ওফ্,
এ আরেক ঝামেলা! অফিসিয়াল চিঠি – সেটা ডাকে পাঠাতে কী হয়েছিল? এই যে ম্যাডাম… কী যেন নাম আপনার? নিবেদিতা! এই ইমেলটার প্রিন্ট বার করব কী করে?
বক্তা
ও শ্রোতার মাঝে বয়সের ফারাক চল্লিশ বছরের। কাজেই প্রায় একটা দাদু-নাতনি গোছের
সম্পর্ক এসে পড়তে চায়। কিন্তু বক্তা সেটা চান না। তাই, ছোট্টো খাট্টো মিষ্টি
মেয়েটিকে তুই বলে ডাকার ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও ডাকেন না। জানেন, কর্মজীবন আর বেশী
দিনের নয়। মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? তাও আবার এটা বাড়তি – অবসরগ্রহণের পর।
শ্রীবাস্তব এসে বলেছিল, কী করবেন শিকদারবাবু
বসে বসে? তার চেয়ে বরং আমার সংস্থাটায় এসে কিছু কাজ করুন! একাউন্টেন্টের পোস্টটায়
আপনার থেকে বেশী যোগ্য আর ভরসা করার মত মানুষ আমার চোখে আর কেউ এ মুহুর্ত্তে নেই। যদিও
পনেরো হাজারের বেশী এখন দিতে পারবো না।
অবসরগ্রহণের
পর সত্যি বলতে প্রিয়রঞ্জন শিকদারের সময় কাটছিলো না। কাজ একটা খুঁজছিলেন। একটা
ফাইনান্স কোম্পানির অফার রিজেক্ট করেছিলেন, কেন না কাজটা ছিল সেলসের। ওসব সেলস
প্রমোশন কোনোদিনই তাঁর ধাতে সয়নি। শ্রীবাস্তবের সংস্থা মানে একটা এন.জি.ও.। কাজটা সেই একাউন্টসের, যা তিনি সারাজীবন করতে অভ্যস্ত।
তার ওপর এন.জি.ও. কী জিনিষ, সেটাও একটু জানতে
পারবেন হাতে কলমে, তাই হয়তো মন লাগবে বেশী। আর শ্রীবাস্তব মনে হয় বেশী ছড়ি ঘোরাবে
না ভবিষ্যতে, কেননা জানে যে যে কোম্পানিটা ডেকেছিলো তারা প্রথমেই কুড়ি অফার
করেছিলো।
অফিসে
সাকুল্যে আটজন লোক। তার মধ্যে তিনজন বেশীর ভাগ সময় ফিল্ডে থাকে। সর্বক্ষণের
সহকর্মী বলতে এ্যাকাউন্টেন্ট প্রিয়রঞ্জন শিকদার,
ম্যানেজার কুশল প্রসাদ, দুজন প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর সুমন কুমার আর সুধাংশু
সিং আর এই নতুন ডক্যুমেন্টেশন অফিসার নিবেদিতা যাদব। সবচেয়ে বয়স্ক শিকদার আর
সবচেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ নিবেদিতা, দুজনেই এই অফিসে সবচেয়ে নতুন। নিবেদিতার দুমাস হয়েছে
আর শিকদার তো এখনো প্রথম মাসের, মানে আট জুলাই থেকে একত্রিশ অব্দি, চব্বিশ দিনের
মাইনে ওঠান নি। আজ দশই আগস্ট। শ্রীবাস্তব বলেছে আগামীকাল চেক জমা পড়বে ব্যাঙ্কে।
বন্ধ কাঁচের সাকুল্যে একটা জানলা দিয়ে দেখা যায় ভালোরকম বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ছাতের
নোংরা জল জানলার গায়ে লেগে লেগে মোটা দড়ির মত নামছে।
নিবেদিতা
নিজের জায়গা থেকেই বলে, “ওখানেই ওপরে ডানদিকে দেখুন না ছোট্টো একটা প্রিন্টারের
আইকন। ওটাতেই ক্লিক করুন!”
-তিনবার
ক্লিক করলাম! আপনার টেবিলেই তো প্রিন্টার! কিছু বেরুলো?
-দেখি!
(নিবেদিতা উঠে এসে নিজে করতে গেল) আরেঃ, তিন বারই আপনি পি.ডি.এফ.এ সেভ করেছেন। এই দেখুন, প্রিন্টের পেজটা খুলে এখানে বাঁদিকে সেভ এ্যাজ পি.ডি.এফ.টার নীচে দেখুন প্রিন্টারগুলোর নাম – ক্যানন লেজারজেটটা
নিয়ে আসুন অপশনে। (নিয়ে আসে) তারপর প্রিন্ট কম্যান্ড দিন। (নিজেই দেয়)
-কই,
তাও তো হল না!
ছোট্টো
শ্যামলা মুখটায় চিন্তার ভাঁজ জাগে। শিকদার ভাবেন তাঁর ছেলের বৌ হিসেবে এই যাদব-দুহিতা
মন্দ হত না। তবে এধরণের বিয়ে তো আর সম্বন্ধ করে হয় না! ছেলে থাকে দামনে। সেখান
থেকে সে বৌ ধরে আনবে কিনা, কোথাকার বৌ ধরে আনবে কে জানে!
-(নিবেদিতা
ডাকে সুধাংশু সিংকে) সুধাংশুজী! এই টার্মিনালটা সেদিন বদলানো হল না?
-সেদিন
মানে?
-মানে,
দিন কুড়ি আগে?
-হ্যাঁ!
সি.পি.ইউ.টা শুধু।
শিকদারের
সামনে ঝুঁকে মেয়েটি মাউজ নিয়ে কী কী করতে থাকে। শিকদার উঠে দাঁড়ান।
আপনি বসুন। এখানে বসে করুন কাজটা।
মেয়েটার
মুখ লাল হয়। সাহেবের চেয়ারে বসবে কী করে? শিকদার বোঝেন। তাই জোর দিয়ে বলেন, “আঃ
বসুন তো! অত ফর্মাল হতে হবে না। পিঠ ধরে যাবে ওভাবে ঝুঁকে কাজ করতে। বসুন! বসুন!”
মেয়েটা বসে পড়ে। একটু পরে উঠে যায় নিজের
টেবিলে। আবার কিছু করে।
-এবার
দিন স্যার!
