“এভাবে কোনোদিন যাওয়ার সুযোগ হবে ভাবিনি। সেই ৪৬ বছর আগে গুরুচরণ সামন্ত ও নরেন মুখার্জি গিয়েছিলেন। ডাক্তার ঘোষালের গাড়িতে। সঙ্গে নিশ্চয়ই ড্রাইভারসাহেবও ছিলেন। আজকে আমি দেবল, বুড়ো আর শ্যামাদা, ড্রাইভারসাহেবকে নিয়ে চারজন। তবে তাঁদের, কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের বাড়ির খোঁজ করে ফিরে এসে লিখিত রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছিল বাঙালি সমিতিকে। আমাদের কাউকে কোনো রিপোর্ট দেওয়ার নেই কেননা বিদ্যাসাগরের বাড়িটা কোথায় সবাই জানে। খুঁজে বার করতে হবে রাস্তা, মানে গাড়িতে পাটনা থেকে কর্মাটাঁড় যাওয়ার হ্রস্বতম রাস্তাটা, আর সেটার খোঁজ পাওয়ার কারো কোনো দরকার নেই। দিব্যি ট্রেনে করে যাওয়া যায়। আমরা গাড়ি করেছি কেননা আমাদের... নাঃ বিশেষ করে আমার দায়।
“একটা বয়সের পর
সব যাত্রা যেন নিজেরই অতীতে হয়ে যায়। তাও আবার সেই অতীত যেগুলো বাঁচিনি, বাঁচার
ইচ্ছে হয়ে জমে ছিল বেঁচে থাকার পরতে পরতে। পরত বলছি কেন? পরতই তো! দশ-বিশ বছরের,
বা হয়ত তারও কম, পাঁচ বছরের! এদেশে ভোট তো হয় পাঁচ বছরেই! নতুন প্রেক্ষিত দেয় সময়,
আর সেই অনুসারে বদলে নিতে হয় বেঁচে থাকার চর্যা – সে তুমি ছাপোষা হয়েই বাঁচো আর লড়াকু হয়েই বাঁচো। আশির কথা সত্তরে
ভেবেছিলাম? নব্বইয়ের কথা আশিতে? আর এই ২০১৯শের কথা ২০০৯এ?
“১৯৭০এ ২০০০এর ভাবনাটা
১৯৭০এরই ভবিষ্যৎ-ভাবনা ছিল। আর ১৯৯০এ ১৯৮০এর ভাবনা বস্তুতঃ ১৯৯০এরই অতীত-ভাবনা। সেরকম
বিদ্বান হলে বলতাম ভবিষ্যত-দৃষ্টি আর অতীত-বিশ্লেষণ।
“এত তফাৎ হয়ে যায়!
যেন কাংস্যযুগের উদ্ধত রৌদ্র-সমুজ্জ্বল নগরায়ন, জানেই না যে লৌহ বলে এক নতুন ধাতু
আসবে, মুছে দেবে কাংস্যযুগের সমস্ত স্মৃতি-সত্বা-ভবিষ্যৎ। মানুষ আর ভাবতেই পারবেনা
যে কাংস্যযুগটা লৌহযুগের প্রতীক্ষা ছিলনা, তার ইতিহাস বইয়ে পরের অধ্যায়ের প্রতীক্ষার
মত। একটা সম্পূর্ণ সভ্যতা ছিল, পূর্ণ, সার্বভৌম, নিজের দিগন্তের অনিঃশেষ নিজেরই বলয়ে
রেখে।
“এভাবেই মানুষ
এগোয়।...”
- শুনছেন? দেবলবাবু! নিজের মোবাইলে একটু – ক্যা বোল রাহে হ্যাঁয় ড্রাইভরসাহেব ... জিপিএস! – হ্যাঁ, একটু জিপিএসটা খুলুন! ড্রাইভারসাহেব পথ হারিয়ে ফেলেছেন।
শ্যামাদার কথায় চমক ভাঙল। ড্রাইভারসাহেবকে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, “হামকো জিপিএস নহি আতা হ্যায়। গুগলম্যাপ মেঁ দেখকর তো আপকো
বতায়ে থে, বিহারশরিফ সে মোড়না থা। আপ হরনওত মেঁ হি মোড় দিয়ে। (জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম), অব ইয়ে তো স্টেট হাইওয়ে ভি নহি হ্যায়, গাঁও
কা রাস্তা হ্যায়, ক্যা দিখেগা গুগলম্যাপ মেঁ?”
