বাবার মুখে আজ অব্দি এত জোরালো ‘না’ কখনো
শোনেনি সন্দীপ। তাই থতমত খেয়ে গেল। প্রশ্ন করতে পারল না ‘কেন’। ওদিকে সুচিত্রা
দেবীর মনে হল যে ‘না’টা হঠাৎ বেরিয়ে আসেনি। বেশ কিছুদিন ধরে দিব্যজ্যোতির চেহারা
দেখে ওনার মনে হচ্ছিল যে কিছু একটা গুমরে উঠছে ভিতরে ভিতরে।
প্রসঙ্গটা একজন নারীকে নিয়ে, তাই না চাইতেও ছেলে
এবং মা, দুজনেরই মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি দিল। আর দিব্যজ্যোতি, মনে মনে ওদের
মুশকিলটা বুঝতে পারা সত্ত্বেও নিজের কথাটা স্পষ্টভাবে বলতে প্রবৃত্ত হলেন না।
কেননা, সুচিত্রা দেবীর নিষ্পত্তিটা সঠিক ছিল যে ‘না’টা হঠাৎ বেরিয়ে আসেনি।
দিব্যজ্যোতি নাথ একটি সরকারি ব্যাংক থেকে
কিছুদিন আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। জেনারাল ম্যানেজার হয়ে অবসর গ্রহণ করলেও চাকরি
শুরু করেছিলেন কেরানি হয়ে। যদিও ওই একই সংস্থায় আজ তাঁর পুত্রও কর্মরত, তবে সে
কেরানি হয়ে ঢোকেনি। চার্টার্ড একাউন্টেন্টের পরীক্ষা পাশ করে সোজা স্পেশ্যালিস্ট
অফিসার ক্যাডারে ঢুকেছে, এখন হেড অফিসের
চেয়ারম্যান সেক্রেটারিয়েটে মেজোকর্তা।
ঘটনাটা যখনকার তখন দিব্যজ্যোতি নাথ একটা বড়
ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। একদিন সকালে কাজ শুরু হতেই শুরু হল গন্ডগোল। প্রথমে অধস্তন
অফিসারকে ডাকলেন কী হয়েছে জানতে। জানার পর মনে হল ব্যাপারটা জটিল। বুঝলেন যে তিনি
নিজে এখনই যেচে হস্তক্ষেপ না করলে অনেকখানি জল ঘোলা হয়ে তারপর তাঁর কাছে পৌঁছবে।
তাতে আদ্ধেক দিন বেরিয়ে যাবে। তাই নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে কর্মচারী সংগঠনের প্রতিনিধি
দু’তিনজনের কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলেন, “প্লীজ, আপনারা ভিতরে আসুন, আমার সাথে
কথা বলুন; বাকি সবাইকে বলুন কাজ শুরু করতে, প্লীজ! আমার ওপর ভরসা রাখুন, অন্যায়কে
প্রশ্রয় দেব না আমি। আসুন!”
কথায় কাজ হল। কিন্তু সমস্যাটা সত্যিই জটিল।
তাঁর ব্রাঞ্চেই কর্মরত একজন কেরানি, মোহিত
রায়। তার আগে থেকে একটা বিয়ে ছিল। বৌ আর দুই ছেলে থাকত গ্রামের বাড়িতে। এদিকে বড়
শহরে পোস্টিং হওয়ার পর থেকেই মনটা ছুঁকছুঁক করতে শুরু করেছিল। কাউকে বলেনি সে
বিবাহিত। কন্যাদায়গ্রস্ত বাপের তো আর অভাব নেই। চুপচাপ আরেকটা বিয়ে সেরে ফেলল।
অফিসের কয়েকজন এসেছিল। তারাও জানতো না যে মোহিত আগে থেকে বিবাহিত। চুলে রংটং
লাগায়, তা আর কী করবে, কোনো কারণে সময় মত বিয়ে হয়নি হয়ত! এর বেশি তারা জানতেও চায়
নি।
ওদিকে দুমাস পর খবর পৌঁছল মোহিতের আগের
শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। আগের পক্ষের বৌ, দুই ছেলে আর বৌয়ের কাকা রওনা দিতেই খবরটা
পেয়ে গেল মোহিত। ছুটির দিনে নতুন বৌকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ছল করে বেরিয়ে তাকে
“এক্ষুণি আসছি” বলে দাঁড় করিয়ে দিল ঠিক বেশ্যাপাড়ার মুখে। তারপর হাপিশ হয়ে গেল।
মহিলা এশহরে নতুন। কিছুই চেনেন না। একটু
পরেই পাড়াটার হালচালে সন্দেহ হতে শুরু করল তাঁর। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নিজের
আতঙ্কটা কাটানোর চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছু ভেবে পাচ্ছিলেন না। একঘন্টা কেটে গেছে।
সন্ধ্যা নামছে। কয়েকজন গায়ে ঘেঁষে জোরজার করতে শুরু করল।
তখনই দেবদূতের মত এসে পৌঁছল তার স্বামীর
অফিসেই কর্মরত একজন যুবক। “একি, বৌদি! এখানে দাঁড়িয়ে? মোহিতদা কোথায়?” বলতে বলতে হাত
ধরে টেনে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল, “ব্যাপার কী, বলুন তো?” মহিলা আর সামলাতে
পারলেন না নিজেকে। একটা বন্ধ দোকানের দুধাপ সিঁড়িতে, নোংরায় ধপ করে বসে পড়ে
কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
সব শুনে দিব্যজ্যোতিবাবু থ’ মেরে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর মুখ দিয়ে বেরুল, “তারপর?”
