Thursday, May 6, 2021

মীরকাসিমের কিলা

 

          কিলা হয়ে কষ্টহরনি ঘাটের দিকে যেতে, ঠিক বেরোবার মুখে কিলার দেওয়াল থেকে উঠেছিল এক বিশাল শিমুল। তার ডাল যেন দৈত্যের হাতের মত করতলে ফুল নিয়ে নেমে আসত নিচে!

সুন্দরী বালিকার হাতের নাগালে আনতে?

কী যেন নাম ছিল বিউটি এন্ড দ্য বীস্টের সেই বিউটির?

          রতনবাবুর মনে নেই। তবে নিজের সুন্দরী অথচ দেমাকি নয় ভীরু, লাজুক মেয়েটিকে তার কৈশোরে মনে করার চেষ্টা করতে আজ কেন জানি ওই গল্পটির কথা মনে এল। 

তবে কি সুন্দরীরা লাজুক হয়না?

রতনবাবুর স্ত্রী পাশে থাকলে হয়ত রসিকতা করে তাকে বলতেন, হুঁহঃ, আমাদের সময়ে যেমন, এখনও তেমন, শরীরে যৌবনের ঢল নামলে দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না তাদের। তখন ফ্রক পরে দেমাক দেখাত, এখন ওই হাঁটু অব্দি জিন্স পরে দেমাক দেখায়।

-      মানে, এখনও দেখ তুমি! তিয়াত্তরে পড়লে। খেয়াল আছে?

 

          কিন্তু অণিমার পা কেন, দৃষ্টিটাও থাকত মাটিতে।

          রতনবাবু ভাবেন, “সবই হল, বাইরে থেকে কোথাও খাদ নেই, স্বামী স্বচ্ছল চাকুরে ছিল, এখন অবসর নিয়েছে, নিজেদের বাড়িঘর, ছেলে মেয়ে নিজেদের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত, আজ বাদে কাল বিয়ে টিয়েও হবে ওদের… কিন্তু সেই অস্বস্তিকর দূরত্ব থেকেই গেল ওদের দাম্পত্যে!”

          “আর সেটাই বাড়ছে! বেড়ে ভারসাম্যহীনতার দিকে যাচ্ছে বয়সের সাথে সাথে।“ রতনবাবু অভ্যাসবশতঃ হাতজোড় করেন ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ডানদিকের মন্দিরের দিকে ঘুরে। তবে কাছে যান না। মেয়ের বিয়ের পর থেকেই কেমন যেন রহস্যময়ী মনে হয় এই দেবীকে। একটু সমীহ করে চলেন।

          এখানে উত্তরমুখী গঙ্গা। আগে উন্মুক্ত দেখা যেত সামনে নদীর চওড়া পাট, তারপর চর, আকাশে আগেরই মত ফাল্গুনের মেঘে আসন্ন সন্ধ্যার ব্যাপ্ত বর্ণালী। এখন ছবিটা সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে ঢুকছে নির্মীয়মান সেতুটার বড় বড় ধুসর কালো পায়া। এদিক থেকে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে ওদিকের খগড়িয়া থেকে।

          “বয়সের সাথে বরং কাছাকাছি আসে স্বামীস্ত্রী। কিন্তু অণিমার বেলায় উলটো হল। যতদিন ছেলে মেয়েরা বড় হয়নি, তাদের মানুষ করা ধ্যানজ্ঞান মনে করে চুপচাপ সংসার করে গেছে” রতনবাবু ভাবেন। মনে পড়ে রানিকুঠির রাস্তায় বেরিয়ে জামাইয়ের বলা কথাগুলো, “এখন তো ছেলে মেয়েরা এসেছে। তাই দেখছেন, কতটা স্বাভাবিক! যেই ওরা যাবে, ব্যাস শুরু হয়ে যাবে ওর পাগলামি”।

          “পাগলামি বলে পাগলামি! এ তো হিংস্র উন্মত্ততা! স্বামীকে এভাবে মারা, গায়ে ফুটন্ত জল ঢেলে দেওয়া…ছি ছি!”

-      আচ্ছা কোনো ট্রিটমেন্ট করাচ্ছ?

-      সে তো করাচ্ছিই। তবে ডাক্তার বারবার বলছে …

-      কী, হোমে (জিভটা আড়ষ্ট হয়ে যায়) দিতে?

-      হ্যাঁ!

