Sunday, August 15, 2021

রবীন দত্তের কবিতা

 মানুষের নামভূমিকায়



একবুক বারুদ নিয়ে

একবুক বারুদ নিয়ে, মে মাসের রোদ্দুরে,
                                      মাথা, বুক ঝাঁ ঝাঁ করছে
আপনারা চিন্তা করুন
কারণ আমি বহুদিন এভাবে মাস বছর সপ্তাহ
হু হু করে পেরিয়ে এসে
এখনো একবুক বারুদ নিয়ে বসে আছি;
চুল মুখ সারাটা শরীর যেন মহেঞ্জোদড়োর চিড় ধরা পাঁচিল
          চোখের কোলে ইতিহাসের কালি
চোয়াল শক্ত করে মাস বচ্ছর সপ্তাহ পেরিয়ে আজ এখনো
সময়ের ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছি আর বলছি
আপনাদের যে কেউ একজন বুকের কাছে পাটকাঠিটা ধরুন
মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন কেন, দেখুন না
দারুণ একটা শব্দের মধ্যে দিয়ে
সবকিছু ওলোট পালোট করে কিভাবে ফেটে পড়ি;
এদিক ওদিক একরাশ জঞ্জালের ডাঁই ছাই করে চলে গেলে
দেখবেন সাততলা গাছতলা সব একাকার হয়ে গেছে
নাকউঁচু পাঁচিলগুলো এধার ওধার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে
দেখবেন আঙন ভরা চালগুঁড়ির আলপনা, মাটির ঘটে
                                                          আমডাল
লালপেড়ে মেয়েরা ঘুরে ঘুরে শাঁখ বাজাচ্ছে
ছেলে বুড়ো সব্বাই গোল হয়ে হাত ধরে ঘুরবেন আর
ভাববেন ছেলেটা ঠিকই বলেছিল/ ঠিকই বলেছিল
                                                          ছেলেটা
   *         *          *         *         *          *   
একবুক বারুদ নিয়ে, মে মাসের রোদ্দুরে
মাথা বুক ঝাঁ ঝাঁ করছে
আপনারা দয়া করে আগুনের কথাটা ভেবে দেখবেন একবার?

 

 

 

আপন্ন-স্বপ্নের আপনি

মৃতের শহরে আছে
                   আমৃত্যু অবক্ষয়
                             মাঝে মাঝে মনে হয়
ছিন্নভিন্ন মন আর স্নায়ুরা কি অদ্ভুত নৈরাশ্য নিয়ে
বাঁচা বাঁচা দেখছে নিশ্চিন্তে
যেন
বাঁচা শুধু
          ঘটনার বদ্ধ পরিসর
ঘটনা তো
          সত্তার নিভৃত কোণে
মন নিয়ে লুকোচুরি খেলে
                   অনেক সময়
তখনই সময় তাকে আস্তে ইসারার কাছে
হাত তুলে কতবার হাসতে দেখেছি
মেঠো পথে
          ফিরোজা
                   সবুজে-শকুন্তলা আপনাকে
ঠোঁট বাহু চোখ পথ মাঠ মন
                             আশ্বাস আশাতে
আপন্ন-স্বপ্নের আপনি
অথচ সময় তার
            বহতা মিছিলে মিশে
                     আমি বসবাস করি
মহাসুখে !!!
কিম্বা ঘুরি অলি গলি
                   আপিস
                   কাছারি
                   বাড়ী
                   ট্রামবাস         আত্মীয় স্বজন
ছিন্নভিন্ন
          স্বপ্নমন
                   স্নায়ু নিয়ে অবক্ষয়ের এই ধূসর শহরে!
ধূসর শহরে
          আপন্ন-স্বপ্নের আপনি
                             ইদানিং কোথায় থাকেন?
 

