রোদ বলতে রোদ! শীতকালে দক্ষিণায়নে সূর্য! আর তার ভরা রোদ পিঠের ওপর। এই রোদটুকু এই ফ্ল্যাটবাড়ির সবচেয়ে বড় পাওনা। “কিন্তু পাওনা হলে কী হবে। প্রথম বেশ কয়েক বছর তো বসতেই ভয় করত। এই বুঝি পিছনের বড়বাড়ি থেকে চাকর নালিশ নিয়ে আসে – কেন বসেছ!”
প্রতিমা বলেন তাঁর বান্ধবীকে, “প্রায় সে রকমই ব্যাপার ছিল ভাই। না, মানে আমাদের সাথে কিছু নয়, কিন্তু পরিস্থিতিটা বোঝ। বলতে গেলে একটা গ্রাম ছিল পাড়াটা। গ্রামের মুখিয়া না হোক, মুখপাত্রও না হোক, কিন্তু ধনবলে আর কুকীর্ত্তির দৌলতে এই বড়বাড়ি আর তার মালিক ছিল পাড়ার মুখ। মানে, এখনও আছে, তবে এখন অন্যরকম। সেসময় তো কোথায় ফ্ল্যাট কিনেছি বললে প্রথম প্রশ্ন করত ‘ওখানেই ওমুকের বাড়ি না? ওখানে কেন নিলেন?’ বোঝো ঠ্যালা! যা সাধ্যে কুলোয় তার মধ্যেই তো ব্যাবস্থা করতে হত মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইয়ের! ওরও তো বয়স হচ্ছে। তখন না করলে আর বোধহয় হতই না!”
-
কুকীর্ত্তির কথা কী বললে?
-
সে লম্বা রহস্যময় ফিরিস্তি।
(গলাটা নামিয়ে)জুয়ার ঠেক, মদের ব্যাবসা, বন্দুকের চোরাচালান, হয়ত দু’একটা খুনটুনও …
-
সে কি!
- তবে আমাদের সাথে কক্ষনো খারাপ ব্যবহার করেনি ওদের বাড়ির কেউ। বাড়ির মেয়েরা ছাদে এলে আমার ছেলেটার সাথে হেসে কথা বলত, ডাকত নিজেদের বাড়িতে। বরং, শহরের ভালো ভালো পাড়ায় রাতের দিকে রংবাজি, ছিনতাই, মেয়েদের দেখে টিটকিরি এসবের ঝামেলা বাড়লেও আমাদের পাড়ার গলিটায় কখনো কিচ্ছু হয়নি। সেটাও ওই বড়বাড়ির দৌলতে।
* * *
- সে আপনি বলছেন বলুন! কিন্তু বিল্ডার যেভাবে ঠকিয়েছে আমাদের! জল নিকাশির ব্যবস্থায় কারচুপি, জেনারেটরে কারচুপি, পার্কিং স্পেসে কারচুপি… সমস্যাগুলো প্রতিদিন ফেস করতে করতে তো নাজেহাল হয়ে যেতে হচ্ছে! আপনারা বলছেন এসোসিয়েশন, কী করল এসোসিয়েশন এতদিনে? আবার তার ওপর এই হাঙ্গামা! এতো বাড়তে বাড়তে এক্কেবারে খুনোখুনিতে দাঁড়াবে। আমার গিন্নি তো ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে যাওয়ার কথা বলছে।
১। ফ্ল্যাট সংখ্যা ৪০৫এর
ছোটো ছেলেকে বড়বাড়ির মেজছেলে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, তার একটা বিহিত