-      আচ্ছা, দিলে যদি ভালো হয়… আমাদেরই মেয়ে, বলতে খারাপ (গলায় কথাটা আটকে যায়)

-      না বাবা, ওটা পারব না। ছেলে মেয়ে তো এর বিরুদ্ধে হবেই, ওরা তো থাকে না, বোঝেও না কী চলে এখানে সারাদিন, আমারও ইচ্ছে করে না ওদের সব বলতে, মনে হবে ওদের কাছে ওদের মায়ের নামে নালিশ করছি… আর ইন ফ্যাক্ট আমিও ওকে হোমে পাঠাবার কথা ভাবতে পারি না। আর কি, কদিনের জীবন! যদিন আছি, চলবে এভাবেই।

 

ফেরার সময় আর কিলার ভিতরে না ঢুকে বাইরের রাস্তাটা দিয়ে ফেরেন। আবর্জনার ডাঁই হয়ে আছে যেখানে সেখানে। কত ভীড়, হট্টগোল! বেঁচে থাকার মাপকাঠিগুলোই বদলে যাচ্ছে এত দ্রুত যে কোনটা মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই আর কোনটা জীবনের বিরুদ্ধে লড়াই, বিচার করা মুশকিল হয়ে যায়।

শীতলাবাবুর হোমিওপ্যাথিক ডিস্পেন্সারির কাছে এসে হাঁক ছাড়েন, “কী ডাক্তার, রুগী কই? বসে বসে পেপার পড়ছ? পালিয়ে গেছে চিকিৎসার বহর দেখে?”

-      বলে নাও। সুস্থ আছ তাই গলা ছাড়ছ। যেদিন পটকান্‌ খাবে আর অ্যালোপ্যাথি হাত তুলে নেবে তখন আসবে এই হোমিওপ্যাথিরই কাছে।

-      তাই তো বলি, মানুষের নিরুপায় আর অসহায় অবস্থায় পৌঁছোবার অপেক্ষা করে বসে থাক তোমরা। আর ওই জার্মান বুড়োটার নামে ব্যাবসা চালাও।

-      বল, কী খবর? অনেকদিন পর দেখছি বাজারের রাস্তায়?

-      ছিলাম না তো মাঝে! মেয়ের কাছে গিয়েছিলাম।

-      সব ভালো তো?

-      হ্যাঁ। জামাই তো রিটায়ার করে গেল। ছেলে মেয়ে দুজনেই চাকরি করছে – একজন গুড়গাঁওএ, একজন হায়দ্রা- বাদে।…

 

ডাক্তারকে কি বলবেন? মেয়ের অসুখের কথা? রতনবাবু ভাবেন। নাঃ, কী লাভ? ডাক্তার রুগীকে দেখতে চাইবে একবার। রুগীকে এখানে আনতে গেলে জামাইকে বলতে হয়। অলরেডি একটা চিকিৎসা চলছে।

কিছু না বলেই ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাজারের ভিতরের রাস্তাটায় ঢুকে পড়েন। একটু নকুলদানা আর ধুপকাঠি নিয়ে ফিরতে হবে। স্ত্রী বারবার করে মনে করিয়ে দিয়েছেন।

মাসকাবারির দোকানটার পাশেই নিতাইয়ের সাইকেলের দোকান। সাইকেল মেরামতের দোকান ছিল আগে। রোজ রাতে মদ খেত। মাতলামো করতে অবশ্য কখনো দেখেন নি। শুনতেন, জুয়াটুয়াও খেলে কোথাও, কোনো ক্রিমিন্যালদের ঠেকে। লোকে বলে ওই জুয়ার ঠেকেরই কোনো বন্ধুর বোনের সাথে ফেঁসে, তাকে বিয়ে করল একদিন।

এক বছরের মধ্যে সবাই দেখল নিতাই অন্য মানুষ। পুরোনো সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কেনাবেচা শুরু করল, মেরামতের সাথে সাথে। তারপর  সাইকেলের জিনিষপত্র আর কিছু নতুন সাইকেল। এখন তো বাজারপাড়ার প্রতিষ্ঠিত দোকানদার। দুধের এজেন্সি নিয়েছে। রোজ ভোরবেলায় এসে নিজের তদারকিতে মাল নামায় ট্রাক থেকে। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে।  

ছেলেটি তাঁর মেয়েরই সমবয়সী। একসাথে বড় হয়েছে। ছোটোবেলায় তাঁর বাড়িতেও আসত। আজকাল আর আসেনা। ইতিউতি তাকান দোকানের ভিতরে, কোথায় নিতাই? হঠাৎ পাশ থেকেই একটা কর্কশ আওয়াজ ওঠে, “অ্যাই, কখন থেকে গ্রাহক মাল চাইছে, শুনতে পাচ্ছিস না?”

