অমরকন্টক। দুই নদীর উৎসমুখ।
পূর্বদিকে সোন। উৎসমুখটা তো মন্দিরের কব্জায়। মন্দিরের ভিতর থেকে কিছুদূর গিয়ে ক্ষীণ ধারা সোজা সাড়ে তিনশো ফুট নিচে নেমেছে (উপুড় হয়ে শুয়ে সেখানে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে জল খেয়েছি, ভাবতে পারো?)। বিন্ধের পাহাড়শ্রেণী এঁকেবেঁকে পেরোতে পেরোতে, রাস্তায় জলধারা সংগ্রহ করতে করতে শেষে বিহারে, কোইল্ওয়রের কাছে গঙ্গায় মিশেছে।
আর পশ্চিমদিকে নর্মদা। জঙ্গলে যেখানে ঝরনা হয়ে নামছে তার পিছনে একটা ছোট্টো গুহা ছিল, অবশ্য সিনেমার মত নয়, ভিতরে কোথাও যায় না, একটা পুজোর জায়গা ছিল; গিয়েছিলাম সেখানে – জলের পর্দার ভিতর দিয়ে শালবন, কেমন দেখতে লেগেছিল অবশ্য মনে নেই। নদীটি প্রথম থেকেই গায়েগতরে সোন থেকে বেশি। সাতপুরা পাহাড়শ্রেণী ঠিক ওভাবেই পেরোতে পেরোতে, বরং নিজের এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী হতে হতে শেষে গুজরাটে। সোজা সমুদ্রেই গিয়ে পড়ে বোধহয়! আরবসাগরে? ছিয়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে সন্ধ্যায় বাস থেকে নামার সময় ঠিক মনে পড়ে নি।
সত্যি বলতে, কোনো নদীর কথাই মনে ছিল না তখন। মনে ছিল শুধু ওই ছেলেটির কথা। সকালে জব্বলপুর বাসস্ট্যান্ডে, প্রতিবাস-একটাকা-মজুরির-বদলে-সওয়ারি-ডাকা যে বাচ্চা ছেলেটির সস্নেহ থাপ্পড় পড়ছিল বাসটার গায়ে, “যা রে বুঢ়ি মাই, কাশি টাশি বন্ধ কর এবার! সওয়ারি ফুল! স্টার্ট নে আর বেরিয়ে যা!… অমরকন্টক! অমরকন্টক! ক্র্যাকমেল! আসুন! আসুন!
এর বয়সেরই বাচ্চা ছেলের পুরো একটা দল
দেখেছিলাম আগের দিন ধুঁয়াধার জলপ্রপাতে। আমরা এপারে, ওরা ওপারে। মার্চ মাস, নদীর
ধারা শীর্ণ; হয়ত পাথরে পাথরে টপকে ওপারে চলে গেছে। চিৎকার করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছিল,
চারআনার সিকি ফেলুন প্রপাতের নিচে। লোকে ফেলছিল, যেখানে জল পড়ছে ধোঁয়া হয়ে – ওরা
ঝাঁপ দিয়ে পড়ছিল সিকির সাথে সাথে, জলে ডুব দিয়ে উঠিয়ে আনছিল।
একেই কি বলে জীবনের সাথে মরণখেলা? অমরকন্টকে নেমে মনে ছিল সেই ছেলেগুলোও।
পুরো রাস্তায় ‘বুঢ়ি মাই’ কোথাও বেগড়বাঁই করেনি। নিজের লজ্ঝড় শরীরে গোঁ গোঁ শব্দ তুলতে তুলতে পার করেছে, সাতপুরার ভিতর দিয়ে দীর্ঘ উপত্যকাপথ। মাঝে মধ্যে নির্জন পাহাড়তলিতে থেমেছে। দূরের লোকালয়গুলোতে যাওয়ার জন্য দু’একজন স্থানীয় সওয়ারিকে নামিয়েছে।
অমরকন্টকে পৌঁছে বাস যেখানে নামাল, তার পাশেই সন্ধ্যারাতের ভাঙাহাট। একটা ভাতরুটির দোকান। চা’ও পাওয়া যায়। ফর্সা মোটা মহিলাটি বললেন, সামনেই মন্দির, ওরা জায়গা দিয়ে দেবে। চোখে পড়ল একটি ফুটফুটে সুন্দরী কিশোরী ভিতরে খাটে বসে লেখাপড়া করছে। সেই এসে চা করে দিল।
মন্দিরের পুজারীজি একটা আস্ত ভাঙা ঘর দিলেন।
ঘরের মেঝে ওপড়ানো, একটা বন্ধ জানলা, একটা বাল্ব, ছ’ফুট বাই ন’ফুট দেয়াল। কম্বল আর
বাক্স রেখে ফিরে গেলাম দোকানে।
মা রুটি করছিলেন; সেই মেয়েটিই, সুমন, শালপাতার দোনায় আলুর তরকারি আর রুটি এনে রাখল বেঞ্চের ওপর। মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। মনে পড়ল পারুল বোনের কথা। দেখব নাকি এক্ষুণি ভেড়াঘাটের ওই ছেলেদের দলটাকে, আর বাসস্ট্যান্ডের ওই ছেলেটাকে! ঢুকবে ওরা রাতের নিশুতি পেরিয়ে দোকানে?
রাত্রে মন্দিরের ওই ঘর থেকে জানলা টপকে জংগলে নেমেছিলাম একবার। উপরে তাকিয়ে অজস্র তারার ঝাঁকের যেন শিশিরে ভিজবার শব্দ শুনলাম, মুড়ি দুধে ভিজতে থাকলে যেমন হয়।
শেষরাত। ছুট দিলাম। অনেকখানি শালবনের চড়াই উৎরাই পেরোতে আলো ফুটতে শুরু করল। যখন পৌঁছোলাম!… এ কোথায় পৌঁছোলাম! আদিগন্ত বিস্তৃত জমাট কালো সমুদ্রের তরঙ্গরাজি! এই তাহলে বিন্ধ্য পর্বতমালা? আর তার শেষ প্রান্ত থেকে এক লাফে আকাশ বিকীর্ণ করে ঝলসে উঠছে সাদা সুর্য! যেহেতু ধুলো নেই, মেঘ নেই তাই আকাশে কোথাও লাল, গোলাপি, কমলার বর্ণবিচ্ছুরণও নেই।
ফিরছিলাম। হঠাৎ ঘাসের ওপর দেখি নৃত্যরত একটি টিট্টিভ! …
একটু পরে বাস আসবে শহডোল হয়ে অনুপপুর যাওয়ার। হাতে বাক্স, কাঁধে কম্বল, পৌঁছোলাম দোকানটায়, জলখাবার খেতে। সুমন পড়ছে। নাঃ, ভাইগুলো আসার সময় পায় নি।
যদি ভাইগুলো আসত? ধুঁয়াধার থেকে নিয়ে এসে মেয়েটির কোঁচড়ে ঢালত কয়েক মুঠো ভেজা নুড়ি? জব্বলপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে কিনে নিয়ে আসত লজেন্স? নাকি মেয়েটিই যাবে কোনোদিন?
দেখা তো হয়েছিলই। কে কাকে কিভাবে চিনেছিল? নাকি আদৌ চেনেনি?
___________________
No comments:
Post a Comment