পূর্বভাগ – পূর্ব খন্ড
(১)
জন্ম এবং শৈশব
আমার ঠিক মনে নেই
মায়ের গর্ভ থেকে কবে বাইরে এলাম। যখন জানতে পারতাম তখন তো চেষ্টাই করিনি – করতে পারলামও
না আর এখন আধ-শতকের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর জানার চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব। তাই
সেটা নিয়ে ভাবাই ছেড়ে দিয়েছি। তবুও লেখাপড়া করতে গেলে স্কুলে যে কিছু একটা
মোটামুটি লেখানো হয় তার ভিত্তিতে আমি অনুমান করেছি যে ১৮৮৯ সালের প্রথম দিকের
মাসগুলোর কোনো একটায় আমি প্রথম প্রথম এই জীবনে এই দুনিয়াটা বোবা অবস্থায় দেখেছিলেম।
তারপরেও যতটা আরো জানতে পেরেছি, ফেব্রুয়ারি মাসে ফাল্গুনের মহাশিবরাত্রির দিন ছিল,
যদিও নিশ্চিত হতে পারিনি।
আমার মায়ের আমি শেষ
ছেলে ছিলাম এবং কিছুটা সাবালক হওয়ার পর জানতে পারলাম যে আমার তিন বা চার বছর বয়সে
মায়ের মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল। ফলে মাতৃসুখ আমি ঠিক মত পাইনি। মায়ের সেবা করার তো প্রশ্নই নেই। তার সুযোগ
ওই পরিস্থিতিতে আমি পেতামই বা কি করে?
আমার পিতা শ্রী
বেনীরায়, দু’ভাই ছিলেন এবং মা’ও দু’বোন ছিলেন। ফলে মায়ের মরার পর আমার মাসি আর কাকী
– কেননা দুই বোনের বিয়ে বাবা আর তাঁর বড় ভাইয়ের সাথেই হয়েছিল – আমার লালন-পালন করেছিল।
আসলে মাসিকেই আমি সব সময় মায়ের মত মনে করেছি এবং তিনিও আমাকে পুরোপুরি ছেলের মতই দেখেছেন।
তার পরিণতিতেই, যখন প্রায় আঠেরো বছর বয়সে আমি সন্ন্যাস নিয়ে নিলাম, সেই মর্মান্তিক
বেদনায় বেশি দিন উনি আর বাঁচতে পারলেন না। বাবাও ভীষণ কষ্ট পেলেন এবং আমার গৃহত্যাগের
পর কয়েক বছরের মধ্যেই মারা গেলেন। কিন্তু আমি ঠিক ঠিক বলতে পারব না দুজনের মৃত্যু কবে
এবং কোন সময়ে হয়েছিল। শুধু এটুকু খবর পেয়েছিলাম যে দুজনেই স্বর্গবাসী হয়েছেন।
কাকা শ্রী বিশ্বেশ্বর রায়ের তো একটিই ছেলে ছিল – সুন্দর রায়। কিন্তু
আমরা পাঁচ ভাই ছিলাম। বোন ছিল না, শুধু এক খুড়তুতো বোন ছাড়া। পাঁচ ভাইয়ের একজন
তো আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই মারা গিয়েছিল। তাই এখন আর ওর নামও আমার মনে নেই। শেষ চারজনের
মধ্যে শ্রী রামদিলাস রায়ের মৃত্যুও আমার সামনেই হল। বাকি রইল তিনজন। সবার থেকে বড় ছিলেন
শ্রী জংবাহাদুর রায় এবং তারপর ছিলেন শ্রী রামধ্যান রায়। ও হ্যাঁ, বাপ-মায়ের দেওয়া আমার
নিজের নামটা বলতে তো আমি ভুলেই গেলাম। আমাকে সবাই বলত নওরংগ রায়। খুড়তুতো ভাইয়ের বা
মৃত ভাইদের বংশের আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই। কিন্তু শেষ যে দুজন ভাই বেঁচেছিলেন, তাঁদের
বংশ আছে; ইতিমধ্যে বড় ভাইয়েরও মৃত্যু হয়েছে।
বাল্যকালের কোনো বিশেষ কথা আমার মনেও নেই আর আমি জানিও না। একটাই
কথা শুধু জানি; বাড়ির গুরুজনস্থানীয় এবং বৃদ্ধা নারীদের মুখে শুনেছিলাম। তাঁরা কখনো
কখনো ঠাট্টা করে আমার বিষয়ে বলতেন, “এর তো পাথরের কলজে! যখন এর মা মরেছিল, সবাই কাঁদছিল।
আর এ বলছিল কিনা – মা তো মরেই গেল! কাঁদতে কাঁদতে কি আপনারাও মরে যাবেন?” কিন্তু আমার
স্মৃতিতে নেই এমন বলেছিলাম কিনা; ৩-৪ বছর বয়সের কথা। হ্যাঁ, আরো একটা কথা মনে আছে।
জানিনা কেন আমার স্বভাবটাই এমন যে ছোটোবেলায় ছেলেরা মিলেমিশে যে খেলা করে, দুষ্টুমি
করে, আমি সেসব থেকে সব সময় দূরে দূরে থেকেছি।
ফলে আমি ওই সব খেলা আর দুষ্টুমি জানিই না। এমনকি দরজার সামনে জলে
ভরা লম্বা পুকুর থাকা সত্ত্বেও, যেটাকে শুধু বাওড়ি (বৌলি) বলতাম, সাঁতার শিখিনি। যখন
নাকি আমার বয়স্র সব ছেলেরা সাঁতারে নিপুণ ছিল। গ্রামে অনেকগুলো পুকুর ছিল। কিন্তু নিজের
স্বভাব বশতঃ আমি সাঁতার শিখিনি। আসলে এ কাজেও তো দুরন্তপনার প্রয়োজন হয়, আর আমার
মধ্যে সেটা ছিলই না। ফলে ভালো করে সাঁতার কাটতে আজ অব্দি আমি শিখিনি। শুধু ১৯১৬
সালে যখন ঐতিহাসিক বন্যা এল, বিশ্বম্ভরপুর (গাজিপুর) এর ঝিলে একটু সাঁতার শিখতে পেরেছিলাম
– সন্ন্যাসি হওয়ার অনেক পর। তাও এই কারণে যে একবার সারন জেলায় স্নান করার সময় একটা
পুকুরে ডুবতে ডুবতে বেঁচেছিলাম। জানিনা সেটুকুও সাঁতার এখন কাটতে পারব কিনা, নাকি ভুলে
গেছি। কেননা তারপর আর কখনো নিজের পরীক্ষাও নিইনি।
(২)
স্থান এবং বংশ
আমার জন্ম হয়েছিল দেওয়া নামের গ্রামে। জায়গাটা যুক্ত প্রদেশের একেবারে
পূর্ব সীমান্তে বিহারের সাথে মিশে থাকা গাজিপুর জেলার সৈদপুর তহসিলে পড়ে। পরগনা শাদিয়াবাদ
আর থানার নাম বিরনো। গাজিপুর শহরের পশ্চিমোত্তর দিকে কুড়ি মাইল গেলে পড়ে বেঙ্গল নর্থ
ইস্টার্ণ (ও.টি.) রেলওয়ের দুলহপুর স্টেশন। তারই কাছে এই গ্রামটা। গাজিপুর থেকে এ গ্রামে
দুটো – একটা কাঁচা ও একটা পাকা রাস্তা আসে। কাঁচা রাস্তাটা তো গ্রাম হয়েই ধার দিয়ে
বেরিয়ে যায়। কিন্তু পাকা রাস্তাটা বিরনো থানা হয়ে আসে এবং উত্তর দিক বরাবর গ্রামের
কাছ দিয়েই সোজা আজমগড় চলে যায়। কাঁচা রাস্তাটা গ্রাম হয়ে কিছু দূর অব্দি গিয়ে উত্তর-পশ্চিম
দিকে এই পাকা রাস্তাটার সাথে মিশে শেষ হয়ে যায়। দেওয়া গাজিপুর জেলার বায়ব্য কোণের শেষ
গ্রাম; এর পর আজমগড় জেলা শুরু হয়ে যায়।
গ্রামের চারদিকে পুরোনো খাদ যার অধিকাংশ জায়গায় সময়ের সাথে মাটি
ভরে গেছে। তাও, বর্ষায় তো জলে টইটুম্বুর হয়েই ওঠে এবং নির্দিষ্ট দু-চারটে রাস্তা ছাড়া
গ্রামের বাইরে যাওয়ার কোনো পথ থাকে না। খাদের অনেক জায়গায় এবং বিশেষ করে পুরো উত্তর
ভাগে গরম কালেও জল ভরা থাকত। উত্তর ভাগটা চওড়াও বেশি। খাদ ছাড়া, খাদের ভিতরেই ধার ঘেঁষে,
গ্রামের চার কোনে চারটে খুব উঁচু, মাটির ‘ধুস’ [এখানে লুপ্ত দুর্গপ্রাকারের ঢালু অংশ
অর্থে – অনু.] রয়েছে, যেগুলোকে এখনো অব্দি লোকে মোর্চা বলে। শুধু তাই নয়, গ্রামের উত্তর
ভাগে, বিশেষ করে যেখানে আমাদের বংশের ভিটে, এক পুরোনো গড়ের চিহ্ন এখনো অব্দি পাওয়া
যায় যা থেকে লম্বা লম্বা ইঁট বেরোয়। সে গড়টাকে কোট বলা হয়। লুপ্ত গড়ের জায়গাটায় এক
পুরোনো দেবীও আছেন, যাঁকে কোটের দেই বা দেবী বলে সবাই। প্রায় সমতল হয়ে আসা ওই গড়ের
ওপরই, আমাদের বাড়ির পাশেই একটি পুরোনো কবর রয়েছে, যার মেরামত সে সময় আমাদের ঘরের লোকেরাই
কখনো কখনো করে দিতেন। কবরটিকে ‘শহীদ পুরুষ’ নামে অভিহিত করা হত। আমি এও দেখেছি যে আমাদের
বাড়ির লোকেরা কখনো কখনো ‘শহীদ পুরুষ’এর ওপর প্রদীপ জ্বালাতেন। মনে হয়, অতীতে যখন গড়টা
ছিল, কোনো লড়াইয়ে কোনো বাহাদুর মুসলমান কোনো কারণে লড়তে লড়তে হকের জন্য মারা গিয়েছিল।
তার বীরত্বের সম্মানে মানুষেরা তার কবরটাকে ‘শহীদ পুরুষ’ বলা শুরু করল। গ্রামে মুসলমান
তো, জোলা আর চুড়িহার [চুড়িবিক্রেতা – অনু] মিলিয়ে মাত্র দু-চার ঘর। দুই ঘর ভাটও আছে,
যার মধ্যে একজন রামখেলাওন মিয়াঁ ভালো গায়ক ছিল। সে সারেঙ্গিরও বাদক ও কারিগর ছিল। তাই
আশেপাশে এবং দূরে খ্যাতি ছিল তার। বিস্ময়কর সারেঙ্গি বাজাত সে। তার আচার-আচরণে হঠাৎ
করে কেউ বলতে পারত না যে সে মুসলমান। শোনা যায় সে নিজে থেকেই একবার হিন্দু হতে প্রস্তুত
হয়েছিল। কিন্তু গ্রামের বড়-বুড়ো হিন্দুরাই সেটা হতে দিল না। তার ছেলে শ্রী প্রদীপ তো
গান-বাজনায় বাপকেও টেক্কা দিয়ে গেছে; অনেক দূর অব্দি ধনীমানী মানুষদের মধ্যে তার খ্যাতি।
গ্রামের ‘দেওয়া’ নাম, কোটের পুরোনো দেবী এবং গড়ের কথা ভাবলে আন্দাজ
হয় যে গ্রামটা আগে হিন্দুদের ছিল, পরে কোনো মুসলমান নবাব বা সামন্ত গ্রামটাকে অধিকার
করে। সেই অধিকারকে ধ্বংস করেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা গ্রামটাকে আবার থেকে কব্জা করে
এবং সেই লড়াইয়েই কোনো চমকপ্রদ মৃত্যুবরণের কারণে কবরে শায়িত ওই মুসলমানের নাম পড়ে “শহীদ
পুরুষ”।
বুড়োরা বলত তারা শুনেছে যে চারটে মোর্চার ওপরই কামান থাকত। তারা
এটাও বলত যে খুব পুরোনো কথা নয় যখন উত্তরদিকের পাকা সড়ক দিয়ে পল্টন যেত যাদের তিলঙ্গা
বলা হত। মনে হয় ১৮৫৭ সালের পর তেলেঙ্গা লোকেদের ফৌজে ভর্তি করে ওদিকে গোরা পল্টনের
সাথেই মার্চ করানো হত। তাই সব পল্টনের সেপাইদেরই তেলেঙ্গা বলার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
আমার বংশ জুঝৌতিয়া ব্রাহ্মণদের বংশ, যারা পশ্চিম থেকে এসে এই গ্রামে
অনেক আগেই বসত করেছিল। হ্যাঁ, বুড়োরা এটাও বলত যে তাদের পূর্বপুরুষেরা গ্রামের উত্তরদিকের
ডিহিতে বসবাস শুরু করেছিল যেটা এখন ক্ষেত হয়ে গেছে, যদিও ভালো করে দেখলে প্রথম বসত
হওয়ার আভাস পাওয়া যায়। যখন ডাকাতের উপদ্রব বাঁচা মুশকিল করে দিল তখন তারা গড়ের ভিতরে
এসে বাসা বাঁধল। সে যা হোক, জুঝৌতিয়া ব্রাহ্মণদের একটা দল কয়েকজন কায়স্থের সাথে বুন্দেলখন্ডের
দিক থেকে কোনো ভাবে ওই গ্রামে এসে পড়েছিল। কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণদেরই একটি শাখাকে জুঝৌতিয়া
বলা হয় যেমন সরওয়রিয়া বা সর্যুপারী। জুঝৌতী বা জজাক্মুক্তি ছিল পুরোনো নাম। বুন্দেলখন্ডে
থাকতে থাকতেই ওদের নাম হয়ে গেল জুঝৌতিয়া। ওখানকার লোকেরা খুব লড়িয়ে আর বীর হত, সেটা
সবাই জানে। ইতিহাসও তার সাক্ষী। তাই বুন্দেলখন্ডকে জুঝৌতিও বলা হত। অধিকাংশ জুঝৌতিয়া
ব্রাহ্মণ ওই অঞ্চলেই এবং হামীরপুর, ললিতপুর, ঝাঁসীতে পাওয়া যায়। ওদের মধ্যে একজন আগে
চিত্রকূটের কাছে কোথাওকার এক ছোট-খাটো রাজা বা জমিদারও ছিল। ওদের সভাও এক এবং বংশাবলী
ইত্যাদিও ছেপেছে।
এই কয়েকজন জুঝৌতিয়া ব্রাহ্মণ সুদূর পশ্চিম থেকে দেওয়া গ্রামে কবে
আর কিভাবে এল কেউ জানে না। ওই এলাকায় বা এদিকওদিক কাছাকাছি কোথাও ওদের
এদিকে আসার কোনো যোগসুত্র পাওয়া যায়না। শুধু ওই একটাই গ্রামে ওরা আছে, সেখানেও সংখ্যায়
বেশি নয়। পনের-বিশটা ঘর, সেও আন্দাজ হয় গোনাগুনতি পূর্বপুরুষদের থেকেই বেড়ে হয়েছে।
আশেপাশের গ্রামে হয় সর্যুপারী ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় নয় তো ভুমিহার ব্রাহ্মণ, তাও অনেক
কম। মনে হয়, চাষবাস করা এবং মাঝেমধ্যে যুদ্ধকৌশল দেখানো এই জুঝৌতিয়ারা বুন্দেলখন্ডে
বসবাসরত নিজেদের ভাইদের থেকে, রেলপথ, টেলিগ্রাফ ইত্যাদির যুগ না হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং ক্রমে নিজেদেরই অনুরূপ ভুমিহার ব্রাহ্মণদের সাথে আহার, বিবাহাদির
সম্পর্ক স্থাপন করে নেয়। আমার ভালো করে মনে আছে যে পুরো এলাকায় একটি মাত্র গোষ্ঠি হওয়ার
কারণে ভুমিহার ব্রাহ্মণেরাও এদের তেমন সম্মানের চোখে দেখত না। ওরা বুঝতেই পারত না জুঝৌতিয়া
কেমন প্রাণী। কান্যকুব্জ, সর্যুপারী ইত্যাদি তো তারা বুঝতো। তাই আমার সময়ে, আমাদের
গ্রামের মানুষেরা জুঝৌতিয়া বলতেও সঙ্কোচ করত এবং নামটাকেও না বুঝে বদলে জুজহুতিয়া বা
জিজহুতিয়া ইত্যাদি করে নিয়েছিল। এদিকে জানতে পেরেছি যে সাঁওতাল পরগনার দুমকায় কোনো
একজন জুঝৌতিয়া অধ্যাপককে মৈথিলরা এই কারণে অপমানিত করত যে সেই জাতিনামের অন্য কেউ ওখানে
নেই। হয়েই এমন। হাজারজনের মধ্যে যে একা হয় সেই একলষেঁড়ে হয়। দেওয়ার জুঝৌতিয়া ব্রাহ্মণদের
গোত্র কশ্যপ বা কাশ্যপ।
(৩)
আর্থিক অবস্থা
আমাদের বংশের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। মনে হয়, আমাদের ঠাকুরদা
শ্রী ঠাকুর প্রসাদ রায়ের সময় বংশ সুখী ও সংগতিসম্পন্ন ছিল; পরে অবস্থা খারাপ হয়েছে।
ঠাকুরদাকে বা তাঁর সময়টা তো আমি দেখিনি, কিন্তু ওনার বিষয়ে একটা কথা বার বার শুনতাম।
উনি সবসময় একটা ভালো মাদি ঘোড়া রাখতেন এবং তার পিঠে চড়েই আসাযাওয়া করতেন। কথিত আছে
যে একবার এক ভদ্রলোক বরযাত্রার জন্য ঘোড়া চাইতে এলে ঠাকুরদা তাঁকে প্রথমে দিতে চান
নি। ঘোড়াটাকে উনি খুব স্নেহ করতেন এবং যত্ন নিতেন। তাই দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু
ভদ্রলোক জিদ ধরলে, তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার তাগাদা করে দিয়ে দেন। ভয় ছিল যে তাঁর অনুপস্থিতিতে
ঘোড়াটার ঠিকমত সেবাযত্ন হবে না। হলও তাই। সে বাবুমশায় ঘোড়া নিয়ে বরযাত্রী গেলেন কিন্তু
কে জানে কেন সহিসকে নিয়ে গেলেন না। বরযাত্রায় যেমন হয়, ঘোড়দৌড় ইত্যাদিও হল কিন্তু তারপর,
মামুলি টাট্টুর মত ঘোড়াটার দু’পা বেঁধে এমনিই ঘাস চরার জন্য ছেড়ে দেওয়া হল। এ অভ্যাস
তার ছিল না। ফলে রাতেই দুই পা নিজের মধ্যে জড়িয়ে ঘোড়াটা পড়ে গেল আর মরেও গেল। ঠাকুরদা
খবরটা পেয়ে দুঃখে কষ্টে খাওয়া দাওয়া ছাড়লেন। শেষে উনিও মারা গেলেন।
আমাদের বংশে একটুখানি জমিদারি ছিল আর বাকিটা ভাগচাষ। ঠাকুরদার কালে
বংশ ছোটো ছিল। কাজেই কাজকর্ম ঠিকমত হত, কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু পরে বিষয়সম্পত্তি
ছ-সাত ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই অবস্থা খারাপ হল। যদিও শুনেছি যে এদিকে,
অংশীদারেরা সব মরে যাওয়ার পর সম্পত্তি আবার এক জায়গায় হয়ে গেছে। জমিদারিতে, বিশেষ করে
বাঁটোয়ারার পর তো কিছু ছিল না। চাষ করে কাজ চলত। বিক্রম সম্বত ১৯৫৬র সেই ঘোর আকালের
স্মৃতি আমার মনে এখনো তাজা, যখন চার দিকে মানুষ ক্ষুধায় মরছিল। কে জানে কোন দিক থেকে
ভুট্টার চলন এসেছিল। ভুট্টার দানাই ভেঙে লোকে ভাতের মত সেদ্ধ করত আর খেত। আমি এও ভুলিনি
যে ছাপ্পান্নর সেই কুখ্যাত আকালে, (পরে তো আকালটার নামই ছাপ্পান্নর হয়ে গেল; বোধহয়
ইংরেজি সাল ১৯০০য় হয়েছিল) একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার হয়েছিল। অড়হরের চাষ সেবারে ভালো হয়েছিল
এবং এমনই সমাপতন যে মাসখানেক আগেই তৈরি হয়ে গেল। ফলে অড়হরই রেঁধে খেত লোকেরা।
গ্রামের অন্যান্যদেরও আর্থিক অবস্থা সাধারণ ছিল। চাষ-বাস করেই তারা কাজ চালাত। হ্যাঁ, একটা উল্লেখযোগ্য কথা যে ওখানে গুড়ের পুরোনো কারখানার চিনি খুব হত। তিন-চারটে ভালো কারখানা ছিল। হাতে তৈরি ওই চকচকে চিনির স্মৃতি আজও টাটকা। টাকায় দু-আড়াই সের বিকোত। তাই সব কৃষকেরা আখের চাষ করত। চিনির কারখানাদারদের এবং আরো দু’একজনকে সুখী, সমৃদ্ধ মনে করা হত। গ্রামে অন্য কোনো রোজগার বা ব্যবসা ছিল না। চাকরি-বাকরিও না। লেখাপড়াও যেমনতেমন ছিল। শুধু কায়স্থদের মধ্যে কয়েকজন লেখাপড়া জানা ছিল এবং বাইরে চাকরি করত। যদ্দুর মনে আছে, কায়স্থদের খারে বলা হত এবং মাত্র চার-পাঁচ ঘর ছিল তারা।
(৩)
আর্থিক অবস্থা
আমাদের বংশের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। মনে হয়, আমাদের ঠাকুরদা
শ্রী ঠাকুর প্রসাদ রায়ের সময় বংশ সুখী ও সংগতিসম্পন্ন ছিল; পরে অবস্থা খারাপ হয়েছে।
ঠাকুরদাকে বা তাঁর সময়টা তো আমি দেখিনি, কিন্তু ওনার বিষয়ে একটা কথা বার বার শুনতাম।
উনি সবসময় একটা ভালো মাদি ঘোড়া রাখতেন এবং তার পিঠে চড়েই আসাযাওয়া করতেন। কথিত আছে
যে একবার এক ভদ্রলোক বরযাত্রার জন্য ঘোড়া চাইতে এলে ঠাকুরদা তাঁকে প্রথমে দিতে চান
নি। ঘোড়াটাকে উনি খুব স্নেহ করতেন এবং যত্ন নিতেন। তাই দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু
ভদ্রলোক জিদ ধরলে, তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার তাগাদা করে দিয়ে দেন। ভয় ছিল যে তাঁর অনুপস্থিতিতে
ঘোড়াটার ঠিকমত সেবাযত্ন হবে না। হলও তাই। সে বাবুমশায় ঘোড়া নিয়ে বরযাত্রী গেলেন কিন্তু
কে জানে কেন সহিসকে নিয়ে গেলেন না। বরযাত্রায় যেমন হয়, ঘোড়দৌড় ইত্যাদিও হল কিন্তু তারপর,
মামুলি টাট্টুর মত ঘোড়াটার দু’পা বেঁধে এমনিই ঘাস চরার জন্য ছেড়ে দেওয়া হল। এ অভ্যাস
তার ছিল না। ফলে রাতেই দুই পা নিজের মধ্যে জড়িয়ে ঘোড়াটা পড়ে গেল আর মরেও গেল। ঠাকুরদা
খবরটা পেয়ে দুঃখে কষ্টে খাওয়া দাওয়া ছাড়লেন। শেষে উনিও মারা গেলেন।
আমাদের বংশে একটুখানি জমিদারি ছিল আর বাকিটা ভাগচাষ। ঠাকুরদার কালে
বংশ ছোটো ছিল। কাজেই কাজকর্ম ঠিকমত হত, কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু পরে বিষয়সম্পত্তি
ছ-সাত ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই অবস্থা খারাপ হল। যদিও শুনেছি যে এদিকে,
অংশীদারেরা সব মরে যাওয়ার পর সম্পত্তি আবার এক জায়গায় হয়ে গেছে। জমিদারিতে, বিশেষ করে
বাঁটোয়ারার পর তো কিছু ছিল না। চাষ করে কাজ চলত। বিক্রম সম্বত ১৯৫৬র সেই ঘোর আকালের
স্মৃতি আমার মনে এখনো তাজা, যখন চার দিকে মানুষ ক্ষুধায় মরছিল। কে জানে কোন দিক থেকে
ভুট্টার চলন এসেছিল। ভুট্টার দানাই ভেঙে লোকে ভাতের মত সেদ্ধ করত আর খেত। আমি এও ভুলিনি
যে ছাপ্পান্নর সেই কুখ্যাত আকালে, (পরে তো আকালটার নামই ছাপ্পান্নর হয়ে গেল; বোধহয়
ইংরেজি সাল ১৯০০য় হয়েছিল) একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার হয়েছিল। অড়হরের চাষ সেবারে ভালো হয়েছিল
এবং এমনই সমাপতন যে মাসখানেক আগেই তৈরি হয়ে গেল। ফলে অড়হরই রেঁধে খেত লোকেরা।
গ্রামের অন্যান্যদেরও আর্থিক অবস্থা সাধারণ ছিল। চাষ-বাস করেই তারা
কাজ চালাত। হ্যাঁ, একটা উল্লেখযোগ্য কথা যে ওখানে গুড়ের পুরোনো কারখানার চিনি খুব হত।
তিন-চারটে ভালো কারখানা ছিল। হাতে তৈরি ওই চকচকে চিনির স্মৃতি আজও টাটকা। টাকায় দু-আড়াই
সের বিকোত। তাই সব কৃষকেরা আখের চাষ করত। চিনির কারখানাদারদের এবং আরো দু’একজনকে সুখী,
সমৃদ্ধ মনে করা হত। গ্রামে অন্য কোনো রোজগার বা ব্যবসা ছিল না। চাকরি-বাকরিও না। লেখাপড়াও
যেমনতেমন ছিল। শুধু কায়স্থদের মধ্যে কয়েকজন লেখাপড়া জানা ছিল এবং বাইরে চাকরি করত।
যদ্দুর মনে আছে, কায়স্থদের খারে বলা হত এবং মাত্র চার-পাঁচ ঘর ছিল তারা।
(৪)
লেখাপড়ার প্রারম্ভ
যদিও বাড়িতে লেখাপড়া জানা কেউ ছিল না। গ্রামেও খুব হলে দু’চারজন
কৈথী [একটি পুরোনো প্রচলিত লিপি যা সে সময় বিহারের, উত্তর প্রদেশের স্থানীয় ভাষাগুলো
লিখতে ব্যবহৃত হত – অনু.] লিখতে পড়তে জানা লোক ছিল, তা সত্ত্বেও বাড়ির লোকেদের অভিমত
হল যে ছেলে বুদ্ধিমান, তাই একে স্কুলে পাঠান হোক। গ্রামের আরো কয়েকটি ছেলে পড়ত। তাই
১৮৯৯ সালের জানুয়ারির শুরুতেই আমায় জালালাবাদের আপার প্রাইমারি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে
ভর্তি করে দেওয়া হল। জালালাবাদ দেওয়ার উত্তরে প্রায় দু’মাইল দূরে। ওখানে বাজার বসে;
ডাকঘরও আছে। বানিয়া আর রাজপুতদের বস্তি। জোলা এবং অন্যান্য মুসলমানরাও থাকে। আমার মনে
আছে, আমার গ্রামের এবং অন্যান্য গ্রামের অনেক মহিলা চরকায় সুতো কেটে ওখানে নিয়ে যেত
এবং জোলাদের হাতে তুলোর বদলে সুতো দিয়ে আসত। এটা মনে নেই যে সুতোর বদলে কয় গুণ তুলো
পেত ওরা। এও দেখেছি যে চার পাঁচ বছরে সব চরকা শেষও হয়ে গেলে।
জালালাবাদের পশ্চিম দিকে একটি পুরোনো আর অনেক বড় কেল্লার ধ্বংসাবশেষ
আছে। পুরোনো লাখোরি ইঁটের পড়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়া দেয়ালগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে
একটা পাকা চাতাল, যার বিষয়ে বলা হত যে ওটার নিচে ধনরত্ন পোঁতা আছে। যদি কেউ খুঁড়তে
যায়, তাহলে ভিতরে থাকা দৈবশক্তিধারী রক্ষক সাপ হয়ে দংশে নেয়। এধরণে লোকশ্রুতি আকচার
পাওয়া যায়।
আপার প্রাইমারি স্কুলে অক্ষর পরিচিতি থেকে শেষ অব্দি ছয়টি শ্রেণি
ছিল। প্রতি বছর দু’দুটো শ্রেণি পার করে আমি তিন বছরেই আপার প্রাইমারির পড়া পুরো করে
নিলাম। ১৯০২ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে আমাদের শিক্ষক আমাদেরকে আপার প্রাইমারির
শেষ শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য জালালাবাদ থেকে অনেক দূরে, গাজিপুর শহরের পশ্চিমে
কারান্ডা পরগনার গোশন্দেপুর গ্রামে নিয়ে গেলেন।
স্কুলগুলোর ডেপুটি সাহেব পরীক্ষা নিলেন। কুড়ি নম্বরে আমি উনিশ পেয়েছিলাম
এবং তা দেখে আমাদের পরীক্ষক অবাক হয়েছিলেন, মনে আছে। আমার এটাও খুব ভালো করে মনে আছে,
এক নম্বর কম শুধু, হিন্দি ব্যাকরণে ওনার করা একটি প্রশ্ন ব্যাকরণের নির্ধারিত বইয়ের
বাইরে থেকে ছিল বলে পেয়েছিলাম। নইলে কুড়িতে কুড়ি আমি নিশ্চিত পেতাম। ডেপুটি সাহেব দেখে
এও বলেছিলেন, “ভুল হল, এই ছেলেটি স্কলারশিপের পরীক্ষায় গিয়ে থাকলে স্কলারশিপ নিশ্চয়ই
পেত।” কিন্তু যখন মামুলি পরীক্ষাও ২০-২৫ মাইল দূরে গিয়ে দিতে হল, স্কলারশিপের পরীক্ষা
না জানি কোন জগতে গিয়ে দিতে হত। মাস্টারসাহেবও বোধহয় জানতেনই না। নইলে সেখানেই নিয়ে
যেতেন। অথবা অন্য কোনো ব্যাপার কিনা জানিনা। কিন্তু এটা ঠিক যে মাস্টার অথবা শিক্ষা
বিভাগের ভূল এবং অব্যবস্থার কারণেই আমি স্কলারশিপ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। যাহোক, পরীক্ষার
পর গোশন্দেপুর থেকে ফিরে এলাম।
পরের পর্যায়ে যাওয়ার আগে আরো দু’একটা মজার কথা বলার আছে। নিয়মানুসারে
আমি পড়তাম তো হিন্দি কিন্তু দুজন মাস্টারই (স্কুলে দুজনই শিক্ষক ছিলেন) উর্দু জানতেন।
ফলে ক্লাসে উর্দু পড়া ছেলেদের পড়া শুনে শুনে বই ছাড়াই উর্দু শিখে নিই; উর্দুর ব্যাকরণও
শুনে শুনে মুখস্ত করে নিই। ফলে হিন্দির আপার প্রাইমারির শেষ পরীক্ষা দেওয়ার সময় উর্দুর
পরীক্ষা পাশ করারও যোগ্যতা ছিল আমার, যদিও পরীক্ষা দিতে পারলাম না। দিতামই বা কিকরে?
দুটো পরীক্ষা তো একসাথেই হচ্ছিল। তাহলে হিন্দিরটা দিতাম না উর্দুরটা? আরেকটা ব্যাপার
ছিল যে উর্দুর টানা লেখা পড়ারও সুযোগ পেতাম। কেননা শিক্ষা বিভাগের তরফ থেকে সে সময়
যুক্ত প্রদেশে যা কিছু চিঠি লেখালিখি হত সব শিকস্তএ (টানা লেখা) হত। ফলে, সে সব চিঠি
যখন আসত এবং হেডমাস্টার তার জবাব দিতেন তখন পড়ার সুযোগ পেতাম। কেননা আমি হেডমাস্টারের
সাথে মিলেমিশে থাকতাম; ভালোবাসতাম ওনাকে। উনিও আমায় ভালোবাসতেন। পরে একজন হেডমাস্টার
সাহেব এমনও এলেন যিনি ফার্সি জানতেন। আমাকে ফার্সি পড়াবেন, ভাবলেনও। একটু একটু শুরুও
করলেন। কিন্তু হঠাৎ উনি অন্য জায়গায় চলে গেলেন তাই ইচ্ছেটা মনেই রয়ে গেল। বহুকাল বাদে
১৯২২ সালে লখনউ জেলে কিছু বই আনিয়ে আমি ফার্সি পড়া শুরু করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতও
ওখানেও শেখাটা পুরো হল না; শুরু করেই রয়ে যেতে হল।
সে সময় দূর দূর থেকে – কয়েক মাইল দূর থেকে ছেলেরা স্কুলে পড়তে আসত।
কেননা স্কুলের অভাব ছিল। সব পড়ুয়ারাই, সে যেমন পরিবারেরই হোক, সকালে কিছু খেয়ে দেয়ে
বাড়ি থেকে বেরুত। দুপুরের খাওয়ার জন্য সঙ্গে গুড়, ছোলা ইত্যাদি নিয়ে আসত। যাদের নিজেদের
মধ্যে মেলামেশা থাকত তারা নিজেদের খাবার একটু আধটু অদলবদল করে খেত। ছেলেদের জন্য দুপুরের
খাবার রেঁধে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তার চলনও ছিল না আর প্রয়োজনও বোধ করা হত
না। হ্যাঁ, শিক্ষকদের দুপুরের খাবার অবশ্যই রান্না হত এবং আমরা সে কাজে তাঁদের সাহায্য
করতাম। সে সময় শিক্ষকদের সব রকম ভাবে সেবা করার সাধারণ চলন ছিল। আমি খুব মন দিয়ে সেবা
করতাম শিক্ষকদের। খুব ভালো আর পাতলা রুটি তৈরি করা আমি সেসব দিনগুলোতেই শিখেছিলাম।
প্রথম প্রথম যে শিক্ষকদের সংসর্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল, তাঁরা হলেন
প্রধানশিক্ষক শ্রী শিবধনী সিং এবং সহায়ক শিক্ষক শ্রী রামদাস সিং। দুজনেই ক্ষত্রিয় ছিলেন,
গোঁড়া সনাতনপন্থী এবং শিব-বাবার ভক্ত। বড়জনের কাছে তো শিবপুজোর অনেক জিনিষপত্র ছিল
– সর্পাকৃতি পেতলের মাথাওয়ালা প্রদীপ, ঘন্টি, আচমনি, বাটি, থাল ইত্যাদি। আমিই প্রায়
প্রতিদিন ওগুলো মেজেঘষে পরিষ্কার করতাম। ছোটজনের কাছে এসব দন্ড-কমন্ডলু ছিল না। কিন্তু
উনি পুজোয় বেলপাতা চড়াতেন এবং প্রতিদিন পুষ্পদন্তাচার্যের মহিম্নস্তোত্র পাঠ করতেন।
সে সময় তো বুঝতে পারিনি মহিম্নস্তোত্র কি জিনিষ। কিন্তু পরে সংস্কৃত পড়ে জানতে পারলাম।
ওই সব পুজো এবং পুজারি শিক্ষকদের সংসর্গে থাকার কারণে বলুন আর গ্রামবাসীদের প্রবৃত্তির
প্রভাবে বলুন, আমি চিরকাল সনাতনী থেকেছি। এর গভীর প্রভাব যে সে সময় মনের ওপর পড়েছিল
তা মোছেনি। যদিও আগের মত গোঁড়ামি আর নেই এবং পরে আমি ধর্মের শুধু সেই সব কথাগুলো সবসময়
মেনেছি, যেগুলো বুদ্ধি দিয়ে মানতে পেরেছি। এটা সত্যি যে এখনো অব্দি সেই সনাতনপন্থার
কিছু না কিছু প্রভাব রয়ে গেছে। পরে শুনেছি যে সহায়ক শিক্ষক আর্যসমাজী হয়ে গেছেন; যে
মানুষটি আগে গোঁড়া মুর্তিপূজক ছিলেন তিনিই এখন মুর্তিপূজকদের পরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
যদি স্মৃতিভ্রংশ না হয়ে থাক, উনি একবার আমার সাথেও, হঠাৎ দেখা হওয়ায়, এ নিয়ে তর্ক করেছিলেন।
সে সময় জালালাবাদে একজন ক্ষত্রিয় বৈদ্য ছিলেন। ভালো মানুষ ছিলেন এবং স্কুলে প্রায়শঃ
আসতেন। এক দিন এমনিই খেলাচ্ছলে ছেলেরা ওনাকে নিজেদের নাড়ি দেখাতে শুরু করল কোনো অসুখ
আছে কিনা জানতে। ছেলেরা অসুখের গুরুত্ব কী বুঝবে? সে তো দেখাদেখিতে এগিয়ে যাওয়ার বালখিল্যতা
ছিল। আমিও পাশে ছিলাম আর হাতটা এগিয়ে দিয়েছিলাম। উনি নাড়ি দেখে বললেন যে যকৃতে পিত্ত
জমছে। এখনি এর উপায় না করলে পরে ক্ষতি হবে। আমি পিত্ত-টিত্ত কিছু বুঝলামই না। কাজেই
তা নিয়ে চিন্তাই বা কী করতাম? কিন্তু কত অভিজ্ঞ ছিলেন উনি সেটা পরে জানলাম। কেননা সত্যিই
সেই পিত্তের প্রকোপ, পরে তহশিলের স্কুলে কুইনাইন খাওয়ার পর আমায় অনেক হয়রান করেছে এবং
তার গরমে আমি সব সময় রুগ্ন থেকেছি। এদিকে বিশ বছরের বেশি কাল ধরে নুনমশলা ছেড়ে দেওয়ার
এবং কঠোর সংযমে থাকার ফলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে অসুখটা; একটু আরাম পেয়েছি।
লেখাপড়ার ব্যাপারে আরো দুটো কথা এখানে বলে রাখা জরুরি। প্রথমতঃ,
আমি খুব মন দিয়ে, ষোলো আনা মন লাগিয়ে লেখাপড়া করতাম। অন্য কোনো কাজের দিকে নজরও দিতাম
না। স্কুলে কখনো আমি অনুপস্থিত হইনি। কখনো, অসুখে পড়ে থাকলে হয়ত হয়ে থাকব, যা আমার
স্মৃতিতে নেই। কেননা সে বয়সে অসুখে কবে পড়েছিলাম তাও মনে নেই। ষোল বছর বয়স হওয়ার আগে
আমি বলতে গেলে অসুখেই পড়িনি। পড়ায় আমার মনোযোগ দেখে সবাই অবাক হত। কিন্তু দু’একদিন
কে জানে কী হল যে বাড়িতে থাকলে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত আর স্কুলে গেলে বাড়িতে ফিরে আসার
তীব্র ইচ্ছে জেগে উঠত। এমনকি একদিন চুপচাপ স্কুল থেকে মাঝসময়ে বেরিয়ে চলেও এলাম বাড়ি।
কিন্তু দু’একদিনের ভিতরেই মনের সেই অবস্থাটা চলে গেল। আমি ছাড়া আর কেউ জানতেও পারলনা
ব্যাপারটা। আজ অব্দি আমি বুঝতে পারিনি কেন এমন হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা এত অভাবিত
ছিল যে এখনো অব্দি ভুলিনি।
মন দিয়ে লেখাপড়া করার আর তীক্ষ্ণবুদ্ধি হওয়ার ফলেই ছাত্রজীবনে আমায়
কোনো শিক্ষক কখনো বকেওনি, মারেওনি। সে অভিজ্ঞতাই আমার নেই। প্রায়শ শুনতাম, পড়াশুনায়
ভালো হলেও অনেক ছেলে ফেল হয়ে যায়। কিন্তু নিজের জীবনে সেরকম দেখার ইচ্ছেটা রয়েই গেল।
মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করার সাথে সম্পর্কিত আরো একটি ঘটনা আছে। জালালাবাদে
যখন পড়তে যেতাম তখনকারই ঘটনা। ক্ষেত থেকে কেটে আনা ধান বাগানের খলিহানে জমা ছিল আর
সেই ফসল মাড়ানোর জন্য কতকগুলো বলদও ছিল সেখানে। ঠিক তখনই বাড়ির সব লোকের কোনো কাজ পড়ল
ক্ষেতে আর বলদগুলোকে পাহারা দেওয়ার জন্য আমি ছাড়া কেউ রইল না। আমি বইখাতা নিয়ে পড়তে
যাচ্ছিলাম। নিরুপায় হয়ে বাড়ির লোকেরা আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিল আর বলদের পাহারায় লাগিয়ে
কাজে চলে গেল। একদিনের জন্যও স্কুলে অনুপস্থিত থাকা আমার জন্য অসহ্য ছিল। ফলে সবাই
চলে যাওয়ার পর, বলদগুলোকে ওই ধানের স্তুপের ওপর ছেড়ে রেখা আমি স্কুলে চলে গেলাম। পেট
ভরে ধান খেল বলদগুলো। আমার মনে নেই যে ওদের আমি খুঁটিতে বেঁধে গেলাম না কেন। বোধহয়
বাঁধার কোনো সরঞ্জাম ছিল না। বাড়ির লোকেরা ফিরে এসে যখন ধানের দশা দেখল ভীষণ রেগে গেল।
আমিও সন্ধ্যেবেলা ভয়ে ভয়ে বাড়ি এলাম। কিন্তু, রেগে থাকা সত্ত্বেও তারা শুধুই জিজ্ঞাসাবাদ
করল আমাকে, কিছু বলল না। পরে জানতে পারলাম, লেখাপড়ায় আমার মনোযোগ দেখে ওরা আমার গাফিলতিটা
বরদাস্ত করে নিয়েছিল, পেটাই করেনি।
সে সময়কার আরো একটি কথা মনে আছে। আসলে আমি আজ অব্দি ঘোড়ায় চড়তে জানি
না। তাই ভীষণ ভয় পাই। এদিকে দু’তিনবার বাধ্য হয়ে ঘোড়ায় চড়তে হয়েছে। কিন্তু ঘোড়া একেবারে
শান্ত স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও আমি শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। তিন বছর আগে একবার জলন্ধর (পাঞ্জাব)
জেলায় কৃষক-সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে গিয়েছিলাম। স্টেশন থেকে তিন মাইল লোকেরা ঘোড়ায়
করেই আমায় নিয়ে গেল। ওরা বলল ওখানকার এটাই রেওয়াজ। আমাকে চড়তেই হবে। নিরুপায় ছিলাম।
গড়েপিটে বৈদ্যরাজ হওয়া ছাড়া আর গতিই বা কী ছিল? সেটা প্রথম বার ছিল। তিন মাইল মিছিলে
বাজনাবাদ্যির সাথে ধীরে ধীরে সভাস্থল, বড়াপিন্ড গ্রাম অব্দি যেতে হল। দ্বিতীয়বার এই
গত বর্ষায়। কৃষকদের বকাশ্ত সত্যাগ্রহের ব্যাপারে মাঝিয়াওয়াঁ (গয়া) যেতে হয়েছিল। সেখান
থেকে রাতে টেকারি ফিরে মোটরগাড়িতে গয়ায় এসে ট্রেনে পাটনা পৌঁছোন অপরিহার্য ছিল। মাঝিয়াওয়াঁতেই
রাত হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে একটা মাদি ঘোড়ায় চাপতে হল। রাস্তা ভীষণ খারাপ, চোদ্দ মাইলের
দূরত্ব আর অন্য কোনো উপায়ও ছিল না।
হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে আমি আরো একবার, যখন জালালাবাদে পড়তে
যেতাম, এক মাদি ঘোড়ায় চড়েছিলাম। সে ব্যাপারটা ভোলার মত নয়। সে সময় চলন ছিল যে গ্রামের
ছেলেরা যখন পড়তে যেত তখন কারোর না কারোর বাড়ি থেকে ছোটোখাটো টাট্টু নিয়ে গিয়ে পথে জালালাবাদের
দক্ষিণদিকের ঝিলে ঘাস চরার জন্য ছেড়ে দিত, তারপর ফেরার সময় সেগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসত।
যাওয়ার সময় টাট্টুগুলোকে তারা দৌড়ও করাত। আমি আলাদা থাকতাম। কিন্তু একদিন মনে নেই কী
করে বন্ধুরা আমাকেও একটা মাদি ঘোড়ায় চাপিয়ে দিল। আর তারপরেই হঠাৎ সেই ঘোড়া একটা গভীর,
যদিও শুকনো পুকুরের এক অংশে নেমে পড়ল। সেখানে কিনারটা খুব উঁচু ছিল। আমার তো রক্ত হিম!
বুঝে গেলাম যে এবার আমি উল্টে পড়ব, ঘোড়া আমার ওপর দিয়ে ছুটে যাবে, ব্যাস, আমার জীবন
শেষ! কিন্তু, প্রাণপণে আমি ঘোড়াটার পিঠ জাপটে ধরলাম এবং জানিনা কিভাবে বেঁচে গেলাম।
সেদিন থেকেই আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। সংকল্প করে নিলাম যে ভুলেও আর কখনো ঘোড়ায় চড়ব না।
সে সময় গ্রামাঞ্চলে চলন ছিল যে স্কুলপড়ুয়া ছেলেদেরকে দিয়ে রাতে তুলসীকৃত
রামায়ণ জোরে জোরে মিঠে আওয়াজে পড়ানো হত এবং গ্রামের অনেক মানুষ জমা হয়ে আগ্রহের সাথে
শুনত। অন্ততঃ আমাদের গ্রামে তো এ প্রথাই ছিল। মাঝে মাঝে থামিয়ে কোনো একজন বুঝদার মানুষ
অন্যদেরকে পঠিত অংশের মানে বুঝিয়ে দিত। আমি এবং আমার সাথে আরো একটি ছেলে, আমার সহপাঠী,
দুজনেই প্রায় প্রতিদিন এভাবে রামায়ণ পড়তাম। এমনও হত যে ঢোল-করতাল সহকারে গ্রামের লোকেরা
দুই লাইনে বসে রামায়ণের চৌপাইগুলো বিভিন্ন ভাবে গাইত এবং মাঝে যখন ওরা থামত আমাদেরকে
দিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ওদেরকে মানে বোঝান হত। এক ভাবে এটা রোজকার নিয়ম ছিল এবং সন্ধ্যাবেলায়
খাওয়ার পর অনুষ্ঠানটা হত। সে সময় বোম্বাইয়ে ছাপা রামায়ণ পাওয়া যেত। কৈথি অক্ষরে লেখা
রামায়ণও পাওয়া যেত। এভাবে দিনের পর দিন কয়েক বছর ধরে অনবরত পাঠ করার ফলে রামায়ণ প্রায়
পুরোটাই আমার মুখস্ত ছিল; এত দিন পরেও অনেকটা মনে আছে। সেই কারণে আজকালকার ছাপা রামায়ণে
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করি। পাঠে অনেক বদল হয়েছে, এত বেশি যে সে আর বলার মত নয়।
যখন রোজকার পাঠে ব্যবহৃত অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থটির এই অবস্থা, তাহলে অন্যান্য পুঁথি-পুরাণে
বদল করে দেওয়া, কপোলকল্পিত কথা ঢুকিয়ে দেওয়া খুব সহজ। কেননা ওসব বইয়ের প্রচার কম। কেউ
ধরতেও পারবে না। যখন ছাপাখানা ছিল না তখন তো এসব করা করা আরো সহজ ছিল।
আমাদের গ্রামে এবং গ্রামাঞ্চলে সে সময় আখ মাড়াই করার ঘানি খুব বড় আর মোটা একটা পাথরের হত, যেটা সব সময় মাটিতে এক জায়গায় পোঁতা থাকত। ওটাকে পাথুরে ঘানি [পথরিয়া কোল্হু] বলা হত। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরান যেত না। সে সময় প্লেগের ভয় ছিল না। পরে যখন আমার চোখের সামনেই প্রথম প্রথম গ্রামে ইঁদুর মরে পড়ল আর প্লেগ দেবতার আগমন ঘটল তখন ভয় পেলাম। কেননা নিয়ম মত, লোকেদের গ্রাম ছেড়ে খড়ের ছাউনিতে চলে যাওয়া জরুরি হয়ে গেল। কিন্তু পাথুরে ঘানি-মহারাজ তো যেতে অপারগ। উনি তো গ্রামের সীমানার ভিতরে উঠোনে বিরাজিত ছিলেন আর মানুষের জন্য ওখানে থাকা বারণ ছিল। তাই লোহার নতুন ঘানির বা কলের আবির্ভাব হল এবং তার প্রসার ঘটল। এই ঘানি যে কোনো জায়গায় সহজে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। আজ সেই পাথুরে ঘানি অর্থহীন দাঁড়িয়ে আগের দিনগুলোর স্মরণ করায়। এই ঘানির রস খুব ভালো হত। মাড়াইয়ের পর ছিবড়েয় একফোঁটাও রস থেকে যেত না। ঘানির পাথরটার মাথায় মাঝখানে একটা গর্ত থাকত যার চারদিকে আখের ছোট ছোট টুকরো ভরার জায়গা থাকত। ওই গর্তটায় একটা শক্ত আর লম্বা কাঠ দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত যেটাকে জাঠ বলা হত। জাঠের ওপর দিকটা ছুঁচলো হত। তাতে একটা কাঠ পরিয়ে নিচে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। সেই কাঠটা আবার জোড়া হত একটা লম্বা আর চ্যাপ্টা কাঠের সাথে যাকে কাতর বা কতরি বলা হত। কতরির একটা অংশ ঘানির কোমরের চারদিকে তৈরি নালিতে ডুবে ঘুরত। পুরো ব্যাপারটা তেলির ঘানির মত করেই বুঝুন। প্রতিদিন মাড়াই শুরু হওয়ার আগে, জাঠ বার করে ঘানিটাকে খুব ভালো করে ধোয়া হত যাতে কোথাও টকের ছোঁয়াচ না থেকে যায়। এই ঘানির ব্যাপারে আরো রকটি কথা যে এটা বেশ কয়েকটি পরিবারের সহযোগিতায় চলত। খুব বড় কোনো কৃষক হয়ত বা কোথাও একলা চালাত। সব বাড়ির মানুষ আর বলদ মিলেমিশে রোজ ঘানিটা চালাত এবং এক এক করে প্রত্যেকটি কৃষকের আখ কাটা হত এবং মাড়াই করা হত। রোজ দুপুরের আগে কিছুটা আখ মাড়াই করে তার রস সেই সব পরিবারের বাড়িতে পাঠান হত যারা মাড়াইয়ে শরিক হয়েছে। লোহার তৈরি কলটাকে তো কুকুরে চাটতেই থাকে। কিন্তু এই ঘানিটাকে চাটার বা ছোঁওয়ার জো ছিল না কেননা, এক তো বন্ধ হাতায় থাকত, যথেষ্ট উঁচু ছিল আর ধোয়াও হত প্রতিদিন। গুড় বানাবার কড়াইটাও বন্ধ ঘরে থাকত। আমি তো লোহার কলের নোংরা দেখে তার রস খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছি। সাহসই হয় না যে খাই।
(৫)
উপনয়ন সংস্কার এবং গুরুমন্ত্র
যদ্দুর মনে পড়ে বারো বছর বয়সে আমার উপনয়ন সংস্কার হয়ে গিয়েছিল এবং
আমি নিয়মিত ভাবে সান্ধ্য-উপাসনা করা শুরু করে দিয়েছিলাম। একাজ দুবেলা, ‘সকাল-সন্ধ্যা’
কয়েক ঘন্টা ধরে চলত। এ ছাড়া মন্দিরে শিবপুজোও নিয়মমত করতাম। মলমাসের সারাটা মাস প্রতিদিন
হাজার হাজার বেলপাতা আর ফুল শিবের মাথায় চড়িয়েছি। কখনো কখনো সে পাতায় চন্দন দিয়ে রাম-রাম
লিখেও চড়াতাম। ধীরে ধীরে এই পুজো বেড়েই চলল।
আমাদের বংশপরম্পরাগত গুরু ছিলেন এক নানকশাহি ভদ্রলোক। আগে তাঁর পূর্বপুরুষ
হয়ত সাধু ছিলেন। কিন্তু নিজে তিনি ছিলেন বাল-বাচ্চাওয়ালা। গ্রামাঞ্চলে এবং শহরেও একটা
চলন হয়ে গেছে যে স্ত্রী-পুরুষ সবাই গুরুর কাছে মন্ত্র নেওয়া জরুরি মনে করে। গুরুর কাছে
মন্ত্র নেওয়া মানে কয়েকটি সাধারণ আচরণবিধি পালন করার পর নির্জনে ভাবী শিষ্যের এবং নিজের
মাথা এক কাপড়ে ঢেকে তারই আড়ালে ভবিষ্যতের গুরুজির, ভাবী শিষ্যের কানে মন্ত্রের নামে
একটা বাক্য বলে দেওয়া। একেই কানে ফুঁ দেওয়ান, কানফোঁকান বা মন্ত্র নেওয়া বলে। সাধারণতঃ
উপনয়ন বা বিবাহের সময় ব্যাপারটা হয়। না হলে তীর্থযাত্রার সময় তো অবশ্যই হয়। লোকেরা
ভাবে যে এটা না করলে ধর্মের কাজ সফল হয় না, ব্যর্থ যায়। তাই বলা হয় যে নিগুরার (যে
গুরুমন্ত্র নেয়নি) ছোঁয়া জল খাওয়াও উচিৎ নয়। এটা একটা শক্তিশালি ধারণা যে গুরুমন্ত্র
না নিয়ে কেউ ভবসাগর পার হতেই পারে না। এর মহাপ্রমাণ হিসেবে ‘বিনু গুরু ভবনিধি তরৈ ন
কোই, যো বিরঞ্চি শঙ্কর সম হোই’ উদ্ধৃত করা হয়। এটাও বলা হয় যে নিগুরা যেখানে বসে সে
যায়গাটা অপবিত্র হয়ে যায়। তাই শেষমেশ, অন্ততঃ মরার আগে গুরুমন্ত্র নিয়ে নেওয়া অনিবার্য।
আর গুরুদের এমন দশা যে সংস্কৃতের ঠিক-ভুল শ্লোক, বাক্য বা পদসমূহ থেকে শুরু করে হিন্দি,
কৈথি, গুরুমুখি অথবা নিকৃষ্ট ও নিরর্থক শব্দাবলি অব্দি গুরুমন্ত্রের নামে চ্যালার কানে
ঢুকিয়ে দেয়। আর সেটাকেই সে বেদবাক্যের থেকে বড় বলে মনে করে। রীতিটা এই যে গুরুমন্ত্র
কাউকে বলা যায় না। কঠোর নিষেধ। বোধ হয় হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয়ে নিষেধটা করা হয়ে
থাকে। প্রতিদিন গুরুমন্ত্র জপ করা চ্যালাদের ধর্ম। কিন্তু খুব কমজনেই সেটা করে।
গুরুমন্ত্র নেওয়ার প্রথাটা এমন অনমনীয় যে কেউ ছাড়ার সাহস করে না।
গুরুরা বংশপরম্পরায় হয়। বাবা মরলে পর তার উত্তরাধিকারী পুত্র এবং সাধু মরলে পর তার
চ্যালা বা উত্তরাধিকারীই গুরু হতে পারে এবং তার কাছেই গুরুমন্ত্র নেওয়া জরুরি মনে করা
হয়। একজন গ্রাজুয়েট ব্রাহ্মণ, যে পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গিয়েছিল, আমায় লিখল
– গুরুমন্ত্র নেওয়া কি জরুরি, আর সেটা কি বংশের গুরুর কাছেই নিতে হবে? আমি উত্তর দিলাম
– ইউনিভার্সিটির ডিপ্লোমা লেখাপড়া করে পেয়েছিলে না চুরি করে? লেখাপড়া করলে তো বুদ্ধি
গজায় এবং এসব বোকামি পিছনে ছেড়ে যায়। বলার অর্থ, রীতিটা এত প্রবল যে তীক্ষ্ণবুদ্ধি
ইংরেজি লেখাপড়া জানা লোকেরাও এর থেকে বেরিয়ে আসার সাহস করে না আর মূর্খামির শিকার হয়।
এই বংশপরম্পরাগত গুরুগিরি গুরুগুলোকে নিরক্ষর এবং দুরাচারী বানিয়ে দিয়েছে। কেননা তাদের
পূজাপ্রাপ্তি, সম্মান আর আয় তো বন্ধ হবে না; লেখাপড়া করার বা সচ্চরিত্র থাকার চিন্তা
তারা কেন করবে? মূঢ় চ্যালাদের এটুকুও বোধ নেই যে গুরুনামধারী মানুষগুলো স্বয়ং নিরক্ষর
ও পাপী, ফলে নরকে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারবে না। যারা নিজেরাই ভবসাগরে ডুববে তারা ওদেরকে
কি করে নরকে যাওয়া থেকে বাঁচাবে বা ভবসাগর পার করাবে?
আমি দেখেছি যে পুরুষ তো পুরুষ, মহিলারাও এই গুরুদের কাছে মন্ত্র
নেয়। পুরুষেরা যদিও বা কেউ বাদ যায়, মহিলারা বাদ যায় না। কতটা পতন! হিন্দুদের পুঁথি-পুরাণে
তো স্ত্রীর জন্য পতিই গুরু। তুলসিদাসও বলেন, “সপনেহু আনপুরুষ জগ নাহীঁ”। কিন্তু কে
মানে? আসলে মহিলারা অনেক জামাকাপড়, গুরুপত্নীর জন্য শাড়ি ইত্যাদি এবং টাকা (পুজো ধার্য
করে) দেয়। তাই জেনেশুনে ওদেরকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখেছি যে যখন
গুরুজি বা তাঁর ছেলে আসত তখন তাদের খাটের ওপর বসিয়ে গ্রামের বয়োবৃদ্ধা মহিলারা একটা
থালায় জল নিয়ে আসত। সেই জলে গুরু মহারাজের দুই পা ধোয়া হত। সেই থালায় করে সেই জল বাড়িতে
উঠোনে চার দিকে ছেটান হত সমস্ত জিনিষ পবিত্র করার জন্য। গুরুজি জুতো পরে আসুক, বা খালি
পায়ে, গোড়ালিতে নোংরা নিয়ে, পা ধুয়ে সর্বত্র সেই জল ছেটাবার বিধান অপরিহার্য ছিল। তারপর
আবার অন্য জল সেই থালায় এনে দ্বিতীয়বার চরণ ধোয়া হত এবং সেই জল সমস্ত মহিলা ও পুরুষেরা,
চ্যালা-চেলিরা অঞ্জলি ভরে পান করত এবং মাথায় ছিটিয়ে নিত। কেমন নোংরামি আর মূঢ়তা! তারপর
গুরুজি ভোজন গ্রহণ করার পর তার উচ্ছিষ্টেরও লুট হত। তাকে প্রসাদ বলা হত; এখনও বলা হয়।
গুরুজির অন্যান্য সেবা তো সাধারণ ব্যাপার। যখন তার বিদায় নেওয়ার সময় আসত তখন সবাই
(প্রত্যেকটি ব্যক্তি) তার পায়ে কিছু না কিছু দ্রব্য এনে রাখত। সে প্রথাকে আগেও পুজো
বলা হত, এখনও বলা হয়। অদ্ভুত ব্যাপার যে টাকা-পয়সার নাম পুজো হয়ে গেল। গুরুজিরা সাধারণতঃ
প্রতি বছর একবার চক্কর দিয়ে যায়; সেটাকে ‘রামত’ও বলা হয়। হ্যাঁ, যখন চ্যালাদের সংখ্যা
খুব বেশি হয়ে যায় তখন ফি-বছরকার ‘রামত’ আর হতে পারে না। প্রত্যেক ‘রামত’এ চ্যালাদের
ধর্ম হল পুজো চড়ান আর কাপড়চোপড় দেওয়া। মাঝে যদি বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে তো আরো বেশি পুজো
গুরুজির প্রাপ্য হয়ে যায়। এভাবে প্রচুর আয় হয় গুরুজিদের। এটা সবচেয়ে সহজ উপায়ে সবচেয়ে
বেশি উপার্জন করার রাস্তা। পুজো-সৎকার ইত্যাদিও প্রচুর হয়। তাই জগতে সবচেয়ে ভালো পেশা
হল গুরুগিরি। সেই কারণেই, বড় বড় বিবেকবান এবং বিদ্বান মানুষেরাও, যারা বিচারদৃষ্টিতে
কখনোই এর ‘সমর্থন’ করতে পারবেন না, লোভে পড়ে এর আবর্তে আটকা পড়েন এবং হাজার হাজার চ্যালা
বানিয়ে ফেলেন।
আমার এধরণের চিন্তাভাবনা তো নিঃসন্দেহে অনেক পরে হয়েছে, যখন সব ব্যাপারে
অভিজ্ঞতা হয়েছে, ‘গুরুডম’এর নগ্নরূপটা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু জানিনা কেন, অল্পবয়স থেকেই
বা বলতে পারেন প্রথম থেকেই এর প্রতি আমার স্বভাবগত অনাস্থা, এ কাজ আমার প্রবৃত্তি-বিরুদ্ধ।
আমি কক্ষনো পছন্দ করিনি ব্যাপারটা। উপনয়নের সময়েও, সংযোগবশতঃ এই ভড়ংএর ‘গুরুমন্তর’
নেওয়ার সুযোগ হয় নি। বেঁচে গিয়েছিলাম। আমাদের পুরোহিতজি আমায় শুধু গায়ত্রীমন্ত্রের
উপদেশ দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল সমীচীন। যদিও শাস্ত্রমতে পুরোহিত নয়, বাবা অথবা বড় ভাইয়েরই
এই গায়ত্রীমন্ত্রের উপদেশ দিতে হত। যেমন সমস্ত ব্রাহ্মণ গোষ্ঠিতে এবং, ফলে, ভুমিহার
ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তিরহুত প্রভৃতি এলাকায় এখনো প্রচলিত। জুঝৌতিয়া ব্রাহ্মণ তো ওদিকে
এবং গ্রামে হয়ই নি। কিন্তু যুক্ত প্রদেশে ওই প্রথা তখনও ছিল না এবং এখনও নেই। এখানে
পুরোহিত অথবা একেবারে ভিন্ন কেউ আচার্য্য হয় এবং গায়ত্রী উপদেশ দেয়। এই প্রথা সব ব্রাহ্মণ
গোষ্ঠিতেই প্রচলিত। আমার বাবা তো গায়ত্রী জানতেনও না। একেবারে গ্রাম্য কৃষক ছিলেন।
ছোটো বেলা থেকেই, নিজের অজান্তেই, স্বাভাবিক ভাবে আমার ভিতরে ব্রাহ্মণ্য
ধর্মে এবং ব্রাহ্মণত্বে পুরো আস্থা ছিল এবং সে আস্থায় গর্ব করতাম। তাই ব্রাহ্মণোচিত
সান্ধ্য-উপাসনা ইত্যাদিতে আমার স্বাভাবিক আগ্রহ জন্মাল। সেটা দেখে একজন অন্য সর্যুপারী
ব্রাহ্মণ শ্রী হরিনারায়ণ পান্ডে, যিনি পুরোহিত না হওয়া সত্ত্বেও সে সময়ের হিসেবে ভালো
সংস্কৃত লেখাপড়া জানা, ধর্ম-কর্ম জানা এবং নিষ্ঠা সহকারে সান্ধ্য-উপাসনা ইত্যাদি করা
মানুষ ছিলেন, আমাকে নিজের দিকে টানলেন এবং বিস্তারিত ভাবে সান্ধ্য-উপাসন, স্নান, শৌচাদির
বিধি জানালেন। তাড়াতাড়িই সেসব আমি মনে গেঁথে নিলাম। দুবেলা তিন-তিন, চার-চার ঘন্টা
এই সমস্ত কাজে যেতে লাগল। কিন্তু, লেখাপড়ার কাজে কোন ত্রুটি হতে দিলাম না। ফলে, বাড়ির
লোকেদের রাগ হলনা আমার ওপর। হ্যাঁ, ধর্ম-কর্মের বহর দেখে, ঘরদোর ছেড়ে আমার বিবাগী হওয়ার
ভয় হল ওদের মনে। তাদের সেই দুশ্চিন্তা এদিক ওদিক ছড়াতে লাগল। পন্ডিত হরিনারায়ণ পান্ডের
খুব দুর্নামও ছিল যে তিনি মানুষকে বিবাগী করে দেন। দু’একবার উনি নিজেও বাড়িঘর ছেড়েছিলেন,
কিন্তু ফিরে এসেছিলেন পরে। অন্য কয়েকজনকে ওই পথে এগিয়ে দেওয়ার গুরুতর অপরাধ ছিল ওনার
কাঁধে। তাই লোকে ভয় পেত।
গ্রামে একজন বুড়ো ছিলেন, যাঁর দশা ছিল নারদের মত। আকছার এদিক ওদিক
ঘুরে নানা রকম কথা বলতেন। একদিন সান্ধ্য-উপাসনের প্রাণায়ামকে কটাক্ষ করে উনি বললেন,
যে মানুষ নিজের নাক চেপে ধরে, অন্যেরটা চেপে ধরতে তার কিসে দ্বিধা হবে? কিন্তু, এসব
কানাঘুষো আর উত্তেজনা সত্ত্বেও আমার দিনযাপন অবাধে চলতে লাগল। হরিনারায়ণজি যোগসাধনার
অনেক বই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। খুব শখ ছিল প্রাণায়াম এবং বিভিন্ন মুদ্রার। এদিক ওদিক
থেকে একটু আধটু শিখেওছিলেন। ব্যস, আমারও নেশা হয়ে গেল প্রাণায়াম এবং যোগাভ্যাস করার।
অনুশীলন শুরু করলাম। পরে এই নেশা এবং এর মূলে থাকা অন্তরের ব্যপ্ত বৈরাগ্য আমায় হঠাৎ
বাড়িঘর ছেড়ে যোগী হতে এবং ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্য সন্ন্যাসি হতে বাধ্য করল। এভাবে বাড়ির
লোকেদের ভয়টাও সত্যি প্রমাণিত হল। পরে, প্রসঙ্গ এলে এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়া যাবে।
পন্ডিত হরিনারায়ণ পান্ডের সাথে আমার সম্পর্ক দিনের পর দিন ঘনিষ্ঠ
হয়ে উঠছিল। যত চেষ্টা হচ্ছিল আমায় আটকাবার, তত বেশি আমি জেদের সাথে সম্পর্কটাকে দৃঢ়তর
করে তুলছিলাম। আসলে এটা আমার স্বভাব। যে ব্যাপারে পড়ি, বাধা-বিঘ্ন আমায়, তা থেকে সরিয়ে
দেওয়ার বদলে আরো জড়িয়ে দেয়। হ্যাঁ, যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কেউ আমায় ফিরিয়ে আনতে চায় তাহলে
অন্য কথা। কিন্তু চাপের মুখে নুয়ে পড়া তো আমি জানিই না। এই ভাবটা এখনো আছে। তাই অনেকে
আমায় জেদি এমনকি স্বৈরাচারীও বলে দেয়। কিন্তু আমি এটাকে নিজের একটি অপূর্ব শক্তি মনে
করি, এবং এতে গর্ব অনুভব করি।
এর রহস্য না বুঝতে পারা মানুষদের মুর্খতায় কখনো কখনো হেসেও উঠি মনে
মনে। হ্যাঁ, তো পন্ডিতজির সাথে আমি, আগে যে ধরণের গুরুমন্ত্রের কথা বললাম সে রকম কোনো
গুরুমন্ত্রের সম্পর্ক স্থাপন করিনি। কেননা তার সম্ভাবনা ছিলই না। তবুও হৃদয় থেকে তাঁকে
গুরুর মত মানতাম। উনিও আমায় খুব ভালোবাসতেন। উনি আমার সংস্কৃত পড়ায় হাতেখড়ি করালেন।
ধীরে ধীরে সে পড়া এমন বাড়ল যে পরে সংস্কৃত সাহিত্যে ভালোভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হলাম।
হ্যাঁ, ওই গুরুডমএর সম্পর্ক আমি কখনো পছন্দ করিনি। সেদিনও ওই সম্পর্কের আমি তীব্র বিরোধী
ছিলাম, আজও তাই। কয়েক হাজার জনকে এই অন্ধ-পরম্পরা থেকে ছাড়িয়েছি এবং কখনো একজনও শিষ্য
তৈরি করিনি। যদিও নিজে তো নিয়েই ছিলাম সন্ন্যাসের দীক্ষা। কিন্তু সেটা অপরিহার্য ছিল।
এটা আমার এক প্রকারের সিদ্ধান্ত এবং সঙ্কল্প যে কোনো ধরণের শিষ্য বা চ্যালা তৈরি করব না এবং সন্ন্যাসি তো কখনো কাউকে বানাবই না। নিঃসন্দেহে, সন্ন্যাসি হওয়ার পর এমন
সুযোগ বার বার এসেছিল যে আমি চ্যালা বানানোয় ফেঁসেই যেতাম। কিন্তু কোন ভাবে চুপি চুপি
উঠে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে পালিয়েছি।
অধ্যয়ন থেকে সন্ন্যাস অব্দি
(১)
গাজিপুরে – হিন্দি মিড্ল স্কুলে
১৯০২ সালের শুরুতে আপার প্রাইমারি পরীক্ষায় পাশ করার পর বাড়ির লোকেরা
আমায় হিন্দি মিড্লে পড়ানো স্থির করল। তাই, গাজিপুরের পুরানি কোটে অবস্থিত তহসিল স্কুলে
ভর্তি হলাম। ওখানেই বোর্ডিংহাউজে থাকতাম আর লেখাপড়া করতাম। ওখানে না জানি কতজন শিক্ষকের
সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমার। লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো ছিলাম এবং দুষ্টু-স্বভাবের
ছিলাম না বলে এধরণের ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়ারই ছিল। কিন্তু ওই জেলারই বিশ্বম্ভরপুর
গ্রামের নিবাসী শ্রী অমৃতরায়ের সাথে আমার একটু বেশিই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। আসলে উনি তীক্ষ্ণবুদ্ধি
ছিলেন এবং অঙ্ক খুব ভালোবাসতেন। আমিও সেই রকম ছিলাম। অঙ্ক আমারও হৃদয়ের বস্তু ছিল।
তাই হয়েছিল অমন ঘনিষ্ঠতা, যা সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও একই রয়ে গেছে। শ্রী অমৃতরায়
সেসময় আমাকে যেমন খাতির করতেন, সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও, কখনো কখনো দেখা হলে তার থেকে
বেশি খাতির ও সমাদর করতেন। উনি পরিশ্রমও অনেক করলেন এবং অর্থও উপার্জন করলেন। কিন্তু
বাড়ির লোকেদের আর প্রতিবেশিদের দুর্বুদ্ধিপরায়ণতায় এবং যাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ
করেছিলেন তাদের অকালমৃত্যুতে উনি সবসময় দুখী থাকতেন। দেখা হলে উনি সেইসব নিয়েই অনুযোগ
করতেন।
অঙ্ক আমি এমন ভালবাসতাম যে কঠিন কঠিন প্রশ্ন পেলেই তক্ষুণি বসে যেতাম
আর সমাধান না করে উঠতাম না। কখনো কখনো কয়েকদিন অব্দি লেগে থাকতাম প্রশ্নটার পিছনে,
তবে গিয়ে সমাধান পেতাম। আকচার এমন হত যে পায়খানায় গিয়েও প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে থাকতাম
এবং প্রায়শঃ পায়খানাতেই তার ঠিক উত্তর এবং সমাধানের পথটা পেয়ে যেতাম। অবাক হতাম ঠিকই,
কিন্তু ব্যাপারটা নিয়মিত চালিয়ে গিয়েছি। বিশেষ করে কঠিনতম প্রশ্নগুলোর সমাধান তো তখনই
হয়ে যেত। যখন আমি শ্রী অমৃতরায় এবং অন্যদের, কথাটা বললাম, ওরা বলল যে পায়খানায় বসে
অন্তঃকরণের সমস্ত বৃত্তি স্বাভাবিক ভাবে একাগ্র হয়ে যায় এবং কঠিন থেকে কঠিন প্রশ্নগুলোর
সে সময় নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কথাটা সত্যি। তারপর থেকে ব্যাপারটা আমি অন্যভাবেও পরীক্ষা
করেছি। তফাত শুধু এটুকু যে পায়খানে যেন স্বাভাবিক ভাবে হয়, কোনো অসুস্থতা বা অসুখের
জন্য না হয়। তহসিল স্কুলে প্রথমবার আমি কঠিন জ্বরে পড়লাম। শিগগির গেল না সে জ্বর। আগে
তো, মনে আছে যে জ্বর এলেই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিতাম আর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জ্বর নেমে
যেত। লোকেরা শুধু মাথাব্যথা দূর করার জন্য সরষে জলে পিষে কপালে লাগিয়ে দিত। অন্য
কোনো ওষুধের প্রয়োজন হত না। কিন্তু এবার তেমন হল না। লেখাপড়া জানা মানুষেরা ছিল কাছে,
তারা জ্বর নামাবার জন্য কুইনাইন খাওয়ালো খুব করে। ভালো তো হয়ে উঠলাম কিন্তু পেটে কুইনাইনের
গরম ধরে নিল, শিরায় ঢুকে গেল। বোধ হয় গরুর দুধ খাওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু আমি তখন বুঝিনি।
এই কুইনাইন পরে গিয়ে ভীষণ জ্বালিয়েছিল।
মিডলে দুটোই ক্লাস ছিল এবং দুটোতেই লেখাপড়া
অবাধ ভাবে চলল। তার মাঝে পুজোপাঠেও কোন কমতি এল না। মাঝে মাঝে যখন বাড়ি যেতাম পন্ডিত
হরিনারায়ণজির সাথে দেখা হত। যদ্দিন বাড়িতে থাকতাম আমার সৎসঙ্গ নিয়মিত চলত। হ্যাঁ, এখানে
আরেকটা কথা বলার। তখনই বিএনডব্লিউ রেলওয়ে লাইন
গাজিপুরের দিকে আর দেওয়ার দিকেও বেছানো হয়েছিল (কেননা বেনারসের উত্তর-পূর্ব
দিকের ঔরিহার থেকে একটা লাইন গাজিপুর হয়ে ছাপরা যায় আর দ্বিতীয়টা দুলহপুর মউ হয়ে ভটনি)।
তাই কখনো ওই লাইনে ট্রেন ধরে আর কখনো পায়ে হেঁটে বাড়ি যেতাম। দুলহপুরের লাইন তো জালালাবাদে
পড়ার সময়েই তৈরি হয়েছিল। একবার যখন প্রথম প্রথম লাইন বেছানোর জিনিষপত্র নিয়ে বেছানোর
যন্ত্রবাহী ট্রেন এসেছিল তখন আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রওনা হওয়ার ট্রেনটা বাঁশি
বাজাল, তার অদ্ভুত আওয়াজ শুনে ভয়ের চোটে আমরা সবাই পড়ি কি মরি করে পালালাম।
আপার প্রাইমারিতে পড়ার সময়কার একটা কথা ভূলে গেছি। সে সময় লোয়ার
ক্লাসে এক পয়সা আর আপারে দুই পয়সা ফিস দিতে হত। এদিকে তো বাড়িয়ে কয়েক আনা করে দেওয়া
হয়েছে। এটাই হল সরকার কর্ত্তৃক প্রাইমারি শিক্ষা সহজলভ্য করার অদ্বিতীয় উদাহরণ!
