনা!

সেই ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহা মহাশয় ভারতের নদী বিষয়ে বক্তৃতায় বলেছিলেন, প্রাচীন মৌর্যকালীন পাটলিপুত্র শহর সতেরো ফুট মাটির নিচে চলে গেছে। আপাততঃ আমরা দেখি, এই রাজধানী-শহরের উন্নয়ন কত বাঁও বিভ্রান্তির তলায় গেলে শুরু হবে!        

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, অক্টোম্বর ২০১৯

    

 

 

 

 

বাঙালি বনাম বাঙালি  

৬ই ডিসেম্বর ২০১৭এ রাজস্থানের রাজসমন্দে এক উন্মত্ত হত্যাকারী, এক বাঙালি শ্রমিককে প্রথমে কুপিয়ে ও তারপর পুড়িয়ে মেরে, ও একই সঙ্গে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করল। ১লা নভেম্বর ২০১৮এ আসামের তিনসুকিয়ায় পাঁচজন বাঙালি শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করল একটি অসমিয়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ২৯শে অক্টোবর ২০১৯এ কাশ্মীরের কুলগামে পাঁচজন বাঙালি শ্রমিককে একটি কাশ্মীরী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলি করে হত্যা করল।

আগে দুটো প্রশ্ন ধরে এগোই। একটি খুব পরিচিত আক্ষেপ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। “কেন? বাঙালিই কেন?” – উত্তরে বলতেই হবে যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহে ভারতে ধর্মের পরেই আসে ভাষিক পরিচয়, আর সে পরিচয় নিয়ে দেশের বেশির ভাগ রাজ্যে বাঙালি সহজলভ্য শিকার। কেউ এতেই আবার লাইন নিতে পারেন – “রাজস্থানে তো বাঙালি মুসলমান!” – হ্যাঁ, কাশ্মীরেও বাঙালি মুসলমান, অর্থাৎ নির্যাতিত হওয়ার যুগল পরিচয়। আর আসামে বাঙালি হিন্দু। কোনো প্রয়োজন আছে কথাটাকে ঘুরিয়ে ওদিকে নিয়ে যাওয়ার?  

দ্বিতীয় প্রশ্নটিও একই ধরণের, কিন্তু সেটির চর্চা শুধু বামপন্থী আলোচনাতেই হয়ে থাকে। “কেন? শ্রমিকই কেন?” – এ প্রশ্নেরও উত্তর ওইভাবেই দেওয়া যেতে পারে যে শোষিতের ওপর অত্যাচারের রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যে অত্যাচারের সহজলভ্য শিকারগুলির একটি যেমন দলিত জাতিসমূহ, অন্যটি প্রবাসী বা পরিযায়ী শ্রমিক।

এবং এই দ্বিতীয় প্রশ্ন থেকে তৃতীয় প্রশ্নের দিকে এগোনো যাক। বাঙালির হল কী? যে বাঙালি নাকি বাংলা ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না, কলকাতাবাসী বাঙালি নাকি কলকাতা ছেড়েই নড়তে চায় না, আর যে বাঙালি-সংস্কৃতির দেশজোড়া খ্যাতি ধুয়ে খাচ্ছে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির নবজাগরণী ‘সম্ভ্রান্ত আরাম’, সেই বাঙালির শ্রমিক-জাত আজ এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে? কেরলে কৃষিফার্মে বাঙালি শ্রমিক, বেঙ্গালুরুর মহানগরপালিকার আবর্জনা সংগ্রহের কাজে বাঙালি শ্রমিক, মুম্বইয়ে রমরমা গয়নার ব্যবসার পিছনের বড় বড় কর্মশালায় বাঙালি স্বর্ণকার-শ্রমিক, আহমদাবাদে, সুরতে জমজমাট কারবারি আবহাওয়ায় বাঙালি শ্রমিক, কাশ্মীরে, হিমাচল প্রদেশে ... কোথায় নেই! ঘরের কাজের লোক, ঝি হিসেবে তো বাঙালি শ্রমিক মহিলাদের খ্যাতি তো আছেই – গুড়গাঁওয়ে তো তারা মিছিল করছে, হত্যা, ধর্ষণের প্রতিবাদ করছে! আর রাজমিস্ত্রি হিসেবে তো বাঙালিদের তুলনা নেই। বিহারে হোক বা অন্য প্রদেশে হোক, বিল্ডারের সাথে বা ব্যক্তিগতভাবে নিজের বাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত কোনো ছাপোষার সাথে কথা বলুন, শুনবেন বাঙালি রাজমিস্ত্রির হাতের কাজই আলাদা।...

ব্রিটিশ আমলে সারা এশিয়া-প্যাসিফিক, ক্যারিবিয়ান ও আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি কুলি যেত বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে। কিন্তু তার সাথে বাঙালিও যে যেত, সেটা মানিকবাবুর ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে পড়লেও তেমন গা করিনি। আসামের চা বাগানের কাজে বাঙালি ম্যানেজার, কেরাণির কথা জেনেছি, আর কুলি-বস্তিতে আদিবাসি শ্রমিকদের সংস্কৃতি নিয়ে ভাবালু হয়েছি কিন্তু বাঙালি শ্রমিক ও চাষিদের যে ধরে ধরে এনে বসবাস করানো হয়েছিল আসামে, চা বাগানে বা অন্যান্য কাজে, তা জেনেছি এই সদ্য, এনআরসি নিয়ে তর্কাতর্কিতে মেতে।... বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়ে যে ঘরের টান ছেড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, পুণে, অথবা দিল্লি, গুড়গাঁও ইত্যাদি শহরের আইটি সেক্টরে (শুধু ভারতের কথাই বলছি), তা আমরা জেনেছি, ফলাও করে বলেছি, গর্ব করেছি কিন্তু চাষের কাজ থেকে ঘরের কাজ অব্দি সবক’টি ক্ষেত্রে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের এই অবাধ বিচরণ আজ দেখতে পাচ্ছি।

কিন্তু আজও, সত্যিই দেখতে পাচ্ছি কি? যদি দেখতে পেতাম তাহলে অনেক আগে থেকেই অনেক কিছু দেখতে পেতাম। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের কথা ছেড়েই দি। বিহারের পাটনা শহরের বাঙালি কি জানত না বেতিয়ার কাছের গ্রামগুলোতে বাঙালি চাষি ফসল ফলাচ্ছে সত্তর বছর ধরে, রিক্সা চালাচ্ছে, ঠেলায় দোকান সাজাচ্ছে? লখনৌয়ের বাঙালি জানতো না উধম সিং নগরের বাঙালি শ্রমজীবী পরিবারের কথা যারা চানাচুর বানিয়ে বিক্রি করছে? রায়পুর, বিলাসপুরের বাঙালি, ভিলাইয়ের বাঙালির কয়জন, যাওয়া তো দূরের কথা, ঘরে বসেও খেয়াল করেছিল যে ছত্তিশগড়ের উস্বাস্তু গ্রামে বসবাসকারি হাজার হাজার বাঙালি রায়পুরের রাস্তায় মিছিল করে তপশীলী জাতির অধিকার আর জমির পাট্টা দাবি করছে? তারা কি জানে যে উদ্বাস্তু মধ্যপ্রদেশ, বিদর্ভের সীমায় বেতুলেও আছে? রাঁচি, জামশেদপুর ছাড়ুন, খোদ কোডারমার বাঙালি কি কোডারমার উদ্বাস্তু পল্লীর কথা জানে? দ্বারভাঙার বাঙালি জানে তাদের শহরের উদ্বাস্তু পল্লীর কথা? বেঙ্গালুরুতে কোটি কোটি টাকার দুর্গোপূজো করা বাঙালি কি জানে যে কর্ণাটকেরই এক জেলায় মাত্র দুটো উদ্বাস্তু গ্রামের বাঙালি বাংলা পড়ার অধিকার আদায় করে নিয়েছে সরকারের কাছ থেকে? মুম্বইয়ের বাঙালি নাহোক, নাগপুরের বাঙালি কখনো কি ভাবে গড়চিরোলির বাঙালির কথা?

কী বলব? বাঙালি বাঙালিকেই চেনে না তো ভারতবর্ষকে চেনার কথা ভাবে কোন স্পর্ধায়? নাকি বলব, দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকা দেশটাকে নতুন করে চেনার স্পর্ধায় যারা মাতবে, তারাই হয়তো নতুন ভাবে বাঙালিকে চিনবে!

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, নভেম্বর ২০১৯

 

 

 

বিহার বিধানসভায় জাতীয় নাগরিকপঞ্জী

কিছুদিন আগে, সঠিক ভাবে বলতে গেলে এবছর ২৬শে নভেম্বর, বিহার বিধানসভায় বিভিন্ন বিরোধী দলের সদস্যেরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে ছিলেন যে বিহারে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বাস্তবায়িত করা হবে না, এই মর্মে একটি প্রস্তাব আনা হোক।

প্রত্যুত্তরে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর দলের যতজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা কেউ মুখ খুললেন না। এমনকি, সাধারণতঃ যা হয়, বিরোধী দলের সদস্যদের কটাক্ষ করে কোনো মন্তব্য – না, তাও তাঁরা করলেন না। আর অধ্যক্ষ? স্পীকার? যা খবরে জানা গেল, তিনি শুধু বলেছিলেন যে বিষয়টি যথা সময়ে উত্থাপন করা উচিত। সেই যথাসময়টি কী? তাঁর কথা ছিল যে নাগরিকত্ব বিধেয়ক যেহেতু এখনো গৃহীত হয় নি* কাজেই এনআরসি নিয়ে আলোচনারও সময় আসে নি।

