জীবনে নষ্ট করা সময়ের বেশ কিছুটা কলমের দোকানেও কেটেছে। গেলেই বসে গল্প করতে করতে এই কলম, সেই কলম, ঝর্ণাকলমের নিবের নতুন ধরণ, খোলের নতন ডিজাইন ...। স্কুলে পড়ার সময় একটা ভোঁতা দেখতে কলম খুব চলত, প্রেসিডেন্ট, কেননা মোটা ছিল আর কালি বেশি আঁটত। সে সময়েই প্রথম এল, কালো গায়ে জ্বলজ্বলে সবুজ অথবা মেরূন বা তামা রঙের চৌকো আঁশ ভেসে ওঠা শরীর, ফ্লোরা নাম ছিল বোধহয়। একটা কলম ছিল, জিভ-চেরা নিবের জায়গায় একটা সরু নল, যার ভিতরে ঢিলে একটা তার – বেশি চলেনি এক্সপেরিমেন্টটা। ম্যাট্রিক পাশ করতে বাবা একটা চিনে ঝর্ণাকলম দিয়েছিলেন – উইং সাং। ভালো ঝর্ণাকলমের নেশা, বলপয়েন্ট এসে যাওয়ার পরেও বহু বছর অব্দি কাটেনি।
বোধহয় দেশটারও কাটেনি। তাই বহুদিন পর্যন্ত, বলপয়েন্ট বা ডটপেন দিয়ে পরীক্ষার খাতায় লেখা বা সরকারি কাগজপত্র ভরা মানা ছিল। অবশ্য মানাগুলো ওইরকমই হয়। রঙীন ছবি এসে যাওয়ার বহুদিন পর অব্দি চলেছিল ফর্মান – না, সাদাকালো ছবিই সাঁটাতে হবে ফর্মে।
তারপর, বলপয়েন্টেরও কত রকমফের – বড় রিফিলের জটার, লম্বা রিফিলের লেখো-ফেলো, জার্মান টেকনলজি, জেল...
কবে যেন শুরু হয়েছিল?
প্রথম যখন কালির দোয়াতে ডুবিয়ে নিবের কলম দিয়ে লেখার অধিকার পেলাম,
কী গর্ব!
মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সরস্বতী ঠাকুরকে চিঠি লিখতে কলাপাতা কেন লাগে? খাগের কলম তাও আবার দুধে ডুবিয়েই বা কেন লিখতে হয়। মা তার জবাবে কিছু বলতে বলতে চিলের পালকের কথা বলে ফেলেছিলেন। রাজপুত্ররা নাকি ময়ুরের পালক বা চিলের পালক দিয়ে লেখে। ময়ুরের পালক তো পাওয়া যাবেনা। খেলার মাঠে দৌড়ে দৌড়ে খুঁজে চিলের পালক পাওয়ার নাম করে পায়রার পালক, কাকের পালক উঠিয়ে আনতে শুরু করলাম। শেষে একটা পালক দেখে মা বলল, হ্যাঁ, এটা চিলের পালক। ব্যাস, আর কি! ভালো করে ছুলে দাও সামনেটা। কালিতে ডুবিয়ে লিখব!
আর এখন! বাড়িতে কলমই নেই। লেখার জন্য ল্যাপটপ, ছোটো নোটের জন্য ট্যাব অথবা স্মার্টফোন। যতক্ষণে একটা কলম খুঁজে পেয়ে ঘষে দেখবে যে আদৌ চলছে কিনা, ততক্ষণে ট্যাবে লিখে নেবে ঠিকানা বা ফোন নম্বরটা। এমনকি মন্তব্যটাও।
তবে সবচেয়ে মজার ছিল সেই লটারিগুলো। বাজার থেকে ফেরার সময় রাস্তার
অন্ধকার কোণে, কার্বাইড জ্বালিয়ে ঝুড়ি সাজিয়ে বসে থাকত ছেলেগুলো। বেশির ভাগ আমারই
বয়সী। রোজগারের চেষ্টায় লাগিয়ে দিয়েছে বাপ-মায়েরা। ঝুড়িতে ভরা থাকতো
দোমড়ানো-মোচড়ানো খবরের কাগজের গোল্লা। খেলাটা এই যে ওর মধ্যে কোনো একটা গোল্লায় বেশ
দামি কিছু একটা আছে। এখন তোমার ভাগ্য – এক পয়সা দাও, যেটা
ইচ্ছে ওঠাও!
যতবার উঠিয়েছি, কাগজের মোড়ক খুলতে খুলতে, খুলতে খুলতে শেষে দুটো
কালির বড়ি ছাড়া কিছু পাইনি। তাই গুলেছি, বাবার কথায় একটু গ্লিসারিন মিশিয়েছি আর
কলম ডুবিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি।
২৪.৫.১৯
No comments:
Post a Comment