মিডলের শেষ পরীক্ষা ইউনিভার্সিটির স্তরে হত এবং তার ফল সরকারি গেজেটে
ছাপত। আমি সেই পরীক্ষা দিলাম ১৯০৪ সালের শুরুতে। গরমকালে যখন মামার বাড়ি গিয়ে মামার
সাথে আজমগড় শহরে গিয়েছিলাম তখন পরীক্ষার ফল বেরুল। আমি আর মামা নিজের চোখে গেজেট দেখে
নিশ্চিত হলাম। যুক্ত প্রদেশের সবক’টি হিন্দি মিডল স্কুলের পরীক্ষার ফল এক সাথেই বেরিয়েছিল।
আর কত হাজার ছাত্র পাশ করেছিল! প্রদেশে আমার স্থান সপ্তম ছিল। এতে নিশ্চিত হওয়া
গেল যে সরকারি ছাত্রবৃত্তি (স্কলারশিপ) এবার নিশ্চয়ই পাব; আমায় পড়ানোর খরচের কম চাপ
পড়বে বাড়ির ওপর। ঠিক মনে নেই – চার, পাঁচ অথবা ছয় টাকা বৃত্তি পেতাম আর সে সব সস্তার
দিনকাল ছিল। ফলে, কম পয়সাতেই কাজ চলে যেত। ভালো করে মনে আছে যে আঠাশ গন্ডায় এক সেরের
হিসাবে একটাকায় দুই সের ঘী পাওয়া যেত। আজমগড় থেকে খুশিতে ডগমগ করতে করতে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়িতে এসে নিশ্চিত হল যে আমি ইংরেজি পড়ব।
তহসিলের স্কুলে পড়ার সময় আমি হিন্দির সাথে উর্দুর অনুশীলনও একটু-আধটু
চালিয়ে গিয়েছিলাম, যদিও আগের মত সুবিধা ছিল না। কেননা উর্দুর ক্লাস আলাদা হত আর তার
শিক্ষক ছিলেন মৌলবিসাহেব। তাই পড়ানো শোনার সুযোগ পেতাম না। তবুও, চেষ্টা করলে কী না
হয়! সে সময় উর্দুতে ‘বাহারিস্তান’ নামে একটি বই পড়ানো হত। খুব কঠিন মনে করা হত বইটা।
নতুন বেরিয়েছিল। আমি সেই বইটা পড়ার অভ্যাস করলাম কিছুটা। ব্যাকরণেরও অভ্যাস করলাম।
ওখানেই গাজিপুরের কাছে তারি-ঘাটের শ্রী লোটু সিংএর সাথে বন্ধুত্ব হল। সে বন্ধুত্ব ইংরেজি
পড়ার সময়েও রইল। সন্ন্যাস নেওয়ার পরেও সেই বন্ধুত্ব অনেকটা বজায় ছিল। উনি ছিলেন গোঁড়া
শিবভক্ত, দেহে বিভূতির প্রলেপ লাগানো মানুষ, গলায় লম্বা রুদ্রাক্ষের মালা। এই সেদিন
অব্দিও তাঁর গলায় সেই মালা দেখেছি। আমার মত ওনারও খাওয়াদাওয়ায় ভালো মতন ছোঁয়াছুঁইর
বাছবিচার ছিল। এই খাওয়া-দাওয়া আর ছোঁয়াছুঁইর ব্যাপারে পরে লিখব।
(২)
ইংরেজি পড়া – মিশন স্কুল
মাস ঠিক মনে নেই, কিন্তু গরমের ছুটির পর স্কুল খুলতেই আমি গাজিপুরের
জার্মান-মিশন-হাই ইংলিশ-স্কুলের স্পেশাল ক্লাসে ভর্তি হলাম। আসলে ভার্নাকুলার হিন্দি
বা উর্দুতে মিডল পাশ করে যারা ইংরেজি পড়তে চাইত, তাদের দশ বছরের বদলে পাঁচ বছরেই ম্যাট্রিকুলেশন
পাশ করিয়ে দেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল সে সময়। জানি না, সে ব্যবস্থা আর আছে না নেই।
এমন ছাত্ররা অঙ্ক, ভুগোল ইত্যাদি তো জেনেই আসত। শুধু ইংরেজি পড়ায় একটু বেশি সময় দিতে
হত। গাজিপুরে ভিক্টোরিয়া এবং মিশন, দুটো হাই স্কুল থাকা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থা শুধু
জার্মান-মিশন-স্কুলেই ছিল। এখানে ওদের জন্য স্পেশ্যাল ক্লাস হত, যেটা সিক্সথ বা ছয়
ক্লাসের সমকক্ষ ছিল। সে সময় আরো একটা নিয়ম ছিল যে যারা দশ ক্লাস (এখন ও এগার ক্লাস
হয়ে গেছে) বা ম্যাট্রিকুলেশনের পরীক্ষা দেবে তাদের বিজ্ঞান (সায়েন্স), সংস্কৃত অথবা
ফারসি, তিনটে বিষয়ের মধ্যে একটা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পড়তে হবে। তাই স্পেশ্যাল ক্লাসে
সংস্কৃতও পড়তে হত। আমি তো নিজেও সংস্কৃত পড়তে চাইতাম। ফলে পাঠ্যবই ‘ঋজু ব্যাকরণ’এর
সাথে আমি ‘লঘুসিদ্ধান্তকৌমুদি’ও পড়া শুরু করলাম। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কিছুটা আগের
সংস্কার, কিছুটা ক্লাসের পড়া আর কিছুটা, বিশেষ করে ইংরেজির সাথে ‘লঘু কৌমুদি’ পড়ার
জন্য সংস্কৃত ভাষাটা আমার কাজচালানোর মত আয়ত্ত হয়ে গিয়েছিল। স্কুল ছাড়তে ছাড়তে সেটা
ভালো রকম আয়ত্ত হয়ে গেল।
ধার্মিক মনোভাবের ব্যাপারটায় বলতে হয় যে ইংরেজি আর সংস্কৃতের সাথে
সাথে ধর্মের দিকে আমার ঝোঁকটা বাড়তেই থাকল। হরিশঙ্করী পাড়ার কাছে মহাজন টোলার, গুণেশ্বর
মহাদেব নামে প্রসিদ্ধ এক শিব মন্দিরে আমি থাকতে শুরু করলাম। ওখানে থাকলে পুজোপাঠটা
সহজ হত। এক বুড়ি মাড়োয়ারিন এবং গেরুয়াধারী বাবা ওখানে থাকতেন। দুজনেই আমায় খুব ভালো
বাসতেন। আমি আগে চামড়ার জুতো পরতাম। ধর্মভাব এমন প্রবল হল যে সে জুতো ছেড়ে রোপসোলের,
কাপড় বা ক্যানভাসের জুতো পরা শুরু করলাম। সে অভ্যেস সন্ন্যাস নেওয়ার পরও এই সেদিন অব্দি
ছিল। মাত্র তিন-চার বছর হল আমি আবার চামড়ার জুতো পরা শুরু করেছি। এ ব্যাপারেও বিশেষ
কিছু কথা পরে বলব। হ্যাঁ, এদিকের বছরগুলোয় কাপড়ের জুতো পরা ছাড়ার আগে আমি রবারটায়ারের
সোলওয়ালা জুতো পরতে শুরু করেছিলাম কেননা, রোপসোল ভালো পাওয়া যেত না। জুতো ছাড়া স্কুলে
কোট, জামা ইত্যাদি যা পরতাম সেগুলো স্কুল থেকে ফিরে আলাদা করে রেখে দিতাম এবং পরের
দিন যাওয়ার আগে ছুতামও না। এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল ছোঁয়াছুঁইর বাতিক। সব ধরণের মানুষের
সাথে স্কুলে সংস্পর্শ হওয়ার কারণে আমি ওই জামাকাপড়গুলোকেও অন্য সময়ের জন্য অস্পৃশ্য
মনে করতাম; যদি ওই জামাকাপড়গুলোর ছোঁয়া লেগে যেত তাহলে স্নান করতে হত। স্কুলের জামাকাপড়
পরে জলও খেতাম না। ধার্মিক গোঁড়ামি বাড়তে বাড়তে পাগলামির মত হয়ে গিয়েছিল।
ওদিকে স্কুলে, মিশন স্কুল ছিল বলে বাইবেল পড়া জরুরী ছিল। ফলে ওরই
মধ্যে বাইবেল পড়ে আমি বইটায় যা কিছু আছে জেনে নিলাম। যদিও বিগত ইয়োরোপীয় মহাযুদ্ধের
সময় ইংরেজ সরকার স্কুলটাকে, জার্মান মিশনের স্কুল ছিল বলে বাজেয়াপ্ত করে নিল। এখন স্কুলটার
নাম সিটি হাই স্কুল। অবশ্য সে সময় তো স্কুলটা জার্মান মিশনেরই ছিল। স্কুলে ভারতীয়
পাদরীরা বাইবেল পড়াত; কখনো কখনো জার্মান সাহেবরাও পড়াত। পড়ানোর সময় অন্যান্য ধর্ম,
বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের সমালোচনা তো ওরা করতই। কিন্তু আমার জন্য সেটা অসহ্য ছিল। এক
সাহেব পড়াচ্ছিল। পড়ানোর সময় এমন সমালোচনা করল যে আমি বরদাস্ত করতে পারলাম না। আমি জানতান
যে সেই সাহেবই স্কুলের মালিক। তবু উঠে দাঁড়িয়ে সোজা প্রশ্ন করলাম যে এটা স্কুল না ধর্মাদির
প্রমাণ-অপ্রমাণের আখড়া? সাহেব এটাকে নিজের অপমান ধরে নিয়ে আমায় ধমকাল বটে, তবে তার
পর থেকে অন্ততঃ আমার সামনে সেসব সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেল।
যখন স্পেশ্যাল ক্লাসের প্রথম বছর (ফার্স্ট স্পেশ্যাল আর সেকেন্ড
স্পেশ্যাল নামে দুটো ভাগ ছিল স্পেশ্যাল ক্লাসের যা দুবছরে পুরো হত) পাশ করে দ্বিতীয়
বছরে পৌঁছোলাম তখন একটা প্রশ্ন উঠল। দ্বিতীয় বছর সাত ক্লাসের সমান হত। তারপর আট ক্লাস,
যেটাকে সে সময় মিডল বলা হত। আট ক্লাসে গেলে স্কলারশিপ বা ছাত্রবৃত্তির পরীক্ষা ইয়ুনিভার্সিটির
তরফ থেকে বছরের শেষে নেওয়া হত। শিক্ষকদের খেয়াল হল যে রেজিস্টারের হিসাবে বছর শেষ হতে
না হতে আমার বয়স অধিকতম সীমা থেকে কয়েক মাস বেড়ে যাবে; ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা থেকে আমি
বাদ পড়ে যাব। তাই শিক্ষকেরা রায় দিলেন যে আমি যেন দুটো ক্লাসের পরীক্ষাই এক বছরে দিয়ে
দিই, তাহলে কাজ হয়ে যাবে। নইলে ষোল টাকা খরচ করে সিভিল সার্জনের কাছ থেকে কম বয়সের
প্রমাণপত্র (সার্টিফিকেট) নিতে হবে। আমার এক সঙ্গী তাই করল। কিন্তু আমার, সাত আর আট,
দুটো ক্লাসের পরীক্ষাই এক বছরে দেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া বেশি সহজ মনে হল। আমি তাতে সফলও
হলাম। ছাত্রবৃত্তির পরীক্ষা বেনারস কুইন্স কলেজ স্কুলভবনে হল আর আমি খুব ভালো ভাবে
পাশ করলাম। এবার আমার জায়গা ইউনিভার্সিটিতে পঞ্চম ছিল। আসলে তাড়াহুড়োয় ইংরেজিতে যেটুকু
কাঁচা রয়ে গিয়েছিলাম বোধহয় তার জন্যই পঞ্চম স্থান পেলাম। নইলে নিশ্চিত ওপর দিকে যেতাম।
মিডলের ছাত্রবৃত্তি তো ছিলই। এই পরীক্ষার পর দু’একটাকা বেশি পেতে শুরু করলাম।
মিডল ক্লাসে আমাদের এক মাস্টার সাহেব ছিলেন যাঁর নাম ছিল সুর্য প্রসাদ।
উনি কাশির বাসিন্দা, খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। মিডল বা আটক্লাসের
পরীক্ষা না দেওয়া পর্য্যন্ত উনি আমাকে ইংরেজি পড়িয়ে গেলেন। অফিসের কাজও ওনার জিম্মায়
ছিল। উনি খুব তীক্ষ্ণবুদ্ধিও ছিলেন। যখন সন্ন্যাসি হওয়ার পর ১৯০৭ সালে আমি গাজিপুরে
গেলাম এবং পাহাড়খাঁএর পুকুরের দক্ষিণ দিকের ঘরে (যেখানে আগেও মাঝে মাঝে গিয়েছি) উঠলাম,
তখন অন্যান্য মানুষ এবং স্কুলের শিক্ষকদের সাথ্র উনিও আমার সাথে দেখা করতে গেলাম। উনি আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কী এমন খারাপ কাজ করেছি যে আপনি কাঁদছেন? চট করে উনি জবাব দিলেন
যে মহারাজ, যদি আপন বা ভালোবাসার কেউ বৈকুন্ঠেও যায় তবুও তো মানুষ কাঁদেই। যদিও যুক্তির
দিক থেকে দেখলে তার খুশি হওয়া উচিত। এর উত্তর আমার কাছে ছিল না।
যখন ১৯০৬ সালে আমি নয় ক্লাসে, নবম শ্রেণী ব ম্যাট্রিকুলেশনের আগের ক্লাসে পৌঁছোলাম তখন শিক্ষকেরা ভাবতে শুরু করলেন যে পরের বছর (১৯০৭ সালে) ম্যাট্রিকুলেশনের পরীক্ষায় আমি যেন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট হই, আর এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়; শুধু একটু বেশি পরিশ্রম করে আমায় ইংরেজিতে মজবুত হতে হবে। মাস্টারেরাও আমার পুজো-পাঠ দেখে ভয় পেতেন। তাঁরা চাইতেন যেন বেশি সময় ওসবে না দিয়ে ইংরেজি পড়ায় লাগাই। অন্য দিকে আমার অদ্ভুত অবস্থা ছিল। পড়াশোনায় মন বসত না আর বার বার সন্ন্যাসি হওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠতাম। তার গল্প পরে আছে। বাড়ির লোকেরাও চাপ দিত। বকত যে ধর্ম-কর্মের এত লম্বা দিনচর্যা ছেড়ে লেখাপড়ায় বেশি মন দিইনা কেন। ওদেরও ভয় ছিল যে বৈরাগী হয়ে আমি জঙ্গলে না চলে যাই। তাই পন্ডিত হরিনারায়ণজির ওপর ওরা খাপ্পা হয়ে থাকত। কখনো কখনো কথাও শোনাত ওনাকে। কিন্তু আমি তো থামবার পাত্র ছিলাম না। আমার কাজ বাধাহীন ভাবে চলত আর বাধা দেখলে আরো তীব্র ভাবে চলত।
(৩)
প্রথম বৈরাগ্য
১৯০৬ সালেরই কথা। কোনো একটা ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম, আবার সেখান থেকে
গাজিপুরে ফিরে এসেছিলাম। গ্রীষ্মের দিন ছিল। চুপিচুপি একদিন বেনারসের টিকিট কাটিয়ে
ট্রেনে বসলাম আর হরিদ্বারের পথে রওনা হয়ে গেলাম যাতে ওখানে গিয়ে সন্ন্যাস নিতে পারি।
হ্যাঁ, গরমের ছুটির পর ফিরেছিলাম। জুলাইয়ের শুরুতে। সন্ন্যাস নেওয়ার মাস কয়টি পেরিয়ে
যাওয়ার পর। বর্ষাকালে সন্ন্যাস নিতে মানা আছে শাস্ত্রে, আমি জানতাম। তাই তাড়াতাড়ি রওনা
হয়ে গিয়েছিলাম; কাউকে কিছু বলিনি। বেনারসে পৌঁছে হরিদ্বারের টিকিট কিনতে চাইলাম। কিন্তু
পেলাম না, আর তাতেই ঝামেলা হল। যাহোক, লখনউএর টিকিট কেটে ট্রেনে চাপলাম, পরের দিন সকালে
লখনউ পৌঁছোলাম। স্নান, শৌচ ইত্যাদি কিছুই করিনি। ট্রেনে বা কলের জলে তো করতেও পারতাম
না। কেননা সে জল ব্যবহার করার অভ্যাস ছিলই না, ঘেন্না করতাম। তাই শিগগিরই টিকিট কেটে
ট্রেনে চেপে হরিদ্বারের দিকে এগোলাম। লখনউএর পর কাকোরি স্টেশনে পৌঁছে ভাবলাম এখানেই
নিত্যকর্ম, স্নানাদি সেরে কিছু খেয়ে নিই, তারপর অন্য ট্রেন ধরে এগোব। ব্যস, নেমে পড়লাম।
সেরেও নিলাম সব কাজ। ট্রেন পেতে দেরি ছিল। বসে বসে মাথায় চিন্তা এল হঠাত, যে যদি হরিদ্বারে
পৌঁছে যোগ্য সন্ন্যাসি গুরু খুঁজে পেতে দেরি হয়ে যায় এবং সন্ন্যাসের সময় পেরিয়ে যায়
তাহলে? তাহলে তো খারাপ ব্যাপার হবে। মিছিমিছি অপেক্ষা করতে হবে লাগাতার কয়েক মাস। আর
তার মাঝে যদি বাড়ির লোকেরাই খুঁজতে খুঁজতে এসে ধরে নিয়ে যায় তাহলে তো আরো খারাপ হবে।
আসলে কোনো সন্ন্যাসির সাথে আমার পরিচয় ছিল না আর ভয় পাচ্ছিলাম যে যদি ওরা তাড়াতাড়ি
সন্ন্যাস না দিয়ে পরীক্ষা করার জন্য রেখে নেয় তাহলে এখন সন্ন্যাসি হতে পারব না। সেই
ভয়টা মাঝে মাঝে আরো প্রবল হয়ে ফিরে আসতে লাগল। শেষে ভাবলাম এর চেয়ে তো চুপচাপ গাজিপুরে
ফিরে যাওয়া ভালো। তাহলে কেউ জানবেও না আর পরে যখন চাইব পালিয়ে সন্ন্যাস নিতে পারব।
কিন্তু যদি সন্ন্যাস নিতে বাধা পেয়ে এবার এমনি এমনি ধরা পড়ে যাই, তাহলে সব সময়ের জন্য
বাড়ির লোকেদের কড়া পাহারা বসে যাবে আমার ওপর; ভবিষ্যতে সন্ন্যাস নেওয়া অসম্ভব না হলেও
কঠিন নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। তাই শেষে ফিরে যাওয়াই স্থির করলাম। কাকোরি থেকে ফিরতি ট্রেনে
বসে চুপি চুপি গাজিপুর চলে এলাম। স্কুল খুললে পর স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। লোকেরা ভাবল
ছুটির বাড়ি থেকে ফিরেছি। আসলে ছুটি শেষ হওয়ার মাত্র দু’একদিন আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম
তাই কেউ বুঝতে পারেনি। নইলে স্কুল থেকে দু’একদিন অনুপস্থিত থাকলেও ঝড় বইত আর খামোখা
সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদ হত। তাই আগেই চালাকি করলাম। এখানে এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে
দিই। যখন পরে, এদিকের দিনগুলোয় কাকোরি ট্রেন ডাকাতির খবরের কাগজে পড়লাম আমার চোখে কাকোরির
ছবি ভেসে উঠল – সেই কাকোরি, সন্ন্যাসি হতে হতেও না হয়ে আমার ফিরে আসার পিছনে যার হাত
ছিল, জানিনা কেমন করে।
(৪)
বিবাহ এবং স্ত্রীর মৃত্যু
এগোনোর আগে আমার বিয়ের গল্প বলে দেওয়া জরুরি। যদ্দুর মনে আছে, গাজিপুরে
লেখাপড়ার প্রথম কিস্তি, অর্থাৎ মিডলের পরীক্ষা পাশ করতে করতে গ্রীষ্মের দিনে আমার বিয়ে
হয়ে গেল। এখানে পরিষ্কার করে দিই যে যদিও বিয়েটা ছোটো বয়সেই হল আর আমার মনে একটা বৈরাগ্য
জড়িয়ে থাকত, বিয়েটা আমি পছন্দই করেছিলাম। তার স্পষ্ট অর্থ এই যে সে সময় বাড়িঘর ছাড়ার
বিষয়ে আমার মনে কোনো ধারণাও ছিল না এবং সম্ভাবনাও জাগেনি। নইলে কোন না কোন ভাবে বিয়ের
প্রতি অরুচি নিশ্চয়ই দেখাতাম। অন্যান্য কারণের সাথে বাড়ির লোকেদের এই ভাবনাও যে “ছেলেটাকে
শিগগিরই বিয়ের বাঁধনে ফাঁসাও, নইলে আবার সন্ন্যাসি না হয়ে যায়” নিশ্চয়ই কমবয়সে বিয়ের।
কারণ হয়ে থাকবে। কথাটা, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই চুপিচুপি আমার দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার
তোড়জোড়ে স্পষ্ট হয়ে গেল। সে বিয়ের ভালো দিক একটাই ছিল যে যেমন আমার বয়স কম ছিল, মেয়ের
বয়সও কমই ছিল। গাজিপুর জেলারই, সাদাত স্টেশনের পাশে মৌধিয়া গ্রামে আমার বিয়ে হয়েছিল।
বিয়ের পরের বছর বা বলতে পারেন কয়েক মাস পর আমার দ্বিরাগমনও হয়ে গেল আর বৌ আমার বাড়িতে
চলে এল। মনে হয় এটা হয়ে যাওয়াতে বাড়ির লোকেরা আমার ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল।
কিন্তু এটাও মনে হয় যে ওই মেয়েটির সাথে আমার স্থায়ী সম্পর্ক হওয়ারই
ছিল না। বা এভাবেও ভাবতে পারেন যে যদি ও বেঁচে থাকত আর আমি সন্ন্যাসি হয়ে যেতাম তাহলে
ওকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হত; সে কষ্ট তো ওর পাওয়ার নয়। তাই, যদ্দূর মনে করতে পার বিয়ের
দু’বছরের মধ্যেই হঠাৎ ওর মৃত্যু হল। সেটা সম্ভবতঃ ১৯০৬ সালের শীতের কথা। বা ধরুন, ১৯০৫
সালের শেষে বা ১৯০৬ সালের শুরুতে ওর মৃত্যু হয়েছিল। আমি এক রকম ভাবে খুব খুশি হলাম।
কেননা সে দু’বছরে আমার ভিতরে অনেক বদল চলে এসেছিল; যেমন আগেই বলেছি, মনের ভিতর ধীরে
ধীরে সন্ন্যাসের ইচ্ছে জাগতে শুরু করেছিল। যদ্দূর মনে আছে আমার, স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই
আমি প্রথমবার হরিদ্বারের পথে বেরিয়ে কাকোরি থেকে ফিরে এসেছিলাম। ওই মৃত্যুটা আমার ভাবনায়
একটা বড় বাঁধন সরে যাওয়ার মত ছিল। কেননা সব সময় ভেবে এসেছি যে মা এবং স্ত্রী, এই দুজনের
দায়িত্ব প্রত্যেক মানুষের বা অন্ততঃ প্রত্যেক হিন্দুর কাঁধে থাকে, এ দুজনকে যারা কষ্ট
এবং যন্ত্রণা দেয় তাদের কক্ষনো ভালো হয় না আর নরক নামে যদি কোনো পীড়াদায়ক জায়গা থাকে
তাহলে তারা সেখানে নিশ্চয়ই যায়। প্রথমে তো বিশ্বাসটা পারিপার্শ্বিক থেকেই গড়ে উঠেছিল।
পরে শাস্ত্র পড়ে তার পর্যাপ্ত সমর্থনও পেয়ে গেলাম।
যাহোক, মাঝরাস্তা থেকেই ফিরে, যেমন বলেছি, চুপচাপ লেখাপড়ায় মন বসিয়েছিলাম।
মনে একটা ধারণা ভিত গাড়ল যে কিছু দিন এভাবেই থাকতে হবে আর লেখাপড়া করতে হবে। জানিনা
সেই অসম্পূর্ণ ও অসফল হরিদ্বার যাত্রার প্রভাব আমার মনের ওপর কেন এমন পড়েছিল। মনে হয়
প্রথম চেষ্টায় অসফল হওয়ার পরিণামেই এমনটা হয়েছিল। চেষ্টাটা তো এমন আটঘাট বেঁধে করেছিলাম
যে কাকপক্ষিও টের পায় নি। এমনকি সন্দেহও করেনি কেউ। তবুও, অসফল হওয়ায় মনের ওপর এমন
প্রভাব পড়ল যে কিছুটা সময় বা কয়েকটা বছরের জন্য সন্ন্যাস নেওয়া অসম্ভব মনে হল। এমনটাই
হতও, বোধহয়। কিন্তু যারা এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে আমি সন্ন্যাসি
না হয়ে যাই, সেই বাড়ির লোকেদেরই অনিচ্ছাকৃত একটি ভুলে তা আর হল না।
যদ্দূর মনে পড়ে, হরিদ্বারের পথে আদ্ধেক গিয়ে ফিরে আসার পরই কাশী
থেকে দুজন সন্ন্যাসি এলেন এবং সেই গুনেশ্বরনাথজির মন্দিরেই উঠলেন যেখানে আমি ছিলাম।
তাঁদের সাথে অনেক কথা হল। তাঁরা কাশীর অপারনাথ মঠের পরিচয় দিলেন। সেখানেই তাঁরা থাকতেন।
এভাবে প্রথমবার অন্ততঃ জানতে পারলাম কোথায় গিয়ে সহজে সন্ন্যাসিদের দেখা পাওয়া যাবে।
এখানে এটাও বলে দিতে চাই যদিও সন্ন্যাসিদের দশটা নাম, পদবি অথবা শাখা আছে এবং সেগুলোর
মধ্যে শুধু তিন শাখার সন্ন্যাসিই – তীর্থ, আশ্রম, সরস্বতী – দন্ডী সন্ন্যাসি। বাকি
সাতটি শাখার – ভারতী, পুরী, বন, আরণ্য, গিরি, পর্বত, সাগর – সন্ন্যাসিদের দন্ড নেই।
বা বলতে পারেন তাদের দন্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, রাখার অনুমতি নেই। অবশ্য এসব কথা আগে
জানতাম না। এও জানতাম না যে ব্রাহ্মণ যদি সন্ন্যাস নেয় তাহলে দন্ড নেওয়া জরুরি। কেননা
ব্রাহ্মণই দন্ডী হতে পারে, অন্যান্য বর্ণের সে অধিকার নেই। তাই ভারতী, পুরী ইত্যাদি
নামধারীদের মধ্যে সব বর্ণের মানুষ পাওয়া যায়।
দন্ডী হওয়ার অর্থ এই যে সন্ন্যাসির হাতে সবসময় বাঁশের একটা দন্ড
(লাঠি) থাকে। সে লাঠি তৈরি করার বিশেষ বিধি আছে যেটা আজ অব্দি অন্যান্যরা জানতে পারেনি।
কেননা খুব কড়াকড়ির সাথে বিধিটা গোপন রাখা হয়েছে। দন্ডের বাইরের রূপ এবং মাপজোক যে কেউ
জেনে নিতে পারে কিন্তু ওতে পরশুর আকৃতিতে যে কাপড় বাঁধা থাকে (যাকে পরশুমুদ্রা বলে),
সে কাপড় যে বিচিত্র ধরণে গাঁথা সুতোয় বাঁধা থাকে (যাকে পরশুসুত্র বলে) এবং দন্ডের মাঝামাঝি
জায়গায় সাদা সুতো (যজ্ঞোপবীত) বিশেষ ভাবে জড়িয়ে একটা মুদ্রা বা আকৃতি তৈরি করা থাকে,
সেগুলোর রহস্য অন্যেরা এখনো অব্দি জানতে পারেনি। বা বলতে পারেন যে তাদের জন্য জানা
সহজ নয়। দন্ডীরা যখন বসে বা শুয়ে থাকে তখন দন্ডটাকে মাটিতে না রেখে মাটি থেকে ওপরে
কোন খুঁটি ইত্যাদিতে বিশেষ ভাবে ঝুলিয়ে দেয় এবং মন্দিরে গেলে নিজের হাতে দেবপ্রতিমা
না ছুঁয়ে দন্ড দিয়ে স্পর্শ করে।
হ্যাঁ, তো এভাবে সন্ন্যাসিদের এবং অন্ততঃ ওদের একটা জায়গার পরিচয়
পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, সুযোগ এলে হয়ত কাজে আসবে।
(৫)
সন্ন্যাস
এভাবে ১৯০৬ সালটT লেখাপড়ায় কাটছিল। ভাবছিলাম খুব লেখাপড়া করে ১৯০৭
সালে ম্যাট্রিকুলেশনের পরীক্ষা ভালো করে পাশ করব। ওদিকে বাড়ির লোকেরা আমার সাথে খুব
সতর্ক ভাবে ব্যবহার করছিল। এক দিকে পাহারা রাখছিল যাতে পন্ডিত হরিনারায়নজির সাথে, এমনকি
তিনি আমাদের বাড়িতে এলেও দেখা করতে না পারি, অন্যদিকে চিন্তাভাবনা শুরু করল যাতে কোনভাবে
দ্বিতীয়বার আমার বিয়েটা হয়ে যায়। তাহলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আর আমার বাঁধনটা শক্ত হবে।
অনেক দিন পর্য্যন্ত তো দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা আমি জানতেই পারিনি। আমার থেকে লুকিয়েও
রাখা হয়েছিল। বোধহয় ওরা ভয় পেত যে জানলে আমি হঠাৎ আগেই পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ওদের
পাহারা আর চাপ দিনের পর দিন এত বাড়ছিল যে আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তাই বাস্তবে
ফল হল উলটো। হয় এধরণের পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা বাড়ির লোকেদের ছিল না, নয়তো ওরা আমার স্বভাবটা
জানত না যে শৈশব থেকেই আমি সর্বান্তঃকরণে “ন দৈন্য ন পলায়নম” এর তত্ত্বটা মানি। আর
তত্ত্ব তো এটাও যে যে বাঁধন শিথিল হয়, তার ওপর জল পড়লে বা ঠান্ডা হলেই সেটা আবার শক্ত
হয়। তাপ বাড়লে তো বাঁধনটা আরো ঢিলে হয়ে যায়। কিন্তু এ কথাটা ওরা বুঝতে পারল না।
১৯০৬ সাল কেটে গেল। ম্যাট্রিকের আগের পড়া পুরো করে ম্যাট্রিক পরীক্ষার
জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। হঠাৎ ১৯০৭এর জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতেই কোনো না
কোনো ভাবে জানতে পেরে গেলাম যে আমার দ্বিতীয় বিয়ের তোড়জোড় করা হচ্ছে, তাও প্রথম বৌয়ের
বোনের সাথে। ব্যাস, আর কি? সজাগ হয়ে গেলাম। স্থির করে নিলাম, ফেব্রুয়ারি মাসে যে মহাশিবরাত্রি
আসছে সে সময় কাশী গিয়ে নিশ্চয়ই সন্ন্যাস নিয়ে নেব। মনে ভাবলাম, “মা তো স্বর্গে চলে
গেছেন। তাই তাঁর বাঁধন তো নেই। আর মায়ের জায়গায় যিনি আমার লালনপালন করলেন তাঁর প্রতি
আমার সে ঊত্তরদায়িত্ব তো নেই যা আমার প্রসু বা জন্মদাত্রীর প্রতি হতে পারত। তাছাড়া,
ওনার নিজের এক ছেলে এবং আমার কয়েকজন ভাইয়েরা তো আছেই, যারা ওনার দেখাশোনা করতে পারবে।
রইল স্ত্রীর বাঁধন। সে তো ছিঁড়েই গেছে, কিন্তু এখন আবার জোড়ার চেষ্টা চলছে। আবার বিয়ে
হয়ে গেলে সন্ন্যাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই আর দেরি করলে পস্তাতে হবে।” আমি মানি
যে স্ত্রী এবং মা থাকতে সন্ন্যাস নেওয়া উচিত নয়। আর যদি নিতেই হয় তাহলে তাদের স্বীকৃতি
নিয়ে নেওয়া উচিত। শ্রী শঙ্করাচার্যের স্ত্রী তো ছিলেন না, তাই মায়ের আজ্ঞা নিয়েই সন্ন্যাসি
হয়েছিলেন।
এখন আর তারিখ মনে নেই। কিন্তু ১৯০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, মহাশিবরাত্রির
কয়েক দিন আগে আমি হঠাৎ কাশীর অপারনাথ মঠে গিয়ে পৌঁছোলাম। মঠটা ঢুন্ডিরাজ গণেশের কাছেই।
ওখানে সেই দুজন পুরোনো পরিচিত সন্ন্যাসির সাথে দেখা হয়ে গেল। ওঁদেরকে আমি নিজের সংকল্পের
কথা বললাম। ওঁরা রাজি হয়ে গেলেন। ওই মঠেরই নিবাসী, ভালো সংস্কৃতজ্ঞানী বৃদ্ধ সন্ন্যাসি
শ্রী অচ্যুতানন্দগিরিজি মহারাজের কাছে ওঁরা আমায় সন্ন্যাসি করার আর্জি জানালেন। উনি
রাজিও হয়ে গেলেন। আমি সঙ্গে কিছু টাকাপয়সা নিয়ে গিয়েছিলাম যা দিয়ে পুজোআচ্চার জিনিষপত্র
কেনা যাবে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হল আর বাড়ির লোকেদের বা বাইরের দুনিয়ায় কারোর কানে
যাওয়ার আগেই আমি মাথা ন্যাড়া করিয়ে গেরুয়া বস্ত্র পরে সন্ন্যাসি হয়ে গেলাম, আমার নতুন
নাম হল সহজানন্দ। এত শিগগির করা হল কাজটা যে কাউকে অবাক করার মত। কেননা আমি সারাক্ষণ
ভয়ে ভয়ে থাকতাম যে জানতে পারলেই বাড়ির লোকেরা চারদিক থেকে দৌড়ে আসবে আর খোঁজখবর নিয়ে
পৌঁছে আমায় নিশ্চিত ধরে নিয়ে যাবে। এই ব্যাপারটা কল্পনা করে করেই আমি অস্থির হয়ে পড়ছিলাম।
কিন্তু শেষ অব্দি আমার মনের ইচ্ছে পুরো হল। সে সময় আমার মত সুখী বোধহয় আর কেউ ছিল না।
আর এভাবেই, মাস্টারদের এবং আমার স্বপ্ন, যে ম্যাট্রিকের পরীক্ষায় ইউনভার্সিটিতে ফার্স্ট
হব, পুরো হতে হতেও হল না। কেউ ভাবতেও পারেনি যে এমনটা হবে। সত্যি কথা যে মানুষ ভবিষ্যতে
ঘটনাচক্র জানতে পারে না। কত উৎসাহের সাথে কত কিছু ভাবে যে এটা করব সেটা করব। কিন্তু
যা হবার, তা মনের সব ইচ্ছেকে ধূলিস্যাৎ করে দেয়।
“অন্যথা চিন্তয়ত্যজ্ঞো, হর্ষাপূরিত মানসঃ
বিধিস্ত্বেষ মহাবৈরি, কুরুতে কার্যমন্যথা” ।।
অর্থাৎ, এভাবে আঠের বছর পেরোতে না পেরোতে, আমার জীবননাট্যের এক কান্ড
বা এক ভাগ, প্রথম ভাগ পুরোটা পেরিয়ে গেল। উনিশ বছর বয়সের শুরু থেকেই মধ্য ভাগ শুরু
হল। পূর্ব ভাগ কিছুটা এমন ছিল যে এতে বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের সম্ভাবনা ছিল
না। বলতে গেলে শৈশবেরই সময় ছিল। অভিজ্ঞতার ব্যাপার গুলো তো এবার আসছিল।
মধ্যভাগ – পূর্বখন্ড
(১)
সন্ন্যাসের পর
যতটা স্মরণে আছে, আমার সন্ন্যাস নেওয়ার খবর এক শ্রী হরিনারায়ণ পান্ডে
ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু গাজিপুর ছাড়তেই উত্তেজনা ছড়াল আর যদি স্মৃতি প্রতারণা
না করে, সন্ন্যাসি হয়েই আমি বাড়ির লোকেদের একটা চিঠিও লিখেছিলাম যে আমার আশা যেন তাঁরা
ছেড়ে দেয়। বাজ পড়ল বাড়িতে। কত আশা করে এবং আকাঙ্খা বুকে নিয়ে ওরা আমায় লেখাপড়া করিয়েছিল।
গৃহস্থ বাড়ির কাজকর্ম থেকে ছোটবেলা থেকেই আমাকে রাখা হত; সেসব কাজে আমি আজও অনভিজ্ঞ।
ওরা ভাবত, ছেলেটা প্রতিভাবান, লেখাপড়া করে ভালো টাকা উপার্জন করবে, নামযশ হবে, ওদের
কষ্ট এবং আর্থিক সঙ্কট দূর করবে। কিন্তু হঠাৎ সব কিছু শেষ হয়ে গেল যেন সবটাই কপোলকল্পনা
আর স্বপ্নরাজ্যের ব্যাপার ছিল। পরে বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল সবাই প্রায় অর্ধমৃত
এবং মুর্ছাগ্রস্ত। শ্রী হরিনারায়ণজির ওপর তো ওদের রাগের শেষ ছিল না। কেননা ওদের মনে
বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে হরিনারায়ণজি সবকিছু জেনেও ওদের বলেননি।
যাহোক, খবর পৌঁছোতেই আমার খুড়তুতো দাদা কয়েকজন লোকের সাথে অপারনাথ
মঠে এল। অনেক কান্নাকাটি করল আর একবারটির জন্য আমায় বাড়ি বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল যাতে
সবাইকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আশ্বস্ত করি। কিন্তু আমি তো শোনার লোক নই। তখন ওরা গুরুজিকে ধরল।
যেমন করে হোক বলেকয়ে রাজি করাল যাতে দু’একদিনের জন্যই সই, আমায় গ্রামের যাওয়ার অনুমতি
দিয়ে দেন। উনি রাজি হয়ে গেলেন। আমায় বললেন, “গেলে কোন ক্ষতি নেই; যাও – সবর মনে সাহস
যুগিয়ে আশ্বস্ত করে ফিরে এস।” তখন রাজি হতেই হল আমায়। ফলে ওদের সাথে ট্রেনে করে আবার
একবার গ্রামে পৌঁছোলাম। কিন্তু ওখানে তো ঝড় চলছিল। চার দিক থেকে কান্নাকাটি। অদ্ভুত
পরিবেশ, অভাবনীয় অবস্থা। দেখে পাথরও জল হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল বাড়ি, দেয়াল, গাছ, ক্ষেত,
মানুষ সবাই কাঁদছে আর করুণায় আর্দ্র্য হয়ে আছে। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ছিলেন বাবা আর
কাকিমা। ও দুজনের সাথে তো কথা বলাই অসম্ভব ছিল। যদিও আমার মন বৈরাগ্যে ভরা ছিল, মোহমমতা
মুছে কঠোর হয়ে গিয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও ওই করূণ বাতাবরণের কিছু না কিছু প্রভাব তো পড়েইছিল।
অন্যান্য মানুষদের প্রশ্নের জবাব তো দিতেই হল। যথাশক্তি সবাইকে সন্তুষ্ট
করলাম। গ্রামের এবং আশেপাশের লোকেদের ভীড় ছিল, আত্মীয় স্বজনেরাও উপস্থিত ছিল। সবার
সাথে আমার এই সন্ন্যাস নেওয়ার উচিত-অনুচিৎ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলল। পন্ডিত হরিনারায়ণ
পান্ডেজিও এলেন কিন্তু এক দিকে চুপচাপ বসে রইলেন। একমাত্র ওনারই মনে কোন দুঃখ ছিল না।
এবং বোধহয় মনে মনে খুশিও ছিলেন। উনিও শুনছিলেন উত্তর-প্রত্যুত্তর। কাকিমার সাথে যে
কথাবার্তা হল তাতে দেখলাম যে শেষ অব্দিও ওনাকে কোন রকম ভাবে আশ্বস্ত করতে পারা গেল
না। আসলে মায়ের থেকে কিছু কম স্নেহ উনি আমায় করেন নি। বয়সকালে আমার যত্নে যে সুখে থাকবেন
আশা করেছিলেন সেটা পুরো হল না। নারীর হৃদয় এমনিতেও খুব নরম হয়। আমার পরলোক নিয়ে কথাবার্ত্তা
উনি বুঝতে পারলেন না, কাঁদতে থাকলেন। আমার মনে হয় এই কষ্টেই কয়েক বছর পর ওনার মৃত্যু
হল। হ্যাঁ, বাবাকে মনে হল তখনকার মত আমি আশ্বস্ত করতে পেরেছি। নিজের বার্দ্ধক্য এবং
দেখাশোনার জন্য কারোর থাকার প্রশ্ন তুলতে উত্তর দিলাম যে ভায়েরা তো রয়েছে! আর আপনি
যদি আমার সাথে চলেন তাহলে সারাজীবন আপনার সেবা করব। এও বললাম যে তিন ভাই তো এই দুনিয়ায়
আপনার জন্য চিন্তা করবে, আমায় পরকালের জন্য রাখুন! ওখানেও তো কেউ চাই। তাতে উনি প্রশ্ন
করলেন, “তোমার এই সুকর্মের ফল কি পরলোকে আমি পাব?” আমি উত্তর দিলাম, “নিশ্চয়ই!” ব্যাস,
তারপর উনি চুপ হয়ে গেলেন। এতেই আমি আন্দাজ করলাম যে আংশিকভাবে উনি আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু
উনিও দুঃখেরই পীড়ায় আমাশয় রোগে পড়লেন আর খবর এসেছিল যে তাতেই মারা গিয়েছিলেন। কাকিমা
এবং বাবা দুজনেই সে সময় পঞ্চাশের কম বয়সে বোধহয় ছিলেন না এবং এই গভীর শোক থেকে সামলে
উঠতে পারলেন না।
হ্যাঁ, ইতিমধ্যে আরেকটা ব্যাপার হল। লোকেরা ভিতর ভিতর আটঘাট বাঁধল
যে কিছু চালাকচতুর লোককে দিয়ে বুঝিয়েবাঝিয়ে যেমন করে হোক আমায় বাড়িতে রাখিয়ে নেবে আর
গেরুয়া কাপড় খুলে ফেলিয়ে দেবে। সেই কাজের জন্য এক ‘খাকি’জিকে ডেকে আনা হল। তাঁকে বড়
মহাত্মা, ফলাহারী, প্রতাপশালী, পুজ্য এবং প্রবীণ মনে করা হত, এবং কাছাকাছিই থাকতেন।
উনি আমায় অনেকভাবে বোঝালেনও। আসলে উনি সাধারণ রোজগেরে ছিলেন, লেখাপড়া জানতেন না। কাজেই
আমার যুক্তির সামনে টিঁকতে পারলেন না। শেষে গ্রামের আর বাড়ির লোকদের বলে দিলেন যে ছেলেটাকে
আটকে রাখার কোনো আশা নেই। সে ইচ্ছে আপনারা ভুলে যান। ছেলেটি খুব ভেবে চিন্তে ও পথে
গেছে। এরপরেই খাকিজি দিনের বেলাতেই ঘুমোতে চললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেন? উনি
বললেন, “আমি তো রাতেই জাগি, দিনের বেলা ঘুমোই, কেননা গীতায় বলেছে – ‘যা নিশা সর্বভূতানাং
তস্যাং জাগর্তি সংযমী। যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনে’। শুনে আমি বললাম
যে গীতার এই উক্তি সাধারণ ঘুম আর দিন-রাতের বিষয়ে নয়, বিবেকবান এবং বিবেকহীন মানুষের
আচরণ এবং ভাবনার বিষয়ে আমি আমার কথাটা সুরেশ্বরবার্তিকের “কাকোলূক নিশেবায়ং সংসারোধ্যাত্মবেদিনো”
ইত্যাদি বলে প্রমাণ করলাম যাতে গীতার ওই উক্তিটিরও উল্লেখ রয়েছে। এরপর খাকিজি আর কোনো
কথা বললেন না। এভাবে আমি প্রথম দেখলাম যে যাদেরকে সাধু-মহামা বলা হয় তাঁরা কেমন করে
অর্থের অনর্থ করেন। গীতার ওই শ্লোকটির এমন অদ্ভুত আর নতুন ব্যাখ্যা আমি প্রথম প্রথম
শুনছিলাম।
কিন্তু এ সমস্ত কিছুর প্রভাব পড়ল মনে। আমার কঠিন হৃদয় ধীরে ধীরে
নরম হওয়া শুরু করল। আশঙ্কা হল যে যুক্তি-তর্কে যা হল না তা হয়ত খুব সহজেই দুঃখে ভরা
এই আবহাওয়ায় হয়ে যাবে। ফলে মায়ামোহে পড়ে সন্ন্যাস ছেড়ে আমি এখানেই থাকতে বাধ্য হয়ে
যাব। সত্যি বলি যে হঠাৎ আমি শিউরে উঠলাম আর ভয়ে তক্ষুনি কাশী রওনা হয়ে গেলাম। লোকেরা
জানতে পারলে না জানি কী হত। কিন্তু আমি বললাম না। দেরি হয়ে যাচ্ছে্, দেরি হয়ে যাচ্ছে
বলতে বলতে বেরিয়ে গেলাম।
পরিবেশের যে কী আশ্চর্যজনক প্রভাব পড়ে মানুষের হৃদয়ে-মস্তিষ্কে তার
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রথম ওখানেই হল। লোকে মৌন প্রার্থনা এবং মূকবেদনার কথা বলে। সাধু-ফকীর
অথবা বড় মানুষদের জাদুর মত প্রভাবের কথা বলে। যোগসূত্রে পতঞ্জলি যোগীদের দেখান অনেক
ভেল্কির কথা লিখেছেন। বলা হয় যে স্বামী বিবেকানন্দের মত চরম নাস্তিক এবং বিলক্ষণ যুক্তিবাদীর
হৃদয় রামকৃষ্ণ পরমহংসের একটা সাধারণ বাক্যে বদলে গিয়েছিল। আসলে কথা, যুক্তি বা যাদুমন্ত্র
ইত্যাদির কোন ব্যাপার নয়। যা আপনি বলতে চান, করতে চান, সেটা হৃদয় থেকে বলুন, করুন।
সে পথে নিষ্ঠা এবং সত্যপরায়ণতার সাথে কাজ করুন। একটুও জাহির করার ভাব যেন না থাকে।
বাইরে এবং ভিতরে কোনো তফাৎ না থাকে। তখন দেখবেন আপনার চার দিকের বাতাবরণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট
হচ্ছে কিনা, সরাসরি প্রভাব অন্যান্য লোকেদের ওপর পড়ছে কিনা। যে পরিস্থিতি এবং যে বাতাবরণ
অকৃত্রিম হবে, স্বাভাবিক হবে তার প্রভাব বিদ্যুতের মত নিশ্চয়ই ছড়াবে। তাই নীতিকারেরা
বলেছেন যে যদি যে কথা ভাব সেটাই বল এবং সেটাই কর তাহলে তুমি মহাত্মা হবে আর এতে গোলমাল
হলে দুরাত্মা।
“মনস্যেকং বচস্যেকং
কর্ম্যণেকং মহাত্মনাম্।
মনস্যন্য দ্বচস্যন্যতকর্মণ্যন্যদ্দুরাত্মনাম্” ।।
আমি মন (মাথা), বচন (বাণী) এবং কর্মের (কাজ) সাথে নিজের থেকে হৃদয়টা
যোগ করে দিচ্ছি। এই চারটের মধ্যে একই সুর থাকলে – পরস্পর সামঞ্জস্য থাকলে
এবং মতানৈক্য না থাকলে – মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব শক্তি জন্ম নেয়। সেই সেদিন
থেকে আজ অব্দি এই সত্যটা আমি নিজে হাজার বার অনুভব করেছি এবং এ পথে চলার পরিণাম প্রত্যক্ষ
করেছি। ইংরেজির সিন্সিয়ারিটি (sincerity) এবং অনেস্টিকে (honesty) আমি এই চারটের সমাবেশ
মানি।
(২)
যোগ এবং ভ্রমণ
আমি এখানে বলে রাখতে চাই যে সন্ন্যাস নেওয়ার আগে আমার মনে মাঝে মাঝেই
একটা ভাবনা আসত – “আমার লেখাপড়া তো শুধু এইজন্যই না, যে টাকা উপার্জন করে খাব, পরব
বা অন্যদের খাওয়াব, পরাব? কিন্তু জঙ্গলের পশুপাখিদের কে খাওয়ায়? ওরা তো নিজেরা চাষবাসও
করে না আর খাওয়া-পরার জিনিষপত্র জোটাবার চিন্তাও করে না! তা সত্ত্বেও ভাল করেই খাওয়াদাওয়া
সারে। তাহলে আমি কেন এসবের চিন্তায় মরব? আমায় তো অন্য কেউই খাওয়াবে-পরাবে।” এই ভাবনাতেই
আমি ভুগছিলাম আর শেষ অব্দি এই চিন্তাতেই বাড়িঘর ছাড়লাম। খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা একেবারে
ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ভগবানকে পাওয়ার চেষ্টা করার উদ্দেশ্যেই আমি সন্ন্যাসি হলাম এবং জঙ্গলে
শরণ নিতে উদ্যত হলাম। অন্য কোনো ভাবনা আমার মনে বা মাথায় ছিল না। এতেই আমি বিভোর ছিলাম।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আগে একটু-আধটু যোগের নেশায় মজেছিলাম। তাই ভালো
যোগী খুঁজে তার কাছে প্রাণ্যাম এবং যোগাভ্যাস শেখার ইচ্ছে ছিল। সাংসারিক সমসত কাজের
প্রতি এমন ঘৃণা ছিল যে বলতে পারব না। এটাও বলে দিই যে প্রাণায়াম, যোগাভ্যাস, ধ্যান,
সমাধি, বেদান্তভাবনা এবং সম্পর্কিত চিন্তাজগত ছাড়া বাকি সমস্ত কিছুকে আমি সাংসারিক
কাজ মানতাম। খাদ্য এবং আশ্রয় তো প্রাণায়াম ইত্যাদির সাধন। তবুও এসব আমার কাছে বাধক
ছিল। কেননা কিছুটা সময় তো এসবের ব্যবস্থায় যেতই আর ততক্ষণ ধ্যান প্রভৃতি থেকে মনটা
সরাতে বাধ্য হতাম। তাই ওসব কাজকে বোঝা ভেবে উদাসীন থাকতাম। গীতাপাঠের অভ্যাস নিয়মিত
করতাম। অন্যান্য বেদান্ত গ্রন্থও কয়েকটি পড়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনের
এই অবস্থা ছিল।
আজ গীতা যেভাবে আমি বুঝি, তা থেকে ভিন্ন ভাবে বুঝতাম সে সময়। নইলে
এ অবস্থা হত না। পরে সুযোগ পেলে গীতার আরো বেশি লিখব। যতই শ্রেষ্ঠ পরোপকারধর্মী কাজ
হোক না কেন, সে সময় আমার দৃষ্টিতে সেটা তুচ্ছ সাংসারিক কাজই হত। তাই দেশ-দুনিয়ার কথা
আর কী বলব? যেমন আজকের অধিকাংশ বা প্রায় সব সাধু-নামধারীরা দেশসেবা ইত্যাদিকে ছোট কাজ
বা নিজেদের অকর্তব্য মনে করে, আমারও সেই দশা ছিল সে সময়। তফাৎ শুধু এটুকু যে দেশসেবা
ইত্যাদির বিষয়ে জানতামই না যে এটাও একটা বিশেষ কাজ যার সাথে আমার সম্পর্ক থাকা উচিৎ।
আমার তো একমাত্র কর্তব্য ছিল ভগবানকে পাওয়া। পাগলের মত তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, তো গ্রাম থেকে ফিরে গ্রীষ্ম আমি কাশীতেই কাটালাম। ঠিক বলতে
পারব না যে আগের থেকেই জানতাম না সন্ন্যাস নেওয়ার পর গ্রামে গিয়েই জানতে পেরেছিলাম
যে পন্ডিত হরিনারায়ণজিও সন্ন্যাস নেবেন। দুজনের মত এটাই ছিল যে সন্ন্যাসি হওয়ার পরেই
ভারত-ভ্রমণ করব। আর সবচেয়ে আগে একজন ভালো যোগী, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, খুঁজে বার
করব। পন্ডিতজি দু’একজন যোগীর বিষয়ে কিছু জানতেনও। তাই ওনারই প্রতীক্ষায় আমি কাশীতে
কোনভাবে দিন কাটাচ্ছিলাম। তারই মধ্যে লোকে আমায় টেনা গাজিপুর নিয়ে গেল, যে প্রসঙ্গে
শ্রী সরযু প্রসাদজি মাস্টারের কথা আগেই লেখা হয়েছে। কেননা, বর্ষাকাল আসতেই আমরা দুজন
যে ভ্রমণে বেরুলাম, ফের কয়েক বছর পরেই কাশীতে ফিরতে পারলাম।
একদিন হঠাৎ অপারনাথ মঠে দেখি এক পরিচিত ব্যক্তি গেরুয়াবস্ত্র পরে
বেরুলেন আর আমার কুশল জিজ্ঞাসা করতে করতে সামনে এলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দেখলাম
সন্ন্যাসির বেশে সেই শ্রী হরিনারায়ণজি। ব্যস, আর কি? আনন্দের আহ্লাদিত হয়ে উঠলাম। আষাঢ়ের
দু’এক ফোঁটা পড়েইছিল মাত্র – আমরা চুপচাপ মঠে কাউকে কিছু না বলে প্রয়াগের পথে রওনা
দিলাম। উনি কোন দন্ডী সন্ন্যাসির কাছেই দীক্ষা নিয়েছিলেন কিন্তু দন্ড ওনার হাতেও ছিল
না। নিজের গুরুমহারাজকে না বলে উনিও বেরিয়ে পড়েছিলেন। আমিও মঠে গুরুজিকে কিছু বললাম
না। চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে বাড়ির লোকদের অজান্তে সন্ন্যাসি হলাম দুজনেই, আবার
সন্ন্যাসিদেরও অজান্তে লুকিয়ে দুজনেই পালালাম। কারণ এটুকুই যে ওরা জানলে পর বাধা নিশ্চয়ই
পেতাম। কেননা বাবারা বলতেন যে চাতুর্মাস্য (বছরে) সন্ন্যাসির ভ্রমণ শাস্ত্রে নিষিদ্ধ।
তখন তো বাধ্য হয়ে থামতে হত।
কিন্তু এদিকে তো ভগবান এবং যোগীর সাথে শিগগিরই দেখা করার অস্থিরতা
ছিল, প্রীতমের দর্শনের জন্য পিয়াসী ছিল নয়ন। তাহলে আবার ধর্মশাস্ত্র কিসের? কী অদ্ভুত
ব্যাপার যে যে ধর্মশাস্ত্র অনুসারে সংসারের প্রতি বিরাগে সন্ন্যাসি হলাম, দরকারে, যখন
জানলাম যে পরে গিয়ে বাধক হবে, সেই ধর্মশাস্ত্রকে জেনেশুনে প্রত্যাখ্যান করলাম। একথা
কোনো নাস্তিকের নয়। তখন তো আমরা দুজনেই পুরোপুরি আস্তিক ছিলাম এবং সমস্ত পুঁথি-পুরাণ
অক্ষরে অক্ষরে মানতাম। আসলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হল ধ্যেয় আর স্বার্থ এবং তার বেদিতে
বড় বড় জিনিষ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে উৎসর্গীকৃত হয় বা করে দেওয়া হয়। সে সময় আমরা এই বিরাট
সত্যটা হৃদয়ঙ্গম করিনি। যদিও কাজটা করেছিলাম সেই নীতি অনুসারেই। এধারে সত্যটা বুঝেছি।
তবুও, স্বভাববশতঃ বা বলুন, কার্যকারণবশতঃ, কাজটা সেই নীতিতেই হঠাৎ করে ফেলেছিলাম।
এর পরের কথায় যাওয়ার আগে অপারনাথ মঠের বিষয়েও কয়েকটি কথা বলে নিতে
চাই। ওটা আজকের প্রচলিত অর্থে মঠ ছিল না। আজকাল যেমন সাধু-নামধারী কেউ মঠাধীশ হয় এবং
বড় বড় ভূসম্পত্তি রেখে ফুর্তি করে, সেরকম ব্যাপার ওই মঠে ছিল না। ওটা কোনো মঠাধীশের
সম্পত্তি ছিল না। আসলে, বলা হয় যে আগে কাশীতে বাবা অপারনাথ নামে একজন সিদ্ধ মহাপুরুষ
থাকতেন। তাঁরই ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হয়ে কয়েকজন ভদ্রলোক তাঁর বাসস্থানের নাম করে ভব্য পাথরে
তৈরি দুটো বড় বড় বাড়ি তৈরি করিয়ে দিলেন, যার মধ্যে একটার নাম অপারনাথের টেকরা এবং দ্বিতীয়টার
নাম অপারনাথ মঠ। দুটোতেই আশ্রয়হীন এবং বাড়িঘর-ছাড়া বৈরাগী সন্ন্যাসিরা থাকত। বোধহয়
আজকালও থাকে। যদিও এদিকে শুনেছিলাম, কয়েকজন কোন অছিলায় ওই মঠদুটোর ওপর আংশিক প্রভুত্ব
কায়েম করার চেষ্টা করেছিল। এমনিতে সন্ন্যাসিরা কিছু দিন ওখানে থাকত। ফের বাইরে ঘুরেটুরে
আসত। ভ্রমণ করে বোধহয় কেউ কেউ কিছু টাকাপয়সাও আনত এবং মঠে থাকার সময় তা দিয়েই কাজ চালাত।
এমনিতে সবার জন্যই যেখানে সেখানে অন্নসত্রে বা অন্যান্য জায়গায় রান্না করা খাবার দিনে-রাতে
একবার পাওয়া যেত। সন্ধ্যার জন্য শুধু কোথাও কোথাও জলপানের ব্যবস্থা থাকত। ওখানে থাকা
সন্ন্যাসিদের অধিকাংশ ছিল সংসার-বিরক্ত, সংস্কৃত ব্যাকরণ ও দর্শনাদি পড়া বৃদ্ধ-যুবক
এবং কাঁচা বয়সেরও গেরুয়াধারীরা। কাশীর রেওয়াজ এটাও যে মাঝে মাঝেই ভান্ডারার নামে এই
সাধুদের জন্য লুচি, হালুয়া ইত্যাদির বড় বড় ভোজ হতে থাকে। তাতে সারা বছরের জন্য কাজ
চালান জামাকাপড়ও পাওয়াই যায়। যারা লেখাপড়া করে তাদেরকে ভদ্রলোকেরা টাকাপয়সা বা বই ইত্যাদিও
দিয়ে থাকে। এমনও হয় যে অধিকাংশ লেখাপড়া করা সাধুদের অভিভাবক হয় ওদের গুরুমহারাজ হয়
অথবা ওদের কোনো চিন্তাই থাকে না। বা বাইরে থেকে, ভক্ত ভক্তিন বা চেলাচাপাটির কাছ থেকে
পয়সা নিয়ে এসে তারা কাজ চালায়।
অপারনাথ মঠ এমনই। উঠোনে তুলসি-মঞ্চের মত একটা উঁচু জায়গা করা আছে।
তাতে একটা বড় তাক আছে। সেই তাকে মাটির একটা খুব বড় প্রদীপে কয়েক সের তেল ভরা থাকে আর
সে প্রদীপে অখন্ড জ্বলতে থাকে। কখনো নেভে না। একজন সাধু সারাক্ষণ তার দেখাশোনায় থাকে।
ওখানেই পাশের কুঠরিতে তৈরি অপারনাথ বাবার সমাধির পুজোও সেই করে সব সময়। প্রদীপের প্রসিদ্ধি
আছে যে কোনো কুকুর, শেয়াল ইত্যাদি বিষাক্ত পশুর কামড়ে, জখমে তার তেল মালিশ করলে এবং
সেরে না ওঠা অব্দি ক্ষতটায় জল না লাগতে দিলে জখম সেরে ওঠে; বিষের প্রভাবও নেমে যায়।
যে ওই প্রদীপ থেকে তেল নেয় সেই নতুন তেল ঢেলে ভরে দেয়। সে সময় এই নিয়মই চালু ছিল। বোধহয়
আজকেও আছে। সব মিলিয়ে দু’বছর আমি ওখানে কাটিয়েছি। কাশীতে তো লাগাতার অনেক বছর থেকেছি।
হাজার হাজার মানুষকে আমি তেল নিয়ে যেতে দেখেছি। দূর দূর থেকে এসে লোকে তেল নিয়ে যেত।
১৯০৭ সালের বৃষ্টির দিন ছিল এবং আমরা দুজন হেঁটেই রওনা দিলাম। গঙ্গার
উত্তরদিকের তীর ধরে চলতে চলতে দু’চারদিনেই আমরা এলাহাবাদের কাছে গঙ্গার পূর্বতীরের
ঝুঁসীতে গিয়ে পৌঁছোলাম। রাস্তার গল্প মনে নেই। যদিও, শ্রী হরিনারায়ণজি তীর্থযাত্রার
নামে আগেও অনেক ভ্রমণ করেছিলেন, সন্ন্যাসির রূপে এটা আমাদের প্রথম যাত্রা ছিল। বৈরাগ্যের
ভুত কাঁধে চেপেছিল। তাই কষ্টের চিন্তা আর কিসের? না থাকার জায়গা না খাওয়ার। অন্যের
বাড়িতে রাতে থাকাও এবং খাওয়াও, তা সে কেউ থাকার জায়গা দিক, খাওয়াক বা মুখের ওপর জবাব
দিয়ে দিক। অন্য কোন উপায়ও ছিল না। আমরা দুজনেই ছিলামও পুরো মস্তরাম। চাপ দিয়ে কিছু
চাওয়ারও অধিকার ছিল না। শুধু ভিক্ষাবৃত্তি এবং ধর্মের পথ ছিল। সঙ্গে না তো পয়সা ছিল
না কোন জিনিষপত্র। জামাকাপড়ও নামমাত্র ছিল। কোন রকমে কাজ চালানর মত। ছাতা রাখা তো মানাই
ছিল। তাই কাপড় ভিজলে আরো দুর্গতি। সন্ন্যাসির ধর্মই তো কষ্ট সহ্য করা! এবং আমাদের পুরো
আস্থা ছিল সে ধর্ম পালনে। ফলে আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, যা হয়ে যাক, ধর্মটা পুরোপুরি
পালন করব।
মনে নেই ঝুঁসী পৌঁছোন অব্দি কোন বিশেষ সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল
কিনা। কখনো খাবার পাইনি কখনো কাপড় জলে ভিজে যাওয়ায় অসুবিধে হয়েছে। খাওয়াও তো চব্বিশ
ঘন্টায় একবারই সারতে হত। প্রাতঃরাশও নয় বিকেলের জলখাবারও নয়। চা-টা’এর তো প্রশ্নই ছিল
না। পন্ডিতজিও যুবকই ছিলেন। তবে আমি তো মাত্র আঠার-উনিশ বছরের ছিলাম যখন খিধে তেষ্টাও
বেশি উত্যক্ত করে। কিন্তু সর্বোপরি, দৃঢ়সঙ্কল্প বলেও তো একটা কথা আছে। ওই বয়সে কয়েকবার
আহারের দরকার পড়ে, না পেলে খিদেয় মাথা এবং কলজে ফেটে পড়তে থাকে। কিন্তু সংকল্প করে
নিয়েছিলাম যে চব্বিশ ঘন্টায় একবারই খাব। আর যদি কোন দিন এমন হত যে দু’একবার চেষ্টা
করেও পেলাম না তখন বার বার খাবার পাওয়ার চিন্তা ছেড়ে পরের দিন পাব ভেবে চুপচাপ বসে
পড়তাম বা শুয়ে পড়তাম। ঝুঁসী অব্দি নয় যদিও, কিন্তু তারপর বহুবার এমন হয়েছিল দিন-রাত
পেরিয়ে যাওয়ার পরই খাবার জুটেছে। কখনো কখনো ৩০, ৩৬ বা ৪০ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। একবার
তো পুরো ৫২ ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর খাবার পেয়েছিলাম। এতে একটা লাভ নিশ্চয়ই হল যে খিদে
আমাদের আয়ত্তে চলে এল। তারপর সে আর খোলাখুলি আমাদের শরীরে-মনে অত্যাচার চালাতে পারত
না। খাবার-দাবার না পেলে কী হবে, এই ভয়ের যে মহাভুতটা সবার কাঁধে চড়ে, আমাদের কাঁধেও
চড়ত – কিন্তু সেটা সবসময়ের জন্য নেমে গেল। এই একটা ব্যাপারে আমরা পাকা সন্ন্যাসি হয়ে
গেলাম।
আমরা দেখেছি যে সন্ন্যাসিরা ভ্রমণ করেনা, তারা সবসময় দুর্বলতা দেখায়।
লেখাপড়া জানা, জ্ঞানী বৈরাগী হওয়া সত্ত্বেও খাওয়াদাওয়ার কষ্ট সহ্য করার সাহস হারিয়ে
ফেলে। আর তাছাড়া, আমরা তো সে সময় গোঁড়া নিয়তিবাদী এবং ভগবানবাদী ছিলাম। আমাদের তো বিশ্বাস
ছিল যে ভগবানও মরেনি আর আমাদেরও কপাল পোড়েনি; বন্ধকও রাখা হয়নি। তাহলে আর খাওয়াপরার
চিন্তা কিসের? আমরা তো ভাবছিলাম –
“কা চিন্তা মম জীবনে যদি হরির্বিশ্বম্ভরো গীয়তে”
তাহলে চিন্তা কেন করব? ফল হল যে আনন্দের সাথে আমরা এগোতে থাকলাম।
সঙ্গে ছিল শুধু একটি কমন্ডলু, আর বোধহয় গীতা এবং আরো কিছু বইপত্র। এভাবেই ঝুঁসী পৌঁছোলাম
এবং ওখানে একটা মঠে গিয়ে উঠলাম।
মঠে কয়েকজন সাধু থাকতেন। যদ্দুর জানতে পেরেছিলাম, সম্পত্তি বিশেষ
ছিলনা মঠটার। বোধহয় ভক্তদের উপহার এবং নৈবেদ্যাদি দিয়েই কাজ চলত। আমরা মাসখানেক ওখানে
ছিলাম। মঠের সবাই এবং মঠের ব্যবস্থাপক, নাম ভুলে গেছি, খুব সজ্জন ছিলেন। ব্যবস্থাপক
আমাদের ভালোবাসতেন। ওখানেই আমরা কথায় কথায় প্রথম ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং তার
পরিণামে ওঠা ঢেউয়ের খবর পেলাম। সেটা স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু আমাদের তো কোন রুচি ছিল
না সে ব্যাপারে। আসলে “উলুবনে মুক্তো ছড়ানো”র ব্যাপারটাও ছিল! সাধুসন্ন্যাসিদের দুনিয়াটাই
যে ভিন্ন! এমনিতে তো ভালো খাবার, কাপড় আর মঠ নিশ্চয়ই চাই, যা সাধারণ গেরস্ত পরিবারের
জন্য দুর্লভ। অথচ, “জগৎ-সংসারের কথায় আমাদের কী কাজ? এইসব সাংসারিক ঝামেলা নিয়ে আমাদের
কী?” বলে দেশসেবা এবং সার্বজনিক কাজকে ওরা ঘৃণা করে। যেন ভালো অন্ন-বস্ত্র সংসারের
বাইরের জিনিষ, তাই তা থেকে বিমুখ হতে নেই! আমরা অবশ্য সে মানসিকতায় ছিলাম না। শুধু
বৈরাগ্য ছিল প্রচন্ড। ফলে ওই রাজনৈতিক আন্দোলন আমাদেরকে একটুও প্রভাবিত করল না। আমার
তো আরো বিচিত্র দশা। ইংরেজির প্রতি এমন ঘৃণা ছিল যে বলার নয়। একেবারে ভুলে যেতে চাইতাম।
ইংরেজির একটা শব্দও উচ্চারণ করা আমার অসহ্য মনে হত। ফল হল যে আট দশ বছরের মধ্যে আমি
প্রায় ভুলেই গেলাম ইংরেজি। মনে হত, ইংরেজি জ্ঞানের ওপর একটা পর্দা পড়ে গেছে। তার নিচে
আবছা দেখা যাচ্ছে সেটা। আবার আমার ইংরেজি জানার ঝোঁক কিভাবে হল, কিভাবে আমার ভিতরে
ইংরেজির ঘুমিয়ে পড়া জ্ঞানটা জাগল আর পুষ্ট হল, সেসব কথা পরে হবে।
ঝুঁসীতে আকচার রাত্তির বেলায় মঠের ছাতে কোনো বিছানা না পেতেই শুতাম।
আষাঢ়মাসে গরম তো বিচ্ছিরি হয়ই। বৃষ্টির পর ছাতটা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় শুতে আরাম লাগত।
তাই করতাম। কয়েক দিন পর শরীরে ভীষণ ব্যথার সাথে তীব্র জ্বর এল; কয়েক মাস চল সেই জ্বর।
লোকেরা ঠান্ডা লাগা ব্যথা ভেবে জীবনে প্রথমবার আমায় চা খাইয়ে দিয়েছিল। তাতে ব্যথা তো
চলে গেল। কিন্তু তার জায়গায় প্রচন্ড জ্বর। জ্বরের উষ্মা এত তীব্র হল যে অস্থিরতা ছড়িয়ে
পড়ল শরীরে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। প্রথমবার চায়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা
হল। লোকে বলে চা নাকি জ্বর দূর করে। কিন্তু আমার ওপর তো তার উলটো প্রভাব পড়ল। জীবনে
আরো এক বার চা খেতে হয়েছিল যখন যোগীর খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এক শীতে আমি মধ্যভারতের গ্রামাঞ্চলে
রাজগঢ় ব্যাওরা পৌঁছেছিলাম এবং ওখানেই এক জায়গায় উঠেছিলাম। ওখানকার মানুষদের চা খাওয়ার
অভ্যেস খুব বেশি। শীত বেশি পড়ে। আমাকেও একদিন ওরা চা খাইয়ে দিল। ব্যস, পেচ্ছাপে লালচে
ভাব এসে গেল। ভয়ে তক্ষুনি আমি চা খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। লালচে ভাবটা চলেও গেল। তারপর
থেকে আমি আর চা খাওয়ার নাম নিই না। সাহসই হয় না। আসলে চা এত গরম যে আমার শরীর সহ্যই
করতে পারে না।
জ্বর কমল, কিন্তু রয়ে গেল একটু একটু। এরই মাঝে কষায়বস্ত্রধারী এক
তরুণ সন্ন্যাসি বাবা ওখানে এসে পৌঁছোলেন। আমাকে দেখে জ্বর দূর করার ওষুধ দিলেন। তারপর
চলে গেলেন। ওনারই দেওয়া ওষুধ খেতে শুরু করলাম। কয়েক খোরাক খাওয়ার পর এক অন্য অভিজ্ঞ
সন্ন্যাসি বাবা এসে গেলেন। উনি ওষুধটা দেখে ফেললেন। দেখেই চমকে উঠে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
“এই বিষ কেন খাচ্ছেন? এ তো কাঁচা লোহার ভস্ম। তাওয়ার জ্বলে যাওয়া তলাটার গুঁড়ো বানিয়ে
ভস্মের নামে কোনো মুর্খ আপনাকে দিয়ে গেছে। এ তো মেরে ফেলবে আপনাকে!” জ্বর তো আমার তখন
অব্দি সারেনি আর তার ওপর এই নতুন আপদ। ওষুধটা উঠিয়ে ফেলে দিলাম। প্রতিদিন জ্বর আসতো
না আনার। দু’একদিন বাদে বাদে আসত। আমরা দুজনেই ঠিক করলাম যে এখান থেকে বেরিয়ে পড়াই
ভালো, ব্যস বেরিয়ে পড়লাম। ত্রিবেণি পার করে প্রয়াগ থেকে চিত্রকূট যাওয়া পাকা সড়ক ধরে
এগোলাম; ইচ্ছে ছিল চিত্রকূট হয়ে যাব। তুলসীদাসের রামায়ণে চিত্রকূটের খুব সুন্দর বর্ণনা
পড়ছিলাম। কামদগিরি ইত্যাদির উল্লেখ বার বার এসেছিল। তাই ওখানে যাওয়ার আকুল আকাঙ্খা
ছিল মনে। ঠিক মনে নেই। বোধহয় এক বা দুদিন পরেই শঙ্করগড় (জীআইপি রেলওয়ে) স্টেশনের কাছের
গ্রামটাতে আমরা পৌঁছোলাম। বলতে পারব না ওটাই শঙ্করগড় ছিল নাকি অন্য কোনো গ্রাম। অনেকদিন
পেরিয়ে স্মৃতি ঠিক থাকে না। বর্ষায় ওখানে আমরা থেকে গেলাম। গ্রামটা পাহাড়ের তলদেশে।
বেশি উঁচু পাহাড় নয়। হ্যাঁ, গ্রামের থেকে উঁচু অবশ্যই। রাতে আমরা গ্রামেই এক জায়গায়
শুতাম। ওখানকার মানুষেরা ঝাল, ঢোল ইত্যাদির সঙ্গে খুব আনন্দে রামায়ণ গাইত। আমি ছোটবেলায়
এবং তার পরেও রামায়ণ গান অনেক শুনেছি। কিন্তু দু’জায়গার রামায়ণ গান আমার অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক
ও সুন্দর মনে হয়েছে। এক তো এই গ্রামটার আর দ্বিতীয়, তার দু’তিন বছর পর বালিয়া জেলায়,
গঙ্গাতীরে, ভরওলি গ্রামে – জায়গাটাকে উজিয়ার-ভরওলিও বলা হয়। দু’জায়গার মানুষই খুব সুন্দর
গাইত। কিন্তু এখন তো সেসব প্রথা প্রায় উঠেই গেছে।
হ্যাঁ, তো রাতে গ্রামে থাকতাম আর দিনের বেলা, খাওয়াদাওয়ার সময়টুকু
বাদে পাহাড়ে পড়ে থাকতাম। বর্ষার দিনগুলোয় নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে পাহাড়ি জায়গাগুলো। একটা
সমস্যা ছিল। কে জানে কোত্থেকে ওই গ্রামে এত মাছি আসত ওই গ্রামে যে খাওয়াদাওয়া করতে
খুব অসুবিধে হত। অত বেশি মাছি আজ অব্দি আমি আর কোথাও দেখিনি। সে কারণেও দিনটা বাইরে
কাটাতাম।
কিছুদিন ওখানে কাটিয়ে এগোলাম। কারবি হয়ে চিত্রকূট পৌঁছোলাম। চিত্রকূট
গ্রামের পাশের নদীটাকে মন্দাকিনী বলা হয়। সেই নদীরই তীরে গ্রামটি। সে সময় ওখানকার পেড়ার
খুব নাম ছিল, যেমন মথুরার পেড়ার। কে জানে এখন কী অবস্থা। এগিয়ে আমরা কামদগিরির কাছে
পৌঁছোলাম। বর্ষাকাল, এবং রাতে বাইরে কাটান ঠিক নয় ভেবে আমরা কামদগিরির পরিক্রমা করতে
করতে চারদিকে গড়ে ওঠা বৈষ্ণব সাধু-নামধারীদের মন্দিরে আর মঠে কড়া নাড়লাম, যাতে তারা
রাতে থাকতে দেয়। কিন্তু একস্বরে সবাই না না করে উঠল। যদিও, এটা জেনে আমরা যেমন ক্রুদ্ধ
হলাম তেমনই ঘৃণা বোধ করলাম, যে সবক’টা মঠে কে জানে কতজন মাই আর দাইয়েরা থাকে। তার মানে
বাবাদের চরিত্রের তো খোদা হাফিজ। হার মেনে কোনো একটা ভাঙাচোরা বেওয়ারিশ জায়গায় যেমনতেমন
করে রাতটা কাটালাম।
কামদগিরি আজও খুবই সুন্দর। বর্ষাকালে বিশেষ করে ওর ওপরে কেউ চড়তে
পারে না। কথিত আছে যে শিখরে শ্রী রামচন্দ্রের চরণপাদুকা খোদাই করা আছে। কামদগিরিকে
ওখানে কামতানাথ বলে।
পরের দিন অনুসূয়া নামের জায়গাটা দেখার জন্য প্রমোদ বন হয়ে আমরা হাঁটা
দিলাম। চিত্রকূটের সবচেয়ে দর্শনীয় এবং রমণীয় স্থান আসলে হনুমানধারা, যেখানে পাহাড় থেকে
জলপ্রপাত নামে সারাবছর। কিন্তু বর্ষাকালে সেই গভীর জঙ্গলে যাওয়া অসম্ভব। তাই দূর থেকেই
তার দর্শন সারতে বাধ্য হলাম। তারপর অনুসূয়া পৌঁছোলাম। ঘোরাঘুরি করতে করতে দেরি হয়ে
গেল। চতুর্থ প্রহরে কামদগিরি ফিরলাম। সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম কামদগিরি। খুব কাছে মনে
হচ্ছিল। কিন্তু পাহাড়ের দূরত্ব যে কেমন প্রতারক হয় সেকথা সেদিন প্রথম বুঝলাম। হাঁটতে
হাঁটতে কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। রাত হতে হতে কোনো রকমে পৌঁছোন গেল। মাঝের রাস্তা এমন দুর্গম
যে কী বলব। কে জানে কতগুলো নদী-নালা পেরোলাম, তাও বেশ চওড়া ধরণের সব। বাঁচোয়া ছিল যে
জল বিশেষ ছিল না। নইলে ফেরা অসম্ভব হয়ে যেত। আসলে পাহাড়ি নদী-নালা লাগাতার বৃষ্টিতে
যেমন তাড়াতাড়ি ভরে ওঠে, বৃষ্টি বন্ধ হলেই শুকোতে দেরি হয় না।
অনুসূয়ায় গিয়ে সেখানকার একটা ঘটনা শুনেছিলাম। এক পুরোনো বৈষ্ণব সাধু
থাকত যার কাছে ষোল বা কুড়ি হাজার টাকা জমা ছিল। একাই থাকত সে। টাকার লোভ এমন ছিল যে
কাউকে সঙ্গে রাখত না খরচ হয়ে যাবে বলে। কাউকে বলতও না যে এত টাকা ওর কাছে আছে। চোরেরা
কোনরকমে জানতে পেরেছিল যে সাধুবাবার কুটিয়ায় টাকা আছে। ওরা তো টাকার গন্ধ পায়। এক রাতে
দু’চারটে চোর পৌঁছে কুটিয়ার ছাতে চড়ে গেল। বৈরাগীবাবাকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করল কোথায় আছে
টাকাগুলো। বাবা তো না না করে বলে উঠল, বাচ্চা, সাধুর কাছে টাকা কোত্থেকে আসবে! চোরেরা
তো বোকা নয়, এধরণের সাধুদের ভালো করেই চিনত। ফলে বাবাকে মেরে ওরা ছাত থেকে নিচে ফেলে
দিল আর টাকাগুলো খুঁজে নিয়ে চলে গেল। বোধহয় ভয় ছিল যে বেঁচে থাকলে চ্যাঁচাবে আর পরে
পুলিসকে খবর দেবে। তাই, ‘বাঁশও রইল না, বাঁশিও বাজবে না’। এধরণের টাকার এমনই গতি হওয়া
উচিৎ। সাধুরাও এভাবে টাকাপয়সা রাখে এবং এত দুর্নীতিপরায়ণ হয়, এ কথা অনুসূয়া আর কামদগিরির
মঠগুলোর গল্প শুনে প্রথমবার জানলাম।
প্রমোদ বন আচারি বৈষ্ণবদের ভালো আখড়া মনে করা হয়। যতদিন ওখানে ছিলাম,
আমাদের সাথে ওদের একটু আধটু শাস্ত্রচর্চাও হত। কিন্তু ওখানে তো আমাদের থাকার ছিল না।
ভাবলাম, আবার যমুনা পেরিয়ে ফতেপুর, কানপুরের দিকে যাই। তাই রওনা দিলাম।
চিত্রকূটের কাছেরই গল্প। একদিন মাঝ-মাঠে থাকতে থাকতেই ভয়ঙ্কর ঝড়-জলের
মুখোমুখি হলাম। এমন ভয়ঙ্কর যে আজ অব্দি ভুলতে পারিনি। দৌড়ে গ্রামে যাওয়াও অসম্ভব ছিল।
পাশের ক্ষেতে একটা কুঁড়েঘর ছিল ছাতার মত – খুব ছোট। দৌড়ে গিয়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ভয়াবহ ঝড় ছিল আর এমন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল যে বুক কেঁপে উঠছিল। অনেকক্ষণ চলল। ছাতার মত
ওই কুঁড়েঘর নিচে এবং চার দিকে খোলা। ওদিকে এমনই তৈরি হয়। তাই জলের ঝাপটায় আমরা ভিজে
চুপসে গেলাম। বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাদের মাথার ওপরই বাজ পড়ল। মনে হচ্ছিল ওই
কুঁড়েঘরটাই বলতে গেলে আমাদের বাঁচাচ্ছে। বহুক্ষণ ঝড়জলের এই বিপত্তির মধ্যে আটকা পড়ে
রইলাম। সন্ধ্যে হতে হতে বন্ধ হল ঝড়। জলে ভিজে একসা হয়ে আমরা দুজনে পাশের গ্রামে গেলাম
আর যেমনতেমন করে রাত কাটালাম।
ওই যাত্রাপথেই জীবনে প্রথম দেখলাম যে বুন্দেলখন্ডি মানুষেরা অদ্ভুত
জুতো বানায় যেটা গোড়ালির দিকে ওপর অব্দি ওঠানো থাকে। পায়ের পাতার ওপরও সামনের দিক থেকে
আসা হাতির কানের মত চামড়া লাগানো থাকে। আসলে ওদিকে খুব কাঁটাগাছ হয়। ক্ষেতেও ভরে থাকে।
সেই কাঁটা থেকে বাঁচবার জন্য ওভাবে জুতো তৈরি হয়। লাঙল চালাতে থাকা কৃষক থেকে শুরু
করে মজুর অব্দি, পুরুষ, স্ত্রী, শিশু সবাই এই স্বদেশী জুতো পরে। নইলে কাঁটায় কাঁটায়
পা রক্তারক্তি হয়ে যাবে। উত্তরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যমুনার তীরে রাজাপুর গ্রামে
পৌঁছোলাম। আসলে চিত্রকূট থেকে একটা সড়ক যমুনার ওপারে যাওয়ার জন্য রাজাপুরে আসে। তখন
তো কাঁচা রাস্তা ছিল। এখন জানিনা কী হয়েছে। তাই না জেনেই, হঠাৎ আমরা ওখানে পৌঁছোলাম।
দারুণ খুশি হলাম যে যে তুলসিদাসের রামায়ণে আমাদের অসীম ভক্তি এতদিনকার, সেই তুলসিদাসের
জন্মভূমিতে পৌঁছে গেলাম। আমরা পড়তাম, “যমুনার তীরে রাজাপুর গ্রাম, থাকেন ধীরমতি, তুলসি
নাম!” আজ সাক্ষাৎ দর্শন হল। তাঁর হাতে লেখা রামায়ণের কোন অনুলিপি ওখানে পাওয়া যায় কিনা
জানার অনেক চেষ্টা করলাম। পেলে দেখতাম। তাঁর সাথে সম্পর্কিত কোন দর্শনীয় স্থান আছে
কিনা তাও জানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শুধু জায়গাটা ছাড়া বলার মত এমন কিছুই ছিল না।
জানিনা এখন ওনার স্মৃতিতে জন্ম-স্থানে কিছু দর্শনীয় অবশেষ খুঁজে বার করা হয়েছে কিনা
বা কোন বিশেষ আয়োজন ওখানে হয় কিনা। আজকাল তো এসব করার যুগ, কিন্তু তিরিশ-চল্লিশ বছর
আগে ছিল না। তুলসিদাস এবং তাঁর ভূমির প্রতি যে ভালোবাসা আমাদের মনে ছিল, দেখলাম তার
এক শতাংশও ওখানকার মানুষজনের মনে নেই।
যাহোক, এক দিন ওখানে আমরা থাকলাম। পরের দিন বর্ষার ভরা যমুনা পার
করলাম। রাজাপুরটা একদম যমুনার কিনারে, আর গ্রামের জমি কেটে কেটে নদীতে পড়ছিল। জানিনা
আজ কী অবস্থা, জমি নদীর তলায় চলে যাওয়াতে গ্রামটা অন্য কোথাও হয়েছে নাকি যমুনা মাই
দয়া করেছেন – ওখানেই থাকতে পেরেছে।
এক দিনের কথা। ফতেপুর জেলার খাগানগরে দুপুরের ভিক্ষা (সন্ন্যাসিরা
ভোজনকে ভিক্ষা বলে) সেরে আমরা কিছুদূর এগিয়ে একটা গ্রামের বাইরে একটা গাছের ছায়ায় শুয়েছিলাম।
তখনি ঠান্ডা হাওয়ার সাথে জোরে বৃষ্টি এল। দৌড়ে গ্রামের ভিতরে গেলাম কিন্তু কোথাও থাকবার
জায়গা পেলামনা। ধর্মশালার নামে একটা জীর্ণ বাড়ি ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখলাম আবর্জনায় ভরে
আছে। ছাত থেকে জল চুঁইছে। গায়ে ভালো রকম জ্বর ছিল আমার। একটা কথা বলতে ভূলে গেছি। সেদিন
কোন এক ভক্ত পেট ভরে লুচি-মিস্টি খাইয়েছিল। জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা তখন থেকেই ছিল। অন্য
কিছু খাবার পেলামওনা আর চব্বিশ ঘন্টায় একবারই খাওয়ার ছিল। কী করতাম? যাহোক, সেই ধর্মশালার
মেঝে তো জলে ভরা। যত আবর্জনা ছিল সব এক কোনায় জমা করলাম, যেখানে ছাত চুঁইছিল না। তার
পর ওই আবর্জনার ডাঁইয়ের ওপর উঠে দেয়ালে পিঠ টিকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বসার জায়গা কই? শরীর
জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। যেমন হাওয়া তেমন জল … আর আমি দাঁড়িয়ে! কে বুঝবে সে রাতে আমার অবস্থা?
কিন্তু ওভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির তোড়টা কাটিয়ে, যেই বৃষ্টি থামল, বেরিয়ে পড়লাম।
জ্বর নেমে গিয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। গ্রামের এক সজ্জন ওখানে এসে আমাদের
তার বাড়িতে যেতে বলল। ফলে রাতটা তার বাড়িতে কাটল। সকাল হতেই আবার রাস্তা ধরলাম।
আমার সঙ্গী বলেছিল, যেমনই জ্বর হোক যদি মহাদেব বাবার সামনে বসে তাঁর
ধ্যান করা হয়, তিন দিন ধ্যান করার পর নিশ্চয়ই নেমে যায়। আমি দুদিন ধ্যান করে নিয়েছিলাম।
তৃতীয় দিন পথেই আবার জ্বর এল। জ্বর নিয়েই যেমন তেমন করে সন্ধ্যেবেলায় ফতেপুরের পুরোন
শিবমন্দিরে পৌঁছোলাম এবং শিবজির সামনে গেড়ে বসলাম। ধার্মিক তো আমি ছিলামই, মনে পুরো
বিশ্বাস ছিল। কিছুক্ষণ পরে ঘাম বেরুনো শুরু হল। শরীর জবজবে হয়ে উঠল ঘামে। তবুও বসে
রইলাম। শেষে জ্বর যে সেদিন গেল, একেবারের মত বিদেয় হল – অন্ততঃ লম্বা সময়ের জন্য। এটাও
আশ্চর্যের ব্যাপার যে লুচি-মিষ্টি খেয়ে, জলে ভিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যে জ্বরটা সারাদিন
সহ্য করলাম সেটা হঠাৎ সেদিন নেমে গেল। আমার জ্ঞাতসারে তারপরেও আরো অনেকের জ্বর এধরণের
আরাধনায় নেমেছে। বুদ্ধিমান মানুষেরা বলুক যে এর কারণ, ধ্যানে জ্বর উপশমের বিষয়ে মনের
দৃঢ় বিশ্বাস। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমি তো আর কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি
না। আমার কাজ, নিজের জীবনসংগ্রামে অভিজ্ঞতালব্ধ একটি ঘটনার উল্লেখ করা মাত্র।
এখানে আরো একটি কথা। যখনই হাঁটতে হাঁটতে বেশি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তাম,
দেখতাম গায়ে জলের ফোঁটার মত কিছু বেরিয়ে আসত যার ওপর খুব মিহি সাদা পর্দার মত থাকত।
হাত দিয়ে রগড়ালেই সেটা সরে যেত, কিন্তু আবার বেরিয়ে আসত। আমি আন্দাজ করলাম এটা কাঁচা
লোহারই প্রভাব হবে। ছোটবেলায় পিত্তের প্রকোপ আর পিত্ত জমা হওয়ার কথা আগে বলেছি। হিন্দি
মিডল পড়ার সময় বেশি কুইনাইন খাওয়ার কথাও বলেছি। এই দুটো জিনিষে মিলে কাঁচা লোহা খেল
দেখাতে শুরু করল। এই ভয়ঙ্কর ত্রয়ী আমায় ভয় পাইয়ে দিল। লক্ষণগুলো দেখে মনে হত যে পেচ্ছাপ
এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ওপরও এর তীব্র প্রভাব পড়বে, যা দেখে লোকে মিছিমিছি সন্দেহ
করবে যে এই যুবক সন্ন্যাসি নিশ্চয়ই ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে সিফিলিস আর গনোরিয়ায় আক্রান্ত
হয়েছে। এই ভাবনা আমায় ভীষণভাবে বিচলিত করে তুলল। কিন্তু আমি সাহস হারালাম না। নিজের
সঙ্গীকেও কিছু বললাম না। শুধু সাবধান আর সংযমিত হয়ে থাকতে শুরু করলাম। ফলে কিছুদিন
পর ওই সমস্ত কুলক্ষণ দূর হয়ে গেল। আমি না জানি কোন কোন দেবতাকে ধন্যবাদ দিলাম। এটা
ঠিক যে রক্তে ওই অসুখের তাপ প্রবেশ করেছিল এবং শরীরের অষ্টধাতুর ওপর তার খুব প্রভাব
পড়েছিল। কিন্তু বাইরে তার আর কোন চিহ্ন দেখা গেল না।
আমরা হেঁটে হেঁটেই ফতেপুর থেকে এগোলাম এবং কানপুরে বেশ কিছুদিন থাকলাম। রাতে এক বাগিচায় থাকতাম আর দিনের বেলায় শহরে ভিক্ষা করে আসতাম। সরসৈয়াঘাটের বিষয়ে প্রথম প্রথম আমি সে সময়েই ১৯০৭ সালের বর্ষার দিনগুলোয় জানলাম। পরে তো কয়েকশো বার কানপুরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। স্থির করলাম যে কানপুরের পর গঙ্গার তীর ছেড়ে ঝাঁসিলাইনের পাশ দিয়ে চলা পথ ধরব। কেননা আমাদের অভিপ্রায় ছিল মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলার ওঙ্কারেশ্বরে গিয়ে, নর্মদা নদীর মাঝে, হিন্দুদের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি, শ্রী ওঙ্কারেশ্বরনাথজির দর্শন করব। তারপর ওখানেই পাশের জঙ্গলে শ্রী কমল ভারতী নামে যোগীর সাথে দেখা করে যোগাভ্যাস শিখব। সঙ্গে টাকাপয়সা ছিল না। শাস্ত্রমতে আমাদের টাকাপয়সা রাখার অনুমতি ছিলনা। ইচ্ছেও ছিল না রাখার। হেঁটে হেঁটে পথ চলার অভিজ্ঞতা আর আনন্দও পাওয়ার ছিল। তাই পায়ে হেঁটেই এগোলাম।
(৩)
ক্ষুধার অনুভূতি – অন্যান্য ঘটনা
উরই ইত্যাদি জায়গাগুলো হয়ে আমাদের পথ এগোল। যেমন যেমন এগিয়ে চললাম
খাওয়াদাওয়ার কষ্ট বাড়তে লাগল। ফলে এক এক দিনে অনেকখানি পথ পেরোতে হত। কেননা প্রদেশটা
জঙ্গলে ভরা। মনে হত আরেকটু দূরে গেলে হয়ত কোন শহর বা বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম পেয়ে যাব, সহজে
খাবার জোটাতে পারব। পরিণাম এই হল যে কোনোভাবে ঝাঁসী হয়ে ললিতপুর অব্দি পৌঁছোতে আমরা
অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লাম। আর চলার সাহস হচ্ছিল না। এখন তো আর চব্বিশ ঘন্টারও প্রশ্ন
ছিল না। মাঝে মাঝেই দেড় বা দু’দিন পর একবার কোনরকমে খাবার পেয়ে গেলে আমরা সৌভাগ্য মনে
করছিলাম। সব জাতের বাড়িতে খাবার খেতামও না। পারলে শুধু ব্রাহ্মণের বাড়িতেই খেতাম, আর
তা না হলে কখনো কখনো ক্ষত্রিয়ের বাড়ি। গোঁড়ামিটা যে ছিল। পূঁথিপত্রের জ্ঞানও নতুন নতুন
হয়েছিল।
ললিতপুরে, মনে আছে, আমরা বেশ কিছু দিন ছিলাম এবং একটু ক্লান্তি দূর
করলাম। আসলে গঙ্গার তীরের তো মানুষেরা সন্ন্যাসিদের জানে এবং কদর করে। কেননা হাজার
বছর ধরে অসংখ্য সন্ন্যাসি পায়ে হেঁটে গঙ্গার তীরে ঘুরে বেড়িয়েছে। হাজার হাজার জায়গায়
ওদের কুঁড়েঘরও রয়েছে। তাই এখনো ওদিকে ঘোরাঘুরি করলে অসুবিধে হয়না। কিন্তু ঝাঁসী আর
বুন্দেলখন্ডের জঙ্গলে সন্ন্যাসি কেন যাবে? তাই ওদিককার মানুষেরা বুঝতেও পারত না যে
আমরা কারা এবং কেন আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এই কারণেই বেশি কষ্ট হল ওদিকে
এবং ললিতপুরে বিশ্রাম করতে হল।
ওখানকার, সাজানো গোছানো এক ঠাকুরবাড়িতে একদিন আমরা গেলাম। মনে পড়ে
যে ওটা শহরের বাইরে পুকুরের ধারে ছিল। বৈষ্ণবসাধুদের মত আমরা ঠাকুরকে মাটিতে উপুড় হয়ে
(সাষ্টাঙ্গ) দণ্ডবৎ করলাম না। একটু মাথা নোয়ালাম। তারপর বসে পড়লাম। পুজারি লেখাপড়া
জানা ছিলেন। ওনার ভালো লাগল না আমাদের ধরণ। তবু ভদ্রতার সাথে কথা কথায় প্রশ্ন করলেন,
মহাপুরুষেরা (সন্ন্যাসিদের মহাপুরুষ বলা হয়) ভগবানকে সাষ্টাঙ্গ কেন করেন না? এর পিঠে
ওনার সাথে আমাদের কিছুক্ষণ কখনো হাল্কা কখনো শাস্ত্রীয় কথাবার্তা চলল। খুবই কৌতুহলোদ্দীপক
ছিল সে কথাবার্তা।
শেষে, এক জায়গায় অনেকদিন থাকা অবাঞ্ছনীয় মনে করে আমরা বীনা হয়ে সাগর
এবং সেখান থেকে নর্মদায় পৌঁছোনর কথা ভাবলাম। কিন্তু হাঁটার সাহস পাচ্ছিলাম না। তাই
ললিতপুরের স্টেশনমাস্টারকে অনুরোধ করলাম যেন সে কোনো ভাবে আমাদের বীনা অব্দি পৌঁছে
দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আমাদের অবস্থার কথা ওকে বললাম। বেচারা মানুষটি রাজি হয়ে গেল।
পয়সা ছিল কোথায় যে খরচ করব? সে বলল যে ট্রেন এলেই গার্ডকে বলে দেবে; আমরা নির্বাধ যেতে
পারব। ট্রেন এল। আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। গার্ডকে ইংরেজিতে সে যা বলল আমি শুনলাম।
গার্ডের চামড়া সাদা ছিল। আমায় দেখে ইংরেজিতে উত্তর দিল, এ তো সাধু নয়, বাচ্চা ছেলে!
“He is not a sadhu, but a mere child!” এধরণেরই কিছু শব্দ ছিল, ভুলে গেলেও যার কয়েকটি
আজ বত্রিশ বছর পরেও আমার কানে বাজে। গার্ড কি বুঝেছিল যে আমি শব্দগুলো বুঝতে পারব এবং
অমর করে রাখব? কিন্তু এ এক অসাধারণ ঘটনা ছিল যেটা জীবনে প্রথমবার হল। তখন অব্দি কখনো
পয়সা না দিয়ে ট্রেনে চড়ার ইচ্ছে করিনি, আর এবার ইচ্ছে করলামও তো সেটা নিরুপায় হয়ে।
তাও চুরি করে না চড়ে গার্ডের দয়ার ভিখিরি হলাম। কিন্তু গার্ড স্টেশন মাস্টারের অনুরোধ
প্রত্যাখ্যান করল। তার নিজের বুদ্ধির ওপর অহঙ্কার ছিল যে সে সাধুদের চেনে। আমায় নিছক
বাচ্চা ছেলে ভাবল।
কিন্তু এতে আমাদের ইচ্ছেটা সঙ্কল্পে পরিণত হল যে যাব তো ট্রেনে করেই
যাব। চুপিচুপি হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে চড়ে আর বেরিয়ে পালিয়ে যায়। কোনো গার্ড বলেনা
যে এ বাচ্চা ছেলে, সাধু নয়, কেননা সে সুযোগই তারা দেয় না। তারা যথেষ্ট চালাক চতুর।
অথচ আমরা যখন লুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে চড়া ঠিক নয় মনে করলাম তখন ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যাত
হলাম। আবার কি, আমরা দুজনেই ট্রেনে চড়ে বসলাম। স্টেশন মাস্টার গার্ডকে বলেই নিজের কর্তব্য
পুরো করেছিল। আমাদের চিন্তা সে কেন আর করবে? বরং এক গরীব পয়েন্টস ম্যান আমাদের বীনার
এক স্টেশন আগে নেমে যেতে বলল, কেননা বীনায় টিকিট নিয়ে ঝামেলা হবে। সে এও বলল যে আগের
স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ভালো লোক। ঠিকই তো, পয়েন্টস ম্যান যে গরীব দুখী। সে কেন বুঝবে
না আমাদের মত দুখীদের কষ্ট?
(৪)
সিনাজোরি ও অদ্ভুত ঘটনাবলি
কাজেই চুরির বদলে সিনাজোরি করে আমরা ট্রেনে চড়লাম। জেদ ধরে নিয়েছিলাম
যে যা হয়ে যাক, ট্রেনে চড়বই। আমি তো নিজের এধরণের স্বভাবের কথা আগেই বলেছি। মানুষকে
সময় মত নির্ভীক, বেপরোয়া এবং সাহসী তো হতেই হয়। নইলে আর সে মানুষই বা কেমন। যাহোক,
আমাদের ট্রেন চলা শুরু করল। জোরে চলা ট্রেন ছিল। দুপুরবেলা। বোধহয় বেশি বেলা হয়নি।
পয়েন্টসম্যানের বলা স্টেশনে ট্রেন থামলে আমরা দুজনে তার আশ্বাসে ভর করে নিশ্চিন্ত হয়ে
যেই নেমেছি স্টেশনের কর্মচারিরা টিকিট চাইল। টিকিট না দেখাতে স্টেসজন মাস্টার রেগে
বলল, “এরা দুজনেই চোর, গার্ড সাহেব, বীনায় নিয়ে গিয়ে এদের কাছ থেকে ঝাঁসী (যেহেতু জাংশন)
পর্য্যন্ত ভাড়া নিন।” আমাদের গার্ডের জিম্মায় দিয়ে আবার ট্রেনে চড়তে বাধ্য করল। জানিনা
গার্ড কী ভাবল। ও তো আমাদের দেখেই ছিল ললিতপুরে আর আমায় ‘বাচ্চা ছেলে’ বলেছিল। ওই স্টেশনের
ব্যাপারটা উল্টো হল। যে স্টেশন মাস্টারের বিষয়ে বলা হয়েছিল যে আমাদের সাহায্য করবে,
তাকে পেলাম পাক্কা পুলিসের লোকের মত। বোধহয় বেচারা পয়েন্টসম্যানের কাছে সঠিক তথ্য ছিল
না বা ইতিমধ্যে আগের স্টেশন মাস্টারের বদলে নতুন কেউ এসেছিল। কিন্তু ওই স্টেশনে অন্য
কেউও আমাদের সহানুভুতি দেখাল না।
যাই হোক, আমরা আবার ট্রেনে চড়লাম এবং একটু পরে বীনা পৌঁছে গেলাম।
ট্রেন দাঁড়াতেই আমরা দুজনে শিগগির নেমে গেটের কাছে পৌঁছোতে টিকিট নেওয়ার কর্মচারি টিকিট
চাইল। আমরা নিজেদের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলে দিলাম। সে বল, “যান মহারাজ!” তারপর তো
আমাদের আনন্দের সীমা রইল না। এখানেও উল্টো হল। আশঙ্কা ছিল ফেঁসে যাওয়ার, কিন্তু একটুর
জন্য বেঁচে গেলাম। কেজানে ওই গার্ড বেচারা কোথায় রয়ে গেল। আমরা তো স্টেশনের বাইরে চলে
এলাম। কি করে জানব ও কোথায়? হতে পারে পরে আমাদের বিষয়ে জিজ্ঞে করেছিল আর ভেবেছিল যে
শিকারদুটো ফস্কাল। যদিও আমরা সামনে দিয়ে এলাম এবং স্পষ্ট বলে এলাম। লুকিয়ে চুরিয়ে তো
আসিনি। আর আমাদের এটা কোনো কর্ত্তব্যও ছিল না যে গার্ডকে বলতে যেতাম, বা ওর অপেক্ষা
করতাম, এবং ও এলেই বাইরে আসার চেষ্টা করতাম। আমরা তো ওদের সবাইকার গুমোর এবং অতিবুদ্ধি
দেখে জেদবশতঃ এই পথটা বেছেছিলাম এবং সাহসে ভিত্তি করে নিজেদের সফলতা ওদের দেখাতে চেয়েছিলাম।
তা সফল তো আমরা হলামই।
স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়েই শহরের দিকে হাঁটা
দিলাম কেননা খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। আমরা জানতাম যে ওদিককার শহরগুলোয় ঘি-ওয়ালাদের
আড়ত থাকে। এটাও আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল যে ঘি-ওয়ালারা আমাদের মত সাধুদের দেখলেই লুচি-মিষ্টি
খাইয়ে বিদায় করে। ব্যস, আমরাও ঘিয়ের এক আড়তিয়া খুঁজে তার কাছে পৌঁছোলাম। সে আমাদের
পেট পুরে লুচি-মিষ্টি খাওয়াল। খাওয়ার সময়, খাওয়ার পর এবং আজ অব্দি যখনি মনে পড়েছে,
ভেবেছি, যদি বীনার আগের স্টেশনেই আমরা নেমে পড়তাম এবং কেউ টিকিটের প্রশ্ন তুলে আমাদের
না আটকাত, তাহলে বীনার ওই লুচি-মিষ্টি খেত কে? মনে হয় ওই লুচি-মিষ্টিই বাধা দিয়ে আমাদের
ওখানে নামতে দেয়নি এবং বীনা অব্দি পৌঁছে দিয়েছিল। কোথায় ঝাঁসী পর্য্যন্ত ভাড়া নেওয়ার
কথা ছিল! উল্টে আমরা ভালোভাবে খাবার খেলাম। এমন ধরণের ঘটনা ঘটলেই লোকে নিয়তিবাদ এবং
ভাগ্য দিয়ে ব্যাখ্যা কয়া শুরু করে। এমনই কোনো ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে এক কবি বলেছেঃ
“পাখিদের খাঁচায় পুরল দানা”
(৫)
বাহান্ন ঘন্টার পর
বীনা থেকে আমরা সাগরের দিকে এগোলাম। কেননা আগেই বলেছি, আমাদের নর্মদা
পেরিয়ে নরসিংপুরের গ্রামাঞ্চলে কড়কবেল স্টেশনের কাছে মানে গ্রামে গিয়ে সেখান থেকে খান্ডোয়া
হয়ে ওঙ্কারেশ্বর যাওয়ার ছিল। রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। জংলী এবং তথাকথিত ছোট জাতের
মানুষদের বসত ছিল কোথাও কোথাও। তাদের মধ্যে কোথাও যদি কাউকে ভদ্র (সুখী) গোছের মনে
হত তারা অধিকাংশ জৈনধর্মাবলম্বী। ফলে খাবার পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। সারা জীবনে এবং কোনো
যাত্রায় এমন কষ্ট কখনো পাইনি। কঠিন পরীক্ষা ছিল। গ্রামের মানুষেরা তুলসি রচিত রামায়ণের
মত এত জনপ্রিয় বইটার বিষয়েও জানত না এবং আমাদের প্রশ্ন করত আপনাদের জাতি কী? তাহলে
খাওয়াবে কে? ফলে খিদেয় অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। যেমন ললিতপুরের আগে খিদের গরমে নাক থেকে
রক্তও বইতে শিরি করেছিল। এদিকেও তেমনই হতে লাগল। একদিন তো এমন অবস্থা হল যে পুরো বাহান্ন
ঘন্টা আমরা খাবার পেলাম না। যখন রাস্তায় ছোট ছোট জংলি বৈঁচি ছিঁড়ে খেতে চাইলাম, তাতে
শুধু বীচি ছিল। তার আগে এক দিন ছত্রিশ বা চল্লিশ ঘন্টায় দুজনে মিলে শুধু এক ছটাক ছোলা
পেয়েছিলাম। তবে গিয়ে খাবার পেলাম। আবার বাহান্ন ঘন্টায় আমাদের পুরো আঠাশ মাইল হাঁটতেও
হল। তবে গিয়ে নর্মদার তীরে একটা শহরে পৌঁছোলাম; নামটা ভুলে যাচ্ছি। সেখানে দাক্ষিণাত্যের
এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ভোজে আমরা পেটভরা ভালো খাবার পেলাম।
সে ভোজ খাবার সময়ও একটা অদ্ভুত ঘটনা হল। আমরা খাচ্ছিলাম। একজন চালাক
লোক আমাদের জিজ্ঞেস করল আপনাদের পয়সা পাঠাবার থাকে তো বলুন, আমি পাঠিয়ে দেব। আমরা বুঝতে
পারলাম না। কয়েকবার লোকটা একই কথা বলল। তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কী? শেষে
রহস্য খোলসা হল যে অনেক গেরুয়াধারী পয়সা জমা করতে থাকে এবং ছেলেপুলেদের কাছে পাঠাতে
থাকে। লোকটা জানত যে ওদিকে নর্মদার তীরে এসব হয়। তাই সে ঠাট্টাচ্ছলে আমাদের জিজ্ঞেস
করছিল। সে কী করে জানবে যে টাকাপয়সা থেকে কয় যোজন দূরে আছি আমরা? ওকে আমাদের বক্তব্য
স্পষ্ট বলে দিলাম। কিন্তু আমাদের জীবনে প্রথম আমরা সাধুসন্ন্যাসিদের এমন ঘৃণ্য কাজের
বিষয়ে জানলাম।
সাগরের পর রাস্তায় আরো একটা মজা হল। এক দিন হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গল পেরোচ্ছিলাম। ঘন জঙ্গলের চিরে যাওয়া রাস্তায় হাঁটছিলাম। শীতের দিন; হঠাৎ সন্ধ্যে হয়ে গেল আর তখন অব্দি কোনো গ্রামের হদিশ নেই। আন্দাজ করলাম গ্রাম দূরে হবে হয়ত। ব্যস, স্থির করলাম যে জঙ্গলের মাঝেই পাকা রাস্তার ওপর রাত কাটানো ঠিক হবে। কিন্তু জামাকাপড় কম ছিল। রাতে জন্তুজানোয়ারেরও বিপদ ছিল। হঠাৎ রাস্তার মাঝেই আগুন দেখতে পেলাম। মনে হল গাড়োয়ানরা ওখানেই বিশ্রাম নিয়েছিল; জ্বলন্ত আগুন ছেড়ে চলে গেছে। আর কি, যেমন তেমন করে কাঠকুটো জ্বেলে রাত কাটালাম এবং নিজেদের প্রাণ বাঁচালাম। আগুনের কাছে জন্তুজানোয়ারেরা আসে না এটুকু আমরা জানতাম। সন্ধ্যে থেকে সকাল অব্দি একটা মানুষকেও ওই রাস্তা দিয়ে আসাযাওয়া করতে দেখলাম না। এ থেকে বুঝতে পারলাম যে রাস্তাটা রাতে চলাফেরা করার জন্য নয়।
(৬)
নর্মদার ওপারে মানেগাঁওয়ে
আমরা নর্মদার উত্তর তীরের সেই শহরে রাত কাটালাম এবং পরের দিন নদী
পার করলাম। যার এত মহিমার কথা শুমতাম, জীবনে প্রথমবার সেই নর্মদামাইয়ের দর্শন করলাম।
আমাদের শৈশবে এটাও বলা হয়েছিল যে বৈষ্ণব আচারিরা ভীষণ গোঁড়া হয় এবং নর্মদায় পা রাখে
না। তাদের ধারণা যে নর্মদায় অসংখ্য শিবলিঙ্গ (শিবপ্রতিমা) আছে। তাই সেই শিবলিঙ্গের
সাথে সম্পর্কিত জল স্পর্শ করলে ধর্ম চলে যায়। বৈষ্ণব এবং শৈবদের এই নির্বুদ্ধিতা এবং
মূর্খতাপূর্ণ গোঁড়ামিকে কী বলা যায়? ধর্মের নামেই এ ধরণের বোকামি সম্ভব।
যা হোক, নর্মদার খরস্রোতের অনবরত ঘষায় গোল আর মসৃণ হয়ে যাওয়া প্রচুর
পাথর দেখলাম ওখানে। বুঝলাম যে এগুলোকেই শিবলিঙ্গ বলে পুজো করা হয়। নর্মদা পেরিয়ে নরসিংহপুর
পৌঁছে রাতে ওখানেই থেকে গেলাম। পরের দিন পূর্বদিকে হাঁটা দিলাম। মনে নেই মানেগাঁওয়ে
এক দিনে পৌঁছোলাম না দুদিনে। এ কথাটা আগে বলেছি। এগোবার আগে বলে নিই যে লাগাতার কয়েক
মাসের আনন্দময় ভ্রমণ আমাদের পাকা করে দিয়েছিল। অনেক অভিজ্ঞতাও হল। আগে খিদেয় এমন কষ্ট
পেতাম যে অস্থির হয়ে পড়তাম। এক বেলা খাবার না পেলে সমস্যা। একাদশী বা উপোস করাও অসম্ভব
ছিল। ফলাহার করতে হলেও ক্ষেপে যেতাম। কিন্তু এ সমস্তই চলে গেল। চব্বিশ ঘন্টায় একটি
বার খাবার পেয়ে গেলে খুশি থাকতাম।
নরসিংহপুর জেলার (মধ্য প্রদেশ) মানেগাঁও নামের গ্রামে এক অত্যন্ত
ধনী ক্ষত্রিয় মালগুজার থাকতেন। বিহার, বাংলা, যুক্তপ্রদেশের জমিদারদের বদলে মধ্যপ্রদেশে
ওদের মতই মালগুজার হয়। আক্ষেপ হচ্ছে যে এখন তার নামটা আমি ভুলে যাচ্ছি। যখন ওঁর বাড়িতে
পৌঁছোলাম তখন সেখানে তার চারটে সুযোগ্য ছেলেও ছিল। গৃহস্থ থাকার কালে আমার যাত্রাসঙ্গী
একবার ওবাড়িতে গিয়েছিল। তাই আমরা দুজনে ওখানেই গেলাম। উনি সন্ন্যাসিদের খুব সেবা করতেন।
প্রথম দর্শনে না হলেও পরে আমার সঙ্গীকে উনি চিনতে পারলেন এবং সন্ন্যাসি রূপে দেখে খুব
খুশি হলেন। নিজের বাড়ির সামনেই লম্বা বাগানের পূর্বে পশ্চিমে শিব এবং বিষ্ণুর দুটো
মন্দির তৈরি করিয়ে রেখেছিলেন। দুটো মন্দিরের মাঝখানে লম্বা পাকা মেঝে ছিল। এতে স্পষ্ট
বোঝা যাচ্ছিল যে তাঁর বাড়িতে শৈব আর বৈষ্ণবের ঝগড়ার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। ওনার
নিজের উৎসাহ ছিল বেদান্ত দর্শনে। অবশ্য সংস্কৃত উনি জানতেন না। কিন্তু বেদান্তের যতগুলো
গ্রন্থ হিন্দিতে লেখা হয়েছে, বা সংস্কৃত ইত্যাদি থেকে কোথাও হিন্দিতে অনুবাদ হয়েছে
সেসব উনি খুঁজে আনিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সবগুলো বই উনি পড়েছিলেন এবং বুঝেছিলেন।
একজন ভালো বিদ্বান বিবাগী সন্ন্যাসি ওনার গুরু ছিলেন। তাঁর কাছেই উনি সব গ্রন্থ পড়েছিলেন
এবং জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাই সে সন্ন্যাসির এবং সেইসাথে অন্যান্য সন্ন্যাসিদেরও উনি
পরম ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
সে বিবাগী মহাত্মারও বিচিত্র গল্প। বাবুসাহেব আমাদের বললেন যে হাজার
চেষ্টা করলেও উনি এখানে কিছুতেই থাকেন না। একাধ মাস থেকে চুপচাপ বেরিয়ে পড়েন এবং ঘুরে
বেড়ান, কষ্ট সহ্য করেন। আবার কিছুদিন পর হঠাৎ চলে আসেন। এবং সেভাবেই চলেও যান। সৌভাগ্যবশতঃ
উনি সে সময় ওখানেই ছিলেন। সামনের বাগানে যে সুন্দর পাকা বাংলোবাড়িটা ছিল তাতেই উঠেছিলেন।
আমরা ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম। দেখলাম বাংলোর ভিতরে দেয়ালে আলমারি তৈরি করা আছে।
সাজিয়ে গুছিয়ে বই রাখা আছে সে আলমারিগুলোতে। ঠাকুর সাহের সব বই ওখানেই ছিল। মহাত্মাজি
সংস্কৃত লেখাপড়া জানা মানুষ। আমাদের সাথে কথাবার্তায় বললেন যে কেন উনি সবসময় ওখানে
থাকেন না।
তাঁর বক্তব্য ছিল এবং আমাদেরও আজ অব্দিকার অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে
গৃহস্থ মানুষেরা প্রথম প্রথম তো খুবই আদর-যত্ন করে এবং মনে প্রাণে সেবা করে। এমন করতে
করতে ওরা বিবাগী সাধু-সন্ন্যাসিদের ফাঁসিয়ে নেয়। কিন্তু যখন তারা দেখে যে এই মহাত্মারা
এক ভাবে ওদের আশ্রিত এবং অলস হয়ে পড়েছে, ফলে আর বাইরে যেতে পারবে না, তখন জ্ঞাতে বা
অজ্ঞাতে এদের অসম্মান করা শুরু করে দেয়। সাধু বেচারাও অসহায়ভাবে সেসব সহ্য করে। কেননা
অনেকদিন আরামের জীবন কাটিয়ে তার সাথে সাধারণ গৃহস্থের বস্তুতঃ আর কোনো তফাৎ নেই। তাই
কোথাও চলে যাবে ভাবতে গেলে কষ্ট আর খিদে-তেষ্টা আশঙ্কা তাদের ভয়াক্রান্ত করে। এসব শুনে
আমরা ওনাকে বললাম, এ ব্যাপারগুলো যখন জানেন, তখন আপনি কেন ফাঁসবেন? সজাগ থাকবেন আর
যেই পরিবর্তনটা টের পাবেন চুপচাপ পালিয়ে যাবেন। এভাবে কয়েক দিন পরে পরেই পালাবার কী
দরকার? নিজেকে এত দুর্বল হৃদয় কেন মনে করেন যে ফেঁসে যাবেন? মহাত্মা উত্তর দিলেন, যখন
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকায় তখন কঠিনতম হৃদয়ের মানুষদেরও চোখের পলক পড়ে যায় অজান্তেই। ইন্দ্রিয়সুখেরও
একই অবস্থা। যত বড় ত্যাগী, বিবাগী এবং বিবেকবান হোক না কেন, ইন্দ্রিয়সুখ তাদের ফাঁসিয়ে
দেয় এবং বাঁধনে ফেলে দেয়। তাই আমি থেকে থেকে পালিয়ে যাই এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণা ইত্যাদি
কষ্টের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে ভিতর-বা’র দু’দিক থেকেই দৃঢ় রাখতে চাই। কথাটা তো উনি ঠিকই
বললেন। আমরা কয়েক হাজার সন্ন্যাসি দেখেছি যারা শুরুতে বিবাগী এবং ত্যাগী হওয়া সত্ত্বেও
এভাবেই পরে সংসারী হয়ে পড়েছে। যদিও, শেষ অব্দি ভেবে গেছে যে তারা মহাত্মা।
কয়েক বছর পর সেই ত্যাগী সন্ন্যাসির দর্শন আমরা হঠাৎ হৃষিকেশে পেয়েছিলাম।
কিন্তু সেখান থেকেও হঠাৎ উনি চলে গেলেন। যদ্দূর স্মৃতি সঙ্গ দেয়, আমরা মনে হয় মানেগাঁওয়ে
কয়েক মাস থেকে গিয়েছিলাম। বেদান্ত নিয়ে অনেক আলোচনা হত। ঠাকুর সাহেব বুদ্ধিমান এবং
সুপাঠক ছিলেন। তাই তর্ক-বিতর্ক এবং বেদান্তের সূক্ষ্ম প্রশ্নাদির ওপর প্রচুর কথাবার্তা
হত। ঠাকুর সাহেব বলতেন, যথাসাধ্য চার রকম দান করি আমি। বাইরে থেকে যে কেউ সাধু-ফকির
বা ভুখা-নাঙ্গা আসে আমি তাকে অন্নবস্ত্র দিই। নিরাশ হয়ে কেউ ফেরে না। বিনামূল্যে ওষুধ
দেওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছি যাতে গ্রামাঞ্চলে অসহায় মানুষকে ওষুধ-পত্র দিতে পারি। পুস্তকালয়
এবং বেদান্ত গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করে মানুষের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করি। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের
পদে থেকে পক্ষপাতশূন্য এবং সুলভ ন্যায় দান করি। ঠিক কথাই বলছিলেন। আমরা নিজের চোখে
দেখলাম। নিজের চার সুপুত্রদেরকেও এই একই শিক্ষা দিয়েছিলেন যে তারাও যেন চার প্রকারের
দান চালিয়ে যায়। এভাবে দেখলাম যে নিরেট বৈদান্তিক নন; বরং বেদান্তের ব্যবহারিক রূপ
পেলাম ওনার মধ্যে। বস্তুতঃ আদর্শ গৃহস্থ ছিলেন উনি।
যদি অন্যান্য মানুষেরাও ওনার দৃষ্টান্তে এমনই শিক্ষা গ্রহণ করতেন
এবং এমনই অসংখ্য বৈদান্তিকের দেখা পেতাম দেশে? এখানে তো বেদান্তের জ্ঞান বিষয়লালসা,
ধনসম্পদসংগ্রহ এবং কর্তব্যবিমুখতার সাধনে পরিণত হয়েছে। বৈদান্তিকেরা বলেন যে আমরা তো
অখন্ড নির্লিপ্ত ব্রহ্মস্বরূপ। আমাদের কর্তব্য বলে কিছু নেই। বলা হয় যে বৈদান্তিকদের
পাড়ায় একটা মুর্গি কোনোদিক থেকে পথ ভুলে এসে পড়ায় বৈদান্তিকেরা সেটাকে উদরস্থ করে নিল;
পরে প্রশ্ন উঠলে উত্তর দিল, সংসার তো স্বপ্নবৎ মিথ্যা, তাহলে তোমার মুর্গি কোত্থেকে
এল?
