Thursday, August 12, 2021

ব্রুনোর মেয়েরা - আলোকধন্বা

ওরা ছিল না চট
          আর শ্যাওলার বুনট
মায়েদের পেটে জন্মে
নিজেরাও
মা ছিল ওরা সকলে।

ওদের নাম ছিল
যে নামে শৈশব থেকেই
ওদের ডাকা হল
          হত্যার দিনটি অব্দি
ডাকল সে নামে
তাদেরও কন্ঠস্বর
যারা ওদের হত্যা করল।

চেহারা ছিল ওদের
ছিল শরীর, ছিল গোছা-চুল
এবং ছায়া
          ছিল রোদে। 

গঙ্গার সমতলে ওদের ঘন্টা ছিল কাজের
এবং প্রতিবার
          মজুরি ওদের দিতে হল
যেমন পুরো পৃথিবীকে গ্যালিলিওর
দূরবীন দিয়ে হল দেখতে।

ছাই আর মিথ্যা ওরা ছিল না
মা ছিল সকলে
আর কে? কে সে বর্বর? যে বলে
কোনো ইচ্ছা ছিল না ওদের জননে?

উদাসীনতা ছিল না ওদের গর্ভধারণ
ছিল না ভুল
অভ্যাস ছিল না ওদের গর্ভধারণ
কোনো নেশা   কোনো নেশা
কোনো হামলা ছিল না ওদের গর্ভধারণ
কে বলে?
কে সে অর্থনীতিবিদ?

প্রণয়সখা ছিল ওদের
ঝংকার ছিল অন্তরে

মা ছিল ওরা
নয়টি মাস ছিল ওদেরও
কোনো তিমির পেটে নয় পুরো দুনিয়ায়
পুরো দুনিয়ার নয়টি মাস।

দুনিয়া তো যে কোনোখানে পুরো
পুরোটাই থাকে অটুট
কোনো অংশ আলাদা
          করা সম্ভবই নয়
তাহলে এই নির্জন শিকার?
মাতৃত্বের?

তুমি কখনো চাও না
যে পুরো দুনিয়া ওই গ্রামটায় আসুক
যেখানে ওই শ্রমিক নারীদের হত্যা করা হল?

কোন দেশের নাগরিক হয় ওরা
                   যখন ওদের অস্ত্বিত্ত্বের
সব প্রমাণ মোছা হতে থাকে?
গতকাল সন্ধ্যা অব্দি এবং
গতকাল মধ্যরাত অব্দি ওরা
জনসংখ্যায় ছিল পৃথিবীর
যেমন ছিল পৃথিবী
যেমন খোদ হত্যাকারীরা
আর আজ সকালে?
যখন নাকি কাল রাতে ওদের
          জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হল?

শুধু কি জীবিত মানুষদেরই ওপর
টিঁকে আছে
জীবিত মানুষদের জগৎ?

আজ সকালেও ওরা আছে
পৃথিবীর জনসংখ্যায়
আছে ওদের সখীকুল
ওদের কবিরা
ওদের অসফলতাগুলো
যা ভারতীয় সময়কে প্রভাবিত করেছে
শুধু ওদের শ্রেণী নয় ওদের সময়।

আগামীকাল সন্ধ্যা অব্দি এই পুড়ে যাওয়া জমি
কাঁচা মাটির প্রদীপের মত তুলবে শিখা আর নিজের
নতুন বাসিন্দাদের ডাকবে।



ওরা ছিল না যাযাবর
কুঁয়োর পাড়ে ওদের কলসির চিহ্ন রয়েছে
শিশমের সাদা গুঁড়িতে
রয়েছে ওদের কুড়ুলের দাগ
বাঁধের উৎরাইয়ে
                   নামার জন্য বসান
ওদের পাথর রয়েছে।

ওদের দিনযাপন
রাস্তা গড়েছে মাটির ওপর।
হঠাৎ কোথাও থেকে নয়
বরং নীলনদের তটরেখা ধরে চলে ওরা
পৌঁছেছিল এখানে।

ওদের দরজা ছিল

যা দিয়ে দোলনা দেখা যেত
চুল বাঁধার রঙীন ফিতে
পেপে গাছ
টাটকা কাটা ঘাস
ধীরে ধীরে শুকোতে থাকা তামাকপাতা আর
সাপ মারার বর্শাটাও
                   দেখা যেত।



ওরা ছিল না দাগ
ছিল না কোলাহল।
ওদের বাতি ছিল
পশু ছিল
ছিল বাসা।

ওদের বাসা ছিল
যেখানে ছোলার ডাল
অনেকটা সময় ধরে সেদ্ধ হত উনুনে।
আটা মাখা হত
মাটির পাত্রে থাকত নুন,
গলত বৃষ্টির দিনগুলোয়।

