Tuesday, August 3, 2021

গ্রীষ্ম – বর্ষা

 

প্রথম দৃশ্য

 

(একটি রিক্সায় দুজন প্রৌঢ় একজন চালক, অন্যজন পিছনে বসে মাইক হাতে ঘোষক নাট্যস্থলে প্রবেশ। অথবা রকমফেরে এক প্রৌঢ়ের রিক্সা চালাবার মুদ্রায় এবং তাঁর পিছনে অন্য জনের ডান মুঠি মাইকের ভঙ্গীতে ঠোঁটের সামনে রেখে নাট্যস্থলে প্রবেশ।

ঘোষক -        একটি জরুরি ঘোষণা। গতকাল অর্থাৎ বারো তারিখ সকাল আটটায়, নেয়ামতপুর পাড়ার পঞ্চদেব মন্দিরের পাশের ভগীরথ লেন থেকে দশ বছরের একটি বাচ্চা ছেলে হারিয়ে গেছে। ছেলেটির রঙ কালো, চুল ছোটো ছোটো। পরনে নীল রঙের হাফ প্যান্ট আর গোলাপী শার্ট। ছেলেটি হিন্দী বলতে পারে, লিখতে পারে, নিজের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারে। ছেলেটির মায়ের নাম শিউরতি দেবী। যদি কোনো সহৃদয় ব্যক্তি ছেলেটির সন্ধান পান এবং অনুগ্রহ করে তার বাড়িতে খবর দেন তাহলে তাঁকে নগদ পাঁচশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সাথে দুয়া পাবেন এক গরীব মায়ের। বাড়িতে খবর দেওয়ার নম্বর ২৬৬০৩৪ (বাঁহাতের কাগজটা খুলে দেখতে দেখতে স্বগত) ... যাঃ, এক লাইন তো ভুলেই গেলাম ... (মাইকে) ছেলেটি, জিজ্ঞেস করলে নিজের নাম বলে অরুণ কুমার। এমনিতে ওর ডাক নাম পাপ্পু। ... একটি জরুরি ঘোষণা (রিক্সাওয়ালাকে) এ্যাই... এ্যাই... এদিকে নয়! এদিকে তো দুবার হয়ে গেল। ডান দিকে চল (মাইকে) একটি জরুরি ঘোষণা ...

রিক্সাওয়ালা -  ছেলেটির বাপের নাম কী?

ঘোষক -        ডান দিকে চল্‌ না ভাই। রাজেন্দ্রনগর ছয় নম্বর দিয়ে বেরিয়ে যাব। ফের গোলচত্বর হয়ে ঢুকে যাব লোহানিপুরে। গোলচত্বর কী নাম যেন? শাস্ত্রী চৌক! রামাওতার শাস্ত্রী চৌক।

রিক্সাওয়ালা -  ছেলেটির বাপের নাম লেখায়নি কাগজে?

ঘোষক -        (মাইকে) কাল সকাল আটটায় (হঠাৎ খেয়াল হল যে রিক্সাওয়ালা কিছু জিজ্ঞেস করছে রিক্সাওয়ালাকে) তুমি কিছু জিজ্ঞেস করছিলে?

রিক্সাওয়ালা -  জিজ্ঞেস করছিলাম, কাগজটায় ছেলের বাপের নাম লেখা নেই?

ঘোষক -        বাপের নাম! (বিরক্ত হয়ে) কিসের বাপের নাম! শালা, গরমে প্রাণ আঁকুপাঁকু করছে। তার ওপর এই (বাঁদিকে দেখে, নাকের ওপর হাত রাখে) আবর্জনার দুর্গন্ধ! কে জানে, কোথায় থাকি আমরা, শহরে না মুর্গির আধারির ভেতর। সেটা চিরলেও তো শুধু আনাজ বেরোয়। বোধহয় শুওরের আঁতের মধ্যে থাকি। ... কী বললে? বাপের নাম? (লুঙ্গি উঠিয়ে ঘাড়ের মুখের ঘাম মুছতে মুছতে) যে ছিল সে নেই আর যে আছে সে কোথাও নেই!

রিক্সাওয়ালা -  বুঝলাম না।

ঘোষক -        দরকারও নেই। তুমি চল না ভাই!

রিক্সাওয়ালা -  আমার বেরাদরিতেও এমনই হয়ে ছিল। এখন লিলুয়ায় কাজ করে, বাঙ্গালে, নাম লখন। ওর ছেলেটা হারিয়ে গিয়েছিল। তার এলাউন্সমেন্ট করান হল তো বাপের নাম বলা হয়েছিল। ... আর, পাওয়া গেল কোথায়! ওই (পিছনে ঘুরে বলার চেষ্টা করে) দিদারগঞ্জ ছাড়িয়ে। যিনি পেলেন, তিনি বাপের নাম জিজ্ঞেস করলেন, ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন ...

ঘোষক -        (সামনে এগিয়ে আসতে থাকা গাড়ি দেখে শঙ্কিত হয়ে) আরে সামনে দেখ। সামনে দেখ। এ্যাক্সিডেন্ট করবে যে!

রিক্সাওয়ালা - (দক্ষতার সাথে রিক্সার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে) না আ আঃ! এ্যাক্সিডেন্ট কেন হবে? নজর আছে আমার। ... লোকটি ভালো ছিলেন। সিটি কোর্টের উকিল। সকালে হাঁটতে বেরুলেন তো দেখলেন চায়ের দোকানে ওখানেই ভদ্রলোক রোজ এক কাপ চা খান আর খবরের কাগজ পড়েন একটা ছেলে এসে দাঁড়াল। কাজ চাইতে লাগল দোকানির কাছে। ... ওই! চা দেব, বাসন মাজব; ভদ্রলোক এগিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন। বলে দিল। বাপের নাম বলে দিল। ঠিকানা ব্যস, শুরু হয়ে গেল উল্টোপাল্টা কথা। ভূল বলার চেষ্টা করল তো গলির নামে। পাড়ার নামে বেমেল হয়ে গেল। উকিল সাহেব তো জেরা করতে ওস্তাদ। ধরে ফেললেন। বললেন, নিশ্চয়ই তুই পালিয়ে এসেছিস। ব্যাস। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল ছেলেটি। তখন উকিল সাহেব তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন, জোর করে খাবার খাওয়ালেন, তারপর সঠিক ঠিকানা ওর পেট থেকে বার করে, পৌঁছে দিয়ে এলেন। আর, একটা পয়সা নেওয়া তো দূরের কথা লখনওয়া দিতই বা কোত্থেকে আসা, যাওয়া, খাওয়ানোর খরচ তো ছিলই, তার ওপর একশটা টাকা হাতে গুঁজে বলে গেলেন ছেলেটাকে স্কুলে ভর্ত্তি করতে। ছেলেটা সত্যিই স্কুলে পড়ে এখন সেভেন ক্লাস লিলুয়াতেই। ... তাই বলছিলাম বাপের নাম লেখা থাকলে সুবিধে হত।

ঘোষক -        বুঝলাম। জ্ঞান-প্রাপ্তি হল। এবার আমাকে এলাউন্স করতে দেবেন? লোহানিপুরে ঢুকে পড়েছি। (মাইকে) একটি জরুরি ঘোষণা! গত কাল, অর্থাৎ বারোই মে ...

