Friday, July 2, 2021

প্রফুল্ল রঞ্জন দাস (১৮৮১ – ১৯৬৩)

[বিহার বাঙ্গালি সমিতির প্রতিষ্ঠা দিবস ৭ই এপ্রিল। অনেক দিন আগে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি (পাটনার বিখ্যাত উকিল) সমিতির প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি প্রফুল্ল রঞ্জন দাসের একটি ছোট্ট জীবনী লিখেছিলেন। ইন্সটিট্যুট অফ হিস্টোরিকাল স্টাডিজের তরফ থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ডিকশনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফিতে (এন আর রায় সম্পাদিত) জীবনীটি সঙ্কলিত হয়। সে জীবনীর একটি ভাবানুবাদ। সঞ্চিতায় প্রকাশিত। ]

প্রফুল্ল রঞ্জন দাস একজন বিখ্যাত ব্যারিস্টার এবং বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ছিলেন। একজন মানবতাবাদী, সাংবাদিক এবং নাগরিক অধিকারের প্রবল সমর্থক হিসেবে, সাধারণভাবে তিনি সবার কাছে পি আর দাস নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। শুভ্রকেশ, উজ্জ্বল দৃষ্টিসম্পন্ন এই অদম্য অভিজাত বৃদ্ধটি আইনের জগতে তাঁর দান ও ওকালতির জন্য কিম্বদন্তি হয়ে উঠেছিলেন; আটান্ন বছর আইনের পেশায় তাঁর আধিপত্য ছিল।

কলকাতা হাইকোর্টের এক সলিসিটর ভুবন মোহন দাসের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন প্রফুল্ল রঞ্জন দাস। ১৮৮১ সালের ২৯শে এপ্রিল তাঁর জন্ম হয়। ঢাকা জেলায় তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল। তাঁর বড় ভাই ছিলেন ছিলেন চিত্ত রঞ্জন দাস, যাঁকে দেশের মানুষ দেশবন্ধু নামে জানে। এই পরিবারের আরেক খ্যাতনামা মানুষ হলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, যিনি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং এখন সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট। প্রফুল্ল রঞ্জন দাস, ইংল্যান্ডে থাকাকালীন বিয়ে করেন ডঃ ইভান্সের মেয়ে ডরোথীকে। তাঁদের দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে হয়। তারা সবাই তাঁর জীবৎকালেই মারা যায়।

প্রথম জীবনে প্রফুল্লবাবুর পড়াশুনো কলকাতায় হয়। ১৯০০ সালে তিনি ইংল্যান্ডে যান ব্যারিস্টারি পাশ করতে। সেখানেই তাঁর একটি ইংরেজি কবিতার বই, মথ এন্ড দ্য স্টার প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করে ফিরে আসেন এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টে এডভোকেট হিসেবে যোগ দেন। এডভোকেট হিসেবে তাঁর যোগদানের গল্পটা প্রফুল্লবাবু এভাবে শোনান, বলতে গেলে অনেক বছর, ছাপ্পান্নো বছর আগে কলকাতা হাইকোর্টের আদি দিকটার রেজিস্ট্রার আমাকে নিয়ে যান ওল্ড সেশন্স কোর্টে মিঃ হ্যারিংটনের কাছে। যদ্দুর মনে পড়ে, কিছু একটা শপথবাক্য পড়ি। তারপর আমায় কলকাতা হাইকোর্টের এডভোকেট হিসেবে নথীভুক্ত করে নেওয়া হয়। (ওল্ড মেমরিজ, ক্যালকাটা হাইকোর্ট স্যুভেনির, সেন্টিনারি সেলিব্রেশন ১৮৬২ ১৯৬২)

নিজের ওকালতি জীবনের শুরুর দিনগুলোয় যে মনে রাখার মত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের সম্বন্ধে প্রফুল্লবাবু বলেন, ফ্রান্সিস ম্যাক্লিন তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং ওকিনেলি ছিলেন এডভোকেট জেনারেল। শ্রী এস পি সিনহা ছিলেন স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল। ওকিনেলিকে আমি বিশেষ দেখিনি, তবে যে মানুষটি আমায় আকৃষ্ট করেছিল তিনি ছিলেন এস পি সিনহা (পরবর্তিকালে লর্ড সিনহা)।

পি আর দাস নিজের ওকালতি জীবনে অনেক ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে ওকালতি পেশায় ঢুকলেও, সাফল্যের তোরণ তৎক্ষণাৎ খুলে যায়নি।