ওদের বাসা ছিল
যা বেড়ালদের আসাযাওয়ার
পথে পড়ত। 

রাত ওখানে গড়িয়ে ফিকে হত
গোল হত চাঁদ
ছিল দেয়াল
          তার উঠোন ছিল
যেখানে উড়ে আসত খড়কুটো
পাখি তা ধরে ফেলত হাওয়াতেই।

ওখানে কল্পনা ছিল।
ওখানে স্মৃতি ছিল।

ওখানে দেয়াল ছিল যার ওপর
চিহ্ন ছিল মেঘ ও শিংএর
দেয়াল যা আগাছাগুলোকে
উঠোনে আসতে বাধা দিত।

ঘরের দেয়াল
বসবাসের ঘনকঠিন ইচ্ছাগুলি
ওরা তৈরি করেছিল
ভেজা মাটির তাল দিয়ে
শজারুর কাঁটা দিয়ে নয়
ভাল্লুকের নখ দিয়ে নয় 

কে ধাপ্পাবাজ নিজের ক্যামেরার রঙিন ফিল্মে
জঙ্গলের মত দেখায় ওই দেয়ালগুলিকে

ওগুলো মাটির দেয়াল ছিল
প্রাচীন শিলাখন্ড নয়
প্রতিবছর
নতুন মাটির পড়ত প্রলেপ!
ওগুলো বাসা ছিল ওদের প্রতীক্ষা ছিল না।
গাছের কোটর ছিল না
উড়তে থাকা চিলের পাঞ্জায় চেপে ধরা
                   ইঁদুর ছিল না।

সিংহের চোয়ালে ছিল না বাসা ওদের
পুরো দুনিয়ার মানচিত্রে
ছিল পুরোটা আস্ত, এক জায়গায়। 

এত সকালে ওরা কাজে যেত 

ওদের আঁচল
শিশির আর সদ্য ডোবা চাঁদে
                   ভিজে যেত
এত সকালে ওরা আসত
কোথায়, কোথায় আসত ওরা?
কেন আসত ওরা এত সকালে
কোন দেশের জন্য
এত সকালে ওরা আসত

শুধু কি মালিকদের জন্য
ওরা আসত এত সকালে?
আমার জন্য নয়?
তোমার জন্য নয়?

এত সকালে ওদের আসা কি নিছক
নিজেদের পরিবারের ছিল প্রতিপালন?

কিভাবে দেখ তুমি এই শ্রমটাকে?

ভারতের সমুদ্রে যে তেলের
কুঁয়ো খোঁড়া হচ্ছে সে কি আমার
জীবনের বাইরে?
          নিছক সরকারি কাজ?

শ্রমকে কিভাবে দেখ তুমি?

শহরকে ওরা বলেনি প্রবঞ্চনা আর জাল
শহর ওদের জন্য শুধু জেল আর
হেরে যাওয়া মামলা ছিল না

কোনো বন্যপশুর চোখ দিয়ে ওরা
শহরকে দেখেনি।

শহর ওদের জীবনে
আসত, চলে যেত 

শুধু জিনিষপত্র আর আইন হয়ে নয়
সবচে বেশি ওদের ছেলেদের সাথে সাথে
যাদের এখনো দেখা যাচ্ছে
                             ওখানে
                             ওই শহরের
চিমনিগুলোর চারদিকে।



ওদের হত্যা করা হল
ওরা আত্মহত্যা করেনি
এ কথাটির গুরুত্ব ও উৎসব
কবিতায় বিবর্ণ হবে না কখনো।

কী সে ছিল ওদের থাকায়
যার জন্য জ্যান্ত ওদের
                   পুড়িয়ে দেওয়া হল?
বিশ শতকের শেষ বছরগুলোয়
এক এমন দেশের সামনে
যেখানে লোকসভা বসে।
কী সে ছিল ওদের থাকায়
যা কেনা গেল না
যার ব্যবহার করা গেল না
আগুনে পোড়াতে হল শুধু
তাও মধ্যরাতে, কাপুরুষদের মত
বন্দুকের ঘেরাটোপে।

একই কথা বার বার বলছি
এক সামান্য কথার প্রচার করছি ফলিয়ে!

আমার সব কিছু নির্ভর করে আছে
এই সামান্য কথায়
যে
কী সে  ছিল ওদের থাকায়
যাকে পুড়িয়েও
নষ্ট করা গেল না!



ওদের পথ
ছিল না উন্মত্ত তরবারি
ওদের জনসংখ্যা মুছে যায় নি রাজাদের মত!

পাগলা হাতি আর অন্ধ কামানের মালিক
বেঁচে থাকতেই ফসিল হয়ে গেল
কিন্তু কাঠের লাঙল যে চালায়
সে চলছে

রানীরা মুছে গেল
তাদের স্মৃতির দাম
জং ধরা টিনেরও সমান রইল না

রানীরা মুছে গেল কিন্তু দিগ্বলয় অব্দি
ফসল কাটতে থাকা নারীরা
ফসল কাটছে।

  


No comments:

Post a Comment