করা।
২। জলনিকাশির ব্যবস্থার
এপ্রুভড প্ল্যানে দশইঞ্চির পাইপ বড়রাস্তা অব্দি টেনে নিয়ে গিয়ে বড়নালার সাথে
মেলানোর কথা ছিল, কিন্তু বিল্ডার সহজ পন্থা নিয়েছে – পিছন দিকে পাইপ টেনে নিয়ে
পঞ্চায়তী নালায় ফেলেছে – নালা উপচে পড়ে ডুবিয়ে দিয়েছে আশেপাশের বাড়ির একতলার মেঝে;
তার একটা তাৎক্ষণিক বিহিত করা কেননা গ্রামের লোকেরা মারমুখি হয়ে আছে, বড়বাড়ির
বড়মালিক রিভলবার হাতে নিয়ে এসে শাসিয়ে দিয়ে গেছে।
৩। ফ্ল্যাটবাড়ির বাচ্চাদের ছাতে খেলতে মানা করা কেননা বড়বাড়ি থেকে নালিশ এসেছে যে ওরা ঢিলপাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি করে যার দু’একটা বড়বাড়ির উঠোনে গিয়ে পড়েছে। নিচে, বেসমেন্টে খেললেও বাচ্চাদের মানা করা যে বেশি হাল্লা যেন না হয়, কেননা তাহলে বড়মালিকের ঘুমের ব্যাঘাত হয়।
এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ভিন্ন রাজ্যে সরকারি আমলা। উৎসাহী মানুষ। সবাইকার পিলে চমকালেন, “আরেকটা এজেন্ডা রাখুন, এবারের হোলিতে বিকেলে আমরা বড়মালিকের সঙ্গে আবির খেলতে যাব। সবাই যাব!”
* * *
এ এক্কেবারে অবস্থান
ধর্মঘট। বিল্ডারের বাড়ির সামনে সকাল থেকে ছুটি নিয়ে বসে আছে ফ্ল্যাটমালিকেরা।
বাড়িতে বিল্ডার নেই, পুরুষমানুষও কেউ নেই। কাজেই বাড়ির বাইরেই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে
থাকা অথবা বসা। শুধু মিডিয়া কভারেজেরই যা কমতি।
-
এটা কোনো সমাধান নয়। মিছিমিছি
ছুটি গেল একদিনের। দুটো বাজতে চলল। আদৌ আসবে কিনা কে জানে।
-
কী করতেন বলুন। অফিসে তো এতবার
গেলাম। দেখা পাওয়া যায়না। যা কিছু ঘোঁট পাকিয়ে গেছে, বড়মালিককে কী বুঝিয়েছে,
জলনিকাশির পাইপ বসাতে গ্রামবাসীদের কী বুঝিয়েছে…
-
কত পাউচ দেসি ঠররা না বিলিতি
খাইয়েছে…
-
আমরা কিছুই জানিনা। ফ্ল্যাট
কিনেছি, তার ভোগান্তি তো আমাদেরই ভুগতে হবে। কিন্তু বিল্ডার গিয়ে দাঁড়ালে অন্ততঃ
ওকে সাক্ষী রেখে কিছু চুক্তি তো করা যাবে গ্রামের মানুষের সাথে!
-
বড়বাড়িকে বোঝানোর দায়িত্বও ওনার
অনেকটাই বর্তায়।
-
আজ এখানে প্রেসিডেন্ট কেন
এলেননা?