আমিও যখন এতদিন পর সেই ঠাকুর সাহেবের চার রকমের দান এবং বেদান্তজ্ঞানের
কথা ভাবি তখন নিজের ওপর করুণা হয় – আমি তো সেসব দিনে পাকা বৈদান্তিক ছিলাম, তবুও আমি
ওনার মত কর্তব্যপরায়ণ এবং ব্যবহারিক মানুষ হতে পারলাম না কেন? এমনকি ওনাকে দেখার পরও
ওই বোধ বহুদিন অব্দি, প্রায় দশ বছর অব্দি, আমার মধ্যে কেন এল না এবং কেন আমি ভুল পথে
ঘুরে বেড়ালাম। আসলে আমার বেদান্ত তখন ছিল অপরিপক্ক এবং ওনার পরিপক্ক। তাই বেদান্তের
ওই সত্যটা আমি দেখতে পেলাম না। পরে যখন আমার জ্ঞান পরিপক্ক হল তখন দেখতে পেলাম। কিন্তু
ওনার ওই চার রকমের দানের কথা আমার খুব ভালো লেগেছিল। এটাই ইঙ্গিত ছিল যে আমার ভিতরে
সুষুপ্ত কিছু আছে যেটা কালান্তরে আমায় ওইদিকে টানবে।
এবং, জীবনে প্রথমবার ওখানেই আমি এমন পায়েস খেলাম যাতে নুন মেশানো ছিল। বলা হল যে এটাই ওদিককার রীতি। জানিনা আজকালও আছে কিনা।
(৭)
ওঙ্কারেশ্বরের দিকে
মাসখানেক পর এক দিন আমরা ঠাকুর সাহেবের কাছে বিদায় নিলাম। তারপর
পশ্চিমের দিকে রওনা হলাম। খান্ডোয়া যাওয়ার ছিল। যদ্দুর আমাদের মনে আছে, বাবুসাহেব কড়কবেল
স্টেশনে নিজের লোক পাঠিয়ে আমাদের দুজনের জন্য খান্ডোয়া অথবা ওঙ্কারেশ্বর অব্দি টিকিট
করিয়ে দিয়েছিলেন এবং ট্রেনে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই খুব সহজে আমরা ওঙ্কারেশ্বর পৌঁছে
নিশ্চয়ই গেলাম কিন্তু ভ্রমণের আনন্দটা পেলাম না। খান্ডোয়া থেকে ছোট লাইন ওঙ্কারেশ্বর
হয়ে উজ্জৈনের দিকে যায়। সেই লাইনেই আমরা ওঙ্কারেশ্বরে গেলাম। নর্মদাজিতে স্নান করে,
মাঝনদীতে অবস্থিত পাহাড়ে গিয়ে বাবা ওঙ্কারেশ্বরের দর্শন করলাম এবং তাঁর ওপর নর্মদাজির
জল ঢাললাম।
কথিত আছে যে শ্রী শঙ্করাচার্য এবং শ্রী মন্ডন মিশ্রের মাঝে যে প্রসিদ্ধ
শাস্ত্রার্থ হয়েছিল, যাতে হেরে গিয়ে শ্রী মন্ডন মিশ্র, শ্রী সুরেশ্বরাচার্যের নামে
শঙ্করের শিষ্য হয়ে গিয়েছিলেন, সেই শাস্ত্রার্থ মাহিষ্মতী পুরীতে হয়েছিল। শঙ্কর দিগ্বিজয়ে
লেখাও আছে, “মাহিষ্মতী মন্ডন মন্ডিতা সঃ”। ওঙ্কারেশ্বরেই আমরা মাহিষ্মতীর ঠিকানা পেলাম
– আরেকটু পশ্চিমে, নর্মদার তীরে। উক্ত ‘বিজয়’এ এটাও লেখা আছে যে রেওয়া (নর্মদা) থেকে
শীতল সমীরণ প্রবাহিত হত মাহিষ্মতীতে – রেওয়া মরুতকম্পিত সালমালঃ। তাহলে, মন্ডন মিশ্রকে
মিথিলায় কেন টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয় বুঝতে পারি না। বোধহয় ‘মিশ্র’ পদবী দেখে। কিন্তু
হাজারেরও বেশি বছর আগে আজকের যে বংশপরম্পরাগত মিশ্র ইত্যাদি পদবী তার লেশমাত্রও তো
ছিল না। তখন তো ‘মিশ্র’ আর ‘পাদ’ শব্দ সম্মানার্থে এবং বিদ্বান বোঝাতে কখনো কখনো প্রয়োগ
করা হত। পুরোনো গ্রন্থে আমি দেখেছি এমন।
ওঙ্কারেশ্বরজির দর্শনের পর আমাদের, বাবা কমলভারতীজির দর্শন করার
চিন্তা হল। উনি ওখানেই নর্মদার উত্তর তীরে জঙ্গলে কুটির তৈরি করে থাকতেন এবং যোগাভ্যাস
করতেন। এমনই বলা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু ওখানে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম উনি যোগী-টোগী
ছিলেন না। উনি তো শুধু ঔষধি এবং সংযমের শক্তিতে পুনঃশক্তিসঞ্চার অর্জন করেছিলেন। সে
কারণেই তাগড়া এবং হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন এবং ওনার ভক্তরা ওনাকে যোগী ঘোষণা করেছিল।
তবে, পাড়াগাঁয়ের এবং আশেপাশের প্রতিবেশিরা কাছে থাকা মানুষের প্রতি অনেকসময় যথোচিত
সম্মান দেখায় না ভেবে জিজ্ঞেস করলাম যে তাঁর কোনো শিষ্য আছে কিনা। আমাদের বলা হল যে
খুব ভস্মলেপন করে থাকা এক নাগা যুবক ওনার উত্তরাধিকারী। ব্যস, এটুকুই জানা আমাদের জন্য
যথেষ্ট ছিল। আমরা তাঁর কুটিরে গেলাম। জানতে পারলাম যে নাগা মহারাজ গুহায় বন্ধ, পরে
বেরুবেন – সন্ধ্যায় অথবা রাতে। আমরা ভাবলাম যোগাভ্যাস করতে গিয়ে হবেন। তাই রাতে ওখানেই
থাকতে হল। যখন উনি বেরুলেন, কথা বলে বুঝলাম একেবারেই আনকোরা। আমরা জানতে পেলাম যে কমলভারতীর
গুহায় ঢুকে উনি খুব ঘুমোন এবং আরাম করেন। আর তাতেই সরল ভক্তরা মনে করে যে উনি যোগাভ্যাস
করেন। ব্যস, এটুকুর জন্য উনি সম্মান এবং পুজো পেয়ে থাকেন।
যেভাবে হতাশ হলাম সেটা বলে বোঝাতে পারব না। যে খবরটার ওপর নির্ভর
করে এত বাধা-বিঘ্ন পার হয়ে এলাম এবং এত কষ্ট সহ্য করলাম, সে খবরটাই ভিত্তিহীন প্রমাণিত
হল। কিন্তু করারই বা কী ছিল? আমরা দেখেছি যে এভাবেই কারোর যোগী এবং সিদ্ধিপ্রাপ্ত মহাত্মা
হওয়ার খ্যাতি ছড়ান হয় এবং ধার্মিক ও অন্ধবিশ্বাসী মানুষদের সহজে ঠকান হয় দুনিয়ায়। তবুও
এই প্রথম ধাক্কায়, সাচ্চা যোগীদের অস্তিত্বের প্রতি আমাদের বিশ্বাস টলল না। স্থির করলাম,
এগিয়ে যাব।
যখন ওখান থেকে পায়ে হেঁটে উত্তরের দিকে এগোলাম তখন আমাদের পথ হল
হোলকরের (ইন্দোর) রাজত্ব হয়ে। এক এলাকায়, নামটা ঠিল মনে নেই, বোধহয় বঢ়ওয়ান, খুব সুন্দর
একটা জায়গা পেলাম। একটি শীর্ণ ঝর্না বয়ে সুন্দর একটি কুন্ডে পড়ছিল। লোকেরা বলল, সরস্বতীর
ধারা। তাই তীর্থস্থানের মত লোকেরা স্নান ইত্যাদি করে এখানে। এই সরস্বতীও বিচিত্র। জায়গায়
জায়গায় এর ধারা দেখান হয়। কথিত যে নদীটি গুপ্ত। স্থানে স্থানে আবির্ভূত হয়ে ওঠে। পরে
আবার সরস্বতীর কথা লিখব। সে সরস্বতী সিদ্ধপুরে, যেখানে মানা হয় যে কপিল মহারাজ অবতার
নিয়েছিলেন, দূর অব্দি ছড়িয়ে থাকা খাতে বয়ে যায়। অবশ্য জল নামমাত্রই থাকে। আবার মেহসানার
কাছে পাটনেও (বরোদা-স্টেট) সিদ্ধপুরের সেই স্রোতটা পেয়েছিলাম।
সে যাহোক, ওখানে থেকে আমরা এগোলাম। মৌএর সৈন্য-ছাউনি হয়ে খাস ইন্দোরে
পৌঁছে গেলাম। ওদিকে আমরা জৈন মতাবলম্বীদের জায়গা এবং বাড়ি দেখলাম অনেক; ওদের মন্দিরও
ছিল। জৈনসাধুও দেখলাম। ওরা নাকের ওপর থেকে একটা ছোট কাপড়ের ঢাকনি মুখের নিচে অব্দি
ঝুলিয়ে রাখে। একটা লম্বা সুতোয় ছোট কাপড় বেঁধে সুতোটা মাথার পিছনে বেঁধে নেয়; কাপড়টা
নাকমুখের ওপর ঝুলে থাকে। বলা হয় যে এতে গরম নিঃশ্বাস দূর অব্দি ছড়িয়ে হাওয়ায় ছড়িয়ে
থাকা জীবদের নাশ করতে পারে না। আর কিছুই না, অহিংসার পুজোর পরিণতি। ওরা ছোট ডান্ডায়
বাঁধা সুতোর গোছা দিয়ে তৈরি একটা ঝাঁটাও সঙ্গে রাখে। যেখানে বসবে, সেখানটা ওই ঝাঁটা
দিয়ে পরিষ্কার করে তবেই বসে যাতে পাছার চাপে পোকামাকড় না মরে যায়। সুতোর ঝাঁটা নরম
হয়। তাই তার ঝাড়নে পোকা মরে না। কিন্তু চলার বেলায় কী হয়? সেখানে কিসের ঝাঁট দিয়ে পা
ওঠায় আর ফেলে? যদি চলাফেরা আর নিঃশ্বাস নেওয়া বন্দ করে দেওয়া হয় তাহলেই বোধহয় ওদের
অহিংসা পূর্ণ হবে। এরা হাতে আবার লম্বা একটা কাষ্ঠদন্ডও রাখে। সেটি রাখার উদ্দেশ্য
ভুল হোক বা ঠিক, আমায় বলা হল যে পথে কোথাও বিষ্ঠা থাকলে ওই দন্ড দিয়ে তারা সে বিষ্ঠা
ছড়িয়ে দেয় যাতে তাড়াতাড়ি সেটা শুকিয়ে যায়; ফলে তার পচনে কীটের জন্ম, মৃত্যুর আশঙ্কা
আর থাকে না। নারীদেরও ওই একই রূপে দেখলাম। কয়েকজন জৈন সাধু-সাধুনিকে শ্বেতবস্ত্র পরিহিত
দেখলাম আবার কয়েকজনকে পীত। কিন্তু মাথায় চুল প্রায় কারোরই ছিল না। যেমন দীর্ঘ জ্বরের
পর মাথার চুল পড়ে যায় – কোথাও কোথাও দু’একগাছ দেখা যায় - আর চেহারাও হয় হলদেটে এবং
হতভাগ্য, হুবহু একই অবস্থা দেখলাম সবার। বলে যে স্নান-টান করলে, শরীর বা জামাকাপড় ঘষলে-রগড়ালে
নাকি হিংসা হয়। তাই স্নান বোধহয় করেই না। ফলে শরীরে গরম থাকে বেশি, চেহারা রক্তশূন্য
হতে থাকে এবং চুল ঝরে যায়। ঠিক কী ব্যাপার, বলতে পারব না। কিন্তু সবার মুখ দেখে বিচলিত
হলাম – যে ধর্মে বেঁচে থাকতে এই দুর্দশা, সে ধর্ম কোন কাজের? শরীর অন্ততঃ প্রাণবন্ত
থাকুক, চেহারায় উজ্জ্বলতা থাকুক, হাসি থাকুক! শরীর ও জামাকাপড় পরিষ্কার থাকলে বোঝা
যায় যে মনও পরিষ্কার এবং সুস্থ থবে। কেননা মনের বাড়ি তো শরীর! আর যদি বাড়িটাই নড়বড়ে
এবং নোংরা হয় তাহলে তার বাসিন্দার কী অবস্থা হবে সে তো সহজেই বোঝা যায়।
বলতে পারব না ১৯০৭ সালের শীতে না ১৯০৮ সালের শুরুতে, কবে আমরা ইন্দোরে
পৌঁছোলাম। সেখানে বাদশাহী বাগে আমরা পোষা চিতাবাঘ-টাঘ দেখলাম। লোহার ঘেরার ভিতরে ওদের
রোজ মাংস খেতে দেওয়া হত। একদিন দেখলাম ভিতরে ঢুকে একজন মেথর সাফাই করছে। যখন বড় একটা
চিতা ওর দিকে এগোল, ও হাতে ধরা একটা পাতলা মামুলি ছড়ি দিয়ে চিতাটাকে মারল। চিতাটা পালিয়ে
গেল। আমরা অবাক হলাম। বোধহয় ও’ই রোজ মাংস দিত চিতাটাকে। তাই একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার
কারণে চিতাটা ওকে লেহাজ করত। নইলে পাতলা কাঠির পরোয়া না করে চিবিয়ে খেত ওকে।
শীতে আমাদের ঠোঁট ফাটতে শুরু করেছিল। তাই শুধু চোখদুটো বাদ দিয়ে
পুরো চেহারা কাপড় দিয়ে ঢেকে আমরা হাঁটতাম। একদিন রাস্তায় ইন্দোর রাজ্যের পুলিস আমাদের
বলল মুখ খুলে চলতে হবে। বোধহয় ভেবেছিল আমরা পলাত্তক বা ফেরারি, মুখ লুকিয়ে চলেছি। কিন্তু
আমরা দু’এক দিনেই ইন্দোর ছেড়ে উজ্জৈনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাই পুলিসের সাথে আমাদের
মুখোমুখি কোন সংঘাত হল না।
(৮)
মহাকাল দর্শন
অবশেষে চলতে চলতে, রাস্তায় অনেক কষ্ট ভুগতে ভুগতে (কেননা মাঝেমাঝেই
খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হত) আমরা হিন্দুদের দ্বাদশজ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম, বাবা মহাকালেশ্বরের
পুরী উজ্জৈনে পৌঁছোলাম। শীতেরই দিন ছিল। পথে কয়েক মাস ধরে আমাদের মাথার চুল কাটা হয়
নি। তার ওপর, ধুলো পড়ে মাথার অদ্ভুত অবস্থা হয়েছিল। প্রয়োজন ছিল এক চালাক-চতুর নাপিতের
যে আমাদের মাথা মুড়িয়ে শান্তি দেবে। পেয়েই গেলাম এক বুড়ো নাপিত। মাথায় তার সরু একটা
পাগড়ি বাঁধা। তার কথা ভুলতে পারি না। অত চালাক-চতুর এবং ওস্তাদ নাপিত আর পাইনি। সরু
ছুরি দিয়ে কথায় কথায় সে ধুলোমাটিতে ভরা আমাদের মাথাদুটো পরিষ্কার করে দিল। ছুরিটাও
তেমনই ধারালো আর ভালো ছিল। মাথার এক কোণ থেকে অন্য কোণ অব্দি খস-খস করে চলত যেন কেই
নিশ্চিন্তে ঘাস কাটছে। নাপিতকে আমরা প্রাণ ভরে ধন্যবাদ দিলাম।
উজ্জৈনে ক্ষিপ্রা নদী আছে যাকে শিপ্রাও বলে। শহরটাকে রাজা ভোজের
পুরীও বলা হয়। আমরা পুরোনো গড় ইত্যাদি দেখলাম। বাবা মহাকালেশ্বর শিবের দর্শন করলাম।
সে সময় উনি খুবই ছোট মন্দিরে ছিলেন। লোকে শিপ্রায় স্নান করত, দর্শন করত এবং রাতে জুনা
মহাকালের মন্দিরে থাকত। বলা হয় যে মহাকাল দুটো। আজকাল নতুন মহাকালেরই খ্যাতি এবং পুজো
হয়। জুনা (পুরোনো) মহাকালকে আজকাল লোকেরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। ওনারই মন্দিরে আমরা থাকতাম।
মন্দিরটা ছিল সাদা পাথরের। খুব পুরোনো মনে হচ্ছিল না। যদিও জুনা নামটার হিসেবে পুরোনো
হওয়ারই কথা ছিল। ঠিক মনে নেই কত দিন আমরা ওখানে ছিলাম। তবু, বোধহয় পনের দিন বা তার
বেশিই থেকে হব। তারপর বিরক্ত হয়ে পড়লাম। ভাবলাম বেরোন উচিৎ।
মথুরা পৌঁছোন স্থির হল আর সেটা ভেবেই উজ্জৈন থেকে বেরোলাম। পথে এক
বিচিত্র ঘটনা হল। সেদিনই বা পরের দিন সন্ধ্যায় একটি শহরে পৌঁছোলাম। খাওয়াদাওয়া হয়েই
গিয়েছিল; চব্বিশ ঘন্টায় একবারই খেতাম। তাই শহরের ভিতরে না গিয়ে বাইরেই একটা মন্দিরে
উঠলাম। সেখানে পাথরে তৈরি একটি গুহা ছিল। ভাবলাম ওতেই কিছুক্ষণ থাকি। শহরে একবার ভিক্ষা
করব আর এখানেই নির্জনে অভ্যাস করব। কাছেই একটু তফাতে একটি লম্বা পুকুরের পাড়ে ছাইয়ের
কিছু স্তুপ দেখলাম। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম জৈনিরা নিজের মৃতদের দেহ এমনিভাবেই কাঠ
এবং ঘুঁটের মাঝে রেখে পোড়ায় এবং সেখানেই ছেড়ে রাখে। ছাইটাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে নদী-নালায়
ভাসায় না।
অতঃপর, পরের দিন খাওয়ার সময় যখন আমরা শহরে গেলাম তখন বিচিত্র ব্যাপার
হল। চার দিকে নজরে এল শুধু জৈনি। ব্রাহ্মণ বা হিন্দু দু’একজন ছিল তাও গরীব। ফলে কেউই
আমাদেরকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করল না। আমাদের সমস্ত মনোবাঞ্ছা ব্যর্থ হল। নিরুপায় হয়ে
সে শহর ছেড়ে রওনা হয়ে আমরা পাকা রাস্তা ধরে পূর্বদিকে এগোলাম। তৃতীয় প্রহরে অন্য একটা
গ্রামে আমরা কিছু খাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অসফল হলাম। আর চেষ্টা করা ছেড়েই দিলাম
সেদিন।
(৯)
সেই খাবার
সন্ধ্যা হতে হতে একটা গ্রামে পৌঁছোলাম এবং যেমন ওদিককার রেওয়াজ, কারোর বাড়িতে না থেকে গ্রামের মাঝখানে তৈরি মাটির ধর্মশালায় গিয়ে উঠলাম। সারাদিন খাওয়াদাওয়া না হওয়ায় একটা অবসন্নতা তো ছিলই। এরই মধ্যে একজন এসে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কে। আমরা বললাম। তাকে জিজ্ঞেস করায় নিজেকে ব্রাহ্মণ বলল। তারপর চলে গেল। আময়াও সব আশা ত্যাগ করে মুখ ঢেকে ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। রাত ন’টা বা দশটা হয়ে হবে। হঠাৎ সে এসে আমাদের জাগাল। বলল, চলুন, খাবার খেয়ে নিন। সে সময় আমাদের মনের যে কেমন অবস্থা হল তা কী বলব! ভাবলাম, লোকটা ভগবান? না কে? যাহোক, আমরা দুজনে তার বাড়িতে গেলাম। প্রথমে তো গরম জল দিয়ে সে আমাদের পা ধুল। শীতের পথের ক্লান্তি দূর হল। তারপর খাবার পরিবেশন করল। তার স্ত্রী জোয়ারের পাতলা পাতলা রুটি তৈরি করে যাচ্ছিল আর সে ব্রাহ্মণ গরম গরম রুটি দিয়ে যাচ্ছিল। একটু গুড়, একটু তরকারি এবং আরো এমন সব পদ ছিল যা ওই রুটির সাথে স্বাদে মিলছিল। খুব খেলাম আমরা, বড় বেশিই খেয়ে নিলাম। এত মিষ্টি মনে হল সে রুটিগুলো যে আজ অব্দি ভুলিনি। এক তো খিদে, আর দুই তার অসীম শ্রদ্ধা। তিন, ওদিকে জোয়ারই বেশি হয় আর ওরা জোয়ারের রুটি বানাতে জানে। এই তিন কারণেই দারুণ মিষ্টি ছিল রুটি। খাওয়ার পর আমরা মন খুলে সেই গরীব ব্রাহ্মণকে আশীর্বাদ দিলাম। জীবনে এমন ঘটনা ওই একটিবারই ঘটেছিল এবং আর কাউকে সেভাবে আশীর্বাদও আমরা আর দিইনি। হ্যাঁ, শুধু আরেকজনকে – তার কথা পরে আসবে। রাতে আমরা ধর্মশালায় ফিরে গিয়ে ঘুমোলাম। সকালে চুপচাপ রওনা হয়ে গেলাম।
(১০)
গুরুডমের মায়া
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আসলে সে সময়ের কোন নোটবই আমাদের কাছে না
থাকার কারণে গাফিলতিটা হল। উজ্জৈনে আসার আগে আমরা মধ্যভারতের একটি ছোট রাজত্ব রাজকোটে
পৌঁছেছিলাম। রাজকোট কয়েকটি আছে। তাই পাশেই অবস্থিত ব্যাওরা নামের জায়গাটার সাথে যোগ
করে রাজত্বটাকে রাজকোট-ব্যাওরা বলা হয়। ব্যাওরায় একটা বৈষ্ণব মঠে দেখলাম এক সাধুকে।
সে দিনের কখনো মাটিতে বসে না বা শোয় না – সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে। লোকেরা বলত যে বারো বছর
এমনই থাকার সঙ্কল্প করেছে। রাত্রে ঘুমোবার সময় একটা উঁচু চাতালে মাথা রেখে ঘাড় নুইয়ে
দিত এবং এবং চাতালটাকে হাত দিয়ে ধরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিত। তার হাঁটুর নিচে জায়গায়-জায়গায়
ক্ষত হয়ে গিয়েছিল যেখান থেকে জলের মত কিছু চুঁইত। ক্ষতের জায়গাটা ফোলা ছিল। সে নিজেই
ছুরি দিয়ে ওই জায়গাগুলো থেকে রক্ত বা জল বার করাত। ওই ক্ষতগুলোর মাধ্যমে প্রকৃতি তাকে
ডাকত – বসে পড়, ঘুমিয়ে পড়। কিন্তু তার জেদ ছিল – না, কিছুতেই না! শোনা যায় যে বারো
বছর অব্দি যারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তাদেরকে বৈরাগী সাধু (ঠড়েসরি) বলা হয় এবং কোনো মোহান্তের
মঠে অধিকারী হওয়ার অধিকারপ্রাপ্ত হয়। মুক্তি তো কাছে এসেই যায় এই তপস্যায়। কেমন মূর্খতা
এবং অন্ধভক্তি! ধর্মের নামে কিই না হতে পারে।
যখন আমরা রাজকোট পৌঁছোলাম, দৈবাৎ খাওয়ার সময় হওয়ায় রাজার দেওয়ানের
বাড়িতে পৌঁছোলাম। এক কায়স্থ মহাশয় রাজার দেওয়ান ছিলেন। উবিই আমাদের খাওয়াদাওয়া ইত্যাদির
ব্যবস্থা করলেন। তারপর ঈষৎ ধর্মচর্চা চলল। উনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, গীতা জানেন? আমাদের
জবাব ছিল, ওটাই তো আমাদের বিশেষ বস্তু। ব্যস, আর কী চাই, উনি আমাদের ভালোবেসে আটকে
দিলেন আর বললেন যে রাজদরবারে গীতার একটি শ্লোক নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। উর্দু, ফার্সি, ইংরেজিতে
অনেক টীকা আছে। কিন্তু ওগুলো পড়ে রাজাসাহেব সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। কাজ থেমে আছে।
আমি গিয়ে খবর দিচ্ছি। তারপর আপনাদের ডাকা হবে। এটুকু বলে উনি অলে গেলেন। পরে রাজদরবার
থেকে আমাদের ডাক এল। আমরা গেলাম। অত্যন্ত সম্মানের সাথে আমাদের বসানো হল। গীতার, “কর্মণ্যকর্ময়ঃ
পশ্যেদকর্মণি চ কর্ম ইয়ঃ। স বুদ্ধিমান মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃত্স্নকর্মকৃত” (৪/১৮)
শ্লোকটি নিয়েই ওখানে ঝামেলা ছিল। আমরা শিগগিরই সেটার সমাধান করে দিলাম এবং অনেকক্ষণ
ধরে ব্যাখ্যা করে সবাইকে সন্তুষ্ট করলাম। তার পর বিলক্ষণ সম্মান দেখান হল আমাদের। রাজাসাহেব
দেওয়ানজিকে বললেন, মহাত্মাদের এখানে অন্ততঃ কয়েকটি দিন অবশ্যই আরামে থাকার ব্যবস্থা
করুন।
সেখান থেকে দেওয়ানসাহেবের বাড়িতে এলাম। দেওয়ানসাহেবের বৃদ্ধা মা
জেদ ধরলেন, আমি এখনো গুরুমুখ হইনি, আমায় মন্ত্র দিয়ে দিন। বাড়ির অন্যান্য মানুষেরাও
চাইছিলেন। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছিল বাজারটা বাড়ছে। আমরা ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। কোথায় এসে
ফাঁসলাম? ভয় হল এবার তো রাজধানির অনেক মানুষের সাথে এবং রাজার সাথেও ফেঁসে গিয়ে এখানেই
থেকে যেতে হবে। ফলে, কথাটা চরিতার্থ হবে, “মিটল হরিনামের আশ, বাছতে বসল কাপাস”। দুই
চার দিন ‘আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি’ করে আমরা টালবাহানা করে কাটালাম। তারপর একদিন চুপচাপ
পালালাম। এভাবেই বাঁচলাম গুরু হওয়ার মহাজাল থেকে।
সেদিন ওখান থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে জালখেড়ী বা এমনই কোনো নামের
গ্রামে পৌঁছোলাম। সেখানে একজন বৈশ্য সজ্জন বেদান্তের সৎসঙ্গী ছিলেন। রাজকোটের সাথেও
ওনার সম্পর্ক ছিল। তাঁর কাছেই আমরা কয়েকদিন রয়ে গেলাম। সেখানেই শীতের আধিক্যে চা খাওয়ার
রেওয়াজের বিষয়ে জানলাম। আমাদেরও বলেকয়ে দু’একবার চা খাওয়ান হল। জীবনে দ্বিতীয় অবকাশ
ছিল এটা চা খাওয়ার। শেষে যখন পেচ্ছাপে লালচে ভাব আসতে লাগল তখন সবাই চিন্তিত হল। তবে
গিয়ে চায়ের হাত থেকে বাঁচলাম। লালচে ভাবটা গেল আর আমরাও চা মহারাণীর সঙ্গে অসহযোগ করে
নিলাম।
ওদিকে এটাও লক্ষ্য করলাম যে লোকে লাল লঙ্কা খুব বেশি খায়। একটা লোকের খাবারে কম-সে-কম এক ছটাক তো থাকেই। আমরাও একটু বেশিই লঙ্কা খেয়ে নিচ্ছিলাম। ফলে পায়খানার সময় মলদ্বারে এক ধরণের জ্বলুনি হত। সব খাবারে লঙ্কা থাকত। চেষ্টা করলেও এড়ান অসম্ভব হয়ে পড়ত।
(১১)
মথুরার দিকে
হ্যাঁ, তো সেই গরীব ব্রাহ্মণের বাড়িতে রাতে জোয়ারের রুটির সবচেয়ে মিঠে ভোজনপর্ব সেরে পরের দিন আমরা এগোলাম। কিছুটা দূর যাওয়ার পর কোনো রেলস্টেশনে এক ভদ্রলোক আমাদের ট্রেনে বসিয়ে দিলেন। ফলে আমরা মথুরায় এসে পড়লাম। ব্রজধামে ঘুরে বেড়িয়ে হাথরস হয়ে গঙ্গার তীরে পৌঁছে স্থির করলাম হরিদ্বার যাব। সেখান থেকে হৃষীকেশ হয়ে বদ্রীনারায়ণের দর্শন করব ভেবেছিলাম। হাথরসে আমরা প্রথমবার এমন গভীর কুঁয়ো দেখলাম যাতে জল ছিল ষাট হাতের বেশি গভীরে। আমাদের লম্বা দড়ি ফুরিয়ে গেল তবু আমাদের কমন্ডলু (জলপাত্র, জোড়া নারকেলে তৈরি হয়) জল অব্দি পৌঁছোল না। সঙ্গে থাকা কাপড় তার সাথে জুড়ে তবে জল বার করতে হল। এও এক অভিজ্ঞতা ছিল যে এত গভীর থেকে জল বেরোয়। বোম্বাইয়ের কাছে দ্বীপগুলোয় জলে এক ধরণের জিনিষ হয় পানিফলের মত। তফাৎ এটাই যে তার ফলগুলো খুব লম্বা হয় এবং দুটো করে জোড়া থাকে একসাথে। সেটাই জোড়া নারকেল। এত শক্ত হয় যে কাটা কঠিন। ভারিও হয়। জলে পচেও না। তার ভিতরের শাঁস দিয়ে ওষুধ তৈরি হয় এবং ওপরের খোলসটা দিয়ে কমন্ডলু ইত্যাদি তৈরি হয়। বলা হয় যে ওই শাঁস অথবা উপায় না থাকলে কমন্ডলুটাকেই ঘষে জল খাইয়ে দিলে কলেরার উপশম হয়। সন্ন্যাসিরা, এবং এখন তো অন্যান্য সাধুরাও এই কমন্ডলু ব্যবহার করে, এতে কাঠের হাতল ইত্যাদি লাগিয়ে নেয়। এমন ধারণা আছে যে শাস্ত্রে সন্ন্যাসিদের ধাতুর পাত্র রাখার অনুমতি নেই।
(১২)
আমার সঙ্গীর গল্প
আমার সঙ্গী শ্রী হরিনারায়ণজির বিষয়ে এখানেই কিছু বলে নিতে চাই। ওনার
বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ ছিল না, শুধু স্ত্রী, মেয়েরা এবং এক পিসি। পিসি বৃদ্ধা এবং
বিধবা ছিলেন তাই ওখানেই থাকতেন। হরিনারায়ণজি কখনো কখনো স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে দু’একটা
চিঠি লিখে পাঠাতেন; স্পষ্ট লিখতেন না যে উনি সন্ন্যাসি হয়ে গেছেন। এটা আমি পছন্দ করতাম
না। কিন্তু কী করতাম? উনি বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন। তবে আমি
কখনো ভাবিনি যে এর পরিণতিটা অনেক দূর গড়াবে। হল তাই। ১৯০৮ সালে বদ্রীনারায়ণের যাত্রাপথে
আমরা দুজন আলাদা হয়ে গেলাম। উনি সেখান থেকে ফিরে ঘুরতে ঘুরতে কাশি এলেন, বাড়ি পৌঁছোলেন
এবং গ্রাম থেকে দূরে একটা কুটির তৈরি করিয়ে থাকতে শুরু করলেন। তারপর গেরুয়া-টেরুয়া
ফেলে গেরস্তও হয়ে গেলেন। অজুহাত দিলেন যে জমি-জমার কোনো লেখা-পড়া না হলে স্ত্রীয়ের
কষ্ট হবে; অন্যান্য আত্মীয়েরা জমি হাতিয়ে নেবে। জমিজমার লেখা-পড়া করলেন। বোধহয় দু’একটি
সন্তানেরও উৎপত্তি ঘটালেন। তারপর আবার সন্ন্যাসি হলেন এবং আমার সাথে দেখা করলেন। এবার
আমার গুরুজির কাছেই দন্ডী হলেন। তত দিনে আমিও দন্ডী হয়ে গিয়েছিলাম। সে কথা যথাস্থানে
হবে।
কাশীতে আমি দর্শন প্রচুর পড়লাম। ব্যাকরণও পড়লাম। আবার দুজনে একসাথেই
ভ্রমণে বেরুলাম। সঙ্গে দর্শনের অনেক গ্রন্থ মোট বেঁধে নিয়ে নিলাম। কেননা এবার ওনার
এই গ্রন্থগুলো পড়ার ছিল এবং আমাকে পড়াবার ছিল। শেষে গুজরাটে সারা বছরের কয়েকটি মাস
পাটনে কাটিয়ে উনি আবার আমার থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। আমি আবার কাশীতে ফিরে এলাম এবং উনিও
কিছুদিন পর নিজের বাড়ি পৌঁছোলেন। ওখানেই থেকে সন্ন্যাসির বেশে ঘরের ব্যবস্থায় ব্যাপৃত
হলেন। আমি খবর পেয়ে গেলাম; উনি আমার সাথে দেখা করলেন। আমি বোঝালাম, এই ভন্ডামি কেন
করেন, গেরস্থ হয়ে থাকুন এবং এখানেই থাকুন, কোথাও যাবেন না। আমার কথাটা মানলেন। কিন্তু
কিছুদিন পর আবার সন্ন্যাসি হলেন। শেষে আবার বাড়ি ফিরে এলেন। তারপর থেকে নিয়মিত বাড়িতেই
রইলেন।
এদিকে যখনই দেখা হয়েছে আমি ওনাকে সাহস দিয়েছি। আমি জানতাম ওনার মধ্যে এই দুর্বলতা আছে। এর জন্য উনি খুব লজ্জিত থাকতেন। ভালোরকমের বিদ্বান এবং ধর্মকর্মের জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এই দশা হল। এর থেকে আমরা শিক্ষা পাই। প্রথমবার যে কীর্তিটা উনি করলেন, বাড়ি চলে গেলেন তাতে আমার আত্মীয়দেরও সাহস হল যে আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে বাড়িতে এনে বসিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তো এসবে পড়নেওয়ালা ছিলাম না। শেষে ওরা সবসময়ের জন্য ছেড়েই দিল চিন্তাটা। এটা ওদের শেষ চেষ্টা ছিল। তারপর কতবার আমার ওদিকে যাওয়ার অবকাশ হয়েছে। কিন্তু গ্রামের আর বাড়ির লোকেদের মন দেখেছি বদলে গেছে।
(১৩)
হরিদ্বার এবং হৃষিকেশ
হাথরস থেকে হেঁটে হেঁটে আমরা সোরোঁ পৌঁছোলাম একেবারে গঙ্গামায়ের
তীরে। যতটা মনে আছে, মহাশিবরাত্রির মেলা ছিল। মানুষে কি গঙ্গাস্নান করছিল? জীবনে প্রথমবার
আশ্চর্যচকিত হয়ে দেখলাম মানুষে এমনিই গঙ্গা পারাপার করছে, নৌকোর প্রয়োজন নেই। কেননা
জলই নেই। বুঝতেই পারলাম না রহস্যটা কী। পরে জানলাম গঙ্গা থেকে দু’দুটো খাল বার করা
হয়েছে বলে শীতে আর গ্রীষ্মে জল থাকেই না। হ্যাঁ, কানপুরের কাছে এই খালগুলোর বেঁচে থাকা
জল যখন আবার গঙ্গায় পড়ে তখন জল দেখা যায়।
অতঃপর, গঙ্গার তীর ধরে আমরা উত্তর দিকে চললাম। রাস্তায় সে জায়গাটা
দেখলাম যেখান থেকে খাল দুটো বেরিয়েছে। যখন আমরা অনুপশহরে পৌঁছোলাম দেখলাম অনেক সেঁকা
রুটির দোকান। ময়রার দোকানের মত লোকে সেখানে বসে লুচির বদলে ডাল, রুটি, শাক, তরকারি
খায়। আমাদের মাথায়ও তার আগে অব্দি কথাটা আসেনি যে ময়রার দোকান বাদে হিন্দুদেরও ডাল,
ভাত, রুটি ইত্যাদির হোটেল এবং ভোজনালয় হতে পারে। তাই যখন প্রথম দেখলাম ভীষণ অবাক হলাম।
দ্বিতীয়বার অবাক হলাম অনেক দিন পর যখন সনাতন ধর্মসভার পথে মুলতান
যেতে যেতে আম্বালা স্টেশনে “হিন্দু রোটি লো, মুসলমান রোটি” বলতে শুনলাম এবং সেঁকা রুটি
বিক্রি হতে দেখলাম। আসলে আমাদের ধারণা ছিল যে হোটেল শুধু মুসলমান আর ক্রিশ্চানদেরই
হতে পারে। কাশী, প্রয়াগ এসব জায়গায় আমরা দেখিওনি হিন্দুদের দোকান। পরে যখন হোটেল সবার
জন্য খুলে গেল তখনও মাথায় ছিল যে ছোঁয়াছুঁয়ির জন্য স্টেশনে, আর যেই হোক, হিন্দুরা রুটি
বেচতে পারে না। আমরা কী করে ভাবব যে সবাই একে অন্যের ছোঁয়া খেয়ে নেবে! মুসলমান ছুঁয়ে
নিলেও কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু তৈরি তো কোনো না কোনো জাতের হিন্দুর হাতে হতে হবে! আমরা
তো বুঝতামই না তখন যে এই হিন্দু রুটি, হিন্দু জল, মুসলমান রুটি, মুসলমান জলের ডাক ছোঁয়াছুঁয়ির
আর ধর্মের জন্য নয়, নিরেট মুর্খতা, যা শুধু হিন্দু-মুসলমানের লড়াই লাগাতে এবং বাড়াতে
কাজে আসে। আপসোস এটাই যে আজ যারা খাওয়াদাওয়া নিয়ে এই বাছবিচার মুছে ফেলেছে তারাও এই
ঝগড়ায় একটা না একটা পক্ষ নিয়েই নেয়। খোলাখুলি নিক বা লুকিয়ে। হাজারে মুষ্টিমেয় কয়জন
আছে যাদের হৃদয় নির্মল এবং যারা এই লড়াইগুলোকে চরম বোকামি মনে করে। তাদের সংখ্যা ধীরে
ধীরে বাড়ছে অবশ্যই। সেটাই আশার কথা যে এই বোকামির শেষ একদিন হবেই।
গ্রীষ্মের দিন আসতে আসতে আমাদের বিজনৌর ইত্যাদি শহরগুলো দেখা হয়ে গেল। গঙ্গার দুই তীরেই ঘুরতে ঘুরতে প্রথম হিমালয় দর্শন করলাম এবং হরিদ্বার পৌঁছোলাম। কনখল হয়ে হরিদ্বার গেলাম। কনখলে খাল এবং তার ওপর চলা জলচক্র দেখলাম, হরিদ্বারে হর-কী-পৌড়িতে গেলাম, স্নান করলাম, হিসেব নেই কোন কোন মঠে গেলাম এবং থাকলাম। কিন্তু ওই দুনিয়া আমাদের ভালো লাগল না। ওখানেই দেখলাম বর্তমান বিজ্ঞান, হিমালয়ের কোল থেকে বেরুতেই গঙ্গাজিকে কিভাবে বেঁধে নিয়েছে এবং তার প্রচন্ড গতিবেগের অহঙ্কার চূর্ণ করে দিয়েছে। কয়েকজন পরিচিত সাধুর সাথেও দেখা হল। কিন্তু তবুও আমাদের মন বসল না ওখানে। ফলে আমরা ওখান থেকে হেঁটেই হৃষীকেশ রওনা দিলাম। হৃষীকেশে পৌঁছে দেখি অন্য দুনিয়া। গঙ্গার ধারে একটা ছোট্ট গ্রামের মত বসত। সেখানেই কয়েকটি অন্নসত্র (ক্ষেত্র) ছিল যাতে সাধুদের, দুপুরের আগে একবার রুটি আর গাঢ় ডাল বা তরকারি দেওয়া হত। বাবা কমলিওয়ালে এবং অন্যদেরও ক্ষেত্র ছিল। পাহাড় থেকে বেরুতেই গঙ্গা ধনুকের আকৃতি নেয়। সেই ধনুকেরই মধ্যস্থলে পশ্চিমদিকে হৃষীকেশ ছিল সে সময়। তার উত্তরদিকে ঝোপঝাড়ের সুন্দর দীর্ঘ কেয়ারিতে যেখানে সেখানে ঘর-দোর হারা গেরুয়াধারী বাবারা পড়ে থাকত। সে সময় তারা ক্ষেত্র থেকে রুটি এনে খেত, কিন্তু এদিকে কী কী পরিবর্তন এসেছে তা আর আমরা দেখতে পাইনি।
(১৪)
আবার লেখাপড়া
আমরা দুজনে ওই ঝোপঝাড়ে না থেকে ওপরদিকে শ্রীযোগানন্দজির ছোট একটা
মঠে গিয়ে উঠলাম। অবশ্য ভিক্ষা তো ক্ষেত্র থেকে রুটি এনেই সারতাম। হ্যাঁ, রাত্রে ওই
মঠে ঈষৎ জলখাবার পাওয়া যেত। পাশে আরেকটু উঁচুতে কৈলাশ নামে খ্যাত শ্রী ধনরাজপুরীর বড়
মঠ ছিল। সেখানেই এক শান্ত এবং বিদ্বান সন্ন্যাসির কাছে আমরা ‘বেদান্ত সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী’
পড়তাম। এটিকে বেদান্তের একটি ক্লিষ্ট গ্রন্থ বলা হয়। আমরা এই গ্রন্থেই পাঠ শুরু করলাম।
যদিও তার আগের অন্যান্য পাঠ্য গ্রন্থ পড়িনি। অনেক জনের সঙ্গে চলত আমাদের পাঠ। বা বলা
যায় আমরাই অন্যদের পাঠে শামিল হয়ে গিয়েছিলাম। পাঠে যখন ন্যায়, মীমাংসা ইত্যাদির প্রসঙ্গ
আসত তখন কখনো কখনো আমরা তাঁকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতাম। অবশ্য, সাধারণতঃ একবার বললেই
বুঝে যেতাম। বুদ্ধিটা তো তীক্ষ্ণ ছিলই। কিন্তু কয়েক বার জিজ্ঞেস করায় উনি একদিন আমাদের
বিষয়ে জানতে চাইলেন। সব জেনে নিয়ে বললেন, এখনো আপনারা দুর্বল, কাশী গিয়ে ব্যাকরণ, ন্যায়
মীমাংসা ইত্যাদি পড়ুন। তখন বেদান্তের এই গ্রন্থ পড়ার আনন্দ পাবেন। সে সময় তো আমরা লজ্জিত
হলাম এবং তাঁর কথা ভালো লাগল না। কেননা তখনও যোগী পাওয়ার ভুত ছিল মাথায়। কিন্তু পরে
তাঁর উপদেশই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হল।
যাহোক, বেদান্ত মুক্তাবলীর পাঠ চলতে থাকল। একটা আনন্দ আমরা মাঝেমাঝেই
পেতাম। যখন ক্ষেত্র থেকে রুটি আনতাম তখন গঙ্গার ধারে চলে যেতাম। জল এমন কিছু বেশি ছিলনা।
কিন্তু পা রাখলে কোথায় গিয়ে পৌঁছব তার হদিশ পাব না; এমন তীব্র ছিল স্রোত। তবে উঁচু
উঁচু চিকন পাথর পড়ে থাকত সেই স্রোতে। সেই পাথরের ওপর লাফাতে লাফাতে একটু ভিতর অব্দি
যেতাম, একটা চিকন পাথর ধুয়ে তার ওপর রুটি-ফুটি রাখতাম এবং অন্যটার ওপর বসে খেতাম। যখন
ইচ্ছে হত অঞ্জলি ডুবিয়ে ঢোঁকে ঢোঁকে টাটকা জল খেয়ে নিতাম। জল এত ঠান্ডা থাকত যে জেঠ-বোশেখের
দুপুরেও খোলা রোদে বসলে গরম লাগত না এবং সারা শরীর তরতাজা থাকত। যতদিন ওখানে ছিলাম
এই আনন্দ নিয়মিত উপভোগ করতাম। অন্যান্য সাধুরাও করত। স্নান করার সময়েও দারুণ আনন্দ
হত।
কিন্তু হৃষিকেশের যে জগতটা দেখলাম এবং সাধুদের যেরকম দুর্নাম শুনলাম,
তাতে বিরক্তি এল। পাঞ্জাব এবং অন্যান্য প্রদেশ থেকে দলে দলে নারী-পুরুষেরা ওখানে আসত
এবং সাধুদের খুব করে হালুয়া, পুড়ি আর মেওয়া খাওয়াত, ওখানেই সৎসঙ্গও হত। এসবের ফল কি
অন্য কিছু হওয়ার ছিল? জানতে পারলাম যে খাওয়াদাওয়ার এত সুবিধে এবং সব ধরণের মজার যোগাড়
আছে দেখে অনেকে চাষবাস থেকে ছুটি পেয়েই গরমে গেরুয়া কাপড় পরে সাধুবেশে এসে ওই ঝোপঝাড়গুলো
আবাদ করে, বর্ষাকাল আসার আগে খেয়েদেয়ে তাগড়া হয়ে যায়, কিছু পয়সাকড়িও পেয়ে যায় ভক্ত
আর ভক্তিনদের কাছ থেকে। তারপর বাড়ি ফিরে যায়। জানিনা এখন কী অবস্থা।
কৈলাশ সম্পর্কে একটা কথা বলব। ওই মঠের অধিষ্ঠাতা শ্রী ধনরাজ গিরিজির বয়স যদিও বেশি ছিল, খুব শক্তিশালী ছিলেন উনি। শরীর দৃঢ় এবং ঠাসা ছিল। বলতেন যে বছরভর নিয়মিত উনি শ্রীফল (বেল) খান। বেল যখন পুরোপুরি শুকিয়ে ঝরে যেত, সেই বেল শুকিয়ে রাখতেন এবং গাছে যখন আর পাওয়া যেতনা তখন সেই শুকোনো বেল খেতেন। গাছে কাঁচা বেল তৈরি হলেই পুড়িয়ে খেতেন। অন্ন বাদে নিয়মিত বেল খেতেন, অন্যভাবে না পেলে মোরব্বাই খেতেন। তারই পরিণামে শরীর ঠাসা ছিল। বুড়ো হয়েও কখনো অসুস্থ হননি। শরীর ঢিলেঢালাও হয়নি কখনো। বলা হয়, নিয়মিত বেল সেবন করলে নাকি এমনই লাভ হয়। ঝোপঝাড়ের কেয়ারিগুলো পেরিয়ে ভরতজির মন্দির আর তারও পর লছমনঝুলা। ওখানেই গঙ্গার ওপর মোটা তারের দড়িতে ঝোলা কাঠের পুল বানান রয়েছে। কেননা তীব্র স্রোতে পায়া তৈরি করা এবং দাঁড় করান অসম্ভব। ঝুলতে থাকা পুল নড়ে তো বটেই – যখনই আপনি চড়েন। কিন্তু খুব মজবুত। মানুষ, টাট্টু আর ছাগল সবাই জিনিষ নিয়ে পার হতে থাকে। আসলে যখন তার-টার ছিল না, সেই পুরোনো জমানাতেও পাহাড়ি মানুষেরা গঙ্গার স্রোত পার করে এদিক ওদিক যেতই। তীর্থযাত্রীদেরও গঙ্গা ইত্যাদি নদীর স্রোত কয়েকবার পেরোতে হত। তখন একটা উপায় বার করা হয়েছিল। স্রোতের দুদিকে কাছাকাছি যে শক্ত গাছগুলো আছে তাতে দুটো সমান্তরাল শক্তিশালী দড়ি দেড়-দুই হাতের দূরত্বে বেঁধে দেওয়া হবে। তারপর তাতে মানুষের বসার মত একটা ছোট্টো দোলনা বানিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। দোলনার সাথে একটা লম্বা দড়ি থাকবে যেটা দুদিকে বাঁধা থাকবে। ব্যাস, একজন লোক যদি দোলনায় বসে সঙ্গের দড়িটা দুই হাতে জোরে জোরে টানতে থাকে তাহলে দোলনা ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে অন্য তীরে পৌঁছে যাবে। আবার ওদিক থেকে একই ভাবে এদিকেও এসে যাবে। এভাবেই সে সময় মানুষেরা নদীগুলোর ভয়াবহ স্রোত পার করত। দোলনা বা তার দড়িগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অবশ্যই থাকত। কিন্তু অন্য উপায় ছিল না। তাই লক্ষণঝুলা নাম পড়ল। এখন তো ঝুলে থাকা পুল তৈরি হয়ে গেছে। বদ্রীনারায়ণের যাত্রায় আমরা পাহাড়ি মানুষদের পুরোনো দোলনাগুলো কাজে আনতে দেখলাম। কেননা সবকটা স্রোতে তো আর ঝুলে থাকা পুল তৈরি হয়নি। এ ধরণের পুল তো শুধু কেদার-বদ্রীর রাস্তাতেই আছে। এই পুলগুলো সেই পুরোনো দলনার নকল। কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে অবশ্যই। আমরা ঝোপের এলাকা থেকে দূরের জঙ্গলে জঙ্গলে লক্ষণঝুলার ওপর অব্দি যোগী এবং সাধুদের খোঁজে চলে যেতাম, আবার ফিরে আসতাম। জংলী জড়ি-বুটিগুলোর বিষয়ে জেনে গেলে খাওয়াদাওয়া নিয়ে রোজকার চিন্তা থেকে মুক্ত হব সে ইচ্ছেও মাথায় থাকত। কিন্তু সেরকম বুটিও পেলাম না আর যোগীও পেলাম না। ভাবলাম, ঠিক আছে তাহলে বাবা বদ্রীনাথেরই দর্শন করে আসা যাক। ওদিকেই হয়ত যোগী পাব। কেননা উত্তরাখন্ডেই তারা বেশি থাকে একথা বারবার শুনেছিলাম। তাই বদ্রীনাথ যাওয়া স্থির করে ফেললাম। কিন্তু বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়ার (অক্ষয় তৃতীয়া) আগে তো বদ্রীনারায়ণজির পাট (দরজা) খোলে না। তার আগে পুজারিরা ওখানে যায়েই না। বরফের জন্য প্রায় ছ’মাস মন্দির বন্দ থাকে। বরফ সরার পর প্রথম প্রথম অক্ষয় তৃতীয়াতেই পুজারিরা ওখানে যায়। কখনো কখনো বরফ বেশি পড়লে আরো দেরি হয় যেতে। তাই যাত্রীরাও ওই সময়েরই আশেপাশে যাত্রা শুরু করে। আগে নয়। কেননা আগে যাওয়া শুধু অর্থহীনই নয়, অসম্ভবও বটে। কেননা রাস্তায় দোকান ইত্যাদি ঠিক মত থাকে না তাই খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হয়। ওখানে পৌঁছে কোথাও থাকাও সম্ভব হয় না। যতটা স্মরণে আছে হৃষীকেশ থেকে ১৮৯ মাইল বা সেরকমই দূরত্বে বদ্রীনাথের মন্দির। তাই আমরা সে হিসেবেই রওনা হওয়া ঠিক করলাম যাতে সময় মত ওখানে পৌঁছে যাই।
(১৫)
বদ্রীনাথের সফর
আমরা দুজনেই একসাথে রওনা হলাম। আগে তো রাস্তা খুব দুর্গম এবং বিপজ্জনক
ছিল। কিন্তু আমাদের সফরের সময় পাহাড় কেটেকুটে যতটা সম্ভব ভালো আর সমতল করে দেওয়া হয়েছিল।
এদিকে তিরিশ-বত্রিশ বছরে আরো উন্নতি হয়ে গিয়ে হবে। তবুও ধীরে ধীরে কোথাও চড়াই শুরু
হয় কোথাও উতরাই। এই চড়াই-উতরাই লাগাতার বজায় থাকে। কোথাও কোথাও তো ভীষণ সঙ্কীর্ণ হয়ে
যায় পথ। তার একদিকে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ উঠে আকাশ ছুঁয়েছে, অন্যদিকে অতল খাদ যেখানে কলকল
নিনাদ করতে করতে গঙ্গা বইছে। সে নিনাদ শোনা যায়না। হ্যাঁ, স্রোত দেখা যায়। রাস্তা কখনো
গঙ্গার ডানদিক ধরে যায় কখনো বাঁদিক ধরে। এপার ওপার যাওয়ার জন্য ঝোলা পুল রয়েছে যেখানে
সেখানে। আজকাল কী হয়েছে বলতে পারিনা। তীর্থযাত্রায় জুতো পরা বারণ বলে সে সময় লোকে ওখানকার
তৈরি ঘাস বা কাপড়ের জুতো পরে নিত। তবে আমরা তো সবসময় খালি পায়ে চলেছি, ওখানেও খালি
পায়েই ছিলাম। অবশ্য তার ফল খারাপ হল। ফিরে আসতে আসতে আমাদের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে গেল।
ফলে হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়ল।
এটাও দেখলাম যে পয়সাওয়ালাদের জন্য মানুষের সওয়ারি ওখানে তৈরি রয়েছে।
ওই মহান তীর্থযাত্রার মত পবিত্রতম শুভ যোগেও। ধর্মও কী কিম্ভুত জিনিষ! মানুষের বুকের
ওপর চড়ে চলা। তাও একজনের বুকে একজন চড়ে। বহনকারীরা বেশির ভাগ ব্রাহ্মণ অথবা ক্ষত্রিয়,
আর সওয়াররা ঘোর সনাতন হিন্দু। তুলনাহীন যথেচ্ছাচারের রাজত্ব। অন্য কোনো সওয়ারি পাওয়া
অসম্ভব। বড় ঘোড়া নয়, তবে শুধু জিনিষপত্র নিয়ে টাট্টু আর ছাগল যেতে পারে। টাট্টুর ওপর
মানুষ চড়লে সবসময় বিপদ থাকত পড়ার, কেননা রাস্তা বেঢপ।
মানুষের সওয়ারিও দুধরণের, কান্ডি আর ঝাম্পান। কান্ডি মাছ ধরার ফাঁদের
মত। এক তরফে একটু কাটা যাতে মানুষ ওতে বসে নিচে পা ঝোলাতে পারে। যেমন চেয়ারের কাজে
লাগানোর জন্য বাঁশ বা বেতের মোড়া তৈরি করা হয়, প্রায় তেমনই। ওতে মানুষকে বসিয়ে বহনকারী
নিজের পিঠে ওটা বেঁধে নেয়। সওয়ারের সুরক্ষার জন্য তার পায়ে-টায়েও কিছু বাঁধা থাকে।
যদি সওয়ারের পূর্বদিকে যাওয়ার তাহলে তার মুখ পশ্চিম দিকে আর বহনকারীর মুখ পূর্বদিকে
থাকবে। ঝাম্পানের চেহারা তো বিহারে ব্যবহার করা চারপাইয়ের মত হয়। কান্ডী নিয়ে যায় একজন।
তাই সস্তা পড়ে। ঝাম্পানে চারজন লাগে তাই বেশি ভাড়া পড়ে। অবশ্য আরাম হয় ওতে। আজকাল তো
উড়োজাহাজ যাওয়া শুরু করেছে।
রাস্তার ব্যবস্থা এমন যে একটু পরে পরে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা
ঝরনার কাছে চট্টি (বিশ্রামস্থান) থাকে যেখানে আটা ইত্যাদির দোকান এবং থাকবার সাধারণ
জায়গা থাকে। সফরের দিনগুলোতেই এই চট্টিগুলো আবাদ থাকে। তারপর আর কে তাদের পোছে? পানচাক্কিতে
পেষা সুন্দর আটা পাওয়া যায় ওখানে। চালও পাওয়া যায়। শুধু গুড়, ছোলা আর নুন মহার্ঘ্য।
কেননা, পাহাড়ে উৎপন্ন হয়না বলে নিচে থেকে নিয়ে আসতে হয়। বাকি সমস্ত জিনিষ সাধারণতঃ
নিচের (সমতলের) দামেই পাওয়া যায়। ঘি, দুধ পাওয়া যায় প্রচুর।
আগে তো চুরি হতই না। কারোর কোনো জিনিষ ছেড়ে গেলে, ফেরার সময়, অনেকদিন
পরে হলেও, যেখানে ছেড়ে গেছে সেখানেই পাওয়া যেত। পাহাড়িরা ছুঁতোও না। যদি যাত্রীদের
মধ্যে থেকেই কেউ চুপিচুপি উঠিয়ে নিয়ে থাকে তাহলে আলাদা কথা। এটাই ছিল আমাদের দেশের
পুরোনো সদাচার। জানিনা সভ্যতার পিশাচ এখন কী অবস্থা করেছে। দেখলাম যে ওখানকার ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়েরা দারিদ্র্যের কারণে, কান্ডি, ঝাম্পান বয়ে বা যাত্রীদের জিনিষপত্র সঙ্গে
করে নিয়ে গিয়ে যে মজুরি পায় সেই মজুরিতেই জীবন-যাপনে আত্মসম্মান মনে করে। রাস্তায় বা
চট্টিতে পড়ে থাকা অন্যের জিনিষ ছোঁয় না পর্য্যন্ত। এও দেখলাম যে প্রায় সবার পরনে শুধু
ল্যাঙট। পাছা উদোম, যদিও তথাকথিত উঁচু জাতের মানুষ সবাই। এমন অবস্থা যে যে কোনো কায়িক
শ্রম, তা সে যত ছোটোই হোক, করতে আপত্তি নেই। বরং করার জন্য উদগ্রীব, খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমাদের প্রাচীন সভ্যতা ও সদাচারের এই প্রসঙ্গগুলো আমাদের সবার শেখার।
কে জানে কোত্থেকে আমরা অদ্ভুত ধর্ম আর সদাচার শিখলাম যে কাজকেই ছোট আর বড় করে দিলাম।
এমনকি কিছু কাজ করতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতির জাতি, ধর্ম, গর্ব সব ধুলোয় মিশে যেতে
থাকে। হ্যাঁ, চুরি করতে তেমন দ্বিধা নেই। অন্যের ধনসম্পদ পেয়ে গেলে মহাপ্রসাদের মত
তক্ষুনি হজম! আমাদের ধর্ম, আমাদের সদাচার এবং আমাদের সম্মান এতেই যে আমরা যেন রোজগার
করে খাই এবং কোনো কাজকে ছোট বা নীচ না মনে করি। এ ব্যাপারে আমাদের গুরু উত্তরাখন্ডের
গরীব মানুষেরা।
এই সফরে খিদে ভীষণ পায়। এক তো পাহাড়ে চড়াই-উতরাইয়ের পরিশ্রম। দুই,
পরিষ্কার জলবায়ু। তিন, বরফগলা জল। তিনটেই খিদে পাওয়ার কারণ। তাই যারা খাওয়ায় কমতি করে
অথবা ঘি-দুধ বেশি করে না খায় তাদের ওপর ধীরে ধীরে বরফ-জলের প্রভাব পড়ে। যার ফলে সে
ধরণের লোকেরা ওখান থেকে ফেরার পর প্রায়শঃ পেটখারাপের অসুখে পড়ে।
কিন্তু অভিজ্ঞতা এটাও হল যে খাওয়াদাওয়ার কষ্ট সত্ত্বেও আমাদের ওপর
ওই জলের কোনো প্রভাব পড়ল না। পয়সা তো আমাদের কাছে ছিলই না এবং আমরা সফর শুরু করেছিলাম
অনেক আগে যখন যাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল না। যে কজন ছিল বেশির ভাগ নিজেদের নিয়েই চিন্তিত।
তাই চব্বিশ ঘন্টায় একবার খাবার পাওয়াও কখনো কখনো অসম্ভব হয়ে যেত। দু’বার পেতে তো আমরা
চাইতামই না। রাস্তায় ধনী এবং ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা আমাদের খাওয়ায় অবশ্যই। কিন্তু
ওরা দেরিতে সফর করে। জায়গায় জায়গায় অন্নসত্রও আছে ঠিক। কিন্তু সেগুলো সে সময় কুড়ি-পঁচিশ
মাইল দূরে দূরে ছিল। তাই নিরুপায় হয়ে আমাদের প্রতিদিন অতটাই দূর এবং কখনো কখনো আঠাশ-তিরিশ
মাইল অব্দি হাঁটতে হয়েছিল। ফেরার সময় একশো উনআশি মাইলের সফর আমরা এই জন্যই ছ-সাত দিনে
পুরো করে ফেলেছিলাম। বোধহয় এটাই কারণ যে জল-টলের কোনো প্রভাব আমাদের ওপর পড়েনি।
রাস্তায় আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। তারুণ্যের গর্বে উদ্ধত অনেক
যুবককে দেখলাম পিছিয়ে পড়ছে কিম্বা দমে যাচ্ছে! অথচ শিশু, বৃদ্ধা মহিলা কিম্বা বৃদ্ধ
পুরুষদের দেখলাম লাগাতার হেঁটে চলেছে। আসলে ধীরে ধীরে হাঁটলে পাহাড়ের চড়াই দমিয়েও দেয়
না আর ক্লান্তও কম করে। তাই স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকা শিশু বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা
দমত না। অথচ দ্রুত হাঁটার দর্প-ওয়ালারা দমে যেত। আমরা দ্রুত হাঁটছিলাম; কিন্তু সেটা
অপবাদ। আমাদের তো এটাও নিয়ম ছিল যে আমরা কমন্ডলুতে জল নিয়ে চলতাম। সেই জলে রাস্তায়
না জানি কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার তৃষ্ণা মেটালাম।
হ্যাঁ, তো আমাদের সফর শুরু হল। বেশ কয়েক দিন চলার পর রাস্তায় পড়া
দেবপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ ইত্যাদি তীর্থে দু’একদিন করে থেকে তারপর এগোলাম।
আমাদের চার প্রধান তীর্থে যাওয়ার ছিল – গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদার এবং বদরিনাথ। প্রথম
দুটোর দিকে যাওয়ার পথেই উত্তরকাশী পড়ে। মুসৌরি হয়েও যাওয়া যায়, তবে আমরা ওদিকে না গিয়ে
এদিক ধরলাম। ভেবেছিলাম কিছুটা এগিয়ে অন্য রাস্তা ধরে ওখানে যাব। কিন্তু পথে খাওয়াদাওয়ার
কষ্টে মনে হল গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীর পথ ধরা ঠিক নয়। কেননা এত আগে ওদিককার যাত্রী তো
রাস্তায় থাকবে না। রাস্তায় অন্ন বিনে মরতে হবে। তাই ওদুটো তীর্থে যাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ
করে শুধু কেদার এবং বদরি দর্শন রাখলাম পরিকল্পনায়। তাতেও আগে কেদার গিয়ে তারপর বদরি
যায় লোকে। ঠিক মনে নেই, বোধহয় দেবপ্রয়াগ থেকে কেদারের রাস্তা বদলায়। ওখানেই গঙ্গার
যে দুটো স্রোতের মিলন হয়, যাওয়ার সময় বাঁদিকে যে স্রোতটা পড়ে সেটা ধরে কেদার যাওয়া
হয়। ফেরার সময় এতটা দূর না ফিরে উখী মঠ থেকেই একটা বাঁকা রাস্তা এসে এগিয়ে বদরির রাস্তায়
মিশে যায়।
আমরা কেদার বাবার রাস্তা ধরলাম এবং যেমনতেমন করে কখনো খাবার খেয়ে কখনো ভুখা থেকে এগোতে থাকলাম। যেখানে চারবার খেলেও খিদে পেয়ে যায় সেখানে একবারও না খেয়ে চড়াই পার করা মামুলি ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রথমতঃ, সাহস ছিল, আর দ্বিতীয়তঃ নিরুপায়ও ছিলাম।
(১৬)
অগ্নিপরীক্ষা এবং সফলতা
ওই রাস্তায় আগে ত্রিযুগী নারায়ণের একটি বিকট চড়াই আসে। অবশ্য সে
চড়াই থেকেও বিকটতর ও বিকটতম চড়াই আসে আরো এগিয়ে। বিশেষত্ব ছিল যে ত্রিযুগী নারায়ণের
চড়াইয়ে সারাদিন খাবার পেলাম না। এমনিই চলতে থাকলাম। তার ওপর আমার সঙ্গী রাস্তায় পেচ্ছাপ
করার অছিলায় পিছনে থেমে গেলেন। অনেক ক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এলেন না। পরে জানতে পারলাম
উনি জেনেশুনে সঙ্গ ছাড়তে চাইছিলেন। আগে থেকেই ওনার কথাবার্তা সে ধরণেরই হচ্ছিল। কী
আর করার ছিল? একলাই এগোলাম। যদিও, কষ্টের সময় একাকীত্ব আরো খারাপ লাগে। লোকে রাতে ত্রিযুগী
নারায়ণে থেকে যায়। কিন্তু যখন খাবার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখলাম না তখন এগিয়ে যাওয়াই
স্থির করলাম। ভয় ধাওয়া করছিল, এমন না হয় যে দেরি হলে দুর্বল হয়ে পড়ি আর পথেই থেকে যাই।
সেদিন অনেক হাঁটলাম। গৌরিকুন্ডে পৌঁছে থামলাম সন্ধ্যার মুখে। সেখান থেকে ভীমগোড়া অব্দি
ছয়-সাত মাইলের চড়াই বড়ই বিচ্ছিরি। ভীমগোড়ার পরের চড়াই তো আর জানতে চাইবেন না। সিঁড়ি
তৈরি করা রয়েছে। তা বেয়েই চড়তে হয়। কিন্তু বোধহয় দু’তিন মাইলের পরই কয়েক মাইল সমতল
জমি পড়ে যা বরফে ঢাকা থাকে। সেই বরফের ওপর দিয়েই হাঁটতে হয়। তারপরেই কেদারজির মন্দির।
সেই আশাতেই সাহস করে, বার বার জল খেয়ে কোনোরকমে গৌরিকুন্ডে পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালেই রওনা হয়ে গেলাম এবং খুব কষ্ট করে ভীমগোড়া পৌঁছোতে
পারলাম। রাতে যাত্রীরা এখানেই থেকে যায়। এখান থেকে কেদার কাছে। কেদারে তো, বরফ জমে
থাকার কারণে রাতে থাকার জায়গাও নেই আর সাহসও হয় না। বরফে কে মরবে? লোকেরা ভীমগোড়া ছেড়ে
এগিয়ে গিয়েছিল এবং এগিয়ে চলেছিল। সেটা দেখে আমিও সাহস করলাম। কিন্তু অবস্থা খারাপ ছিল।
দু’চার সিঁড়ি চড়ছিলাম কোনোভাবে আর মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। আবার চড়ছিলাম, আবার পড়ছিলাম।
এভাবে চড়তে চড়তে পড়তে পড়তে রামের নাম নিয়ে সে চড়াই পার করলাম এবং লম্বা বরফের মাঠে
পৌঁছোলাম। এবার সাহস ফিরে এল। বেশি সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ার পর কম কষ্টগুলো পেরিয়ে যাওয়ার
সাহস বেড়েই যায়। এটাও ভাবলাম যে এখন তো কেদারজি কাছেই। বরফে পা দিতেই পা কনকনিয়ে উঠছিল
এবং ভীষণ ব্যথা করছিল। তার সাথে, ঠান্ডার চোটে শরীরের শক্তিও কমে আসছিল। ঠান্ডায় এমনই
হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে পা অবশের মত হয়ে গেল এবং কনকন করা বন্ধ হয়ে গেল।
অবশেষে মন্দিরের কাছে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম পাশে বরফ গলে গলে একটি
নদী বইছে এবং লোকে তাতে স্নান করছে। এ সেই গঙ্গারই প্রবাহ যার তীর ধরে এসেছিলাম। এখান
থেকেই শুরু হয়। চার দিকে সাদা বরফে ভরা পাহাড়। কোনো গাছপালাও নেই, কোনো গাঁ-ঘরও নেই।
ইতিমধ্যে এক গৃহস্থ এসে আমায় বলল, “মহারাজ, ভোজন করুন”! শব্দ ছিল না অমৃত? আমি হৃদয় থেকে তার প্রতি অনুগৃহীত হলাম। বললাম, স্নান, দর্শনের পরে খাব। সে অপেক্ষা করতে থাকল। আমি তাড়াতাড়ি স্নান করতে গেলাম। জলে হাত দিতেই হাত অবশ! কমন্ডলু ওঠানোই অসম্ভব! তবুও যেমনতেমন করে স্নান করলাম এবং জল নিয়ে মন্দিরে গেলাম। ভিতরে বরফের উঁচু উঁচু শিলা গলে পড়ছিল। বাবা কেদারনাথের দর্শন করলাম, জল ঢাললাম তারপর ফিরে এলাম। দেখলাম এক লুচি ভাজতে থাকা ময়রার কাছে আমার অন্নদাতা দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে লোকে টাটকা টাটকা লুচি নিয়ে খেয়ে চলেছে। ভুর্জপত্র গাছের কাঁচা সবুজ কাঠগুলো জ্বলছে এবং কড়াইয়ের ঘিয়ে লুচি ভাজা হচ্ছে। যদি এই কাঠ না জ্বালানো হয় লোকে খিদেয় মরেই যাবে। শুকনো কাঠ পাবে কোথায়? সে কাঁচা কাঠও তো নিচের থেকে আনতে হয়। আমিও ওখানে পৌঁছে গেলাম; পেট ভরে লুচি খেলাম। মনে হয় এক সেরের কম (ভাজার পর) খাইনি। শুধু লুচিই পাওয়া যেত। শাকসব্জি কোথায় পাবে? সেটুকুও পাওয়া তো ভাগ্যের কথা।
(১৭)
কেদার থেকে ফেরত – বদরির পথে
তারপর শিগগিরই ওখান থেকে রওনা হয়ে গেলাম। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি
যে আমি যেমন মধ্যভারতের সেই গরীব ব্রাহ্মণকে প্রাণভরে আশীর্বাদ দিয়েছিলাম, দ্বিতীয়জন,
কেদারনাথের এই অন্নদাতাকেও প্রাণভরে আশীর্বাদ দিলাম। এই দুটো ঘটনা সবসময় মনে টাটকা
জেগে থাকে। যাহোক, সন্ধ্যা হতে হতে গৌরিকুন্ডে পৌঁছে রাত্রে থেকে গেলাম। পরের দিন আবার
সফর শুরু হল। ফিরবার সময় ত্রিযুগীনারায়ণের রাস্তা ছেড়ে নিচের রাস্তা ধরে এলাম। ফেরার
সময় মিছিমিছি হয়রানি পোহাতে ওদিকে কেউ যায়ই না। উখী মঠের পর বাঁকা রাস্তা ধরে বদরি
বাবার দিকে হাঁটা দিলাম। পথে তুঙ্গনাথের বিপজ্জনক চড়াই পড়ল। তারপর এগোতে থাকলাম। কেদার
থেকে ফেরার সময় তো আমার সঙ্গীর সাথে দেখা হয়নি। হ্যাঁ, যখন বদরিনাথের দর্শনের পর ফিরছিলাম
তখন চলতে চলতে দেখা হল। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে বদরিনাথের পাশে জ্যোতির্মঠ বা যোশিমঠ এল।
বলা হয় যে ধর্মপ্রচারের লক্ষ্যে শঙ্করাচার্য ভারতের চার কোনায় চারটে
মঠ স্থাপন করেছিলেন। সেই মঠ-চতুষ্টয় থেকে তাঁর অনুগামীরা ভারতকে চার ভাগে বিভক্ত করে
ধর্মপ্রচার চালাত। সেগুলোর নাম – শৃঙ্গেরিমঠ (দক্ষিণ), শারদামঠ (পশ্চিম-কাঠিয়াওয়াড়),
গোবর্ধনমঠ (পূর্ব জগন্নাথ) এবং জ্যোতির্মঠ (উত্তর)। রামেশ্বর, দ্বারকা, জগন্নাথ এবং
বদরিনারায়ণ এই চারটে তীর্থ ওই মঠগুলোর পাশে অবস্থিত। কিন্তু এখন তো জ্যোতির্মঠের ওপর
রাওয়লজির দখলদারি, যিনি নাকি গৃহস্থ। গোবর্ধনমঠও সমস্যায় ভুগছিল, এখন সামলেছে। জ্যোতির্মঠ
ছাড়া বাকি তিনটেই দন্ডী সন্ন্যাসিদের নিয়ন্ত্রণে। যদিও ধর্মপ্রচারের ব্যাপারটা এখন
ব্যাস নাম কে ওয়াস্তে।
আমি সকালেই বদরিনাথ পৌঁছে গেলাম। যদ্দূর মনে আছে সেদিনই মন্দির খুলেছিল
প্রথম প্রথম। ওখানেও চার দিকে প্রান্তর। সে প্রান্তরে এক ধরণের ঘাস হয় যেটা বরফে শুকিয়ে
গিয়েছিল। ওই ঘাস উপড়ে জ্বালান হত। চার দিকে বরফে ঢাকা পাহাড়। গাছপালার বালাই নেই। অনেক
ধর্মশালা। ওগুলোরই একটার ওপরতলায় আমি থাকতাম। স্নান, দর্শন সারলাম। গঙ্গার ধারা তো
ওখানেও বইছে। মন্দিরের সামনে নিচে গরম জলের একটা ঝরনাও আছে যেটা কুন্ডে পড়তে থাকে।
জল বেশি হলে বয়ে গঙ্গায় চলে যায়। কুন্ডটা পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং ততটুকুই গভীর
যাতে কেউ ডুবে না যায়। আগে তো কুন্ডের জলটা খুব গরম লাগে। ফলে ভিতরে যাওয়ার সাহস হয়
না। কিন্তু একবার নেমে পড়লে, পরে আরাম লাগে। আমি তো কয়েক ঘন্টা ওতে পড়ে থাকতাম। শুধু
একটা উলের চাদর ছিল আমার কাছে। শীত বেশি ছিল ওখানে। তাই বহুক্ষণ ওই কুন্ডে নেমে কাটাতাম
আর রাতে, একটু আগে বলা ওই শুকনো ঘাস জ্বালিয়ে কাজ চালাতাম। মনে হয় তিন-চার দিন ছিলাম।
তারপর রওনা হয়ে পড়লাম।
ভক্তদের বিশ্বাস আছে যে ঝরনার জলটা ভগবানের পায়ের নিচে হয়ে আসে। তাই তাঁর কৃপাতেই গরম থাকে জলটা, যাতে গরীবেরা ঠান্ডা থেকে রেহাই পেতে পারে। কিন্তু গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রীতে তো বলা হয় ভীষণ গরম – ফুটতে থাকা জলস্রোত। ওখানে কোন ভগবানের চরণ থেকে আএ? আসলে প্রকৃতির বিন্যাসই এমন। ওখানে নিচে গন্ধকের খনি হবে নিশ্চয়ই। সেই খনি হয়ে আসে বলেই জলটা গরম হয়ে যায়। জলে গন্ধও সেরকম থাকে। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে বুদ্ধি আর যুক্তির স্থান কোথায়?
(১৮)
ফেরৎ হৃষীকেশ
আগেই বলেছি যখন ফিরলাম তখন খুব জোর কদমে হাঁটলাম। খাওয়া-দাওয়ার জন্য এবার কোন ভক্ত পাওয়ার তোয়াক্কা করলাম না। শুধু সদাব্রত বা অন্নসত্রেই খাওয়া সারতাম। সত্রগুলো দূরে দূরে ছিল। সেই হিসেবেই আমায় পা চালাতে হত। জুতো না পরার আর বেশি হাঁটার ফল হল যে দুটো পায়েরই তলার চামড়া উঠে রক্তাক্ত হয়ে গেল। কিন্তু কিছু করার ছিল না। কোনো ভাবে সফরটা পুরো করার ছিল। যেমন আগে বলেছি, ছ’সাত দিনে প্রায় দুশো মাইল চললাম। যারা ফেরে তারা আলমোড়া, কাশিপুরের রাস্তা দিয়ে ফেরে। কিন্তু আমার তো আবার হৃষীকেশ যাওয়ার ছিল। তাই সে রাস্তা দিয়ে গেলাম না। অবশেষে এসেই পড়লাম হৃষীকেশ। কিন্তু বরফের অঞ্চল থেকে আসছিলাম বলে হৃষীকেশে লু বইছে মনে হল। যদ্দুর মনে আছে, জৈষ্ঠ মাস শুরুই হয়েছিল মাত্র। কেননা অক্ষয় তৃতীয়ার কয়েক দিন পরে রওনা হয়েছিলাম আর আর রাস্তায় এক সপ্তাহ পেরিয়েছিল। এভাবে ১৯০৮ সালের জুনে ফিরে এলাম। প্রায় এই সময়েই (আষাঢ়ে) গত বছর আমরা কাশী থেকে রওনা হয়েছিলাম। এক বছরে হেঁটে হেঁটেই জানিনা কতটা দূরত্ব পার করলাম এবং কত অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। শুধু তাই নয়। যোগীর সাথে দেখা করার এবং যোগাভ্যাস করার মনস্কামনাটা ব্যর্থও হল। ওই ব্যাপারটা বলতে গেলে নিরাশই করল। বা বলতে পারি যে সন্ন্যাসি জীবনের প্রায় এক বছর শেষ হতে না হতে তার পূর্ব খন্ড শেষ হতে চলল এবং কিছু দিনের মধ্যেই মধ্য খন্ড শুরু হল।
(১৯)
আবার কাশী ফিরলাম
জানি না কেন বদরিনারায়ণ থেকে ফিরে হৃষীকেশে বেশি দিন থাকার ইচ্ছে
হল না। তাড়াতাড়িই কাশী যাওয়া স্থির করলাম। কিন্তু পা সঙ্গ দিল না। বদরিনাথের সফর থেকে
তো কোনোভাবে পায়ে ন্যাকড়া জড়িয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু এবার কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তা
হল। শেষে ঠিক করলাম যেভাবে হোক হরিদ্বারে পৌঁছে ট্রেনে করেই কাশী ফিরব, যা হয়ে যাক।
এটা দ্বিতীয়বার বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ার ইচ্ছে ছিল। আসলে লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনো
কাজ করা আমার স্বভাবের বিপরীত। ওভাবে কিছু করতে আত্মা কেঁপে ওঠে। নিজেকে ভীষণ দুর্বল
মনে হয়। যা কিছু করার, পরিষ্কারভাবে হেঁকে সাহসীদের মত করাই আমার পছন্দ। মিথ্যাচার ও
প্রতারণা থেকে দশ হাত দূরে থাকি। জানি যে দুনিয়ায় ওসবেরও দরকার পড়ে। মহৎ, মহত্বর কাজও
পন্ড হয়ে যেতে পারে যদি প্রয়োজনে মিথ্যাচার বা প্রতারণা না করা হয়। কিন্তু কী করব?
এখানে তো আমার বিবশতা ছিল। তাই ঠিক করলাম, যেখানে সুযোগ পাব ট্রেনে চড়ে বসব। চড়ে লুকিয়েও
থাকব না। চোখ এড়িয়ে পালাব না। কর্তাব্যক্তিরা ধরে যদি কোনো শাস্তি দেয় তাহলে সে শাস্তি
সইব। ওদেরকে পরিষ্কার বলব যে পায়ের এই অবস্থায় করতে বাধ্য হয়েছি, বা করা স্থির করেছি।
এই ভাবনা নিয়েই হরিদ্বারের পথে রওনা হলাম।
কিন্তু সেখানে তো বিনা টিকিটে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছোনোও অসম্ভব ছিল।
তাই আরো এগিয়ে জ্বালাপুরে ট্রেনে চাপলাম। আবার লক্সরেই নামতে হল। লক্সরে ট্রেন অদল
করার ছিল। কর্তাব্যক্তিরা মানা করল যে এর পর আর ট্রেনে চড়বেন না। আমি তো শোনার পাত্র
ছিলাম না। ফলে কাশী যাওয়ার ট্রেনে চড়ে বসলাম আর সোজা মুরাদাবাদ পর্য্যন্ত চলে এলাম।
মুরাদাবাদে টিকিট-পরীক্ষক আমায় নামিয়ে স্টেশনের আধিকারিকদের সোপর্দ করল। সকালের ন’টা
বা দশটা বাজছিল। আমি স্টেশনের আধিকারিকদের বললাম, আটক যখন করেছেন, খেতে তো দিন! সে
বেচারারা বলল, যান মহারাজ! ব্যস, আবার কী! শহরে গেলাম, খেয়ে দেয়ে নদীর বালি পার করলাম
পায়ে হেঁটে তারপর পরের স্টেশনে ট্রেন ধরলাম। সেখান থেকে এমন হল যে নির্বাধ আমি পরের
দিন বেনারসে এসে পৌঁছোলাম। প্ল্যাটফর্মে নেমে সোজা পূর্বদিকে এগোলাম। কেউ আটকাল না।
ফলে আমি সোজা এগোতে থাকলাম আর স্টেশনের বাইরে চলে এলাম। মনে নেই অপারনাথ মঠে গেলান
না অন্য কোথাও। বোধহয় ওখানেই গিয়ে উঠলাম।
এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে যোগীর দেখা আর পাব না। কিন্তু শাস্ত্র-অধ্যয়নে
মাথা গোঁজার ইচ্ছে করছিল না। তাই খুব শিগগিরই গঙ্গার তীর ধরে এগিয়ে গেলাম। ভরা বর্ষার
সময় ছিল। তবুও আনন্দ পেলাম। গাজিপুর হয়ে বক্সারের কাছে কোটোয়া নারায়ণপুরে এসে গেলাম।
আবার ওখান থেকেও এগিয়ে উজিয়ার হয়ে ভরৌলি পৌঁছোলাম। ওখানে এক সন্ন্যাসি বাবার মঠ ছিল।
সেই মঠেই উঠলাম।
গ্রামের পূবদিকে অনেকটা দূর গিয়ে গঙ্গার উত্তর তীরে নির্জনে একটি
বটগাছ ছিল। সকালে ওখানেই গিয়ে থাকতাম, স্নান-টান করে ভিক্ষার সময় গ্রামে ফিরে আসতাম
এবং মঠে খাবার খেতাম। যখন এ জায়গা ছেড়ে এগোতে গেলাম তখন মোহান্ত শ্রী শিবপ্রসাদ গিরি
আটকে দিলেন। বললেন, চাতুর্মাস্যে (বছরে) কোথায় যাবেন? এখানেই থাকুন। কথাটা মনে ধরল
আমারও, তাই থেকে গেলাম। মোহান্তজি আমায় ‘পরমহংসজি’ বলে ডাকতেন এবং খুব ভালোবাসতেন আমায়।
গ্রামের কৃষকদের সাথেও আমার এমন ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে গেল যে এক রকম ভাবে ফেঁসে গেলাম।
ব্যস, দিনের অধিকাংশ সময় দূরের নির্জন বটগাছটার তলায় কাটাতাম আর রাতে মঠে থাকতাম। এভাবেই
চাতুর্মাস্য কাটালাম। ভরৌলির মানুষেরা খুব সুন্দর রামায়ণগান করতেন। দু’একজন ভালো ভজনগায়কও
ছিলেন ওঁদের মধ্যে। তাই আরো জমত রামায়ণগান। শঙ্করগড়ের পর ওখানেই এত মধুর গানের সংস্পর্শ
পেলাম।
মোহান্ত শ্রী শিবপ্রসাদ গিরির এক চ্যালা ছিলেন যিনি কাশী থেকে বেদান্ত
পড়ে এসেছিলেন। বুদ্ধিমান ছিলেন। তাঁর এক চ্যালা ছিল রামচন্দ্র গিরি। বাচ্চা ছেলে। একটু
আধটু পড়ত টড়ত। মোহান্তজি ভালো পয়সাওয়ালা ছিলেন। উনি বার বার বলতেন, আমি মানুষদেরকে
অনেক ধার দিয়েছি এবং ছত্রিশ হাজার টাকা শুধু সুদের নামে উশুল করেছি। গ্রামের সব গেরস্ত পরিবার ওনার শিষ্য (চ্যালা) ছিল এবং ঋণীও ছিল। সবার খেত ওনার কাছে বন্ধক ছিল। কিন্তু
চাষ করত ওরাই। মোহান্তজি টাকার সুদ নিতেন। এত টাকা কর্জে দিয়েছিলেন। কিন্তু উশুল করার
বা ফেরত পাওয়ার কোনো চোস্ত ব্যবস্থা ছিল না যে তাগাদা চলতে থাকবে। ফলে গেরস্তরা বেখেয়াল
হয়ে পড়ত, ঋণের টাকা ফেরত দিত না। সুদ চড়তে চড়তে এমন হত যে অবশিষ্ট খেতটুকুও মোহান্তের
কব্জায় চলে যেত। মোহান্ত লাভে ছিল। গেরস্তরা ফতুর। আমার বড় ক্ষোভ হল দেখে। খাওয়াদাওয়া
তো মঠেই করতাম। তবুও সুযোগ করে গেরস্তদের সাবধান করতাম – সামলে যান এবং ওনার সংসর্গ ছাড়ুন
বা কম করুন। নইলে নুনের পাত্রের মত গলে যাবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সন্ন্যাসির
জামাকাপড় পরে ঢনসম্পদ জমা করা পাপ। এবং সে পাপের ধন যার কাছে যাবে তাকে গলিয়ে দেবে।
তাই ওদের বোঝাতাম। চ্যালা হতেও মানা করতাম। কিন্তু শুনবে কে?