সামনের সিট থেকে বুড়ো আশ্বস্ত করল, “চিন্তিত হবেন না। আমি তো খুলে রেখেছি জিপিএস। একদম ঠিক যাচ্ছি
আমরা। ড্রাইভারসাহেব আসলে একটু ক্রসচেক চাইছিলেন। কাহে কো পরেশান হো রহে হ্যাঁয়
বলরামজি, মেরে ফোন কা জিপিএস অওর উনকে ফোন কা জিপিএস অলগ হোগা ক্যা? বস আপ জহাঁ সে চঢ়
সকেঁ, সামনে এক এনএইচ হোগা, উস পর চঢ় যাইএ। ফির বাঁয়ে শেখপুরা মিলেগা বিস কিলোমিটর
পর।... দেবলদা, আপনি কখনো গেছেন ওই হরনওতের রেল-ওয়র্কশপে?”
-
তাহলে? কিছুদিন পর ওটা আর থাকবেই না হয়ত। একটা
ভাঙা দেয়ালের টুকরো হয়ত খাড়া থাকবে বেদীতে – এখানেই ছিল ঐতিহাসিক
জামালপুর রেল কারখানা ...
শ্যামাদা প্রশ্ন
করলেন, “জামালপুরে কিছু আছে আমাদের? মানে বাঙালি সমিতির ব্রাঞ্চ টাঞ্চ?”
-
অব কহীঁ নহী রোকেঙ্গে। ইতনা দের কর দিয়ে নিকলনে
মে আপলোগ। অব চকই কা ঘাটি পার করনা হোগা রাত মে। পতা নহী কহাঁ ফঁসেঙ্গে।
পঞ্চায়েতের সরু রাস্তা
দিয়েই বুন্দি থানা হয়ে কখন জানি পৌছোলাম বেলছি, সকসোহরা।
-
এখানে ইলেকশন ডিউটতে এসেছিলাম শ্যামাদা। অনন্ত
সিং, ছোটে সরকারের এলাকা। আর এই বেলছিতেই ইন্দিরা গান্ধী এসেছিলেন সত্তরের দশকে মনে
আছে? হাতিতে চেপে আসতে হয়েছিল, বেলছি নরসংহারের পর।
বারবিঘায় ঢুকতেই
আলোয় আলো। অবশ্য শহরের বাড়িঘরগুলোর আলো নয়, রাস্তার ওপর পর পর দু’তিনটে মন্দিরের
আলো। বাঁদিকে পিছনে অন্ধকার ওই উঁচু আকৃতিটা গিরিহিন্দা পাহাড়ের না? যবে থেকে
গিরিহিন্দার বিষয়ে জেনেছি, মাথায় ঘুরছে। নাঃ, অন্য কিছু হবে।
ড্রাইভারসাহেব
গাড়ি থামালেন সিকান্দ্রায়। নদী পেরিয়ে, বড় জৈন মন্দিরটা ছাড়িয়ে। তখন ন’টা বাজছে।
-
নাঃ অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলুন। ভাগ্যে যা আছে
তাই হবে।
আসলে ড্রাইভারসাহেব নিজেই বলেছিলেন বেশি রাত
হওয়ার আগে চকাইয়ের ঘাটি পেরিয়ে যেতে চান। মাওবাদীদের উৎপাত, আর ফলে পুলিশের খানাতল্লাশি।
যদিও, মাওবাদী হোক আর পুলিশ, পেত শুধু চারশো কপি বিদ্যাসাগরের জীবনী, ব্যানার, কিছু
ওষুধপত্র আর বিস্কুট, চানাচুর। ও হ্যাঁ, জামাকাপড়ের ব্যাগগুলো আর পয়সা।