সংগঠনের ব্রাঞ্চস্তরের নেতা আর নন কিন্তু
সর্বজনশ্রদ্ধেয় অগ্রজ একজন ছিলেন চেম্বারে আলোচনারত প্রতিনিধিদের মধ্যে।
সেক্রেটারি তাঁর দিকে আঙুল দেখাল। “এখন রবিদা’র বাড়িতে আছে।”
-
!
-
হিমাংশু ওনাকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছে।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা রইল চেম্বারে।
-
একি সিনেমা নাকি! এভাবে বিয়ে হয়? আর তাৎক্ষণিক দয়া-করুণা
হওয়া এক জিনিষ, বিয়ে অন্য জিনিষ …। আর…মোহিতবাবু এসেছেন?
-
নাঃ, এখন আসে! আমরা সবাই মিলে তো ওর বাড়িতেই গিয়েছিলাম কাল
রাতে! তবে ঢুকেছিলাম শুধু আমি আর সত্য। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম বৌ কই? বলল কিনা
বাপের বাড়ি গেছে! যখন চেপে ধরলাম তখন আলফাল বকতে আরম্ভ করল। মহিলার চরিত্র খারাপ।
নিজে নিজেই বেরিয়ে চলে গেছে, তাই ওকে বাপের বাড়ির কথা বলে চাপা দিতে হচ্ছে।
-
আর ঠিক তখনই ওর আগের পক্ষের বৌ, দুই ছেলে, খুড়শ্বশুর ঢুকল।
আর যায় কোথায়!…
-
লোকটাকে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল।
-
ঠিক কথা। এসব বিয়েটিয়ের সেন্টিমেন্টালিটিতে না ঢুকে…
-
হিমাংশু এত ইমোশন্যাল আর বোকা ছেলে জানতাম না তো!…ওর
ফ্যামিলিই তো রাজি হবে না… যখন দেখতে পাচ্ছি লোকটি একটা ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট করেছে
তখন পুলিশের কাছেই যাওয়া উচিৎ ছিল।
-
মহিলাকে পুলিশের হেপাজতেই সোপর্দ করতাম। কিন্তু হিমাংশু যখন
ওকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, কথা দিয়েছে, আর পেছপা হতে রাজি নয় তখন… তুই নিজেই বল না
হিমাংশু!
হিমাংশু বলতে গেলে সত্যিকারের বিবাহযোগ্য
পাত্র। রোজই কোনো না কোনো দিক থেকে ওর জন্য সম্বন্ধ আসে অফিসে। আর নিজে তেমনই
মুখচোরা। বলতে বলায় কালো উজ্জ্বল মুখটা ঘেমে উঠল। রবিদা জোর খাটালেন, “তোমাকেই
বলতে হবে হিমাংশু। সিদ্ধান্তটা তোমার। এই আমাদের সামনে যেমন, তেমনই তোমার বাবা
মা’য়ের সামনে আর বার বার নিজের সামনে দাঁড়াতে হবে তোমায়, যে কাজটা দয়াপরবশ হয়ে
করছ, নাকি…”
-
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে দিয়েই বলান। এসব নাটকীয় ব্যাপার
স্যাপারের স্ক্রীনপ্লে বলতে আমরা অভ্যস্ত নই। হিরোই হিরোর ডায়লগ বলুক। ভিলেন এলে
তার ব্যবস্থা করব। মোহিত রায়ের রক্তআমাশায় ভিলেনের ডায়লগ বেরোবে।
হিমাংশুর কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেলেন
দিব্যজ্যোতিবাবু। নাঃ, এ তো খেলো সেন্টিমেন্টের ব্যাপার নয়! ভালো দৃঢ়তা আছে
ছেলেটির! বাইরে থেকে বুঝতে পারা যায় না।
কিন্তু, গন্ডগোলের জায়গাটা থেকেই যাচ্ছে।
এদের দাবী, মোহিত রায়কে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। এরা কেউ মোহিতের সাথে কাজ করতে
প্রস্তুত নয়। ওকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হোক অন্য কোথাও। মরুক শালা গিয়ে যেখানে
খুশি!
