তখন খোয়াই অন্য রকম ছিল। কোপাইও তো অন্য রকম ছিল। প্রান্তিকে বাড়িঘর, অন্ততঃ স্টেশনটার আধমাইলের মধ্যে হয়নি। মানে, শান্তিনিকেতনও অন্যরকম আর আমার তো কথাই নেই। মাথায় শান্তিনিকেতনের স্ট্যাটাসটা ‘এ্যাই গরু, সর না’ থেকে একটু এগিয়েছে জাস্ট।
সদ্য ঘুরে এসেছি বিদিশা। বনলতা সেনের সাথে কোনো সম্পর্ক টের পাইনি। তবে
ওই উদয়গিরি না কি নাম ছিল – শিল্পিত গুহা দেখে ফেরার
পথে দাঁড়িয়ে পড়েছি চাকার মেলায়! হ্যাঁ, চাকারই মেলা বটে, বিভিন্ন ধরণের চাকা মাঠ ভর্তি
সাজানো!... হঠাৎ বুড়োটে দেখতে একটা লোক পথ আটকাল। কোথা থেকে আসছেন? পুলিশি জেরার
মত। কোথায় উঠেছেন? দুটোই বললাম। কেন এসেছেন?
‘ঘুরতে’ই বলেছিলাম, ‘বিদিশার
নিশা দেখতে’ বা ‘বনলতা সেনের সাথে
সম্পর্ক খুঁজতে’ বলিনি। কঠোর আদেশ পেলাম, বারো ঘন্টার মধ্যে বিদিশা ছেড়ে
দেবেন। ট্রেন থাকবে তবে তো! পেয়ে যাবেন। যাঃ স্সালা। এখানেও নকশাল আছে নাকি? দাড়িওলা
বাঙালি যুবককে এছাড়া আর কিছু তো ভাবতে পারে না এখানকার পুলিশ!
উনিশশো ছিয়াত্তর ছিল সালটা। এক বছরও হয়নি পাটনা ফিরেছি। পঁচাত্তরের বন্যা
পুহিয়ে একটু ঘুরছি এদিক ওদিক, কাছে, দূরে, একটু নিসর্গ, একটু ইতিহাস দেখছি ...কবিতার
মুখ খুঁজছি নতুন বন্ধুদের সাথে কথোপথনে, তাই মনে হল, কেউ যদি বরোব্বর চেটে নেয়? “ওমা!,
শান্তিনিকেতন যাওনি?”
সত্যি বলতে, বিদিশার নিশায় যেমন বনলতা সেনকে পাইনি, হোটেলের পাশের ঘর
থেকে জুয়ার হাল্লা আর মদের গন্ধ পেয়েছিলাম, শান্তিনিকেতনেও রবিঠাকুরকে ঠিক সেভাবে
পাইনি। ব্যস, বসের বাড়ি, ঘোরার চান্স পেয়েছি ঘুরে নিই, এই ছিল মনের ভাব।
বসেও ছিলাম অনেকক্ষণ ওই মাটির বাড়িটার ভিতর (কি যেন নাম?) কিন্তু পেটের
ভিতরে কিছু নেইই তো জাগবে কী? গোনাগুনতি শোনা-পড়া চার পাঁচটা গান আর
কবিতা। আর বিশেষ ফিলিংও জাগত না সেসব শুনে। শুধু মা’র
কন্ঠস্বরটা রান্নাঘর থেকে শুনতে পেতাম, ভালো লাগত। অবশ্য ফিলিং একেবারেই কখনো
জাগেনি বললে ভুল হবে। ছোটোবেলায় রান্নাঘরে বসে মা যখন শোনাত, “আমি
বনেই যাব চলে” – হাতপাখার ডাঁটির বাড়ি খাওয়ার মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে নয় হাপুস নয়নে
কাঁদতাম।
বোলপুরে নেমেছিলাম সন্ধ্যেবেলায়। সকালে উঠেই মনে হল, এখানকার লোকেরা
বেশ সচেতন যে এটা ট্যুরিস্টদের জায়গা, তাদের ভালো লাগাতে হবে পরিবেশটা। তবেই রুজি
জুটবে। নইলে সকালে, চা দেবে কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য ছেলেটি এত মিষ্টি বাঁশির সুরে ঘুম
ভাঙাত না। আর সে শুধু আমার ঘরে নয়, সব ঘরের জানলার কাছে গিয়ে। এত পরিচিত সুর!