 

 

নতুন আবাদ দেখো

সে রকমই কথা আছে প্রয়োজনে মিছিলের রক্তিম জোয়ারে
সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে যোঝা যাবে বিপক্ষের হিংস্র চাতুরী
এখন ওদের কাছে ভিক্ষা নয় উচ্ছিষ্টের পেছন দুয়ারে
দাবীর মশাল জ্বেলে আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ পোহাবো শর্বরী

বিপন্ন বিপক্ষ দেখো বিদ্ধ হবে বিপ্লবের তীক্ষ্ণ ইস্পাতে
এখানে আপোষ নেই, (চতুরেরা সখ্য চায় নতুন আঁতাতে)
বিশশো বছর ধরে রক্ত ক্লেদ নির্য্যাতনে ক্লিষ্ট ইতিহাস
অনেক তো দ্যাখা হোলো অরণ্য শাসন আর বুর্জ্জোয়া বিলাস

সে রকমই কথা আছে সকলে মিলবো এসে আসন্ন মিছিলে
নতুন আবাদ দেখো বোনা হবে এ মাটিতে বুনো গাছ তুলে।

 

  

সে

সে তো এক তীর্থের কাক  
৩২ বছর ধরে জীবনের ঘাটে ঘাটে ঘুরে
এখন জেনেছে শুধু প্রজ্ঞা নয় বুদ্ধি নয়
বেঁচে থাকা জৈব এক জীবন ধারণ
মগজের ঘিলু শুধু প্রবৃদ্ধ কুঞ্চনে এক কিম্ভুত জিনিষ
প্লীহাতেও ব্যাথা হয়,
শরীর জবাব দেয় উত্তর যৌবনে
এবং সকালে উঠে আড়মোড়া ভেঙে দেখে
লড়ে যেতে হবে
এভাবেই একা একা ন্যূনপক্ষে ২৯ বছর
তবুও জবাবদিহি দিতে হয় মধ্য রাতে
প্রতিরোধে কি করেছো আজ
কারণ প্রতিটি দিন পিছু নেয়
চোখে যার গভীর গগল্‌স্‌।

 

  

ভার্সিটির দরজায় প্রাণ ভেতরে সচিব


অমৃতং তু বিদ্যা

প্রবেশ নিষেধ বেশ

এই আর্জিটুকু শুধু ভেতরেতে পেশ করে দিন

(কারণ তাঁদের কাছে কৃপাবৃষ্টি তার জলে আচমন চাই);

যদিও ইদানীং

ছাব্বিশ বসন্তের প্রাণ, বিবশ আকাশে দ্যাখে, ছাব্বিশ শকুন

তবুও দেখুন

আমি তো অমৃত চেয়ে, জন্ম থেকে, সময়কে টানতে টানতে

বয়েসের এইখানে এনে এখন নিজের কাছে, নিরাকার

শূন্য সৎ একা বসে আছি;

 

আমি তো প্রবেশ চেয়ে, পাড়ি দিয়ে, আসতে আসতে

অবশেষে এইখানে এসে তাঁর দরজার পাশে বই হাতে

নতজানু বাধ্য বসে আছি;

  যেমন বধির থাকে মুখর সংলাপ দেখে নির্বোধের মতো

   *         *          *         *         *          *   

(সচিবের কন্ঠস্বর, বলেছি তো হবে না এখানে)

কারণ তাঁদের কাছে কৃপাবৃষ্টি তার জলে আচমন চাই !!

 

 

 

 

স্মৃতিতে সমুদ্র নেই

 

স্মৃতিতে সমুদ্র নেই

আছে শুধু তিক্ততার সারিবদ্ধ দীর্ঘ ক্যারাভান

স্বপ্নে নেই মন্থনের অমৃত-আস্বাদ

আর এই নিদাঘের প্রচন্ড রোদ্দুরে

এখানে রয়েছে পড়ে ধূ ধূ বালি কোনোদিন বৃষ্টি তো নামে না।

মাটি নেই জল নেই

তবুও এখানে দেখ দ্যাখো উত্তপ্ত সীমুমে

মৃত্যুকে তর্জনী তুলে অদূরের করোটীতে রেখে

ক্যাকটাস মাথা তোলে পরিবেশে তপ্তশ্বাস ফেলে

কি হবে সমুদ্র নিয়ে সুক্তি আর ঝিনুকের রঙীন বিলাস

সত্তা, তুমি বাস্তবের কঠিন মাটিতে চলো দৃঢ় পদক্ষেপে

কারণ আগামী দিনে এ মরুতে বোনা হবে জীবনের চাষ।

 

