Labels
- Ajker dintar janya (10)
- Alokji's poems in English translation (6)
- Articles (116)
- Behar Herald (2)
- Bhinshohore (55)
- Biography (1)
- Engels (11)
- Hindi (48)
- Housing Question (10)
- Kedarnath Bandopadhyay (1)
- Krishak Sabhar Smriti (2)
- Lok Janwad (4)
- Magadher Sahitya (6)
- Meghsumari (155)
- Phire ese (170)
- Plays (10)
- Poems (462)
- Poems by Robin Datta (5)
- Priyo Pochis (8)
- Sanchita (1)
- Sirir mukhe ghor (20)
- sketches (6)
- Smritiprasanga (2)
- Somudro Dubhabe Dake (29)
- Song (1)
- Songs (7)
- Stories (51)
- Translations (88)
- Video (5)
- कौन थे इश्वरचन्द्र विद्यासागर (200वीं जन्मजयंती पर एक कर्मवीर की कीर्तिगाथा) (19)
Friday, May 28, 2021
পিন্ডদান
Wednesday, May 26, 2021
দেরী
প্রতিদিনের মত বিকেল গাঢ় হতেই সে ছটফট করে উঠল। নোংরা দাগধরা ঘরটায় দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎ এক উদ্দীপক বোধের সঞ্চার তাকে ঘুরে তাকাতে বাধ্য করল। সে দেখল জানলার বাইরে – দূরে বিজ্ঞান কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাতের কার্নিশে ডিসেম্বরের রোদ সোনালি হয়ে এসেছে। মুখটা তার বড় বড় পাতার ছায়ায় ভরে গেল।
যেখানে সে কাজ করে সে জায়গাটা একটা দোতলা
বাড়ির নিচের তলা। রয়েছে একটা বড় হলঘর, দুটো ছোটো ছোটো ঘর আর দুফালি বারান্দা। তার
মধ্যেই কর্মচারী গোটা পঞ্চাশেক। দুপুর অব্দি দেড়শ দুশ লোকের কোলাহলে ভরে থাকে
জায়গাটা। টিফিনের পর থেকে ছুটি অব্দি নিঃশব্দে কাজকর্ম চলে। জানলাগুলো বন্দ থাকে
সারাদিন, বিশেষকরে এই শীতকালে। কেননা ঠান্ডা হাওয়া দেয় খুব, আর অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ও
বৃদ্ধ কর্মচারিদের তাতে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয় থাকে। এবং অন্যান্য ঋতুতেও। গ্রীষ্মের
গরম শুকনো ধুলো হাওয়া, বসন্তের ও শরতের দ্রুত হাওয়াবদল তথা বর্ষার রোগসমূহ –
কোনোটাই দুর্বল দেহের পক্ষে সহ্য করা কঠিন।
তবু মাঝে মাঝে খোলে জানলাগুলো যেমন আজ। হয়ত
কারো ইচ্ছে হয়েছিল বাইরে তাকাবার, হয়ত তরুণতর কর্মচারিদের কেউ বন্ধুকে দেখাতে
চেয়েছিল কলেজ থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েদের দলটা অথবা হয়ত কেউ পানের পিক ফেলার জন্য
খুলেছিল (জানলার নিচের চৌকাঠগুলি কফ আর থুথুর কালচে দাগে ভরে থাকে) তারপর বন্ধ
করতে ভুলে গেছে।
দুপুর পড়ে এলে বাইরের রাস্তার কোলাহল মাঝে
মধ্যে ভিতরে ঢুকে পড়ে জানান দিয়ে যায় যে দিন শেষ হতে চলল। দিনভর জ্বলতে থাকা বাল্বের
আলোগুলো ক্লান্ত আর ম্লান মনে হয়। দূরে কোনো কোনায় বহুক্ষণ ধরে চলতে থাকা একটা
কথার গুঞ্জন ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্পষ্টতর হয়ে উঠে হঠাৎ দমকা হাসির ধাক্কায় ফেটে পড়ে।
ঘর ভরে ঠাট্টামস্করার একটা পালা চলে কিছুক্ষণ। অমুকের পুংসত্ব নিয়ে সন্দেহ, অমুকের
বৌকে অন্যের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব, কাকে কোন গলির মোড়ে বেশি রাতে দেখা
গিয়েছিল, কাকে লাল্টুস বলে ম্যানেজার নিজের ঘরে বসিয়ে রাখে সারাদিন, তার প্যান্ট
খুলে দেখা যেতে পারে তার ‘কুমারীত্ব’ বজায় আছে কি না – ইত্যাকার কথার বাহক
শব্দগুলো, বছরের মার খেয়ে কালসিটে পড়া দেওয়ালে, টেবিলে, কাগজপত্রে, আলমারিগুলোয় আর
চোখেমুখে ঘষটা খেয়ে হারিয়ে যায়। নৈঃশব্দ আবার ভারি হয়ে নেমে আসে তারপর।
সে এখানেই কাজ করে তিন বছর হল। আপাততঃ এই ঘরে,
দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে। সামনে ধুলোটে জাবদা লেজারটা খোলা; এখনো কিছু কাজ বাকি।
উঠে দাঁড়াল সে। তার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে মনে
হবে, কিছু একটা এই মুহুর্তে তার করার আছে অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে। পেচ্ছাপ করতে গেল।
ছোট্টো জানলাটা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখল একটা বাস যাচ্ছে। সোনালি রোদে ঝকঝক করে উঠল
তার ছাদ। আবার উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার দুটো বড় ছায়া খেলল তার মুখে। বড় হলঘরটা পেরিয়ে
নিজের টেবিলে আসার সময় দেওয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। কাজের সময় শেষ হতে এখনো এক ঘন্টা
বাকি।
নিজের টেবিলে এসে সে খোলা লেজারটার দিকে
তাকাল। তারপর ম্যানেজারের ঘরের দিকে। আবার লেজারের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকাল। একটু
পরেই সহজ হয়ে উঠল তার মুখ। বদলটা সামান্য। কেউ বুঝল না মাঝের কয়েকটি মুহুর্তে ঢেউ
ভাঙা লবণাক্ত জলস্রোত বালির ওপর এগিয়ে গেল অনেকদূর, হয়ত এখানে এই ঘরটায় ঢুকে তার
গোড়ালি ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
লেজার ও দেরাজ বন্ধ করে সে ছিটকে বেরিয়ে এল
দপ্তর থেকে। অনুমতি দূরের কথা, কাউকে বলল না পর্যন্ত্য – এত বেশি ছিল তার ভিতরে
নিজের প্রতি ক্ষোভ।
সাইকেলটা নিল না যে! নাঃ, পরে এসে নেবে। তার
মন স্থির – এই তো কাছেই যাওয়ার। কাছেই তার এক বন্ধুর বাড়ি। ওখানে পৌঁছতে পারলেই
তার কাজ হয়ে যাবে।
বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
মুখটা ইষৎ ম্লান – যদি সত্যিই দেরি হয়ে গিয়ে থাকে? একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটা গলি।
চায়ের দোকান, মানুষজন, কিছু তার পরিচিত। কিন্তু আপাততঃ সে ভীষণভাবে আত্মমগ্ন, মাথা
নিচু, দাড়িতে হাত, লোকে বুঝবে নিশ্চই, তাকে অযথা ডেকে দেরি করিয়ে দেবে না।
যদিও এধরণের ব্যবহার, কেউ ডাকলেও এড়িয়ে
যাওয়া সে সহজে করতে পারে না। এক বিচিত্র মনস্থিতির জন্ম হয় তার ভিতর। ‘যদি কোনো
দুর্ঘটনা ঘটে? যদি কাল সকালে ও বা আমি আর না থাকি? একটা অপরাধবোধ থেকে যাবে। কিন্তু নাঃ এরকম চিন্তা করছি কেন? পরিচয়ের
বৃত্তের বাইরে কত মৃত্যু তো হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে! তারা সকলে আমারই বয়সের সাথে
যুক্ত এক অপরিচয়ের বয়স! যেন অস্তিত্বের শিরাউপশিরায় জড়িয়ে থাকা ছিন্ন অসমাপ্ত কিছু
শিরা।…’ বস্তুতঃ এধরণের চিন্তার কোনো
মাথামুন্ডু নেই। তবু এইসবই চিন্তা করে সে কষ্ট পেতে থাকে।
গলি পেরিয়ে আবার একটা রাস্তা। আকাশের আলো
কমছে। কুয়াশার একটা পাতলা স্তর নামতে শুরু করেছে শহরের ওপর। বাঁদিকে একটা
ক্যাম্পাসে ঢোকার গেট। এবার সে দৌড় লাগাল ভিতরে। ঠিক তখনইঃ-
-
আরে, তুই এখানে?
-
এখানে তো প্রায় রোজই আসি! আমার এক বন্ধু থাকেন সামনের
ফ্ল্যাটবাড়িটায়। তুই?
-
আর বলিস না। আমাদের কোম্পানির জোনাল ম্যানেজার থাকে এখানে।
একটু তেল লাগাতে এসেছি রে। প্রদীপটা, তুই চিনিস তো, কবে থেকে বলছে ওর ভাইয়ের একটা
চাকরি করে দিতে…। চল্, একটু চা খাই কোথাও বসে। অনেকদিন পর দেখা হল।
-
পাঁচ মিনিট দাঁড়া। বরং ওই সামনের চায়ের দোকানটায় বোস না
গিয়ে। আমি শুধু খোঁজ নিয়ে আসছি বন্ধুটি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলা
যাবে।
-
চল আমিও যাই!
-
না, না দরকার নেই, তুই বোস না গিয়ে! আমি এক্ষুণি আসছি।
সিঁড়ির কাছে পৌঁছে সে একবার আড়চোখে পিছনে
তাকাল। এতদিন পর দেখা হওয়া সহপাঠিটি একা একা রাস্তার দিকে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। একটু
লজ্জিত বোধ করল সে। কিন্তু উপায় নেই। সহপাঠিটি বুঝবে না তার উৎকন্ঠা। তিনতলায়
বন্ধুর ফ্ল্যাটটার কাছে আর দাঁড়াল না সে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল একেবারে ছাদে।
বিরাট ছাদ। দৌড়ে সে পশ্চিমের কার্নিশের কাছে গেল।
আঃ! সাফল্যের একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস তার
ফুসফুস নিংড়ে বেরিয়ে এল। আনন্দের অন্তরঙ্গ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ। না,
দেরি হয়নি তার। দূর অব্দি ছড়ান শহর – ফাঁকে ফোকরে গাছগাছালি। হর্নের আর ঘন্টির
আওয়াজ, কোলাহল নিচ থেকে উঠে আসছে। এক ঝাঁক শালিক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তাদের
কিচিরমিচিরের এক পশলা বৃষ্টি হল তার মাথার চুলে, কাঁধে, কোটের ভাঁজে। দূরে এক সার
বক শহর পরিক্রমা করে চলেছে। সামনের দুটো শিরিষ গাছের গা ভরা কূজন। একটা দলছুট টিয়া
অকস্মাৎ খুব নিচ দিয়ে উড়ে ডাকতে ডাকতে চলে গেল।
না, দেরি হয় নি। ওই তো তালগাছটার পিছনে এখনো
প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে লাল, এক্কেবারে গাঢ় লাল আজকের সূর্যটা। তৃপ্তিতে চোখ
বুঁজে এল তার। চরাচরে ব্যাপ্ত সন্ধ্যার গুঞ্জরণে অনুরণিত তাকে জড়িয়ে ধরল
সূর্যাস্তের বাতাস।
_________________________
সুগন্ধী তেল
শেষ রক্তরাগ, রাজপথের খাড়া উঁচু গাছগুলির চুড়োয়। নিচে চৈত্রের অন্ধকার জড়িয়ে ধরছে গুঁড়ি। ছেঁড়া, ফ্যাকাশে কাপড়ে এক অতিশীর্ণ বৃদ্ধা, হাতে একটা পুঁটলি নিয়ে আসছিলেন; হঠাৎ হোঁচট খেয়ে ঠিকরে পড়ে গেলেন ফুটপাথের ওপর। ক্ষীণ ঝনঝন শব্দে শিশি বা কাঁচের জিনিষ ভাঙবার শব্দ শোনা গেল।
এগিয়ে কাছে যেতে
দেখলাম বৃদ্ধা উঠে বসেছেন আর কী যেন কুড়োচ্ছেন দ্রুত। ঝুঁকে অন্ধকারে তীব্র একটা
সুগন্ধ পেয়ে ঠাহর করে দেখলাম পাথরের ওপর তরল কিছু একটা ছড়ান। বুঝলাম তেল, সুগন্ধী
তেল। পাথরের খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে পড়ছে আর ধুলোয় শুষে যাচ্ছে। অদূরে রাস্তার আলোগুলো
জ্বলে উঠেছিল। আলো মানে সাবেক টাংস্টেন বাল্ব – ঘটনাটা ১৯৭৬এর। সে আলোয় চকচক করছিল
কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলি।
বৃদ্ধার বাঁ হাঁটু
কেটে গিয়েছিল। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল ফোঁটা ফোঁটা। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ না করে
তিনি হামলে পড়েছিলেন তেলের ওপর। দু’হাতে কাচিয়ে তুলছিলেন ওই মাটিমাখা তেল আর মাথায়
মুছে চলেছিলেন। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছিলেন কিছু। ব্যস্তভাবে হাত বাড়িয়ে
থামাচ্ছিলেন পাথরের খাঁজে খাঁজে বয়ে চলা তেলের ক্ষীণ ধারাগুলি। জরাগ্রস্ত দু’হাতের
ত্বক শুকিয়ে ফেটে আঁশ হয়ে গেছে – হাল্কা আলোয় তা তুষারের মত চকচক করছিল।
কী ঘটছে চোখের
সামনে দেখতে পেয়েও আমি অভ্যাসবশতঃ জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল?”
