Tuesday, November 3, 2020

কবিতা লেখা হয়নি

অনেক বছর আগে, তা বলতে গেলে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে আমি এবং আমার এক অগ্রজ শিল্পী বন্ধু, রবীনদা, রোববারে বা ছুটির দিনে সাইকেলে বেরিয়ে যেতাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় এক ধরণের ক্যাম্পিং হত, যাতে কথা থাকত যে রবীনদা, ড্রয়িং বোর্ডে ড্রয়িং বা পরে তেলরং করার জন্য স্কেচ করবেন আর আমি কবিতা লিখব (যদিও রবীনদা যা কবিতা লিখতেন তা তখনকার বিহারের বাঙালিরা জানত; আমিও ওনাকেই অনুসরণ করতে চেষ্টা করতাম) কথা থাকত যে দুজনে নিজের নিজের মত করে কাজ করব শুধু ক্যাম্পিং পয়েন্টটা এক জায়গায় হবে আবার মাঝে মধ্যে রবীনদা একাও বেরিয়ে যেতেন সেই সুত্রেই এক দিন রবীনদা এক বস্তী ভাঙার আর সে বস্তীতে বসবাসকারী কার্টার নামে এক এ্যাংলো-বার্মীজ মানুষের গল্প করলেন বোধহয় সেদিনটা ছুটির দিন ছিল কিন্তু আমি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম তার দুদিন পরেই রোববার দুজনে সাইকেলে বেরিয়ে গেলাম সাড়ে দশটা নাগাদ

গিয়ে দেখলাম এ বস্তীটা, বা অন্ততঃ বস্তী বাঁধার এ এলাকাটা আমার শৈশব থেকে পরিচিত আগেও এর ভাঙা গড়া দেখেছি, সন্ধ্যে বেলায় মদ খেয়ে মারপিট দেখেছি তবে এবার, এক শিল্পীর সান্নিধ্যে নতুন চোখে শুধু দেখার নয় কবিতার রসদ জোটানোর চ্যালেঞ্জ ছিল মাথায়

কবিতা লেখা হয়নি সেদিন দুপুরে বস্তীতে বসে বসে যে দৃশ্যগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলাম তা লিখে রেখেছিলাম পুঙ্খানুপুঙ্খ সেটাই তুলে দিচ্ছি

পিছনে বাঁদিকে থিয়েটার হলের একাংশ তারপ অর্থাৎ ঠিক পিছনে এজি অফিসের প্রস্তাবিত বাড়ির জমি, পাইলড্রাইভার ... ডান দিকে হার্ডিঞ্জ পার্কের পিছন দিক

ফুলধরা একটা কপার-পড গাছের নিচে চায়ের দোকান চেপ্টা আলমারীর ওপর বিস্কুটের বোয়াম, দুধের ডেকচি, গেলাস উনুনটার দুটো মুখ, একটায় বড় কেটলিতে গরম জল চাপানো, আরেকটায় তৈরি চালু-চা স্পেশ্যাল চায়ের জন্য সসপ্যানটা মাঝখানে রাখা উনুনের একটা দিক ভাঙা

পাশে আরেকটা তোলা উনুনে কাঠকুটো জ্বেলে, বুড়ো, রোগা চাওয়ালার মোটা সোটা বৌ আলুবেগুনের তরকারি চাপিয়েছেন

দোকানের সামনের বেঞ্চিটায় আমরা বসে আমি চায়ের দোকানের দিকে ঘুরে বসে চা খাচ্ছি আর রবীনদা ডান দিকে ঘুরে আঁকছেন তিন চারটে গাছের ছায়ায়, রোদে, ভেঙে যাওয়া বস্তীটার ছবি ডাঁই করে রাখা জিনিষপত্র, সাজি, খাঁচা ইত্যাদি বুনবার জন্য তারের গুছি, গুটিয়ে রাখা শোবার চাটাই কাজকর্ম চলছে। যারা ভোররাত থেকে কাজ করে ক্লান্ত তারা একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে।