শিকদার
প্রিন্ট দেন। নিবেদিতা প্রিন্টটা হাতে করে নিয়ে আসে।
-কী
হয়েছিল কী?
-এই
টার্মিনালের নামটা ভুল দেওয়া ছিল, মানে আগেরটা দেওয়া ছিল।
প্রিন্টটা
একটা ফাইলে রাখতে রাখতে শিকদার বলেন, “তাহলে এটা তোমার এক্সট্রা কাজ!”
-কী
কাজ?
-এই
যে, কম্পিউটারের সমস্যাগুলো মেটানো।
-এটা
আবার কোনো কাজ নাকি?
ওদিক
থেকে সুমন কুমার বলে ওঠে, “কাজ তো বটেই! আপনি না থাকলে ঐটুকু কাজের জন্য লোক ডাকতে
হত। পাঁচশো খানেক টাকা বেরিয়ে যেত।”
কুশল
প্রসাদ বলে ওঠেন, “বেরুলে ভালো হত। কাজের টাকা কাজের লোকের হাতে যেত। বেচারি এই
মেয়েটিতো এক পয়সাও পাবে না এর জন্য!”
বাকি
থাকে সুধাংশু সিং। আস্তে করে ফুট কাটে, “শিকদারবাবু তো আমাদের শ্রীবাস্তবসাহেবের
বন্ধুস্থানীয়। রিকমেন্ড করতেই পারেন, নিবেদিতাজীর মাইনে আট থেকে বাড়িয়ে দশ হাজার
করার জন্য!”
শিকদার জবাব দেন না। সব সময় সব কিছুর জবাব
দিতে নেই।
সামনের
অফিস থেকে বুড়ো জীবন ঘোষ চা’য়ের কেটলি আর গেলাসের ক্রেট নিয়ে এই অফিসে ঢোকেন। “আঃ,
কী সময় মত এলেন ঘোষদা!” সুমন চেঁচিয়ে ওঠে, “হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আমার এই এয়ার
কন্ডিশনে। এরা কী করে সহ্য করে এরাই জানে!”
নিবেদিতা
ইশারায় ডাকে, “আমাকেও চা দেবেন আঙ্ক্ল্জী!”
-আঙ্ক্ল্জী!
আরে উনি ইউনিভার্সাল ঘোষদা! সামনের অফিসে সি.ডব্লিউ.সি.র বড়সাহেবও ওনাকে ঘোষদা বলে ডাকেন। কত বয়স হল আপনার ঘোষদা?
-(ঘোষদা
জবাব না দিয়ে একটা নোটবুক খুলে এগিয়ে ধরেন) আটাত্তর টাকা বকেয়া পড়ে গেছে আপনার
সুমনবাবু!
-এঃ,
চায়ের মিষ্টিটাই মেরে দিলেন আপনি ঘোষদা। দিয়ে দেব, মাইনেটা পাই আগে! তা বলুন না
আপনার বয়স কত হল?
সুধাংশু
ধমক দেয়। “কেন ফালতু কাঠি করতে থাকিস? যান, ঘোষদা। আর এ ব্যাটা পয়সা না দিলে আমাকে
বলবেন, মাসের শেষে।”
নিবেদিতা
হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেন সুধাংশুজী? বয়স জানতে চাইলে কী উনি রেগে যান?”
আরে
না, তাতে রাগেন না। ওনার একটা হিসেব আছে যে রাজীব গান্ধী যে বছর মারা গিয়েছিল সে
বছর উনি ষাট পেরিয়েছিলেন। আর এটা বললেই এই ব্যাটা সুমন শুরু করবে, ∙∙∙বলতে গিয়ে আপনার মুখটা দুঃখ দুঃখ হল কেন? রাজীব গান্ধী
আপনার কে হয়? ইন্দিরা গান্ধী আপনার কে হয়∙∙∙ ব্যাস্ ফায়ার হয়ে যান ভদ্রলোক! শুরু হয়ে যায় পলিটিক্যাল স্পীচ! দেশকে
ডোবালো ওই নেহরু আর তার বেটি ইন্দিরা আর তার
দুই নাতি রাজীব আর সঞ্জয়!∙∙∙ জানিনা কিসের রাগ!”
শিকদার
বলেন, “রাজীব গান্ধীর হত্যা! সে তো বোধহয় একুশে না বাইশে মে, উনিশ শো একানব্বই।
লোকসভা ভোটের একটা পর্ব বাকি ছিল! তার মানে ওই ঘোষদার বয়স এখন বিরাশি বছর! আর
দিব্যি সাত তলা অব্দি ঘোরাফেরা করে চা বিক্রি করে চালিয়ে যাচ্ছেন! গ্রেট!” মাথা
তুলে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে সেই ঘোষদা।
-আমি
তো চা খাই না আপনি জানেন! তা, আপনার বয়স বিরাশি বছর? আর এই অফিসে অফিসে চায়ের
যোগান দেওয়া রোজ! আপনার ছেলে মেয়ে? একটা দোকানটোকান করেননি নিজের?
-(হাসেন,
মুখটা সৌম্য দেখায় হাসিতে) আছে একটা। ছেলে বসে ওতেই। আমি বুড়ো মানুষ, কী করবো? বসে
বসে হাড়ে খিল ধরে যাবে। এটাই ভালো। সচল থাকি সারাদিন। কিছু পয়সাও আসে!
-(শিকদার
গলাটা আস্তে করেন, যদিও বাঙালি আর কেউ নেই অফিসে) যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা
জিজ্ঞেস করবো?
-কী?
-আপনি
কি পার্টি-টার্টি করেন?
-সে
কি! কেন?
-না,
ওই যে ওরা বললো যে রাজীব-ইন্দিরার নাম শুনলে আপনি∙∙∙
-হুঁহ্।
শাহীপরিবার! (যেতে উদ্যত হয়ে, হাসলেন) বুড়ো মানুষের রসিকতা ধরে নিন! আমি ক্ষেপা
ভাব দেখালে ওরা আনন্দ পায়! (ফিরে, ঝুঁকে পড়লেন টেবিলের ওপর) একটা কথা বলুন তো!
