আজকাল
ছুটির দিন ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে গেলে দুজনে পাটনা কলেজের মাঠ পেরিয়ে গঙ্গার ঘাট অব্দি
হেঁটে আসে। ছেলে পাশেই তার দিদার বাড়িতে থাকে। কখনো কখনো গিয়ে তাকেও নিয়ে যায়। ফেরার
মুখে ঈষৎ লোকজন বাড়তে থাকে রাস্তায়। একটা বদল টের পায় স্বপন। কথায় কথায় যেন একটা তাড়াতাড়িই
উত্তেজিত হয়ে পড়ছে মানুষ। মারমুখো না হলেও, তেমন পরিস্থিতি এলে জবাব দিতে প্রস্তুত,
এটা বুঝিয়ে দেওয়ার একটা মনোভাব দেখা যায়। নর্দমার ওপর পাটা পেতে দোকান খোলার কাজটাই
বেআইনি। কাউকে কিছু না কিছু দিতে হয় জায়গাটা পাওয়ার জন্য। অথচ সেই জায়গাটুকু নিয়ে মাথা
ফাটাফাটি চলল একদিন। একদিকে গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকা, সোভিয়েত সঙ্ঘ ধ্বংস আর অন্যদিকে
ইঁটপুজো, কারসেবা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস … ইতিহাসের চাকার অমোঘ গতি এমনই, একটি ঘটনা অন্যটির সঙ্গে এমনভাবে
জড়িয়ে থাকে যে পরিকল্পিত মনে হয়। অথচ পরিকল্পিত নয়। একই শক্তির অভিব্যক্তিবহুল জয় – রুশে, ভারতে, ইরাকে, ইয়োরোপে …! সাম্রাজ্যবাদী পূঁজি।
বনজ সকাল
গলির শেষপ্রান্তে
একতলার এই ভাড়াবাড়িতে সূর্যের আলো ঢুকবে না কোনোদিন। বাড়ি ভেঙে নতুন তৈরি হলে আলাদা কথা। তখন তো
আর তাদের থাকার অওকাত হবে না। কিছুটা মন খুলত মাঝে মাঝে যদি ছাতে যাওয়ার একটা সিঁড়ি বা মই
থাকত। তাও নেই। কোনোদিন সামনের বাড়ির দোতলায় ওদিকের বারান্দাটা সকালে খুললে
সূর্যের সোজা একটা রশ্মি স্বপনদের রান্নাঘরে বাসনের ওপর পড়ে। দাঁড়ালে মুখে ধরা যায় কয়েক মিনিট।
ওই কয়েক মিনিটই
অনেক। তক্ষুণি তো শুরু হয়ে গেল তাড়া। পরের গলিতে নিজের মায়ের বাড়ি চলে গেছে বৌ, মৌসুমি – সাধারণতঃ ওখানেই রাতে ওদের ছেলেটি থাকে; দিদিমাকে পায় আর তাছাড়া ওখানে দোতলায় ছাত আছে, রোদ আছে,
খেলার জায়গা আছে। বৌ গিয়ে ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করাবে। তারপর নিজে তৈরি হবে, স্বপনও তৈরি হয়ে সেখানে যাবে। প্রায় একই সময়ে বৌ যাবে নিজের কাজে; স্বপন নিজের।
পাড়াটা কোচিং
পাড়া। ভোর থেকে সরগরম। হাওয়ায় কিশোর-কিশোরিদের মুখে কিচির-মিচির করে উড়ে বেড়ায়
পদার্থের গণিত, গণিতের সিঁড়ি, রসায়নের জারক আর জীববিদ্যার স্পন্দন। পাখিরা তারই
মধ্যে খুঁটতে থাকে তাদের খাবার। তারই মধ্যে এল রিকশাওয়ালা, ছেলে আর তার মাকে
বসিয়ে। স্বপন দৌড়ে গিয়ে তাদের আদর করে ফিরে এল।
অদ্ভুত এই
ভাড়াবাড়ি, নিছক ভাড়া খাটানোর জন্য ঘর তোলা। ঢুকেই বাঁদিকের ঘরটা ঘর নয়, খোঁড়ল। হাত
চুলকোতে হলে, উঠিয়ে ছাতে ঘসে নেওয়া যায়। কোনো
জানলা নেই। ঘরটা পেরোতেই বাঁদিকে দুপা মাটি টপকে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে টঙে চড়ে আছে
পায়খানা। আবার নিচে নেমে জলের কল। ডানদিকে রান্নাঘর আর সামনে, যাকে বলা যায় ঘর,
তবে সে-ঘরেরও কোনো জানলা নেই। তবু পয়সা থাকলে
কিনে নিত বাড়িটা – স্বপন
ভাবে। ভালো জায়গা। আরো পয়সা থাকলে ভেঙে নতুন করে ওঠাত। কেউ না কেউ তো
ওঠাবেই, তারা ছেড়ে যাওয়ার পর। … ধুর! কী সব ভাবছে সে? এখন তো জালি লোক।
কী যেন বলে ইংরেজিতে? ফ্রডস্টার! ব্যাঙ্কে জালিয়াতি করেছে – সেকশন ৪২০, ১২০বি … চাকরিটা বাঁচুক আগে!
