গঙ্গা-তটবর্তী এই শহরে ফাল্গুন শেষ হতে না হতেই প্রচন্ড গরম
পড়ে যায়। দ্রুততর গতিতে গাছগাছালি শেষ হয়ে যাওয়াও এর একটা কারণ। বিশেষ করে এবার
আরো বেশি গরম পড়েছে। তাই সে যখন ঘরে ঢুকে বসে একটা বইয়ের পাতায় নিরুদ্দেশ চোখ রেখে
প্রশ্ন করল, “দারুণ সুন্দর ছিল আজকের সকালটা না?” তখন তার স্বরে একটা বক্রোক্তির আভাস পেয়ে অবাক হলাম।
ভিতরে গিয়ে মা’কে দুকাপ চায়ের অনুরোধ করে এসে ঘরে ঢুকতে দেখলাম সে ডানদিকের মেঝের ওপর আপাতলক্ষ্যহীন
দৃষ্টি রেখে ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবছে। আমার সাড়া পেয়ে ঘুরে তাকাল। আমি জলের
বোতলটা টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে গলা ভেজালাম। সে হাত বাড়িয়ে চাইল। জল খেয়ে, হাতের তেলো
দিয়ে মুখটা মুছে, গোঁফের ওপর আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে উঠল, “আবিশ্বএকাত্মবোধ”...!
-
তার মানে? ওইরকম ভারি একটা শব্দ তুলে
আনলে কোত্থেকে?
-
নাঃ, বোধহয় ভুল হল, অন্য কোনো শব্দ
হবে।... যা বলতে চাইছি তা হল যে যদি কোনো অনুভূতি, সুখ বা দুঃখের, আনন্দের বা
যন্ত্রণার, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মনে এক সাথে, এক ভাবে আসে, বোধের সে পর্যায়টাকে
কী বলবে?
-
হয় তোমার চিন্তার এ্যাবসার্ডিটি অথবা
বোধের মৃত্যু!
উত্তরটা এত পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক দেব সে আশা করেনি। তা তার মুখের
খানিক ছায়াচ্ছন্নতায় বোঝা গেল। কিন্তু সামলেও নিল তক্ষুনি। হাসতে হাসতে প্রশ্ন
করল, “আজ সকালে উঠে কী করলে?”
“দাঁড়াও, বলছি” বলে আমি চা আনতে উঠে গেলাম।
চা নিয়ে ফিরে আসতে সে আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, সকালের কথায় পরে আসছি, আগে বল কাল রাতে কী করছিলে?”
-
তুমি যা বলতে চাইছ সেটা বল তো! কিছু একটা তোমার মনে রয়েছে। তুমি তার জন্য নাট্যমুহুর্ত
গড়ে তুলতে চাও মনে হচ্ছে।
-
তা ঠিক।
বলছি। তবে আগে বল কাল রাতে কী করছিলে।
-
কখন?
-
এই একটা
কি দুটো নাগাদ।
-
করব কী? তখনই
তো ঘুমোলাম। একটা অব্দি ছটফট করেছি গরমে। হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে টের পেয়ে বাইরে
গিয়ে দাঁড়ালাম – দেখি মেঘে ভরে গেছে আকাশ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া
উঠছিল বেশ জোরে ... কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে মনে হল। ভিতরে এসে মাথায় মুখে জল
দিয়ে শুয়ে পড়লাম, পাক্কা পাঁচ ঘন্টার গাঢ় ঘুম; কেন, তুমি কী করছিলে?
-
আমি তো
আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বড় ক্লান্ত ছিলাম কাল রাতে।
-
?