নিরক্ষর গরীব মানুষ প্রতারণা করেছে, শুনেছেন কখনো? (শিকদার বুঝতে না পেরে
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন) গরীব মানুষ খুব বেশী হলে চুরি করে, সিঁধ কাটে, ডাকাতি
করে নয়তো গলা কাটে। এসবের চৌহদ্দি আর কতটুকু?∙∙∙ ফ্রড, চিটিংবাজি, জাল, দুর্নীতি - এসব করেই লেখাপড়া জানা লোকেরা শাসন
চালিয়ে যাচ্ছে পঁয়ষট্টি বছর ধরে! বুদ্ধিজীবীদের দল! গরীবের সাথেও করে, নিজেদের
মধ্যেও করে আবার দেশের সাথেও করে। সাহেবদের বাচ্চাকাচ্চা সব।
-সে
ঠিক কথা হয়তো, কিন্তু শাহীপরিবার বলতে শুধু নেহরুপরিবার কেন? অনেক পরিবার আছে! এখন
তো পরিবারতন্ত্র আরো ছড়িয়ে পড়েছে! পলিটিক্যাল ফ্যামিলি, জুডিসিয়াল ফ্যামিলি, আই.এ.এস.ফ্যামিলি, ডাক্তার ফ্যামিলি∙∙∙
-সবের
শুরু ওখান থেকেই!∙∙∙ আচ্ছা, পরে কথা হবে। (বেরিয়ে গেলেন)
কুশল
প্রসাদের বয়স পঁয়তাল্লিশের মত। কম কথা বলেন। ঘোষদা বেরিয়ে যেতে মাথা না তুলেই
শিকদারকে বললেন, “একটা কথা কিন্তু আছে। ভালো করে কথা বললে বুঝবেন, মাঝে মধ্যে চাবুকের
মত এক-একটা যুক্তির আঘাত করতে পারেন ঘোষদা। পুরো ইতিহাস নখদর্পনে। চা বেচেন বলে
বোঝা যায় না। খুব নলেজেবল লোক।”
-অদ্ভুত
লোক!
-হ্যাঁ,
অদ্ভুত। কোনোদিন আর হয়তো আসবেন না চা দিতে। দুদিন পর খবর পাবো মারা গেছেন, তাই না?
“কিভাবে
মরবেন?” শিকদারের মাথায় হঠাৎ খেলে যায় প্রশ্নটা, “বৃষ্টির রাতে ছেঁড়া ইলেক্ট্রিকের
তারে জড়িয়ে?” বুঝতে পারেন না কেন তাঁর মনে এল এরকম একটা কথা।
একটু
পরে নিবেদিতা কম্পিউটার থেকে মুখ না তুলেই বললো, “হ্যাঁ স্যার, একুশে মে, উনিশ শো
একানব্বই।”
-আপনি
ইন্টারনেটে খুঁজলেন?
-হ্যাঁ।
-এ
একটা আজব জিনিষ! আজকাল তো যা চাও সব পেয়ে যাবে ইন্টারনেটে! কী লেখা আছে রাজীব
গান্ধীর হত্যার বিষয়ে? আচ্ছা, ওই সুইসাইড বম্বার ছিল যে মেয়েটি, তার নাম আছে?
-না
স্যার, ওভাবে খুঁজিনি। আমি ১৯৯১এ কী কী হয়েছিল, মানে মেজর ইভেন্টস, সেভাবে
খুঁজলাম।
আর কী কী আছে ওতে?
নিবেদিতা
কম্পিউটারে চোখ রেখে পড়তে শুরু করলো) বছরের শুরুতে ১৬ই জানুয়ারি কুয়েতের মুক্তির
জন্য ইউএন ফোর্সেসের ইরাক আক্রমণ, ২১শে মে রাজীব গান্ধী হত্যা, ১৪ই জুন ভারতে
নরসিম্হারাও সরকার তৈরি হল, ৬ই জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলা এ.এন.সি.র প্রেসিডেন্ট হলেন∙∙∙ কুশল প্রসাদ হেসে বললেন, “এই মেয়েটিরও জন্ম ১৯৯১এ, তা জানেন শিকদারবাবু?”
-ওমা,
তাই নাকি?
-এই
তো, ওর বায়োডাটা শীটটা ধরে আছি।
-কবে?
নিবেদিতা
ইষৎ লজ্জা পেয়েও স্মার্টনেস বজায় রাখলো, “খুব ইম্পর্ট্যান্ট দিনে স্যার, ৬ই আগস্টে।”
-কেন,
সেদিন কী হয়েছিল?
সুধাংশু
ফোড়ন কাটলো, “নিবেদিতা ম্যাডামের জন্ম হয়েছিল!” (লজ্জায় রাঙা হল নিবেদিতা) না
স্যার! আপনিও জেনে রাখুন সুধাংশুজী! পরে কাজ দেবে – জেনেরাল নলেজ। (কম্পিউটারে চোখ
রেখে পড়লো) সেদিনই টিম-বার্নার্স লী নামে একজন বৈজ্ঞানিক প্রথম দুনিয়াকে দেখালেন
এই ইন্টারনেটের সম্ভাবনা। ডব্লিউ.ডব্লিউ.ডব্লিউ. –
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবএর কন্সেপ্টটা নিয়ে এলেন।
-বাঃ,
এ তো দারুণ ঘটনা! জানতাম না তো! ওই বছরই? আর আজ ও ছাড়া গতি নেই!
