Wednesday, July 21, 2021

মীর অব্দি

সহজ ভেব না, ঘোরে আকাশ বছরের পর বছর
তবে ধুলোর পরত থেকে মানুষের আবির্ভাব হয়।।
বনজ সকাল
গলির শেষপ্রান্তে একতলার এই ভাড়াবাড়িতে সূর্যের আলো ঢুকবে না কোনোদিন। বাড়ি ভেঙে নতুন তৈরি হলে আলাদা কথা। তখন তো আর আমাদের থাকার অওকাত হবে না। কিছুটা মন খুলত মাঝে মাঝে যদি ছাতে যাওয়ার একটা সিঁড়ি বা মই থাকত। তাও নেই। কোনোদিন সামনের বাড়ির দোতলায় ওদিকের বারান্দাটা সকালে খুললে সূর্যের সোজা একটা রশ্মি আমাদের রান্নাঘরে বাসনের ওপর পড়ে। দাঁড়ালে মুখে ধরা যায় কয়েক মিনিট।

ওই কয়েক মিনিটই অনেক। তক্ষুণি তো শুরু হয়ে গেল তাড়া। পরের গলিতে নিজের মায়ের বাড়ি চলে গেছে বৌ সাধারণতঃ ওখানেই রাতে আমাদের ছেলে-মেয়ে দুটো থাকে; দিদিমাকে পায় আর তাছাড়া ওখানে দোতলায় ছাত আছে, রোদ আছে, খেলার জায়গা আছে। বৌ গিয়ে ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করাবে, মেয়েকে খাওয়াবে। তারপর ফিরে এসে নিজে তৈরি হবে, আমিও তৈরি হব। প্রায় একই সময়ে ও যাবে নিজের কাজে; আমি আমার।

পাড়াটা কোচিং পাড়া। ভোর থেকে সরগরম। হাওয়ায় কিশোর-কিশোরিদের মুখে কিচির-মিচির করে উড়ে বেড়ায় পদার্থের গণিত, গণিতের সিঁড়ি, রসায়নের জারক আর জীববিদ্যার স্পন্দন। পাখিরা তারই মধ্যে খুঁটতে থাকে তাদের খাবার। তারই মধ্যে এল রিকশাওয়ালা, ছেলে আর তার মাকে বসিয়ে। আমি দৌড়ে গিয়ে আদর করে ফিরে এলাম।

অদ্ভুত এই ভাড়াবাড়ি, নিছক ভাড়া খাটানোর জন্য ঘর তোলা। ঢুকেই বাঁদিকের ঘরটা ঘর নয়, খোঁড়ল। হাত চুলকোতে হলে উঠিয়ে ছাতে ঘসে নেওয়া যায়। কোনো জানলা নেই। ঘরটা পেরোতেই বাঁদিকে দুপা মাটি টপকে পাঁচ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে টঙে চড়ে আছে পায়খানা। আবার নিচে নেমে জলের কল। ডানদিকে রান্নাঘর আর সামনে, যাকে বলা যায় ঘর, তবে এরও কোনো জানলা নেই। তবু পয়সা থাকলে কিনে নিতাম বাড়িটা। ভালো জায়গা। আরো পয়সা থাকলে ভেঙে নতুন করে ওঠাতাম। কেউ না কেউ তো ওঠাবেই, আমরা ছেড়ে যাওয়ার পর। ধুর! কী সব ভাবছি? এখন তো আমি জালি লোক। কী যেন বলে ইংরেজিতে? ফ্রডস্টার! ব্যাঙ্কে জালিয়াতি করেছি সেকশন ৪২০, ১২০বি চাকরিটা বাঁচুক আগে!

চাকরি বাঁচুক? না এই দুর্নাম থেকে মুক্তি পাই? কোনটা বেশি জরুরি? ঠিক সেভাবে হয়ত কেউ দেখে না, কিন্তু কাগজে কলমে তো তাই! সেদিন দুজন অফিসার এসেছিল ব্যাঙ্ক থেকে। বন্ধুস্থানীয়, বন্ধুরই মত এসেছিল, কিন্তু উদ্দেশ্যটা টের পাচ্ছিলাম। স্বচক্ষে খতিয়ে দেখতে এসেছিল আমি কিভাবে বাঁচছি ফ্রিজ, টিভি, এয়ারকন্ডিশনার, সোফাসেট ; না পেয়ে হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে ওরা দুজন খুশি হল কিন্তু যে ওদের পাঠিয়েছিল সে পিন্‌কে যাবে আমি জানি শালা, হারামি, গিট্টিসগাড়ি

ছেলেকে টা-টা করে খোঁড়লটার পাশ দিয়ে ঢুকতেই উঁকি দিল সামনে টেবিলে রাখা দিওয়ান-এ-মীর রাজকমল প্রকাশন, পেপারব্যাক, আলি সরদার জাফরি সম্পাদিত, মাঝপাতায় কলম গোঁজা, জানি কোন পাতায়, শহাদতগাহ হ্যয় বাগ-এ-জমানঃ / কি হর গুল উসমেঁ ইক খুনীঁ কফন হ্যয় খোঁড়লটাই আমার পড়ার জায়গা। কিন্তু এখন যাওয়ারই সময় নেই ওদিকে।