-
না, শারীরিক
কিছু নয়, মানসিক। ইদানিং কিছু লিখতে পারছি না। তাছাড়া রাতে ভালো ভাবে পড়তেও পারি
না। ফ্যান নেই, মশার জ্বালা, একটা ভালো ল্যাম্প কিনব ভাবছি – লোড শেডিং
তো চলবে এখন সেই শীত অব্দি..., রাত সাড়ে দশটা এগারটা অব্দি রেডিও, টিভি, পাশের
বাড়িতে ভজন, এদিকে আবার বাঁচোখটা বোধহয় খারাপ হতে চলেছে (কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে),
হঠাৎ দেড়টা নাগাদ ঠান্ডা হাওয়া আর বৃষ্টির ফোঁটায় জেগে উঠলাম ... অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল
বাইরে ... সোঁদা গন্ধ ... কালচে নীল চকচকে রাস্তাটা ঝলকে উঠল একবার। ... কী স্বপ্ন
দেখছিলাম মনে পড়ল না। আচ্ছা, তুমি লক্ষ্য করেছ কি? ধরে নাও একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছ
– ভ্যাপসা গরমের রাতে – হঠাৎ
স্বপ্নটা সুন্দর হয়ে গেল! হয়ত দেখছ কাদা, গলা অব্দি বন্যার জল, মাথার ওপর নড়বড়
করতে থাকা বড় বড় লোহার বীম ... হঠাৎ রেল লাইনে পা ফেঁসে গেল, ট্রেন আসছে ... বা
একটা লোক এগিয়ে আসছে ছুরি নিয়ে ... বা আরো বীভৎস অন্ধকার, বমি, ধর্ষণ ... একটা ঘোড়ার
করোটি নিঃশব্দ মৃত শহরে দেয়ালে ঝুলে আছে ... তার চোয়াল থেকে রক্ত গড়াতে আরম্ভ করল ...
তারপরেই করোটিটা কথা বলে উঠল অদ্ভুত ভাবে ... পাঁচজন সাদা কাপড় পরা বৈজ্ঞানিক
টেবিলের ওপর ঝুঁকে একটা নিরর্থক শব্দ নিয়ে দারুণ বিতন্ডায় মত্ত ... একটা মেয়ে
ক্রমাগত ফোন করছে কোনো শহরের বুথে দাঁড়িয়ে আর ডায়ালটোনগুলো স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে বোমা
পড়ার আওয়াজে (হাসতে লাগল সে)... বস্তুতঃ দুঃস্বপ্ন আর মাথার যন্ত্রণা আমাদের সময়ের
সবচেয়ে বড় মানবিক বোধ বলে চিহ্নিত হওয়া উচিৎ। ... যাই হোক, কিছু একটা দেখছিলে আর হঠাৎ
স্বপ্নটা সুন্দর হয়ে গেল। দেখলে, খুব ভোর বেলা একটা শিশিরভেজা পার্কে বেড়াতে এসেছ,
সঙ্গে অনেকে রয়েছে, যাদের ভালোবাস তারা সক্কলে – যারা মরে
গেছে, যারা অনেক দূরে চলে গেছে সক্কলে – তোমার কোলে একটা শিশু, অনেক বয়স
হয়ে গেছে তোমার, আর একটা অনুভব, সর্বান্তঃকরণে, যে পৃথিবীর যা হওয়ার ছিল ভাবতে,
অনেক রক্তক্ষয়ের পর তা হয়েছে ... আর তুমিও সে যুদ্ধে শরিক হয়েছ ... ভোর বেলায় চার
দিকে সবুজ, নীল, ভেজা ধূসর আর কমলা রঙের খেলা ... এক বেদনাময় অথচ আনন্দ অনুভব ...