-হ্যাঁ।
আর ওই বছরেই প্রথম ঘরে ব্যবহার করার মত পার্সোনাল কম্পিউটার দেখালো আইবিএম।
“আর
সোভিয়েত সঙ্ঘ ভেঙে গেল ওই বছরই”, শিকদারের মনেও হঠাৎ দুটো রাজনৈতিক তথ্য কে জানি
কেন উঠে এল, “নরসিম্হারাও সরকার নয়া অর্থনীতি চালু করল ওই বছরই”।
-ছয়ই
আগস্ট মানে তো চারদিন আগে। বাঃ, সেদিন মনে করালেন না কুশলজী। সেলিব্রেট করা যেত।
এনি ওয়ে ম্যাডাম, দেরীতেই সই, হ্যাপি বার্থডে। (বাকি সবাই শিকদারের কথার ধুয়ো দিল)
-থ্যাঙ্ক
ইউ।
* * * * * *
বিকেলের
দিকে হঠাৎ কাজের চাপ পড়ে গিয়েছিল। শ্রীবাস্তব এসেছিল একটা সুইডিশ ডোনার এজেন্সির
প্রতিনিধি দুজনকে নিয়ে। কাল ওদের সামনে একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে – একটা বড়
প্রজেক্ট হাতে পাওয়া যেতে পারে, পুরোটা বাগাতে পারলে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা।
শ্রীবাস্তব টেনশনে, আর পুরো চাপটা গিয়ে পড়লো বেচারি নিবেদিতার ওপর। পি.পি.টি.র কাজটা বাড়িতে নিয়ে গেল, রাতে বসে করবে।
শিকদার
বাড়ি ফিরলেন রাত ন’টায়। বাড়িতে স্ত্রী আর একটা কুড়িয়ে নেওয়া মেয়ে। কুড়িয়ে নেওয়াটা
কথার কথা, আসলে ছোটো ভাইয়ের মেয়ে। ছোটো ভাইয়ের এক ছেলে দুই মেয়ে, কষ্টের সংসার,
তাই ছোটো মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখেন। স্ত্রী তপতীরও সময় কাটে ওকে নিয়ে, আর তাঁরও
ঘরটা ফাঁকা মনে হয়না। বেশী বয়সে বিয়ের একমাত্র ছেলে তো সেই দামন - ছোটোবেলায়
স্কুলে পড়তেন, দামন, দিউ, দাদরা নগরহাভেলি∙∙∙ ছেলের কাছে এতদিনে একবারই যেতে পেরেছেন। ছেলের জিদ যে সে বিয়ে করবে একটু
ভালো চাকরী পেলে তবে।
তা সে
মেয়েও এখন নেই। দুদিনের জন্য মায়ের কাছে গেছে। সাত ক্লাসের জন্য দাদার পড়ার
বইগুলোও নিয়ে আসবে।
তিরিশ
বছর শিকদার কাজ করেছেন রাজ্য পাঠ্যপুস্তক পর্ষদের একাউন্টস সেকশনে। চাকরীজীবনের
শেষ বছরগুলোয় কম্পিউটারের সামনে আর কম্পিউটার জানা নতুন ছেলেমেয়েগুলোর সামনে শিশু
পড়ুয়া হয়ে কাটাতে হয়েছে। সূক্ষ্ম একধরণের অপমানবোধে আর গ্লানিতে ভুগতে হয়েছে মাঝে
মধ্যে। তাই যেটুকু কাজের প্রয়োজনে শিখতে হয়েছিল, অফিসের সফ্টওয়্যারটায় টিপটাপ
করা, তার বেশী শিখতে প্রবৃত্তি হয়নি। কিন্তু ছেলে নিজের প্রয়োজনে, বাপেরই পয়সায়
কিনেছিল একটা কম্পিউটার, সেটা পড়ে ছিল। অবসরগ্রহণের পর শিকদার উঠে পড়ে লেগেছেন
সেটা আয়ত্ত করতে। বই কিনেছেন, মাঝে মধ্যেই ছেলেকে ফোন করে বিরক্ত করেন। কিছুদিন
রোজ দশ টাকা খরচ করে বিকেলে সাইবার ক্যাফেতে বসতেন, এখন ছেলের কম্পিউটারেই কিনে
লাগিয়েছেন একটা ডাটাকার্ড।
“কী
অদ্ভুত জাদুর দুনিয়া! বুঝলে তপতী! কী যেন বলে? সাইবারস্পেস! যেন রাতের মহাশূন্যটা
দূর বহুদূর অব্দি চলে যাওয়া এক রাজপথ যার দুধারে ঝলমল করছে দোকান, বাজার, জাদুঘর,
গ্রন্থাগার, নানাদেশ, তাদের সময় আর মানুষজন, মাঝে মধ্যে চমকে দিচ্ছে ঘটনা। আর তাতে
হেঁটে নয়, ভেসে বেড়ানো∙∙∙ যখন যার সাথে ইচ্ছে কথা বলা, কথা পাঠানো∙∙∙ আবার আজকাল শুনছি দেশে দেশে নতুন যুবক-যুবতীরা রাজনৈতিক আন্দোলনও চালাচ্ছে
এই ইন্টারনেটের সাহায্যে!” ∙∙∙ ইদানিং নিজেওএকটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছেন। কোথাও নিজের
নাম/ঠিকানা লিখে দিতে হলে নিজের ইমেল আইডিটা দিতে ভোলেন না।
মাঝে মধ্যে তপতী স্বাভাবিক দুশ্চিন্তায়
ভোগেন – কী করছে, ওই অত দূরে কী খাচ্ছে দাচ্ছে ছেলেটি একা একা! শিকদার গুগল ইমেজে
গিয়ে বার করেন দামনের একটা রাস্তার দৃশ্য। একটা বাইক রাখা সামনে বাঁদিকে। তার
পিছনে একটা দোকানের দরজার সামনে রাখা জামাপ্যান্ট পরানো প্লাস্টিকের পুতুল। জীবন্ত
যেন! ডানদিকে কাছ থেকে দূর অব্দি বাড়ির সারি। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে বাঁদিকে বাঁক
নেওয়া রাস্তাটায় মানুষজন, নানা কাজে আসছে যাচ্ছে, খুব ভীড় নেই তাবলে। এসবেরই মধ্যে
কোথাও আছে তাঁদের সন্তান!∙∙∙ দিউএরও দৃশ্য বার করেন কম্পিউটারে। সেই যখন গিয়েছিলেন দামনে, ছেলে দিউ
শহরটাও ঘুরিয়ে দিয়েছিল বাবা-মাকে। কী সুন্দর! পর্তুগীজ শাসনের ইতিহাসের
ফিসফিসানিতে ভরা জায়গাটা। তার ওপর যেদিকে যাও সমুদ্র!
তপতী,
তোমার কিছু মনে আছে ১৯৯১এর কথা?
-কী
ধরণের কথা?
-মানে,
মনে রাখার মত, বড় ধরণের∙∙∙
-ওই
তো, বাবরি মসজিদ ভাঙলো।
-আরে
ধুৎ, সে তো বিরানব্বইয়ে, ৬ই ডিসেম্বর!