চাকরি
বাঁচুক? না এই দুর্নাম থেকে মুক্তি পাক? কোনটা বেশি জরুরি? ঠিক সেভাবে হয়ত কেউ দেখে
না, কিন্তু কাগজে কলমে তো তাই! সেদিন দুজন অফিসার এসেছিল ব্যাঙ্ক থেকে। বন্ধুস্থানীয়,
বন্ধুরই মত এসেছিল, কিন্তু উদ্দেশ্যটা টের পাচ্ছিল স্বপন। স্বচক্ষে খতিয়ে দেখতে এসেছিল
সে কিভাবে বাঁচছে – ফ্রিজ,
টিভি, এয়ারকন্ডিশনার, সোফাসেট … ; না পেয়ে হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে ওরা দুজন খুশিই হল – বন্ধু যে – কিন্তু যে ওদের পাঠিয়েছিল সে পিন্কে যাবে
স্বপন জানে – শালা, হারামি, গিট্টিস্গাড়ি …
ছেলেকে টা-টা করে খোঁড়লটার পাশ দিয়ে ঢুকতেই উঁকি দিল
সামনে টেবিলে রাখা দিওয়ান-এ-মীর – রাজকমল প্রকাশন, পেপারব্যাক, আলি সরদার জাফরি সম্পাদিত, মাঝপাতায়
কলম গোঁজা, জানি কোন পাতায়, ‘শহাদতগাহ হ্যয় বাগ-এ-জমানঃ / কি হর গুল উসমেঁ ইক খুনীঁ কফন হ্যয়’ – খোঁড়লটাই তার পড়ার জায়গা। কিন্তু এখন উঁকি মারারও সময় নেই সেদিকে।
“তুমি তৈরি হলে”, পিছন থেকে ঢুকতে ঢুকতে মৌসুমি বলল। তাতেই খেয়াল হল, বৌ ভাতটা করে রাখতে বলে গিয়েছিল, ভুলে গেছে। দৌড়ে আগে রান্নাঘরে ঢুকে ভাত বসাবার
যোগাড়ে লেগে গেল। কাজের মেয়েটি আসছেনা ক’দিন ধরে। …
একটাই বাঁচোয়া যে অফিসটা কাছে। গিয়ে নিজের টেবিলে বসে একটা আবেদন দিল ম্যানেজারকে – আজ মামলা সংখ্যা অমুক অমুকে, আদালতে হাজিরা, যেতে হবে। যাই স্যর, বলে বেরিয়ে গেল।
চিলের দুপুর
শনিবার বেলা দশটার সময় জজকোটেতে কোনোদিনই
লোক ধরে না। তা সে ক্ষুদিরামের ফাঁসির সাজা হওয়ার দিন হোক অথবা নব্বই বছর পর আজকের
সাধারণ একটা ঘেমো দিন, যাতে স্বপনের মত এক
ভেতো কেরানি সেকশন ৪২০ আর ১২০বি এর দায়ে সিবিআই কোর্টের এজলাসের সামনে হাকিমের
আসার অপেক্ষা করছে।
গরমের দিন। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ
আরও বাড়িয়ে তুলছে তাত। উঁচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে আদালত পরিসরের খোলা গেট দিয়ে ঘাম জবজবে কালো, ছাই-ছাই আর সাদা মাথাগুলো,
ঘাম মুছতে মুছতে ঢুকছে, ঢুকছে তো ঢুকছেই, ঢুকেই চলেছে – কতগুলো মামলার তারিখ পড়েছে
আজকে? ভাগ্যিস, এসব আদালতবাড়ির সামনে – বাড়ি না ব্যারাক! স্বপনের মনে হল – ওই শেতপাথরের, হাতে দাঁড়িপাল্লা, চোখে ফেট্টি বাঁধা
সুন্দরী দেবীমুর্তিটুর্তি থাকে না। ত্থাকলে কবে ভীড়ের ধাক্কায় পড়ে যেত আর
দাঁড়িপাল্লার একটা পাল্লা ঠকাস করে কারোর
কপালে ...
কাল্পনিক আঘাতে কপাল রগড়াতে রগড়াতে ভাবল, আমারটার
শুনানি হবে তো আজ? না হলেও ভালো। উকিলের
মুন্সিসাহেব এসে বলুক, “দাদা, নহি হোগা আজ, নয়া ডেট মিলেগা বাদ মে”। মুন্সিসাহেবের মুখে
ফুলচন্দন দিয়ে এই অদ্ভুত ‘ন্যায়বিচারের
প্রতীক্ষা সমাবেশ’ থেকে ছিটকে বেরিয়ে বাইরে যাবে। নাঃ, দূরে কোথাও নয়। এখানেই থাকবে, ওই শিরীষ
গাছটার তলায়, চায়ের দোকানে। একটা সিগরেট ধরিয়ে এই দৃশ্যগুলোই দেখবে, একটু নিরপেক্ষ ভাবে। ... মানে, কবিতার রসদ হিসেবে – নিজের কেসের তারিখে ঝুলতে
থাকলে কবিতা-টবিতা সব গুলিয়ে যায়!
