ডানদিকে অদূরে বিশাল স্তুপটার দিকে নজর রাখতে রাখতে সুবীরবাবু বলে উঠলেন, “কেসরিয়া নিকল রহা হ্যয়। বস, অব আ জায়েগি আপকি চায়। থোড়ি দূর পর এক লাইন হোটল হ্যয় ঠিকঠাক।”
সামাদ সাহেব প্রসন্নতার হাসি হাসলেন, “সিধা খড়া হোনে কা মওকা
ভি মিলেগা, গুপ্তাসাহব। ব্যয়ঠে, ব্যয়ঠে কমর, পিঠ সব অকড় গয়া হ্যয়। খ্যয়ের, ছোড়িয়ে,
ক্যা বতা রহে থে আপ?”
সুবীরবাবু চোখ সরালেন। কেসরিয়ার প্রাচীন স্তুপটা বিশাল। লাল ইঁটের
তৈরি, মনে হয়। বাইরের আস্তরণ বোধহয় খসে গেছে সময় আর জোলো আবহাওয়ার হামলায়। কখনো গিয়ে
কাছ থেকে দেখা হয়নি। পাটনা থেকে বৈশালী হয়ে পশ্চিম চম্পারণের দিকে যেতে পড়ে। বুদ্ধিস্ট
সার্কিটের মধ্যে বলে রাস্তাটা ভালো।
সামাদ সাহেব, শাসক দলের নেতা। রাজ্য সংখ্যালঘু আয়োগের অধ্যক্ষ।
সুবীর গুপ্ত, পাটনার প্রতিষ্ঠিত বাঙালি, উপাধ্যক্ষ। আয়োগের নিয়মাবলি অনুযায়ী, ধার্মিক
সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমান হবেন অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ পদে, মেয়াদের আবর্তনে একেকবার
ভাষিক সংখ্যালঘু বাঙালি, ধার্মিক সংখ্যালঘু শিখ এবং ধার্মিক সংখ্যালঘু ক্রিশ্চান সমুদায়
থেকে প্রতিনিধি মনোনীত হবেন। তবে, সুবীরবাবু খুব খুশি সামাদ সাহেবের মনোনয়নে। যোগ্য
ব্যক্তি। নিরহঙ্কার, জ্ঞানপিপাসু, কাজ করতে ভালোবাসেন। কাজের নতুন আইডিয়া ঘোরে মাথায়।
যেমন এখন, পাটনা ছাড়ার একটু পরই নিজের গাড়ি ছেড়ে উপাধ্যক্ষের গাড়িতে এসে বসলেন, “যেতে
দিন খালি গাড়িটাকে সামনে। আপনি আমায় বোঝান এই ভাষিক সংখ্যালঘু কী ব্যাপার। কী তাদের
অধিকার।”
সামাদসাহেব বিশেষ ইংরিজি বোঝেন না। আর সুবীরবাবু বিহারের মানুষ
কাজেই হিন্দিতে কোনো অসুবিধে নেই। হিন্দিতেই ধরলেন কথার খেই, “সংবিধানে তো স্পষ্টই
লেখা আছে, ভাষিক ও ধার্মিক সংখ্যালঘু। সব অধিকার এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দায়িত্বও
পরিভাষিত করা আছে। সেই অনুযায়ী বিধানসভায় পাস হয়েছে আমাদের এই আয়োগ তৈরি করা সম্পর্কিত
আইন, এবং আমরা তার অধীনে কাজ করছি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই অধিকারগুলো রক্ষা করার
ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি কমেছে, ইচ্ছে কমেছে আর তারই সাথে কমেছে আমাদের চেতনা। এই যেমন,
আপনি, অন্ততঃ জানতে চাইলেন। অথচ, সচিবালয়ের কোনো বড় আধিকারিককেও জিজ্ঞেস করে দেখুন।
আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। বাংলা পড়ানো বন্দ হয়ে গেছে বলে যখন অভিযোগ করতে গিয়েছিলাম, শুনতে