ঘুরে তাকিয়ে দেখেন, নিতাই; কর্মচারীকে বকছে।

-      কেমন আছ নিতাই?

-      কে? ওঃ, রতনকাকা! (একটা প্রণাম করে পায়ে হাত দিয়ে) আপনি কেমন আছেন? এমন জড়িয়ে পড়েছি কাজে, আমারই খবর নেওয়া উচিৎ, অথচ হয়ে ওঠে না। কাকীমা ভালো আছেন?

-      হ্যাঁ।  

-      আর (একটু থেমে) অণি? মানে অণিমা আর… যাঃ, দেখেছেন, নামটাও ভুলে যাচ্ছি ওর হাসব্যান্ডের!

-      পরিতোষ।

-      পরিতোষদা। আমার সাথে তো দেখাও হয়েছিল গত বছর!

-      গত বছর? কখন? এখানে তো আসেনি…

-      না না এখানে নয়, হাওড়া স্টেশনে। আমি কিছু মালপত্তর কিনে ফিরছিলাম। উনি, মানে দুজনেই, ছেলেকে ছাড়তে এসেছিলেন দিল্লী-রাজধানীতে। আপনি ভিতরে এসে বসুন না কাকু। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন?

 

রতনবাবু খুব সহজেই ফেরার তাড়া দেখিয়ে দোকানের ভিতরে এসে বসাটা এড়াতে পারতেন। এত বছরে কখনো নিতাইয়ের দোকানের ভিতরে ঢোকেন নি। অবশ্য আগে, মানে অনেক আগে, দোকানের ভিতর বলতে ছিল একটা টুল আর একটা ভাঙা কাউন্টার। এখন তো ভোল পালটে গেছে।  

নিতাই শশব্যস্ত হয়ে একজন কর্মচারীকে চা আনতে পাঠাল। “চিনি নেন তো?” “হ্যাঁ হ্যাঁ, কম করেই দেবে!… জলদি নিয়ে আয়!… একটু বসুন কাকু, গ্রাহক দেখে নিই একটু”।

সত্যি, দোকানের ভিতরে ঢুকে বসার একটা মজা আছে। একটা ছোট্টো দুনিয়া। তার খুঁটিনাটি। যে কারবারি, তার জন্য শুধু মাল। যে আন্‌জান, তার জন্য বিষ্ময়! ওই তারটা কী কাজে লাগে?

-      ওটা ওই ফ্রীহুইলের ভিতরে লাগে।…

 

হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভাঙলো রতনবাবুর। দেখলেন পায়ের কাছে একটা সাইকেলের চাকার রিম তখনো নাচছে।

-      এঃ, হারামজাদা, একটা কাজ ঠিক মত করতে পারিস না। দিলি তো কাকুর ঘুমটা ভাঙিয়ে!

ঘুম! তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? তাও এই দোকানের ভিতর? বসে বসে? কখন? ছি ছি, কী লজ্জা!

-      এতে লজ্জার কী আছে কাকু? ক্লান্তি আসতেই পারে! ওই ছোঁড়া চা’টা দিতে গিয়ে দেখল আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি বললাম না জাগাতে।… চা খাবেন?

-      না রে ভাই। আমার খুব খারাপ লাগছে। তোমাদের ব্যবসার সময়। আর আমি কিনা দোকানের ভিতরে বসে… আসি আমি। তুমি সময় করে এস আমাদের বাড়িতে। দুই বুড়োবুড়ি থাকি। কবে কে চলে যাব!

-      আমি আসব কাকু। নিশ্চই আসব। মিনতিকে নিয়ে আসব।

মিনতি কে, জিজ্ঞেস করতে গিয়ে খেয়াল হল সমীচীন হবে না। তিনি জানেন না সেটা আলাদা কথা, এটা সাধারণ বুদ্ধির ব্যাপার যে মিনতি ওর স্ত্রীর নাম। সন্তান ক’টি তাও তো জানেন না! অথচ তিনি প্রতিবেশী।

 

বাড়িতে ফিরে একচোট বকুনি খেলেন। পুজোর জায়গায় একটু আলাদা করে, হাত বলতে রাখা চিনি ছিল, নকুল- দানার অভাবে তাই দিয়ে রমলা পুজো সেরেছেন। ধুপকাঠি পাননি, কাজেই জ্বালানোও হয়নি।

-      দোকানে বসে ঘুমিয়ে পড়লে? কোনো কান্ডজ্ঞান নেই? তুমি তো আজ অব্দি এও জান না ওই ছেলেটি কে!

