নিজের কাউন্টারে বসে লগ-ইন করতেই অসিতদার
ফোন পেল তরূণ, “একটা কাজ করে দিবি?”
- বলো!
-আজ বুধবার। পার্টির কাগজটা এসে যাবে। তুই
বিকেলের দিকে এলসি-অফিসে গিয়ে ওগুলো পৌঁছোবার ব্যাবস্থা কর। আমি একটা অন্য কাজে
ফেঁসে আছি।
- কিন্তু আমি তো ...
- আমি যেখানে বসি তার সামনেই রাখা থাকবে
কাগজগুলো, দু’শো ষোলোটা, আর আমার চেয়ারের ডানদিকের ড্রয়ারে পেয়ে যাবি
ডিস্ট্রিবিউশনের লিস্ট। লিস্ট দেখে বান্ডিল করে সতেরোটা ব্রাঞ্চে বিলি করা...
- সতেরো...
- তার মধ্যে একটা তো তোরই ব্রাঞ্চ। আর একটা
আট নম্বর ব্রাঞ্চ, ওদেরকে পৌঁছতে হবেনা, ওরা নিজেরাই এসে নিয়ে যায়। আর একদিনে তো
বলছিনা। আজ কিছু কর, কিছু কালকের জন্য রাখ। পারবিনা?
ওই একটা শব্দে খাড়া হয়ে উঠলো তরূণ। অসিতদাকে
‘পারবোনা’ বলার জন্য ও পার্টির প্লেজ ভরেনি।
পাশের কাউন্টারে জয়তীকে বলে রাখলো, “আমি আজ
একটু আগে বেরুতে চাই ম্যাডাম, সাহায্য করবেন তো?”
মেয়েটি ওর থেকে বয়সে বেশ ছোটো, কিন্তু
অফিসার, ছ’মাস হল জয়েন করেছে। তাই প্রথম দিকে জয়তী বলে ডাকা শুরু করলেও পরে
ম্যাডাম বলে একটা সম্ভ্রমের দুরত্ব তৈরি করে নিয়েছে। মেয়েটি বলতে পারতো কিছু,
কিন্তু বলেনি। এমনিতেও, তরূণ দেখেছে, মেয়েটি সবার থেকেই একটু দূরত্ব বজায় রেখে
চলে। তবে কাজে চৌখস আর সৎ। কে জানে সাহায্য করবে কিনা! আগে কখনো এমন অনুরোধ করতে
হয়নি।
মেয়েটি ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়। ঈষৎ হেসে ছোট্টো
করে সায় দেয়।
বিকেলের দিকে বলে উঠতে যাবে, ডাক শোনে, “লগ
আউট করে যান!”
- যদি আপনার প্রয়োজন হয়?
মেয়েটি হেসে ফেলে, “তাহলে তো পাসওয়ার্ডটাও
দিয়ে যেতে হবে!”
- ওহ শিওর, লিখুন... (এটুকু রিস্ক তো নিতে
হবে, আর মেয়েটি বিশ্বাসযোগ্য বলেই চিনেছে এতদিন)
দু’ঘন্টা সময় আছে হাতে। এলসি পৌঁছতে পৌঁছতে
আর কাগজের বান্ডিল বাঁধতে বাঁধতে রইল দেড় ঘন্টা। অবশ্য নেতারা প্রায় সবাই সাড়ে ছটা
সাতটা অব্দি থাকবেনই। নিজের ব্রাঞ্চের বারোটা ছাড়া আরো নয়টা ব্রাঞ্চের বান্ডিল
ব্যাগে ভরে নিল। ব্রাঞ্চ-৮ সবচে’ বেশি, ছেষট্টি, কিন্তু ওরা তো নিজেরাই এসে নিয়ে
যাবে, অসিতদা বলেছেন।
অফিসপাড়ার রাস্তায় এখন ভীড় কম। ভীড় সব
অফিসগুলোয়। এলসি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরল। ব্রাঞ্চ-৭টাই সবচেয়ে দূরে। বেশ
কিছুটা ফুটপাথ ধরে গিয়ে তেমাথায় সামনের রাস্তা ধরে আরো খানিকটা। তারপর নতুন তৈরি
সাততলা। আগুনে পুড়ে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে। এক কোণে ইউনিয়নের ঘরে কেউ নেই, তবে
দরজাটা খোলা। বাইরে জিজ্ঞেস করলো, “কেউ নেই?”
- পাঁচ তলায় গেছে। পেপার তো? রেখে দিয়ে যান
ভিতরে, টেবিলে। বলে দেবো।
পাঁচ তলায় মানে কিছু কথাবার্তা চলছে
ম্যানেজমেন্টের সাথে, দেরী হবে। সাত লেখা বান্ডিলটা রেখে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে
মোবাইলে ধরল অধীরদাকে। আস্তে, হাত চাপা গলার আওয়াজ, “বলো তরূণ!”
- পেপারটা রেখে দিয়ে গেলাম।
- কেন, অসিত?