                   (এই পুরো কথোপকথনটা নাট্যস্থলে ঘুরতে ঘুরতে, রিক্সা দাঁড় করিয়ে পিছনে ঝুঁকে খোলা চেন চড়াবার অভিনয় করতে করতে, জিরিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সারা যেতে পারে। তারপর, দুজনে বেরিয়ে গেলে, রাতভর দিশ্চিন্তার ক্লান্তিতে অবসন্ন শিউরতি, বয়স পঁয়তাল্লিশ, নাট্যস্থলে প্রবেশ করে। এক এক করে নিজের জিনিষ টেনে আনে। সবচেয়ে আগে স্টোভে আগুন ধরিয়ে এক সসপ্যান জল বসায়, তারপর দোকান সাজায়। প্যাকিং বাক্স, তিন বোয়াম বিস্কুট, চায়ের কেটলি, সিগারেটের প্যাকেট, গেলাস, জলের বাল্টি, দুধ গরম করার ডেকচি, এক প্যাকেট দুধ, দেশলাই, কেরোসিন তেলের গ্যালন (পাঁচ লিটারের কন্টেনার)। রাতভর কাঁদতে থাকায় চোখ ফুলে আছে। জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে একটা পায়া ভাঙা বেঞ্চিও টেনে আনে। ভাঙা পায়ার নিচে চারটে ইঁট লাগায়। তখনি জনসেবক হাফিজ নিয়ামতপুরি এসে পৌঁছোন।)

জনসেবক -    কী গো গীতার মা! কোনো খবর পেলে?

শিউরতি -      (নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে) কেউ কিছু দেখতেই পায় নি। শুধু গণেশ বলল যে যখন খবরের কাগজ বিলি করে ফিরছিল তখন নাকি উমা সিনেমার কাছে একটি বড় ছেলের সাথে ওকে দেখেছে।

জনসেবক -    কটার সময়?

শিউরতি -      টা, সাড়ে নটা হবে আর কি।

জনসেবক -    বড় ছেলেটা কে?

শিউরতি -      কী করে জানব? দেখেছে তো গণেশ। ওও নিশ্চয়ই জানে না। জানলে তো খবর পেয়েই যেতাম এতক্ষণে!

জনসেবক -    যুগটা খারাপ। যদি কোনো খারাপ সঙ্গতে পড়ে যায় ...

শিউরতি -      কেউ তো নেই আমার, কাকে দিয়ে খোঁজ করাব? নইলে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও দিল্লী গেছে।

জনসেবক -    দিল্লী? কেন? বেড়াতে?

শিউরতি -      (ফুটতে থাকা চায়ের সসপ্যানটা তাড়াতাড়ি স্টোভ থেকে উঠিয়ে কেটলিতে ছাঁকতে ছাঁকতে) কাজকর্ম শিখতে। বলত সবসময়।

জনসেবক -    আরে, ও তো বাচ্চা এখন!

শিউরতি -      বাচ্চা বলেই তো স্বপ্ন দেখে। বাচ্চা বলেই তো ভরসা পায় যে যুগটা খারাপ নয়। বাচ্চা বলেই তো (চোখ মুছে) ভাবে যে কাজকর্ম শিখে রোজগার করবে, মাকে সাহায্য করবে।

জনসেবক -    তুমি বলছ এ কথা!

শিউরতি -      আমি না বললে কে বলবে ওর মনের কথা? আর আছেটা কে? কত ইচ্ছে ছিল, লেখা পড়া শিখবে। বিদ্বান না হোক নিরক্ষর থাকবে না।

জনসেবক -    নিরক্ষর কোথায়? নিজের নামটা তো বেশ লিখতে পারে হিন্দীতে, সেদিন দেখছিলাম।

শিউরতি -      ব্যস, ওইটুকুই। (আনমনা) আমি ভাগ্য টাগ্য মানিনা, কিন্তু আমার মন বলত এরকম কিছু একটা হবে। যেমন আমি এসেছিলাম এখানে নিজেত বাড়িঘর ছেড়ে, বাপ-মায়ের কাছ থেকে এত দূরে ...

জনসেবক -    তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলে!

শিউরতি -      কিসের শ্বশুরবাড়ি! আপনি এত দিন ধরে আসছেন আর জানেন না? সত্যি আপনি অন্য দুনিয়ার লোক। এত মুখে মুখে রসালো গল্প! ...

(জনসেবকের সরল, শীর্ণ, বয়স্ক মুখের দিকে তাকিয়ে) সাত বছর বয়সে আমার বাপ আমায় বেচে দিয়েছিল পঞ্চাশ টাকায়। বাড়ি বঙ্গালে, জেলা দিনাজপুর। ...

জনসেবক -    তারপর?

শিউরতি -      তারপর আর কী? মানুষটা ভালো ছিল। কোনো খারাপ জায়গায় নিয়ে পৌঁছে দিল না। বাড়ির কাজ করতে করতে বড় হলাম। মানুষটা সত্যি ভালো ছিল। ঘর-পরিবার ছিল তার। ছেলে পুলে ছিল। আমার বয়স বাড়তে তার মনে হল ঘরে গোলমাল হতে পারে তাই এলাকারই একটা লোক খুঁজে, দেখেশুনে আমার বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ে হল। বাচ্চাকাচ্চা হল। তারপর ওই লোকটাই উখড়ে গেল। পয়সার লোভে একটা অলক্ষ্মীর সাথে পালিয়ে গেল। তবু ঘরটা বেঁধে রাখলাম এই দোকান চালিয়ে। বড় মেয়েটির সৌভাগ্য। ওর বাপের বিষয়ে সব কিছু জানার পরেও ওর শ্বশুরবাড়ি ওকে কিছু বলল না। বড় ছেলে ডুবে মরল গঙ্গায় চান করতে গিয়ে (চোখ মুছে)... এই ছোটো ছেলেটাই তো বল ছিল আমার!

                   (তখনি শিউরতির মেয়ে গীতা এবং তার স্বামী প্রবেশ করল। গীতা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। তার স্বামী, শ্বাশুড়ির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে পাশে দাঁড়িয়ে রইল।)

গীতা -           কী হয়েছে মা? কোথায় গেছে পাপ্পু?

শিউরতি -      (জামাইকে) বস বাবা! কতদিন পরে এলে তুমি। যখন নাকি মাত্র দুটো পাড়া পেরিয়ে থাক। বেয়ান বেয়াই ভালো আছেন? (জনসেবককে) আমার জামাইকে বোধহয় আপনি কখনো দেখেননি!

জনসেবক -    সেই বিয়ের দিন দেখেছিলাম। তুমি তো আবার চাকরি কর কোথাও! কোনো কম্পানিতে!