 

 

 

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

 

এখানে তো মধ্যরাতে সত্তার গভীরে শুধু পদধ্বনি শুনি

ভ্লাদিমির আপনি কি আমাকে আজ ক্রুশে বিদ্ধ করে যাবেন

কারণ নিজের কাছে সমর্পিত রক্তের লেগুনে

                                                সূর্যোদয় হলোনা এখনো

এবং আমি এই মিছিলের শরণার্থী ভীড়ে

মানুষের স্বীকৃতিকে দলিত দেখেছি

ইলিচ আপনিও দেখুন এখানে বান্ধব মুখে নিয়তই

                                                শব্দ সৃষ্টি হয়

মাইকের আর্ত্তনাদে প্রতিদিন বাক্যের বেলুন

লেনিন আপনিই বলুন, ইদানীং বার্ষিকীর ভীড়ে

উচ্চারিত মন্ত্র কেন ফ্রেমেতে আবদ্ধ আজ ফ্রিজ ঝুলে আছে

(জীবন চলেছে তার পল্বলিত খাতে)

অথচ এ সমাবেশে কাজের আদেশ চেয়ে চেতনার ভিতরে

                                                          যে জ্যোতি

তার স্থির বৃত্তে এসে তিতিক্ষায় বিবিক্ত থেকেছি

কিন্তু কর্মের কাছে শুধুমাত্র শব্দসৃষ্টি একেবারে অর্থহীন

                                                          বলে মনে হয়

অনিবার্য আপনাকে আমি জীবনের প্রেক্ষিতে রেখে

স্ফুলিঙ্গের মুখোমুখি দাঁড়াতে এসেছি

যেমন মশাল জ্বেলে বল্লমের স্পর্ধিত হাসি

পৃথিবীর ক্ষুধা মৃত্যু মোকাবিলা করে

এখানে তো মধ্যরাতে সত্তার গভীরে শুনি দ্রিম দ্রিম

                                                          মাদলের ধ্বনি

ভ্লাদিমির আপনি কি আমার রক্তে আমাকেই দীক্ষিত

                                                          করে যাবেন

কারণ ক্রুশের কাছে সমর্পিত রক্তের লেগুনে সূর্যোদয়

                                                          দেখে যেতে চাই

 

 

 

 

জ্বলন্ত এক্‌জিট

 

আসরের সব বাতি ম্লান হোলো

শেষ দৃশ্যে গোধুলি আলোয়;

একঘর দর্শক সামনে রেখে অতঃপর সামান্য সময়ে

ভূমিকা, সংলাপ আর নেপথ্য সংগীত বেয়ে

নায়ক তো নীত হল আর্য কোনো ট্র্যাজিক পর্য্যায়ে।

 

ছাব্বিশ বছর ধরি, ট্রাম বাস ট্রাফিকের ভীড়ে

ন্যুব্জ সত্তার এক রক্তমাংস আমি পথ চলিতেছি

অদৃশ্য ইংগিতে; আমি একা কেহ কোথা নাই

প্রেম নাই, প্রীতি নাই, আসা নাই, ভালোবাসা নাই;

হাহাকার ভরা এক অন্ধ করা কবন্ধ আঁধারে

পথ চলিতেছি ছাব্বিশ বছর ধরি পৃথিবীর পথে।।

 

আশেপাশে খস্‌খস্‌ বেসামাল শাড়ী

চারিদিকে পুষ্পিত সুবাস আর

মেলোড্রামা ফেলে রেখে আমি তাড়াতাড়ি

সীট ছেড়ে

অন্ধকার সুমুখে খুঁজি জ্বলন্ত এক্‌জিট্‌।।

 

 

 

 

এখনো এ চতুরঙ্গ

 

এখনো এ চতুরঙ্গে নৃপ, মন্ত্রী, তুরঙ্গের যথেচ্ছ দৌড়!