হয়েছিল, ‘বাঙালি? বাঙালি তো সব ঝাড়খন্ডে চলে গেছে, বিহারে বাঙালি কোথায়? তারপরেই তো
শুরু হল আমাদের লড়াই। … ওই তো লাইন হোটেলটা এসে গেছে। সামনের গাড়িটা থামাতে বলুন সিকিউরিটিকে।
বাঁদিকে হোটেলটা।”
একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখানকার মাটি সাদা। বৃষ্টির জলে ভিজে
নিলচে দেখাচ্ছে। তার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি পাতিহাঁস। লাইন হোটেলটার আশেপাশে আর
কোনো দোকানঘর বা বাড়ি নেই। খেত, জলাশয় আর উঁচু, উঁচু ঘাসঝোপ। শিশম গাছের সারি।
ভিতরে বসেননি তাঁরা। দোকানের কর্মচারিরা বাইরে চেয়ার বের করে
দিয়েছিল। তাতেই বসেছিলেন সামাদ সাহেব আর সুবীরবাবু। সিকিউরিটিরা দাঁড়িয়েছিল। ড্রাইভার
দুজন শুধু ভিতরে বসে চা খাচ্ছিল। আড়ালে সিগরেট খাওয়াটা উদ্দেশ্য।
࿕ ࿕ ࿕ ࿕
ডাকবাংলোয় স্বরূপ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল।
- অনেকক্ষণ থেকে?
- না, আপনাদের সাথেই তো এলাম। এখন যাবেন তো মিটিংএ?
- হ্যাঁ, তোমরাও থাকবে। মিটিংটা কালেক্টারিয়েটেই কোনো হলে হবে। পিছনদিকে কিছু জায়গা
থাকবে নিশ্চয়ই। ওদের তরফেরও জনপ্রতিনিধিরা তো থাকবে।
- আপনি কথা বলেছিলেন ডিএমের সাথে? পালিতবাড়ির মার্ডারের ব্যাপারটা নিয়ে?
- হ্যাঁ। বলেছিলাম। এসপির সাথেও কথা বলেছিলাম। সেইজন্যই তো বলছি তুমি বা তোমরা দু’একজন
থাকবে। প্রয়োজনে ‘দর্শকদীর্ঘা সে আওয়াজ উঠানি পড়েগি’!
স্বরূপ হেসে উঠল। নাঃ, তার দরকার হবে না। আপনার ফোন আর এই মিটিংএর
খবরেই কাজ হয়েছে।
- কী হয়েছে?
- পালিতবাবুকে ছেড়ে দেবে পুলিস। এই হয় তফাৎ। আমরা গিয়ে দেখা করেছিলাম সাহেবদের সাথে
তো ভুজুংভাজুং দিচ্ছিল – ফ্যামিলি ফিউড, হাসব্যান্ডই মারিয়েছে ওয়াইফকে, প্রপার্টি ডিস্পিউটও
হতে পারে … শালা সব হতে পারে কিন্তু ওই হারামজাদা
প্রমোটারের পাঠানো গুন্ডা হতে পারে না। উইটনেস দিচ্ছি, এ্যালিবাই দিচ্ছি … না … দেখছি।
আপনারা মিছিমিছি ব্যাপারটাকে কম্যুন্যাল এ্যাঙ্গেল দিচ্ছেন! … বাঙালি বলে হয়নি ঘটনাটা।
বাঙালি সফট টার্গেট এটা আপনাদের … কি যেন বলল ডিএমটা? ‘ফিগমেন্ট অফ ইম্যাজিনেশন’! …
আর যেই আপনার চিঠি এল, মাইনরিটি কমিশনের চিঠি এল, ডিজিপি ফোনে জিজ্ঞেস করল ব্যাপারটা
কি … তখন সুনারি ধরা পড়ে গেল পাশের চায়ের দোকানটার দেওয়া ক্লু থেকে … আর এসআই ডেকে
বলল আমাকে পালিতবাবুকে আমরা ছাড়ছি আপাততঃ। বেচারা আধঘন্টার জন্য সে রাতে দুর্গাবাড়িতে
গিয়েছিলেন। নইলে বৌএর সাথে উনিও মরতেন। আর কিনা ওনাকেই বৌকে মেরেছেন সন্দেহে কাস্টডিতে
থাকতে হল এতদিন।
ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন সামাদ সাহেব এবং সাঙ্গোপাঙ্গরা, “চলিয়ে