- ও অন্য কাজে ব্যস্ত আছে।
- ঠিক আছে।
এরপর? ব্রাঞ্চ-১১। ফিরতি রাস্তায় বাঁদিকেই,
রাস্তা পেরুতে হবেনা। পুরোনো দোতলা বাড়ি। ঠিক হেরিটেজ নয়, তবে পুরোনো নকশাকাটা
হলদেটে বাড়ি আর সবুজ জানালা, কাঠের জাফরি। শুধু মেন গেটটা কাঁচের, ঢোকার মুখে
পিতলের ছোটো থামে শিকল লাগিয়ে সাজানো। ফুলের টব। ঢোকার মুখে সিকিউরিটি, “কাস্টমার
আওয়ার তো শেষ হয়ে গেছে স্যার!”
- আরে না, আমি কাস্টমার নই, অর্ধেন্দু বোস
আছেন?
“ও আচ্ছা, হ্যাঁ নিশ্চয়ই” বলতে বলতে দরজাটা
খুলে ধরলো।
বাপ রে, কী ঠান্ডা, এত বেশি কেউ এসি চালায়?
অর্ধেন্দুদা নিজেই উঠে এলেন ওকে দেখে,
“তুমি তরূণ না! অসিত তোমার ঘাড়ে চাপালো কাজটা! ও নিজে কোথায়?”
- কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
- এস, এস, তুমি প্রথম এলে এই অফিসে, চা না
খাইয়ে যেতে দিচ্ছিনা।
নিজের টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে নিচের
ক্যাবিনেট থেকে বিস্কুটের বোয়াম বার করলেন, “আমার তো এসিডিটি, তাই রাখতেই হয়। নাও,
খাও।”
ব্রাঞ্চ-৩এ যাওয়া মানে অনেক সিকিউরিটির
ঝামেলা। কারো নাম টাম চলবেনা। ফোন করলো শিশিরকে। ওর সমবয়সী, পাড়ার ছেলে, বন্ধুও,
বিশ্বাস করা যায়, “একবার গেটের কাছে নেমে আয়না, একটা কাজ আছে।”
ভালো হল। পৌঁছোতে পৌঁছতে দেখলো শিশির গেটের
কাছে দাঁড়িয়ে ওকে খুঁজছে।
- কী হল?
- সায়ন্তনী মুখার্জিকে চিনিস?
- হ্যাঁরে ভাই, ওনাকে কে না চেনে।
- এই বান্ডিলটা ওনাকে দিয়ে দিতে হবে,
পারবি?
- পার্টির কাগজ! তুই বিলি করিস?
- না। এ সপ্তাহে করছি, যিনি করেন তিনি অন্য
কাজে আছেন। দিবি তো?
- নিশ্চয়ই।
এরপর ৫, ৬, ১০, ১২, ১৩, ১৫। সব দিয়ে যখন
ছুটি হল তখন সাতটা। ঝোলায় শুধু নিজের ব্রাঞ্চেরটা পড়ে আছে। দড়ি খুলে দুটো কাগজ বার
করে রাখলো। নিজের আর অনির্বাণের। অনির্বাণের বাড়ি ওর পাড়ার একটু আগে। স্টপেজে নেমে
একটু পিছিয়ে যেতে হয়। মনের শান্তিতে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তরুণ, পরের খালি বাসটা
ধরলো।
অনির্বাণের দরজায় টোকা দেওয়ার আগেই দরজা
খুলে গেল। অনির্বাণের কোলে ওর মেয়ে। পিছনে ওর স্ত্রী।
- কী হল রে?
- ওকে নিয়ে যাচ্ছি ক্লিনিকে। দুপুর থেকে
শুরু হয়েছে ডাইরিয়া। ওআরএস ফোআরএস চালাচ্ছি কিন্তু মনে হচ্ছে ড্রিপ চাই। যাই, আগে
ডাক্তার দেখুক!
- তন্দ্রাও যাচ্ছে নাকি?
- ও গেলে আবার ছেলেকে কে দেখবে?
- বেশ, চল আমি যাচ্ছি সঙ্গে।
রাত দশটা বেজে গেছে। মেয়েটার ড্রিপ চলছে।
অনির্বাণকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছেনা। বাড়িতে একটা ফোন করলো, “হ্যাঁ, শোনো, সরি,
আমি রাত্রে আসছিনা... পাড়াতেই আছি। অনির্বাণের মেয়ের ড্রিপ চলছে ক্লিনিকে।
ভোরবেলায় আসবো।”
রাত দুটোয় ঝিমোতে থাকা তরূণ আড়চোখে দেখলো অনির্বাণ হাত বাড়িয়ে ওর
ঝোলা থেকে নিজের কাগজটা বার করে নিচ্ছে। মেলে ধরে পড়ছে অন্যমনস্কভাবে।
ভোরবেলায় ঝিমোতে ঝিমোতে বাড়ি ফিরলো তরূণ।
দরজা খুললো মানসীই। ওদের বিয়ে একটু দেরিতেই হয়েছে। গত বছরই মানসী তার ঘরে এসেছে।
- হঠাৎ অনির্বাণদার বাড়ি তুমি পৌঁছোলে কী
করে? উনি ফোন করেছিলেন?
- না, কাগজ দিতে গিয়েছিলাম।
- কিসের কাগজ?
মানসী এখনো ওর প্লেজ ভরার কথাটাই জানেনা।
তারপর কাগজ বিলি। বলবে? হ্যাঁ, বলেই ফেলা উচিৎ। এইরকম একটা বিকেল, সন্ধ্যা, রাত তো
আরো আসবে জীবনে!
২১.৭.১৭
No comments:
Post a Comment