এক্সট্যাসি ...! (আবার হেসে উঠল সে) তারপর ঘুম থেকে উঠে বুঝলে চিন্তার কোনো কারণ
নেই। কোনো বোধগত উপলব্ধি বা উত্তরণ ঘটেনি তোমার ... নিছক আবহাওয়াটা বদলে গিয়েছিল
সে সময়। হয়ত প্রচন্ড গরমের পর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল অথবা পাঁচ ঘন্টা লোডশেডিংএর
পর ফ্যানটা চলতে শুরু করেছিল বা আরো হাস্যকর – বুকের ওপর
হাত রেখে শুয়েছিলে, হাতটা নিজে থেকেই পাশে সরে গিয়েছিল, গোঙাতে হয়নি। ...(হেসে, একটা সিগারেট ধরিয়ে এ্যাশট্রেটা টেবিল থেকে তুলে পাশে নিয়ে, পা গুটিয়ে
বসল সে) অনেকক্ষণ জেগে ছিলাম। একটা সিগারেট খেলাম,
দরজা খুলে বৃষ্টির ছাঁট বুকে নিতে নিতে। ... ওঃ, এই কদিন গরমে একেবারে কাহিল করে ছেড়েছিল।
-
আবার তো
আজ দুপুর থেকে গরম শুরু হয়ে গেল। মাঝে আদ্ধেকটা রাত আর একটা সকাল। মার্চের শেষেই
এই অবস্থা, মে-জুনে কী হবে ভাবছি। আচ্ছা, তুমি সত্যিই এত কিছু স্বপ্নে দেখ? তা
আবার মনেও রাখতে পার? আমি তো কিছুই মনে করতে পারি না কী দেখেছি।
-
আমার মনে
থাকে। আর, একবার তো নয়, কিছু স্বপ্ন তো আমি বার বার দেখি ... মানে দেখছি গত – ধরে নাও
দশ বার বছর ধরে ...।
-
তুমি
একটা কেস!
-
বলতে
পার, (ওর মুখে আবার একটা বিচলন আর দুষ্টুমিভরা হাসি এসে চলে গেল)... চৈত্র শুরু
হতে না হতেই কী গরম পড়ে যায় এখানে!
-
আর বোলো
না, (আমি ওকে প্রশ্নে না জড়িয়ে নিজের মত এগিয়ে যেতে দিলাম) গরম বলে গরম? নামেই
বসন্তের দ্বিতীয় মাস। আসলে এটা গ্রীষ্মকাল, নিখাদ।
-
নাঃ, তা
বলা ঠিক নয়। গাছপালা, পাখি, হাওয়া, মানুষের চোখমুখ সবকিছুই তো বলে এটা বসন্ত! আমের
মঞ্জরী, পাতাঝরা, শিমুলের তুলো ওড়া, পলাশ ... আচ্ছা এবার গিয়ে মিউজিয়ামের সামনের
জ্যাকারান্ডা গাছটা দেখেছ? দেখে এস একবার, নীলচে বেগুনি ফুলে ভরে আছে।
-
আর ধুলো,
ঝড়, রোগ?
-
রোগ? ওতে
তো বসন্তের একচেটিয়ে মালিকানা স্বত্ব নেই। ভারতবর্ষের সবকটি ঋতুর পরিসংখ্যান এ
ব্যাপারে সমান। বরং অন্য একটা ব্যাপার আছে। ন্যাচারাল ডেথ, স্বাভাবিক মৃত্যু। বয়স্ক,
বৃদ্ধ মানুষদের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি এই ঋতুবদলটাতেই হয় না? প্রকৃতির একটা অদ্ভুত
নিয়মের মত! মিলন, সৃষ্টি আর মৃত্যুর একটা বাৎসরিক কালখন্ড?
কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে রইলাম দুজনে। এখনো
সে কথাটা বলেনি। আমারও ঔৎসুক্য বাড়ছিল। তাই আমিই আবার প্রসঙ্গে ফিরে এলাম।
-
অবিশ্বাস্য
সুন্দর ছিল আজকের সকালটা! ‘টমেটোর রসে ভেজা স্যালাডপাতার মত’ ...
কোট, নেরুদা। ... খিদে পাচ্ছে আমার। দেখি কী আছে। তুমি খাবে কিছু?
-
নাঃ।
আমি ভিতর থেকে মুড়ি মেখে নিয়ে ফিরে
এসে বসলাম।
-
সত্যি,
কী ভালো লাগছিল সকালে উঠে! একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল ঘুম ভাঙতে। উঠেই মনটা ভরে গেল।
বিছানার পাশেই খোলা জানলা দিয়ে পৃথিবীর একটা সবুজ দ্যুতিময় আয়তক্ষেত্র – বাড়ির দেয়াল
আর রাস্তাগুলো শৈশবের গন্ধে ভরে আছে – আর হাওয়া। যেন সদ্যস্নাত যুবতী
একগুচ্ছ অমলতাসের মত ঝুঁকে পড়েছে আমার বুকের ওপর।
-
সে কে?