কোর্টে পরিচিত কারুর চেহারা দেখলে আগে মুখ
লুকোত। এদিক ওদিক সরে যেত যাতে দেখা না হয়। হলেই তো প্রশ্ন করবে কিসের মামলা। কথা
ঘুরিয়ে সময় কাটাবার চেষ্টা করত যাতে হয় তাকে মুনশি ডেকে নেয়, নয় সামনের জনের মনে পড়ে যে তাকে এগোতে হবে অন্য এজলাসের
দিকে।
এখন আর সে লজ্জাটা নেই। বেবাক বলে দেয় সিবিআইয়ের কেস, প্রতারণা, জালিয়াতি আর
যোগসাজশের অভিযোগ। ধারাগুলোও গুনিয়ে দেয় – ৪২০, ১২০বি, আরো কয়েকটা আছে কিনা মনে করার চেষ্টা করে। দেখে লক্ষ্য করে, সামনের লোকটার মুখের ভাব বদলাচ্ছে কিনা। বদলালে মজা
পায় ভিতরে ভতরে।
সত্যি বলতে, হত না এমন। মুষড়ে পড়ত হয়ত। মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যেত। কিন্তু সব ওই, যাকে বলে সৎসঙ্গ। লালঝান্ডার সৎসঙ্গ, গুরুকৃপা। এমন ক্রিমিন্যাল,
ক্রিমিন্যাল করে ডাকতে আরম্ভ করে দিল দাদারা, আর তারপর চা’য়ে হাসতে হাসতে চোখ মেরে, “তারপর! কত কামালি?” ... সব বিষ ঝেড়ে দিল কয়েক
দিনে।
হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতে চৈতন্য
হল। আকাশ কখন কালো হয়ে গেছে টের পায়নি।
কয়েক মিনিটের মধ্যে উঠল ঝড় আর তারপর মুষলধারে বৃষ্টি। তারই মধ্যে মুনশি এসে বলল, “ন হোগা দাদা আজ! জজসাহব কা
তবিয়ৎ খরাব হ্যয়। যাইয়ে আপ ঘর। তারিখ বাদ মে জান লিজিয়েগা ফোন সে। খালি বিসঠো
রুপইয়া দেতে যাইয়ে পেসকার কে লিয়ে। ... ন হ্যয় তো ছোড় দিজিয়ে। বাদ মে দে দিজিয়েগা।”
কিন্তু যাবে কোথায় এ বৃষ্টিতে। কটা বাজে? পৌনে বারটা। এ মুহুর্তে কোনো কাজ নেই। তবু,
এখানে দাঁড়ানোর তো আর কোনো মানেই হয়না। কাফকার বর্ণনায়
এমন হাজার মানুষের ধাক্কাধাক্কি ভিড় আর রোদ্দুরের ছবি হয়তো নেই, খুব কম জনসংখ্যাওয়ালা
শীতের দেশের দৃশ্য, তবে আদালতের ধরণধারণগুলো তো এক! বিশেষ করে
তার যে বিচারক, সিবিআই স্পেশ্যাল কোর্টের বুড়ো হুঁকোমুখোটা। তারপর এপিপি। পেশকার। …
যাঃ, দাঁড়াচ্ছে না। পার্টি আছে। সংগঠন আছে,
বৌ-ছেলে, মেয়ে, মা-বাবা, বোনেরা …। এ জমানাটা অন্যরকম মীরসাহেব! নাদির শাহ আর আহমদ শাহ আব্দালির জমানা
নয় যে আপনার চোখের সামনে আপনাদের সাধের দিল্লি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। অবশ্য এখনো পৃথিবীর
কোথাও না কোথাও ধ্বংসস্তুপ হয়েই চলেছে কারোর না কারোর শহর!…
চায়ের গেলাসে
বৃষ্টি
হ্যাঁ, প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে জীবন। কিছুটা ভিজে, জল ছপছপিয়ে চায়ের দোকানে পৌঁছোল। এখানেই বা দাঁড়াবে কোথায়। টাঙানো প্লাস্টিকের চাদরটার নিচে একজনেরও আর দাঁড়াবার জায়গা নেই।
তার বাইরে দাঁড়ালে শিরীষের পাতায় বিশেষ
ছড়ান্ নেই বৃষ্টি আটকাবার। টপটপ করে পড়ছেই বড় ফোঁটাগুলো, কাঁধে আর মাথায়। চায়ের
গেলাসটা হাতে এসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে অবশ্য প্লাস্টিকের নিচে
মাথা গোঁজার জায়গা হয়ে গেল। লাভ হল যে সে এবার জুৎ করে
সিগরেটটা ধরাতে পারবে।
-
লাল সলাম! আপনি
এখানে?
-
বাঃ, এ তো
গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ! সবাইকেই আসতে হয়।
-
আসুন চা খাই।
... না মানে আপনার মামলা তো বরখাস্ত করার বিরুদ্ধে – ট্রাইব্যুনাল হয়ে গেলে
হাইকোর্ট! এই সেসন্স কোর্টে ... কোনো
দেওয়ানি মামলা?
-
না না। আমি আসলে
এসেছিলাম থানায়। ওখানকার কাজ হয়ে গেলে এখানে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
আর আপনি?
নিজের গল্পটা বলল।
-
বাঃ, তার মানে
ফৌজদারি! আমার থেকে উঁচুতে। যাক ভালো। সাসপেন্ড হন নি তো? মাইনে পাচ্ছেন?
-
হ্যাঁ।
-
তার মানে উকিলের
খরচটা দিতে পারছেন। বাচ্চাদের লেখাপড়া ...