শরীর রুগ্ন, চুল
হলদেটে সাদা, সিঁথির কাছটা ফাঁকা – বৃদ্ধা মাথা না তুলেই বিড় বিড় করে উঠলেন, “খুব
দামী তেল ছিল! ঠান্ডা তিল তেল, পুরো এক টাকার।…সেই কোন
বাজার থেকে ফিরছি! কোথাও কিছু হল না আর এখানে এই ফাঁকা রাস্তায়…! চোখে দেখতে পাই
না ভালো করে। এত দামী তেল! অসুস্থ মানুষ!”
হাতদুটো একবারের
জন্যও তেল কাচানো থামায় নি। আমি ওনার পিছন থেকে পাথরটা (যেটায় হোঁচট খেয়ে বৃদ্ধা
পড়েছিলেন) তুলে পাশে ফেলে দিলাম। কাঁচের টুকরোগুলো দেখে দেখে তুলে মুঠোয় করে
রাস্তার কিনারে ফেলতে ফেলতে বললাম, “উঠে পড়ুন এবার। আর তোলা যাবে না ওই তেল। লাভের
মধ্যে হাতে কাঁচ ফুটে…”
আমার কথা শেষ না
হতেই উনি একবার শিউরে উঠে বাঁ হাতটা নিজের চোখের
সামনে আনলেন। দেখলাম করতলে একটা গভীর ক্ষত, তা থেকে রক্ত
আর তেলের বুদবুদ বেরিয়ে আসছে। কড়ে আঙুলের কাছে দেখা যাচ্ছে কাঁচের টুকরোটা। বৃদ্ধা
আমার দিকে এগিয়ে দিলেন হাতখানি। “দেখ তো, এখনো লেগে আছে নাকি কাঁচটা!” দিনের
ব্যস্ততায় কাউকে সময় জিজ্ঞেস করার মত করে কথাটা বলে প্রথমবার চোখ তুললেন।
সহজ ও স্থির দুটো চোখ।
অসহায়, কাতর বা অস্থির কোনো ভাব নেই। যেন এসব তো লেগেই আছে রোজকার!
ক্ষতস্থানে হাত দেবার আগে এক
মুহূর্তের দ্বিধা!… গরম রক্তের নিজস্ব একটা প্রভাব পড়ে শরীরে – একটা জান্তব শিহরণ
জাগে।
হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম ওনার, বসে থাকা ছোট্ট শরীরের কাছে
আসতে।
হঠাৎ মনে হল, জরা ও ব্যাধিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও কত দুর্মূল্য
এই রক্ত! এই ক’ফোঁটার মানে হয়ত নাতিটার রুজিরুটির কোনো ব্যবস্থা হল কিনা দেখে যেতে
পারা, কর্পোরেশন বস্তি ভেঙে দেওয়ার পরের মাঘী-রাত কয়েকটি টিঁকে দেখে যেতে পারা যে
নতুন কোনো ঘর খাড়া করা গেল কি না কোথাও!…
ক্ষতস্থানটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরখ করে বললাম, “না, কাঁচ নেই”। কড়ে
আঙুলের কাছে লেগে থাকা কাঁচের টুকরোটা ফেলে দিলাম। শেষে রক্তস্পর্শে জেগে ওঠা এক
দুর্বোধ্য আত্মীয়তার পুরো জোর খাটিয়ে বললাম, “অব উঠ্ যা মাই!” কিন্তু বৃদ্ধা কোনো
উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে আবার ঝুঁকে পড়লেন তেলের ওপর।
তাঁর মুখে কোনো কথা ছিল না। তবু ওই, মাথায় তেল বোলানো দেখে
মনে হল বৃদ্ধা যেন নিজের আশি বছরের, নানা অশান্তি ও দুর্যোগ ভোগা শরীরটাকে বলছেন,
“নে রে অলক্ষুণে নে! যেটুকু পারিস এর থেকেই নে। কত কি যে দাবী করিস দিনরাত!
কোত্থেকে মেটাবো আমি!”… বোধহয় সবারই এমন হয়। বয়স বাড়লে শরীরটা শরীরেরই ভিতরে এক
প্রতিপালিত অসুস্থ জন্তু হয়ে কখনো ঘ্যানঘ্যান কখনো চাপা গরগর করতে থাকে সারাটা
সময়। আমি যদি ওই বয়সে আদৌ পৌঁছই তখন এদেশের স্বাধীনতার বয়স কত হবে?
আর তেল কাচাতে না পেরে বৃদ্ধা এবার নিজেই ওঠার তোড়জোড়
করছিলেন। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু হাত ধরলেন না তিনি। করতলের ভরও দিলেন না
মাটির ওপর। রক্তমাখা বাঁ হাতে পুঁটুলিটা ধরে, হাঁটুর ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে উঠে
দাঁড়ালেন। তেলজবজবে ডান হাতটা আলগা করে সামনে ধরে রাখা। মাথায় আর মুছবার জায়গা
নেই। কপাল বেয়ে চুঁইছে তেল আর মাটি। তবু, বোধহয় কোনো নাতির ছোটো মেয়ের
অনেকদিন-তেল-না-পড়া রুক্ষ মাথাটা মনে পড়েছে!
বৃদ্ধা দাঁড়াতে তাঁর মাথাটা আমার বুকের কাছ অব্দি এল। তৈলাক্ত
হয়ে চকচক করছিল দূর থেকে ভেসে আসা আলোয়। সুগন্ধের ঝোঁকাটা তীব্র হয়ে নাকে এসে
লাগল।
প্রথম বসন্ত কবে এসেছিল এই শরীরে! এই হলদেটে সাদা মাথাটা তখন
আরেকটু উঁচু, আরেকটু বড় আর কালো ও সতেজ। এই রাজপথে তখন এঁর বা এঁর কোনো
পূর্বপুরুষের ছায়াও পড়েনি। হয় কোনো গ্রামে অথবা শহরের পুরোনো দিকের কোনো পাড়ায়
কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে উঠছেন! এই রাজপথ তখন আরো সরু। হয়তো পাথরবসানো। ইংরেজ
রাজপুরুষদের বাংলো আর সরকারি দপ্তরের মাঝ দিয়ে ফিটন আর ঘোড়ার শব্দে মুখর! মোহনদাস
করমচাঁদ গান্ধী নামের মানুষটি তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেছেন। সুরাটে আছেন নাকি
মোতিহারিতে এসেছেন!…
তখন কত দাম পড়ত আধশিশি সুগন্ধী তিল তেলের?
আমি তখন কত পেতাম দিনে, রোজগেরে জোয়ান থাকলে? কারো মাথা
নিশ্চই থাকতো আমার বুকের এত কাছে? সে কে? এমনই তো হত তার বয়স, এখন!
অন্ধকারে, তীব্র মাদক সুগন্ধের এক অদৃশ্য গুল্মের মধ্যে আমায়
দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধা, ডান হাতটা সামনে প্রসারিত রেখে ধীরে ধীরে চলে গেলেন।
টর্চ
গত কাল নিশুতি রাতে গ্রামের পিছন দিয়ে এই দোতলা মাটির বাড়িটার দিকে আসছিলাম। হঠাৎ দু’ফুট সামনে, একটা টর্চের জোরালো আলো জমির দিকে দেখিয়ে সাবধান করেছিল, “নর্দমা আছে এখানে, দেখে পার হবেন”।
টর্চটা যে জ্বালিয়েছিল, অন্ধকারে তার মুখ দেখি নি। তার যে
প্রায় সারা রাত ওখানে দাঁড়িয়ে টর্চ দেখানোর ডিউটি, তাও জানতাম না।
সকাল থেকে বৈঠক চলছে। বৈঠক নয়, প্রথম, স্থাপনা সম্মেলন। এখন রাত। দ্বিতীয় অধিবেশন। মাটির দোতলা, ঘরের ভেতর লন্ঠনের আলো, বাইরে শরতের আকাশ, দেশে এমার্জেন্সী –
আদর্শ পরিবেশ।
যা কিছু সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিচার, সব হয়ে গেছে। এমনকি সবচেয়ে
বিতর্কিত বিষয়, ভারতবর্ষের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী না মুৎসুদ্দী, তারও নিষ্পত্তি হয়ে
গেছে।
নিষ্পত্তি হয়ে গেছে অর্থাৎ, আমাদের মূল অবস্থানটা স্থির হয়ে
গেছে যে, যেহেতু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা ভ্রান্তি এমনকি উদ্ভ্রান্তির শিকার
হচ্ছি বার বার তাই আপাততঃ আমাদের গ্রুপটির প্রধান কাজ হবে অধ্যয়ন এবং অন্যান্য
দলের সাথে ভাবধারাগত বিতর্ক।
অধ্যয়ন। বিশেষকরে দেশের
সমাজব্যাবস্থা, ইতিহাস, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী জনতার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, ধ্রুপদী
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ…
-
আর দর্শন?
সামনে ব্যানারের বদলে,
লন্ঠনের আলোয় ভারতবর্ষের মানচিত্র। তাতে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে একজন প্রশ্নটা ওঠাল।
-
ভারতীয় দর্শন? তাতে জড়বাদী
পরম্পরার সুত্র?
-
অবশ্যই! চার্বাককে পুড়িয়ে মারা
হয়েছিল এটা আমরা ভুলি কী করে?…
পরের দিন সকালে শুনলাম
কোনো একজন কমরেড ভোররাতে বাড়ি ফিরে গেছেন – তাঁর মেয়ে গুরুতর অসুস্থ। একটু বেলায়
খবর এল মেয়েটি মারা গেছে।
-
কে সেই কমরেড?
-
ওই যে, যিনি আগের রাতে গ্রামের
পিছনে নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালছিলেন – আসতে থাকা দলগুলিকে পথ দেখাচ্ছিলেন!
কৈমুরের পাহাড় দেখা
যাচ্ছে দূরে। দোতলা এই মাটির বাড়িটার উঠোনে ইষৎ মেঘলা রোদ। গোপনতার খাতিরে
বাইরে বেরুনো মানা। আবজানো
দরজা-জানলার ফাঁকে ফসল কাটা হয়ে যাওয়া ক্ষেত দেখা যাচ্ছে দিগন্ত অব্দি। আর দেখা
যাচ্ছে এই গ্রাম – এই টোলা এবং আরো কিছু এদিক ওদিক ছড়ান টোলা নিয়ে।
সকালে, দুপুরে, সেশনের অবসরগুলোয় বাড়িটায় বার বার ছড়িয়ে পড়ছে
চাপা স্বরে অসংখ্য তুমুল বিতর্ক। অথবা একটা - এবং একটাই – গান। ভারতবর্ষ হয়ে উঠতে
চাওয়ার। কতবার কত জায়গায় এভাবে হয়ে উঠতে চেয়েছে ভারতবর্ষ। আরো বড় ভাবে হয়ে উঠতে
চাওয়ার সাথে মিশে গেছে। অথবা মিশতেও পারে
নি।
……………
রাত।
হঠাৎ বক্তার কন্ঠস্বর
থেমে গেল। ঘরে ঢুকল তিনজন। কারা, এরা?