এত দিন সাধারণভাবে প্রদেশের মানুষ জানতো এবং বিশেষ করে বাঙালিরা ভরসা রাখত যে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল বিহারে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে। কেন না দলের সর্বভারতীয় একজন নেতা, সর্বভারতীয় উপাধ্যক্ষ এবং পেশায় বিখ্যাত রাজনৈতিক রণনীতি বিশেষজ্ঞ কিছুদিন আগে সংসদে এনআরসি নিয়ে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিভিন্ন খবরের কাগজে এবং নিউজ চ্যানেলে তাঁর কথা ফলাও করে ছাপা হয়। শাসকজোটের অন্য দলটি স্বাভাবিকভাবেই গৃহমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সমালোচনা করে। এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রীর দলটির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মিডিয়ার সামনে বক্তব্য রাখেন। ২২শে নভেম্বর ২০১৯ তারিখে টাইমস নিউজ নেটওয়ার্ক তাঁর যে ইংরেজিতে উদ্ধৃত করা হয় তা হলঃ

“এনআরসি নিয়ে এমনকি শীর্ষ আদালতেরও আদেশ শুধু আসামের জন্য ছিল। সেই আদেশ কোথাও বলেনি যে সারা দেশে এনআরসি প্রয়োগ করা হবে। পার্লামেন্টও কখনো বলেনি যে এনআরসি সারা দেশে প্রয়োগ করা হবে।”

তিনি বলেন যে তাঁর দলও মানে যে দেশে বেআইনি অভিবাসীদের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।  “কিন্তু,” তিনি এগোন, “দলের জাতীয় কার্যকারিণী আগেই একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে যতক্ষণ দেশের সংসদ ও শীর্ষ আদালত থেকে কোনো বার্তা না আসে, জাতীয় স্তরে এনআরসি প্রয়োগ করা উচিত হবে না।”

যদিও, মুখ্যমন্ত্রী নিজে মিডিয়ার সামনে মুখ খোলেন নি। যখন নাকি কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এনআরসির বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন যে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সাথেই আছেন! আর এটাই ছিল বিধানসভায় বিরোধী দলগুলোর তোলা দাবির প্রেক্ষাপট।

সংবাদ-মাধ্যমগুলোর তো কথাই আলাদা। বিরোধী দলগুলোর চালচরিত্র সম্পর্কে বক্তব্য থাকতেই পারে, কিন্তু বিধানসভা তো বিধানসভাই! তার প্রসিডিং তো অফিসিয়াল! তবুও হিন্দী ও ইংরেজি মিডিয়া পরের দিন একটাই শব্দ ব্যবহার করল এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মত করে জানাল যে এনআরসি নিয়ে বিরোধী দলগুলোর “হাঙ্গামা”, ইংরেজিতে “ফ্যুরোর” সত্ত্বেও চারখানা বিল পাশ করানো গেছে! অর্থাৎ এনআরসি হবেই, এবং হওয়াই সমীচীন।   

পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, যা হচ্ছে হোক, সঞ্চিতার পাতায় রাজনীতির এই কচকচি কেন? বিহার বাঙালি সমিতি তো সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক!

সঞ্চিতার পাতায় লিখতে হচ্ছে কেননা আমরা, বিহারের বাঙালিরা ঘর পোড়া গরু। আমরা গত শতকের ছত্রিশ সালে ডোমিসাইল খাওয়া বাঙালি। ঝাড়খন্ড আলাদা হওয়ার পর প্রশাসনের অলিন্দ থেকে এই বার্তা পাওয়া বাঙালি যে “বিহারে আবার বাংলাভাষা, বাংলাশিক্ষার কী দরকার? বিহারে তো আর বাঙালি নেই! সব তো ঝাড়খন্ডে!” আমরা এখনো বেতিয়ার ডিএম অফিসে, দ্বারভাঙ্গা, ভাগলপুর, মোতিহারির ডিএম অফিসে জাতি-প্রমাণপত্র পাওয়ার জন্য, জমির পাট্টা পাওয়ার জন্য দৌড়ে দৌড়ে নাজেহাল হওয়া বাঙালি। এনআরসি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আসামে বাঙালিদের কী দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি তো! বিহারে এনআরসি হলে এ প্রদেশের বাঙালিরা কী করবে তাও তো ভাবতে হবে! বিহার বাঙালি সমিতি আগেই এনআরসি নিয়ে একটি সতর্কতাবাণী জারি করেছে, সব বাঙালিকে প্রয়োজনীয় দলিল, দস্তাবেজ হাতের কাছে রাখতে বলেছে, প্রয়োজনে বিহার বাঙালি সমিতি সর্বতোভাবে সাহায্য করবে জানিয়েছে।

বিধানসভার এই ঘটনাবলি এবং পরবর্তি ঘটনাক্রমে আমরা জেনে নিলাম যে বিহারে এনআরসি হওয়া-না-হওয়া নিয়ে দোনামনায় থাকার কোনো অবকাশ নেই, এনআরসি বাস্তবায়নে শাসকজোট একজোট। - আমাদের লড়াইটা আমাদেরই লড়তে হবে, আর লড়তেই হবে।

*যদিও এই সম্পাদকীয় প্রকাশিত হতে হতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়ক এসে গেছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর দলের সাংসদরা সেটা সমর্থন করেছেন।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, ডিসেম্বর ২০১৯

 

 

 

একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি

এই সংখ্যা যখন আপনাদের হাতে পৌঁছোবে, তার আগে বিহারের জেলায় জেলায় বিহার বাঙালি সমিতির নেওয়া একুশে ফেব্রুয়ারির ধরণার কর্মসূচি সম্পন্ন হয়ে যাবে। ভরসা রাখি যে সেই ধরণা সফল হবে এবং রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বাংলা পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের ব্যাপারে হয়ত একটু নড়ে চড়ে বসবে। বাংলা শিক্ষকেরা বাংলা পড়ানোর কাজেই নিযুক্ত হবেন। ভরসা রাখি, ধরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশেষ করে শহরাঞ্চলের অভিভাবকেরা নিজেদের সন্তানদের হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাবেন আর জোর গলায় বলবেন, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা! সরকারি নিয়মানুসারে আমাদের সন্তানদের জন্য বাংলা পড়াবার ব্যবস্থা করুন!

দুঃখের কথা যে এই সব ‘মুদ্দা’গুলো আজও শুধু বাঙালি সমিতির ‘মুদ্দা’। এর আগেও তো ধরণা হয়েছে, অন্যান্য কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়েছে। কখনো কোনো ধরণায় বাঙালিদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করতে (ব্যক্তিগত বলছিনা, প্রতিষ্ঠানগত ভাবে) বা অংশগ্রহণ করতে দেখেছি কি? কালিবাড়ির কর্মকর্তা, হরিসভার কর্মকর্তা, দুর্গাবাড়ির কর্মকর্তা, সংস্কৃতি পরিষদের কর্মকর্তা, রবীন্দ্র পরিষদের কর্মকর্তা, লাইব্রেরির কর্মকর্তা, ক্লাবের কর্মকর্তা, যদি তাঁরা নিজেরাই বাঙালি সমিতির কর্মকর্তা না হন, কখনো অংশগ্রহণ করেছেন আমাদের ধরণায়? বাঙালিদের দাবির সমর্থনে একটা ব্যানারও কখনো দিয়েছেন?  

লক্ষ্য করে দেখবেন যে বিহারের বাঙালিদের দাবির প্রতি তাঁদের এই উপেক্ষাটা মূলতঃ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক রেষারেষি প্রসূত নয়। যদিও মুখে কয়েকজন বাঙালি সমিতিকে কয়েকজনের কুক্ষিগত সংগঠন হওয়ার অভিযোগ তোলেন। যদি তা হয়ও, তাঁরা নিজেরা তো আলাদা করেও ওই দাবিগুলোর পক্ষে আওয়াজ তুলতে পারেন। ধরণা-টরণা না হোক, নিদেনপক্ষে একটা চিঠি দিতে পারেন সরকারকে। প্রেসকে একটা বক্তব্য দিতে পারেন। দেন না।

কারণ, রোগটা অন্য জায়গায়। একটা দ্বিচারী মনোভাবের রোগ। যেটা নিজেদের 'প্রবাসী’ ভাবা মানুষজনে থাকে। হয়ত, সমিতিরও অনেক সদস্যের মধ্যে আছে। তাঁদের নিজেদের একটা ঠেক থাকে বঙ্গে, অথবা নিজেরাই ঠেক গড়ে নেন পরিণত বয়সে, বছরে দু’একবার ওই ঠেকে গিয়ে কল্পিত-শিকড়ে জল-সার গুঁজে, ফিটফাট হয়ে বিহারে ফিরে আসেন। তারপর এখানে প্রবাসী বাঙালির ‘সংস্ক্রিতি-চচ্চা’ করেন। বহির্বঙ্গে বাংলা শিক্ষা বা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্নকে তাঁরা নিজেদের অস্তিত্বের সংকট মনে করেন না। এই দেশের যে প্রাণ, বহুভাষিকতা, সাংস্কৃতিকবহুত্ব, তার সংকটটা দেখার তো প্রশ্নই উঠছে না।

অনেক লড়াই করে এই দেশে ভাষাভিত্তিক রাজ্যের কাঠামোটা তৈরি হয়েছিল। কাজেই রাজ্যগুলোকে ‘বহুভাষিক’ বলা কোনো কাজের কথা নয়। আসামের কয়েকজন বাঙালিকে শুনি তাঁরা আসামকে বহুভাষিক রাজ্য বলেন ও সরকারকে দিয়ে বলাতে চান। এটা ভূল। আসাম অসমিয়াভাষী রাজ্য, যেমন কর্ণাটক কন্নড়ভাষী রাজ্য। কিন্তু প্রত্যেক রাজ্যেই একটা বহুভাষিক স্পেস রাখতে হবে এটা ভেবেই সংবিধান ভাষাগত সংখ্যালঘুর ধারণাটাকে অঙ্গীভূত করেছে এবং তাদের অধিকারের কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিখেছে। যদি না লেখা থাকত, তাহলে কি অতবড় কর্ণাটকের একটা জেলার একটা গ্রামে দুটো মাত্র বাঙালি উদ্বাস্তু কলোনি বাংলা পড়ার অধিকার আদায় করে নিতে পারত। অথচ দেখুন বেঙ্গালুরু শহরের দশ লক্ষ না কয় লক্ষ কে জানে বাঙালি, এই দাবি তোলা তো দূরের কথা, এ নিয়ে ভাবেও না। কেননা তারা তো সব ‘প্রবাসী বাঙালি’! অধিবাসী হতে হলে আমেরিকার বা ইংল্যান্ডের হতে হয়, ভারতের রাজ্যগুলোতে শুধু প্রবাসী হওয়া সাজে।