-
মোহিতবাবু এসেছেন?
-
বললাম তো, না। জানে, কী হবে এখানে এলে। তাই এখন ছুটিতে
থাকবে দু’চারদিন।
-
আচ্ছা আপনিই বলুন রবিবাবু। আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। আমার থেকে
সিনিয়র। এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারি আমি। সরকারি সংস্থা। আমি ওনাকে ডিমোট করতে
পারিনা। সাসপেন্ড করতে পারিনা। ট্রান্সফার করা তো দূরের কথা, ট্রান্সফার রিকমেন্ডও
করতে পারি না। কিছু করতে গেলে কারণটা দিতে হবে। আর কারণটা দিলেই আইনগত কিছু দিক
চলে আসবে। অফিসের কোনো ব্যাপার তো নয়। সামাজিক ব্যাপার। যদি অন্য কোনো ভাবে ওনার
ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করিও, উনি তো থাকবেন
আমাদেরই সমাজে!… সে থেকে তো বরং ওনার এখানে আপনাদের মধ্যে থাকাটাই ওনার পক্ষে
সবচেয়ে বড় শাস্তি। প্রত্যেকে জানবে ওনার কুকীর্তির বিষয়ে। কেউ কথা বলবেনা ওনার
সাথে। একসাথে টিফিন করবেনা। চা খাবেনা। আমার তো মনে হয় কিছুদিনের মধ্যে উনি নিজেই
ট্রান্সফার চাইবেন। তখন সঙ্গে সঙ্গে ওনাকে কোথাও পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব! কী
বলেন!
আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা রইল চেম্বারে। তবে
কেউ প্রতিবাদ না করায় দিব্যজ্যোতিবাবু বুঝলেন সবাই বুঝতে পারছে পরিস্থিতির
জটিলতাটা।
-
তা’ হিমাংশুর সাথে ওই মহিলার বিয়ে হবে কবে?
-
মহিলার বাড়িতে খবর দিয়েছি।
-
কী বললেন?
-
এসব ব্যাপার তো আর ফোনে বলা যায় না। তাই, বললাম ওনাদের
জামাই মোহিত রায়ের বড় অসুখ। মেয়েই ফোন করে জানাতে বলেছে।
-
কবে আসবেন ওনারা?
-
আজ দুপুর নাগাদ।
-
আর হিমাংশুর বাড়ির লোকেরা কী বলছেন?
-
বাড়ি সায় দেয় নি। মনে হয় না কেউ আসবে।
-
ওনারা জানেন, পুরো ব্যাপারটা?
-
হিমাংশু নিজেই ফলাও করে বলে এসেছে।
-
হুম!… হিমাংশুর বাড়ির লোকেদেরও দোষ দেওয়া যায় না। তা’
বিয়েটা ফাইনালি হবে কবে?
-
আগামীকাল।
-
আগামীকাল? কোথায়?
-
রবিদার বাড়িতেই। সন্ধ্যাবেলায়। রেজিস্ট্রার আসবেন। একটু
গাঁইগুঁই করছিলেন পুরো গল্পটা শুনে। সত্যর পরিচিত। তাই শেষে রাজি হলেন।
-
পুরুতও আসবে। মন্ত্রটন্ত্রও পড়া হবে। মহিলার পরিবারের দিকটাও
তো দেখতে হবে।
-
আমিও চেষ্টা করব আসতে। র্যাদার, আসবই। (হেসে) যদিও এখনো
হিমাংশু আমাকে নেমন্তন্ন করেনি। কী বলেন রবিবাবু, আসব তো? আর ওই বেহায়াটাকেও
নেমন্তন্ন করুন। একটু তো বুঝুক, পশুতে আর মানুষে ফারাকটা কোথায়!
