Sunday, May 16, 2021

মই

         

        পঁচিশ টাকায় একটা পনেরো ফুট সাবুত মই! বাঁশঘাটে যাও, বাঁশ পছন্দ করে ওখানেই তৈরি করাও, সাইকেলের হাতল বাঁহাতে ধরে ডান হাতে ঝুলিয়ে চলে এস বাড়ি। উঠোনে দাঁড় করিয়ে ছোটো ছাতটার গায়ে লাগাও। এবার লম্বা তার জুড়ে টেবিল ল্যাম্পটা নিয়ে যাও ছাতে।

ব্যাস! এত সহজ! এক ধাপে ছিনিয়ে নিলে আকাশের তারা, কবিতার সময়, এঙ্গেলসের ডায়ালেক্টিক্স অফ নেচার, রেকর্ডে অ্যাকার বিল্কের ক্ল্যারিওনেট, আর জীবনে যে এখনো আসেনি সেই নারীর মুখ! অথচ, এত দিন লাগল এটুকু কাজ সারার দিনটা বার করতে। একবছর হয়েছে ধানবাদ থেকে ফিরেছি।

এবার তুমি রাজা। কতখানি রাজত্ব তোমার?

তা তো পায়ে হেঁটে মাপতে হবে টলস্টয়ের গল্পের সেই চাষীটির মত। সাবধানে হেঁটো, পা পুড়িয়ে দিতে পারে সদ্যমৃত তারার অবশেষ, আবার সকাল হওয়ার আগে ফিরে আসতে না পারলে সব হবে অদৃশ্য।…

যাই মা ডাকছে খেতে।

………………………………

 

         মা ডাকছে খেতে। অথচ বন্যা আসছে,সকাল থেকেই খবর পাচ্ছি। ওই তো উইমেন্স কলেজের দেয়াল ভেঙে পোড়ো জমিটায় ঢুকছে জল। বেলা ন’টা নাগাদ মদনভৈয়া রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলে গেলেন, “খাটে ওঠালে হবে না। বড় জল আসছে। ঘর ডুবে যাবে। সব জিনিষপত্র ছাতে ওঠাবার ব্যবস্থা কর!”

প্রথমে চৌকির ওপর চৌকি রেখে ট্রাঙ্ক,স্যুটকেস উঠিয়ে ভাত খেতে বসেছিলাম। যখন দেখলাম ঘরের দরজা ছাপিয়ে উঠে আসছে তোড় তখন বুঝলাম কি সুক্ষণে কিনেছি মইটা। সব মাল উঠিয়ে, দুইবোন, মা আর বাবাকে উঠিয়ে নিজে যখন ছাতে উঠবো তখন উঠোনটা ভাসতে ভাসতে পেরোলাম। উঠে পশ্চিমে দেখলাম ঝিলের বুকে সুর্যাস্ত!

রাতে ঝড় এল। তার সাথে তুমুল বৃষ্টি। ডাঁই করে রাখা আমার বইগুলো কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে, সারাক্ষণ ধরে রেখে আমি একা বাঁচাই কী করে ভাবছিলাম। দেখলাম বাবাও হাত লাগাল। বিদ্যুৎচমকে বইয়ের ওপর চাদর টেনে বাবার ঝুঁকে থাকা শরীরটা… চকিতে দেলাক্রয়ের একটা ছবি! বাকি সব কিছুই ভিজল সারারাত।

পাশের বাড়ির ছাত হয়ে তার পরের বাড়িটায় গেলে দোতলায় একটা বাথরুম পাওয়া যায়। আবার সেই মইটাই কাজে লাগল ছাতে ছাত জুড়তে। মা বাবারা তো পুরোনো দিনের মানুষ! ভোর হওয়ার আগেই সেরে নেন ছোটো ছাতের আড়ালে গিয়ে। বেশির ভাগ মানুষ তাই করছে নিরুপায় হয়ে। দোতলা বাড়ি আর ক’টা! আবার ওই জলই বাল্টিতে উঠিয়ে ফিটকিরি দিয়ে রাখা! পরের দিন ভাত ফোটানো, জল খাওয়া! অ্যাঃ ছিঃ, তবু তাই চলল দশদিন।

জল একটু কমতে, নামলাম। একটু এগোতেই – ও ব্বাওয়া! এ তো সাঁতার কাটার ব্যাপার! আর আমি শুধু বিছানায় সাঁতার কাটতে পারি! তবু এগোলাম এর ওর তার ভেলা ধরে। পাড়া ছাড়তেই বিশাল যেন একটা বিল! মাঝে মধ্যে বাড়ির দোতলা, একতলার ছাতের কুমিরডাঙা আর গাছের শাখাপ্রশাখা-পত্রপুষ্প। তারই মধ্যে ভেলা ধরে ভাসতে ভাসতে তবু হাতের লাঠি দিয়ে পথটা ঠাহর করে চলা।…