সময়টা তো ঠিক মনে নেই। কিন্তু এক বছর কাটার পর আমার মন বদলাল এবং এগিয়ে কোথাও যাওয়ার বদলে কাশী ফিরে গিয়ে দর্শন, ব্যাকরণ এবং বেদ ইত্যাদি পড়ার ইচ্ছে জাগল। ভাবলাম, জঙ্গল, পাহাড় তো অনেক ঘোরা হল। যোগী তপস্বীরও তাল্লাশ করা হল। ঘোরাঘুরিও অনেক করলাম। কিন্তু পেলাম না কিছুই। ভগবান এখনো দূরে দূরেই রইলেন। তাই যাই, শাস্ত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি ওতে কী আছে। হৃষিকেশের (কৈলাশ) বৃদ্ধ মহাত্মার কথাও মনে এল। মোহান্তজী এবং তাঁর চ্যালাও বলল, পড়ুন। তখন ইচ্ছেটা দৃঢ় হল। ওদিকে মোহান্তজির চ্যালার যে চ্যালা ছিল শ্রী রামচন্দ্র গিরি, তাকেও ওরা কাশী পাঠিয়ে লেখাপড়া করাতে চাইছিল। তাই স্থির হল যে আমরা দুজনেই একসাথে যাব। সে তো ধনী মোহান্তের চ্যালা। তাই সে মাসিক খরচের জন্য পয়সা পাবে স্থির হল। কিন্তু আমার তো পয়সার পরোয়াও ছিল না আর পয়সা নিয়মিত কেউ দিতই বা কেন? কাশীতে তো বিবাগী সাধুদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ছিলই। আর কী চাই? আমরা দুজনেই কাশী চলে এলাম। সেটা, যদ্দুর মনে আছে, ১৯০৯ সালের শুরুর সময় ছিল। রামচন্দ্র গিরি কর্ণঘন্টা মঠে উঠল আর আমি সেই অপারনাথ মঠে। এভাবে সন্ন্যাসকালের প্রথম খন্ড শেষ করে দ্বিতীয় খন্ডে প্রবেশ করলাম।
মধ্য ভাগ – মধ্য খন্ড
(১)
শাস্ত্রের অধ্যয়ন
অপারনাথ মঠেই সংস্কৃতের পাঠশালা ছিল। সেখানে ব্যাকরণ, ন্যায়, বেদান্ত
ইত্যাদি সমস্ত বিষয় পড়ান হত। ভাবলাম ভালো ভাবে ব্যাকরণ না পড়লে দর্শন পড়তে ভালো লাগবে
না। তাই ব্যাকরণই পড়ব স্থির করলাম। তাতেও, লঘুসিদ্ধান্তকৌমুদি তো কিছুটা পড়েই রেখেছিলাম।
সংস্কৃতটাও ভালোই বুঝতাম। তাই সিদ্ধান্তকৌমুদি শুরু করলাম। সে সময় কৌমুদি পড়ানোয় কাশীতে
শ্রেষ্ঠ ছিলেন শ্রী হরিনারায়ণ ত্রিপাঠী বা তিওয়ারিজি। ভাগ্যবশতঃ অপারনাথে উনিই পড়াতেন।
সোনায় সোহাগা হল – খুব মনোযোগ সহকারে কৌমুদি পড়া শুরু করলাম। কূটপ্রশ্নগুলো এবং কঠিন
জায়গাগুলো বুঝলাম। মঠে কয়েকটি পাঠ হত কৌমুদির। আমি সবকটা শুনতাম এবং তিওয়ারিজি যা কিছু
বলতেন, এক এক করে সব লিখে নিতাম বাড়িতে গিয়ে। এভাবে একটা লম্বা আর মোটা নোটবই তৈরি
হয়ে গেল। সেটা ছাত্রদের জন্য খুব কাজের ছিল। পরে একজন ছাত্রই নিজের বিদ্যাচর্চার কাজে
ওটা নিল আর আমি ওর কাছ থেকে ফেরত নিতে ভুলে গেলাম। ফলে নোটবইটা আর রইল না। নইলে ওটা
সিদ্ধান্তকৌমুদির খুব ভালো টীকা হতে পারত এবং ছাপিয়ে দেওয়া যেত।
১৯১১র মাঝামাঝি সময় আসতে আসতে আমি সিদ্ধান্তকৌমুদি পড়ে ফেললাম। লোকে
বলে কৌমুদি পড়তে বারো বছর সময় চাই। ছয় বছর তো সাধারণতঃ পড়িয়েরা লাগিয়েই থাকে। তবে পড়ে
নেওয়া তেমন কঠিন নয়। তবে কাশীতে পুঁথিটা পড়ার যে রীতি এবং বিশেষ করে তিওয়ারিজি যেভাবে
ওটা পড়াতেন তাতে বেশি সময় লাগা স্বাভাবিক ছিল। পুঁথিটাও তো খুব বড়। কিন্তু প্রতিদিন
কয়েকটি করে পাঠ পড়ার ফলে আমি প্রায় আড়াই বছরে পুরোটা পড়ে ফেললাম। তিওয়ারিজি নিঃসন্দেহে
গ্রন্থটার প্রত্যেকটি কথার কয়েক স্তর গভীরে গিয়ে খোলসা করতেন। ফলে শ’য়ে শ’য়ে ছাত্র
শুধু কৌমুদিরই পাঠ শুনতে ওনার কাছে জমা হত।
কিন্তু এমন ছিল না যে আমি শুধু কৌমুদির পাঠেই সন্তুষ্ট হব। কিছুদিন পরেই আমি ন্যায়ের পাঠও শুরু করে দিয়েছিলাম। দুটোই একসাথে চলছিল। পরে গিয়ে যখন সিদ্ধান্তকৌমুদির পর শব্দেন্দু শেখর, পরিভাষেন্দু শেখর ইত্যাদির পাঠ চলতে লাগল, আবার ভূষণ, মঞ্জুষা এবং মহাভাষ্যেরও সময় চলে এল, তখনি অন্যদিকে সাংখ্য, মীমাংসা, বেদান্ত, যোগ ইত্যাদি দর্শনের পাঠও আমি শুরু করে দিলাম। সেটুকুই নয়। দিনের বেলা সময় বাঁচলে সঙ্গী পড়ুয়া এবং অন্যান্যদের কৌমুদি ইত্যাদি পড়াতামও। দেখলাম, আমার আগে কয়েক বছর থেকে যারা সিদ্ধান্তকৌমুদি পড়ছে, তারাই আমার কাছে আসছে সেই একই গ্রন্থ পড়তে। আমি স্থির করে নিলাম যে পাঁচ-সাত বছরের ভিতর দর্শনের মন্থনটা আমার পুরো করে নেওয়া উচিৎ। তাই দিনরাত লেগে থাকতাম। দিনের বেলায় নিজের পড়াটা ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো আমার হত না। কেননা কয়েকটি পাঠ পড়তে এবং অন্যদের পড়াতেই সারা দিন বেরিয়ে যেত। তাই রাতে পড়াগুলো অভ্যাস করতাম। সে সময় ঘুম না আসে, তাই সময় বাঁচিয়ে দিনের বেলাতেই একটু ঘুমিয়ে নিতাম। তখন থেকেই দিনের বেলায় ঘুমোবার এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে আজ অব্দি যায়নি। এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে যদি দিনে একটুও না ঘুমোই মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে থাকে। এক ধরণের অবসাদ এবং অস্থিরতা গ্রাস করে নেয়। বারোমাস আমি দুপুরের খাওয়ার একটু নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে নিই। আয়ুর্বেদের লোকেরা বলে দিনে ঘুমোনো খারাপ। কিন্তু আমার গঙ্গা তো উল্টো বয়। হয়ত পিত্তের প্রবৃত্তি যাদের আছে তাদের জন্য দিনে ঘুমোন খারাপ নয়। বরঞ্চ হয়ত লাভজনক। যাই হোক, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই বলতে পারি যে দিনের সংক্ষিপ্ত নিদ্রায় আমার লাভই হয়েছে সবসময়।
(২)
স্বভাব, বাধা এবং মাধুকরী
আমার তো স্বভাবটাই এমন যে একা থাকতে চাই, দিন রাতের ভীড়-ভাড়াক্কা
থেকে বাঁচতে চাই। খুব বেশি হলে একটু সময়ের জন্য ভীড় সইতে পারি। কিন্তু সারাটা দিনরাত
জুড়ে নয়। আরেকটি কথা। আগে ভাবতাম সন্ন্যাসি মানেই মহাত্মা। কিন্তু পরে কাছ থেকে দেখলাম
ওদের মাঝেও সেই একই দুনিয়া। ছেলের জায়গায় চ্যালা, পরিবারের জায়গায় গুরুভাই, সঙ্গী ও
ভক্তগণ, বাড়ির জায়গায় মঠ নয়ত কুটির – এসব ব্যাপার নিয়েই ওরা চিন্তিত থাকে বেশি। টাকা-পয়সা
জমা করার চিন্তাও কম থাকে না। বরং মঠ তৈরি হলে সে চিন্তা গেরস্তদের থেকে বেশি বেড়ে
যায়। তফাৎ শুধু এটুকুই থাকে বেদান্তের ব্রহ্মজ্ঞানের ভাগিরথীর ধারায় অবগাহন করে নিয়েছেন
বলে নরক ও যমযন্ত্রণার চিন্তা ওদের করতে হয় না। ষাঁড়ের মত নিশ্চিন্তে বিচরণ করতে থাকে।
মরার পর গেরস্তদের মত ওদেরও কোনো না কোনো ভাবে মরণোত্তর কর্মাদি এবং ভোজ (ভান্ডারা)
হয়ই। এসব ব্যাপার দেখে বিরক্তি এসে গেল আমার মনে। অপারনাথে অন্যান্য বাধাও ছিল, নিয়ন্ত্রণও
ছিল। ফলে কিছুদিন পর আমি অন্য একটি জায়গায় আলাদাভাবে বাস করা শুরু করলাম। সেখানে ভীড়
কম ছিল, স্বাধীনতা ছিল এবং শুধু নিরাশ্রয় সন্ন্যাসিরাই থাকত; ইচ্ছেমত চলেও যেত তারা।
তারপর সেখানেও থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। তখন ললিতাঘাটের ওপরদিকে ফাটা-গণেশ পাড়ায় ফাটা-গণেশের
ওপরতলায় এক টাকার ভাড়াবাড়ি নিয়ে একটা ছোটো কামরায় থাকা শুরু করলাম। সেখানেই তো একবার
নিচে পড়ে যাওয়াও আমার পা ভাঙল। সে কথা পরে হবে।
অপারনাথে থাকার সময় তো সত্রেই ভিক্ষা (আহার) করতাম। সেখান থেকে সরে
যাওয়ার পর মাধুকরী বৃত্তি শুরু করলাম। কিন্তু সেটাও বন্ধ হয়ে গেল ফাটা-গণেশে আসার পর।
তারপর বাছা বাছা কিছু ব্রাহ্মণ গেরস্তের বাড়িতে খাবার খাওয়া শুরু করলাম। এটা শেষ পর্য্যন্ত
চলল। বলা হয়েছে যে সন্ন্যাসিদের জন্য সর্বোত্তম হল মাধুকরী ভিক্ষা।
যেমন মধুকর (ভ্রমর) অনেকগুলো ফুল থেকে একটু একটু রস নিয়ে নিজের কাজ
চালায়। এতে ফুলের একটুও ক্ষতি হয় না, এমনকি ওরা টেরও পায় না যে ওদের রস নেওয়া হয়েছে।
ঠিক তেমনই অনেকগুলো গেরস্তবাড়ি থেকে এক-একখানা রুটি বা একটু একটু রান্না করা খাবার
নিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে নেওয়াকে মাধুকরী বৃত্তি বলে। কাশীতে অনেক সন্ন্যাসি এবং গেরুয়াবস্ত্রধারী
নিয়মিত এমনভাবে চালিয়ে এসেছে। বাড়ির কাছে গিয়ে ‘নারায়ণ হরে’ বলতেই গেরস্তরা বুঝে যায়
এবং রুটি, ভাত, ডাল, তরকারি কিছু না কিছু দিয়ে যায়। যেসব পাড়ায় নিয়মিত এরকম হয়ে এসেছে
সেখানেই সহজ হয় মাধুকরী। এতে কয়েক রকমের জিনিষ পাওয়া যায় এবং খেতেও ভালো লাগে। অনেক
সাধু আছে যারা বেশিরকম বৈরাগ্যের বদহজম মেটানোর জন্য, মাধুকরীর অন্ন যে থলেতে জমা করে
সে থলেটা গঙ্গায় ডুবিয়ে উঠিয়ে নেয়। তারপর খায়। এতে অন্নের স্বাদ থাকে না। ফলে জিভে
স্বাদ জাগে না। তবে আমি কখনো করিনি এমন।
সন্ন্যাসিদের দুটো পাঠশালা ছিল। একটা অপারনাথে এবং অন্যটা টেঢ়ি-নিম
পাড়ায়। ওদের দলদুটোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এই বোঝাপড়াটা হয়েছিল।
আসলে দশনামী সন্ন্যাসিদের (যারা দন্ডী নয়) মধ্যে এই ব্যবস্থা আছে
যে কয়েকজন লেখাপড়া সারার পর কয়েকটি সাধু এবং পন্ডিতকে নিয়ে একটি দল তৈরি করে নেয়। তারপর
নিজেই দলটার অধিষ্ঠাতা হয়ে যেখানেসেখানে ঘুরে বেড়াতে থাকে আর পুজো পেতে থাকে। দলটাকে
বলা হয় মন্ডলী এবং অধিষ্ঠাতাকে মন্ডলেশ্বর। এমন দুজন মন্ডলেশ্বর তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। তাই দুটো পাঠশালা ছিল। দুটোতে দুই মন্ডলেশ্বরের
আধিপত্য ছিল। ওখানে যারা থাকত এবং পড়াশোনা করত তাদেরও মাঝে মধ্যে নিজেদের মন্ডলেশ্বরের
কাছে গিয়ে প্রথামত অভিবাদন ইত্যাদি করে আসতে হত।
আমি প্রথমে একটায় পরে অন্যটায় পড়তে থাকলাম। কিন্তু এসব আদবকায়দা
মানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি কেন এসব করব? ওই মন্ডলেশ্বরদের তো আমি বলতে গেলে
পথভ্রষ্ট ও পতিত মনে করতাম। সন্ন্যাসি হয়ে এইসব প্রতারণা, অর্থসংগ্রহ আর জাঁকজমকের
কী প্রয়োজন? ফলে, প্রথমে অপারনাথে বাধা এলে অপারনাথ ছাড়লাম। পরে দ্বিতীয়টাও, বাধা দেখে
ছাড়লাম; যদিও পরে সে বাধা অপসৃত হয়েছিল। তারপর তো এমনিই পন্ডিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়া
করতাম।
কিছুদিন পরে আমি বুঝলাম, ব্রাহ্মণের তো দন্ড গ্রহণ করা দরকার। দন্ড গ্রহণ না করে (দন্ডী না হয়ে) সন্ন্যাসি হতেই পারা যায় না। ধর্মশাস্ত্রেরও এটাই আজ্ঞা; আমি নিজেই কয়েকবার পড়েছি। তাই আমি শ্রী দন্ডী স্বামী অদ্বৈতানন্দজি সরস্বতী মহারাজের চরণে গিয়ে পড়লাম। আবার থেকে সন্ন্যাসের সংক্ষিপ্ত বিধি অনুসরণ করে দন্ড ধারণ করলাম। ফলে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী নামে আমার খ্যাতি হল। এতে দশনামী সাধুদের সাথে আমার আরো বেশি মনকষাকষি শুরু হল। শেষে ওদের পাঠশালাগুলো ছাড়তে হল আমায়। দন্ডী হওয়ার পরের হালচাল পরে বলব। আলাদা বাড়ি নেওয়ার পিছনেও প্রধান কারণ ছিল দন্ডী গ্রহণ।
(৩)
অগ্নিপরীক্ষা
সংস্কৃত পড়ার দিনগুলোয় যে অগ্নিপরীক্ষা পার করতে হল আমায় এবং তাতে
যে আমি ভালোভাবে পাশ করতে পারলাম, সেটা নিয়ে আমি গর্ব করি। আমি বিশ্বাস করি যে যদি
কোনো কাজ করব বলে দৃঢ় সঙ্কল্প করে নিই তাহলে বাধা আমায় বিচলিত করতে পারে না। আমি তো
সঙ্কল্প করেইছিলাম যে বেদ, বেদাঙ্গ এবং দর্শনগুলোকে মথে ফেলব। সেপথেই পূর্বোক্ত বাধাগুলো
এল। সেগুলোর মুখোমুখি হতে থাকলাম।
মাঝে মধ্যে খুশকি হত আর মাথায় ব্যথা করত। আসলে কাশীর আবহাওয়ার দোষ
এটা। হাওয়ায় শুকনো ভাব আছে, বিশেষকরে গঙ্গাজির জলে। তাই অনেকে সকাল-বিকেল বাইরে চলে
যায় এবং কুঁয়োর জল খায়। খুশকি থেকে নিজেদের বাঁচায়। কিন্তু আমার তো দম নেওয়ার ফুরসত
ছিল না। বাইরে কয়েক মাইল যেতাম কিভাবে? দিনে একবার রুক্ষ ও শুকনো খাবার খাওয়া আর খুব
বেশি করে মাথার কাজ করা – সে কারণেও খুশকি হত। কাশীতে যারা পড়াশুনো করে তারাই প্রায়
সবাই এই রোগের শিকার হয়; শুকনো কাশিতেও ভুগতে শুরু করে তারা। আমারও সেই একই অবস্থা
হত কখনো কখনো। কিন্তু কিইবা করতাম? ভুগতাম, আর পড়ার কাজে দৃঢ় থাকতাম।
শেষে এক পাঞ্জাবি, উদাসীন, লেংটিধারী সাধু যাকে ‘অবধূত’জি বলা হত,
কাশীরই এক বৈশ্যকে বলে আমার জন্য সন্ধ্যেবেলায় দুধের ব্যবস্থা করে দিল। সেই দুধই খুশকি
থেকে বাঁচাল। ‘অবধূত’জি শুধু একটি লেংটি পরতেন, শহরের বাইরে গঙ্গার তীরে থাকতেন এবং
শীতে একটা সাধারণ চাদর গায়ে দিতেন। সবসময় ওনাকে আমি সেভাবেই দেখেছি। লাগাতার অনেক বছর
অব্দি ওনার ভিতরে কোনো রকম লোভ, বাসনা বা নেশা পাইনি। দিনের বেলায় শহরে চলে আসতেন এবং
কয়েকজন সজ্জনের বাড়িতে বা আমার বাড়িতে এসে বসে সন্ধ্যেবেলায় চলে যেতেন। সেই মানে গ্রামে
এক সাচ্চা সাধু পেয়েছিলাম আর দ্বিতীয় এই। এই দুজনকে আমি ভুলতে পারব না।
গরমের দিনগুলোয় আমি থাকতাম ফাটা-গণেশে, দুপুরে খাবার খেতাম এক মাইল
দূরে গিয়ে সরায়গোবর্ধন পাড়ায় তারপর ফিরে এসে একটু পরে, এক মাইল দূরে, বাঙালিটোলা ছাড়িয়ে
সোনারপুরায় ন্যায় পড়তে যেতাম। কতদিন অব্দি এই আমার রোজনামচা ছিল! অন্যান্য পন্ডিতদের
বাড়ির পাঠশালাতেও পড়তে যেতে হত। কিন্তু আনন্দ পেতাম।
নব্যন্যায়ের দুই ভালো পন্ডিতের সাথে কাশীতে কাজ পড়েছিল আমার। আরেকজনের
সাথে মিথিলায়। তিনজনেই নিজের নিজের মত করে অনন্য। একজন ছিলেন বাঙালি শ্রী শঙ্কর ভট্টাচার্য
এবং দ্বিতীয়জন মৈথিল শ্রী জীবনাথ মিশ্র। তৃতীয় প্নডিত শ্রী বালকৃষ্ণ মিশ্রকে দারভাঙ্গায়
পেয়েছিলাম। কিছু দিন ওনার কাছেও বাধা, সৎপ্রতিপক্ষ ইত্যাদি নবীন ন্যায়ের গ্রন্থগুলো
পড়েছিলাম। কাজ তো আরো কয়েকজনের সাথে পড়েছিল। কিন্তু এই তিনজনের আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
সবচেয়ে বেশি গ্রন্থ তো আমি ভট্টাচার্যজির কাছেই পড়েছিলাম। তাঁর বোঝানোর ঢংটা একদম অন্যরকম
ছিল। গ্রন্থের আশয়টা হৃদয়ঙ্গম করাতে উনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করতেন। এই ব্যাপারটা কমবেশি
পন্ডিত বালকৃষ্ণ মিশ্রের মধ্যেও পেয়েছিলাম।
পন্ডিত জীবনাত্থ মিশ্র একটু তাড়াতাড়ি কথা বলতেন। এমন হত যে যখন সব্যাভিচার
এবং সামান্য নিরুক্তি ওনার কাছে পড়তাম তখন ওনার ঘোড়দৌড় চলত। উনি কী বলছেন সেটুকুই মনে
রাখতাম। ওই কঠিন গ্রন্থগুলোর কোনো লাইনে থেমে যদি ওখানেই ঠিক ঠিক বোঝার চেষ্টা করতাম
তাহলে পিছিয়ে পড়তাম আর উনি এগিয়ে যেতেন। তাই ওনার বলা কথাগুলো মাথায় নোট করে নিতাম
আর রাতে সেই মাথায় ধরে রাখা নোটগুলোর ভিত্তিতে সামান্য নিরুক্তি ইত্যাদির মত ক্লিষ্টতম
গ্রন্থগুলো ভালো করে বুঝে যেতাম। কখনো বুঝতে অসুবিধে হয় নি। এতে লাভ হল যে শিগগিরই
ওই গ্রন্থগুলো পড়ে নেওয়া সম্ভব হল। পরে তো সমস্ত কথা কাগজে নোট করা শুরু হল। অন্য পন্ডিতদেরও
বলা সমস্ত কথা হুবহু পরে নোট করে যখন ওনাদের দেখাতাম তখন ওঁরা আশ্চর্য হয়ে যেতেন।
সাহিত্যের গ্রন্থাদি পড়তে আমার রূচি হত না বেশি। কেননা সাধারণতঃ
ওসবে অশ্লীলতা বেশি থাকে। তবুও শিশুপাল বধ, কিরাতার্জুনীয় এবং নৈষধ ইত্যাদি পড়ে ফেললাম।
ওগুলোয় অশ্লীলতা কম। নৈষধ আমায় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত। শ্রীহর্ষের অলৌকিক প্রতিভায়
আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কাব্যপ্রকাশ ইত্যাদি পড়ার সময় তো অধ্যাপক মশাই কৃপা করে অশ্লীল
বাক্যগুলোর জায়গায় অন্যান্য শ্লোকের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমাদের পড়ালেন। তাই তাঁর কাছে অনুগৃহীত
রইলাম। কিন্তু মেঘদূতের মতন নীতিভ্রষ্ট গ্রন্থগুলো পড়ার সাহস করতে পারলাম না।
ব্যাকরণ এবং নবীন ন্যায় পড়ারও সব সুবিধা কাশীতে ছিল। কিন্তু প্রাচীন
ন্যায়, মীমাংসা, যোগ এবং সাংখ্য পড়তে যে সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হল তা আমিই জানি। এসব
বিষয়ের যোগ্য অধ্যাপক খুব কম ছিল। যারা ছিলেনও, তাঁরা পড়ানো থেকে দূরে থাকতে চাইতেন।
এ সেই কাশীর কথা যাকে সংস্কৃত বিদ্যার শহর বলা হয়। বেদান্ত পাঠ তো তবুও চলত কিন্তু
মীমাংসা এবমগ প্রাচীন ন্যায়ের পাঠ খারাপ অবস্থায় ছিল। আপোদেবী, ন্যায়প্রকাশ এবং অধিকরণ
রত্নমালাই শুধু মীমাংসা নয়। আসল মীমাংসা গ্রন্থ তো শাবরভাষ্য, শ্লোকবার্তিক, তন্ত্রবার্তিক
ইত্যাদি। কেউ এসব গ্রন্থ পড়াত না। কেবল প্রথমোক্ত দু-তিনটে পড়িয়েই শেষ করে দিত।
কুমারিল ভট্টের টুপ্টীকার ওপর শ্রী পার্থসারথী মিশ্রের যে টীকা তৈরি হয়েছিল তন্ত্র রত্ন নামে, সে তো আজ অব্দি ছাপাই হয়নি। আমি দ্বারভাঙ্গায় নিজের হাতে লিখে নিয়েছিলাম সে টীকা। প্রভাকরের অভিমত সম্পর্কিত গ্রন্থের বিষয়ে তো কেউ জানতই না। শাবরভাষ্য যেটা ছাপা হয়েছে, ভূলে ভরা। সে ভূল সংশোধন করারও কেউ নেই। একই দশা প্রাচীন ন্যায়-দর্শনের ভাষ্যের, তার বার্তিক এবং তার ওপর শ্রী বাচস্পতি মিশ্র লিখিত তাৎপর্য টীকা ইত্যাদি গ্রন্থের। সব কটা ভূলে ভরা। যথার্থভাবে ন্যায় কুসুমাঞ্জলি এবং আত্মতত্ত্ববিবেক পড়াও অসম্ভব ছিল। আত্মতত্ত্ববিবেক অত্যন্ত কঠিন বলে বেশি রকম ভূল ছেপেছে। তার কিছুটা অংশ নিশ্চয়ই, যেটুকু ওখানকার সংস্কৃত পরীক্ষায় আছে, টীকাটিপ্পনীর সাথে ছাপা হয়েছে। কিন্তু বাকি বইটার বিষয়ে কে কাকে জিজ্ঞেস করবে?
(৪)
অন্ধকারাচ্ছন্নতা
একাধটা নমুনা শোনাই। ন্যায়বার্তিকের তাৎপর্যটীকা কাশীর ল্যাজারাস
প্রেসে ছাপা হয়েছে। প্রকাশক, কাশীর প্রসিদ্ধ বিদ্বান পন্ডিত গঙ্গাধর শাস্ত্রীজি। উনি
বইটার প্রুফ ঠিক করেছেন। বইটায় হেত্বাভাস প্রকরণে এক জায়গায় আসে ‘কৃতৃরাসদিবেত্যাদি’।
এর অর্থ উনিও জানতে পারেন নি আর অন্য কোনো পন্ডিতও না। উনি শুরুতেই উক্ত বাক্যের তিনটে
অর্থ লিখেছেন – একটা নিজের করা, দ্বিতীয়টা পন্ডিত শিবকুমার শাস্ত্রীর করা আর তৃতীয়টা
পন্ডিত সুধাকর দ্বিবেদীর করা। কিন্তু তিনটেই ভুল এবং জবর্দস্তি মানে বার করা। আমি দেখে
অবাক হচ্ছিলাম, এটা কী ব্যাপার? শেষে শ্রী ভোজরাজ লিখিত একটি ছোট গ্রন্থ রাজমার্তন্ড
পড়ছিলাম। তাতে ভদ্রার ভোগের সময়কার প্রকরণে ‘কৃতৃরাস দিবেদরভূত দিবা’ ইত্যাদি শ্লোক
আসে। দেখেই তাৎপর্যটীকার বাক্যটা মনে পড়ল। মানে বুঝতে দেরি হলল না। আসলে ভোজ ‘কৃতৃরাস’
শ্লোকের অর্থবোধে সংকেত হিসেবে কৃষ্ণ অর্থে ‘কৃ’, তৃতীয়া অর্থে ‘তৃ’, রাত্রি অর্থে
‘রা’ এবং সপ্তমী অর্থে ‘স’ লিখেছেন। পরেও এমন করেই অর্থে অক্ষর অথবা শব্দ লিখেছেন।
এভাবে নিজের কাজ বের করেছেন। কিন্তু ;তাৎপর্যটীকায় বাচস্পতি বলছেন যে যদি ওই বাক্যটা
অন্য কোনো জায়গায় প্রয়োগ করা হয় তাহলে অর্থহীন বা অর্থভ্রান্তিই ঘটবে। ওনার ওই সংকেত
তো আভ্যন্তরীণ। কিন্তু এই মোটা কথাটা মহামহোপাধ্যায়রাও বুঝতে পারল না!!
এমনই, মীমাংসা দর্শনের শাবরভাষ্য ধরুন। অত্যন্ত ক্লিষ্ট গ্রন্থটি।
কাশীতে যে সংস্করণটি ছেপেছে সেটি ততটাই অশুদ্ধ যতটা আগের সংস্করণ। কিন্তু দু’একজন পন্ডিতের
কাছে আমি গেলাম ভাষ্যটা পড়তে। কেননা শুনেছিলাম তাঁরা পড়ান। কিন্তু ওঁদের তো স্পেশ্যাল
গাড়ি দৌড়ত আর আমি ওঁদের মুখ দেখতাম বসে বসে। কিচ্ছু বুঝতে পারতাম না। জানি না অন্যদের
কী অবস্থা হত। ওরাই বা কী বুঝবে? খোদ পন্ডিতজিও বুঝতে পারতেন কিনা সন্দেহ। আমার তো
মনে হয় উনিও আনকোরা ছিলেন। কেননা উনি তো জানতেনই না কোথায় কোথায় মুদ্রণে অশুদ্ধি রয়েছে।
যদিও আমি নিজে, কতবার পড়ে, ভেবেচিন্তে এবং অন্যান্য গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে জেনেছিলাম
সে অশুদ্ধিগুলো। আমার এটাও অভিমত ছিল যে এর ভিন্ন পাঠ হওয়া উচিৎ। পরে যখন দ্বারভাঙ্গায়
মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত চিত্রধর মিশ্রজির সাথে কথা হল উনি আমায় সে ভাষ্যের একাধটা অশুদ্ধির
সুত্রে নিজের একটি দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন। শোনালেন, উনিও কিভাবে ধোঁকা খেয়েছিলেন এবং
পরে কোনো ভিন্ন গ্রন্থ পড়ার সময় কেন মনে হয়েছিল যে বাস্তবিকই সেটা অশুদ্ধি। আমি আগে
থেকেই ভাষ্যের সে জায়গাটির ভিন্ন পাঠ ভেবে নিয়েছিলাম। যা আমি ভেবেছিলাম উনিও তাই বললেন।
মীমাংসার বিষয়ে আগেই বলেছি। মনে হত, ন্যায়প্রকাশ ইত্যাদি যে দু’তিনটে
বই পড়ান হত সেগুলোও পড়া-মুখস্ত করার মত। ন্যায়প্রকাশের অনেক কথার রহস্য আমি তখন বুঝলাম
যখন আলাদা করে বিধিবিবেক, ন্যায়রত্নমালা ইত্যাদি বইগুলো যোগাড় করে মন দিয়ে পড়লাম। পরের
দিকে তো আমার কাছে অনেক এমন সুবোধ ছাত্র আসত যাদের প্রাচীন ন্যায় ইত্যাদি পড়ার জন্য
মাইলের পর মাইল হাঁটতে হত। কেননা প্রাচীন দর্শনগুলোর যেমন অবহেলা, বিদ্যার কেন্দ্র
কাশীতে করা হচ্ছিল সেটা ওদের কাছে অসহ্য ছিল। শাস্ত্রার্থ নামের যে অসুখটা ওখানে ছড়িয়ে
পড়েছিল তার কারণে ব্যাকরণ এবং নব্য-ন্যায়ের ফক্কিকা, পংক্তি এবং ব্যাখ্যার অনুশীলন
করে নেওয়াই যথেষ্ট মনে করা হত। অধ্যয়নে শাস্ত্রের গভীর মন্থন প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল
এবং সেদিকে কারোর দৃষ্টি ছিল না।
বারাণসীতে দেখলাম যে ব্যাকরণাচার্যরা বেদান্তের পূঁথি পড়াতে বসে
যান আর নব্যন্যায়ের পন্ডিত প্রাচীন ন্যায় এবং মীমাংসার অধ্যাপক হওয়ার দুঃসাহস দেখান।
বিশেষত্ব এটাই যে এর ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ছাত্ররাও এত সরল আর বোকা যে একজন গুরুজির
কাছেই সবকিছু পড়তে চায়। যে পন্ডিতদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ত, তাঁরাও ভাবতেন যে তাঁদের
কাছে যেহেতু ছাত্রদের ভীড় হয়, তাঁরা যদি কোনো বিষয় পড়াতে নিজের অক্ষমতা দেখায় তাহলে
সম্মানে ঘা লাগবে। তাই তাঁরা পড়ে যেতেন। শুধু তাই নয়, কোথাও বুঝতে না পারলেও থামতেন
না। মাথায় থাকত সম্মানে ঘা লাগার ভুত। কেননা ছাত্রেরা যে বুঝে ফেলবে, পন্ডিতজি বোধহয়
ভালো করে বোঝেন না এই বইটা!
দু’তিনজন পন্ডিতের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম পেলাম। তাঁরা যেখানে বুঝতে পারতেন না, থেমে যেতেন। পন্ডিত শিবকুমার শাস্ত্রী তো ন্যায়দর্শনের ভাষ্য পড়ানর সময় এক জায়গায় কয়েক দিন থেমে রইলেন এবং যতক্ষণ বুঝতে না পারলেন, এগোলেন না। আরেকজন পন্ডিত ছিলেন যিনি কোথাও না বুঝতে পারলে থেমে যেতেন। দৈবাৎ যদি কোনো ছাত্র সঠিক অর্থটা বুঝতে পেরে বলে দিত, তাহলে উনি নির্দ্বিধায় সেটা মেনে এগিয়ে যেতেন। পন্ডিত অচ্যুতানন্দ ত্রিপাঠিজি সন্ন্যাসি পাঠশালায় দর্শন পড়াতেন। উনিও এমনই করতেন। সার কথা এই যে কে বুঝবে, “নিজেও ডুবলাম, অন্যদেরও ডোবালাম”এর তত্ত্ব অনুসরণ করে যে পন্ডিতেরা কাজ করতেন, তাঁরা কত খারাপ? নৈয়ায়িক না হলে বৈয়াকরণ ন্যায় কিভাবে পড়াবে? কিন্তু তারা পড়াতে অস্বীকারও করত না এবং তাদের ভোঁদা ছাত্রেরাও ভাবত না যে অন্যত্র পড়া যাক। একবার তো আমি একজন ভালো বৈয়াকরণের সাথে ট্রেনে বসে কথা বলছিলাম। তাঁর নাম বলা অনুচিত মনে করি। কথায় কথায় ন্যায়ের কোনো প্রসঙ্গ চলে এল। আমি জানতাম উনি নিরেট বৈয়াকরণ। তা সত্ত্বেও একটুও দ্বিধা না করে উনি আমার সামনে ন্যায়ের সমস্যা ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় রত হলেন। আমার হাসি পেল। ১৯২২ সালে লখনউ জেলে আমি অনেক ইংরেজিওয়ালা লোকেদের সাথে ছিলাম। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রফেসরও ছিলেন। এক ভদ্রলোকের, ব্যাকরণের সিদ্ধান্ত-কৌমুদী পড়ার ইচ্ছা হল। ভাবলেন এক প্রফেসর সাহেবের কাছে পড়বেন। যখন আমায় উনি নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন, আমি বললাম, সে প্রফেসর সাহেব তো সব বিষয়ের প্রফেসর নন। আমি জানি যে উনি সিদ্ধান্ত কৌমুদী জানেন না। কিন্তু পড়তে চাওয়া ভদ্রলোক বললেন, “বাহ, উনি প্রফেসর! তাহলে পড়াবেন না কেন?” শেষে উনি গেলেন প্রফেসর সাহেবের কাছে। প্রফেসর সাহেবও নিজের দর্প বজায় রাখতে স্বীকার করলেন না যে উনি সিদ্ধান্ত কৌমুদী জানেন না। যদিও কোনো না কোনো অজুহাতে আজ-কাল করতে থাকলেন. শেষ অব্দি এমন কোনো সুযোগ আসতেই দিলেন না যে কৌমুদীর পূঁথিটা ওনার সামনে খোলা হয় আর হাটে ওনার হাঁড়ি ভাঙে। এভাবে শেষে এটাই বলতে পারি যে অসুখটা খুব প্রবল দেখলাম চারদিকে। এবং একে অন্ধকারাচ্ছন্নতাই বলব।
(৫)
পরিচয় এবং দন্ড গ্রহণ
১৯১৫ সাল অব্দি আমি কাশীতে নিয়মিত সংস্কৃত অধ্যয়নে ব্যাপৃত ছিলাম।
ক্বচিৎ কখনো অসুস্থ হলে বাইরে যেতাম। সে কথাও পরে বলব যে বাইরে যেতাম কিভাবে। ১৯১৫
সালেই আমি দ্বারভাঙ্গার শ্রী রামেশ্বরলতা বিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম কেননা ন্যায়ের হেত্বাভাসের
কয়েকটি গ্রন্থ কাশীতে পড়তে অসুবিধে হচ্ছিল। মীমাংসারও কিছু গ্রন্থ যোগাড় করার ছিল।
দ্বারভাঙ্গায় পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এভাবে সাতটি বছর দিনরাত অবিরাম মাথাভাঙা পরিশ্রম
করে আমি পুরো সংস্কৃত বাঙ্ময় মন্থন করলাম। বলতে পারি যে এতে অসীম তৃপ্তি হল আমার। বেদান্ত
দর্শনের অদ্বৈতবাদ এবং জগতের অনির্বচনীয়তা ও মিথ্যাত্বের পুষ্টি হল ন্যায়বিষয়ক এবং
অন্যান্য গ্রন্থাদি থেকে। আমার মনোরথ পূর্ণ হল। খন্ডন খন্ডখাদ্য, পদার্থ খন্ডন ইত্যাদি
গ্রন্থের যুক্তিগুলো আমার মনে তাদের অব্যর্থ প্রভাব ফেলল। যোগী পেলাম না তো পেলাম না।
কিন্তু এটা নির্বিবাদ তথ্য যে সে অভাবপূরণে মনের প্রয়োজনীয় পরিতোষটা হয়ে গেল।
এই সময়েই, বা বলতে পারি ১৯০৯-১০এই, কাশীতে স্বামী পূর্ণানন্দজি নামে
এক সন্ন্যাসির সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। আমার বিষয়ে জানতে চাইলেন। বাড়ি কোথায় তাও জানলেন।
উনিও গাজিপুর জেলারই করন্ডা পরগনাবাসী পূর্বাঞ্চলের ভুমিহার ব্রাহ্মণ ছিলেন। উনি আসতেন
আমার কাছে। কখনো কখনো প্রয়োজন হলে দর্শনের বইটইও কাউকে দিয়ে কিনিয়ে বা অন্য কোনো ভাবে
আমাকে পাইয়ে দিতেন।
পরে জানতে পারলাম যে ভুমিহার ব্রাহ্মণ মহাসভা এবং তার কর্মীদের সাথে
তাঁর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সে সময় একথা উনিও বলেননি এবং আমিও জানতে চাইনি। কিন্তু আমার
বুদ্ধি এবং পরিশ্রম দেখে উনি হৃদয় থেকে চাইতেন যে ভালো করে লেখাপড়া করে আমি প্রগাঢ়
বিদ্বান হই। অন্যান্য বুঝদার মানুষেরাও সেটাই চাইতেন। পরে জানলাম যে ওনার ভিতরের ইচ্ছেটা
ছিল অন্যরকম। আমি যেন বিদ্বান হয়ে দুনিয়ায় পুজ্য হয়ে উঠি, টাকাপয়সা জমা করি এবং কাশীতে
একটা বড় মঠ তৈরি করাই। যেমন গৌড় স্বামী বা স্বামী বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী প্রভৃতি সন্ন্যাসিরা
করিয়েছেন। কিন্তু উনি আমার মনের ভাবনা জানতেন না। উনি ভুল রাস্তা বেছে ভুল লোকের মাধ্যমে
নিজের আকাঙ্খা মেটাতে চেয়েছিলেন। যদিও সে সসময় উনি জানতেন না নিজের ভুলটা। এখনো উনি
বলতে ছাড়েন না যে আমি ওনার জন্য কিছু করলাম না। কিন্তু সেটা তো আমার বাধ্যবাধকতা ছিল।
এখনো আছে। ওনার মঠই তৈরি করার ছিল তো বাড়িঘর কেন ছাড়লেন? আমার জন্ম কি বড়লোক, সেঠ আর
রাজামহারাজার দরবার সাজানোর জন্য হয়েছিল? এরই জন্য আমি বাড়িঘর ছেড়েছিলাম?
হ্যাঁ, তো ওনার মাধ্যমেই সরাই গোবর্ধন পাড়ার কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত ভুমিহার
ব্রাহ্মণের সাথে আমার পরিচয় হল। কখনো কখনো আমি ওদিকে যেতামও। ওরা দু’একটা বইও কিনে
দিত। স্বামী পূর্ণানন্দজি যদিও নিজে দন্ডী ছিলেন না, তা সত্ত্বেও আমার সাথে এ নিয়ে
নিয়মিত আলোচনা করতেন। উনি চাপ দিতেন যে আমার দন্ডী হয়ে যাওয়া উচিৎ। আমারও মনে হত। ধর্মশাস্ত্রাদি
পড়তে পড়তে আমার মনের ধার্মিক ভাবনাও বলত যে দন্ডী না হয়ে আমি খুব বড় ভুল করেছি, এখনো
শুধরে নেওয়া সমীচীন। যখন উনি বার বার বলতে শুরু করলেন তখন সে ভাবনাটা দৃঢ়তর হল। অত্যন্ত
বৃদ্ধ এবং কোনো গৃহস্থের জীর্ণ-শীর্ণ বাড়িতে বসবাস করা এক গুরু মহারাজের সাথে উনি বেশ
কয়েকবার আমার দেখা করালেন এবং কথা বলালেন। শেষে সব ঠিক হয়ে গেল আর ১৯১১ সালে আমি
বিধিসম্মত ভাবে দন্ড গ্রহণ করলাম। শেষমেশ আমিও দন্ডী স্বামী হয়েই গেলাম। পরে তো
স্বামী পূর্ণানন্দজিও দন্ডী হলেন।
এদিকে আমি কয়েকবার গল্প শুনলাম যে “আমার দন্ডী হওয়ার পথে সর্যুপারীণ অথবা কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণেরা অনেক বাধা দিয়েছিল এবং বলেছিল যে ভুমিহার ব্রাহ্মণদের দন্ডী হওয়ার অধিকার নেই। তাই যখন আমি ওদের শাস্ত্রার্থে হারিয়ে দিলাম তখনই দন্ডী হতে পারলাম। এই ক্ষোভ থেকেই আমি পরে গিয়ে ভুমিহার ব্রাহ্মণদের পুরোহিত ইত্যাদি হওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি।” কিন্তু এ সমস্ত গল্প পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আমার সামনে তো কখনো এধরণের কোনো পরিস্থিতি আসেই নি। এটা ঠিক যে আমার বংশের লোকেরা বিয়ে-শাদির মাধ্যমে ভুমিহার ব্রাহ্মণদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। তবুও, আমি তো জুঝৌতিয়া ব্রাহ্মণ, আগেই বলেছি। তাহলে ঝগড়া কিসের? ভুমিহার ব্রাহ্মণদের সাথে তো মৈথিল, কান্যকুব্জ এবং সর্যুপারীণ ব্রাহ্মণেরাও বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। এসব কথা প্রমাণ এবং বিবরণের সাথে অন্যত্র বলা হয়েছে। তা বলে কি ওরাও নিজেদের বিষয়ে কখনো এমন কথা শোনে? ওদের নিয়ে কখনো এধরণের বিবাদ হয়েছে? সবচেয়ে বড় ব্যাপার তো এই যে এধরণের কোনো বিবাদের কথা না আমার সময়ে শোনা গেছে, না গুরু মহারাজ বা তাঁর গুরুর সময়ে। যদিও এধরণের কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর আমি নিজেই গুরু মহারাজকে প্রশ্নটা করেছিলাম। প্রায় একশো বছর বয়সে তিনি নিজের দেহ রেখেছিলেন।
(৬)
আমার গুরুদেব
যাঁর কাছে আমি দন্ড গ্রহণ করেছিলাম সেই গুরু মহারাজের নাম ছিল শ্রী
স্বামী অচ্যুতানন্দ সরস্বতী। তিনি সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন না। শুধু গীতা ইত্যাদি পড়ে নিতেন।
কিন্তু প্রেম এবং ভক্তির প্রতিমূর্তি ছিলেন। এটাই কি কম, যে আমার মত তর্কপ্রিয় এবং
নীরস মানুষের হৃদয়কেও তিনি বলপূর্বক নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নিয়েছিলেন? কখনো ভক্তির
প্রসঙ্গ এলে আমি নিজেই হাজার বার দেখেছি যে একদিকে তিনি কথা বলে চলেছেন আর অন্যদিকে
তাঁর চোখের জল বয়ে চলেছে। ভগবানের কথা উঠলেই চোখ ছলছল করে উঠত। অত্যন্ত বৃদ্ধ এবং অশক্ত
হয়ে পড়ার পরেই তিনি মন্দিরে গিয়ে বিশ্বনাথবাবার দর্শন করা বন্ধ করলেন। তখন কথা উঠলে
নিজেই বলতেন চোখে জল নিয়ে, “উনি কি মন্দিরনাথ? উনি তো বিশ্বনাথ! সর্বত্র বিদ্যমান!
তাহলে মন্দিরে কেন যাব? উনি তো পান্ডাদের হাতে বন্দী নন!” নিত্য দর্শনের ফল ছিল শেষের
এই অভিজ্ঞতা এবং অসীম তৃপ্তি! এই তো ভক্তির আসল রূপ।
তিনি সবসময় সাদা ভস্মের প্রলেপ লাগাতেন। দেখা হলে আমাদেরও দিতেন।
রুদ্রাক্ষের মালা পরে থাকতেন। তাঁর সুমিরনি (জপমালা) সবসময় চলতে থাকত। বিরাম পেত না
কখনও। কখনো যদি এমন হত যে জপমালাটা হাতে নেই তখন বুড়ো আঙুলটাই আঙুলগুলোর ওপর ঘুরতে
থাকত আর সেভাবেই সারতেন জপের কাজ। আঙুলের এই অভ্যাসটা খুব বেশিরকম হয়ে গিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাসের
মত স্বাভাবিক। তাই ঘুমের সময়েও বুড়ো আঙুল চলত আঙুলগুলোর ওপর। কতবার এমন হয়েছে যে আমি
হঠাৎ পৌঁছে গেছি আর তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন। তখন আমি নিজে দেখেছি যে আঙুলগুলোর ওপর বুড়ো
আঙুলটা ঘুরছে।
তাঁর চোখ এবং তাঁর দাঁত মৃত্যু অব্দি ঠিক ছিল। সেই একশো বছর বয়সেও
তাঁর কখনও চশমা পরার প্রয়োজন হয়নি। বুড়ো বয়সেও দাঁত দিয়ে তিনি ছোলা চিবিয়ে খেতেন। আমি
অবাক হয়ে দেখতাম। খুব নস্যি নেওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। পরে তো এমন অবস্থা হয়েছিল যে বাজারে
তৈরি যে নস্যি নাকে ছোঁয়াতেই আমরা হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করা শুরু করতাম তাঁর ওপর সে
নস্যির কোনো প্রভাবই পড়ত না। তাই গোলমরিচের খুব মিহি গুঁড়ো তাতে মিশিয়ে শুঁকতেন। তবে
গিয়ে তার কিছুটা তীব্রতা অনুভব করতে পারতেন। বলতেন, ছোটোবেলাতেই নস্যির অভ্যাস হয়ে
গিয়েছিল। এও বলতেন যে মস্তিষ্কের বিকার থাকতে দেয় না নস্যি। ওতে গরম থাকে না। তাই চোখও
ঠিক থাকে, দাঁতও ঠিক থাকে। অন্যদের কাছেও একই কথা শুনেছি। সত্যিটা কী, বলতে পারব না।
ব্যাপারটা নিয়ে পরীক্ষা চালান যেতে পারে। কেননা আজকাল তো দাঁত আর চোখের রোগে সবাই ভুগছে।
তাই, যদি কথাটা সত্যি হয় তাহলে তো খুব সহজ ওষুধ হাতে পাওয়া যাবে।
অতিথি সৎকারে গুরুজি মহারাজের জুড়ি ছিল না। নিজের ঘরে সবসময় খাবার
জিনিষ রাখতেন এবং যে যেত, কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমার তো প্রথম
থেকেই কড়া নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস ছিল। কিন্তু তাঁর ছলনাহীন স্বভাব আমাকেও বিবশ করত।
এত সোজা ছিলেন যে সব কথা বলে দিতেন। কিছুই লুকোতেন না। কখনো কখনো এতে অসম্মানের আশঙ্কা
থাকে। কেননা নিজের দুর্বলতা এবং ছিদ্রগুলো সবাই জেনে যায়। কিন্তু তিনি একেবারেই তার
পরোয়া করতেন না। গঙ্গার অগাধ ও পরিচ্ছন্ন জলের মত শুদ্ধ ছিল তাঁর হৃদয়। ছলনা ও কাপট্যের
কোনো জায়গাই ছিল না তাঁর স্বভাবে। আমি অনেক এমন ঘটনা জানি যেগুলো নিজের মুখে বলার সাহস
কারোর হবে না। কিন্তু তিনি কখনো লুকোননি। তাই শেষ মুহুর্ত অব্দি তাঁর পুজো হয়েছে। ভগবানে
অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাই খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। তাঁর ভাঁড়ারও বোধহয়
সবসময় এই কারণেই ভরা থাকত।
কখনো কখনো এমন হত যে নিজের শৈশবের কথা শোনাতেন। বলতেন এক টাকায় তিন
মন পাকা ওজনে খেসারি কেউ পুছতো না। গ্রামের বানিয়ার কাছে ওজন করিয়ে আমরা জবর্দস্তি
রেখে আসতাম যে বছর-দু’বছরে যখন পারবে দাম দিয়ে দিও। এরকমই চাষের অন্যান্য জিনিষের বিষয়েও
বলতেন। উনিশ শতকের প্রথম সিকিভাগ সময়ের এসব কথা থাকত তাঁর মুখে। বেনারস জেলাতেই গঙ্গার
দক্ষিণে ছিল তাঁর জন্মস্থান। বলতেন একটা গরু পুষেছিলেন। নিজের হাতে তার সেবা করতেন।
কামধেনু ছিল গরুটি। যখন চাইতেন দুধ দুয়ে নিতেন। কোনো সন্ন্যাসি বা মহাত্মা সময়ে অসময়ে
পৌঁছে গেলে তাই করতে হত। মহাত্মাদেরও অনেক সেবা করেছিলেন তিনি।
শেষে আমি তাঁর একটা উপদেশের কথা বলব যেটা আমি আর কারোর কাছে পাইনি।
সাধু এবং অসাধুর যে পরিভাষা তিনি নিজের শব্দে দিয়েছিলেন সেটা যেমন মনে রাখার মত তেমনই
কাব্যময়। একদিন সে প্রসঙ্গেই কথায় কথায় তিনি বললেন, “গুণগ্রাহী সাধু, অবগুণগ্রাহী অসাধু।
অবগুণগ্রাহী সাধু, গুণগ্রাহী অসাধু”। সঙ্গে সঙ্গেই আমায় জিজ্ঞেস করলেন, মানে বুঝলি?
বুঝতে সত্যিই পারিনি। তাই বললাম, না। মহাভারতের কূটশ্লোকের ধরণের কথা ছিল। কিকরে বুঝতাম?
তখন তিনি বোঝালেন, “সাধুর কাজ হল অন্যের শুধু গুণগুলো দেখা। তার হাজারটা অবগুণের দিকে
নজরই না দেওয়া। একই ভাবে, নিজের হাজারটা গুণের দিকে না তাকিয়ে যদি একটাও অবগুণ থাকে
সেটার দিকে বার বার নজর দেওয়া। এর বিপরীতে, অসাধু হল সে যে অন্যের হাজারটা গুণ ছেড়ে
শুধু তার দোষটা দেখতে থাকে। অথচ, নিজের হাজারটা ফুটোর দিকে নজর না দিয়ে একাধটা গুণ
নিজের মধ্যে পেলেই তার ঢাক পেটাতে থাকে।” এই এক নতুন জিনিষ তাঁর কাছ থেকে পেলাম। এত
নতুন আর এত উঁচু যে বলতে পারব না। আমি তাঁর সেবা করতে পারলাম না সে দুঃখ আমার চিরকাল
থাকবে। একটা সময় অব্দি পড়াশোনার কাজ থেকেই ফুরসত ছিল না; পরে সার্বজনিক কাজ থেকে।
এসবেরই মাঝে খুব তাড়াতাড়ি উনি ছলনা ও প্রবঞ্চনায় ভরা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। এটুকুই সন্তোষ রইল মনে যে দেহত্যাগের সময় আমি তাঁর চরণেই ছিলাম।
(৭)
জ্যোতিষবিদ্যা এবং কর্মকান্ড
লেখাপড়ার কথা শেষ করার আগে দুটো প্রসঙ্গে বলতে চাই। এক তো জ্যোতিষ
আর দুই মিথিলাগমন। যখন আমি শ্রীহর্ষের খন্ডন খন্ড খাদ্য পড়ছিলাম (যেটি বেদান্তের অত্যন্ত
উচ্চশ্রেণির ক্লিষ্টতম গ্রন্থ মনে করা হয়), ওতে বৈদ্যক এবং জ্যোতিষ তত্ত্বের বেশ কয়েকটি
কথা পেলাম। সে সময় ওই কথাগুলোর অভিপ্রায় ঠিকমত বুঝতে পারলাম না। যারা পড়াচ্ছিলেন তারাও
আয়ুর্বেদ বা জ্যোতিষ জানতেন না। তাই যেমনতেমন করে কাজ চালিয়ে নিলাম। কিন্তু সেই সময়
থেকেই জ্যোতিষ এবং বৈদ্যকের প্রতি আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হল। জ্যোতিষের চর্চা তো একটু
আধটু আগেও হত। পরে আমি বৈদ্যকের কিছু প্রাচীন গ্রন্থ যোগাড় করলাম এবং ঈষৎ উল্টেপাল্টে
দেখলামও। কিন্তু বিশেষ বুঝতে পারলাম না। যদিও একটু জ্ঞান তো হলই। কিন্তু জ্যোতিষে বিশেষ
করে মাথা কোটার দরকার পড়ল। যখন কর্মকান্ড নিয়ে বই লিখলাম ‘কর্মকলাপ’ নামে, – যাতে হিন্দীতে
সব কথা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন শুধু হিন্দী লেখাপড়া জানা মানুষেরাও বুঝতে পারে – তখন
ওতে জ্যোতিষের ব্যাপারে লেখাও জরুরি হল। নইলে কর্মকান্ড অসমাপ্ত থেকে যায়। তাই, গণিত
এবং ফলিত জ্যোতিষের সবকটা গ্রন্থ যোগাড় করে ওই বিষয়ে বেশি শক্তি নিয়োজিত করতে হল। তখন
পড়াশোনা করার সেই সময়টাও আর ছিল না যে কারোর কাছে গিয়ে পড়ে নেব। তাই পুরোপুরি নিজের
ক্ষমতায় সমস্ত কাজটা সম্পন্ন করতে হল। শেষে সাফল্য এলোই। যখন একবার স্থির করে নিলাম
যে কাজটা পুরো করব, তখন আর বিফল হওয়ার প্রশ্ন কিভাবে আসে? কতটা সফল হয়েছিলাম সে তো
‘কর্মকলাপ’এর জ্যোতিষ প্রকরণ যে পন্ডিত পড়েছে সেই বলতে পারবে।
একই কথা কর্মকান্ডের বিষয়েও প্রযোজ্য। এমনি তে তো স্মার্ত অথবা গার্হস্থ জীবনের সাথে সম্পর্কিত কর্মকান্ডও খুব কঠিন এবং জালের মত ছড়ান। বৈদিক কর্মকান্ড বলতে গেলে প্রায় অভেদ্য এবং দুরূহ। আমার দুর্ভাগ্য যে সান্ধ্যোপাসনাদি নিত্য কর্মগুলো ছাড়া বাকি কর্মকান্ডে আমার প্রবেশই ঘটেনি। কখনো সুযোগও আসেনি। পরে মীমাংসা দর্শনের গ্রন্থগুলো পড়ার সময় বৈদিক কর্মকলাপের প্রসঙ্গ এসেছিল বটে। প্রেমেও পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেসব কর্মের বিষয়ে বলার কেউ ছিলই না। তাই বই আর পদ্ধতিগুলো যোগাড় করে সেসবই ঘাঁটতে থাকলাম। ফলে সেভাবেই সফলতাও পেলাম। ‘কর্মকলাপ’ নামের বইটায় সেই জ্ঞানই আমি ব্যবহার করলাম। বইটার বিষয়ে কাশীর এক বইবিক্রেতা আমায় বলেছিল, বৈদিক কর্মকান্ডের বিজ্ঞ মানুষ অগ্নিহোত্রী পন্ডিত প্রভুদত্তজি শাস্ত্রী একবার তার দোকানে এসেছিলেন। ‘কর্মকলাপ’ দেখে কৌতুহলে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন যে দেখে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু না ফিরিয়ে উনি দাম দিয়ে দিলেন। সাথে সাথে জিজ্ঞেসও করলেন, স্বামীজি কি আগে থেকেই কর্মকান্ড করাতেন? শুনে আনন্দ পেলাম, যে আমার পরিশ্রম সফল হয়েছে এবং আমার কর্মকান্ডজ্ঞান ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়নি।
(৮)
মিথিলা সফর
পড়াশোনার কাজেই আমায় ১৯১৫ সালে দ্বারভাঙ্গা যেতে হয়েছিল। সৎপ্রতিপক্ষ
এবং বাধ ইত্যাদি নব্যন্যায়ের গ্রন্থগুলো ভালো করে পড়ার সুযোগ কাশীতে পাইনি। গ্রন্থগুলো
অনেক কষ্ট করে দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চিপুরিতে পেয়েছিলাম। মীমাংসা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নও
ছিল যার উত্তর কাশীতে পাইনি। তাই দ্বারভাঙ্গায় এসে শ্রী রামেশ্বর লতা বিদ্যালয়ে উঠলাম।
ওখানেই কয়েকমাস থেকে শ্রী পন্ডিত বালকৃষ্ণ মিশ্রর কাছে ন্যাসের গ্রন্থ এবং কাব্যপ্রকাশ
পড়লাম। আমি তাঁর তীক্ষ্ণবুদ্ধির ভক্ত ছিলাম। যত পন্ডিতের সাথে আমার দেখা হয়েছে তাদের
মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধি তাঁকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু মাসে কেবল পঁচিশ টাকা পেতেন।
এমনই ছিল দ্বারভাঙ্গা মহারাজের রাজত্বে বিদ্বানের সম্মান। আমারই আগ্রহে পন্ডিতজি মুজফফরপুরের
ধর্ম সমাজ সংস্কৃত কলেজে আবেদনপত্র পাঠালেন। স্বীকৃত হওয়ার পর বোধহয় মাসিক পঞ্চাশ টাকা
মাইনেয় সেখানে গেলেন। পচিশ টাকা মাসিক তো তাঁর খাওয়াদাওয়াতেই প্রয়োজন হত। সারা দিন
রাত পড়ায় এবং পড়ানোয় মাথা খরচ করতেন। ভালো কাব্যরচনা করতেন। বিহারীর [কবি] ‘সতসই’টি
[কাব্যগ্রন্থ] তিনি সংস্কৃত দোহায় রূপান্তরিত
করেছিলেন। কিন্তু ছাপাতে পারেননি। বলতেন, যখন জানতে পারলাম যে অন্য কেউও ‘সতসই’এর রূপান্তর
করেছে সংস্কৃত দোহায় তখন ছাপানোর পরিকল্পনাটা বাদ দিলাম। আমি যখন দ্বারভাঙ্গা থেকে
রওনা দেব তখন নিজের একটি বইয়ের ওপর নিজের হাতে নিচের শ্লোকটা লিখে আমায় দিলেন। ন্যায়
সম্পর্কিত।
প্রেমৈব মাস্তু যদি স্যাতসুজনেন নৈব, তেনাপি চেদ্ গুণবতা ন সমং
কদাচিত । তেনাপি চেদ্ ভবতু নৈব কদাপি ভংগো, ভংগোsপি চেদ্ ভবতু বশ্যমবশ্যমায়ুঃ ।।
ওখানেই মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত চিত্রধার মিশ্র মীমাংসকের সাথে আমার
পরিচয় হল। তাঁর সাথে মীমাংসা নিয়ে কথোপকথন চলতে থাকত আমার। বর্ষার দিনগুলোয় তাঁর কাছ
থেকে ‘তন্ত্ররত্ন’ নামে হাতে লেখা বড় একটা বই এনে নিজের হাতে তার নকল করলাম। পরে সুন্দর
মলাট বানিয়ে নিজের কাছে রাখলাম। দু’মাস লাগাতার পরিশ্রম করে অত বড় বই হাতে লেখা গেল।
অসম্ভব একটা কাজ ছিল। যে কেউ বইটার আয়তন দেখে তাই বলবে। ওখানেই আমি রঘুনাথ শিরোমণির
বই ‘পদার্থ খন্ডন’এরও প্রতিলিপি তৈরি করলাম হাতে লিখে। আসলে এই দুটো বইই তখনো ছাপা
হয়নি।
পন্ডিত বালকৃষ্ণ মিশ্র এখন হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো জায়গায় আছেন। খুব উন্নতি করেছেন। দ্বারভাঙ্গার একটা ঘটনা বলছি। তখন আমার খাবার রান্না করার জন্য এক মৈথিল ব্রাহ্মণকে রাখা হয়েছিল। সেই বাজার থেকে জিনিষপত্র কিনে আনত। আমার একদিন সন্দেহ হল যে সে চুরি করে। তাই সত্যটা জানতে সতর্ক হলাম। চুরিকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করি। শেষে একদিন পয়সায় চুরি ধরলাম। নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলাম ওকে। জিজ্ঞেস করলাম, তুই আমার কাছে পয়সা চেয়ে নিলি না কেন? দু’একটা পয়সা দেওয়া কি এমন ব্যাপার ছিল যে তুই চুরি করলি? ওখানে পড়ার সময় আমার খরচ দিতেন মুজফফরপুরের উকিলবাবু যোগেশ্বর প্রসাদ সিং এবং দ্বারভাঙ্গার উকিলবাবু ধরণীধরজি। দুজনের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল সেসময়। ওরা আমার সামাজিক এবং ধার্মিক বক্তৃতায় মুগ্ধ থাকতেন।
(৯)
দুর্গা সপ্তশতী এবং ফাটা গণেশ
আমার জীবনের আরো একটি ব্যাপার আছে যা সংস্কৃত অধ্যয়নের দিনগুলোর
সাথেই বিশেষ ভাবে সম্পর্কিত। অবশ্য পরেও বজায় থেকেছে। সেটা হল নিয়মিত দুর্গা সপ্তশতীর
পাঠ। কাশিতেই আমি প্রতিদিন নিয়মিত দুর্গা সপ্তশতীর পাঠ শুরু করেছিলাম। বহুদিন থেকেছে
সে অভ্যাসটা। নবরাত্রির দিনগুলোয় তো ক্রমশঃ একবার, দু’বার, তিনবার করতে করতে শেষদিন
নয়বারও পাঠ করতাম। কখনো কখনো পুটিত পাঠও করে ফেলতাম। জানিনা কবে এবং কিভাবে মনে প্রথম
প্রথম ইচ্ছেটা জেগেছিল। পরে তো আমার জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে গেল। মনে নেই দুর্গা সপ্তশতীর
কত কত বই আমি কিনেছিলাম এবং আনিয়েছিলাম। কেননা আজকাল যে বইগুলো ছাপা হয় তাতে বড় বেশি
ভুল থাকে। সেগুলো ঠিক করা জরুরি ছিল। অনেকগুলো বই হাতে থাকলেই সে কাজটা করা যেত। তাছাড়া,
প্রতিটি অধ্যায়ের উপসংহারে এমন কথা লেখা থাকে যেগুলো পাঠের সময় পড়া উচিৎ নয়। আরো কিছু
নিয়ম আছে। এসব সমস্যাগুলোর নিদানের প্রয়োজনে আমি অন্যান্য গ্রন্থও খুঁজলাম। শেষে পন্ডিত
বালকৃষ্ণ মিশ্রজির কাছে এক প্রখর তান্ত্রিকের হাতে লেখা বই পেলাম। তার সাহায্যে আমি
দ্বারভাঙ্গায় নিজের বইটার সংশোধন করলাম। ওখানে একটি ছাপা বইও পেলাম। পন্ডিত বালকৃষ্ণজি
ওই ছাপা বইটাকেই প্রামাণ্য বললেন। তাই অনেকদিন আমি সেই বইটারই পাঠ করতে রয়ে গেলাম।
অনেকের ধারণা যে সারা জীবন দুর্গা সপ্তশতী পাঠের এই অনুষ্ঠানটা করার ফলেই আমার বুদ্ধি
এত তীক্ষ্ণ। কে বলবে, আসলে কী? বুদ্ধি তো আগেও তীক্ষ্ণই ছিল।
কাশীতেই লেখাপড়া করার সময় ফাটা গণেশের মন্দিরের ওপর একটা ছোটো ঘর
ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছিলাম। যদ্দুর মনে পড়ে, ১৯১৩-১৩ সালের কথা। নির্জন জায়গা।
কোনো বাধা আসত না। একবার এমন হল যে পাশে থাকা একটি বড় বাঁদরকে কয়েকজন উত্যক্ত করে তাড়া
করল। হঠাৎ সে আমার ঘরের ওপর উঠে এল। ভীষণ রেগে ছিল। আমি ওর হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলাম।
তাড়াতাড়িতে ঘরে ঢুকে দরজা বন্দ করতে পারা অসম্ভব দেখে আমি দুই হাতে একটা থাম ধরে ঝুলে
পড়লাম। কিন্তু ও আমার হাতের ওপর হামলা করল। ফলে হাত ছেড়ে গেল। আমি নিচে গিয়ে পড়লাম
আর বাঁ পায়ের গোড়ালির ওপরের অংশটা জোরে একটা কোনাকাটা পাথরের থামে গিয়ে ঠোকর খেল। নিচে
ওপরে সর্বত্র পাথরেরই দেয়াল আর মেঝে থাকা সত্ত্বেও আর কোথাও চোট লাগল না; শুধু গোড়ালির
ওপরের জোড়ের হাড়টা ভেঙে গেল। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। যেমন তেমন করে আমায় উঠিয়ে ওপরের
ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। বন্ধুরা যারা ছিল, হাড় ঠিক করার চেষ্টায় রত হল। আমার তো চলাফেরা
করাও অসম্ভব ছিল। স্বামী পূর্ণানন্দ সরস্বতী সে সময় দিন রাত আমার সঙ্গে থেকে অনেক সেবা
করেছিলেন। আমি তো একাই থাকতাম। শীতের দিন ছিল। ধীরে ধীরে আর সমস্ত কষ্ট তো চলে গেল।
ফোলাটোলাও গেল। কিন্তু যেখানে হাড় ভেঙেছিল বা সরেছিল সেখানে একটু ফোলা রয়ে গেল। ভিতরে
কোনো ছুঁচলো জিনিষ ফুটছে মনে হত। তবুও, ভালো করে চলাফেরা করতে পারছিলাম। কয়েক মাস পরে,
গরমকালে হঠাৎ একদিন আজমগড়ের কান্ধরাপুর থানার টীকাপুর গ্রামে শ্রী মথুরা প্রসাদ সিং
রইসের বাড়িতে গেলাম। আগেও যেতাম। সেখানেই হাড় মেরামত করার এক কারিগর আবার থেকে ভাঙা
হাড়ের জায়গাটা একটু ঢিলে করে ফুটতে থাকা হাড়টা ঠিক করে দিল। কিন্তু ছোট্ট একটা হাড়
নিজের জায়গা থেকে যে সরেছিল সেটা সরেই রয়ে গেল। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ায় আর সেটাকে
জায়গা মত বসান গেল না। যাহোক, ফোটা আর ফোলা দুটোই চলে গেল। আর কোনো কষ্ট ছিল না।
কাশীতে থাকার সময় আমি যে ছাত্রদের ন্যায় এবং বেদান্ত ইত্যাদি পড়াতাম
তার মধ্যে দু’তিনজন দ্রবিড় ব্রাহ্মণ ছিল। নাম ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু পন্ডিত মুক্তিরাম
শর্মা এবং ব্রহ্মচারী রামেশ্বরদত্তের নাম ভালো করে মনে আছে। পন্ডিত মুক্তিরাম শর্মা
তো প্রাচীন ন্যায়ের ন্যায়-কুসুমাঞ্জলি ইত্যাদি গ্রন্থ পড়েছিলেন আমার কাছে। ব্রহ্মচারীজি
ন্যায় বেদান্ত ইত্যাদি সবকিছুও পড়তেন। উনি বেশ পটু এবং বাগযুদ্ধে প্রবীণ ছিলেন। চালাক-চতুরও
ছিলেন খুব। কিন্তু বামমার্গের সাথে সংস্রব হয়ে গিয়েছিল। তাই সেই তান্ত্রিক রীতিতে পুজোপাঠ
করতেন যাতে মদ্যমাংসের সেবন শামিল থাকে। আমি একদিন ফাটা গণেশেই পড়াবার সময় কিছুটা আন্দাজ
করলাম যে উনি সেইরকমই পুজো করে আসছেন। জিজ্ঞেস করাতে স্বীকারও করলেন। পরে তো গুজরাতে
বা কাঠিয়াওয়াড়ে বা ওইদিকেই কোথাও নর্মদার তীরে গিয়ে বসবাস করা শুরু করলেন। সেখানে ভক্তমণ্ডলীও
জোটালেন। শুনেছি, তিনি বেদান্ত বিষয়ে উচ্চশ্রেণির গ্রন্থ ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’র হিন্দী অনুবাদ
করেছেন এবং ছাপিয়েছেন। আমি সেই অনুবাদও দেখিনি আর তাঁর সাথে বেনারসের পর কখনো দেখ হয়নি।
মুক্তিরামজির সাথেও ফের কখনো দেখা হয়নি আমার।
কাশীতে থাকার সময়কার একটা ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মঠ থেকে আলাদা হয়ে আমি যখন এদিকে ওদিকে থাকতাম সে সময়, ফাটা গণেশে যাওয়ার আগে লক্ষ্মী কুন্ডের কাছে একটা বড় বাড়িতে উঠেছিলাম। সেখানে ইংরেজি পড়া ছাত্ররাও থাকত। সে সময়েই কয়েকটি বাঙালি ছেলে (যুবক) পাশের মাঠে বল টল নিয়ে খেলত। আমি কী করে জানব যে তাদের মধ্যে এমন ছেলেরাও ছিল যারা পরে বেনারস ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ফাঁসল। সেসব দিনগুলোয় তো আমি রাজনীতি থেকে অনেক দূরত্বে ছিলাম। সেই বাড়িতেই একদিন ছাত্রদের জিনিষপত্র রাতে চোরে নিয়ে গেল। পুলিশ তদন্ত করতে এল। আমাকে সাধুর বেশে দেখে জিজ্ঞাসাবাদ করল। পরে জানতে পারলাম যে আমার ঘরেও পুলিশ ঢুকেছিল এবং [চুরি যাওয়া জিনিষপত্রের] অনুসন্ধান করেছিল। এই তো ইজ্জত সাধুদের!
(১০)
গুজরাতের পথে এবং আবার ফেরৎ
১৯১২ সালের কথা। আমার সঙ্গী পন্ডিত হরিনারায়ণজি আবার একবার আমার
কাছে এলেন এবং সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য নিজের ব্যাকুলতা দেখালেন। শেষে গুরুজির কাছে নিয়ে
গেলাম। ওনাকে সন্ন্যাস দেওয়ালাম। গ্রীষ্মের দিন ছিল। বোধহয় জুন হবে। তারপর উনি বলতে
লাগলেন যে এখানে খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা উত্যক্ত করবে … আর আমার দর্শন পড়ারও ভীষনরকম
ইচ্ছে আছে আর আপনার থেকে ভালো শিক্ষক আর কে হবে … যাতে সারা জীবনের আকাঙ্খাটা পুরো
করতে পারি। সোজা মানেটা ছিল যে কাশী ছেড়ে কোথাও বাইরে যাওয়া উচিৎ। আমি প্রস্তুত ছিলাম
না। কিন্তু ওনার অনুগ্রহ স্বীকার করতাম। আগে আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছেন। সে ঋণ আমার
কাঁধে ছিল। আজ নিজেই আমার কাছে শিখতে চাইছিলেন। কিভাবে না করতাম? ঋণ তো ফেরৎ দিতেই
হত। ব্যস, রওনা হতে তৈরি হয়ে গেলাম। এবার আর হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কথা উঠল না। বইও বেশি
বওয়ার ছিল। তাই ট্রেন ধরলাম।
যদ্দুর মনে পড়ে, কাশী থেকে সোজা দিল্লী গেলাম। সেখান থেকে ভিওয়ানি
গিয়ে পৌঁছোলাম। শহরের কাছে বাইরের দিকে একটা মন্দির ছিল। সে মন্দিরের হাতায় বাইরের
দিকে ছোট ছোট ঘর ছিল। ঘরগুলো ধর্মশালার কাজ দিত। বেওয়ারিশ এবং আশ্রয়হীন মানুষেরা ওতে
উঠত। আমাদের তো মন্দিরের পুজারি ওঠাল মন্দিরের পাশেই একটি সুন্দর বাড়িতে। একদিন সে
টাকার মোহ নিয়ে একটা আকর্ষণীয় গল্প শোনাল। একটা ঘর দেখিয়ে বলল যে অনেক দিন আগে এই ঘরে
এক ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ থাকত এবং ভিক্ষে চেয়ে দিন চালাত। একদিন তার কলেরা হয়ে গেল। কেউ
তো ছিল না ওকে দেখাশোনা করার। আমি জিজ্ঞেস করতে গেলাম যে যদি পয়সা থাকে তো ওষুধ আনিয়ে
দিচ্ছি, বল। সে বলল তার কাছে পয়সা কোথায়? তবুও যেমন তেমন করে তার ওষুধপত্র চলতে লাগল।
ছিল তো বেওয়ারিশই। ধীরে ধীরে রোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করল। আমি তার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস
করলাম। আবার বললাম, পয়সা থাকে তো দে, বাড়িতে তোর ছেলেকে টেলিগ্রাম করে দিই। ফের সেই
একই জবাব, পয়সা কই। পরে মরে গেল সেই ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ। যেমন তেমন করে আমরা তার দাহ-টাহ
করিয়ে দিলাম। পুজারি তারপর বলল ভিক্ষুকের বলা শেষ কথাটা। ঘরের বাইরে ছাইয়ের গাদা ছিল
যাতে সে নিয়মিত আগুন জ্বালিয়ে নিজেকে গরম রাখত। অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ঘরের ভিতরে থাকা
শুরু করেছিল। ভিক্ষুক বলল আমার খাটটা দরজার সামনে করে দিন। পুজারি বলল, আমরাও ভাবলাম
মৃত্যু তো নিশ্চিত; শেষ ইচ্ছে পুরো করি না কেন? তাই খাট সামনে করে দেওয়া হল আর ভিক্ষুক
সেই ছাইয়ের গাদার দিকে দৃষ্টি রেখে মরে গেল। যখন আমরা তার দাহ-টাহ করিয়ে পর সেই ছাইয়ের
গাদা সরাবার চেষ্টায়, লোক লাগিয়ে ওঠাতে গেলাম, তখন ওর ভিতর থেকে ঝনঝন করে টাকা পড়ল।
পুরো তিনশো টাকা ছিল। সে টাকার প্রতি তার টান এমন ছিল যে না ওষুধ আনাতে এক পয়সা খরচ
করল আর না টেলিগ্রাম পাঠাতে। টেলিগ্রাম দিলে তার ছেলে এসে নিয়ে তো যেত। শেষ অব্দি সেই
টাকাগুলোর ওপর দৃষ্টি রেখে সে মরল। টাকাগুলো দেখতে থাকার জন্যই সে দরজার কাছে খাটটা
করিয়ে ছিল। ঘরে কোনা থেকে ছাইয়ের গাদাটা দেখা যেত না। একে বলে টাকার প্রতি মোহ। টাকাটা
না তার নিজের কাজে এল না ছেলেমেয়ের কাজে।
ভিওয়ানি থেকে ফুলেরা হয়ে জয়পুরের পথে আমরা আজমের পৌঁছোলাম। সেখান
থেকে পুষ্কররাজ গেলাম। পুষ্কর শহর এবং সেখানকার অবস্থা ফেখলাম। ভারতে ব্রহ্মাজির মন্দির
শুধু পুষ্করেই আছে। আর কোথাও নেই। মন্দিরে গেলাম। দর্শন করলাম। এটা সত্যি যে আমরা এবার
ট্রেনেই সফর করছিলাম। কিন্তু সাথে পয়সা ছিল না। লোকেরাই টিকিট কাটিয়ে দিত। দন্ডী সন্ন্যাসি
হয়ে পয়সা কী করে রাখতাম? পুষ্কর তো হেঁটেই পৌঁছোলাম। ওখানে ট্রেন কোথায়? সেখান থেকে
আবার জুনা (পুরোনো) পুষ্কর দেখতে চললাম। আমাদের সংস্কৃতিতে প্রাকৃতিক – মনুষ্যনির্মিত
নয় – হ্রদ বা পুকুরকেই পুষ্কর বলে। জুনা পুষ্কর দুটো পাহাড়শ্রেণির মাঝখানে। ওখান থেকেই
আজকাল আজমের শহরের জন্য জল আনা হয়। ঘোরাঘুরি সেরে আমরা আজমের ফিরলাম। তারপর ট্রেনে
চড়ে সিদ্ধপুর হয়ে মেহসানা চলে এলাম। মাঝে সিদ্ধপুর ছাড়া কোথাও থামিনি। মেহসামা তো আহমেদাবাদের
কাছে। তার পাশেই দশ বারো মাইলের দূরত্বে আছে পাটন নামে বড় শহর। বড়োদা রাজ্যের বড় হেডকোয়ার্টার
এই শহরটা। আমরা পাটন যাব ভাবলাম আর বেরিয়ে পড়লাম। যদিও মেহসানা থেকে ট্রেনও যায় পাটন
অব্দি। কিন্তু আমরা হাঁটাপথ ধরলাম।
পাটন পৌঁছোবার আগে একটা কথা সিদ্ধপুরের বিষয়ে বলে নিই। ভাগবত ইত্যাদি
গ্রন্থে পড়েছিলাম যে শ্রী দেবহূতির গর্ভ থেকে কপিল ভগবানের অবতার সিদ্ধপুরে হয়েছিল।
তাই সেখানে আমরা নেমেছিলাম। যে মন্দিরটাকে কপিলজির জন্মস্থান বলা হয় তার পাশে একটা
বাওড়ি আছে। সে সময় লম্বা দাড়ি আর জটাওয়ালা এক বুড়ো ব্রহ্মচারী বাবা মন্দিরের অধিষ্ঠাতা
ছিলেন। দন্ডী দেখে উনি আমাদের সম্মান দেখালেন। সত্যি কথা যে শুধু গেরুয়াবস্ত্র দেখে
লোকে তেমন সম্মান দেখাত না। কিন্তু দন্ডী দেখে মানত। বেশ কিছু দিন আমরা ওখানে রইলাম।
ওখানেই সরস্বতী নদীর দর্শন হল। তাতে স্নান করলাম। একটুই জল ছিল। কিন্তু স্রোত বইছিল
নিয়মিত। ওখানে দন্ডী সন্ন্যাসিদের একটা ভালো মঠ আছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাইরের ভড়ংটা
বেশি। কিন্তু প্রায় সবাই “লেখ নোড়া পড় পাথর” [অশিক্ষিত]। সম্মান-টম্মান করেই থাকে লোকে
আর ভালো খাবার, কাপড় পাওয়াই যায়। তাহলে আর লেখাপড়া করে কোন বোকা?