* * * *
এই মুহুর্তে রাতের খাবার টেবিল থেকে উঠতে
উঠতে হঠাৎ দিব্যজ্যোতিবাবুর মনে পড়ল যে সেই বিশেষ বিয়ের রাতে যাওয়ার আগে গল্পচ্ছলে
সুচিত্রাকে বিয়ের ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলেছিলেন।
“কে জানে কী বুঝেছিল। হয়ত মন দিয়ে শোনেও নি।
নিজের খেয়ালে ছিল। নাহলে, আজ এখন সন্দীপের কথায় আমার ‘না’ শুনে সুচিত্রার চোখদুটো,
কোনো দুর্ভাবনা আড়াল করার চেষ্টায় এত উদাসীন হয়ে যেত না। ছেলে তো সন্দেহ করছেই,
জয়ন্তীর সাথে আমার লটঘট, বৌও সন্দেহ করছে। বাঃ! কিন্তু চেপে ধরবেও না। ভাবটা যেন,
পুরূষমানুষ তো এমন হবেই!”
“কিন্তু”, দিব্যজ্যোতিবাবু ভাবলেন, “তাহলে,
তার দশ বছর পর? যখন জয়ন্তী মাঝে মধ্যেই আমার কাছে আসত? তখন সুচিত্রা সন্দেহ করে নি
কেন? না কি করেছিল কিন্তু বলেনি কিছু! বোঝা মুশকিল!”
জয়ন্তী আর হিমাংশুর বিয়ের বারো বছর ভালোই
কেটেছিল। দিব্যজ্যোতিবাবু তখন জবলপুর, চেন্নাই ঘুরে পর পর আরো দুধাপ উঁচু প্রমোশন
পেয়ে এই শহরে ফিরে এসেছেন। তবে ব্রাঞ্চে নয়, আদ্ধেক প্রদেশের হর্ত্তাকর্তাবিধাতা
হয়ে আঞ্চলিক অফিসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নতুন চেম্বারে। নতুন গাঢ় পর্দা, নতুন
ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ড, নতুন কার্পেট। কম্পিউটার তখন সদ্য এসেছে, বড়কর্তারাই পেয়ে
থাকেন। যদিও নতুন বড়কর্তা দিব্যজ্যোতি নাথ ঘোর সন্দেহের চোখে দেখেন ওই নতুন
জিনিষটিকে। একটা অপরিচিত আসন্ন যুগের মায়াবী প্রতিনিধি যেন।… মাঝে মধ্যে তাঁর
অধস্তন এক তরূণ অফিসার যখন পিসিটা খোলা রেখে চলে যায়, হঠাৎ রহস্যময় ভাবে ভেসে ওঠে
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মুখ আর তাঁর কিছু ড্রয়িং। পরে জেনেছেন ওটাকে স্ক্রিন সেভার
বলে।
একদিন নিজের এক্তিয়ারের ব্রাঞ্চগুলোর
দায়িত্বে কোথায় কে আছে, কী করছে সে বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। অফিসারের মুখে মোহিত
রায় নামটা শুনেই পুরোনো প্রসঙ্গ মনে পড়ে গেল।
-
কোন ব্রাঞ্চে?
-
……
-
আপনারা জানেন ওর কীর্তি?
-
জানি স্যার।
-
আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্কাউন্ড্রেলটা জেলে নেই, বহাল তবিয়তে
ব্যাংকে ম্যানেজারি করছে।
মোহিত রায়ের ব্রাঞ্চে
ভিজিটে গিয়ে দেখা হল তার সাথে। কাগজপত্র দেখে স্পষ্ট বুঝলেন লোকটা দুর্নীতি করছে,
কিন্তু ধরা পড়ার কোনো জায়গা রাখে নি। কাগজের দিকে চোখ রেখেই কথায় এগোলেন।
-
তারপর, মোহিতবাবু? আবার বিয়ে করেছেন নাকি? আরেকজন কাউকে?
-
কী যে বলেন স্যার!
-
না, মানে এখনও তো আপনি সেই একাই। বৌ ছেলে মেয়ে শহরে। মন
উসখুস করতেই পারে!
-
একবার ভুল করে ফেলেছিলাম স্যার! মেয়ের বাপ এমন করে হাতে
পায়ে ধরেছিল! আমার বয়সটাও ছিল কাঁচা। আর তখন তো বুঝিনি মেয়েটার স্বভাবচরিত্র এমন
যে আমাকেই ডোবাবার ব্যবস্থা করবে।
-
মেয়েটার স্বভাবচরিত্র?
