বাংলা নাটক হত – বিশেষ করে মিঠাপুর
বি এরিয়ার পুজোয়। তার পর ইয়ারপুরের মিলনমন্দিরে। আমাদের নিজেদের জক্কনপুরেও । চার
দিনে চারটে করে নাটক। অথবা একদিন বিচিত্রানুষ্ঠান। দেখতে যেতাম। বিশেষজ্ঞের মন্তব্য
করতাম। একটু দেখে হয়ত বেরিয়ে পড়তাম ফচকেমি করে আসতে। আমাদের টার্গেটে
মেয়ে-টেয়ে বিশেষ থাকত না। সেসব নিজের এলেম। টার্গেটে থাকত যাকে
বলে, সুদ্ধা ছেলেগুলো। নিজেদের গম্ভীর, লেখাপড়ায় ডুবে থাকা দেখাতে ব্যস্ত, বাপের
বোতল ধরা ছেলেগুলো। দেখলেই মাথার পিছনে চাঁটি, অথবা চেয়ারে আলপিন – কই আমরা তো কিছু
করিনি!
সে যা হোক, পঁচিশে বৈশাখ,
রবীন্দ্রজয়ন্তী বলে কোনো অনুষ্ঠান হয়, তখন অব্দি আমরা জানতাম না। তারপর
গৌরদা এলেন। আমাদের সামনে থাকা শ্যামলদেরই আত্মীয়, চাকরিসুত্রে পাটনায় এসেছেন, ভাড়ায়
ঘর নিলেন আমার বন্ধু বাচ্চুদের বাড়িতে। কিছুদিন পরেই জিজ্ঞেস করলেন, এখানে পঁচিশে
বৈশাখ হয় না? আমার আর বাচ্চুর সমস্বরে অবাক “কী” শুনেই ঘোষণা
করলেন, এবার হবে। তৈরি হ’।
তৈরি ঘন্টা হব। আমরা তো কিছুই
জানিনা। ঠিক হল, বাচ্চু কবিতা আবৃত্তি করবে, শ্যামলও তাই, আর আমি গান গাইব একটা।
নাচের জন্য যোগাড় হল শ্যামলের খুড়তুতো বোন টুবলু আর তারই মাপের আরও দুতিনটে ছোটো
মেয়ে। বাচ্চুদের বাড়ির ভিতরের বারান্দার পুরোটা খালি করে এক দিকে বাঁপাশে একটা খাট
– প্রয়োজনে নাচের
সময় হার্মোনিয়াম, তবলা আর গায়ক বা গায়িকার জন্য। তার পর মূল মঞ্চ, মানে ওই
বারান্দারই প্রথম পাঁচফুট। তারপর চেয়ার – কমপক্ষে চল্লিশটা তো ছিলই।
একটা পুরো সন্ধ্যার প্রোগ্রাম। গৌরদা নিজেই অনেকগুলো গান গাইলেন। টুবলুরা যে নাচল – সজনি, সজনি, রাধিকা
লো ... সেসব গানগুলোও মাসিমা, বৌদিরা গাইলেন গৌরদার মহড়ায়। জবরদস্ত ব্যাপার।
পাড়াতেও গৌরদার নাম ছড়িয়ে পড়ল। সেবারের পুজোতেও নাটক গান গৌরদা-ময়।
আরো ব্যাপার। নাটকের পুরোনো জায়গাটা পাওয়া যাবে না। পরের গলিতে আরেকটা খালি জমির
মালিকের সাথে কথা বলে নাটকএর জায়গা পাওয়া গেল। সে জমিতে জল-কাদা। সব ছেলেদের কাজে
লাগালেন গৌরদা। জল ছাঁচ। মাটি ভরাট কর। নিজেও হাত লাগালেন যখন তখন।
গৌরদাকে ইর্ষা করতে শুরু করেছিলাম।
অকারণেই, কেননা আমরা কেউ ওনার ধারে কাছেও ছিলাম না, আর উনিও আমাদের পাকা ধানে মই
দেননি। কী জানি কেন! বোধহয় বাইরে থেকে আমাদের জগতে হুট করে ঢুকে পড়া একটা মানুষের
চমকপ্রদ সফলতার জন্য।
রহস্য নাটক ছিল প্রথম দিন। একটা অফিসের দৃশ্য। এক কোণে চেয়ার,
টেবিল, কিছু ফাইলপত্র। আর্দালি এসে, মানে বল্টুদা এসে ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে দিয়ে গেল।
তারপর গৌরদা এলেন। সোজা চেয়ারটা টেনে বসতে গিয়েই ঝপাৎ। চেয়ারটা ভেঙে পড়ল। তার ওপর
গৌরদা চিৎপটাং। একটু খুশি হয়েছিলাম কি? এবার? কী করবেন গৌরদা? নিজেই সামলে উঠে
পড়লেন তৎক্ষণাৎ। একটা বাজখাঁই গলায় ডাক ছাড়লেন, “গাংচাই!” ওটাই নাম ছিল আর্দালির।
প্রম্পটার কনফিউজড। বল্টুদা নিজে বুঝতে পারছে না কী করবে। ডিরেক্টর
মুচকি হেসে ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে ইশারা করলেন ভিতরে যেতে। বল্টুদার ডায়লগ?
বল্টুদা কাছে আসতেই গৌরদা চিৎকার করে শুরু করলেন, “একটা কাজও ঠিকমত করতে
পার না তোমরা? দেখছ কি? কথা বলতে হবেনা। এই ভাঙা চেয়ারটা নিয়ে যাও। বদলে নিয়ে এস।” বলে নিজে এগিয়ে
এসে চেয়ারটা হাতে ধরিয়ে উইংসের দিকে ঠেলে দিলেন।
পরে কেউ বলেছিল, এটাকেই নাটকে দৃশ্য
ইম্প্রভাইজ করা বলে।
সে যা
হোক, এখনও অবাক লাগে, আমি ‘স্টেজে’ গান গেয়েছিলাম! তাও আবার রবিঠাকুরের ‘একলা চলো রে’! আমারটা তো নাহয় আমার মা’ই ধরিয়ে দিয়েছিল, বা, বোধহয় বাবাও। বাচ্চু আর শ্যামলের আবৃত্তি গৌরদা নিজেই। কিন্তু
নাচের
মহড়া কি গৌরদা করিয়ে ছিলেন? নাকি ওনার স্ত্রী? বা অন্য কেউ? গানে আরো কারা কারা ছিল?
টুটু-ভুন্টুর কাকা তবলায় ছিলেন কি?
মনে নেই। আসলে কিছু করার উদ্দেশ্যটা
ভিতরে না থাকলে তো টেরও পাওয়া যায়না আশেপাশের রোজকার চেনা মানুষগুলো কে কোন গুণ
নিয়ে বসে আছে। ওমা, নীরুমাসিমা গান গাইতে জানেন – এত সুন্দর?
২৩.৫.১৯
No comments:
Post a Comment