শুকনো এলাকার বাজার থেকে গাড়ির পুরোনো দুটো টিউব কিনে হাওয়া ভরিয়ে, আর্মির একটা ঠাসা নৌকো ধরে ঝুলে ফিরলাম। আবার সেই মই। টিউবদুটো মইয়ের সাথে বেঁধে দুইবোনকে বসিয়ে পৌঁছে দিয়ে এলাম এক পরিচিতের বাড়ি। ওদিকে পুনপুনের বন্যা আসে, এবারে আসেনি।

পনেরো দিন পর নিচে নামা, ঘরদোর পরিষ্কার… কত পরিষ্কার করবে? দেয়াল থেকে ভকভক করে সারাদিন সারারাত পাঁকের গন্ধ, স্যাঁতস্যাঁত! কলেরার টিকে নেওয়াতে জ্বর, বাঁহাত ফুলে ঢোল… সবাইকে জোর করে পাঠিয়ে দিলাম জামশেদপুর। দু’রাত অনেক চেষ্টা করে ভুতের মত কাটালাম ওই পাঁকাল ঘরে, আর পারলাম না।

…………………………

 

কতদিন পর জল-পাঁক-সাপ-জোঁকহীন তেতলায় বন্ধুর বাড়িতে চা। এ বন্ধু আমার নামজাদা কবি। জিজ্ঞেস করলেন, মায়াকভস্কি পড়েছি নাকি! পড়িনি। বইটা এগিয়ে দিলেন। বললেন পড়ে শোনাতে আর মানে করে বোঝাতে – উনি ইংরেজি জানেন না নাকি বিশেষ! শুরু করলাম, ‘পাতলুনে মেঘ’!

মইটা কাঁচা বাঁশের ছিল। বন্যার ধকলে পচতে শুরু করেছে। কিন্তু ততদিনে পেয়ে গেছি আরেক বন্ধুকে। টিউশন পড়িয়ে, ‘জয়বমবম’ ঝুপড়িতে রাতের খাবার খেয়ে রাত দশটায় আসেন আমার সেই, এতদিনে শুকিয়ে ওঠা পাঁকাল ঘরে। প্রথমে কবিতা নিয়ে আলোচনা একঘন্টা। তারপর কিশোরি আমোনকর, আমীর খাঁ, রবিশঙ্কর-আলিআকবর বা বিঠোভেনের লা এম্পেরিওর… দু’ঘন্টা। তারপর বাইরে দিয়ে তালা লাগিয়ে স্টেশনে যাই, সারারাত খোলা চায়ের দোকানে। চা খাই।

যখন রাত চারটের সময় ফিরি, দেখি চাঁদে দাগ কেটে যাচ্ছে কয়েকটি পাখির রাতের উড়াল।

একদিন একটু বেশি দেরি হয়েছিল। বাড়ির মুখে দেখি বাবা উঠোনের দরজা খুলে বেরিয়ে দুধ আনতে যাচ্ছে। আমি মাথা চুলকে বললাম, “দাও না আমি নিয়ে আসি!” আর সত্যিই তো। আগে তো আমিই আনতাম। সেই ছোটবেলায়। আসলে আজকাল তো বেলা ন’টা অব্দি পড়ে পড়ে ঘুমোই। রাতের খামতিটা পোষাতে। তারপর অফিসে ছুটি। সে তো অবশ্য বাবাও অফিসে যায়!

 

গরমের দুপুর। অফিস কাট। বই পড়তে হলেই করি মাঝে মাঝে। মাইনে কাটা যায়। ব্রাদারস কারামাজভে আল্যোশা আর ফাদার জোসিমার কথোপকথনে আছি, ছোটো বোন কলেজ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।

-      দাদা, টোটনদাকে মনে আছে? স্যুইসাইড করেছে!

একবার অনেক আগে, আগের পাড়ায় আমাদের বন্ধুদের একটা আড্ডার ঘরের কথা মনে পড়ল। টোটন আমাদের বন্ধু ছিল না। মিঠুর ছোটো ভাই। একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর গিয়ে বসল। আমি জানতাম ওটা ভাঙা, সত্যি বলতে আমিই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম, বলিনি। বসল আর ঝপাস। আমরা হেসে উঠতে গিয়ে ওর মুখ দেখে থেমে গেলাম। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। উঠিয়ে দেখি প্যাকিং বাক্সের একটা খাড়া বড় পেরেক পেছনে ফুটে আছে। ধরে ধরে ওর মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে, শুইয়ে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। অথচ বলতে পারলাম না যে আমিই অপরাধী।

শেষ ওকে দেখেছিলাম নালা রোডে, পুজোর সময়, সন্ধ্যায়। একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে মাটির পুতুল সাজিয়ে বেচছে। শুনেছিলাম তখন ও একটি মেয়েকে ভালোবাসে।

আশ্চর্য, ফাদার জোসিমা আর আল্যোশার মাঝেই কী করে ঢুকল ওর স্যুইসাইড?  

……………………………

 

সে পাড়াতেই, ছোটোবেলায়, পুজোর দিন অষ্টমীর ভোরবেলায় দুধ নিয়ে ফিরছি, সামনের বাড়ির ছোটকাকার সাথে দেখা। “কী রে, রাতে যাস নি প্রোগ্রামে?”