গাছের গুঁড়ি থেকে, আমাদের বেঞ্চিটার সমকোণে পাতা আরেকটি বেঞ্চি, তাতে কেউ বসে নেই। বাঁদিকে একটা ছোটো টুল, তাতেও কেউ বসে নেই। চায়ের দোকানের পিছন দিকেও দুটো বেঞ্চি এদিককার মত করেই পাতা। আমাদের সামনাসামনি উল্টোদিকের বেঞ্চিটায় চাওয়ালার বড় ছেলে আর ছোটো ছেলে (রোগা পাতলা, খুব কোমল কালো মুখ) মুখোমুখি বসে একই থালা থেকে দুধভাত খাচ্ছে। দাদার হাত তাড়াতাড়ি চলছে দেখে ছোটো ছেলেটি আর চিবোবার ফুরসৎ পাচ্ছে না; গ্রাসটা সোজাসুজি পাচার করছে পেটে বাঁ মুঠোয় একটু চিনি, মাঝে মাঝে ছড়িয়ে নিচ্ছে গ্রাসটুকুর ওপর।

ওদের পাশের বেঞ্চিটায়, গান্ধী টুপি, ময়লা ও মোটা ধুতি পাঞ্জাবি পরে একজন নিচু স্তরের সর্বোদয়ী বা লোহিয়াবাদী নেতা গোছের বুড়ো। আরও ডানদিকে মাটিতে ওদিক ফিরে বসে তিন-চারজন মহিলা কেউ কাজ করছে, কেউ আরেকজনের উকুন বাছছে আর তাদের সামনে আরেকজন, স্তন দিচ্ছে বাচ্চাটাকে।

চাওয়ালার মেজছেলে, যে এতক্ষণ ছিল না, একটা থলে হাতে ফিরে এল। ওদিকে বড় আর ছোটোর খাওয়া হয়ে যেতে, বড়জন থালা ধুয়ে উঠে গিয়ে পিছনে রাখা তার ঠেলাটা সাজাতে লাগল। দুটো কাচ বসানো টিনে ভাজা ছোলা, আনার্‌সা ও আরো অন্য কিছু খাদ্যপদার্থ, পাল্লা-বাটখারা ... একটা বড় বস্তা উপুড় করে ঠেলার মাঝখানটায় চিনেবাদাম স্তূপ করল ছেলেটি। প্রায় সাথে সাথেই, থিয়েটার হলের দিক থেকে একটা মেয়ে এসে গ্রাহিকা হয়ে দাঁড়াল। তারপর আরো একজন লোক। ছেলেটি পয়সা পেয়ে, সেটা পয়সার বাক্সে ঠেকিয়ে, তারপর মাথায় ঠেকিয়ে বাক্স খুলে ভিতরে ফেলল।

ওদিকে ছোটো ছেলে, মেজদার কাছ থেকে শালপাতা আর কাঁচি নিয়ে ডান দিকে চলে গেল কোনো নিরিবিলি জায়গায় বসে কাটতে।