-      তার মানে? নিতাই! ওকে তো ছোটোবেলা থেকে চিনি। ওর বাবা মা সবাইকে চিনি।

-      হুঁহ্‌! আজও ভাবি তোমার মেজদি আর আমার দাদা এসে শক্ত হাতে হাল না ধরলে কী করে হত অণিমার বিয়ে!

-      কী হেঁয়ালি করছ? তোমার দাদা নমস্য ব্যক্তি, আমার মেজদি আমার মাতৃসমা… আর কাকে পেন্নাম ঠুকতে হবে বলে দিও। কিন্তু তার সাথে নিতাইয়ের দোকানের কী সম্পর্ক?

-      তোমার সাধের মেয়ে ওই ছোঁড়াটার জন্যই বিয়েতে বেঁকে বসেছিল, সেটা আজ তিরিশ বছর ধরেও তুমি জান না?

 

রাতের খাবারটা খেয়ে সিঁড়ির দরজা খুলে একবার ছাতে যাওয়ার অভ্যাস রতনবাবুর। আজও এসে দাঁড়িয়েছেন জলের ট্যাঙ্কটার কাছে। সামনের বাড়িটা তিনতলা হয়ে গেছে। এপাশের ইঁট বেরোনো দেয়ালের আলো আঁধারিতে যাওয়া আসা করছে কয়েকটি টিকটিকি।

জানলে কী হবে? বিয়ে তো দিয়েই দিয়েছিলে তোমরা জোর করে! আমি কি ভেঙে দিতাম সেই বিয়ে? অবিশ্বাস তো মেয়েই করল আমায়। তোমরা আর কী করবে! একবার মুখ ফুটে বলল না আমায়, কেন বিয়েতে মত ছিল না ওর।

নাকি ওর নিজেরই মনে দ্বন্দ ছিল? কিসের দ্বন্দ ছিল?…হয়ত একটু সময় চাইছিল! নিতাই সত্যিই কিছু করে দাঁড়াতে পারে কিনা দেখার জন্য! যদি না দাঁড়াতে পারত? তাহলে নিতাইয়ের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলত, ‘তাহলে তোমরা যেমন চাইছ তেমন বিয়ে করতে আমি রাজি’…?”

 

“আর এই সময়টুকু না পাওয়ার জন্য যে রাগ, সেটাই আজ এত বড় অসুখ? সম্ভব?”

নাকি, যার ভালোবাসা এত দুর্বল, তার রক্তেই এটা সম্ভব?”

“নিতাইয়েরও কিছু অসুখ আছে নাকি? ওর বৌকে তো দেখিও নি কখনো!”

 

          রতনবাবু জলের ট্যাঙ্কটায় টোকা দিলেন। খালি হয়ে এসেছে। রাত্রে একবার চালিয়ে দিতে হবে পাম্পটা, সকালে ইলেক্ট্রিসিটি না থাকতে পারে। নিতাইয়ের চেহারাটা মনে ভেসে উঠল। আধময়লা কুর্তা-পায়জামা, কাঁচাপাকা চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পকেটটা নানা কাগজে, নোটবুকে, পয়সায় ঠাসা, ভারি হয়ে ঝুলে পড়েছে।

          “যাহোক, অণিমার অবিশ্বাসের জবাবটা তো দিয়েছে, তিরিশ বছরের পরিশ্রমে! অণিমা জানে সেটা? কথা হয় নাকি দুজনের মধ্যে কখনো কখনো? আচ্ছা, পরিতোষ কি জানে এসবকিছু?”

          “এত প্রশ্ন! এত প্রশ্ন!… যত মনে হয় সঠিক উত্তরের দিকে এগোচ্ছি, প্রশ্ন আরও বেড়েই চলে জীবনে! যেমন ওই সেতুটা, গঙ্গার ওপর। যেই তৈরি হবে, আরো প্রশ্নাকীর্ণ হবে এই শহরের আর ওপারের খগড়িয়ার জীবন! আর দু’তিন বছর! ততদিন কি থাকব?



 

No comments:

Post a Comment