-
হ্যাঁ স্যার! বাড়ি থেকে বেরুলো আমার সাথে আর মাঝরাস্তায় বলে
কিনা তুমি কেনাকাটা করে এস, আমি এই দোকানটায় একটু বসছি! আমি ভাবলাম বসে শাড়ি দেখবে
হয়ত! ছেড়ে এগিয়ে গেলাম আর হারামজাদি সুড়সুড় করে বেরিয়ে অন্য পথে হাঁটা দিল! গিয়ে
নিজের নাগরের অপেক্ষা করতে লাগল, তাও আবার ভরসন্ধ্যাবেলায় বেশ্যাপাড়ার মোড়ে?”
হতভম্ব হয়ে
দিব্যজ্যোতিবাবু মুখ তুলে তাকালেন, “এত বড় একখানা মিথ্যে আপনি এতদিন ধরে সাজিয়ে
গুছিয়ে রেখেছেন! থানাপুলিস হলে এ্যালিবি! এতটুকু চক্ষুলজ্জা নেই?”
-
না স্যার, আপনি বড় সাহেব, যা শাস্তি দেবার দিতে পারেন,
কিন্তু একবর্ণ মিথ্যে বলছি না। সে তো হিমাংশু এসে পড়ল। মাগী একটা নতুন জোয়ান মরদ
পেয়ে গেল, ধরে ঝুলে পড়ল। আমার তো কষ্ট হয় হিমাংশুর দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে।… আর, এই
তো, পাশের গ্রামেই আমার শ্বশুরবাড়ি, এই ব্রাঞ্চের সার্ভিস এরিয়ায় পড়ে। চলুন না,
একবার ভিজিটের নামে একটু পায়ের ধুলো পড়ুক ও বাড়িতে!
তার কিছুদিন পরেই এক বিকেলে হিমাংশু এসে
হাজির। বারো বছরে একি চেহারা হয়েছে ওর! কোথায় গায়ে গতরে বিয়ে, চাকরি এসবের জল
লাগবে তা না শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে শরীর; আর একটা রুগ্ন ভাব চোখেমুখে। তাই কিছুক্ষণ
হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। ওর নমস্কারে সাড়া দিতেও ভুলে গেলেন।
-
কী হয়েছে তোমার হিমাংশু? বড় কোনো অসুখ হয়েছিল? তোমাদের
ব্রাঞ্চেও গিয়েছিলাম একদিন, সেদিন তুমি আসো নি। রবিবাবু তো রিটায়ার করে গেছেন। সে
যাক! তোমার স্ত্রী কেমন আছেন বল। আর তোমাদের ছেলে মেয়ে। ক’টি?
-
একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি স্যার!
-
বল, বল!
-
জয়ন্তী ভালো আছে স্যার। আমাদের দুটো ছেলে। একটা ফোরে আর
একটা এই সদ্য কেজিতে গেছে।
-
(একটু ইতস্ততঃ করে) তোমাদের মধ্যেকার…মানে রিলেশনশিপ…
-
আপনার অধিকার আছে প্রশ্ন করার, স্যার। হেসিটেট করার দরকার
নেই। সেদিক দিয়ে খুব ভাগ্যবান আমি। আমি তো ঠাট্টা করে বলি জয়ন্তীকে যে মোহিতের ওপর
সেদিন শয়তান নয়, স্বয়ং ভগবান ভর করেছিলেন। ও বিয়ে না করলে জয়ন্তীকে আমি জানতামও
না। আর ভরসন্ধ্যেবেলা ওই রাস্তার মোড়ে দাঁড় না করালে পেতামও না। … জানেন, সেদিন
সন্ধ্যেবেলায় যখন জয়ন্তী সিঁড়ির ওপর বসে কাঁদছে আর আমি ভাবছি কী করা যায়… তখন একটি
মহিলা, জানিনা ও কোথায় ছিল আর কতক্ষণ ধরে দেখছিল জয়ন্তীকে, গলি থেকে বেরিয়ে এগিয়ে
এল আমাদের দিকে। আশ্চর্য, সোজা বলল, ‘সোয়ামী ফেলে পালিয়েছে তো? এই হয়। পালাতে
পারলে পালা এক্ষুণি। দেরি করলে দাগী হয়ে পড়বি। আপনি ওর সোয়ামির বন্ধু?’ আমি মাথা
নাড়লাম। কিছু বলল না। পানের পিক ফেলে চলে গেল। আমার, ওই পানের পিক ফেলাটাই থুতু