-বিরানব্বইয়ে?
তাহলে মনে নেই। হ্যাঁ, তার এক বছর আগে দেবুর টাইফয়েড হয়েছিল, মানে ওই একানব্বইয়েই
হবে। আর ডিসেম্বরেই সেরে উঠেছিল। আমি মানত করেছিলাম। এক বছর পর, তোমার সেই ছয়
ডিসেম্বরেই দ্বারভাঙ্গা কালীবাড়ি থেকে ফিরছিলাম বিকেলে হঠাৎ মছুয়াটোলির রাস্তা
দেখি সুনসান, পুলিসে পুলিসে ছয়লাপ∙∙∙ তারপর বেশ কিছুদিন কার্ফ্যু, দাঙ্গার ভয়, ভাগ্যিস কিছু
হয় নি সে সময় এখানে।∙∙∙
শিকদার
নিজের ইমেলটা খোলেন। অফিসেও একবার খুলেছিলেন। কিন্তু আজেবাজে ছাড়া কিছু চোখে
পড়েনি। এখন খুলে দেখলেন একটা সম্বন্ধ এসেছে ছেলের জন্য, এজেন্সি থেকে। মেয়েটি
নাসিকে কাজ করে। “বাঃ, ভালোই তো!” চেহারাটাও ভালো মনে হল ছবিতে। বাবা, মা থাকেন
কুজু, হাজারিবাগে। ছবিটা বড় করে তপতীকে ডাকতে গেলেন তখনই তপতী খেই ধরলো আগের কথার,
“আর, দাঁড়াও। ওই টাইফয়েডের সময়েই যোগেন্দরভাইয়ার বাবা এসেছিলেন একদিন সকালে,
দেবুকে দেখতে। মনে আছে? বড়েচাচার কথা?
-ফুলচন্দবাবুকে
মনে থাকবেনা কেন? তবে দেবুকে কবে দেখতে এসেছিলেন মনে নেই।
-মাঝে
মাঝেই তো আসতেন ওকে দেখতে। সুস্থ থাকতে কত খেলা করতেন ওর সাথে! তখন তো প্রতিবেশী
ছিলাম আমরা। মারাও গেলেন আমরা ওবাড়িতে থাকতেই, সে বোধহয় পাঁচ বছর পর।
-হ্যাঁ,
তো?
-তুমি
ওই ১৯৯১ জিজ্ঞেস করতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল। কী দৃষ্টি ছিলো তাঁর চোখে সেদিন!
-কী
বলছো, বুঝতে পারছি না।
-(তপতী
মনে করার চেষ্টা করতে থাকে) এলেন। দেবুকে কোলে নিয়ে দেখি হুহু করে কাঁদছেন। আমি
এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে বড়েচাচা? ওই নামেই তো ডাকতাম সবাই ওনাকে! কিছু
বললেন না। মুখে শুধু বিড়বিড় করছিলেন ‘এ কী হয়ে গেল! এ কী হয়ে গেল’!
-তারপর?
-চলে
গেলেন তক্ষুনি। পরে আমার বন্ধু মন্দিরা – ওই যে কম্যুনিস্ট পার্টির ওই খুব বড় নেতা
ছিলেন, কী নাম যেন, বলরামবাবু, তাঁর বাড়িতে ও ভাড়ায় থাকতো। বললো বড়েচাচা আমাদের
বাড়ি থেকে বেরোবার একটু পরেই নাকি গিয়ে পৌঁছেছিলেন তাঁর বাড়িতে। আর কী
চ্যাঁচামেচি। মন্দিরার কাছে শুনেছিলাম, বাহাত্তর বছরের ওই বুড়ো লোকটা হাউহাউ করে
কেঁদে বলছিল বলরামবাবুকে ‘কিচ্ছু করলেন না আপনারা। চোখের সামনে বিপ্লব ধুলিস্যাৎ
হয়ে গেল, আর আপনাদের সবক’টা নেতা নিজেদের ছেলেমেয়েদের মস্কোয় ডাক্তারি পড়াবার
ধান্ধায় লেগে রইলো! আঙুল তুলে একবার বলবার সাহস হলনা তাদের যে ‘কমরেড! ভূল করছেন
আপনারা!’ পেরেস∙∙∙ পেরেস∙∙∙ কী যেন একটা শব্দ খুব চলেছিল তখন বাজারে?
-দাঁড়াও,
মনে করি∙∙∙ পেরেস্ত্রোইকা?
-হ্যাঁ,
হ্যাঁ, আরেকটা?
-গ্লাসনস্ত?
-হ্যাঁ,
যে ‘কমরেড, একবারও মুখ তুলে বললেন না যে পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্ত আপনাদের ধ্বংস
করছে∙∙∙। আর সেদিনই নাকি বড়েচাচা
পার্টি বদল করে ফেললেন। তাতেই তো আমি জানলাম যে এখানে, বিহারে কম্যুনিস্ট পার্টিও
আছে আবার সিপিএমও আছে। আবার এমএলও আছে। আমি তো লখনৌএর মেয়ে∙∙∙
-বাঃ,
বত্রিশ বছর বয়সে আক্কেল দাঁত গজালো, আবার অজুহাত দেওয়া হচ্ছে ‘আমি লখনৌএর মেয়ে!’