গুপ্তাসাহেব! ডিএমএর অফিস থেকে ফোন এসেছিল। ওরা তৈরি।”
࿕ ࿕ ࿕ ࿕
কালেক্টারিয়েটের হলঘরটা নেহাৎ ছোট নয়। মঞ্চে সংখ্যালঘু আয়োগের
অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ এবং জেলাশাসকের আসন। ডিএম সাহেব একটা কাজে গেছেন, বলেছেন একটু পরে
আসবেন। তাঁর জায়গাটা খালি রেখে বাকি দুজন বসেছেন। পিছনের সারিতে দুদিকে চেয়ারের সারি।
একদিকে এক এসডিও সমেত জেলাশাসকের তরফের বড়কর্তারা, অন্যদিকে সংখ্যালঘু আয়োগের আধিকারিকেরা।
নিচে সামনের দিকে, ডানদিকে বেশ কয়েকজন সহায়ক শ্রেণীর কর্মচারী। বাঁদিকে ধার্মিক সংখ্যালঘু
স্থানীয় প্রতিনিধিরা। মুসলমানই বেশি। দুতিনজন ক্রিশ্চান। শিখ এখনো অব্দি কেউ নেই। স্বরূপ
এবং তার সাথের ছেলেরা এই বাঁদিকেই দেয়াল ঘেঁষে বসল।
কিছুক্ষণ অভ্যর্থনা পর্ব চলল। ফুলের গুচ্ছ, মালা। আয়োগের অধ্যক্ষ
জেলায় জেলায় এধরণের মিটিং করার যে নতুন ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়েছে তার গুরুত্বের কথা বললেন।
অনেকক্ষণ কথা চলল ওয়ক্ফএর জমিবিবাদে। আয়োগ থেকে চিঠি দিয়ে আগেই
জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল আজকের আলোচনার বিষয়গুলো। সেইমত সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরা স্ট্যাটাস
রিপোর্ট তৈরি করে এনেছিলেন। ক্রিশ্চানদের একটা গোরস্তান নিয়ে বিবাদেও রিপোর্ট রাখা
হল কী কী করা হয়েছে না হয়েছে।
ফাঁসবি তো ফাঁস, এসে ফাঁসল বাঙালিদের প্রশ্নে। উপাধ্যক্ষ উঠে
বললেন, আয়োগ থেকে পাঠানো চিঠির সাত নম্বর প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছিল জেলায় বাঙালি
মাইনরিটি সঞ্চালিত স্কুল কটা, তাদের মধ্যে সরকারি অনুদান কটি পায়, প্রতি বছর তারা ঠিক
মত পেয়ে আসছে কিনা, স্কুলগুলোয় শিক্ষক সংখ্যা কত, ছাত্রসংখ্যা কত। আট নম্বরে জানতে
চাওয়া হয়েছিল সাধারণভাবে যে কটি স্কুলে বাঙলাভাষী ছাত্রছাত্রীরা পড়ছে এবং ভাষাবিকল্পে
মাতৃভাষা বাংলা পড়ছে, তাদের জন্য পাঠ্যবই আসছে কিনা, যদি না এসে থাকে তাহলে পাঠ্যপুস্তক
নিগমের কাছে বই চেয়ে ইন্ডেন্ট পাঠানো হয়েছে কিনা। এ সম্পর্কিত স্ট্যাটাস রিপোর্টটা
দিলে আমরা পরের প্রশ্নগুলো করতাম। আর চিঠি পাঠানোর এক মাস পর আমরা যখন এখানে এসেছি,
আপনারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সাথে কন্ট্যাক্ট করা যায়নি, ডিইও ছুটিতে আছেন
… এটা কী?
স্বরূপের পাশে বসে থাকা রতন বলল, “এটা শালা … বাল! হারামজাদাগুলো
জানে বঙ্গালিকে ঠেঙ্গা দেখালেও বঙ্গালি কিচ্ছু করতে পারবে না। মুরোদই নেই।”
- এ্যাই চুপ!