ছেটানোর মত মনে হল।
-
ওর চোখে পুরুষজাতটাই এক।
-
(কিছুক্ষণ চুপ থেকে) জয়ন্তীর আসার কথা ছিল হয়ত আমারই জীবনে।
এই যে একটু অন্যভাবে পেলাম। আর, আমার যা মনে হয়, ও নিজেও এত বছরে ওই কয়েকদিনের
দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
-
তোমার বাড়ির…
-
বাড়ির লোকেরা, মানে মা-বাবা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন। এসে
আমাদের আশীর্বাদ করে গেছেন। তবে জয়ন্তীকে নিয়ে দু’একবার গিয়ে দেখেছি একটা
অস্বস্তিকর অবস্থা হয়, একটু দূরে দূরে রাখা, তার ওপর এদিকওদিকের কৌতুহল… তাই আজকাল
একাই যাই ওবাড়িতে। খোঁজখবর তো রাখতেই হয়, দুজনেরই বয়স হয়েছে, ওষুধপত্র টুকিটাকি
কিনে দিয়ে আসা… যেটুকু পারি করি।
-
(একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে) তোমাদের বিয়ের দুদিন আগে আমার
চেম্বারে তুমি যেভাবে নিজের পক্ষটা রেখেছিলে, আই ওয়জ এমেজ্ড্ বাই দ্য ডেপ্থ অফ
ইওর পার্সোনালিটি। সেদিনই আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে তুমিই পারবে ওই মেয়েটিকে নতুন
জীবনে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু… কী প্রয়োজনের কথা বললে?
-
আমার… একটা অসুখ হয়েছে স্যার। বড় অসুখ।
-
!
-
লিভারে। সিরোসিসের দিকে যাচ্ছে।
-
!! বাবা-মা জানেন?
-
না। বললে সমস্যাটার কোনো সুরাহা হবে না, বরং কিছু নতুন
সমস্যার সৃষ্টি হবে।
-
ভুল করছ। নতুন সমস্যার সৃষ্টি না হয় তার ব্যবস্থা কর,
বন্ধুদের সাহায্য নাও, কিন্তু না বললে কাল আরো বড় সমস্যার জায়গা তৈরি হবে তোমার
স্ত্রী’র জন্য। ভেবে দেখ।
-
ভেবে দেখছি। মনে হচ্ছে ঠিক বলছেন আপনি।… সে যা হোক, মোদ্দা
কথা যে মিথ্যে আশা পুষে রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। (একটা ছোট্টো দীর্ঘশ্বাস
আটকে) আমি চলে গেলে জয়ন্তী যাতে পথে না বসে সেটা আপনাকে দেখতে হবে। দেখবেন?
-
(কিছুক্ষণ সময় নিয়ে) দেখব। কথা দিচ্ছি দেখব। তবে, বাই দি
ওয়ে, জেনে রাখতে চাই, ওর বাপের বাড়ির কেমন সম্পর্ক তোমাদের সাথে?
-
খুবই ভালো। ওনারা তো আমায়, মানে বুঝতেই পারছেন, পুরো ঘটনাটা
জানার পর এককথায় মাথায় করে…! কিন্তু খুবই দুঃস্থ, নইলে মোহিতের বয়সী একটা পাত্রের
হাতে আগুপিছু না বিচার করে মেয়ে তুলে দিতেন না।
-
তোমার স্ত্রীর বয়স কত এখন?
-
আমার থেকে দু’বছরের মত বড়। মানে আটত্রিশ ধরুন।
-
কী পাশ?
-
হায়ার সেকেন্ডারি। গ্র্যাজুএশনের জন্য নাম লিখিয়ে দিয়েছি।
মাঝে মধ্যে বসে পড়াইও। তবে সংসারের চাপ…
-
দেখব আমি নিশ্চয়ই। তবে তোমাকে বলি ভালো করে চিকিৎসা করাও।
ক্যান্সার শুনলেই চিকিৎসার অসাধ্য মনে করার কিছু নেই। অফিস থেকে তোমার যা প্রাপ্য,
সে ছাড়াও যদি বিশেষ কোনো সাহায্যের দরকার হয়, টাকার দরকার হয় বিনা দ্বিধায় আমাকে
বলবে। ঠিক আছে?