বিপরীতে, অন্যান্য সাধু এবং গেরুয়াধারীরা লেখাপড়া করে ভালো ভালো
পন্ডিত ব্যক্তি হয়। কেননা, লেখাপড়া না জানলে ওদের পুছবে কে? একটা সময় ছিল আগে যখন শ্রী
মধুসুদন সরস্বতী প্রভৃতির মত অকাট্য জ্ঞানী বিদ্বানেরা ছিলেন যাঁরা বেদান্ত ইত্যাদির
সর্বোৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলো তৈরি করলেন। সেখানে আজ দন্ডীদের মধ্যে অধিকাংশই মূর্খদের দল।
জায়গায় জায়গায় ওদের কাজ দেখলাম মঠে জমা হলে শুধু এটুকুই বলাবলি করা যে আজ কোন ক্ষেত্রে
কী খাবার পাওয়া গেছে। কার কী গোত্র এইসব নিয়ে ব্যর্থ আলোচনায় তারা সময় নষ্ট করে। এক
মঠের অধ্যক্ষ দন্ডী আমায় কাশীতে বলল, একবার নাকি এক দন্ডী তার কাছে নালিশ করেছিল যে
অমুক স্বামী নাক বেঁকিয়ে আমাদের ভ্যাংচায়। তার জবাবে সেই অধ্যক্ষ দন্ডী নাকি নালিশ-করা
দন্ডীকে বলেছিল, তুমি হাত ঘুরিয়ে তাকে ভেংচিয়ে দাও। এই তো অবস্থা। মঠ তৈরি হয়ে আছে।
খাওয়ার জন্য ক্ষেত্রও [অন্নসত্র] আগে থেকেই আছে। কাজেই বাড়িতে কাজকর্ম করার যোগ্যতা
হারিয়ে ফেললে এসে সব দন্ডী বাবা হয়ে যায়। সিদ্ধপুরেও এই ব্যাপারই দেখলাম। আমার দন্ড
দিয়ে এক দন্ডীজির খুঁটিতে টাঙান কাপড় (সোলা) হঠাৎ ছুঁয়ে যাওয়ায় তিনি রেগে গেলেন। আমি
জবাব দিলাম, রাগ তো আমার হওয়া উচিৎ যে যে দন্ডকে বিষ্ণু মানি সেটা আপনার অপবিত্র ধুতিতে
ছুঁয়ে গেল। উল্টে আপনিই সংযম হারিয়ে ফেললেন? এই রয়ে গেছে ওদের ধর্মকর্ম।
সিদ্ধপুরে যে দাড়িওয়ালা ব্রহ্মচারী বাবার দেখা পেলাম ওই ধরণের ব্রহ্মচারী
ওই প্রদেশে অনেক থাকেন। একটা পন্থের মত হয়ে গেছে ওরা। বড় একটা দল। তার মধ্যে কয়েকজন
লেখাপড়া জানাও আছে। তবে বেশির ভাগ ওই পুজোপাঠ করা আর লোককে ঠকানোয় ওস্তাদ। প্রচুর খাবার
জোটে। টাকাও প্রচুর আসে। এইসব মহাশয়দের অধিকাংশের চরিত্রও ভয়ানক। ওই প্রদেশে এক তো
বেদান্ত এবং ব্রহ্মজ্ঞানের বাহুল্য, অন্যদিকে পর্দার অভাবে স্ত্রী পুরূষে দেখাসাক্ষাতে
কোনো বাধা নেই – সেক্ষেত্রে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তারপর আমিও এধরণেরই বেশ কয়েকজন
ব্রহ্মচারীর দেখা পেলাম। ফলে একবার ত আমি এতটাও ভেবেছিলাম যে এধরণের চল্লিশটা ব্রহ্মচারী
খুঁজে “ব্রহ্মচারী চালিশা” লিখে ফেলি। কিন্তু সে ভাবনা আর ফলপ্রসূ হল না।
হ্যাঁ, তো বলদের মত কাঁধে বইয়ের বোঝা নিয়ে আমরা মেহসানা থেকে পাটন
পৌঁছোলাম। প্রথম প্রথম ওখানেই সন্ধের সময় বাইরে থেকে আসা গরুর পাল দেখলাম। সিং ছিল
বলদের মত। আকারও সেই ধরণেরই ছিল। খোঁজ নিতে নিতে নাগরওয়াড়া মোহল্লায় পৌঁছোলাম। দন্ডী
স্বামীদের ভক্ত নাগর এবং অন্যান্য গুজরাটি ব্রাহ্মণদের সাথে ওখানে দেখা হয়ে গেল। কাছেই
একটি মন্দিরের পাশে নির্মিত বাড়িতে আমাদের ওঠান হল। চাতুর্মাস্যের সময় ঘনিয়ে আসছিল।
ধর্মশাস্ত্র অনুসারে আমরা সে সময় যাত্রাও করতে পারতাম না।
সন্ন্যাসিদের জন্য পর্যটনের সময় আট মাস আর এক জায়গায় বিশ্রাম নেওয়ার
সময় চার মাস। সেই সময়টাকেই চাতুর্মাস্য বলে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এবং আশ্বিন এই চার
মাস নিয়ে চাতুর্মাস্য। এখন তো দন্ডীরা শ্রাবণ এবং ভাদ্র এই দুই মাসকেই চাতুর্মাস্য
করে রেখেছে। মাত্র ঐ দু’মাস তারা ভ্রমণ করে না আর নদী নালা পার হয়না। পুঁথিতে তো লেখা
আছে যে বছরের এই সময় মাটি হাওয়া এবং চার দিক নতুন নতুন জীবে ভরে যায় এবং চলাফেরা করলে
সে প্রাণের বিনষ্টি হয় অত্যধিক। একই সঙ্গে, তখন নদী নালা জলে ভরে যায় বলে পার করার
সময় ভেসে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই দন্ডীরা যেন সে সময় ভ্রমণ না করে।
যদিও এখন তো আর পায়ে হাঁটার প্রয়োজনও নেই। ট্রেন, মোটরগাড়ি, উড়োজাহাজ,
রাস্তা, পুল কত কিছু তৈরি হয়ে গেছে। তবুও এই নিয়মটা এত কঠোর ভাবে কেন পালন করা হয় বুঝতে
পারি না। ত্রেন তো চলেই। লরিগুলোও চলে। তাদের চলায় জীবে হিংসা হতেই থাকে। সন্ন্যাসিরা
তাতে চেপে ভ্রমণ করলে হিংসাটা বেড়ে তো যাবে না। একেই বলে বাঁধা গৎ।
এ ব্যাপারে কাশীতে একটা মজার কথা আমাদের বলা হয়েছিল। দয়াও হল, হাসিও
পেল আর রাগও হল। চাতুর্মাস্যের সময় ছিল। কিন্তু বৃষ্টি পড়েনি। তাই কাশীর অস্সী নামের
নালাটা শুকিয়ে ছিল। কয়েকজন দন্ডী নালার ওপারে থাকত এবং ওখানেই খাওয়াদাওয়া করত। কিন্তু
ওদের মোহান্ত নালার এপারে মঠে থাকত। একদিন মোহান্তের মনে এল যে ওপারে থাকা দন্ডীদের
কিছু বোঝাবেন। লোক পাঠানো হল আর হুকুম হল যে ওপারেই নালার ধারে এসে ওরা দাঁড়াক। এপারে
যেন না আসে, নইলে ধর্ম নষ্ট হয়ে যাবে। খোদ মোহান্তজী গেলেন, এপারেই দাঁড়িয়ে উপদেশ দিয়ে
ফিরে এলেন। অথচ সে মোহান্তজি এমন যে নিজের মঠ তো ছিলই, টাকা-পয়সাও প্রচুর ছিল; স্বভাবচরিত্রও
ছিল তেমনই। কিন্তু সেসবে ধর্ম নষ্ট হত না। ধর্মটা শুধু শুকনো নালায় পা রাখলে ভেসে যেত।
‘গাছ কেটে পাতায় জল দেওয়া’ একেই বলে। ধর্মের দুনিয়াও এমন অন্ধ যে এটাকেই সঠিক পথ মনে
করে।ধর্মের ব্যাপারে বুদ্ধির কোনো জায়গা নেই।
আসলে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা তো আমার ছিলই। ওখানকার ব্রাহ্মণেরাও জেদ
ধরল যে আমরা যেন থেকে যাই। ওরা নিজেরাও একটু পড়াশোনা করতে চাইছিল। এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও
ছিলেন, মরণাপন্ন অবস্থায়। তাঁর দন্ডী হওয়ার ছিল, যাতে অন্তিম সময়ে সদ্গতি প্রাপ্ত
হন। তাই স্থির হল যে শ্রাবণ আর ভাদ্র এখানেই থাকি। তারপর দেখা যাবে।
সেই পাটনেই এক নাগর-ব্রাহ্মণ ভাই উমাশঙ্করজির বাড়িতে প্রথম দেখা
হল ডঃ সুমন্ত মেহতার সাথে, যিনি গুজরাটের প্রসিদ্ধ জনসেবক এবং ত্যাগী মানুষ। শ্রী উমাশঙ্কর
ভাই বাদে আয়াচি মণিশঙ্কর মগনলাল নামে গুজরাটি ব্রাহ্মণ প্রচুর সেবা করেছিলেন আমার।
তাঁর বাবা আয়াচি মগনলালজি মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমার সঙ্গীর কাছ থেকে সন্ন্যাসের দীক্ষা
নিয়েছিলেন। আমাদের পড়া আর পড়ান নিয়মিত জারি রইল। মণিশঙ্করজির বংশটাকেই ‘আয়াচি’ বাহ্মণ
বলা হয়। তাঁরা কখনো পৌরোহিত্য কর্ম বা পুরোহিতগিরি করেননি। তাই আয়াচি বলা হয়। এমনিতে
তো নাগর ব্রাহ্মণেরাও সাধারণতঃ পুরোহিতগিরি করেন না। কিন্তু মণিশঙ্করজির বংশের এটাই
বিশেষত্ব ছিল। তাই তাঁরা বংশগত পদবীই পেয়ে গিয়েছিলেন ‘আয়াচি’।
দু’তিন মাস সময় ওখানে খুব আনন্দে কাটল। ওখান থেকে মাত্র দু’তিন মাইল
দূরেই ছিল সরস্বতী; নদীটি আরো কিছুটা এগিয়ে লুপ্ত হয়ে যায়। কখনো সখনো তার তীরে যেতাম।
ওখানে পীলু গাছের অনেক ঝোপ ছিল।
কিন্তু এই অবসরেই ওই প্রদেশের যা সামাজিক অভিজ্ঞতা হল এবং যাকিছু
ওখানে দেখলাম শুনলাম, সেসবের ফলে মনে কাশীর দিকে ফিরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগল। আমার
সঙ্গী অনেক করে বোঝাল আমায়। কিন্তু আমার আর ওদিকে থাকার সাহস হলনা। দোষ হোক অথবা গুণ,
ছোটবেলা থেকেই আমি নারীসংসর্গ থেকে দূরে থেকেছি। আমার স্বভাবই কিছুটা এমন হয়ে গেছে
যে এধরণের সংসর্গ আমার পছন্দ নয়। কিন্তু ওখানে এই ব্যাপারটা বেশি রকম ছিল আর সেটা আমার
জন্য অসহ্য ছিল। সত্যি কথা এটাও যে আমার মত যুবক সন্ন্যাসির জন্য এ ধরণের সংসর্গ কিছুতেই
বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু কাকে বলতাম সে কথা? ব্যস, এই চিন্তাটাই মাথায় এল যে ফেরা যাক।
পড়ায় যে বাধা এসে পড়েছিল সেটাও এভাবে কাটবে মনে হল। শুধু, আমার এবং আমার সঙ্গীর সম্পর্ক
শেষে আরেকবার ছিন্ন হল। রেলওয়ে পার্সেলে বইগুলো রওনা করিয়ে আমি ওখান থেকে কাশী পর্য্যন্ত
একটাই টিকিট কাটালাম। পথে কোথাও থামার ছিল না। ট্রেনে খাওয়াদাওয়া তো কখনই করতাম না
আমি। কিন্তু যদি লম্বা সফরে তেষ্টায় কষ্ট পাই তাহলে? তার জন্য একটু মৌরি বেঁধে নিলাম।
মৌরি গলা ভিজিয়ে রাখে। ভাবলাম, এই মৌরিই মাঝেমধ্যে মুখে ফেলে চুষব।
এভাবে আবার কাশী এসে পৌঁছোলাম এবং আগের মত পড়া আর পড়ান শুরু করলাম।
মাঝের চার-পাঁচ মাস বেরিয়ে যাওয়ার দুঃখ অবশ্যই হল।
(১১)
অসুখে
কাশীতে থাকার সময় অত্যধিক পরিশ্রমে, ১৯০৯ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে
বেশ কয়েক বার অসুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু ওষুধ খাওয়া তো আমার স্বভাবে ছিলই না। জানি
না কেন বৈদ্য, ডাক্তার আর হাকিমদের আমি আজও ভয় পাই। আমি পছন্দ করি না যে ওরা আমার শরীর
ছোঁবে। আগেও এমনি ছিলাম। এক সময় আমার অজ্ঞাতে কুইনাইন এবং কাঁচা লোহা খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল
বলে আরো সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বলে যে দুধে মুখ পুড়লে ঘোলও লোকে ফুঁ দিয়ে খায় – সেই
রকমই অবস্থা হল আমার।
জীবনে মাত্র দুই বার ভাঙ খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাও না জেনে। একবার
তো ছোটোবেলায় কোনো বরযাত্রীতে – সব সঙ্গীসাথীরা খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল; এক আমিই
কিভাবে জানিনা ওই রকম নেশার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। ফলে আমিই বাকি সবাইকার এবং তাদের
জামাকাপড়ের হেফাজত করলাম। দ্বিতীয় বার কাশীতে ছুটির দিনে বেশ কয়েকজন সঙ্গী মিলে আমায়
বাইরে কুঁয়োয় নিয়ে গেল যে ঘোরাফেরাও হবে আর জল খাব। ওখানেই ওরা ঠন্ডই খাওয়াবার নামে
তাতে ভাঙ মিলিয়ে আমায় খাইয়ে দিল। তখন তো কিছু বুঝলাম না। পরে ফিরে এসে রাত্রে যখন ছাতে
শুয়েছিলাম হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল পুরো ছাতটা ঘুরছে। ভয় পেয়ে অন্যদের বললাম। তারা
শিগগির চাল ধুয়ে সেই জলটা আমায় খাওয়াল। তৎক্ষণাৎ বমি হল আর আমি স্বস্তি অনুভব করলাম।
ঘুমিয়ে পড়লাম তারপর।
বমি করানোর জন্য এই চালের জল খুব কাজের এবং সহজলভ্য। সাপে কামড়ালে
বমি করিয়ে দেওয়াটা কাজের আর সেটা সহজে হতে পারে। নেশা কাটাতে তো জবাবই নেই, সে যে নেশা
হোক – ভাঙ, মদ বা অন্য কিছুর। কিন্তু সেদিন আমি স্থির করে নিলাম যে ভাঙের কছেও যাব
না। পান তো কখনোই খাইনি। ছোটবেলায় হয়ত কখনো খেয়ে থাকব। কিন্তু আঠেরো বছর বয়স থেকে আজ
অব্দি কখনো পান ছুঁয়েও দেখিনি। একই কথা তামাকের ব্যাপারেও। তামাক তো মুখে ছোঁয়াইও নি;
নাকেও ছোঁয়াইনি। মুখের ভিতরে নেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
যখনি জ্বরে ভুগতাম, চুপচাপ পড়ে থাকতাম। ওষুধপথ্যের ধারেকাছেও যেতাম
না। যখন অনেকদিন হয়ে যেত, জ্বর ছাড়ত না কিছুতেই তখন জ্বর নিয়েই টমটমে বসে স্টেশনে যেতাম
আর ট্রেনে চেপে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতাম। কখনো কখনো তো খুব বেশি জ্বরেও, সবার হাজারবার
মানা করা সত্ত্বেও, বাইরে চলে গিয়েছি – হয় ট্রেনেই জ্বর ছেড়ে গেছে অথবা গ্রামাঞ্চলে
কোনো পরিচিত স্থানে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই। কিন্তু জ্বর ছেড়ে গেছে এটা সত্যি। আমিও অবাক
হয়ে যাই, যখন জ্বরে লোকে বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, গায়ে হাওয়া লাগাতেও ভয় পায়, সেখানে
আমি উল্টোটা করলাম কেন আর করা সত্ত্বেও ফল ভালোই হল।
এক বারের কথা তো খুব বেশিরকম মনে আছে যে জ্বরের মধ্যেই ট্রেনে চড়ে
আজমগড় যাচ্ছিলাম। মৌ জাংশনে ট্রেন বদলাতে নামার সময় জ্বরের তাপে পড়ে গেলাম। তারপর কোনো
রকমে ট্রেনে চড়লাম। কিন্তু আজমগড় পৌঁছোতে পৌঁছোতে চাঙ্গা হয়ে গেলাম। অবশ্য ব্যাথা ছিল
শরীরে। গ্রামাঞ্চলে পৌঁছোতেই সেটাও ছেড়ে গেল। এভাবেই, তীব্র জ্বর নিয়ে বড় লাইন ধরে
বক্সার গেলাম একবার। পৌঁছোতে পৌঁছোতে পালিয়ে গেল জ্বর। কাজেই স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটেই
গঙ্গা পার করে ভরৌলি গেলাম।
অসুখবিসুখের মধ্যে আমার যখনই হয়েছে জ্বরটাই হয়েছে, আর আমি সবসময় নিয়ম করে অনশন করেই সেটাকে দূর করেছি। এদিকে দশ বারো বছরে আমি অসুখেই পড়িনি। কিন্তু আগে বছরে এক বার এবং কখনো কখনো দু’বার অসুখে পড়তাম। আকছার পনেরো দিনের অনশনে জ্বর থেকে মুক্তি পেতাম। তারপর দু’তিন মাসে অনশনের দুর্বলতা দূর হত। কিন্তু অন্য উপায় ছিল না। যবে থেকে জলচিকিৎসা জেনেছি এবং তার অভ্যাস করেছি, তবে থেকে, কখনো অভ্যাস ছেড়ে গেলে যখন জ্বর মনে হয়েছে, স্টীমবাথ এবং তারপর হিপবাথ নিয়ে নিয়েছি। সারা দিনে তিন বার করে এ দুটো বাথ নিয়ে জ্বর ভাগিয়ে দিয়েছি। অন্যদের জ্বরও এভাবেই ভাগিয়েছি। জ্বরে স্নান করতে লোকে ভয় পায়। কিন্তু সুফল দেখে সে ভয় নিজেই উবে যায়।
(১২)
ভুমিহার ব্রাহ্মণ সভায়
১৯১৪ সালের ডিসেম্বরের কথা। স্বামী পূর্ণানন্দ সরস্বতী এবং তাঁর
সঙ্গীরা বার বার বলে আমায় রাজি করালো যে আমি যেন ১৯১৪ সালে বলিয়ায় ভুমিহার ব্রাহ্মণ
মহাসভার যে অধিবেশন হওয়ার ছিল তাতে যাই। ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেশি দিন পেরোয়
নি। শেষে আমি রাজি হয়ে গেলাম আর গেলাম বলিয়া।
ঠিক মনে নেই ওখানে দু’বার বলেছিলাম না আরো বেশি বার। তবে এটা ঠিক
যে এক বার সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে উঠে জার্মানির নাম নিয়েছিলাম। কেননা
আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল যে আমাদের পতনের ফলে সংস্কৃতের না জানি কত গ্রন্থের উদ্ধার
করতে হল জার্মানির ম্যাক্সমুলারের মত বিদ্বানদের। যে বেদ গ্রন্থ ছাপা হয়নি, বিশেষ করে
ঋগ্বেদ, সে তো উনিই ছাপালেন। মীমাংসা দর্শনের অন্তর্গত প্রভাকরের মত, যা প্রভাকরের
লেখা, এখানে পাওয়াই যায়না। তার হাতে লেখা একটি প্রতিলিপি একবার আর্মানি থেকেই এখানে
এসেছিল। জার্মানির নাম নিয়েছিলাম এখানকার ব্রাহ্মণদের ধিক্কার করার জন্য। ভুমিহার ব্রাহ্মণেরাও
ব্রাহ্মণ, তাই ওদেরও কথা শুনিয়েছিলাম। কোনো রাজনৈতিক অর্থ ছিলইনা আমার কথার। রাজনীতি
তো আমি জানতামও না সে সময় যা জিনিষটা কি। সত্যি কথা এটাই যে যুদ্ধের গুরুত্ব এবং গূঢ়
ব্যাপারগুলো সম্পর্কেও আমি একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। শুধু শুনেছিলাম যে জার্মানি
আর ইংল্যান্ডের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু উপরোক্ত কারণেও জার্মানির নাম নেওয়া
বোধহয় অক্ষম্য অপরাধ ছিল। ফলে সভাপতির ইশারায় এক ভদ্রলোক এসে আমায় আস্তে করে বললেন
যে আমি যেন জার্মানির প্রশংসা না করি।
আসলে ওখানে জমিদার এবং রাজামহারাজাদের ভীড় ছিল এবং স্বভাবতঃ তারা
রাজভক্তই হয়। তাই কিভাবে হজম করত আমার কথাগুলো? পরে আমি জানতে পারলাম যে ভুমিহার ব্রাহ্মণদের
নামে সভা দাঁড় করিয়ে তারা নিজেদের কাজ হাসিল করে এবং সমাজের তরফ থেকে সবসময় সরকারকে
রাজভক্তির আশ্বাস দেয়। রাজনীতির হাওয়া এভাবে প্রথমবার অজান্তেই আমার অন্তরে সজোরে আঘাত
করল। যদিও সে সময় আঘাতটা আমি অনুভব করতে পারিনি।
ওখানে আরেকবার আমি কথা রেখেছিলাম এবং সবাইকে বলেছিলাম ব্রাহ্মণ ধর্ম
কী। শাস্ত্রকথার ভিত্তিতে প্রমাণ করেছিলাম যে “পুরুতগিরি করা ব্রাহ্মণের জন্য একেবারেই
জরুরি নয়”।
বরং, আচার্যরা পুরুতগিরিকে নিন্দার যোগ্য বলেই মনে করে এসেছেন। ব্রাহ্মণদের
জন্যও পুরুতগিরি থেকে অনেক ভালো চাষবাস করা। চাষবাসের অভাবেই তার পুরুতগিরির দিকে যাওয়া
উচিৎ ইত্যাদি। মনুর উদ্ধৃতি দিয়ে আমি চাষ এবং ব্যাবসার কথাটা প্রমাণ করলাম কেননা চতুর্থ
অধ্যায়ের শুরুতেই উনি ব্রাহ্মণের জীবিকা গোনাতে গিয়ে “ঋতামৃতাভ্যাং জীবেত্তু মৃতেন
প্রমৃতেন বা”, “প্রমৃতং কর্ষণং স্মৃতম্”, “সত্যানতং তু বাণিজ্যং তেন চৈবাপি জীব্যতে”
ইত্যাদি কথাগুলো বলেছেন।
মহাভারতের শান্তিপর্ব থেকে “ব্রাহ্মণা দ্বিবিধা রাজন ধর্মশ্চ দ্বিবিধা
স্মৃতঃ । প্রবৃতশ্চ নিবৃতশ্চ নিবৃতোSহং প্রতি গ্রহাত” উদ্ধৃত করে আমি বললাম যে প্রবৃত
এবং নিবৃত অথবা যাচক এবং অযাচক এই দুই ধরণের ব্রাহ্মণ সব কালেই হয়ে এসেছে। ফলে আপনারা
নিবৃত বা অযাচক। আমার এসব কথাগুলো ওদের সবার কাছে নতুন দুনিয়ার অদ্ভুত জিনিষ মনে হল।
হঠাৎ যেন চোখ খুলল ওদের। দেখল, এসব কী? ওরা তো নিজেদের অধঃপতিত মনে করত। কিন্তু এখানে
উল্টো শুনতে পেল। বিপরীত! সবাই আশ্চর্যচকিত ছিল।
আমিও ওদের ভাবভঙ্গী দেখে একভাবে ক্ষুব্ধই হলাম এবং মনে আঘাত পেলাম।
আমি ভাবতাম যখন ভুমিহার ব্রাহ্মণে ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটা আছে, যেমন কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ,
মৈথিলিব্রাহ্মণ ইত্যাদিতে আছে, তখন ব্রাহ্মণত্বের গর্ববোধ তো থাকবেই ওদের মধ্যে। এও
শুনেছিলাম ওরা ২০-২৫ বছর ধরে নিয়মিত এই সভা করছে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে ওরা নিজেদের
এত অধঃপতিত মনে করে। আমার সংস্কারগুলো তো ব্রাহ্মণেরই সংস্কার ছিল।
উপনয়ন সংস্কার এবং সান্ধ্যোপাসনাদি সব সময় ব্রাহ্মণোচিত হয়েছে। বংশও
তেমনই ছিল। তাই আমিও আশ্চর্যচকিত হলাম এবং মনে এক বার প্রশ্নটা এল যে আমি কি এদের স্বাভিমানের
পথে নিয়ে যেতে পারি না? এটা কি আমার কাজ নয়? এদের ব্রাহ্মণত্ব জাগিয়ে তোলা আমার কর্তব্য
নয় কি? তক্ষুনি চলেও গেল।
আবার কাশীতে ফিরে এলাম আর লেখাপড়ায় মন বসালাম। কিন্তু মনে এসে লাগা ধাক্কাটা অজান্তেই আমার জীবনের মধ্যভাগের (সন্ন্যাসি জীবন) মধ্যখন্ডের পরিসমাপ্তি শুরু করে দিল। সেটা আমি লক্ষ্য করতে পারলাম না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ধাক্কাটা অদৃশ্যভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছিল আর এভাবে, মধ্যভাগের উত্তরখন্ডের প্রস্তুতি হয়ে গেল।
মধ্যভাগ - উত্তরখন্ড
(১)
সামাজিক কাজে কেন ঢুকলাম
বালিয়ার ভুমিহার ব্রাহ্মণ সভার যে প্রভাব আমার মনের ওপর পড়েছিল অন্যান্য
কিছু ব্যাপারও তাতে সাহায্য করেছিল। ফলে শুধু ব্রহ্মজ্ঞানে আনন্দিত থাকা এবং নিজেরই
মুক্তির চিন্তা করার বদলে মনে ভাবনা আসা শুরু হল যে একটু সমাজসেবা করা এবং এধরণের অধঃপতিত
মানুষদের ওপরে তোলা দরকার। একটা কথা এখানে বলে দেওয়া উচিৎ যে আগেও অনেক সভায় অনেকবার
সুযোগ হয়েছিল ধার্মিক বক্তৃতা দেওয়ার। একবার কাশীতে পড়াশোনা করার সময় ভারত ধর্ম মহামন্ডলের
ধার্মিক সমারোহে কোনো ধার্মিক বিষয়ে আমি ভালো উপদেশ দিয়েছিলাম। শ্রোতারা আকৃষ্ট হয়েছিল।
তাই তার কিছুদিন পরেই মুলতানে সনাতন ধর্মসভার অধিবেশনে আমি আমন্ত্রিত হলাম। এভাবে প্রথম
ওদিকে যাওয়ার সুযোগ হল। সমস্তিপুরে, দ্বারভাঙ্গায় গিয়ে তো এরকম কতবার আমি উপদেশ দিয়েছিলাম।
কিন্তু সামাজিক ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার ঔৎসুক্য ছিল না। ধর্ম তো আমার
বিষয় হতেই হত। সন্ন্যাসি ছিলাম যে! কিন্তু সামাজিক (social) কাজ তো স্থুল দৃষ্টিতে
ধর্মের আওতায় আসে না। তাই হঠাৎ করে ওদিকে দেখার প্রবৃত্তি হয়নি। আসলে তখন অব্দি সামাজিক
কাজের গুরুত্ব এবং যাথার্থ্য আমি হৃদয়ঙ্গমই করতে পারিনি। পূঁথি, বই আর বক্তৃতার মাধ্যমে
ব্যাপারটা ঠিকমত বোঝাও যায়না। এটা তো ঘটনারই কাজ যে চিত্তের গভীরে তার গুরুত্ব, প্রাথমিকতা
এবং করণীয় কর্ত্তব্য অঙ্কিত করে দেয়। বালিয়ায় সেটাই হয়েছিল। ভুমিহার ব্রাহ্মণ সমাজে
ব্রাহ্মণোচিৎ গর্বের অভাব, সেই অনুসারে কর্তব্য এবং আচরণের একান্ত অভাব এবং সে কারণেই
পুরো সমাজটা সম্পর্কে অন্যান্যদের অত্যন্ত কুৎসিত এবং ভিত্তিহীন কল্পনার ফলে ওই সমাজের
অনেক সাচ্চা সেবক বিচলিত এবং মর্মাহত অবস্থায় ছিল। ওদের ভিতরে এক অস্থিরতা ছিল যে কি
করে এর সমুচিত প্রতিকার হবে। নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে এ কাজ তারা করতও। কিন্তু কাজটা
তাদের কাছে সমুদ্র-মন্থনের মত বা হিমালয়-আরোহণের মত ছিল। তাই করে উঠতে পারছিল না। এমনই
ধারণা হল আমার। এটাও অনুভব করলাম যে খোদ ওদের মধ্যেই আত্মবিশ্বাস নেই। মন দ্বিধাগ্রস্ত।
এটাই ওদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাই সফলতায় বাধা আসছিল। বালিয়ায় এটাই তো প্রত্যক্ষ করলাম
যা আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করল।
পরের ঘটনাগুলোয় আমার ধারণা দৃঢ়তর হল। হ্যাঁ, ওদের মধ্যে একজনের বিষয়েই
জানতে পারলাম যে অসীম আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়সংকল্পের সাথে তিনি কাজে লেগে ছিলেন। কিন্তু
আমার এ তরফে আসার আগেই তিনি গত হয়েছেন। তিনি ছিলেন মুঙ্গের জেলার বেগুসরাই এলাকার দাহিয়া
গ্রামের পন্ডিত ভাইলালজি পরমহংস। ছিলেন মৈথিল ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভুমিহার ব্রাহ্মণদের
সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণে এদিকে এদের সাথেও যুক্ত ছিলেন আর ওদিকে মৈথিলদের
সাথেও। তাই এঁদের পরিচিতি হিসেবে একটি শব্দ ‘দোগামিয়াঁ’ প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। মানে
হল, ভুমিহার এবং মৈথিল, দুজনের সাথেই যে সম্পর্ক রাখে। তাই ভুমিহার ব্রাহ্মণদের পতন
এবং সংস্কারহীনতা তাঁর খুব খারাপ লাগত। কাজে নেমেওছিলেন সেজন্যই যে এদের এই দুরবস্থা
যেন শেষ হয়। কিন্তু লেখাপড়া কম জানতেন। তাই পুরোপুরি সফল হতে পারেন নি।
আজ যখন ভাবি, হাসি পায়। স্বামী পূর্ণানন্দজি এবং অন্যান্যরা আমায়
বার বার এটাই বলতেন যে ভুমিহার-ব্রাহ্মণদের বিষয়ে হাজার-পাঁচশোটা শ্লোক রচনা করে একটা
বই তৈরি করে দিন আর পরশুরামজির গল্পের ওপর ভিত্তি করে ওদের এধরণের একটা ইতিহাস লিখে
দিন। কিছুটা সময় গেলে সেটা নিজে থেকেই প্রামাণ্য হয়ে যাবে। তাঁদের কল্পনায় ছিল যে সংস্কৃতে
পদ্যরচনা হলেই সেটা একটা প্রামাণ্য জিনিষ হয়ে যাবে এবং মানুষজন সেটাকে মানতে বাধ্য
হবে। সংস্কৃতের কিছুটা এমনই গুরুত্ব হিন্দু সমাজে এবং বিশেষ করে সনাতনপন্থীদের মধ্যে
রয়েছে। ‘মিয়ার দৌড় মসজিদ অব্দি’ বাগধারা অনুসারে তাদের জন্য এটাই অনেক ছিল, এটাই তারা
যথেষ্ট মনে করত। আসলে তারা নিজেরাই বিশ্বাস করত না যে বাস্তবে ভুমিহারেরা কান্যকুব্জ,
মৈথিল ইত্যাদি থেকে কোনো অংশে হীন বা ছোটো নয়। তাদের সংস্কারেই ঢুকে গিয়েছিল হীনমন্যতা।
তাই খুব দূরে তারা যেতে পারত না। আমার জ্ঞাতানুসারে এটাই ছিল তাদের প্রধান দুর্বলতা।
সংস্কারকের ভিতরে এধরণের ন্যূনতা তাকে কখনও সফল হতে দেয় না। কিন্তু আমার তো শৈশব থেকেই
এমন সংস্কার ছিল যে অন্য কিছু আমি ভাবতেও পারতাম না। আমার মধ্যে ব্রাহ্মণত্ব এবং তার
জন্য গর্ব, দুটোই ঠুঁসে ভরা ছিল। ব্যাপারগুলো স্বভাবে এবং আচরণে ঢুকে ছিল। আমার অন্তরে
যেন কেউ ডাক দিত যে আমার পূর্বপুরুষেরা, বুন্দেলখন্ডে নিজেদের জুঝৌতিয়া ভাইদের ছেড়ে
ভুমিহারদের সাথে মিশে যাবার মত মূর্খ ছিল না, যদি না এদের মধ্যেও নিজেদেরই মত ব্রাহ্মণত্ব
এবং যোগ্যতা না দেখে থাকত। আমার হৃদয় বলত যে এটা হতেই পারে না। তাই আমার অটল বিশ্বাস
ছিল যে এই ভুমিহারেরা ঠিক তেমনই ব্রাহ্মণ যেমন মৈথিল, কান্যকুব্জ প্রভৃতিরা। তাই যে
কেউ যতবার ইচ্ছে বলুক, কাল্পনিক শ্লোকের ভিত্তিতে এদের ইতিহাস লেখার কথাটা আমার হৃদয়ে
ঢুকতই না। শুধু তাই নয়, কথাটা শুনে ভীষণ ক্ষোভ এবং কষ্ট হত। কিন্তু বলতাম কাকে? যার
ভিতরে নিজে থেকে ব্যাপারটার ধারণা জন্মায়নি, তাকে এই সব বলা মানে মিছিমিছি ঝগড়া করা।
এটাও সত্যি যে এটা আমার হৃদয়ের স্বাভাবিক একটা ডাক ছিল মাত্র। এর পক্ষে কোনো প্রমাণ
তো ছিল না। তাই বলতামই বা কি? লোকে কথাটাই কেটে দিত। একেই বলে, “উলুবনে মুক্তো ছড়ানো,
অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্”। তাই আপশোষ করে রয়ে যেতাম আর ‘ও তাই’ বলে ওদের খুশি করতাম।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে সঙ্কল্প করে নিলাম যে এক দিকে শাস্ত্র-পুরাণে খুঁজে এবং অন্যদিকে
সব জায়গায় ঘুরে রহস্যটা জানতেই হবে। হ্যাঁ, যদি দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার ধারণাটার প্রমাণ
না পাই এবং আমার হৃদয়ের ডাকটা ভুল প্রমাণিত হয় তখন দেখা যাবে। তখন হয়তো সে ধরণের কোনো
বই লিখব যেমন ওরা বলে। বানিয়ে বানিয়ে লেখা তো আমার স্বভাববিরুদ্ধও ছিল। তবু যদি পূর্বপুরুষদের
ভুলটাই প্রমাণিত হত তাহলে আমি নিরুপায় হতাম। তাই মনে পুরো বিশ্বাস নিয়ে আমি অন্বেষণের
কাজে প্রবৃত্ত হলাম। এসব কাজ তো পুঁথি-পুরাণে আগেও হত। কিন্তু ১৯১৫ সালে, বিশেষ করে
তার উত্তরার্দ্ধে, হই হই করে কাজে লাগলাম। অনেক প্রদেশে ঘুরে নিজে আমি অনুসন্ধান করলাম।
অন্যান্যদের দিয়েও করালাম। ফল হল যে আমার ধারণা এবং অন্তরাত্মার ডাক ষোল আনা সত্যি
প্রমাণিত হল। সেসব কথা পরে লিখেছি যেখানে ভুমিহার ব্রাহ্মণ পরিচয় এবং ‘ব্রহ্মর্ষিবংশ’
বিস্তারের কথা আছে।
(২)
সমাজ সেবা – অভিযোগের জবাব
আগে তো আমার ধারণাই অন্যরকম ছিল। মুক্তি ও জ্ঞানের প্রশ্নে আমিও
সে স্বার্থপরদের মত ছিলাম যারা একান্তে বাসা বেঁধে জীবন কাটিয়ে দেয় এবং ভাবনাচিন্তা
করাটাই হয় তাদের একমাত্র কাজ। শুরুতে তো এই ইচ্ছে নিয়েই বাড়ি ছেড়েছিলাম এবং জঙ্গলের
ধুলো ঘাঁটলাম – কোথায় কোথায় না ঘুরেছি! কিন্তু ভাবনাটা বদলায় নি। আসলে যে বদ্ধ ধারণা
মাথায় নিয়ে লোকে পুঁথি পড়ে, সেই ধারণাগুলোই বলবতী হয়। হ্যাঁ, যদি আগে থেকে কোনো ধারণা
মাথায় না থাকে তাহলে সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু আমি তো বদ্ধ ধারণা নিয়েই পড়াশোনা শুরু
করেছিলাম। তাহলে অন্য কিছু হত কি করে? পরে এই ধারণাটা দূরে সরিয়ে রেখে যখন গ্রন্থগুলোর
মন্থন করলাম তখন অন্য অর্থ প্রতিভাত হল। গীতা প্রসঙ্গে এই কথা পরে লিখব।
হ্যাঁ, তো এদিকের ঘটনাগুলোর মাঝে গিয়ে যখন আমি পড়লাম, অন্তরে মহাভারত
শুরু হল। অন্যধরণের কথা মনে উঠতে লাগল। শ্রীমদ্ভাগবতে কিছু এমন উক্তি পেলাম যা আমার
চোখের পর্দা সরিয়ে দিল। নৃসিংহ এবং প্রহ্লাদের প্রসঙ্গে একটা শ্লোক আসে ভাগবতে যাতে
ভক্তপ্রবর প্রহ্লাদ নৃসিংহ ভগবানকে উত্তর দিতে গিয়ে স্পষ্ট করে দেন যে জনগণের সেবাই
ভগবানের সেবা এবং আরাধনা। তিনি বলেন –
“প্রায়েণ দেবমুনয়ঃ স্ববিমুক্তিকামা
মৌনং চরন্তি বিজনে ন পরার্থনিষ্ঠাঃ।
নৈতান্ বিহায় কৃপণান্ বিমুমুক্ষ একো
নান্যত্বদস্য শরণং ভ্রমতোSনুপশ্যে।”
সারাংশ এই যে ঋষিমুনিরা তো স্বার্থপর হয়ে নিজেদেরই মুক্তির জন্য
একান্তে বাস করেন। তাঁরা অন্যদের চিন্তা করেন না। কিন্তু আমি কখনোই তা করতে পারব না।
সব দুখীদেরকে ছেড়ে শুধু নিজের মুক্তি আমার চাই না। আমি তো অদেরই সঙ্গে থাকব এবং মরব,
বাঁচব। এভাবেই রাজা রহুগণ এবং জড়ভরতের মাঝে কথাবার্তায় পাওয়া যায় যে নিষ্ঠার সাথে নিজের
কর্তব্যপালনই ভগবানের পুজো, ‘স্বধর্ম আরাধনমচ্যুতস্য’। গীতার কথা আর কী বলব। ওতে তো
বার বার ঘোষণা করা হয়েছে যে ঈশ্বরের আরাধনা ধ্যান, সমাধি বা পুজোপাঠে হয় না, মন দিয়ে
নিজের কর্তব্যপালনেই হয়। গীতায় তো এত দূর বলা আছে যে “যা ইচ্ছে করো, খাওদাও, পান করো,
দান দাও, যজ্ঞ করো, তপ করো, সব ভগবানের পুজো হয়ে যাবে যদি পুজোর ভাবে, আসক্তি বাদ দিয়ে
কাজগুলো করো।”
“যত্করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যত।
যত্তাপস্যসি কৌন্তেয় তত্কুরুষ্ব মদর্পণম্” (৯/২৭)
তাই আমার ভাবনাচিন্তা এবার বদলাল। ১৯১৫ সাল পেরোতে না পেরোতে আমি
ধার্মিক এবং সামাজিক কাজে সময় দেওয়ার সঙ্কল্প করে নিলাম। এভাবে ভাবতে গেলে মনে হয় আমি
কোত্থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছোলাম। পরিস্থিতি এমন হল যে যোগী-সন্ধান, প্রাণায়াম এবং সমাধির
মশলামুড়ি ছেড়ে শাস্ত্রমন্থন শুরু করলাম ব্রহ্মজ্ঞানপ্রাপ্তির আনন্দে থাকব। কিন্তু শাস্ত্রমন্থন
শেষ হতে না হতে জনসেবার ঝোঁক হল। ভবিষ্যতে আরো অনেককিছু হওয়ার ছিল। এখন তো সূচনা ছিল
মাত্র, যাকে বলে ইশ্কের ইব্তিদা [প্রেমের সূত্রপাত]। এটাও আমার স্বভাব যে যে কাজে
হাত দিই সর্বশক্তি লাগিয়ে দিই। আধখ্যাঁচড়া কাজ আমার পছন্দ নয়।
এটাও আপনাদের জেনে রাখা উচিৎ যে জনসেবার কথা আমার মনে প্রথম প্রথম
উঠল সেটা সর্বসাধারণের জন্য ছিল না। আমি তো শুধু এটুকুই ভেবেছিলাম যে যাই, ভুমিহার
ব্রাহ্মণদের সমাজটার উদ্ধার করে দিই। তারপর আবার নিজের পড়াশোনা আর ব্রহ্মজ্ঞানপ্রাপ্তির
আনন্দে ফিরে যাব। এক ধরণের মন বদলানোর (diversion) ব্যাপার ছিল শুধু। কে জানত যে এই
মন বদলানোর পথটাই স্থায়ী হয়ে যাবে? শাস্ত্রাভ্যাসের আনন্দ আর জুটবেই না আমার জীবনে?
কে জানত যে এটা ‘ইব্তিদাএ ইশ্ক’ হবে সত্যি সত্যি? আসলে পরিস্থিতিজনিত কারণে শুধু
সেবার ইচ্ছে আর কর্তব্যবোধের বশে এদিকে চলে এলাম, অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই
এগিয়ে যেতে হল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে যদি কোনো বিশেষ অনুরাগে বা বিদ্বেষভাবনায়, তুচ্ছ
স্বার্থে বা নীচ মনোবৃত্তি নিয়ে এ কাজে আসতাম তাহলে এগোনো কঠিন হত।
অনেকে বলেন যে সন্ন্যাসি হয়ে জাতপাতের কাজে নামা উচিৎ হয়নি। আমি
বুঝিনা এধরণের প্রশ্ন কিভাবে ওঠে। যে ঘটনাগুলোর উল্লেখ করেছি সেগুলো তো আমার নিয়ন্ত্রণে
ছিল না। আকস্মিক ভাবে আমায় টেনে নিয়েছিল। আগে থেকে কোনো প্রস্তুতি নিয়ে কি এ কাজে নেমেছিলাম?
যদি কেউ তেমন মনে করে তাহলে সে ভুল করে। আমি তো দেখালাম কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম।
অবশ্য বলা যেতে পারে যে আকস্মিক ভাবে কোনো খারাপ কাজে ঢুকে পড়লে তো আর মানুষকে নির্দোষ
বলা যায় না। কথাটা সত্যি। কিন্তু তার উত্তরও আমি দিয়েছি।
আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে একাজে আসিনি। একটা খুব বড় সমাজ – উচ্চ আর
কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজকে আমি দেখলাম অন্যদের তুলনায় পদদলিত অবস্থায়। দেখলাম সমাজটা ছটফট
করছে, অপমানিত হচ্ছে। কিন্তু কিছু করতে পারছেনা। বিচ্ছিরি ভাবে অপমানিত হলেও প্রতিকার
করতে পারছে না। আমি বিচলিত হলাম এবং ওই সমাজকে ওঠালাম। ওঠাবার চেষ্টা করলাম এবং যারা
অপমানিত করছিল তাদেরকে যথোচিত উত্তর দিলাম, জোঁকের মুখে নুন পড়ল। এতে অপরাধটা কী? খারাপ
কী? পুরো দেশটাকেও তো ওপরেই ওঠাতে হবে। স্বাধীনতার যুদ্ধের অর্থটাই বা কী, যদি দেশকে
ওপরে না ওঠানো হয়? যার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয় বা ছিনিয়ে নেওয়া হয়ে থাকে তার অধিকার
তাকে ফেরত দেওয়ানো, এই তো আমার জ্ঞাতানুসারে স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং আসল সমাজ সেবার রহস্য।
সমষ্টিগত ভাবে পুরো সমাজটাকে উন্নত করাকেই আমি সমাজসেবা এবং সামাজিক
কার্য মনে করি, আর সেটাই আমি প্রথমে আরম্ভ করলাম। তাই তো পরে ছোট সমাজটাকে ছেড়ে সারা
দেশের কাজে আকর্ষিত হলাম বা ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হ্যাঁ, যদি সেই সমাজসেবায় কোনোরকম রাজনৈতিক
প্যাঁচপয়জার বা অন্যদেরকে দাবিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকত তাহলে নিশ্চিত সেটা নিন্দার
যোগ্য এবং খারাপ হত। কিন্তু সেসব কথা স্বপ্নেও আমি ভাবিনি।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার তো ছিল যে সে সময় রাজনীতির অআকখও আমি জানতাম না।
অন্যদেরকে দাবিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন তো ছিলই না আমার সামনে। যারা পড়ে আছে তাদেরকে উঠিয়েই
ফুরসত ছিল না। সেটাই একটা বড় সমস্যা ছিল। শুধু তাই নয়। এই কাজে নেমে প্রথম যে বই আমি
লিখলাম সেই ‘ভুমিহার ব্রাহ্মণ পরিচয়’ বইটা শুরু থেকে শেষ অব্দি ভালো করে পড়ে পক্ষপাতহীন
যে কোনো মানুষ বলতে পারবে কোনো দল বা ব্যক্তিকে দাবিয়ে দেওয়ার সামান্যতম প্রবৃত্তিও
ওতে আছে কি না। বরং তার বিপরীত কথাই বলা আছে বিভিন্ন জায়গায়। পরে গিয়েও কাউকে দাবিয়ে
দেওয়ার প্রশ্ন কখনো আসেনি। রাজনীতির কথা তো প্রথম থেকে শেষ অব্দি আমার মনে কখনো আসেইনি
যে জাতের সংগঠন করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কথা ভাবব।
(৩)
অনুসন্ধান এবং বইপত্র
তা, বিশেষভাবে আমি খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম ১৯১৫ সালের দ্বিতীয়ার্দ্ধে।
তখনো আমার স্পষ্ট মত ছিল এবং এখনো আছে যে যে দল যে সমাজের অঙ্গ বা অংশ, সে সমাজের সাথে
তার বৈবাহিক এবং অন্ন-জলের সম্পর্ক কোথাও না কোথাও অবশ্য থাকবে। নইলে প্রমাণ কি থাকবে
যে দলটা সেই সমাজের অঙ্গ? বা সেই সমাজেরই অন্তর্গত? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি সমাজগুলোর
অনেক অংশ বা টুকরো আছে। সেগুলো যদি কোথাও পারস্পরিক কোনোরকমের বিবাহাদির সম্পর্কের
মাধ্যমে সংবদ্ধ না থাকে, তাহলে কিভাবে সে টুকরোগুলোকে সেই বৃহৎ সমাজের অন্তর্গত বা
তার অংশ ভাবা সম্ভব হবে? অন্য কোনো সমাজের অংশ কেন মনে করা হবে না? একটা কিছু তো চাই
যার ওপর ভিত্তি করে নিশ্চিত করা যেতে পারে যে কোনো একটা সমষ্টি কোন সমাজের অংশ।
তাই স্থির করলাম যে যেখানে-যেখানের ভুমিহার, মৈথিল, সর্যুপারি, কান্যকুব্জ
ইত্যাদিদের সাথে এই ভুমিহারদের সামূহিক ভাবে প্রদেশগত সম্পর্ক আছে, অর্থাৎ যে প্রদেশের
ভুমিহারদের সাথে এদের বেশির ভাগ দেখা যায়, সেখানেই গিয়ে ব্যাপারটার ভালো করে খোঁজ করা
উচিৎ। আমি নিজেই দ্বারভাঙ্গা, ভাগলপুর, মুঙ্গের ইত্যাদি জেলায় গেলাম। আমার সাথে স্বামী
পূর্ণানন্দ সরস্বতীও ছিলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম যখন দেখলাম যে একটা দুটো নয়,
এধরণের হাজার হাজার বৈবাহিক সম্পর্ক বর্তমান। এমন নয় যে সাধারণ মৈথিল এবং ভুমিহারদের
মধ্যেই শুধু এধরণের সম্পর্ক, কুলীন থেকে কুলীন এবং ধনী থেকে ধনী পরিবারদের মাঝেও এধরণের
সম্পর্ক যেমন এখন আছে, একটা ঐতিহাসিক পরম্পরাও আছে তার।
এটা ঠিক যে কোন অজ্ঞাত কারণে এই সম্পর্কগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা
করা হত। তাই জানতে অসুবিধেও হল একটু। কিন্তু ভালো করে খুঁজে, তদন্ত করে আমি সেসব সম্পর্কগুলোর
তথ্য সামনে নিয়ে এলাম। এমনকি মৈথিল-মহাসভার সে প্রস্তাবটাও কোনোরকমে যোগাড় করলাম যাতে
লেখা ছিল যে এধরণের সম্পর্ক বন্ধ করা হোক। এ থেকে আরো বেশি করে প্রমাণিত হল যে সম্পর্কস্থাপন
চলছে। নাহলে থামাবার চেষ্টা কেন? এধরণের সম্পর্কসূত্রে দ্বারভাঙ্গার মহারাজা থেকে শুরু
করে শ্রোত্রিয় যোগ্য এবং অন্যান্য শ্রেণীর মৈথিলদেরও আবদ্ধ পাওয়া গেল। শুধু তাই নয়।
রঘুনাথপুর, পতৌরএ (দ্বারভাঙ্গা) ডজন ডজন এমন চিঠি পাওয়া গেল যাতে ওখানকার ভুমিহার ব্রাহ্মণদের
দ্বারভাঙ্গার মহারাজা এবং তাঁর জ্ঞাতিরা ‘নমস্কার’ জানিয়েছে। নমস্কার জানানোর চলন ব্রাহ্মণদের
নিজেদের মধ্যেই আগেও ছিল এবং এখনও সময়-সময় পাওয়া যায়।
ব্যস, আর কি, স্বামী পূর্ণানন্দজিকে আমি এলাহাবাদ, ফতেহপুর এবং গোরখপুরের
দিকে পাঠালাম যাতে কান্যকুব্জ এবং সর্যুপারিণদের এলাকায় গিয়ে খোঁজ করতে পারেন যে এধরণের
সম্পর্ক হয় কি না। উনি পরিশ্রম করে ঘোরাঘুরি করলেন আর খুঁজে খুঁজে কয়েকশো সম্পর্কের
হদিশ নাম, ঠিকানা সুদ্ধু লিখে নিলেন, যেমন মিথিলায় মৈথিলদের সম্পর্কের ব্যাপারে করা
হয়েছিল। এভাবে, মৈথিল, কান্যকুব্জ এবং সর্যুপারি ব্রাহ্মণদের সাথে ভুমিহার ব্রাহ্মণদের
বিয়ের লম্বা ফিরিস্তি তৈরি হয়ে যাওয়ায় আমাদের কাজ হয়ে গেল। দুই গোষ্ঠির ছেলে এবং মেয়েদের
পারস্পরিক বিয়ে হয় কিনা, আমরা নাম এবং গ্রামের ঠিকানা সহকারে সেটাও জানার চেষ্টা করলাম।
এমন নয় যে এক গোষ্ঠির শুধু মেয়ে আর অন্য গোষ্ঠির শুধু ছেলের বিয়ে হয়। কেননা, সাধারণ
ধারণায় কন্যাপক্ষকে বরপক্ষ থেকে ঈষৎ হীন মনে করা হয়। এটাও বলা হয় যে নেওয়ার বেলায় তো
নিজেদের থেকে ছোট জাতের কন্যাও নেওয়া হয়, কিন্তু দেওয়া হয়না। কিন্তু যেখানে দেওয়া এবং
নেওয়া দুটোই চলে সেখানে একথা খাটে না।
এই অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সমস্ত সংস্কৃত গ্রন্থগুলোরও তত্ত্বতালাশ
করলাম। হিন্দি এবং ইংরেজিরও বেশ কয়েকটি বই পড়ে ফেললাম। যেখানে যেখানে ভুমিহারদের বিরুদ্ধে
দোষারোপ পেলাম সেগুলো পড়ে সংগ্রহ করে রাখলাম।
তারপর ‘ভুমিহার ব্রাহ্মণ পরিচয়’ নামের বইটাতে শুধু দোষারোপগুলোরই
উত্তর নয়, সমস্ত শাস্ত্রগত এবং অন্যান্য প্রমাণ বিস্তারিত ভাবে দেওয়ার সাথে সাথে বৈবাহিক
সম্পর্কের দীর্ঘ সূচিটা প্রকাশ করে দিলাম। ‘নমস্কার’ প্রণাম লেখা পূর্বোল্লিখিত চিঠিগুলোও
হুবহু ছেপে দিলাম। এভাবেই লিখলাম আমার এই প্রথম বইটা। পৃষ্ঠা হল প্রায় চারশো। বইটার
সমালোচনায় পন্ডিত মহাবীর প্রসাদ দ্বিবেদী ‘সরস্বতী’তে লিখলেন, “বইয় কোনো কথা বাদ যায়
নি। ভালোই। আলাদা আলাদা প্রস্তাবে সবক’টি দিক নিয়ে বিস্তারিত এবং প্রামাণ্য আলোচনা
করা হয়েছে।”
বইটা ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটা লেখার বা প্রকাশিত হওয়ার আগে
অনেক সভায় আমি কথাগুলো রেখেছিলাম। কয়েকজন অবাক হয়েছিল, কয়েকজন আনন্দিত হয়েছিল। ওদিকে
যারা ভুমিহারদের দাবিয়ে রাখতে চাইত, নীচ মনে করত এবং নিজের ব্রাহ্মণত্বের ডিঙ হাঁকত,
তারা অস্থির হয়ে উঠল। এক ধরণের চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল তাদের মধ্যে। এমনকি, এত দূর বলতে
শুরু করল যদি ভুমিহারেরা সত্যি সত্যি ব্রাহ্মণ হয় তাহলে নিজেদের জন্য পুরোহিতগিরি নিজেরাই
কেন করে না, নিজেরাই দান নেয় না কেন? এই প্রশ্নটা আন্দাজ করে আমি আমার বইটাতে দু’তিন
জায়গায় আগেই লিখে দিয়েছিলাম যে “দান নেওয়া এবং পৌরোহিত্য করা ব্রাহ্মণদের জন্য জরুরি
নয়। কিন্তু যদি বিরোধীরা বার বার এই একই কথা বলে, যেহেতু ভুমিহারেরা পুরোহিতগিরি করে
না তাই তারা অব্রাহ্মণ এমন প্রমাণ করার অপচেষ্টা বন্ধ না করে, তাহলে বাধ্য হয়ে ভুমিহার
ব্রাহ্মণেরাও পুরোহিতগিরি শুরু করবে।” আমি তো সতর্ক করেছিলাম। যাতে বিরোধীরা এধরণের
নিকৃষ্ট কাজ না করে। কিন্তু শুনবে তবে তো? ওদের কুপ্রচার আরো তীব্র হতে থাকল।
তাই ভাবলাম কাজেই এর সমুচিৎ উত্তর দিই। তাই খোঁজ করা শুরু করলাম
যে ভুমিহার ব্রাহ্মণেরাও কোথাও পুরোহিতগিরি করে কি না। কেননা মনে একটা অনুমান ছিল কোথাও
না কোথাও নিশ্চয়ই ভুমিহারেরা দান নেয় এবং পুরোহিতগিরি করে। যাই হোক না কেন, ব্রাহ্মণদেরই
তো ধর্ম এটা, আর যদি পুরোপুরি ছেড়েই দিয়ে থাকে তাহলে আর ব্রাহ্মণত্ব কিসের? খোঁজখবর
নিয়ে জানতে পারলাম, প্রয়াগে ত্রিবেণির সব ক’জন পান্ডাই তো ভুমিহার। ভুমিহারদের সাথেই
তো তাদের সম্পর্ক। একই সঙ্গে হাজারিবাগ জেলার চাতরা সাবডিভিশনে, ইটখোরি আর চৌপারন থানায়
এমন ভুমিহার ব্রাহ্মণ পেলাম যারা মাহুরি বৈশ্য এবং অন্যান্যদের জন্য বারম্বার পুরোহিতগিরি
করে এসেছে। সেটাই ওদের পেশা। গয়ার দেবএ যে সূর্যমন্দির আছে তার পুজারিও দেখা গেল ভুমিহার
ব্রাহ্মণ। এরকম অন্য জায়গাতেও কোনো না কোনো ভাবে এধরণের কিছু কিছু ব্যাপার-স্যাপার
পাওয়া গেল।
ব্যস, আমি দ্বিতীয় বইটা লিখলাম – ‘ব্রাহ্মণ সমাজের অবস্থা’। প্রমাণ
করলাম যে ভুমিহারেরা পুরোহিতগিরি করে এবং স্পষ্ট ভাবে ভুমিহারদের বললাম যে এটা আত্মসম্মানের
প্রশ্ন, সবাই পুরোহিতের কাজ ধরুন। এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে, অনেক জায়গায় পুরোহিতরা বিয়ে,
শ্রাদ্ধ ইত্যাদি করানো বন্ধ দিলি। বলল, যদি ব্রাগ্মণ পাও তো করিয়ে নাও অথবা নিজে করে
নাও। এতে একটা বাধ্যবাধকতাও তৈরি হল। ফলে ভুমিহারেরাও ধীরে ধীরে পুরোহিতগিরি গ্রহণ
করা শুরু করল। আমি হাজার হাজার সভা করে ব্যাপারটার ওপর জোর দিলাম ভালো করে।
এক তো এদের মাঝে সংস্কৃত পড়া মানুষ প্রায় ছিলই না। দুই, এসব কর্মকান্ড
বুঝিয়ে বলার মত উদারমনাও কেউ ছিল না। এমনকি সংস্কৃত পড়ানোও বন্ধ করে দেওয়া হল। তিন,
খোদ ভুমিহার ব্রাহ্মণদের মাঝে যারা বাবু বা সরল, নিরক্ষর ছিল তারাও এই নতুন পুরোহিতগিরির
বিরোধ করছিল। তাই বিরোধিদের যুৎসই জবাব দেওয়ার জন্য “মিথ্যে ভয় এবং ঝুটো অহঙ্কার” নামে
বই লিখলাম। তারই সঙ্গে, কর্মকান্ড এবং জ্যোতিষ নিয়ে বারো’শ পৃষ্ঠার বই লিখলাম হিন্দিতে,
“কর্মকলাপ”। তাতে শুধু মন্ত্রগুলো সংস্কৃতে লেখা। সব কথা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে লেখা
আছে। মন দিয়ে পড়লে যে কেউ কর্মকান্ডি এবং জ্যোতিষি হতে পারে। আমি সংস্কৃতের পাঠশালাও
শুরু করালাম অনেকগুলো এবং ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে সংস্কৃত পড়ানোর ব্যবস্থা করলাম। আট
দশ বছর অব্দি ন্যূনাধিক চলল এই কাজ। বিরোধিরা বুঝতে পারল কার সাথে লড়াইটা বেধেছে তাদের।
ইতিমধ্যে আরো একটা ব্যাপার হল। “ভুমিহার ব্রাহ্মণ পরিচয়”এর প্রথম মুদ্রণের দেড় হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেল এবং দ্বিতীয় মুদ্রণের প্রয়োজন হল। তখন ভাবলাম, ভুমিহারদের মতই ত্যাগী (তগে) এবং মাহিয়াল ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলো আছে যাদের বাস যুক্তপ্রদেশের পশ্চিম প্রান্তে এবং পাঞ্জাবে। তাই, গৌড় এবং সারস্বতদের সাথে তাদের সম্পর্ক তালাশ করে এই দ্বিতীয় মুদ্রণে যোগ করে দেওয়া যাক। তেমনই করা হল। শ’খানেক ভালো ভালো বৈবাহিক সম্পর্ক খুঁজে বার করা হল। তখন আবার মনে হল যে বইএর পুরোনো নামটা আর চলবে না। তাই বইএর নাম বদলে রাখলাম “ব্রহ্মর্ষিবংশ বিস্তর”। আরো কথা আছে। আসলে বইটা সবধরণের ব্রাহ্মণদের নিয়ে ঐতিহাসিক আলোচনা বলে আগেও এই নামটাই হওয়া সমীচীন ছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য মাথায় ছিল বলে হয় নি। তাই এবারে অনিবার্য হল নামটা বদলানো।
(৪)
রাজনীতিতে প্রবেশ
‘পরিচয়’ লেখার পর, যদ্দূর মনে পড়ে, ১৯১৬র শেষে বা ১৯১৭র শুরুতে আমি
গাজিপুর জেলার করিমুদ্দিনপুর থানায় বিশ্বম্ভরপুর গ্রামে চলে গেলাম। দু-আড়াই বছর ওখানেই
থেকে প্রচার করতাম। কাজ পড়লে বাইরে যেতাম। আবার ফিরে আসতাম। ওখানকার জমিদারদেরই আগ্রহে
ওখানে গিয়ে থেকেছিলাম। আমার সেই ব্রাহ্মণত্বের আন্দোলন নিয়েই ওদের, অধিকাংশ নিরক্ষর
গুরুমহারাজেরা ওদের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠেছিল এবং অসহযোগ শুরু করেছিল। ধনী মানুষেরাআ তো
ভীতু হয়ই। ওদের আশঙ্কা ছিল যে গুরু মহারাজদের কোপে ওদের বিনাশ না হয়ে বসে। তাই নিজেদের
সুরক্ষার স্বার্থে আমায় খুব আগ্রহের সাথে রেখেছিল। আমিও গুরুজিদের ভালো করে শিক্ষা
দিয়ে দিলাম। ওরা ঠান্ডা হয়ে গেল। পরে অনুভব করেছি, যে সময় ওখানে খরচ হল, সে সময়ে কয়েক
গুণ বেশি কাজ হতে পারত। জনসাধারণের মাঝে গিয়ে যে কোনো কাজ করলে তার পর্যাপ্ত পরিণাম
পাওয়া যায়। কাজ তাড়াতাড়িও হয় এবং স্থায়ী হয়। কিন্তু ধনীদের মাঝে গিয়ে কাজ করলে বিপরীতটাই
সত্য হয়। তাই হল। তিন বছর পর ওখান থেকে সরলাম। কতদিন থাকতাম? পরে জানতে পারলাম ওখানকার
সব কাজ ব্যর্থ হয়েছে। যা কিছু শিখিয়েছিলাম শেষ হয়ে গেছে।
এটা ঠিক যে ধনীদের মধ্যে গিয়ে থাকার কারণে একটু আরামপ্রিয় হয়ে পড়েছিলাম।
মানে গ্রামের সেই বীতরাগ সাধু যা বলেছিল সে কথাটা আমি অনুভব করলাম।
আগে তো দিনে রাতে একবারই খাবার খেতাম। কিন্তু ওখানে দুবার খাবার খাওয়া শুরু করেছিলাম।
ফলে ঈষৎ রোগীও হয়ে পড়লাম। ভয় হল, পরাধীনতা না চলে আসে জীবনে। এ কথাটাও মাথায় এল যে
এরা যখন আমায় নিজেদের অধীন দেখবে তখন অসম্মান করবে। হাওয়ার গতি টের পাচ্ছিলাম। সবচেয়ে
বড় ব্যাপার ছিল যে ওই দীর্ঘ পরিবারে পড়াশোনার নিতান্ত অভাব ছিল। হ্যাঁ বংশবৃদ্ধির চিন্তা
ছিল বেশি রকম। আমার মত সারাজীবন লেখাপড়ায় মেতে থাকা মানুষ কি করে সহ্য করত এসব? পড়াশোনার
প্রবৃত্তি জাগাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু তা নিষ্ফল হল। শেষ পরিণাম হল যে আমি ওখান থেকে
সরে এলাম। বিশ্বম্ভরপুরের পাশেই ভরৌলিতে বাবু গোকুল রায় নামে, কথার খেলাপ না করা এবং
সাহসী পুরুষ এক ব্যক্তিকে পেলাম।
বক্সারের কাছে, গঙ্গার উত্তরে কোটোয়া নারায়ণপুরে আমি আগেও মাঝে মাঝেই
যেতাম। নারায়ণপুর সব সময় সন্ন্যাসিদের সেবা করে এসেছে। ওখানে গ্রামের বাইরে একটি কুটির
তৈরি করা আছে। কখনো কখনো সাধুরা এসে ওতে থাকেন। সন্ন্যাসি-সেবায় বিশেষ যত্নবান ছিলেন
শ্রী আদিত্য রায়। ওনার ভাই গঙ্গা রায় এবং ওনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরাও সমভাবাপন্ন
ছিলেন। প্রায় পুরো গ্রামটাতেই এই মনোভাবটা আছে। তাই ১৯১৮ সালে যে ওখানে গেলাম, তারপর
বেশ কয়েক বছর ওখানেই থেকে গেলাম। গ্রামটায় পড়াশোনা করার ভালো রেওয়াজ আছে। বেদান্ত ইত্যাদির
আলোচনা চলতে থাকে। ওখানেই থেকে আমি রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো কিছুটা জানলাম। খবরের
কাগজ পড়তাম। হ্যাঁ, পাটনার কয়েকজন বন্ধু এবং ভক্তরা আগ্রহ জানাল যে এভাবে ইংরেজি ভুলে
যাওয়া আপনার জন্য ঠিক নয়; যদি কোনো সামাজিক বা অন্য কাজ করতে হয়, ইংরেজি দরকার। ওরা
আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করাল যে ইংরেজি খবরের কাগজ পাঠালে যেন আমি নিশ্চিত পড়ি। তাই ওরা
পাঠাত আর আমি পড়তাম। রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা আমি ওখানেই পড়লাম এবং পাঞ্জাবে
মার্শাল ল সম্পর্কিত ঘটনাবলীর বর্ণনা পড়লাম। তারপর, কংগ্রেসের যে অধিবেশন হল অমৃতসরে
তার সমস্ত বিবরণ পরলাম। এভাবে, যদিও রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমি জানতাম না, ঘটনাচক্রে
সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া শুরু করলাম।
আমার ভাল করে মনে আছে যে নারায়ণপুরেই আমি হিন্দি খবরের কাগজ ‘প্রতাপ’
পড়তাম। প্রতাপেই স্বর্গীয় লোকমান্য তিলকের মৃত্যুর খবর পড়লাম। কাগজে ওনার একটি ছবি
দিয়ে এক কোনে জন্মতিথি এবং আরেক কোনে মৃত্যুতিথি লেখা ছিল। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীও লেখা
ছিল। শেষে ছিল এই কবিতা –
তাঁর মৃত্যু তো হল ১৯১৯ সালের ৩১শে জুলাই মধ্যরাতের পর। পয়লা আগস্ট
খিলাফত কনফারেন্সের তরফ থেকে অসহযোগ দিবস পালন করার ছিল। গান্ধিজি পক্ষে ছিলেন। মালবীয়জি
এবং অন্যান্যরা বিরোধ করছিলেন। তাঁরা বলতেন, কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমাদের কিছুই
করা উচিৎ নয় কেননা কংগ্রেসই দেশের সবচেয়ে বড় সংস্থা। কিন্তু গান্ধিজি বলতেন যে কংগ্রেস
গড়া-ভাঙা তো আমাদের হাতে। আমরাই তো তৈরি করব তার অভিমত, যেমন চাই। কাজেই আজ সেই সিদ্ধান্তের
অপেক্ষায় থেমে যাব কেন? যদিও, সেই গান্ধিজি এখন ঠিক উল্টো কথা বলেন। এখন তো মালবীয়জি
থেকেও এগিয়ে গেছেন।
লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন ১৯২০ সালের
সেপ্টেম্বরে হয়েছিল, কলকাতায়। তার পুরো বিবরণ আমি পড়েছিলাম। গান্ধিজির বিরুদ্ধে শ্রী
বিপিনচন্দ্র পাল, দেশবন্ধু এবং লালাজিও ছিলেন। এতেই বিরুদ্ধে হওয়ার কথা ছিল সিদ্ধান্ত।
তা সত্ত্বেও গান্ধিজি অসহযোগের প্রস্তাব সে অধিবেশনে পাশ করিয়েই নিলেন।
হ্যাঁ, আরেকটা কথা ছেড়ে যাচ্ছে। ১৯১৬ সালের ব্যাপার। সমস্তিপুরে
এক ভদ্রলোক বললেন, কংগ্রেসে তিলক এবং স্যার ফিরোজ মেহতার দলের মধ্যে চুক্তি হয়ে গেছে।
ফলে এবারে লখনউয়ে যে কংগ্রেস হবে সেটা যুক্ত (united) হবে। যুক্তপ্রদেশে যুক্ত কংগ্রেস
ভালো কথাই। লখনউয়ে হওয়ার ছিল। তাই কেউ ইংরেজি ‘লখনউ’ শব্দটার দু’টুকরো (Luck now) করে
বলল যে এটা সৌভাগ্যের সংকেত। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট শ্রী মজুমদার
যে ভাষণটা দিয়েছিলেন, আমি ভালো করে পড়েছিলাম। ইংরেজ সরকারের ভুল শীর্ষক পরিচ্ছেদে
(chapter of mistakes) উনি বলেছিলেন, সময়ে সময়ে পরিস্থিতিজনিত কারণে বাধ্য হয়ে সরকার
যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলকাতা, বম্বে ইত্যাদি শহরে খুলেছে, সেগুলো একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত
ছিল। কেননা, ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য মানুষের চোখ খুলেছে এবং এখন তারা স্বাধীনতার
দাবী পেশ করা শুরু করেছে।
এভাবে, ১৯১৯ এবং ১৯২০ সাল নাগাদ আমি নিজের চৈতন্যে, রাজনৈতিক সমস্যাবলী
এবং দেশে হতে থাকা সে সংক্রান্ত ঘটনাবলীর একটা সঙ্কলন করা শুরু করে দিয়েছিলাম। এমনিতে,
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে ইওরোপে যে মহাযুদ্ধ হয়েছিল তার খবরাখবরও আমি পড়তামই। সেই
সময়েই আমি পাটনা থেকে প্রকাশিত হিন্দি পাটলিপুত্র এবং ইংরেজি দৈনিক ‘এক্সপ্রেস’(Express)
মন দিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম। এটা ঠিক যে রাজনীতিতে প্রবেশ তখনো হয়নি। তবু মনে ঘটনাগুলোর
প্রভাব পড়তই। মনে হত যেন নিজের অজান্তেই টান খেয়ে আমি ধীরে ধীরে ওদিকে চলে যাচ্ছি।
এভাবে ১৯২০ সাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমার জীবন-সংগ্রামের মধ্যভাগও পুরো হল। যদিও আমি সেটা জানছিলাম না। সে বছর ডিসেম্বরেই উত্তরভাগ শুরু হওয়ার ছিল। কি করে বুঝব যে কোনো অপরিচিত শক্তি আমায় সেদিকে টানছে? আমার মত ধার্মিক আর গোঁড়া সনাতনপন্থী মানুষ, যার রক্তে ঠুঁসে ভরা ছিল অন্ন-জল গ্রহণের ছুঁতবিচার এবং এখনও এক ভাবে রয়েই গেছে, কে ভেবেছিল সে দিন-রাতের হায়-হায়ে পড়বে? কে ভেবেছিল যে ভুলতে থাকা ইংরেজিটা মনে রাখার জন্য পাঠানো খবরের কাগজ আমায় রাজনীতিতে নিয়ে এসে ফেলবে? কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে একটা আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল, অনায়াসেই মনে হত যে গান্ধিজির অসহযোগের কথাটাই ঠিক, তার অন্য কোনো পরিণতি তো হতেও পারত না। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অব্দি অসন্তোষের ঢেউ বয়ে যাবে, হিন্দুমুসলমান ইত্যাদি সব ধর্মের লোকেদের এবং সব জাত-পাতের লোকেদেরও অস্থির করে দেবে, তবুও তার ছোঁয়াচ আমার গায়ে লাগবে না – এটা তো সত্যিই অসম্ভব ছিল। ফলে, টান খেয়ে আমি ঢুকে পড়লাম।
উত্তরভাগ – পূর্বখন্ড
(১)
গান্ধিজির সাথে আলাপচারিতা
ভালো করে মনে আছে, আমি পাটনাতেই ছিলাম। গান্ধিজি, মৌলানা মোহম্মদ
আলি, আবুল কালাম আজাদ এবং অন্যান্যদের সাথে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে, খিলাফত এবং পাঞ্জাবের
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশকে অসহযোগের জন্য তৈরি করার উদ্দেশ্যে সফরের পথে পাটনায় এসেছিলেন।
সেখান থেকেই বিহারের সফর শুরু হওয়ার ছিল। সবাই মওলানা মজহরুল হকের বাড়িতে উঠেছিলেন।
৩ বা ৪ ডিসেম্বরে আমি ওদের ভাষণও শুনেছিলাম। সে সময় আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল মওলানা
আজাদের ভাষণ। এমন নয় যে সে ভাষণে গর্মি বা জোশ বেশি ছিল, বা জানার কথা বেশি ছিল। সে
তো সবার ভাষণেই ছিল। আমায় তো এসব বেশি প্রভাবিত করতই; কেননা রাজনীতির আমি কিই বা জানতাম?
আসলে আমি দেখলাম, মওলানা মুহম্মদ আলি প্রভৃতি নেতারা যা কিছু বললেন
তাতে জন্মভূমি আর দেশের কথা তো থাকতই, কিন্তু তারই সঙ্গে বার বার তারা ইসলামের কথা
ওঠাতেন। এ ব্যাপারটায় জানিনা কেন আমার খটকা লাগত। আমি এতে বিপদ দেখলাম। আমার মন বলল,
যখন দেশে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষেরা আছে আর সবাইকে নিয়েই লড়াইটা লড়তে হবে, তখন এক
ধর্মের নাম নিলে বাকিদের মনে আঘাত না লাগে। অথবা ইসলামের দাবি পুরো হয়ে গেলে এই মওলানারা
এবং এদের সাথে সমস্ত মুসলমানেরা মাঝপথে লড়াই ছেড়ে সরে না পড়ে। রাজনীতির বিষয়ে খুব বেশি
না জানলেও জানি না কেন এই চিন্তাটা আমার মাথায় এল। তাই মওলানা আজাদের ভাষণ আমার ভালো
লাগল। কেননা মন দিয়ে শুনলাম; দেখলাম যে প্রথম থেকে শেষ অব্দি উনি একবারও ইসলামের নাম
না নিয়ে শুধু দেশ এবং সে সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোরই উল্লেখ করলেন বার বার। যদিও ঘন্টাখানেক
উনি বলে চললেন। তাই গান্ধিজির সাথে আলাপচারিতার সময় তাঁকে প্রশ্ন করলাম, এই মওলানারা
মাঝপথে ছেড়ে পালাবে না তো?
স্পীচ ইত্যাদির পর মনে হল, গান্ধিজির সাথে কথাটথা তো বলি। শুধু কৌতুহল
মেটাতে এবং জানার জন্যই কথা বলার কথাটা আমার মনে এসেছিল। স্বপ্নেও ভাবিনি যে তাঁর সাথে
কথা বলার পরিণতিতে আমি রাজনীতিতেই ঝাঁপিয়ে পড়ব। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম। তারাও সম্মতি
জানাল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে গান্ধিজিকে চিঠি লিখে সময় চাইলাম। জবাব পেলাম, ৫ ডিসেম্বর
সকাল দশটায়। ঠিক সময়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। খবর পাঠাতে ভিতর থেকে ডাক এল। উনি দুধে
পাঁউরুটির টুকরো ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন। খাটে বসেছিলেন। সামনে চেয়ার রাখাছিল। ইশারা করলেন
আমি যাতে চেয়ারে বসি। কিন্তু আমি নিচে বেছান মেঝেতে বসাই পছন্দ করলাম।
তারপর তাঁর সাথে আমার যে কথা শুরু হল তা ঘন্টাখানেক চলল। তাঁকে অনেক
প্রশ্ন করলাম। সন্ন্যাসির ধর্ম কী, তাও জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, যার মধ্যে ঘৃণা,
অনুরাগ বা দ্বেষের জায়গা নেই সেই সন্ন্যাসি। এ কথায় আমি নৈয়ায়িকদের মত তর্ক শুরু করে
বললাম, যে মন্দ নিজের ভিতর থেকে সরাতে হবে, সে মন্দটাকে ঘৃণা না করলে সরবে কীকরে? আর,
মন্দ তো সন্ন্যাসির ভিতরেও হতে পারে। এতে উনি বললেন সেই ঘৃণাকে আমি ঘৃণা মানিই না।
তখন আমার প্রশ্ন হলকী করে জানা যাবে কোন ঘৃণা ঘৃণা আর কোনটা না? যাতে সন্ন্যাসির লক্ষণ
জানতে পারা যায়? উনি এতে বললেন, আমি তর্ক করি না। আমিও চুপ করে গেলাম।
তারপর রাজনীতির কথা শুরু হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এমন তো হবেনা যে
খিলাফতের প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে এই মওলানারা লড়াই থেকে সরে যাবে আর হিন্দুদের একলাই
লড়তে হবে? আমি তাঁকে স্পষ্ট বললাম চিন্তাটা মুসলিম জনতাকে নিয়ে নয়। তাদেরকে সন্দেহও
করিনা কিন্তু ওদের লিডার আর মওলানারা এরকম করতে পারে, এ ভয়টা আমার মনে আছে নিশ্চয়ই।
তিনি আমায় আশ্বাস দিলেন যে এমন হতে পারে না। আমি যা বুঝেছি, এরা ভালো এবং সম্ভ্রান্ত।
ভালোমানুষদের কথায় বিশ্বাস করা উচিৎ। তাদের কথা পাকা হয়। এবং তারা এ বিষয়ে ভরসাও দেয়।
উনি যুক্তি দিতে চাইলেন কিন্তু আমি স্পষ্ট বললাম, যুক্তি চাইনা, এ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা
জানতে চাই। উনি বললেন আমার অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাস বলে যে এরা প্রতারণা করবে না, কিছুতেই
না।
তখন আমি বললাম, আপনার কথা মেনে নিচ্ছি নাহয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে
হিন্দুদের সাহায্যে ওরা নিজেদের কাজ বের করে নিল আর তারপর তাকত বেড়ে গেলে, আপনাদের
সঙ্গ তো ছাড়লই, হিন্দুদের ওপর হামলাও শুরু করে দিল – তখন কী হবে? এ প্রশ্নের উনি একটাই
জবাব দিলেন যে হিন্দুদের গীতার ওপর ওনার ভরসা আছে। যতক্ষণ গীতা আছে, হিন্দুধর্মের কিচ্ছু
করতে পারবে না কেউ। আর যদি গীতাও সত্যি না হয়, তাহলে এমন কাঁচা হিন্দু ধর্মটা শিগগিরই
শেষ হয়ে যাওয়া উচিৎ। এর পর আমার আর কোনো কথা বাকি থাকল না। আমি চলে এলাম। পুরো কথোপকথনটা,
যেভাবে হয়েছিল ঠিক তেমনভাবেই প্রশ্নোত্তরের মত লিখে, ১৯২০ সালের ৬ বা ৭ ডিসেম্বর তারিখের
পাটলিপুত্রে আমি ছাপিয়ে দিয়েছিলাম।
কথাবার্তার একটাই প্রভাব পড়ল আমার মনে যে শিগগিরই আমার রাজনীতিতে
ঝাঁপিয়ে পড়া উচিৎ। এজন্য নয় যে দেশের উপকার হবে। বরং এজন্য যে তাহলেই আমি সাচ্চা সন্ন্যাসি
হতে পারব। এখন তো আমি কাঁচা। বন্ধুদের সাথেও পরামর্শ করলাম। বিশেষ করে মুঙ্গের জেলার
দুর্গাপুর (খগড়িয়া) নিবাসী শ্রী উমেশ্বরবাবু এবং কানহাইয়াচকের শ্রী সূর্যনারায়ণবাবুর
সাথে। সবার এতে সায় দিল। এটাও সিদ্ধান্ত হল যে এই ডিসেম্বরেই নাগপুরে যে কংগ্রেস হবে
তাতেও অবশ্যই অংশগ্রহণ করা উচিৎ। উমেশ্বরবাবুর সাথে এ কথাও হল যে নাগপুর থেকে ফিরে
খগড়িয়া অঞ্চলেই থেকে কাজ করব।
এখানে আরেকটা কথা বলে দিই। যখন খিলাফতের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল
এবং ১৯২৫-২৬ সালে মওলানা আজাদ এবং ডঃ আনসারির মত দু’একজন বাদে সব মুসলমান নেতা আর মওলানারা
দ্রুততার সাথে তবলীগ আর তনজিমে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এমনকি হাকিম আজমল খাঁকেও একটু ওদিকে
ঝুঁকতে দেখলাম, তখন ইংরেজিতে তিরস্কারের স্বরে গান্ধিজিকে একখানা চিঠি লিখলাম। লিখলাম,
আপনি তো পুরো অভিজ্ঞ মানুষ! তাহলে কী করে ধোঁকায় থেকে ১৯২০ সালের ৫ই ডিসেম্বরে আমায়
বলেছিলেন যে মওলানা মোহম্মদ আলি প্রভৃতি মানুষেরা কখনো ধোঁকা দেবে না? ধোঁকা তো এরা
দিচ্ছে! সবাই মনে-প্রাণে তনজিমে পড়ে আছে! আমি যে আশঙ্কা করেছিলাম সেটা তো সত্যি প্রমাণিত
হল।
এসব আমি যা কিছু লিখলাম সে শুধু মুসলমান নেতাদের বিষয়ে। কেননা, প্রশ্নও
আমি তাদের বিষয়েই করেছিলাম পাটনায়। মুসলমান জনগণকে তো তারাই দিকভ্রান্ত করে যেমন হিন্দু
লিডাররা করে হিন্দু জনগণকে। জনগণ তো সবাই অন্তর থেকে নির্মল এবং নির্দোষ। কিন্তু গান্ধিজি
যে উত্তরটা দিলেন সেটা অদ্ভুত এবং চাতুর্যে ভরা ছিল। ওনার মত পরিষ্কার কথা বলা মানুষের
কাছে এমনটা আশা করিনি। উনি একটা বাক্য লিখেই জবাবটা শেষ করে দিলেন যে “মুসলমানদের সম্পর্কে
যে অনুমান আমি সে সময় করেছিলাম তা নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ নেই” (I do not repent my
estimate of mohammedans)। এটুকু কি আমার প্রশ্নের উত্তর হতে পারে? মুসলমানদের বিষয়ে
আমি প্রশ্ন কখন করলাম? আমার প্রশ্ন তো কয়েকজন মওলানা এবং নেতাকে নিয়ে ছিল। তার সঠিক
উত্তর কি এই? এই উত্তরে আমি গান্ধিজির ব্যাপারে প্রথম ধাক্কা খেলাম। কিন্তু বিশেষ কোনো
ফল হল না তাতে। আসলে ধাক্কাটা আমি বুঝতেও পারলাম না। প্রথম ধাক্কা ছিল যে।
(২)
নাগপুর কংগ্রেসের স্মৃতি
কথাবার্তার পর বেশি সময়ও পেলাম না। কেননা নাগপুরের কংগ্রেস সেই ডিসেম্বরের
শেষেই হওয়ার ছিল। আমি শিগগিরই মুঙ্গেরের উত্তর ভাগে খগড়িয়া অঞ্চলে গেলাম; শ্রী উমেশ্বরবাবুর
সঙ্গেই রওনা হলাম নাগপুর। মোগলসরাই থেকে বম্বে মেলে জব্বলপুরে গিয়ে শেঠ গোবিন্দ দাসের
ধর্মশালায় উঠলাম। সেখান থেকে রাতে ছোট লাইন ধরে গোদিয়া হয়ে পরের দিন নাগপুর পৌঁছোলাম।
ওখানে কংগ্রেসের প্রস্তুতিতে ডঃ মুঞ্জেকেই প্রধানভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখলাম। বাকি কারোর
নাম মনে নেই। সে সময় একমাত্র ওনাকে ছাড়া আমি আর কাকেই বা চিনতাম। উনিই ছিলেন অভ্যর্থনা
সমিতির অধ্যক্ষ। আজকের আর সে যুগের মুঞ্জেতে আকাশ-পাতালের তফাৎ হয়ে গেল। নাগপুরে দেশটা
চিরপরিচিত ‘ভিক্ষাং দেহি’ বলা আর গরম গরম লেকচার ঝাড়ার পথ ছেড়ে আত্মসম্মানের পথ ধরল।
ভারতের অধিকারের দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে, পুরো না হলে সরকারের সাথে ‘যুদ্ধং দেহি’র
সিদ্ধান্তে এল প্রথমবার। এবং এভাবে নিজেকে নবজীবন প্রদান করল দেশ। এসবে নিজের সামর্থ্য
অনুসারে পুরোপুরি নিজের ভূমিকা পালন করলেন ডঃ মুঞ্জে। শুধু তাই নয়। সেই ভূমিকা পালনে
তিনি অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ফলে তাঁর ডাক্তারি থেকে হওয়া ভালো আয় বন্ধ হয়ে
গেল। পরে লোকেরাই বলল সে কথা এবং জানাল যে উনি তো ধ্বংস হয়ে গেলেন! (He is a
ruined man!) কিন্তু আজ সেই পথের, বা বলা যায়
নাগপুরে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ উপ্ত হল সেই সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণ করছেন মুঞ্জে।
আর তাও সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করে! যে শক্তি সে সময় ওদিকে লেগেছিল সেটাই এখন বিপরীত দিকে
লাগছে! যদিও উনি নিজে সেটা মনে করেন না। কথাটা ঠিকই যে বিশ্বসংসার পরিবর্তনশীল!
নাগপুর কংগ্রেসের দু’একটা কথা আমি ভুলতেই পারি না। বিহারের মওলানা
শফী দাউদিকে ওখানে প্রথম প্রথম দেখলাম – কত কর্মতৎপরতা দেখিয়ে কংগ্রেসের প্যান্ডেলে
মানুষদেরকে ওঠাচ্ছেন বসাচ্ছেন। কতটা ভদ্র এবং নম্র ব্যবহার করছেন। তারপর ফিরে এসে উনি
অনেক কাজও করলেন। যখন আমি ফিরে এসে শাহাবাদ জেলার বক্সার সাবডিভিশনে কাজ করা শুরু করলাম
সে সময় আরা শহরে ওনাকেই বিহার প্রান্তীয় রাজনৈতিক সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত করা হল।
যদিও খুব ভালো করে ওনাকে জানতাম না, কিন্তু দেখেছিলাম ওনার মধ্যে ধার্মিক গোঁড়ামি একেবারেই
ছিল না। কিন্তু কিছুদিন পরেই অন্যান্য মৌলবিদের মত উনিও এমন পালটি খেলেন, এমন গোঁড়া
হলেন যে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একদিকে শুদ্ধি আর সংগঠনের আর অন্যদিকে তবলীগ আর তনজিমের
এমন ঝড় উঠল যে অন্যদের সাথে উনিও আমাদের মধ্যে থেকে উড়ে এক তীরে গিয়ে বসলেন! যে কাজের
জন্য ভালো ওকালতিটা বরবাদ করলেন সেটাই মাঝপথে ছেড়ে তনজিমে জড়িয়ে পড়লেন।
নাগপুরেই আমি দেখলাম, আগে দ্বারকার এবং শেষে জগন্নাথের শঙ্করাচার্য
শ্রী ভারতী কৃষ্ণতীর্থ, লখনউয়ের আর এস নারায়ণস্বামী প্রভৃতির সাথে ওখানেই বসে রয়েছেন।
কংগ্রেসের জন্যই তাঁরা ওখানে এসেছিলেন। কিন্তু যখন প্রতিনিধিদের, কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে
স্বাক্ষর করার সময় এল তখন তাঁরা অস্বীকার করলেন। সাম্রাজ্যের ভিতরে স্বরাজ্যের উদ্দেশ্যে
স্বাক্ষর করতে তাঁরা রাজি ছিলেন না; আর সে সময় অব্দি সেটাই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ছিল।
আমি তো সে সময় এসব কথা কিছুই জানতাম না বা বুঝতাম না যে সাম্রাজ্যের ভিতরে আর বাইরে
ব্যাপারটা কী। কিন্তু তিনিও দন্ডী এবং আমিও দন্ডী। তাই তাঁর কাছে মাঝে মধ্যেই যেতাম
আর বসতাম। আনন্দও হত যে এই রাজনীতিতে একলা আমিই এক দন্ডী সন্ন্যাসি নেমে পড়িনি। আমার
চেয়ে বড় আর বিদ্বান শঙ্করাচার্য অব্দি পড়েছেন। তাঁর সাথে আরো সন্ন্যাসিরা ছিলেন। কংগ্রেসের
উদ্দেশ্য নিয়ে নরম দল আর গরম দলের যে পুরোনো ঝগড়া ছিল তারই অনুসরণে তাঁরা স্বাক্ষর
করতে অস্বীকার করছিলেন।
পরে, নাম ভুলে যাচ্ছি এক চালাক-চতুর ভদ্রলোক ছিলেন, যিনি অত্যন্ত
উৎসুক ছিলেন তাঁদের প্রতিনিধি করতে, এই বলে তাঁদের রাজি করলেন যে আপনারা তো কংগ্রেসের
উদ্দেশ্যে স্বাক্ষর করে এটাই বলছেন যে এই উদ্দেশ্য কংগ্রেসের ধ্যেয়। কিন্তু সেই ধ্যেয়
আপনিও স্বীকার করে নিচ্ছেন এ মানে কী করে বেরুচ্ছে স্বাক্ষরে? যারা ওই উদ্দেশ্য বদলাতে
চাইছে তারাও তো ওই কাগজে স্বাক্ষর না করে ঢুকতে পারবে না। ফলে, বদলাতেও পারবে না। তাই,
এটা তো নিছক কায়দাকানুনের বিধিনিষেধ (formality)। এ কথায় ওনারা স্বাক্ষর করে দিলেন।
পরে তো করাচিতে মওলানা মোহম্মদ আলি প্রভৃতি সাতজন নেতার ওপর (পরে ওদেরকে করাচির সাত
‘Karachi seven’ বলার এওয়াজ হয়ে গিয়েছিল) খিলাফতের অভিযোগে যখন মোকদ্দমা চলেছিল তখন
তাদের মধ্যে একজন এই ভারতী কৃষ্ণতীর্থও ছিলেন। আনন্দের ব্যাপার ছিল। দেশের সৌভাগ্যের
সূচনা ছিল মুসলমানদের ধর্মরক্ষায় হিন্দুদের ধর্মাচার্য শঙ্করাচার্যের জেলে যাওয়া।
কিন্তু কয়েকদিন পর, জেল থেকে ফিরেই রাজনীতিতে বিরাগ হল তাঁর এবং
আবার মঠ আর গদির ঝগড়ায় বিচ্ছিরি ভাবে জড়িয়ে পড়লেন। এমনকি রাজনীতির নাম নেওয়াই ছেড়ে
দিলেন। যখন নাকি সাম্রাজ্যের বাইরের তো নয়ই, ভিতরের স্বরাজ্যও চোখে দেখা যায়নি তখন অব্দি। জানিনা
এই বাস্তব অবস্থাটা এদিকে তাঁর হৃদয়ে আদৌ মোচড় জাগিয়েছিল কিনা।
অখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির ১৯২৪ সালের যে বিখ্যাত বৈঠক আহমেদাবাদে
হয়েছিল তাতেও আমি ছিলাম। ওখানেই বেশ চালাক-চতুর এক দন্ডীর সাথে দেখা হল এবং কথাবার্তা
হল। তিনি বললেন যে জেল থেকে ফিরলে ভারতী কৃষ্ণতীর্থকে দিয়ে আমরা প্রায়শ্চিত্ত করাব
যে জেনেশুনে উনি কেন জেলে গিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাসটা ছিল সরল প্রকৃতির, তাই ভারতী প্রায়শ্চিত্ত
করবেন এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাঁকে এতটা দুর্বল ভাবতাম না। কিন্তু
সেই দন্ডী সন্ন্যাসির দৃঢ়তা দেখে ইঙ্গিত পেলাম যে ব্যাপারটা গোলমেলে অবশ্যই। পরে তো
শুনলাম জেল থেকে ফিরে তিনি প্রায়শ্চিত্ত করেও ছিলেন। বোধহয় ওটা রাজনীতিতে আসার মহাপাপেরই
প্রায়শ্চিত্ত ছিল। তাই সরেও গেলেন।
নাগপুরে এটাও দেখলাম যে বিষয় সমিতির সদস্য নির্বাচনে দারুণ হট্টগোল।
কেননা পুরোনো নিয়মাবলি অনুসারে কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়কালেই, প্রতিনিধিদের ভিতর থেকেই
কয়েকজনকে নির্বাচিত করে বিষয় সমিতি তৈরি হত। তাই প্রত্যেকটা প্রদেশের প্রতিনিধি এই
চেষ্টাতেই ব্যস্ত ছিল যেন অমুক বা তমুক দলের অনুরূপ চিন্তাভাবনা করা লোকেরাই জেতে।
অন্যান্য প্রদেশের কথা তো জানি না। কিন্তু বাংলার প্রতিনিধিরা যখন একত্র হয়ে নিজেদের
প্রদেশের তরফ থেকে সদস্য নির্বাচন করছিল তখন হাতে-পায়ে ভালো রকম চলল। চেয়ারও চলল। কয়েকজনের
মাথাও ফাটল। দেশবন্ধুর পার্টিওয়ালারা চাইছিল যেন তাদেরই সমর্থকেরা নির্বাচিত হয়; গান্ধিজির
অনুসারী, অসহযোগের সমর্থকেরা যেন না নির্বাচিত হয়। দাস সাহেব তখনো অব্দি অসহযোগের পক্ষে
ছিলেন না। কিন্তু শুনতে পেলাম যে কংগ্রেসের অধিবেশন পুরো হওয়ার আগে গান্ধিজির সাথে
তাঁর কোনো চুক্তি হয়ে গেছে।
ওই অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন সালেমের (ম্যাড্রাস প্রদেশ) পুরোনো জনসেবক
চক্রবর্তি বিজয় রাঘবাচার্য। ছিলেন উনি পুরোনো নরম দলেই। দেখলাম কপালে আচারী বৈষ্ণবদের
লম্বা তিলক। বাড়িতে খাওয়াদাওয়ায় পর্দা পুরো আচারীদের মতই। ছোঁয়াছুঁয়িও হুবহু তেমনই।
পর্দার আড়ালেই খাবার খেতেন যেমন সব আচারীরা করে। নিজের পুরোনো ধ্যানধারণা অনুসারে ভাষণে
অসহযোগের বিরোধই করলেন। ছাপা ভাষণ ছিল। কিন্তু সে অরণ্যে রোদন। কংগ্রেস অধিবেশনে তো
অসহযোগের প্রস্তাব প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। বিরোধ তো বোঝাই গেল না, দু’একটা
ছাড়া, পরে যার উল্লেখ করেছি। এটাও লক্ষ্য করলাম যে কংগ্রেসের সভাপতি সময়োপযুক্ত ছিলেন
না। উনি সেই ভাবধারার সমর্থক ছিলেন যার সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই নাগপুরের পর সভাপতি
মহারাজ বলতে গেলে নিখোঁজই হয়ে গেলেন। নামও খুব কম শুনতে পাওয়া যেত।
ওখানেই আমি মহম্মদ আলি জিন্না সাহেবকে প্রথম প্রথম দেখলাম। ওখান
থেকে যে উনি অদৃশ্য হলেন তারপর আজ অব্দি ওনাকে দেখার সুযোগ অন্ততঃ আমার তো হয়ই নি।
জমানা বদলে গিয়েছিল। কুর্তা, টুপি আর ধুতিওয়ালারাই বেশির ভাগ কংগ্রেসে ছিল। কিন্তু
জিন্না সাহেব কেতাদুরস্ত ভাবে হ্যাট, কোট, প্যান্ট ইত্যাদিতে সুসজ্জিত ছিলেন। উনি অসহযোগের
পুরোপুরি বিরোধিতা করলেন। ভাষণ দিলেন ইংরেজিতে। বিস্তারিতভাবে উনি অসহযোগের সম্ভাবিত
ক্ষতি গোনালেন আর বললেন যে অসহযোগের প্রস্তাব পাশ হয়ে গেলে ওঁদের মত মানুষদের কংগ্রেসে
থাকার আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। হলও তাই। শুধু উনিই নয়, ওনার সাথে কংগ্রেসের পুরোনো
নরম দলের নেতারা সবাই কংগ্রেস থেকে একেবারের মত আলাদা হয়ে গেল। তারা নিজেদের একটা আলাদা
প্রতিষ্ঠান গড়ল যার নাম হল অখিল ভারতীয় লিবারাল ফেডারেশন।
কংগ্রেস পুরোনো দুনিয়া ত্যাগ করে নতুনে প্রবেশ করল। দেশের ভাবধারা
একশ ভাগ বিপরীত দিকে বইয়ে দিল নাগপুর। নাগপুরের পর, দেশে উৎসাহ আর উদ্দীপনার যে ঢেউ
ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছিল, বর্ণনাতীত ছিল সে ঢেউ। দেশ কংগ্রেসের মাধ্যমে স্বাবলম্বনের পথ
তো ধরলই, ইতিহাসে প্রথম এমন হল যে দেশের সবচে’ বড় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি নিজের রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যসিদ্ধির প্রয়োজনে দেশের মূক ও পীড়িত জনতার দিকে, কৃষক, মজুর এবং খেটেখাওয়া
মানুষগুলোর দিকে নজর ফেরাল আর সিদ্ধান্তে এল যে ওদের সাহায্য না নিয়ে, সামূহিকভাবে
ওদের রাজনীতিতে না এনে দেশের রাজনৈতিক দাবির পূরণ হবে না। স্পষ্ট স্বীকার করল যে ওই
জনগণে সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত, কংগ্রেসও মজবুত হবে না, স্বাধীনতার লড়াইটা শক্তিশালী
হবে না আর সরকারও নুইবে না। আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার ছিল যে ঠিক এমনই সময় আমি কংগ্রেসে
এবং রাজনীতিতে প্রথম প্রথম শামিল হলাম। এই পরিস্থিতি আর আবহাওয়া আমার স্বভাবেরও অনুকূল
ছিল। সন্ন্যাসি হয়েও চিরকাল আমি ‘ভিক্ষাং দেহি’র বিরোধী।
কংগ্রেসের এই পথ-পরিবর্তন এবং জনগণের দিকে যাওয়ার পরিণামটাও ভালোই
হল। দুনিয়াও দেখল আর নিজের অসীম শক্তির নেশায় বুঁদ ইংরেজ সরকারও আশ্চর্যচকিত চোখে দেখল
এক বছরের মধ্যে, কী ছিল আর কী হয়ে গেল কংগ্রেস – অপ্রতিম হয়ে উঠল তার শক্তি! যে কংগ্রেস
সব সময় সরকারের সামনে নুয়ে থাকত আর হাত জোড় করে আর্জি জানাত সেই কংগ্রেসকে লোকে সরকারকে
নুইয়ে দেওয়ার শক্তি হিসেবে দেখা শুরু করল। খেটেখাওয়া মানুষের, কৃষক ও শ্রমিকের আশ্রয়ে
যাওয়ার এটাই পরিণাম হয়। সে জনগণ যদি নিজে ভিক্ষে চাওয়া জনতা হয় তাও। তাও সে জনগণ নিজের
আশ্রিতদেরকে শিবের মত, সবদিক থেকে পূর্ণ এবং শক্তিশালী তৈরি করে দেয়। তেমনই কংগ্রেসের
সাথে হল। ফলে ভাইসরয় লর্ড রিডিকে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় বলতে হল, আমি হতবুদ্ধি
ও বিভ্রান্ত (I am puzzled and perplexed)!
(৩)
অসহযোগে – বক্সারে
নাগপুর থেকে ফিরে খগড়িয়া যাব। ঠিক ছিল যে ওটাই আমার কর্মক্ষেত্র
হবে। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির দপ্তরে আমি আমার ঠিকানা খগড়িয়ার প্রতিনিধি হিসেবেই
দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে কিছু বইটই ছিল সেগুলোও আমি খগড়িয়াতেই পাঠালাম। কিন্তু বক্সারের
(শাহাবাদ) কয়েকজন পরিচিত বন্ধু আগ্রহ জানাল যে আমি যেন কয়েকদিনের জন্য হলেও বক্সারেই
যাই। কেননা কাউন্সিলের নির্বাচনী ক্ষেত্রের একটা জায়গা ঐ এলাকায় খালি আর সেখানে হাথুয়ার
মহারাজ প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। আজকের প্রাদেশিক এসেম্বলির জায়গাতেই সে সময়
কাউন্সিল ছিল। কংগ্রেস সে কাউন্সিল বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। হাথুয়ার মহারাজা
কংগ্রেসের কথা অমান্য করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তাই তার বিরোধ করা জরুরি ছিল যাতে লোকে ভোট
না দেয়। আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। ভাবলাম কাজটা শেষ করে খাগাড়িয়া চলে যাব। ফলে, বক্সার
পৌঁছে কাজে জুটে পড়লাম। গ্রামাঞ্চলে মহারাজের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিলাম। বক্সার
আর ভভুয়া দুই সাবডিভিশন থেকে ছিল তাঁর নির্বাচন। আরা শহরের মানুষেরা মস্করার ছলে মহারাজার
বিরুদ্ধে একজন ধোপাকে দাঁড় করিয়ে দিল। তার পক্ষে কংগ্রেস সামান্যতম চেষ্টা করলেও সে
জিতে যেত আর মহারাজা হেরে যেত। কিন্তু বয়কটের সিদ্ধান্ত গৃহীত ছিল, কাজেই সে তরফে ইশারা
করতেও আমরা অপারগ ছিলাম। তা সত্ত্বেও, শুধু মাত্র তার দাঁড়িয়ে যাওয়ায় মহারাজা যথেষ্ট
অপমানিত হলেন এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।
আমি সে কাজে পড়লাম তো মনপ্রাণ দিয়ে পড়লাম। দিনে, রাতে অন্য কোনো
কাজ ছিল না। গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে কংগ্রেসের বার্তা শোনাতাম। বলতাম যে কেউ যেন ভোট
না দেয় আর ভোটে না দাঁড়ায়। মহারাজ যদি কংগ্রেসের সে বার্তা না মানেন তাহলে যেন ওনাকেও
একটাও ভোট না দেওয়া হয়। কিন্তু মুশকিল ছিল যে এত লম্বা একটা এলাকায় ঘুরে বেড়াবার মত
লোক তো বেশি ছিলই না, টাকাপয়সা বা গাড়ি ইত্যাদিরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নাগপুর থেকে
ফিরতে ফিরতেই কাজটা এসে পড়েছিল; তখনও অব্দি মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে বিশেষ উত্তাপ জন্মায়
নি। কিছুদিন পর এল সে উত্তাপ। সময়ও কম। ফলে আমারই সব জায়গায় আর বক্সারের কাজ পুরো করে,
বিশেষ করে ভভুয়া এলাকার রামগড় থানা এবং অন্য জায়গায় যাওয়ার ছিল। কিন্তু এত অল্প সময়ে
কোথায় কোথায়ই বা যেতাম?