তুমি তৈরি হলে, পিছন থেকে ঢুকতে ঢুকতে বৌ বলল। তাতেই খেয়াল হল, ও ভাতটা করে রাখতে বলে গিয়েছিল, ভুলে গেছি। দৌড়ে আগে রান্নাঘরে ঢুকে ভাত বসাবার যোগাড়ে লেগে গেলাম। কাজের মেয়েটি আসছেনা কদিন ধরে।

একটাই বাঁচোয়া যে অফিসটা কাছে। গিয়ে একটা আবেদন দিলাম ম্যানেজারকে আজ কোর্টের ডেট, যেতে হবে তারপর বেরিয়ে গেলাম।    

চিলের দুপুর

শনিবার বেলা দশটার সময় জজকোটেতে কোনোদিনই লোক ধরে না। তা সে ক্ষুদিরামের ফাঁসির সাজা হওয়ার দিন হোক অথবা নব্বই বছর পর আজকের সাধারণ একটা ঘেমো দিন, যাতে আমার মত এক ভেতো কেরানি সেকশন ৪২০ আর ১২০বি এর দায়ে সিবিআই কোর্টের এজলাসের সামনে হাকিমের আসার অপেক্ষা করছে।

গরমের দিন। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ আরও বাড়িয়ে তুলছে তাত। উঁচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি আদালত পরিসরের খোলা গেট দিয়ে ঘাম জবজবে কালো, ছাই-ছাই আর সাদা মাথাগুলো, ঘাম মুছতে মুছতে ঢুকছে, ঢুকছে তো ঢুকছেই, ঢুকেই চলেছে কতগুলো মামলার তারিখ পড়েছে আজকে? ভাগ্যিস, এসব কোর্টবাড়ির সামনে ওই হাতে দাঁড়িপাল্লা, চোখে ফেট্টি বাঁধা সুন্দরী দেবীমুর্তিটুর্তি থাকে না। ত্থাকলে কবে ভীড়ের ধাক্কায় পড়ে যেত আর দাঁড়িপাল্লার একটা পাল্লা ঠকাস করে আমার কপালে ...

কাল্পনিক আঘাতে কপাল রগড়াতে রগড়াতে ভাবলাম, আমারটার শুনানি হবে তো আজ? না হলেও ভালো।  উকিলের মুন্সিসাহেব এসে বলুক, দাদা, নহি হোগা আজ, নয়া ডেট মিলেগা বাদ মে। মুন্সিসাহেবের মুখে ফুলচন্দন দিয়ে এই অদ্ভুত ন্যায়ের প্রতীক্ষা সমাবেশ থেকে ছিটকে বেরিয়ে বাইরে যাব। নাঃ, দূরে কোথাও নয়। এখানেই থাকব, ওই শিরীষ গাছটার তলায়, চায়ের দোকানে। একটা সিগরেট ধরিয়ে এই দৃশ্যগুলোই দেখব, একটু নিরপেক্ষ ভাবে। ... মানে, কবিতার রসদ হিসেবে নিজের কেসের তারিখে ঝুলতে থাকলে কবিতা-টবিতা সব গুলিয়ে যায়!

কোর্টে পরিচিত কারুর চেহারা দেখলে আগে আমি মুখ লুকোতাম। এদিক ওদিক সরে যেতাম যাতে দেখা না হয়। হলেই তো প্রশ্ন করবে কিসের মামলা। কথা ঘুরিয়ে সময় কাটাবার চেষ্টা করতাম যাতে আমাকে মুনশি ডেকে নেয়, নয়তো সামনের জনের মনে পড়ে যে তাকে এগোতে হবে সামনে অন্য এজলাসের দিকে।

এখন আর সে লজ্জাটা নেই। বেবাক বলে দিই সিবিআইয়ের কেস, প্রতারণা, জালিয়াতি আর যোগসাজশের অভিযোগ। ধারাগুলোও গুনিয়ে দিই। সত্যি বলতে, হত না এমন। মুষড়ে পড়তাম হয়ত। কিন্তু সব ওই যাকে বলে সৎসঙ্গ। লালঝান্ডার সৎসঙ্গ, গুরুকৃপা। এমন ক্রিমিন্যাল, ক্রিমিন্যাল করে ডাকতে আরম্ভ করে দিল দাদারা, আর তারপর চায়ে হাসতে হাসতে চোখ মেরে, তারপর! কত কামালি? ... সব বিষ ঝেড়ে দিল কয়েক দিনে।   

হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতে চৈতন্য হল। আকাশ কখন কালো হয়ে গেছে টের পাইনি। কয়েক মিনিটের মধ্যে উঠল ঝড় আর তারপর মুষলধারে বৃষ্টি। তারই মধ্যে মুনশি এসে বলল, ন হোগা দাদা আজ! জজসাহব কা তবিয়ৎ খরাব হ্যয়। যাইয়ে আপ ঘর। তারিখ বাদ মে জান লিজিয়েগা ফোন সে। খালি বিসঠো রুপইয়া দেতে যাইয়ে পেসকার কে লিয়ে। ... ন হ্যয় তো ছোড় দিজিয়ে। বাদ মে দে দিজিয়েগা।