- কিসের চুপ? কউনো গুনাহ করলে বানি? তুই থাকবি তো থাক বসে। আমি যাচ্ছি। দুটো ফুঁক
মেরে আসি।
- চল, আমিও যাই। বলে আসছি সুবীরদাকে।
࿕ ࿕ ࿕ ࿕
কালেক্টারিয়েট ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিকের শেষপ্রান্তে দুতিনটে
চা জলখাবারের তোলা দোকান। বলতেই তোলা, কয়েকজনকে ফ্রি খাবার, চা যুগিয়ে যাওয়ার দৌলতে
প্রতিবছর ঠিকার রিনিউয়াল হয়ে যায়। দুটো বড় অমলতাস গাছের নিচে দোকানগুলো আর তাদের খদ্দেরের
ভীড়। রতন সিগরেট ধরিয়ে চা হাতে নিতে নিতে পিছন থেকে স্বরূপ চলে এল। দুজনে হাফ-বসা হয়ে
দাঁড়ালো রাস্তার ধারের দেয়ালটায় – নিচের সিমেন্টের অংশটুকুতে চায়ের ভাঁড় রেখে ঈষৎ বসে,
ওপরের লোহার রেলিংএ পিঠ দিল। রোদ থাকলেও বৃষ্টি হয়ে গেছে বলে গুমোট নেই।
- খালি তাও দেখিয়ে সব কাজ হয়ে যায় রে?
- অবস্থাটা যেমন তুই জানিস, তেমন আমিও জানি। লেগে থাকতে হয়। সরকারি মেশিনারি বস্,
এর মধ্যে থেকেই কাজ বার করতে হয়। করছি তো, এ্যাদ্দিন ধরে। কেউ ভাবতে পারত বিহারে বাঙালি
বিধানসভার ভোট বয়কট করার ডাক দেবে, মিছিল করবে রাজধানীতে, আর এখন পঞ্চায়েতের ভোটে লড়বেও
।
- সে ঠিক আছে। কিন্তু এইসব সরকারি লোকগুলোকে দেখলেই রাগ হয়ে যায়। কিভাবে দিব্যি
মুখের ওপর বেহায়ার মত বলে দিল, হয়নি। জানে যে এর ওপর কোনো এ্যাকশন হবে না। বাঙালিরা
তো আরো পারবে না কিছু করতে। … আরে আমার চা’টা কোথায় গেল?
“মানে?” রতনের সাথে সাথে স্বরূপও পিছন ফিরল
রেলিংএর দিকে। ওর কাপটাও নেই। “আরে?” বলতে বলতে দেয়ালের ওপারে উবু হয়ে বসে থাকা দুটো
পিঠের দিকে নজর পড়ল, “আরে, চোরনি পকড়ি গই!” রেলিংএর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা বিনুনি ধরে
টেনে ওঠাল দুজনকে। রতনের দিদির দুই মেয়ে – শ্রেয়া আর রানি, বছর নয় আর সাতের। পরণে স্কুলের
পোষাক, পিঠে ব্যাকপ্যাক। দুজনেরই হাতে চুরি করা দুটো চায়ের ভাঁড়।
“তু সব কহাঁ সে রে?” দারুণ খুশি হয়ে প্রশ্ন
করল রতন, “মম্মি কহাঁ হ্যয়?” বলতে বলতেই চোখ তুলে দেখল রাস্তার ওপারে রিকশায় বসে সুপ্রিয়া
হাসছে।
“আ, ভিতর আ, সমোসা খায়েগি, কি মিঠাই”, বলে
হাত তুলে ডাকল সুপ্রিয়াকে। রিকশাওয়ালাকে হেঁকে এদিকে আসতে বলল। “ভিতর আও তুমসব!”
স্বরূপ ধমকের সুরে থামাল, “ওদেরকে ভিতরে আসতে
বলছিস কেন? ওইদিকে ক্যাম্পাসের গেট। ঘুরে আসতে আসতে দশ মিনিট লেগে যাবে ফালতু। বেচারারা
খিদে, তেষ্টায় আছে। ওরা এখানেই থাক, যা খাবে ওরা এনে হাতে দিয়ে দে, খেতে খেতে বাড়ি
চলে যাবে। “কী খাবি? আচ্ছা দাঁড়া, এ সত্রুঘনজী, আঠ সমোসা অওর আঠ গুলাবজামুন পার্সেল
কিজিয়ে তো!”