জামাই -        আজ্ঞে হ্যাঁ! ক্যুরিয়ার কম্পানি। (শ্বাশুড়িকে) কোনো খোঁজ পেলেন মা? (এরই মধ্যে তিন চারজন গ্রাহক প্রবেশ করে।)

প্রথমজন -      চারটে চা। আলাদা করে তৈরি করুন।

শিউরতি -      দুধ আনতে হবে বাবু। তবে চাটা একটু আগেই তৈরি। দেব?

দ্বিতীয়জন -    এগোবি? আরেকটা ভালো দোকান আছে চায়ের।

তৃতীয়জন -    বাদ দে ইয়ার! বসে পড়! যা আছে চলবে। (তিনজন বসার পর আর জায়গা থাকে না। শিউরতি নিজের প্লাস্টিকের খাটুলিটা এগিয়ে দেয়। জনসেবক বেঞ্চি থেকে উঠে ওই খাটুলিতে বসতে যান। একজন গ্রাহক তাঁকে কাঁধে হাত দিয়ে বেঞ্চে আবার বসিয়ে নিজে খাটুলিতে বসে পড়ে) দিন, চা দিন চারটে। আর জল খাওয়ান।

শিউরতি -      (গীতা গ্রাহকদের জল দেওয়ার কাজে মাকে সাহায্য করতে যায়; মা তাকে থামিয়ে দেয়) তুই যা। জামাইকে নিয়ে বাসায় যা। হা-মুখ ধুয়ে একটু আরাম করতে দে ওকে। আমি একটু পরে এসে রান্নার ব্যবস্থা করছি।

গীতা -          একটু পরে! কার ভরসায় ছেড়ে যাবে দোকান? আমি রন্না করে রাখব। তুমি দোকান বন্ধ করেই নাহয় এস।

শিউরতি -      (সবাইকে জল দিয়ে ফিরে এসে চায়ের কেটলিটা একটু গরিম বসাতে বসাতে) বলছি তো আমি আসব। এক্ষুণি আসবে তোদের মঙ্গলচাচা।

গীতা -          মঙ্গলচাচা?

শিউরতি -      হ্যাঁ। ওই তো বেচারা কাল থেকে ঘুরে ঘুরে এ পাড়ায় ও পাড়ায় এলাউন্স করে বেড়াচ্ছে।

গীতা -          আর প্রেসের কাজ? এটাও ছেড়েছে?

                   (গীতা, শিউরতি আর জামাই নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে যেটা মাইমে চলতে থাকে। একটু পরে গীতা ও তার স্বামী বাসার দিকে চলে যায়। এরই মধ্যে গ্রাহকদের কথাবার্তা চলতে থাকে।)

চতুর্থগ্রাহক -   (যে খাটুলিতে বসে আছে; পেপার খুলে পড়তে পড়তে) পঞ্চায়েত ভোটের পর এবার এই নগর নিগম আর নগরপালিকার ভোট। এতেও রক্ত বইবে বিস্তর। পরশুই তো শেষ দিন নমিনেশন ফাইল করার।

প্রথমগ্রাহক -   হ্যাঁ, রক্ত বইবে আর হিজড়েরা জিতে আসবে।

শিউরতি -      (চা দেয় সবাইকে, তারপর জনসেবককে জিজ্ঞেস করে) আপনিও খাবেন চা?

জনসেবক -    দাও! (চা হাতে নেয়) আচ্ছা, আপনাদের কী মনে হয়? গণতন্ত্রকে একটা বিশ্রী ঠাট্টা বানিয়ে দেওয়া কি দেশের জন্য অকল্যাণকর নয়? ক্ষতিকারক নয়?

প্রথম -          ক্ষতিকারক? আরে এই তামাশাটাই তো জিইয়ে রাখে। নইলে তো বোরিং হয়ে যেত লাইফ। এবার রাণি হিজড়ার প্রচারে কী হচ্ছে তা জানার জন্য কৌতুহল থাকবে সারাদিন।

তৃতীয় -         তুই হিজড়ে হিজড়ে কেন করছিস বল তো? যেন সবেতে অধিকার শুধু । ওদের কোনো দোষ নেই, তবু যেহেতু বায়োলজিক্যালি ওরা একটু ভিন্ন, তাই ওরা একটা গালি? ওরা সমাজের মার্জিনেই বেঁচে থাকবে?

                   (তৃতীয়জনের হঠাৎ উত্তেজনায় সবাই চুপ করে যায়।)

দ্বিতীয় -         আঃ, বড্ড বেশি সিরিয়াস হয়ে যাস তুই।

তৃতীয় -         সরি। কিন্তু যবে থেকে এই হিজড়ে ক্যান্ডিডেট নিয়ে খবরের কাগজে লেখালিখি পড়ছি, সহ্য করতে পারছি না।

জনসেবক -    আমি অন্য কথা বলছিলাম। এই যে পুরো ব্যাপারটা চলছে, গুন্ডা, খুনী, অপরাধীরা পয়সার খেলায় জিতে আসছে, কখনো এই পার্টি কখনো ওই পার্টিতে যাওয়া আসা চলছে পয়সার লোভে, কারুর মাথায় দেশের মানুষের কোনো চিন্তাই নেই, এটা কি ক্ষতিকর নয়? মানুষের আস্থাটাই আর থাকছে না গণতন্ত্রে কী ভীষণ ব্যাপার বলুন তো!

                   (কথাবার্তা চলছিল, এরই মধ্যে নেপথ্যে কোলাহল ওঠে। জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ! হাফিজ নিয়ামতপুরী জিন্দাবাদ! জনসেবকজী জিন্দাবাদ! হমারা নেতা ক্যায়সা হো! জনসেবকজী জ্যায়সা হো! স্লোগান দিতে দিতে কয়েকজন হাতে মালা নিয়ে প্রবেশ করে এক এক করে সবাই নিজের হাতের মালা হতবাক জনসেবকের গলায় পরিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে হাফফাতা কুর্তা, পাজামা পরা একজন হাত উঠিয়ে বাকি সবাইকে চুপ করায়।)