লাইন হোটেলটা ড্রাইভারসাহেবের পরিচিত কিনা
বুঝলাম না। তবে লাইন হোটেলগুলোর প্রিয় খদ্দের তো ড্রাইভারেরাই। এটা ব্যক্তিত্বের অদ্ভুত
এক পরিচায়ক। লাইন হোটেলে রাত বারোটা নাগাদ সবাই দায়ে পড়ে খায়। কেউ একটু কিছু মুখে গুঁজে
নেয়। কেউ বেশ আয়েস করেই খায়। কেউ ওদিক ঘেঁষে বসে, মদের বোতলটা রেখে। কিন্তু, সব কিছু
সত্ত্বেও তাদের চোখেমুখে শান্তি আর পরিতৃপ্তির সেই ভাবটা থাকে না যেটা ড্রাইভারের চোখে
থাকে। এটা তার যাত্রাপথের সরাইখানা নয়, ওয়র্কশপের, কাজের জায়গার লাঞ্চরুম বা টিফিনঘর।
ড্রাইভারের ওয়র্কশপটাই পথে পথে আর রাতে রাতে ছড়িয়ে, তাতে সে আর কী করতে পারে! এমনই
একটা ভাব নিয়ে মুখ নিচু করে সে তার খাবার খায়। আমি মুগ্ধ হই এই এ্যাটিচুডটা দেখে।
ঝাঝা, জমুই পেরিয়ে চকাইয়ের ঘাটি। কালো মেঘে
ভরা আকাশ। তার প্রান্তগুলো কোথাও কোথাও দূরের বসতের আলোয় স্তিমিত উজ্জ্বল। বাকিটা অন্ধকারে
পাহাড় আর পাহাড়। ড্রাইভারসাহেব এমন শঙ্কিত করে দিয়েছিলেন, একবার পেচ্ছাপ করার অজুহাতে
দাঁড়াতে বলার সাহসও হল না। দাঁড়ালে পথের ধারে ঈষৎ নেমে উপভোগ করতাম চকাইয়ের ঘাটির এই
রূপ।
ঘাটি পেরিয়ে কিছুটা গিয়েই জসিডি, তারপর দেওঘর।
গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র, তাই ‘বিকাস’এর কল্যাণে আলোয় আলো। নানা দিক থেকে পথ এসে মিলছে কাজেই ট্রাকের
ভীড়ও তেমন।
আলো থাকলে অন্ধকারের মানে বদলে যায়। আলোরও মানে বদলে যায় অন্ধকার থাকলে। বিহার ‘ডেভেলাপ’ করে গেছে। ঝারখন্ডও ‘ডেভেলাপ’ করে গেছে। পিছিয়ে থাকা জায়গাগুলো পঞ্চদশ শতকের জার্মানিতে
চলে গেছে। বদলটাই শাশ্বত। দেওঘর পেরোতে পেরোতেই অনেককে জিজ্ঞেস করলাম
আমরা কর্মাটাঁড় কোনদিক দিয়ে যাব। জসিডি ফিরে গিয়ে রেললাইনের ধারের রাস্তা দেখে দেখে
গেলে হয়ত মধুপুর হয়ে যাওয়া যেত। অথবা হয়ত যেত না। আমরা কেউই কিছু জানতাম না সেরকম কোনো
রাস্তার বিষয়ে। আর দেওঘর থেকে সোজা রাস্তা আছে কেউ বলেছিল। গুগলও সেরকমই দেখাচ্ছিল।
চিত্রা কোলিয়ারি হয়ে। কিন্তু কিভাবে?