-
উনি অন্য রাজ্যে থাকেন,
ছুটিছাটায় আসেন। সরকারি আমলা। এই সামান্য ব্যাপারে ছুটি নিয়ে কেন এলেননা এটা
অবান্তর প্রশ্ন।
- তা উনি যে প্রস্তাবটা দিলেন, হোলিতে বড়বাড়িতে যাওয়ার…
সেক্রেটারি এতক্ষণে মুখ
খুললেন। ইনশিওরেন্সের চাকুরে। ঠান্ডা মাথা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে সচেষ্ট থাকেন।
সবসময় মাঝামাঝি একটা রাস্তা বার করেন। ওনার বিশ্বাস যে সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে
যাবে।
“দেখুন, আসল ব্যাপারটা বুঝুন। এই এলাকায় এটা এখনও অব্দি একমাত্র এপার্টমেন্ট। পাড়ার ভিতর দিকে গিয়ে দেখবেন পঁচানব্বই পার্সেন্ট কয়েক পুরুষ ধরে এই পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। আগে মাটির বাড়ি ছিল, এখন কেউ কেউ পাকা তুলেছে, দোতলাও তুলেছে। বেশির ভাগ এক জাতের, সেটাও একটা দিক। আমরা হঠাৎ উটকো কতগুলো লোক কতগুলো পায়রার খোপের মালিক হয়ে জুড়ে এসে বসেছি। একটা স্বাভাবিক অস্বীকারের মনোভাব কাজ করছে দুদিক থেকেই। আমরাও ওদের সাথে মিশি না, ওরাও আমাদের সাথে মেশে না। মাঝখানের এই দেয়ালটা তো ভাঙতে হবেই। প্রেসিডেন্ট সেদিন যে প্রস্তাবটা দিলেন, যদিও কোনো সিদ্ধান্ত হলনা, আমি মনে করি সঠিক প্রস্তাব। এখন আমরা যা করছি, নালাটা পরিষ্কার করেছি, বাচ্চাদের ছাতে খেলা বন্ধ করিয়েছি, মারপিটের ব্যাপারটা একটা মিটমাট হয়ে গেছে… সে সব চলুক, কিন্তু হোলির ওই প্রোগ্রামটা হওয়া উচিৎ। শত্রুতা করে তো আর বেঁচে থাকা যায় না। বন্ধুত্বের জন্য হাতটা আমাদেরই সামনে বাড়াতে হবে।”
সন্ধ্যাবেলায় প্রতিমার
শ্বাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন ছেলেকে, “কী হল রে! দেখা পেলি বিল্ডারের?”
-
হুঁহ, অত সহজ! বিকেলে খবর
পেলাম, দিল্লি চলে গেছে। ভাঁওতা আর কি। এসেছে হয়ত রাতে। যা হোক, বিল্ডারের বাবার
সাথে দেখা হল। অবশ্য ও লোকটাও বিশেষ সুবিধের মনে হলনা।
প্রতিমা রান্নাঘর থেকে
চা নিয়ে আসতে আসতে বলল, “তবে? কী লাভ হল?”
-
লাভ তো হলই। আশেপাশের লোক জানল
বিল্ডারটা কী চীজ! বিল্ডারের কাজেও সুনামের তো দরকার আছে। আর যেখানে সে নিজে
পরিবার নিয়ে থাকে! একটা চাপের সৃষ্টি হল। আমার বিশ্বাস যে আমাদের পরের মিটিংটায়
বিল্ডার আসবে। কেন গিয়েছিলেন, আমার ফ্যামিলিকে বিরক্ত করেছিলেন, চাইলে অনেক কিছু
করতে পারি ইত্যাদি ভুজুংভাজুং দেবে তবে কিছু কাজে সুরাহা ও করবে। দেখা যাক!
-
তা তোরা নাকি ঠিক করেছিস হোলির
দিন ওদের বাড়িতে যাবি? (পিছন দিকে ইশারা করেন)
-
ঠিক করিনি। একটা প্রস্তাব
এসেছে।
-
আবার ৩০২ এর ভদ্রলোক এসে সাবধান
করে দিয়ে গেলেন যে ভুলেও যেন এসব না করা হয়।
প্রতিমা ভিতরের ঘরের
দিকে যাচ্ছিল। ছেলের হোমটাস্কগুলো বাকি আছে। ঘুরে দাঁড়ালো, “উনি আবার কী বলবেন।
সেদিনের ঘটনাটায় ওনার ছেলের দোষ কম ছিল না। এমনি এমনি মাথা ফাটেনি। ওদের পুরো
পরিবারেরই ধারণাটা ওই… যে বলে না? ‘লফঙ্গাকে ভগবানও ভয় পায়’… ওই টাইপের। কিছু কিছু
এ টাইপের লোক সবজায়গাতেই থাকে।
-
আঃ, আস্তে বল না!
-
(গলাটা নামিয়ে) ইতরের মত কথা
বল, দুদশটা গালি রাখ মুখের ডগায়, ব্যাস্ সবাই সমীহ করে চলবে। বাবা, মা, ছোটো ছেলে
সবার এক অ্যাটিচুড। শুধু বড় ছেলেটা একটু অন্য রকম।… আমার তো মনে হয় একদম সঠিক
প্রস্তাব। যাওয়া উচিৎ তোমাদের হোলির দিন!