এই সেরেছে! বাচ্চাদের লেখাপড়া বলতেই স্বপনের মনে পড়ে গেল ছেলের স্কুলে যেতে হবে ছুটির
সময়। ভালো হল যে জজটার শরীর খারাপ। সেকেন্ড হাফে শুনানি হলে
আজ মুশকিলে পড়ে যেত। চন্দ্রদীপজির কথাগুলো থেকে কিছুক্ষণের জন্য মন সরে গিয়েছিল।
-
আমার সাথে তো
রাহু লেগেই আছে। নতুন পিএজি এল। ইনি আবার আরেক কাঠি বাড়া। জানিনা কি বললেন তাকে
আগের জন, ইনি থানায় রিপোর্ট করলেন যে আমি নাকি নটোরিয়াস নেতা, পিএজির চেম্বারে
ঢুকে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ঘেরাও করার জন্য গ্রস ইন্ডিসিপ্লিনের অভিযোগে বরখাস্ত করা
হয়েছে, এবং তার পরেও আমি নিয়মিত অফিসে যাই, কর্মচারিদের উস্কানি দিতে থাকি,
অফিসারদের হুমকি দিতে থাকি, মা-বাপ তুলে গালাগাল দিতে থাকি … ভাবুন, কেমন মানুষ আমি! … আর তাই, থানাকে অনুরোধ
করলেন আমায় চোখে চোখে রাখতে। থানার এসআইও তেমন, আমার নামে আদেশ জারি করল যে নিয়মিত থানায় এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে। তাই
দিচ্ছি। চাকরি খেয়েই নিল, ট্রাইব্যুনালও জবাব দিয়েই দিল, সিএজি কোনো এ্যাপিল শুনল
না ... ! আমার পরিবারের মুখে অন্ন জুটবে কিভাবে তা কেউ
জিজ্ঞেস করেনি আজ পর্য্যন্ত। কিন্তু কর্মচারি সংগঠনের নেতা হিসেবে, এখনো অব্দি সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে,
মাঝে মধ্যে আমার পুরোনো অফিসে আমি কেন যাই, বন্ধু বা
কর্মচারিদের সাথে কেন কথা বলি, কেন কর্মচারিদের সমস্যা ইত্যাদির নিদান করতে ওদের
সাহায্য করি ... সেটা ওদের প্রশ্ন। আশ্চর্যের কথা, চিঠিতে এই কথাটা কিন্তু নেই যে আমি
গিয়ে অফিসের কাজে বাধার সৃষ্টি করি, আমার যাওয়ায় অফিসের কাজে
অসুবিধে হয়। জানে যে ধোপে টিঁকবেনা। আমি যাই ছুটির মুখে।
কিন্তু ঐ! পিএজিও সাহেব, থানার এসআইও
সাহেব! সাহেবের কথা সাহেব না রাখলে আর কে রাখবে! এই তো অবস্থা।
-
কবে অব্দি দিতে
হবে এমন হাজিরা? (চন্দ্রদীপজির মুখের হাসিটায় ঈষৎ ম্লান ভাব এসেছিল কি?)
-
সে তো থানেদারই
জানে। আমি তো আর এ নিয়ে ওই হারামজাদা পিএজির কাছে এ্যাপিল করতে যাব না, যে অনেক
হল, এবার ছাড়ান দিন! ... চা খান, চা খান! জীবন এরকমই। আপনিও জমিয়ে লড়ুন নিজের
লড়াই। এসবেরই মধ্যে কাজ করতে হবে আমাদের।
কোর্টের গেটের কাছে বিদায় নিয়ে দুজনে দুদিকে হাঁটা দিল। ঐ আগের
পিএজিকে স্বপন চিনত। একজনের বলায়
তদ্বিরও করেছিল চন্দ্রদীপজির কেসটা নিয়ে। জানত কিচ্ছু হবে
না। সিস্টেমে ঢুকলেই সব জায়গা মত সেট হয়ে যায়। ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা সব, বিজ্ঞানের
ছাত্র, প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক, পিজি ... রিসার্চ স্কলার। গণমঞ্চে বড় বড় কথা,
বাকস্বাধীনতা ... মতের উদারতা ... মার্ক্সীয় দর্শনে নতুন পথসন্ধান ... আর কোথাও বড়
সাহেব হয়ে গেলেই ব্যাস – সব কর্মচারী চোর, কাজে
ফাঁকি দেয়, অনুশাসনহীন ... আর কি রিরংসা ভিতরে ... উপরের মন্ত্রীটন্ত্রী থেকে বেশি
অমানুষ তো এরাই ...
কাগজের নৌকো
ছেলের স্কুলে যখন পৌঁছোল তখন আর বৃষ্টি
নেই। আকাশটা ধরে আছে অবশ্য। আর রাস্তায় টলমল জল, কোথাও গোড়ালি কোথাও হাঁটু। আজকে
আবার স্কুলে ইচ্ছেমত ড্রেস পরে আসার দিন ছিল। তাই একরত্তি ছেলের গায়ে সিল্কের
পাঞ্জাবি আর পাজামা, দিদিমার ভালো লাগে বলে – পাজামাটা যে খুলে আসে, হাত
দিয়ে টানতে হয় বারবার, সেটা তাঁর কাছে এহ বাহ্য। স্কুলব্যাগটা বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে
ছেলেকে ঘাড়ের দুপাশে দু’পা ঝুলিয়ে বসাল স্বপন। যদি বৃষ্টি না নামে তাহলে এটাই সবচেয়ে সুরক্ষিত উপায়, যাতে ওর গা না
ভেজে আর স্বপন নিজেও ঠিক মত হাঁটতে পারে।
গোবিন্দ মিত্র রোড থেকে অশোক রাজপথে উঠে
এল। খুদাবক্শ লাইব্রেরির সামনেই ঢুকবে, খাজাঞ্চি রোডে। তার আগে চৌধুরি স্টোর্সে দাঁড়াল।
অনেকদিন পর ছেলেটা তার কাঁধে চেপেছে, ওকে কিছু খাওয়ান
যাক। কি খাওয়ায়?