শেষে এক টেম্পোড্রাইভার ঠিক রাস্তাটা বলল। দেখাল, এদিক দিয়ে সারাঠ
চলে যান। সারাঠ পেরিয়ে একটা মোড় পাবেন। কোনদিকে না বেঁকে সোজা কিছুদূর এগিয়ে গেলে দেখবেন বাঁদিকে রাস্তা গেছে চিত্রা কোলিয়ারির দিকে। ওদিকেই কর্মাটাঁড়। অথচ টেম্পোড্রাইভারের
কথায় বিশ্বাস না করে সারাঠের মোড়ে আমরা দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন পুলিসকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
তারা জিজ্ঞেস করল, কর্মাটাঁড়? সারাঠ ব্লকে? তারপর তিনদিকে যাওয়া তিনটে রাস্তার দিকে
আঙুল দেখিয়ে বলল, এদিক দিয়েও যেতে পারেন, সোজাও যেতে পারেন আর ওদিক দিয়েও যেতে পারেন।
… শ্রদ্ধা বেড়ে গেল টেম্পোড্রাইভারের ওপর।
*
অন্ধকারে চোখ সয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণেই। এদিকে ভালো বৃষ্টি হয়ে গেছে।
গাড়িটা একেক বার জমা জলের ওপর দিয়ে ছুটলেই স্ক্রীন অব্দি ভিজে যাচ্ছে জলের ছিটেয়। অনেকক্ষণ
পরে গেট দেখা গেল চিত্রা কোলিয়ারি কলোনির। ঢুকে এগোচ্ছি। গভীর রাত। একটাও দোকান খোলা
নেই। মানুষজন নেই রাস্তায়। অন্য কোনো গাড়ি বা যানবাহনও দেখছি না। ট্রাকও দেখলাম না
এখন অব্দি একটিও। ধরেই নিয়েছি, কর্মাটাঁড় আমরা পৌঁছোচ্ছি না। এভাবে হাতড়ে হাতড়ে জামতাড়া
হয়ত পৌঁছোব, জেলাশহর। তারপর সেখান থেকে দেখা যাবে।
হঠাৎ একটা বাইক দেখলাম দাঁড়িয়ে। তারপর লোকটিকেও দেখলাম, বাঁপাশে
দাঁড়ানো একটা ট্রাকের আড়ালে পেচ্ছাপ করছে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করলাম তার ফিরে
আসার। কর্মাটাঁড় জিজ্ঞেস করায় সে হেসে বলল, এদিকে কেন এলেন? যেখানে ঢুকলেন এ রাস্তায়
সেখান থেকেই তো আলাদা রাস্তা গেছে। আচ্ছা, আমার সঙ্গে চলুন। বলে সে পিছন দিকে বাইক
নিয়ে চলল। আমরা অনুসরণ করলাম। অনেকটা দূর গিয়ে সে বলল, এবার আমি বাঁদিকে যাব। আপনারা
সোজা এগিয়ে যান। সামনের মোড়ের পর আরেকটা মোড়। তারপর অন্যদিক।
আমাদের মনের অবস্থা শোচনীয় ছিল। রাতের খাওয়া গেল, ঘুম গেল, নন্দনকাননে
পৌঁছোলেও শোবার জায়গা পাব নাকি গাড়িতেই বসে কাটাতে হবে। জামতাড়া গেলেই বোধহয় ভালো হত।
সেটাই বা কোনদিকে।
চিত্রা কলোনির বোর্ড লাগানো মোড়ে এসে পৌঁছোলাম। এবার? হঠাৎ সামনে
অন্ধকারে চোখ পড়ল। গ্রামীণ পথ পরিযোজনার ছোট্টো বোর্ড ঝোপগুলোর সামনে। তাতে প্রথম নামটাই
কর্মাটাঁড় – ১৯ কিমি। পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ভিতরে ঢুকে
গেছে। যাব? এই রাতে? অন্ধকারে? যাওয়াই যাক। পথটায় চলতে চলতে বুঝলাম, অন্ধকারে মনে হলেও,
পথ ততটা সরুও না আর খারাপও না। একটু পরে একটা বাঁধ পেরোলাম। নদীটা দেখা গেল না। এবার
বসত আসছে। মাঝে মাঝে আলো। বাড়িঘর। সরকারি ভবন, স্কুল, মাঠ। একটা জায়গা দেখে মনে হল
এটাই। ড্রাইভারসাহেব বললেন, আমার মিটারে এখনো উনিশ কিলোমিটার হয়নি। এটাকেই আমি ভরসা
করি।
ঠিক উনিশ কিলোমিটারে পৌঁছোলাম একটা লেভেলক্রসিংএ। বন্ধ। নেমে রেললাইনের
ওপরে দাঁড়িয়ে দেখলাম অদূরে একটা স্টেশন। ওটাই
কি বিদ্যাসাগর স্টেশন? তাহলে আমরা কোনদিকে আছি? ঠিক হদিশ পেলাম না। কী করি? রেললাইনের
পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই প্ল্যাটফর্মে? ট্রেনই বা আসছে না কেন? এমন তো নয় যে
এসব এলাকায় এটাই নিয়ম? যানবাহন বিশেষ থাকে না বলে দুর্ঘটনা এড়াতে রাতে বন্ধ করে দেওয়া
হয় লেভেলক্রসিংগুলো? কী যে করি? লেভেলক্রসিংএর ওপারে কোনো বাড়িতে কড়া নাড়ি?