কিন্তু যাব কোথায় এ বৃষ্টিতে। কটা বাজে? পৌনে বারটা। এ মুহুর্তে কোনো কাজ নেই। তবু, এখানে দাঁড়ানোর তো আর কোনো মানে হয়না। আক্ষরিক অর্থে মাথায় পেনসিল, থুড়ি, চিরুনি ঢাকা দিয়ে ছুটতে যাচ্ছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পকেটে ঢোকালাম, পিছনের চোখগুলোর জন্য হাসাহাসির ব্যাপার হয়ে যাবে।

আপনা হী হাথ সর পে রাহা আপনে হাঁ সদা
মুশফিক কোই নহী হ্যয় কোই মেহেরোয়াঁ নহী ।

যাঃ, দাঁড়াচ্ছে না। পার্টি আছে। সংগঠন আছে, বৌ-ছেলে, মেয়ে, মা-বাবা, বোনেরা । এ জমানাটা অন্যরকম মীরসাহেব! আছে, আছে, বিপর্য্যস্ত হয়ে আছে ইন্সানিয়ত, কিন্তু একটা লড়াই আছে গড়ে উঠেছে দেড়শো বছরে । জানিনা মীর শুনতে পেলেন কিনা আকাশে। হ্যাঁ, ঠিক পেয়েছেন! একটু পরেই শুনলাম

ইস অহদ কো ন জানিয়ে অগলা সা অহদ মীর
ওয়হ দওর অব নহী ওয়হ জমী আসমা নহী ।

চায়ের গেলাসে বৃষ্টি

হ্যাঁ, প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে জীবন। কিছুটা ভিজে, জল ছপছপিয়ে চায়ের দোকানে পৌঁছোলাম। এখানেই বা দাঁড়াব কোথায়। টাঙানো প্লাস্টিকের চাদরটার নিচে একজনেরও আর দাঁড়াবার জায়গা নেই। তার বাইরে  দাঁড়ালে শিরীষের পাতায় বিশেষ ছড়ান্‌ নেই বৃষ্টি আটকাবার। টপটপ করে পড়ছেই বড় ফোঁটাগুলো, কাঁধে আর মাথায়। চায়ের গেলাসটা হাতে আসতে আসতে অবশ্য প্লাস্টিকের নিচে মাথা গোঁজার জায়গা হয়ে গেল। লাভ হল যে এবার জুৎ করে সিগরেটটা ধরাতে পারব।

পিছন থেকে একটা হাত পড়ল কাঁধে, লাল সলাম, কামরেড! সিগরেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে ঘুরে লাল সলাম বলতে বলতে মানুষটার কালো প্রশস্ত কপাল চোখে পড়ল। কতটা অব্দি কপাল এবং কতটার পর থেকে টাক শুরু তা অবশ্য বোঝা মুশকিল, তবে মাথার গড়ন দেখে কপালটা প্রশস্ত মনে হয় চন্দ্রদীপজির। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের নেতা। অনেকদিন যাবৎ চাকরি থেকে বরখাস্ত। চাকরি চলে যাওয়ার এত বছর পরেও নিজের চোখে মুখে তার ছাপ আসতে দেন না। দাড়িগোঁফ নিখুঁত ভাবে রোজ কামান, ফিটফাট থকেন সব সময়।   

-      লাল সলাম! আপনি এখানে?
-      বাঃ, এ তো গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ! সবাইকেই আসতে হয়।
-      আসুন চা খাই। ... না মানে আপনার মামলা তো বরখাস্ত করার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল হয়ে গেলে হাইকোর্ট! এই কোর্টে ... কোনো দেওয়ানি মামলা?
-      না না। আমি আসলে এসেছিলাম থানায়। ওখানকার কাজ হয়ে গেলে এখানে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। আর আপনি?