শেষে, ভোটের ঠিক আগের দিন আমি খিরি আর সেখান থেকে মানিকপুর গেলাম।
ফের সন্ধ্যেবেলায় গরুর গাড়িতে বসে সারারাতের সফরে রামগড় যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলাম।
গরু গাড়িও ওখান অব্দি যেতে পারত না। দুমদুমা অব্দি যেতে পারলাম। সেখানেই গরুর গাড়ি
ছেড়ে দু’একজনের সাথে হেঁটে রওনা দিয়ে সকাল আটটা নাগাদ রামগড় পৌঁছোলাম। স্কুলবাড়িতে
বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া সারলাম। তারপর গ্রামে গেলাম। সময় তো একেবারেই ছিল না।
বোধহয় সকাল দশটা থেকে ভোট হওয়ার ছিল। গ্রামের লোকেদের মিটিং করতে বললাম। কিন্তু মিটিং
হবে কি করে? শেষে একটা রাস্তা বেরুল। একজন বলল গ্রামের মাঝখানে সভাস্থানে একটা ধৌঁসা
(নাগাড়া) রাখা আছে। এখানকার কায়দা এটাই যে ধৌঁসাটা জোরে বাজালে যে শুনবে সেই দৌড়ে আসবে।
ধৌঁসাটা বিপদের ঘন্টির (Alarm) কাজ দিত। তাই করা হল। সঙ্গে সঙ্গে লোকে এসে পড়ল আর আমরা
আমাদের আসার উদ্দেশ্য ওদের বললাম। তারপর তো বিদ্যুৎ খেলে গেল। ভোট দিতে যাওয়ার বদলে
থানার চারদিকে সবক’টি রাস্তায় লোকেরা ভোটারদের থামাবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও দাঁড়িয়ে
পড়লাম ওদের মাঝে।
পুলিশ তো নিশ্চিন্ত ছিল। ভেবেছিল যে কোথাও কিছু হবে না, সব ঠিকঠাক
আছে। যখন হঠাৎ তারা নতুন মেজাজ দেখল গ্রামবাসীর তখন চিন্তিত হয়ে উঠল। চৌকিদার বা কনস্টেবলকে
দিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর বলাল যে স্বামীজি এখান থেকে চলে যান। কিন্তু আমি তো যাওয়ার পাত্র
নই। তখন দারোগা নিজে এলেন আর আমায় চলে যেতে বললেন। শাসানিও দিলেন। আমি বললাম লিখিত
আদেশ দিন তখন ভাবব কী করা উচিৎ। তখন থতমত খেয়ে মুখ ছোটো করে চলে গেলেন। আমি সদলবলে
দাঁড়িয়ে রইলাম। যে কেউ ভোটার বা দর্শক পৌঁছাত, কৌতুহলের বশে আমার কাছেই আসত। আমি বুঝিয়ে
দিলে ফিরে যেত। মনে নেই মহারাজা দু’চারটেও ভোট পেয়েছিলেন কিনা। যদিও সে সময়েও দেখলাম
গ্রামাঞ্চলের কয়েকজন ধূর্ত এঁটোখোর মহারাজের জন্য আকাশ-পাতাল এক করছিল। এটা সত্যি যে
ধোপা হেরে গেল আর মহারাজ নির্বাচিত হলেন। কোথাও না কোথাও থেকে দু’চারটে ভোট তো পেয়েইছিলেন।
সেখান থেকে ফিরে বক্সারে এলাম। ওখানেই থাকলাম, মাস্টার সাহেব বলে
পরিচিত শ্রী জয়প্রকাশ লালজির সঙ্গে। এবার খগড়িয়া চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু এলাকায়
আমার একটা বিশেষ পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। কংগ্রেসের প্রোগ্রাম নিয়েছিল জুলাই মাস শেষ হতে
হতে সারা দেশে সদস্য-সংখ্যা এক কোটি করতে হবে, তিলক স্বরাজ্য তহবিলে এক কোটি টাকা সংগ্রহ
করতে হবে আর এক লাখ চরকা চালু করতে হবে। সে কাজেই এমন ফেঁসে গেলাম যে যাওয়া অসম্ভব
হয়ে পড়ল। আমি চরকা বিতরণের কাজে লেগে গেলাম। সিমরি (ডুমরাঁও) থানা থেকে যতটা পারি সস্তায়
চরকা তৈরি করিয়ে বক্সারে নিয়ে এলাম আর প্রচার শুরু করলাম। সে সময় বক্সারের বেশ কয়েকজন
বেনে এই কাজে অংশ গ্রহণ করল। যথেষ্ট সাহায্য করল তারা। কিন্তু বাবু ভগবান দাসের এমন
পরিবর্তন হল যে তা আজ অব্দি ভুলিনি। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। কয়েক বাক্স ভরে নানা ধরণের
বিলিতি জামাকাপড় জমিয়ে রেখেছিলেন যেগুলো সময় মত নিজে ব্যবহার করতেন। সব ছেড়ে দিয়ে খদ্দরের
ব্রত নিলেন। যত জামাকাপড় ছিল সবের ‘হোলি জ্বালিয়ে’ (আগুনে পুড়িয়ে) দিলেন।
সে সময় তো গান্ধিজি এই হোলির বড় সমর্থক ছিলেন। এধরণের কাজেকর্মে
উনি এবং ওনার অনুযায়ীর একেবারেই হিংসার নামগন্ধ পেতেন না। এখন তো যুগ এমন পাল্টেছে
যে সাম্রাজ্যবাদের নাশে, পূঁজিবাদের নাশে, জমিদারী প্রথার নাশে এবং এদের কুশপুতুল জ্বালানোয়
এঁরা হিংসার গন্ধ পেয়ে যান। মনে হয় এদের ঘ্রাণশক্তি আজকাল একটু বেশিই তীব্র হয়ে পড়েছে।
আগে এমন ছিল না। বিশ্বসংসার পরিবর্তনশীল।
এখানে এটা বলে দেওয়া অনুচিত হবে না যে আমি কট্টর গান্ধিবাদি হিসেবেই
কংগ্রেসে আর রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলাম। তাই গান্ধিজির প্রত্যেকটি আদেশ অক্ষরে অক্ষরে
পালন করতাম এবং অন্যদেরকে দিয়েও করাতাম – অন্ততঃ চেষ্টা করতাম পুরোপুরি। তাই শিগগির
চরকা চালানো শিখে সুতো কাটা শুরু করলাম। তারপর তো তকলিও শুরু হল। এভাবে প্রতিদিন যতটা
চরকা চালানোর লক্ষ্য নিজের জন্য ধার্য করেছিলাম, তা ভালোভাবেই পুরো হতে লাগল। আমি আশা
করতাম লেখাপড়া জানা সমঝদার যে লোকেরা কংগ্রেসে শামিল হবে তারা তো গান্ধিজির আদেশ এবং
তাঁর বলা নিয়মগিলো পালন করবেই। কিন্তু পরে যখন জেলে গেলাম, প্রচন্ড হতাশ হলাম। কিন্তু
তার আগেও, তিলক স্বরাজ্য তহবিলে টাকা জমা হতে-না-হতেই আসল ব্যাপারটা জানতে পারছিলাম
আর আমার চোখ খুলতে শুরু করেছিল।
কাজের এমন চাপ ছিলযে শীত, গ্রীষ্ম, বৃষ্টির পরোয়া না করে দিনরাত
গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি। আজও সেসব গ্রীষ্মের অগ্নিবর্ষী লু’এর ঘটনাগুলো মনে আছে।
পায়ের এমন অবস্থা হল যে জুতো পরা ছেড়ে দিলাম। আসলে চামড়ার জুতো তো আগেই ছেড়ে গিয়েছিল।
বাকি ছিল রোপসোলের জুতো, তাও ছেড়ে গেল। ভালো পাওয়াও যেত না। যা পাওয়া যেত তা এই ঘোড়দৌড়ে
টেঁকার মত নয়। দশ দিনেই শেষ হয়ে যেত। জুতোর পিছনে এভাবে জলের মত পয়সা কে ঢালে? জনগণের
পয়সা এভাবে কেন খরচ হবে? গান্ধিজির পথ তো তপস্যার পথ! তাহলে নিজে কষ্ট সহ্য করব না
কেন? এসব চিন্তা জুতোর সাথেও অসহযোগ করিয়ে দিল। ফল হল যে গরমের দিনেও পায়ে লম্বা ফাটলের
মত করে পা ফাটল আর হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়ল। কখনো কখনো ওতে মোম ঢেলে আগুনে সেঁকতাম। ব্যাথা
তাতে একটু কম হলে আরাম পেতাম। তখন ঘোরাফেরা সম্ভব হত। কে জানে কত মাস এই পদ্ধতি চলল।
সে সময় অবশ্যই, সিমরির পন্ডিত রামদর্শ পান্ডেয়, পন্ডিত রামসুভগ পান্ডেয় প্রভৃতি যুবকেরা
আমার সব ব্যাপারে পুরোপুরি সঙ্গ দিল।
কিন্তু অনুভব করলাম যে অসহযোগের এই পবিত্র ধারায় স্নান করতে না জানি
কত পুরোনো পাপীরা ঢুকে পড়ল। সব এমন বকতপস্বী আর মহাত্মা হয়ে গেল যে মানুষেরা বিস্মিতও
হল আবার ভক্তিও করল। অনেকে ভাবল যে গান্ধিজির জাদু কাজ করেছে। তাতে এই সব ভালোমানুষদের
হৃদয়-পরিবর্তন হয়েছে। এমন ব্রত আর অনশন আরম্ভ করল এরা যে তাজ্জব হয়ে যেতাম। কতজন তো
গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে নিল! ভালোই! সমবেত আন্দোলনে সব ধরণের মানুষ এসেই পড়ে। কে থামাবে
ওদের? বহতি গঙ্গায় স্নান করা কে পছন্দ করে না? পরিস্থিতির প্রভাবও কিছুটা এমন পড়ে যে
পাপীদের আর সাহস হয়না পাপাচার চালিয়ে যাওয়ার। আবহমন্ডলের এই তো বিশেষত্ব! কিন্তু এই
ব্যাপার, এই জাদু, এই প্রভাব বেশিদিন টেঁকে না। শ্মশানে মড়া পোড়াবার সময় তো বৈরাগ্য
আসেই। কিন্তু স্থায়ী তো হয় না। একই ব্যাপার হয় আবহমন্ডলের বশীভূত হয়ে কাজ করা মানুষদের
সাথে। তারাও কিছু কাল পর অন্য পথে, পুরোনো, চিরাচরিত পথে ফিরে যাওয়া শুরু করে। কোনো
শক্তি তাদের থামাতে পারে না।
কিছুদিন পরেই দেখলাম এ ধরণের মানুষেরা পাশ ফিরতে শুরু করল। নিজেদের
বিকট রূপের খবর দেওয়া শুরু করে দিল। কিন্তু আমার কাজ জারি রইল; সবার সম্মিলিত প্রয়াসও
বন্ধ হল না। শেষে জুন মাস আসতে না আসতে তিলক স্বরাজ্য তহবিল পুরো করতে সবাই ঝাঁপিয়ে
পড়ল। বক্সারই তো আমার কর্মক্ষেত্র রইল। ছোটো শহর। জমকালো কোনো বাণিজ্যও ছিল না। সাধারণ
ব্যবসাদারেরা ছিল। তবু আরা শহরকে হারিয়ে দিল। আমার মনে আছে শেষ দিন ৩১শে জুলাই, এই
জন্যই শ্রী রাজেন্দ্রবাবুর সফর হল আরা আর বক্সারে। যদি ভুলে না গিয়ে থাকি, উনি আরা
থেকে প্রায় তিনশো এবং বক্সার থেকে আটশো বা এক হাজার টাকা পেয়েছিলেন। সে টাকা তো ওনার
সাথেই চলে গেল।
কিন্তু মাঝে মাঝে যে টাকা উশুল হত তার কিছুটা প্রাদেশিক অফিসে যেত
আর কিছুটা জেলায়, সাবডিভিশনে বা থানায় থেকে যেত। আমি দেখলাম যে সেই টাকাগুলো নিয়েই
নয়ছয় শুরু হল। কয়েকজন ভালোমানুষ এদিক-ওদিক ওড়ান শুরু করে দিল। এটা আমার বরদাস্তের বাইরে
ছিল। সার্বজনিক ধনকে আমি সবচেয়ে পবিত্র জিনিষ মনে করি। কিন্তু পয়সা আসতেই মানুষদের
রূপ পালটাল। ফলে ওখানকার অনেক কর্মকর্তার সাথে আমার বিবাদ শুরু হল। শেষ হল তখন যখন
নভেম্বরের শেষে বিরক্ত হয়ে আমি বক্সারই ছেড়ে দিলাম। চলে গেলাম গাজিপুর। সেখানকার মানুষেরা
অনেক বেশি পিছিয়ে ছিল। আমিও ভাবলাম বক্সারে থেকে ঝগড়া করতে থাকা আর কাজে বাধা উৎপন্ন
হতে দেখা ঠিক নয়। গাজিপুরেই চল।
১৯২১ সালের গ্রীষ্মে মওলানা মোহম্মদ আলির সঙ্গে গান্ধিজির সফর চলছিল
যুক্ত প্রদেশে। বিহারেও আসার কথা ছিল তাঁর। যারপরনাই আগ্রহের সাথে এবং প্রস্তুতি নিয়ে
আমরা তাঁদের বক্সারে ডাকলাম। প্রাদেশিক নেতারা এই শর্তে তৈরি হলেন যে মোটরগাড়িতেই ওঁদেরকে
আরা পৌঁছে দেওয়া হবে। কম সে কম দুটো ভালো মোটরগাড়ির দরকার ছিল। ভাড়ায় দুটো মোটরগাড়ি
করা হল। চেষ্টা করা হল যাতে স্টেশনে তাঁরা কখন নামবেন তার খবর কেউ না পায়। তাই হল।
কিন্তু আভাস পেয়েই লোকের রাত তিনটে থেকে স্টেশনে এসে বসে রইল। ভীড় হয়ে গেল বিশাল। ট্রেন
থেকে নামলে পর অতিথিদের রাখা হল শ্রী চুন্নীরামজির বাড়িতে। সভার ব্যবস্থা ছিল শহরের
বাইরে, পূর্বদিকের বাগানের উত্তরে মাঠে। আন্দাজ ছিল যে সকালেই আটটা অব্দি সভা করে তাঁরা
ওখান থেকে চলে যাবেন। ফলে মাঝরাত থেকেই মানুষেরা সভাস্থলে একত্রিত হওয়া শুরু করল। সকাল
হতে হতে বিরাট ভীড় জমা হয়ে গেল। পায়খানা, পেচ্ছাপও না করে মানুষেরা প্রতীক্ষায় ছিল
যে সভা তাড়াতাড়ি শেষ হলে ফিরবে।
কিন্তু গান্ধিজি হঠাৎ বোমা ফেললেন। ঠিক সকালে বলে দিলেন যে আজ যেহেতু
বৃহস্পতিবার তাই চার ঘন্টা উনি ‘নবজীবন’ এবং ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’র জন্য লেখা তৈরি করবেন।
তাই দুপুরের আগে সভা হতে পারবে না। আমার মাথায় বজ্রাঘাত। গরমে মানুষেরা তেষ্টায় আর
খিদেয় ছটফট করছিল। তার মধ্যে আবার কতজনের স্নানটানও হয়নি, এমনকি পায়খানায় যাওয়ার সুযোগও
হয়নি। নিজেদের জায়গা থেকে সরা অসম্ভব কেননা পিছিয়ে বা দূরে দাঁড়াতে হলে দর্শনও ঠিক
মত হবে না। ফলে সবাই আমাকেই বকা শুরু করল যে আপনিই ধোঁকা দিয়েছেন – বলেছেন যে সকালে
সভা হবে। আমার কথা শুনতে কেউ প্রস্তুতই নয়। আমি নিজেও একবার এদিকে একবার ওদিকে দৌড়োচ্ছিলাম।
রোদে পুড়ছিল মানুষ। আমিও বিবশতায় জ্বলছিলাম ভিতরে ভিতরে। কী বা করতাম?
এরই মধ্যে বালিয়ার লোকেরা আরেকটা সমস্যা খাড়া করল। গান্ধিজির তো
ওখানে যাওয়ার কোনো প্রোগ্রামই ছিল না। কিন্তু বেমতলব ওরা ওনাকে বালিয়া নিয়ে যাওয়ার
জিদ ধরে বসল। কোনো উপায় না পেয়ে ওরা শ’য়ে শ’য়ে গান্ধিজির থাকার জায়গার সামনের রাস্তাটার
দুপাশ ঘিরে শুয়ে পড়ল। বলল, যতক্ষণ গান্ধিজি যাওয়ার জন্য কথা দেবেন না, আমরাও সরব না;
ওনার মোটরগাড়ি যেতে দেব না। গান্ধিজিও মানার পাত্র ছিলেন না। ওরাও শোনার পাত্র ছিল
না। এতে সভা শুরু হতে আরো দেরি হতে লাগল। আমার মাথায় আরো অনেক বিপদ ছিল। শেষে গান্ধিজি
যখন কথা দিলেন যে উনি বালিয়া অবশ্যই যাবেন তবে এখন নয় পরে, তখন ওরা সরল আর গান্ধিজি
সভায় যেতে পারলেন। কিন্তু দুপুরও পেরিয়ে যাচ্ছিল আর মানুষেরা বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে
গান্ধিজি সভাস্থানে পৌঁছোতেই হো-হাল্লা শুরু হল। ফলে কারোরই আর বক্তৃতা দেওয়া হল না।
ঠিক ১৭ নভেম্বরের কথা। বাদশাহজাদা সাহেব বোম্বাইয়ে জাহাজ থেকে নামবেন।
উনি এখানে সেই নতুন বিধান জারি করবেন যেটা বয়কট করেছে কংগ্রেস। তাই সর্বত্র হড়তাল হওয়ার
কথা ছিল। বালিয়ার (দদরি) মেলায় আমরা ছিলাম। সমস্যা জটিল ছিল। মেলায় হড়তাল হলে আমাদের
সফলতা হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু মেলা বিরাট বড়। তা সত্ত্বেও এমন প্রচার চালান হল যে
সেদিন একটাও দোকান খুলল না। এক ডেপুটি সাহেব সদলবলে ঘুরছিলেন হড়তাল কেমন হয়েছে দেখতে।
এক পানওয়ালার কাছে পান কিনতে চাইলেন তো সে স্পষ্ট না করে দিল। তারপর চুড়িওয়ালি এক বুড়ির
কাছে গিয়ে কাপড়ের নিচে ঢেকে রাখা চুড়িগুলোর ওপর (হড়তালের জন্য ঢেকে দিয়েছিল বুড়ি) নিজের
ছড়িটা আস্তে করে ঠুকল ডেপুটি; জিজ্ঞেস করল বেচছিস না কেন? ঢেকে কেন রেখেছিস? বুড়ি এমন
ক্ষিপ্ত ভাবে জবাব দিল যেন কামড়ে খেয়ে নেবে। ডেপুটি সাহেব বোকা বনে গেলেন। আমরা মানলাম
আমাদের পূর্ণ সফলতা। তৃতীয় প্রহরে ঘোষণা করিয়ে দেওয়া হল যে এবার দোকানপাট খোলা যেতে
পারে আর লোকেরা খাওয়া-দাওয়ার জিনিষ কেনাবেচা করতে পারে। তখন গিয়ে দোকান খুলল।
(৪)
বিরাট ভুল
সেই দিনগুলোতেই ব্রহ্মপুরের আমার বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা হল আর হিন্দুদের
গোরক্ষার ভড়ংটা আমি খুব ভালো করে বুঝে নিলাম। বক্সার সাবডিভিশনের ব্রহ্মপুরে – যেটাকে
কাঁট ব্রহ্মপুরও বলা হয় এবং সেটা পুলিস থানাও – ফাল্গুন আর বৈশাখের কৃষ্ণপক্ষের শেষে
শিবরাত্রি উপলক্ষে খুব ভালো মেলা বসে। প্রচুর পশু বিক্রি হয়। ঘোড়া, মোষ, গরু আর বলদ
জমা হয় এন্তার এবং বিক্রিও হতে থাকে। ওই এলাকার ক্ষত্রিয় জমিদারদের জমিতে মেলা বসে
বলে ওরা অনেক টাকাও কামায়। ফি পশু কিছু পয়সা উশুল করে ওরা। মেলাটা মুখ্যতঃ পশুমেলাই
মনে করা হয়।
ওখানেই পুকুরের পাশে বাবা ব্রহ্মেশ্বর বা বর্মেশ্বরনাথের প্রসিদ্ধ
মন্দির। তার পুজারিরও হাত গরম হয় ভালো রকম। কেননা মেলা যত জমবে তত বেশি লোক আসবে আর
ভগবানের নামে চড়ান তত বেশি বেশি টাকা উনি পাবেন – শিব বাবার ওপর তত বেশি পুজো চড়বে।
তাই ধর্মের ঠিকেদার পুজারিরা, যাদের ব্রাহ্মণ বলা হয় আর ক্ষত্রিয় জমিদারেরা, যাদের
হিন্দুদের পূঁথিতে ধর্মরক্ষক বলা হয়েছে, দু দলই চায় যে মেলা যত বড় চায় হোক। সোজা অর্থ,
পশু বেশি বিক্রি হোক। এটাও জানা কথা যে পশুদের অধিকাংশ গরু আর বলদই হবে।
পয়সা কামান এই দুই দল ছাড়া আরো একটা দল আছে যেটা এখান থেকে কিছুটা
দূরে, উত্তরে গঙ্গাতীরে হয় গঙ্গায় নৌকো চালায় নয় সরকার বা ডি. বোর্ড থেকে ঘাটের বন্দোবস্ত
নেয়। ঠিকেদার এবং মাঝি দুজনেই চায় বেশি বেশি পশু নৌকোয় নদী পার হোক, তাহলে পারানিতে
বেশি পয়সা পাওয়া যাবে। তাই পশুমেলা ওই দলটার জন্যও লাভের। ওরা মন থেকে চায় যে মেলায়
বেশি পশু আসুক। ওই দলটারই মত আরেকটি চতুর্থ দল আছে পশুব্যবসায়ীদের, যারা দূরদূরান্ত
থেকে পালের পর পাল গরু-বলদ কিনে মেলায় নিয়ে আসে এবং এভাবে তার বেচাকেনার লাভ তোলে ঘরে।
তাই এরাও স্বাভাবিকভাবেই মেলার উন্নতি চায় যার স্পষ্ট অর্থ বেশি গরু-বলদের বিক্রি।
আমি দেখলাম সারন এবং বিশেষ করে চম্পারন জেলার ব্যবসায়ীরা পালের পাল পশুদের গঙ্গা পার
করিয়ে ওই মেলায় নিয়ে আসে।
এবার দুটো দল আরো থাকে যারা এই পশু বিক্রির সমর্থক। প্রথম তো আশেপাশের
গ্রামাঞ্চলের বেচাকেনা করা মানুষেরা বা এমন যারা কয়েক পাল করে পশু কিনে অন্য গ্রামাঞ্চলে
বা মেলায় বিক্রি করে। সাধারণতঃ গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা সহজেই মেলায় নিজেদের গরুবলদ বেচাকেনার
কাজ করে নেয়। কিন্তু যেমন বেচার ব্যবসায়ীরা পশুর পাল নিয়ে আসে তেমনই এমন খরিদ্দারও
আসে যারা ওখান থেকে কিনে অন্যত্র বিক্রি করে এবং পয়সা কামায়। আরেকটা দল কসাইদের আছে
যারা সহজে, কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়া মেলাতেই গরু-বলদ কিনে কসাইখানায় বিক্রি করে দেয়। মেলার
বাইরে পশু কেনা ওদের জন্য কঠিন। বিপদও আছে, অসুবিধাও আছে। কোথাও লোকে জেনে ফেললে লুটপাট,
মারপিট আর খুনখারাপিরও ভয় আছে। তাই এরাও মেলার উন্নতি চায়।
সবার ওপরে রয়েছে সরকার, যে এই সব মেলার রক্ষক। ক্যান্টনমেন্টের
(ফৌজি ছাউনি) গোরা সেপাইরা যেন নিয়মিত মাংস খেতে পায় সেদিকেও লক্ষ্য থাকে সরকারের।
তাই একদিকে সে যেমন চোর-বদমাশের উৎপাত থেকে মেলাটাকে রক্ষা করে, সেটা এই স্বার্থেও
করে যাতে নির্বাধে পশু কিনে ছাউনিতে পৌঁছোতে পারে। যদি এই মেলাগুলো না হয়, সরকারের
জন্য সমস্যা হবে ছাউনির জন্য পশু কেনা। সে সমস্যার সমধান সরকারের জন্যও সহজ নয়, কঠিন,
বলা যায় অসম্ভব। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে চায় যে মেলাগুলো সুরক্ষিত চলুক। এভাবে এই পশুমেলার
সমর্থক সাতটি দল।
এধরণের পরিস্থিতিতে, অজ্ঞতাবশতঃ আমি ভাবলাম যে আজকাল তো হিন্দু-মুসলমানে
মিলনের যুগ আর গরু সাথে কসাইয়ের সম্পর্কের প্রশ্নটাই এই মেলায় সবচেয়ে বড় বাধা। কেননা
সে সময় মসজিদের সামনে বাজনা আর মন্দিরে পুজো, আরতি বা কাঁসর বাজানোর চল হয়ই নি, আর
যদি তজ্জনিত সমস্যা কোথাও হয়েও থাকে, সাধারণ মানুষ জানত না। এসব তো পরে হয়েছে। এসব
অসহযোগ যুগের পরের ব্যাপার যখন ১৯২৪এ এবং তারপর শুদ্ধি আর তনজিমএর বিকট সমস্যা মাথা
চাড়া দিয়ে উঠল। সে সময় তারা এসব ধাঁধার জন্ম দিল যেগুলোর সমাধান, শুদ্ধি আর তনজিমের
ঝগড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হয় নি। বরং প্রতিদিন আরো বেশি জটিল হয়ে উঠছে।
তাই ভাবলাম আর সঙ্গীদের সাথেও আলোচনা করলাম যে চেষ্টা করে সমস্যাটার
সমাধান করা যাক। সবাই একমত হল। আশেপাশের জেলাগুলোতেও খবর পাঠিয়ে দিলাম যে আপনারা চেষ্টা
করে নিজের নিজের জেলায় বুঝিয়ে দিন যেন তারা ব্রহ্মপুরে গরু-বলদ না আনে। কিন্তু আসল
কাজ তো ছিল আমাদের শাহাবাদ জেলাতেই মেলার চারদিকের এলাকায় প্রচার। তারপর মেলার সময়
তার চারদিকের রাস্তায়, মেলা থেকে একটু দূরত্ব রেখে জোরদার পিকেটিং করালাম যাতে কোনো
লোক মেলায় গরু-বলদ না আনতে পারে। ওদিকে আমরা নিজেদের স্বেচ্ছাসেবকদের দল কে দল মেলায়
ছড়িয়ে রাখলাম যাতে পশু এসে গেলেও কসাইরা না কিনতে পারে। এর সোজা পথ আমরা বার করেছিলাম।
চেষ্টা করে কসাইদের চিনে নিয়েছিলাম। প্রত্যেকের সঙ্গে নিজেদের লোক লাগিয়ে দিলাম। যেখানে
কসাইরা যেত সেখানেই আমাদের লোকেরা আস্তে করে মানুষজনকে বলে দিত যে লোকটি কসাই।
এভাবে আটঘাট তো পুরো বাঁধলাম। কিন্তু এবার আমাদের অসুবিধের কথা শুনুন।
কসাইদের আটকাতে কোনো বেগ পেতে হল না। শান্তিতে হয়ে গেল কাজটা। কিন্তু ওরা এসেছিল লাভের
জন্য। ঘরের পয়সা খরচ করে এসে ফেরা এখন ওদের জন্য মৃত্যুর শামিল। তার ওপর সরকার আর পুলিস
ওদের পশু কেনায় রাজি ছিল এবং সে কারণে আমাদের লোকদের ধরপাকড় করার প্রয়োজন হলে তাও করত।
সেটা আমরা জেনেও গেলাম। কিন্তু যাহোক, তখন কোনো প্রকারে আমরা কসাইদের স্টেশনে পৌঁছে
দিলাম। কসাইরা একদিকে ভয়ও পাচ্ছিল যে মারপিট না শুরু হয়ে যায়, আবার অন্যদিকে পুলিশের
শক্তির ওপর ভরসাও ছিল ওদের। শুধু তাই নয়। ওখানেই আমরা দেখলাম, কসাইদের এজেন্ট ছিল ব্রাহ্মণ
এবং অন্যান্য হিন্দুরা, যারা কপালে চন্দনের বড় ফোঁটা পরে, গলায় কন্ঠী বেঁধে কাজ করছিল।
বেশ কয়েকজনকে আমরা ধরলামও। এই এজেন্টদের জন্যও কসাইদের সাহস বাড়ত। আমাদের ভয় ছিল যে
যদি সরকারি পুলিশ জোর খাটিয়ে কসাইদের দিয়ে পশু কেনায় তাহলে দাঙ্গা হয়ে যাবে এবং আমাদের
সমস্ত প্রয়াস ধুলোয় মিশে যাবে। তাই আমরাও ভয় পাচ্ছিলাম এবং কসাইরাও। এই অবস্থায় কসাইরা
কোনো রকমে ফেরার জন্য রাজি হয়ে টিকিট কাটিয়ে দিতে বলল। কেননা লাভ তো এমনিতেই গেল। এটুকু
অন্ততঃ হোক। আমরাও ভাবলাম ভাগ্য ভাল। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে মেলা থেকে দু’শোর কিছু বেশি
টাকা তুলে ওদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
কিন্তু এর মধ্যে যে আসল সমস্যাটা এল সেটাই তো মজাদার। হিন্দু এজেন্টদের
কথা তো মামুলি। যেই আমরা মেলার চার দিকে পিকেটিং শুরু করলাম, ওখানকার জমিদারেরা আমাদের
ওপর অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। বলতে লাগল, আপনারা তো আমাদের মেলা ভেঙে আমাদের রোজগারের বারোটা
বাজাচ্ছেন! মন্দিরের পান্ডারা আলাদা খাপ্পা হয়ে উঠল। হাল্লা করতে শুরু করল, যে যদি
গরু-বলদ এখানে না-ই আসে তাহলে মানুষে আসতে যাবে কেন? তখন তো মন্দিরে দান-অর্পণ-উৎসর্গ
প্রভৃতিও কমে যাবে, আমাদের রোজগারও কমে যাবে। তাই আপনারা আমাদের শত্রু! যারা পালের
পর পাল পশু নিয়ে আসত, বাধা পেয়ে তারা নিজের জায়গায় কান্নাকাটি শুরু করে দিল যে বাপ
রে বাপ! হাজার হাজার টাকা ঢেলে আমরা পশু কিনেছি! এভাবে একবার ফিরলেই তো আমরা সর্বস্বান্ত
হয়ে যাব – আমাদের বালবাচ্চারা মরে যাবে। ওদিকে গঙ্গার পাড়ে ঘাটের ইজারাদার আর মাল্লারা
বলছিল যে পশুদের নিয়ে যাওয়া-আসা থেকে হওয়া রোজগারটাই তো আসল রোজগার। যদি আপনারা সেটাই
বন্ধ করে দেন তাহলে জানবেন যে আমরা দেউলিয়া হব আর যাদের সন্তানাদি আছে তারা খিদের জ্বালায়
মরবে। শুধু তাই নয়, ঘরদোর বিক্রি করে আমাদের ইজারার পয়সা ফেরত দিতে হবে সরকারকে। এসবের
থেকে আলাদা গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা রেগে ছিল যে আমাদের তো বচ্ছরকার প্রোগ্রামটাই শেষ
হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বেচা-কেনা, যেটা জরুরিও আর মেলার জন্য সহজে হয়েও যেত, বন্ধ হয়ে
যাবে। মেলার দোকানদারদেরও এধরণেরই ত্রাহিত্রাহি ভাব ছিল। সরকার তো রেগে ছিলই আর কালেক্টার
সাহেবের ক্রোধাগ্নি থেকে সেবার আমরা বাঁচলাম কিভাবে সেটাও একটা গল্পই।
এটাও জানিয়ে দেওয়া দরকার যে সরকার বাদে – সরকার তো খোলাখুলি সামনে
আসেওনি – ওপরে উল্লিখিত বাকি সব কটা দল আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে আর
কি। বিশেষত্ব তো এটাই যে তারা সবাই হিন্দু ছিল, তাও আবার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি।
এরাই গোরক্ষার নামে হাওয়া তোলে আর কসাইদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। কসাই গরু কিনে নিলে
এদেরই ধর্ম রসাতলে যায়, এদের ভগবান রুষ্ট হন, আর এঁদের জন্য রৌরব নরকের দরজা খুলে যায়।
এরাই গোরক্ষা আর গরুর জন্য আর্তধ্বনি ওঠাতে থাকে দিন রাত। অথচ এরাই মনেপ্রাণে, গোরক্ষার
জন্য আমাদের তৈরি করা সর্বশ্রেষ্ঠ পথটার বিরোধ করল। সবাইকে আমরা বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত
হয়ে পড়লাম যে এটা আপনাদেরই ধর্মরক্ষার ব্যাপার, যার জন্য আপনারা আহবান করেন। কিন্তু
শোনে কে? আমাদের যুক্তি, আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা তো ঝড়ের সামনে পাখার হাওয়ার মত ছিল।
তার আর কী প্রভাব পড়বে?
কারণ কী ছিল? এটাই তো, যে ধর্ম এবং ভগবান তাদের সামনে এলেন তো বটে,
কিন্তু টাকাপয়সার বিরুদ্ধে, টাকাপয়সার বিরোধী হয়ে। তাই তিরস্কৃত হলেন। বুঝেশুনে এলেন
না। উনিও ভাবলেন না আর আমরাও ভাবলাম না যে আমরা কাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি। সেটাই তো
বিরাট ভুল ছিল। ছোট ধর্ম আর ছোট ভগবান, পয়সা নামের বড় ধর্ম আর বড় ভগবানের বিরোধ করলেন
আর হেরে গেলেন। জবরদস্ত টক্কর হল বস্তুবাদের (materialism) সাথে আধ্যাত্মবাদের (spiritualism)
এবং আধ্যাত্ম গো-হারান হেরে গেল। ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেওয়া হল যে খবরদার, এমন
ভুল আর কখনো কর না, নইলে দেখলে তো ফল? আমার তো চোখের পর্দাই সরে গেল। স্পষ্ট দেখতে
পেলাম যে ধর্মের প্রশ্ন কতটা বাহ্যিক ও দেখনাই। কতটা ধাপ্পার ব্যাপার। আমার গোঁড়া ধার্মিক
চিন্তাচেতনায় খুব বড় ধাক্কা লাগল আর আমি ছটফট করে উঠলাম।
যদিও এই একটাই দৃষ্টান্ত ধর্মের বাস্তবিক রূপটাকে খোলসা করে দেওয়ার
জন্য যথেষ্ট ছিল। তবুও সে সময় আমি ততটা ব্যাপক ভাবে ঘটনাটাকে নিই নি। আমি শুধু এটুকুই
তাৎপর্য বার করতে পারলাম যে হিন্দুদের গোরক্ষার প্রশ্নটা ভন্ডামি আর ধাপ্পা, দেখনাই
আর লোকদেখানি। তাই এ প্রশ্নে কখনই সঙ্গ দেওয়া উচিৎ নয়। এটাও মেনে নিলাম যে এধরণের গোরক্ষার
জিগির নিছক নির্বুদ্ধিতা; হিন্দুরা এটা তুলতেও পারে না। সেদিন থেকে আমি হিন্দুদেরই
গোহত্যার জন্য পুরোপুরি দোষী মানতে শুরু করলাম এবং এখনও আমি ঠিক তাই মানি।
এটা ঠিক যে ঘটনাটা শুধু কোনো বিশেষ ধর্ম নয়, সব ধর্মেরই নাম ও আসল
চেহারার ভিতরের ফারাকটার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করার মত ছিল। পরে আমি সেটা বুঝলামও। কিন্তু
সে সময় এত ব্যাপক তাৎপর্য অব্দি পৌঁছোন আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। এক তো ধর্মের ভুত আগে
থেকেই কাঁধে চেপে ছিল। দ্বিতীয়তঃ সেই ধর্মচিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়েই আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম।
তৃতীয়তঃ, গান্ধিজি তো রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখতেনই না, আর তাই রাজনীতির সব
কটা দিককে ধার্মিক রূপ দিচ্ছিলেন। আর আমিও সে সময় ছিলাম ওনার গোঁড়া সমর্থক। নিয়মিত
ইয়ং ইন্ডিয়া পড়তাম। তাই আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল যে অকস্মাৎ পুরো ধর্ম বিষয়টারই সেধরণের
ব্যাপক তাৎপর্য ওই একটি ঘটনার মধ্যে থেকে খুঁজে নেব।
সত্যি বলতে, সেসময় বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আমার তেমন সর্বাত্মক ও ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু পরে অভিজ্ঞতাই বলল যে ধর্ম ব্যাপারটাই তাই। ফলে ধর্ম প্রসঙ্গে আজ আমার বিচিত্র অবস্থা। এক দিকে পঞ্চাশ বছরের সংস্কার। তার সঙ্গে আবার গীতা, যা আমার রক্তে বইছে। অন্য দিকে ঠিক তার বিপরীত অভিজ্ঞতা আছে সারা জীবনের, তাও খুব কাছ থেকে। তাই পরে কী হবে বলতে পারি না। কিন্তু এটা ঠিক যে ধর্ম সম্পর্কে আমার সমস্ত পুরোনো ধারণা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং চিন্তায় বিপ্লব ঘটে গেছে। ধর্মের যে রূপ, যে স্থান আমার হৃদয়ে রয়েছে তার বর্ণনা আমি শেষে করব। কিন্তু এটুকু স্পষ্ট যে ধর্ম সার্বজনিক বস্তু নয়, এবং সবার জন্যও নয়। ব্যতিক্রম হিসেবে কারুর কারুর জন্য ধর্ম; নিয়ম রূপে নয়। তাও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং সে হিসেবেও তার রূপ আমার মনে অনন্য এবং প্রচলিত ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
(৫)
আহমেদাবাদ কংগ্রেস
আগে যেমন বলেছিলাম, বছর ফুরোতে না ফুরোতে আমি চলে গেলাম গাজিপুর।
সেখানেই কাজে নেমে পড়লাম। সেখান থেকেই কয়েকজন সাথীর সঙ্গে আহমেদাবাদ কংগ্রেসে অংশগ্রহণ
করতে রওনা হয়ে গেলাম। রাস্তায় দেখলাম অনেক কিছু। প্রথম তো জয়পুরে নেমে সেখানকার জেলখানা
দেখলাম। দেখে অবাকও হলাম এবং আনন্দও হল যে সে জেলখানায় কয়েদিদের পশুর মত করে, অপমানিত
করে রাখা হয় না। আমাদের জেলের মত ডোরাকাটা কাপড়ও তাদের দেওয়া হয় না। ছোট তোয়ালে, টুপি
ইত্যাদি না দিয়ে ধুতি আর গামছা দেওয়া হয়। পরিবেশ এমন ছিল যাতে তারা নিজেদের ওপরে ওঠাতে
পারে, ব্রিটিশ-ভারতের জেলের মত নিজেদের আরো নামিয়ে যেতে না থাকে। সবচেয়ে বড় কথা যে
গালচে, সতরঞ্চি ইত্যাদির কারিগরির এমন সমস্ত কাজ ওদের শেখান হত যেন বাইরে গিয়ে তারা
সহজে দু-চারটাকা রোজগার করতে পারে। এ কথাটা আমাদের বলাও হল আর আমরা নিজেরাও ওখানকার
তৈরি জিনিষ দেখলাম। এটাও বলা হল আমাদের যে একবার যারা এই জেলের বাইরে যায় তারা দ্বিতীয়বার
আসেই না বলতে গেলে।
দ্বিতীয় ব্যাপার যা দেখলাম, জয়পুরের পর পথে যেখানেই ট্রেন থামত,
পাঞ্জাবিদের একটা দল সঙ্গে সঙ্গে করতাল ইত্যাদি নিয়ে স্টেশনে নেমে পড়ত। গাইতে শুরু
করত, “রাখব না এ সরকার, অত্যাচারী, রাখব না”! এমন উৎসাহ এবং সুরে-তানে তারা গাইত যে
অবাক হয়ে যেতাম। ওদের গানে স্টেশনে ভীড় জুটে যেত।
কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কিন্তু সরকার তাঁকে
আগেই গ্রেফতার করে নিল। ফলে সভাপতিত্ব করলেন হাকিম সাহেব আজমল খাঁ। কংগ্রেসে উদ্দীপনা
তো দেখার মত ছিল। ঢেউ উঠছিল। সেই অধিবেশনেই সত্যাগ্রহের নিয়ম এবং প্রতিজ্ঞাপত্র পাশ
হল। আর কংগ্রেসের উদ্দেশ্য থেকে ‘স্বরাজ্য’ সরিয়ে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ করার সংশোধন
পেশ করলেন মওলানা হসরত মোহানি। মোহানি গান্ধিজির কথার অন্ধ ভক্ত ছিলেন। তাই মওলানার
প্রস্তাব আমার ঠিক রুচল না। কত দিনের পর না জানি প্রস্তাবটা আমার সঠিক মনে হয়েছিল আর
এখন তো ওতেও মনে হয় আমার কাজ চলবে না। এখন তো পূর্ণ স্বাধীনতারও পুরো ব্যাখ্যা চাই।
মওলানা ওখানেই মুসলিম লীগের অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। সেই পদ থেকেই যে ভাষণ দিলেন, তার
ভিত্তিতে ওনার ওপর মোকদ্দমা চলল আর ওনাকে বন্দী করা হল। আজকের মুসলিম লীগ আর তখনকার
মুসলিম লীগে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আজ কবির কথায়, “সেই উচ্চশিখর এই ধ্বংস, সেই তেজ এই অধঃপতন”
অক্ষরে অক্ষরে চরিতার্থ হয়।
গান্ধিজির ভাষণ আমি খুব মন দিয়ে শুনলাম। শোনার মতই ছিল। টেবিলে বসে
বলছিলেন। সারা শরীর এবং বিশেষ করে চেহারায় রক্তিমাভা ছিল। মনে হচ্ছিল কালরূপী কোনো
শক্তি ঐকান্তিকভাবে সরকারকে যুদ্ধে আহ্বান করছে এবং সাবধান করছে যাতে তার শুভবুদ্ধির
উদয় হয়। কয়েক ঘন্টা বললেন। প্যান্ডেলে পূর্ণ নীরবতা ছিল। তাঁর ওই রকম ভাষণ এবং চেহারা
আমি পরে আর কখনো দেখনি। এক একটি শব্দ যেন সরকারের জন্য বজ্র। মনে হচ্ছিল কালাগ্নি-রুদ্র
বলছে, গর্জন করছে এবং এর পরেই সে প্রলয় নিয়ে আসবে।
একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম। সরকারের গতিপ্রকৃতি ডিসেম্বর আসতে না
আসতে বদলে গিয়েছিল। ক্রিমিনাল ল এমেন্ডমেন্ট আইন জারি করে স্বেচ্ছাসেবক হওয়া বা বহাল
করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই জায়গায় জায়গায় লোকে ম্যাজিস্ট্রেটকে চিঠি লেখা শুরু করে
দিয়েছিল এই মর্মে যে, আমরা স্বেচ্ছাসেবক হই এবং বহাল করি। ভাবা হয়েছিল যে সরকারকে চ্যালেঞ্জ
করা হবে। কিছুদিন আগেই যুক্ত প্রদেশের কংগ্রেস কমিটির ৫৫ জন সদস্যকে মিটিংএর সময় একসাথে
গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কেননা কংগ্রেস বেআইনি প্রতিষ্ঠান ঘোষিত হয়েছিল। তাই সরকারকে
চ্যালেঞ্জ জানানো দরকার হয়ে পড়েছিল। আমরা যে তিন-চারজন গাজিপুর থেকে ডেলিগেট হয়ে আহমেদাবাদ
গিয়েছিলাম, তার মধ্যে কয়েকজন রওনা হওয়ার আগেই ম্যাজিস্ট্রেটকে খবরটা জানিয়ে দিয়েছিল।
বাকিরা, যার মধ্যে আমিও ছিলাম, ট্রেন থেকেই লিখে পাঠিয়েছিল। তার পরিণতি হল এই যে আহমেদাবাদ
থেকে ফিরেই আমি জেলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম।
এখানে, জেলে যাওয়ার প্রস্তুতির ব্যাপারে এও বলে দিই যে জেলের কষ্টের
কথা ভেবে কয়েক মাস আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। তখন অব্দি জেলে যাওয়ার সুযোগ
হয় নি। শুধু লোকের মুখে জেনেছিলাম তার কষ্ট। সে হিসেবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
লেখাপড়া করার সময় থেকেই আমার একটা অভ্যেস ছিল। ঘুমোবার সময় মাথায়
কোনো ঠান্ডা তেল, সাধারণতঃ তিল-তেল, নিয়মিত লাগাতাম। খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল অভ্যেসটা।
এমন অবস্থা হয়ে পড়েছিল যে এক দিন তেল না লাগালে পুরো মাথাটা গরম হয়ে উঠত এবং ব্যথা
করত। ভাবলাম যে কুড়ি বছরের এই অভ্যেসটার জন্য জেলে গিয়ে ভীষণ অসুবিধে হবে। তাই আগে
থেকেই তেল না লাগানর অভ্যেস করে নেওয়া উচিৎ, যাতে তেল না লাগিয়েও কাজ চলে। তাই বক্সারে
থাকার সময়েই আমি তেল লাগান ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রথম বার আমি বিশেষ ভাবে অনুভব করলাম যে
মানুষের সংকল্পে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্তে খুব বড় শক্তি আছে। সেই শক্তি ব্যবহার করে সে যা
চায় করতে পারে। তাই সংকল্প নিয়ে তেল লাগান ছাড়ার পর আমার এক দিনও কষ্টের বোধ হল না।
বরং, সবসময় তেলের চিন্তা, লাগানর আর জামাকাপড় নোংরা হয়ে যাওয়ার হয়রানি থেকে একেবারের
জন্য বেঁচে গেলাম। তারপর থেকে আজ অব্দি আমি মাথায় কখনোই আর তেল লাগাইনি। শরীরে তেল
লাগান আর মালিশ করা তো তার আগেই না জানি কবে ছেড়ে গিয়েছিল। এখনো ছেড়েই আছে। ফলে, জ্বর
হলে শরীরে ব্যথাবেদনা যাই হোক, মাথায় আর ব্যথা হয়ই না। এমনিতেও মাথাব্যথায় আমি তারপর
থেকে আর কখনো ভুগিনি। শীতের দিনে তেল না লাগালে গায়ের চামড়া আমার রুক্ষ হয় না কখনো।
অবশ্য এদিকে দু বছর ধরে শোয়ার সময় দুটো পায়ের তলায় গোড়ালির দিকে একটু করে সর্ষের তেল
মালিশ করি। কেননা এদিকে, বয়স বেড়ে গেছে বলে, যখনি বেশি কথা বলি বা লম্বা বক্তৃতা দিতে
হয়, মাথায় শুকনো ভাব লাগে; এই মালিশে সেটা শেষ হয়ে যায়। ঠোঁটও আজকাল আর শীতের শুকনো
ভাবে কখনো ফাটে না।
(৬)
প্রথম জেলে যাওয়া – গাজিপুরে
আহমেদাবাদ থেকে ফিরতেই, গাজিপুরের স্টিমারঘাটায় গোয়েন্দাপুলিসের
দেখা পেলাম। চেহারায় উদ্বেগ ছিল। সেদিন ১লা জানুয়ারি ১৯২২। আমরা বুঝে গেলাম
যে এবার গ্রেপ্তারি হবে। হলও তাই। যদ্দূর মনে পড়ে, ২রা জানুয়ারিতে পুলিসের অফিসার সকালেই
জেলা কংগ্রেস কমিটির দপ্তরে পৌঁছোল আর বেলা হতে হতে আমাদের তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিল।
আর কী? স্নান-টান করে, একটু কিছু খেয়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। একে অন্যেকে মালা পরান
হলে আমাদের কোতোয়ালি নিয়ে আসা হল। সেখান থেকে আমরা জেলে প্রবেশ করলাম।
ভিতরে পৌঁছোতেই, খুব জোরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকা একটা আওয়াজ শুনলাম।
বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কী। ইতিমধ্যে জেলার এসে বলল বালিয়া জেলা থেকে কয়েকজন রাজনৈতিক
বন্দী এসেছে। কোনো কাজ তো করেই না, উল্টে ঝামেলা পাকায় আর চ্যাঁচায়। আমি হতবাক হয়ে
পড়লাম। কেননা গান্ধিজির কড়া আদেশ ছিল যেন জেলের সব নিয়ম পালন করা হয় এবং অবাঞ্ছিত কোনো
কাজ না করা হয়। জেলার বলল, একটু চলুন, বুঝিয়ে বলবেন। গেলাম। ওদিকে জাঁতাঘরে বালিয়ার
পরিচিত কর্মকর্তাদের পেলাম। ওদের গম পেষার কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গম পেষার বদলে
ওরা গমে মিশে থাকা ছোলাগুলো বেছে বেছে খেয়ে ‘মহাত্মা গান্ধির জয়’ আওয়াজ তুলত। আমায়
দেখেই চুপ করে গেল। দণ্ডবৎ প্রণাম সেরে ঔৎসুক্যের সাথে আহমেদাবাদ কংগ্রেসের কথা জিজ্ঞেস
করতে লাগল। সংক্ষেপে সব কিছু বলে জিজ্ঞেস করলাম চ্যাঁচামেচি কিসের? কাজ করতে অস্বীকার
করছেন কেন? জবাব পেলাম আমরা তো স্লোগান তুলি। আগে যে স্লোগান তুলতাম সেটা ছেড়ে দেব
কেন? কাজই বা করব কেন? আমি বললাম, ‘গান্ধিজির জয়’ বলেন। তাঁর কথা মেনেই জেলে এসেছেন।
তাঁরই আজ্ঞা যে জেলের সব নিয়ম যেন পালন করা হয়। কাজ করা উচিৎ এবং স্লোগান বন্ধ করা
উচিৎ। ওরা জবাব দিল, “বাহ, কাজ করে আমরা শত্রুকে সাহায্য করব কেন? স্লোগানই বা বন্ধ
করব কেন?” যদিও সে সময় তারা আমার কথায় স্লোগান বন্ধ করে দিল। কিন্তু ওদের বোঝাতে পারলাম
না। কাজটায় অসফল হলাম। ফলে ওদের স্লোগানও বন্ধ হল না আর ওরা কাজও করল না। শিগগিরই কয়েক
দিনের মধ্যে আমায় আরো কয়েকজন লোকের সঙ্গে বেনারস জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
ঘটনাটা আমায় বুঝিয়ে দিল যে আমি ভিন্ন জগতে বাস করছি। অবাক হচ্ছিলাম
যে এসব কী হচ্ছে? লেখাপড়া জানা মানুষেরা এভাবে গান্ধিজির আজ্ঞা অমান্য কেম করেন? গান্ধিজির
জয়ধ্বনির সঙ্গে তাঁর আজ্ঞার এমন গুরুতর অবহেলা অত্যন্ত বিচলিত করল আমায়। লক্ষণ ভালো
মনে হল না। সেদিন থেকে বার বার আমি এই ব্যাপারটা দেখেছি। দ্বিতীয়বার ১৯৩০ সালে যখন
হাজারিবাগ জেলে ছিলাম সেখানেও এই একই ব্যাপার দেখলাম। জেলের নিয়ম পালন সংক্রান্ত ওনার
আদেশ অদৃশ্য থাকত বন্দীদের ব্যবহারে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর রাজবন্দীরা গান্দিজির
কথার বিন্দুমাত্র পরোয়া করত না, যদিও তারাই দেশের নেতা ছিল। ভবিষ্যতে স্বরাজ্যের সরকার
ওদেরই পরিচালনা করার ছিল। হাজারিবাগ জেলে এ ব্যাপারে দেখলাম রাজেন্দ্রবাবুও অসমর্থ।
কেই তাঁর পরোয়া করত না। সেদিন থেকেই আমি মাঝে মধ্যে ভাবতে শুরু করলাম, আর এদিকে আরো
বেশি অভিজ্ঞতা হওয়ায় মনে মনে বললাম যে এক দিন, যদি প্রয়োজন হয়, ‘গান্ধিজির জয়’ বলে
তাঁর হত্যাও লোকে ঠিক এভাবেই করতে পারে, যেভাবে আজ তারা গান্ধিজির আদেশগুলোর হত্যা
করছে। ‘মহাবীরের জয়’ বলে লুটপাট করার, আগুন লাগানোর বা মুসলমানদের সাথ মারপিট করার
অর্থও আমি সেদিনগুলোয় বুঝে গেলাম।
বস্তুতঃ আমরা যতই আদর্শবাদী হই বা তার প্রচার করতে চাই না কেন, জনগণের
নিজস্ব নিক্তি থাকে জিনিষগুলো ওজন করার। নিজস্ব রাস্তা থাকে কাজ করার। যদি আমাদের কথা
সেই নিক্তিতে তাদের সাচ্চা মনে হয় তাহলে ভালো। তাহলে সে কথাগুলো তারা ভালোভাবে পালন
করবে। কিন্তু সাচ্চা না মনে হলে পালনের নামে উল্টোটা করবে। তেমনই, ওদের নিজস্ব রাস্তা
থেকে ভিন্ন কোন রাস্তায় যদি আপনি ওদের নিয়ে যেতে চান, একই বিপদ হবে। কিছুক্ষণ বা আপনার
সামনে হয়ত ওরা আপনার রাস্তায় চলছে দেখতে পাবেন। কিন্তু তারপর ওরা স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের
চিরপরিচিত রাস্তা ধরবে। এটা ধ্রুব সত্য। জগতের ইতিহাস এবং সে জগতে জন্ম নেওয়া নানান
ধর্ম, মত ও সভ্যতার ইতিহাস স্পষ্ট বলে যে মাঝে মধ্যে অবতার, পেশোয়া [অগ্রণী অর্থে],
পয়গম্বর, মুক্তিদাতা অথবা মুনি-ঋষি জন্ম নিয়ে থাকেন সত্যি। অক্লান্ত পরিশ্রমে, বহু
বাধাবিপত্তি পেরিয়ে কিছু দিনের জন্য তাঁরা কিছু মানুষকে সত্য, নম্রতা, দয়া ইত্যাদির
পথে অবশ্যই চালিত করেন। কিন্তু তাঁরা সরে যেতেই শিথিলতা এবং বিশৃংখলা মাথা ওঠাতে শুরু
করে। ব্যাপারটা প্রথমে বোঝা যায় না। কিন্তু পরে গিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় এবং কয়েক দিনের
পর ‘সেই বেঢঙা গতি’ শুরু হয়ে যায়। তাঁদের হাজার, লক্ষ বছরের চেষ্টার পরেও এই দুনিয়ায়
সেই এক অসত্য, এক নিষ্ঠুরতা, এক অনাচার-ব্যাভিচার আজও কী ভীষণ পরিব্যাপ্ত! যেন কিছু
হয়ই নি!
জগতের এই সহজ প্রবৃত্তি, নিজস্ব নিরিখ এবং নিজস্ব পথটা নজরে না রেখে
বা উপেক্ষা করে যে সংস্কারক বা পেশোয়া কোনো আদর্শবাদের প্রচার করতে চায়, সে পাথরে মাথা
খোঁড়ে। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় তো এটা বুঝিনি কিন্তু আজ বা কিছুদিন আগে থেকে আমি
এই নিষ্পত্তিতে পৌঁছেছি। দুঃখের কথা যে গান্ধিজি আজও এই প্রকট সত্যটাকে – যে শুনতে
চায় তার জন্য পাহাড়ের চুড়ো থেকে ডাকতে থাকা এই সত্যটাকে – বিগত কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতার
পরও বুঝতে পারেন নি। মনে হয় উনি বোধহয় বুঝতেও চান না।
যাহোক, শিগগিরই আমার মামলা এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পেশ
হল। ন্যায়ের ঢং করল, যেমন সে জমানায় আকচারই হত। কেননা, কংগ্রেসওয়ালারা নিজেদের তদ্বির
তো করতই না বরং অপরাধ স্বীকার করে নিত; এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং পঁচিশ টাকা
জরিমানা হল আমার। জরিমানা না দিলে আরো এক মাসের সশ্রম, মানে সব মিলিয়ে তের মাসের সশ্রম
কারাদন্ড শোনান হল। ক্রিমিনাল ল এমেন্ডমেন্টের দ্বিতীয় বা (ব) ধারা অনুসারে এই দন্ড
দেওয়া হল। তারপর তো জেলে পৌঁছোতেই নিয়মমাফিক গলায় তক্তা (তৌক) পরিয়ে দেওয়া হল, জেলের
জামাকাপড়ও পেয়ে গেলাম আর আমি পুরোপুরি কয়েদি হয়ে গেলাম। পরে আমার সেই দু-তিনজন সঙ্গীও
একইভাবে ধরা পড়ল এবং কয়েদি হয়ে গেল।
এগোবার আগে একটা কথা বলে নিই। প্রথম থেকেই অন্নজল-গ্রহণের ব্যাপারে
আমি পরিচ্ছন্নতা এবং তজ্জনিত স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার পক্ষপাতী ছিলাম। ফলে, এমনকি রেলগাড়িতে
চেপেও খাবার খেতাম না। মিষ্টির দোকানের মিষ্টিও খেতাম না। এই অভ্যেসটায়, বিশেষ করে
বাজারের রান্না করা জিনিষ না খাওয়ার ব্যাপারে আরো কঠোর হয়ে পড়েছিলাম। অথচ জেলে ঢুকেই
দেখি, সেখানে লোহার বাসন। সেগুলো তো ভালো করে ধোওয়াও হয় না কখনো। যেমন তেমন করে ধুয়ে
রেখে দেওয়া হয়। ধোয়ার নামে নিয়মরক্ষা করা হয় মাত্র। জলও এমন জায়গায় ভরা থাকে যে সেটাও
এঁটোই হয়ে যায়। দরকার নেই, তবু এঁটো হাত আর বাসন ওতে ডুবিয়ে নেয় কেউ না কেউ। এসব দেখেই
আমি ক্ষেপে গেলাম। ফলে জেলের খাবার খাওয়ার সাহস হল না। ওই জলও নিতে পারলাম না। দু’একদিন
তো কিছুই খেলাম না। তারপর জেলার দুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করল। ইতিমধ্যে আমাদের বেনারসে
পাঠাবার হুকুম এসে গেল। সেখানেই গেলাম। কাজেই গাজিপুর জেলে মাত্র কয়েকটা দিনই কাটল।
ভালোই হল যে সন্ন্যাস নেওয়ার আগে যেখানে লেখাপড়ায় বেশকিছু বছ গেছিল সেখানেই, রাজনৈতিক
জীবনে প্রবেশ করার পথে প্রথম কেস চলল এবং জেলযাত্রা সম্পন্ন করলাম।
(৭)
বেনারসে জেল-অনশন
গাজিপুর থেকে অনেক সঙ্গী-সাথী সহকারে আমাদের বেনারস জেলে পাঠানো
হল। পাঠানোর আগেই আমাদের গলা থেকে তক্তা (তৌক) সরিয়ে নেওয়া হল। রহস্যটা বুঝলাম না।
বেনারসের জেলা কারাগৃহে আমাদের সবাইকে পৌঁছে দেওয়া হল। কয়েকজনকে আগেই ওখানে যুক্ত প্রদেশের
অন্যান্য জেল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের সংখ্যা বেশি ছিল না। কিন্তু প্রতিদিন লাইন
লেগে থাকত আগন্তুকদের। ওখানে আমরা নিজেদের জামাকাপড় পরতে পেয়ে গেলাম। খাওয়া-দাওয়ারও
ওখানে ভিন্ন ব্যবস্থা ছিল। লোকেরা নিজেদের খাবার রান্নার ব্যবস্থা নিজেরা করে নিত।
তাই আমার খাবারের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। উপোষ করার প্রয়োজন রইল না। ওই জেলে কাশীর
পরিচিত মানুষদের সাথেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত। আমার দন্ডী সঙ্গীর সাথেও দেখা হয়ে গেল।
আমার দন্ড আমার সঙ্গেও জেলে গিয়েছিল এবং সুরক্ষিত রাখা থাকত। ওখানে প্রথম বার শ্রী
কৃপালনির সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত হলাম। গান্ধি-আশ্রমের (খাদি-কেন্দ্র) জনা কুড়ি যুবকও
তাঁর সাথে ছিল। শ্রী সম্পূর্ণানন্দজির সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল কাশীতে। উনিও জেলে
এসে গিয়েছিলেন। গোরখপুরের বাবা রাঘব দাসের সাথে ওখানেই দেখা হল। যুক্তপ্রদেশের প্রতিটি
জেলা থেকে মোট তিন-চারশ’ রাজবন্দি ওখানে জমা হয়েছিল। সব ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মানুষ
ছিল তাতে।
আজ যারা গান্ধিবাদের পূজারি, সে সময় তারা কী করত তার দৃষ্টান্ত আমি
জেলে পেয়েছিলাম। জানা গেল যে যুক্তপ্রদেশের সবক’টি জেলার প্রথম শ্রেণির রাজবন্দীদের
ওই জেলেই রাখা হবে। এটাই সরকারের সিদ্ধান্ত। তাই সেই শ্রেণির বন্দীদেরই ওখানে আনা হল।
ফলে, ওদের মনোভাব ও প্রবৃত্তি থেকে স্পষ্ট জানা যাবে যে গান্ধিজির আদেশ ওরা কতটা মানত।
এক দিন এমন হল, সন্ধ্যেবেলায় নিয়মমাফিক গুনতির সময় হল সমস্যা। কারণ
ছিল সেই কৃপলানিজির দল। ওরা নিজেদের মধ্যেকার দু’একটি ছেলেকে প্রতিবার গুনতির
সময় কে জানে কেমন করে লুকিয়ে রাখল যে একবারও সঠিক গুনতি হতে পারল না। তখন সেন্ত্রাল
জেলের জেলার এবং তাঁর লোকজনও এল। রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল, জেলারের লোকেরা গুনতি করছিল।
তবুও সফল ভাবে গুনতি হল না। শেষে ‘হয়ে গেছে’ বলে ওরা দরজা বন্ধ করে চলে গেল। সেদিন
থেকে ওদের ক্ষ্যাপানোর জন্য ‘হয়ে গেছে’ বলা শুরু হল। জেলের লোকেদের দেখতেই কয়েদিরা
হাসত আর ‘হয়ে গেছে’, ‘হয়ে গেছে’ বলা শুরু করত। লোহার ডেকচিগুলো অনেক রাত অব্দি ওরা
বাজাত আর হই-হট্টগোল বাধিয়ে রাখত। ওই একটাই দল ছিল যেটা এই সমস্তকিছু করত। আজ তো সেই
দলটাকেই মহাত্মাজির সাচ্চা অনুগামী মনে করা হয়। মিস্টার হার্বি নামে এক ক্রিশ্চান ভদ্রলোক
জেলটার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন এবং খুব ভালো মানুষও ছিলেন তিনি। কিন্তু সরকারী চাকর
ছিলেন এটাই তাঁর অপরাধ ছিল। আমাদের সঙ্গীরা ওঁকে কিভাবে যে বার বার উত্যক্ত করত সে
বলার মত নয়। এসব দেখে একদিন আমার মনে হয়েছিল যে বস্তুতঃ মিস্টার হার্বিই এই হিসেবে
গান্ধিজির আজ্ঞাবাহক যে উনি এত শান্ত, আর আমরাই যেন ওনার তুলনায় পেশাদার দুর্বৃত্ত।
বান্দা জেলার কয়েকজন ওখানে ছিলেন। জানতে পারলাম যে ওদের মাঝে একজন
লম্বা দাড়িওয়ালা ব্রহ্মচারিও আছে। কিছুকাল পর হঠাৎ একদিন সে অনশন করা শুরু করল। দু’একদিন
পর তার সঙ্গীদের মাঝে এ নিয়ে আলোচনা হল এবং ওরাও অনশনে বসে পড়ল। তিন-চার বা ছ-সাত দিনের
পর বাকি সবাইয়ের মাঝে উত্তেজনা ছড়াল যে তাদের কী করণীয়, এবং সবাইকে নিয়ে মিটিং করার
প্রস্তুতি শুরু হল। সে সময় আমাকেও ডাকা হল। তখন আমি জানতে পারলাম যে কয়েক সপ্তাহ ধরে
অনশন চলছে। আগে এত ছড়ায়নি খবরটা। মিটিংএ দেখলাম সবাই অনশন শুরু করার দিকে ঝুঁকছে। আমার
ঠিক মনে হল না। জানিনা কেন স্বভাবগত ভাবে চিরদিন আমি অনশনের এবং বিশেষ করে জেলে
অনশনের বিরোধী।
আমি প্রশ্ন করলাম, প্রাণ দেওয়ার তোরজোড় কী জন্য? কোনো একটা বড় কারণ
থাকাও তো দরকার? বলা হল যে যখন সঙ্গীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে করছে, আমাদেরও ওদের সঙ্গ দিতে
শুরু করে দেওয়া উচিৎ। আমি বললাম এই পথটাই ভুল। কেউ এগিয়ে গেছে বলেই আমাদেরও সেদিকেই
যাওয়া ঠিক নয়। হ্যাঁ, যে উদ্দেশ্যে ওরা ওই পথে গেছে সে উদ্দেশ্যটা যদি ঠিক হয়,
এবং সে উদ্দেশ্য যদি দাবি করে যে আমাদেরও সে পথে যাওয়া জরুরি তাহলে নিশ্চয়ই অনশন করা
উচিৎ। কিন্তু যদি সে উদ্দেশ্যটাই ভুল হয় তাহলে ওদের স্পষ্ট ভাবে, অনশন ভেঙে দিতে বলা
উচিৎ।
কিন্তু মানসম্মানের প্রশ্ন উঠিয়ে ওরা আমার কথা শুনল না। বলল, সপ্তাহ
খানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর ওদের মানা করা ঠিক হবে না, ওরা মানবেও না। কাজেই আমাদের মর্যাদারক্ষা
এতেই হবে যে আমরাও সঙ্গ দিই ওদের। অদ্ভুত যুক্তি ছিল। কিন্তু কুঁয়োতেই যখন ভাঙ মেশানো,
শুনবে কে? মানসম্মানের ব্যাপারগুলো এধরণেরই হয়। জানি না কতজন এই পথে বরবাদ হয়েছে, পথভ্রষ্ট
হয়েছে।
সেই অনশনরত ব্রহ্মচারীজির বক্তব্য ছিল যে আমরা চোরডাকাত তো আর না?
রাজবন্দী! কাজেই আমাদের ভালো মতন ঘী, দুধ, হালুয়া ইত্যাদি খেতে পাওয়া উচিৎ। কতটা করে
পাওয়া উচিৎ সেটাও উনি বলেছিলেন; আমার মনে নেই। অনশনের দিনগুলোয় তিনি লোকমান্য তিলকের
ছবি সামনে রেখে বসে থাকতেন। ভুল করছিলেন, গান্ধিজির আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন এবং
সেটা ক্ষতিকর ছিল। পরে লিখেছি এ নিয়ে। কিন্তু বললাম তো, কে পরোয়া করছিল গান্ধিজির?
মর্যাদা এবং মানসম্মানএর (prestige) প্রশ্ন ছিল যে।
ফলে সবাই খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিল। বাধ্য হয়ে আমাকেও ছাড়তে হল। এটাও
বলে দিই যে এর আগেও বেশ কয়েক বছর আগে দু’একবার বাধ্য হয়ে আমায় অনশন করতে হয়েছিল – জেলের
বাইরে। একবার তো ছ’দিন অব্দি কিছু খাই নি। একবার বোধহয় তিনদিন। ব্যাস, এই দু’বার। এবার
তৃতীয় বার হল। প্রথম দু’বার তো অন্তরের ডাক ছিল, বাধ্য ছিলাম মানতে। এবার অন্য ধরণের
বাধ্যতা ছিল। কাজেই আগের অনশনগুলোয় যেমন মনে লাগেনি, এই অনশনে রীতিমত লাগল। অনশন লাগাতার
চারদিন চলল এবং চতুর্থ দিন, যদ্দুর মনে আছে, সন্ধ্যেবেলায় ভাঙল। যখন খিদে পেত, ঠান্ডা
জল খেলে কিছুটা শান্তি পেতাম। অনশনের এটাই রীতি।
তিন দিন অব্দি কষ্টটা বাড়তে থাকল। কিন্তু চতুর্থ দিন কম হয়ে গেল।
বলা হয় যে সাধারণতঃ তৃতীয় দিন অব্দি জঠরানল তীব্র হতে থাকে। পেটের ভিতর যাকিছু স্থুল
মল বা পদার্থ অবশিষ্ট থাকে সেগুলোকে জ্বালায়। এটা তিন দিনে হয়ে যায়। কারো কারো চার
দিন লাগে। যেই এ কাজটা পুরো হয় জটরানল ভিতরে ঢুকে সুক্ষ্ম মলকে জ্বালাতে শুরু করে।
ফলে চতুর্থ বা পঞ্চম দিন খিদের কষ্ট কম হয়ে যায়। তারপর যখন সব মল জ্বালিয়ে জঠরানল শরীরকে
শুদ্ধ ও নীরোগ করে দেয় তখন ওপরে উঠে আসে। তার কোনো সময়সীমা নেই। সঞ্চিত সুক্ষ্ম মলের
ওপর নির্ভর করে – কতটা আছে আঁতে আর নাড়ীতে, কম না বেশি। কিন্তু যখন মল জ্বালিয়ে জঠরানল
আবার একবার বাইরে (ওপরে) উঠে আসে তখন শরীরে শিরশিরে টান শুরু হয়, ঝিনঝিন করতে থাকে
গাটা। সে অবস্থায় খাবার না পেলে সে জঠরানল রক্ত-মাংস জ্বালাতে থাকে। তখন আসল দুর্বলতা
আসতে থাকে। যদি বেশিক্ষণ খাবার না পাওয়া যায় তাহলে মৃত্যু হয়। কেননা রক্ত আর মাংস জ্বালানোর
পর আএ কিছু থাকে না যেখানে প্রাণ থাকতে পারে। উপবাস চিকিৎসা যারা করে তারা বলে এসব
কথা।
হ্যাঁ, তো যখন সকলেই উপোষ শুরু করল তখন বাইরে থেকে বন্ধুদের আসা
শুরু হল, বোঝানো-সোঝানো শুরু হল। যদিও পুরো ব্যাপারটার মাথামুন্ডু ছিল না। তাও সে সময়
যখন গান্ধিজির নাম সবার মুখে মুখে ছিল। যখন চাকরি, কাউন্সিলের মেম্বারি, ওকালতি, সরকারি
সুযোগ-সুবিধা এবং পদবী ইত্যাদিতে লাথি চালিয়ে আমরা এখানে এসেছি তখন এই সাধারণ, খাবার-দাবারের
বিশেষ সুবিধে কী এমন জিনিষ? কাজেই, লোকে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেবেই বা কেন? তাই বাইরে
থেকে আসা সবাই বিস্মিত ছিল যে হচ্ছেটা কী? জেলের বাইরে সবরকম কষ্ট সইবার প্রস্তুতি
সবাই নিয়েছিল এবং এটা জেনেই জেলে এসেছিল যে এমনই খাবার পাওয়া যাবে। ভালো খাবারদাবারের
প্রশ্ন কেউ কখনো ওঠায়নি, ওঠানোও হয়নি। তাহলে হঠাৎ এটা কী হল? কথাটা তো ঠিকই।
ফলে, বাইরের বন্ধুরা এবং অন্যান্য মানুষেরা বোঝানর পর, অবশেষে চতুর্থ
দিন এরা নিজেদের বোকামি বুঝতে পারল এবং অনশন ভাঙতে বাধ্য হল। যদি আমার কথা শুনত এই
অপমানটা হত না। এরকম ভেবে আত্মতুষ্ট হওয়া যে আমাদের বাধ্য করল বাইরের নেতা এবং বন্ধুরা
– বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেউ বলতেই পারে যে এটা অনশন ভাঙার একটা বাহানা মাত্র। কেননা
অনশনের যে উদ্দেশ্য ছিল তা তো পুরো হল না। সরকারের কানের পোকাও, অন্ততঃ সে সময় নড়ল
না। পরে ওই অনশনের ফলে সরকার যা কিছু ভেবে থাকুক। কেন না বোধহয় বলা যেতে পারে যে লখনউ
জেলে ফার্স্ট ক্লাস রাজবন্দীরা খাওয়াদাওয়ার যে সুবিধে পেল তা ওই অনশনেরই প্রভাবে। যাই
হোক, অনশন ভাঙার সময় তো এসব কোনো কথাই হয় নি। তা সত্ত্বেও অনশন ভাঙল এবং সবাই খাওয়াদাওয়া
করল। যদি ভুলে না গিয়ে থাকি – সেই ব্রহ্মচারীজি খাওয়াদাওয়ায় এমন গোলমাল করে নিলেন যে
তাঁর কলেরাও হয়ে গেল এবং বোধহয় উনি মারাও গেলেন।
কিন্তু অনশন ভাঙতে না ভাঙতে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে ফার্স্টক্লাস
বন্দীদের আর বেনারস জেলে রাখা হবে না; লখনউ ডিস্ট্রিক্ট জেল নির্দ্ধারিত থাকবে। এ নিয়েও
আলোচনা শুরু হল যে ওদের জন্য ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা এখানে থাকতে থাকতেই শুরু করা
হবে না যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লখনউ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে। ঠিক সে সময়টাতেই আমি
একটা জটিল প্রশ্ন ওঠালাম যার ফলে আমার দ্বিতীয় তিক্ত আর বড় অভিজ্ঞতা হল।
আমাদের সাথে প্রত্যেকটি জেলা থেকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ জেলে গিয়েছিল।
এখন যদি ভাল খাওয়াদাওয়ার কথা ওঠে তাহলে তার নৈতিক পরিণতি খারাপ হবে। আমাদের মাঝে যারা
সাধারণ কয়েদি হয়ে থেকে যাবে তারা কী ভাববে? এই তো, যে যখন স্বরাজ্য পাওয়ার আগেই সরকারের
দেওয়া সুবিধেগুলো আমরা নিয়ে নিলাম আর সঙ্গীদের এমনি ছেড়ে দিলাম, স্বরাজ্য পাওয়ার পর
সেই সঙ্গীদের পরোয়া আর কে করবে? এই ভাবনাই বার বার আমায় কষ্ট দিত। এও ভাবতাম যে এসব
সুবিধে স্বীকার করে নিলে কত পতন হবে আমাদের! তাহলে আর চাকরি, ওকালতি, কাউন্সিল ইত্যাদি
ছাড়া কেন? ওগুলোও তো সরকারেরই দেওয়া সুযোগসুবিধে! এ তো সেই “জন্মাবধি সয়ে কাশী, মৃত্যুকালে
মগধবাসী”! নিকৃষ্ট অপরাধের মত ব্যাপার হবে এটা, সরকারের বিভেদনীতি পুরোপুরি সফল হবে।
কেননা আমাদের যে সঙ্গীরা সাধারণ কয়েদি হয়ে থাকবে, পরে আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দেবে।
আমি শ্রী কৃপালনিজি এবং অন্যান্যদের সামনে এই প্রশ্নটা ওঠালাম। বললাম
আমি এই সুবিধেগুলো স্বীকার করব না। ওনারাও বললেন ঠিক, স্বীকার করা উচিৎও নয়। কিন্তু
যখন অনশনের ঘটনাটা ভাবলাম, তখন বোঝা কঠিন হল যে ওনারা এমন বলছেন কেন। তবুও যখন সবাইকার
মত পাওয়া গেল, বিশেষ করে নেতাদের, ভালই হল। সবার মত না থাকলেও আমি তো অস্বীকার করতামই।
নীতির ব্যাপার ছিল। যে লোকটা সন্ন্যাসি হয়েও শুধুমাত্র নীতিগত কারণে রাজনীতিতে এল সে
নিজের নীতি ছাড়বে কেন? তাছাড়া গান্ধিজির আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। কষ্ট সইবার
আদেশ তো উনি সব সময় দিতেই থাকতেন।
ঘটনাচক্রে এমন হল যে গাজিপুরের চারজন রাজবন্দীর সাথে, যার মধ্যে
আমিও একজন ছিলাম, ফার্স্ট ডিভিজনের কয়েদি হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল সরকার।
সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য, আমরাই প্রথম সরকারি সিদ্ধান্তের আওতায় এলাম। পরে অন্যদেরও
সেসব সুবিধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে আমরা বেনারস জেল থেকে ফৈজাবাদ জেলে চলে গিয়েছিলাম।
ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার খারে ছাটের আসার আগে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমাদের
কথাটা বলল। অন্যান্য সঙ্গীদের থেকে আলাদা থাকার কথাও উঠল। আমি স্পষ্টভাবে অস্বীকার
করে বললাম যে না আমার আপনাদের গদিওয়ালা বিছানা চাই আর না ঘী, দুধ ইত্যাদি। আমি এমনিতেই
ভালো আছি। আমার তিনজন সঙ্গীও একই কথা বলল। শুধু তাই নয়। আমি এতটাও বলে দিলাম যে মনে
রাখবেন, জবরদস্তি নিজেদের ঘী, দুধ আপনি আমাকে খাওয়াতে পারবেন না। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট
এলেন। তাঁকেও ওই একই জবাব দিলাম। তাতে উনি বললেন যে তাহলে ঘানি টানতে হবে। জবাব দিলাম,
সে তো আগে থেকেই ভেবে এসেছি। তিন সঙ্গী তো এতটাও বলে দিল, ঘানি টানা কী এমন, গুলিও
খাব। এও বললাম যে গাজিপুরের ৩৫ জন এখন অব্দি জেলে আছে। ৩১ জনকে আমি ছাড়ব কেন? সবাই
একরকম থাকব। শুনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চলে গেলেন।
এরপর শিগগিরই সেখান থেকে মোট ১০৫ জন বন্দীকে ফৈজাবাদ জেলে পাঠানো
হল, যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি বা সেকেন্ড ক্লাস কয়েদিদের রাখার কথা ছিল। কাজেই বলা সত্ত্বেও,
ঘানি টানাটা তো আর হল না। আমি সে সময়েও দেখলাম আর চলে যাওয়ার পর বিশেষভাবে শুনলাম যে
ওন্য জেলা থেকে আসা আমাদের সঙ্গীরা যারপরনাই চিন্তিত ছিল যে ওরা ফার্স্টক্লাস পেল কিনা।
একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছিল ওরা। কখনো জেলারকে কখনো অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে করেও শান্তি
পাচ্ছিল না। বিশেষত্ব তো এটাই একজনও ফার্স্টক্লাস অস্বীকার করল না, শুধু এক বাবা রাঘব
দাস ছাড়া, যিনি জিদ করে সাধারণ কয়েদিদের জন্য রান্না খাবারই খেতেন। কতটা কষ্ট-দেওয়া,
কতটা বিস্ময়-জাগান আর কতটা পতন-ইঙ্গিতকারী ঘটনা ছিল এটা। গান্ধিজির আজ্ঞা লোকে কতখানি
মানে, সে বিষয়ে এ আমার দ্বিতীয় তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল।
(৮)
ফৈজাবাদ জেল
শেষ অব্দি, একদিন আমাদের সাতসকালেই তৈরি হতে বলা হল। ভাবলাম বেনারস
ক্যান্ট স্টেশনে ট্রেনে চাপতে হবে। কিন্তু বিরোধ-প্রদর্শন এড়াতে সরকার শিবপুর স্টেশনে
একটা স্পেশ্যাল ট্রেন তৈরি রেখেছিল। আমাদের লরিতে ভরে ভরে সেখানে পৌঁছোন হল। গাজিপুর
থেকে আসার সময় যেমন, এখনও রেলগাড়ির জানালাগুলোয় জাল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বোধহয় আমাদের
পালিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। বিদেশি সরকারের বুদ্ধি দেখে করুণা হল আমাদের। আমরা তো মনের আনন্দে
জেলে এসেছিলাম। একবার মুখ নাড়লে বেরিয়ে যেতে পারতাম। তাহলে পালাতাম কেন? কিন্তু নিয়মপালন
তো হওয়াই উচিৎ আর এসব নিয়ম সেসময় তৈরি হয়েছিল যখন রাজবন্দী নামে কিছু ছিলই না। তখন
থেকে আর বদলান হয় নি। কার গরজ ছিল বদলাবার? রাজবন্দীরা নিজেদের অপমান ভাববে কিছুটা,
এটুকুই বা কী কম ছিল সরকারের জন্য? তবে ওই জালের সাথে চলা পুলিসদের যে হয়রানি হল রাস্তায়
সেটাই জালগুলোকে অর্থহীন প্রমাণ করে দিল।
ট্রেন চলছিল। যদ্দুর মনে আছে, শাহগঞ্জ স্টেশন আসার পর আমাদের সঙ্গীরা
এবং সব বন্দীরা খাবার চাইল। সঙ্গে থাকা সার্জেন্ট এবং অন্যান্য পুলিসরা বলল ছোলা খেতে
পারি। বন্দীরা অস্বীকার করল এবং পুড়ি চাইল। পুড়ি দেওয়ার ব্যাপারে পুলিসেরা স্পষ্ট কিছ
বলল না। এতেই কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমি মধ্যস্থতা করে কোনো রকমে বচসাটা থামালাম।
মনে নেই, শেষ অব্দি পুড়ি খেতে পাওয়া গেল কিনা। কিন্তু সঙ্গীরা ধমকাল, ঠিক আছে দেখে
নেব। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার তো কিছুই খাওয়ার ছিল না।
হঠাৎ রাস্তায় স্টেশন আসার আগেই চ্যাঁচামেচি শুরু হল আর আমাকে জাগান
হল। শুনলাম যে একজন গাড়ি থামাবার শিকল টেনে দেয়। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ায় রাগে লাল হয়ে সার্জেন্ট
এবং পুলিসেরা পৌঁছে জিজ্ঞেস করে কে টানল। যে টেনেছিল সে বুক ঠুকে বলে, আমি। সার্জেন্ট
সাহেব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বলে, “নিয়ে চল একে আমাদের কামরায়, এর নামে রিপোর্ট হবে।”
শুনে অন্যেরা বলে, “কাকে কাকে নিয়ে যাবে? আমরা ১০৫ জন আছি; একের পর একজন করে শিকল টানব
আর ট্রেনটাকে চলতেই দেব না। তখন কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের?” এবার বেচারা সার্জেন্ট এবং
তার সঙ্গীরা রীতিমত ঘাবড়ে গেছে। আমি জেগে উঠে সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলাম। ট্রেন
চলতে শুরু করল। যদিও পুলিসেরা ভিতর ভিতর রাগে জ্বলছিল আর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা
ভাবছিল। যাই হোক, সঙ্গীরা পুড়ি নিয়ে বচসার পুরো বদলা নিয়েছিল।
যখন ট্রেন ফৈজাবাদ ক্যান্ট স্টেশনে থামল, আমাদের নামার হুকুম হল।
সবাই নেমে পড়লাম। জিনিষপত্র নিজেদের সঙ্গেই ছিল। তাই সেসবও নামল। এবার পুলিসেরা ট্রেন
থামাবার বদলা নেওয়ার জন্য বলল দু’জনকে করে একসাথে হাতকড়া না পরিয়ে চলতে দেব না। মজার
ব্যাপার যে জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সওয়ারির ব্যবস্থাও ছিল না। আমরা বললাম, ঠিক আছে।
হাতকড়া পরান শুরু হল। বোধহয় সবাইকে পরান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চলার সময় আমরা নিজেদের
জিনিষপত্র ওঠাতে অস্বীকার করলাম। বললাম, আমাদের একেকটা হাত তো বাঁধা। আবার পুলিসদের
মনঃক্ষুন্ন হতে হল এবং শেষ অব্দি হাতকড়া খুলতে হল। এসবের পর আমরা ফৈজাবাদ জেলে – স্টেশনের
কাছেই – ঢুকে পড়লাম। পথে গান গাওয়া আর স্লোগান তোলা তো চলছিলই। শহরের মানুষেরাও দেখতে
পৌঁছে গিয়েছিল। আমরা ব্যারাকে গিয়ে নিজের নিজের ডেরা নিলাম। আমি পছন্দ করলাম সেল, বা
একলা থাকার ব্যারাক। আমরা ৪০-৫০ জন সঙ্গী, যারা বেশি শান্তিপ্রিয় ছিলাম, পুরোটা সময়
ওখানেই রইলাম। পরে তো চার দিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির রাজবন্দীরা ওখানে বেশি পৌঁছে গিয়েছিল।
প্রচুর মানুষজন ছিল জেলটায়। গাজিপুর থেকে কিছু সঙ্গী ছিল আমার। ওরাই আমার খাবার রান্না
করত। এর জন্য অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল।
আমরা যে আলাদা নিরালায় থাকতাম তার একটা বিশেষ কারণ ছিল। চ্যাঁচামেচি,
ঝগড়া ইত্যাদি অত্যধিক হত। এভাবেই লোকেরা নিজেদের দামী সময় নষ্ট করত। জেলের কর্মচারিদের
সাথেও নিয়মিত ওরা ঝগড়া করত। এসব অসহ্য লাগত আমার। তাই আলাদা থাকা পছন্দ করলাম। জেলের
সুপারিন্টেন্ডেন্ট, দক্ষিণভারতের বাসিন্দা ছিল এবং খুব ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু সেও
উত্যক্ত হয়ে থাকত সব সময়।
একবার এমন হল যে হোলি এসে পড়ল। আমাদের সঙ্গীরা বলল আমরা হোলি জ্বালাব।
একটা কোনো বাহানা তো চাই জেল-কর্ত্তৃপক্ষের সাথে ঝঞ্ঝাট করার! বেচারা সুপারিন্টেন্ডেন্ট
বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু শোনে কে? ধর্মের নামে দাবি খাড়া করা হল যে হিন্দুদের
উৎসব। কে জানে এদের মধ্যে ক’জন বাইরে এই ধর্মের পালন করত! সুপারিন্টেন্ডেন্ট গান্ধিজির
দোহাই দিল। কিন্তু কেউ শুনলে তবে তো? অবশেষে হার মেনে সে কাঠ আনিয়ে দিল আর বলল যে সেন্টারে
কোথাও জ্বালিয়ে ধর্ম পুরো করুন। বন্ধুরা সেই কাঠগুলোর তো হোলি জ্বালালই, সাথে জল তোলার
জন্য কুঁয়োর ওপর যে তক্তা-টক্তা লাগান ছিল সেগুলোও ভেঙে জ্বালিয়ে দিল। হাজারবার মানা
করা সত্ত্বেও শুনল না। আমরা তো নিজেদের ব্যারাকের দরজা জবরদস্তি বন্দ করে বাঁচিয়ে নিলাম।
কিন্তু কুঁয়োর কাঠগুলো গেল। নিছক পাগলামি! ভাবা উচিৎ ছিল জল কিকরে ভরা হবে। বন্ধুরা
এমন উন্মত্ত ছিল যে শুনছিলই না। ফলে ‘অ্যালার্ম’ করে বাইরে থেকে অস্ত্রধারী পুলিস ডাকতে
হল। ব্যাস, আক্কেলগুড়ুম! সবকটা মাটির বাঘ ব্যারাকে ঢুকে পড়ল। জিজ্ঞাসাবাদে কিছু জানা
গেল না। কেউ স্বীকার করতে তৈরি হল না যে হ্যাঁ, আমরা কুঁয়োর তক্তা জ্বালিয়েছি। যদি
বাইরে থেকে পুলিস না আসত তাহলে তো যা কিছু হাতের কাছে পায় জ্বালিয়ে দিতে ব্যগ্র হয়ে
পড়েছিল। এমনি ছিল আমাদের সে সময়কার ভালমানষির লক্ষণ। যাহোক, যেমন তেমন করে ব্যাপারটার
মিটমাট করা হল।
খুব বেশি হলে গাজিপুর আর বেনারস মিলিয়ে এক মাস আর বোধহয় দু’তিন মাস
ফৈজাবাদে থাকতে পারলাম। তারপর তো আমাদেরও লখনউ পাঠিয়ে দেওয়া হল। ফৈজাবাদ জেলে আমাদের
একটা দল ছিল। সে দলটা পুরোপুরি নিয়ম মেনে চলত। তাই জেলওয়ালাদের মনেও সেই দলটির বিরুদ্ধে
কোন নালিশ ছিল না, সবসময় খুশি থাকত। আমরা সবাই এক জায়গায় থাকতাম। আমি ওদের গীতা পড়াতাম।
অন্যান্য বিষয়েও প্রায়শঃ সন্ধ্যায় উপদেশ দিতাম। দার্শনিক বিষয়াদি এবং হিংসা-অহিংসা
ওপর আলোচনা চলত। এভাবেই আমাদের দিন কাটত শান্তিতে।
সেই জেলেই যখন একদিন ফৈজাবাদের এক মাড়োয়াড়ি ভদ্রলোক সবার সাথে দেখা করতে এলেন এবং আমাদের সাথেও দেখা করলেন, তখঞ আমরা ওনাকে একটা ছোট্ট গীতা পাঠিয়ে দিতে বললাম। উনি তক্ষুনি কিনে পাঠিয়ে দিলেন। সত্যিই একদম ছোট্ট। ওটার থেকে বেশি ছোট গীতা আমি দেখিনি। তখন থেকে ওই গীতাটাই আমার সাথে সবসময় থেকেছে। বিশেষ করে জেলে তো থেকেইছে। এবারও রয়েছে পাশে রাখা। প্রথম পেয়েছিলাম ২৬.৩.২২ তারিখে। জেলের তারিখগুলো লেখা আছে এর পৃষ্ঠায়। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিষ। ইতিহাস আছে এর পিছনে।
(৯)
গীতার অর্থ বুঝলাম
এমনিতেও গীতা সব সময় আমার জীবনের অভিন্ন অঙ্গ থেকেছে। অন্যান্য সব
গ্রন্থ থেকে বেশি আমি গীতা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছি। পড়েওছি, আর পড়িয়েওছি প্রচুর। কিন্তু
একটা বড় ত্রুটির সাথে। সংস্কৃতের পন্ডিত ও ছাত্রদের যে রীতি, আমিও সেই রীতিতে সবসময়,
ভাষ্য এবং টীকার ভিত্তিতে, সেগুলোর সাহায্য নিয়ে গীতা প্রসঙ্গে ভাবনাচিন্তা করেছি।
পঞ্চাশের বেশি টীকা আর ভাষ্য আমার কাছে রয়েছে। সংস্কৃতে যত টীকা এবং যত ভাষ্য পাওয়া
গেছে সব সংগ্রহ করেছি। সেসবেরই সাহায্যে গীতার অর্থ বোঝার এবং বোঝাবার চেষ্টা করেছি
সেসময় অব্দি। স্বাধীনভাবে পুরো গীতা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ বোধহয় কখনো পাইনি। তার
প্রয়োজনও কেউ বোধ করত না। আমি নিজেও কখনো ভাবিনি এদিক থেকে। কখনো সখনো কোনো শ্লোক নিয়ে
ভেবেছি বটে, তবে পুরো গীতা নিয়ে কখনোই নয়। এর পরিণতি হয়েছিল যে বুদ্ধি এবং বিশ্লেষণীক্ষমতা
পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। গীতার অর্থ নিয়ে স্বাধীন-সংশয়ের শক্তি তৈরিই হল না। এটা খুব বড় বিচ্যুতি
ছিল, ভয়ানক দুর্বলতা ছিল।
আরেকটা ব্যাপার। আগে থেকেই কিছু তত্ত্ব মানুষ খাড়া করে রাখে, অন্যান্যদের
কাছ থেকে জেনে বা অন্যান্য গ্রন্ধ পড়ে, পড়িয়ে। হয়ই এমন। না পড়েই কিছু তত্ত্ব তো মেনেই
নেয় লোকে। আজকাল তো ভারতবর্ষের নিরক্ষর বৃদ্ধ, যুবা, পুরুষ, নারী সবাই কর্মবাদ, অদৃষ্টবাদ
এবং ভগবানবাদের দোহাই দিতে থাকে। যার সাথেই কথা বলুন ভাগ্য, কর্ম এবং ভগবানের দয়ার
কথা বলতে থাকে পঞ্চমুখে। কথা বলার ঢং নেই। অথচ বড় বড় দার্শনিক তত্ত্ব এভাবেই কপচাতে
থাকে। যদি তাদের বিপরীত কোন কথা বলেন তাহলে মনক্ষুন্ন হবে এবং হেসে ফেলবে। এরকম মানুষকে
বোঝান সহজ কাজ নয়। বংশপরম্পরাগত সংস্কার এবং শৈশবের রক্ষণশীল পরিমন্ডলের প্রভাব থাকে
তার ওপর।
একই ব্যাপার লেখাপড়া জানা মানুষদের সাথেও হয়। আগে থেকেই কিছু কথা
মনে গেঁথে নেয় এবং বইয়ে সেসবই খুঁজতে থাকে। সেগুলোরই পুষ্টি করে। আমার ভিতরেও সেরকমই
ভাব ছিল। কিছু তত্ত্ব আমি খাড়া করে রেখেছিলাম এবং গীতার মধ্যে যখন তখন সেগুলোই খুঁজতাম
এবং পেতাম। এও এক ধরণের পঙ্গুতা। এসবের জন্যই স্বাধীনভাবে গীতার্থ আমি বুঝতে পারিনি।
গীতার গুরুত্ব সম্পর্কে তো অনেক শুনেছিলাম, বিভিন্ন মানুষজনের কাছেও
এবং পুঁথি-পুরাণেও। কিন্তু তখন অব্দি বিশেষ কিছু আমি ওতে পাই নি। তাই কখনো আশ্চর্য
লাগত যে লোকে এমন মানে কেন। কখনো কখনো শুনতাম যে কিছু মানুষ – স্বদেশে এবং বিদেশে –
ঘুরে ঘুরে আমজনতার মাঝে গীতার উপদেশ দিয়ে থাকেন; কিন্তু বুঝতাম না এর প্রয়োজন। আমি
তো জানতাম যে গীতায় অদ্বৈত দর্শন এবং আধ্যাত্মবাদ আছে। আমজনতা কী করে বুঝবে সে জিনিষ।
এটাই ভাবতাম। হিন্দি, ইংরেজি, মারাঠি ইত্যাদি টীকাগুলোও তো আমায় এমন কিছু বলে নি।
মনের এরকম অবস্থায় ফৈজাবাদ জেলে, কিছুটা পরিস্থিতি জনিত কারণে আর
কিছুটা এমনিই ভাবনা এল যে গীতার মন্থন করা যাক স্বাধীনভাবে। তাই সেই ছোট্ট গীতাটির
পূর্ণপাঠ, চিন্তন এবং মন্থন শুরু করলাম। বাধ্যতা তো ছিলই। ভাষ্য ইত্যাদিগুলো পেতাম
কী করে? যেখানে রাখাছিল সেখান থেকে আনান সহজ ছিল না। আসতে আসতেও সময় লেগে যেত। এও ভাবলাম
কত আর ওসবের ওপর চিন্তা করব? অনেকদিন ভাষ্য পড়লাম, টীকা পড়লাম। এমনইও একটু পড়ে দেখা
যাক। এক ধরণে ঔতসুক্যও ছিল। ফলে, স্বাধীনভাবে, কোনোকিছুর সাহায্য ছাড়া আমি গীতা নিয়ে
চিন্তাভাবনা শুরু করলাম।
শুরু করার সাথে সাথে ভাল লাগতে লাগল। তারপর তো নেশা ধরে গেল। যারা
আমার কাছে পড়ত তারা প্রশ্নও করত। উত্তরও দিতেই হত। এভাবে যখন আমি গীতা পাঠের অভ্যাস
করা শুরু করলাম কয়েক দিনেই আমার চোখের পর্দা সরে গেল। এক নতুন দুনিয়া দেখতে পেলাম।
নতুন অর্থ পেতে শুরু করলাম। অর্থ তো প্রায়শঃ পুরোনোই ছিল, কিন্তু তাতে নতুন আলো ছিল,
নতুন আভা ছিল, নতুন তেজ ছিল যা হৃদয়কে ফুটিয়ে তুলল। গীতার রহস্য বোঝার এটা প্রথম অবকাশ
ছিল – জীবনের বাধা এবং চিন্তা থেকে নিরুদ্বিগ্ন হয়ে গেলাম। সারা জীবন বেদান্ত ও অন্যান্য
দর্শনাদি পড়ে যে শান্তি পাইনি, সে শান্তি আমি গীতার কৃপায় ফৈজাবাদ জেলে পেয়ে গেলাম।
আমার জীবন স্থিরতা পেল (My life became settled)। তখন আমি বুঝলাম গীতাকে এত গুরুত্ব
কেন দেওয়া হয়। আমজনতার মাঝে গীতার উপদেশ শোনান ব্যক্তিদেরও বুঝতে পারলাম যে তারা কেন
শোনায়। এটাই কারণ যে ওই ছোট্ট গীতার প্রতি আমার ভালোবাসা অসীম। সুন্দর খাদির মলাট লাগিয়ে
একটা ব্যাটনে বইটা লপটে রাখি।
লখনউ যাওয়ার কয়েকদিন আগেই ফৈজাবাদে আমায় অজীর্ণ এবং আমাশায় ধরল।
কিছু খেতে পারছিলাম না। নিরুপায় হয়ে জেলওয়ালারা রোজ একটু করে দই দিত। তাই খেতাম। ইতিমধ্যে
সরকার জেল কর্তৃপক্ষকে আমাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল – ওরা চারজন ফার্স্টক্লাসের কয়েদি,
ওখানে কেমন আছে, ওদের অবস্থা লিখে জানান। জেলকর্তৃপক্ষ আমাদের জিজ্ঞেস করল তো আমরা
সবকিছু বললাম। আমাদের বলা কথাগুলোই বোধহয় ওরা সরকারকে লিখে দিয়েছিল। কেননা অন্য কোনো
কারণ তো ছিল না। ওরা আমাদের এটাও বলল যে আপনারা এখানে থাকতে পারবেন না, লখনউ পাঠিয়ে
দেওয়া হবে। এ কথার পিঠে বলে দিই যে আমার তিনজন সঙ্গী যখন দেখেছিল যে বাকি সবাই লখনউ
চলে গেল, অস্বীকার করলনা তখন ওদের ভিতর থেকে গ্লানি হয়েছিল। ওরা নিজেদের ভুলের জন্য
আপসোস করতে শুরু করেছিল।
(১০)
লখনউ জেল
একদিন হঠাৎ জেলার এসে বলল আপনারা চারজনই লখনউ যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে
নিন। আপনারা তো ফার্স্টক্লাসের কয়েদি। তাই সরকারের হুকুম যে আপনারা এখানে থাকতে পারবেন
না। আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। আমি তো অপছন্দই করছিলাম ব্যাপারটা। তবে একটা খুশির ভাব ছিল
মনে যে সঙ্গীদের – যারা কোনোদিন স্বাধীন ভারতের অধিপতি হবে – অনেকটা সময় নিয়ে কাছ থেকে
দেখতে পাব এবং ভবিষ্যতের জন্য তার সারমর্ম বার করব। আমার তিনজন সঙ্গীর তো আনন্দ হল
যে লখনউ গিয়ে অন্যান্যদের মত ঘি, দুধ খাব।
এটাও আশ্চর্যের কথা ছিল যে আমরা হঠকারিতার সাথে অস্বীকার করলেও সরকার
আমাদের সাথে হতে থাকা প্রথম শ্রেণির ব্যবহার সরিয়ে নিতে রাজি ছিল না। মহাভারতে এক জায়গায়
লেখা আছে যে যখন আমি জগতের বস্তুগুলোকে তিরস্কারের দৃষ্টিতে দেখি এবং হঠকারিতার সাথে
সেগুলো নিতে অস্বীকার করি তখন সেগুলো আমার কাছেই পড়ে থাকে। কিন্তু যখন সেগুলো চাই তখন
কেজানে কোথায় চলে যায়। তারই একটা নমুনা এখানে দেখলাম।
হ্যাঁ, তো আমরা ট্রেনে চেপে লখনউ স্টেশনে পৌঁছোলাম। স্টেশন থেকে
আমাদের জেলার জেলে পৌঁছে দেওয়া হল। সব পুরোনো সঙ্গীদের দেখা পেলাম সেখানে। সেখানেই
মুরাদাবাদের এক সাথী আমার সাথে কথা বলে, আমার আমাশয়ের কষ্ট নিবারণ করতে জলচিকিৎসার
পদ্ধতি জানাল। তাঁর সব কথা শুনে আমি মনে মনে ভেবে নিলাম যে চিকিৎসাটা করব। কেননা, আমার
প্রকৃতির সাথে মিল ছিল। ওষুধে আপত্তি এবং সংযমে ঝোঁক আমার স্বভাব। জলচিকিৎসায় দুটো
ব্যাপারই আছে। তাহলে আর আমার ভালো লাগবে না কেন? তাই সে চিকিৎসার জন্য টব আনালাম এবং
স্থির করলাম যে শুধু রুটি খাব। সেটাই এই চিকিৎসার অনুকূল। পরে লিখেছি জলচিকিৎসার কথা।
লখনউ জেলে আমার তিন সঙ্গী তো সব কিছুই খেতে শুরু করল। কিন্তু আমি
যে অস্বীকার করেছিলাম। ফলে, কথায় দৃঢ় থাকতে হলে জেলের লোকেদের স্পষ্ট বলে দিতে হত যে
আমি এসব খাব না, যেমন বাবা রাঘব দাস করতেন। অথবা যা আসছে আসতে দিতাম, কিন্তু নিজে ব্যবহার
না করে অন্য কোনো কয়েদিকে দিয়ে দিতাম। আমি দ্বিতীয় পথটা ধরলাম। মনে হল যে প্রথম পথটায়
কিছু প্রচার হয়ত হবে যে দেখ, আমি তবুও নিলাম না ওই সমস্ত সুবিধেগুলো। কিন্তু আর কোনো
লাভ হবে না। আমি এধরণের প্রচার বা খ্যাতি বিশেষ পছন্দ করি না। তাই জিনিষপত্র সবই আসত।
কিন্তু আমি নিঃশব্দে সেই সমস্ত জিনিষ সেই কয়েদিটিকে দিয়ে দিতাম, যাকে আমার কাজ করার
এবং জল ইত্যাদি নিয়ে আসার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। শুধু আটা নিয়ে নিতাম। তাও একবেলা
খাওয়ার মত। কিন্তু জলচিকিৎসার জন্য তো ভুষিসুদ্ধু আটা চাই! তাই কিছুটা আটা জেলের লোকেদের
ফিরিয়ে তার বদলে ভুষি নিয়ে আটায় মিশিয়ে নিতাম। শুধু সেই আটার রুটিটুকু খেতাম – শাকসব্জি,
ডাল, ঘি, দুধ ইত্যাদি কিচ্ছু না। একবেলাই খাবার খেতাম। রুটি তৈরি করতে ঝামেলা দেখে
আর জলচিকিৎসার পক্ষে অনুকূল হবে মনে করে আমি কলকাতা থেকে একটা ইকমিক কুকার আনিয়ে নিলাম।
জলচিকিৎসক মহাশয়ও জিনিষটা পছন্দ করল। ওতেই আমি রুটি সেঁকতাম।
রুটি তৈরি করা তো আর নয় – আটাটা মেখে একটা বাটিতে রেখে কুকারে বসিয়ে
দিতাম। ভাপে ওটা পুরো সেদ্ধ হয়ে যেত। ওটাই আমার খাবার ছিল যা পুরো দেড় ঘন্টায় আমি খেতাম।
কখনো কখনো পাতলা পাতলা রুটি বেলে উপুড় করা বাটির ওপর রেখে দিতাম। যাতে একে অন্যের সাথে
সেঁটে না যায় তাই দুটো রুটির মাঝখানে একটু শুকনো আটা ছিটিয়ে দিতাম। রুটি হোক আর
মাখা আটার একটাই পিন্ড হোক, একই রকম স্বাদ হত। হ্যাঁ, একটু বেশি মিষ্টি লাগত। এই
খাদ্যই চলল আট-ন’ মাস। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরেও, অনেক দিন পর্য্যন্ত এটাই খাদ্য ছিল
আমার। কখনো গমের দালিয়াও রান্না করতাম আবার কখনো আস্ত গমও সেদ্ধ করে নিতাম। আমার দালিয়া-প্রেমও
ওখানেই শুরু হল এবং তখন থেকেই, ফলের পর প্রধান খাদ্য আমার দালিয়াই হয়ে গেল। ফল পেলাম
তো ভালো। নইলে দালিয়া চাই।
জলচিকিৎসার আবিষ্কর্তা লুইকুনে বলেছেন যে মানুষের উচিৎ তার নিজের
স্বাভাবিক ভোজন করা; আর সেটা ফল ও শাকপাতা ছাড়া অন্য কিছ নয়। তাও প্রথমে
কাঁচা ফল, না পাওয়া গেলে শুকনো, তার অভাব হলে আস্ত কাঁচা গম, তারও অভাব হলে ভুষির সাথে
আটা এবং আটার অভাবে সে আটার রুটি। ব্যস, একটা না পেলে আরেকটা, এই আমার খাবার। আমি কখনো
কাঁচা আটাও খেয়েছি আবার কখনো আস্ত গমও। আমি অনুভব করেছি যে সামান্য গম বা আটাতেই পরিতৃপ্তি
হয়ে যায়। আসলে বেশিক্ষণ মুখে রাখলে খাদ্য পদার্থে একটা স্বাভাবিক মিষ্টত্ব পাওয়া যায়।
আহারের মূলমন্ত্র হল খুব চিবিয়ে খাওয়া এবং জল বা দুধ একটু একটু করে খাওয়া, মুখের ভিতর
চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে – যাকে ইংরেজিতে সিপ (sip) করা বলে। খাওয়াদাওয়ার সময় যদি এভাবে
খাওয়া হয় তাহলে বদহজম ইত্যাদির কষ্ট তো কখনই হতে পারে না।
প্রথম শ্রেণির সুবিধার ব্যাপারটা তো অদ্ভত জায়গায় দাঁড়াল। খাওয়াদাওয়ার
জায়গাটায় তো এক রকম ভাবে সবাইকে ঠকিয়ে দিল সরকার। যদ্দূর মনে আছে, আগে প্রত্যেকজন দেড়
টাকা পেত। কিছুদিনের মধ্যেই সেটা বন্ধ করে দেওয়া হল। এ কথা বেনারস জেলের সময়কার। লখনউ
জেলে আসার পর, আমার সামনে তো টাকার বদলে ঘি, চিনি, দুধ ইত্যাদি জিনিষপত্র দেওয়া হচ্ছিল।
আমি জানি না কতদূর সত্যি, কেননা আমার সামনের কথা নয়, কিন্তু আমায় বলা হয়েছিল যে যখন
বরাদ্দ টাকাটা শুধু খাওয়াদাওয়ায় খর্চা না করে আমাদের সঙ্গীরা অন্যভাবে খর্চা করতে লাগল
বা জমা করতে শুরু করল, তখন সরকার টাকার বদলে জিনিষপত্র (Ration) দেওয়া শুরু করল। কিন্তু
সেটাও বজায় থাকল না। কিছুকাল পর, হঠাৎ সরকার জানাল যে আপনাদেরও সাধারণ কয়েদিদের মতই
খাওয়দাওয়ার জিনিষ দেওয়া হবে। যদি বেশি কিছু খেতে চান তাহলে বাড়ি থেকে আনিয়ে খেতে পারেন।
দেখলাম অনেকেই মুষড়ে পড়ল। বাইরে থেকে আনান তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল
না। তা সত্ত্বেও কয়েকজন বাইরে থেকে আনিয়ে টানিয়েও খেল। করবে কী? অভ্যেসটা বিগড়ে গিয়েছিল।
না আনিয়ে কাজ চলহিল না। সরকারও ভালো রকম বুঝে গিয়েছিল আমাদের দুর্বলতা। জেনে গিয়েছিল
যে এবার এদের অভ্যেস হয়ে গেছে। না দিলেও বাড়ি থেকে আনিয়ে খাবেই, যখনি ইচ্ছে হবে। এভাবে
সরকার ভিজিয়ে জুতো মারতে চাইল আমাদের; আমাদের তাতেও চৈতন্য হল না সে আলাদা কথা। দেখলাম
যে শেষ পর্য্যন্ত আমিই ভালো রইলাম। সে সময় যে আনন্দ হল আমার কী বলব। নিজের চোখে দেখলাম
‘বিস্বাদ পাপ'এর মত ব্যাপার ছিল আর আমি একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম।
(১১)
জেলের বিশেষ অভিজ্ঞতা
ওপরে নিজের লোকেদের যে দুর্বলতার কথা লিখলাম সে ছাড়াও আরো অনেক কিছু
দেখলাম জেলে। পৌঁছোবার কিছুদিন পরেই দেখলাম কয়েকজন মিলে একটা ‘হালুয়া পার্টি’ তৈরি
করল। ওটাকে আবার ‘রাক্ষস পার্টি’ও বলা হত। অনেকজনের পাওয়া ঘি, দুধ ইত্যাদি এক জায়গায়
জমা করে হালুয়া তৈরি করা হত এবং সবাই মিলে খেত। তাই নাম হল ‘হালুয়া পার্টি’। ঠাট্টা-তামাশা
আর হুজুগ তো লেগেই থাকত। কখনো নাটক, কখনো প্রহসন কখনো অন্য কিছু কীর্তিকলাপ হতে থাকত।
দিন রাত লেগে থাকত হুলুস্থুল। সে জন্যই ওটাকে ‘রাক্ষস পার্টি’ও বলা হত। ভোগ করা আর
হুলুস্থুল বাধান তো রাক্ষসদেরই কাজ। হালুয়ার রোগ এমন পেয়ে বসল যে যখন সরকার ঘি ইত্যাদি
দেওয়া বন্ধ করে দিল তলহনও হালুয়া তৈরি হওয়া বন্ধ হল না। সবাই যে একটু একটু করে তেল
পেত তাই জমা করে হালুয়া তৈরি হত।
জেলে এটাও দেখলাম যে যারা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ছোঁয়াছুঁয়ির মধ্যে
থাকত তাদের রান্নার জায়গায় রাক্ষস পার্টির লোকেরা জবরদস্তি ঢুকে খাবার ছুঁয়ে দিত। তাতে
অসুবিধে হত ওদের। চ্যাঁচামেচি হত। বলা যেতে পারে যে কাজটা খারাপ ছিল। কিন্তু আমিও
তো ছোঁয়াছুঁয়ি করারই লোক ছিলাম। কিন্তু আমার সাথে কেউ কখনো তেমন করেনি – অসুবিধের
সৃষ্টি করেনি। আসল ব্যাপার ছিল যে অন্যান্যদের জন্য ছোঁয়াছুঁয়ি এক ধরণের মেকি, লোকদেখানি
ব্যাপার ছিল। কেননা যখন ভালো মিষ্টি বা সে ধরণের কিছু জিনিষ কোথাও থেকে কারোর কাছে
আসত, তখন সেসব খেতে তো ওরাও শামিল হয়ে পড়ত। কিন্তু রুটিতে, ভাতে ছোঁয়াছুঁয়ি মানত। অথচ
আমি সব ব্যাপারেই একই রকম থাকতাম। তাই ওদের ভড়ংটা শেষ করতে চাইত রাক্ষসেরা। আমারটা
তো ভড়ং ছিল না। আমাকে কোনো অসুবিধেয় কেন ফেলত ওরা?