যা হোক। বাঙালি সমিতি একাই লড়াই করে দেশের স্বাধীনতার আগের নয় বছরে ও পরের বাহাত্তর বছরে অনেক কিছু আদায় করেছে। ডোমিসাইল নীতি বস্তাবন্দি করিয়ে বাঙালিদের জন্য ভূমিপুত্র থাকার অধিকার আদায় করেছে সেই ১৯৩৮এ। বাংলা পাঠ্যক্রম, বাংলা পাঠ্যপুস্তক, বাংলা শিক্ষক আদায় করেছে স্বাধীনতার পর। সংখ্যালঘু বিদ্যালয়গুলোর জন্য অনুদান আদায় করে চলেছে সেই থেকে – পরিমাণে কম বেশি যাই হোক। বাঙালিরা রাজ্যের ভাষাগত সংখ্যালঘু হিসেবে আইনে স্বীকৃত হয়েছে। রাজপথ থেকে আদালত, ও ভোট-বয়কট - কোনো পন্থা বাকি থাকেনি লড়াইয়ে। এই তো সেদিন, প্রথম শ্রেণিতে মাধ্যমিক পাশ বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এককালীন দশহাজার টাকার বৃত্তি শুরু হল।

কাজেই, লড়াই চলছে, চলবে।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২০

 

 

 

 

আমাদের কথা

এক অসম্ভব পরিস্থিতিতে সঞ্চিতার প্রকাশন সম্ভব করতে হয় প্রতি মাসে। তার সাত কাহন রাখবার জায়গা এটা নয়। তবু যে মাঝে মধ্যে আমরা সাহিত্য-কেন্দ্রিত বিশেষ সংখ্যা তৈরি করতে পারি তার সাহসটা নিঃসন্দেহে বিহারের বিভিন্ন জেলাশহরে ও গ্রামে, উদ্বাস্তু-পুনর্বাস কলোনিতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি সমিতির সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীরাই যোগান।

কথা ছিল এবারে কলকাতা বইমেলা সংখ্যা হবে। হল না। যদিও বিহার বাঙালি সমিতি বইমেলায় একটি স্টল দিয়েছিল। বহির্বঙ্গের স্টল হিসেবে চিহ্নিত সমিতির এই প্রয়াস অনেক সাধুবাদ পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০তম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে স্মরণিকা যা বেরোবে, তাতে সঞ্চিতারও একটা দায়ভাগ থাকবে আশা করি। এরই মধ্যে সমিতির পাটলিপুত্র শাখা দ্বিতীয়বার ‘বিদ্যাসাগর মেলা’ করতে উদ্যোগী হল। তাঁদের উদ্যোগকে সম্মান জানাতেই সঞ্চিতার এই ‘বিদ্যাসাগর মেলা’ সংখ্যা।

বিহারে বাংলা সাহিত্য-সৃজনে অনেকদিন ধরে ভাঁটার টান। যাঁরা লিখছেন, অনেকদিন ধরেই লিখছেন, তাঁদের সংখ্যা প্রকৃতির নিয়মে কমবে। তাঁদের পরিবারের নতুন প্রজন্মের সাথে তাল রাখতে তাঁরা অনেকেই ভারতের অন্য প্রদেশে, বা মাতৃভাষাক্ষেত্রের আবহে শেষজীবনে সিঞ্চিত হতে বাংলার কোনো শহরে চলে যাবেন। শিক্ষার নতুন পদ্ধতিতে মানবসম্পদ তৈরির কারখানায় ভাষাশিক্ষার স্থান গৌণ হতে থাকবে। রুজির জন্য প্রয়োজনীয় না হতে পারলে ইংরেজি ও হিন্দির পরেও তার স্থান সঙ্কুচিত হতে থাকবে। তবে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে ভাঁটার টানের।

তার জন্য বিহারের বা বহির্বঙ্গের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গও দায়ী (বাংলাদেশ দায়ী নয় কেননা সেটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র)। বা বলা যায় সাহিত্যজগতের মানুষেরা দায়ী। আগে বাংলাসাহিত্যের মনোভূমিতে একটা বৃহত্তর প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিসরের প্রয়োজন গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন তাগিদে। তাই বিহার, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী থেকে আলাদা হওয়ার অনেকদিন পর অব্দি - বেশ কয়েক দশক অব্দি - শুধু বিহারবাসী বাঙালি নয়, বিহারবাসী বিহারি বা মৈথিলি, বজ্জিকা, অঙ্গিকা, মগহী ও ভোজপুরি ভাষী, সাঁওতাল, মুন্ডারি বা অন্যান্য ভাষী মানুষেরাও উঠে আসতে শুরু করেছিল। সেই নান্দনিক খিদেটা তৈরি না হলে পূর্ণিয়াবাসী সতীনাথের ঢোঁড়াইচরিত মানস যেমন তার প্রকৃত মূল্য পেত না, কলকাতাবাসী বিভুতিভূষণের বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যকও প্রকৃত মূল্য পেত না। বিভুতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জীবনতীর্থ যেমন মূল্য পেত না, পরবর্তীতে দেবেশ রায় ও অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের বিহারের মানুষজনকে নিয়ে লেখা উপন্যাসও মূল্য পেত না।

ওই সব উপন্যাসে বিহারের মানুষজনের আগমন মাত্র শুরু হয়েছিল। বাংলাভাষী ও অন্যান্যভাষীদের মিলনক্ষেত্রটা একটু তৈরি করেছিলেন সাংবাদিকতার ধরণে লেখা জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকেরা। সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা বিহার ও বহির্বঙ্গের পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের ওপর বর্তাতে পারত। ডিজিটাল ও অন্তর্জালের সুবিধা আসার আগে, পরম্পরাগত কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা প্রকাশনার জগতে বহির্বঙ্গের লেখকদের যে উপেক্ষার সম্মুখীন হতে হত, সে উপেক্ষা সত্ত্বেও ভালো বাংলা লেখক তো ছিলেন বিহারের শহরগুলোতে বা গুয়াহাটিতে, শিলচরে, আগরতলায়, এমনকি দিল্লিতে, মুম্বইয়ে, রায়পুরে বা অন্য শহরে! কিন্তু সেই মনোভূমিটাই সঙ্কুচিত হতে হতে হারিয়ে গেল। আন্তর্ভাষিক (আন্তর্ধার্মিক তো ছেড়েই দিচ্ছি) পরিবার ও পরিবেশ, কাজের জায়গা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা যত বাড়ল বিগত শতাব্দির শেষ বছরগুলোতে এবং এই নতুন শতাব্দিতে, যত বাড়ল বাংলার চোখ দিয়ে নতুন ভারতকে দেখার, তার অংশ হওয়ার সাহিত্যিক সম্ভাবনা, সাহিত্যের নান্দনিক দৃষ্টি ততটাই হয়ে পড়ল ‘ঘরকুনো’ – তার বাঙালিত্বের বৃহত্তর প্রেক্ষিতটাই যেন হারিয়ে গেল। তারা ভুলেই গেল যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লড়াইটা আত্মরক্ষার লড়াই নয়, একটা নতুন, প্রতিশ্রুত ভারত গড়ে তোলার লড়াই।

আর এটাও বহির্বঙ্গে বাংলা সাহিত্যচর্চায় ভাঁটার টান আসার একটা বড় কারণ।

এই জায়গা থেকে এক পা এগোবার উদ্দেশে ‘বিহার বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’ শুরু করেছিল বিহার বাঙালি সমিতি। দুটো হয়েছে আজ অব্দি। ফল আশানুরূপ হয় নি। তা সত্ত্বেও হবে আবার।

বিহার বাংলা আকাডেমি যদি আবার সক্রিয় হয় সরকারের দয়াদাক্ষিণ্যে, তাহলে আন্তর্জাতিক সেমিনারও হবে, যেমন ২০১১ আর ২০১৩য় হয়েছিল। আরো অনেক কাজ হতে পারবে যা হতে পারেনি এযাবৎ।

আর, মাঝে মধ্যে এভাবেই সঞ্চিতারও বিশেষ সংখ্যা বেরোবে। অনেক খুঁত থাকবে তাতে। কাজের লোকের অভাব। যারা লিখবে, যে বা যারা ডাটা এন্ট্রি করবে, প্রুফ যে বা যারা দেখবে তাদের সবার বাংলাজ্ঞানে খামতি থাকবে। হিন্দির ছোপ লেগে থাকবে। তবু চেষ্টা চলবে।   

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, বিদ্যাসাগর মেলা সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২০

 

 

 

সুদীপ্ত অধিকারী চলে গেলেন

সুদীপ্ত অধিকারী পড়াশোনার জগতের মানুষ ছিলেন। ভুগোলের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিদ্বান।

বিষয়টা এমন, যার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক থাকলেও নাড়াচাড়া খুব কম করি। সেই যে স্কুলে কিছুদিন বাধ্য হয়ে পড়তে হয়েছিল, তারপর আর ছুঁইনি। আমাদের স্কুলের জিওগ্রাফি স্যার আবার মারকুট্টে ছিলেন; ক্লাসে ওনার ছড়ির বাড়ি থেকে কেউ বাদ যেত না। অথচ অধিকারীদা, স্যার, বা সুদীপ্ত অধিকারীকে, ভুগোলের অধ্যাপক বা পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, যে পদেই থাকুন, হাসিমুখে ছাড়া দেখিনি। কোনো ছাত্রের মুখে কখনও স্যারের কখনো রেগে ওঠার কথা শুনিনি (রাগতেন না কখনো তা তো আর হতে পারেনা, হওয়া উচিতও নয়, তবে সামাজিক জীবনে বা পেশায় তার বহিঃপ্রকাশ হত না)।