নিজের গল্পটা বললাম।
-      বাঃ, তার মানে ফৌজদারি! আমার থেকে উঁচুতে। যাক ভালো। সাসপেন্ড হন নি তো? মাইনে পাচ্ছেন?
-      হ্যাঁ।
-      তার মানে উকিলের খরচটা দিতে পারছেন। বাচ্চাদের লেখাপড়া ...
এই সেরেছে! বাচ্চাদের লেখাপড়া বলতেই মনে পড়ে গেল আমাকে ছেলের স্কুলে যেতে হবে ছুটির সময়। ভালো হল যে জজটার শরীর খারাপ। দেরি করে শুনানি হলে আজ মুশকিলে পড়ে যেতাম। চন্দ্রদীপজির কথাগুলো থেকে কিছুক্ষণের জন্য মন সরে গিয়েছিল।
-      আমার সাথে তো রাহু লেগেই আছে। নতুন পিএজি এল। ইনি আবার আরেক কাঠি বাড়া। জানিনা কি বললেন তাকে আগের জন, ইনি আবার থানায় রিপোর্ট করলেন যে আমি নাকি নটোরিয়াস নেতা, পিএজির চেম্বারে ঢুকে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ঘেরাও করার জন্য গ্রস ইন্ডিসিপ্লিনের অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে, এবং তার পরেও আমি নিয়মিত অফিসে যাই, কর্মচারিদের উস্কানি দিতে থাকি, অফিসারদের হুমকি দিতে থাকি। আর তাই, থানাকে অনুরোধ করলেন আমায় চোখে চোখে রাখতে। থানার এসআইও এমন, আমার নামে আদেশ জারি করল যে নিয়মিত থানায় এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে। বুঝুন! তাই দিচ্ছি। চাকরি খেয়েই নিল, ট্রাইব্যুনালও জবাব দিয়েই দিল, সিএজি কোনো এ্যাপিল শুনল না ... আমার পরিবারের মুখে অন্ন জুটবে কিভাবে তা কেউ জিজ্ঞেস করেনি আজ পর্য্যন্ত, কিন্তু আমি কর্মচারি সংগঠনের নেতা, এখনো অব্দি সম্মেলনে নির্বাচিত সভাপতি, মাঝে মধ্যে আমার পুরোনো অফিসে কেন যাই, বন্ধু বা কর্মচারিদের সাথে কেন কথা বলি, কেন কর্মচারিদের সমস্যা ইত্যাদির নিদান করতে ওদের সাহায্য করি ... সেটা ওদের প্রশ্ন। আশ্চর্যের কথা, চিঠিতে এই কথাটা কিন্তু নেই যে আমার যাওয়ায় অফিসের কাজে অসুবিধে হয়। জানে যে ধোপে টিঁকবেনা। আমি যাই ছুটির মুখে। কিন্তু ঐ! ইনিও সাহেব, এসআইও সাহেব! সাহেবের কথা সাহেব না রাখলে আর কে রাখবে! এই তো অবস্থা।
-      কবে অব্দি দিতে হবে এমন হাজিরা? (চন্দ্রদীপজির মুখের হাসিটায় ঈষৎ ম্লান ভাব এসেছিল কি?)
-      সে তো থানেদারই জানে। আমি তো আর এ নিয়ে ওই হারামজাদা পিএজির কাছে এ্যাপিল করতে যাব না, যে অনেক হল, এবার ছাড়ান দিন! ... চা খান, চা খান! জীবন এরকমই। আপনিও জমিয়ে লড়ুন নিজের লড়াই। এসবেরই মধ্যে কাজ করতে হবে আমাদের।  

কোর্টের গেটের কাছে বিদায় নিয়ে দুজনে দুদিকে দিকে হাঁটা দিলাম। ঐ আগের পিএজিকে আমি চিনতাম। একজনের বলায় তদ্বিরও করেছিলাম চন্দ্রদীপজির কেসটা নিয়ে। জানতাম কিচ্ছু হবে না। সিস্টেমে ঢুকলেই সব জায়গা মত সেট হয়ে যায়। ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা সব, বিজ্ঞানের ছাত্র, প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক, পিজি ... রিসার্চ স্কলার। গণমঞ্চে বড় বড় কথা, বাকস্বাধীনতা ... মতের উদারতা ... মার্ক্সীয় দর্শনে নতুন পথসন্ধান ... আর কোথাও বড় সাহেব হলেই ব্যাস সব কর্মচারী চোর, কাজে ফাঁকি দেয়, অনুশাসনহীন ... আর কি রিরংসা ভিতরে ... উপরের মন্ত্রীটন্ত্রী থেকে বেশি অমানুষ তো এরাই ...

কাগজের নৌকো

ছেলের স্কুলে যখন পৌঁছোলাম তখন আর বৃষ্টি নেই। আকাশটা ধরে আছে অবশ্য। আর রাস্তায় টলমল জল, কোথাও গোড়ালি কোথাও হাঁটু। আজকে আবার স্কুলে ইচ্ছেমত ড্রেস পরে আসার দিন ছিল। তাই একরত্তি ছেলের গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা, দিদিমার ভালো লাগে বলে পাজামাটা যে খুলে আসে, হাত দিয়ে টানতে হয় বারবার, সেটা তাঁর কাছে এহ বাহ্য। স্কুলব্যাগটা বাঁকাঁধে ঝুলিয়ে ছেলেকে ঘাড়ের দুপাশে দুপা ঝুলিয়ে বসালাম। যদি বৃষ্টি না নামে তাহলে এটাই সবচেয়ে সুরক্ষিত উপায়, যাতে ওর গা না ভেজে আর আমিও ঠিক মত হাঁটতে পারি।

গোবিন্দ মিত্র রোড থেকে অশোক রাজপথে উঠে এলাম। খুদাবক্‌শ লাইব্রেরির সামনেই ঢুকব, খাজাঞ্চি রোডে। তার আগে চৌধরি স্টোর্সে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পর ছেলেটা আমার কাঁধে চেপেছে, ওকে কিছু খাওয়াই। কি খাওয়াই?

একটা ছোট্টো ভাজা কাজুবাদামের প্যাকেটের দর করলাম। এক ছটাকও হবেনা, পঁচিশ গ্রাম, গুনে দশটা খানেক দানা, পাঁচ টাকা। তাই নিলাম। খুলে একটা একটা করে মাথার ওপর ওর ঠোঁটে গুঁজতে গুঁজতে এগোলাম খাজাঞ্চি রোডের দিকে।

শুধু জল তো নয়, সাথে গর্তও। কোথায় কতটা জল পাব, কোথায় পাকা, কোথায় কাঁচা, আগে থেকে রাস্তাটা না দেখা থাকলে টেরও পাওয়া যায় না। ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে খেয়াল ছিল না যে বাড়িতে ঢোকার গলির মুখে নালার ওপর কংক্রিটের পাটা বসান আর তারপরেই কাঁচা মাটি। ভচ্‌ করে ডান পাটা একটু বেশি ভিতরে ঢুকে পিছলে গেল। পড়লাম না এই রক্ষে, নইলে ছেলেটাও ছিটকে পড়ত।