হাফ-কুর্তা -    বন্ধুগণ! এ পাড়ার বা আশেপাশের পাড়ার মানুষজনকে এটা বলার প্রয়োজন নেই যে হাফিজ নিয়ামতপুরী বা জনসেবকজী কে এবং কেমন মানুষ। বছরের পর বছর, নিঃস্বার্থভাবে উনি জনতার সেবা করে চলেছেন। এত সাধারণ তাঁর জীবন যাপন! কেউ হয়ত মনেও রাখেনি যে নিজের যৌবনে হাফিজ সাহেব এক প্রখর সমাজবাদী ভাবুক হিসেবে সারা ভারতে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অথচ নিজের সমসাময়িক বুদ্ধুজীবীদের থেকে একদম আলাদা জাতের মানুষ হাফিজ সাহেব বুদ্ধিজীবিতার চাকচিক্য থেকে দূরে নিজের দুনিয়া গড়লেন। ভালোবাসার দুনিয়া। সুফী সন্তের মত, গুমনাম, নিজের মাটি, নিজের মানুষদের সেবা করার, তাদের নালিশ, অভিযোগ নিয়ে সরকারি তন্ত্রের দরজায় জোরদার কড়া নাড়ার, তাদের প্রতিবাদে প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেওয়ার পথ বেছে নিলেন। (মুঠি মাটির দিকে সজোরে নামিয়ে) প্রতিবাদ করতে, প্রতিরোধ করতে সংগঠিত হতে শেখালেন আমাদের। হিন্দু-মুসলমানে সদ্ভাব বাঁচিয়ে রাখতে পথে বসে পড়েছেন কতবার! আজ সময় এসেছে যে আমরা তাঁর মানুষের প্রতি এই একনিষ্ঠ দায়বদ্ধতার একটু সম্মান করি। এমনিতেও ইনি আমাদের নেতা। কিন্তু এবার আরো বড় স্তরে জনতার সেবা করার সুযোগ পাবেন হাফিজ সাহেব। (জনসেবকের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে) হাফিজ সাহেব! জনসেবকজী! আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ওয়ার্ড নম্বর ৪২ থেকে আপনিই আমাদের প্রার্থী হবেন। (আবার স্লোগান ওঠে; তাদের শান্ত করে) পার্টি অফিসে একবার আপনাকে যেতে হবে হাফিজ সাহেব। আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। (এই ভাষণ ও স্লোগানবাজির মধ্যে মঙ্গলও ক্লান্ত হয়ে প্রবেশ করে। এক ধারে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে।)

জনসেবক -    আমি কিছুই বুঝতে পারছি না এসব কী?

হাফ-কুর্তা -    বেশি কিছু বোঝার নেই হাফিজ সাহেব। ব্যস, আপনি চলুন। নেতাজি বলেছেন আপনাকে নিয়ে আসতে। আপনাকে ওনার কাছে পৌঁছে আমাদের ফেরৎ আসতে হবে এক্ষুনি। বিকেলে এখানেই জনসভা হবে। নেতাজি আপনার নাম ঘোষণা করবেন।

জনসেবক -    নেতাজি মানে? কে? তোমরা জানো আমি পার্টিও করি না, রাজনীতিও করি না। যা সব বললে আমার বিষয়ে ওসবও আমি কিছুই বুঝি না। আমি শুধু মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি, করেছি এতদিন।  

হাফ-কুর্তা -    (জনসেবকজির কানে কানে) মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছেন শোভা রজকজীকে, যেন আপনাকে দিয়ে নমিনেশন করানো হয়। (জোরে জোরে, জনসমক্ষে) জানি, সব জানি আমরা হাফিজ সাহেব, তাই তো আপনাকে নিয়ে এত গর্ব আমাদের। কিন্তু একথাও আপনি মানবেন যে একসময় যে পার্টি আপনি করতেন সেটা থেকে আপনি দূরে সরে যাননি। শুধু জীবনটা অন্যরকমভাবে বাঁচার সংকল্প করে সেই পথে চলছেন। আপনার এই সংকল্প পার্টিরই গৌরব। সেই পার্টিই আপনাকে ডাকছে। (ভঙ্গীটা হাত জোড় কিন্তু প্রায় জোর খাটিয়েই, হাফিজ সাহেবকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে, সবাই মিলে তাঁকে প্রায় কোলে উঠিয়ে জিন্দাবাদ করতে করতে বাইরে চলে আয়। চারজন গ্রাহকও পয়সা মিটিয়ে পিছু পিছু যায় তামাশা দেখতে।)

মঙ্গল -          বাপ রে! এটা সত্যি না স্বপ্ন! জনসেবকজী তো লটারি পেয়ে গেলেন! এবার আমিও জনসেবা করব।

শিউরতি -      তুই আজকেও গেলি না কাজে?

মঙ্গল -          এলাউন্স করছিলাম না? তোর ছেলের খোঁজে! (গামছাটা আছড়ে)  কোথাও পেলাম না। কাল যাব সুলতানগঞ্জের দিকে।

শিউরতি -      আর এলাউন্স করতে হবে না। কাল থেকে কাজে যাবি। এবার দোকাম দেখ্‌। আমি বাসায় যাচ্ছি। জামাই এসেছে। জামাই এসেছে। গীতাও এসেছে। কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করি ওদের জন্য।

মঙ্গল -          জনসেবকজী তো ওস্তাদ লোক রে! কিছু বললও না! চুপচপ চলে গেল ওদের সঙ্গে

শিউরতি -       কেন বদনাম করছিস মানুষটাকে? এতদিন গলি, মোহল্লা, টোলায় প্রতিদিন আমাদের সবাইকার কুশল কামনা করেছে মানুষটা। নেতা যদি হয় তো কল্যাণই হবে সবাইকার। (শিউরতি বাসার দিকে যায়। মঙ্গল সামনে থেকে খাটুলিটা উঠিয়ে এনে রাখে শিউরতির বসার জায়গায়। নিজে বসে তার ওপর। তারপর ঢাকনা সরিয়ে সরিয়ে দেখে দুধের ডেকচি, চায়ের কেটলি, সসপ্যান। একটা গান গুনগুন করে মনে। গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নদৃশ্য শুরু হয়। আগের গ্রাহকেরাই ফাইল হাতে প্রবেশ করে। হাফিজসাহেবকে নিতে আসা লোকগুলোও ফাইল হাতে প্রবেশ করে। দুই লাইনে দাঁড়ায় দোকান অর্থাৎ মন্ত্রীজীর টেবিলের সামনে। মন্ত্রীজী অর্থাৎ মঙ্গলের ঘুম ভাঙে না। উপস্থিত অফিসারেরা গলা খাঁকারি দেয়। হঠাৎ সে জাগে। গামছাটা পাট করে কাঁধের ওপর রাখে।)

অফিসার -      স্যার! আপনি আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

মঙ্গল -          (উঠে হাঁটতে শুরু করে অফিসারদের দুই সারির মাঝে)  হ্যাঁ, আমি ডেকেছিলাম। কিন্তু আমি কেন ডেকেছিলাম? (একটু ভেবে, প্যাকিং বাক্সের ভিতরে রাখা পয়সার ডিবেটা হাতে নিয়ে খোলে। চশমা বার করে পরে। একটা পান নিয়ে মুখে দেয়।) হ্যাঁ, বিরহা গানের সুরটা আমায় একটু মনে করান তো, আপনাদের মধ্যে কেউ একজন!

অফি-বৃন্দ -    (চমকে উঠে) আজ্ঞে?

মঙ্গল -          হ্যাঁ, গান, গান, লজ্জা পাবেন না।

অফিসার ২ -   (একটু চেষ্টা করে এক লাইন বিরহা গায়) এর পরে মনে নেই স্যার!