জেলেই পন্ডিত জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ভালো করে পরিচিত হওয়ার এবং কথাবার্তা
বলার সুযোগ হল। একদিন দুপুরে, খাবার খাওয়ার পর, ওনার সাথে আমার কথাবার্তা হওয়ার ছিল।
উনি অন্য ওয়ার্ডে থাকতেন। আমি বললাম, রোদ বেশি, আপনার আসতে কষ্ট হবে। আমিই চলে আসব।
মাথায় ছিল যে উনি আনন্দভবনে বড় হয়েছেন। উনি চট করে জবাব দিলেন – উকিল যখন, খাওয়া শেষ
করেই মাঝদুপুরে কাছারিতে দৌড়ে পৌঁছোবার অভ্যেস আছে। কষ্টের প্রশ্ন নেই। আমিই আসব আপনার
কাছে। আমি এমন উত্তরের জন্য তৈরি ছিলাম না। কাজেই অবাক হয়ে গেলাম। এই একটা কথাই আমার
মনে খুব উঁচু জায়গা তৈরি করে দিল তাঁর জন্য। খুব কম লিডার এবং নেতা এত সহজ এবং অনাড়ম্বর
থাকেন। এটা আমাদের রাজনীতির খুব বড় দুর্বলতা। সবকিছুর যারা আসল করিয়ে, জনসাধারণ এবং
সাধারণ কর্মকর্তা, এধরণের সহজ এবং অনাড়ম্বর আচরণ ছাড়া তাদের হৃদয় জয় করা যায় না। বড়লোকামি
তো আমাদের রাজনীতির জন্য প্লেগ।
জেলে থাকার সময়েই অসৌঢ়ার (মেরঠ) চৌধুরি রঘুবীর নারায়ণ সিং ও এলেন।
ওনার সাথে আমার পুরোন জানাশোনা ছিল। খুব বড় জমিদার এবং অভিজাত। বড়লোকামি ওনারও প্রচুর
ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, নিজের আরাম ছেড়ে এসবে কেন এলেন? উনি লেখাপড়া তো ভালোই জানেন এবং
বুদ্ধিও তীক্ষ্ণ, যদিও ইংরেজি-বলিয়ে নন। তাই আমি অবাক হলাম যে উনি এই রাজনীতিতে ফাঁসলেন
কী করে। কিন্তু কথায় বুঝতে পারলাম যে ভালো করে বুঝেসুঝেই উনি এতে এসেছেন। তাঁর তীক্ষ্ণ
বুদ্ধি তাঁকে যুগের হাওয়া বুঝিয়ে দিয়েছিল। ফলে বুঝে গিয়েছিলেন যে যেসব জমিদার দেশের
স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হবে না তারা বাঁচতে পারবে না। তাই উনি নিজের কর্তব্য পালন
করলেন এবং নিজের জমিদার ভাইদের শুধু মুখের কথায় নয় কাজে উপদেশ দিলেন। তাঁর ওপর আমার
শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। বুঝলাম যে আরামে থাকা ধনীদের মধ্যেও রাজনীতির ভালো রকম প্রভাব রয়েছে।
ফলে এই রাজনীতির প্রতি আমার নিজের নিষ্ঠা আরো বেড়ে উঠল।
ওখানেই প্রফেসর ধর্মবীরজী, এম.এ.র দেখা পেলাম। দেখলাম, শান্ত এবং
জলের মত ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ এবং সারল্যের প্রতিমূর্তি। এমন বিদ্বান সজ্জন মানুষটাকে
পুলিস যখন ধরেছিল, কোমরে দড়ি বেঁধে পায়ে হাঁটিয়ে হিন্দু কলেজের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে থানায়
এনেছিল। লোকজনেরা ভেবেছিল কোনো তাগড়াই চোর-ডাকাত হবে। দিনরাত স্লেট নিয়ে গণিতে ব্যস্ত
থাকতেন। অন্য কোনো কাজ ওনার ভালোই লাগত না।
অনেক মওলানারাও সঙ্গেই ছিল জেলে। ফলে ইসলাম নিয়ে আলোচনা হত। ব্যাপারটা
এই যে আমরা একে অন্যের ধর্মটা ঠিক মত জানি না। তাই সে ধর্মের বিষয়ে নানা রকম অবিশ্বাস
থাকে। নিঃসন্দেহে সে সমস্তই ভিত্তিহীন। যারা গোঁড়া ধার্মিক তারা তো আরো বেশি – নিজের
ধর্মটুকু ছাড়া অন্য ধর্মের বিষয়ে জানেই না। আর যদি জানে তো উল্টোটা জানে। শৈশবে
আমারও একই অবস্থা ছিল। ইসলামকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতাম। খারাপ মানতাম। ভাবতাম যে সে ধর্ম
তো জোরজবরদস্তি করা আর মারকাট করা শেখায়। অন্যান্য ধর্মের প্রতি আদৌ সহনশীলতা নেই ইসলামে।
নিঃসন্দেহে সেসব ভুল ধারণা আজ একেবারেই নির্মূল হয়ে গেছে মন থেকে। কিন্তু রাজনীতিতে
আসার আগে অব্দি সেগুলো ছিল।
অসহযোগের জমানায় কোথাও কোথাও মওলানাদের কিছু লেকচার শুনে আর তাদের
আচরণে হিন্দুদের প্রতি সম্মানের ভাব দেখে মনের পুরোনো ধারণাগুলোতে ধাক্কা অবশ্যই লেগেছিল।
কিন্তু ছিল ভিতরে ভিতরে। জেলে এসে নির্মূল হল সেসব। তারপর তো এ বিষয়ে আমূল পরিবর্তন
হল আমার অন্তঃকরণে। আসলে ওখানে মওলানারা কোরানশরিফের আয়ত পড়ে পড়ে দেখাল যে তাতে
মন্দির, গির্জা ইত্যাদি ধর্মস্থানগুলোর সম্মান করার এবং অসম্মান না করার স্পষ্ট নির্দেশ
দেওয়া আছে। তারা এ কথাও বলল যে কোরান অনুসারে প্রতিটি দেশে সময়ে সময়ে পয়গম্বরের আবির্ভাব
হয়। সেই দেশেরই ভাষায় মানুষজনকে তারা উপদেশ দেয়। এভাবে ওরা বোঝাল যে তাহলে রাম,
কৃষ্ণ, যীশু এদেরকে পয়গম্বর না মানার কি কোনো কারণ আছে? বরং এটাই তো প্রমাণিত যে তারা
পয়গম্বর ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় হোক বা ইহুদি ভাষায়, যে দেশে যে ভাষা ছিল, সে ভাষায় তাঁরা
মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। এবং এভাবে বোঝা যায় যে একটা সময় ছিল আমাদের দেশে যখন প্রত্যেকটি
ধর্মের দোষ না খুঁজে তাদের গুণগুলোই খুঁজে বার করার চেষ্টা হত। আমি তো নিজেই এটা অনুভব
করেছি। আর আজ এমন একটা যুগ যখন ঠিক তার উল্টো পথে আমরা চলছি।
যা হোক, আমার খুব লাভ হল। পরে তো আমি নিজেই কোরানের হিন্দি অনুবাদ
পড়েছি আগাগোড়া এবং মনটা পরিষ্কার করেছি।
লখনউ জেলেও আমি সঙ্গীদের একটা দলকে গীতা পড়াতাম। সে দলটি ভালো ইংরেজি
জানা শিক্ষিত লোকেদের দল ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে লোকমান্য তিলকের গীতা রহস্য পড়েছিল।
তারা এটাও জানত যে গীতা রহস্যের বেশ কয়েকটি অংশের আমি যুক্তিপূর্ণ খন্ডন করেছি খবরের
কাগজে। তাই ওরা আমার সাথে বিশেষভাবে তর্ক করত। শঙ্কর-সিদ্ধান্ত থেকে তিলকের মত কোথায়
এবং কিভাবে ভিন্ন সেটাও জানতে চাইত। এভাবে, জেলে ভালোই আনন্দ পেতাম। আমার কাছে তো সেই
এক ছোট্টো গীতা ছিল। তার ভিত্তিতেই ওদের প্রশ্নের সমাধান করতাম।
আসলে গীতা রহস্য নিয়ে আমার একটাই নালিশ যে তিলক শঙ্করের সিদ্ধান্ত
না বুঝেই তাঁকে কটাক্ষ করেছেন। ব্যাপারটা এমন যে মানুষের মনে শঙ্করাচার্য্যের মত
নিয়ে সাধারণতঃ একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। তারা তাঁর সিদ্ধান্তগুলি মোটামুটি ভাবেই জানে।
দুর্ভাগ্যবশতঃ তিলকও সেই ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়েছিলেন। শঙ্করের জীবনটাই তো ছিল
কর্মময় এবং কর্মযোগীর। নিজের গীতাভাষ্যের শুরুতেই
উনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে জ্ঞানীদের কর্মকে উনি কর্মই মানেন না, যেভাবে, ভগবান
কৃষ্ণের ক্ষত্রিয়োচিত কর্মকেও উনি কর্ম মানেন না, “জ্ঞানিনাং কর্ম তু কর্মেব ন ভবতি,
যথা ভগবতঃ কৃষ্ণস্য ক্ষাত্রাং চেষ্টিতম”। শঙ্কর তাকেই কর্ম বলেন য কর্তাকে নিজের
ফল, সুখদুঃখ ইত্যাদি দিতে পারে। জ্ঞানীর কর্ম, সে অনুসারে কৃষ্ণের কর্মও কর্মই নয়।
কেননা সে কর্ম তাদের সুখদুঃখের বাঁধনে বাঁধতে পারে না। তাই শঙ্কর যেমন একদিকে এধরণের
কর্মের সমর্থন করেছেন এবং আজীবন নিজেও এধরণের কর্ম সম্পন্ন করেছেন, অন্যদিকে, অজ্ঞান
বা আসক্তিমূলক কর্ম ত্যাগ করা অথবা সন্ন্যাস নেওয়াকে সর্বশক্তিতে সমর্থন করেছেন। এ
অবস্থায়, শঙ্করকে কর্মযোগের বিরোধী বলা কি তাঁর প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করা নয়?
ওই জেলে কয়েকজন এমন সঙ্গীও পেলাম যারা আগ্রার দিকে এবং যুক্ত প্রদেশের অন্যান্য জায়গায় শুদ্ধিকরণের কাজ করেছিল। এমনিতে যাই হোক না কেন, ওরা যখন নিজের নিজের অভিজ্ঞতা শোনাত বা কথা বলত তখন অন্ততঃ সেসময়টুকু তাদের মধ্যে গোঁড়ামি থাকত না। যেমন সে সময় মুসলমানদের গোঁড়ামি কমে আসছিল, গোঁড়া আর্যসমাজিদেরও গোঁড়ামি দেখা যেত না। একেই বলে যে একই বিপত্তির (Common enemy) মার খেয়ে একতা হওয়া এবং মতের ভিন্নতা ভুলে যাওয়া। তাই পান্ডবের জয়ের পর যখন কৃষ্ণ মথুরা যেতে উদ্যত হলেন তখন কুন্তী দুঃখের সাথে বললেন, আমাদের জন্য তো বিপত্তিই ভালো ছিল – নিয়মিত আপনার দর্শন পেতাম। আজ সে বিপত্তি কেটে যাওয়ায় আপনি চলে যেতে প্রস্তুত! “বিপদঃ সন্তু নঃ শশ্বত্তাত্রা তত্রা জগদ্গুরো। ভবতো দর্শনং যস্মাদপুনর্ভবদর্শনম্”। আজ যখন আবার হিন্দু-মুসলমানকে একে অন্যের রক্তপিপাসু হয়ে উঠতে দেখি, তখন মনে হয় অসহযোগের যুগটাই ঠিক ছিল। হায়, যদি ওরা বুঝতে পারত যে আজও সে সময়কার সে একই শত্রু সামনে রয়েছে!
(১২)
জলচিকিৎসা
প্রসঙ্গক্রমে এখানেই জলচিকিৎসার কিছুটা বর্ণনা সেরে নেওয়া জরুরি।
ওই চিকিৎসায় শুধু যে আমার লাভ হয়েছে তা নয়, হামেশার জন্য আমায় ভক্ত করে নিয়েছে। পুরো
পদ্ধতিটা আমি ভালো করে অভ্যাস করেছি। নোট তৈরি করেছি তার ওপর। ওই চিকিৎসা সম্পর্কিত
দুটো বই, আচার্য লুই কুনে (Louis Kuhne) লিখিত ‘আরোগ্যের নতুন বিজ্ঞান’ (New
science of healing) এবং ‘মুখাকৃতি বিজ্ঞান’ (Science of facial expression) আমি ভালো
করে পড়ে বুঝে নিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়। ওই চিকিৎসার কয়েকটি কথা এবং তত্ত্বের ভিত্তিতে
আমি কিছু উপতত্ত্ব খুঁজে বের করেছি এবং তা থেকে উপকার পেয়েছি। অন্যদেরও পাইয়েছি। উদাহরণ
হিসেবে বলতে পারি, আচার্য যে বলেছেন, আহারের পর যদি মোটামুটি এক তোলা বিশুদ্ধ বালি
চিবিয়ে খাওয়া হয় তাহলে কঠিন থেকে কঠিন কোষ্ঠবদ্ধতা (Constipation) সেরে যায়, তার পরীক্ষা
আমি অনেকজনের ওপর করেছি। তাতে সফল হওয়ার পর পেটব্যথা এবং মাড়িফোলার চিকিৎসাতেও সেই
বালির ব্যবহারে সফলতা পেয়েছি। আসলে যখন বুঝলাম যে বিকৃত বায়ু বা অতিরিক্ত বায়ু শুষে
নেওয়াই বালির কাজ, তখন ব্যথার উপশমে সেটার ব্যবহার করলাম। হ্যাঁ, বালিতে যেন মাটি একটুও
না থাকে। খুব ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়ে থাকে যেন। খুব মোটাও হবে না আর খুব মিহিও
হবে না সে বালি। গঙ্গার বালি সবচেয়ে ভালো। দাঁতব্যথা, মাড়িফোলা এবং পেটে ব্যথারও কারণ
ওই বিকৃত বায়ু। তাই বালির ব্যবহার উপশমকারী। হ্যাঁ, কুনে যে দুধকে মানুষের স্বাভাবিক
আহার মানেন নি, সেটা আমি স্বীকার করি না। আমার ধারণা যে লক্ষাধিক বছর ধরে মানুষ যেহেতু
দুধ খাচ্ছে, তাই দুধটাও তার এক ধরণের স্বাভাবিক আহারে পরিণত হয়েছে।
আমি কুনের এই জলচিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়মিত কাজে লাগিয়ে এই সিদ্ধান্তে
উপনীত হয়েছি যে যদি আমরা আহারে সংযম বজায় রাখি, উল্টোপাল্টা জিনিষ না খাই, ভালো রকম
খিদে পেলেই খাই এবং তখন খবারটা খুব চিবিয়ে খাই তাহলে বারো আনা অসুখ তো এমনিতেই হবে
না। বাকিটুকুর পৌনে চার আনা এড়ান যাবে নিয়মিত ব্যায়ামে এবং হাঁটায়। মাত্র এক পয়সা জায়গা
থাকে ওষুধের। ব্যায়ামের মধ্যেও, হাঁটা সবচেয়ে ভালো, এটা আমার অভিজ্ঞতা। ডন-বৈঠক, দৌড়,
আসন ইত্যাদি সবকিছু অভ্যাস করে হাঁটার উপকারিতার সাথে মিলিয়ে দেখেছি হাঁটাটাই সর্বোত্তম।
এবং এটা মানবশরীরের স্বভাবগতও বটে। যদি উপরে বলা কয়েকটি নিয়ম আমরা পালন করি তাহলে,
আমার বিশ্বাস যে নীরোগ থাকার জন্য জলচিকিৎসারও প্রয়োজন হবে না। নিজের ওপর আমি এই নিয়ম
প্রয়োগ করেও দেখেছি। নিছক ভাবনার কথা বলছি না। আমার শরীরটা যে অসুখের ডিপো হয়ে গিয়েছিল,
আজ এতটাই সুস্থ যে গত ১০-১২ বছরে কখনো জ্বর আসেই নি। ফোঁড়া, গোটা, ঘা ইত্যাদি তো কাছেও
ঘ্যাঁষে না। এর জন্য আমি জলচিকিৎসার কাছে ঋণী; যদিও অনেক দিন হল ছেড়ে গেছে। আমি কলসিতে
ঠান্ডা জল রেখে তাতেই হিপবাথ নিতাম। গরম কালে সিট্জবাথ তো সম্ভবই নয়। তার জন্য খুব
ঠান্ডা জল চাই যা শীতেই সম্ভব। তাই যখন শীত এল, সিট্জবাথ শুরু করলাম। হিপবাথে কোমরটা
জলে ডুবিয়ে তলপেট ভেজা কাপড় দিয়ে রগড়ায় আর সিট্জবাথে মুত্রেন্দ্রিয়। কিন্তু সিট্জবাথে
জলের ওপর বসতে হয়। যখন দাঁতে ব্যথা হত তখন বা এমনিতেও আমি স্টিমবাথ (বাষ্প দিয়ে) নিতাম।
স্টিমবাথের পর তো হিপবাথ জরুরি হয়ে যায়। আমি ওই জেলেই এটা করতে দেখলাম এবং পরে নিজেই
অনুভব করলাম যে কঠিন কঠিন জ্বরও, দিনে তিন বার বা বলতে পারেন একটু পর পর স্টিমবাথের
সাথে হিপবাথ নিলে এমনিই কমে যায়। জেলেও এমনি করা হয়েছিল। বাইরে এসে তো আমি কতবার এ
পদ্ধতি প্রয়োগ করেছি, নিজের ওপরও এবং অন্যের ওপরও। এতে আমার আমাশয়ের সমস্যাও দূর হয়ে
গেছে, খিদেও বেড়েছে। দিনে তিনবার, সকালে দুপুরে এবং সন্ধ্যায় বাথ নিতাম আর খুব হাঁটতাম।
দেখলাম যে শিশুদের মত, বাথের পরেই দৌড়োতে ইচ্ছে করে। বাথের পর শরীরে উত্তাপ আনা জরুরি।
সেটা হয় দৌড়ে আসুক বা হেঁটে বা কসরত করে। অসুস্থ মানুষদের শরীরে তো কম্বল ইত্যাদি চাপা
দিয়েই তাপ ফিরিয়ে আনতে হয়। আমি লক্ষ্য করেছি যে যদি দাঁতে ব্যথা হয় বা মাড়ি ফোলে তাহলে
কোনো বাসনে জল খুব গরম করে ঢেকে রাখতে হয়; ঢাকনা খুলে মুখের ভিতরে ভাপ নিলে তক্ষুনি
ব্যথা চলে যায়। যদিও একবার করার পর মুখটা ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার ব্যথা ফিরে আসে। তাই
থেকে থেকে বার বার এই রকম করে সেঁক নিলে ফোলাও কমে যায় আর ব্যথাও চলে যায়।
আমার প্রথম প্রথম দাঁতে ব্যথা তো হল বাথ শুরু করার পরেই। তার আগে
কখনো হয়নি। তার পর সে ব্যথা নিয়মিত হতে থেকেছে। মাত্র কিছুদিন আগে গেছে। তাও যখন আমি
দাঁতের ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ হয়েছি। এখনও, অসাবধান হয়ে পড়লেই আবার হয়ে যাবে। আসলে পায়োরিয়ার
অসুখে এমনি হয়। সেটাই ভিতর ভিতর ছিল। বাথ নেওয়া শুরু করতে জেগে উঠল। বাথ নিলে চেপে
থাকা অসুখগুলো অবশ্যই বেরিয়ে আসে আর তীব্র রূপ নেয়। একে হিলিং-ক্রাইসিস বলা হয়। মানে
হল যে অসুখটা বেরিয়ে এল এবং কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি মিটে যাবে যদি না ঘাবড়ে গিয়ে
আমার জলচিকিৎসা বন্ধ করে দিই। মনে করা হয় যে যত শিগগির আর তীব্র ভাবে হিলিং-ক্রাইসিস
হবে, ততই শিগগির রোগটা মিটবে। তাই কম বয়সে এই চিকিৎসায় বেশি প্রভাব পড়ে। শরীরে জীবনীশক্তি
যত বেশি হবে তত শিগগির ক্রাইসিসটা ফুটে উঠে রোগ চলে যাবে। কুনে এটাও মানেন যে ফরেন
ম্যাটার বা মলই অসুখ। আর সেটা এক। জ্বর, ব্যথা, প্লেগ, কলেরা ইত্যাদি সব তারই বিভিন্ন
রূপ। তাই চেষ্টাটা এই যে শরীরে যেন নতুন মল জমা না হতে পায় এবং আগে থেকে জমা মল বেরিয়ে
যায়। এটাই জলচিকিৎসার মূলতত্ত্ব। আহারাদির সংযম এবং অন্যান্য নিয়ম এর জন্যই তৈরি হয়েছে।
খাবারে গরম মশলার ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে জলচিকিৎসা। তার থেকেও বেশি নুন
খেতে নিষেধ করে। আয়ুর্বেদেরও এটাই বক্তব্য যে সব রোগের শিকড় হল মল – সর্বেষামেব রোগাণাং
নিদানং কুপিতা মলাঃ। তাই আয়ুর্বেদও জোর দিয়েছে সংযমের ওপর। পুরোনো বৈদ্যরা তো জ্বর
ইত্যাদি হলে বলেন অনশনই মুখ্য নিদান। তাই কুনের মত অনেকটাই আয়ুর্বেদের সাথে মেলে। কুনে
এটাও বলেন যে সপ্তাহে এক দিন বা মাসে দু’চার দিন বাথ না নিয়েই থাকা উচিৎ। দেখেছি যে
হিন্দিতে এ বিষয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে যাতে খাদ্যাখাদ্যের বিষয়ে উল্টোপাল্টা কথা লেখা
আছে। নুন ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সব বাজে কথা। এটুকু ঠিক যে এই চিকিৎসায়
রোগের নিরাময় হয় – কখনো তাড়াতাড়ি কখনো দেরি করে। শরীরের জীবনীশক্তি এবং রোগ কত পুরোনো,
তার ওপর সেটা নির্ভর করে। অনেকে তো ১২ বছর, ১৬ বছর অনবরত এই চিকিৎসা চালাবার পর নীরোগ
হয়েছে।
(১৩)
আমার নিষ্পত্তি
যাহোক, লখনই জেলে আট-নয় মাস অনবরত এই হট্টগোল, উচ্ছৃংখলতা আর যা
ইচ্ছে তাই করার প্রবণতা দেখে আমি কিছু নিষ্পত্তি করলাম। ওখানে দেখলাম, বোধহয় কেউই এমন
নেই যে জেলের নিয়মকানুনকে তাচ্ছিল্য করে না। লুকিয়ে লুকিয়ে খবরের কাগজ তো আসতই। সরকার
যেগুলো পাঠাত সে ছাড়াও অন্যান্য খবরের কাগজ আসত। নিজেদের মধ্যে চাঁদা করে একেকটা সংখ্যার
জন্য চার-চার আনা দেওয়া হত। এটাও দেখলাম যে জেলের আধিকারিকেরা যার ওপরেই রুষ্ট হত,
ওখান থেকে সরিয়ে নৈনি জেলে পাঠিয়ে দিত। নৈনি জেল সে সময় জেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টদায়ক
জায়গা মনে করা হত। খুব কষ্ট দেওয়া হত কয়েদিদের। তাই পরে দেখলাম কত কয়েদি জেলের লোকদের
তোশামোদে রত হয়ে আছে যাতে নৈনি না যেতে হয়। কেউ তো কারোর কোনো কথা শুনত না। লুকিয়ে
লুকিয়ে চিঠি তো লেখা হতই। একজনও বোধহয় ছিল না যে এসব কিছুতে থাকত না।
জেলে থাকতেই আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম যে রাজনীতিকে নৈতিক
(relegious and moral) রূপ দিয়ে এত তাড়াতাড়ি সার্বজনিক করে দেওয়া গান্ধিজির একটা বড়
ভুল। নিজের এই পদক্ষেপ তাঁকে পিছিয়ে নিতে হবে। যদি ঠিক মত এই রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে
যেতে হয় তাহলে এখন অব্দি নির্মিত সমস্ত প্রাসাদ ভেঙে ফেলতে হবে। শুধু ভিতটুকু থাকবে।
তার ওপর আবার থেকে তৈরি করতে হবে প্রাসাদ। নইলে এই রাজনীতিতে শুধু নামে রাজনীতি, দূষিত
রাজনীতি ছাড়া আর কিছু থাকবে না। যদি গান্ধিজি শিগগিরই পা না পেছোন তাহলে পস্তাতে হবে।
আমি যা কিছু গুপ্ত সমিতিগুলোর কঠোর নিয়মের বিষয়ে শুনতাম এবং রাওলাট রিপোর্টে পড়েছিলাম
তার ভিত্তিতেই ভাবতাম যে গান্ধিজিকে ওইরকমভাবে কঠোর হতে হবে। যদি মেম্বার তৈরি করার
সময় ওইরকম কঠোর না হওয়া যায় তাহলে খারাপ পরিণতি হবে। আমি স্পষ্ট দেখলাম যে আমাদের জাতীয়তা
শুধু মুখেই। জাত-পাতের ব্যাপারগুলো এত বেশি আমাদের মধ্যে ঢুকে গেছে দেখে আমার কষ্ট
হল। এমত অবস্থায় রাজনীতিকে নৈতিক বিষয় করা খেয়ালি স্বপ্ন মনে হল। যখন রাজনীতিই নিজের
জায়গাটা আমাদের অন্তরে ঠিকমত তৈরি করতে পারল না, তখন তার সংস্কারের কীই বা অর্থ হতে
পারত?
আমার ধারণা তো এটাই ছিল যে এসমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা গান্ধিজির
কানে যেতেই তিনি এর নিদান করবেন। যদিও পরের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে জানলাম যে আমার ধারণা
ভুল ছিল। গান্ধিজি সব কথা জানলেন এবং ভালো করে জানলেন। কিন্তু করলেন কী? খবরের কাগজে
লিখলে আর লেকচার দিলে সমষ্টিগত আন্দোলনে, যেটা বস্তুতঃ গণআন্দোলন, নৈতিক পরিবর্তন হতে
পারে না। কয়েকজন বাছাই করা মানুষের মধ্যেই হতে পারে। এর জন্য দরকার ছিল নির্মম মাপদন্ড
তৈরি করে, তাতে যাচাই করে তবেই সদস্যতা দেওয়া। কিন্তু তাহলে আবার এই গণআন্দোলনটা থাকতই
না। হ্যাঁ, হতে পারত ধীরে ধীরে সময় পেয়ে গণআন্দোলন রূপ পেত এই প্রক্রিয়ায়। কিন্তু মাঝের
কয়েক বছর তো কোনো গণআন্দোলন থাকত না।
গান্ধিজির জন্য অন্য রাস্তা ছিল যে রাজনীতিকে নৈতিকতা বা ধর্মনীতির
জোব্বা পরানোর ভাবনাটাই উনি ত্যাগ করতেন। কিন্তু গণআন্দোলন বজায় রাখা আর সেটাকে
ধর্মনীতির পথে নিয়ে চলার আশা করা একসাথে চলতে পারে না। অসম্ভব। তা সত্ত্বেও গান্ধিজি
তাই করেছেন। পরিণাম সবার সামনে। সত্য, অহিংসা এবং সদাচারের নামে কংগ্রেসে শুধু
দম্ভ, প্রবঞ্চনা, হিংসা এবং অসত্যের বাজার গরম। মজার ব্যাপার যে যারা স্পষ্টবক্তা তাদের
জন্য গান্ধিজির দলে স্থান নেই আর বকতপস্বীরা সবার মাথা হয়ে বসে আছে। ধর্মের নামেও আগে
এই ব্যাপারটাই হত। কিন্তু যখন থেকে ধর্ম রাজনীতিতে ঢুকেছে, এখানেও সেই একই ব্যাপার
চলছে।
মগজে ঢোকে না যে গান্ধিজির মত অভিজ্ঞ এবং ব্যবহারকুশল ব্যক্তি ব্যাপারগুলো
বুঝতেন না। তাই অনেকের কাছে এটা একটা বড় ধাঁধা যে কেন এমন হয়? গান্ধিজি কেন এমনটা চলতে
দেন? আমার জন্যেও অনেক দিন পর্য্যন্ত এটাই ধাঁধা ছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি। প্রাচীন
মানুষেরাও মানতেন যে রাজনীতি আর ধর্ম-নীতির চিরকালিক বিরোধ। যাজ্ঞবল্ক্য নিজের স্মৃতিতে,
রাজনীতি ধর্মবিরোধী হয়ে পড়লে ছেড়ে দিতে বলেছেন – ‘অর্থশাস্ত্রতুবলবদ্ধর্মশাস্ত্রমিতি
স্থিতিঃ’। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য করাটাই ভুল।
(১৪)
জেলের বাইরে
বারো মাস পর ১৯২৩ সালের শুরুতে আমি লখনউ জেল থেকে বাইরে এলাম। আমার
জরিমানা ছিল পঁচিশ টাকা। কেউ আমায় জিজ্ঞেস না করেই দিয়ে দিয়েছিল। ফলে আরো একমাস জেলে
থাকার সুযোগই হল না। বাইরে এসে প্রথমে গাজিপুরে পৌঁছোলাম। মিছিল করে লোকে স্টেশনে নিতে
এসেছিল। ভালো উৎসাহ ছিল ওদের মধ্যে।
কিন্তু বাইরের আনহাওয়া দূষিত এবং অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল। দেশবন্ধু দাশ
এবং পন্ডিত মোতিলাল নেহরু জেল থেকে বেরুনোর পর তাঁদের উদ্যোগে কংগ্রেসের তরফ থেকে সত্যাগ্রহ
অনুসন্ধান কমিটি তৈরি হয়েছিল। দেশের কোনায় কোনায় গিয়ে সেই কমিটি সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি
নিয়ে খোঁজখবর কী নেবে, সে কাজ ছেড়ে কাউন্সিলে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করা শুরু করল।
গান্ধিবাদিদের তো বটেই, অন্যদেরও মত ছিল যে কমিটিটা অভিশপ্ত ছিল। দেশের আবহাওয়া আরো
দূষিত করে দিল। এই অশুভ পরিস্থিতিতে গয়ায় ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে দেশবন্ধুর সভাপতিত্বে
কংগ্রেসের অধিবেশন হল। কিন্তু দেশবন্ধুর কাউন্সিলে তৈরি করা প্রবেশ নীতি সেই অধিবেশনে
স্বীকৃত না হওয়ায় আরো সমস্যা হল।
সে সময় কংগ্রেসে দুটো শক্তিশালী দল ছিল। একটা, দাশ সাহেব এবং নেহরুর
পরিবর্তনবাদী (Pro changer) দল এবং দ্বিতীয়টা, শ্রী রাজগোপালাচারি প্রভৃতির অপরিবর্তনবাদী
(No changer) দল। অনেক বছর ধরে দুই দলের লড়াই চলল। এখন তো সময় এমন পাল্টেছে যে রাজাগোপালাচারি
সেরা পরিবির্তনবাদী হয়ে গেছেন। দাস, নেহরুরও নাক কাটছেন।
কিন্তু আসল সমস্যা সত্যাগ্রহ অনুসন্ধান কমিটির জন্য হয় নি। যে পরিস্থিতির
ফলে ওই কমিটি তৈরি হয়েছিল সেই পরিস্থিতি বা সেই পরিস্থিতি উৎপন্ন করা মানুষেরাই আসলে
উত্তরদায়ী ছিল এই অশুভ আবহাওয়ার জন্য। যদিও, সে সময় কথাটা বুঝতে পারিনি। যে সময় সৈন্যবাহিনী
উৎসাহের সাথে এগিয়ে চলেছে এবং সারা দেশে উদ্দিপনার ঢেউ উঠছে, ঠিক সেই সময়েই, লক্ষ্যপূরণ
না হওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ ‘থামো’র আদেশ দিয়ে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে বলার পরিণাম কি অন্য
কিছু হতে পারত? যখন আমি বেনারস জেলে ছিলাম তখনি চৌরি-চৌরার ঘটনা হল। ফলে গান্ধিজি বারদৌলিতে
সত্যাগ্রহ স্থগিত করার ঘোষণা করে দিলেন। তারই পরিণতি ছিল এ সমস্ত কিছু। আমরা তো ঘোষণা
পড়ে স্তব্ধ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলাম। অবশ্য এ অটল বিশ্বাস আমার সে সময় নিশ্চয়ই ছিল যে
গান্ধিজি যা করবেন ঠিকই করবেন। পরাজয়ের কোন লক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ লড়াই থামিয়ে
দেওয়া অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। তাই এগিয়ে চলার শক্তিগুলো এদিক ওদিক নিজেদের পথ খুঁজতে লাগল।
অহিংসার চুলচেরা বিচার গান্ধিজির মত আর কেউ করতে পারত না। ফলে, ব্যাপারটা
সাধারণ মানুষ তো বুঝতে পারেই নি, দেশবন্ধু এবং নেহরুর মত নেতারাও বুঝতে পারে নি। তাই
ওরা ক্ষুব্ধ ছিল এবং লড়াইটাকে এমন রূপ দিতে চাইছিল যাতে অন্তঃকরণের প্রেরণা বা দৈব-ডাক
ধরণের কোনো জিনিষের প্রয়োজন না হয়। বিশুদ্ধভাবে বস্তুগত হয়। তাই ওরা আবার কাউন্সিলে
প্রবেশের প্রশ্ন ওঠাল। ১৯২৩ সাল পেরুতে না পেরুতে ওরা এতে সফলও হল। রুশ ইত্যাদি দেশের
ইতিহাসেও দেখা গেছে যখন বাইরে কোনো প্রবল সংগ্রাম জারি না থাকত এবং জনগণ ঝিমিয়ে থাকত,
তখন পার্লামেন্ট এবং আইনি সভাগুলোয় ঢুকেই বাইরে সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত।
আমি গাজিপুরেই কাজ করতে থাকলাম – মানুষজনকে জাগিয়ে তুলতে মশগুল ছিলাম।
কিন্তু খাওয়া-দাওয়া এমন হয়ে গিয়েছিল যে বাইরে দৌড়োদৌড়ি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি
অনুভব করলাম যে দুধ না পেয়ে আমরা সাধারণতঃ মাথার কাজ করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলি। আমি
তো শুধু দুধই নয়, মশলা ইত্যাদিও ছেড়ে দিয়েছিলাম। মশলা তো অনেক আগেই ছেড়ে গিয়েছিল। নুনটা
ছাড়লাম জেলে। এখন পর্য্যন্ত ছেড়েই থেকেছি। বাইরে এসে হয়ত নুন খাওয়ার চেষ্টা করতাম।
কিন্তু সে বছরই নুনের ওপর ট্যাক্স বেড়ে যাওয়ায় একটা অতিরিক্ত কারণ পেয়ে গেলাম এবং নুন
ছাড়া থাকা বহাল রইল। এসব ব্যাপারের ফল হল এই যে আমি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লাম। তবুও,
ঘোরাফেরা চলছিল। তার পরিণামে ১৯২৩ সালের গরমকালে লু লেগে এমন হল যে আহারে রুচি চলে
গিয়েছিল। পিপাসা পেত। কিন্তু জল খেতেও ভালো লাগত না। বড় সমস্যা পড়লাম। শেষে আমি আবার
বক্সারের এলাকায় সিমরি চলে গেলাম। সেখানে যবের দালিয়া পাতলা করে জলে সেদ্ধ করে খেতাম
আর আম পুড়িয়ে তার ভেতরটা দিয়ে শরীরে মালিশ করতাম। এভাবে ধীরে ধীরে লু’এর প্রভাব কমল
এবং আবার কাজ করতে সক্ষম হয়ে উঠলাম। তারপর আবার গরুর দুধ খাওয়া শুরু করলাম। বাকি সব
খাওয়াদাওয়া একই রকম রইল। আর কোনো অসুবিধা হল না আমার।
কিন্তু আমি আবার গাজিপুরে চলে গেলাম। ওখানে কিছু পয়সা জমা করলাম
কংগ্রেস কমিটির জন্য। সে সময় দুটো ঘটনা ঘটল। এক তো এই যে আমি পন্ডিত জহরলাল নেহরুর
সাথে চিঠি লেখা-লিখি শুরু করলাম যে প্রদেশের সমস্ত জেলায় এবং জেলারও সবক’টি অংশে কাজ
করে যাওয়ার বদলে আমাদের একটুখানি জায়গায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করা উচিৎ। গান্ধিজির তো
এটাই শক্তি যে উনি নিজের দুর্বলতা স্বীকার করেন। আমাদেরও তাই করা উচিৎ। আমার অভিজ্ঞতা
বলে যে যদি আমরা কিছুটা জায়গাতেই নিবিড়ভাবে (intensive) কাজ করি এবং সফল হই তাহলে বাকি
জেলাগুলো বা জেলার অংশগুলো নিজের থেকেই আকৃষ্ট হবে এবং আমাদের পদ্ধতিতে চলবে। এভাবে
শেষে আমরা সফল হব।
কিন্তু জহরলালজির বক্তব্য ছিল যে যেখানে কাজ হবে না সে জায়গার খারাপ
প্রভাব (reaction) কাজের জায়গায় পড়বে এবং ফলে সেখানেও সমস্যা হবে। তাই উনি পুরো প্রদেশে
বিস্তৃত (extensive) কাজের পক্ষপাতী ছিলেন। এভাবে, জেল থেকে বেরোবার কিছুদিন পর থেকেই
এবং অনেক দিন অব্দি তাঁর সাথে আমার চিঠিপত্র আদান-প্রদান চলেছিল। শেষে উনি আমার দৃষ্টিভঙ্গি
স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু ততদিনে তো অবশিষ্ট শক্তিও ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল এবং একটুখানি
জায়গাতেও নিবিড়ভাবে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
লু’এর প্রকোপ থেকে সেরে ওঠার পর এবং পয়সা জমা করার পর আরেকটি ঘটনা
হল। আমাদের কর্মীরা পয়সাগুলো এমনিই খরচ করে ফেলতে চাইছিলেন। কিন্তু আমি বিরুদ্ধে ছিলাম।
জনগণের দেওয়া পয়সার এক এক কড়ি আমি পবিত্র মনে করি এবং চাই যে অধিকাধিক লাভজনক কাজে
সে পয়সা খরচ হোক। তাই আমি সঙ্গীদের প্রস্তাবের বিরোধ করলাম। যখন দেখলাম ওরা মানছে না
তখন জেলা কংগ্রেস কমিটির দপ্তর গাজিপুর শহর থেকে সরিয়ে মুহম্মদাবাদে (ইউসুফপুর) কাজি
নিজামুলহক সাহেবের বাংলোয় নিয়ে এলাম। উনি সভাপতি ছিলেন। জমিদার হওয়া সত্ত্বেও সারা
জীবন কংগ্রেসের সাথেই ছিলেন। এত ভদ্রলোক যে কী বলব।
বিখ্যাত নেতা ডঃ আনসারির আসল বাড়ি ইউসুফপুরেই ছিল। কাজি সাহেবের
জামাই ছিলেন উনি। তাঁর সাথে আমার ভালো হৃদ্যতা ছিল। সেখানে থেকেই ভাবলাম পাঁচ বা সাত
শো, যে টাকাটা আছে সেটা খাদি কর্মসূচিতে লাগিয়ে দিই। নইলে খরচ হয়ে যাবে। কংগ্রেসের
আর কোনো কর্মসূচি ছিলও না। সিমরিতে আমি আগে থাকতেই খাদির কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম। সেই
কাজটা নিয়েই এগোলাম আর সমস্ত টাকা ওতেই ঢেলে দিলাম। আসলে গাজিপুরে খাদি নিয়ে কোনো কাজ
হচ্ছিল না। তাই সিমরিতে চালু করতে হল। কাজ তো চলছিলই আগে থেকে। বিস্তারিত রূপ দিলাম
সেটাকেই – আর খাদির কাপড় তৈরি করা শুরু হয়ে গেল। ওখানে তুলোও হত, চরকাও চলত। এবার খাদি
বোনাও চলতে লাগল। কিন্তু সঙ্গীদের সাথে বিবাদ জারি রইল। এ ধরণের ঝামেলা আমায় সব সময়
পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে সার্বজনিক তহবিল নিয়েই। আজও পিছু ছাড়েনি। ভবিষ্যতেও ছাড়বে
এমন আশা রাখি না।
সাল ১৯২৩ এবং ১৯২৪ আমি গাজিপুরেই রইলাম এবং সেখান থেকেই যুক্ত প্রদেশ
কংগ্রেস কমিটি এবং অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির মেম্বার ছিলাম। সেখান থেকেই অল ইন্ডিয়া
কংগ্রেস কমিটির আহমেদাবাদ বৈঠকে গিয়েছিলাম। আগেই এ প্রসঙ্গটা উল্লেখ করেছি। পরে আবার
করব। সে সময় গান্ধিজি শর্ত রাখতেন যে কংগ্রেসের মেম্বাএ সেই হবে যে চার আনার বদলে নিজের
হাতে কাটা সুতো দেবে। শ্রী পুরুষোত্তম দাস টন্ডন এই শর্তের সমর্থনে ছিলেন। যুক্ত প্রদেশের
যে রাজনৈতিক সম্মেলন গোরখপুরে হল ১৯২৪এ, তাতে উনি এই শর্তটা পাস করিয়ে নিতে চাইলেন।
কিন্তু সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ নেতা বাবা রাঘব দাস এর বিরুদ্ধে ছিলেন, যদিও জেলে চরকার
জন্য বড় গোলযোগ করেছিলেন যাতে চরকা দেওয়া হয়। সুতো কাটতেনও নিয়মিত। কিন্তু এদিকে ওনার
মত পাল্টে গিয়েছিল। টন্ডনজি দেখলেন, সুতোর প্রস্তাব, যেটাকে ইয়ার্ন ফ্র্যাঞ্চাইজ
(yarn franchise) বলা হত, আমি পেশ করলেই ভালো হয়। এক বাবা (সন্ন্যাসি) এদিকে, আরেক
বাবা ওদিকে। আমি সুতো কাটতামও নিয়মিত, তকলিতে। সেখানেও সঙ্গেই ছিল। টন্ডনজি আমায় বললেন,
প্রস্তাবটা রাখবেন না? আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং পেশ করে দিলাম প্রস্তাব। রাঘব দাসজি
বরোধ করলেন। জেলাটাও তাঁর,তা সত্ত্বেও আমার প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। এসব দেখে কয়েকজন
প্রেসওয়ালা আমায় আলাদা নিয়ে গিয়ে জবরদস্তি তকলিতে সুতো কাটতে থাকার ছবি তুলল।
সে সময় এক মজার ঘটনা ঘটল। কাশীর শিবপ্রসাদ গুপ্ত ঠাট্টা করে বললেন,
সন্ন্যাসি হয়ে কী এসব সুতো-ফুতো কাটার কথা বলেন? আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, আমার
ধর্ম এবং আপনার ধর্মও আমি খুব ভালো করে জানি। কাজেই আপনার কাছ থেকে আমার শেখার নেই।
সবাই হেসে উঠল। উনি চুপ মেরে গেলেন।
পরিবর্তনবাদী আর অপরিবর্তনবাদীদের মধ্যেকার ঘরোয়া লড়াই কিভাবে শান্ত
হবে তার কিছু রাস্তা শেষ অব্দি বেরুলোই না। দাস আর নেহরুর জোরদার প্রচেষ্টা চলছিল।
ওদিকে কাশীর ভগবান দাসজি নিয়মিত গান্ধিজির ওপর চাপ দিচ্ছিলেন যে স্বরাজ্যটাকে পরিভাষিত
করে ফেলুন, নইলে বিপদ আছে। কিন্তু গান্ধিজি তখন শুনলেন না। তখন ভগবান দাসজি নিজের পরিকল্পনা
তৈরি করে দাশ সাহেবকে দিলেন। তাঁর পার্টি সেটা পাসও করে নিল। তারপর ভাবনাচিন্তা হল
যে কংগ্রেসের দুই পার্টির মধ্যে থেকে কোন একটির জয় না হলে ব্যাপারটা শান্ত হবে না।
তাহলেও, দাশ সাহেবের পার্টিরই জয়ের সম্ভাবনা ছিল। শেষে দিল্লিতে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন
করে সিদ্ধান্তে পৌঁছোন স্থির হল। মওলানা আবুল কালাম আজাদ তার সভাপতি নির্বাচিত হলেন।
আমিও তাতে শামিল ছিলাম। অনেক লোকজন হয়েছিল।
মওলানা নিজের ভাষণে কাউন্সিল পক্ষের সমর্থন করলেন। তারপর আর কী,
দাশ সাহেব জয়ের আশায় আশান্বিত হলেন। শেষে গান্ধিজি দুটো দলে আপোষ করিয়ে দিলেন। স্থির
হল যে কংগ্রেসমেন যদি চায়, নিজেরা কাউন্সিলে যেতে পারে, বা অন্যদেরকে পাঠাতে পারে।
কিন্তু এ কাজ কংগ্রেসের নামে হবে না। ফলে স্বরাজ্য-পার্টির জন্মের সূচনা হল। সেই পার্টির
তরফ থেকে কাউন্সিলের ভোটের লড়াই লড়া হল পরে। এখানে এটাও বলে দিই যে সে সময় আমি পাক্কা
অপরিবর্তনবাদী ছিলাম।
দিল্লিতে এই যে দুটো দলে আপোষ হল সেটা দাশ ও নেহরুর প্রবল প্রচেষ্টার
ফল ছিল। ওখানেই আমি দেখলাম যে স্বরাজ্য পার্টির কাজ জোরদার ঢঙে চালানর জন্য দাশ সাহেব,
ইংরেজিতে নতুন ফরোয়ার্ড (forward) নামে দৈনিকের বিজ্ঞাপন বিলি করালেন প্রচুর। তখন থেকেই
সেই খবরের কাগজ চালু হল। সে খবরের কাগজটাই পরে নাম বদলে ক্রমশঃ ‘লিবার্টি’ আর ‘এডভান্স’
নামে বেরিয়ে আসছে। সরকারের আক্রমণের নাম বদলাতে হয়েছিল।
কলকাতার পন্ডিত শ্যামসুন্দর চক্রবর্তি গোঁড়া অপরিবর্তনবাদী ছিলেন। যখন উনি দুটো দলের মধ্যে আপোষ হয়ে যাওয়ার খবরটা পেলেন তখন নিজের ইংরেজি খবরের কাগজ (servant)এ লিখলেন, দুই বিরোধী দলের নেতা শ্রী চিত্তরঞ্জন দাশ আর চক্রবর্তি রাজগোপালাচারির মধ্যে, একমাত্র এইটুকু ছাড়া যে দুজনেরই নামের আদ্যাক্ষর সী আর (C. R.), আর কোন জিনিষটা সমান হয়ে গেল? আর কী করে দুজনের আপোষ হয়ে গেল? কথাটা তো ঠিকই ছিল তাঁর!
(১৫)
গান্ধিজি জেলে এবং বাইরে
১৯২২ সাল থেকে ১৯২৪ এর মাঝে দুটো আরো বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করা জরুরি।
১৯২২ এর ফেব্রুয়ারিতে বারদৌলি থেকে অসহযোগের সংগ্রাম স্থগিত করে গান্ধিজি বোধহয় মার্চ
মাসে দিল্লিতে অখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির মিটিং ডেকেছিলেন। তাতে উনি নিজের চিন্তানুসারে
কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। সংগ্রাম স্থগিত করার সমর্থনে যে প্রস্তাব
ছিল তাতে উনি যোগ করতে চাইলেন যে কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে যে দুটো শব্দ আছে লেজিটিমেট
(legitimate) এবং পিসফুল (peaceful), তার অর্থ হল ক্রমশঃ ট্রুথফুল (truthful) এবং ননভায়োলেন্ট
(non-violent)। কিন্তু কমিটি এই ব্যাখ্যা মানল না। এর পর নিজের সাপ্তাহিক ইয়ং ইন্ডিয়ায়
উনি একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন এওং বললেন, আমরা কোথা থেকে কোথায় চলেছি তার ঠিকানা জানি
না। যদি সময় থাকতে সচেতন না হই তাহলে অতল সমুদ্রে গিয়ে ডুবব। সত্য এবং অহিংসা না মেনে
আমরা সরকারকে দুর্বল করার বদলে দেশের প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি।
কিন্তু এর কোনো প্রভাব মানুষজনের ওপর তো পড়ল না বরং সরকার ভালো ভাবে
বুঝে গেল যে গান্ধিজির প্রভাব কমে গেছে। ব্যস, ছ বছরের জন্য ওনাকে জেলে ঠুঁসে দিল।
তখন থেকে এখন অব্দি, যদ্দুর আমি জানি, কংগ্রেস বা অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি কখনো কংগ্রেসের
উদ্দেশ্যের ওই দুটো শব্দের গান্ধিজি প্রদত্ত অর্থ স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নি। কেউ খোলাখুলি
চেষ্টাও করে নি স্বীকার করাবার। তা সত্ত্বেও আজ কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হিসেবে সত্য আর
অহিংসারই ঢাক পেটান হয়। একেই বলে সময়।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল জেল থেকে দু’বছর পুরো হওয়ার আগেই গান্ধিজির ফিরে
আসার পর। ১৯২৪ সালে আহমেদাবাদে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির বৈঠক ছিল। আমিও সে কমিটির
সদস্য ছিলাম। গিয়েছিলাম সেখানে। যা দৃশ্য দেখলাম তা ভোলার মত নয়। বাংলার বিখ্যাত এক
বিপ্লবী যুবক শ্রী গোপীনাথ সাহার ফাঁসি হয়েছিল। হিংসার, গান্ধিজি কৃত ভর্ৎসনা মেনে
নিয়েই দাশ সাহেব একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, যাতে সেই বিপ্লবী যুবকের হিংসাশ্রয়ী কাজের
নয়, কিন্তু উদ্দেশ্যের প্রশংসা ছিল। খুব তর্ক হল গরম গরম। শেষে সম্মতি নেওয়ার বেলায়
প্রস্তাবটা পড়ে গেল। সভাপতি ছিলেন মওলানা মোহম্মদ আলি। প্রস্তাবটা অস্বীকৃত হওয়ার সাথে
সাথেই দেশবন্ধু, পন্ডিত মোতিলাল নেহরু প্রভৃতির সাথে বড় একটা দল কমিটি থেকে উঠে বাইরে
চলে গেল। এতে গান্ধিজি বিচলিত হলেন। এ কথাও বললেন যে এবার গুনে দেখুন ক’জন ভিতরে রইল
আর ক’জন বাইরে গেল। গোনায় বোঝা গেল যে দু’দিকেই সমান সমান, সামান্য কিছু তফাৎ। সেটা
শুনেই উনি দাশ সাহেব এবং অন্যান্যদের ডেকে পাঠালেন এবং আবার সেই প্রস্তাবটা উত্থাপন
করিয়ে পাশ করিয়ে দিলেন। যদিও, মনে গভীর আঘাত পেলেন ব্যাপারটায়।
এর পরেই উনি আরেকটা প্রস্তাব নিয়ে – সেটাও আগে পড়ে গিয়েছিল – আবার
থেকে চিন্তাভাবনা করতে বলেন কমিটিকে এবং ইচ্ছা জানান যে সেটাও পাশ হওয়া উচিৎ। আসলে
কংগ্রেসিরা মোকদ্দমায় তদ্বির করত না। এমনই কঠিন নির্দেশ ছিল কংগ্রেসের। ওদিকে বেলগাঁওয়ে কংগ্রেস হওয়ার ছিল। সে কংগ্রেসের হর্তাকর্তা শ্রী গঙ্গাধর রাও দেশপান্ডের সমস্ত সম্পত্তি
নিয়ে নিতে উঠে পড়ে লেগেছিল সরকার। অথচ কেস তো উনি লড়বেন না। তাই প্রস্তাবটা এধরণের
ছিল যে বিশেষ বিশেষ কেসে যেন তদ্বির করা হয়। কিন্তু কমিটি আগে এটা স্বীকার করেনি। গান্ধিজি
সেই প্রস্তাবটাকেই দ্বিতীয়বার পেশ করে, চাইছিলেন কমিটি যেন মেনে নেয়। এতে সদস্যেরা
নিয়মের ভিত্তিতে ওজর-আপত্তি ওঠান শুরু করল যে এই বৈঠকেই পড়ে যাওয়া প্রস্তাব এই বৈঠকেই
আবার কী করে পেশ হবে ইত্যাদি। গান্ধিজি যুক্তিতর্কগুলো শুনছিলেন আর ওনার চেহারা রক্তাভ
হয়ে উঠছিল। গোপী সাহার প্রস্তাবে একটা ধাক্কা আগেই লেগেছিল। এই প্রস্তাবে আরেকটা ধাক্কা
লাগল। ওতেও হেরেছিলেন, এতেও হারলেন। ভেবেছিলেন যেভাবে সাহা-সম্পর্কিত প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার
পেশ হয়ে পাস হয়ে গেল সেভাবে যদি এটাও হয়ে যায় তাহলে মনটা শান্ত হয়। উনি পাশ করানর পক্ষে
ছিলেন। কিন্তু লোকে শুনলে তবে তো?
শেষে উনি ফেটেই পড়লেন। কিছুটা রাগ আর কিছুটা অস্থিরতার কারণে শিশুর
মত মুখ করে অগ্নিবৃষ্টি শুরু করলেন। বললেন, স্বরাজ্য পেলে এই কমিটিই পার্লামেন্ট হবে
যেটা আজ শিশুদের মত কাজ করছে। এক্ষুনি যখন সাহা-সম্পর্কিত প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার পেশ
করে পাশ করা হল কেউ কায়দাকানুন দেখাল না; আস্তে করে গলার নিচে নামিয়ে নিল। কিন্তু যখন
এই প্রস্তাবটার বিষয়ে বললাম তখন সবাই কায়দার বদহজম দূর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ব্যাপার
কী? এখন এসে পড়া এই সব যুক্তিতর্কগুলো ওই প্রস্তাবটার সময় ছিল কোথায়? ওদিকে প্রস্তুতি
হয়ে গেছে যাতে দেশপান্ডের মত দক্ষ কর্মকর্তা এবং নেতা সর্বস্বান্ত হয়ে যায় আর বেলগাঁওয়ের
কংগ্রেস সেশন না হতে পারে। আমি ওই প্রস্তুতিটাকেই অসফল করতে চাই। তাই এই প্রস্তাব আবার
করে এনে পাশ করাতে চাইলাম। কিন্তু আপনারা দেখতেই পান না। আপনারা আমায় কংগ্রেসে থোড়াই
কয়েদ করে নিয়েছেন? এক্ষুনি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। নিজের চিন্তাভাবনা ছেড়ে বা তার হত্যা করে
আমি কোথাও থাকতে পারব না। দেখি কে আমায় কংগ্রেসে রাখে। ইত্যাদি।
ব্যস, তারপর আর কী? কিছুক্ষণ সব নিঃশব্দ হয়ে রইল এবং গান্ধিজির ফোঁপানি
বন্দ হওয়ার আগেই চার দিক থেকে অনুনয়-বিনয় শুরু হল। এমনটা হবে ওরা বুঝতে পারে নি। তাই
ঘাবড়ে গিয়ে কোথাও দেশবন্ধু, কোথাও পন্ডিত মতিলাল, কোথাও সভাপতি মওলানা মোহম্মদ আলি
হাত জোড় করে গান্ধিজিকে তোষামোদ করা শুরু করলেন। কিন্তু যখন দেখা গেল যে উনি শুনতে
রাজি নন, তখন মওলানা মোহম্মদ আলি নিজের মাথার টুপি ওনার পায়ের ওপর রেখে দিলেন। তখন
গিয়ে উনি নরম হলেন। সে দৃশ্য দেখার মত ছিল। লিখে বোঝান যাবে না।
(১৬)
আমার ছোঁয়াছুঁয়ি
১৯২৩ সালের শেষের একটা মজাদার এবং জরুরি ঘটনার কথা বলে আমি ১৯২৫
সালে পৌঁছোব। মওলানা মোহম্মদ আলির সভাপতিত্বে অন্ধ্র প্রদেশের কাঁকিনাড়ায় কংগ্রেসের
অধিবেশন হওয়ার ছিল। একটি দলের সাথে আমিও রওনা হলাম তাতে অংশগ্রহণ করতে। মানমাড জাংশন
থেকে হায়দরাবাদ স্টেট রেলওয়েতে বেজওয়াড়া গিয়ে সেখান থেকে অন্য ট্রেন ধরে কাঁকিনাড়া
পৌঁছোনর ছিল। আমরা মানমাডে বম্বে মেল ছেড়ে দিলাম। কাছের ধর্মশালায় গেলাম। সেখানেই কাকতালীয়ভাবে
কাশীর প্রসিদ্ধ দেশসেবক শ্রী শিবপ্রসাদ গুপ্তের সাথে দেখা হল। আলাপচারিতার মাঝে স্থির
হল যে পথে ইলোরার বৌদ্ধকালীন ঐতিহাসিক গুহাগুলো দেখা জরুরি। সকালে স্নান ইত্যাদি করে
আহার সেরে আমরা ট্রেনে চাপলাম।
ওখানেই আমি প্রথম প্রথম গান্ধিটুপি পরা একটা দল দেখলাম। জানতে পারলাম
যে তারা সাবরমতির সত্যাগ্রহ আশ্রমের লোকজন। শুনেছিলাম, এবং পড়েওছিলাম যে এরা খুব সংযমের
সাথে চলাফেরা করে। মিষ্টি-ফিস্টি এরা খায় না। কিন্তু ওখানে ওদের কাছে পুরো ভাঁড়ারঘর
দেখলাম লাড্ডু, বোঁদে আরো নানারকম মেঠাইয়ের। জমিয়ে খেয়ে চলেছিল ওরা। অবাক তো হলাম নিশ্চয়ই
– এরা কি সত্যিই গান্ধিজির সেই ঐতিহাসিক আশ্রমবাসী? পরে মনকে বোঝালাম, আশ্রমের বাইরে
এসে যে একটু স্বাধীনতা পেয়েছে বোধহয় সেটুকুরই উপভোগ করছে ওরা। কিন্তু বার বার ব্যাপারটা
মনকে খোঁচাতে লাগল – এ কী ব্যাপার? নিশ্চয়ই কিছু অসাধুতা আছে এর মধ্যে!
ট্রেন যখন ইলোরা স্টেশনে দাঁড়াল দেখলাম কয়েকজন ইলোরা যাওয়ার জন্য
নামছে। ওখান থেকে ইলোরা বোধহয় আট মাইল। কিন্তু আমাদের বলা হয়েছিল যে পরের স্টেশন সেকান্দ্রাবাদে
নামলে ভাল হবে। সেখান থেকে টাঙ্গা ইত্যাদি পাওয়া যাবে। আমরা তাই করলাম। সেকান্দ্রাবাদে
নেমে গুপ্তাজি কয়েকটা টাঙ্গা ঠিক করলেন সবার জন্য। যাহোক, আমরা ইলোরা গেলাম। ঘুরে ঘুরে
দেখলাম পাহাড়ের পেটে, পাহাড়টাকেই কেটে তৈরি করা দোতলা তিনতলা বাড়ি; তার দেয়ালে আঁকা
রঙিন ছবি তখনও টাটকা মনে হচ্ছিল। সত্যিই আশ্চর্যজনক যে বৌদ্ধযুগের এই সৃষ্টি এখনও ফিকে
হয় নি। কে বলবে যে রঙ তৈরি করার কেমন বিজ্ঞান ছিল সেসময়? পাহাড় কেটে এত তলার উঁচু বাড়িগুলো
কী করে তৈরি হল? সব দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তও হয়ে পড়লাম। ওদিকে
সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছিল। কেউ বলল, পাশেই গ্রাম আছে যেখানে পান্ডারা থাকে। সেখানেই থাকা
উচিৎ। সবারই ভাল লাগল কথাটা যে রাতটা ইলোরা গ্রামে কাটান যাক। ব্যাস, সেখানেই কোন পান্ডার
বাড়িত উঠলাম।
পরের দিন সকালে উঠলাম। শৌচ, স্নান ইত্যাদি সারলাম। গুপ্তজির সাথে
কাশীর এক যুবক ব্রাহ্মণ পাচক ছিল। সেই আহারের জন্য লুচি আর তরকারি তৈরি করা শুরু করল।
ওদিকে গুপ্তজি স্নান করে পায়জামা পরলেন এই বলে যে সন্ধ্যা করবেন। সন্ধ্যা আর কি, বোধহয়
প্রাণায়াম করলেন। তারপর ধুতি পরে নিলেন। আমি তো কারুর হাতে তৈরি খাবার খেতামই না সচরাচর।
কিন্তু ওখানে খাবার রান্না করার অসুবিধে ছিল। ট্রেন ধরারও তাড়া ছিল। ভাবলাম পাচক তো
ব্রাহ্মণ। গুপ্তজি আর্যসমাজী। তাই পাচক সচ্চরিত্রই হবে। দুশ্চরিত্রকে উনি রাখবেনই বা
কেন? তাই তার হাতে তৈরি লুচি খেয়ে নিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারলাম লোকটা বড়ই দুশ্চরিত্র।
ভীষণ গ্লানি হল। হাসতে হাসতে গুপ্তজিকে বললাম, আপনার সাথে থাকার দৌলতে একে সচ্চরিত্র
ব্রাহ্মণ ভেবে এর হাতের লুচি খেয়ে নিলাম। পরে জানলাম লোকটা বড়রকমের দুরাচারী। এটুকু
শুনেই উনি হেসে বললেন, “সচ্চরিত্র কাকে বলে?” আমি বললাম, “যে দুরাচার, ব্যভিচার ইত্যাদি
না করে।” উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “গরুর বাচ্চা বড় হয়ে ষাঁড় হয় আর সেই গরুর ওপরই চড়ে,
তার মানে কী, সে দুরাচারী, ব্যভিচারী?”
এটুকু শুনেই বুঝে গেলাম ব্যাপারটা এখানে বেঢপ। আমি ভুল করে এনাকে
আর্যসমাজী ভাবছিলাম। সাধারণ যুক্তিতর্কগুলো করা অর্থহীন। কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তখনই
উনি বললেন, “যদি শ্রী প্রকাশ এখানে থাকত তাহলে আপনাকে আরো বেশি হতচকিত করত।” আমি বললাম,
“গুপ্তজি, একটা প্রশ্ন করি। যদি আপনি উত্তর দিয়ে দেন তাহলে আমি হেরে যাব। কিন্তু এ কথাটা
বলে দিই যে আমাকে সেরকম সন্ন্যাসি ভাববেন না যারা অন্ধ পরম্পরার অনুগামী। আমি নিজের
বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারটা মানি।”
তারপর শুরু করলাম, “একজন এমন ব্রাহ্মণ কল্পনা করুন যিনি ভাল বিদ্বান,
বেদজ্ঞ, কর্মঠ, দেশভক্ত, খাদিধারী এবং পরোপকারী। দেশের সেবায় সে জেলেও গেছে, কষ্টও
ভোগ করেছে। এমন মানুষ হওয়া সম্ভব। ফলে তাকে সবাই মান্য করবে। এবার কল্পনা করুন, দৈবাৎ
সে ঘন জঙ্গলে অবস্থিত একটি গ্রামের কাছে ঝোপে বসে কিছু করছে; বা হয়ত নিজের ক্লান্তিই
দূর করছে। আপনিও কিছুটা দূরে বসে আছেন এবং তার কীর্তিকলাপ দেখছেন। কিন্তু কিছু বলছেন
না। কোনো কারণে আপনার জিভে কথা বলার শক্তি আর নেই। ইতিমধ্যে এক বড়লোকের ছোট্ট শিশু,
সারা শরীর ভরা সোনা, জহরৎ, সেই ঝোপে এল। সোনা, জহরৎ দেখে ব্রাহ্মণ প্রলুব্ধ হয়ে পড়ল।
এমন হওয়া অসম্ভব তো নয়। এবার ব্রাহ্মণ ভাবল যে যদি ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করি তাহলে শিশুটি
চিৎকার করবে আর যদি কাছে কেউ থাকে তাহলে ধরা পড়ে যাব। ব্যাস, একটা বড়সড় ছুরি বার করে
সে শিগগিরই শিশুটির গলা কাটল এবং সব মাল নিয়ে তক্ষুনি পালাল। আপনি ওর সমস্ত ক্রিয়াকলাপ
দেখলেন, আপনি ওকে চেনেনও।”
“এখন, যদি ভবিষ্যতে আপনার জল খাওয়ার ইচ্ছে হয় এবং কাকতালীয়ভাবে সেই
ব্রাহ্মণের সাথে দেখা হয় এবং সেই খাওয়ার জল নিয়ে আসে, আপনার সাহস হবে, জলটা খাওয়ার?
আমি থেমে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু গুপ্তজির তো মুখে কুলুপ এঁটে গিয়েছিল।
আমি বার বার চাপ দিলাম, বলুন, চুপ করে আছেন কেন? কিন্তু তাঁর মুখ খুলল না। খুললই না।
বললাম এরকম অনেক প্রশ্ন করতে পারি। এটাকেই চরিত্র বলে। আমার বিশ্বাস, চরিত্রের অর্থ
আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
এভাবেই তাঁকে আমি নিরুত্তর করলাম এবং তাঁর মত উচ্ছৃংখল ব্যক্তির
সামনে নিজের সমঝদারিটা স্পষ্ট রাখলাম। উচ্ছৃংখলতা শুধু এইটুকু যে সে পূঁথিপত্র না মেনে
এঁড়ে তর্ক নিয়ে চলে। আমি তাঁকে এ কথাও বললাম যে আমার এই ছোঁয়াছুয়িতে আমি বাইরের এবং
ভিতরের, দু’ধরণেরই শুদ্ধি মেনে চলি। বাইরের বলতে ধোয়া-টোয়া, স্নান এবং বাসস্থানাদির
পরিচ্ছন্নতা। ভিতরের বলতে চরিত্রের শুদ্ধির সাথে সাথে কোন ধরণের সংক্রামক রোগ না থাকা।
এটা তো একান্ত পরিচিত কেউ না হয়ে বাইরের কেউ হলে জানা যাবে না। তাই অপরিচিত হাতের তৈরি
খাবার খাওয়া সনাতনীদের মানা। বললাম, জেলেও এই জন্যই আমি খাবার তৈরি করা কয়েদিদের দিয়ে
নিজের খাবার তৈরি করাতাম না। কেন না ভাবতাম, কে জানে কোন কোন কুকর্ম করে জেলে এসেছে!
কলের জলও এই কারণে আমি খাই না। ঘটি ইত্যাদি তো বার বার রগড়ে রগড়ে বাইরে ভিতরে ধোয়া
হয়। নইলে ধাতুতে বিষ তৈরি হয়ে যাওয়ার এবং নোংরা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু কলের ভিতর
বা বাইরেটা তো কখনো সেভাবে রগড়ে ধোয়া হয় না। কেউ কি ভালো করে না ধোয়া ঘটিতে জল খাওয়ার
সাহস করবে? তাহলে কলের জল খাওয়ার সাহস কী করে করি? কাশী প্রভৃতি শহরে তো পায়খানা ইত্যাদির
নলের (drains) সঙ্গেই জলের নল থাকে। তাই আরো প্রবৃত্তি হয় না। নদীতেও নোংরা জিনিষ পড়ে
নিশ্চয়ই। কিন্তু সেখানে ধাতুর ব্যাপারটা নেই। বরং, স্রোত বইতে থাকে বলে জলের আভ্যন্তরীণ
ক্রিয়ায় (chemical action) শুদ্ধি হয়ে যায়। তাই বলা হয়, “বহতা জল নির্মল, বাঁধা জল
ময়লা”।
কিন্তু তখন থেকেই আমার মনে এর একটা বিচিত্র প্রভাব পড়ল; এটা আগে
ছিল না। তখন থেকেই ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে আমি আরও কঠোর ও নির্মম হয়ে পড়লাম। কেননা সেদিন
দেওয়া যুক্তিগুলো মাথায় সব সময় টাটকা ঘুরতে থাকে। আগে এমনটা ছিল না। মানুষের আচরণ নিয়ে
এত কঠোর ভাবে খোঁজাখুঁজি করতাম না। আমার আহার্য বা জল নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির অর্থ এ নয় যে
আমি কোনো মানুষ বা জাতকে সব সময়ের জন্য অস্পৃশ্য মনে করি। এটা তো ভুল। আমার ধারণা যে
পুঁথিতেও এ ভাবনার যাথার্থ্য প্রমাণিত হতে পারে না আর স্বাধীনভাবে চিন্তা করলেও ভাবনাটা
যুক্তিযুক্ত মনে হবে না। আমি শুধু আহার্য আর জলে ছোঁয়াছুঁয়ি মানি। কারণ বলেইছি। আমার
ছোঁয়াছুঁয়ি চিন্তাপ্রণোদিত, যুক্তিমূলক। আমি এ বিষয়ে বার বার ভেবেছি এবং যত চিন্তা
করেছি ততই কঠোর হয়েছি। যদিও আজকের যুগে এর পরিণামে আমার বিরুদ্ধে অনেক সন্দেহ ছড়িয়েছে।
এমনকি লোকে ভেবে নিয়েছে যে নিচুজাত, উঁচুজাত, হিন্দু, মুসলমান ইত্যাদি ভেদবুদ্ধির কারণে
আমি এই ছোঁয়াছুঁয়ি মানি। কিন্তু মানুষের এ ধারণা ভুল।
আমি জাত বা বর্ণ দিয়ে কাউকে নিচু-উঁচু বা স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য মানি
না। মুসলমান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের অস্পৃশ্য মানার মূর্খতাও করতে পারি না। যদি
কারোর মনে এবিষয়ে সন্দেহ থাকে তাহলে একবার যে কোনো জাতের বা ধর্মের মানুষ আমার রুটি
বা জল ছুঁয়ে পরীক্ষা করে নিক আমি খাই না ছেড়ে দিই। কিন্তু সব সময় এধরণের ছোঁয়া আহার্য
বা জল খাওয়ার সাহস আমার হয়ই না। আমার স্বভাবই কিছুটা এমন হয়ে গেছে। যে নিষেধটা ৫০ বছর
ধরে অনবরত পালন করলাম, এদিকের দিনগুলোয় তো যুক্তিসহকারে করলাম, সেটা স্বভাব না হয়ে
যায় কোথায়? এতে স্বয়ং আমারই কষ্ট হয়। কিন্তু শেষ পরিণাম ভালোই হয়। খাওয়াদাওয়ায় আমার
সংযম বজায় থাকে। তাতে স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। তাই এখন তো খাওয়াদাওয়ার এই বজ্রগোঁড়ামিকে
আমি আমার স্বাস্থ্যরক্ষার ঢাল মনে করি। ফলে এটা ছাড়তে চাই না, যাতে নীরোগ থেকে বেশি
কাজ করতে পারি। নীরোগ থাকিও।
পরে বলব কখন আমি আমার এই গোঁড়ামি ত্যাগ করি এবং কেন? তার দৃষ্টান্ত আসবে। নিশ্চয়ই আমার এই গোঁড়া ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার আজকের যুগের জন্য নয়। এ যুগে এমন থাকা অসম্ভব। অত্যন্ত অসুবিধের মধ্যে থেকে আমি পালন করি। তাই সে অর্থে আমি সনাতনপন্থী। তাও আবার পাকা। এটা মানতে আমার একটুও দ্বিধা বা লজ্জা নেই। এ কারণেই এ পন্থায় চলার প্রস্তাব আমি কখনো কাউকে দিই নি। এত বড় ভুল আমি কিছুতেই করতে পারি না। যারা গোঁড়া বৈষ্ণব, আচারি হয়েও বাজারের অমৃতি বা ডাক্তারি ওষুধ খায় তাদেরকে আমি ভন্ড মনে করি। যদি তারা ভাবত যে সে জিনিষগুলো কী করে বানানো হয় এবং মিলে চিনি কিভাবে তৈরি হয় তাহলে বোধহয় ভন্ডামিটা করত না। হয় সোজাসুজি সব রকম খাবার খেত আর নয়ত ছেড়ে দিত। আমি তো ওসব জিনিষ ছুঁইও না। তাই আমি এটাও মানি যে হয় আমার মত ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার থাকুক নয়ত পানাহারের নতুন ধরণের পদ্ধতি জারি হোক। একদিকে বাজার এবং হালুইকরের জিনিষ খেয়ে আর অন্য দিকে হিন্দু হোটেলে ব্রাহ্মণের হাতে তৈরি খাবার হজম করে যারা মনে করে যে তারা ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার পালন করছে তারা ভন্ড এবং মুর্খ। আমার তো এই ছোঁয়াছুঁয়ির জন্য প্রচন্ড অসুবিধে হয় ট্রেনের লম্বা সফরে। তাই মাঝপথেই ট্রেন ছেড়ে আমি আহার্য আর জলের ব্যবস্থা করি আর নয়ত চব্বিশ ঘন্টা এমনিই থেকে যাই। সেই সফরেই তো, সেকেন্দ্রাবাদ থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছোলাম বেজওয়াড়া। তারপর পায়খানা গেলাম, দাঁতন করলাম। ফলে ভীষণভাবে বেড়ে গেল দাঁতের ব্যথা।
(১৭)
আবার পুরোহিতগিরির প্রশ্ন
১৯২৪ সাল শেষ হতে না হতে বিহারের সাথে আমার আবার থেকে সম্পর্ক গড়ে
উঠল। আসা যাওয়া তো ইউ.পি.তেও চলতেই থাকল। কংগ্রেসের কাজ বলতে তো কিছু ছিল না। চরকা
আর খাদির কাজ কি এমন কিছু যা জনগণকে আকর্ষণ করতে পারে? তারা তো রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা
চায়। জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি যাকে জীবিকার জন্য প্রতিদিন মাটি, হাওয়া, সূর্য, জল এবং
মানুষের সাথে তীব্র সংগ্রামে থাকতে হয়, সে জনগণ সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো জিনিষকে নিজের
জন্য যথার্থ কল্যাণময় কী করে বুঝবে? তাই একদিকে যেমন নির্বাচনের প্রশ্ন প্রবল হয়ে উঠতে
শুরু করেছিল, তেমনই, সংগ্রামের দিনগুলোয় চাপা থাকা কংগ্রেসের পুরোনো নোংরামো মাথা চাড়া
দিয়ে উঠতে লাগল। বলা হয় যে সংগ্রামের সময় আমাদের দুর্বলতাগুলো জেলের ভিতরে চলে যায়।
সেখানেই আমরা সেই দুর্বলতাগুলো প্রদর্শিত করি এবং তার শিকার হই। কিন্তু যখন সংগ্রাম
থাকে না তখন বাইরেই আমাদের দুর্বলতাগুলো আমাদের চেপে ধরে।
এদিকে কংগ্রেসের সংগ্রামে আমার ব্যস্ত হয়ে পড়ায়, ভুমিহার ব্রাহ্মণদের পুরোনো আন্দোলনটার বিরোধীদের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। যেখানে সেখানে তারা আন্দোলনকারীদের দমিয়ে
দেওয়া শুরু করেছিল। পুরোহিতেরা পুরোহিতের কাজ না করার হুমকি তো দিলই, অনেক জায়গায় ভুমিহার
ব্রাহ্মণদের পুরোহিতগিরি – বিয়ে, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি করান – ছাড়িয়ে দিল। এতে সমাজে এক
ধরণের হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল। বিরোধীরা ভাবছিল, এখন তো আর স্বামীজি একাজে মাথা গলাবেন না।
সমাজের মানুষেরাও কিছুটা এমনি ভাবতে শুরু করেছিল। তারা খুব করুণভাবে বারবার নিজেদের
অবস্থা জানাল আমায়। ফলে আমার মন আবার গলে গেল। প্রথমতঃ কোনো রাজনৈতিক কাজ ছিল না সে
সময়। দ্বিতীয়তঃ জালিয়াঁওয়ালা বাগের করুণ-ক্রন্দন যেমন আমায় ওদিকে টেনেছিল, এদের কান্না
এদিকে টানতে শুরু করল।
যে আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিল বলে আমি এবং আমার সাথে হাজারে হাজারে
হাসতে হাসতে জেলে গিয়েছিলাম, সে আত্মসম্মানে অন্য দিক থেকে অন্য ধরণের আঘাত হল, যাতে
বিচলিত হল মানুষেরা। যখন সরকারের হুমকি কিছু করতে পারল না, পুরোহিতদের হুমকিতে কে বিচলিত
হত? পুরোহিতেরা ভাবত এদের মধ্যে কেউ পুরোহিতের কাজ জানেই না। ফলে হার মেনে এদের মাটিতে
নুয়ে পড়তে হবে। তখন যেমন চাই তেমন শর্ত স্বীকার করিয়ে নেব। ঠিক যেমন সরকার ভাবত।
পুরোহিতেরা এবং তাদের বন্ধুরা একথাও প্রচার করল যে স্বামীজি তো সব
কাজ এমনি মাঝপথে ছেড়ে আলাদা হয়ে যান। দেখলাম সে প্রচারের প্রভাবও পড়ছে। তখন আর সেটা
আমি সহ্য করতে পারলাম না। আরো একবার সমাজের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হল। এই সময়টাতেই সিমরিতে
থেকে, এক চাতুর্মাস্য পরিশ্রম করে বারো’শ পৃষ্ঠার বই লিখলাম, ‘কর্মকলাপ’। আগে উল্লেখ
করেছি। বইটা, দ্বিতীয়বার এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরই লেখা হল।
যুক্ত প্রদেশ এবং বিহারে ঘুরে ঘুরে শ’য়ে শ’য়ে সভা করলাম এবং ভুমিহার
ব্রাহ্মণদের উস্কানি দিলাম, যদি আত্মসম্মান ফিরে পেতে চাও তাহলে নিজেরা পুরোহিতগিরি
ধর। প্রয়াগের পান্ডাদের উদাহরণও দিলাম। বললাম, ওরাও তো ভুমিহার। ব্যাস, এতেই মানুষজনের
চোখ খুলল আর পুরোহিতগিরি শুরু করে দিল।
কিন্তু একাজে সবচেয়ে বড় বাধা ছিলেন পুরোনো ধ্যানধারণার বশবর্ত্তী
কয়েকজন বুড়ো, জমিদার এবং রাজা-মহারাজা। নিজেদের অজ্ঞানে এঁরা পুরোহিতগিরিকে খারাপ বলতেন।
যদিও টাকার জন্য ঘৃণ্যতম কাজও করে ফেলতেন। যুক্তিতর্ক মানতেন না। তাই স্থির হল যে ভুমিহার
ব্রাহ্মণ সভা থেকেই ব্যাপারটা পাস করিয়ে নিতে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ, যুক্ত প্রান্তের ভুমিহার
ব্রাহ্মণ সভার অধিবেশন ১৯২৫ সালের গ্রীষ্মকালে হওয়ার ছিল, কাশীতে। আমি জোর খাটালাম
যাতে সেখানে সফল হতে পারি। সৌভাগ্য এটাও যে দু’একজন ছাড়া গাজিপুরের প্রায় সমস্ত লেখাপড়া
জানা লোকেরা আমার সঙ্গ দিল। কিন্তু কাশীতে সভার স্তম্ভ এবং অধিবেশনের ব্যবস্থাপক বাবু
কবিন্দ্র নারায়ণ সিং ব্যাপারটার বিরুদ্ধে ছিলেন। উনি ওখানকার মানুষদেরও নিজের দিকে
টেনে নিলেন। তা সত্ত্বেও যুবকদের দল আমার সাথেই রইল, এমনকি ওনার বড় ছেলেও। কথাটা যে
আত্মসম্মান ফিরিয়ে আনার এবং স্বাবলম্বী হওয়ার! চ্যালেঞ্জের জবাবটাও দেওয়ার ছিল! যুবকদের
মাঝে সব সময় এ ধরণের ব্যাপারের একটা আবেদন থাকে। ওদিকে কবিন্দ্রবাবু নিশ্চিন্তে বসে
রইলেন যে কাশীতে তো ওনার জয় নিশ্চিত। কিন্তু সভায় প্রস্তাবের সমর্থনে হঠাৎ আমি একটা
বক্তৃতা দিলাম – মনে বিঁধে যাওয়ার মত। ফলে, বহুক্ষণ বিতর্কের পর সবার মত নেওয়া হলে
প্রস্তাবটা পাস হয়ে গেল। সে তো দারুণ আনন্দ! কিন্তু কবিন্দ্রবাবু ব্যাপারটাকে নিজের
ব্যক্তিগত অপমান ভেবে নিলেন। কেননা বাঘের ঘরে ঢুকে তার নাকে দড়ি পরানো হল। মনে মনে
উনি, যেমন করে হোক, প্রতিশোধ নেওয়ার সঙ্কল্প করলেন।
তাঁর সৌভাগ্য ছিল যে সে বছরই যুক্ত প্রদেশের বস্তি জেলায় অখিল ভারতীয়
ভুমিহার ব্রাহ্মণ মহাসভার অধিবেশন হওয়ার ছিল। হলও, খলিলাবাদে। উনি সবরকমভাবে প্রস্তুতি
শুরু করে দিলেন। বস্তী জেলার লোকেদের সাথে যোগসাজশও করলেন। ওদিকে মকসুদপুরের (গয়া)
রাজা চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ নারায়ণ সিংকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করালেন, প্রচার করলেন যে
ভুমিহার ব্রাহ্মণ শিক্ষা কোষে রাজা ষাট হাজার টাকা দেবেন। তাঁর চালটা ছিল যে এই কথায়
যুবকদের ওপর প্রভাব পড়বে এবং রাজার বক্তৃতায় পুরোহিতগিরির বিরোধ করিয়ে বাজিমাৎ করবেন।
প্রস্তুতি চলতে লাগল। আমিও বস্তীতে পৌঁছে সভার জন্য তৈরি হলাম। কেননা চাঁদা যোগাড়ে
সাহায্য করার জন্য লোকেরা আমায় আসার আগ্রহ জানিয়েছিল। বস্তী এমন একটা জেলা যেখানে বস্তী
শহর থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণপূর্বে বেশ কিছু গ্রামের ভুমিহার ব্রাহ্মণদের বৈবাহিক সম্পর্ক
সরযুপারিদের সাথে নিয়মিতভাবে হয়ে এসেছে। কিন্তু সময়ের ফের যে ওই ভুমিহার ব্রাহ্মণদের
অন্যান্য বাবুরা ছোট ঘর হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। আমি ওদের বাড়ি গিয়ে ওদেরকে উৎসাহিত
করলাম। ওরাও সভায় এল। ওদিকে কবিন্দ্রবাবু নিজের প্রস্তুতিতে কোনো কমতি রাখেননি। বাইরে
থেকে নিজের লেখাপড়া জানা বন্ধুদের ডেকে এনেছিলেন যাদের একমাত্র কাজ ছিল সভার সময় বিভিন্ন
ভাবে লোকেদের ফুসলানো আর ভুল বোঝানো।
এদিকে চার দিক থেকে আমার সমর্থকেরাও অনেক এসেছিল। বিহার থেকে তো
খাসা একটা দল পন্ডিত ধনরাজ শর্মার সাথে এল। সবাই নিজেদের কাজে রীতিমত জুটেও গেল। অধিবেশনে
সভাপতি যে লিখিত ভাষণটি পড়লেন তাতে মন খুলে পুরোহিতগিরির পক্ষে প্রচারের বিরোধ করলেন।
এত দূর লিখলেন যে, “কয়েকজন হামবড়া লোকেরা আমাদের সমাজে এর প্রচলন করতে চাইছে।” এতে
লোকেরা ভীষণ অসন্তুষ্ট হল। “হামবড়া” শব্দটা না সরানো অব্দি তাঁকে এগোতে দেওয়া হল না!