পদাতিক

তুমি শুধু একঘর যেতে পারো, তার বেশী নয়,

নিয়ত এ সম্মুখ সমরে তুমি এক ক্রীড়নক

আরোপের বোঝা বয়ে যুঝে যাবে মৃত্যু অবধি;

(অথচ) তোমাকে ছাড়া ওই সব চতুরের গত্যন্তর নেই।

 

ব্যবস্থা বদল ভিন্ন শোষণের হাত থেকে মুক্তি হবে কি?

এখনো তোমার হাতে বিধৃত রয়েছে সেই বিদ্রোহের বীজ

পদাতিক ভেবে দেখো

অন্যথায় চতুরঙ্গে নৃপ মন্ত্রী তুরঙ্গের যথেচ্ছ দৌড়।

 

 

 

 

পর্যটন সপ্তাহে নালন্দা

 

সারাদিন বিচিত্র শব্দ

ট্রান্‌জিস্টার

          ট্যুরিস্ট ভীড়

          ইতস্ততঃ অর্ধভুক্ত গাইডের দল

মন্তব্যে মুখর-মুখ-মহিলারা বলে যান

          ইস্‌ কি অদ্ভুত

স্তিমিত রোদের আলো পৌষের পড়ন্ত বেলায়

অতর্কিতে সন্ধ্যা আসে নামে অন্ধকার

তখন নৈঃশব্দ শুধু খুঁজে ফেরে

নালন্দার বারান্দা অলিন্দে

হুয়েন সাঙ্‌ কিম্বা অন্য নাম।

 

 

 

 

সারাটা ইতিহাস ধরে

 

(অকারণে হাত মুচড়ে ধরো না, বলতে দাও)

কারণ সারাটা ইতিহাস ধরে

আমি

          মাঠ ছুঁয়ে ঘাস,

                   ঘাস ছুঁয়ে ধান,

                             ধান ছুঁয়ে চাল আনলুম

 

কিন্তু কি আশ্চর্য্য দেখুন

          (অকারণে হাত মুচড়ে ধরো না, বলতে দাও)

কারণ সারাটা ইতিহাস ধরে

আমি

          গাছ বুনে তুলো,

                   তুলো ধুনে সূতো,

                             সূতো বুনে ধুতি আনলুম

 

কিন্তু কি আশ্চর্য্য দেখুন

          (অকারণে হার মুচড়ে ধরো না, বলতে দাও)

কারণ সারাটা ইতিহাস ধরে

আমি

          মাটি ছেনে লোহা,

                   লোহা ঢেলে চাকা,

                             চাকা থেকে টাকা আনিলুম

 

কিন্তু কি আশ্চর্য্য দেখুন

অকারণে হাত মুচড়ে ধরো না

কারণ আপনারাই দেখুন

আমি

এ ব্যবস্থার শেষ না দেখে মরবো না।

 

 

 

 

জীবন মারা গেছে

 

হঠাৎ খবর পেলাম

জীবন মারা গেছে;

জীবনের সঙ্গে আমাদের

অনেকদিনের চেনাজানা

তাই মনটা খারাপ হল;

আনমনা হয়ে

ছেলেবেলার কথা

ভাবতে ভাবতে

মনে পড়লো

আমরা পাঁচ বন্ধু

হাতের পাঁচটা আঙুলের মতো,

জীবন, সুনীতি

সত্য, আমি আর সুকৃতি

বলতে গেলে আমরা সকলে

একই সঙ্গে মানুষ হয়েছি;

