-
“ডাক্তারবাবু,
আমাদের জাতি প্রমাণপত্র হবে না? আমাদের জমির পাট্টা? বিপিএলের লালকার্ড? কিসান ক্রেডিট
কার্ড? … সেচনালায় জল আসছে না! ফসল খেয়ে যায় সরৈয়ামন অভয়ারণ্যের হরিণ, বুনোশুয়োর! জমি
জবরদখল করছে স্থানীয় দবঙ্গেরা! ডিসিএলয়ারকে বলা হয়েছে। … ডাক্তারবাবু, আমাদের বাচ্চাগুলোর
বাংলা পাঠ্যপুস্তকের কী হল? আর বাংলা টিচার?”
এরই মধ্যে হাতে
পিটিশন নিয়ে এগিয়ে এল তিনটি মেয়ে, “আমাদের তিন কিলো করে ডাল দিয়ে ন’কিলো লিখিয়ে নিয়েছে
আঙ্গনবাড়ি সেবিকা, জিজ্ঞেস করলে বলছে – ‘সিডিপিওকে পাঁচ হাজার টাকা কি আমি আমার ঘর
থেকে দেব?’ … “
পশ্চিম চম্পারণের
বিভিন্ন ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চব্বিশেরও বেশি বাঙালি উদ্বাস্তু গ্রাম বা গ্রামের
মধ্যে বাঙালি উদ্বাস্তু টোলা। বাইরে থেকে হঠাৎ করে কেউ ঢুকে গ্রামের মুখে চা-বিড়ির
গুমটিটার সামনে দাঁড়ালে বুঝতেও পারবে না আশেপাশে সবাই বাঙালি, দোকানদারও বাঙালি। কেন
না কথাবার্তা তার সামনে টিপিক্যাল চম্পারণি ভোজপুরিতে হতে থাকবে।
একটু ভিতরে
ঢুকতে হবে বাংলা শুনতে হলে।
বাঙালি সমিতি
বলতে গেলে কাকতালীয় ভাবে সেই ‘একটু ভিতরে’ ঢুকে পড়েছে। যদি ঝাড়খন্ড রাজ্য আলাদা হয়ে
যাওয়ায় বাকি বিহারের বাংলাভাষী বিহারী জনসাধারণ রাজনৈতিকভাবে মার্জিনালাইজড হয়ে পড়ার
সঙ্কটটা না অনুভব করত, আর যদি ঠিক সেই সময়েই ডাঃ (ক্যাপ্টেন) দিলীপ কুমার সিংহ বিহার
বাঙালি সমিতির অধিবেশনে সভাপতির পদে কাকতালীয়ভাবে (এমনকি তাঁর অনুপস্থিতিতে) নির্বাচিত
না হতেন তাহলে হয়ত বাংলাভাষী বিহারীদের ঐক্যের এই ডাইমেনশনটা তাদের নিজেদেরই কাছে অজানা
থেকে যেত। এর বেশি বলতে গেলে বিগত সাত বছরব্যাপী সংগ্রামের ইতিহাসটা বলতে হয়।
* *
* * * *
১। জমি সংক্রান্ত
সমস্যা
মোটামুটি চার
একর করে জমি প্রত্যেক উদ্বাস্তু পরিবারকে সে সময় দেওয়া হয়েছিল। তিন চার প্রজন্ম পেরিয়ে
আজ পাঁচজনের পরিবার পঁচিশ-তিরিশ জনের হয়েছে, অথচ যেহেতু জমির পাট্টা তারা আজ অব্দি
পায়নি তাই জমির বাঁটোয়ারাও হয়নি। ফলে সরকারী স্তরের যে কোনো সার্ভেতে প্রতিটি সদস্যের
আর্থিক অবস্থার হিসেবে ওই পারিবারিক চার একর জমির মালিক (অবশ্যই দানসত্বধারী) হিসেবে
করা হয়। কাজেই তাঁরা বিপিএলের লাল কার্ডও পান না, ইন্দিরা আবাস যোজনার লাভও পান না,
ব্যাঙ্কে গিয়ে কিসান ক্রেডিট কার্ডও পান না।
বিহার সরকারের
বর্তমান আধিকারিকেরা জানেনই না, অথবা জেনেও মানতে চান না যে কোনো এক সময়ে এই জমিগুলো
কেন্দ্রীয় সরকার কিনে নিয়েছিল। তারপর মোটামুটি চার একর হিসেবে প্রত্যেকটি উদ্বাস্তু
পরিবারকে দেওয়া হয়েছিল। প্রতি মাএ উদ্বাস্তু পরিবারেরা যে অর্থসহায়তা পেত তা থেকে জমির
দাম বাবদ কিছু টাকা কেটে নেওয়া হত। শেষে ১৯৯৪ সালে নির্দেশাবলী জারি করে কেন্দ্রীয়
সরকার তাদের বাকি দাম মকুব করে এবং জমির মালিকানা সত্ব ওই পরিবারগুলিকে হস্তান্তর করে।
কাজেই তারা এখন জমির মালিক এবং পাট্টা পাওয়ার হকদার। এই সাধারণ সত্যটা বিহার বাঙালি
সমিতি আজও সরকারকে বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
পূর্ববঙ্গ বা
পূর্বপাকিস্তান থেকে এসে যাঁরা এই বিহারের জমি আবাদ করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই তপশীলী
জাতির মানুষ। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের জাতিগুলির নাম বিহারের তপশীলে নেই।
