Monday, July 26, 2021

পহলেজা ঘাটের টিকিট

স্টিমারটা তো স্টিমারই থাকবে । বদলাবে আকাশের রঙ, মেঘের পরিমাণ, হাওয়া । বদলাবে আমার রক্তের অভিসার ।

যেমন আজ, বৃষ্টিঘন দুপুর ঝিরঝির আঁধারে বেলা বোঝা যায়না । পাঁপরওয়ালা তার তোলা উনুনটা ডেকের রেলিঙের ওপার থেকে ছাদঢাকা এপারে, ভীড়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে । যদিও দুটোই বেআইনি চলন্ত স্টিমারের ডেকে উনুন জ্বালানো, রেলিঙের এদিকে হোক বা ওদিকে দুটোই চলে এখানে গঙ্গার বুকে । পাঁপরভাজা চলছে । নীট দুভাঁজ করা এক এক পীস । বিক্রিও হচ্ছে হাতে হাতে ।

কী নেই এ স্টিমারে । এটা পূর্ব রেলের নিজস্ব স্টিমার । নীচে কেটারিংএর দোকানে টোস্ট, পকোড়া, চা । দোতলায় ডেকের একপাশ দিয়ে ফার্স্টক্লাস কেবিন । নীচে মাঝখানটায় ইঞ্জিনঘর । তার ওপরে দোতলায়, ডেকের ঠিক মাঝখানে কন্ট্রোলরুম । তেতলায় ছাদের মাঝখানে ক্যাপ্টেনের ঘর । সেখানে উঠে যাওয়ার সিঁড়িটা কী রোমাঞ্চকর !

আর আছে আমাদের বোদ্ধা-মেজাজ । সহকর্মীদের নিয়ে একসাথে নতুন সংগঠন গড়তে চলেছি ।

কিন্তু সে সফরে কি বৃষ্টিঘন দুপুর আছে ? নাঃ, বৃষ্টিঘন দুপুর তো আছে সেই... কয়েকটি বছর আগের, ভালোবাসায় টইটুম্বুর এক নিজস্ব একাকী সফরে ! যেমন রাতের ডেকের আলোআঁধারি আছে তারও অনেক আগের, মা-বাবার হাত ধরে সারা সফরগুলোয় ।

সংগঠন গড়ার সফরে তো সকাল, মার্চের, পাশে সুমিত; আমার সব সাংগঠনিক ধারণাগুলো খুব সহজে মেনে নিচ্ছে আর আমি দমে যাচ্ছি যে কোথাও একটা গলদ রয়েছে আমার চিন্তায় । কেননা আমার চিন্তাধারাটা ওর নয় বলেই জানতাম । যেমন তার আগের, সংগঠন ভাঙার সফরটাতেও, জুন মাসের সকাল । যদিও দুপুর পেরোতে পেরোতে আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গ দেব না স্থির করে নিয়েছি । তাও কোনো সাংগঠনিক কারণে নয় । শুধু, দুপুরে খাবারে দেরি হচ্ছে বলে ডেলিগেট খেপিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দুটো বড় বড় ভরা দইয়ের মালসা, ডালের হাঁড়ি, তরকারির ডেকচি ওরা যেভাবে মাঠে আছাড় দিয়ে নষ্ট করল, সেটা দেখে । যে বুড়ো, সঠিয়ে যাওয়া নেতাটির একাধিপত্যের বিরুদ্ধে অভিযানে শামিল হয়ে এসেছিলাম, তারই গৃহশহরে তার ও তার সাথীদের করা এই সম্মেলন-প্রস্তুতি, যত্ন ... এগুলো পন্ড করে দেওয়ার মানে কী ? আবার সেটাও এক সফর, আরো কিছুকাল পরে বোধহয় শেষ বা তার আগের সফরটা । ফেডারেশনের সম্মেলন । অনেকে রাতের শেষ স্টিমারটা ধরে বেরিয়ে গেছে । আমরা কয়েকজন দেরিতে পৌঁছে, মহেন্দ্রু ঘাটের দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িটার নীচের জায়গাটায় চাদর পেতে, বেশ ঘাপটি মেরে বসেছি; নভেম্বর মাস, গোলাপি শীত, মার্ক্সবাদের ক্লাস নিচ্ছি রাতভর ।

এত বার স্মৃতিতে এই স্টিমারের চাকার ঘর্ঘর শব্দ, জলে অপসৃয়মান মানুষের ছায়া যে সব মিশে এক হয়ে যায় । সফর ছাড়াও তো স্টিমারঘাটে যাওয়াগুলো থাকবে । যেমন পাতাঝরার দিনে একটা বেলা খুঁজে দোতালার রেস্তরাঁটায় পৌঁছোনো । নিজেকে বেশ একজন উঠতি কবি ভেবে, খোলাছাতে বসা, এক পট কালো চা আনিয়ে সিগারেট ধরানো ।... গাছের ডগায় বেরুনো লালচে নতুন পাতাগুলো থাকবে, টেবিলে বসে লেখা কবিতার, যেমন হোক, লাইনগুলো থাকবে । দীপন, রবীনদা, আলোকজী, মাঝে মাঝে শিউবচ্চনজী... সবাইকে শোনানো থাকবে প্রফেসর্স লেনের দোতলায় অথবা দশ নম্বর রোডের অন্ধকারে । শিউবচ্চনজী যাবেন গোপালগঞ্জ কলেজে পড়ান । স্টিমারের ডেকে পৌঁছেই চাদরটা ব্যাগ থেকে বার করে জড়িয়ে নেন । নীচে দাঁড়িয়ে আমরা অবাক হচ্ছি দেখে হেসে চেঁচিয়ে বলেন, হিমালয়ের দিকে যাচ্ছি তো, ঠান্ডা লাগছে !

