Wednesday, May 26, 2021

টর্চ

           গত কাল নিশুতি রাতে গ্রামের পিছন দিয়ে এই দোতলা মাটির বাড়িটার দিকে আসছিলাম। হঠাৎ দু’ফুট সামনে, একটা টর্চের জোরালো আলো জমির দিকে দেখিয়ে সাবধান করেছিল, “নর্দমা আছে এখানে, দেখে পার হবেন”।

          টর্চটা যে জ্বালিয়েছিল, অন্ধকারে তার মুখ দেখি নি। তার যে প্রায় সারা রাত ওখানে দাঁড়িয়ে টর্চ দেখানোর ডিউটি, তাও জানতাম না।

          সকাল থেকে বৈঠক চলছে। বৈঠক নয়, প্রথম, স্থাপনা সম্মেলন। এখন রাত। দ্বিতীয় অধিবেশন। মাটির দোতলা, ঘরের ভেতর লন্ঠনের আলো, বাইরে শরতের আকাশ, দেশে এমার্জেন্সী – আদর্শ পরিবেশ।

          যা কিছু সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিচার, সব হয়ে গেছে। এমনকি সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়, ভারতবর্ষের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী না মুৎসুদ্দী, তারও নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

          নিষ্পত্তি হয়ে গেছে অর্থাৎ, আমাদের মূল অবস্থানটা স্থির হয়ে গেছে যে, যেহেতু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা ভ্রান্তি এমনকি উদ্ভ্রান্তির শিকার হচ্ছি বার বার তাই আপাততঃ আমাদের গ্রুপটির প্রধান কাজ হবে অধ্যয়ন এবং অন্যান্য দলের সাথে ভাবধারাগত বিতর্ক।  

অধ্যয়ন। বিশেষকরে দেশের সমাজব্যাবস্থা, ইতিহাস, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী জনতার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ…

-      আর দর্শন?

সামনে ব্যানারের বদলে, লন্ঠনের আলোয় ভারতবর্ষের মানচিত্র। তাতে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে একজন প্রশ্নটা ওঠাল।

-      ভারতীয় দর্শন? তাতে জড়বাদী পরম্পরার সুত্র?

-      অবশ্যই! চার্বাককে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এটা আমরা ভুলি কী করে?…

 

পরের দিন সকালে শুনলাম কোনো একজন কমরেড ভোররাতে বাড়ি ফিরে গেছেন – তাঁর মেয়ে গুরুতর অসুস্থ। একটু বেলায় খবর এল মেয়েটি মারা গেছে।

-      কে সেই কমরেড?

-      ওই যে, যিনি আগের রাতে গ্রামের পিছনে নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালছিলেন – আসতে থাকা দলগুলিকে পথ দেখাচ্ছিলেন!

 

কৈমুরের পাহাড় দেখা যাচ্ছে দূরে। দোতলা এই মাটির বাড়িটার উঠোনে ইষৎ মেঘলা রোদ। গোপনতার খাতিরে

বাইরে বেরুনো মানা। আবজানো দরজা-জানলার ফাঁকে ফসল কাটা হয়ে যাওয়া ক্ষেত দেখা যাচ্ছে দিগন্ত অব্দি। আর দেখা যাচ্ছে এই গ্রাম – এই টোলা এবং আরো কিছু এদিক ওদিক ছড়ান টোলা নিয়ে।

          সকালে, দুপুরে, সেশনের অবসরগুলোয় বাড়িটায় বার বার ছড়িয়ে পড়ছে চাপা স্বরে অসংখ্য তুমুল বিতর্ক। অথবা একটা - এবং একটাই – গান। ভারতবর্ষ হয়ে উঠতে চাওয়ার। কতবার কত জায়গায় এভাবে হয়ে উঠতে চেয়েছে ভারতবর্ষ। আরো বড় ভাবে হয়ে উঠতে চাওয়ার সাথে মিশে গেছে।  অথবা মিশতেও পারে নি।

          ……………

          রাত।

হঠাৎ বক্তার কন্ঠস্বর থেমে গেল। ঘরে ঢুকল তিনজন। কারা, এরা?

          পাশের কমরেড বললেন, “মাঝের জন সেই, যাঁর মেয়ে মারা গেছে আজ বেলায়”।

          এই প্রথম তাঁকে দেখলাম। কালো, রোদে পোড়া কিন্তু চোখা চেহারা। বয়স আমার থেকে যথেষ্ট বেশি, প্রায় দেড়গুণ; চল্লিশের মত হবে। নীলচে একটা শার্ট আর পাজামা পরণে। মাঝারি উচ্চতা, রোগা কিন্তু মজবুত গড়ন।

          কমরেড সভাপতি উঠে দাঁড়ালেন। আমাদেরই মত তাঁরও কাঁচা বয়স। ভাষায় একটা ভুল করে ফেললেন ধার করা অভ্যেসের দরুন।

-      কমরেডস্‌! কমরেড মহেশ আমাদের সভায় ফিরে এসেছেন। আপনারা জানেন যে তাঁর মেয়ে আজ সকালে মারা গেছে। তার শেষকৃত্য সেরে সোজা শ্মশান থেকেই উনি আসছেন। আমরা মৃতকের আত্মার শান্তি কামনা করে দু’মিনিটের নীরবতা পালন করব।

সভাপতির নির্দেশ পালন হবার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে আপত্তি জানালেন মৃতকের পিতা, প্রথম রাত্রে টর্চের আলো দেখানো লোকটি।

-      কমরেড সভাপতিজী! এটা কী বলছেন? আমরা কি আত্মায়, পরলোকে বিশ্বাস করি যে আত্মার শান্তি কামনা করব?

 

সভাপতি তোৎলালেন, “না, মানে আত্মা নয়, ওটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। তার স্মৃতিতে দুমিনিটের নীরবতা…”

-      কিসের স্মৃতি? বারো বছরের মেয়ের স্মৃতি তো শুধু তার বাপ মায়ের ভিতরে! সে তো কিছুই করে যেতে পারল না জীবনটা নিয়ে। (লোকটির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কি?) বলুন, একটা অসাময়িক মৃত্যুতে! এমনই আরো অনেক মৃত্যুর মত আরো একটি অসাময়িক মৃত্যুতে আমরা শোক পালন করব।

 

মাটির দোতলায় আমরা জনা পঁয়ত্রিশ সাথী বোবা সশ্রদ্ধ বিষ্ময়ে ওই পিতার দিকে তাকিয়ে, দাঁড়িয়ে রইলাম দু’মিনিট। বাইরে কি চাঁদ ছিল? তার আলোয় বাইরে প্রান্তরটা কি একটা ঘড়ির ডায়াল হয়ে গিয়েছিল? কি জানি কেন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল যে কোথাও একটা ঘড়ি খুব জোরে টিকটিক শব্দ করে চলেছে।

 


__________________  

 

No comments:

Post a Comment