পাশের কমরেড বললেন, “মাঝের জন সেই, যাঁর মেয়ে মারা গেছে আজ
বেলায়”।
এই প্রথম তাঁকে দেখলাম। কালো, রোদে পোড়া কিন্তু চোখা চেহারা।
বয়স আমার থেকে যথেষ্ট বেশি, প্রায় দেড়গুণ; চল্লিশের মত হবে। নীলচে একটা শার্ট আর
পাজামা পরণে। মাঝারি উচ্চতা, রোগা কিন্তু মজবুত গড়ন।
কমরেড সভাপতি উঠে দাঁড়ালেন। আমাদেরই মত তাঁরও কাঁচা বয়স।
ভাষায় একটা ভুল করে ফেললেন ধার করা অভ্যেসের দরুন।
-
কমরেডস্! কমরেড মহেশ আমাদের
সভায় ফিরে এসেছেন। আপনারা জানেন যে তাঁর মেয়ে আজ সকালে মারা গেছে। তার শেষকৃত্য
সেরে সোজা শ্মশান থেকেই উনি আসছেন। আমরা মৃতকের আত্মার শান্তি কামনা করে
দু’মিনিটের নীরবতা পালন করব।
সভাপতির নির্দেশ পালন
হবার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে আপত্তি জানালেন মৃতকের পিতা, প্রথম রাত্রে টর্চের আলো
দেখানো লোকটি।
-
কমরেড সভাপতিজী! এটা কী বলছেন?
আমরা কি আত্মায়, পরলোকে বিশ্বাস করি যে আত্মার শান্তি কামনা করব?
সভাপতি তোৎলালেন, “না,
মানে আত্মা নয়, ওটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। তার স্মৃতিতে দুমিনিটের নীরবতা…”
-
কিসের স্মৃতি? বারো বছরের মেয়ের
স্মৃতি তো শুধু তার বাপ মায়ের ভিতরে! সে তো কিছুই করে যেতে পারল না জীবনটা নিয়ে।
(লোকটির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কি?) বলুন, একটা অসাময়িক মৃত্যুতে! এমনই আরো
অনেক মৃত্যুর মত আরো একটি অসাময়িক মৃত্যুতে আমরা শোক পালন করব।
মাটির দোতলায় আমরা জনা
পঁয়ত্রিশ সাথী বোবা সশ্রদ্ধ বিষ্ময়ে ওই পিতার দিকে তাকিয়ে, দাঁড়িয়ে রইলাম দু’মিনিট।
বাইরে কি চাঁদ ছিল? তার আলোয় বাইরে প্রান্তরটা কি একটা ঘড়ির ডায়াল হয়ে গিয়েছিল? কি
জানি কেন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল যে কোথাও একটা ঘড়ি খুব জোরে টিকটিক শব্দ করে
চলেছে।
__________________
Tuesday, May 25, 2021
চোখ পেতে আছি
Monday, May 17, 2021
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদ সন্ধানে অক্ষয় কুমার দত্ত
ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, খন্ড ২এর উপক্রমণিকা পাঠ
দুই খন্ডে রচিত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়।
দুটি খন্ডেরই শুরুতে দীর্ঘ উপক্রমণিকা। প্রথম খন্ডেরটি ১১৬ পৃষ্ঠার। দ্বিতীয় খন্ডেরটি
৩২৩ পৃষ্ঠার। যেটুকু আমি দেখার চেষ্টা করছি তা ছাড়াও এই দুটো উপক্রমণিকায় অক্ষয় দত্তের
ভাবনাচিন্তার অনেক মণিরত্ন ছড়িয়ে আছে, যা উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণীয় চিন্তার জগতে
তাঁর ভাস্বর ছবি ফুটিয়ে তোলে। আমি তো এমনকি তাঁর নিরীশ্বরবাদেরও সমস্তটা ধরছি না। যেমন
প্রথম খন্ডের উপক্রমণিকা নিয়ে আলোচনায় ‘ধর্ম নিয়ে তাঁর
বস্তুবাদী সমালোচনা’ দেখতে চেয়েছিলাম,
দ্বিতীয় খন্ডের উপক্রমণিকাতেও মূলতঃ, দর্শন ও মনুসংহিতা নিয়ে আলোচনায় তাঁর বস্তুবাদী
দৃষ্টিভঙ্গী যেখানে যতটুকু পাওয়া যায় সেটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাতে ওই দর্শনগুলোর
নিরীশ্বরবাদ, বা যুক্তিবিন্যাস নিয়ে ওনার যে বিশ্লেষণ, তা স্বাভাবিক ভাবেই পুরোটা আসবে
না।
এটাও আগের লেখায় বলেছি যে তাঁর বস্তুবাদ মার্ক্সীয়
বস্তুবাদের আগের। যেমন, উনি বলেন যে “আদিম আর্য্য-বংশীয়দিগের ধর্ম্মের অবস্থা জানিতে হইলে, তাঁহাদের বুদ্ধি
বিদ্যা ও সামাজিক অবস্থার বিষয় পরিজ্ঞাত হইলে ভাল হয়” (শব্দে জোর আমার) কিন্তু সামাজিক অবস্থার আভ্যন্তরীন
কোন সংঘাতে বা কোন প্রয়োজনে ঈশ্বর, দেবদেবীর সৃজন হয়, ধর্মের নির্মাণ হয়, ‘মর্ত্যলোক’এর ভিতরে ‘স্বর্গলোক’ সৃজিত হয়ে নভোমন্ডলে ‘উৎক্ষিপ্ত’ হয় এসব তিনি বিচার করেননি।
আবার তিনি সমাজের বিকাশের সাথে সাথে ধর্মের বিবর্তনের
কথাও বলেছেন। বলেছেন, “আর্য্য-বংশীয়দিগের
আদিম আর্য্য-ভাষা যেমন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া গ্রীক ও ল্যাটিন,
কেল্টিক ও টিউটোনিক, সংস্কৃত ও পারসীক প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার ভাষায় পরিণত হইয়াছে,
আদিম আর্য্য-ধর্ম্মও সেই রূপ ক্রমে ক্রমে পরিবর্ত্তিত ও রূপান্তরিত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন
দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করিয়াছে। ঐ আদিম ধর্ম্মই ক্রমশঃ পরিবর্ত্তিত হইয়া গ্রীসে
গ্রীক, রোমকে রোমক, জর্ম্মেনিতে জর্ম্মেন, পারসীকে পারসীক এবং হিন্দুদিগের দেশে হিন্দুধর্ম্ম
রূপে পরিণত হয়।” স্বাভাবিকভাবেই
এটা মনে করা যায় যে ভৌগোলিক এবং সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনই যে এর কারণ তা তিনি বিশ্বাস
করতেন। দেখতে পাই যে এই পরিবর্তন ও বিবর্তনের ইতিহাস নেই বলে কী গভীর আক্ষেপ ছিল তাঁর।
এবং তিনি সে অর্থে
দার্শনিক বা দর্শনবেত্তাও ছিলেন না। নতুন দর্শন উদ্ভাবন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং
অক্ষয় কুমার দত্ত, এই দুজন কর্মযোগী ও চিন্তাবিদের কাজের পরিধিতে ছিল না। তবুও, তাঁদের
চিন্তার ধারায় সমকালীন বস্তুবাদের সুত্রগুলো পেলে, বিশ শতকের ভারতীয় মননে বস্তুবাদের
ধারাটির একটা অব্যবহিত পূর্বসূরি পাওয়া যাবে। নইলে মনে হবে রুশে বিপ্লবের পর ভারতবিদ্যার
সংস্থা স্থাপিত হওয়ার পরই আধুনিক ভারতে বস্তুবাদী চিন্তার আলোড়ন শুরু হল। প্রাচীন ভারতীয়
দর্শনের নিরীশ্বরবাদ, মধ্যযুগীয় ভারতে ভক্তি-আন্দোলনের মানবতাবাদ এবং আধুনিক ভারতের
সমাজ-সংস্কার প্রচেষ্টার মধ্যে যে একটা সম্পর্ক আছে, সেটার দিকেও চোখ যাবে না।
শুরু করি।
“উপনিষদে হিন্দু জাতির
বুদ্ধি-বিকাশের সুস্পষ্ট পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। বুদ্ধি-জ্যোতিঃ একবার প্রকাশিত
হইতে আরম্ভ করিলে, আর স্থির থাকে না; নানা দিকে কিরণ-জাল বিকীর্ণ করিতে থাকে। তদনুসারে,
বেদের সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ অবলম্বন করিয়া ক্রমে ক্রমে পরমার্থ-সংক্রান্ত কয়েকটি
মত উৎপাদিত হয়, তাহার নাম দর্শন। তাহার মধ্যে ছয়টি দর্শন প্রাচীন বলিয়া পরিগণিত আছে;
সাংখ্য, পাতঞ্জল, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত।
“পরমার্থ তত্ত্ব-অনুসন্ধানই
ভারতবর্ষীয় দর্শনশাস্ত্র সমুদায়ের প্রধান উদ্দেশ্য। জগতের কারণ-নিরূপণ ও মনুষ্যের মুক্তি
বা পারলৌকিক সদ্গতি-সাধনের উপায়-নির্দ্ধারণ-বিষয় সেই সমুদায়ে বিচারিত হইয়াছে। এ প্রবন্ধটি
পরমার্থ-বিষয়ক; অতএব এ স্থলে সেই দুইটি পারমার্থিক বিষয় ক্রমশঃ অতি সংক্ষেপে লিখিত
হইয়েছে।” [ভা.উ.স., উপ.