পুরোনো দিনে কলেজ জীবনে

বইপাড়ায়, পূজোয় পার্ব্বণে

রোয়াকে আড্ডায় আমরা পাঁচজনে

একই সঙ্গে উঠেছি বসেছি।

তারপর যা হয়

দুনিয়ার অমোঘ নিয়মে

হিসেবে নিকেশে

দেনায় পাওনায়

লাভে লোকসানে

আর পাঁচটা ভাবনায়

ক্রমে ক্রমে আমাদের

আনাগোনা কমে কমে

দেখা হত বছরে

নিদেনপক্ষে একবার।

তাও শেষ দেখা হয়েছিলো

বেশ কবছর হয়ে গেল।

তারপর বহুদিন বাদে

হঠাৎ সেদিন খবর পেলুম

জীবন বেশ সুখেই আছে,

বাড়ী গাড়ী বিষয় আশয়

এ সব নিয়েই দিন চলে যায়,

তাছাড়া এখন

বেশ গুছিয়ে বসেছে

এর তার সঙ্গে

দেখা করার

আর তার সময় নেই।

ঠিক তখনই জানলুম

জীবন মারা গেছে।

আমরা চার মাথা এক হয়ে

জীবনকে কাঁধে নিয়ে

ঘাটের পথে পা বাড়ালুম

   *         *          *        

মাফ করবেন, তারপর লাসটা কদ্দিন ধরে বইছেন?

সিগারেটে শেষটানটা দিয়ে, আমি

ছোকরার চোখে চোখ বুলিয়ে বল্লুম্‌

জিজ্ঞেস করো লাসটা আরো কদ্দিন বইবেন?

এই শুনে, আড্ডার পাঁচজনে চেঁচিয়ে উঠলো,

আর সুনীতি, সত্য, সুকৃতি?

ফেরার,বলেই আমি দরজার দিকে পা বাড়ালুম।

 

 

 

 

সাইক্লিক্‌

 

ওরা এসে মিলেছিলো পরস্পরের ভাবপ্রবণতার ছায়ায়

ওদের মন একে অন্যকে দেখেছিলো নেড়ে চেড়ে

একটা প্রেমপত্রের মতো উল্টে পাল্টে

যেন অনেক রহস্য আছে এপিঠে ওপিঠে

আর যেমন সব পার্থিব জিনিষেরই ছায়া আছে

সব ফলেরই খোসা আছে

আর যেমন ছায়াহীন জিনিষ

আর খোসাহীন ফলের কথা ভাবাই যায় না

তেমনি ওরাও ছিল অভিন্ন হৃদয়।

কিন্তু কখন যেন ওদের চিন্তাধারা আলাদা হল

দৃষ্টিকোণ পাল্টালো

কখন যেন ওদের অন্তস্থিত সত্তা

একে অন্যকে

বিদ্ধ করল অন্ধ আবেগে

আর অনেক কাছে থেকেও

ওদের ব্যবধান বেড়ে গেল যথারীতি

সেটা উনিশশো ছাপ্পান্নো সন; তারিখ মনে নেই।

   *         *          *          *         *

চোখ তুলে তাকালাম। তুমি যাকে দেখলে

তার পরণে ধূসর স্ল্যাক্স আর বুক খোলা জামা

হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে

কপালে বয়েস রেখা ফেলেছে।

তুমি অনেক কাছে এলে যেন বললে

এ সন্ধ্যেটা তোমার জন্য রেখেছিলাম।

যেন এর আগে কোনো সন্ধ্যে আমার জন্যে রাখতে না

থেকে থেকে ভাঙা ভাঙা কথা হল;

