Monday, July 26, 2021

এক পিট্‌ঠা কাগজের গল্প

এখন তো রোজকার জীবনের লেখালিখিও কাগজহীন। বাজারে বেরোলে জিনিষপত্রের ফর্দও হয় নিজেই মোবাইলে লিখে নিই অথবা গলির মোড়ে পৌঁছোতে পৌঁছতে হোয়াটস্যাপে পেয়ে যাই। ছোটো ছোটো মনের কথা বা সভায় বক্তার কথার নোট, সবই মোবাইলে সারা হয়, ছোট্টো নোটপ্যাড বলে কিছু আর পকেটে রাখতে হয় না। আর বড় লেখালিখির জন্য তো ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ!

কিন্তু এক সময়, মানে, অন্ততঃ আমাদের জীবনে তো দশ-বারো বছর আগেও এমনটা ছিল না। নতুন প্রযুক্তি ঢুকতে শুরু করলেও পুরোনো অভ্যাসগুলোকে পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলতে পারে নি।

ঘরে, পড়ার টেবিলে, কাজের টেবিলে কাগজ থাকত নানা রকমের। ছোটো নোটপ্যাড, ছোটো, খুচরো লেখালিখির জন্য। মোড়কে রাখা ভালো ফুলস্ক্যাপ (পরের দিকে, জেরক্স বা প্রিন্টারের এ-ফোর) সাদা কাগজ, কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধের শেষ ফেয়ার কপিটা পত্রিকা সম্পাদককে পাঠানোর জন্য। আর এই দুইয়ের মাঝামাঝি থাকত নানা ধরণের এক-পিট্‌ঠা। রুলদার, রুলছাড়া। হলদে, সাদা। বড়, ছোটো। নিজেরই বাতিল ফেয়ার কপির উলটো পিঠ। কিছু খোলা তা, কিছু স্টেপ্‌ল মারা, কিছু, সুতো দিয়ে সেলাই করা।

স্কুলের লেখাপড়ায় আমি সাধারণতঃ একপিট্‌ঠা ব্যবহার করিনি, প্রতি বছর নতুন খাতা পেয়েছি নিয়মিত। কিন্তু আরো গরীব ঘরে ব্যবহার হতই। আর যাঁরা যুদ্ধের সময় কাগজের আকালে লেখাপড়া করেছেন তাঁরা ওতেই করেছেন। বাবা, কাকারা বাড়ির স্কুলপড়ুয়াদের জন্য একপিট্‌ঠা কাগজের খাতা যত্ন করে সেলাই করে দিতেন।  

এমনকি, অনেক সময় লেখার জগতের অগ্রজদের, মানে যাঁদের লেখাটার জন্য পত্রিকা শেষ মুহুর্ত অব্দি অপেক্ষা করত, তিন বার লোক পাঠাত, দেখেছি ওই হলদে, কিনার-খোবলানো এক পিট্‌ঠাতেই লেখা পাঠিয়ে দিলেন, ছেপেও গেল।

এক পিট্‌ঠা কাগজের একটা রোমাঞ্চ থাকত। কাগজটার, আগে থেকে লেখা বা ছাপা দিকটায় কি আছে আপনি জানেন না বা ভুলে গেছেন। কাগজটা উলটে পড়তে গিয়ে দেখলেন আপনারই পুরোনো কোনো লেখার বাতিল ফেয়ার কপি, হয়ত রাগে-ক্ষোভে ঘ্যাঁচঘোঁচ করে কাটাকুটি করা (সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথ নন)। অনেক দিন পর পড়ে আপনার নিজেরই খারাপ লাগল, সত্যিই তো, কি কাঁচা লেখা, ছিঃ। অথবা ভালো লাগল, আরেক প্রস্থ রাগ হল লেখাটা বাতিল হয়েছিল বলে এবং এক মুহুর্তের আত্মকরুণায় আপনি আচ্ছন্ন হলেন! ... হয়তো, আপনার লেখা নয়, অন্য কারো লেখা বা ছাপা... শুরু নেই বা শেষ নেই বা দুটোই নেই ... কোনো আইনি খসড়া। অথবা শুরু শেষ দুটোই আছে ... বাতিল কারো আবেদন পত্র। এধরণের ছিন্ন সুত্রগুলো আপনাকে প্রতিবার কল্পনার খেলা শুরু করতে আকর্ষণ করত।