এমন মাটির মানুষও খুব কম হয়। কয়েক বছর আগে বিহার বাংলাসাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল পাটনায়, রামমোহন রায় সেমিনারিতে। মঞ্চ থেকে হঠাৎ চোখ গেল পিছনে। দেখি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য একেবারে পিছনের চেয়ারগুলোর একটায় দিব্যি বসে আছেন। মঞ্চ থেকে নাম ঘোষণা করলাম, কাছে গিয়ে বললাম মঞ্চে আসতে, এলেন না। রাজনৈতিক ভুগোল নিয়ে লেখা যাঁর তিন-চারটে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম গুগল করলেই আমাজনে নিয়ে যায়, তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, আমি তো আর সাহিত্যিক নই, ওখানে গিয়ে কি করব? আর শুধু ‘প্রাক্তন’ বলে নয়! যখন প্রাক্তন ছিলেন না, ‘বর্তমান’ ছিলেন, এসেছিলেন কালিদাস রঙ্গালয়ে, বিহার বাঙালি সমিতিরই কোনো অনুষ্ঠানে, তখনও ওই একই রকম।

মাঝে কিছুদিন, বিহার হেরাল্ডের তরফ থেকে প্রত্যেক মাসে একটা করে শনিবাসরীয় আলোচনাচক্র হত। বেশ স্টাইল করে নাম রাখা হয়েছিল ‘টি-ডেক’। বাড়ির পিছনের যে বারান্দাটা বাগানে খোলে, সন্ধ্যার আলোয় যেখানে বসে চা খাওয়া যায়, সেই বারান্দার পোষাকি নাম হল ‘টি-ডেক’। ‘ডেক’ শুনলেই আবার স্টিমার, লঞ্চ বা জাহাজের সামনের দিকের খোলা জায়গাটা চোখে ভাসে, যেখানে সবাই আগেভাগে গিয়ে রেলিংএর ধারে জায়গা লুটতে চায়। তা সেই ‘টি-ডেক’এ এসেছিলেন অধিকারীদা। বললাম, বিহার হেরাল্ডের কলামের জন্য একটা লেখা দিতে। দিয়েও ছিলেন, বড় লেখা, তিন কিস্তিতে ছেপেছিল। বিষয়টাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ – ‘ছিটমহল’। সদ্য চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল ভারত আর বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে। এই তো সেদিন সংসদে মন্ত্রী বয়ান দিলেন যে গত পাঁচ বছরে ভারতে, বিভিন্ন দেশ থেকে যে আঠেরো হাজার উদ্বাস্তু বা অভিবাসীরা এসেছেন তাঁদের মধ্যে পনেরো হাজার বস্তুতঃ ছিটমহলের লোক, মানে ভারতেরই বাসিন্দা ছিলেন কিন্তু ‘ছোটো ছোটো টুকরো টুকরো বাংলাদেশাংশের’ ভিতর ‘ছোটো ছোটো টুকরো টুকরো ভারতাংশে’ বসবাস করছিলেন। শুনতে অদ্ভুত শোনাচ্ছে তো? এই ছিল ছিটমহল। আর এই ছিল সুদীপ্ত অধিকারীর লেখার বিষয়। কেউ যদি পড়তে চান, ফেসবুকে বিহার হেরাল্ডের পৃষ্টায় গিয়ে খুঁজতে পারেন। সদ্যই, মানে স্যার মারা যাওয়ার পর বিহার হেরাল্ডের ব্লগ থেকে শেয়ার করা হয়েছিল।

সুস্থই তো ছিলেন! ভাবিনি এভাবে হঠাৎ চলে যাবেন। সুদীপ্ত অধিকারীকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।  

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, মার্চ ২০২০

 

 

অসুস্থতা – সুস্থতা

অনেকদিন আগে একটা গল্প শুনেছিলাম। এক কর্মব্যস্ত মানুষের গল্প। যিনি বলেছিলেন আমি তাঁর বলাটাই রাখছি, যে সেই মানুষটির নাকি নানা রকম রোগ ছিল। আর ছিল উচ্চ রক্তচাপ। কিন্তু কিছুতেই নিয়ম করে ওষুধ খেতেন না। বাড়ির সবাই বার বার বলে, বকে-ঝকেও না ওনার ওষুধ খাওয়া নিয়মিত করতে পারত, আর না ওনার কর্মব্যস্ততা, সারাদিনের ঘোরাঘুরি বন্ধ করতে পারত। শেষে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে, সুঝিয়ে, সমুদ্রসঙ্গম ইত্যাদি দেখাবার লোভ দেখিয়ে, এরোপ্লেনে করে দক্ষিণ ভারতে, দেশের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানকার ডাক্তাররা তাঁকে দেখলেন, যাবতীয় পরীক্ষা করলেন এবং বললেন যে সব চিকিৎসা চলবে, তবে, প্রথমে তাঁর রক্তচাপটা স্বাভাবিক করা জরুরি। তাঁরা রক্তচাপ স্বাভাবিক করার জন্য ওষুধ দিলেন। এখানে তো ফাঁকির কোনো জায়গা নেই। অনুশীলিত সেবিকারা আছেন, তাঁরা ওষুধ দেওয়া শুরু করলেন। আর আশ্চর্য! হঠাৎ সেই মানুষটির শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে শুরু করল। ভিতরে ও বাইরে রক্তক্ষরণ শুরু হল। এবং আটচল্লিশ (বা হয়ত বাহাত্তর হবে, মনে নেই) ঘন্টার মধ্যে, ডাক্তাররা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই তিনি মারা গেলেন।... যিনি আমাকে গল্পটা বা ঘটনাটা শুনিয়েছিলেন তিনি বললেন যে আসলে শরীরের অস্বাভাবিক অবস্থাটাই সেই মানুষটির জন্য স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। শরীরের সবকটা ইন্দ্রিয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মস্তিষ্কের সাথে তাদের যোগসুত্র এমনকি খোদ মস্তিষ্কের নিজস্ব ক্রিয়া... সবকিছু নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল রক্তচাপ ইত্যাদির অস্বাভাবিক অবস্থার সাথে। হঠাৎ করে সেই অবস্থাটা স্বাভাবিক করতে গিয়েই হল মর্মান্তিক বিভ্রাট। সমস্ত কিছু বিকল হয়ে যেতে শুরু করল অস্বাভাবিক দ্রুততায়।

এমনকি হয়? সত্যিই কি সেই কারণেই মানুষটি মারা গেলেন? নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল? জানিনা। ডাক্তাররাই বলতে পারবেন এমনটা হয় কিনা। তবে মনে হয় ভগবান এই ঘটনাটার কথা জানতেন। ওঃ, জানতেন কি বলছি? তিনিই তো করেছিলেন, যা কিছু হয়েছিল সেই হাসপাতালে। এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন! মানে, তিনি বিকল্প পথটা ভেবে নিয়েছিলেন আর কি। যে নাঃ, দ্রুততার সাথে জগতটাকে স্বাভাবিক করতে গেলে সব কিছু বিকল হয়ে যেতে পারে। যে গরু প্লাস্টিক খেয়ে দুধ দিচ্ছে, তাকে হঠাৎ জাবনায় বিশুদ্ধ কচি ঘাসের স্ট্যু আর গুড় দিলে দুধ দেওয়াই বন্ধ করে দিতে পারে। তখন আবার ...। বরং অন্য পন্থা ভাবা যাক। অস্বাভাবিকটাকে স্বাভাবিক করতে গেলে ফল মৃত্যু। তাহলে বরং অবশিষ্ট স্বাভাবিকটুকুও অস্বাভাবিক করে দিলে কেমন হয়? বা, স্বাভাবিকতা কী, তার অভ্যাস নতুন ভাবে করতে শেখালে কেমন হয়?

তা সেই কেমন হয় দেখতেই জগতের অবশিষ্ট স্বাভাবিকটাকেও ঈশ্বর অস্বাভাবিক করে দিয়েছেন আজকাল। অস্বাভাবিক তো আমরা ছিলামই। রাস্তার মাঝখানে কেউ কারোর মাথা ভাঙছে, আর রাস্তার পাশে বসে আমরা সিঙাড়া ভাঙতাম। দিনের পর দিন নিরপরাধ মানুষকে শুধু হত্যার মজায় হত্যা করা হয়েছে, নারী এমনকি শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে আর তারপর, হত্যাকারীদের, ধর্ষণকারীদের গণ-অভ্যর্থনা জানিয়ে, তাঁদেরকে দেশ ও দশের ভাগ্যনিয়ন্তা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা কি করেছি? বলেছি, এসব তো একটু হতেই থাকে। আগে হত না?... তা ঈশ্বর, বাকি যে স্বাভাবিকতাটা ছিল, একে অন্যের সাথে বাজারে দেখা হলে করমর্দন করতাম, অনেকদিন পর দেখা হলে জড়িয়ে ধরতাম, বড় আয়োজনে সবাই মিলে একসাথে দুটো দুপুর কাটাতাম ... সব বন্ধ করে দিলেন। একশো তিরিশ কোটি দেশবাসীর মধ্যে যদি আশি কোটি কর্মক্ষম এবং শ্রমজীবী (কায়িক ও মানসিক) হয়, তার মধ্যে এক-দু কোটি হয়ত ‘ঘরে বসে কাজ’ করছে, আরো কয়েক কোটি হয়ত ‘ঘরে বসে হিমশিম’ খাচ্ছে কেননা মাইনেটা সুরক্ষিত, আর বাকিরা? ‘কাজ নেই, তাই ঘরের দিকে’ হাঁটছে হাজার হাজার মাইল।... কোথায় দেশের প্রগতির মহান সুত্র জিডিপি কে আট প্রতিশতে নিয়ে গিয়ে পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতির কথা ভাবা হচ্ছিল! দেড় মাসে এমন অবস্থা হল যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সাহেব গর্ব করছেন (দ্রষ্টব্যঃ তাঁর ১৭ এপ্রিলের বক্তব্য) যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি-দর সোয়া প্রতিশতে ইতিবাচক, যখন নাকি অনেক তাবড় তাবড় দেশের, নেতিবাচক!...