- ২, পৃ – ১]
‘পরমার্থ তত্ত্ব-অনুসন্ধান’ অর্থাৎ পরমসত্য-অনুসন্ধান অথবা ‘সৃষ্টির অন্তিম কারণ বা প্রথম কার্য অনুসন্ধান’ যেটা স্বাভাবিকভাবেই আজ ঈশ্বরের সমার্থক।
কিন্তু এই অনুসন্ধানের প্রশ্ন বা তাগিদটা জাগে সমাজের এক বিশেষ অবস্থায়, যখন শ্রেণী-দ্বন্দ্ব
ও শ্রেণী-সংঘাতে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ‘এই যদি – তাহলে কেন’, এভাবে, বিভিন্ন ধরণের কূটাভাসে বা আপাত-বৈপরীত্যে
মনে জাগে অনুসন্ধানের ইচ্ছেটা।
উপরের অংশটিতে ‘প্রবন্ধ’ শব্দের অর্থ আমি উপক্রমণিকা ধরছি না, মূল গ্রন্থটি ধরছি; ভারতবর্ষের
তৎকালীন বিভিন্ন উপাসক সম্প্রদায়ের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে তিনি পরমার্থ তত্ত্ব-অনুসন্ধানের
একটা দেশজোড়া রূপ তুলে ধরেছেন। উপক্রমণিকায় তিনি ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথটি ধরিয়ে দিয়েছেন
যার মধ্যে দিয়ে ওই উপাসক সম্প্রদায়গুলো জন্ম নিয়েছে। কাজেই “এই স্থলে” অর্থাৎ উপক্রমণিকায় উনি “সেই দুইটি পারমার্থিক বিষয়” অর্থাৎ “জগতের কারণ-নিরূপণ ও মনুষ্যের মুক্তি বা পারলৌকিক সদ্গতি-সাধনের
উপায়-নির্দ্ধারণ” নিয়ে আলোচনা করবেন।
প্রথমেই সাংখ্য।
“মহর্ষি কপিল সাঙ্খ্য-মতের
প্রবর্তক। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নাই – ईश्वरासिद्धे:। (সাঙ্খ্যপ্রবচন। ৯২ সুত্র। ‘কেননা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ হয় না’)। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ না হইল, তবে
কিরূপে জগতের সৃষ্ট হয়, এ বিষয় সুতরাং তাঁহাকে বিবেচনা করিতে হইয়াছিল।”
এই বিবেচনা-প্রসঙ্গে সাংখ্যের হেতুবাদ – অবস্তু থেকে বস্তুর সৃষ্টি হওয়ার অসম্ভাব্যতা,
সৃষ্টির কারণ হিসেবে প্রত্যেকটি বস্তুর উপাদান-স্বরূপ এবং কারণ-লয়ে নাশ – ইত্যাদির বর্ণনা মাঝেই লেখক চিন্তার ঐতিহাসিকতা
মনে করিয়ে দেন – “যে সময়ের কথা লিখিত হইতেছে, সে সময়ের পক্ষে
এই ভাবটি অতীব প্রগাঢ়। … উল্লিখিত সূত্রগুলির
ভাবার্থ পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে বোধ হয়, মহর্ষি যেন বুদ্ধিযোগে জগতের সৃজন-রহস্যের
তল-স্পর্শ করিতে উদ্যত হইয়াছেন; কিন্তু তাহার উপায় নাই!” [শব্দে জোর আমার]
এর পর লেখক সাংখ্য-প্রতিপাদিত, সৃষ্টির প্রথম,
‘অমূল-মূল’ কারণ, ‘প্রকৃতি’র বর্ণনা করেন। ‘প্রকৃতি’ যে সৃষ্টির প্রারম্ভ-অনুসন্ধানের
ক্রমে ‘কারণ’এর পর্য্যাবসানের সংজ্ঞামাত্র, তাও উল্লেখ
করার পর জগতের বস্তুমাত্রের, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, তিনটি গুণের বর্ণনা করেন; কারণের পর্য্যাবসান
প্রকৃতি এই তিনটি গুণের, বা ‘গুণবিশিষ্ট বস্তুর’ সাম্যাবস্থা। তারপরেই বলেনঃ
“এই তিনটি গুণের কার্য
ও পরস্পর সম্বন্ধাদি লইয়া সাঙ্খ্য-শাস্ত্রে সবিশেষ আন্দোলন সহকারে অনেক তর্ক, বিতর্ক,
বিচার ও সিদ্ধান্ত আছে। সেই সমস্ত কুটিল ও জটিল অবাস্তবিক বিষয়ের বৃত্তান্ত
লিখিলে, পাঠকগণের অসুখ বই সুখের বিষয় হইবে না। ফলতঃ একবার মনে হয়, চিরকাল এই সমস্ত
ভ্রান্তিভার বহন করিবারই বা প্রয়োজন কি? পুনর্ব্বার ভাবি, ইতিহাস-রচয়িতাদিগকে সত্য
মিথ্যা সকলই কীর্ত্তন করিতে হয়। … মানবীয় মনের ইতিবৃত্ত পর্য্যালোচনা করিলে কখন বা সুখী ও কখনও দুঃখিত
হইতে হয়। এই পুস্তকের অধিকাংশই তো ভ্রান্তি-ভূধরের বর্ণনা বই আর কিছুই নয়। মানুষে বুঝি
ঐ অতি দুর্ভেদ্য ভূধর-শ্রেণীর বহুতর শৃঙ্গ অতিক্রম না করিলে, তত্ত্ব-ভুবন আরোহণ করিতে
সমর্থ হয় না।”
এরপর লেখক সাংখ্য-প্রতিপাদিত ‘পুরুষ’ ধারণাটির বর্ণনা করেন। “পুরুষ চেতন-স্বরূপ, কিন্তু সুখ-দুঃখাদি-শূন্য। ইনি … বিকার-শূন্য, এবং অকর্ত্তা … প্রাণীদিগের আত্মা-স্বরূপ; … প্রকৃতি ও পুরুষ
পরস্পর-সাপেক্ষ। … প্রকৃতি ঐ পুরুষ-সন্নিধান
প্রযুক্ত বিশ্বরচনায় প্রবৃত্ত হইয়া থাকে”। এ কথাগুলো বলার মাঝেই নিজের বস্তুবাদী দৃষ্টি থেকে বলেন, “কপিল ঋষি জগতের সচেতন অচেতন দুই প্রকার পদার্থ
দেখিয়া তাহার মূলস্বরূপ ঐ দুইটি পদার্থের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াছেন বোধ হয়”।
তারপর, প্রকৃতি ও পুরুষের সাংখ্য-বর্গীকৃত
পঁচিশটি তত্ত্বের সারণি দিয়েছেন, যথা “প্রকৃতি, পুরুষ, মহৎ, অহঙ্কার, মন, এবং পশ্চাল্লিখিত পঞ্চ মহাভূত,
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ তন্মাত্র।” তাদের মধ্যেকার যে কার্য্য-কারণ সম্পর্ক সাংখ্যে
বিবেচিত হয়েছে তা স্পষ্ট করেছেন। এবং পরের অনুচ্ছেদেই বলছেনঃ
“সাঙ্খ্য-শাস্ত্রের
কোন কোন অংশে সমধিক বুদ্ধির প্রাখর্য্য প্রদর্শিত হইয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু
এ অংশটি নিতান্ত মনঃকল্পিত একথা এখন বলা বাহুল্য। যে সময়ে, ভূমন্ডলে বিজ্ঞান-রাজ্যের
পথ-প্রদর্শক বেকন ও কোন্তের জন্ম হয় নাই, সে সময়ে আর অধিক প্রত্যাশা করাই বা কেন?”
আধুনিক সময়ে বস্তুবাদের বিকাশে জার্মান বস্তুবাদের
আগে, ইংরেজি বস্তুবাদ ও ফরাসী বস্তুবাদের গুরুত্ব মার্ক্স নিজেই স্বীকার করেছেন; ‘ধর্মের বস্তুবাদী আলোচনায় …’ শীর্ষক লেখাটায় এ বিষয়ে মার্ক্সকে উদ্ধৃত
করেছি। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) ইংরেজ ভাবনায় বস্তুবাদের (যদিও প্রচলিত ভাষায় তাকে
অভিজ্ঞতাবাদ, ইম্পিরিসিজম বলে জানি) প্রবর্তক বলে খ্যাত এবং অগস্ত কোম্তে (১৭৯৮-১৮৫৭) ফরাসী ভাবনায় পজিটভিজ্ম
(বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে পেলাম দৃষ্টবাদ, প্রত্যক্ষবাদ, জল্পনাকল্পনা
বা মানসবিচারের স্থলে ইন্দ্রিয়গম্য প্রপঞ্চ ও সন্দেহাতীত তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত) এর
জনক।
এখানে আশা করাই যেতে পারত যে অক্ষয় দত্ত নিজে
আরেকটু স্পষ্ট হবেন। কারা ‘অধিক প্রত্যাশা’ করছে? কেউ কি ছিল যে প্রাচীন ভারতীয় নিরীশ্বরবাদ
এবং বস্তুবাদী ধ্যানধারণার প্রশংসা করছিল? নাকি উনি নিজেই প্রত্যাশা করে হতাশ হচ্ছিলেন?
কেন হচ্ছিলেন? ‘ইতিহাস-রচয়িতা’কে তো ‘সত্য মিথ্যার কীর্তন’ করতেই হয়! অক্ষয় দত্ত স্পষ্টভাবে ইংরেজশাসন-বিরোধী ছিলেন এবং সে
কারণেই ঘৃণা করতেন নিজের সমাজের পশ্চাৎপদতা। তাই কি মনে আক্ষেপ ছিল যে কেন ভারতীয় বস্তুবাদ
ইতিহাসের বিবর্তনে সমকালীন ইওরোপীয় বস্তুবাদের সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারল না?
যেখানে যেখানে চমকপ্রদভাবে লেখক সাংখ্যদর্শনপ্রণেতার
বা তার পরবর্ত্তী ব্যাখ্যাকারদের ‘সমধিক বুদ্ধির প্রাখর্য্য’ লক্ষ্য করেছেন, আপ্লুত হয়ে ইওরোপের নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে তার
তুলনা করেছেন। কার্য্য-কারণ-পরম্পরা সম্পর্কে সাংখ্যের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে
বললেন, “যেমন দুগ্ধ হইত দধি,
দধি হইতে নবনীত ও নবনীত হইতে ঘৃত উৎপন্ন হয়, সেইরূপ, সকল বস্তুই সাক্ষাৎ বা পরম্পরা
সম্বন্ধে ঐ প্রকৃতিরই পরিণাম দ্বারা উৎপন্ন হইয়া থাকে। জগতের যাবতীয় পদার্থ মূল প্রকৃতিরই
কার্য্য-পরম্পরা মাত্র।” এর সাথেই ফুটনোট
দিয়েছেন সেই পৃষ্ঠায়, “অধুনাতন বিজ্ঞানবিৎ
সর্ব্বপ্রধান ইয়ুরোপীয় পন্ডিত-সম্প্রদায়ের সৃষ্টিবিষয়ক মত The Theory of Evolution
কিয়দংশে কি এই সাংখ্য-মতের অনুরূপ বোধ হয় না? তাঁহারা বলেন, যেমন শূক কীট রূপান্তরিত
হইয়া প্রজাপতি উৎপন্ন হয়, সেইরূপ এক বস্তু ও এক প্রাণী পরিণত হইয়া অন্য বস্তু ও অন্য
প্রাণী উৎপন্ন হইয়া আসিতেছে। কপিল ঋষি তাঁহাদের ঐ মতের একটি সঙ্কুচিত অঙ্কুর রোপন করিয়া
গিয়াছেন একথা বলিলে কি বলা যায় না?
‘জগতের কারণ-নিরূপণ’এর পর বিচার্য ছিল ‘মনুষ্যের মুক্তি বা পারলৌকিক সদ্গতি-সাধনের
উপায়-নির্দ্ধারণ’ – “সাঙ্খ্য-পন্ডিতেরা সংসারের যাবতীয় তাপ অর্থাৎ দুঃখ তিন ভাগে বিভক্ত
করেন; আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। জ্বরাদি রোগ, প্রিয়বস্তুর বিয়োগ ও অপ্রিয় বস্তুর
সংঘটন, এবং কাম, ক্রোধ, লোভাদি দ্বারা যে সকল দুঃখের উৎপত্তি তাহার নাম আধ্যাত্মিক
দুঃখ। অগ্নি, বায়ু, জলাদি স্থাবর এবং পশু, পক্ষী, কীটাদি অস্থাবর বস্তু হইতে যে সমস্ত
দুঃখ-ঘটনা হয়, তাহাকে আধিভৌতিক দুঃখ বলে। শীত, উষ্ণ, বাত, বর্ষা, বজ্রপাতাদি হইতে উৎপন্ন
দুঃখ সমুদায় আধিদৈবিক দুঃখ বলিয়া উল্লিখিত হয়। …
“ব্যক্তিমাত্রেই এই
তিন প্রকার তাপে সন্তপ্ত। মনুষ্যদিগকে এই ত্রিতাপ হইতে মুক্ত করা সাঙ্খ্য-দর্শনের প্রধান
উদ্দেশ্য।…
“বিবেক অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানই
এই রূপ মুক্তি-সাধনের একমাত্র উপায়।…
“প্রকৃতির সহিত পুরুষের
ভেদ-জ্ঞানকেই তত্ত্বজ্ঞান বলে। …
“… তত্ত্বানুশীলন করিলে, আমি নাই; আমার শরীর নাই, কেন না আমি ভিন্ন,
শরীর ভিন্ন; আমি অহঙ্কার-বর্জ্জিত এই শেষ-সিদ্ধান্ত-স্বরূপ এবং নিঃসংশয়িতা-প্রযুক্ত
বিশুদ্ধ একমাত্র জ্ঞানটি উৎপন্ন হয়। (এই জ্ঞানে মুক্তি হয়)।”
এই ‘মুক্তি’ নিয়ে কিন্তু অক্ষয়
দত্ত কোনো প্রশ্ন তোলেননি। তখন অব্দি ভারতের এবং বাংলার চিন্তার জগতে, ব্যক্তিজীবনের
‘দুঃখ’ ও তাপ’এর – এবং সে কারণেই ‘মুক্তি’রও – প্রায় নব্বই প্রতিশত
যে সামাজিক প্রশ্ন, দর্শনচিন্তাও যে শেষবিচারে সমাজচিন্তা, সে চর্চা কি শুরু হয়েছিল?