কথায় কথায় ফিরে গেলাম সেখানে

যেখানে সবুজ ঘাসে ঢাকা কানন পথ

আর সমুন্নত চিনার গাছ

যেখানে চিত্রিত পটের ওপর শুধু তুমি

দিন নেই রাত নেই সময় নেই ইতিহাস নেই শুধু তুমি।

দেখতে দেখতে সময়ের কাঁটা ঘুরে গেল

আর মনে হল

পৃথিবীর সব পথের শেষ বুঝি শুরুতেই ফিরে আসে।

সম্বিৎ ফিরে পেলে; এবার ফেরার পালা

যাকে ফেলে গেলে ভুল বোঝাবুঝির বাষ্পে

সে একটা মিয়োনো বিস্কুট

আর মুচমুচে হবে না তোমার ভালবাসার

চুল্লিতে একটু সাহচর্য্যের উত্তাপে

                   সামনের ক্যালেন্ডার হাওয়ায় দুলে উঠলো

যেন শব্দ করে বললো

এটা উনিশশো ছেষট্টি সাল, জুলাই মাস, বাইশ তারিখ।

আজ শুক্রবার মনে পড়লো মিতা বলেছে

অপেক্ষা করবে পাড়ার সিনেমা হলে।

 

 

 

 

তবুও কি যেন নেই

 

সুব্রত, এখানে এসে নিয়েছিলে অতি মৃদু নিমফুল ঘ্রাণ

তরাই-এর মতো এক চড়াই উৎরাই আর লাল মাটি শান

এখানে। শ্রাবণ মাসে নিবিড় সবুজ গাছ, পাতা কিম্বা ঘাসে

সকালে বিস্তর রোদে মড়কের মত খরা নিঃশব্দে আসে;

সাঁওতালডিহিতে এক শালবনে নিয়ে গিয়ে সুব্রত তোমাকে

দেখিয়েছি আদিবাদী হাড়। মানুষ তবুও দেখি খুব বেঁচে থাকে

রেশনে বরাদ্দ চালে, অনাহারে কিম্বা এক নিতান্ত অভ্যাসে

আমরাও অথচ অনেকটা সই শীতে সুপ্ত মন্ডক প্রবাসে।।

নিমফুল ঝরে গেছে জাম নোনা কাঁঠালেরও ফুরিয়েছে কাজ

বেঁচে আছি আমরাও? তবুও কি যেন নেই এ দশকে আজ?

 

 

 

 

নেক্রোপলিস্‌

 

রোদের পীচের গন্ধ শহরের; ধোঁয়ার কালির রঙে ধূসর আকাশ

ঐহিক যন্ত্রণায় মৌননীল অথর্ব শহর; ট্রাফিকের আর্ত্তনাদ

বিদীর্ণ বাতাস চারিধার; পড়ে আছে শতাব্দীর বিসর্পিল পথ

                             শেষ কোথা? শুধালো সে,

সত্তার উত্তরে, বয়স্ক পৃথিবী শুধু হাই তুলে পিছনে তাকালো

 

 

 

 

পালোজোরি চোদ্দ মাইল সাঁরোয়া বারো

 

দুরাস্তা দুদিকে, মাঝামাঝি এক হাঁটু ধুলো নিয়ে

সিমেন্টের নিশানা পালোজোরি চোদ্দ মাইল সাঁরোয়া বারো

বাসের পর বাস ঠাসাঠাসু মানুষ টিয়া হাতে বুক

উঁচু সাঁওতাল

ধান তোলার সময় এটা

                             এরকম প্রচ্ছদপটে আমি নিতান্তই বেমানান

কিন্তু যেহেতু গ্রামে গঞ্জে শাখা প্রশাখা ছড়াতে ছড়াতে

অফিস এখন অজয়ের জলে মুখ দেখছে এবং

টাঁড়ে টাঁড়ে সাঁওতাল পরগণার ভেতরে আরো ভেতরে

পাহাড়ীডি গ্রামে কিম্বা বাসাহায় হায়

দুবেলা দুমুঠো জোটেনা গাঁ ঘর হাঁ করে দেখছে আমাকে

(সেহেতু) এ লোকটা এখানে নিতান্তই বেমানান;