আজকের দিনের যারা বীর সৈনিক, সেই ডাক্তার, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতা-কর্মীরা... তাঁদেরকে সম্মান জানাতে হলে জানাচ্ছি খবরের কাগজে আর ফেসবুকে, টুইটারে! (আমেরিকার ভিডিও দেখলাম ডাক্তারকে সম্মান জানাতে পঞ্চাশ হাত দূর থেকে গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে – ওটাই একমাত্র সম্ভব সম্মান-প্রদর্শন!) নিজেদের পরিবারের কাছে তাঁরা যেতে পারছেন না দিনের পর দিন। অথচ, এ দেশেরই খবর, তাঁদের কেউ মারণ-রোগে মরলে পর তাঁদেরই পাড়া তাঁদের শরীরটাকেও ঢুকতে দিচ্ছে না। শ্মশানে মড়া পোড়াতে দিচ্ছেনা, গোরস্থানে গোর দিতে দিচ্ছে না। ...

শাস্তিস্বরূপ, আমাদের একটা পুরো নববর্ষ উদযাপন ঈশ্বর কেড়ে নিলেন – কি, তাই তো বলতে হবে? আর এটাও বলতে হবে যে তাঁরই আশীর্বাদে ভাগ্যিস, গায়ের সাথে গা ছোঁয়াবার শেষ দিনগুলো দোলের পর্ব ছিল, তাই রঙও একটু মাখিয়ে নিয়েছিলাম। এখন একা একা ঘরে – লকডাউনে, কে কোথায় – দিনের পর দিন কাটিয়ে আমরা অনেকেই হয়ে উঠছি আরো অস্বাভাবিক, আরো অসুস্থ।

কিন্তু, শুধুই কি তাই? ওই যে বললাম, স্বাভাবিকতা কী, কাকে বলে, সেটাও এরই সাথে নতুন পথে শেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন সেই ওপরওয়ালাই। কোরোনারই ভয়ে যে আমরা নিজেদের আত্মকেন্দ্রিক ব্যস্ততা আর স্বার্থের কথা কম ভেবে বাড়ির সবার সঙ্গে থাকার ও তার মধ্যেই আনন্দ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিপাড়া প্রতিবেশীর জন্যেও ভাবছিযারা এই সময়ে নিজেদের বিপন্ন করেও মানুষকে বাঁচাচ্ছেন তাদের জন্যে স্বতস্ফূর্ত হয়ে হাততালি দিচ্ছি, প্রশংসার দুটো শব্দ ছড়িয়ে দিচ্ছি বৈদ্যুতিন সামাজিক মাধ্যমে, এ সবই সুস্থ জীবনের দ্যোতক কিন্তু অতি অভ্যাসিত আধুনিক জীবনের পরিপন্থী হয়ে পড়েছিল| তাই প্রশ্ন হল যে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমরা কি এবার সুস্থ হবার মহড়াটা ধরে চলব? নাকি আবার একদিন দুহাত তুলে ‘ধ্যুত্‌ ধ্যুত্‌ আর পারছিনা’ বলে শুধু নিজের জন্য ভাবতে শেখানো সমাজে থাকার জন্যে বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ব?  

জানিনা, ঈশ্বর এই বিকল্প পথে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনতে পারবেন কিনা। আমাদের চুড়ান্ত অসুস্থতা থেকে সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন কিনা।... ‘জানিনা’ বলা কিন্তু নিন্দা নয়, আমার নিজের অক্ষমতার বয়ান, মনে রাখবেন। বরং সাচ্চা সনাতন ভারতীয় বলে আমি এটাও বলতে পারি যে তিনিও, মানে “স্রষ্টাও জানেননা হয়ত”(বেদে লেখা আছে)। তবে আশা করতে পারি। করতেই হবে। সৃষ্টি মানেই তো আশা, নয় কি?

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, এপ্রিল ২০২০

 

 

 

মে ২০২০

মে মাস বাঙালিদের সাংস্কৃতিক ব্যস্ততার মাস। ৭ বা ৮ তারিখে পঁচিশে বৈশাখ। মোটামুটি এক হপ্তা, রবীন্দ্রসপ্তাহ বলে চলে। তার চেয়ে কম চললে মনে হয় খামতি থেকে গেল। বৈশাখ শেষ হয়। আর জৈষ্ঠের ১১ তারিখ, অর্থাৎ ২৫শে মে নজরুল জয়ন্তী। সপ্তাহব্যাপী না চললেও যে একদিন বা দুদিন চলে, তার জোরটা কম থাকে না। কেন না, ছবিতেও রবি ঠাকুরকে একটু ঋষিমুনি টাইপের গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হয়, আর রবীন্দ্রজয়ন্তী করতে গেলেই যেন একটা বিশেষ ধরণের পবিত্র পবিত্র ভাবের অনুশাসন আপনা থেকেই এসে পড়ে। বাংলার ও বাঙালিজীবনের ভৌগোলিক বৃত্তের বাইরের ছোটো ছোটো শহরে অনুষ্ঠান যারা সাজিয়ে তোলেন নানা রকমের গান ও নাচ দিয়ে, এবাড়ি-ওবাড়ির দিদি, বৌদি, মা-মাসিমারা, তাদেরও একটু সাবধান থাকতে হয়। ঠিক রাবীন্দ্রিক নৃত্যশৈলি যদি নাও হয়, কাছাকাছি যেন কিছু একটা দাঁড়ায় তার খেয়াল রাখতে হয়। আজকাল ইন্টারনেট হওয়ায় যেমন সুবিধে হয়েছে, অনেক কিছু দেখে শিখে নেওয়া যায়, অসুবিধেও হয়েছে – সমালোচক বলে উঠবে, “এটা কি হল? একবার ভালো করে দেখে নিতে পারে না?”

নজরুলের সে বালাই নেই। কবিতার কথাগুলো বেশি আটপৌরে মনে হয়, গানে সুরের খেলায় মাদকতা আনা যায় প্রায় ইচ্ছে মত, যেমন ইচ্ছে নাচে বাঁধা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, নাচের বাচ্চারা একটু বেশি নিজেদের সময়ের কাছাকাছি থাকতে পারে। সেই জন্য যে বাঙালি সংস্থার সামর্থ্য কম তারা নজরুল জন্মতিথির কাছাকাছি এক সাথে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী করে।

আর, আরেকজনকে নিতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু তাঁর জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিন এই মে মাসে। ১৩ই মে। তা, স্মরণীয় মানুষদের জন্ম-মৃত্যু দিনে স্মরণে তো বিশেষ তফাৎ হয় না। ২৫শে বৈশাখে সবই আনন্দ-কথা আর বাইশে শ্রাবণে শুধুই দুঃখ-কথা, তেমন কি হয়? সবটাই তো সৃজন-কথার উৎসব – গ্রীষ্মের দাহে অথবা বর্ষণধারায়! কাজেই ১৩ই মে যাঁর মৃত্যুদিন, সেই ঘরের ছেলে সুকান্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে নিলে মে মাসে যে কোনো দিন ব্যানার টাঙানো যায় – রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী। পাটনায় করেওছি আমরা একবার।

একুশ বছর বয়স পুরো হওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলেন সুকান্ত। মিশে গিয়েছিলেন কম বয়সে মৃত অথবা নিহত, বিশ্বের বিপ্লবী কবিদের মাঝে – মায়াকভস্কি, ভাপসারভ, সুকান্ত। ...

কম বয়সে মৃত (ঘাতকের আঘাতে নিহত) এক বাঙালি লেখকেরও জন্মদিন এই মে মাসে। আর এ বছর, অর্থাৎ ২০২০ তে তাঁর জন্মশতাব্দী। সোমেন চন্দ নামে এই লেখক ঢাকার মানুষ ছিলেন। ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের সচিব ছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বখ্যাত গল্প ‘ইঁদুর’ পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ, মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করে সাম্প্রদায়িক ঘাতকেরা।

মে মাসে আগুন এটুকুতেই থামে না। সৃষ্টির আগুন, আনন্দের আগুন আর ব্যথার আগুনে প্রাণকে ভরে দিয়ে যায় সারা বছরের জন্য। কি করে ভুলে যাব উনিশে মে’র কথা। একুশ আর উনিশ তো একই মাতৃভাষার জন্য দুইটি রক্তধারা! আর উনিশ, আমাদের জন্য আরো বেশি প্রাসঙ্গিক কেননা, ভারতের সঙ্ঘ-ব্যবস্থায়, সাংবিধানিক প্রশাসনে, ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলিতে ভিন্ন মাতৃভাষাভাষীদের আইনগত অবস্থান নিয়ে সচেতন হতে শেখায় উনিশে মে – উনিশে মে ১৯৬১র শিলচরে পুলিসের গুলিতে শহীদ হওয়া মানুষেরা।

মে মাস এমনই যে হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! শুরুটাই যে মে দিবস দিয়ে! ৫ই মে আবার বাংলার এক অগ্নিকন্যা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মদিন। তাঁর জন্মদিন উদযাপন আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মসূচির অঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি এখনো। কিন্তু এই শহীদনারীর বীরত্ব আমাদের জাতিস্মৃতির অঙ্গ। 

মহামারীর আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত কালপঞ্জী প্রত্যক্ষ করছি আমরা। অর্থনীতি স্তব্ধ, স্কুল-কলেজ বন্দ, হয় গৃহবন্দী নয় ক্ষুধামিছিলযাত্রী দেশ। পরিযায়ী শ্রমিকদের ছবিগুলো যেন দেশভাগের সময়কার ছিন্নমূল মানুষদেরই ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। তারই মধ্যে জেগে উঠেছে মানুষের শুভবোধেরও নানান অভিব্যক্তি। হাসপাতালে দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে খেটে যাচ্ছেন ডাক্তার, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। খেটে যাচ্ছেন বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা। পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমে উঠলেও চাপের মধ্যে তাঁরাও কর্তব্য সম্পাদন করে চলেছেন দিন রাত। কাজে রয়েছেন ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পরিষেবার কর্মীরা। কত বেশি মানবিক হতে পারি আমরা তার একটা চ্যালেঞ্জ যেন ছুঁড়ে দিয়েছে এই মহামারী।   

আর সেই মানবিকতার অভিব্যক্তির একটা অংশ হিসেবেই ফুটে উঠছে এবারের মে মাসের সাংস্কৃতিক উদযাপনগুলো। একসাথে জড়ো হওয়ার কোনো জায়গা নেই বলে স্থগিত থাকবে? না, তা হবার নয়। ঘরে বসেই, ঘরের বারান্দায় বা ছাতে দাঁড়িয়েই একা একা বা পরিবারের হাত ধরে হয়ে চলেছে উদযাপন। এভাবে পরিবারের হাতে হাত রাখাও অনেক দিন হয়েছিল না যে!