মেজ ছেলে আমাদের সামনে রাখা টুলটা উঠিয়ে ডানদিকের বেঞ্চিটার এক পাশে রাখল। তারপর কী ভেবে আবার, বেঞ্চিটাই উঠিয়ে বাঁদিকে নিয়ে চলে এল, তারপর টুলটা নিয়ে এসে রাখল তার পাশে। টুলটা একটু উঁচু মনে হতে, দুটো পাথরের টুকরো খুঁজে কুড়িয়ে এনে, বেঞ্চির সামনের পায়াদুটোর নিচে দিয়ে সমান করল। তারপর চলে গেল পিছনে এজি অফিসের জমির দেয়ালের কাছে। তিন দিন আগে ভেঙে দেওয়া জিনিষপত্র ডাঁই হয়ে ছিল সেখানে। তা থেকে খুঁজে পেতে যোগাড় করে আনল পানের দোকানের জন্য দুটো জরুরি আসবাব একটা কাঠের পাটাতন আর একটা উপরে রাখার লম্বা ও উঁচু গোছের পিঁড়ে। দুটোরই ওপরে রেক্সিনের আস্তরণ লাগান ছিল, এখন ছেঁড়া। দুটো, ঠিকভাবে, বেঞ্চি আর টুলের ওপর আড়াআড়ি ভাবে বসিয়ে নিজের থলে থেকে বার করল কাগজে মোড়া এক টুকরো লাল শালু। আগে পাটাতন ও পিঁড়িটা জলে ধুয়ে তার ওপর শালুটা বিছিয়ে আবার জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে নিল। বাবার চায়ের দোকানের আলমারি খুলে নিয়ে এল ট্রে তাতে জর্দার ডিবে আর দুচারটে সিগারেটের প্যাকেট। চুনের বাটি আর খয়েরের জন্য চিনেমাটির ঘটি। একটা শালপাতা চারকোনা করে কেটে পাটার একধারে বিছিয়ে তার ওপর ট্রেটা রাখল। বাল্টিতে জলে ভেজান কাটা পানপাতা ছিল। সেগুলো উঠিয়ে পাটাতনের ওপর রেখে, ব্যাগ থেকে প্যাকেটে মোড়া আস্ত পানপাতাও বার করে রাখল। ছোটো ভাই ততক্ষণে শালপাতা কেটে এনে দিয়েছে, সেগুলোকেও একপাশে রেখে দোকানদার হল বেঞ্চিতে আড়াআড়ি ভাবে আসন করে বসে।

ইতিমধ্যে চায়ের দোকানের পিছনের বেঞ্চিটায় এসে বসেছে রাস্তার ওপার থেকে সার্কিট হাউজের দারোয়ান। জোয়ান, শরীরে এ্যালকোহলের স্থূলতা। কোঁকড়া চুল, দাড়ি রাখে, চোখের ওপর দিকটা ফোলা, নিচে অনাচারের দাগ। চোখদুটো ঘোলাটে, তাতে ধূর্ততা, সতর্কতা আর ভয়কে-ভয়ঙ্কর-হয়ে-কাটাবার চেষ্টা।

তার পাশে একজন মাঝবয়সী, খুব বলিষ্ঠ শরীরের লোক আগে থেকেই বসে চা খাচ্ছিলেন। তাঁর সামনের দাঁতটা ভাঙা। মুখটা তিনকোনা, টানটান কিন্তু ভাঁজপড়া। চুল এনারও কোঁকড়া। চোখদুটো ছোটো ছোটো কিন্তু বুদ্ধিমান। দারোয়ানের পরনে ছিল লুঙ্গি আর খালি গায়ে উর্দির খাকি জামাটা চড়ানো। এই মাঝবয়সী লোকটির পরনে ধুতি আর গেঞ্জি।

আরেকজন মানুষ মেজছেলের পানের দোকানের বেঞ্চির ধারে বসেছিলেন। পরনে লুঙ্গি আর জামা, উস্কোখুস্কো, কাঁচাপাকা সোজা চুল, রোগা তোবড়ানো চেহারা, দাঁতগুলো ফাঁকফাঁক। কুঁচকে যাওয়া কোটরের ভিতর থেকে উৎফুল্ল ও সরল চোখদুটো ঝিকঝিক করছে।

দারোয়ানটি এসেই চায়ের দোকানের মালিকের মন যোগাতে শুরু করেছিল উনুনের ভাঙা দিকটা সে কেন সারিয়ে নিচ্ছে না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আর কিছু হবে না আপাততঃ। ... ওর চোখ বলছিল এটা চাওয়ালাকে সহানুভুতি দেখিয়ে নিজের বাগে রাখার ধান্দা। চাওয়ালাও অকে একটু কুরে যাচাই করতে আস্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, আর কী সারাব, আবার তো এসে ভেঙে দেবে!