বরং আরেকবার লেখক হিন্দু সমাজে বেদের প্রভাব
নিয়ে , আক্ষেপ করেন, “চিরকাল হিন্দু-সমাজে
বেদের কি অতুল প্রভাব ও দুর্জ্জপ্য পরাক্রমই চলিয়া আসিয়াছে! কপিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব
অক্লেশে অস্বীকার করিলেন, কিন্তু বেদের মহিমা অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না। তিনিও বেদার্থ
প্রামাণিক বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন। …
“কপিল সুপ্রসিদ্ধ নাস্তিকতাবাদী হইলেও, স্বধর্ম-পক্ষপাতী হিন্দুজাতির
পূজ্য হইয়া রহিয়াছেন ইহা সামান্য কৌতুকের বিষয় নয়।”
পাতঞ্জল দর্শন।
পাতঞ্জল দর্শন নিয়ে আলোচনা সংক্ষেপে সেরেছেন
লেখক। তার কারণঃ
(১) ‘জগতের কারণ-নিরূপণ’এ “সাংখ্যদর্শনের সহিত
এই দর্শনের অনেক বিষয়ের ঐক্য আছে। কপিল যেমন প্রকৃতি পুরুষ প্রভৃতি পঁচিশটি মূল তত্ত্ব
স্বীকার করেন, পতঞ্জলিও সেইরূপ অঙ্গীকার করিয়া গিয়াছেন। বিশেষ এই যে, কপিল মুনি ঈশ্বরের
অস্তিত্ব অঙ্গীকার করেন নাই, পতঞ্জলি বিশ্বনির্ম্মাতা সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বশক্তিমান্
পরমেশ্বরের সত্তা স্বীকার পূর্বক মনুষ্যের পরিত্রাণ-সাধন উদ্দেশে যোগশাস্ত্র প্রবর্ত্তন
করেন। এই নিমিত্ত পাতঞ্জলদর্শন সেশ্বর ও কপিল-দর্শন নিরীশ্বর সাংখ্যদর্শন বলিয়া উল্লিখিত
হইয়া থাকে। …… পতঞ্জলি মতে ঈশ্বর
লইয়া ষড়্বিংশতি তত্ত্ব হয়। তিনি বলিয়া গিয়াছেন জগদীশ্বর স্বেচ্ছানুসারে শরীর ধারণ
করিয়া জগৎ নির্ম্মাণ করেন।”
(২) পাতঞ্জলের দর্শন যোগসুত্র বলে খ্যাত। “মনুষ্যের নানারূপ চিত্তবৃত্তি আছে এবং সেই
সমস্ত বৃত্তির ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নির্দ্ধারিত আছে; যেমন দর্শনের বিষয় রূপ, শ্রবণের বিষয়
শব্দ, ঘ্রাণের বিষয় গন্ধ ইত্যাদি। অন্তঃকরণকে ঐ সকল বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া পরমেশ্বরাদি
ধ্যেয় বস্তুতে সংস্থাপন পূর্ব্বক তন্মাত্র ধ্যান করাকে যোগ বলে।” এতটা পরিভাষিত করার পর লেখক বলেন, “ঐ যোগের যম নিয়মাদি আটটি অঙ্গ আছে। পাঠকগণ
এই পুস্তকের অন্তর্গত যোগি-সম্প্রদায়ের বিবরণ মধ্যে তাহার সবিশেষ বৃত্তান্ত দেখিতে
পাইবেন।”
(৩) মনুষ্যের মুক্তি বা পারলৌকিক সদ্গতি-সাধনের
উপায়-নির্দ্ধারণ বিষয়ে লেখক পাতঞ্জল দর্শন সম্পর্কে বলেন, “পাতঞ্জল মতেও তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা মুক্তি লাভ
হয়। পুরুষ অর্থাৎ জীবাত্মা জড়ময় জগৎ হইতে নিতান্ত পৃথক্ভূত এইরূপ জ্ঞানকে তত্ত্বজ্ঞান
বলে। ইহার অন্য একটি নাম বিবেকখ্যাতি। স্ফটিক যেমন স্বভাবতঃ শুভ্র, সেইরূপ জীব স্বভাবতঃ
চিন্ময়মাত্র। … উল্লিখিতরূপ তত্ত্বজ্ঞানের
উদ্রেক হইলে অজ্ঞান রহিত হইয়া কেবল ঐ চিন্ময় স্বরূপই বিদ্যমান থাকে। ইহাকেই কৈবল্য
ও ইহাকেই মুক্তি বলে।”
অক্ষয় দত্ত বিশ্বাস
করেন না যে যোগসূত্রের প্রণেতা পতঞ্জলি এবং পাণিনি ব্যাকরণের ভাষ্য রচয়িতা পতঞ্জলি
একই ব্যক্তি। কেননা, “পন্ডিতগণের চিরসংস্কার
ব্যতিরেকে তাহার অন্য কোনরূপ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না।”
বৈশেষিক দর্শন।
বৈশেষিকের আলোচনা অক্ষয় কুমার সাংখ্যের মতই
বিশেষভাবে করেছেন কেননা এই দর্শন নিরীশ্বরবাদী এবং বস্তুবাদী, “কপিল যেমন প্রকৃতি পুরুষকে নিত্য বলিয়া স্বীকার
করেন, কণাদ সেইরূপ জল, বায়ু, মৃত্তিকাদি প্রভৃতি নয়টি পদার্থ নিত্য বলিয়া অঙ্গীকার
করিয়াছেন।” তারপর বিশদে উল্লেখ
করেছেন বৈশেষিক প্রতিপাদিত ‘দ্রব্য পদার্থ’, ‘গুণ-পদার্থ’, ‘কর্ম-পদার্থ’, ‘সামান্য-পদার্থ’, ‘বিশেষ-পদার্থ’, সমবায়-পদার্থ’ ও অভাব-পদার্থ’ কী কী এবং কেন। তার মধ্যে নিত্য পদার্থ কোনগুলো এবং কোনরূপে। অনিত্য
পদার্থ কোনগুলো।
যে “বিশেষ নামে একটি অতিরিক্ত পদার্থ”এর অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে দর্শনটির নাম “বৈশেষিক দর্শন” সে পদার্থটা নিয়ে পরে আলোচনা করবেন বলেন। কিন্তু,
পদার্থের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনাকালে, ফুটনোটে দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। প্রথমটি
ওই, “মনুষ্যের মুক্তি
বা পারলৌকিক সদ্গতি-সাধনের উপায়-নির্দ্ধারণ” সংক্রান্ত। ঠিক মন্তব্যও নয়, বৈশেষিক দর্শন থেকে একটি সংস্কৃত বাক্য
উদ্ধৃত করে তার অনুবাদ করেছেন, “ধর্ম-বিশেষ হইতে তত্ত্বজ্ঞান জন্মে এবং তত্ত্বজ্ঞান হইতে নিঃশ্রেয়স
অর্থাৎ আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি হইয়া থাকে। দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়
এই কয়েক পদার্থের স্বাধর্ম্ম্য বৈধর্ম্ম্য হইতে ঐ তত্ত্বজ্ঞানের উৎপত্তি হয়।”
পরে এ নিয়ে আরো কয়েকটি কথা আশা করে এগোই।
দ্বিতীয় মন্তব্যটি স্পষ্টভাবে আধুনিক বস্তুবাদী
দৃষ্টি থেকে করা এবং সমালোচনাত্মক, “জগতের যথার্থ স্বরূপ ও প্রাকৃতিক নিয়ম দৃষ্টে এ বিভাগগুলি নির্দ্ধারিত
হয় নাই। অন্যান্য পদার্থের কথা দূরে থাকুক, অধুনাতন বিজ্ঞানবিৎ পন্ডিতেরা কাল ও মৃত্তিকা
এক শ্রেণীভুক্ত বলিয়া ভ্রমেও মনে করিতে পারেন না।”
বৈশেষিক অনুসারে “পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা,
মন এই … নয়টি পদার্থই নিত্য।
কিন্তু তন্মধ্যে জল, বায়ু, মৃত্তিকা, তেজ এই চারি প্রকার জড় পদার্থের পরমাণু মাত্র
নিত্য; আর পরমাণু সমষ্ট-স্বরূপ ঘট পটাদি দ্রব্য সমুদায় অনিত্য।” এখানেই লেখক এই দর্শনে “বিশেষ” নামক পদার্থটির প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেছেন, “পরমাণু সৎ-স্বরূপ নিত্য পদার্থ; তাহার আর কারণ
নাই। … প্রত্যক্ষ-গোচর
যাবতীয় জড়-পদার্থ উহারই সংযোগে উৎপন্ন হইয়াছে। বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, কুন্ডল, কটাহ প্রভৃতি
সমুদয় বস্তুর আকার দেখিলেই তাহাদিগকে পরস্পর ভিন্ন বলিয়া প্রতীতি জন্মে। কিন্তু পরমাণুর
তো আকার দেখা যায় না, তবে কিরূপে জল, বায়ু, মৃত্তিকাদি ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর পরমাণু ভিন্ন
ভিন্ন প্রকার বলিয়া নিশ্চয় হয় এই প্রশ্নের সিদ্ধান্ত করিতে গিয়া কণাদ ঋষি কল্পনা করিলেন,
বিশেষ বিশেষ প্রকার পরমাণুতে বিশেষ নামে একটি পদার্থ আছে, তাহারই শক্তিতে ভিন্ন ভিন্নরূপ
পরমাণু ভিন্ন ভিন্ন বলিয়া নিশ্চয় হয়।”
এরপর লেখক, কয়েকটি অনুচ্ছেদে ভারতীয় দর্শনে
কণাদের গুরুত্ব দেখিয়েছেন, সমকালীন ভারতে সেই চিন্তাধারার ঐতিহ্য অবলুপ্ত হওয়ায় আক্ষেপ
প্রকাশ করেছেন এবং কণাদের নিরীশ্বরবাদকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করেছেন। একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি
দিলামঃ
“ইয়ুরোপের মধ্যে পরমাণুবাদ
এখন সর্ব্ববাদি-সম্মত। শ্রীমান ডেল্টন্ ইদানিং” [লেখকের নিজের ফুটনোটে আছে “অর্থাৎ খ্রীষ্টাব্দের উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে”] “ইহার পুনরুদ্ভাবন করেন এবং রসায়ন-বিদ্যা-সংক্রান্ত বিচারক্রমে একরূপ
সপ্রমাণ অথবা অতিমাত্র সম্ভাবিত করিয়া তুলেন। তাহার দুই সহস্র বৎসর অপেক্ষাও অধিক কাল
পূর্বে ভারতবর্ষে মহর্ষি কণাদ এই মত প্রবর্ত্তিত করেন তাহার সন্দেহ নাই। পূর্বকালে
গ্রীস্ দেশে শ্রীমান ডেমক্রিটস্ এইরূপ পরমাণুবাদ প্রকাশ করিয়া যান। কণাদের সহিত তাঁহার
কিরূপ সম্বন্ধ, স্থির করা কঠিন। এই উভয়ের মধ্যে কেহ কাহার নিকট ঋণ-বন্ধনে বদ্ধ আছেন
কি স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র স্ব স্ব দেশে নিজ নিজ মত প্রচলিত করেন, নিশ্চয় বলা যায় না।
ডেমক্রিটস্ গ্রীস-দেশীয় কণাদ এবং কণাদ ভারতবর্ষীয় ডেমক্রিটস্।
“অন্যান্য দর্শনকার
অপেক্ষা কণাদের জড় পদার্থের জ্ঞানানুশীলনে সমধিক প্রবৃত্তি জন্মে দেখা যাইতেছে।
তিনি পরমাণুবাদ সংস্থাপন করিয়া সে বিষয়ের সূত্রপাত করেন। মেঘ, বিদ্যুৎ, বজ্রাঘাত, ভূমিকম্প,
বৃক্ষের রস-সঞ্চরণ, করকা ও হিমশিলা, চুম্বক ও চৌম্বকাকর্ষণ, জড়ের সংযোগ-বিভাগাদি গুণ
ও গত্যাদি ক্রিয়া প্রভৃতি নানা ব্যাপারে তাঁহার চিত্তাকর্ষণ হয়। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়
এই যে, সূত্রপাতেই অবশেষ হইল। অঙ্কুর রোপিত হইল, কিন্তু বর্দ্ধিত, পুষ্পিত ও ফলিত হইল
না। উহা সংস্কৃত, পরিবর্দ্ধিত ও বহুলীকৃত করিয়া ফল-পুষ্প-শোভায় সুশোভিত করা ভারতভূমির
ভাগ্যে ঘটিল না। কালক্রমে সে সৌভাগ্য বেকন্, কোন্ড্ ও হম্বোল্টের জন্মভূমিতে গিয়া
প্রকাশিত ও প্রাদুর্ভূত হইয়া উঠিল। তথাপি আমাদের সুশ্রুত, চরক, আর্যভট্টাদির পদকমলে
বার বার নমস্কার!
“জগতের কারণ-নিরূপণ
দর্শন-শাস্ত্রের একটি প্রধান উদ্দেশ্য। ইহাতে, কণাদ পদার্থ-গণনার মধ্যে আস্তিক-মাত্রেরই
স্বীকৃত পরম-পদার্থ পরমেশ্বরের নাম উল্লেখ না করিলেন কেন? কেবল গণনা কেন, সমুদায় বৈশেষিক
সূত্রের মধ্যে কুত্রাপি পরমেশ্বরের নাম সুস্পষ্ট উল্লিখিত নাই। উত্তরকালীন বৈশেষিক
পন্ডিতেরা দ্রব্য-পদার্থের অন্তর্গত আত্মা শব্দের দুই প্রকার অর্থ করেন; জীবাত্মা ও
পরমাত্মা। টীকাকারেরা কণাদ-কৃত সূত্র-বিশেষের শব্দ-বিশেষ হইতে ঈশ্বরের বিষয় নিষ্পন্ন
করেন [তারা-চিহ্নিত ফুটনোটে লেখক উল্লিখিত সূত্রটি উদ্ধৃত করে, বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন
যে সেটিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব-সম্পর্কিত নয়] একথা যথার্থ বটে, কিন্তু যখন জগতের কারণ নির্দ্ধারণ
করা দর্শন-শাস্ত্রের একটি প্রধান প্রয়োজন, তখন যদি ঈশ্বরকে বিশ্ব-কারণ বলিয়া তাঁহার
স্থির নিশ্চয় থাকিত, তাহা হইলে সে বিষয়ের সুস্পষ্ট বিবরণ না করা তাঁহার পক্ষে কোন মতেই
সঙ্গত হইতে পারে না।
“ঈশ্বর-বিষয়ে যেরূপ
বিশ্বাস থাকাতে টীকাকারেরা সূত্রের মধ্যে তদীয় প্রসঙ্গ না দেখিয়াও তাহা হইতে যোগে যোগে
কোনরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিষ্পন্ন করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন, কণাদ ঋষির সেইরূপ বিশ্বাস
থাকিলে, সূত্রের মধ্যে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ সুস্পষ্ট না লিখিয়া তাহার অন্তর্গত শব্দ বিশেষের
অভ্যন্তর-গুহায় তাহা প্রচ্ছন্ন রাখা কি কোনরূপে সম্ভব হয়?”