-
সেটাই তো
মুশকিল, সে কেউ নয়। ... ‘গ্রীন গ্রীন আই লাভ ইউ গ্রীন’ ... উঠোনে
বেরিয়ে এসেছিলাম মুখ ধোওয়ার জন্য। আকাশের দিকে তাকাতেই পুর্ণিয়ার দিনগুলোর কথা মনে
পড়ে গেল, আকাশটা যেন নীল জামা পরা একটা বাচ্চা ছেলে, হাতে ঝকঝকে রুপোলি টিনের
বাক্স নিয়ে পাটক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়োচ্ছে ... আশ্চর্য, এই পাটক্ষেত টেত রিফ্লেক্সে
কী করে চলে আসে জানি না, পুর্ণিয়ায় তিন-চার বছর, তা বাদ দিলে তো এ শহরেই জন্ম, এ শহরেই
আছি। পলায়নবাদ, এস্কেপিজম! আহা, এই বিবর্ণ সভ্যতা থেকে বহুদূর, নির্জন প্রকৃতি, ইশ্বরের
কোল। শালা। সেই জোকটা শুনেছ তো? দুই এমেরিকান ট্যুরিস্টকে ট্র্যাভেল এজেন্ট লোভ দেখাচ্ছে,
“একেবারে ভার্জিন ফরেস্ট ম্যাডাম ... এই জটিল যান্ত্রিক
নিউইয়র্ক থেকে অনেক দূরে এক স্বর্গীয় নৈঃশব্দ আর শান্তির মাঝে ... আর সবচেয়ে বড় কথা
ম্যাডাম, পাঁচমিনিটের ড্রাইভে আপনারা মোস্ট সফিস্টিকেটেড মার্কেট স্কোয়ারে পৌঁছে
যেতে পারবেন।” ... শালা উদোম করে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ! নে পাথর ঘষে
হাতিয়ার তৈরি করে শিকার কর! কাঁচা মাংস খা! হেইল ইউ গ্রেট প্রিমিটিভিটি অ্যান্ড
ব্লেসেড চাইল্ডহুড অফ ম্যানকাইন্ড! পাছায় কাঁকড়া কামড় দেবে তখন তিড়িং তিড়িং করে
প্রিমিটিভ নাচ নাচিস! ... সারাঠ থেকে বাসাহা গিয়েছিলাম মনে আছে?
-
(ওর
উদ্দেশ্য বুঝে উত্তর দিলাম) মেঘলা আকাশ, বাদামি পাহাড়, তার কোলজোড়া ধানক্ষেত, মাঝে
লাল শাড়ি পরা একটি যুবতী কাজ করছে ...
-
হ্যাঁ,
কিন্তু কেন? এভাবে সুন্দরকে দেখা কেন? আমার মনে হয় এটাকে সৌন্দর্য হিসেবে দেখা
একটা বিকৃতি। বর্তমান পরিস্থিতি যেমন আছে, সেটা সেভাবেই রাখার সপক্ষে একটা বিকৃতি,
বা অনুভূতিপ্রবণ মনকে বিভ্রান্ত করার একটা চেষ্টা। কোলজোড়া ধানক্ষেত, লালশাড়ি-যুবতী
ইত্যাদির এই যে ছবি ... এসব এমন সৃজন যার উদ্দেশ্য হল ধ্বংস ...
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সে আবার প্রশ্ন
করল, “কী করছিলে আজ সকালে, বললে না তো?”
-
মুখ ধুলাম।
তাড়াতাড়ি স্নান করে, এক কাপ গরম কড়া চা খেয়ে সিগারেট ধরালাম, তারপর কিছু একটা শুরু
করি ভাবতে ভাবতে ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে বসলাম, অনেকদিন পর, আবার।
-
ঠিক, ঠিক!