-
(মুচকি হেসে) ভেঙে পড়ার মত মানুষ আমি নই স্যার। সংগঠন করি। সংগঠনেই
আমার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। রবিদা বললেন, “নাথসাহেব যেদিন ব্রাঞ্চে এসেছিলেন,
তুই তো সেদিন ছুটিতে ছিলি। আমরা তো যাবই, কিন্তু উনিই যখন জোনের বড়কর্তা, তুই নিজে
পার্সোনালি একবার যা।”…আর আপনাকে আলাদা করে কাছের মানুষ মনে করি বলেই প্রয়োজন বলতে
নির্দ্বিধায় চলে এলাম। নইলে আসতাম না।
নানা রকম চিকিৎসা সত্ত্বেও হিমাংশু মারা গেল
এক বছরের মধ্যে।
অফিসের ডেকোরামে একটা সীমার বাইরে সৌজন্য
দেখালেও সমস্যা। তাই দিব্যজ্যোতি নাথ খোঁজখবর নিয়ে রবিবাবুকে ফোন করে ডাকলেন
একদিন। ভদ্রলোক অবসরগ্রহণের পর ইষৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবু তাঁকে নিয়েই অফিসের
গাড়িতে হিমাংশুর বাড়ি গেলেন।
-
আপনার চাকরিটা হয়ে যাক, আমরা চাই। কিন্তু তার জন্য
গ্র্যাজুএশনটা করে নিলে ভালো হয়। সংসারের ঝক্কি সামাল দিতে দিতেও লেখাপড়াটা চালিয়ে
যান। রবিবাবুরা আছেন, ওনারা সাহায্য করবেন। আমি শুধু এটুকু বলতে এসেছি যে যদি কখনো
কোনো প্রয়োজন বোধ করেন, নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারেন। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি
বহুকাল। তবে একসময় টিউশনি করেছি তো, কিছু কিছু বিষয় আমিও বুঝিয়ে দিতে পারব মনে হয়।
এক রবিবারে জয়ন্তী ফোন করল। এল বিকেলের
দিকে। ছেলেদুটোকে দিব্যজ্যোতিবাবু ড্রাইভারের হেপাজতে দিয়ে জয়ন্তীর বইগুলো নিয়ে
বসলেন। সুচিত্রা এলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একটু পরে চাকরের হাত দিয়ে চা বিস্কুট
পাঠিয়ে দিল সুচিত্রা। ছেলে সন্দীপ কোচিং থেকে ফিরে বাইরে বাচ্চাদুটোকে পেয়ে ওদের
নিয়েই মশগুল হয়ে গেল।
এরকমই পাঁচছয় বার। জয়ন্তী ভোঁতা ছিল না। কিন্তু,
ওর অসুবিধে ছিল মন বসানোয়। প্রথম বিয়েতে প্রতারণা, দ্বিতীয় বিয়ের সুখশান্তির
ক্ষণস্থায়িত্ব, হিমাংশুর বাড়ির এমনিতেই আপত্তি ছিল, তারপর ছেলের অকালমৃত্যুতে ওদের
চোখে একেবারে অভিশপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল জয়ন্তী। পরে দিব্যজ্যোতিবাবু বুঝেছিলেন, তাঁর
কাছে আসাটা পড়া বোঝার জন্য ঠিক নয়। রবিবাবুর কথায় ওর মনে হয়েছিল বড়সাহেবের কাছে
মাঝে মধ্যে গিয়ে তদবির করা চাকরি পাওয়ার জন্য জরুরি। গ্র্যাজুয়েশনটা করা আর হলনা। হায়ার
সেকেন্ডারির ভিত্তিতেই যা হোক, চাকরিটা হয়ে গেল। তাতেও দেরি হল দু’বছর। কেননা
মামলা ঠুকে দিয়েছিল হিমাংশুর ছোটো ভাই।
একদিন তো দিব্যজ্যোতিবাবু রীতিমত রেগে
উঠেছিলেন। “কী হচ্ছেটা কী? গত রোববারেও বলেছিলাম এই তিনটে প্রিন্সিপ্ল মুখস্ত করে
নাও। বুঝতে পারলে বোঝো। না পারলে মুখস্ত রাখো। একটাও বলতে পারছ না!”
