-
আজকাল তো অনেক উন্নতি হয়েছে চিকিৎসার।
মানসিক প্রতিবন্ধকতা আর তেমন ব্যাধি নয় যে সব আশা ছেড়ে দেব। মানুষ চেষ্টা করে। কিছু
হওয়া না হওয়া ভগবানের হাতে। তবে এমন নয় যে কিছু হয় না। রোজই তো টিভিতে দেখায়
মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরা সঠিক চিকিৎসায় আর যত্নে কেমন নানা কাজে বিকশিত
করছে নিজেদের! খেলা করছে, ছবি আঁকছে, গান গাইছে, লেখাপড়া শিখছে, হাতের কাজ করছে – সমাজের বোঝা হওয়ার বদলে সমাজের সম্পদ হয়ে উঠছে।
-
আসলে গ্রাম্যতা। গ্রাম থেকে যত
দূরে চলে যায় মানুষ, গ্রাম তাকে আরো বেশি করে টানে। গ্রামে থাকলে যা কিছু মানুষ তোয়াক্কাও
করেনা – আর কিছু না হোক নিজের শহুরেপনা দেখাতে – শহরে চলে এলে সে সব কিছুই তাকে আক্রান্ত করে। সে ভয় পায়,
পদে পদে মেনে চলতে চায় বিধির বিধান আর নিষেধ। ... ধরে নাও যদি ভালো হতই, চিকিৎসায়।
এ দেশ ও দেশ গিয়ে, অনেক টাকা খর্চা করে, বাড়ি, জমি, ঘটি, বাটি সব বিকিয়ে দিয়ে।
পুরোপুরি ভালো হত কি? স্বাভাবিক হত? একটু ভালো হত। তারপর? বড় হত। মেয়ে বলে কথা!
বিয়ে হত? কে বিয়ে করত? তাও মেনে নিচ্ছি। কেউ করত। স্বাভাবিক কোনো ছেলে অথবা তারই
মত প্রতিবন্ধী কোনো ছেলে। তাদের যে সন্তান হত, সেও যে প্রতিবন্ধী হত না – তাও আবার শারীরিক নয়, মানসিক প্রতিবন্ধকতা বলে কথা – বলা যায়?
-
তাছাড়া যা সমাজ হয়েছে আজকাল! যা
দিনকাল পড়ছে! বোধবুদ্ধিহীন ডাগর মেয়ে। কোথায় কে ওৎ পেতে বসে থাকত! ভিখিরিকে,
পাগলকে ধরে লালসা চরিতার্থ করতে ছাড়েনা, এত পশু হয়েছে মানুষ। সে এক কেলেঙ্কারি হত
সমস্ত পরিবারের জন্য।
-
যাই বল। কত সহজে ও নিজের মৃত্যু
দিয়ে সবাইকে মমতা, মায়া, স্নেহ, দুর্ভোগ, কষ্ট ... সব কিছু থেকে মুক্তি দিয়ে গেল!
কিন্তু আমরা আমাদের সমস্ত কিছু দিয়েও, মানে দেওয়ার পরিস্থিতিতে থেকেও ওকে ওর কষ্ট থেকে
মুক্তি দিতে, নতুন জীবন দিতে অক্ষম রয়ে গেলাম।
-
আমরা? পরিস্থিতি?
সমস্ত কিছু? কী যে বল! তাহলে আবার রাজনীতি, অর্থনীতি টেনে আনতে হয়। সেই ১৯৫৬য় রাজ
কাপুর তাঁর ‘আহ’ ছবিতে বলিয়েছিলেন – মনে আছে?
ডাক্তার নায়কের বাবাকে বলছে, “আর দু’তিন বছর।
সারা পৃথিবীতে গবেষণা চলছে। দু’তিন বছরে আমরা যক্ষ্মার এত ভালো ওষুধ
দিতে পারব যে কেউ আর একে প্রাণনাশক ব্যাধি বলবে না। কিন্তু দুঃখের কথা যে আপনার ছেলেকে
ততদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।”... সে যাই হোক। ওষুধ তো সত্যিই বেরিয়ে এল। তা বলে কি মানুষ এখনো
মরছে না যক্ষ্মায়? নতুন নতুন ধরণের যক্ষ্মা ধরা পড়ছে। ... আর বিজ্ঞান তো এখন আরো তাঁবেদার।
নইলে ক্যান্সারের ওষুধ কবে বেরিয়ে যেত। ... আমরা যদি সত্যিই ‘আমরা’ থাকতাম,
কালাজার আর ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়া আর প্লেগ ফিরে আসত? থাক! এসময় রাজনীতির কচকচি আর ভালো
লাগে না।
* * * * *
-
ঠাকুরদা
রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই বৌ-অন্ত প্রাণ। শুচিবাইগ্রস্ত ঠাকুমা সারাদিন বাল্টি
বাল্টি জল দিয়ে ঘর ধুতে থাকেন আর ঠাকুর্দা নিষ্ঠা ভরে সেই জল এনে দেন। কোথাও ছুঁয়ে
গেলে চুপ করে বৌয়ের বকুনি শোনেন।
-
আর, বাকি
সময়?
-
বাকি সময়
মেয়েটির, মানে নাতনির কাছে বসে থাকতেন। চান করাতেন। খাইয়ে দিতেন। খেলাবার, হাসাবার
চেষ্টা করতেন নানা ভাবে।
.........