সত্যি ধান ভর্ত্তি কাড়াগাড়ি চলে যাচ্ছে

সত্য নারায়ণ মুদির ভেতর ঘর-গোলায়

পুরোনো হিসেব পুরোনোই থেকে গেছে এবং লাল বই

                                                চলে গেছে অন্যত্র

লাক ত্রিকোণ থেকে বেরিয়ে এসে ছেলে পিলে

                                                দেখছে শ্বেত ভীতি

লাল কাগজ পত্তর সেইদিন আসছে আসবে আসছে আসবে

                                                লিখে চলেছে খুব

পুরোনো হিসেব পুরোনোই থেকে গেছে দুরাস্তার মাঝামাঝি

রূগ্নোহি* ছমাইল মাঁঝিতর* দশ ধুলো উড়ছে

আঁজোরিয়া রাতে বারাটাঁড়ে লিক্‌ ধরে ঘরে ফিরছে

                                                আদিবাসী মেয়ে

আজ বান্দনা মাড় ভাত হাড়িয়া আর নাচ কারণ এ লোকটা

নিতান্তই বেমানান এবং আয়নার ভিতর থেকে

গের্ণিকার ষাঁড় বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করছে

এ এলাকায় কাজকম্ম কদ্দুর?

ধুর কিছুই হয়নি অর্থাৎ দুরাস্তা দুদিকে

মাঝামাঝি এক হাঁটু ধুলো নিয়ে পালোজোরি চোদ্দ মাইল

                                                          সাঁরোয়া বারো

এবং

--------

*  গ্রামের নামে মুদ্রণপ্রমাদ ঘটেছে। কিন্তু যাচাই করে নেওয়ার উপায় নেই। 

               

  

 

 

স্প্রিন্ট

 

একটা দূর পাল্লার দৌড়ে দৌড়ুতে দৌড়ুতে

যে ছোটখাটো বাঁক পড়ে

সেখানে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে বললুম

পেছনে অনেক ফেলে দিয়ে

সামনের অনেক না দেখা নিয়ে

এ দৌড়ে পূর্ণতা কোথায়?

পেছনের এক দৌড়বীর আমায়

পেছনে ফেলে যাবার সময় বল্লে

এ দৌড়ে তুমি অংশ নিয়েছ

সেখানেই নিঃসংশয়ে তুমি পূর্ণ।

আমি পেছন ফিরে দেখলুম।

কি পেলুম কি ফেলে এলুম।

আসলে প্রথম পদক্ষেপ থেকে

শেষের ক্লান্ত পদক্ষেপ পর্য্যন্ত পূর্ণতা প্রবঞ্চনা।

কথাটা জনান্তিকে শোনা

তাই বিশ শতকের মাঝামাঝি আমি

সামনে পেছনে দেখতে দেখতে

দৌড়ুচ্ছি

                   দৌড়ুচ্ছি

                                      দৌড়ুচ্ছি

 

 

 

 

 

রাত থেকে সকালে স্রেফ

 

রাত থেকে সকালে স্রেফ সময়

ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে নীল

আলো চলে যাচ্ছে কোল্কাতা থেকে কুড্ডালোরে

নাম পালটিয়ে কি যেন হতে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে এ্যাপোলো

১৬র পেটে জন ইয়ং চ্যাঁচাচ্ছে খসে গেলো খসে গেলো চৌরাস্তায়

পাইপগান হাতে প্রমেথিউস্‌ সকাল থেকে সময়

দুমড়ে মুচড়ে দপ্‌ দপ্‌ করছে রাগে হে অন্ধ হ্রেষাধ্বনি

বুট ও বন্দুকের টেরাকোটা হে ক্রমিক কাঁটাতার

টাট্‌ টাট্‌ টাট্‌ টাট্‌ টাট্‌ টাট্‌ বা রু ম্‌ম্‌ম্‌ম্‌

বি-৫২ বোমারু বিমান হাতিন কোয়াং বিন্‌ বিন্‌ লিন্‌

থেকে শব্দ ভেঙে প্রতিশব্দে নিয়ে যাচ্ছে সকাল

হে কাঞ্চনজঙ্ঘা নারী রূপোলী ঠাসাঠাসি হে কনডম্‌

স্কুটার খাবার পিল্‌ হে বুভুক্ষা পিনিসিলিন দুমড়ে মুচড়ে

নীল অশ্বের যাতায়াত হে ক্যালানে কার্তিক সময়

হে অন্ধ অ্যাপোলো সময় কবে হবে কবে হবে কবে হবে কবে

স্রেফ চুরমার হয়ে যাচ্ছে

 