তারপর কয়েকটি পংক্তিতে ঈশ্বর-বিশ্বাসী টীকাকারদের
মুন্ডপাত করে অক্ষয় কুমার লেখেন, “যদি তাঁহাদের ন্যায় কণাদ ঋষির ঈশ্বরেতে আস্থা থাকিত, তাহা হইলে তিনি
পদার্থ-গণন, সৃষ্টি-প্রক্রিয়া-বর্ণন ও মুক্তি সাধনাদি সংক্রান্ত কোন না কোন সূত্রে
ঈশ্বরের বিষয় সুস্পষ্ট উল্লেখ না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। প্রত্যুত তাঁহার মতে পরমাণু-পুঞ্জের
সংযোগে জড়ময় জগতের উৎপত্তি হয়; অদৃষ্ট অর্থাৎ অদৃষ্ট কারণ বিশেষ সেই সংযোগের প্রবর্ত্তক।
তাহাতে ঈশ্বরের কর্ত্তৃত্ত্ব-প্রসঙ্গও কিছুমাত্র লিখিত নাই। এই সমস্ত পর্য্যালোচনা
করিয়া দেখিলে, তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অঙ্গীকার করিতেন না এইরূপই প্রতীয়মান হইয়া উঠে।”
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এখানে শেষ করলে বিষয়ের
সাথে ন্যায় করা যাবে না। লেখক সে বিষয়ে সচেতন। “যদিও বৈশেষিক দর্শনে অচেতন সচেতন নানাবিধ পদার্থের বিষয়ই সমধিক
বর্ণিত ও বিচারিত হইয়াছে, তথাচ ধর্ম্ম-নিরূপণ ও মুক্তি সাধনের উপায় নির্দ্ধারণই এ শাস্ত্রের
প্রধান উদ্দেশ্য।”
এ প্রসঙ্গে লেখকের
সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আগেই উদ্ধৃত করেছি। “ধর্ম-বিশেষ হইতে তত্ত্বজ্ঞান … এবং তত্ত্বজ্ঞান
হইতে … দুঃখনিবৃত্তি” বিষয়ে বৈশেষিক দর্শনের সূত্রাদির ব্যাখ্যা
করে লেখক, ‘জ্ঞানের উদয়’, ‘রাগ-দ্বেষ’ এর বিনষ্টি, ‘ধর্ম্মাধর্ম্মে প্রবৃত্তি’র লোপ, ফলে ‘পুনরায় জন্মগ্রহণ’ সম্ভাবনার লোপ, ফলে ‘দুঃখ-বিনাশ’ এবং ‘মোক্ষ’তে পৌঁছে শেষ করেন।
ন্যায় দর্শন।
আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে যে লেখক ভারতবর্ষীয়
উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত লিখছেন তিনি পরম উৎসাহে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে নিরীশ্বরবাদের
প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বস্তুবাদের চিহ্ন সন্ধান করতে এত ব্যগ্র কেন? ন্যায়
দর্শন সম্পর্কিত অংশ শুরুই করেন এই বলে যে “গোতম” (ন্যায় দর্শনের
প্রণেতা) “ঈশ্বরের সত্তা স্বীকার
করিতেন এমন বোধ হয় না। … উত্তরকালীন নৈয়ায়িক
পন্ডিতেরা স্পষ্টরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অঙ্গীকার করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাদের মতে। তিনি
জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা নন, নির্ম্মাণকর্ত্তা” (অর্থাৎ, সময়ের শুরুতে একা ঈশ্বর ছিলেন না, পদার্থ বা বস্তুও বিদ্যমান
ছিল)।
যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন উপাসক সম্প্রদায়
সম্পর্কিত নিবন্ধগুলো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল তখন অক্ষয় কুমারের নজরে
বিবাদীপক্ষ কে বা কারা ছিল, তা নিয়ে বরং সবশেষে ভাবা যাবে।
ন্যায় দর্শনবেত্তারাও “বৈশেষিক পন্ডিতদের সহিত একমতস্থ হইয়া, পরমাণুবাদ
স্বীকার করেন, বিশেষ পদার্থ ব্যতিরেকে অপরাপর সমস্ত পদার্থ অঙ্গীকার করেন এবং মৃত্তিকাদি
চারিটি জড় পদার্থের পরমাণু এবং অবশিষ্ট সমুদয় দ্রব্য-পদার্থ নিত্য বলিয়া বিশ্বাস করেন।”
তাঁদের ধারণা যে, “স্থপতিরা যেমন ইষ্টকাদি লইয়া গৃহ নির্ম্মাণ
করে, পরমেশ্বর সেইরূপ ঐ মৃত্তিকাদি জড়-পরমাণু লইয়াই ব্রহ্মান্ড রচনা করিয়াছেন। তিনি
অশরীরী … সুতরাং শরীর-সাধ্য
সুখ, দুঃখ রাগ দ্বেষাদিও বিদ্যমান নাই। জীবের ন্যায় ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার ইচ্ছার উৎপত্তি
ও ভঙ্গ হয় না। তাঁহার জ্ঞান, ইচ্ছা, যত্নাদি সকলই নিত্য।”
“বৈশেষিক শাস্ত্রোক্ত
উল্লিখিত পদার্থ সমুদয় ব্যতিরেকে ন্যায়-শাস্ত্রে আর একরূপ ষোলটি পদার্থ পরিগণিত হইয়াছে।
পদার্থ শব্দ শুনিয়া অনেকে মনে করিতে পারেন, ঐ ষোলটি বুঝি জল, বায়ু, মৃত্তিকাদির মত
কোনরূপ জড় পদার্থ হইবে। না, তা নয়। ন্যায় দর্শন প্রকৃত তর্কশাস্ত্র। উহাতে তর্ক অর্থাৎ
বিচার প্রণালী বিশেষরূপে উপদৃষ্ট হইয়াছে। সেই বিচার প্রণালী প্রদর্শনই প্রকৃত ন্যায়
দর্শন। তাহারই প্রমাণ, প্রমেয়, সিদ্ধান্ত প্রভৃতি ষোলটি অঙ্গ ষোল পদার্থ বলিয়া লিখিত
হইয়াছে।”
এরপর ন্যায় দর্শনের তর্ক-পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা
আছে। যেমন আগের দর্শনগুলো নিয়ে লেখকের সবিস্তার ব্যাখ্যায় যাইনি, এবারেও যাব না। কেননা
‘পরমার্থ-তত্ত্ব অনুসন্ধান’ আমার সীমিত সাধ্যের বাইরে। ‘জগতের কারণ-নিরূপণ’এ ন্যায় দর্শনের অবদান, লেখক প্রথমেই রেখেছেন
যে তাঁরা বৈশেষিকের ‘বিশেষ’ নামের পদার্থকে বাদ দিয়ে একজন ‘নির্মাণকর্তা’ ঈশ্বরের কল্পনা করেছেন। কাজেই সৃষ্টি ব্যাপারটা
আর পদার্থে নিহিত গুণে স্বতঃসৃষ্ট রইল না, এক ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হল, যদিও, “তিনি যাহা জানিবার ও ইচ্ছা করিবার, একবারেই
জানিয়া ও করিয়া রাখিয়াছেন।” অর্থাৎ, সময়ের জন্মক্ষণে,
তারপর থেকে তিনিও নিছক পদার্থ।
সে যা হোক, ন্যায় প্রতিপাদিত তর্কশাস্ত্র ভারতের
দর্শনচিন্তার সম্পদ, এবং ঐতিহাসিক পরম্পরায় ইওরোপীয় চিন্তাপরম্পরার সাথে তুলনীয়, “গ্রীস-দেশীয় ন্যায়দর্শন-প্রবর্ত্তক শ্রীমান
এরিস্টট্ল এইরূপ অনুমান-প্রণালী প্রচার করেন। গোতমের সহিত তাঁহার বিশেষ এই যে, তাঁহার
তর্ক-প্রণালীতে প্রথম দুইটি অবয়ব বিদ্যমান নাই” (প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা ও হেতু)
“ফলতঃ সে দুইটি তাদৃশ
আবশ্যকও বোধ হয় না। গৌতম-কৃত অনুমান-প্রণালী শোধন করিয়া গ্রহণ করিলে যেরূপ হয়, এ অংশে
এরিস্টট্লের অনুমান-প্রণালী সেইরূপ।”
লেখক তাঁর “বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার” বইটার প্রথম ভাগের বিজ্ঞাপনে আক্ষেপ করেছিলেনঃ
“পূর্ব্বে যেমন ভারতবর্ষীয়
পন্ডিতেরা স্ব স্ব বুদ্ধি পরিচালনপূর্ব্বক জ্যোতিষাদি কয়েকটি বিদ্যার সৃষ্টি করিয়া
সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, দেইরূপ যবনাদি অন্যান্য জাতীয় পন্ডিতেরাও স্ব স্ব
ভাষায় বিবিধ বিদ্যা প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু এক্ষণকার ইউরোপীয় পন্ডিতেরা আপনাদিগের
অসাধারণ বুদ্ধি-বলে ঐ সকল বিদ্যার যেরূপ উন্নতি করিয়াছেন, তাহার সহিত তুলনা করিয়া দেখিলে,
সংস্কৃত জ্যোতিষাদিকে অতি সামান্য বোধ হয়।”
তিনি চাইতেন সেই ‘বুদ্ধি-বল’ ফিরে আসুক দেশে।
বৈশেষিক নিরূপিত পদার্থ সমুদয় এবং ‘বিশেষ’ এর বদলে ‘ঈশ্বর’এর সক্রিয়তায় ‘জগতের কারণ-নিরূপণ’ হয়ে গেলেও, ন্যায় অনুসারে ‘মনুষ্যের মুক্তি বা পারলৌকিক সদ্গতি-সাধনের
উপায়-নির্দ্ধারণ’এ জরুরি ন্যায়-নিরূপিত,
উপরোক্ত ষোলটি পদার্থের জ্ঞান।
“মোক্ষাভিলাষী ব্যক্তিদের
এই ষোড়শ পদার্থের বিষয় বিশেষরূপে জানা আবশ্যক। জানিলে কি হয়? না। শরীর যে আত্মা নয়
এইটি নিঃসন্দশয়ে জানিতে পারা যায়। জানিলে মুক্ত লাভ হয়।”
লেখক আবার ন্যায় দর্শনে ঈশ্বরের ধারণার উপস্থিইতি
নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
“দ্বাদশ প্রকার প্রমেয়
পদার্থের মধ্যে ঈশ্বর-পদার্থ পরিগণিত নাই কেন একথাটি বিবেচ্য। উত্তরকালীন নৈয়ায়িকেরা
উহার অন্তর্গত আত্মা শব্দটি জীবাত্মা ও প্রমাত্মা উভয়-প্রতিপাদক বলিয়াই ব্যাখ্যা করেন।
কিন্তু যখন বিশ্ব-কারণ নিরূপণ দর্শন-শাস্ত্রের একটি প্রধান প্রয়োজন, তখন প্রমেয় পদার্থের
মধ্যে ঈশ্বরের নাম পৃথক নির্দেশ না করা কোনরূপেই সঙ্গত ও সম্ভাবিত নয়। একটি সূত্রে
ঈশ্বরকে কারণ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে সত্য, কিন্তু উহার পর-সুত্রেই আবার মনুষ্য-কৃত
কর্ম্মকে কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা হইয়াছে। পশ্চাৎ ঐ উভয় সূত্র যথাক্রমে উদ্ধৃত হইতেছে,
পাঠ করিয়া দেখিলেই জানিতে পারা যাইবে, প্রথম সূত্রটি পূর্বপক্ষ ও পর সূত্রটি সিদ্ধান্ত।
পূর্ব্বপক্ষ – ईश्वर: कारणं पुरूषकर्म्माफल्यदर्शनात्। ঈশ্বর কারণ; কেন না মনুষ্য-কৃত কর্ম্ম সর্ব্বদা সফল হয় না। সিদ্ধান্ত
– न, पुरूषकर्म्माभवे फलानिष्पत्ते:। না, তা নয়। মনুষ্য কৃত কর্ম্ম ব্যতিরেকে ফলোৎপত্তি
হয় না।”
কী ব্যগ্রতা, নাস্তিকতা দেখার! এইসব প্রাচীন
ভারতীয় দর্শনের মূল পাঠে গিয়ে সত্যিমিথ্যে যাচাই করা আমার ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু উনবিংশ
শতকের বাংলায় বসে অক্ষয় কুমার কী ব্যগ্রতার সাথে এই সব দার্শনিক মতের নাস্তিকতা এবং
বস্তুবাদ যাচাই করছিলেন!