অনেকক্ষণ পর দূরপাল্লার একটা ট্রেন এল। এখানে দাঁড়াবার না। জোর গতিতে
চলে গেল। লেভেলক্রসিং খুলল! যেন মনে পড়িয়ে দিল অদৃশ্য হাতটার কথা। কন্ট্রোলরুমে যে
হাতটা জেগে ছিল। কন্ট্রোলরুমটাই বা কোথায়? ওই দূরের স্টেশনটায়, না এদিকেই কোথাও? চোখ
পড়েনি!
আমরা খেয়াল করিনি, ড্রাইভারসাহেব লক্ষ্য করছিলেন আমাদের অস্থিরতা।
খোলা লেভেলক্রসিং পেরোতে পেরোতে হেসে বললেন, “বিদ্যাসাগরজী একটু ধৈর্য রাখতে শেখান নি আপনাদেরকে?”
অবশেষে নন্দনকানন।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা হলঘরটায়। বিদ্যাসাগরের প্রতিমার পিছনে। দিনে এখানেই কিছু অনুষ্ঠান
হবে। আপাততঃ ঢালাও শোওয়ার ব্যবস্থা। বাঃ, দু’তিনটে খালিও রয়েছে, তাও স্টেজের ওপর। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের একটা দুঃস্মৃতি
গড়ে উঠেছে ছোটবেলা থেকে, বন্যা আর বৃষ্টির বছরগুলোয়।
ঘুম যখন ভাঙল, দেখলাম
দেরি হয় নি একটুও। রাত তিনটেয় ঘুমোলেও, বিদ্যাসাগরমশাই ঘেঁটি ধরে উঠিয়ে দিয়েছেন। আশেপাশের
স্কুলগুলোর অনেক অনেক ফুটফুটে কালো মেয়েরা স্কুলড্রেস পরে ব্যানার নিয়ে লাইনের প্রথম
দিকটা বাঁধছে প্রভাতফেরিতে বেরুতে। ছেলেরা পিছনে। বিদ্যাসাগর দেখছেন। এখনও মালায় ঢাকা
পড়েনি নাক। নিশ্চয়ই গন্ধ পাচ্ছেন স্কুলড্রেস আর ঘামের। ঠিক তাঁর চোখের বিপরীতে মাঠের
ওপ্রান্তে তাঁর লাগানো আমগাছটা বিশাল হয়ে উঠেছে।
কী যেন ভাবছিলাম
কাল বিকেলে? একটা
বয়সের পর সব যাত্রা যেন নিজেরই অতীতে হয়ে যায়। তাও আবার সেই অতীত যেগুলো বাঁচিনি,
বাঁচার ইচ্ছে হয়ে জমে ছিল বেঁচে থাকার পরতে পরতে। কতটা অতীত? আঠেরো শতকের শেষ অব্দি? যখন জ্যান্ত বৌকে বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে
জ্বলন্ত চিতায় ঢুকিয়ে রাখা হত? কে ওই বৌ? আমার মা, আমার স্ত্রী? আমার বোন?
পিছন অব্দি পুরো মিছিলটা ধরতে প্রথম সারির মেয়েগুলোকে ঈষৎ কোনাকুনি
রেখে দাঁড়ালাম। তারপর ক্যামেরার ভিতর দিয়ে তাকালাম ওদের কালো চোখগুলোর দিকে। একটা ছবি
নেওয়ার পরই দৃষ্টি গেল বাঁপাশে। ঠিক প্রতিমার গেটটার সামনেই দাঁড়িয়ে গাঢ় নীল ট্র্যাকসুট
পরে তিনটি চাবুকের মত মেয়ে। একজনের পিঠের খানিকটা দেখা যাচ্ছে – বিদ্যাসাগর স্পো …। কাছে গিয়ে
দেখলাম … স্পোর্টস একাডেমি। “এ্যাই, তোমরা তিনজনে পিছন ফিরে দাঁড়াও তো! … হ্যাঁ, তুমি সবচেয়ে লম্বা, মাঝখানে দাঁড়াও। একটা ছবি তুলি।”
ইসস, যদি বিদ্যাসাগরমশাইকে পাঠাতে পারতাম!
[শেষ করলাম ২৯.৮.২১]
No comments:
Post a Comment