প্রতিদিনের মত বিকেল গাঢ় হতেই সে ছটফট করে উঠল। নোংরা দাগধরা ঘরটায় দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎ এক উদ্দীপক বোধের সঞ্চার তাকে ঘুরে তাকাতে বাধ্য করল। সে দেখল জানলার বাইরে – দূরে বিজ্ঞান কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাতের কার্নিশে ডিসেম্বরের রোদ সোনালি হয়ে এসেছে। মুখটা তার বড় বড় পাতার ছায়ায় ভরে গেল।
যেখানে সে কাজ করে সে জায়গাটা একটা দোতলা
বাড়ির নিচের তলা। রয়েছে একটা বড় হলঘর, দুটো ছোটো ছোটো ঘর আর দুফালি বারান্দা। তার
মধ্যেই কর্মচারী গোটা পঞ্চাশেক। দুপুর অব্দি দেড়শ দুশ লোকের কোলাহলে ভরে থাকে
জায়গাটা। টিফিনের পর থেকে ছুটি অব্দি নিঃশব্দে কাজকর্ম চলে। জানলাগুলো বন্দ থাকে
সারাদিন, বিশেষকরে এই শীতকালে। কেননা ঠান্ডা হাওয়া দেয় খুব, আর অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও
বৃদ্ধ কর্মচারিদের তাতে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয় থাকে। এবং অন্যান্য ঋতুতেও। গ্রীষ্মের
গরম শুকনো ধুলো হাওয়া, বসন্তের ও শরতের দ্রুত হাওয়াবদল তথা বর্ষার রোগসমূহ –
কোনোটাই দুর্বল দেহের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।
তবু মাঝে মাঝে খোলে জানলাগুলো যেমন আজ। হয়ত
কারো ইচ্ছে হয়েছিল বাইরে তাকাবার, হয়ত তরুণতর কর্মচারিদের কেউ বন্ধুকে দেখাতে
চেয়েছিল কলেজ থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েদের দলটা অথবা হয়ত কেউ পানের পিক ফেলার জন্য
খুলেছিল (জানলার নিচের চৌকাঠগুলি কফ আর থুথুর কালচে দাগে ভরে থাকে) তারপর বন্ধ
করতে ভুলে গেছে।
দুপুর পড়ে এলে বাইরের রাস্তার কোলাহল মাঝে
মধ্যে ভিতরে ঢুকে পড়ে জানান দিয়ে যায় যে দিন শেষ হতে চলল। দিনভর জ্বলতে থাকা বাল্বের
আলোগুলো ক্লান্ত আর ম্লান মনে হয়। দূরে কোনো কোনায় বহুক্ষণ ধরে চলতে থাকা একটা
কথার গুঞ্জন ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্পষ্টতর হয়ে উঠে হঠাৎ দমকা হাসির ধাক্কায় ফেটে পড়ে।
ঘর ভরে ঠাট্টামস্করার একটা পালা চলে কিছুক্ষণ। অমুকের পুংসত্ব নিয়ে সন্দেহ, অমুকের
বৌকে অন্যের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব, কাকে কোন গলির মোড়ে বেশি রাতে দেখা
গিয়েছিল, কাকে লাল্টুস বলে ম্যানেজার নিজের ঘরে বসিয়ে রাখে সারাদিন, তার প্যান্ট
খুলে দেখা যেতে পারে তার ‘কুমারীত্ব’ বজায় আছে কি না – ইত্যাকার কথার বাহক
শব্দগুলো, বছরের মার খেয়ে কালসিটে পড়া দেওয়ালে, টেবিলে, কাগজপত্রে, আলমারিগুলোয় আর
চোখেমুখে ঘষটা খেয়ে হারিয়ে যায়। নৈঃশব্দ আবার ভারি হয়ে নেমে আসে তারপর।
সে এখানেই কাজ করে তিন বছর হল। আপাততঃ এই ঘরে,
দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে। সামনে ধুলোটে জাবদা লেজারটা খোলা; এখনো কিছু কাজ বাকি।
উঠে দাঁড়াল সে। তার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে মনে
হবে, কিছু একটা এই মুহুর্তে তার করার আছে অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে। পেচ্ছাপ করতে গেল।
ছোট্টো জানলাটা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখল একটা বাস যাচ্ছে। সোনালি রোদে ঝকঝক করে উঠল
তার ছাদ। আবার উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার দুটো বড় ছায়া খেলল তার মুখে। বড় হলঘরটা পেরিয়ে
নিজের টেবিলে আসার সময় দেওয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। কাজের সময় শেষ হতে এখনো এক ঘন্টা
বাকি।
নিজের টেবিলে এসে সে খোলা লেজারটার দিকে
তাকাল। তারপর ম্যানেজারের ঘরের দিকে। আবার লেজারের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকাল। একটু
পরেই সহজ হয়ে উঠল তার মুখ। বদলটা সামান্য। কেউ বুঝল না মাঝের কয়েকটি মুহুর্তে ঢেউ
ভাঙা লবণাক্ত জলস্রোত বালির ওপর এগিয়ে গেল অনেকদূর, হয়ত এখানে এই ঘরটায় ঢুকে তার