যাক, তবু একটা কিছু বললে মনে রাখার মত ঘটনা।
কিন্তু
কিছু একটা আছে, যেটা মনে পড়ছে না, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কম্পিউটার বন্ধ করে এসে
তপতীর পাশে বিছানায় এলিয়ে পড়তে পড়তে মনে হল শিকদারের। ইন্টারনেটেও নেই, স্মৃতিতেও
নেই, তাহলে আছে কোথায়? সেই দুপুর থেকে, যখন থেকে ওই বুড়ো ঘোষদার সুত্রে
একানব্বইয়ের গল্প শুরু হয়েছে, তখন থেকে কথার পিছনে অন্য কোনো একটা কথা, ঘটনার
পিছনে অন্য কোনো একটা ঘটনা ঝিলিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না।
একানব্বইএর
ইলেকশনের সময় রেডিও-স্টেশনের পাশ দিয়ে ফিরছিলেন, প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের পোস্টার সাঁটানো ছিলো – ‘দেখুন, চল্লিশ বছরের আর চার
মাসের তফাৎ!’ সত্যি বলতে, তফাৎটা কারোর কাছেই খুব স্পষ্ট ছিলো না। একটাই কাজ হয়েছিলো
যে তাঁর মুখ দেখে ভি.পি.সিংএর সেই ব্যাকওয়ার্ড রিজার্ভেশনের বিরুদ্ধে হিংস্রতাটা
বোধ হয় একটু কমেছিল। নাকি, কমেনি, মনেও নেই। আর হ্যাঁ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সোনা
পাঠিয়েছিলেন ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডে। চল্লিশ বছর আর চার মাস, মানে চল্লিশ বছর আর
চার মাস –তফাৎ বলতে উনচল্লিশ বছর আট মাস! মনে আছে, হেঁটে হেঁটে আসতে আসতে নিজের
মনে কথার এই প্যাঁচটা আউড়ে খুব হেসেছিলেন।
প্রত্যেকটি
বছর নানাভাবে ঘটনাবহুল বছর হয়ে ওঠে। কিন্তু শুধু ঘটনাবহুল নয়, তার উর্দ্ধে।
দুনিয়াটা পালটে যাওয়ার মত কিছু ব্যাপার ঘটেছিলো ১৯৯১এ। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে
মানচিত্র থেকে মুছে যাবে, কেউ জানতো? নরসিম্হারাও-এর নতুন অর্থনীতির জেরে তাঁর
ছেলে আজ দামনে কাজ করবে, ব্যাঙ্গালোরে, পুনায়, দিল্লীতে আরো কোথায় কোথায়
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আর কাজ খুঁজতে দৌড়োবে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে, কেউ জানতো? বাবরি
মসজিদ, মানে দেশের একটা ন্যাশন্যাল মনুমেন্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ষড়যন্ত্রে ইন্ধন
যোগাবে দিল্লীর আর ইউপির নির্বাচিত সরকার, গম্বুজের মাথায় চড়ে শাবল চালাবে দেশেরই
মানুষ (শিকদার হঠাৎ নিজের মাথায় হাত বোলালেন, ‘চুল নেড়া করালে ওই গম্বুজেরই মত’
তাঁর মনে হল), কেউ জানতো? আবার নিবেদিতা বলছিলো, এই যে জাদুর দুনিয়া, ইন্টারনেট,
তারও সূচনা নাকি সেই বছর! আই.বি.এম.এর
পার্সোনাল কম্পিউটারও! একেই বোধহয় ইংরেজিতে ওয়াটারশেড বলে! কিন্তু পিছনে ওটা কী?
আরেকটি কোনো ঘটনা∙∙∙! একটা বুড়ো মানুষের
শক্ত পিঠ সেই দুপুর থেকে সরে সরে যাচ্ছে আড়ালে! চেহারাটা কিছুতেই ঘুরছে না তাঁর
দিকে!
তপতীর
মাজার ওপর একটা পা তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন শিকদার।
* * * * * *
সকালে
ফোন এল কুশল প্রসাদের। ‘একটু আগে আসতে পারলে ভালো হয় স্যার’। শ্রীবাস্তবের হুকুম
আর বললো না, বললো ‘খুব টেনশনে আছেন শ্রীবাস্তবস্যার’।
সাড়ে
ন’টায় অফিসে পৌঁছে দেখলো মিটিংএর ঘরটা পরিষ্কার ঝকঝকে করা হয়ে গেছে। বড় টেবিলটার
চার দিকে চেয়ার সাজিয়ে রাখা। এক দিকের দেয়ালে স্ক্রীনটা খোলা হয়েছে। ওপরের ফল্স
সিলিং থেকে নীচে নামানো হয়েছে প্রজেক্টর। নিবেদিতা ডানদিকের কোনায় রাখা কম্পিউটার
থেকে খুলে একটা ল্যাপটপে জুড়ছে প্রজেক্টরের তারটা। ল্যাপটপ তো অফিসে নেই। নিশ্চই
নিবেদিতার নিজের। শ্রীবাস্তবের হুকুমে আনতে হয়েছে। আট হাজার টাকায় আর কত কী করাবে
মালিক! একটা নতুন পেনড্রাইভও কিনে নিতে বলতে পারতো! টাকাটা দিতে বলতে পারতো কাল
কুশলকে! বলেনি।
খাবারদাবারের
অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। আজ আর ঘোষদার চা নয়। কফি আসবে। কোল্ড ড্রিংক, মিনারাল
ওয়াটার। টেবিলে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য কাজুবাদাম ভাজা, কাঠবাদাম, কিসমিস, বিস্কুট,
চিপ্স।
একটু পরে এসে পৌঁছোলেন অতিথিরা। পাঁচজনের
মধ্যে মাত্র একজনকে বিদেশী মনে হল। বাকি সব দিল্লীর লোক মনে হল। শিকদারকে কেউ
থাকতে বলেনি ওখানে। কিন্তু দেখলেন সবাই দাঁড়িয়ে আছে, নানা রকম ফাইফরমাস খাটছে,
তাঁরও মনে হল দাঁড়িয়ে থাকাটাই সমীচীন। মালিকের খাতিরে নাহোক, সহকর্মীদের খাতিরে,
ওদের থেকে আলাদা না থাকার খাতিরে।
কিছুক্ষণ
ফাঁই ফাঁই ইংরেজী কথাবার্ত্তার পর নিবেদিতার ডাক পড়লো পাওয়ার পয়েন্টটা প্রেজেন্ট
করতে। ল্যাপটপের টাচপ্যাডে একটা আলতো টোকা দিয়ে নিবেদিতা মাস্টারনির মত একটা স্টিক
নিয়ে দাঁড়ালো স্ক্রীনের বাঁদিকে। মাঝে মধ্যে বলতে থাকলো স্ক্রীনে ফুটে ওঠা
কথাগুলো, অথবা ছবিগুলোর বিষয়ে।
“অবশ্যই গত দুই দশকে ভারত একটি
বিশ্ব-অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে, কিন্তু তারই সাথে বেড়েছে অসাম্য, দারিদ্র্য,
বিহারের মত পিছিয়ে থাকা প্রদেশে বেড়েছে দলিতদের ওপর অত্যাচার∙∙∙ আমাদের সংস্থা নিজেদের প্রয়াসে এই মুসহর শিশুদের কুপথ
থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে∙∙∙ (স্ক্রীনে বিহারের
মানচিত্র ফুটে ওঠে, তাতে কয়েকটি বিন্দু দর্শানো) এই ক’টি জেলায় নানা রকমের
কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের লেখাপড়া শেখানো, হাতের কাজ শেখানো, মেশিন টুলস,
কম্পিউটার ইত্যাদির ট্রেনিং দেওয়া∙∙∙”
“ইয়ং
ছেলেমেয়েদের দিয়ে কাজ করানোর এই অসুবিধে, তারা জ্ঞান ফলাতে শুরু করে!” শিকদার
চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন শ্রীবাস্তব তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে। কখন এসে দাঁড়িয়েছে তিনি
খেয়ালও করেননি। “এত ভূমিকা করার কোনো দরকার ছিলো না। এসব কথা ওরা কি আর জানে না?