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, মে ২০২০

 

 

অভিনন্দন, অঘোর প্রকাশ শিশু সদন

সঞ্চিতার পাঠকেরা অনেকেই হয়ত জানেন যে পাটনার বিধানচন্দ্র রায় পথে (চলতি নাম খাজাঞ্চি রোড) একটি বিদ্যালয় আছে, অঘোর প্রকাশ শিশু সদন। বিদ্যালয়ের মূল বাড়িটা বস্তুতঃ অঘোর কামিনী দেবী এবং প্রকাশচন্দ্র রায়ের বাসভবন ছিল এবং এই বাড়িতেই বাংলার কিম্বদন্তী রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, শিল্পসমৃদ্ধ বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম হয়। তাঁর স্মরণে, তাঁর জন্মদিন ১লা জুলাইয়ে প্রতিবছর এখানে বিহার বাঙালি সমিতি ‘চিকিৎসক দিবস’ পালন করে।

 

তবে সেটা এই মুহুর্তে বিচার্য বিষয় নয়। বিচার্য বিষয় এই বিদ্যালয়, যার স্থাপনা করেন বিধানবাবুর মা, শিক্ষাপ্রাণা, মহীয়সী অঘোর কামিনী দেবী। পাড়ার দুস্থ পরিবারের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে এই নিঃশুল্ক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। পরবর্তিতে, ১৯৪৯ সালে বিধানবাবু একটি ট্রাস্ট তৈরি করে বিদ্যালয়ের পরিচালনভার ওই ট্রাস্টের হাতে দেন এবং বিদ্যালয়ের বর্তমান নামকরণ করেন। ট্রাস্ট বডি পরিচালন কমিটি তৈরি করে| সেই পরিচালন কমিটিতে বিহারের শিক্ষাবিদরা ও সমাজ সেবীরা ছিলেন| সে সবও ৭০ বছর আগেকার কথা। সময়ের সাথে কিছূ সদস্য পাটনা ছেড়ে চলে গেলেন, কিছূ সদস্য ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোক গমন করলেন| যে সদস্যরা উপস্থিত থাকতেন তাঁরাই একজন নতুন ব্যক্তিকে পরিচালন কমিটি তে নিয়ে আসতেন কোরাম পুরো করতে| ২০০৯/২০১০ বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির অনুরোধে বিহার বাঙালি সমিতির অধ্যক্ষ ডাক্তার দিলিপ কুমার সিংহ পরিচালন সমিতির অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন| বার্ধক্য জনিত কারণে ও শেষ বয়সে প্রবাসী সন্তানের সঙ্গে থাকার প্রবণতার জন্যে বার বার পরিচালন সমিতি সঙ্কটের সম্মুখীন হওয়ায় বিহার বাঙালি সমিতি উদ্যোগ নিয়ে পঞ্জিকৃত নিয়মাবলী (বাই ল’জ) অনুসারে পাটনাবাসী শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, আইনজীবি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্ম্মী, সমাজসেবকদের নিয়ে পরিচালন/প্রবন্ধন সমিতি গঠন করে। অবশ্যই এদের মধ্যে বেশির ভাগই বিহার বাঙালি সমিতির সদস্য ছিলেন| আপাততঃ ওই সমিতির রক্ষণাবেক্ষণেই বিদ্যালয়টি চলছে এবং ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের ইচ্ছানুসারে এখনও নিঃশুল্কই চলছে।

কোরোনা-মহাকালে যখন শিক্ষক, শিক্ষিকাদের মাইনে দেওয়া নিয়ে অভূত্পুর্ব সংকট দেখা দেয়, পরিচালন সমিতির সদস্যরা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে নিজেদের মধ্যে টাকা তুলে তিন মাস পুরো মাইনেই দিয়েছেন|

বিদ্যালয়ের ১৮০ বছর পুরান বাড়িটা মেরামত করতে, এবং নতুন কিছু নির্মাণের প্রয়োজনে পরিচালন/প্রবন্ধন সমিতি গতবছর অনুদানের জন্য একটি আবেদন জারি করে। তাতে বর্ণিত ছিলঃ

বিহার সরকার ১৯৯৫তে এই বিদ্যালয়টিকে ভাষাগত অল্পসংক্ষক সংস্হা ঘোষিত করে এবং সরকারী বেতনমানে ছয়টি শিক্ষকের পদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই ছ’টি স্বীকৃত পদ এখন রিক্ত। বিদ্যালয় প্রবন্ধন সমিতি বার-বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও রিক্ত পদগুলিতে সরকার এখনও কোনো নিয়োগ করেনি। যদিও নিয়ম মত সরকারের তরফ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বিপ্রাহরিক ভোজন, সাইকেল বিতরণ, পোষাক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু বিদ্যালয় ভবনটির রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য প্রতি বছর মাত্র ১২,০০০ টাকা দেওয়া হয়।

বিদ্যালয়টিতে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্য্যন্ত সবশুদ্ধ ৪০০র থেকেও বেশী ছাত্র-ছাত্রী পড়ে। শিক্ষক-শিক্ষিকার রিক্ত পদগুলিতে সরকার কাউকে বহাল করেনি বলে, বিদ্যালয় নিজের উদ্যোগে কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা বহাল করেছে। ১২ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা মাত্র ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকার মাসিক বেতনে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান। এত কম বেতন হওয়া সত্ত্বেও এই শিক্ষক শিক্ষিকাদের দেওয়া শিক্ষার গুণে প্রতি বছর ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতিশত ৯০% থেকেও বেশি হয়। এই হার এই রাজ্যের গড় হারের থেকে অনেক বেশি।”

এটাই বিচার্য বিষয় এবং বিষয়টির অবতারণার প্রধান উদ্দেশ্য। এবছরও বিহার বোর্ডের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মোট কুড়ি জন ছাত্রী এই বিদ্যালয় থেকে বসেন এবং উনিশজন উত্তীর্ণ হন। উনিশজনের মধ্যে ষোলোজন প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন, দুজন দ্বিতীয় শ্রেণীতে এবং একজন তৃতীয় শ্রেণীতে। যে একজন উত্তীর্ণ ঘোষিত হননি, তাঁর পরীক্ষাফল আটকে রাখা হয়েছে কেননা তিনি সবক’টি পরীক্ষা দিতে পারেননি।

নিঃসন্দেহে এই বিস্ময়কর পরীক্ষাফলের জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য ওই ছাত্রীদের, যারা এই কোরোনা-বিভিষিকায় আক্রান্ত সময়ে, লকডাউন-জনিত নানান সমস্যা কাটিয়ে নিজেদের বাবা, মা ও দুস্থ পরিবারের সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। অভিনন্দন প্রাপ্য ঐ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, যাঁরা সারাবছর অত্যল্প মাইনেতে পড়িয়ে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রমাগত সাহায্য করে তাদের এই পরীক্ষাফলের জন্য তৈরি করেছেন। এমন একটি বিদ্যালয়ের পরিচালনের সাথে যুক্ত থাকার জন্য বিহার বাঙালি সমিতি গর্বিত।

অবশ্যই, এরই সাথে, বিহার বাঙালি সমিতি বিহারের অন্য সমস্ত বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া অগণিত ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনন্দন জানায়। কোরোনা ও লকডাউনের কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ তাঁরা সাফল্যের আনন্দে হাসিতে ভরিয়ে দিয়েছেন।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জুন ২০২০

 

 

লকডাউন এবং বিহার বাঙালি সমিতি

জীবন থেমে থাকে না। থেমে থাকতে পারে না। লকডাউনের এটা চতুর্থ মাস। যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর আকাশে, দেশের আকাশে আর ব্যক্তিমানুষের, তার পরিবারের আকাশে অবশ্য-আসন্ন সঙ্কটের মেঘ সঘন হয়ে উঠছে। তা বলে সেই আশঙ্কায় তো আর কেউ চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। মানুষের মন সততই সৃজনশীল। ঝড়ে ভেঙে যাওয়া ঘর আবার তুলতে হলেও সেটা মানুষ পুনরাবৃত্তি হিসেবে নয়, যতটা সম্ভব নতুন কাজ হিসেবে করতে চেষ্টা করে। জানা ছকটাও ইচ্ছে করে মনে ওলটপালট করে নেয় – এখানে দরজা ছিল আগে; এখানেই রাখব? আর, জানলাদুটো? বৌকে ডাকে, “রান্নার জায়গাটা এপাশ দিয়ে করি এবার? আর পুজোর জায়গাটা নাহয় ওই জানলার নিচে রাখব; ওদিকে বেশি আলো আসে।”

আর সংগঠন তো তৈরিই করেছে মানুষ নিজেদের সৃজনশীল শক্তিকে একত্র করে বাড়িয়ে তোলার জন্য। কাজেই বিহার বাঙালি সমিতির ক্ষেত্রেই বা তার অন্যথা হয় কি করে? লকডাউনে কোনোরকম সামাজিক সমাবেশ করা যাবেনা, ঘাতক ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা ও সবাইকে রক্ষার স্বার্থে অবশ্য-করণীয় পদক্ষেপগুলো নিতে হবে। মাস্ক পরে থাকতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে... পত্রিকাও প্রকাশ করা যাবে না, বৈঠকও করা যাবে না। তা বলে কি সংগঠন থেমে থাকবে?