-       না নাঃ, রোজ রোজ কি এসে ভাঙে নাকি? তাছাড়া চায়ের দোকান দিলে কী ক্ষতি? ইঁট-খাপরার বা টিনের ঘর তো তুলছ না! আসল সমস্যা তো ... যারা বেআইনি ভাবে জমি অধিকার করে নেয় তাদের নিয়ে (বলেই দূরের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখে মুহুর্তের জন্য বিচলিত হয়ে আবার উদাসীন স্বরে প্রশ্ন করল), ওদিকে কিসের আগুন?

-       ও ... আর কী! ওই সব ভাঙা জিনিষপত্র, আসবাব, কুড়াকচরা যা ছিল সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে আগুনে দিয়ে দিয়েছে ... সব পরিষ্কার হয়ে যাবে (একটা ঝাড়া হাত-পা গোছের দেহভঙ্গি করলেন)। ওই তো, পিছনে আমরাও জমিয়ে রেখেছি, আগুন ধরিয়ে দেব (বলে দেখালেন পিছনদিকে রাখা ভাঙা আসবাব, আটচালা, আরো সব জিনিষের ডাঁই বস্তীর এই অংশের ধ্বংসাবশেষ)।

চাওয়ালার স্ত্রী কড়াইয়ের বস্তুটায় খুন্তি চালাতে চালাতে বললেন, কুড়াকচরা জমলেই ঝামেলা!

দারোয়ান হ্যাঁ, তবু উনুনটা সারিয়ে নাও, (সহানুভুতির প্রকাশটা মাঠে মারা যাচ্ছে দেখে আবার মনে করিয়ে দিল) অন্ততঃ ব্যবসাটা তো চালাতে হবে! কাজ তো করতেই হবে প্রতিদিন! (বলে আদূরে ভাঙা বস্তীর ছড়ানো ছিটোনো কার্যরত মানুষজনের দিকে তাকাল)।

ওই মানুষজনের মধ্যেই কার্টার পরিবারও আছে যাদেরকে রবীনদা আঁকছেন। ওদের সাথে ওনার আলাপ বস্তী ভাঙার আগে থেকেই। কার্টার নিজে এ্যাংলো-বার্মীজ এবং ওঁর স্ত্রী বেতিয়ার মেয়ে ওঁদের তিন ছেলে আর বড় ছেলের বৌ, এই নিয়ে পরিবার পারিবারিক পেশা তারের কাজ খাঁচা, ডিমের ঝুড়ি, সাজি ইত্যাদি তৈরি করে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা এই বস্তীর অনেক পরিবারের ওইটাই মূল পেশা রাস্তার ওদিকে আরেকটা বস্তী ছিল সেটাও ভেঙে দিয়েছে ওখানকার পরিবারগুলোর মূল পেশা শিলনোড়া কুটে বিক্রি করা কার্টার নিজে চমকে দেওয়ার মত ঝকঝকে ইংরেজী বলেন মুন্নালালকে আপাততঃ দেখতে পাচ্ছি না কার্টারদের পারিবারিক বন্ধু রাজস্থানের লোক আসল পেশা কী ছিল জানি না এখন মাঝে মাঝে এদের সাথে বসে তারের কাজও করেন কখনো ঘুরে ঘুরে বেলুনও বিক্রি করেন কিন্তু মুন্নালালের গুরুত্ব অন্য জায়গায় একটু পড়াশোনা জানেন বলে এই বস্তীর রাজনৈতিক কাজগুলো করেন নেতাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করা, কারোর কোনো ফর্ম ভরে দেওয়া, সরকারি দপ্তরে কোন টেবিলে কী কাজ হয় তার সুলুক সন্ধান রাখা, পয়সাকড়ি নিয়ে দরদাম করা সব মুন্নালালের জিম্মায়উনি নিজেই কাজটা নিজের ওপর নিয়ে নিয়েছেন উনিই প্রথম লোক যিনি রবীনদাকে প্রশ্ন করে, ঠুকে বাজিয়ে এই বস্তীর অন্দরমহলে প্রবেশ দিয়েছিলেন এবং সকলকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন যে লোকটা দিলওয়ালা গরিবী আর মেয়েদের উদলো গা দেখিয়ে পয়সা কামাবার ধান্ধা নেই মুন্নালাল যদি উপস্থিত থাকেন তাহলে নিজেই এগিয়ে এসে স্কেচ ও ড্রয়িংগুলোর প্রথম বিচারক হন এবং বললে নির্দ্বিধায়, কোনো রকম আড়ষ্টতা না রেখে মডেলও হয়ে যান