-
আমি পারব না স্যার! আগেও বলেছি…
চোখের জল মুছতে শুরু করে দিল জয়ন্তী।
-
চাকরি করবে কী করে? ছেলেদুটোকে মানুষ করবে কী করে?…
হিমাংশুকে কথা দিয়েছি আমি।
তখনি সুচিত্রা ঢুকেছিল ঘরে।
-
ছেড়ে দাও। একজন বয়স্ক মহিলাকে অত বকাবকি করে পড়া মুখস্ত
করানো যায়? উনি হয়ত সত্যিই পারছেন না। আর তুমি তো বলেছো যে পাশটা না করলেও ওর
চাকরি হয়ে যাবে।
-
হয়ে যাবে। কিন্তু করতে তো হবে প্রতিদিন! একটু এটেন্টিভ না
হলে তো কোনোদিন চাকরিটাও খোয়াবে! হয়ত আমাকেই সেদিন সাইন করতে হবে চিঠিটা!
না, সেরকম কোনো চিঠি সাইন করার আগেই চাকরি
থেকে অবসরগ্রহণ করলেন দিব্যজ্যোতিবাবু। জয়ন্তীর কাজের খবর নিতেন ব্রাঞ্চের
ম্যানেজারের কাছে ফোন করে। মাঝে মধ্যে বড় রকমের ভূলভাল করত জয়ন্তী।
দিব্যজ্যোতি নাথ মাথার ওপর থাকায় বেশি কিছু হয় নি কোনোদিন।
আর আজ, আট বছর পর তাঁর ছেলে তাঁর জায়গায়
পৌঁছে প্রথম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জয়ন্তীকে বর্খাস্ত করার। ভূলটা সত্যিই বড় রকমের।
জয়ন্তী দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
* * * *
সকালে সন্দীপই চেপে ধরল বাবাকে, “তুমি কাল
রাতে ওভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন? তুমি যেখানে ছিলে, আমি আজ সেখানেই আছি। তুমিই
বল এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে? নিয়ম কী বলে? ইন্সটিটিউশনের ইন্টারেস্ট কী বলে? আর
সবচেয়ে বড় কথা, আমার হাতে তো কিছুই নেই। নিচের থেকেও রিকমেন্ডেশন রয়েছে, ওপর
থেকেও, মানে ভিজিলেন্স থেকেও ওই একই ডিরেকশন। তুমি থাকলে, তোমার হাতেও কিছু থাকত
না।”
ছেলে যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে বাবাকে যে একমাত্র
ব্যাক্তিগত কিছু ব্যাপার না থাকলে মুখ থেকে ‘না’টা বেরোতে পারে না।
দিব্যজ্যোতিবাবুর মুখ থেকে তাঁর নিজেরই চিন্তার জেরটা যেন বেরিয়ে এল, “আছে।
ব্যক্তিগত ব্যাপারটাই আছে। আমাদের সময়ে প্রতিটি স্টাফের সাথে এই ব্যক্তিগত
ব্যাপারটা আমরা রাখতাম। নিয়ম কানুন এখনও মানা হয় না সব ক্ষেত্রে। তবে ক্ষেত্রটা পালটে
গেছে। এখন আর এটা ভাবার মত কেউ নেই যে একজন সদ্যবিবাহিত বৌ যখন সন্ধ্যাবেলায়
বেশ্যাপাড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আশেপাশের মাতালদের হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাঁচাবার
চেষ্টা করতে করতে বুঝতে পারে যে কত বড় এক প্রতারণার শিকার তাকে হতে হয়েছে, ভাবতে
চেষ্টা করে যে তার কী হবে এবার – তখন মানুষের মুখে দেবতা আর কুকুরের মুখ একাকার
হয়ে যায়। মেয়েটি পারে না, হয়ত সারা জীবনে আর কখনো মানুষের মুখটাকে আলাদা করতে পারে
না। বার বার তারা হয় দেবতা নয়ত কুকুর হয়ে যায়। কেননা সে যে নিজেরই মনুষ্যজন্মের
ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে না কিছুতেই!”
সন্দীপ বা সুচিত্রা কেউই বুঝতে পারে না
দিব্যজ্যোতিবাবুর কথাগুলো। দিব্যজ্যোতিবাবু নিজেও বুঝতে পারেননা। মাথায় শুধু
জয়ন্তীর নিভে যাওয়া চোখদুটোর ভোঁতা দৃষ্টি ফিরে আসতে থাকে। ম্লান হেসে বলে ওঠেন, “আর
নিয়তিও এমন যে কুকুরগুলো শাস্তি পায় না! না, কিছুতেই না। আমি নিজেই কথা বলে দেখি
কী করা যায়। ওর ছেলেদুটো এখনও দাঁড়াতে পারে নি। আর তার থেকেও বড় কথা ওই ব্রাঞ্চের
ম্যানেজার এখন মোহিত রায়!”
No comments:
Post a Comment