একটা ছোট্টো ভাজা কাজুবাদামের প্যাকেটের
দর করল। এক ছটাকও হবেনা, পঁচিশ গ্রাম, গুনে দশটা খানেক দানা, পাঁচ টাকা। তাই নিল। খুলে
একটা একটা করে মাথার ওপর ওর ঠোঁটে গুঁজতে গুঁজতে এগোল খাজাঞ্চি রোডের দিকে।
শুধু জল তো নয়, সাথে গর্তও। কোথায় কতটা জল,
কোথায় পাকা, কোথায় কাঁচা, আগে থেকে রাস্তাটা না দেখা থাকলে টেরও পাওয়া যায় না।
ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে খেয়াল ছিল না যে বাড়িতে ঢোকার গলির মুখে নর্দমার ওপর কংক্রিটের পাটা বসান আর তারপরেই
কাঁচা মাটি। ভচ্ করে ডান পা’টা একটু বেশি ভিতরে ঢুকে পিছলে গেল। পড়ল না এই রক্ষে, নইলে
ছেলেটাও ছিটকে পড়ত।
ঘরে ঢুকে, ভাতটা ছেলের খাওয়ার মত গরম করে খাইয়ে দিল। অফিসে ফিরে যাওয়ার
নেই। ম্যানেজারও বোঝে। তিন ঘন্টা আদালতে কাটিয়ে টিফিনের সময় থেকে
আর বিশেষ কাজ করা যায় না। লোকদ্যাখানি হয়। আর, যদি সেকেন্ড হাফে শুনানি হত? … ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়ে বাইরে এসে একটা সিগরেট ধরাবে, সামনের দোতলা থেকে ভেসে এল চ্যাঁচামেচি।
ভদ্রমহিলা মেয়ে আর মাকে নিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে বর কাজের জায়গা থেকে এলেই শুরু হয়
চ্যাঁচামেচি আর কান্না। বর শুরু করে ছাই নিয়ে ছাতা নিয়ে ঝঞ্ঝাট, বৌ যে তাকে ছাড়া
সুস্থভাবে মেয়েকে নিয়ে আছে এটাই যেন প্রমাণ যে বৌ অসতী, কেউ আছে তাকে দেখবার।
ভদ্রমহিলা জবাব দেন, আর মেয়েটি কাঁদে। মা বিশেষ ওদের মধ্যে না পড়ে নাতনিকে নিয়ে
ঘরে ঢুকে যান। মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টা এটা চলে। বর কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার কয়েক
ঘন্টা পর ভদ্রমহিলা প্রকৃতিস্থ হন। সেটা বোঝা যায় গানের সুরে। কী অসাধারণ গানের
গলা! ছোটো মেয়েটিও মাঝে মধ্যে গলা মেলায়। তারও সুন্দর গলা। বস্তুতঃ পূবদিকে তাদেরই দোতলার জন্য স্বপনদের সকালের আলোটা আটকা পড়ে যায়। পূব বলতে
থাকে মা আর মেয়ের গান। সারাদিন মাঝে মধ্যে আসতে থাকা মিষ্টি হাওয়ার মত।... মৌসুমি অফিস থেকে ফিরলে ছুটি হবে, অপেক্ষায় থাকে স্বপন।
টেরেসে সূর্যাস্ত
বাড়িতে ফোন নেই। কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না যদি সে নিজে না যায়, বা যার
গরজ সে নিজে না আসে। কিন্তু, পকেটে ছোট্টো কাগজের টুকরোয় টাইপ করা
নোটিশের কার্বন কপিটা যখন আছে, যেতেই হবে। ফোরামের মিটিং। টাইপের এই পাতলা
কাগজগুলো বেশ কাজের। একবারে সাতটা কপি, একটা অরিজিনাল আর ছটা কার্বন, বেরিয়ে যায়।
প্রত্যেকটা কাগজে উপর থেকে নিচে তিনবার টাইপ করা যায় নোটিশ। স্কেল রেখে ছিঁড়ে
আলাদা করলে তিন সাত্তে একুশ, একুশটা নোটিশ তৈরি হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটা,
বীমাক্যন্টিন। সেখানে এক ঘোষদার হাতের নিমকি আর চা জুটবে। এই ঘোষদা যখন চশমার উপর
থেকে তাকিয়ে বলেন “নিমকি তো হবে না, শেষ!” তখন মনে পড়ে ছোটোবেলায় অজিতকাকুর দোকানে
তরকারি কিনতে গিয়ে অজিতকাকুর সিগরেট খাওয়া দেখা। ধুঁয়োটা কেমন জিভের ওপর রোল করে
ভিতরে নিতেন, অবাক হয়ে দেখত স্বপন।
আর এই ঘোষদা (তখন কাকু বলত) অজিতকাকুর পিছনে আলুর বস্তার ওপর বসে গল্প করতেন। তখনই
বোধহয় বীমাক্যান্টিন ধরেছিলেন! এখন বড় হয়ে চাকরি-টাকরি করার মত লায়েক হয়ে গেছে বলে সে-ও ঘোষদা বলে।
মৌসুমি এখনও ফেরে নি। এবার বেরুতে হবে। ছেলেকে
নিয়ে পাশের গলিতে দিদিমার কাছে রেখে দিয়ে
রওনা দিল।
ফ্রেজার রোডে জল ছিল না। কিন্তু বাড়ির কাছের গলিতে পা ডুবিয়ে এসেছে তাই নিচের কলে পা ধুয়ে ওপরে উঠল,
ক্যন্টিনে ঢুকল। ক্যান্টিনে ঘোষদা চশমার ওপর থেকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “মিটিং আছে?” স্বপন মাথা নাড়ল।
- আরো কেউ এল না?
- আসছে, সবাই আসছে।
- কজন হবে?
- ওই যে কজন হয়, আট-নজন!
ঘোষদা
কাউন্টারের ভিতর দিকে দেখে নিয়ে মুখ তুললেন, “নাস্তা-টাস্তা কিছু লাগলে আগেই বলে দেবেন – সব মাল ফুরিয়ে আসছে!”