দারোয়ানের দার্শনিকতার জবাবে চাওয়ালা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, হুম! সারিয়ে নেব আমিও ভাবছি যাক, আর কটা দিন

মাঝবয়সী বলিষ্ঠ লোকটি এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিল এবার সে কথা ঘোরাল অন্যদিকে, তা তুমি তো বেশ আছ বৌ আছে ছেলেপিলে সব সাথেই আছে প্রতিদিন বৌয়ের হাতের রান্না খাচ্ছ, তোমার আর অভাব কিসের?

চাওয়ালার বৌ আর চাওয়ালা দুজনেই মধুর ভাবে হাসলেন বৌটি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে উবু হয়ে তরকারি নাড়ছিলেন, এবার বসে পড়লেন উনুনের পাশে, মাটিতে সামনে হাঁটু জোড়া করে উঁচু উঁচু দাঁত ছড়িয়ে হাসলেন আর উনুনে পাখার হাওয়া দিতে লাগলেন অল্প অল্প            

দারোয়ান ছেলেটি যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচে হেঁকে উঠল, দাও, দাও, চা দাও একটা বলে উঠে দাঁড়িয়ে কার্যরত মেয়েদের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ লুঙ্গির ওপর থেকে হাত দিয়ে কুঁচকির কাছে চুলকোলো তারপর এদিকের বেঞ্চিতে এসে বসল

পিছনে ডানদিকে বসে থাকা ছোটো গোছের নেতা এতক্ষণ কিছুই বলেননি এবার আস্তে করে উঠে ধীরে ধীরে বাঁদিকে এগোলেন একটু দূরে গিয়ে বারেক পিছনে ফিরে তাকালেন, তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে গেলেন

পানের দোকানের বেঞ্চিতে বসা বুড়ো লোকটি হঠাৎ স্বগত ক্ষোভ ব্যক্ত করলেন, কী অবস্থা! যারা প্রতি মাসে ট্যাক্স দিচ্ছিল, ভাড়া দিচ্ছিল, ওই তো ইউনিভার্সিটির দিকে, তাদেরও বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে!

দারোয়ান সরকারি মহলের খবর জানা লোকের মত করে বিজ্ঞের হাসি হেসে জানাল, ভাঙবে না? এ এখানের ব্যাপার নাকি দিল্লীর অর্ডার! তের জন ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে এত ভীড় বেড়ে গেছে শহরে! লোকের পায়ে হাঁটার জায়গা নেই, গাড়ীঘোড়া যাবে কোন দিক দিয়ে? আর ভাঙতে শুরু করলে কারোরটা ভাঙবে, কারোরটা ছেড়ে দেবে, তা তো হয় না!

-       ওঃ, ট্র্যাফিক জ্যাম! আর ওই যে ওদিকে, বস্তী উজাড় করে তারপর আরো এগিয়ে একেবারে রাস্তা অব্দি ঘিরে দিয়েছে, খুঁটি পুঁতে পুঁতে, তাতে অসুবিধে হয় না গাড়ীঘোড়ার? বাঁক নিতে? ট্র্যাফিক জ্যাম হবে না?