মঙ্গল -          মনে করে নেবেন। আপনারা সবাই। ভালো করে প্র্যাক্টিস করে নেবেন। আর ওই বিরহার সুরে গঙ্গার তীরে ফুলের চাষ শুরু করুন। আমি বাজেটে বন্দোবস্ত করে দেব। হ্যাঁ, ওই ফুলের ক্ষেতে বাচ্চাদের জন্য দোলনা আর ঘাসের মাঠও যেন থাকে।

অফি-বৃন্দ -    আজ্ঞে!

মঙ্গল -          ঠিক আছে। এবার আমার দিল্লি যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

অফি-বৃন্দ -    দিল্লি যাবেন? কেন স্যর? প্রধানমন্ত্রী ডেকে পাঠিয়েছেন আপনাকে?

মঙ্গল -          আজ্ঞে না। আমাকে ছাব্বিশ জানুয়ারির প্যারেড দেখতে যেতে হবে। ওই ভীড়ে পাপ্পুকে আমি আলবাৎ পেয়ে যাব। আর পাপ্পুকে পেয়ে গেলে পাপ্পুর মা নিশ্চয়ই (লাজুক ভাব করে) আমারও পরিবার হবে শেষ মেশ বৌ ছেলে, মেয়ে, জামাই !

                  (হঠাৎ শিউরতি পৌঁছোয়। মঙ্গল হড়বড় করে নিজের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।)

                   বসুন ম্যাডাম! (শিউওরতি বসে পড়ে) আপনি সব অফিসারদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সবাই হাজির।

শিউরতি -      (অফিসারদের দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ বাচ্চারা! সবাই নিজেদের বই বার করো ব্যাগ থেকে। (অফিসারেরা ফাইলের ভিতর থেকে বই বার করে।) আশা করি তোমরা সবাই নিজেদের পাঠ ভালো করে পড়ে এসেছ। এবার আমার সাথে পড়োঃ একে অন্যের দুঃখে অংশ নেওয়াকে, দুঃখের ভাগ নেওয়াকে সাধারণ মানুষ মনুষ্যত্বের ধর্ম মনে করে। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। আনন্দ তো এমনিতেই সব সময় আধ-ভরা। ভাগ করো তো আরো আধ-ভরা হবে। ভাগ না করো তাহলেও আধ-ভরাই থাকবে। একমাত্র দুঃখই ভরা পাওয়া যায়। ওটাকে ভাগ করে আদ্ধেক কেন করব? আনন্দ থেকে অনেক বেশি কোমল নাজুক হয় দুঃখ। একটু ফস্কা হাত লাগালেই ছলছলিয়ে পড়ে তার পূর্ণতা। তাই সামলে রাখা উচিৎ কোনো মজবুত কোটরে, যাতে ভরা থেকে টইটুম্বুর, ছলকে না পড়ে। (ধীরে উঠে দাঁড়ায় শিউরতি মঙ্গল বসে পড়ে) এখন এই মঙ্গলের কথাই ধরো। এর পেটে একটি শিশু পালিত হচ্ছে। (সবাই চমকে উঠে মঙ্গলের দিকে তাকায়। মঙ্গল সুখের লজ্জায় ডাইনে বাঁয়ে মুখ ঘোরায়।) ঘাবড়াবার কিছু নেই। এটা ওর পেট থেকে এখন বেরুবে না। কখনোই বেরুবে না। মঙ্গল মরে গেলে বাচ্চাটা অন্য কারুর পেটে জায়গা খুঁজে নেবে। বাচ্চাটা তখনই বেরুবে যখন যখন

মঙ্গল -          (লাফিয়ে উঠে হেসে) যখন লোকেদের বিশ্বাস হবে যে মরদরাও পেটে বাচ্চা ধরতে পারে!

শিউরতি -      চুপ! সব সময় ঠাট্টা। (বলে এক গেলাস জল ছোঁড়ে মঙ্গলের মুখের ওপর।) যাও বাচ্চারা! তোমাদের ছুটি। ছাত্ররা ছুটি ছুটিচিৎকার করে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে যায়। মঙ্গলের ঘুম ভাঙে। শিউরতি সত্যি সত্যি গেলাস হাতে রাগে কাঁই হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে।) যখন দেখ, স্বপ্ন দেখছে। তোকে আমি দোকান সামলাতে বলে গিয়েছিলাম না?

মঙ্গল -          এত ঘুরেছি রোদ্দুরে! ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালও করিনি। গ্রাহকও তো আসেনি একজন!

শিউরতি -      এসে ফিরে গিয়ে থাকবে।

                   (তখনই তিন চারজন গ্রাহক আসে। জল, চা, বিস্কুট চায়। শিউরতি দুধ নিয়ে এসেছিল, চা বানায়। মঙ্গল বিস্কুট দেয়, জল দেয়। দোকান চলতে থাকে।)


দ্বিতীয় দৃশ্য

 

(বর্ষাকাল। দোকানের সামনে জল জমে থাকে। জল ঠেলে ঠেলে দোকানে উঠে এল শিউরতির স্বামী বৈজু। সবসময় রঙ করতে করতে চুল, গোঁফ জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে আছে। শরীর কখনো পেশীবহুল ছিল, মদ খেতে খেতে ঢিলে হয়ে গেছে। হাবে ভাবে একটা অহঙ্কারের মোচড়। আগে থেকেই দুতিনজন গ্রাহক রয়েছে দোকানে। বৈজু প্রথমে দোকানের পিছনে গিয়ে শিউরতির পাশে বসার জায়গা খোঁজে। আশা করে যে শিউরতি নিজের বসার খাটুলিটা তার জন্য এগিয়ে দেবে। কিন্তু শিউরতি ভ্রুক্ষেপ করে না। অবশেষে বৈজু সামনে এসে গ্রাহকদের সাথে, বেঞ্চের এক কিনারে বসে পড়ে। এবার অপেক্ষা করে যে শিউরতি কিছু বলবে। কিন্তু কিছু বলেও না শিউরতি। গ্রাহকদের চা দেয়। গ্রাহকেরা চা খেয়ে পয়সা দিয়ে চলে যায়। এবার দুজনে একা।)

 

বৈজু -           পাপ্পু কেমন আছে?

শিউরতি -      এসেছিস কেন, এখানে?

বৈজু -           এমনি, কুশল সংবাদ নিতে! দেখা করতে। একটা দায়িত্বও তো আছে আমার!

শিউরতি -      দায়িত্ব?

বৈজু -           কেন? এখন, ধরে নে আমি যদি অসুস্থ হয়ে কোথাও পড়ে থাকি তুই খবর পেলে দেখতে আসবি না?