(তার মুখ স্মিত হয়ে উঠল)
-
মানে?
(আমি সত্যিই আনন্দিত ও বিস্মিত বোধ করলাম) তুমিও পড়তে শুরু করে ছিলে নাকি? মনে আছে,
গত বর্ষায় এক দিন আমরা এক সাথে, এক সময়ে নিজের নিজের ঘরে বসে ‘শ্রীকান্ত’ পড়তে শুরু
করেছিলাম?
-
নাঃ, আজ ‘পথের
পাঁচালী’ নিয়ে বসিনি। তবে যা বলতে চাইছি তাহল যে সকালের ওই আবহাওয়া
আমাদের দুজনেরই ভিতরে প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এমন একটা উজ্জ্বল সকাল – যেন
বহুদিনকার আধকরা, হতাশ-হয়ে-ছেড়ে-দেওয়া কাজগুলোয় আজ আবার নতুন উদ্দীপনা নিয়ে হাত
দেওয়া যায় – বা একেবারে নতুন, আনকোরা কোনো কাজ শুরু করা যায়...।
-
আমরা যে
পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের মানুষ তা আমাদের প্রকৃতি-নির্ভরতায় টের পাওয়া যায়। একটা সকাল
নিয়ে এত ওড়াউড়ি!
-
মানি না।
রোজকার দিনযাপনে, রোজকার দিনযাপনে, তা সে যারই হোক, যেখানে হোক, দিনের মুহুর্তগুলো
দাগ কাটবেই।
-
সে যাক।
কিছু লিখলে মনে হচ্ছে!
-
লিখলাম। তবে
দাঁড়ায়নি এখনো।
-
কবিতা?
-
হ্যাঁ,
বড় কবিতা। ব্যাস, আর কিছু এখন শুনতে চেও না। লিখব এই আনন্দে লেখাই আর হল না। খুব
চেঁচিয়ে গাইলাম, ‘আমি চঞ্চল হে’। তারপর মায়াকভস্কি নিয়ে বসলাম। পাশে
হুইটম্যানকেও রাখলাম। আমাদের মহান পিতামহ। ... ‘ইট’ কবিতাটা
পড়েছ? ওটাই পড়লাম। প্রথমে ডিকশনারি দেখে দেখে। তারপর গলা খুলে জোরে। ... আর তারপরই
সমন! সাইরেন!
-
সাইরেন?
-
হ্যাঁ,
সকাল নটার সাইরেন। স্নান কর। ভাত গেল। দপ্তরে ছোটো। কবির বিশ্বসত্বা ছাপোষা কেরানি
হয়ে ছুটল।
সিগারেটে জোরে জোরে টান দিয়ে অ্যাশট্রেতে
ফেলে নিভিয়ে তারপর আবার শুরু করল সে।
খুব ইচ্ছা করছিল যে শহরের রাস্তায়
ওধারে তোমাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে যাব, কয়েকশ বছর পরের মত। হাত তুলে আজকের সুন্দর সকালটার
জন্য নাটকীয়ভাবে অভিনন্দন জানাব। কিন্তু উপায় ছিল না। দপ্তরে বসে জানলার দিকে তাকিয়ে
ছটফট করছিলাম। শেষে থাকতে না পেরে পাশে কাজ করতে থাকা সহকর্মীকেই বলে ফেললাম।
-
কী বললে?
-
বলব আর কী? সাধারণভাবেই হেসে জিজ্ঞেস
করলাম, ‘বড় সুন্দর ছিল আজকের সকালটা তাই না?’ আর সে (তার মুখে একটা বিমর্ষতা এল)...
-
কী বলল?