গোড়ালি ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
লেজার ও দেরাজ বন্ধ করে সে ছিটকে বেরিয়ে এল
দপ্তর থেকে। অনুমতি দূরের কথা, কাউকে বলল না পর্যন্ত্য – এত বেশি ছিল তার ভিতরে
নিজের প্রতি ক্ষোভ।
সাইকেলটা নিল না যে! নাঃ, পরে এসে নেবে। তার
মন স্থির – এই তো কাছেই যাওয়ার। কাছেই তার এক বন্ধুর বাড়ি। ওখানে পৌঁছতে পারলেই
তার কাজ হয়ে যাবে।
বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
মুখটা ইষৎ ম্লান – যদি সত্যিই দেরি হয়ে গিয়ে থাকে? একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটা গলি।
চায়ের দোকান, মানুষজন, কিছু তার পরিচিত। কিন্তু আপাততঃ সে ভীষণভাবে আত্মমগ্ন, মাথা
নিচু, দাড়িতে হাত, লোকে বুঝবে নিশ্চই, তাকে অযথা ডেকে দেরি করিয়ে দেবে না।
যদিও এধরণের ব্যবহার, কেউ ডাকলেও এড়িয়ে
যাওয়া সে সহজে করতে পারে না। এক বিচিত্র মনস্থিতির জন্ম হয় তার ভিতর। ‘যদি কোনো
দুর্ঘটনা ঘটে? যদি কাল সকালে ও বা আমি আর না থাকি? একটা অপরাধবোধ থেকে যাবে। কিন্তু নাঃ এরকম চিন্তা করছি কেন? পরিচয়ের
বৃত্তের বাইরে কত মৃত্যু তো হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে! তারা সকলে আমারই বয়সের সাথে
যুক্ত এক অপরিচয়ের বয়স! যেন অস্তিত্বের শিরাউপশিরায় জড়িয়ে থাকা ছিন্ন অসমাপ্ত কিছু
শিরা।…’ বস্তুতঃ এধরণের চিন্তার কোনো
মাথামুন্ডু নেই। তবু এইসবই চিন্তা করে সে কষ্ট পেতে থাকে।
গলি পেরিয়ে আবার একটা রাস্তা। আকাশের আলো
কমছে। কুয়াশার একটা পাতলা স্তর নামতে শুরু করেছে শহরের ওপর। বাঁদিকে একটা
ক্যাম্পাসে ঢোকার গেট। এবার সে দৌড় লাগাল ভিতরে। ঠিক তখনইঃ-
-
আরে, তুই এখানে?
-
এখানে তো প্রায় রোজই আসি! আমার এক বন্ধু থাকেন সামনের
ফ্ল্যাটবাড়িটায়। তুই?
-
আর বলিস না। আমাদের কোম্পানির জোনাল ম্যানেজার থাকে এখানে।
একটু তেল লাগাতে এসেছি রে। প্রদীপটা, তুই চিনিস তো, কবে থেকে বলছে ওর ভাইয়ের একটা
চাকরি করে দিতে…। চল্, একটু চা খাই কোথাও বসে। অনেকদিন পর দেখা হল।
-
পাঁচ মিনিট দাঁড়া। বরং ওই সামনের চায়ের দোকানটায় বোস না
গিয়ে। আমি শুধু খোঁজ নিয়ে আসছি বন্ধুটি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলা
যাবে।
-
চল আমিও যাই!
-
না, না দরকার নেই, তুই বোস না গিয়ে! আমি এক্ষুণি আসছি।
সিঁড়ির কাছে পৌঁছে সে একবার আড়চোখে পিছনে
তাকাল। এতদিন পর দেখা হওয়া সহপাঠিটি একা একা রাস্তার দিকে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। একটু
লজ্জিত বোধ করল সে। কিন্তু উপায় নেই। সহপাঠিটি বুঝবে না তার উৎকন্ঠা। তিনতলায়
বন্ধুর ফ্ল্যাটটার কাছে আর দাঁড়াল না সে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল একেবারে ছাদে।
বিরাট ছাদ। দৌড়ে সে পশ্চিমের কার্নিশের কাছে গেল।
আঃ! সাফল্যের একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস তার
ফুসফুস নিংড়ে বেরিয়ে এল। আনন্দের অন্তরঙ্গ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ। না,
দেরি হয়নি তার। দূর অব্দি ছড়ান শহর – ফাঁকে ফোকরে গাছগাছালি। হর্নের আর ঘন্টির
আওয়াজ, কোলাহল নিচ থেকে উঠে আসছে। এক ঝাঁক শালিক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তাদের
কিচিরমিচিরের এক পশলা বৃষ্টি হল তার মাথার চুলে, কাঁধে, কোটের ভাঁজে। দূরে এক সার
বক শহর পরিক্রমা করে চলেছে। সামনের দুটো শিরিষ গাছের গা ভরা কূজন। একটা দলছুট টিয়া
অকস্মাৎ খুব নিচ দিয়ে উড়ে ডাকতে ডাকতে চলে গেল।
না, দেরি হয় নি। ওই তো তালগাছটার পিছনে এখনো
প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে লাল, এক্কেবারে গাঢ় লাল আজকের সূর্যটা। তৃপ্তিতে চোখ
বুঁজে এল তার। চরাচরে ব্যাপ্ত সন্ধ্যার গুঞ্জরণে অনুরণিত তাকে জড়িয়ে ধরল
সূর্যাস্তের বাতাস।
_________________________
No comments:
Post a Comment