[দন্ডী সন্ন্যাসী থেকে কিসানসভার প্রথম সর্বভারতীয় সভাপতি]
অবশ্যই গীতার সাথে আমার প্রাথমিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ধার্মিক ছিল – সে অর্থেই ধার্মিক
যে অর্থে সাধারণভাবে শব্দটার ব্যবহার করা হয়, এবং এখনো সে সম্পর্কটা ধার্মিকই। তফাৎ
শুধু এটুকুই যে আগের ‘শুধুমাত্র’ শব্দটা সরে গেছে। বা বলতে পারেন ধর্মের রূপ অনেক ব্যাপক
হয়ে গেছে। ব্যাপক তো অন্যান্য মানুষেরাও বলে এবং মানে। কিন্তু আমার কাছে এর ব্যাপকতা
বিশেষ, এবং “গীতা-হৃদয়”এর পংক্তিগুলোয় সেটা স্পষ্ট। সারকথা এই যে গীতার সার্বভৌম ধর্ম
আমার ধর্মকেও নিজের করে নিয়েছে এবং সেটাকেও সার্বভৌম করে দিয়েছে। এটাই তো আমার বেদান্তের
আসল অদ্বৈতবাদ। একটা সময় ছিল যখন গীতায় আমি সঙ্কুচিত মুক্তির পথ দেখতাম, নিষ্ক্রিয়
বেদান্তবাদ এবং অধ্যাত্মবাদের ঝলক পেতাম। কিন্তু আজ এ সমস্তকিছুই ব্যাপক এবং সার্বভৌম
হয়ে গেছে, পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে পড়েছে। একটা
সময় ছিল – এমনকি আজ থেকে ছ’বছর আগে অব্দি – যখন আমার অভিমত ছিল যে মার্ক্সবাদে আমার
মত গীতা-প্রেমীর স্থান নেই। মার্ক্সবাদের সাথে গীতাধর্মের কোনো মিল নেই – বিরোধ রয়েছে!
কিন্তু আজ? আজ সে চিন্তা স্বপ্নের বস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং আমার অভিমত শুধু এটুকুই
নয় যে মার্ক্সবাদের সাথে গীতাধর্মের কোনো বিরোধ নেই; আমার জ্ঞাতানুসারে গীতাধর্ম মার্ক্সবাদের
পোষক। আমার মতে, সাচ্চা মার্ক্সবাদীরা ছাড়া আর কারা গীতার “সর্বভূতাত্মভূতাত্মা” এবং
“সর্বভূতহিতেরতাঃ” হতে পারে? একমাত্র তারাই তো সমগ্র মানবসমাজের এমনভাবে পুনর্নির্মাণ
করতে চায় যাতে একজনও মানুষ দুখী ও পরাধীন না থাকে, সমুন্নত হওয়ার সমস্ত সাধন থেকে বঞ্চিত
না থাকে।
নিঃসন্দেহে, শুরুতে গীতার যে অর্থ আমি বুঝেছিলাম এবং যে অর্থ অনেকদিন অব্দি আমার
ভিতরে ছিল, সে অর্থ ঠিক সেভাবেই বদলেছে যেভাবে জীবন সম্পর্কিত অন্যান্য ধারণাগুলোর
আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। জীবনের
চল্লিশটা বছর পেরোলেই ভাবনাগুলোয় স্থায়িত্ব আসে এবং পরিপক্ক হয়। ফলে যখন আমি পিছনে
তাকাই তখন সেই পশ্চাদ্মুখী জগতটা দেখে বিস্মিত হই আর আনন্দিত হই যে ভালো হয়েছে রেহাই
পেয়েছি।
[স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী রচিত ‘গীতারহস্য” গ্রন্থের ভূমিকার একাংশ। ১লা জানুয়ারি
১৯৪২ সালে সেন্ট্রাল জেল, হাজারিবাগে বসে লেখা।]
No comments:
Post a Comment