গেলই
বা। চা তো পাওয়া যাবে। এখনো আসেনি কেউ। বাইরের টেরেসটায় গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল।
সিগারেট ধরাল। … নিজেকে ধরে রাখাটাই একটা কাজ। তারপর
জাগিয়ে রাখা। যুগের ধ্বংসে অবশ হয়ে আসা দৃষ্টিতে বুঝে উঠতে চাওয়া কী হচ্ছে! সোভিয়েত
কেন পড়ল? ইরাকের ধ্বংসলীলা এত সহজ? আর ভারতের এই তীব্র বদল? এতদিনকার অর্থনীতির ওপর
সাম্রাজ্যবাদী হামলা, হিন্দুত্বের নামে নাশক-শক্তির হিংস্র উত্থান! … নিজেদের ঠিক পথে রাখার চেষ্টা করাটাই
কি সব? কেন হেরে যাচ্ছি, কেন বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না বিপ্লবী আন্দোলনের পূর্বসুরিরা
যা দিয়ে গেল … কেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না পৃথিবীটাকে
… ! নাকি এর মধ্যে দিয়েই উঠে আসছে কিছু
নতুন সত্য, যা না জানাটাই আমাদের প্রধান দুর্বলতা? …
এক এক
করে সবাই এসে পৌঁছোল। ঘোষদার ভাঁড়ার শূন্য। তাঁরই এক শাগরেদকে পাঠিয়ে বাইরে থেকে ভুঞ্জা
আনিয়ে নেওয়া হল। মোটামুটি ভালোই হল মিটিং। আটটা বাজে। বাইরে বৃষ্টি শেষের পরিষ্কার
কালো আকাশ, ফ্রেজার রোডে ঝলমলে রাত।
কবিদের
হাতে কবিতার ভাবের, বোধের যেমন একটি বিকাশধারা তৈরি হয়, ছন্দেরও বিকাশধারা তৈরি হয়।
ছন্দ শুধুই কারিগরি তো আর নয়!
আজ মেরে
ঘর আয়া তু, ক্যা হ্যয় ইয়াঁ জো নিসার করেঁ
ইল্লা
খেঁচ বগল মেঁ তুঝকো দের তলক হম প্যার করেঁ
এটা
যেন মীরের মধ্যে ঢুকে আছেন নজীর আকবরাবাদী, পরে বেরুবেন।
বাষ্পায়িত সন্ধ্যা
সন্ধ্যা হয়। রাত
আসে। দিনের পরই রাত আসে রোজ। কিন্তু মাথায় মনে হয় দুটো পিনস্ট্যান্ড আছে। দিনের
স্ট্যান্ডে দিনগুলো গাঁথা হয় একের পর এক। আর রাতের স্ট্যান্ডে রাতগুলো। ‘সে’
রাতটা আসার আগে দিনের বেলায় কি হয়েছিল, সেটা মনে থাকে যদি বিশেষ কোনো গল্পে গাঁথা
হয়। নইলে, সে রাতটার আগের রাতে কি হয়েছিল সেটা মনে করা সহজ হয়। অন্ততঃ তার তো হয়। স্মৃতির শেষ পূঁজি বোধহয়, একটা
দিনপঞ্জি আর একটা রাতপঞ্জি।
ফেরার
সময় অটো বদলাতে গিয়ে ময়দানের কাছে পর পর তিনটে সিনেমা হলের দিকে চোখ পড়ল। সিনেমা দেখা
ছেড়ে গেছে। কেননা সিনেমা দেখার বন্ধুটাকেও ঠিক এই সময়েই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে স্বপন।
ব্যাটা, বেশি চালাকি করতে গিয়ে সবাইকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল সংগঠনে। কেন যে করল বোকার মত
কাজটা! একটা ভালো বন্ধু হারানো আপশোষের ব্যাপার।
সবকিছু
যেন সে একই সময়ে ভুগছে। সোভিয়েত পতন, মোকদ্দমা, বাবরি-ধংস, এসবের কিছু আগেই হিন্দুত্বের
গুন্ডাদের হাতে রাস্তায় মার খাওয়া, বন্ধু-বিচ্ছেদ … আর এরই মাঝে, হয়তো এই কোণঠাসা ভাবটা কাটাতেই
মীরকে ধরার চেষ্টা করছে। মীরের কাব্যের প্রিয়তমাকে বোঝার চেষ্টা করছে। সে কোথায়? সে
কে? সে যে জীবনের সৌন্দর্য! সেদিন ডাইরিতে লিখেছিল, অথচ সে যেন দস্যুদলের হাতে বন্দিনী।
কবির দুঃখ এ নিয়ে নয় যে সে বন্দিনী, দুঃখ এটাই যে সে মেনে নিয়েছে বন্দিত্ব; নিজের প্রেমাস্পদ,
নিজের সুন্দর জগতটাকে ভুলে নিজেই হয়ে উঠেছে এক নৃশংস দস্যুরানি! যেন নিজেরই প্রতি সে
প্রতিহিংসাপরায়ণ! তাই কবি ভাবছেন, যা কিছু ঘটছে চারদিকে, সব কিছুর জন্য সেই প্রিয়তমাই
দায়ী –
জলওয়ে
উসীকে হ্যঁয় গুলশন মে জমানে কে
গুল-ফুল
কো হ্যয় উননে পর্দা বনা রক্খা ।।
কী হবে,
বাংলায়? ‘যুগের বাগান তারই লীলা / ফুলগুলো সব
মোহিনী আড়াল।’ …? চলবে? দস্যুরানির দুর্গপ্রাকারের নিচে নিরন্ন
মানুষের ভীড়। অন্যায়কারী শাসন তো আরো বেশি করে নিজেকে মানবিক দেখাতে প্রবৃত্ত হয় – মন্দির গড়ে, অন্নসত্র, কাঙালীভোজন।
অবস্থার ফেরে নিরন্ন কবিও আজ পৌঁছে গেছে সেই কাঙালীভোজনে। কবি নিজেকেই সেখানে দেখতে
পাচ্ছেন, ক্ষণিক আত্মকরুণায় –
জো হো
‘মীর’ ভী উস গলি মে সবা
বহুত
পুছিয়ো তু মিরী ওর সে ।।
‘যদি মীরও থাকে সে গলিতে বাতাস / কুশল জানিস
আমার তরফ থেকে তার।’ নাঃ,
দাঁড়াচ্ছে না। পরে দেখা যাবে। অটো ছেড়ে নেমে গলিতে ঢুকে দেখল দুপুরের বৃষ্টির জল শুকিয়ে
গেছে। মৌলবীসাহেবের দোকান থেকে বিড়ি কিনে নিল এক প্যাকেট। মাসের শেষ। পয়সা ফুরিয়ে এসেছে।
কদিন বিড়িই চলুক। একটু বেশি পয়সা দিয়ে মহারাষ্ট্রের বিড়িটা কিনল। এটা একটু হাল্কা,
খেয়ে দেখেছে।
মদালস রাত
আগে
ঐ বাড়িতেই গেল। বৌও সেখানেই ছিল। ছেলে দিদার কাছে ঘুমোলে পর তারা দুজনে ঐ বাড়িতেই খাওয়া
সেরে রাতে নিজেদের বাড়িতে ফিরল।
সাদাকালো
ছোটো টিভিটা চালিয়ে দিল মৌসুমি। পুরোনো হিন্দি গানের চ্যানেল। একমাত্র ওই চ্যানেলটাই
দুজনে দেখে। আর কিছু ভালো লাগে না। একটা ক্যাসেটপ্লেয়ার আছে। টিভির বদলে বরং সেটাই
চালাত আগে। কিন্তু খারাপ হয়ে গেছে।
মন ভালো করার
তাল্লাশে ছিল স্বপন, শরীরটা চনমন করছিল বহুক্ষণ থেকেই।
মৌসুমিও আজ শরীরে মনে ছিল পুরোটা। তবে বাচ্চাটা সিজারিয়ানে হয়েছে, খেয়াল
রাখতে হয়।
- কত খিদে থাকে তোমার ভিতরে?