কিছুদিন আগে এই এক পিট্‌ঠার এক নতুন গল্প জানলাম।

 

এক পিট্‌ঠা কাগজের মূল্য শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও ছিল। আর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় খোদ লন্ডনে ছিল। আর একপিট্‌ঠা কাগজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ভালো করে বাঁধাই করা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ব্লুবুক, বা বিভিন্ন সরকারি ইন্সপেকশন রিপোর্টগুলোর। সরকারি কাজ! সংসদে পেশ হওয়ার জন্য থরে থরে ছাপা হত আর তারপর থরে থরে বিক্রি হয়ে যেত, ওজন দরে। সেগুলো কিনে নিত ওই একপিট্‌ঠা কাগজের বিক্রেতা ছোটো দোকানদারেরা। কোথাও রাস্তার কোনো কোনে, হয়তো সেলার থেকে উঠে আসা বেসমেন্টের ছোট্টো দোকানে বিক্রি হত নানা ধরণের একপিট্‌ঠা কাগজ বা খাতা বা বই গরীব ছাত্ররা কিনে নিয়ে যেত আর তারই মধ্যে যথোচিত মর্যাদায় শোভিত হত সবচেয়ে ভালো একপিট্‌ঠা, পার্লামেন্টারি ব্লুবুক।

তা একদিন এরকমই এক দোকানে বছর ছত্রিশের এক গাঁট্টাগোট্টা জার্মান মানুষ এসে ওই ব্লুবুকগুলো দেখতে চাইলেন। কি কথাবার্তা হয়েছিল দোকানদারের সাথে তা তো কোথাও লেখা নেই। দোকানদার নিশ্চয়ই বলেছিলেন, আপনার কটা চাই বলুন না। সবচেয়ে পরিষ্কার আর ভালো বাঁধাইগুলোই আপনাকে দেব, নিশ্চিন্ত থাকুন।

কিন্তু বড় বড় কোঁকড়া চুল আর মুখ ভর্তি দাঁড়িগোঁফ ওয়ালা মানুষটি মুচকি হেসে শুধু দেখতে চাইছিলেন ব্লুবুকের পুরো স্টকটা। দেখলেন। বেছে বেছে তারই মধ্যে থেকে কয়েকটি আলাদা করে রাখলেন। তারপর পয়সা দিয়ে, সে কটি ব্লুবুক প্যাক করিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটা দিলেন।

এরকমই তিনি করলেন বেশ কিছুদিন, লন্ডনের এধরণেরই বেশ কটি দোকানে গিয়ে। অনেক সময় এমনও হত যে বাছাই করে আলাদা করে রাখতেন, পরে এসে নিয়ে যাবেন বলে। কেন না সে সময় তাঁর কাছে একপিট্‌ঠা কাগজের দাম দেওয়ার মত পয়সাও থাকত না, তিন কন্যাসন্তানের স্কুলের ফীসটুকুও হয়ত দেওয়া হয়ে থাকত না দুমাস ধরে; ছেলের চিকিৎসার জন্য পয়সা চাইতে প্রাণের বন্ধুকে চিঠি লিখতে হত।

বলার দরকার নেই বোধহয়, মানুষটি ছিলেন কার্ল মার্ক্স; ওই ব্লুবুকগুলো থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি পাবেন তাঁর অমর গ্রন্থ পূঁজির পাতায় পাতায়।

ব্যাঙ্গালোর
১৭.৮.২০২০

No comments:

Post a Comment