-
(হাসতে হাসতে) আর যদি লাঠি নিয়ে
তাড়া করে?
- করুক! লোকে বুঝবে ওরা আদত ছ্যাঁচড়। পরবের দিনেরও মর্যাদা বোঝেনা!
* * *
হোলির
সন্ধ্যায় বড়বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ার সময় দেখা গেল সাকুল্যে চারজন মানুষ।
প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি আর দুজন। ট্রেজারারও আসেনি। বড়বাড়ির ছোটো দরজা খুলল।
ঢুকেই বড়মালিকের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম। সেক্রেটারির ইশারাটা বুঝল প্রেসিডেন্ট এবং বাকি দুজন। কথাবার্তা হল। পুয়া, দহিবড়া, নারিয়লছুহাড়ার মুখশুদ্ধি, চা, সিগারেট। অনেক দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা হল। দেখা গেল বড়মালিক ওশোর একনিষ্ঠ পাঠক। বৌদ্ধদর্শনে রুচি আছে। চেনস্মোকার। আর আগন্তুকদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেনার ক্ষমতা রাখেন।
-
কী বলবেন, সেক্রেটারি সাহেব!
কাজটা ভালো হল কিনা?
-
জবরদস্ত! একেই বলে ট্যাকটিক্যাল
এডভান্টেজ! সঠিক প্রস্তাব ছিল আপনার। কেউ বুঝল না সেটার গুরুত্ব।
-
ঠিক আছে, আমরা চারজন গেলাম তো!
চলুন বড়রাস্তায় একটু হেঁটে আসা যাক। একটা পান খেলে হয়। পেটটা আইঢাই করছে। অনেক
দার্শনিক তত্ত্ব শুনলাম তো! হজমের গোলমাল না হয়ে যায়।
-
লোকটি সত্যিই পড়াশুনো করে, না
কি শোনা কথা ঝাড়ছে?
-
পড়াশুনো ছাড়া আর করবে কী এখন?
নিজে ভদ্রলোক বুড়ো হয়ে গেছেন। ওনার যে ফিল্ডগুলো ছিল সেখানে নতুন কম্পিটিটর চলে
এসেছে। ছেলেগুলোর সে বুদ্ধি নেই, ছাঁটু রংবাজি ছাড়া আর কিছু জানে না।
-
উনিতো সৎসঙ্গ, ভজন-কীর্ত্তনেরও
ব্যাবস্থা করান প্রতি বছর। আসলে ধর্মতত্ত্ব সবসময় অর্থতত্ত্বের খোলস!
-
তবে একটা কথা কি জানেন? ঠিক
ওনার জন্য বলছি না, তবে ওনার কথায় মনে এল, আসলে বেশির ভাগ মানুষেরই পুরো জীবনটা
লেগে যায় বুঝতে যে, যে জীবনটা সে বাঁচল এতদিন সেটা তার নিজের জীবন ছিল না। তার
শত্রুর দেওয়া ছিল।
-
তার মানে কী বলতে চান? এই সব
ক্রাইম করে টাকার পাহাড়ের ওপর বসে যে অ্যায়্যাশী করছে সে নিছক একজন বেচারা,
নিরুপায়, বিভ্রমের শিকার…
-
শুনতে গান্ধীবাদী মনে হচ্ছে
কিন্তু কথাটা এক অর্থে সত্যি। তাবলে…
-
আচ্ছা এবার ছাড়ুন ওসব দার্শনিক
কচকচি। কাজের কথায় আসুন। শুনলেন তো। মালিকের বড়মেয়ের বিয়ে। কার্ড পাঠাবেন। আমি তো
থাকব না। আগেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আপনারা যাবেন কিন্তু নিশ্চই।
……………………
কিছুদিন পরেই বড়বাড়িতে
মেয়ের বিয়ে হল। মেয়েটি ছাতে এসে প্রতিমাকে বার বার করে অনুরোধ করেছিল ছেলেকে নিয়ে
বিয়েতে আসতে। শ্বাশুড়ি একটু খুঁতখুঁত করা সত্ত্বেও প্রতিমা ছেলেকে নিয়ে স্বামীর
সাথে গেল বিয়েবাড়িতে। বাড়ির মেয়েরা কী খুশি! হাত ধরে দুজনকে টেনে নিয়ে গেল ভিতর
বাড়িতে। প্রতিমার স্বামী বাইরেই খাওয়ার জায়গায় ফ্ল্যাটের অন্য কয়েকজনের সাথে বসল।
রাত্রে ফিরতে শ্বাশুড়ি শশঙ্কিত গলায় ওদের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলেন।
-
আপনি ভাবতেও পারবেন না মা, কত
আদরযত্ন করল ওরা। আপনার নাতিকে তো ছাড়তেই চায়না। ওদের ভিতরের ঘরেই খাবার সাজিয়ে
এনে দিল, আপনার জন্য আলাদা করে মিষ্টি দিয়ে দিল…
-
খাইয়েছে ভালো। তবে শুরুতেই ওই
মেজ ছেলেটা…
-
কী? কিছু করেছে নাকি?