“… ভাবিলে বোধ হয় যেন,
কণাদ ও গোতম নামে দুইটি গুপ্ত বুদ্ধ বেদ-বস্ত্র পরিধান করিয়া” (কেননা “এদিকে তো নাস্তিক, কিন্তু বেদ উভয়েরই পরম শিরোধার্য্য বস্তু”) “প্রচ্ছন্নভাবে ভূমন্ডলে বিচরণ করিতেছেন।”
এরপর, উত্তরকালীন
নৈয়ায়িকদের নিয়ে আরো কিছু আলোচনা আছে। কেননা “ন্যায় দর্শনে বাঙ্গালা দেশকে ও বিশেষতঃ সরস্বতীর গৌড় পীঠ-স্বরূপ
সুপ্রসিদ্ধ নবদ্বীপ ভূমিকে জগদ্বিখ্যাত করিয়া রাখিয়াছে। এক সময়ে ঐ স্থানে ঐ দর্শন ও
উহার প্রিয় সহোদর বৈশেষিক দর্শনের সবিশেষ অনুশীলন ও সমধিক আন্দোলন সহকারে উত্তরোত্তর
উন্নতি লাভ হইতেছিল।”
মীমাংসা দর্শন।
“তর্ক-প্রণালীর উদ্ভাবন
করা যেমন ন্যায়দর্শনের উদ্দেশ্য, সেইরূপ, শ্রুতি-বিশেষের অর্থ-সমর্থন ও স্থল-বিশেষে
শ্রুতি ও স্মৃতির পরস্পর বিরোধ ভঞ্জন করিয়া ধর্ম্ম সংস্থাপন করা” জৈমিনি-প্রণীত এই মীমাংসা দর্শনের “প্রধান প্রয়োজন।”
“…শ্রুতি-বিশেষের তাৎপর্য্যার্থ
নিরূপণ এবং শ্রুতি-স্মৃতির বিরোধ সংক্রান্ত কোনরূপ সংশয় ও পূর্ব্বপক্ষ উপস্থিত করিয়া
তাহার বিচার ও সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। এই ব্যাপারকে অধিকরণ বলে। এই দর্শনে এইরূপ অনেক
অধিকরণ আছে। … ন্যায়শাস্ত্রোক্ত
অনুমানের ন্যায় মীমাংসা-শাস্ত্রোক্ত অধিকরণেরও পাঁচটি অঙ্গ; বিষয়, বিশয় (অর্থাৎ সংশয়),
পূর্বপক্ষ, উত্তর ও সঙ্গতি (অর্থাৎ মীমাংসা)। … এই দর্শনে কর্ম্মকান্ড-বিষয়ক শ্রুতিরই সবিশেষ আন্দোলন, বিচার ও
সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। এই নিমিত্ত ইহাকে কর্ম্মমীমাংসা বলে। ইহার মতে স্বর্গভোগই মনুষ্যের
পরম পুরুষার্থ। বেদোক্ত যাগ যজ্ঞাদি কর্ম্ম করিলে, উহা প্রাপ্ত হওয়া যায়। … এই দর্শনের মতে বেদ নিত্য।”
এধরণের দর্শন নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে লেখকের
ভালো লাগছে না। কিন্তু, তিনি যে ইতিহাসকার! বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা তাঁর দায়িত্ব এবং কর্তব্য!
আলোচনা শেষ না হতেই তাঁর রাগ, ক্ষোভ ফেটে পড়বে। কিন্তু তার আগে, বেদের নিত্যতা সম্পর্কে
মীমাংসার বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বেদের ঐতিহাসিকতাকে বিপরীতে দাঁড় করাচ্ছেন।
“বেদের যে অংশ ব্যক্তির
কৃত স্পষ্টই লিখিত আছে, এবং তন্মধ্যে নানা স্থানে ও নানা কালে বিদ্যমান লোকসমূহের ভক্তি
শ্রদ্ধা, রাগ দ্বেষ, কাম ক্রোধ, বিপদ আপদ, যুদ্ধ বিবাদ, ব্যসন বাণিজ্য ইত্যাদি অশেষ
প্রকার ব্যাপারের বিবিধ বৃত্তান্ত বিনিবেশিত রহিয়াছে, তথাপি জৈমিনি মহাশয়ের মত-প্রভাবে
তাহা অপৌরুষেয়, অর্থাৎ কোন পুরুষের কৃত নয়, স্বতঃসিদ্ধ নিত্য পদার্থ, তাহার আদিও নাই
অন্তও নাই এইরূপ অঙ্গীকার করিতে হইবে।”
এরপর একটি সংক্ষিপ্ত প্রসঙ্গে, প্রাচীন বিশ্বাসগুলির
বিশ্বজনীনতা দেখিয়ে লেখক একটি কৌতুহলোদ্দীপক মন্তব্য করেছেন।
মীমাংসা অনুসারে, “শব্দ নিত্য, কেননা অন্যকে উহার অর্থ-বোধ করাইবার
উদ্দেশে উচ্চারণ করা হয়। যদি উচ্চারণ মাত্রেই উহার বিনাশ হইত তাহা হইলে কেহ কাহাকে
উহার অর্থ-বোধ করাইতে সমর্থ হইত না।” এর ফুটনোটে আছে, “মানুষের মনের গতি অনেক স্থানে একরূপ দেখিতে পাওয়া যায়। চীনেদেরও
এইরূপ একটি বচন আছে যে, একবার শব্দোচ্চারণ করিলে, গগন-মন্ডলে চিরদিন তাহার প্রতিধ্বনি
চলিতে থাকে।”
মীমাংসা-প্রতিপাদিত সূত্রগুলির বর্ণনা করতে
লেখক আর পারছেন না। তাও উদাহরণ দিয়ে মীমাংসার তর্ক-পদ্ধতি দেখিয়ে দিয়েছেন।
“এরূপ দর্শনের কাল অতীত হইয়া যে বিজ্ঞানের অধিকার বিস্তৃত হইতেছে,
ইহাতে বিশুদ্ধ-বুদ্ধি সুশিক্ষিত ব্যক্তিরা এক প্রকার নিস্তার পাইতেছেন। সাধে কি রামমোহন
রায় সংস্কৃতকালেজ সংস্থাপনের বিরোধী হইয়া তৎপরিবর্ত্তে ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপনার্থ
অনুরোধ করেন?”
এরপর, লর্ড অ্যামহার্স্টকে
লেখা রামমোহন রায়ের চিঠি থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক কিছুক্ষণের জন্য প্রায় আত্মবিস্মৃত
হয়ে অন্য বিষয়ে চলে গেছেন। রামমোহনের অকালমৃত্যুর আঘাত যে তৎকালীন শুভবোধ-সম্পন্ন মানুষদের
জন্য কতটা বেদনাদায়ক, ভারতবর্ষীয়দের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে রামমোহনের মত ভাস্বর ব্যক্তিত্বের
উদয় যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, নতুন শিক্ষা প্রবর্ত্তনে, সমাজ-সংস্কারে, ইংরেজ সরকারের
শাসন-নীতি নিয়ে বিতর্কে রামমোহনের যে কি বিশাল অবদান তা নিয়ে দীর্ঘ বিষয়ান্তরে স্বদেশপ্রেমিক
অক্ষয় কুমার জড়িয়ে পড়েছেন। তাতে তাঁর নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত থাকলেও সেসব উদ্ধৃত
করলে আমার এই লেখাতেও বিষয়ান্তর হবে। যাহোক, নিজেই স্বীকার করেছেন বিষয়ান্তর, “পূর্ব্বতন শোক-সংবাদ নবীভূত হইয়া উঠিল। অশ্রুজল
নিবারণে একেবারেই অসমর্থ হইয়া পড়িতেছি। এ সময়ে বিষয়ান্তর স্মরণ করিয়া উহা বিস্মৃত হওয়া
আবশ্যক। … আনুষঙ্গিক কথা-প্রবাহ
ক্রমশঃ বৃদ্ধি হইয়া পড়িয়াছে সত্য বটে, কিন্তু প্রিয়তম পাঠকগণ! যিনি ভারতভূমির দুঃখহরণ
ও শুভ-সাধনার্থ প্রাণ, মন, ধন সমর্পণ করেন, ‘মানবকুলের হিত-সাধন করাই পরমেশ্বরের যথার্থ উপাসনা” এই মহার্থ-বোধক পরম পবিত্র পার্সিক বচনটি
যিনি সতত আবৃত্তি করিয়া নিজ চরিতে নিরন্তর সম্যক রূপে তাহার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেন
…… উল্লিখিত কথাগুলি
তাঁহারই পূণ্য-প্রসঙ্গ বলিয়া আমারে ক্ষমা করিও।
এবার একটা বিস্ফোরক মন্তব্য করে মীমাংসা আলোচনায়
ফিরে এলেনঃ
“এখন, বেদ-প্রাণ হিন্দুমন্ডলি!