-       সে তো সরকারি জমি জমিটা নেওয়ার জন্যই তো ভাঙা

ইতিমধ্যে চৌকো চেহারা, পাতা চুল, ফতুয়া আর ধুতি পরা এক বৃদ্ধ রিকশাচালক রিকশাটা বাঁদিকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসে আমাদের বেঞ্চিটায় বসলেন সামনে বসে রবীনদার আঁকা দেখতে চাইছিলেন রবীনদা দৃশ্যের ফ্রেম থেকে তাঁকে সরে যেতে ইঙ্গিত করতে পিছনে এসে বসে ঝুঁকে দেখতে থাকলেন

আগে থেকে যে কথাটা চলছিল তাতে এই রিকশাচালক ফোড়ন কাটলেন, আরে, জমিও সরকারের, বাড়িও সরকারের, কোনোটাই তো আর পাব্লিকের নয়!

মাঝবয়সী বলিষ্ঠ লোকটি আবার উত্তেজনা প্রশমিত করতে এগিয়ে এলেন, আরে, এমন জায়গাতেও ভেঙেছে যেখানে সরকার নিজে জমি দিয়ে বসিয়েছিল করবে কী? রাজধানী শহর! হাজার জায়গা থেকে মানুষজন আসছে, যত্র তত্র তো আর লোককে থাকতে দেওয়া যায়না! ওই তো ওদিকে ধাঙড়দের বস্তী অতদিন ধরে ছিল (বলে বড় নালাটার ধারে ইঙ্গিত করল)! ...

বৃদ্ধ, অতদিন ধরে?

দারোয়ান, অতদিন মানে? দশ বছর ধরে ছিল আগে নালার ওপার অব্দি ছিল তারপর এপার অব্দি ছড়িয়ে পড়ল

চাওয়ালা, তা হবে আমি তো চার বছর ধরে দেখছি

বৃদ্ধ একটু থতমত খেয়ে গেলেন, তা ওদের আর কী? আবার অন্য জায়গায় ঘর তুলে নেবে! কিন্তু যাদের দোকানপাট ছিল?

কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধের যদিও মনে হল তিনি নিজের বিরুদ্ধে চলে গেছেন কিন্তু প্রত্যেককেই নিরুত্তর করল কথাটা কেননা, এটা এখনও অব্দি মান্য যুক্তি যে, শ্রমিক তো নিজের কাজ করবে, যেখানেই থাকুক না কেন, কিন্তু দোকানওয়ালার দোকানটাই যদি ভেঙে যায়, নতুন দোকান তোলা অব্দি খাবে কী?

এরই মাঝে নালার ধারে, যাযাবরদের একটা ছোট্টো বস্তী নিয়ে কথা উঠল যে ওরা তো ছমাস এখানে,মাস ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের আর কী?

চাওয়ালার বৌ, শুনলাম এখানেও নাকি হাল্লা গাড়ি আসবে এবার থেকে?

রিকশাচালক, দুর, এখানে ওসব হবে না

চাওয়ালার বৌ, কেন, বঙ্গালে যে রয়েছে?

রিকশাচালক, আরে বঙ্গালের কথা আলাদা এখানে মানুষজনের চলবার লুরই নেই রাস্তা দিয়ে কোট প্যান্ট পরে নিয়ে ভাবে আমি বাবু হয়ে গেলাম অথচ কী অভদ্র ভাষা! খেঁকখেঁকিয়ে উঠবে রাস্তা দেখতে পাস না? বাঁদিক ঘেঁষে চলতে পারিস না? অথচ তুমি এক্কেবারে বাঁদিক ঘেঁষে চলছ, তারপর আর রাস্তাই নেই!

বঙ্গালের কথা ওঠার পর থেকেই দারোয়ান ছেলেটি উসখুস করছিল ওঠার জন্য হঠাৎ মজলিশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বলিষ্ঠ লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তারপর, বাড়ি যাবে না?