“আটটা কী হবে?” সুপ্রিয়া রিকশা থেকে নামতে নামতে হাঁ হাঁ করে
উঠল। “কেন, ওদের বাবাও তো খাবে বাড়ি ফিরে!”… মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “অফিস
থেকে কখন ফেরে রে তোদের বাবা?” “সাত বজে” মেয়ে দুটো সমস্বরে জবাব দিল। স্বরূপ সুপ্রিয়ার
দিকে তাকাল, “একফোঁটাও বাংলা শেখাওনা ওদের!” “সময়ই পাইনা দাদা। আর ওদেরই বা সময় কোথায়?”
… সুপ্রিয়ার জবাব শুনে রতনের দিকে তাকাল স্বরূপ। রতন দোকানির হাত থেকে একটা পলিথিনে
সিঙাড়ার ঠোঙা আর পাউচবন্দী গুলাবজামুন নিয়ে আসছিল। “তুইও তো মাঝে মধ্যে গিয়ে শেখাতে
পারিস। কিসের মামা তুই? ওরা হিন্দি বলে বলুক, তুই বাংলায় কথা বল, ওদের সাথে! ওদের বাবা
অন্ততঃ তাতে আপত্তি করবে না। বলভদ্রজীকে আমি চিনি।”
কথা থামাতে হল। পকেটে ফোনটা বাজছে। সুবীরদা। “কোথায় তোমরা? এখানকার
কাজ তো শেষ। গেটের কাছে এস। একবার এসপির সাথে দেখা করতে যাব।”
- ফোন করে জেনে নিই, আছেন কিনা?
- একদম না। গেটের কাছে আমার গাড়িটা আছে, এস ওখানে।
গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছিল স্বরূপ আর রতন। ওদিকে দেখতে পেল হলের
পোর্টিকো থেকে বেরিয়ে আসছেন সুবীরদা আর ওদের দলের বাকি দুজন, সুবল গোস্বামী আর নিতাই
বিশ্বাস। স্বরূপ আর রতন শহরের বাসিন্দা, ওঁরা দুজন উদ্বাস্তু কলোনীর প্রতিনিধি – একজন
মাঝেরিয়ায় থাকেন, আরেকজন রামনগরে। একটু চুপচাপ, কেননা ওঁদের আসল প্রতিনিধি, স্কুলশিক্ষক
গোপাল মন্ডল আজকে আসতে পারেননি।
- আপনি ফোন করতে মানা করলেন কেন? এসপি না থাকলে মিছিমিছি হয়রানি হবে।
- কোনো হয়রানি হবে না। ওই তোমাদের পালিতবাবুকে আপাততঃ কাস্টডি থেকে রেহাই দেওয়ার
কথাটা যদি হয়ে থাকে, আমার একটা কার্টেসি ভিজিট কর্তব্য। না থাকলে কোনো ক্ষতি নেই। জানবেন
যে আমি এসেছিলাম।
࿕ ࿕ ࿕ ࿕
বিকেলের আলো ঈষৎ ম্লান। তবে আকাশ আর মেঘলা নেই। ঝকঝকে রোদ্দুর।
ডাকবাংলোর বাগানে, বারান্দায়, বড়ঘরে সব জায়গায় ভীড়। বেশির ভাগই জেলার বিভিন্ন দিক থেকে
আসা মুসলমান সমুদায়ের প্রতিনিধি। বাঙালি বলতে সুবীরবাবু ছাড়া তারা পাঁচজন; গোপাল মন্ডল
শেষে আসতে পেরেছেন। ক্রিশ্চান একমাত্র ওই ব্রাদার রবার্ট এবং তাঁর এক সঙ্গী। লক্ষ্যণীয়
যে পুরো ডাকবাংলোয় মাত্র একজন মহিলা। ডাকবাংলোর কর্মচারী, দুপুর থেকে চলা মেঝে পোছার
কাজটা সেরে বাড়ি যাচ্ছিলেনই, হঠাৎ চা নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে যাওয়া ছেলেটিকে বকার