ওর মা ভাত রান্না করে অফিসে গেছে। ওর মত গরম করে খাইয়ে দিলাম। শনিবার। অফিসে ফিরে যাওয়ার নেই। ঘুম পাড়িয়ে বাইরে এসে একটা সিগরেট ধরাব, সামনের দোতলা থেকে ভেসে এল চ্যাঁচামেচি। ভদ্রমহিলা মেয়ে আর মাকে নিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে বর কাজের জায়গা থেকে এলেই শুরু হয় চ্যাঁচামেচি আর কান্না। বর শুরু করে ছাই নিয়ে ছাতা নিয়ে ঝঞ্ঝাট, বৌ যে তাকে ছাড়া সুস্থভাবে মেয়েকে নিয়ে আছে এটাই যেন প্রমাণ যে বৌ অসতী, কেউ আছে তাকে দেখবার। ভদ্রমহিলা জবাব দেন, আর মেয়েটি কাঁদে। মা বিশেষ ওদের মধ্যে না পড়ে নাতনিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যান। মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টা এটা চলে। বর কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর ভদ্রমহিলা প্রকৃতিস্থ হন। সেটা বোঝা যায় গানের সুরে। কী অসাধারণ গানের গলা! ছোটো মেয়েটিও মাঝে মধ্যে গলা মেলায়। ওরও সুন্দর গলা। বস্তুতঃ পূবদিকে ওদেরই দোতলার জন্য আমাদের সকালের আলোটা আটকা পড়ে যায়। পূব বলতে থাকে মা আর মেয়ের গান। সারাদিন মাঝে মধ্যে আসতে থাকা মিষ্টি হাওয়ার মত।... স্ত্রী অফিস থেকে ফিরলে আমার ছুটি হবে, অপেক্ষায় থাকি।

টেরেসে সূর্যাস্ত

বাড়িতে ফোন নেই। কারোর যোগাযোগের কোনো উপায় নেই যাওয়া ছাড়া। তবে পকেটে ছোট্টো কাগজের টুকরোয় টাইপ করা নোটিশের কার্বন কপিটা যখন আছে, যেতেই হবে। ফোরামের মিটিং। টাইপের এই পাতলা কাগজগুলো বেশ কাজের। একবারে সাতটা কপি, একটা অরিজিনাল আর ছটা কার্বন, বেরিয়ে যায়। প্রত্যেকটা কাগজে উপর থেকে নিচে তিনবার টাইপ করা যায় নোটিশ। স্কেল রেখে ছিঁড়ে আলাদা করলে তিন সাত্তে একুশ, একুশটা নোটিশ তৈরি হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটা, বীমাক্যন্টিন। সেখানে এক ঘোষদার হাতের নিমকি আর চা জুটবে। এই ঘোষদা যখন চশমার উপর থেকে তাকিয়ে বলেন নিমকি তো হবে না, শেষ! তখন মনে পড়ে ছোটোবেলায় অজিতকাকুর দোকানে তরকারি কিনতে গিয়ে অজিতকাকুর সিগরেট খাওয়া দেখা। ধুঁয়োটা কেমন জিভের ওপর রোল করে ভিতরে নিতেন, অবাক হয়ে দেখতাম। আর এই ঘোষদা (তখন কাকু বলতাম) অজিতকাকুর পিছনে আলুর বস্তার ওপর বসে গল্প করতেন। তখনই বোধহয় বীমাক্যান্টিন ধরেছিলেন! এখন অফিসে গিয়ে লায়েক হয়ে আমিও ঘোষদা বলি।

স্ত্রী এখনও ফেরেন নি। এবার বেরুতে হবে। ছেলেকে নিয়ে পাশের গলিতে দিদিমার কাছে  রেখে দিয়ে রওনা হলাম।

ফ্রেজার রোডে জল নেই। কিন্তু গলিতে পা ডুবিয়ে এসেছি। তাই নিচের কলে পা ধুয়ে ওপরে উঠলাম, ক্যন্টিনে ঢুকলাম। ক্যান্টিনে ঘোষদা চশমার ওপর থেকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, মিটিং আছে? আমি মাথা নাড়লাম।
-      আরো কেউ এল না?
-      আসছে, সবাই আসছে।
-      কজন হবে?
-      ওই যে কজন হয়, আট-নজন!
ঘোষদা কাউন্টারের ভিতর দিকে দেখে নিয়ে মুখ তুললেন, নাস্তা-টাস্তা কিছু লাগলে আগেই বলে দেবেন সব মাল ফুরিয়ে আসছে!