১৯১৫ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিভিল মামলা তাঁর হাতে আসে। মামলাটি ভাগলপুর শহরের একটি এস্টেটের ব্যাপারে ছিল। মামলায় বিপরীত দিকে ছিলেন তাঁর ভাই সি আর দাস। এদিকে পি আর দাসের সিনিয়র কাউন্সেল যদিও এস পি সিনহা ছিলেন কিন্তু অপরিহার্য কারণে তিনি শুনানিতে অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হন। ফলে, পি আর দাস নিজেই শুনানিতে নিজের ক্লায়েন্টের প্রতিনিধিত্ব করেন। বেশ কয়েক মাস মামলার শুনানি চলে আর শেষে পি আর দাস মামলাটা জিততে সফল হন।

১৯১৬র মার্চ মাসে পাটনা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। সে বছরই শ্রী দাস কলকাতা হাইকোর্ট থেকে সরে এসে নিজের প্র্যাক্টিস পাটনা হাইকোর্টে করা শুরু করেন এবং পেশাগত জীবনে তাঁর উন্নতি শুরু হয়।

জানুয়ারি ১৯১৮তে উনি পরমেশ্বর আহিরের হ্যাবিয়াস কর্পাস আবেদনের পক্ষে আদালতে হাজির হন এবং সাংবিধানিক গুরুত্বের কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত করেন। প্রশ্নগুলো গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া ইন কাউন্সিলের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংক্রান্ত ছিল। শ্রীদাসের অতুলনীয় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে (পরমেশ্বর আহির বনাম সম্রাট, এআইআর ১৯১৮, পাটনা, পৃ ১৫৫, ফুল বেঞ্চ)। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯১৮ তারিখে নির্গত ফুল বেঞ্চের রায়ে প্রধান বিচারপতি ডসেন মিলার শ্রীদাসের বিষয়ে লেখেন, সন্দেহাতীত সাহস ও ক্ষমতাসম্পন্ন কৌঁসুলি। রায়ে হাইকোর্ট উল্লেখ করল যে যদি ভারতীয় আইনসভার পাশ করা আইন ওই আইনসভাকে দেওয়া ক্ষমতার আওতার বাইরে হয়, তাহলে এই কোর্টের ক্ষমতা ছিল নিয়মানুগ প্রক্রিয়ায় গিয়ে ওই আইনকে আল্ট্রাভাইরেস (নিয়মবিরুদ্ধ) ঘোষিত করার এবং বলবৎ না হতে দেওয়ার। (অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের সম্মানরক্ষার্থে কোর্ট সেই প্রক্রিয়ায় না গিয়েও শ্রী দাসের অকাট্য যুক্তি স্বীকার করে নিল।)

১৯১৯ সালের মার্চে তাঁকে পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৩০ সাল অব্দি শ্রী দাস ওই পদে কর্মরত ছিলেন। তারপর পদত্যাগ করে তিনি আবার ওকালতি পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। ওকালতি জীবনে ফেরার পর শ্রী দাস নিজের পেশায় শীর্ষস্তরে পৌঁছোন। একের পর এক মামলায় জয়লাভ তাঁকে বিপূল পরিমাণে অর্থ আর খ্যাতি এনে দেয়। দেশের প্রায় সব কটি হাইকোর্টে, ভারতের ফেডেরাল কোর্টে, সুপ্রীম কোর্টে এবং অনেক ট্রাইব্যুনালে তিনি মামলা লড়েছেন। তাঁর লড়া মামলাগুলোর মধ্যে জমিন্দারি এবোলিশন (ল্যান্ড রিফর্মস) একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা যাতে শ্রী দাস তাঁর আইনি বিচক্ষণতা প্রমাণ করেছেন (স্টেট অফ বিহার বনাম কামেশ্বর সিং এআইআর ১৯৫২, এসসি পৃঃ ২৫২ এবং কামেশ্বর সিং বনাম স্টেট অফ বিহার এআইআর ১৯৫১, পাটনা পৃঃ ৯১)। গান্ধী হত্যা মামলায় তিনি বীর সাভারকরের পক্ষে সওয়াল করেন এবং তাঁর মক্কেল খালাস পেয়ে যায়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মামলা ছিল যযাতি ভট্টাচার্যের রিট ব্রাহ্ম সমাজ বালিকা বিদ্যালয় এবং একজন ছাত্রের আবেদন (এআইআর ১৯৬৩ পাটনা, পৃঃ ৫৪ ডি এন সরকার বনাম স্টেট অফ বিহার)। ধারা ৩০এর অন্তর্গত নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ও প্রশাসনভার হাতে রাখার সাংবিধানিক অধিকার ব্রাহ্ম সমাজের আছে এবং তাতে রাষ্ট্রের (সরকারের) কোনোরকম হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই এই রায় দেয় হাইকোর্ট। যাঁরা ওই সব মামলা চলাকালীন এজলাসে শ্রী দাসকে যুক্তিজাল বিস্তার করতে শুনেছেন তাঁরা শ্রী দাসের বাগ্মীতা ও পান্ডিত্য কখনো ভুলতে পারেন নি।

নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জায়গা হিসেবে দেখতেন শ্রী দাস। মাদ্রাজে ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে ১৫-১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টিজ কনফারেন্সে তিনি সভাপতি ছিলেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন, ফ্রিডম ফ্রম আর্বিট্রারি এরেস্ট ইজ ফান্ডামেন্টাল আনঅল্টারেবল রাইট অফ ম্যান। এবং, উই মাস্ট নেভার ফরগেট দ্যাট ইটারনাল ভিজিলেন্স ইজ দ্য প্রাইস অফ লিবার্টি বলে নিজের বক্তব্য শেষ করেন। সম্মেলনে ভারতের ড্রাফট সংবিধানের (তখন তৈরি হচ্ছিল) বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি সংবিধান কমিটির উদ্দেশ্যে অনুরোধ জানান, যেন জাপানের সংবিধান ১৯৪৬ থেকে ধার নেওয়া এক্সেপ্ট একর্ডিং টু প্রসিডিওর এস্ট্যাব্লিশড বাই ল অভিব্যক্তিটির জায়গায় ভারতের সংবিধানের ধারা ১৫ (এখন ধারা ২১) এ লেখা হয়, ডিউ প্রসেস অফ ল। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে নইলে নাগরিকদের জীবন ও স্বাধীনতা কার্যবাহক সরকারের দাক্ষিণ্যের অধীন হয়ে পড়বে।

শ্রী পি আর দাস দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ সংক্রান্ত সবরকম বিষয়ের প্রতি সহানুভুতিসম্পন্ন থাকতেন এবং রাজনৈতিক কারণে পীড়িত মানুষদের সাহায্য করতেন। আলিপুর বোমা মামলায় আসামী ধর্মিন্দর গুপ্তাকে তিনি কাজে রেখেছিলেন। শ্রীদাস, রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে পাটনার দৈনিক সংবাদপত্র সার্চলাইটের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং খবরের কাগজটিকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ, শরত বোস, সুভাষ চন্দ্র বোস প্রভৃতি কংগ্রেসের নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তাঁর কাছে রাজনৈতিক তহবিলের জন্য দান গ্রহণ করতে আসতেন। মহাজাতি সদনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস যখন পাটনায় এসেছিলেন তখন শ্রী দাসের বাড়িতেই উঠেছিলেন। শ্রী দাস তাঁর তহবিলে দান দিয়েছিলেন। প্রফুল্লবাবুর হৃদয় মানবীয় দয়ায় পরিপূর্ণ ছিল। দানের কোনো সীমা ছিল না। চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, রামকৃষ্ণ মিশন, দিল্লি কালিবাড়ি, মহাজাতি সদন ছাড়াও আরো বহু সংস্থাকে তিনি দান দিয়েছিলেন। প্রয়োজনে আসা মানুষ তাঁর দরজা থেকে কখনো ফিরে যেত না।

পেশাদারী জীবনে শ্রীদাস দীর্ঘ ইনিংস খেলেছিলেন এবং অতগুলো বছর ধরে একভাবে দীপ্তিমান ছিলেন। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের বিষয়ে ওপর তাঁর দখল, গুণমান ও কর্তৃত্ব এক বিন্দু কমেনি। ১৯৬৩সালের ৩রা সেপ্টেম্বর তাঁর জীবন শেষ হয়। মারা যাওয়ার সময় তিনি কপর্দকশূন্য ছিলেন। অথচ নম্র ছিলেন একই রকম। নিজের উত্তরাধিকারিদের জন্য এক ইঞ্চিও স্থাবর সম্পত্তি রেখে যাননি। বোধহয় আর কোনো আইনজ্ঞ নিজের পেশার জগতে এত বছর ধরে এক ভাবে সগৌরবে এমন আধিপত্য বিস্তার করে থাকেন নি। তাঁর নির্ভীক ও সফলকাম ওকালতি এবং মামলাসংক্রান্ত অসংখ্য আইনের উল্লেখ, আইনী জগতে তাঁর সফলতার জীবন্ত স্মারক। আজও উকিলসভার সেই সব সদস্যরা যাঁরা মানুষের মৌলিক অধিকারের পক্ষ সমর্থন করেন, শ্রী প্রফুল্লরঞ্জন দাস তাঁদের প্রেরণা যোগান।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি

(বাংলায় অনুবাদ বিদ্যুৎ পাল)

 

No comments:

Post a Comment