জন্য থেমে গেছেন। বকেই চলেছেন তখন থেকে কেননা ওর হাত থেকে চা চলকে পড়েছে দরজার কাছে।
আবার পোছাটা নিয়ে আসতে গেলেন মহিলা।
বড় ঘরে অধ্যক্ষকে তাঁর সমুদায়ের লোকজনের সমস্যা সামলানোর জন্য
রেখে উপাধ্যক্ষ ঢুকলেন পাশের ছোটো ঘরটায়। স্বরূপ মিত্র, রতন দাস, গোপাল মন্ডল, সুবল
গোস্বামী, নিতাই বিশ্বাস এবং আরো একজন বসেছিল। সে সদ্য এসেছে। মাথা ন্যাড়া, হাতে একটা
বড় মিষ্টির প্যাকেট। মুখটা চোয়াড়ে।
সুবীরবাবু ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়াল। বড়ঘরটার দিকে আঙুল দেখিয়ে
সুবীরবাবু বলে উঠলেন, “কমিশন ওখানে, তোমরা এখানে, এটা কিরকম? আমায় তো ওখানেই বসতে হত।
তোমরাও ওখানেই যেতে, নিজেদের কথা বলতে। আমি যেমন শুনব, অধ্যক্ষসাহেবও শুনতেন। সামাদসাহেব
ভালো লোক। নিজেই আমার কানে কানে বললেন, ওরা বোধহয় আপনার সাথে আলাদা করে কথা বলতে চায়,
গিয়ে শুনে নিন। বল!”
“এই যে এই কান্তি, কান্তি হীরা। ওর লজ্জা করছিল”, গোপাল মন্ডল
বলতে না বলতে ন্যাড়া মাথা লোকটি ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকল সুবীরবাবুর পায়ে। “লজ্জা?
লজ্জার কী আছে? কী সমস্যা ওনার?” সুবীরবাবু মুখ দেখে হেসে উঠল সবাই। স্বরূপ বলল, “না
না … তেমন কিছু না, আসলে ও বাংলা বলতে পারেনা একবর্ণও। বলল, ওঘরে সবাই যদি জানে যে
বাঙালি সমিতির লোক আর বাংলা জানে না, হয়ত আপনাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। তাই এঘরেই একটিবার
আপনাকে ডেকে নিই। আপনাকে প্রণাম করবে আর … কা হো কান্তি, পহনাব মালা নেতাজীকে, অও মিঠইয়া
কহাঁ রখল?” কান্তি পলিথিন থেকে বার করে একটা মালা পরাল সুবীরবাবুকে আর মিষ্টির প্যাকেটটা
হাতে দিতে গেল।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। তা বাংলা জানোনা কেন?
- আসলে ও …
- (সুবীরবাবু হাত তুলে থামিয়ে দিলেন গোপালকে) ওকেই বলতে দাও। ভোজপুরি বা হিন্দিতেই
বলুক না। আমিও তো বিহারেরই লোক। ভোজপুরিও জানি, মগহি আর মৈথিলিও বুঝি। অঙ্গিকা বলতেও
পারি। বল, তুমিই বল কান্তি।
কান্তি লাজুক গলায় ভোজপুরিতে যা বলল তা এই।
সে থাকে বাল্মিকিনগরের কাছেই একটা গ্রামের উদ্বাস্তু কলোনিতে।
ছোটোবেলা থেকেই জঙ্গলের ঠিকেদারিতে মজুরের কাজ করছে। কাজেই লেখাপড়া সেভাবে শেখেনি।
আর বাংলার প্রতি তার কোনো টানও ছিল না। বরং নিজের পরিচয় ভোজপুরিভাষী হিসেবেই দিত। বাড়িতে
বাবা, মা, দিদি আর ঠাকুমা থাকত। ঠাকুমা তো শুধু বাংলাই জানত। বাবা আর মা বাংলা আর ভোজপুরি