গেলই বা। চা তো পাওয়া যাবে। এখনো আসেনি কেউ। বাইরের টেরেসটায় গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। সিগারেট ধরালাম। নিজেকে ধরে রাখাটাই একটা কাজ। তারপর জাগিয়ে রাখা। যুগের ধ্বংসে অবশ হয়ে আসা দৃষ্টিতে বুঝে উঠতে চাওয়া কী হচ্ছে! সোভিয়েত কেন পড়ল? ইরাকের ধ্বংসলীলা এত সহজ? আর ভারতের এই তীব্র বদল? এতদিনকার অর্থনীতির ওপর সাম্রাজ্যবাদী হামলা, হিন্দুত্বের নামে নাশক-শক্তির হিংস্র উত্থান! নিজেদের ঠিক পথে রাখার চেষ্টা করাটাই কি সব? কেন হেরে যাচ্ছি, কেন বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না, বিপ্লবী আন্দোলনের পূর্বসুরিরা যা দিয়ে গেল কেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না পৃথিবীটাকে ! নাকি এর মধ্যে দিয়েই উঠে আসবে কিছু নতুন সত্য, যা না জানাটাই আমাদের প্রধান দুর্বলতা?

এক এক করে সবাই এসে পৌঁছোচ্ছে। ঘোষদার ভাঁড়ার শূন্য। তাঁরই এক শাগরেদকে পাঠিয়ে বাইরে থেকে ভুঞ্জা আনিয়ে নিলাম।  

বাষ্পায়িত সন্ধ্যা

সন্ধ্যা হয়। রাত আসে। দিনের পরই রাত আসে রোজ। কিন্তু মাথায় মনে হয় দুটো পিনস্ট্যান্ড আছে। দিনের স্ট্যান্ডে দিনগুলো গাঁথা হয় একের পর এক। আর রাতের স্ট্যান্ডে রাতগুলো। সে রাতটা আসার আগে দিনের বেলায় কি হয়েছিল, সেটা মনে থাকে যদি বিশেষ কোনো গল্পে গাঁথা হয়। নইলে, সে রাতটার আগের রাতে কি হয়েছিল সেটা মনে করা সহজ হয়। অন্ততঃ আমার তো হয়। স্মৃতির শেষ পূঁজি বোধহয়, একটা দিনপঞ্জি আর একটা রাতপঞ্জি।

মিটিং অনেকক্ষণ চলেছিল। ফেরার সময় অটো বদলাতে গিয়ে ময়দানের কাছে পর পর তিনটে সিনেমা হলের দিকে চোখ পড়ল। সিনেমা দেখা ছেড়ে গেছে। কেননা সিনেমা দেখার বন্ধুটাকেও ঠিক এই সময়েই ছেড়ে দিয়েছি। ব্যাটা, বেশি চালাকি করতে গিয়ে সবাইকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল সংগঠনে।

সবকিছু যেন একই সময়ে ভুগছি। সোভিয়েত পতন, মোকদ্দমা, বাবরি-ধংস, এসবের কিছু আগেই হিন্দুত্বের গুন্ডাদের হাতে রাস্তায় মার খাওয়া, বন্ধু-বিচ্ছেদ আর এরই মাঝে আমি মীরকে ধরার চেষ্টা করছি। মীরের কাব্যের প্রিয়তমাকে বোঝার চেষ্টা করছি। সে কোথায়? সে কে? সে যে জীবনের সৌন্দর্য! সেদিন ডাইরিতে লিখেছিলাম, অথচ সে যেন দস্যুদলের হাতে বন্দিনী। কবির দুঃখ এ নয় যে সে বন্দিনী, দুঃখ এটাই যে সে মেনে নিয়েছে বন্দিত্ব, যেন নিজের প্রেমাস্পদ এবং এই সুন্দর বিশ্বকে ভুলে সে নিজেই হয়ে উঠেছে এক নৃশংস দস্যুরানি! যা কিছু ঘটছে চারদিকে, সব কিছুর জন্য সেই যেন দায়ী

জলওয়ে উসীকে হ্যঁয় গুলশন মে জমানে কে
গুল-ফুল কো হ্যয় উননে পর্দা বনা রক্‌খা ।।

কী হবে, বাংলায়? যুগের বাগান তারই লীলা / ফুলগুলো সব মোহিনী আড়াল। ? চলবে? দস্যুরানির দুর্গপ্রাকারের নিচে নিরন্ন মানুষের ভীড়। অন্যায়কারী শাসন তো আরো বেশি করে নিজেকে মানবিক দেখাতে প্রবৃত্ত হয় মন্দির গড়ে, অন্নসত্র, কাঙালীভোজন। অবস্থার ফেরে নিরন্ন কবিও আজ পৌঁছে গেছে সেই কাঙালীভোজনে। কবি নিজেকেই সেখানে দেখতে পাচ্ছেন, ক্ষণিক আত্মকরুণায়

জো হো মীর ভী উস গলি মে সবা
বহুত পুছিয়ো তু মিরী ওর সে ।।

যদি মীরও থাকে সে গলিতে বাতাস / কুশল জানিস আমার তরফ থেকে তার।নাঃ, দাঁড়াচ্ছে না। পরে দেখা যাবে। অটো ছেড়ে নেমে গলিতে ঢুকে দেখলাম দুপুরের বৃষ্টির জল শুকিয়ে গেছে। মৌলবীসাহেবের দোকান থেকে বিড়ি কিনে নিলাম এক প্যাকেট। মাসের শেষ। পয়সা ফুরিয়ে এসেছে। কদিন বিড়িই চলুক। একটু বেশি পয়সা দিয়ে মহারাষ্ট্রের বিড়িটা কিনলাম। এটা একটু হাল্কা, খেয়ে দেখেছি।   

