“১৯৩৭ এর কথা। মাস মনে নেই। স্ত্রী সুশীলার সাথে বাড়ি যাচ্ছিলাম – নেপালের বিরাটনগরে। নতুন নতুন বিয়ে। কাটিহার থেকে জোগবানি যাওয়া ট্রেনে ছিল আমাদের সফর। জোরে বৃষ্টি পড়ছিল। একটি স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছাড়লে দেখলাম এক কিশোর আমাদের কামরার বাইরে হাতল ধরে পাদানিতে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনটা দ্রুতগতিতে দৌড়োনো শুরু করেছে। ভিজে জবজবে হচ্ছে যুবকটি। আমাদের কামরাটা সেকেন্ড ক্লাস (সেসব দিনের রাজসিক সেকেন্ড ক্লাস)। কামরায় শুধু আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই ভাবছিলাম ওই একান্ত অপরিচিত ব্যক্তিটিকে কামরার ভিতরে ঢুকতে দেব কি দেবনা। ইতর নয় তো? হতে পারে চোর! আমাদের একলা পেয়ে খুন করে জিনিষপত্তর নিয়ে পালিয়ে যাবে! কিন্তু সুশীলা আর থাকতে পারল না। মনে যে ভয়ই থাক, সে সময় ওর অবস্থা দেখে সুশীলার মায়া হল। উঠে দরজা খুলে দিল সে। ভিতরে এসে যখন ছেলেটি দেখল কামরায় স্বামী-স্ত্রীর মত দেখতে দুজনই মানুষ, সে সংকুচিত হয়ে পড়ল। বসতে চাইছিল না কিন্তু আমরা বার বার অনুরোধ করায় একটা সিটে কুঁকড়ে বসে পড়ল। একটু স্থির হওয়ার পর নিজের পরিচয় দিল; আমাদেরও পরিচয় জানতে চাইল। পারস্পরিক পরিচয়ের পর সে আমাদের সাথে এমন মিশে গেল যে আমাদের সাথে বিরাটনগর চলে এল। বিরাটনগর এসে আমাদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করল। …”
এই ছেলেটিই পরবর্ত্তি সময়ে হিন্দীর খ্যাতনামা সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ
রেণু। ওপরের স্মৃতি-খন্ড নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বেশ্বরপ্রসাদ কোইরালা
লিখিত রেণুর “নেপালী ক্রান্তিকথা” বইটির ভূমিকা থেকে নেওয়া।
এক সময়ে পুর্ণিয়া জেলার অন্তর্গত হলেও এখন আরারিয়া জেলার ফরবেসগঞ্জ
ব্লকের অন্তর্গত গ্রাম ঔরাহি হিংগনা। এই গ্রামেই আজ থেকে একশো বছর আগে, ১৯২১ সালের
৪ঠা মার্চ এক পশ্চাৎপদ জাতের (ধানুক) সম্পন্ন কৃষক পরিবারে ফণীশ্বরনাথের জন্ম হয়। বাবা
শীলানাথ মন্ডলের কৃষিকাজে সম্পন্নতা অবশ্যই এসেছিল, কিন্তু নিষ্ঠাবান স্বাধীনতা সংগ্রামী
ছিলেন। ফণীশ্বরের জন্মের সময় ঋণের দায়ে জড়িয়ে পড়েন। ফণীশ্বরের ঠাকুমা তাই তার ডাকনাম
রাখেন ‘রিনুয়া’। সেই ‘রিনুয়া’ই পরে ‘রেণু’ হয়।
‘বিহারের দুঃখ’ নামের কুখ্যাতি মাথা পেতে নেওয়া কুশী নদীর পূর্বদিকে
পূর্ণিয়া অঞ্চল ও পশ্চিম দিকে দ্বারভাঙ্গা অঞ্চল। বাংলাভাষী অধ্যুষিত হওয়ার কারণে দুটোই
পরে ভাষিক-সাংস্কৃতিক-মিলনধর্মী বাংলা সাহিত্যের তীর্থ হয়ে উঠেছে। ওদিকে বিভুতিভূষণ
মুখোপাধ্যায়, এদিকে সতীনাথ ভাদুড়ি। রেণু বলতে গেলে শৈশব থেকেই বহুভাষিক ছিলেন। বাড়িতে
হিন্দীর সাথে বাংলা পত্রপত্রিকাও আসত। বাবার বাঙালি বন্ধুরা আসতেন। স্কুলে হিন্দীভাষী
ও বাংলাভাষী বন্ধুরা ছিল। একটু উত্তরে পা বাড়ালেই নেপাল। মাটির ভাষা মৈথিলি ও অঙ্গিকা।
ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি। উর্দু তো হিন্দীর সাথেই ছিল। রেণুর মেজাজটা গঠন করতে তাই
এই সব ভাষার সমকালীন হালহকিকৎ সাহায্য করেছিল।
পুরোদস্তুর সাহিত্যিক হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন সামাজিক
ও রাজনৈতিক কর্মী। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জেলে গিয়ে সতীনাথ ভাদুড়ীর সাথে ছিলেন এবং শিষ্যত্ব
গ্রহণ করেছিলেন, এটা বাঙালি পাঠকমাত্রেই জানেন। বন্যায় নৌকো নিয়ে গ্রামে গ্রামে রিলিফের