- কেন? তোমার নেই? না থাকে তো … সরি।
সরে
আসতে যাচ্ছিল, দুই হাঁটু দিয়ে জাপটে ধরল মৌসুমি।
- ধ্যাৎ, তাই বলেছি নাকি? আসলে, একেবারে
পাগল হয়ে উঠেছ তুমি।
- হ্যাঁ, তা হই। বরং হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু,
যেমন বাড়িঘর আমাদের, সে সুযোগটুকুও তো থাকে না। আজ আছে।
চিৎ
হয়ে বৌকে নিজের ওপর টেনে নিল স্বপন। মুখটা ওর ঘেমো বুকে ডুবিয়ে বলল, “আসলে খিদে কথাটাই এ দেশে অভিশাপ। পেটের
খিদে হোক, শরীরের খিদে হোক বা মনের খিদে হোক। কেন? না, অভাব! … যদি অভাব না থাকে কোনোদিন, খিদের থেকে
বড় আনন্দের মুহুর্ত কিছু থাকবে? পেটে ভালো খিদে মানে স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার
খেতে পারা। শরীরে ভালো খিদে মানে ভালোবাসার এমনই স্বর্গীয় সময়! মনের ভালো খিদে মানে
জ্ঞান ও শিল্প ও সাহিত্যের রস নিতে পারা এবং তা থেকে সবচেয়ে বড় খিদে, সৃজনের খিদে তৈরি
হওয়া।
… কিন্তু
সত্যিই কি স্বপনের মন সেভাবে কামুক হয়ে উঠেছিল? নাকি একটা সূক্ষ্ম বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে
মৌসুমিকে এবং নিজেকে পাগল করেছিল, আলিঙ্গনে মেতেছিল যাতে শরীর তেতে ওঠে? বুদ্ধিটা ছিল
এই, যে পরে সুখের শ্রান্তিতে মৌসুমি ঘুমিয়ে পড়বে আর খেয়াল থাকবে না যে স্বপন ঘুমোয়
নি। ওঘরে পালিয়েছে? সকাল থেকে, সকাল থেকে ডাকছে ওঘরের টেবিলটা।
কিন্তু
সে যাই হোক, অনেক সময় এ ভালোবাসাবাসিটাও ভালো করে হয় না। কখনো মৌসুমি তৈরি থাকে না,
কখনো স্বপন তৈরি থাকে না, আর কখনো জায়গাই থাকে না। তারপর আবার ঘর অন্ধকার করো! কেমন
ভালোবাসা হবে যদি দেখতেই না পায় দুজনে ভালোবাসার শরীরদুটো? যদি সারা দেহে চুমু খেতে
খেতে মনে না পড়ে সেই সমস্ত নদী, বর্ষাতি নালা আর ঝর্ণাগুলো যার জলে নগ্ন হয়ে একদিন
প্রতিটি প্রাণকোষে উদ্দাম হয়ে ওঠা এই মৎস্যকন্যাকেই সে খুঁজেছিল? … স্বপন মৌসুমিরও লজ্জাশরম ঝেড়ে দিয়েছে।
সেই, বিয়ের পর এক দিন সম্ভোগের মাঝে দুজনে উলঙ্গ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে!
আজ অনেকদিন
পর সেই খোলা ভাবটা এল। … যৌনতার আনন্দ এখনো যেন নিষিদ্ধ পথে বিচরণ! … “এটা আমি কিছুতেই মানি না। আর যৌনতা মানেই তো
কারোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া নয়! আমি নিজের নগ্নতায় নিজের যৌননিবিড়তাকে ভালোবাসি।” মনে মনে বলল স্বপন। কিছুক্ষণ রসেবশে
নিজের সম্ভোগের শ্রান্তিটা কাটাল।
কবির কাছে সেই অবস্থায় যেতেও কোন সমস্যা ছিল
না। কিন্তু মশার উৎপাতটাও খেয়াল রাখতে হবে যে!