আর ওদের কাছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক পাওয়ার হিসেবে ইন্ডিয়ার কথা বলাও উচিৎ নয়, ওদের
ইগোতে লাগতে পারে। কোথায় কোথায় কী কী প্রজেক্ট আমরা সফলভাবে করেছি আর ফান্ড পেলে
আর কী কী করতে পারি, ব্যাস্ এটুকুই তো বলার। ওরা টাকা দিতে এসেছে, আমাদের কাজকর্ম
দেখে ওদের যেন মনে হয় যে সুনাম হবে। তাহলেই বেশী টাকা দেবে!∙∙∙ আসলে, আমি কি আর জানি না যে একটা ক্রসকারেন্ট কাজ করে।
মেয়েটি প্রেজেন্টেশনের সাথে নিজেকেও প্রেজেন্ট করছে। যদি একটা করিয়র পাথ খুলে যায়,
ওদের সাহায্যে! এত চালাক আজকালকার জেনারেশন!”
অতিথিরা
চলে গেছে। শ্রীবাস্তব আর কুশল প্রসাদও গেছে ওদের সাথে। সুমন প্লেটে পড়ে থাকা কাজুর
এক মুঠো তুলে মুখে দিতে দিতে বললো, “খেয়ে নে সুধাংশু, সাত-আট হাজারের মাইনেয়
বাড়িতে কাজু তো আর জোটাতে পারবি না!” নিবেদিতা বলে, “এমা, ছিঃ, ওটা তো এঁটো!”
-প্রসাদ,
প্রসাদ। টাকা-ভগবানের প্রসাদ। আপনি বুঝবেন না এখন। কিছুদিন যাক! খাবেন নাকি
শিকদারবাবু।
-নাঃ।
অবশ্য আমিও আপনারই মত এঁটো ফেঁটোর ধার ধারিনা। আর, ওই যে আজকাল চলেছে না কথাটা? কী
যেন বললেন আপনি নিবেদিতা, প্রেজেন্টেশনে? কিসের আশায় দেশের গরীবদের বসিয়ে রাখা
হয়েছে? যেমন করে রাজ- প্রাসাদে মহোৎসবের দিন সিঁড়ির নীচে রাস্তায় বসিয়ে রাখা হয়?
-ট্রিক্ল
ডাউন?
-হ্যাঁ,
ট্রিক্ল ডাউন! তাই তো। বড়লোকের পেট ভরবে, তবে তো উপচে পড়বে, আর তবে গরীবেরা সেই
উচ্ছিষ্ট মহাপ্রসাদ পাবে। কাজেই এঁটোর ধার ধারলে কি আমাদের চলে, সুমনবাবু? তবে এখন
আমি খেলে এই মেয়েটি একা পড়ে যাবে। তাই আজ থাক।
বিকেলে
বাড়ি ফেরার পথে জোর বৃষ্টি এল। শিকদার দাঁড়িয়ে গেলেন গোরস্তানটার লাগোয়া একটা
মুড়ির দোকানে। জায়গা কম। লোক বেশি। নিজের দাঁড়াবার জায়গাটুকু ‘মাগনায় নিচ্ছিনা’
বোঝাতেই যেন মুড়ি-বাদাম কিনলেন পাঁচ টাকার। “শিকদারবাবু না?”∙∙∙ মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন বেঁটেখাটো এক বৃদ্ধ। “কী হল, চিনতে
পারছেন না?”
নাম,
ঠিকানা মনে করার চেষ্টা করতে করতেই উত্তরটা সাজিয়ে দিলেন শিকদার, “পেরেছি চিনতে!
এতদিন পর দেখছি তো! কেমন আছেন?”
-উঁ
হুঁ, পারেননি। চোখ বলছে। নামটা বলুন তো! (শিকদার হার মেনে লজ্জিত হলেন)
-কোই
বাত নহীঁ। হতেই পারে। আমার নাম মোহম্মদ ওস্মান। আপনাদের অফিসে∙∙∙
-(শিকদার
এতক্ষণে চিনতে পেরে এগিয়ে হাত ধরে ফেললেন) আর লজ্জা দেবেন না। সমস্ত কিছু মনে পড়ে
গেছে। আপনি তো চলে গিয়েছিলেন∙∙∙
-সারন।
মানে ছাপরার পাশেই আমার গ্রামে। সেখানেই আছি। তারপর? রিটায়ার করে গেছেন?
-ব্যাস,
এই তো, মার্চে করেছি।
-কী
করেন সারাদিন?
-একটা
নতুন চাকরী ধরেছি। সময় কেটে যাচ্ছে।
-বাঃ,
খুব ভালো।
-আপনি
কী করেন এখন?
-যা
করতাম আগে! চাকরীজীবনে! ইন্সানিয়ত কী খেতী!