-       না, পরে যাব

-       (দারোয়ান জামার বোতাম খুলে বসেছিল, এবার জামাটা খুলে ফেলে ভুঁড়িতে চাপড় মারল) তুমি তো খেয়ে দেয়ে নিজেকে মজবুত করে নিয়েছ তোমার আর কী! আমার তো এমন ঝামেলা, শালা খিদেও পায় না ...(একটু চুপ করে থেকে) যাই, স্নানটান করি

দারোয়ান চলে গেল রিকশাচালক বৃদ্ধ উঠে গিয়ে ওর জায়গায় বসলেন, আসল কথা হল, ইউনিটি, একতাএকতা থাকলে, একবার রুখে দাঁড়ালে কারো হিম্মত থাকে কিছু করার? একবার হাঁকো হড়তাল তো সব হড়তাল, সব বন্ধ্‌ তারপর ম্যাজিস্ট্রেট আসুক আর মিনিস্টার আসুক, কেউ কিছু নড়াতে পারবে? বঙ্গালের আসল ব্যাপারই হল ওই, একতা মাঝে মাঝেই আমার দিকে চেয়ে কথাগুলোর জন্য সায় চাইছিলেন, আমি দএকবার মুন্ডু নাড়িয়ে বন্ধ করে দিলাম)

ইতিমধ্যে বলিষ্ঠ মাঝবয়সী লোকটিও উঠে চলে গিয়েছিলেন। রিকশাচালক বৃদ্ধ হাত দুটো দুপাশের বেঞ্চিতে রেখে নিজের উদ্দেশ্যে বললেন, অনেক মজা করেছ বঙ্গালে, ... এবার এখানে ধকল সহ্য কর!

একজন মাঝারী স্তরের নেতা এল একটু পরে। ফর্সা, বেঁটে, রোগা, সিল্কের পরিষ্কার পাঞ্জাবী, ধুতি পরে আর হাতে বর্গাকৃতি একটি ডাইরি নিয়ে। রবীনদার ছবির ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে এসে ওদিকের বেঞ্চিটায় বসল। একবার তাচ্ছিল্যভরে তাকাল ছবি আঁকার কাজের দিকে তারপর একটা চায়ের ফরমাশ দিল।

-       আশ্চর্য!! একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সব কিছু! যেন ভ্রুক্ষেপই নেই যে এটাই এদের ঘর বাড়ি, ব্যবসা ...। লোকে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে কাজের খঁজে। থাকবে কোথায়? আকাশে? ঝুগ্‌গিঝোপড়ি বানিয়ে থাকছে, পাকা বাড়িও তুলছে না, জমিতেও দাবী জানাচ্ছে না! এখানে কবে ভাঙল? কাল?

কেউ কোনো জবাব দিলনা। শেষে চাওয়ালাই নীরবতা ভেঙে আস্তে করে বললেন, না, পরশু।

-       কিছু করেছ এখন অব্দি?

মুন্নালাল কই? আমি ভাবলাম। কার্টার কাছেই বসেছিলেন। নিরুত্তাপ ভাবে বললেন, না, আমরা আর কী করব, গরীব মানুষ!

আবার সব চুপচাপ। সকলে মন দিয়ে ছবি আঁকা দেখা শুরু করে দিয়েছিল। রবীনদা ভাঙা বস্তীটার একটা দৃশ্য এঁকে পাশে রেখে, কয়েকটা মুখচ্ছবি স্কেচ করতে শুরু করেছিলেন।

আরে! লুইস ভাইয়া! একদম পুরো লুইস ভাইয়া! সঙ্গে তারের খাঁচা, পিলাস ..., চাওয়ালার ছোটো ছেলে বলে উঠল

এইটা দেখ না, কার্টারচাচার ভাঙা দাঁতটা অব্দি এসে গেছে আর মাথায় বাঁধা রুমাল...