-   গিয়েছিলাম তো!

-   এখনই তো আসল প্রোগ্রাম!

-   দূর! ওসব ক্লাসিকাল বুঝিনা। অর্কেস্ট্রা শুনে ফিরে এসেছি।

-   শুনবি তবে তো বুঝবি!

 

তখন সকাল হতেই এত হট্টগোল ছিল না রাস্তাঘাটে। অতদূরে প্রোগ্রাম। তবু একটা সুর ভেসে আসছিল। ছোটোকাকা এগিয়ে যাওয়ার পর আমিও পিছু নিলাম। রেললাইনটা পেরিয়েছি, হঠাৎ একটা সুর কানে এসে যেন স্ট্যাচু করে দিল। আস্তে আস্তে এগোতে থাকলাম সুরটার দিকে। রাতেই জেনেছিলাম আজকের রাতশেষের শিল্পী বিসমিল্লা খাঁ। সানাই। সানাই মানে বিয়ের নহবৎ! প্যাঁ ড়্যাঁ প্যাঁপ্প্যাড়্যাঁ প্যাঁ ড়্যাঁ…

কিন্তু এটা কী সুর? এত অসাধারণ ভালো লাগছে কেন? প্রোগ্রামের প্যান্ডালে পিছনের চেয়ারে বসে শুনছি আর ভাবছি। এরকম অবশ করে দিচ্ছে কেন? ক্লাসিকালও এরকম হয়?

পরে, অনেক পরে জেনেছিলাম ‘যোগী মত্‌ যা’। তখন বুঝলাম রেললাইনের কাছে কানে এসেছিলঃ-

‘অগুরু চন্দন কা… চিতা… চিতা রচাউঁ’

…………………………

 

মইটা পচে শেষ। পিছনে একটা কুমড়োলতা বেশ গজিয়ে উঠেছিল। বসিয়ে দিলাম তার পাশে। লতাটা জড়িয়ে দিলাম বাঁশে। মায়ের হাতে ফুলের বড়া খেলাম কিছুদিনে। ডগার চচ্চড়ি।

যখন বাড়িটা ছেড়ে অন্য ভাড়াবাড়িতে গেলাম তখন একটা বেহালা কিনেছি। রাতভর ঘ্যাঁ…কোঁ…। একদিন সকালে বাবা ঘরে এসে একটা স্বরলিপি দিয়ে গেলেন। প্রথম অনুশীলনের জন্য। জ্ঞান গোস্বামীর করা। মনে পড়ল বাবার ভাঙা সেতারটার কথা। দাস কোম্পানিতে দিয়ে এলাম লাউটা বদলে, মেরামত করে দিতে।

এবাড়িতে প্রথম বর্ষায় একমাস ছুটি নিলাম। শেষ করলাম ‘ধীরে বহে ডন’। একজন নতুন বন্ধু জুটেছেন। বয়সে বড়। শিল্পী। তাঁর সাথে যাই নিসর্গের গোপনে, তিনি আঁকেন, আমি লিখি। কখনো রাতে তাঁর স্টাডির সাবজেক্টও হই। একসাথে ক্যানভাস বাঁধি। তারপিন আর লিনসিডের তফাৎ বোঝান, আমি মাথা নাড়ি।

…………………………

 

আমি জানিনা মই নিয়ে শুরু করা কথা এভাবে এগোলো কেন। আর যদি শেষ করতে হয় তাহলে কোথায়? ততদিনে আরো অনেক উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান, ছবি, রাজনীতিচর্চা বন্ধুদের সাথে সারারাত…। একদিন তুমুল বিতর্ক, ঝগড়া তারপর একা, একদম একা। একা হলাম মনের আবেগে। যুক্তিগুলো খুঁজতে গিয়ে দেখি নতুন। বইয়ে নেই, রেকর্ডে নেই। বেহালা শিখে উঠতে পারিনি। কবিতা লিখছি, কিন্তু দাঁড়াচ্ছেনা।  

একদিন এক নতুন বন্ধু সংগঠনে কাজ করার ডাক দিল।    

 

সংগঠনের এক সহকর্মী। তার মুখে ক্যান্সার। কয়েকবার রেডিওথেরাপির পর গালটা পাতলা হয়ে দুটো ফুটো হয়ে গেছে। তবু সারেনি। চিকিৎসা চলছে। সকালে আমরা দু’তিন বন্ধু গেছি তার সাথে দেখা করতে। দেখি সে বাড়ির সামনে, গালে ফেট্টি বেঁধে হেলমেট চড়াচ্ছে। সামনে স্কুটার।

-   একি কমরেড! আপনি কোথায় চললেন?

-   পোদ্দারজীর বাবা মারা গেছেন শুনলাম!

-   হ্যাঁ, আমরা তো যাব ওখানে! বা দেরি হলে একেবারে ঘাটেই যাব।

-   বাঃ, আমি যাব না? চলুন!… আমি তো কাল বিকেলে জমায়েতেও আসতাম, কিন্তু এত খারাপ হয়ে পড়ল শরীরটা!

 


No comments:

Post a Comment