সবচেয়ে আগে তো সংগঠনের মুখপত্রটিকে অন্তর্জালের মাধ্যমে সহজ-লভ্য করার জন্য বিহার বাঙালি সমিতির ওয়েবসাইট ছাড়াও ফেসবুকে এবং হোয়াটস্যাপে পোস্ট করা শুরু হল। তারপর ভিডিও কনফারেন্সিংএর মাধ্যমে বৈঠক করল নেতৃত্ব।

জুন মাসে ভাবা হল ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ উপলক্ষে সর্বভারতীয় অঙ্কণ প্রতিযোগিতার কথা। নতুন অভিজ্ঞতা। বসে আঁকো, কিন্তু ঘরে বসে। সময়সীমা আছে কিন্তু ‘আঁকার কাগজ দেওয়ার বা কেড়ে নেওয়ার মাস্টারমশাই’ নেই। ছবিগুলোও নেই। ছবি রইল ক্ষুদে শিল্পীদের হাতে আর প্রতিযোগিতার আয়োজকদের হাতে পৌঁছোলো ছবির ছবি। ডিজিট্যাল ইমেজ। সেগুলো আবার ড্রাইভে পাঠানো হল বিচারকদের কাছে। শেষে তার ফল ঘোষণা হল। পুরষ্কার বিতরণ ও ই-সার্টিফিকেট পাঠানো হবে, সবই অনলাইনে। আর সাড়া! সবচেয়ে আগে তো তাঁদের সাড়ার কথা বলতে হয় যাঁরা পুরষ্কারের অর্থরাশি স্পন্সর করলেন। একটাও পুরষ্কার বাদ তো থাকলোই না বরং ডবল-ডবল স্পন্সর হল। তারপর বলতে হয় প্রতিযোগীদের সাড়ার কথা। মহারাষ্ট্র অব্দি প্রতিযোগীরা সাড়া দিল এবং নিজেদের অঙ্কণ পাঠালো। তাঁদের সবাইকে সঞ্চিতার অভিনন্দন।

পয়লা জুলাই ছিল চিকিৎসক দিবস। বিধান রায়ের পৈত্রিক ভবন, অঘোর প্রকাশ শিশু সদনে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরে থাকা ইত্যাদি নিয়মাবলী মেনে চিকিৎসক দিবস পালন করা হল। বিধান রায়ের প্রতিমা মাল্যভূষিত করলেন সমাগত অংশগ্রহণকারীরা।

আর এই দিনকে স্মরণ করে বিহার বাঙালি সমিতি আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু করল নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল। বিহারের বিভিন্ন শাখার কার্যকলাপ, সাংস্কৃতিক পরিবেশনাদির ভিডিও ওই ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হবে।

২রা জুলাই শুরু হল সঞ্চিতাব্লগ। অনেকদিন ধরে চিন্তাভাবনা চলছিল যে মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’য় সাহিত্যের জন্য কিছু পৃষ্ঠা যোগ করা যায় কিনা। মাঝে মধ্যে সাহিত্যসংখ্যা প্রকাশও সেই উদ্দেশ্যপূরণে করা হত। এখন এই সঞ্চিতাব্লগের মাধ্যমে বিহারের বাঙালির সাহিত্যপ্রয়াসকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মানুষের কাছে তুলে ধরার একটা আন্তর্জালিক মঞ্চ তৈরি হল।  

এভাবেই এগিয়ে চলেছে সমিতি। ওয়েবিনার করার কথা ভাবছে। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশায়ের ১২৯তম তিরোধান দিবস আসছে। এ বছরটা তাঁর দ্বিশত জন্মশতাব্দিরও বছর। বিহার বাঙালি সমিতি ও বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি, নন্দনকানন নিশ্চয়ই উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করবে।

একটি কাজে আমরা অবশ্যই বেশ পিছিয়ে আছি। এপ্রিল মাসে কোভিড – ১৯ মহামারি রোধে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে ১ লক্ষ টাকা দান দেওয়ার জন্য সবার কাছে আর্থিক সহযোগিতার আবেদন করা হয়। এ পর্যন্ত সমিতির ২৮জন শুভানুধ্যায়ী ২৮,৭৫৩ টাকা দান করেছেন। সমিতির পুর্ণিয়া, কিশনগঞ্জ ও ভাগলপুর শাখা নিজ নিজ এলাকায় দান সংগ্রহ করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা আবার সহযোগিতার আবেদন জানাচ্ছি, যাতে আমাদের ১ লক্ষ টাকার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোতে পারি ও ১৫ই আগস্টের মধ্যে দান সংগ্রহ করে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে পাঠাতে পারি।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, জুলাই ২০২০

 

 

 

শিশুমনে মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক-চেতনার দুই দিশারী  

আজ থেকে দুশো বছর আগে দুমসের ফারাকে বাংলার দুই মনীষার জন্ম – অক্ষয় কুমার দত্ত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তুলনা করা যায়না, তুলনীয় নন তাঁরা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর কাজে, ব্যক্তিত্বে, চরিত্রবলে শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতবর্ষে আধুনিক, সংগ্রামী মানবিকতার আহ্বায়ক, অক্ষয়কুমারের পরিচয়, তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ। তারও সর্বভারতীয় গুরুত্ব আছে, কেননা যে সময় তত্ববোধিনী পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বিজ্ঞান-সম্পর্কিত রচনাগুলি প্রকাশিত হচ্ছিল সে সময় সারাভারতে অন্য কোনো ভাষায় সে ধরণের কাজ শুরু হয়েছিল বলে জানা যায় না। তবুও, অন্য কোনও প্রদেশে বা ভাষায় তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনা হয়নি; একমাত্র যাঁরা উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে বই ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তাঁরা জানেন।  

তবুও এক জায়গায় দুজনে একসাথে স্মরণীয়। দ্বিশত জন্মবার্ষিকী এক সাথে পড়ছে বলে নয়, বিজ্ঞান-মনস্কতার জন্য। বিশেষকরে শিশুমনে জগত সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ধ্যানধারণা বিকশিত করার প্রয়াসের জন্য।

দুটো বই পাশাপাশি রাখা যাক। বোধোদয় চারুপাঠ। দুটোরই প্রথম প্রকাশের বছর সম্ভবতঃ ১৮৫২ (বা কাছাকাছি সময়ে)। বিদ্যাসাগর রচিত তার আগের বই জীবনচরিত (বেতাল পঞ্চবিংশতি বাদ দিলে) আর চারুপাঠের আগে অক্ষয়কুমারের রচনা ভুগোল, পদার্থবিদ্যা বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার

জীবনচরিত এর বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগর বললেন বটে মহাত্মাদের জীবনকাহিনী পড়ে আত্মিক উন্নতিসাধনের কথা, কিন্তু পাড়লেন বিশেষ করে ইয়োরোপীয় জীবনসংগ্রামী জ্ঞানসাধকদের কথা। অর্থাৎ প্রথমে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে কঠোর জীবনসংগ্রামের পথে ছাত্রদের উজ্জীবিত করে তারপর দিলেন সেই জ্ঞানের প্রাথমিক সোপান – বোধোদয় । যার প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেওয়া হল বস্তুপ্রকৃতি, প্রাণীজগত, মনুষ্যজাতি, মানবশরীর, ধাতুপরিচয়, সংখ্যাপরিচয়, মুদ্রা, শ্রম ও অধিকার ... মানে সব মিলিয়ে, রোজকার জীবনসংগ্রামে প্রয়োজনীয় ভাবধারাগত সংঘাতে, বৈজ্ঞানিক-চেতনায় প্রস্তুত থাকার পকেট-বিশ্বকোষ।

আর, বলতে গেলে বিদ্যাসাগরের উলটো পথে, বিজ্ঞানবিষয়ক তিনটে পাঠ্যবই লেখার পর অক্ষয়কুমার পৌঁছোলেন চারুপাঠ এ। যাতে, আগ্নেয়গিরি, জলপ্রপাত, পৃথিবীর পরিমাণ, বৃক্ষ-লতাদির উৎপত্তির নিয়ম ইত্যাদি বিজ্ঞান বা সাধারণজ্ঞান বিষয়ক প্রস্তাবের মাঝেমাঝে ঢোকালেন নীতিকথা – বিদ্যাশিক্ষা, দয়া, তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি উপদেশ, সন্তোষ, কুসংসর্গ, আত্মপ্রসাদ, স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধিসাধন ইত্যাদি।

এইভাবে দুজনে মিলে শিশু ও বালক-বালিকাদের মনে মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক-চেতনা নির্মাণের ভিত রচনা করলেন ও নানা ধরণের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়বার অস্ত্র যোগালেন।

অতিমারীর দুর্যোগগ্রস্ত বছরটায় সামাজিক সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজনে আমরা এই দুই প্রাতঃস্মরণীয় মনীষার দ্বিশত জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্য সমারোহে পালন করতে পারছি না। তার আক্ষেপ থেকে যাবে। তবুও, যেভাবে সম্ভব, মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক-চেতনা গড়ার এই দুই কারিগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী আমাদের উদযাপন করা উচিৎ।

কে বলতে পারে? একদিন আমরা আবার থেকে শিখব মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের পাঠ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা? পৃথিবীর বুকে সারাদিনরাত বিদেশি ভাষায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জয়োল্লাসে মেতে দাপাদাপি করতে করতে শহুরে শিক্ষিত সমাজ আমরা একবারও জোরের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ করতে পারলাম না যে উন্নয়নের এই পদ্ধতি ঠিক নয়। এতে প্রকৃতি ও পরিবেশের খেয়াল রাখা হচ্ছে না। পৃথিবী নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ওজোন স্তর ক্ষীণ হচ্ছে। হিমবাহ শুকিয়ে ও মেরুর বরফের চাদর ফেটে জেগে উঠছে লক্ষ-কোটি বছর ধরে চাপা থাকা অজানা জীবাণু ও প্রাণকোষ। সেসব রোগ ছড়িয়ে পড়লে মহামারীর আকার নিতে পারে। আর নিচ্ছেই তো! নতুন শতাব্দী শুরু হতে না হতে আছড়ে পড়ল উপর্যুপরি নানা ধরণের ভাইরাসের প্রকোপ।...