মদালস রাত

আগে শাশুড়ির বাড়িতেই পৌঁছোলাম। বৌও ওখানেই ছিল। ছেলেমেয়েরা ঘুমোলে পর আমরা দুজনেও খাওয়া সেরে রাতে নিজেদের ঘরে ফিরলাম

সাদাকালো ছোটো টিভিটা চালিয়ে দিল বৌ। পুরোনো হিন্দি গানের চ্যানেল। একমাত্র ওই চ্যানেলটাই দুজনে দেখি। আর কিছু ভালো লাগে না। একটা ক্যাসেটপ্লেয়ার আছে। টিভির বদলে বরং সেটাই চালাতাম আগে। কিন্তু খারাপ হয়ে গেছে।  

আমি মন ভালো করার তাল্লাশে ছিলাম, শরীরটা চনমন করছিল বহুক্ষণ থেকেই। আর ওও আজ শরীরে মনে ছিল পুরোটা। তবে দুটো বাচ্চা সিজারিয়ানে হয়েছে, খেয়াল রাখতে হয়।

-      কত খিদে থাকে তোমার ভিতরে?
-      কেন? তোমার নেই? না থাকে তো নো প্রব্লেম! আয়াম সরি।
আমি সরে আসতে যাচ্ছিলাম, দুই হাঁটু দিয়ে জাপটে ধরল আমায়।
-      ধ্যাৎ, তাই বলেছি নাকি? আসলে, একেবারে পাগল হয়ে উঠেছ তুমি।
-      হ্যাঁ, তা হই। বরং হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু, যেমন বাড়িঘর আমাদের, সে সুযোগটুকুও তো থাকে না। আজ আছে।

চিৎ হয়ে ওকে নিজের ওপর টেনে নিলাম। মুখটা ওর ঘেমো বুকে ডুবিয়ে বললাম, আসলে খিদে কথাটাই এ দেশে অভিশাপ। পেটের খিদে হোক, শরীরের খিদে হোক বা মনের খিদে হোক। কেননা অভাব! যদি অভাব না থাকে কোনোদিন, খিদের থেকে বড় আনন্দের মুহুর্ত কিছু থাকবে? পেটে ভালো খিদে মানে স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার খেতে পারা, শরীরে ভালো খিদে মানে ভালোবাসার এমনই স্বর্গীয় সময়, মনের ভালো খিদে মানে জ্ঞান ও শিল্প ও সাহিত্যের রস নিতে পারা এবং তা থেকে সবচেয়ে বড় খিদে, সৃজনের খিদে তৈরি হওয়া।

কিন্তু সত্যিই কি আমার মন সেভাবে কামুক হয়ে উঠেছিল? নাকি একটা সূক্ষ্ম বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ওকে এবং নিজেকে পাগল করেছিলাম, আলিঙ্গনে মেতেছিলাম যাতে শরীর তেতে ওঠে? বুদ্ধিটা ছিল এই যে রমণের পর সুখের শ্রান্তিতে ও ঘুমিয়ে পড়বে আর আমি ওঘরে পালাব? সকাল থেকে, সকাল থেকে ডাকছে ওঘরের টেবিলটা।

কিন্তু যাই হোক, অনেক সময় এ ভালোবাসাবাসিটাও ভালো করে হয় না। কখনো ও তৈরি থাকে না, কখনো আমি তৈরি থাকি না, কখনো জায়গা থাকে না। তারপর আবার ঘর অন্ধকার কর! কেমন ভালোবাসা হবে যদি দেখতেই না পাই ভালোবাসার শরীরদুটো? যদি সারা দেহে চুমু খেতে খেতে মনে না পড়ে সেই সমস্ত নদী, বর্ষাতি নালা আর ঝর্ণাগুলো যার জলে নগ্ন হয়ে একদিন প্রতিটি প্রাণকোষে উদ্দাম হয়ে ওঠা এই মৎস্যকন্যাকেই খুঁজেছিলাম? আমি তো ওকেও বেহায়া করে ছাড়ি। দুজনে একসাথে গিয়ে দাঁড়াই আয়নার সামনে!   

আজ অনেকদিন পর সেটা হল।  সম্ভোগের আনন্দ এখনো যেন নিষিদ্ধ পথে বিচরণ! এটা আমি কিছুতেই মানি না। আর যৌনতা মানেই তো কারোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া নয়! আমি নিজের নগ্নতায় নিজের যৌননিবিড়তাকে ভালোবাসি।  তাই অনেকক্ষণ রসেবশে আমি সম্ভোগের শ্রান্তিটা কাটালাম।

কবির কাছে এই নগ্ন সম্ভোগক্ষান্ত শরীর নিয়ে যেতেও কোন সমস্যা নেই আমার। কিন্তু মশার উৎপাতটাও খেয়াল রাখতে হবে যে!