এতদিন যাবৎ সেই অজুহাতে তাঁরা কোনোরকম জাতি-প্রমাণপত্র পান নি। সরকারি দপ্তরগুলো থেকে
তাঁদেরকে ‘বঙ্গালি শরণার্থী’ বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হত। অনেক লড়াইয়ের পর সরকার
নির্দেশ জারি করায় এখন তাঁরা জাতি-প্রমাণপত্র পাচ্ছেনও কিন্তু সেটা বিহারের হিসেবে।
অর্থাৎ, ‘অতিপিছড়া’ বা এক্সট্রীমলি ব্যাকওয়ার্ড কাস্টের প্রমাণপত্র। মুখ্যমন্ত্রীকে
সমস্যাটা বোঝানোয় তিনি বাঙালিদের অন্যান্য সমস্যাগুলোকে পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিহার বাঙালি
সমিতিকেই একটা সার্ভে করতে বলেন। সরকারের নির্দেশক্রমে, বিহার বাঙালি সমিতির সহযোগিতায়
আদ্রি (ADRI – Asian Development Research Institute) সদ্য একটি সার্ভে সম্পন্ন করেছে।
সরকার সেই সার্ভের রিপোর্ট স্বীকার করলে, চিহ্নিত বাঙালি জাতিগুলোর নাম বিহারের তপশীলের
অন্তর্ভুক্ত করার শংসা করবেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।
৩। শিক্ষাসংক্রান্ত
সমস্যা
এই সমস্যাটা তত্ত্বগতভাবে তাঁদের ক্ষেত্রে তেমনই যেমন শহরের বাঙালিদের ক্ষেত্রে। বাস্তবে তফাৎ যে তাঁরা আত্মপরিচয়ের তীব্র সংকটের মুখোমুখি হয়ে মাতৃভাষাকে য্রভাবে আঁকড়ে ধরতে চান, শহরের বাঙালিরা সেভাবে চান না।
* *
*
মার্চ মাসের
মাঝ নাগাদ সংখ্যালঘু আয়োগের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ডাঃ (ক্যাপ্টেন) দিলীপ কুমার সিংহ, আমাদের
সবাইকার প্রিয় ডাক্তারবাবু পূর্ব ও পশ্চিম চম্পারণের গ্রামে গ্রামে সভা করে গ্রামবাসী
বাঙালিদের সঙ্গে তাদের সমস্যাবলি নিয়ে কথা বললেন।
পূর্বী চম্পারণে
মোতিহারি শহরের কাছে সভা হল ধরমুহা কলোনি, রুলাই ২ এবং হনুমানগড়ে।
পশ্চিম চম্পারণে
প্রথম সভা হল বেতিয়া শহরের লাগোয়া ওয়ার্ড ১এ হাজারিতে (এটাই নাকি প্রথম ট্রানজিট ক্যাম্প
যেখানে পশ্চিম চম্পারণের সব উদ্বাস্তুকে প্রথমে রাখা হয়েছিল)। তারপর লোরিয়ার রাস্তার
একটু আগে বাঁদিকে শনিচরিতে (বহুঅরোয়া ব্লক), শিবপুরে (রামনগর ব্লক), মশানবাড়িতে (মাঝেরিয়া),
সিরসা এবং বেতিয়ার বাঙালি কলোনিতে।
দুটি ছাড়া সবক’টি
সভায় সম্পর্কিত গ্রামের মুখিয়া এবং কখনও সরপঞ্চও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন – তাঁরাও নিজেদের
তরফ থেকে বাঙালিদের সমস্যাগুলো মেটাতে তাঁদের সাধ্যমত চেষ্টা করার আশ্বাস দিলেন।
উপরে বর্ণিত সাধারণ সমস্যাবলি ব্যতিরেকে গ্রামবাসীরা আরো কিছু সমস্যার কথা জানালেন। ইলেক্ট্রিক লাইনের সমস্যা, জমি জবরদখলের সমস্যা … । সব সমস্যা নিয়ে তারপর বেতিয়ার ডিএমের সঙ্গে দেখা করে ডাক্তারবাবু দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করলেন।
যদিও সভাগুলোতে ডাক্তারবাবুর উপস্থিতি সংখ্যালঘু আয়োগের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিল, তবু মানুষটা তো সেই একই। গ্রামবাসীদের কথায় বোঝা গেল তারা সংখ্যালঘু আয়োগের উপাধ্যক্ষকে বিশেষ চেনে না। চেনে তাদের আশাভরসার স্থল, তাদের কাছের মানুষ, বাঙালি সমিতির প্রিয় অধ্যক্ষকে। এটাতেই নিহিত আছে বিহার বাঙালি সমিতির মেটামর্ফোসিস।
[২০১২য় লেখা। পরের বছরগুলোয় কিছু সমস্যা সমাধানের পথে কয়েক ধাপ এগিয়েছে। কিছু সমস্যা আরো জটিল হয়েছে। ]
No comments:
Post a Comment