শিউরতি -      তুই এসেছিস কেন, সেটা বল্‌।

বৈজু -           (মস্করার ঢঙে) তুই তো বিয়ে করা বউ আমার ডার্লিং! তোর কাছে (কথাটা মাঝ পথে ছেড়ে পিছিয়ে যায় দুপা কেননা শিউরতি ফুটতে থাকা সসপ্যান উঠিয়ে নেয় গায়ে ঢালতে) আচ্ছা আচ্ছা (কানে হাত দিয়ে) আর ঠাট্টা নয়। কাজের কথায় আসছি। (শিউরতি আবার ব্যস্ত হয় নিজের কাজে) হাফিজ মিয়াঁ তো বড় মানুষ হয়ে গেছেন আজকাল। তবে তোকে এখনো মনে রেখেছেন। এদিক দিয়ে যখনি যান, তোর দোকানে চা খেয়েই যান। সব খবর রাখি আমি। (শিউরতি বৈজুর আন্দাজ পাওয়ার জন্য স্থির দৃষ্টিতে তাকায়) মানে বহুৎ ইজ্জত করেন তোর

শিউরতি -      কাজের কথা বল্‌।

বৈজু -           আরে এটাই তো কাজের কথা। একটু বলে দে আমার জন্য। কোনো কাম ধান্ধার যোগাড় । সত্যি বলছি একবার যদি কিসমত খুলে যায় তো তোর সাথেই আবার ঘর (শিউরতির চোখ দেখে চুপ করে যায়)।

শিউরতি -      হয়ে গেছে! কাজের কথা শেষ?

বৈজু -           তুই যদি আমার হয়ে তদ্বির করে দিস!

শিউরতি -      ব্যস! এবার যা এখান থেকে। (সামনে ডান দিকে জলের ড্রামের পাশে বসে এঁটো বাসন মাজতে মাজতে) ঠাট্টা! মস্করা! শালা, ভাঁড়ুয়াগিরি করে জীবন কাটিয়ে দিল, এখন মস্করা শেখাচ্ছে আমাকে।

বৈজু -           এ্যাই, বহুত বেশি বকবক করছিস তুই।

শিউরতি -      তো! কী করবি? মারবি? দেখা তো মেরে! শালা রাঁড়ের পিছনে পালিয়ে গেল, ঘর ভেঙে দিয়ে । ওটার সাথেও ঘর বাঁধতে পারল না। বাঁধলে মানতাম কিছু করল। মেয়েটার সাথে রাস্তায় দেখা হলে অন্ততঃ ক্ষমা চাওয়ার নাটক করেনা। এড়িয়ে যেতে চায়। আমিই ধরে নিই। জবরদস্তি দচার পয়সা ঠুঁসে দিই হাতে। জানি খিদের চোটে গ্রাহক ধরতে ছুটছে মাগি মরে যাবে তবু ভিক্ষে চাইবে না, সাহায্য চাইবে না। ধান্ধাতেই রুটি জোটাবে। আর এই এক পাষন্ড। ওর রুটি থেকেও আদ্ধেক খেয়ে নেয়, পেয়ার মোহব্বতের নাটক করে।

                   (মঙ্গল ঢোকে। কাঁধে বাঁশের ফ্রেমে ঝুলছে বাচ্চাদের খেলনা, ঘড়ি, বেলুন, বাঁশি হরেক রকম রঙচঙে জিনিষ।)

বৈজু -           (একটু শ্লেষের সাথে, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য) ওই যে দ্যাখ। তোর আশিক এসে গেছে। এ ফেরিওয়ালা হল কবে থেকে? কাজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে মালিক? আরে এর জন্যই নাহয় কিছু বল তোর নেতাজিকে। কোনো ভালো কাজে লাগিয়ে দেবেন। কেমন ফটিচরের মত ঘোরে! তোরই তো ইন্সাল্টিং হয়।

                   (শিউরতি বৈজুর সামনে এসে দাঁড়ায়।)

শিউরতি -      তুই যাবি কি যাবি না!

বৈজু -           যাচ্ছি। যাচ্ছি। ব্যাস, তুই কথা দে নেতাজিকে বলবি আমার কথা। তুইও তো চাস আমি শুধরে যাই। কাজের লোক হয়ে যাই। (শিউরতি কিছু বলতে যায় তখনি পাশের এসটিডি বুথ থেকে একটা ছেলে চিৎকার করে, এ পাপ্পুর মা! শিগগির এস! পাপ্পুর ফোন দিল্লি থেকে। শিউরতি চমকে উঠে দৌড় দেয় বুথের দিকে। বুথের ভিতর ঢুকে পড়ে।)

মঙ্গল -          (শিউরতি পিছনে যাবে মনে করে কিন্তু বৈজু আছে দেখে থেমে যায়।) যাক ভরসা তো পাওয়া গেল যে বেঁচে আছে। চার মাস পর মায়ের কথা মনে পড়ল। দিল্লি পৌঁছেই গেল ব্যাটা। (এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বসে পড়ল ওখানেই দোকানের পিছনে।)

বৈজু -           দিল্লি কবে গেল পাপ্পু? কার সাথে?

মঙ্গল -          যা বাবা! তুমি জানোও না যে পাপ্পু হারিয়ে গিয়েছিল?

বৈজু -           হারিয়ে গিয়েছিল! কবে?

মঙ্গল -          জৈষ্ঠ মাসে। কোথায় কোথায় ঘুরলাম আমরা শহরে। রিক্সায় মাইক লাগিয়ে এলাউন্স করলাম। (মুখের ওপর মাইক উঁচিয়ে) দশ বছরের ছেলে পাপ্পু। নাম বলে অরুণ কুমার। মায়ের নাম শিউরতি দেবী। (মুঠি সরিয়ে) হ্যাঁ, বাপের নাম বলিনি। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেসও করল, বাপের নাম? তা আমি বললাম (অপেক্ষা করে রইল যে বৈজু জিজ্ঞেস করবে কী বলল সে। কিন্তু বৈজু কিছু জিজ্ঞেস করল না।) পালিয়ে গেছে।

বৈজু -           (বিরক্ত ভাব দেখিয়ে) ঠিক বলেছিস। মাথায় ঘিলু থাকলে কি আর বেলুন বেচতিস?

                   (শিউরতি চেহারায় আনন্দের ভাব নিয়ে ফিরে আসে।)

শিউরতি -      মঙ্গল! দিল্লি যাবি?

বৈজু -           পাপ্পু হারিয়ে গেছিল কিভাবে?

মঙ্গল -          কেমন আছে ও? কী করছে?

শিউরতি -      সৌভাগ্য যে কোনো দালাল-টালালের চক্কর পড়েনি।

বৈজু -           (জোর খাটিয়ে) হারিয়েছিল কীভাবে পাপ্পু?

শিউরতি      (হঠাৎ কিছুক্ষণ আগের রাগ ফিরে আসে চেহারায়) তুই যাসনি এখনো?

বৈজু -           বাঃ, আমি জিজ্ঞেস করছি পাপ্পু হারালো কিভাবে?