ওদিকে, যারা অশিক্ষিত বলে কথিত, যারা আধুনিক বিজ্ঞানের কিছুই জানে না, আমাজন থেকে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাল্কানগিরি অব্দি সেই সব জনগোষ্ঠির মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল, জেলে গেল, গুলি খেল পরিবেশকে বাঁচাতে, জঙ্গল বাঁচাতে, প্রাণীজগতকে বাঁচাতে, পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা হাজার হাজার বছর প্রাচীন আদিম জীবনের স্মৃতিচিহ্নগুলো বাঁচাতে? শুধু পেটের জন্য? না। নিজেদের আবহমান পারম্পরিক জ্ঞানের তাগিদে, যে এই পরিবেশ না বাঁচলে মানুষও বাঁচবেনা।

যদি আমাদের বিজ্ঞান-চেতনা মাতৃভাষাকেন্দ্রিক হত, যদি বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাগুলো মায়ের ভাষায়, মায়ের দুধের মত রক্তে মিশতো, তাহলে এই ট্র্যজিক, ট্র্যাজিকও না প্যাথেটিক পরিণতিতে আমরা পৌঁছোতাম না।

বিজ্ঞানকে জানবো, হৃদয়ঙ্গম করব মাতৃভাষায়, বৈজ্ঞানিক-চেতনা জাগাবো মাতৃভাষায় – এই সঙ্কল্পে যদি দৃঢ় হয়ে উঠতে পারি, সরকার সুযোগ দিক আর না দিক, ঘরে ঘরে এই চেষ্টা যতটুকু হোক শুরু করতে পারি, সেটাই হবে ওই দুই দিশারীর দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য।

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, আগস্ট ২০২০

 

 

 

শরতচর্চা

আমাদের শরতচর্চা খুব কম। যে উৎসাহে বাঙালিরা সারা পৃথিবীতে রবীন্দ্রজয়ন্তী করে প্রতি বছর, নজরুল-সন্ধ্যা উদযাপন করে সে উৎসাহে শরতচর্চা করার ব্যবহারিক অসুবিধা আছে মানছি। নাচে-গানে-আবৃত্তিতে কচি ছেলে মেয়ে ও বাড়ির বৌদের অংশগ্রহণ করানো এবং সেই অনুপাতে বাবা-মা, অভিভাবক ও পতিদেবদের দিয়ে দর্শক-আসন ভরানো যেভাবে সুনিশ্চিত করা যায় রবীন্দ্রজয়ন্তী বা নজরুল-সন্ধ্যায়, শরতচর্চায় সেভাবে করা সম্ভব নয়। এমনকি তার সিকিভাগ অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতেও রীতিমত খাটাখাটনি করে ছোট বা বড় নাটক, পাঠ-নাট্য, গল্প-পাঠ বা এধরণের আরো কিছু দাঁড় করাতে হবে – সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পরিণত লেখক-জীবনে শরত কবিতা লেখেন নি। আর, কখনো গান লিখেছেন বলে শুনিনি।

কিন্তু করা উচিৎ, শরতচর্চা – শরত-জয়ন্তী বা শরত-সন্ধ্যা উদযাপন। হিন্দীভাষীরা তো প্রেমচন্দ-জয়ন্তী করে প্রতি বছর। বরং তুলনামূলক ভাবে কবিদের জয়ন্তী করার উদ্যোগটা কম।

কথাগুলো মনে হল ভাগলপুরে, বাঙালি সমিতির তিনটি শাখার (ভাগলপুর, বরারী ও চম্পানগর) শরত-জয়ন্তী উদযাপন করার উদ্যোগ নেওয়া দেখে। এবছর জয়ন্তী উপলক্ষে রেল-কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে স্টেশনের প্রতীক্ষালয়ের দেয়ালে শরতবাবুর ছবি টাঙানো হয়েছে, পৌরসভার সাথে কথা বলে শরত-দ্বার ও নামের ফলক লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে, একটি দীর্ঘ ওয়েবিনার করা হয়েছে (যাতে বিশেষ আকর্ষণ ছিল, শরতচন্দ্রের ভাগলপুর স্থিত কৈশোরকালীন বাসস্থানটি দেখানো এবং সেই উঠোনেই সুন্দর নৃত্যের আয়োজন) এবং আরো কিছু করার চেষ্টা চলছে।

এই অস্বাভাবিক সময়ে এতটা যে তাঁরা করতে পারছেন তাই অনেক। আর আমি শুধু ভাগলপুর বা বিহারের কথা তো বলছিনা। সাধারণভাবে বাঙালি সংস্কৃতি-সাহিত্যমনস্ক মানুষদের কথা বলছি। অন্তর্জালে, সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষকরে ফেসবুকে তো দেখি নানা রকম হ্যাশট্যাগ চলে। কই শরতজয়ন্তীতে তো তাঁর নামে কোনো হ্যাশট্যাগ হল না! রিলে হয় – এক বন্ধুর অনুরোধে আরেক বন্ধু পোস্ট করেন, আবার তাঁর অনুরোধে আরেক বন্ধু – বইয়ের প্রচ্ছদের, কবিতার, ছোটো ভিডিওর – কই শরতচন্দ্রের কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ, কাহিনীর অংশ বা তাঁর সাহিত্য ও সমাজ বিষয়ক মন্তব্য নিয়ে তো এসব কিছুই দেখা গেল না! তাঁর উপন্যাস নিয়ে তো এত সিনেমা হয়েছে, কোনো সিনেমার ক্লিপিংও ইউটিউব থেকে নিয়ে কাউকে পোস্ট করতে দেখলাম না। শরত-সাহিত্য কি এতটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে? অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে অভয়া, অন্নদাদিদি, কমল, রাজলক্ষ্মী, আমিনা এবং অভাগীর জীবন? নাকি তাঁরা আছেন স্বস্থানে আর তাঁদের প্রেক্ষিতে আমাদের সংস্কৃতি-চর্চা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে চলেছে?

বিশ্বমানের ঔপন্যাসিক ও ছোটোগল্পকারে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ। তবে শুরুর বড় নাম তিনটে তো বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ আর শরত! আর সারাভারতের বিভিন্ন ভাষার সাধারণ পাঠককে সৎসাহিত্য পাঠে শরত যেভাবে টেনে এনেছিলেন সেভাবে বাকি দুজন টানেন নি। কেন? তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে একসময় বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল যে শরত কনফর্মিস্ট। কনফর্মিস্ট এর বাংলা কী হবে? প্রথানুবর্তী? কিন্তু সাধারণ পাঠককে তেতো ওষুধ গেলানোর জন্য কনফর্মিজমের খোলসে কী করে কশাঘাতটা দিতে হয় তা বোধহয় শরতচন্দ্রের থেকে বেশি ভালো কেউ জানতেন না। একটা আবেগঘন মুহুর্ত তৈরি করে তারপর, রাখালের মা বলিল, এমন সতীলক্ষ্মী বামুন কায়েতের ঘরে না জন্মে ও আমাদের দুলের ঘরে জন্মালো কেন!” এমন সহজ ভাবে করা ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ মন্তব্যে শরত-সাহিত্য ভরা। আর একেকটা গল্প বা উপন্যাসই তো মন্তব্য।

লেনিনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে টলস্টয়কে নিয়ে, যে তিনি নাকি রুশ বিপ্লবের আয়না। কী করে হয়? টলস্টয়ের সাহিত্যে তো বিপ্লবের কোনো কথাই নেই। একেবারেই নেই। আয়নায় তো মুখ দেখা যায়। বিপ্লবের মুখের প্রতিফলন টলস্টয়ের লেখায় কীভাবে হতে পারে? প্রশ্নের উত্তরটা ছিল ওই প্রতিফলন শব্দটার মধ্যে। প্রথম তো, বস্তুজগতের যে প্রতিফলন হয় চেতনায় তা আক্ষরিক অর্থে আয়নার প্রতিফলন নয়। সাহিত্যে ও শিল্পে তো প্রতিফলন আরো ভিন্ন রূপ নেয়। আর এখানে আবার লেনিন বলছেন যে বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার সাহিত্যিক প্রতিফলনটা বিপ্লবের আয়না! তার একটাই মানে হতে পারে যে টলস্টয়ের লেখায় বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার সামাজিক জীবন সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে, সেই প্রশ্নের আয়নায় বিপ্লব নিজের মুখ দেখে নিতে পারে – সে কি সমাধান করতে পারল সেই প্রশ্নগুলোর?

শরত-সাহিত্য সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য। এখনও অব্দি, স্বাধীনতা সংগ্রামই তো এদেশের সবচেয়ে বড় বিপ্লব! তা সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পরবর্তী সময়, শরত-সাহিত্যে নিজের মুখ দেখে মিলিয়ে নিতে পারে, শরত-উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর সমাধান কী হয়েছে?    

সম্পাদকীয়, সঞ্চিতা, সেপ্টেম্বর, ২০২০

          

 

No comments:

Post a Comment