কাজে যেতেন, ভুখামিছিলএর সাথে পুর্ণিয়া থেকে পাটনা ৩৫০ মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন হেঁটে।
বেনারস হিন্দু ইউনভার্সিটিতে পড়ার সময় চুটিয়ে ছাত্র ফেডারেশন করেছেন। নেপালের সাথে
তাঁর শৈশবের ভালোবাসার দায় চুকিয়েছেন ১৯৫১র নেপাল-বিপ্লবে, রীতিমত বন্দুক নিয়ে, কোমরে
পিস্তল ঝুলিয়ে অংশগ্রহণ করে।
লাগাতার এই আন্দোলনাত্মক সক্রিয়তার ফলশ্রুতি হিসেবে রীতিমত অসুস্থ
হয়ে পড়েন। লেখার কাজটা প্রথম থেকে চালিয়ে গেলেও, যে উপন্যাসে তিনি কিছুদিনের মধ্যে
ভারতবিখ্যাত হয়ে ওঠেন, হিন্দী সাহিত্য সমালোচকদের বাধ্য করেন উপন্যাসের চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলোকে,
‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ নামে নতুন শ্রেণী গঠন করে পুনর্ভাষিত করতে, সেই “ময়লা আঁচল” লিখতে
বসেন (বা অন্ততঃ পুরো করেন) বস্তুতঃ অসুস্থ হয়ে পড়ায়। বৌএর গয়না বেচে কাগজের ব্যবস্থা করলে পর সেই উপন্যাস
ছাপা হয়। অবশ্য ছাপা হতে না হতেই এমন আলোড়ন শুরু হয় যে হিন্দীর সবচেয়ে বড় প্রকাশন সংস্থা
অবিলম্বে বইটির প্রকাশনের অধিকার কিনে নেয় এবং নতুন সংস্করণ বার করে।
‘ময়লা আঁচল’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪য়। এর তিন বছরের মধ্যেই বেরোয় তাঁর
দ্বিতীয় মহান উপন্যাস ‘পরতি পরিকথা’। কিন্তু হিন্দী এবং বিশেষ করে অন্যভাষার মানুষেরা
যাদের সাহিত্যের সাথে তেমন যোগ ছিল না তারা ফণীশ্বরনাথ রেণুর নাম জানতে পারে আরো নয়
বছর পর, যখন হিন্দী সিনেমার বিখ্যাত গীতিকার শৈলেন্দ্র, রেণুর ছোটগল্প “উফ্, মারে
গয়ে গুলফাম’ অবলম্বনে তৈরি করেন “তিসরি কসম”, যার প্রধান দুটি চরিত্রে ছিলেন রাজকাপুর
এবং ওয়াহিদা রেহমান।
কিন্তু রেণুর রক্তে ছিল সমাজবদলের আন্দোলনে অংশিদারী। তাই ১৯৭৪
সালে আবার জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে বিহার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয়
সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৭৪ সালে যখন পাটনার রাস্তায় লোকনায়কের ওপর
লাঠিচার্জ হয়, রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে রেণু বলেন, “পদ্মশ্রী আমার জন্য আজ পাপশ্রী হয়ে
গেছে। … এই সম্মান ফেরত দিলাম।“
১৯৭৭ সালে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে পাটনার হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
মৃত্যুকথা নয় জীবনের রূপকথা দিয়েই বরং শেষ
করি। “পরতি পরিকথা’য় কুশীর বন্যা নিয়ে কিছু রূপকথা আছে। সে রূপকথায় দুটো শব্দ আছে,
কুশীর ওপর ভর করা দুটো টোনা, ‘কুড়ুলে ঝড়’ যাতে এক হাজার কুড়ুল নিয়ে দানোরা থাকে আর
‘পাহাড়ি জল’ যা পাহাড়কেও ডুবিয়ে দেয়।
“কুড়ুলে ঝড় আর পাহাড়ি জল কাছে
চলে এসেছে। একদম কাছে! এবার? এবার কী হবে? … কুশীর রণহুঙ্কারে একটা মুনিয়াও ডাকল না,
একটা মুখও নড়ল না। কোনোদিক থেকে কোনো জবাব নেই। তখন কুশীমা গলা চিরে চিৎকার করতে লাগল,
ওরে আয়, কেউ থাকিস তো আয়! কেউ একটা প্রদীপ জ্বালা কোথাও!
“এক মুহুর্তের জন্যও কেউ একটা
প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলে কে জিতবে কুশী মায়ের সাথে? কুড়ুলে ঝড় কুশীর আঁচল ধরেই ফেলছিল,
ঠিক তখনই ওদিকে একটা প্রদীপ জ্বলে উঠল! কুশীমায়ের সবচেয়ে ছোটো সৎবোন দুলারিদায়, বরদিয়া
ঘাটে, আঁচলে একটা প্রদীপ নিয়ে এসে দাঁড়ালো। ব্যাস, মা একটা অবলম্বন পেল। উল্টে নিজের
শেষ টোনাটা ছুঁড়ল।
No comments:
Post a Comment