শেষ রক্তরাগ, রাজপথের খাড়া উঁচু গাছগুলির চুড়োয়। নিচে চৈত্রের অন্ধকার জড়িয়ে ধরছে গুঁড়ি। ছেঁড়া, ফ্যাকাশে কাপড়ে এক অতিশীর্ণ বৃদ্ধা, হাতে একটা পুঁটলি নিয়ে আসছিলেন; হঠাৎ হোঁচট খেয়ে ঠিকরে পড়ে গেলেন ফুটপাথের ওপর। ক্ষীণ ঝনঝন শব্দে শিশি বা কাঁচের জিনিষ ভাঙবার শব্দ শোনা গেল।
এগিয়ে কাছে যেতে
দেখলাম বৃদ্ধা উঠে বসেছেন আর কী যেন কুড়োচ্ছেন দ্রুত। ঝুঁকে অন্ধকারে তীব্র একটা
সুগন্ধ পেয়ে ঠাহর করে দেখলাম পাথরের ওপর তরল কিছু একটা ছড়ান। বুঝলাম তেল, সুগন্ধী
তেল। পাথরের খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে পড়ছে আর ধুলোয় শুষে যাচ্ছে। অদূরে রাস্তার আলোগুলো
জ্বলে উঠেছিল। আলো মানে সাবেক টাংস্টেন বাল্ব – ঘটনাটা ১৯৭৬এর। সে আলোয় চকচক করছিল
কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলি।
বৃদ্ধার বাঁ হাঁটু
কেটে গিয়েছিল। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল ফোঁটা ফোঁটা। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ না করে
তিনি হামলে পড়েছিলেন তেলের ওপর। দু’হাতে কাচিয়ে তুলছিলেন ওই মাটিমাখা তেল আর মাথায়
মুছে চলেছিলেন। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছিলেন কিছু। ব্যস্তভাবে হাত বাড়িয়ে
থামাচ্ছিলেন পাথরের খাঁজে খাঁজে বয়ে চলা তেলের ক্ষীণ ধারাগুলি। জরাগ্রস্ত দু’হাতের
ত্বক শুকিয়ে ফেটে আঁশ হয়ে গেছে – হাল্কা আলোয় তা তুষারের মত চকচক করছিল।
কী ঘটছে চোখের
সামনে দেখতে পেয়েও আমি অভ্যাসবশতঃ জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল?”
শরীর রুগ্ন, চুল
হলদেটে সাদা, সিঁথির কাছটা ফাঁকা – বৃদ্ধা মাথা না তুলেই বিড় বিড় করে উঠলেন, “খুব
দামী তেল ছিল! ঠান্ডা তিল তেল, পুরো এক টাকার।…সেই কোন
বাজার থেকে ফিরছি! কোথাও কিছু হল না আর এখানে এই ফাঁকা রাস্তায়…! চোখে দেখতে পাই
না ভালো করে। এত দামী তেল! অসুস্থ মানুষ!”
হাতদুটো একবারের
জন্যও তেল কাচানো থামায় নি। আমি ওনার পিছন থেকে পাথরটা (যেটায় হোঁচট খেয়ে বৃদ্ধা
পড়েছিলেন) তুলে পাশে ফেলে দিলাম। কাঁচের টুকরোগুলো দেখে দেখে তুলে মুঠোয় করে
রাস্তার কিনারে ফেলতে ফেলতে বললাম, “উঠে পড়ুন এবার। আর তোলা যাবে না ওই তেল। লাভের
মধ্যে হাতে কাঁচ ফুটে…”
আমার কথা শেষ না
হতেই উনি একবার শিউরে উঠে বাঁ হাতটা নিজের চোখের
সামনে আনলেন। দেখলাম করতলে একটা গভীর ক্ষত, তা থেকে রক্ত
আর তেলের বুদবুদ বেরিয়ে আসছে। কড়ে আঙুলের কাছে দেখা যাচ্ছে কাঁচের টুকরোটা। বৃদ্ধা
আমার দিকে এগিয়ে দিলেন হাতখানি। “দেখ তো, এখনো লেগে আছে নাকি কাঁচটা!” দিনের
ব্যস্ততায় কাউকে সময় জিজ্ঞেস করার মত করে কথাটা বলে প্রথমবার চোখ তুললেন।
সহজ ও স্থির দুটো চোখ।
অসহায়, কাতর বা অস্থির কোনো ভাব নেই। যেন এসব তো লেগেই আছে রোজকার!