-----

ব্রীজ তৈরি হয়ে গেছে । স্টিমার বন্ধ হয়ে গেছে । পাটনা জাংশনের টিকিট রিজার্ভেশন কম্পিউটারাইজড হয়ে যাওয়াতে কাউন্টার খুলেছে বেশ কয়েক জায়গায় । হাওড়ার টিকিট কাটার ছিল । হঠাৎ মনে হল, মহেন্দ্রু ঘাটটাও তো পূর্ব রেলের ! ওখানেও খুলে থাকবে নিশ্চই । তখন আবার এসব নিয়ে একটু বেশি চিন্তাভাবনা রেলের কর্মীসঙ্কোচন, ব্যায়সঙ্কোচন, বেসরকারীকরণ ...। দেখাই যাকনা, খুলেছে কিনা, কাছেই তো । মনে হচ্ছে, খবরের কাগজে যেন পড়েওছিলাম ।

ঠিক । খুলেছে । কী অবস্থা হয়েছে ঘাটের বাড়িটার । দোতলার রেস্তরাঁয় তালা । ভিতরে দেখা যাচ্ছে আবর্জনার ডাঁই, মাকড়শার জাল, ঝুল । সিঁড়ির নীচের জায়গাটা যেখানে রাতভর বসেছি, বাতিল বাক্স-প্যাঁটরায় ঠাসা । বাকি বাড়িটাতেও কোথাও কোনো লোকজন নেই । জলে জেটি নেই, জেটিতে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি ভেঙে পড়েছে । ধোপারা কাপড় শুকোচ্ছে দড়ি টাঙিয়ে । শুধু, ওই একটা কাউন্টার খোলা রিজার্ভেশনের । অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে । আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম ।

এগুচ্ছি । পাশ থেকে একটা ছেলে এগিয়ে এলো, কলকত্তার টিকিট চাই, কনফার্মড ?

- নাঃ । -

- কোন জায়গার টিকিট চাই ?

কী মনে হল, বললাম, পহলেজা ঘাটের টিকিট চাই । সবাই ঘুরে তাকালো । ছেলেটা হো হো করে হেসে উঠলো, পহলেজা ঘাট ! আরে স্টিমার কব কা বন্দ হয়ে গেছে । কোত্থেকে আসছেন বলুন তো আপনি ?

ও আচ্ছা, ঠিক আছে বলে লাইন থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা দিলাম । পাটনা জাংশন থেকেই কাটবো হাওড়ার টিকিটটা ।

পহলেজা ঘাটে নেমে বালুচরে সারি দিয়ে ভাত-রুটির দোকান, ডেকচির ঢাকনায় মসলা দিয়ে ভাজা বাচা মাছ । একটু উঠে গিয়ে সোনপুর, মুজফ্‌ফরপুর বা উল্টো দিকে ছাপরা, সিওয়ান, গোপালগঞ্জের ট্রেন । কতবার দৌড়ে সিট লুটলাম ।... সে মাছভাজা-ভাত আর খাওয়াই হলোনা । গঙ্গার বুকেও বিশাল চড়া এখন ।

 

ফেসবুকে Dipon Mitra

বিদ্যুৎ, কত স্মৃতি আমারও যে জড়িয়ে আছে এই বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘাট আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া লঞ্চ যাত্রার! এখানেই বুলুদা বৌদিকে নিয়ে এসেছিলাম। সে এক অলৌকিক জ্যোৎস্নায় গঙ্গার জল স্থির, অল্প দূরে গিয়ে গোল ঢাল হয়ে নেমে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার জীবন আজও যেন সেইখানে স্থির হয়ে আছে। ............মনে পড়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে দাদার বন্ধু নাড়ুদার সঙ্গে যাব দিনাজপুরের বংশীহারী গ্রাম। এই পথেই স্টিমারে এসে শোনপুর থেকে ট্রেন ধরেছিলাম। সেই অপেক্ষমান ট্রেন, তার কালো ধোঁয়া এখনও বাতাসে ভাসমান।।.............এই জেটিতেই শীতের এক প্রায় নির্জন সন্ধ্যায়, ফাল্গুনী রায়ের সঙ্গে প্রথম ব্যোদলেয়ার সম্পর্কে এক গাঢ় বোধ জন্ম নেয়। ওপারে অন্ধকার চরে টিম টিম করছিল কয়েকটি জোনাকির মত আলোর ফোঁটা।

 

১৮.৫.২০১৬

No comments:

Post a Comment