ওদিকে মাঝারি স্তরের নেতা, তার কথায় চিঁড়ে ভিজল না দেখে নিজেও ছবির দিকে ঘুরল ইন্টারেস্ট দেখিয়ে তারপর ভাঙা বস্তীর ছবিটা হাতে উঠিয়ে বলল, সবচেয়ে ভালো কিন্তু এইটা এক্কেবারে পুরো জিনিষটা এসে গেছে বাকি সকলের দিকে তাকিয়ে সায় চাইল, ভালো না?

উস্কুখুস্কু পাকা, কোঁকড়া চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লুঙ্গি আর ঘিয়ে রঙের শার্ট পরে এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছিলেন উনি জবাব দিলেন, ওতে আর ভালো মন্দ কী! ভাঙা বস্তী, ভাঙা বস্তী! আসল আর্ট তো এইখানে আঃ হা! আরে কার্টারভাই, লুইসের বিয়ে দাও তাড়াতাড়ি! কী চেহারা এসেছে ছবিতে মাইরি!

সহানুভুতিটা মাঠে মারা যাচ্ছে দেখে নেতা তবুও নিজের মত জাহির করল, আমি কিন্তু এই ছবিটা নেব কত দাম রাখবেন ঠিক করেছেন মশাই, এই ছবিটার?

রবীনদা একটু বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকালেন বাকি সকলে এমন ভাবে চুপ করে রইল যেন নেতাটি খুব বড় একটা ধৃষ্টতা করে ফেলেছে

কার্টার শুধু পাশ থেকে মনে করিয়ে দিলেন, মুন্নালাল চেয়েছিল ছবিটা

ঘিয়ে জামা পরা বৃদ্ধ ততক্ষণে চায়ের দোকানের পিছন দিকে বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছিলেন তার পাশে একজন মাঝবয়সী লোকও এসে বসলেন, লম্বা মুখ, পাতা বড় বড় চুল

এক ভীষণ রোগা, চওড়া কপাল, পাতলা মুখ আর কোটরগত চোখ মহিলা এসে ঘিয়ে জামা পরা লোকটির সামনে মাটিতে বসলেন লোকটি কোঁচার খুঁট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট, দুতিনটে দুটাকার নোট ও কিছু খুচরো পয়সা বার করে মহিলাটির হাতে দিলেন মহিলা টাকাপয়সাগুলো গুনে, কোঁচড়ে বেঁধে কিছুক্ষণ উপরে মুখ তুলে অন্তরঙ্গ কথা বললেন হেসে হেসে তারপর উঠে দাঁড়ালেন লোকটির চুলের ভিতরে রোদ খেলে রুপোর মত চকচক করছিল মহিলা তাঁর পিছনে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাঁর চুলে হাত দিতে গেলেন আর তখনই পাশের লোকটি চোখ তোলাতে লজ্জিত হয়ে পড়লেন একটু ইতস্ততঃ করে সেটা কাটিয়ে উঠে চুলে হাত বোলাতে থাকলেন জামার কলারটা টেনে উল্টে দেখলেন কতখানি ময়লা জমেছে আস্তে আস্তে কথা চলতে থাকল দুজনের মাঝে লোকটি সুখে আহ্লাদিত হয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন চাওয়ালার উদ্দেশ্যে, কী প্রহ্লাদজী! আড়াই বছর আগে চা চেয়েছিলাম এখনো দিলে না?

-       আড়াই বছর আগে?

-       আবার না তো কী! এক, এক আর আধা আড়াই!

বলে আড়মোড়া ভেঙে আবার আমেজে মাথা এলিয়ে বসে রইলেন তারপর মুখ ঘুরিয়ে চেঁচালেন, আর হ্যাঁ, নেতাজীর জন্যও একটা, আমার তরফ থেকে

নেতাটির চা খাওয়ার স্পৃহা চলে গিয়েছিল, হাসিমুখ-বিনয়ের সাথে অস্বীকার করল

মহিলাটি আপন মনে সামনের পুরুষটির রুপোলি চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন           

No comments:

Post a Comment