ক্ষতস্থানে হাত দেবার আগে এক
মুহূর্তের দ্বিধা!… গরম রক্তের নিজস্ব একটা প্রভাব পড়ে শরীরে – একটা জান্তব শিহরণ
জাগে।
হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম ওনার, বসে থাকা ছোট্ট শরীরের কাছে
আসতে।
হঠাৎ মনে হল, জরা ও ব্যাধিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও কত দুর্মূল্য
এই রক্ত! এই ক’ফোঁটার মানে হয়ত নাতিটার রুজিরুটির কোনো ব্যবস্থা হল কিনা দেখে যেতে
পারা, কর্পোরেশন বস্তি ভেঙে দেওয়ার পরের মাঘী-রাত কয়েকটি টিঁকে দেখে যেতে পারা যে
নতুন কোনো ঘর খাড়া করা গেল কি না কোথাও!…
ক্ষতস্থানটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরখ করে বললাম, “না, কাঁচ নেই”। কড়ে
আঙুলের কাছে লেগে থাকা কাঁচের টুকরোটা ফেলে দিলাম। শেষে রক্তস্পর্শে জেগে ওঠা এক
দুর্বোধ্য আত্মীয়তার পুরো জোর খাটিয়ে বললাম, “অব উঠ্ যা মাই!” কিন্তু বৃদ্ধা কোনো
উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে আবার ঝুঁকে পড়লেন তেলের ওপর।
তাঁর মুখে কোনো কথা ছিল না। তবু ওই, মাথায় তেল বোলানো দেখে
মনে হল বৃদ্ধা যেন নিজের আশি বছরের, নানা অশান্তি ও দুর্যোগ ভোগা শরীরটাকে বলছেন,
“নে রে অলক্ষুণে নে! যেটুকু পারিস এর থেকেই নে। কত কি যে দাবী করিস দিনরাত!
কোত্থেকে মেটাবো আমি!”… বোধহয় সবারই এমন হয়। বয়স বাড়লে শরীরটা শরীরেরই ভিতরে এক
প্রতিপালিত অসুস্থ জন্তু হয়ে কখনো ঘ্যানঘ্যান কখনো চাপা গরগর করতে থাকে সারাটা
সময়। আমি যদি ওই বয়সে আদৌ পৌঁছই তখন এদেশের স্বাধীনতার বয়স কত হবে?
আর তেল কাচাতে না পেরে বৃদ্ধা এবার নিজেই ওঠার তোড়জোড়
করছিলেন। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু হাত ধরলেন না তিনি। করতলের ভরও দিলেন না
মাটির ওপর। রক্তমাখা বাঁ হাতে পুঁটুলিটা ধরে, হাঁটুর ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে উঠে
দাঁড়ালেন। তেলজবজবে ডান হাতটা আলগা করে সামনে ধরে রাখা। মাথায় আর মুছবার জায়গা
নেই। কপাল বেয়ে চুঁইছে তেল আর মাটি। তবু, বোধহয় কোনো নাতির ছোটো মেয়ের
অনেকদিন-তেল-না-পড়া রুক্ষ মাথাটা মনে পড়েছে!
বৃদ্ধা দাঁড়াতে তাঁর মাথাটা আমার বুকের কাছ অব্দি এল। তৈলাক্ত
হয়ে চকচক করছিল দূর থেকে ভেসে আসা আলোয়। সুগন্ধের ঝোঁকাটা তীব্র হয়ে নাকে এসে
লাগল।
প্রথম বসন্ত কবে এসেছিল এই শরীরে! এই হলদেটে সাদা মাথাটা তখন
আরেকটু উঁচু, আরেকটু বড় আর কালো ও সতেজ। এই রাজপথে তখন এঁর বা এঁর কোনো
পূর্বপুরুষের ছায়াও পড়েনি। হয় কোনো গ্রামে অথবা শহরের পুরোনো দিকের কোনো পাড়ায়
কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে উঠছেন! এই রাজপথ তখন আরো সরু। হয়তো পাথরবসানো। ইংরেজ
রাজপুরুষদের বাংলো আর সরকারি দপ্তরের মাঝ দিয়ে ফিটন আর ঘোড়ার শব্দে মুখর! মোহনদাস
করমচাঁদ গান্ধী নামের মানুষটি তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেছেন। সুরাটে আছেন নাকি
মোতিহারিতে এসেছেন!…
তখন কত দাম পড়ত আধশিশি সুগন্ধী তিল তেলের?
আমি তখন কত পেতাম দিনে, রোজগেরে জোয়ান থাকলে? কারো মাথা
নিশ্চই থাকতো আমার বুকের এত কাছে? সে কে? এমনই তো হত তার বয়স, এখন!
অন্ধকারে, তীব্র মাদক সুগন্ধের এক অদৃশ্য গুল্মের মধ্যে আমায়
দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধা, ডান হাতটা সামনে প্রসারিত রেখে ধীরে ধীরে চলে গেলেন।
No comments:
Post a Comment