এটাই আমাদের প্রথম জয় ছিল। এতে ওদের দলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল – ভিতরে ভিতরে স্থানীয় মানুষদের
বলা হল সভায় বাইরে থেকে সব জাতের মানুষ এনে ভরিয়ে দিতে এবং তাদের দিয়ে পুরোহিতগিরির
বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াতে। বন্ধুরা এই চক্রান্তের ছকও সাজিয়ে নিলেন পুরোপুরি। আমি পরে জানলাম
ব্যাপারটা, যদিও আমার সঙ্গীরা আগে থেকেই জানছিল।
সভায় যখন প্রস্তাবের সময় এল তখন বিশাল ভীড়। বাবু কবিন্দ্র নারায়ণ
সিং নিজে পুরোহিতগিরির প্রস্তাবের বিরোধ করলেন এবং চাপ দিয়ে তমকুহির রাজাসাহেবকে দিয়ে
সেই বিরোধের সমর্থন করালেন। তমকুহি গোরখপুরে এবং বস্তীর প্রতিবেশী বলে বস্তী জেলার
মানুষজনের ওপর তাঁর ভালো প্রভাব ছিল। রাজাও বটে। প্রস্তাবটা আমি নিজেই পেশ করেছিলাম।
পেশ করার সময়েও আমি ভালো বক্তৃতা করেছিলাম। কিন্তু সব তর্ক-বিতর্কের পর যখন আমায় উত্তর
দিতে বলা হল তখন পন্ডিত ধনরাজ শর্মা বললেন একটু আবেগের (feeling) সাথে আবেদনটা করুন।
সত্যিই যে বক্তৃতা আমি সে সময় করেছিলাম, ও বিষয়ে ওই ধরণের বক্তৃতা বোধহয় আর কখনো করিনি।
অনেকক্ষণ বললাম এবং এমন বললাম যাতে পাথরও গলে যায়। জানতে পেলাম যে সেই বক্তৃতার পর
কবিন্দ্রবাবুর গোঁড়া সমর্থকেরাও ওনাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিল যে আর ওদের বিরোধ করার সাহস
নেই। সবার হৃদয়ে কথাটা বিঁধে গেছে।
তখন কবিন্দ্রবাবু ভাবলেন, সভাপতি তো তাঁরই লোক। কাজেই ভোট নেওয়ার
সময় গোলমাল করে বা এমনিই যেমন তেমন করে ঘোষণা করিয়েই দেব যে প্রস্তাবটা পাস হতে পারেনি।
তাই হল। ভোট নেওয়ার সময় হাত ওঠানো হল। বিরুদ্ধে খুব কম হাত উঠেছিল আর পক্ষে অসংখ্য।
তা সত্ত্বেও উনি সভাপতিজির কানে কিছু একটা বলে ঘোষণা করিয়ে দিলেন যে প্রস্তাবটা পড়ে
গেছে। তখন আমাদের সঙ্গীরা সভার অংশগুলো ভাগ করে আলাদা আলাদা গুনবার দাবি জানাল। কিন্তু
সেসব কিছুই শোনা হল না। তিন বার চেষ্টা করার পর আর চেষ্টা করা আমাদের অর্থহীন মনে হল।
এবং এভাবে কবিন্দ্রবাবুর ইজ্জৎ বেঁচে গেল যেমন করে হোক। সভাশেষ হল। কিন্তু আমরা সভা
শেষ হওয়ার আগেই ট্রেন ধরে কানপুর কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করতে ছুটলাম।
কানপুর থেকে ফিরে সঙ্গীদের সাথে শলাপরামর্শ করলাম যে শিগগিরই কবিন্দ্রবাবুর
শয়তানির শোধ সুদের সাথে ওনার ওপর নিতে হবে। ঠিক মনে নেই কী কারণে মহাসভার অধিবেশন ১৯২৬
সালের গরম কালেই করার সিদ্ধান্ত হল। খলিলাবাদে নেমন্তন্নটা তো বিহারের তরফ থেকেই এসেছিল।
কিন্তু ডিসেম্বরে না করে গরমকালে করার সিদ্ধান্ত বোধহয় এই কারণেই হয়েছিল যে ডিসেম্বরে
কংগ্রেসের অধিবেশন থাকায় কংগ্রেসিরা ভুমিহার ব্রাহ্মণ মহাসভায় অংশগ্রহণ করতে পারবে
না। খলিলাবাদ থেকে কানপুর তো কাছে। কাজেই যাওয়া সম্ভব হত কোনো রকমে। কিন্তু দূরের কোনো
প্রদেশে হলে অসম্ভব হত যাওয়া। তাই গরমকাল ছাড়া অন্য কোনো সময়ে করলে চলত না। কবিন্দ্রবাবুর
দুর্ভাগ্যবশতঃ শোধ নেওয়ার সময় তাড়াতাড়িই চলে এল। অধিবেশনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল
জোর কদমে।
পাটনার বাকরগঞ্জে দুন্দা সিংএর ঠাকুরবাড়িতেই অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত
হল। ওতেই স্যার গণেশদত্ত সিংএর ডেরা ছিল। একটা কথা বলে দিই। মোটামুটি ১৯২৪ সালে যখন
পুরোহিতগিরির আন্দোলন এগিয়ে চলল, কয়েকজন জমিদার তারপর স্যার গণেশদত্ত সিংএর কাছে নালিশ
করল যে স্বামীজি খুব দ্রুততার সাথে ভুমিহার ব্রাহ্মণদের পুরোহিতগিরির দিকে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে। একদিন ওনার ডেরায় কয়েকজনের সাথে আমিও বসে ছিলাম ঠিক তখনই এ বিষয়ে আলোচনা শুরু
হয়ে গেল। আলোচনাক্রমে স্যার গণেশ বললেন আপনি তো আমাদের সমাজটাকে নষ্ট করে দিচ্ছেন।
ছেলেদের আর যুবকদের লেখাপড়া ছাড়িয়েছেন। ওদের এবং অন্যদেরও বেশি নেশি করে জেলে পাঠিয়েছেন।
এখন যেটুকু আছে সেটুকুও এই পুরোহিতগিরির ভিক্ষাবৃত্তি শিখিয়ে বরবাদ করতে চাইছেন। আমি
কিছু বলতে চাইছিলাম যে এসব আপনি কী বলছেন। কিন্তু উত্তেজিতভাবে উনি বলতেই থাকলেন। এ
কথাও বলে দিলেন যে যদি বাভনের (ভুমিহার ব্রাহ্মণকে বিহারে বাভনই বলে) বাচ্চা পাঁচালি
শুনিয়ে পয়সা নেয় আর খায় তাহলে সেটা লজ্জায় ডুবে মরার ব্যাপার হবে।
এ কথায় আমিও রেগে গেলাম। স্পষ্ট বলে দিলাম যে বাভনের বাচ্চা যদি
পাঁচালি শুনিয়ে উপার্জন করে তাহলে সেটা লজ্জার নয় গৌরবের ব্যাপার হবে। কেননা সে তো
ব্রাহ্মণ এবং যেহেতু পাঁচালি শোনান ব্রাহ্মণেরই ধর্ম, কাজেই সেটা পালন করা তো তার জন্য
বাধ্যতামূলক। বরং যে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে আর গায়ে চাপকান পরে এজলাসে গঙ্গাজল-তুলসিপাতা
মুঠোয় ধরিয়ে মিথ্যে শপথ খাওয়ায় আবার তার পারিশ্রমিক হিসেবে পয়সাও নেয়, তার ডুবে মরা
উচিৎ লজ্জায়। এটুকু বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। স্যার গণেশ সে সময় মিনিস্টার ছিলেন,
তার আগে ওকালতি করতেন। কিন্তু তখনো অব্দি ‘স্যার’ হন নি। তাঁকেই লক্ষ্য করে আমি কথাগুলো
বলেছিলাম। শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তখন থেকেই তাঁর সাথে আমার ভালোরকম মনোমালিন্য
চলত।
যাহোক, স্যার গণেশও অভ্যর্থনা সমিতির সদস্য ছিলেন। সমিতির সামনে
প্রশ্ন ছিল যে অধিবেশনের সভাপতি কে হবে। আমি চাইছিলাম কোনো একজন জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসি
হোক সভাপতি। তাই অসৌঢ়ার (মেরঠ) চৌধুরি রঘুবীর নারায়ণ সিংকে সভাপতি করতে চাইছিলাম। কিন্তু
তখন অব্দি সভার সূত্রধার যাঁরা ছিলেন সেই রাজা-মহারাজা আর তাঁদের উপদেষ্টা স্যার গণেশ
প্রভৃতি তাঁর নাম সহ্য করতে পারতেন না। নিজেরা জীহুজুর ছিলেন তাই সেরকমই সভাপতি চাইছিলেন।
আগে সভায় প্রতি বছর রাজভক্তির প্রস্তাব পাস হত। সেটা তো আমি কবেই বন্ধ করিয়ে দিয়েছিলাম।
এখন সভাটাকে আরেকটু সময়ানুগ করতে চাইছিলাম। কিন্তু ওরা বিরুদ্ধে ছিল। আসলে এটাই ওদের
দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বার্থের তাগিদ ছিল। দোষ ছিল না কারোর। চৌধুরি রবিনারায়ণ সিং পুরোহিতগিরির
প্রশ্নে আমায় সমর্থন করতেনই। কেননা এটা আত্মসম্মানের প্রশ্ন ছিল এবং উনি পাক্কা অসহযোগী
এবং জেলযাত্রী ছিলেন। তাঁর ছেলের বিয়ে তো গৌড়-জমিদারের ঘরে হয়েছিল। কাজেই তাঁর মনে
দ্বিধা থাকার কোন প্রশ্ন ছিল না।
যেদিন অন্তিম নিষ্পত্তি হওয়ার ছিল যে কাকে বাছা হবে সভাপতি পদে,
সেদিনের মিটিংএ স্যার গণেশ এলেন না তো এলেন না, আমার বেড়াবার সময় হয়ে গেছে বলে হাঁটতে
বেরিয়ে গেলেন। তাই বাকি সবাইকে নিয়েই মিটিং হল। বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত মানুষেরাই ছিল।
একের পর এক বিভিন্ন নাম পেশ করতে লাগল লোকেরা। বেনারসের মহারাজা থেকে শুরু করে ক্রমশঃ
এগারটা নাম পেশ করা হল। তার পরেও যখন চৌধুরিসাহেবের নাম না পেশ করে একজন সামান্য ভদ্রলোকের
নাম পেশ হওয়া শুরু হল, আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বললাম, এ তো নষ্টামি হচ্ছে! আর
আমি মানব না। দ্বাদশতম নাম চৌধুরিসাহেবেরই হবে। যাহোক, লোকেরা মেনে নিল। আর কারো নাম
দেওয়া হল না। সবাই আশ্বস্ত ছিল যে এগারজনের মধ্যে কেউ না কেউ হয়েই যাবে। সবাই একসাথে
তো আর অস্বীকার করবে না! ফলে চৌধুরিসাহেব হতে পারবেন না। ওদের ভাবনা ছিল যে, সরকারের
নজরে বিদ্রোহী ব্যক্তি যদি সভাপতি তাহলে তো বিষম কান্ড হবে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে
সরকারের শুভানুধ্যায়ী হয়ে থাকার বারোটা বেজে যাবে। কিন্তু তারা থোড়াই জানত যে ওদের
সব ক’জন এসে পৌঁছোবে না আর বাধ্য হয়ে চৌধুরিসাহেবকেই সভাপতি করতে হবে!
এভাবে সভাপতিদের নাম ঠিক করার পর আমরা অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম
তখনই স্যার গণেশও মিটিংএ এসে পড়লেন। এসেই প্রশ্ন করলেন কী হচ্ছে? বলা হল। চৌধুরিসাহেবের
নাম শুনেই চমকে উঠলেন। কিছু একটা গোলমাল পাকাতে চাইলেন। আমি সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ
করলাম যে এ এজেন্ডা তো শেষ হয়ে গেছে। নিয়ম অনুসারে এ ব্যাপারে আমরা আর কোনো কথা ওঠাতে
পারি না। ব্যাস, এটুকুতেই ক্ষেপে গিয়ে স্যার গণেশ বললেন, আপনি যদি আমায় না চান তাহলে
যাচ্ছি – বলে ওঠার তোড়জোড় করলেন। আমি বললাম, চাওয়া না চাওয়ার তো কোন কথা নেই, আমি নিয়মের
কথা তুলেছি। তবুও যদি আপনি চলে যান, দুনিয়াটা তো ফাঁকা হয়ে যাবে না! আমার মনে নেই তারপর
উনি চলে গিয়েছিলেন কিনা। কিন্তু অন্যান্যরা আমাদের দুজনকেই শান্ত করল এবং মিটিংএর কাজ
পুরো করল। কিন্তু স্যার গণেশ ভালো করেই বুঝলেন যে এই সন্নেসিটা বড় বেয়াড়া। তারপর থেকে
উনি আমার সাথে ওভাবে কথা বলা একেবারেই ছেড়ে দিলেন। কেননা দু দু বার মুখেমুখে জবাব পেয়েছিলেন।
মনে কষ্ট তো ছিলই। সমাজে আমার প্রভাব ছিল, কাজেই করতেনই বা কী? এটা সত্যি যে অসহযোগের
যুগে জেলে যাওয়া মানুষজনদের প্রায় পচাত্তর প্রতিশত ভুমিহার ব্রাহ্মণই ছিল। সেই অনুপাতেই
ছেলেরা স্কুলকলেজও ছেড়েছিল। আমি তো বিশ্বাস করতাম যে যে সমাজের সেবা করতে গিয়ে দুর্নাম
কুড়িয়েছি সে সমাজ আমায় সঙ্গ দিয়েছে এবং দেশের মাথা উঁচু করার কাজে প্রথম সারিতে থেকেছে।
কিন্তু স্যার গণেশের মত লোকেদের মনে তো কষ্ট ছিলই ব্যাপারটা নিয়ে। তা সত্ত্বেও বাধ্যতা
ছিল।
তারপর ইয়ারদোস্তেরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করল। এগারজন মহাশয়ের কাছে চিঠি
গেল, স্মারকপত্র গেল, বেশ কয়েকজনের কাছে একজনের পর আরেকজনকে পাঠানো হল। কিন্তু ওদের
দুর্ভাগ্য একজনও ওদের অনুরোধ রাখতে রাজি হল না। ফলে ভয় ছড়াল। তবুও আবার করে বিশেষ চেষ্টা
করা হল। তাও ব্যর্থ! অবস্থা খারাপ। সরকারের নজরে বিদ্রোহী, এমন কাউকে ওরা চাইছিল না
আর বাকি এগারজনের একজনকেও ওরা পাচ্ছিল না। শেষ অব্দি, হেসে কেঁদে সেই চৌধুরিসাহেবকেই
কোনোরকমে গলাধঃকরণ করতে তারা বাধ্য হল।
এরই মধ্যে, সভারই কাজে একদিন সভার অফিসে গেলাম। অফিসটা স্যার গণেশেরই
বাড়িতে ছিল। উনি বললেন, “স্বামীজি, আমায় একেবারে যাচ্ছেতাই ভাববেন না। আমিও মানি, আগে
দেশ পরে জাতপাত, ‘First country, then community’। হুবহু তাঁর বলা কথাটাই লিখলাম। উনি
ভাবতেন আমি ওনাকে দেশের শত্রু এবং নিজের জাতের পক্ষ নেওয়া মানুষ মানি। কিছুটা সত্যিও
ছিল কথাটায়। তাই উনি বললেন। এ বিষয়ে আরো কিছু কথাবার্তা হল আর যেমন আমার অভ্যাস, তাঁর
কথা আমি মেনে নিলাম। সেদিন থেকে তাঁর প্রতি আমার মনোভাব পাল্টাল। ফলে, ওখানে আসা-যাওয়া
যে বন্ধ হয়েছিল সেটা আবার শুরু হল। তারপর তো ১৯২৯ সালের গ্রীষ্মের পর হামেশার জন্য
বন্ধ হয়ে গেল। তার গল্প পরে আছে। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯২৯ অব্দি তিন বছর তাঁর কথায় বিশ্বাস
করে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখতে থাকলাম।
অস্তু, সভাপতি চৌধুরি সাহেব পাটনা এলেন। জমকালো অভ্যর্থনা হল। লম্বা-চওড়া,
সাজান-গোছান সভার জায়গা। লোকে যেমন অবাক ছিল তেমনই খুশিও ছিল। কিন্তু আমার মাথায় তো
পুরোহিতগিরির ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা ছিল। কবীন্দ্রবাবুর বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার ছিল সুদে-আসলে।
তাই, সে কাজেই লেগেছিলাম। অন্যদিকে পাটনায় কবীন্দ্রবাবুর আত্মীয়দের বাস, বিহারের অন্যান্য
জমিদারদের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক – কাজেই উনিও পুরো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমনকি এও খব্র
পেলাম যে টেকারির মহারাজা কুমার গোপাল শরণ সিংকে মিথ্যে খবর দেওয়া হয়েছে যে আপনার বিরুদ্ধে
তো অনেক নালিশ তাই সভায় আপনার বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনা হবে। রেলগাড়িতে করে কয়েক হাজার
লোক পাঠান যারা সে সময় আপনার পক্ষে ভোট দেবে। ওদিকে পাটনার ধরহরা গ্রামে তাঁর ছেলের
বিয়ে। তাই ওখানকার অত্যাচারী জমিদারেরা নিজেদের কৃষকদের দল কে দল সভায় আনার জন্য তৈরি
করেছে। সবার একটাই উদ্দেশ্য ছিল – পুরোহিতগিরির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া। এটুকুই
নয়। স্বয়ং কবীন্দ্রবাবু ঘোষণা করলেন যে খলিলাবাদে দেওয়া কথা রেখে রাজা চন্দ্রেশ্বর
প্রসাদ নারায়ণ সিংএর স্বাক্ষরে ষাট হাজার টাকার কাগজ লিখিয়ে আনছি; মহাসভাকে দিয়ে দেব।
শর্ত একটাই, পুরোহিতগিরির প্রস্তাবটা যেন পড়ে যায়।
শুনেছিলাম তরোয়ালের জোরে আগে ধর্মের প্রচার হত। লোভ দেখিয়ে মানুষকে
পথভ্রষ্ট করা হত। তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সামনে পেলাম। তবুও কিস্যু করতে পারল না তারা।
এমন হল যে সভার দু’একদিন আগে থেকেই উত্তর বিহার থেকে হাজারো হাজার মানুষ ট্রেনে, পায়ে
হেঁটে, নৌকোয় করে আসতে শুরু করে দিল। মানুষের ঢেউ বয়ে চলল যেন। যে কেউ জিজ্ঞেস করত
ওদের কোথায় এসেছেন, কী করতে এসেছেন, সোজা জবাব দিত ওরা – ভুমিহার ব্রাহ্মণ সভায় এসেছি,
পুরোহিতগিরির প্রস্তাবটা পাস করাতে! শুনতে শুনতে কবীন্দ্রবাবুর দলে দুশ্চিন্তা আর আতঙ্ক
ছড়িয়ে পড়ল। ভাবল, দশ বিশ হাজার বা যতই আসছে সবার একটাই মন্ত্র – পুরোহিত-গিরি। এরপর
তো খোলা সভায় হেরে ভুত হতে হবে! তাই ওরা মিটমাট করার কথা ভাবল। যাহোক, রামদয়ালু সিং
যিনি আমার প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন এবং যাঁকে ওরাও বিশ্বাস করত, মিটমাটের কথায় রাজি
হয়ে গেলেন এবং এমন একটা প্রস্তাব তৈরি করলেন যাতে আমার সবক’টা কথা ছিল। বরং যা আমি
চাইছিলাম তার থেকে বেশি ছিল। এই প্রস্তাবে অন্য দলেরও সমর্থন ছিল। শেষে এটাই পেশ হল
আর তর্কবিতর্ক ছাড়াই সভাপতির তরফ থেকে পাস করিয়ে দেওয়া হল। ওদের ভয় ছিল যে তর্ক-বিতর্ক
হলে ব্যাপারটা আরো গোলমেলে হয়ে যাবে। তাই আস্তে করে পাস করিয়ে নেওয়াটাই শুভ মনে হল,
যাতে কেউ শোনে, কেউ না শোনে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। এভাবেই পুরোনো ঝঞ্ঝাট শেষ হল আর
পুরোহিতগিরির ওপর মহাসভার সিলমোহর পড়ে গেল। চৌধুরি সাহেব নিজের ভাষণেও খুব সুন্দর ভাবে
প্রস্তাবটার সমর্থন করেছিলেন।
তারপর তো পুরোহিতগিরির কাজ এমন বাড়ল আর লোকজনের মাঝে নিজেদের দলের পুরোহিতের চাহিদা এত বেশি হয়ে গেল যে যদি আমার নিজের ‘কাজকর্ম’ না থাকত খুব মুশকিল হত। মানুষের মনে হতাশা জাগত, খারাপ হত পরিণতি। অবশ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সমাজে কিছু এমন লোকও তৈরি হল যারা পুরোহিতগিরির নামে মানুষের উৎসাহের অন্যায় ফায়দা লুটল, লুটতে চাইল। কিন্তু সেটা অবধারিত ছিল। কিছু বুঝদার মানুষ এ কথাও বলল যে মূর্খ আর স্বার্থপর লোকেদের পসার বাড়িয়ে আপনি ভুল করেছেন। আগে থেকেই এধরণের একটা দল ছিল। এবার তার জায়গায় নতুন একটা দলকে আপনি জায়গা করে দিলেন। আমরা তো আগের দলটাকেই ওপড়াতে চাইছিলাম। যাহোক সে দল তো নিজে থেকেই পিছু হটতে শুরু করেছে। কিন্তু এই নতুন দলটি তো হটবে না। কেননা এদের নতুন দাবি। এদের প্রয়োজনের জিনিষটাই আপনি যুগিয়ে দিয়েছেন। আমি তাদের জবাব দিলাম, যদি এরা অযোগ্য হয় তাহলে এদেরও উপড়ে ফেলবে ওরা যারা বংশ পরম্পরায় গদিতে এঁটে বসা পুরোনো লোকগুলোকে উপড়ে ফেলেছে। এখানে তো “বুড়ির মরার ব্যাপার নয়, যমের দুয়ার খুলে গেছে যে!” তাই ভরসা রাখুন, যারা শালগ্রাম শিলা ভেজে তুলেছে, বেগুন ভাজতে তাদের দেরি হবে না। পুরোনো লোকেরা যদি শালগ্রাম শিলা হয় সে তুলনায় এ নতুন লোকগুলো (পুরোহিত) তো বেগুন। বহু জায়গায় এমনটাই হল। নতুন পুরোহিতমশাইকে সরিয়ে লোকেরা নিজেরাই নিজেদের পুরোহিতের কাজ সেরে নিল। এভাবে আমার কথাটা সত্যি হল।
শ্রী সীতারামাশ্রম – বিপ্লবের প্রতীক
প্রসঙ্গত এখানেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখতে চাই। যদিও কালানুক্রমে
১৯২৭ সালের ঘটনাগুলো বলার সময়তেই এ কথাটা বলা উচিৎ ছিল। তবুও, উপযুক্ত সুযোগ এখনই।
তখন আর ভালো লাগবে না। আগেই বলেছি যে আত্মসম্মানের ভাবনা এবং আহ্বান আমায় কিছু সময়ের
জন্য ভুমিহার ব্রাহ্মণদের সামাজিক কাজের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কোনো প্রতিহিংসা,
স্বার্থপরতা বা তুচ্ছ রাজনীতির ভাবনা ছিল না। শুধু পড়ে যাওয়া বা বলতে পারেন ধাক্কা
দিয়ে ফেলে দেওয়া সমাজটাকে ওঠাতে চেয়েছিলাম, তার ভিতরে সেই আত্মগৌরবের অনুভূতি জাগাতে
চেয়েছিলাম যা বহুলাংশে শেষ হয়ে গিয়েছিল বা হয়ে চলেছিল। আমি বই পড়ে রাজনীতি শিখিনি।
এমনকি উগ্র রাজনীতিও না। তার সুযোগই পাইনি, এবং তার প্রবৃত্তিও হয় নি। ধীরে ধীরে এগিয়েছি।
আমার অভিজ্ঞতাই আমার গুরু, শিক্ষক এবং বইয়ের কাজ করেছে। অবশ্য, এগিয়ে যাওয়ার প্রবৃত্তি
আমার সবসময় ছিল। এখনো রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ অন্ধকারাবৃত রাজনৈতিক জগতে লাফিয়ে পড়তাম কী
করে? হ্যাঁ, যদি ছোটবেলা থেকে এধরণের শিক্ষা পেয়ে থাকতাম বা এধরণের সংসর্গ হয়ে থাকত,
তাহলে বোধহয় সোজাসুজি রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ত পারতাম। কিন্তু তা তো হয় নি। ২৫-৩০ বছর
বয়স অব্দি তো নিরেট ধার্মিক এবং দার্শনিক ছিল আমার জগত। তাও আবার গোঁড়া সনাতন ধর্মের
আওতায়। ফলে এমনি মানুষজনের সাথে সংসর্গ রইল যারা রাজনীতি জানতই না। বরং উল্টো – তারা
এধরণের কাজের কঠিন শত্রু হয়ে থাকে। এমত পরিস্থিতিতে, স্বভাবের জোর যতই খাটাই না কেন,
উপযুক্ত সাধন না থাকায় অভিজ্ঞতা প্রাপ্তির শক্তিতেই নিয়মিত এগিয়েছি এবং এখনও এই অগ্রগতি
কায়েম রয়েছে। তাই বিহারের এক সাংবাদিক, যে আমার কট্টর সমালোচক এবং সবসময় আমায় কটু কথাই
শোনাতে থাকে, তাকেও একবার স্বীকার করতে হল “স্বামী আর কিছু হোক বা না হোক, নিরন্তর
এগিয়ে চলা মানুষ অবশ্যই, Swami is nothing if he is not progressive”।
যারা জানে না আমার এই খুঁত যে রাজনৈতিক বই-টই পড়ার সুযোগ আমি পাই
নি – সাধনের অভাব বলতে পারেন, কিন্তু আমি সেটা কখনোই মানি না – তারা আমায় ঠিক মত বুঝতে
ভুল করে। আর সে ভূলের ফলে ভ্রান্ত সমালোচনাও করে। কিন্তু অভিজ্ঞতার সাহায্যে এগোবার
সুন্দর পরিণাম যে আমার ভিত মজবুত হয়েছে, এবং – যেটার খুব বড় বিপদ থাকে রাজনীতিতে –
পিছনে যাওয়ার সম্ভাবনা আর নেই।
হ্যাঁ, যখন পুরুতদের দল এদিকে এসে প্রত্যক্ষ ভাবে অসহযোগ শুরু করে
ভুমিহার ব্রাহ্মণদের এবং ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাকেও নুইয়ে ফেলতে চাইল তখন আমি স্থির
করলাম যে এমনটা হতে দেব না। পুরুতদের তীব্র আন্দোলনের কথা আগে বলা হয়েছে। আমি ভাবলাম
পুরুতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই উচিৎ হবে। ব্যাস, তাই বিপ্লবের নিশান ওঠালাম।
এসবের মাঝে এ খবরও এল যে কাশী এবং অন্য স্থানেও ভুমিহার ব্রাহ্মণদের
সংস্কৃত পড়ান বন্ধ হয়ে আছে। জেনেশুনে তো আর কেউ পড়ায় না। হতে পারে যে জানে না সে হয়ত
পড়িয়ে দেয়। একথাও শুনতে পেলাম যে এদের সংস্কৃত পড়ান মানে সাপকে দুধ খাওয়ান। অর্থ স্পষ্ট
ছিল – পুরুতদের সমাজ বড় রকমের ষড়যন্ত্র করেছিল যাতে ভুমিহার ব্রাহ্মণেরা কোথাও সংস্কৃত
পড়তে না পারে। ভাবটা ছিল, এরপর দেখব এরা নিজেদের পুরোহিতগিরি, নিজেদের বিয়ে, শ্রাদ্ধকর্ম
ইত্যাদি কিভাবে করায়। এমন অবস্থা ছিল যে আলাদাভাবে সংস্কৃত পাঠশালা খুলে তার জন্য পন্ডিত
খুঁজলে হয় পাওয়া যেত না অথবা বেশি বেতন দিয়ে পাওয়া গেলেও পাঠশালাতেই গোলমাল শুরু করে
দিত। ওখানেও, ভুমিহার ব্রাহ্মণের বাচ্চাদের হয় ঠিকঠাক পড়ান হত না অথবা এদিক ওদিককার
কথা বলে বাচ্চাদের মনে সংস্কৃত পাঠে বিরক্তি ধরিয়ে দেওয়া হত।
এধরণের পরিস্থিতিতে আমার সামনে বিরাট সমস্যা ছিল। পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে
ছিল – হয় সমাধান খুঁজে বার কর নয় বিরোধিদের কাছে হার স্বীকার করে নাও। সমাধান শুধু
একভাবেই, তাও আংশিক, নিজে একটা কর্মকান্ড লিখে হতে পেরেছিল। পুরোটা সমাধান হওয়া এখনো
বাকিই ছিল। এ অবস্থায় বিদ্রোহের নিশানটা কিভাবে উঁচুতে তুলে ধরা যায় ভাবতে হল। সেই
ভাবনাচিন্তার পরিণতি হিসেবে, আমার এই বিপ্লবের প্রতীক-রূপে পাটনার বিহটায় শ্রীসীতারামাশ্রম
স্থাপন করা হল। এ কারণেই, জেলে বসে বসেও সেই আশ্রমের চিন্তা ঘুরছে মাথায়। কেননা, প্রতীক
বলেই আশ্রমের সাথে আমার গভীর প্রীতি। যদিও এখন আর বিশেষ কিছু করি না।। করার সুযোগও
পাই না আর তেমন দরকারও পড়ে না, আগে যেমন পড়ত। তা সত্ত্বেও, বিপ্লবের প্রতীকটি চিরকাল
কায়েম থাকুক, নিশান উড়তে থাকুক সেটা তো চাইই।
আশ্রমের গল্পটা এই। ১৯২৬-২৭ সালে যখন এই চিন্তাতেই মজে ছিলাম যে
কিভাবে সফলভাবে বিদ্রোহের নিশানটা তুলে ধরি তখনই পাটনার এক উকিল পন্ডিত রামবাহাদুর
শর্মা, যিনি সে সময় আমার ব্যথাটা বেশ ভালো করে বুঝতেন, ১৯২৭ সালের গ্রীষ্মে একদিন হঠাৎ
আমার সাথে দেখা করে বললেন, বিহটায় (রাঘবপুর) একজন পরমহংসজি থাকেন। তাঁর নাম শ্রীসীতারাম
দাস। তাঁর একটা বাগান আছে; জমিটায় বাড়িঘরও আছে। লোকটি ভুমিহার ব্রাহ্মণ। বুড়ো মানুষ,
এবং মৃত্যুর আগে ওই বাগান, বাড়িটাড়ি সব এমন কাউকে দিয়ে যেতে চান যে ওখানে ব্রহ্মচর্যাশ্রম
প্রতিষ্ঠা করে ভুমিহার ব্রাহ্মণের ছেলেদের বেদ, শাস্ত্র ইত্যাদি পড়াবে। শর্মাজি বললেন
যে পরমহংসজির কাছে প্রায় দু’হাজার টাকাও আছে। সে টাকাও উনি দিয়ে যেতে তৈরি। তাহলে আর
কী? হঠাৎ আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, যা চাইছিলাম তাই পেলাম। আমি তো চাইছিলামই যে একটা
ব্রহ্মচর্যাশ্রম খুলে শ’য়ে শ’য়ে ছেলেদের সংস্কৃতে প্রবীণ, বিদ্বান এবং বেদ-বেদাঙ্গে
পারদর্শী করে তুলি। যত পন্ডিত পাওয়া যায় তাদেরকে কাজে লাগাই। নইলে নিজেও পড়াই। তাহলেই
তো পুরুতদের হামলা এবং অসহযোগিতার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে পারব। ব্যাস, আমি raরজjি
হয়ে গেলাম। শিগগিরই পরমহংসজির সাথে দেখা করার কথা হল। তারিখও স্থির হয়ে গেল কবে। পন্ডিত
রামবাহাদুর শর্মা এবং একজন ফটোগ্রাফারকে সঙ্গে নিয়ে একদিন বিহটা গিয়ে দেখাও করলাম।
কথাবার্তাও হয়ে গেল। আমার আর পরমহংসজির একসঙ্গে সে সময়কার একটা ফটোও রয়েছে। হ্যাঁ,
এটা ঠিক মনে নেই যে ফটোটা প্রথম দেখার সময়েই নেওয়া হয়েছিল না পরে, কিন্তু নেওয়া অবশ্যই
হয়েছিল।
পরমহংসজির সাথে বেশ কয়েকবার কথা হল। শেষে স্থির হল যে সমস্ত ভূসম্পত্তি
একটি অছিব্যবস্থার অধীনে করা হোক এবং একটি অছি-দলিল তৈরি করা হোক। তাই হল। স্যার গণেশদত্ত
সিং প্রভৃতি ন’জন লোকের অছি কায়েম করে তার নামেই লেখা-পড়া এবং রেজিস্ট্রি হয়ে গেল।
অছিতে আমার এবং পন্ডিত রামবাহাদুর শর্মারও মান আছে। তাতে পরিষ্কার লেখা আছে যে ব্রহ্মচর্যাশ্রম
খোলা হবে যাতে শুধু ভুমিহার ব্রাহ্মণের ছেলেদেরই খরচ দেওয়া হবে এবং তাদেরই পড়ান হবে।
একটা মন্দির তৈরি করার কথাও ওই অছি-দলিলে লেখা হল। কিন্তু আমি ওদেরও এবং অন্যান্য মানুষদেরও
স্পষ্ট বলে দিলাম যে যদি অন্যেরা চায় ঠাকুরবাড়ি বানিয়ে দিক, আমার দ্বারা হবে না। আমি
শুধু ব্রহ্মচর্যাশ্রমটা চালাতে এবং বড় করতে চেষ্টা করব। তাই হল। মন্দির কেউ তৈরি করায়
নি। আশ্রম চালু হল, এখনও চলছে। সেই পরমহংসজিরই স্মৃতিতে আমি আশ্রমের নাম শ্রী সীতারামাশ্রম
স্থির করালাম, কেননা তাঁর নাম ছিল সীতারাম দাস। পরমহংসজির কাছে টাকা-পয়সা তো ছিলই,
এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিল, কিছু হ্যান্ডনোট ইত্যাদিও ছিল। কিন্তু উনি এক কড়িও দিলেন না;
মরার পর সে সব টাকা তেমনই এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়ে গেল। এত সরল ছিলেন! এটুকুও বুঝতে পারলেন
না যে লেখা-পড়া করে দিলে মরার পরও উশুল হয়ে যাবে। ভাবতেন মানুষে দিয়েই দেবে! কে দেয়!
সে সময় তো অতটা নয়, মাঝে খুব বেশি এবং আজও কিছুটা, লোকেরা আমায় কটাক্ষ
করে যে আমি তো অন্তর থেকে জাতপাত-পন্থী এবং ভুমিহার ব্রাহ্মণদের পক্ষে থাকি। পুরোনো
আন্দোলনের কথা তো আসেই, আশ্রমটারও উল্লেখ জয় প্রমাণ হিসেবে যে এতে শুধু ভুমিহার ব্রাহ্মণদেরই
ছেলেরা কেন পড়ে এবং শুধু ওদেরই কেন খর্চা দেওয়া হয়। যখন নাকি আমিই এই আশ্রমের অধ্যক্ষ
এবং সর্বময় কর্তৃত্ব আমারই।
কিন্তু এমন মানুষেরা অনেক কথা ভুলে যায়। অথবা ইচ্ছে করে ভুলে নেয়।
কয়েকজন তো জেনেশুনেই কটাক্ষ করে। আন্দোলন কেন হয়েছিল তা তো আমি বলেইছি। রইল আশ্রমের
কথা। কথাটা এই যে আশ্রমে পড়তে কারোর জন্য কোন মানা নেই। সরযুপারি এবং কান্যকুব্জের
ছেলেরাও পড়ে। হাইস্কুলের এবং অন্যান্য কত বানিয়া বা বিভিন্ন ধরণের ছেলেরা যখন চায় এখানকার
পন্ডিতদের কাছে এসে পড়ে যায়। পন্ডিতেরা সানন্দে পড়িয়ে দেয়। কাজেই পড়ার ব্যাপারে কোনো
ভেদাভেদ নেই।
রইল খাইখরচের কথা। সে ব্যাপারে তো যে পরিস্থিতিতে আশ্রম খুলেছিল
এবং অছি-দলিলে যে শর্তাবলি লেখা আছে সেগুলোর দিকে নজর রাখতেই হবে। সে সময় যে পরিস্থিতি
ছিল, অন্য কিছু লেখা সম্ভব ছিল না, এবং অছি-দলিলের বিরুদ্ধে আমি এখন আর কিছু করতে পারব
না।
আমার সর্বময় কর্তা হওয়ার কথাটা ভিত্তিহীন। এটা ঠিক যে ব্যবস্থাপনা
এবং ধনসংগ্রহ বেশির ভাগ সময় আমিই করে এসেছি। তবুও। সর্বময় কর্তা তো অছি-সদস্যেরা (trustees)।
আমি তো ওদেরই নিযুক্ত ব্যবস্থাপক মাত্র। যখন চাইবেন তখনই ওঁরা আমায় আশ্রম থেকে সরিয়ে
দিতে পারেন, অছি থেকেও সরিয়ে দিতে পারেন। অছির (ট্রাস্টের) আইনটা তো সেরকমই। লোকে তো
জানেও না যে যদিও রাজনীতির সাথে আশ্রমের কোনো সম্পর্ক নেই, আমার ব্যক্তিগত রাজনীতি
এবং কৃষক আন্দোলনের সাথে সম্পর্কের কারণে ভয় পেতে থাকি যে ট্রাস্টিরা আমায় আশ্রম থেকে
সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে। কেননা আজও ওই ট্রাস্টিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এমনি সব
মানুষের যারা কোনো না কোনো কারণে আমার বিরুদ্ধে। অনেকেই তো বড় জমিদার অথবা তাদের পেটোয়া।
তাই জেনেশুনেই আশ্রমকে আমি প্রত্যক্ষতঃ রাজনীতির সাথে জড়াতে দিই না। এটা ঠিক যে আমায়
সরান খুব সহজও নয়। তা সত্ত্বেও সুযোগ পেলে ওরা সেটা করতে পারে। এবং তা হলে আমার অসুবিধে
বাড়তে পারে।
এসবের পরেও যখন লোকেরা বার বার আমায় এই প্রশ্নগুলো করা বন্ধ করল
না তখন আমি বললাম এবং ঘোষণাও করলাম যে যদিও ট্রাস্টের নিয়ম অনুসারে ওই আশ্রমে অন্যান্য
ছেলেদের খাইখরচ দেওয়া হবে না, যদি অভিযোগকারী মানুষেরা চেষ্টা করে কিছু ধনসংগ্রহ করে
তাতে আমিও সাহায্য করব। তখন তো ওই আশ্রমেরই অবশিষ্ট অংশে লাগোয়া আরেকটি আশ্রম খুলে
সব জাতের ছেলেদের খাইখরচ দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দেব। পড়া তো এ আশ্রমে এখনও হয়, পরেও
হবে। কিন্তু এসব করবেটা কে? যদিও আমার ঘোষণা এখনও যেমন ছিল তেমনই আছে এবং আমি প্রস্তুত।
কিন্তু আমি একাই এ সমস্ত করব সেটা তো অসম্ভব। প্রথম তো ফুরসৎই নেই।
যখন এই আশ্রমের জন্যই ধনসংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে, আগে যা ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাই
দিয়েই যেমন তেমন চলছে, নতুনটার জন্য কেনই বা করব আর কিভাবে করব? প্রথমটা করার কারণ
ছিল। দ্বিতীয়টার তাও নেই যে সেটা মাথায় রেখেই নেমে পড়ব। যদি অন্য কোনো জাত বা গোষ্ঠির
সামনেও আজ সে ধরণেরই আত্মসম্মানের প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায় এবং তার লড়াইয়ে বেদবেদাঙ্গের
পাঠ জরুরি হয়ে ওঠে, নিঃসন্দেহে আমি আজও নিজে থেকেই সে কাজ হাতে নেব। কিন্তু তেমন কিছু
তো নেই। তাহলে কেন ব্যস্ত হব নতুন আশ্রম নির্মাণে? এটাও ভাবা উচিৎ যে অন্যান্যদের জন্য
তো হাজারটা জায়গা আছে যেখানে খাবার, জামাকাপড়, থাকার জায়গাও পাওয়া যায় এবং পড়াবার লোকও
আছে। কিন্তু ভুমিহার ব্রাহ্মণদের জন্য দরজা বন্ধ ছিল বলেই তো আশ্রম শুরু করেছিলাম।
একটু আধটু ভেদাভেদ ওদের সাথে আজও হতে থাকে।
যদি মৈথিল, সরযুপারি প্রভৃতি পন্ডিতেরা আশ্রমে থাকে তাহলে আবার সেধরণের
কলহ আর গোলমাল হবে যেমন অন্যান্য জায়গায় হয়েছে। তাই ভাবা হল যে আশ্রমে শুধু ভুমিহার
পন্ডিতদেরই রাখা হোক। সেটাই করা হল। পাওয়াও গেল বৈয়াকরণ, জ্যোতিষী, বৈদিক পন্ডিত। তা
সত্ত্বেও মাঝে মাঝে আমাকেই, বিশেষ করে ন্যায় অথবা অন্যান্য দর্শন পড়াতেও হত। কিন্তু
তার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ব্যাপার কখনো আসেনি। কাজেই জাতগত পক্ষপাতিত্বের দৃষ্টি থেকে
দেখার সুযোগও আসেনি। যদি অপ্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনীতি এসেও থাকে সেটা ছিল কৃষক ও শ্রমিক
সভার। কেউ যদি চায় তাহলে গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে জেনে নিতে পারে।
বরং ওই কৃষক ও শ্রমিক সভার রাজনীতির সাথে সম্পর্ক রাখি বলে আশ্রমের
সাহায্যকারী ভুমিহার ব্রাহ্মণেরা সবাই মিলে বছরে যে হাজার হাজার টাকা দিত সেটাও তারা
বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু বন্ধ করেই থামে নি, আশ্রমের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে
বেশ কয়েকজন তো ওই আশ্রমের পাশেই থাকে। এসব কিছু হল তার কারণ ওদের অত্যাচারে পীড়িত গোয়ালা
এবং অন্যান্য চাষিরা আমার কাছে এসেছিল আর আমি ওদের পক্ষ নিয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ
তুলেছিলাম। আজ যে কেউ যাচাই করে নিক, যে কোনো জাত বা ধর্মের উৎপীড়িত মানুষেরা আমার
ওপর এবং এই আশ্রমের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখে, না রাখে না। কাজেই জাতীয়তার প্রশ্ন
আশ্রমে উঠবে কেন?
প্রথমতঃ এই আশ্রম বিপ্লবের প্রতীক, তাই আমার প্রিয়। দ্বিতীয়তঃ, কৃষক
আন্দোলনের সাথে আমার সম্পর্ক দেখে যখন জমিদারেরা রেগে গেল, নিজেরা চাঁদা দেওয়া বন্ধ
করল আর যদ্দূর পারল অন্যদেরও দেওয়া বন্ধ করাল যাতে অর্থাভাবে আশ্রমটাই ভেঙে পড়ে, আমি
স্থির করলাম যে জমিদারদের কাছ থেকে পয়সা নেওয়ার জন্য কাউকে পাঠাবও না এবং আশ্রমটাকে
ভেঙে পড়তেও দেব না। জমিদারদের অহঙ্কার এভাবেই, ওদের একটুও পরোয়া না করে চূর্ণ করব স্থির
করলাম। হ্যাঁ, জমিদার যদি নিজেই এসে চাঁদা দিয়ে যায় তাহলে সে চাঁদা ফিরিয়ে দেওয়া হয়
না। কিন্তু পাঠাই না আর কাউকেও, জমিদারদের কাছে চাঁদা চাইতে। তা সত্ত্বেও, গেরস্ত আর
কৃষকদের সাহায্যে আশ্রম চলছেই, চলবেও। এখনও মাসিক খরচ কয়েকশো টাকা। ফলে, আশ্রমের প্রতি
আমার ভালোবাসা আর মমতা বরং বেড়েইছে।
আশ্রম নিয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধাচরণ আমায় আরো স্পষ্ট ভাবে বলে দিল
যে জাতের সভা এবং জাত আর ধর্মের নামে দেওয়া দানের প্রকৃত অর্থ কী। এই সভাগুলোকে ধনিক
এবং ধূর্ত লোকেরা নিজেদের হাতের খেলনা বানিয়ে রাখে এবং মাঝে মাঝে কিছু টাকা দিয়ে নিজেদের
জমিদারি, ব্যবসা এবং প্রভুত্ব দৃঢ় করে নেয়। ওরা পরলোকের জন্যও কিছু করে না এবং কারো
উপকার করতেও কিছু করে না। ‘কৃষকদের ফাঁসানর প্রস্তুতি’ নামের চটিবইটায় আমি এই অভিজ্ঞতার
বিস্তৃত বর্ণনা করেছি।
আগে চাঁদায় যা টাকা আসত তা থেকে কিছু একটু প্রতি বছর বাঁচত। চাঁদা
তুলতে আমি পরিশ্রমও যথেষ্ট করতাম। যে চার-পাঁচটা বই লিখেছি তার বিক্রির চার-পাঁচ হাজার
টাকাও আশ্রমেরই ফান্ডে জমা আছে। এভাবে আশ্রমের নামে সব মিলিয়ে প্রায় ষোল হাজার টাকা
বিভিন লোকের কাছে জমা আছে এবং কিছু টাকা রাইয়তি জমি নিতে লগ্নি করা হয়েছে। এভাবে, একশ
টাকায় ছয় টাকা ফি বছর সুদ এবং জমির ফসল, সব মিলিয়ে প্রায় একশো টাকা প্রতি মাসে আসে।
এছাড়া চাঁদায় কিছু আরো টাকা এবং কিছু আনাজপাতি পেয়েই যাই। সব বই আমি আশ্রমকে দিয়ে দিয়েছি।
সেগুলোর বিক্রি থেকেও কিছু টাকা আসে। ‘লোক-সংগ্রহ’ পত্রিকা বার করার সময় যে প্রেস নিয়েছিলাম,
পরে সে প্রেসটা চব্বিশ শো টাকায় পন্ডিত যমুনাকার্যীজির জিম্মায় দিয়ে দিই এবং টাকাটা
কিস্তিতে দেয় করে দিই। ফলে সেদিক থেকেও কিছু টাকা চলে আসে। এভাবেই কাজ চলে যায়। আলাদা
করে কোনো পরিশ্রম করতেও হয় না এবং করার ফুরসতও আমার নেই। প্রয়োজনও নেই।
এটুকু বলতে পারি, আশ্রমের জন্য সব কিছু করেও আশ্রমের একটি পয়সা বা এক ছটাক অন্ন আমি জ্ঞানতঃ নিজের জন্য খরচ করি নি। ভবিষ্যতেও করব না ভেবেছি। বইএর টাকা থেকেও এক পয়সা আগেও কখনো নিজের জন্য খরচ করিনি। এখন তো সব বই আশ্রমের সম্পত্তি করে দেওয়া হয়েছে।
(১৯)
একটি দুঃখজনক ঘটনা
১৯২৬ সালেরই শেষে কাউন্সিলের নির্বাচন হওয়ার ছিল। স্বরাজ পার্টির
নামে কংগ্রেসের লোকেরা নির্বাচনে লড়বে। কংগ্রেসের নামে তো সম্ভব নয়। এমনই চুক্তি হয়েছিল
দিল্লিতে। কিন্তু, অন্ততঃ বিহারে সে নির্বাচনে যাকিছু অনর্থ হল তা ভোলার মত নয়। ভিতরে
ভিতরে দলাদলি ছিল। কংগ্রেসের প্রধান প্রধান লোকেরা ভিতরে ভিতরে জাতপাত করত। খোলাখুলি
তো করতে পারত না। শুধু সেই নির্বাচনই নয়, তারপর থেকে আজ অব্দি যত নির্বাচন হয়েছে সবক’টির
অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি – ‘ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন’ – অধিকাংশ বিহারি জাতীয়তাবাদি নেতা
ভিতরে ভিতরে জাত-বাদিও বটে। একেবারে ভূলও নয় পন্থাটা। জাতীয়তা আর জাতপাতে সামান্যই
তফাৎ। জাত ছোট আর জাতি বড়। ব্যস, এটুকুই তফাৎ। এটাও সত্যি যে ‘চোরে চোরে মাস্তুতো ভাই’
অনুসারে প্রায় সবাইকার, নিজের নিজের জাতের পক্ষপাতিত্বের পথ ধরলে সাট্টা লেগে যায়।
তাই খোলাখুলিভাবে কেউ কাউকে কিছু বলে না। সেবারও এমন ধরণেরই কিছু দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
আমি তো আগে জানতামও না। পরে দেখলাম কিছু কায়স্থ স্যার গণেশদত্তর
ওপর রীতিমত ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এ ব্যাপারটা আজও আছে। কিছু মানুষ এমন আছে যারা ভুমিহার
ব্রাহ্মণের উন্নতি দু’চোখে দেখতে পারে না। তাই সব সময় চেষ্টা করে টেনে নামিয়ে দেওয়ার।
এটাও সত্যি যে কিছু ভুমিহারও একইভাবে, কায়স্থ বা অন্যদের টেনে নামাতে দেরি করে না।
প্রথমে কারা শুরু করেছিল তা নিয়ে ভাবনা অর্থহীন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা এটাই। বিশেষ
করে ১৯২৬ সালে তো এমনি ছিল।
দুর্ভাগ্যবশতঃ বিহারের রাজনীতির ভিতরে দুটো পার্টি আছে। যদিও সেটা
দেখা যায় না কিন্তু খুব ভালোভাবেই চলে। এক পার্টি হল কায়স্থ, রাজপুত, মৈথিল, গোয়ালা,
কুর্মি প্রভৃতিদের নিয়ে, যেটা ভুমিহারদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় হল ভুমিহার এবং রাজপুতদের
যেটা কায়স্থদের বিরুদ্ধে। কিছুসংখ্যক ভুমিহার মুসলমানদেরও নিজেদের দলে শামিল করে কায়স্থ
প্রভৃতিদের জবাব দিতে চায়। ভিতর ভিতর ভালোমতই চলে এদের প্যাঁচপয়জার। রাজপুতদের দুটো
দল, একটা কায়স্থদের সাথে, অন্যটা ভুমিহারদের সাথে। দেশের জন্য, প্রদেশের জন্য এবং আমাদের
জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এটাই সত্য যে ব্যাপারটা আছে। কোন সৎ মানুষ যে
ভিতরের কথা জানে, অস্বীকার করতে পারে না। অবশ্য বাইরের কোনো প্রমাণ এ বিষয়ে দেওয়া সহজ
নয়।
এই দলাদলির রাজনীতির অঙ্কে, ১৯২৬ সালে কাউন্সিলের জন্য কংগ্রেসের
প্রার্থী নির্বাচনের সময় কংগ্রেসের নেতারা ভুমিহার ব্রাহ্মণদের সাথে অন্যায় করেছিল।
পন্ডিত ধনরাজ শর্মার মত পাকা কংগ্রেসিদের প্রার্থী না করে এমন লোকেদের প্রার্থী করল
যাদের সাথে কংগ্রেসের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং যারা আগে কংগ্রেসের শত্রু ছিল। এমনই
আরো কিছু ঘটনা ঘটল। পুরো আঁটঘাট বাঁধা হল যাতে স্যার গণেশদত্ত কোথাও থেকেও প্রার্থী
নির্বাচিত না হতে পারেন। শ্রী নন্দনবাবু (ছাপরার) জেলা কংগ্রেস কমিটির উপ্সভাপতি ছিলেন।
কিন্তু ওনাকে না নিয়ে এমন এক ভদ্রলোককে নেওয়া হল যাঁর একমাত্র যোগ্যতা ছিল যে তিনি
কয়েকজন বড় মানুষের আত্মীয় ছিলেন। পরে ওনার বিষয়ে আরো কিছু নালিশ পাওয়া গেল। অন্ততঃ
আমায় বলা হল। আমার সামনে এমনই একটা ছবি খাড়া করা হল কেননা ভিতরের কথাগুলো সেসময় আমি
জানতাম না।
দুর্ভাগ্য বলুন বা সৌভাগ্য, – যদিও আমি এখন দুর্ভাগ্যই মনে করি –
সে সময় স্যার গণেশের সাথে আমার মনোমালিন্য (যার গল্প আগে বলেছি) কিছু দিনের জন্য মিটে
গিয়েছিল। কখনো কখনো ওয়ার বাড়িতে আমার যাওয়া আসাও চলত। একদিন সকালে পৌঁছেই দেখলাম কয়েকজন
কংগ্রেসি, কয়েকজন জমিদার এবং অন্যান্য ভুমিহার ব্রাহ্মণ স্যার গণেশের সাথে বসে এসব
কথাই বলছিল। আমি এক কর্মভ্রষ্ট জানি না কেন ওখানে পৌঁছে গেলাম। ওখানে জমায়েত লোকেরা
এমনিই দাঁড় করিয়ে আমায় নির্বাচনের গল্প শোনাল। আমি তো কিছুই জানতাম না। ছিলাম অপরিবর্তনবাদি।
এবং এধরণের নোংরা কথাবার্তা থেকে সব সময় আলাদা থেকেছি। আমি তো মানতাম যে রাজনীতি শুধু
কংগ্রেসের জিনিষ। কাজেই এসব কথা জানার কোনো প্রশ্নই ছিল না। আমি বিশ্বাসও করতাম না
যে কংগ্রেসের বড় বড় লিডাররা কখনো জাতপাতের পক্ষপাতিত্ব বা বিদ্বেষের কথা আনতে পারে
কংগ্রেসে। মনে এসব ব্যাপার থেকে ওদের অনেক উঁচুতে স্থান দিতাম ওদের।
সত্যি বলতে, কংগ্রেসে যে জাতপাতের কথাও উঠতে পারে এটা আমি ভাবিই
নি। সেই কংগ্রেসে যেখানে দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা বড় বড় মানুষেরা রয়েছেন। তাই
ওরা আমায় বার বার বোঝাবার এবং বিশ্বাস করাবার চেষ্টা চালিয়ে গেল। কয়েকজন কংগ্রেসিও
ছিল ওখানে। ওদের কথা শুনে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। সাথে সাথে অবাকও হলাম। তারপর তো
এমন সব কথা বলা হল যে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। তখন আমি স্পষ্ট বলে দিলাম ঠিক আছে,
আমি আপনাদের সঙ্গ দেব এবং ওদের নোংরামির হাঁড়ি ভাঙব হাটে। খুব খুশি হল ওরা। যেমন আমার
স্বভাব, কংগ্রেসি লীডারদের এই কপট আচরণে এবং পক্ষপাতিত্বে ভীষণ রাগ হল। সেই রাগেরই
প্রভাবে ওদেরকে কথা দিয়ে দিলাম। খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কংগ্রেসিরা একটু বিচলিতও
হল অবশ্যই।
কিন্তু আমার মধ্যে তো লুকোচুরি ছিল না। একদিন স্টিমারে বেগুসরাই
যাওয়ার জন্য ঘাটে যাচ্ছিলাম। স্টিমারেই দেখা হয়ে গেল কংগ্রেসের এক ধূর্ত নেতার সাথে।
সে লোকটি এসব জোচ্চুরিতে বেশি রকম থাকে। সবাই জানে তার বিষয়ে। দুর্নামও আছে সে কারণে।
আমায় জিজ্ঞেস করল, কোথায় চললেন মহারাজ? আমি জবাব দিলাম, কংগ্রেসে বসে আপনারা যে বেইমানি
এবং পক্ষপাতিত্ব করেছেন তারই হাঁড়ি ভাঙতে। চুপ মেরে গেল সে। সে নির্বাচনে আমি তিন জায়গায়
খোলাখুলি স্বরাজ্য পার্টির বিরোধ করলাম এবং মনেপ্রাণে কাজ করলাম। ফলে শ্রী নন্দন বাবু
এবং স্যার গণেশদত্ত সিং নির্বাচিতও হলেন। যদিও আমি শ্রী নন্দন বাবুকে জেতানোর জন্যই
বেশি জোর লাগিয়েছিলাম।
যদিও সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কংগ্রেসের নামে হয় নি, স্বরাজ্য পার্টির
নামে হয়েছিল। আরো একটা ব্যাপার ছিল। পাঞ্জাব কেশরি লালা লাজপত রায় এবং পন্ডিত মদনমোহন
মালবীয়ও স্বরাজ্য পার্টির বিরোধ করেছিলেন এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় দলের নামে নির্বাচনে
লড়েছিলেন। সেই দলেই শ্রী নন্দন বাবুরাও শামিল ছিলেন। যদিও আজ আমি মানি যে সেই নির্বাচনে
অংশগ্রহণ বলতে গেলে এক ভাবে কংগ্রেসেরই ছিল। স্বরাজ্য পার্টির বিরোধ প্রকারান্তরে কংগ্রেসেরই
বিরোধ ছিল। এটাও মানি যে আমি ভুল করেছিলাম। কেননা রাজনীতির বা দেশদুনিয়ার পুরো অভিজ্ঞতা
আমার ছিল না। কংগ্রেসের লীডারদেরও ঠিক মত বুঝতে পারিনি। যদি আজ সেরকম ব্যাপার হত
আমি কিছুতেই বিরোধে দাঁড়িয়ে পড়তাম না। এসব ব্যাপার তো রাজনীতিতে হতেই থাকে। গান্ধিজির
আসায় বা তাঁর কথায় রাজনীতির দূষিত রূপ পাল্টে তো আর যায় নি। এদিকে তো নির্বাচনের সময়
১৯২৬ সালের থেকেও খারাপ সব ঘটনা ঘটতে দেখেছি। তা সত্ত্বেও হয় আলাদা থেকেছি নয় তো কংগ্রেসের
সাহায্য করেছি।
কেননা সে সময় আমার বিরোধের ভিত্তিটা ছিল কাঁচা। রাজনীতিতে এসব ব্যাপার
নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিৎ নয়। হ্যাঁ, নীতিগত প্রশ্ন হলে বিবেচনা করা উচিৎ। এবং সে নীতিগত
প্রশ্নগুলো যেন উঁচু স্তরের হয়, আর্থিক ও সামাজিক প্রশ্ন হয়, বিপ্লবের সমর্থন বা বিরোধের
মধ্যে বাছার প্রশ্ন হয়। তাহলেই সে বিবেচনা অনুসারে সমর্থন বা বিরোধের দায় নেওয়া উচিৎ।
তাও খুব ভেবে চিন্তে। আমি খুশি এবং সন্তুষ্টও যে পরে আর এ ধরণের ভুল কখনো করিনি। যদিও
অনেক সঙ্গীকে, যারা বিপ্লব এবং রিভলিউশনের কথা বলে, নিয়মিত, কখনো প্রত্যক্ষ কখনো অপ্রত্যক্ষভাবে
এধরণের কাজ করতে দেখেছি। আমায় এ ধরণের সুযোগ আর বিচলিত করতে পারেনি, সেটাকে আমি আমার
সৌভাগ্য মনে করি।
১৯২৬ সালের দুটো আরো ঘটনা প্রসঙ্গতঃ সংক্ষেপে বলে তারপর এগোব। সে
দুটোর প্রত্যক্ষতঃ কোনো সম্পর্ক উপরোক্ত দুঃখজনক ঘটনাটির সাথে নেই। আসলে জাত-পাত নিয়ে
চ্যাঁচামেচি করা আর ধর্মের দোহাই দেওয়া ধনাঢ্য এবং তাদের সমর্থকদের পাল্লায় পড়ে আমায়
ওই শোচনীয় ঘটনার শিকার হতে হয়েছিল আর তাদেরই সাথে এ ঘটনাদুটোও সম্পর্কিত। ওপরের ঘটনাটির
সাথে সম্পর্কিত যেমন অনেক কিছু দেখলাম এবং শিখলাম, এ দুটো ঘটনাও সে সুত্রেই দৃষ্টিগোচর
হল।
একটি ঘটনা তো ১৯২৬ সালেরই, ভুমিহার ব্রাহ্মণ সভার প্যান্ডালের। আমারই
পাশে ধরহরার রায়বাহাদুর বাবু চন্দ্রধারি সিং কপালে চন্দন (ভস্ম) লেপে বসেছিলেন। একবার
আমায় বললেন আপনি সন্ন্যাসি, আপনার তো কাশীতে থাকা উচিৎ। আমি চুপ করে রইলাম – বুড়ো মানুষকে
কী বলব। আবার ওই একই কথা বললেন। তখনও আমি চুপ করে রইলাম। ভাবলাম লোকটা বেআদব। আমায়
ধর্ম শেখাবার সাহস করে। যদিও ধর্মের এই ভড়ংএর পিছনে লোকটির বস্তুগত স্বার্থ আছে। কেননা
এক দিকে লোকটি দেখেছে যে পুরোহিতগিরির প্রশ্নে এর বেয়াই শ্রী কবীন্দ্র নারায়ণ সিং হেরে
ভূত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ, সবাই বলে যে নিজের জমিদারিতে এ নিজেই প্রচন্ড অত্যাচারী। ততক্ষণে
লোকটা তৃতীয়বার ওই একই কথা যেই বলল আমি সোজা শুনিয়ে দিলাম, আপনার লজ্জা করে না? কার
সাথে কথা বলছেন? আমি আপনার কাছ থেকে নিজের ধর্ম শিখতে পারব না। সঙ্গে সঙ্গে বেচারা
এক্কেবারে চুপ মেরে গেল। এই ধনাঢ্য মানুষগুলোর মুন্ডুও অদ্ভুত। সবাইকে এক পাল্লায় ওজন
করতে চায়। আর সে পাল্লা হল পয়সার।
দ্বিতীয় ঘটনাও ওই সভার সাথেই সম্পর্কিত। সেবার প্রথমবার সভার সভাপতি
ছিল সরকারের বিরোধী এবং প্রথমবার এমন হয়েছিল যে বড়লোক, গরীব সবাই একই ধরণের মাটিতে
পাতা বিছানায় বসে ছিল। সভাপতি ছাড়া অন্য কারোর জন্য উঁচু বা বিশেষ জায়গা ছিল না। কেনই
বা হত? জাতের সভা ছিল এবং জাত হিসেবে তো সবাই সমান। তাহলে কেউ উঁচুতে কেউ নিচে কেন
বসবে? বিভেদ কেন হবে? লড়ে এধরণের সাম্য এবং গণতন্ত্র এনে দিয়েছিলাম আমি সভায়।
কিন্তু বাবুদের জন্য সেটা বিষের পেয়ালা ছিল, জ্বলন্ত অপমান ছিল যে
তারা সাধারণ মানুষের সাথে এক বিছানায় বসে আছে। সব মরে কাঠ হয়ে ছিল যেন লাঠিপেটা করা
হয়েছে, কিন্তু লোহার খাঁচায় বন্দি কালনাগের মত ভিতরে ভিতরে ফোঁস ফোঁস করছিল। কিন্তু
কিই বা করতে পারত তারা? ব্যস, সভা শেষ হতেই তারা প্রস্তাব দিল যে যারা বছরে বারো টাকা
দেবে তারাই সভার মেম্বার এবং প্রতিনিধি হতে পারবে। তখন অব্দি মাত্র এক আনা ছিল চাঁদা।
এভাবেই গরীবদের এবং আমজনতাকে সভা থেকে বার করে আবার থেকে নিজেদের কেল্লা তৈরি করার
পরিকল্পনা করতে লাগল ওরা।
আমি বললাম সেটা হতে পারে না। হবেই বা কেন? তখন বলা হল যে রাজা, মহারাজা,
বড়লোক, গরীব সবাই একভাবে বসে। কারোর আর ইজ্জৎ রইল না। আমি বললাম, এর জন্য সভাটাকে বড়লোকদের
জায়গা করার এই দ্রাবিড় প্রাণায়াম করার কী দরকার? দর্শকদের চাঁদা করে দিন পচিশ টাকা
থেকে পাঁচশো বা এক হাজার টাকা অব্দি। সে হিসেবেই চেয়ার, গদি ইত্যাদির ব্যবস্থা করিয়ে
দিন। যে যত বেশি টাকা দেবে সে তত বেশি আরামে বসবে। এমন তো কংগ্রেসেও হয়ই। এটুকু শুনেই
সবাই চুপ মেরে গেল। এভাবেই ওদের চালাকিটা দেখেও নিলাম এবং সবাইকে দেখিয়েও দিলাম।
জাতের সভাগুলো আগে সরকারি অফিসারদের অভিনন্দন পত্র দেওয়ার জন্য এবং রাজভক্তির প্রস্তাব পাস করার জন্য তৈরি হয়েছিল। এর মাধ্যমে কিছু ধূর্ত এবং বড়লোকেরা জাতের নামে সরকারকে দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়ে নিত। এখন যুগ বদলে যাওয়ায়, সেটা যদি নাও হতে পারে, সভার সাহায্যে ভোট তো জোটান যেতেই পারে। আমি খুশি যে ভুমিহার ব্রাহ্মণ সভার মাধ্যমে এই দুটো কাজই করিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা আমি শেষ করে দিলাম। ১৯২৯ সালের গরমকালে মুঙ্গেরে তো কবরই দিয়ে দিয়ে দিলাম ব্যাপারটাকে। না ‘বাঁশ থাকবে, না বাঁশি বাজবে’। এ সত্ত্বেও যদি কিছু মানুষ আমাকে জাতের পক্ষ নেওয়ার দোষ দেয়, সেটা থামাতে আমি অপারগ।
(২০)
লোকসংগ্রহ
১৯২৬ সালের শেষে আমি দ্বারভাঙা জেলার সমস্তিপুরে থাকা শুরু করলাম।
সেখানে কয়েকজন সঙ্গীর কথায় আর নিজের অভিজ্ঞতা না থাকায় মাথায় ভূত চাপল যে হিন্দিতে
একটা খবরের কাগজ বার করি এবং তার জন্য প্রেস ইত্যাদির ব্যবস্থা করি। পরে নিজের অভিজ্ঞতায়
জানতে পারলাম সিদ্ধান্তটা আমার কত বড় ভুল ছিল। আকছার দেখেছি অনেকেরই প্রেস চালানোর
এবং খবরের কাগজ বার করার হুজুগ থাকে। কিন্তু এতদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এটাই বলতে
পারি যে প্রথম তো প্রেস রাখাটাই ভুল। তাও যদি বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে সেটা ক্ষম্য হয়ও,
খবরের কাগজ বার করা তো সাধারণ নিয়মে অক্ষম্য অপরাধ! ‘লোক সংগ্রহ’এর অভিজ্ঞতার পর আমি
স্থির করে নিয়েছিলাম যে এই দুটো বিচ্যুতির শিকার আমি কিছুতেই আর হব না। লোকজনকেও আমি
বার বার একথাই শেখাই। বিশেষ করে খবরের কাগজ বার করার ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচার উপদেশ তো আমি
সবসময়ে দিয়ে থাকি। এদিকে যে ‘জনতা’য় এসে আমি ফেঁসে গেলাম, তার কারণ বন্ধুরা। আমার ইচ্ছের
বিরুদ্ধে ওরা জবরদস্তি আমায় ফাঁসিয়ে দিল। আমার ভুল হল যে আমি শেষ অব্দি নির্মম ভাবে
না করতে পারলাম না। দুঃখের কথা যে এর পরিণতি এবং অভিজ্ঞতা দুটোই তিক্ততম। এই ‘জনতা’
শুধু আমাকেই নয় আমার অনেক সাচ্চা সঙ্গীদেরকেও কাঁদিয়েছে, তাও রক্তের অশ্রু। পন্ডিত
পদ্মসিং শর্মা বলতেন, যার কোনো কাজ নেই আর নেতা হতে চায়, নামডাক চায় নিজের, সে কোনো
প্রতিষ্ঠান খুলে নিক। কিন্তু ভালো মানুষদের তো এসব প্রতিষ্ঠানগুলো মেরে ফেলে। আমি কেঁদে
কেঁদে এই কটু সত্যের আক্ষরিক অভিজ্ঞতা জুটিয়েছি।
হ্যাঁ, খবরের কাগজ বার করার হুজুগ চড়ল মাথায়। এবং তাই প্রেসেরও।
১৯২৬ সালের শেষ এবং ১৯২৭এর শুরুর কয়েকটি মাস আমার এই চিন্তাতেই কাটল। যেমন আমার স্বভাব,
সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। এটা আমার দোষ আবার গুণও যে এক সময়ে আমি একটাই কাজ করতে
পারি এবং তাতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করি। সেভাবেই সফলও হই। যদিও সমস্তিপুরের শ্রী বাচ্চুনারায়ণ
সিংএর প্রেরণা ছিল এর পিছনে এবং কিছুদূর উনি আমায় সঙ্গও দিলেন। কিন্তু ওনার তো একটা
সীমা ছিল। উনি তার বেশি এগোতে পারতেন না। কিন্তু আমার পক্ষে আর পিছু হটা সম্ভব ছিল
না। উনি এ কাজটাও করতেন এবং অন্য কাজও করতেন। কর্মবহুল মানুষ ছিলেন। অবশেষে ১৯২৭এর
গ্রীষ্ম আসতে আসতে প্রেসও হয়ে গেল এবং সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রস্তুতিও পুরো হয়ে গেল।
গীতার “লোক সংগ্রহ মেবাপি সম্পশ্যঙ্কত্তুমর্হসি” শ্লোকটাই আমাদের মোটো (পথ প্রদর্শক
বাক্য) হল এবং সংবাদপত্রের নাম স্থির হল ‘লোকসংগ্রহ’। অবশ্য এ ধরণের নাম রাখার প্রেরণা
আমরা কিছু মারাঠি সংবাদপত্র থেকে পেয়েছিলাম। পত্রিকা বেরুনো শুরুও হল। আমিই তার সম্পাদক
হলাম। কিন্তু শুরু হতেই অসুবিধেও শুরু হল। শিগগিরই টের পেলাম সমস্তিপুরের মত জায়গায়
প্রেস রাখা এবং পত্রিকা বার করাটাই বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তাই কিছু দিনের মধ্যেই
প্রেস আর পত্রিকা পাটনায় নিয়ে আসতে হল।
কিন্তু মধ্যেকার কয়েকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সমস্তিপুরে একটা পুরোনো
প্রেস ছিল, ‘নেমনারায়ণ প্রেস’। প্রেসটা ছিল নরহন (বিভুতিপুর) এর জমিদার বাবু কামেশ্বর
সিংএর। নিজের স্বর্গীয় পিতার নামে উনি প্রেসটার নামকরণ করেছিলেন। প্রেসটা ছিল খারাপ।
কিন্তু সেটা টের পেলাম আমি পরে। বেশির ভাগ সময় বন্ধই থাকত প্রেসটা। বাচ্চুবাবু প্রস্তাব
দিলেন যে বিভুতিপুরে গিয়ে সেই বাবুসাহেবের কাছ থেকে সেই প্রেসটাই চাওয়া যাক। চাঁদা
হিসেবে তিনি প্রেসটাই দিয়ে দিন। পরিচয় তো ঘনিষ্ঠ ছিলই। আমরা দুজনে গেলাম এবং তাঁকে
বললাম। উনি দিতে রাজি হলেন কিন্তু শর্ত রাখলেন যে নামটা ‘নেমনারায়ণ প্রেস’ই থাকবে।
চালাক তো ছিলেনই। ভাবলেন রদ্দি প্রেসটা দিয়ে বাপের নাম অমর করে রাখবেন। কিন্তু আমরা
দুজনে টা বুঝতে পারলাম না। ফলে শর্ত মানতে প্রস্তুত হয়ে গেলাম।
কিন্তু আরো শর্ত আসা বাকি ছিল। যখন খেতে বসলাম বাবুসাহেব বললেন,
কার হাতে প্রেস থাকবে তারও পাকা ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া উচিৎ। এ কথায় আমি চটে গিয়ে বললাম
যাকে দিতে হয় দিয়ে দিন প্রেসটা নইলে নিজের কাছেই রাখুন। আমার চাই না। ব্যস, ওইটুকুতেই
ঠান্ডা হয়ে গেলেন আর প্রেসটা পেয়ে গেলাম।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই উনি আমায় খুব বিচ্ছিরি ভাবে ঠকালেন। প্রেসের
দাম ধার্য করা হয়েছিল আট বা নয়শো টাকা। উনি আমার সঙ্গী – যিনি ওনারও ভালো সঙ্গী – বাচ্চুবাবুকে
দিয়ে বলে পাঠালেন যে এক ভদ্রলোক (যার নাম আমি বলতে চাই না) একটি বই আমায় উৎসর্গ করতে
চান। তার শর্ত এই যে বইটা ছাপার খরচ আমি দিয়ে দিই। ছাপাইয়ে সেই আট-নয়শো টাকা লাগার
ছিল। বই ছেপে গেলে পর বিক্রি করে উনি টাকাটা নিশ্চিত ফিরিয়ে দেবেন। আমার কেমন খটকা
লাগল। ধন্ধে পড়ে গেলাম, কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। ইতি মধ্যে বাচ্চুবাবু (বাচ্চুনারায়ণ
সিং) টাকাটা ওনাকে দিয়ে দিলেন। কেননা প্রেসের জন্য যোগাড় করা টাকা তাঁর কাছেই জমা ছিল।
উনি আমায় জিজ্ঞেসও করলেন না। যখন জানতে পারলাম, রাগ তো হল খুব, কিন্তু কিই বা করতাম?
যিনি বইয়ের জন্য টাকাটা আমার কাছ থেকে নিলেন তিনিও ভালোভাবেই আমার পরিচিত। কিন্তু হাজার
বার তাগাদা করা সত্ত্বেও টাকাটা উনি ফেরত দিলেন না। বইও ছাপালেন না। বিরক্ত হয়ে আমি
চাওয়া ছেড়ে দিলাম, কিন্তু ঘটনাটা আমায় চমকে দিল। বাচ্চুবাবুকেও আর আমি বিশ্বাস করতে
পারছিলাম না। টাকাটা তো সার্বজনিক ছিল। তাই সে টাকার এমন অপব্যবহার আমার বরদাস্তের
বাইরে ছিল।
ওদিকে ওই রদ্দি প্রেসে কাজ চলার ছিল না। অন্য প্রেস আর টাইপের দরকার
ছিল। প্রেসের অন্যান্য জিনিষেরও প্রয়োজন ছিল। যা টাকা ছিল তা বাচ্চুবাবু খুইয়ে দিয়েছিলেন।
এবার কী হবে? চিন্তায় ভুগছিলাম। রাত্রে ঘুম পর্য্যন্ত আসছিল না। আর এই ঘুম না আসাটা
আমার জন্য বিশেষ ব্যাপার ছিল। কাজ যাই হোক, চুটিয়ে করি। কিন্তু রাতে নিয়মিত ভালোভাবে
ঘুমোই। বাহান্ন বছর বয়সেও সাত ঘন্টার একটা গাঢ় ঘুম আসে। আগেও এমনই ঘুমোতাম। রাতে কোনো
চিন্তা রাখতাম না মাথায়। কিন্তু এই চিন্তাটা এমন ধরল মনে গেঁথে গেল। রাতের ঘুম উবে
গেল। ব্যাপারটা বিপজ্জনক ছিল।
এরই মধ্যে পাটনায় একজন বলে দিল আপনি তো এভাবেই কাজ শুরু করেন অথচ
শেষ করেন না। কথাটা মিথ্যে, কিন্তু বিঁধে গেল। তখুনি কলকাতা গেলাম। সেখানে সোনাপট্টিতে
শ্রী হরিদ্বার রায়ের বাড়িতে উঠলাম। আগেও ওখানেই উঠেছি। পুরোনো পরিচিত। কলকাতায় আরো
পরিচিতেরা থাকেন তাই ভাবলাম তাদের কাছ থেকে দরকার মত টাকা পেয়ে গেলে আমার কাজ হয়ে যাবে।
টাকা পেলামও। কিন্তু ছোটখাটো চাকরি করা মানুষেরা আর কত দেবে? তবুও কয়েক হাজার টাকা
জমা হল। মাত্র তিন শো টাকা কম পড়ছিল। এবার কী হবে? রাতভর অস্থিরতায় কাটালাম। ওদিকে
হরিদ্বার রায় জেনে গেলেন যে চিন্তায় আমার ঘুম আসছে না কেননা প্রেস কেনার সঙ্কল্প নিয়ে
এসেছি। আর কী! তক্ষুনি একবারে তিন শো টাকা উনি দিয়ে দিলেন। ভালো দোকান চলে তাঁর সোনারূপোর।
এবার আমার কাজ হয়ে গেল। কলকাতায় সব জিনিষপত্র কিনে, পাটনা থেকে আরো একটা প্রেস কিনে
সমস্তিপুরে ফিরে এলাম।
প্রেস নিয়ে ঝঞ্ঝাটের এই প্রসঙ্গে একটা পুরোনো, বলার কথা মনে পড়ে
গেল। সেটাও প্রেসের সাথেই সম্পর্কিত। যদ্দুর মনে আছে, ১৯১৫ সালে কাশীতে একটা প্রেস
নিয়ে আমি আরো বেশি ঝামেলায় পড়েছিলাম। সে প্রেস থেকে মাসিক পত্রিকা ‘ভুমিহার ব্রাহ্মণ’
বার করেছিলাম। কাশীতে তিনজন যুবক – সে সময় তারা ছাত্র ছিল, পরে চাকরিবাকরিতে ঢুকে পড়েছিল
– নিজেদের তরফ থেকে কুড়ি কুড়ি টাকা জমা করেছিল। সেই ষাট টাকা পূঁজিতেই বেরিয়েছিল পত্রিকা।
চলতে শুরু করল এবং বেশ কিছুদিন অব্দি চলল। আমার সাথে ওই যুবকেরাও কাজে লেগে থাকত। পত্রিকা
ছাপানো হত আগে অন্য প্রেসে। পরে ওর নিজের প্রেস হয়ে গেল। এটা আমার সব সময়ের অভিজ্ঞতা
যে যদি সততার সাথে কোনো কাজে হাত দেওয়া যায় সেটা পয়সার অভাবে আটকায় না। ওই পত্রিকাটাও
এরই একটি উদাহরণ।
পরে যখন আমি ‘ভুমিহার ব্রাহ্মণ পরিচয়’ নামে বই লিখলাম তখন ওই তিন
যুবকের মধ্যে একজন বইটি ছাপানো ইত্যাদি কাজে একটু বেশি পরিশ্রম করল। ছাপাইয়ের কিছু
টাকা বকেয়া রয়ে গিয়েছিল যেটা পরে বই বিক্রি করে শোধ দেওয়া হল। বই বিক্রি করে আরো যে
টাকা এসেছিল সে টাকায় প্রেস কেনা হয়েছিল। সে প্রেস থেকেই পরে পত্রিকা বেরুতে শুরু করল।
পরে আমি বইয়ের টাকার হিসেব চাইলাম। প্রেস আর পত্রিকার হিসেব চাইলাম। আর দুই যুবক সঙ্গীও
শামিল হল এই হিসেব চাওয়ায়। তখনি সেই তৃতীয় যুবক টালবাহানা শুরু করল আর শেষ পর্য্যন্ত
হিসেব দিলই না। বইয়ের প্রায় দেড় হাজার টাকা চুরি করে নিল। শেষ দুজন সঙ্গী মুখ তাকিয়ে
রইল।
যাহোক, বেঁচে থাকা বইগুলো তার কাছ থেকে কোনোরকমে নিয়ে আমি নিজেকে
আলাদা করলাম। কাশীরই এক ভালো মানুষের কাছে বইগুলো রেখে দিলাম। পরে তাঁর সাথেও ঝঞ্ঝাট
হল এবং অনেক কষ্টে তার কাছ থেকে বইগুলোর টাকা পেলাম। কিছু টাকা রয়েই গেল। কয়েক শো,
বেশি নয়। দু’একজন এধরণেরই ধর্মাত্মা এবং ধনাঢ্য বলে কথিত লোকেরা বইয়ের দাম রেখে নিয়েছে,
দেয়ই নি শেষ পর্য্যন্ত। এভাবে প্রায় তিন হাজার টাকা – সার্বজনিক কাজেই লাগত, ব্যক্তিগত
নয় – লোকে হজম করে নিল। আমি দেখতে থেকে গেলাম। কোনো গোপন কথা নয়, সবাই জানে গল্পগুলো।
আসলে টাকা জিনিষটাই এমন। বড় বড় মানুষের সততা চিড় খেয়ে যায়। এতদিনের
অভিজ্ঞতা এটাই শিখিয়েছে যে যদি কাউকে পরীক্ষা করতে হয় তাহলে তার কাছে কিছু টাকা গচ্ছিত
রেখে দিন এবং পরে চেয়ে দেখুন। আপনিই টের পাবেন কত অসুবিধে হয় টাকাটা ফেরত পেতে। তাও
সবার কাছ থেকে পাবেন না, কয়েকজন হয়ত দেবে। তাই টাকা-পয়সা যদি কাউকে ধার দিতে হয় বুঝেই
দেবেন যে ও টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। তা সত্ত্বেও যদি পেয়ে যান সেটা আপনার ভাগ্য।
যাহোক, আবার ‘লোক সংগ্রহ’এর কথায় ফিরে যাই। সমস্তিপুর থেকে বেরুল
তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আগেই যেমন বলেছি খুব শিগগির অসুবিধেগুলো শুরু হল। যেখানে বেশ কিছু
সংখ্যায় প্রেস নেই এবং তাই প্রেসের জিনিষপত্র এবং কাগজ ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে না পাওয়া
যায় সেখানে প্রেস খোলা মানে বিপদ ডেকে নেওয়া। একজন কম্পোজিটর অসুস্থ হলে বা কাজ ছেড়ে
দিলেই প্রেস বন্ধ। যদি শত্রুরা উত্তেজিত হয়ে প্রেসওয়ালাদের কাজ বন্ধ করতে বলে তাহলেও
বিপদ। এসব জায়গায় ছাপার কাজও কম পাওয়া যায়। এই সব সমস্যায় আমি বার বার হতবাক হতে লাগলাম।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন তো কেউ দিত না। তাই বিজ্ঞাপনের জন্য দরবার করা
থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার মত সব সময় এটাই যে বিজ্ঞাপন, মনে হয় পত্রিকার বুকে বসে
জাঁতা ঘোরাচ্ছে। বিজ্ঞাপন যারা দেয় তারাও হয়রাণ করে ছাড়ে। খোশামোদ করতে করতে প্রাণ
ওষ্ঠাগত হয়। তারপরেও এড়িয়ে যায় তারা। যারা বিজ্ঞাপন চায় তাদের অবস্থা জলবিন্দু-পিয়াসী
চাতকের মত। এধরণের লাঞ্ছনার জীবন কোনো স্বাভিমানী মানুষ কেন বরদাস্ত করবে। তাও আবার
সে যদি সাচ্চা গণসেবক এবং জাতীয়তাবাদী হয়। তাই প্রথম থেকেই বিজ্ঞাপনকে আমি আমার প্রণাম
জানিয়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে এবং পুরো পত্রিকাটার জন্য সংবাদাদি
লিখতে বেশি পরিশ্রম করতে হত। বেশির ভাগ সময় সব কিছু আমাকেই করতে হত। আমার সঙ্গী বাচ্চু
বাবুর অবস্থা কিছুটা অদ্ভুত ছিল। উনি বেশি কিছু করতে পারতেন না। যখন নাকি, ম্যানেজার
উনিই ছিলেন। এভাবে কাজ করতে করতে আমি বিরক্ত হয়ে শেষে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মতামত নিয়ে
প্রেসটা পাটনায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত করলাম। কিন্তু বাচ্চুবাবু সহ্য করতে পারছিলেন না
যে পত্রিকার প্রকাশন সমস্তিপুর থেকে সরে যাবে। কাজেই বড় সমস্যা এল – কী হবে? ছোটোখাটো
জিনিষ হলে চট করে সরিয়েও দেওয়া যায়। এটা তো প্রেস। দুটো প্রেস এবং তার সমস্ত জিনিষপত্র
এত দূর পাঠানো খেলা কথা নয়। দুই মালগাড়ির জিনিষ। তাও ভারি লোহার। ওঠাতে-পাঠাতে পড়ে
গেলেই শেষ!
এসব নিয়ে চিন্তাভাবনায় ছিলাম। তারই মধ্যে বাচ্চুবাবু দু’তিনদিনের
জন্য কোথাও বাইরে চলে গেলেন। ব্যস, আমি লাফিয়ে উঠে আঙারঘাট স্টেশনের কাছের ডিহুলি গ্রামের
শ্রী গয়াবাবুর সাহায্যে শিগগিরই পুরো প্রেসটা উপড়ে সবকিছু ট্রেনে চাপিয়ে দিলাম। সে
সব রওনাও হয়ে গেল পাটনার দিকে। বস্তুতঃ গয়াবাবু না থাকলে কিছুই হতে পারত না। লোকজনের
সাহায্য নেওয়া, ট্রেন ঠিক করা এবং মালপত্র লোড করায় উনি সর্বশক্তি লাগিয়ে দিলেন। অন্যান্যরাও
এসব দেখে চমকে গেল। কিন্তু অন্য কোনো উপায় ছিল না। ফলে বাচ্চুবাবু ফিরে এসে যখন দেখলেন
সব ফাঁকা, হতবাক হয়ে গেলেন। কেননা, কাজটা জাদুমন্তরের মত হয়েছিল। রাগ তো হলই ওনার প্রচন্ড।
কিন্তু করতেনই বা কী? আমি তো ততক্ষণে সব মালপত্তর নিয়ে পাটনায়! এভাবেই প্রেসটা পাটনায়
এল আর দুন্দা সিংএর ঠাকুরবাড়িতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে রাখা হল। পরে ওখানে জায়গার অভাব
বুঝে নিউ এরিয়া (কদমকুঁয়া)য় একটা বাড়ি নিয়ে সেখানে আনা হল। শেষ অব্দি ওখানেই ছিল।
পাটনায় অসুবিধেগুলো কমে গেল। সাহায্য করার লোকও পাওয়া গেল। শ্রী
বশিষ্ঠনারায়ণ সিং ‘অ্যাডভোকেট’ আমার পুরোনো দিনের পরিচিত। কাশীতেই ওনার সাথে আলাপ হয়েছিল।
সেসময় অ্যাডভোকেট হওয়ার তৈয়ারিতে ব্যস্ত থাকতেন। বেশ কয়েক মাস উনি ‘লোকসংগ্রহ’র সম্পাদনায়
ভালো মত আমাকে সাহায্য করেছিলেন, বিশেষকরে খবর সংগ্রহ করায়। এতে আমার ওপর চাপ হাল্কা
হল। আসলে প্রেসের ম্যানেজারও আমিই ছিলাম। ‘সম্পাদক’ তো ছিলামই। তার ওপর আবার যবে থেকে
আশ্রম শুরু হয়েছিল, মাঝেমধ্যেই আমি বিহটায় চলে যেতাম। প্রেস পাটনায় এল ১৯২৭ সালের আদ্ধেক
বেরিয়ে যাওয়ার পর এবং সেবারে বর্ষাও তাড়াতাড়ি চলে এল। ওদিকে বিহটার আশ্রম নিয়মিত ভাবে
খুলে গেল শ্রাবণ মাসের গুরু পূর্ণিমায়। যদিও তার আগে থেকেই ওখানে আমি থাকা শুরু করে
দিয়েছিলাম।
পাঁচটা বাজার আগে আমি প্রেস থেকে বেরিয়ে যেতাম। পায়ে হেঁটে স্টেশনে
পৌঁছোতাম মোটামুটি ২০-২৫ মিনিটে। মাসিক টিকিট নিয়েই যাওয়া আসা চলত। যেদিন পত্রিকা বেরোবার
থাকত তার আগের রাতে মাঝরাতের ট্রেনেই চলে আসতে হত। সেসময় একটা ট্রেন চলত মাঝরাতে, বিহটা
থেকে। কিন্তু প্রতিদিন বিহটা ফিরে যাওয়াও জরুরি হত। আশ্রমের দেখাশুনো ছাড়াও, প্রথম
থেকেই আমার গ্রামাঞ্চলেই থাকার অভ্যেস। ফলে শহরে ভালো করে ঘুম আসে না। পাটনায় মশার
উৎপাত তো আছেই।
এই দশায় প্রেস আর পত্রিকা, দুটোই চালানো কতটা কঠিন ছিল যে কেউ বুঝতে
পারবে। আমায় সাহায্য করতে একজন আরদালি রাখা হয়েছিল। দৌড়োদৌড়ি করত। বাইরের ছাপাইয়ের
কাজও প্রেসে কিছু না কিছু তো হতই। আজকালকার দিনে কি এত কম, প্রায় না রাখার মত লোকবল
নিয়ে সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং প্রেস চালানো যেতে পারে? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করাই যায়।
জবাব পরিষ্কার যে কয়েক বছর ধরে আমিই চালিয়েছি। শুধু বশিষ্ঠবাবুর কিছুটা সাহায্য এবং
একজন আরদালির মদতে সব কাজ করেছি। সময় মত না পৌঁছোবার বা না পাওয়ার নালিশ ‘লোকসংগ্রহ’এর
ব্যাপারে প্রায় কখনো হয়নি। তেমনই ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম আমি। বিজ্ঞাপন না থাকায় সব
খরচ গ্রাহকের টাকাতেই চলত। বাইরের কাজ সামান্য একটু আধটু ছাপত।
তা সত্ত্বেও যখন পন্ডিত যমুনাকার্যীকে ওই পত্রিকা আর প্রেস আমি চব্বিশ
শো টাকায় দিলাম তখন আরো টাইপ এবং নতুন জিনিষ প্রেসে লাগান হয়েছিল। সোজা অর্থ যে সব
খরচ চালাবার পরেও কিছু সঞ্চয় হয়েছিল। আসলে মাসিক টিকিট ছাড়া আমি তো এক পয়সাও নিতাম
না, খাবার বা জামাকাপড়ও না। চাকর বেশি ছিল না। আমি তো এটাও হিসেব করেছিলাম যে আরো দুজন
লোক (যার মধ্যে একজন ম্যানেজার হবে) রাখলেও ক্ষতি হত না। কিন্তু আজকাল তো বিজ্ঞাপন
এবং চাঁদার পয়সা (গ্রাহকচাঁদার বাইরে) নিয়েও সাপ্তাহিকগুলো দেউলিয়া হয়ে থাকে। বন্ধও
হয়ে যায়।
আমি মনে করি আমরা পত্রপত্রিকার এবং সার্বজনীন কাজকর্মের উত্তরদায়িত্ব
ঠিক ভাবে বুঝিই না। সার্বজনীন উদ্দেশ্যে সংগৃহীত টাকাকড়ি তো আমরা বলতে গেলে তছনছ করি।
এটাই পত্রিকাগুলোর দেউলিয়া হওয়ার কারণ। ‘পত্রিকা’ লিডারি করার রাস্তাও নয়, টাকা রোজগার
করা বা কয়েকজনের দিনগুজরান করার যোগাড়ও নয়। পত্রিকা লড়াইয়ের অস্ত্র। সেই দৃষ্টিকোণ
থেকে যদি পত্রিকাকে ব্যবহার করা হয় তাহলে কোন অসুবিধা হয় না। মানুষের দেওয়া টাকাপয়সাকে
তরিতরকারি বা হালুয়া ভেবে অবিবেচকের মত উড়িয়ে দেওয়ার ফল হয় যে একশো রকমের কুকর্ম এবং
নোংরা উপায় করে পয়সা আনতে হয়। বিজ্ঞাপন ইত্যাদির জন্য মিথ্যে-মিথ্যে বলতে হয়। তারপরেও
দারিদ্র্য পিছু ছাড়ে না।
শেষে, এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করার পর বুঝলাম যে কী বিতিকিচ্ছিরি
কাজে ফেঁসেছি – অন্য সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও যেতেও পারি না, আসতেও পারি না। যেন
বিহটা থেকে পাটনা অব্দিকার জেলখানায় বন্দি হয়ে গেছি। পরিশ্রমও হচ্ছে অত্যধিক। মন চাইছে
একটু বিশ্রাম নিই। এটা সত্যি যে কাজ দেখে আমি কখনো বিচলিত হই না। কাজ করে কখনো অসুস্থও
হই না।। এদিকে তো যাহোক, অসুখ ইত্যাদি হয়ই না আমার। কিন্তু আগেও তখনই অসুখে পড়েছি যখন
সাধারণতঃ অবসরযাপনের সময় ছিল – কাজের ভার মাথার ওপর ছিল না। কিন্তু সে সময় অনবরত একই
ধরণের কাজ করে করে আমি বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাও, বিশেষ করে ঘোরাফেরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়।
ঘোরাফেরা বজায় থাকলে কোনো অসুবিধে হত না। কেননা ওটা আমার জীবনের অঙ্গবিশেষ। তাই ওটা
থাকলে বিরক্তও হই না আর ক্লান্তও হই না। কিন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিরক্তও হয়ে পড়লাম
আর ক্লান্তি এসে পড়ল। তাই দ্বারভাঙার পন্ডিত যমুনাকার্যী, বি.এ.র জিম্মায় প্রেস আর
লোকসংগ্রহ দুটোই দিয়ে দিলাম। প্রেসের দাম ধার্য হল চব্বিশ শো টাকা। এই শর্তটাও লেখাপড়া
হয়ে গেল যে পুরো টাকাটা উনি কিস্তিতে ধীরে ধীরে সীতারামাশ্রমকে দিয়ে দেবেন। উনি কথা
দিলেন যে পত্রিকার নীতি ইত্যাদি যা ছিল তাই রাখবেন। সেভাবেই চালালেন। প্রেস নিয়ে গেলেন
মুজফফরপুরে। ওখানেই রাখলেন কাজকারবার। ১৯৩০-৩২ সালের সত্যাগ্রহের সময় আরেকটা প্রেস
করলেন উনি, ‘সুলভ প্রেস’ নাম দিয়ে। এখন তো সেই নামটাই রয়ে গেছে। ‘নেম নারায়ণ প্রেস’
নামটা প্রায় হারিয়েই গেছে। এখন সে নামটা ধরে রাখার কোনো কারণও নেই। আগেই এ ব্যাপারে
বলেছি। যখন টাকা দিতে হল, তাও আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হল, তখন নাম কেন থাকবে? তা
সত্ত্বেও, কথা দিয়েছিলাম বলে নাম বদলাইনি। কার্যীজি পরে পাল্টে ভুলটা কী করেছেন?
প্রেস আর ‘লোক সংগ্রহ’এর ব্যাপারে আরেকটি কথা উল্লেখযোগ্য। যখন সুস্থির হয়ে পাটনায় থাকতে লাগলাম তখন অসওঢ়ের চৌধুরি রঘুবির নারায়ণ সিং নিজের দুই পৌত্র – শ্রী সুখবংশ নারায়ণ সিং এবং শ্রী মুখবংশ নারায়ণ সিংকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন যাতে ওদের একটু আধটু লেখাপড়া শিখিয়ে দিই এবং ওদের স্বভাবচরিত্র ঠিক করে দিই। লেখাপড়া শেখানোর থেকে স্বভাবচরিত্র ঠিক করার চিন্তাটাই বেশি ছিল। এ বিষয়ে আমার ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল যে ওরা যেন জাতীয়তাবাদী হয়। সরকারি বা হাফ-সরকারি স্কুলে পড়ানোর উনি বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল যে স্কুলে গেলে ছেলেরা আর কোনো কাজের থাকে না। চরিত্রভ্রষ্ট তো হয়েই যায় আকছার। এসব কারণেই আমার কাছে পাঠালেন। অনেক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মানবিকতার কারণে আমি ওদের স্বীকার করলাম এবং লাগাতার পাঁচ-ছয় মাস নিজের সঙ্গেই পাটনায় প্রেসের বাড়িরই এক অংশে ওদের আলাদা করে রাখলাম। ছেলেরা ভালো করেই রইল। আসলে ওদের পৈতের সময় আমিই ওদের গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলাম। তাই যেমন ওনার জন্য জরুরি ছিল আমার কাছেই পাঠানো, আমার জন্যেও জরুরি ছিল ওদের স্বীকার করে নেওয়া। আমিও খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করতাম যাতে ছেলেরা আজেবাজে জিনিষ খেয়ে অসুস্থ বা রুগী না হয়ে যায়। প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু দেখলাম যে ওরা বড়লোকের ছেলে এবং ওদের ঠাকুমা অত্যন্ত স্নেহশীলা ওদের ওপর। ফলে কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে ওরা আমার নিয়ম ভাঙত। তাই ওদের দায়িত্ব নেওয়া বন্ধ করে ওদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিলাম।
No comments:
Post a Comment