-
নাঃ, করেনি কিছু। এমনি
কথাবার্ত্তা বলছে, তারই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে পিস্তলের গল্প এনে ফেলল। আসলে আমাদের
টেবিলে ওর এক বন্ধুও ছিল। তাকেই দেখাচ্ছিল। তারপর আমাদের হাতেও দিয়ে দেখাল নতুন
কেনা ওর চাইনিজ পিস্তল! কত হাল্কা, কত দূরে চোট করতে পারে! অবশ্য বিশেষকিছু নাও
হতে পারে। ওর তো ওটাই জীবন! ওসব জিনিষ ছাড়া আর কী নিয়েই বা কথা বলবে!
-
বরকে কেমন দেখলি।
- সে তো ভালোই মনে হল। নিজেদের ব্যবসা আছে। আর, অনেক পুরোনো পরিচিতের সাথে দেখাও হল। ওদের এই বিয়েতে দেখব ভাবিনি। অবশ্য ওরা আর কী করবে। থাকতে তো আমাদেরই হবে। টেনশনটাও আমাদেরই থাকবে।
* * *
মাঠে
বিরাট জনসভা। শুধু এই পাড়া নয় আশেপাশের পাড়ার লোকজনেরাও উপস্থিত। সরকারের নির্দেশ
এসেছে। এসব নাকি প্রতিবন্ধিত জমি। ইংরেজ আমলের আইন। সুপ্রীম কোর্টেরও রায় আছে
এবিষয়ে পনের বছর আগের। কেউ জানে না আইনটা কী। রায়টা কী নিয়ে। কোনদিক থেকে কতখানি
জমি প্রতিবন্ধিত। কিন্তু হাল্লা উঠে গেছে। বিধায়কজীকে ডাকা হয়েছে। পার্ষদ এসেছেন।
এপার্টমেন্টের সেক্রেটারি, ট্রেজারারও পৌঁছেছেন ব্যাপারখানা বুঝতে। আর নতুন যারা
জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেছে বা করছে তাদের তো মাথায় হাত! আর তাদেরই সংখ্যা বেশি হয়ে
উঠেছে গত দশ বছরে। সামনে যে আরেকটা এপার্টমেন্ট উঠছিল, তার বিল্ডার তো শোনা গেল
কাজ বন্দই করে দিয়েছে।
একটা সংগ্রাম সমিতি তৈরি
হবে। সভার পরিচালনা করার জন্য সভাপতি মন্ডলীর নামের ঘোষণা করা হচ্ছে। সেক্রেটারি
এগিয়ে গিয়ে প্রস্তাব দিলেন বড়বাড়ির বড়মালিকের নামটাও শামিল করা হোক।
-
কিন্তু তিনি তো এ সভায় আসেননি।
- তাতে কী? সভাপতিমন্ডলী তো সংগ্রাম সমিতির জন্য, স্থায়ী। তাতে উনিও থাকবেন!