-
বাবা!
বাজারে আপনি যাবেন? না আমি যাব?
-
হ্যাঁ,
এই যাচ্ছি। মেয়েটাকে একটু খাইয়ে নিই। খা বাবু, খা ... এ ...এ ... এই যে। আর একটুখানি
আছে।
-
ও শেষ
হতে একঘন্টা লাগবে। কিছুটা তো খেয়েছে! এবার ছেড়ে দিন। দেরি করলে ফিরতেও দেরি হবে।
কাঁচা সবজি কিছুই বাড়িতে নেই। ... সবিতা! এই কাপড়গুলো ছাতে মেলা হয় নি... শুকোবে
কী করে? আমি দিয়ে আসছি ছাতে।
-
একটু শোনো
না এদিকে!
-
কী?
-
বাবার
জন্য অপেক্ষা না করে বাজারটা করে দাও। খেয়ে যাবে কী? রবিকে তো দুধরুটি খাইয়ে
স্কুলে পাঠালাম। আর ঐ কাপড়গুলো ছাড়। শুকনো দিন, বেশিক্ষণ লাগবেনা শুকোতে।
-
ঠিক আছে
যাচ্ছি। সামনের দোকান থেকে কিছু একটু এনে দিচ্ছি। বড় বাজারটা বাবার জন্যই থাক।
বাবা তো ওকে পুরোটা না খাইয়ে ...
* * * * *
-
কিষণ
অনেক ধারধোর করে এই বাড়িটা করেছে। তারপর বাবা-মাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এক ছোটোকাকাও
বেশির ভাগ সময় এখানেই কাটান। কিষণের ছেলেটা তো ছোটো, ছটফটে। স্কুল, পড়াশোনা, খেলা।
... ওকে তো কাছে পেতেন না ঠাকুর্দা। তাই নাতনিকে – নিজের সারা
জীবনের এক অবোধ করূণার নাকি এক করুণ অবোধ্যতার রসদ হিসেবে নিয়ে বসে থাকতেন।
-
কত বয়স
হয়েছিল?
-
তিরাশিতে
বিয়ে ... তা পনেরো, ষোলো, সতেরো ... না ষোলো ... না সতেরো! হ্যাঁ সতেরো! সতেরো তো
হয়েই গিয়েছিল।
... ছোটো ছিল যখন, দেয়াল ধরে দাঁড় করিয়ে দিলে
দাঁড়িয়েও থাকত। হয়ত মাথায় কোনো বোধশক্তি ছিল না বলে হাতে পায়ে জোর খেলত অসম্ভব। যখন
বুকের ওপর বসিয়ে খেলা করতাম, দুটো পা আমার গলার দুদিকে ঝুলিয়ে মাঝে মাঝে চেপে ধরত।
চেপে ধরা কাকে বলে, কোথায় গিয়ে থামতে হয় তা বুঝত না বলেই অসহ্য হত সে চাপ। নিঃশ্বাস
বন্দ হয়ে আসত... হাঁসফাঁস করতে করতে জোর করে ছাড়াতাম ওর পা দুটো। কিছুই তো ধরতে
পারত না হাত দিয়ে। কিন্তু নিজের অজান্তেই যদি হাতের আঙুলগুলো বসে যেত আমার কব্জিতে,
ভালো মত হ্যাঁচকা টানে ছাড়াতে হত।
...
ধীরে ধীরে বয়সের সাথে ধড়টা একটু বাড়তে লাগল, কিন্তু কোনো ব্যবহার নেই বলে শুকিয়ে
যেতে লাগল হাত পা।
...
হাঁটা চলা ছিল না বলেই মাঝে মধ্যে ওর পেট খারাপ থাকত। দু’চারদিন
চলত জলের মত পায়খানা আর বমি। এবারও তো তাইই হয়েছিল। ভাবিনি যে শেষ হয়ে যাবে। তবে
এক ডাক্তার বলেছিল দশ বছর আগেই, যে এধরণের বাচ্চারা কুড়ি পেরোতে পারে না।
...
রাত তিনটে নাগাদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওর মা তো আসতেই পারল না। লখনউ গিয়েছিলাম আমরা
দুজনেই। শ্বশুরমশাই, মানে ওর বাবাকে দেখতে। আমি একদিন আগে রওনা দিয়েছিলাম। ... আশ্চর্য!
ওর মায়ের আসার অপেক্ষায় প্রায় আঠাশ ঘন্টা ওকে বরফে শুইয়ে রাখতে হল ; রাতে মাঝে মধ্যেই
পেটে হাত রেখে দেখছিলাম – পেটটা ফুলছে না তো? নাঃ, ঠিক তেমনই পিঠের সঙ্গে সেঁটে
থাকা পেট, পাঁজরগোনা বুক আর জলের অভাবে কালো হয়ে যাওয়া শরীর!
... কী দৈব যে আমি ফিরে
আসতে পেরেছিলাম ওর মৃত্যুর আটঘন্টা আগে! একেই ডাক বলে!
* * * * *
-
বাবু!
অতিথিদের নিয়ে ওপরে চলুন, খাবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
-
এখনই?
-
বিয়ের
ব্যাপার তো নয়, মৃত আত্মার কল্যাণে একটু কিছু মুখে দেওয়া। চলুন, চলুন, লুচিগুলো
গরম ভাজা হচ্ছে এখন।
No comments:
Post a Comment