মনে
পড়ে গেল ওস্মানসাহেব তাঁদের অফিসে আসতেন প্রতি বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার। কোনো
রাজনৈতিক দলের সাপ্তাহিক বিলি করে যেতেন জনা তিন গ্রাহকের হাতে।
বৃষ্টি
না ধরা অব্দি কথাবার্ত্তা চললো দুজনের। বেশি কথা ওসমানসাহেবই বললেন। একটা কথা মনে
দাগ কেটে গেল, “আশা বা নিরাশা দুটোই গান্ধীজীর সেই দুই সহচরী শিষ্যার মত শিকদারবাবু।
গুলিটা সামনে থেকে যখন আসে দুটোর কেউই আটকায় না।∙∙∙ বুঝলেন, মাঝে মধ্যে পাঁজরে আঙুল ছুঁইয়ে চোখের কাছে আনি, ক্ষরণের
গতিটা বুঝি, তারপর করে যাই – যেটুকু কাজের ভার আমার ওপর। মানুষের মধ্যে আছি,
লড়াইয়ে আছি, মনের আনন্দে আছি।”
বর্ষাক্ষান্ত
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে নিজের টেবিলে থুম্বো মেরে বসেছিলেন শিকদার। হঠাৎ যেন দূর থেকে তপতীর গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন। ধড়মড় করে উঠে
বসলেন চেয়ারে।
-কী
হয়েছিলো?
-সেটাই
তো আমি জানতে চাইছি, কী হয়েছে তোমার?
-(চোখমুখ
কচলে ঘোর কাটালেন শিকদার) নাঃ, কিচ্ছু না।∙∙∙ জানো, নিবেদিতা∙∙∙
-নিবেদিতা
আবার কে?
-এ্যাঁ,
ও না! আমার মনে হল অফিসে আছি। নিবেদিতা আমাদের অফিসের একটা মেয়ে। ওভাবে তাকাচ্ছো
কেন? মেয়েটাকে ছেলের বৌ করবো কি না ভেবেছিলাম। মেয়েটি কিন্তু জাতে গোয়ালা, যাদব।
দারুণ মিস্টি, ছোট্টো খাট্টো। আর, ওই ১৯৯১এর গল্পটা ওর সাথেই শুরু হয়েছিল। তাই ওর
নামটা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। সামনে থাকলে ওকেই বলতাম কথাটা।
-কী
কথা?
-১৯৯১এর
সেই, কাল দুপুর থেকে আড়ালে ঝিলিক দিয়ে যাওয়া ঘটনাটা। আজ সুমনের সাথে কথা বলার সময়
মনে পড়ে গেল।∙∙∙ সেদিনও ভরা বর্ষার রাত ছিলো। আগস্টই হবে - বোধহয় শ্রাবণের শেষ বা ভাদ্রের
শুরু। ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যে সাইকেলে ফিরছিলাম ঝন্টুর বাড়ি হয়ে। আমার সামনে কুড়ি
হাত দূরে একজন বৃদ্ধ কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ মানুষ, তিনিও সাইকেলে। রোজই ওই সময়েই
কাজ থেকে ফেরেন। ঝন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছিলাম যে তিনি একজন কবি, রুদ্রজী
নামে জানে সবাই। ঘরসংসার চালানোর জন্য প্রেসে প্রেসে ঘুরে প্রুফ রীডারের কাজ করেন।
তার কিছুদিন আগেই, মানে তাঁর সেই সত্তর বছর বয়সে প্রায়, তাঁর চতুর্থ কবিতার বই
বেরিয়েছিলো। এবং প্রথম সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন সুধীসমাজে। খবরটা পেয়ে আমিও যেচে তাঁর
সাথে আলাপ করে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম দুদিন আগে। কী সাদাসিধে, সৎ মানুষ ছিলেন!
স্বাভিমানী ছিলেন! ছেলে, জামাই দুজনেই মারা যাওয়াতে বাড়িতে বিধবা পুত্রবধু, বিধবা
মেয়ে আর স্ত্রী! সবাইকার মুখে অন্ন তুলতেন সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে! (থেমে গেলেন শিকদার)
-কী
হল?
-(মুখটা
ডলে মুছে আবার স্বাভাবিক হলেন) নাঃ, কিচ্ছু না। বৃষ্টির রাতে, অন্ধকারে একটু এগিয়ে
তিনি আর পিছনে আমি। আমি ডাকতে গেলাম তাঁকে, ‘রুদ্রজী’ আর ঠিক তখনই সাইকেলসুদ্ধু
মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ফ্যাৎফ্যাৎ ধরণের একটা বিচ্ছিরি শব্দ হল, ধুঁয়ো বেরোতে
শুরু করল তাঁর গা থেকে, শরীরটা একটু নড়েচড়ে স্থির হয়ে গেল। হয়ত আর্তনাদও করেছিলেন
অস্ফুট, শুনতে পাইনি। ততক্ষণে আশপাশ থেকে দু’একজন দৌড়ে এসেছে। কাছে গিয়ে দেখলাম পোল
থেকে ছিঁড়ে পড়া ইলেক্ট্রিকের তারে জড়িয়ে গেছে শরীরটা।
বহুক্ষণ
ছটফট করতে থাকলেন শিকদার। উঠে কম্পিউটারের কাছে গেলেন। ফিরে এলেন। আবার গেলেন। তপতী
অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলেন। নরম ভাবে বললেন, “তোমার কী হয়েছে বল তো? শরীর খারাপ
লাগছে? যখন থেকে এসেছ, কেমন ঘোরের মধ্যে আছো।
-না
তপতী। কিছু হয় নি। আসলে, কোনো যোগসুত্র নেই রুদ্রজীর অপঘাত মৃত্যুর সাথে ১৯৯১এর বড়
ঘটনাগুলোর। অথচ দুপুর থেকে বার বার মনে হচ্ছে যে যোগসুত্র আছে, আমিই ধরতে পারছি
না। যেন অনেক কিছু এই কুড়ি বছরে শেষ হয়ে যাওয়ার সুত্রপাতটা ওই ঘটনায় ছিল, সেরাতে,
নিঃশব্দে∙∙∙ সত্যিকারের জ্ঞানী হলে হয়তো ঠিক ধরতে পারতাম। বলতে পারতাম - একটা অঙ্ক কষার
মত করে দেখাতে পারতাম। কী সেই অঙ্কটা?∙∙∙ কোনোদিন নিজের কাছে এত ছোটো হইনি জ্ঞানের অভাববোধে।
-তা,
নিবেদিতা বললে যে, ওই মেয়েটিকে ডাকলে কেন?
-জানিনা। কে জানে কেন মনে হল যে ওকে বলা বড় দরকার। ওর জন্ম তো ওই ১৯৯১য়েই।
No comments:
Post a Comment