প্রস্তাব স্বীকৃত হল।
“এর বেশি এখানে আমাদের কিছু করার নেই, এরপর দুই পার্টির কম্পিটিশন, আমাদের ভাগ্যে
যা আছে তা তো হবেই”, সেক্রেটারি ট্রেজারারকে বললেন, “আমাদের আসল কাজটা করতে হবে
কর্পোরেশনের অফিসে। সাধারণ আবেদন করে হোক বা আরটিআই করে হোক, ফ্ল্যাটবাড়ির আসল নকশাটা
বার করাতে হবে। শুনছি সেটাও নাকি ঠিকমত পাশ করান হয়নি। চলুন, আজকের ছুটিটা তো
গেলই, ওদিকেও একবার ঘুরে আসি। আমার একজন পরিচিত উকিল আছেন। তাঁর সাথেও একটু আলোচনা
সেরে নেওয়া যাবে। কী বলেন!”
………………………………
প্রতিমা
কাপড় মেলতে এসেছে পিছনের ব্যালকনিতে।
এবারে পুজো দেরিতে এল
তাই এখনই ব্যালকনির ভিতরে রোদ। দুপুরটা মিঠেও নয়, ভালো তাত। “ছেলে কী করছে আজকাল?”
প্রশ্নটা শুনে প্রতিমা চোখ উঠিয়ে দেখল বড়বাড়ির বড়মালিকের স্ত্রী। বাড়িতে পুরুষদেরই
রমরমা। বড়মালিক, তার তিন ছেলে; এমনকি বড়ছেলের দেড়ফুটিয়া বাচ্চা, সেও মাস্তান। এদের
ছাড়া সচরাচর মেয়েদের দেখা মেলে ছাতে, উঠোনে। কিন্তু এই মহিলাকে বেশি দেখা যায় না।
মেয়েরা কলেজে লেখাপড়া করছে, ভিতরে যাই থাক ওপরে একটা সপ্রতিভতা আছে। এই মহিলা
একেবারেই গ্রাম্য। চোখে পড়লেও চোখে পড়েন না কেননা যে চেনেনা সে কাজের লোক মনে
করবে।
-
ছেলে তো এখন কলেজে, গ্র্যাজুএশন
করছে।
-
বিএ?
-
বিএসসি (মহিলার মুখ দেখে) ওই
বিএ-ই।
-
আর একটা মেয়েও আছে না তোমার?
-
হ্যাঁ! ও সাত ক্লাসে যাবে এবার।
-
বাঃ।… সেই বিয়ের সময় এসেছিলে
আমাদের বাড়িতে। তাই না? পারলে একদিন এস! আমার যে যাওয়া হবেনা তোমার বাড়িতে তা তো
জানোই।
-
আসব! আপনি যখন বলছেন নিশ্চই আসব।
-
তোমার শ্বাশুড়িকে দেখছি না!
-
শ্বাশুড়ি তো মারা গেলেন তিন বছর
আগে!
-
ওঃ। কে জানে, শুনেছিলাম বোধহয়,
ভুলে গেছি।… তোমার এই, কী যেন বলে…?
-
ব্যালকনি!
-
হ্যাঁ, বড় সুন্দর!
-
বাঃ, আপনার তো ওই বিশাল ছাত,
ভরা রোদ!
- তবু, তোমার ওই ছোট্টো ঘেরা জায়গাটুকু! যখনই দেখি, গিয়ে বসতে ইচ্ছে হয়। কতবার ভেবেছি, ওখানে বসে তোমার শ্বাশুড়ির সাথে গল্প করব। সে আর হল না।
মহিলা সিঁড়ির দিকে চলে
যান। সিঁড়িঘরের ওপাশে বিশাল ডিশ এন্টেনা। মেজছেলে জেলটেল ঘুরে এসে এখন কেব্লের
ব্যবসা আরম্ভ করেছে। ফ্ল্যাটবাড়ির সবাই তার গ্রাহক। গ্রিলের বাইরে টাঙানো তারের ওপর
ভেজা হাতদুটো রেখে রোদের মিঠেকড়া তাতটা অনুভব করে প্রতিমা।
No comments:
Post a Comment