শিউরতি -      (শাড়ির আঁচল কোমরে কষে মারপিট করার ভঙ্গিতে বৈজুর সামনে এসে) তোর কী? কে পাপ্পু? তোর কেউ হয়? তুই কে? আমি শিউরতি! আমার মেয়ে গীতা! তিন বছর আগে বিয়ে দিয়েছি। একটা ছেলে হয়েছে তার। একটা মরা ছেলে আমার নদীতে আছে নাম অজয়। আরেকটি আছে বেঁচে অরুণ। তুই কে? হ্যাঁ, এক অভাগী বোনও আছে আমার মালতী! বেশ্যাবৃত্তি করে নিজের মরদটাকে খাওয়ায়। খিদে আর অসুখে মরে যাবে কিছুদিনের মধ্যে! তুই কে রে সালা ভাঁড়ুয়া? (হঠাৎ বৈজুর জামা ধরে টেনে দেয়। টাল সামলাতে না পেরে বৈজু নিচে পড়ে যায়। শিউরতি একটা ভারি কাঁচের বয়াম ওর মাথায় ভাঙতে যায় কিন্তু মঙ্গল ধরে ফেলে। টানাটানিতে বৈজু সময় পেয়ে যায়। উঠে, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ায়।)

বৈজু -           খুব গরম দেখাচ্ছে হারামজাদি। আমাকে ভাঁড়ুয়া বলে আর নিজে এক ভাঁড়ুয়াকে পোষে। দ্যাখ, আমি কী করি এবার। (হাঙ্গামার গন্ধে কিছু লোক জড়ো হয়েছিল) আপনারাই বলুন। আমি হলাম এর বাচ্চাদের বাপ। এর স্বামী। হ্যাঁ কিছু ব্যাপার নিয়ে বনিবনা হচ্ছিল না তাই আলাদা থাকি আমরা। আর আমাকে প্রাণে মারতে যায়! ভাঁড়ুয়া বলে! তাও কেন? জমির ঝগড়া? সম্পত্তির ঝগড়া? এর দোকানে হিসসা চাইতে এসেছি আমি? এসেছিলাম এই জন্য যে কাজকম্ম নেই, খিদের জ্বালায় মরার অবস্থা আর এর ভালো সম্পর্ক রয়েছে হাফিজ সাহেব, মানে কাউন্সিলর সাহেবের সাথে একবার আমার জন্য একটা কাজের তদ্বির করে দিলে দুবেলা ডাল-রুটির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এটুকুই বলেছি আর ছেলের কুশল জানতে চেয়েছি, ব্যাস আমাকে টেনে মাটিতে ফেলে কাঁচের বয়াম তুলে মাথায় ভাঙতে আসে! ছেলে হারিয়ে গেছে না ঘর থেকে পালিয়ে গেছে, আমি খবরটুকুও পাইনি শুনলে দুঃখ হবে না? জিজ্ঞেস করলে অপরাধ হবে?

                   (মঙ্গলের সাথে বয়াম নিয়ে টানাটানির পর শিউরতি হাঁপাতে হাঁপাতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। বৈজুর ভাষণ শুনেও ওভাবেই বসে থাকে।)

ভীড় ১ -        মারপিট করার কঈ দরকার? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনকষাকষি হতেই পারে। আকথা-কুকথা যা বলার মুখেই বল না ভাই!

ভীড় ২ -        বুথওয়ালা বলল ছেলের ফোন এসেছে চার মাস পর। এ তো খুশির কথা!

ভীড় ৩ -        আর তুইও কম যাস না বৈজু! তুই এলি কেন এখানে?

ভীড় ৪ -        হাড়ে হাড়ে চিনি শালাকে। দারুর পয়সা চাইতে এসে হবে।

ভীড় ৫ -        দিয়ে দে শিউরতি! (শিউরতি এক ঝটকায় উঠে বাক্স থেকে কিছু টাকা বার করে বৈজুর দিকে ছোঁড়ে। মাটিতে ছড়িয়ে পড়া নোটগুলো উঠিয়ে মঙ্গল বৈজুর দিকে এগিয়ে দেয়। বৈজু রাগতভাবে মঙ্গলের দিকে তাকায়, তারপর নোটগুলো নিয়ে নেয়।)

বৈজু -           না নিলে শুনতে হত ঢঙ দেখাচ্ছি। তাই এত অপমানিত হওয়ার পরও নিয়ে নিলাম টাকাটা। ছেলের দিব্যি দিচ্ছি যে এই টাকা দিয়ে আমি মাল খাবো না। আর পয়সার জন্য আমি আসিওনি শিউরতি! (গলা ভেঙে যাওয়ার ভান করে) শুধু তুই আমার কাজটা করে দে। তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব সারা জীবন। (ভীড়ের দিকে) তামাশাটা ভালো লাগল তো? এবার যান! নিজেদের কাজে যান! আর তুই মঙ্গল এর (শিউরতির দিকে ইশারা করে) খেয়াল রাখিস!

                   (বৈজু চলে যায়। ভীড় সরে যায়। শিউরতি আগের মতই বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। মঙ্গল দাঁড়িয়ে আছে দোকানের পিছনে। শিউরতি ওঠে। জলের ড্রামের কাছে ধুয়ে রাখা গেলাসগুলো উঠিয়ে নিয়ে যায় দোকানের পিছনে।)

শিউরতি -      তুই আবার এখানে দাঁড়িয়ে কিসের ঢঙ দেখাচ্ছিস? যা নিজের কাজে যা। (মঙ্গল যাওয়ার উদ্যোগ করে) শোন্‌! দিল্লি যাবি?

মঙ্গল -          দিল্লি?

শিউরতি -      বুথের সন্তোষের কাছে ঠিকানা আছে। গিয়ে দেখ কেমন আছে পাপ্পু। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে দেখ একবার। লেখাপড়া কিছুটা করে নিক। একটু বড়ও হবে তখন। তারপর যাবে যেখানে যাওয়ার।

মঙ্গল -          ঠিক আছে। সন্ধ্যেবেলায় বসে কথা বলে নেব।

                   (মঙ্গল চলে যায়। শিউরতি বন্ধ করার তোড়জোড় করে। তখনই একটা ছেলে ঢোকে।)

ছেলে -          মাসি, পাঁচটা চা, স্পেশ্যাল!

শিউরতি -      হবে না। দোকান বন্ধ করছি।

ছেলে -          এখন?

শিউরতি -      কাজ আছে বাড়িতে সোনা! দেখ না এগিয়ে, রামবাবুর দোকান খোলা হবে।

                   (দোকান বন্ধ করে জিনিষপত্র উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। বেঞ্চটাও পিছনে সরিয়ে দেয়। তার নিচে রেখে দেয় প্যাকিং বাক্সোটা। শূন্যমঞ্চে রাত ও বৃষ্টির আভাস দিয়ে ছাতা মাথায় হাতে টর্চ নিয়ে, আধভেজা উর্দিতে প্রবেশ করে একজন পুলিশ কনস্টেবল। দুবার এদিক ওদিক তদারক করে হাই তোলে, তারপর পিছনে বেঞ্চটা দেখে। কাছে গিয়ে রুমাল দিয়ে মুছে রুমালটা নিংড়োতে নিংড়োতে বসে পড়ে। অদূরে একটা ট্রেন ঢোকার আওয়াজে বোঝা যায় যে জায়গাটা রেলওয়ে স্টেশন। দুজন হাতে মালপত্র নিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বাঁচতে মঞ্চের ডানদিক দিয়ে প্রবেশ করে। একজনের বয়স পনেরো ষোল, অন্যজন একেবারেই ছোট, দশ বছর হবে বয়স।)

পুলিশ -         (আকাশের দিকে তাকিয়ে) রাতভর চলবে এই ফিসির-ফিসির! (যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে) কোন ট্রেন এল?