-
বলল, ‘হ্যাঁ তা সুন্দর ছিল বটে, কিন্তু সব তো গেল!’ আমি অবাক হলাম, “সব গেল মানে?” সে বলল, “চৈত্রের খাড়া ফসল তো সব নষ্ট করে দিল এই বৃষ্টি!" ধাক্কা
খেলাম। ঝন ঝন শব্দ করে একটা কাঁচের স্ট্রাকচার, নম গ্যাবোর মত, সকাল থেকে যেটাকে
গড়ে তুলেছিলাম ভিতরে ভিতরে, গুঁড়িয়ে গেল। দুঃখ পেলাম না। যেটুকু বাকি ছিল, নিজেই
গুঁড়িয়ে দিলাম। ... অথচ দেখ, এটা স্বাভাবিক। আমি যে জানতাম না তাও নয়। তবে সংবাদ
হিসেবে জানতাম যে রব্বির তৈরি ফসল, মানে দলহন আর তিলহন এই সময়ের বৃষ্টিতে নষ্ট হয়।
চাষের সাথে কোনো যোগসুত্র নেই আমার। তাই রিফ্লেক্স সেভাবে কাজ করে না। আর সেটা কথা
নয়। ধর, মনে পড়েই গেল। তাহলেই বা সকালটা অস্বীকার করব কীভাবে? ... তবু, এটা একটা
বিড়ম্বনা। যে বৃষ্টির রাত আর সকাল আমাকে অনুপ্রাণিত করল, ঠিক যে সময় আমি লিখতে
বসলাম ধরে নাও, ঠিক সে সময়েই এই শহরের একটু বাইরে এক চাষি দীর্ঘশ্বাস ফেলল বা আক্ষেপ
করল তার নষ্ট ফসলের দিকে তাকিয়ে! মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসত্বা বলে উত্তর
দিতে যেও না। প্রসঙ্গ বদলে নাও, দেখবে সব জায়গাতেই এই বিড়ম্বনাটা আছে। ...
* * * * * * *
উপরের কাহিনী অংশ বা বলা যায় দীর্ঘ সংলাপগুলো বহুবছর আগে লিখে
ফেলে রেখেছিলাম। আমাদের কথাবার্তা আরো অনেক দূর এগিয়েছিল। একটা সমাপ্তিও টেনেছিলাম
নদীর ধারে।
এতদিন পর সে সমাপ্তি ক্লান্তিকর মনে হয়। ইতিমধ্যে সে এবং
আমি দুজনেই জীবনটাকে কাজের মধ্যে বাঁচার চেষ্টা করছি। সাহিত্যের কাজ। রাজনীতির
কাজ। সুখদুঃখের সময় ছোটো হতে হতে প্রায় অদৃশ্য হয়েছে। নেশার মত হয়ে উঠেছে বর্তমান।
তবু সমাপ্তির একটা টুকরো সংলাপ এখনো টানে। সে বলেছিল, “মনে আছে, ‘ফল অফ বার্লিন’ সিনেমায় রাইখস্ট্যাগের চুড়োয় লাল পতাকা
ওড়াবার পর নেমে আসা, না, সরি, পতাকা যে ওড়াল সে তো গুলি খেয়ে মরল ওখানেই ... তার
সাথী যে ছিল, নেমে এসে ওপর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘দাভাশকিন!’ দেয়ালে, গম্বুজে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল সেই ডাক। সে জানত, দাভাশকিন বেঁচে
নেই। ওই ডাকে সে অতিক্রম করছিল বিশ্বযুদ্ধের সাতটি বছর – দুই কোটি দেশবাসীর মৃত্যু ও ধ্বংসে তৈরি সন্ধিক্ষণ। ... সব
রক্তক্ষয়ের শেষে যেদিন আনন্দমুহুর্ত আসবে পৃথিবীতে, সেদিন যারা বেঁচে থাকবে তারাও তেমনি
পিছন ফিরে তাকাবে। ইতিহাসে যতদূর দেখা যায় ততদূর দৃষ্টি মেলে তারা ডাকবে তাদের,
যারা সে দিনটা দেখার স্বপ্ন দেখেছিল সারা জীবন কিন্তু দেখতে পেল না। ... আনন্দ সুখদুঃখ
নয়, সুন্দরও সুখদুঃখ নয়, একটা বেদনাঘন উপলব্ধি, রণরক্তসফলতার ভিতরে এগোতে থাকা
একটা সত্য, জীবনের।”...
No comments:
Post a Comment