প্রচলিত সুর, তবে আমি শুনেছিলাম বাবার গলায়, ‘লহ
গৌরাঙ্গের নাম রে’ গানটির সাথে। নাঃ, মনটা সিরিয়াসলি ভালো করে দিল ছেলেটি।
তৈরি হয়ে খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বোধহয় ছুটি ছিল সে সময়। মার্চ-এপ্রিলে
কিসের ছুটি? নাকি রবিবার ছিল হয়ত। যত লোক সব বেড়াতেই এসেছে। রবিঠাকুরের দেখা তো
কোত্থাও পেলাম না। তবে আরেকজনের দেখা পেলাম –
রামকিঙ্কর!
ইদানিং তো গিয়ে দেখেছি সব ঘেরাটোপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন খোলা ছিল।
সুজাতাকে পেয়েছিলাম বনপথে। মাঠে পেয়েছিলাম সাঁওতাল দম্পতিকে। আর কলের বাঁশি। ওফ্,
হাত দিয়ে, পিঠ দিয়ে, মাথার পিছনটা চেপে চেপে নিয়েছিলাম কংক্রিট হয়ে থাকা ওই পাথরকুচিগুলোর
ছোঁওয়া, বা বলব খোঁচা। হ্যাঁ, রামকিঙ্করকে পাওয়ার মত করে পেয়েছিলাম। আটত্রিশ বছর
পরে যখন পড়ছি ‘দেখি নাই ফিরে’, তখন ওই খোঁচাগুলো
কাজে লেগেছিল।
বললাম না, খোয়াই অন্যরকম ছিল! আজকের মত সাজানো গোছানো ছিল না, সামাজিক
বনসৃজনের দীর্ঘ শালগাছের সারি ছিল না, ছিল না ভিডিও শুটিংএর জন্য তৈরি বসে থাকা এথনিক,
এক্সকুইসাইট ঝোলামালা সুদ্ধু বাউলেররা। বন্য উজাড় ছিল লাল মাটির, মাঝে মাঝে গভীর খাতগুলো
নিয়ে যেন কারো একাকীত্বের ক্ষতের মত। যেই নামবে পুরো প্রান্তরটা তার একাকীত্ব হয়ে
যাবে। আমারও হয়ে গেল। জামাপ্যান্ট খুলে অনেকক্ষণ মার্চের রোদ্দুর পোহালাম ওই গভীর খাতে
শুয়ে। বা, নিজের একাকীত্বের গভীরে শুয়ে। বুড়োটা, মানে রবিবস্ হাসছিলেন কিনা জানি
না।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে কোপাইয়ের ধারে পৌঁছোলাম।
পরে সে কোপাইকে আর খুঁজেই পাইনি।
নদী দেখলেই নেমে চান করার একটা লোভ জাগে আমার, কিন্তু জুতো পরে ছিলাম
বলে আর সেটা করলাম না। জেলেদের মাছ ধরা আর ধোপাদের কাপড় কাচা দেখতে দেখতে আস্তে
আস্তে এগোতে শুরু করলাম। আসলে খিদে পেয়েছিল। তাই ডানদিকে, দূরে একটা ট্রেনের পথ
অনুসরণ করে দেখলাম স্টেশন দেখা যাচ্ছে, ওদিকেই রওনা দিলাম।
কী স্টেশন! কিচ্ছু নেই। চায়ের দোকানও নেই। খালি বেঞ্চ দেখে শুয়ে
পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ একটা গানের সুর শুনে চোখ তুলে তাকালাম।
স্টেশন মাস্টারই হবেন, গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ব্লেড দিয়ে একটা
পেন্সিল ছুলতে ছুলতে। আর মুখে একটা গান। কী সুন্দর গলা ভদ্রলোকের!
আর কী গান এটা? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল যেন। “তুমি সুন্দর তাই
চেয়ে থাকি প্রিয়...”!
-----
অনেক পরে জেনেছিলাম ওটা নজরুলের গান।
বুড়ো! নিজে দেখা দিল না অথচ নজরুলের হাত ধরিয়ে দিয়ে গেল সেদিন!
No comments:
Post a Comment