দুর্গ প্রাকারের নিচে

এমনিতেই এ বাড়ির সিলিং এত নিচু যে ভিতরের ঘরটায় একটা সিলিং ফ্যান কোনো রকমে লাগিয়েছি। বাইরের ঘরটার ছাত আরো নিচু হয়ে যায় কেননা মেঝে উঁচু। বোধহয় পায়খানা বা স্নানঘর বা কুঁয়োতলা ছিল আগে। ঢালাই করা হয়েছে। একটা টেবিলফ্যানে কাজ চালাই। এখানে কাউকে বসানোও যায়না। শুধু আমার বই, একটা টেবিল, একটা চেয়ার আর কিছু বাতিল জিনিষপত্রের ডাঁই।

সামনে খোলা বিড়ির বান্ডিল থেকে একটা বিড়ি ধরিয়ে বইটা খুললাম। দিওয়ান-এ-মীর খুলে বসলাম পেজমার্ক দেওয়া পাতায়। ডাইরির পাতাটা খুলে কলম হাতে নিলাম।

মন বসছে না। ওদিকে বইয়ের পিছনে একটা রামের বোতল রাখা আছে, আধ খাওয়া। খাব? আসলে খেতে চাই না আমি। বিশেষ করে মন দিয়ে পড়া বা লেখার সময়। সেসব অন্য দিন ছিল যখন চুটিয়ে খেয়েছি। চরস, গাঁজা, ম্যান্ড্র্যাক্স কিছু বাদ দিইনি। কিন্তু কে যে বলে নেশায় নাকি কবিতা বেরোয়। একদম মিথ্যে। যার হয় তার হয়, আমার ঝাপসা হয়ে যায় সব কিছু। কিছু একটা লিখলে তখন তো মনে হয় বাঃ। পরে নেশা কেটে গেলে জঘন্য লাগে। তবু মাঝে মধ্যে কিনি। বস্তুতঃ, নিজেরই বিরুদ্ধে যেতে প্রয়োজন হয়। নিজের ওপর রাগ দেখাতে প্রয়োজন হয়।

নাঃ, সেসব কিছু করলাম না। রান্নাঘর থেকে জল, গেলাস এনে দুএক ঢোঁক খেলাম। আবার ঢুকতে চাইলাম মীরে।

কোথায় যেন আমার প্রিয় লাইনদুটো? কী অদ্ভুত লাইন।

পস্‌এ নামূস্‌এ ইশ্‌ক থা ওয়র্না
কিতনে আঁসু পলক তক আয়ে থে ।
অব জাঁ আফতাব মেঁ হম হ্যঁয়
ওয়াঁ কভু সর-ও-গুল কে সায়ে থে ।।

সত্যিই তো। কী ভীষণ ক্ষোভে পুড়ছিলাম যখন মস্কোর একটা মেয়েকে দিয়ে আমেরিকান টিভি বলাচ্ছিল যে সে ডলার-বেশ্যা হতে চায়, আর ওদিকে ইয়েলতসিন ট্যাঙ্কে চেপে মাতলামো করছিল প্রাভদার অফিসের সামনে। কী অসাড় লাগছিল যখন আমার নিজেরই ভাইয়েরা গিয়ে ভেঙে আসল বাবরি মসজিদ! অথচ কাঁদলে চলবে না। লড়াইয়ের ময়দানে আছি। তেমনই তেজী আওয়াজে বলছি প্রত্যেকটা সভায়-সম্মেলনে, শ্রমিকশ্রেণীর জয় হবেই হবে। সমাজবাদ আসবেই!

ভালোবাসার সম্মানের প্রশ্ন দোস্ত, নইলে
কত জল এসেছিল চোখে!
এখন যে পোড়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে, কখনো
গাছ আর ফুলের এখানে ছায়া ছিল।   

ঠিকই বলেছেন গালিব, এক মীর ছিলেন তাঁর আগে, এই হিন্দের মাটিতে।
ফিরে এলাম, কালকের পেজমার্ক দেওয়া শেরটায়  শহাদতগাহ হ্যয় বাগ-এ-জমানঃ / কি হর গুল উসমেঁ ইক খুনীঁ কফন হ্যয়
যুগের বাগান শহীদভূমি।
প্রতিটি ফুল, রক্ত-কাফন ।।

এবার ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ছাড়ব না। ওঘরে গিয়ে বৌএর গায়ে চাদরটা দিয়ে এলাম। নিজেও একটা জামা গায়ে দিয়ে নিলাম। নেশাটা নামতে শীত শীত লাগছে। বাইরে আবার মেঘ করেছে আর হাওয়া উঠছে মনে হয়। এঘরে ঢুকে রামের বোতলটা সরিয়ে রাখলাম। আরেকবার ঢোকা যাক তাঁর শাইরিতে।

যদিও বেশিক্ষণ নয়। কাল অফিস যেতে হবে। বাচ্চাদের স্কুল, বৌয়েরও অফিস। সকালের ব্যবস্থা। উকিলের বাড়িও যেতে হবে সন্ধ্যেবেলায়। তার আগে ডাকবাংলো মোড়ে সমাবেশ।  ঘুমও পাচ্ছে এবার।

কতক্ষণ জানিনা। বোধহয় ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে সামনেই চোখে পড়া শেরটা পড়লাম।  

অব ভী দিমাগ-এ-রফ্‌তঃ হমারা, হ্যয় অর্শ্‌ পর
গো আসমা নে খাক মে হমকো মিলা দিয়া ।।

রয়েছে মনের গতি এখনো আকাশপানে
যদিও আমায় ধুলোয় মিশিয়ে গেছে আকাশ ।।

-------------------




No comments:

Post a Comment