দুটোই বলত। দিদি বাংলা, ভোজপুরি, হিন্দি সব বলত দিব্যি। এক ওই অভাগা জঙ্গলে জঙ্গলে
কাজ করেছে, কিছুই শেখা হয় নি। … দিদির বিয়ে হয়ে গেল। এই আষাঢ় মাসে বাবা মাকে নিয়ে গিয়েছিল
পাটনায় বড় ডাক্তার দেখাতে। … বাড়িতে ঠাকুমা একা থাকবে বলে ও এক সপ্তাহ কাজ থেকে ছুটি
নিয়ে বাড়িতে ছিল। এমনিতেও খুব ভালোবাসত ঠাকুমাকে। হবি তো হ, তখনই ঠাকুমার হল ধূম জ্বর।
যায় যায় অবস্থা। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঝমঝম বৃষ্টির রাত। ঠাকুমা বলল, ইস, যদি কেউ
পাঁচালীগান শোনাত এই শেষ সময়ে! … কান্তি জানত পাঁচালীগান হয়। মাঝেমধ্যে প্রোগ্রাম করে
হয়েছে কোনো গ্রামে শুনেওছে। ঠাকুমার প্যাঁটরার মধ্যে সত্যনারায়ণের পাঁচালী আছে তাও
ও জানে। কিন্তু পড়বে কী করে? শেষে ঠাকুমার অবস্থা দেখে সেই বৃষ্টির মধ্যে ছুটল হাইওয়ে
ধরে পাশের একটা গ্রামে, যেখানে একজনের বিষয়ে সে জানত, দরকার পড়লে সত্যনারায়ণ পুজোয়
পাঁচালী পড়ে। লোকটি বাঙালি নয়, এদিককারই ব্রাহ্মণ, কিন্তু রোজগারে সুরাহা হয় বলে বাংলাটাও
শিখে নিয়েছে। … তার বাড়িতে গিয়ে হাতেপায়ে ধরে, ভালো দক্ষিণা দেওয়ার কসম খেয়ে নিয়ে এল
বাড়িতে। সেই রাতে ব্রাহ্মণ ঠাকুমার কানের কাছে সত্যনারায়ণের পাঁচালী পড়ে গেল আর … ঠাকুমার
মুখটা কান্তি দেখল, শান্ত হয়ে যাচ্ছে। পাঁচালী শুনতে শুনতে ঠাকুমা মরে গেল। যেন পাঁচালী
ছিল না, গঙ্গাজল ছিল, অপ্পন ভাসা কে গঙ্গাজল! তাই আমি এখন সংকল্প করে নিয়েছি যে নিজের
ভাষা আমি শিখেই ছাড়ব। আর আপনাদেরই সাথে থাকব। …
“একদম, একদম, কান্তি! সব সাথে রহে কে চাহি। ”, গোপাল মন্ডল বলে উঠল।
সুবীরবাবু অবাক হয়ে কান্তি হীরার জলে ভরা চোখের দিকে চেয়ে রইলেন।
রাত্রে গাড়ি ছুটছিল ফেরার পথে লালগঞ্জের অন্ধকার রাস্তায়। সুবীরবাবু
যেন নিজেই কান্তির সেই রাতের বৃষ্টিতে ভিজছিলেন। হাতের মোবাইলটায় গুগল সার্চে গিয়ে
বাংলায় টাইপ করলেন সত্যনারায়ণের পাঁচালী। পড়ে মনে মনে গুনগুন করে উঠলেন, “প্রণমহ নারায়ণ
সত্য অবতার …”
সামাদ প্রশ্ন করলেন, “আপনাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে গুপ্তাসাহব?
কী দেখছেন?” মোবাইলটা পাশে নামিয়ে রেখে কান্তি হীরার গল্পটা সামাদকে শোনালেন সুবীরবাবু।
“তীর্থযাত্রা হয়ে গেল সামাদসাহেব! বোতলে নয়, কিন্তু বুকে ভরে গঙ্গাজল নিয়ে যাচ্ছি।
মাতৃভাষার গঙ্গাজল!”
࿕࿕࿕࿕࿕࿕࿕࿕࿕࿕
No comments:
Post a Comment