শ্রবণ কর। তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদ-মন্ত্রের মীমাংসাকারী পূর্ব্বকালীন
আচার্য্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন, না দেবতাই স্বীকার করিতেন। তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।
… বিস্ময়াপন্ন হইবেন
বোধ হয়। কিন্তু একথার অন্যথা হইবার সম্ভাবনা নাই। মীমাংসা-পন্ডিতেরা বিশেষতঃ প্রাচীনতর
মীমাংসকগণ, মুক্তকন্ঠে ও সুষ্পষ্টরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া গিয়াছেন।”
এরপর লেখক উদ্ধৃতি
দিয়ে, ব্যাখ্যা করে এবং বিভিন্ন মীমাংসকদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই দর্শনের জগত-ব্যাখ্যায়
ঈশ্বর ও দেবতাগণের অনুপস্থিতি দেখিয়েছেন।
বেদান্ত দর্শন।
“অবশিষ্ট প্রধান দর্শনটির
নাম বেদান্ত। মীমাংসা যেমন কর্ম্ম-মীমাংসা, বেদান্ত সেইরূপ ব্রহ্ম-মীমাংসা। যাঁহা হইতে
জগতের উৎপত্তি স্থিতি ও ভঙ্গ হয়, তিনিই ব্রহ্ম।”
এখানে, মীমাংসা দর্শনের ‘শব্দ’ ধারণাটির ব্যাখ্যায় একটা ফুটনোট প্রাসঙ্গিক হতে পারে, “পূর্ব্বেই লিখিত হইয়াছে, মীমাংসার মতে একটি
নিত্য শব্দ সকল অনিত্য শব্দের অন্তর্ভূত আছে; কেহ কেহ সে শব্দকেই ব্রহ্ম বলেন।” দুই দর্শনের সম্পর্কটা স্পষ্ট, “জৈমিনি দর্শন পূর্ব্ব মীমাংসা এবং বেদান্ত-দর্শন
উত্তর মীমাংসা বলিয়া প্রসিদ্ধ।”
এরপর বিস্তারে গিয়ে লেখক এই দর্শনের ব্যাখ্যা
করেছেন। এবং সে ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে করেছেন, যাতে দর্শনটির একেকটি ধারণার
অন্যের সাথে প্রতিসাম্য এবং সব মিলিয়ে তার আভ্যন্তরীণ সঙ্গতি দেখা যায়। এই মতবাদের
যে বিশ্বজনীন স্বরূপটা বিভিন্ন মনিষীদের চিন্তায় পরিলক্ষিত হয়, আবার সাকারপন্থী, যেমন
সাধককবি রামপ্রসাদের গানেও পরিলক্ষিত হয়, সে সমস্ত কিছুর বিশদ চর্চা করেছেন। বুদ্ধদেবের
মৃত্যুর বছরটির সাথে মিলিয়ে মতবাদটির কালনির্ণয়ও করেছেন।
সবশেষে এই দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাকারদের নামোল্লেখ
করার পর লিখছেন –
“উল্লিখিত রূপ দার্শনিক
গ্রন্থকারেরা অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি তত্ত্বানুসন্ধানের
প্রকৃত পথাবলম্বন পূর্ব্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-মার্গে বিচরণ করিতে পারিতেন, তবে বহুকাল
পূর্ব্বে ভারত-ভূমিও ইয়ুরোপ-ভূমির ন্যায় এ অংশে ভূ-স্বর্গ-পদে অধিরূঢ় হইতেন, তাহার
সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতিসিদ্ধ নিয়মাবলী নির্দ্ধারণ
পূর্ব্বক কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চেষ্টা না করিয়া কেবল আপনাদের
অনুধ্যান-বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মনঃকল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন।
তাঁহাদের একটি পথ-প্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন্ - একটি বেকন্ - একটি বেকন্ তাঁহাদের
আবশ্যক হইয়াছিল। একটি তাদৃশ গুরুর আশ্রয়-বিরহে, তাঁহারা মেঘাচ্ছন্ন ও তিমিরাবৃত নিশীথ
সময়ে দুর্গম বনস্থলে পথ-ভ্রান্ত পথিকের ন্যায় চিরজীবন পরিভ্রমণ করিয়াছেন। যদি কদাচিৎ
এক একবার ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুল্লতা প্রকাশিত হইয়া অন্ধকারের বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দেয়, পরক্ষণেই
আবার ঘোরতর তিমির-রাশি উপস্থিত হইয়া সমুদায় আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। তাঁহাদের চিরস্থায়ী
সূর্য্য-প্রভা আবশ্যক ছিল।”
তারপর যুদ্ধজয়ের জন্য সেনাদলে “একটি রণজিৎ - একটি বোনাপার্ত্ - একটি ওয়াশিংটন”এর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলছেন –
“ধী-শক্তি অংশে তাদৃশ
পরাক্রমশালী, দিগবিজয়ী, বীরপুরুষ প্রাপ্ত হইলে, ভারতভূমি অক্লেশে অজ্ঞানের অধিকার হরণ
করিয়া বিজ্ঞানকে সিংহাসন প্রদান করিতে পারিতেন। কিন্তু বুঝি এ জল-বায়ু-মৃত্তিকায় প্রকৃত
তত্ত্ব-পথ-প্রদর্শিনী, যুগ-প্রলয়-কারিণী, নবোদ্ভাবিনী, মহীয়সী বুদ্ধি-শক্তির সমুদ্ভাব
হওয়া সম্ভব নয়। সে ব্যাপারটি বুঝি ইয়ুরোপেরই কার্য্য। রত্ন-গর্ভা ইয়ুরোপ দুই কালে যেরূপ
দুইটি অমূল্য রত্ন প্রসব করিয়াছেন, সেরূপ আর কস্মিন্ কালে কুত্রাপি হয় নাই। বেকন্
ও কোন্ত্, দুই ভূখন্ডের উপর দুই সূর্য্য। ঐ দুইটি পরম পবিত্র জ্যোতির্ময় শব্দ মূর্ত্তিমান
জ্ঞানেরই সংজ্ঞা।”
ভুয়সী প্রশংসা করেছেন এই দুই দার্শনিকের। বুঝতে
অসুবিধা হয় না যে এই প্রশংসা জগৎ-চিন্তায় বিজ্ঞানমনস্কতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি শুরু করার
জন্য, ইংরেজ-স্তুতি নয়। কিন্তু তাহলে কি ভারতীয় প্রাচীন দর্শনচিন্তা ফ্যালনা?
“তথাপি, সুপ্রাচীন দার্শনিক পন্ডিতগণ! তোমরা পূর্ব্বকালীন বুদ্ধিমান
লোকের মধ্যে অগ্রগণ্য। তোমরাই মনুষ্যের বুদ্ধিচালনায় পথ প্রদর্শন করিয়াছ। তোমাদের বিচার-প্রণালী
ও তাহার ফলাফল পর্য্যালোচনা করিয়া বিজ্ঞানবিৎ সুবুদ্ধি ব্যক্তিরা মানবকুলের জ্ঞানাধিকারের
চরম সীমা অক্লেশে নির্দ্ধারণ করিয়াছেন। কিন্তু তোমরা যে কয়টি মূল বিষয়ের (বিশ্ব-কারণের
স্বরূপ, আদিম সৃষ্টি-প্রকরণ ইত্যাদি বিষয়ে) তত্ত্বানুসন্ধানে অনুরক্ত ছিলে, তাহা মনুষ্যের
জ্ঞেয় বিষয় নয় এবং যে তীর্থ-পর্য্যটনে (মুক্তি প্রভৃতি পারলৌকিক অবস্থার জ্ঞান-লাভে)
প্রবৃত্ত হইয়াছিলে, তাহাও তাঁহার অধিগম্য নয়।”
এই কথাগুলোয় নিজের দেশের ও জাতির চিন্তাজগতের
উন্নতিসাধনে লেখকের ব্যাকুল আকাঙ্খা প্রকাশ পেলেও, মার্ক্সপূর্ব বস্তুবাদের ইতিহাসবোধ
এবং/অথবা হেগেলীয় বিষয়গত ভাববাদের ইতিহাসবোধ, দুটোরই অভাব দেখা যায়। “পথ প্রদর্শকের অভাব”, “জ্ঞেয় বিষয় নয়” ইত্যাদি মন্তব্য আজ অত্যন্ত হাল্কা মনে হয়। তাঁর নিজেরই কথা, বিশ্বের
যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতিসিদ্ধ নিয়মাবলী নির্দ্ধারণ”এ যদি মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাসও
শামিল হত, যদি হেগেলীয় ঢঙেও শামিল হত, তাহলে “পথ প্রদর্শকের অভাব”, “জ্ঞেয় বিষয় নয়” ইত্যাদি মন্তব্য থাকত না।
দ্বিতীয়তঃ, লেখক ‘উপক্রমণিকা’য় দর্শন-বিচার এখানে শেষ করছেন। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনে নিরীশ্বরবাদের
প্রাধান্য (এমনকি বেদান্ত-দর্শনেও, “জগৎ সৃষ্টই হয় নাই, বিশ্বব্যাপার ভ্রমমাত্র, ইহাতে আর সৃষ্টিকর্ত্তার
সম্ভাবনা কি?”) পূনর্বার উল্লেখ
করে বলছেন, “এই ছয় ব্যতিরেকে
আরও কতকগুলি দর্শন শাস্ত্র বিদ্যমান আছে; তাহার মধ্যেও সমুদয় আস্তিকতাবাদ নয়। চার্ব্বাক
তো ঘোর নাস্তিক; না ঈশ্বরই মানেন, না পরকালই স্বীকার করেন।” এবং তারপর, ‘সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ’ (আশা করা যায় বন্ধুবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
সম্পাদিত) থেকে চার্ব্বাক দর্শন সম্পর্কিত শ্লোক-সমুদয় উদ্ধৃত করেন। আবার, উপনিষদ-সমকালীন
আরো কিছু নিরীশ্বরবাদী ধারণার সন্ধান দেন। এমনকি, প্রাচীন গ্রীক দর্শনের সাথে প্রাচীন
ভারতীয় দর্শনের তুলনা করে এইচ এইচ উইলসনের এই মতকেও সমর্থন করেন যে ভারতের প্রাচীন
দর্শন গ্রীস প্রভাবিত নয়, বরং গ্রীসের প্রাচীন দর্শনই ভারত প্রভাবিত। তা সত্ত্বেও,
বৌদ্ধদর্শন এবং জৈনদর্শন নিয়ে আলাদা করে কোনো আলোচনা করেন না। যখন নাকি, ধর্মমত থেকে
বিযুক্ত করে এই দুইএর দর্শন বা জগদ্বিচার-পদ্ধতিকে প্রাচীন দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করা
শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধ নিয়ে আলোচনা আছে। বিশদ ও ভালো আলোচনা আছে। কিন্তু কৃষ্ণের পর! অর্থাৎ, মনুসংহিতা, মহাকাব্যের
(রামায়ণ ও মহাভারত) পর পুরাণ-অংশে। কেন?
কেননা, দর্শন নিয়ে আলোচনা বা দর্শনের ইতিহাস
লেখাকে তিনি তাঁর এই বইয়ের কেন, জীবনেরও উদ্দেশ্য মনে করেন নি। দেশটা জার্মানি নয় ভারত,
এখানে দর্শন-চিন্তা ধর্ম-চিন্তার হাত ধরেই এগিয়েছে, এবং সাধারণভাবে ধর্ম-চিন্তাকেও
তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য মনে করেন নি, যেমন রামমোহন রায় মনে করেছিলেন বা দেবেন্দ্রনাথ
ঠাকুর মনে করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সমসাময়িক বাঙালি সমাজকে, বিশেষ করে হিন্দু
সমাজকে বোঝান যে বিজ্ঞান অধ্যয়ন ও বিজ্ঞানচিন্তা ছাড়া স্বদেশচিন্তা অর্থহীন। সত্যি
সত্যি স্বদেশের কল্যাণ চাইলে প্রাচীন গৌরব কপচালে চলবে না, জ্ঞানে, বিদ্যায় শাসনকারী
ইংরেজজাতির বা ইয়োরোপের সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে। তারই আনুসঙ্গিক বিস্তারে তিনি হিন্দু
সমাজকে এটাও দেখাতে চেয়েছিলেন যে তারা যেটাকে ধর্ম বলে মানে সেটা ধর্মই নয়, একটা গোঁজামিল;
হিন্দুধর্মকে খুঁজতে হলে খুঁজতে হবে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’এর বিচিত্র বিবিধতায় – এবং এই বহুবিচিত্র, বর্ণময় হিন্দু আস্থাযাপনের প্রাচীনতম শিকড় যে
দর্শনচিন্তায়, সে দর্শনচিন্তার বহুলাংশে ঈশ্বরও নেই, সর্বময় কর্তাও নেই, স্রষ্টা, ত্রাতা
কিছুই নেই। অথচ সেসব কিছু না জেনেই হিন্দুসমাজ নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব তো করেই, তার
থেকেও দোষনীয় যে সেই মিথ্যে গর্বকে দাঁড় করায় আধুনিক বিজ্ঞান-অধ্যয়ন, বিজ্ঞান-চিন্তা
এবং তার জন্য জরুরি ইংরেজি ভাষাশিক্ষার বিরুদ্ধে। সেই জন্যেই, বৌদ্ধ বা জৈন দর্শনের
স্বরূপ তাঁর সামনে উদ্ঘাটিত (বিদেশি ভারতবিদদের গবেষণার মাধ্যমে) থাকা সত্ত্বেও তিনি
বুদ্ধ (এবং মহাবীরকেও) সেখানে রাখেন, হিন্দুসমাজ নিজেদের আত্মম্ভরিতায় যেখানে রাখে
– অর্থাৎ, পুরাণে
বর্ণিত অবতারসমূদয়ের একেকজন অবতার হিসেবে। তারপর সেখানেই তুলোধোনা করা শুরু করেন হিন্দু-পন্ডিতদের
ছড়ানো ভ্রান্তিটাকে –
“বুদ্ধ। এখন হিন্দু-সমাজে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ-ধর্মের বিষয় সবিশেষ প্রচারিত নাই।
অতএব হিন্দু-শাস্ত্রোক্ত বুদ্ধাবতারের প্রস্তাব লিখিতে হইলে, প্রথমে উল্লিখিত বিষয়
কিছু অবগত করা আবশ্যক।
“ভারতবর্ষীয় আর্য্য-বংশীয়দের ইতিহাস দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত; হিন্দু
ও বৌদ্ধ। হিন্দুধর্ম আবহমান কাল প্রচলিত ছিল, ইতিমধ্যে একট মহার্থকরী মহীয়সী ঘটনা উপস্থিত
হইয়া হিন্দুধর্ম্মের ইতিহাসকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া দেয়। তাহাতে ধর্ম্ম বিষয়ের একটি
বিষম বিপ্লব ঘটিয়ে গিয়াছে বলিলে হয়। সেইটি বেদ ও বর্ণাভিমানের মস্তকোপরি পদাঘাতকারী
বৌদ্ধধর্ম-প্রকাশ বই আর কিছু নয়। অসাধারণ মানসিক বীর্য কেবল ইয়ুরোপেই উৎপন্ন হয়
এমন নয়; এক কালে ভারতভূমিতেও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় মানবীয় মনের অন্তর্ভূত
প্রজ্বলিত অগ্নি-রাশি সতেজে বিনির্গমন পূর্ব্বক চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া ভূমিকম্প উৎপাদন
করিয়াছিল।”
কিন্তু সেখানে পৌঁছোতে হলে লেখককে অনুসরণ করতে
হবে মনুসংহিতা, মহাকাব্যাদি হয়ে পুরাণ, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি নয়ে আলোচনার পথে।