দুর্গ প্রাকারের নিচে
এমনিতেই বাড়ির
সিলিং এত নিচু যে ভিতরের ঘরটায় একটা সিলিং ফ্যান কোনো রকমে লাগান গেছে। বাইরের ঘরটার ছাত আরো নিচু হয়ে যায়
কেননা মেঝে উঁচু। বোধহয় পায়খানা বা স্নানঘর বা কুঁয়োতলা ছিল আগে। ঢালাই করা হয়েছে।
একটা টেবিলফ্যানে কাজ চলে। সেখানে কাউকে বসানোও যায়না। শুধু বই, একটা
টেবিল, একটা চেয়ার আর কিছু বাতিল জিনিষপত্রের ডাঁই।
সামনে খোলা বিড়ির
বান্ডিল থেকে একটা বিড়ি ধরিয়ে বইটা খুলল। দিওয়ান-এ-মীর খুলে, বসল পেজমার্ক দেওয়া পাতায়। ডাইরির পৃষ্ঠা খুলে কলম হাতে নিল।
মন বসছে
না। ওদিকে বইয়ের পিছনে একটা রামের বোতল রাখা আছে, আধ খাওয়া। খাবে? খেতে চায় না স্বপন।
বিশেষ করে মন দিয়ে পড়া বা লেখার সময়। সেসব অন্য দিন ছিল যখন চুটিয়ে খেয়েছে। চরস, গাঁজা,
ম্যান্ড্র্যাক্স কিছু বাদ যায় নি। কিন্তু কে যে শালা বলে নেশায় নাকি কবিতা বেরোয়। ফালতু
মিথ্যে। “আর নয়তো যার হয় তার হয় ভাই। সরি নমস্য
কবিদেরকে গাল দিই কেন? আমার, দাদারা, ঘুলিয়ে যায় সব কিছু।” স্বপন বলে মনে মনে। সে দেখেছে, নেশার মধ্যে
কিছু একটা লিখলে তখন মনে হয় বাঃ। পরে নেশা কেটে গেলে জঘন্য লাগে। তবু মাঝে মধ্যে কেনে।
বস্তুতঃ, কখনো কখনো নিজেরই বিরুদ্ধে যেতে একটা নেশার অবলম্বন লাগে। নিজের ওপর রাগ দেখাতে
লাগে। আর মদের নেশাটা অন্যান্য নেশার থেকে বেশি সময় অব্দি সুখকর আমেজ দেয়।
খেল
না। রান্নাঘর থেকে জল, গেলাস এনে দু’এক ঢোঁক খেল। আবার ঢুকতে চাইল মীরে।
কোথায়
যেন আমার প্রিয় লাইনদুটো? কী অদ্ভুত লাইন।
পস্এ
নামূস্এ ইশ্ক থা ওয়র্না
কিতনে
আঁসু পলক তক আয়ে থে ।
অব জাঁ
আফতাব মেঁ হম হ্যঁয়
ওয়াঁ
কভু সর-ও-গুল কে সায়ে থে ।।
সত্যিই
তো। কী ভীষণ ক্ষোভে পুড়ছিল স্বপন যখন মস্কোর একটা মেয়েকে দিয়ে আমেরিকান টিভি বলাচ্ছিল
যে সে ডলার-বেশ্যা হতে চায়, আর ওদিকে ইয়েলতসিন ট্যাঙ্কে চেপে মাতলামো করছিল প্রাভদার
অফিসের সামনে। কী অসাড় লাগছিল যখন নিজেরই পরিচিত গলির মানুষেরা গিয়ে ভেঙে এল বাবরি
মসজিদ! অথচ কাঁদতে পারো না তুমি। লড়াইয়ের ময়দানে আছ। তেমনই তেজী আওয়াজে বলতে হচ্ছে
প্রত্যেকটা সভায়-সম্মেলনে, শ্রমিকশ্রেণীর জয় হবেই হবে। সমাজবাদ আসবেই! –
ভালোবাসার
সম্মানের প্রশ্ন দোস্ত, নইলে
কত জল
চোখে এসেছিল!
এখন
যে পোড়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে, কখনো
গাছ
আর ফুলের ছায়া ছিল।
ঠিকই বলেছেন
গালিব, এক মীর ছিলেন তাঁর আগে, এই হিন্দের মাটিতে।
ফিরে এল কালকের
পেজমার্ক দেওয়া শেরটায় – ‘শহাদতগাহ হ্যয় বাগ-এ-জমানঃ / কি হর গুল উসমেঁ ইক খুনীঁ কফন হ্যয়’।
যুগের বাগান
শহীদভূমি।
প্রতিটি
ফুল, রক্ত-কাফন ।।
“এবার
ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ছাড়ব না।” ওঘরে গিয়ে বৌএর গায়ে চাদরটা দিয়ে এল। নিজেও একটা জামা গায়ে দিয়ে
নিল। নেশাটা নামতে শীত শীত লাগছে। বাইরে আবার মেঘ করেছে আর হাওয়া উঠছে মনে হয়। ঘরে
ঢুকে রামের বোতলটা সরিয়ে রাখল। আরেকবার ঢোকা যাক তাঁর শাইরিতে।
যদিও
বেশিক্ষণ নয়। কাল অফিস। বাচ্চাদের স্কুল, মৌসুমির অফিস। সকালের ব্যবস্থা। উকিলের বাড়ি
যেতে হবে সন্ধ্যেবেলায়। তার আগে ডাকবাংলো মোড়ে সমাবেশ। ঘুম পাচ্ছে এবার।
বোধহয়
ঝিমিয়ে পড়েছিল। উঠে সামনেই চোখে পড়া শে’রটা পড়ল।
অব ভী
দিমাগ-এ-রফ্তঃ হমারা, হ্যয় অর্শ্ পর
গো আসমা
নে খাক মে হমকো মিলা দিয়া ।।
রয়েছে
মনের গতি এখনো আকাশপানে
যদিও আমায় ধুলোয় মিশিয়ে গেছে আকাশ ।।
-------------------
No comments:
Post a Comment