বড় যাত্রী -     মগধ। নয় ঘন্টা লেট।

(যাত্রী দুজন মালপত্র নিয়ে বাঁদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। শীর্ণ দেহী, অত্যধিক কিন্তু সস্তা সাজগোজ করা দুই নারী একজন সালোয়ার কামিজ, একজন জিন্স টপ্‌স পরিহিতা এসে মাঝমঞ্চে দাঁড়ায়। আগে থেকে চলতে থাকা কথার রেশ শোনা যায়।)

জিনস -         বলল আর তুমি চলে গেলে?

কামিজ -        কী করব? বুঝিস তো, খুব খারাপ অবস্থায় আছি।

জিনস -         কত ঠিক হয়েছিল?

কামিজ -        রাত ভর, পাঁচশো।

জিনস -         ধরাল কত?

কামিজ -        দুশো।

জিনস -         শালা হারামি। ওই জন্য তোমায় বুঝিয়েছিলাম বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা কিছুতেই মানবে না। মাল মায়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করতে চায় হোটেল নেবে। আচ্ছা যাই!

                   (বলে জিনস পরা নারী বাঁদিকে একটু আলো আঁধারিতে চলে যায়। সালোয়ার-কামিজ পরা নারী ডানদিকে সরে আসে। ঝিরঝির বৃষ্টি। জিনস পরা নারী ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের বাহারি বর্ষাতি বার করে গায় জড়ায়। কামিজ পরা নারী ব্যাগ থেকে ছোট ছাতা খুলে মাথায় ছড়ায়। একে দেখে পুলিশের লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। পাশে এসে ইঙ্গিতবহভাবে দাঁড়ায়।)

কামিজ -        কী সিপাহিজি, ধান্ধায় এক পয়সা কামাইও হল না আপনি আগেই চলে এলেন?

পুলিশ -         তা বললে চলে?

কামিজ -        সত্যি বলছি সিপাহিজি এই দেখুন, ব্যাগটা দেখুন (খুলে দেখায়)

পুলিশ -         ওই তো, কোনায় ওটা কী?

কামিজ -        ও তো মাত্র কুড়ি টাকার একটা নোট!

পুলিশ -         দেখি!

                   (হঠাৎ এই নারীর নজর পড়ে একটি ঢ্যাঙা লোক জিনস পরা নারীর সামনে দাঁড়িয়েছে। দরদাম চলছে।)

কামিজ -        (চিৎকার করে) আরে ওই তো সেই লোকটা! এ্যাই সিমরন! এই হারামজাদাই (দৌড়ে যায় সিমরনের দিকে) তিনশো টাকা মেরেছিল পরশু। (পুলিশকে) এ সিপাহিজি! কসম খেয়ে বলছি আদ্ধেক দিয়ে দেব, ওর থেকে তিনশো উশুল করিয়ে দিন।

                   (লোকটি কেটে পড়তে চায়; সিমরন ধরে রাখে, এই নারীও গিয়ে ধরে ফেলে। লোকটি একেও ঝটকা দেয়। ততক্ষণে পুলিশ পৌঁছে যায়।)

পুলিশ -         তুই তো ওস্তাদ রসিক রে ভাই। হ্যাঁ? রন্ডির পাওনা থেকেও মেরে দিস?

সিমরন -        (সাহস পেয়ে সোজা লোকটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বার করে আনে।) এই দেখুন সিপাহিজি। কুল তিনশো নিলাম। (বাকিটা রেখে দেয়) নাও মালতীদি! হিসাব বরাবর।

লোকটি -       দেখে নেব সালা। দুজনকেই দেখে নেব। (পুলিশকে) সালা তোমাকেও দেখে নেব। (বলে আর দাঁড়ায় না, কেটে পড়ে।)

মালতী -        নিন সিপাহিজি, পঞ্চাশ টাকার নোট আছে?

পুলিশ -         রাখ তুই। তোর কামানো টাকা। আমাকে দিয়ে দিস পরে।

মালতী -        (খুশির স্বরে) নাঃ, ডোবা টাকা পেয়েছি। আপনাকেও দেবই। ওই তো একজন আসছে দেখি।

                   (স্টেশনের দিক থেকে প্রবেশ করে প্রথমে মঙ্গল, পিছনে শিউরতি।)

মঙ্গল -          ছোঁড়াটার কান্ড দেখ! চারদিন আগে ফোন করল। (সেদিন বলল না যে বাড়ি ফিরছে। তোর বলায় আমি টিকিট কিনলাম যাওয়ার। আর কাল রাতে ফোন করে ভায়া জানালেন যে উনি বাড়ি আসছেন। দেখাও হল না। নয় ঘন্টা হাপিত্যেশ করে বসে রইলাম। গাড়ি এল। খালি হল। ইয়ার্ডে গেল। পাপ্পু সাহেব বেপাত্তা। কোথায় গেল?

শিউরতি -      কোথায় আবার যাবে? বাড়ি গেছে। এত বোকা তো আর নয়। চল্‌ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে।

মালতী -        (মঙ্গল কাছে এলে) ভাইজি, দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট হবে?

শিউরতি -      (দূর থেকেই চিনে) মালতী না? (মালতী শিউরতিকে দেখে এড়িয়ে যেতে চায়। শিউরতি এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে ফেলে।) পালাস কেন রে ভাই? তোর জন্য আমি চোখের জল ফেলি। (খুঁট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে দেয়) দিয়ে দে। সিপাহিজিকেই দিতে হবে তো? (মঙ্গলকে) তুই যা বাড়ি। পাপ্পু ফিরে গিয়ে হবে ওকে দেখ। আমি এই বোনটার সাথে দুটো কথা বলে তারপর আসব।

(মঙ্গল চলে যায়। পুলিশ কনস্টেবল কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফিরে চলে যায় পিছনের বেঞ্চটার দিকে। সিমরন ফিরে মঞ্চের বাঁদিক দিয়ে বাইরে চলে যায়। শিউরতি মালতীর হাত ধরে নিয়ে আসে একেবারে সামনে। মাটিতে বসে পড়ে। ওকেও টেনে বসায়। নেপথ্যে, স্টেশনে হতে থাকা ট্রেনের ঘোষণ ধীরে ধীরে জোরে, আরো জোরে হয়ে ওঠে।)

 

[২০১০ ১১ সাল নাগাদ সঞ্চিতার কোনো বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত]

  

 


No comments:

Post a Comment