 

 

 

গাড়ীটা

 

গাড়ীটার নাম রাখলুম ভালোবাসা

অনেক দৌড়ঝাঁপ করে ছবছর পর

কপাল ভালো তাই পেলুম।

মনে হল এতদিনে ভালোবাসাকে পেয়ে

রঙীন স্বপ্ন সার্থক। এত ভালোবাসলুম

যে কাজে অকাজে ওকে নিয়ে

ঘুরে বেড়ালুম এখানে ওখানে।

তারপর

          যায়

                   দিন

                             যায়

ভালোবাসার মোহ কমতে লাগলো

আর খরচ বাড়তে লাগলো;

এর তার পরামর্শে ভালোবাসাকে

রাস্তায় নামালুম ভাড়া খাটাতে।

তারপর এ রাস্তা ও রাস্তা

এ গলি ও গলি ভাবটা

ফেললে কড়ি তুমি কি আমার পর।

তারপর

          যায়

                   দিন

                             যায়

ভালোবাসার সঙ্গে আজকাল আর দেখাই হয় না

বহুদিন বাদে হঠাৎ একদিন গাড়ীবারান্দায়

ভালোবাসার সংগে দেখা। ওর আর

সে জৌলুষ নেই এখানে ধুলো ওখানে ময়লা

রঙ চটে গেছে

পুরোনো দিনের কথা মনে পড়তে

আমি আর দাঁড়ালুম না।

 

তারপর

          যায়

                   দিন

                             যায়

ভালোবাসার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম নানা কাজের ভীড়ে

এমন সময় একদিন বিকেলে মালী এসে খবর দিলে

ভালোবাসা বেসামাল হয়ে আমার

বাড়ীর ফটকে মাথা কুটছে।   

   *         *          *

 

দিন তিন পরে ওজন করে

লোহার দরে

ভালোবাসাকে বেচে দিলুম। 





[এই নামেই সংগ্রহ বিজ্ঞাপিত হয়েছিল সপ্তদ্বীপার (জীবনময় দত্ত সম্পাদিত ও প্রকাশিত) পাতায়। এই সংগ্রহ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সপ্তদ্বীপা এবং অভিযানের (অভিযান সাহিত্য গোষ্ঠি প্রকাশিত এবং পার্থসারথি মিত্রের সহযোগিতায় বিদ্যুৎ পাল সম্পাদিত) দুটো সংখ্যায় একই সাথে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল দু'গুচ্ছ কবিতা - একটি পত্রিকার ১ থেকে ১৬ পৃষ্ঠা এবং আরেকটির ১৭ থেকে ৩২ পৃষ্ঠা অব্দি। ওই পৃষ্ঠাগুলোর (দুই ফর্মা; ডিমাই সাইজ; এ্যান্টিক কাগজ) ৫০০-৫০০ করে অফপ্রিন্টও বেরিয়েছিল। একই প্রেসে ছাপা হয়েছিল - বিষ্ণুদার রেনেশাঁ প্রিন্টার্সে, যাতে কোনোরকম মিসম্যাচ না হয়। 
কিন্তু সবচেয়ে বড় মিসম্যাচ তো ঘটিয়ে দেয় জীবনটাই। রবীনদা না করে দিলেন। তারপর কত বছর একসাথে কাটিয়েও হ্যাঁ আর করাতে পারলাম না।]   



No comments:

Post a Comment